প্রকৃত মৃত্যুর স্মরণ ও একটি ঘটনা

650
শহীদি মরণ

“প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে এবং তোমরা নিজ নিজ কাজের প্রতিফল সম্পূর্ণভাবেই কিয়ামাতের দিন পাবে….” [সূরা আলে ইমরান-১৮৫]

তখনো আমি অনেক ছোট। শীতের এক রাতে ওয়াজে গিয়েছিলাম বাসা থেকে একটু দূরে। তিতাস পাড়ের মসজিদ প্রাঙ্গনের মাহফিলে। তখন ওয়াজ বলতে মাহফিল উপলক্ষে বসা দোকান-পাট থেকে কেনা-কাটা,চটপটি,ঝালমুড়ি খাওয়া, এসবই মনে করতাম। আমি এবং আমার দুই মামাতো ভাই মাহফিলের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছিলাম। ওয়াজ করছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন প্রসিদ্ধ বক্তা। তিনি রাসুল (সাঃ) এর এই হাদিসটি বর্ণনা করছিলেন। যার অর্থ হল-

যে ব্যাক্তি দৈনিক বিশবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করবে তাকে মহান আল্লাহ তায়ালা শহীদি মৃত্যু দান করবেন।

কথাটি শোনা মাত্রই কেমন যেন থ খেয়ে গেলাম। ভাল লাগাই ভরে গেল মন। তাড়াতাড়ি বাসায় চলে গেলাম।ভাবতে লাগলাম দৈনিক মাত্র বিশবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করলেই শহীদি মৃত্যু লাভ করতে পারবো ! বাহ,খুব চমৎকার !

শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে আম্মাজির কাছে শুনেছিলাম। শহীদদেরকে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে বিনা হিসেবে জান্নাত দান করবেন। মনে মনে এমন মৃত্যু লাভের আকাঙ্খা হল এবং পরের দিনই বিশটি দানা দিয়ে একটি মালা তৈরি করলাম। আর দুই মিনিট পরপর আমাকে মরতে হবে একথা স্মরণ করে ২০ বার পূর্ণ করতাম মাত্র এক ঘণ্টাই। কিন্তু যখন একটু বুঝতে শুরু করলাম তখন মনে হল আসলে এভাবে কি মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে বলা হয়েছে ? প্রকৃত মৃত্যুর স্মরণ কিভাবে করতে হয়।

    আব্বাজীর ব্যাখ্যায় কিছুদিন আগে এই প্রশ্নের জট খুলল। প্রতিদিন ফজরের পর মসজিদে তা’লীমে করেন তিনি। তা’লীমের ব্যাপারে তার স্বাভাবিক নিয়ম হল-কিতাব খোলার পর যে হাদিস খানা বের হয় সেই আলোকে বয়ান করা। ঘটনাক্রমে সেদিন মৃত্যুর স্মরণের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বর্ণনা করলেন ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে ঘটে যাওয়া তার জীবনের এক আশ্চর্য ঘটনা। চারদিকে চলছে তুমুল যুদ্ধ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একের পর এক হত্যা করছে নিরীহ বাঙ্গালীকে। একদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামে মসজিদের আশপাশ এলাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণ শুরু হল। একের পর এক তারা কামানের গোলা ছুড়ছে বসতবাড়ি গুলোর উপর। প্রান বাঁচাতে সকলে আশ্রয় নিল মসজিদে, মুসলমানদের জন্য আল্লাহর ঘরই তো সবচাইতে নিরাপদ। আব্বাজী তখন সকলের উদ্দেশ্যে তা’লীম করছিলেন। তা’লীম শেষে অনিচ্ছাকৃতভাবেই মসজিদের মিম্বারের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। সাথে ছিলেন পরিচিত এক হাজী সাহেব। আনুমানিক ১৫-২০ মিনিট ঘুমানোর পর ধমকের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল । চোখ খোলে দেখলেন তাদের দিকে বন্দুক উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তানী কয়েকজন সৈন্য। আব্বাজী হাজী সাহেবকে বললেন- চলুন । ওরা বাইরে যেতে বলছে । মসজিদের সাথেই ছিল একটি পুকুর। রাতে বৃষ্টি হওয়াতে ঘাটটি ছিল একদম পরিষ্কার । আব্বাজী তাদের কাছে অজু করার অনুমতি চাইলেন । সাথে হাজী সাহেবকেও অনুমতি দিল। অজু শেষে তিনি এবং হাজী সাহেব ঘাটলাতেই নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন । এদিকে বিলম্ব দেখে পাকিস্তানী বাহিনীর সৈন্যরা অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করছিল । নামায শেষে এক সারিতে দাড় করিয়ে শুট করার আদেশ দিলেন বাহিনি-প্রধান। আব্বাজী ছিলেন সারির প্রথম ব্যাক্তি, তাঁর পিছনে ছিলেন হাজী সাহেব । আব্বাজী তাকে বললেন- চোখ বন্ধ করে কালিমা পড়ুন । তখন তাদের যেভাবে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়েছিল সেটাই তো ছিল প্রকৃত মৃত্যুর স্মরণ। আর এভাবেই কেউ যদি দৈনিক বিশবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করে নিঃসন্দেহে সে শহীদি মৃত্যু লাভ করবে। তো যাক, সেদিন তাদেরকে আর প্রান হারাতে হোল না। বাঙ্গালী মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে পালাতে বাধ্য হয়েছে।

পরকথা,আমি কখনো কি মৃত্যুকে সেভাবে স্মরণ করতে পেরেছি । এমন গভীরভাবে মৃত্যুর স্মরণই মানুষকে অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং সৎকাজের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। আর এভাবে মৃত্যুর কথা স্মরণ করলে নিঃসন্দেহে আমরা পাব শহীদি মর্যাদা। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন।

উল্লেখ্য এখানে আব্বাজী হল- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুফতি নুরুল্লাহ রঃ।

লেখক- মুহাম্মাদ আজমতুল্লাহ নুর

Facebook Comments