ভালোবাসার বানিজ্য- কয়েকটি অপ্রিয় সত্যকথন

624
ভালবাসা ভালোবাসা লাভ love

ভ্যালেন্টাইন ডে অর্থ কি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস? সংসদ অভিধানের ১২৫৪ পৃষ্ঠায় ভ্যালেন্টাইন শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে ‘দ্যা নেইম অব টু সেইন্টস (দু’জন খ্রিস্টান ধর্মযাজকের নাম)’। সেখানে আরো উল্লেখ আছে, ভ্যালেন্টাইন অর্থ- ‘এক বছর ধরিয়া বর কনে হিসেবে খেলিবার জন্য নির্বাচিত বর বা কনে’।

ইতিহাস বলে, যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগে চতুর্থ শতকে পৌত্তলিক, মূর্তিপূজারীরা তাদের পশুর দেবতা ও জমির উর্বরতার দেবতা লুপারকালিয়ার সম্মানে ১৪ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। অনুষ্ঠানে যুবতীদের নামে লটারি ইস্যু করা হতো। লটারিতে যে যুবতী যে যুবকের ভাগে পড়তো পরবর্তী এক বছর ওই যুবক সে যুবতীকে ভোগ করতো। এভাবেই শুরু হয় দিবসটির উদযাপন। পরবর্তিতে ৪৯৬ সালে ভ্যালেন্টাইন নামক এক খ্রিস্টান পাদ্রির নামে ভ্যালেন্টাইনস ডে নামে তা রূপান্তরিত হয়।

কই? এখানে তো কোথাও ভালোবাসার কথাই নেই। তাহলে এখানে ভালোবাসা আসলো কোত্থেকে? আসলে প্রথমেই অশ্লীলতার কথা বললে অনেকেই হয়তো গ্রহণ করবে না; তাই, এখানে ভালোবাসার মোড়ক লাগানো হয়েছে। প্রস্রাবের বোতলের ওপর ‘আতর’ লিখে দিলেই যেমন তা পাক হয়ে যায় না তেমনি অবাধ যৌনতায় উদ্বুদ্ধকারী ভ্যালেন্টাইনের সাথে ভালোবাসার মোড়ক লাগালেই তা শুদ্ধ হয়ে যায় না। 

অন্যদিকে আভিধানিকভাবেই এর অর্থ- ‘এক বছর ধরিয়া বর কনে হিসেবে খেলিবার জন্য নির্বাচিত বর বা কনে’। প্রশ্ন হলো, এই নির্বাচিত তরুণ-তরুণী ১ বছর ধরে যে খেলাটি খেলবে তা কী? এক্কাদোক্কা, লুডু, কাবাডি, ফুটবল, ক্রিকেট বা কম্পিউটারের গেম খেলা? না। বরং এ হলো সেই খেলা যার ফলে পৃথিবীতে জারজ সন্তানের জন্ম হবে। চারিত্রিক পবিত্রতা বিনষ্ট হবে। নারী-পুরুষের ব্যক্তিত্ব নষ্ট হবে। দুরারোগ্য ব্যাধি হবে।

আমাদের দেশের অতি উৎসাহী কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া বেশ আগে থেকেই দিনটিকে সামনে রেখে পরিকল্পনা করে থাকে। তাদের একটি বড় উদ্দেশ্য থাকে বিজ্ঞাপন প্রাপ্তি ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া। হোটেল, বিনোদন কেন্দ্রগুলো অধীর আগ্রহে থাকে দিনটির জন্য। মূলত শুধু একালে নয়; শুরু থেকেই বাণিজ্যিকীকরণের হাত ধরেই ভ্যালেন্টাইন ডে ছড়িযে যায় বিশ্বজুড়ে। ১৮৪০ সালে সর্বপ্রথম ভ্যালেন্টাইন কার্ড বের করে পশ্চিমারা। ব্যাপক প্রচারের কারণে প্রায় পাঁচ হাজার ডলারের কার্ড বিক্রি হয় ওই বছর। পরবর্তিতে এ দিবসে বিভিন্ন ধরনের ভ্যালেন্টাইন কার্ড ও গোলাপ ফুল আসল মূল্যের তিন-চারগুণ হারে বিক্রি হয়। তখন থেকেই ধান্দাবাজ পশ্চিমা ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়িক ও পুঁজিবাদী চিন্তা নিয়ে এ দিবসটিকে বিশ্বজুড়ে ছড়ানোর চেষ্টা করে। এভাবেই শুরু হয় ভালোবাসা নিয়ে রমরমা বাণিজ্য।

বাণিজ্যিক ভালোবাসার দিবসটিতে কী করা হয়? কী ভালোবাসা! ভ্যালেন্টাইন ডে অর্থ যদি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হয় তাহলে ঘটা করে দিনটি পালনকারীরা গরিব-দুখী অনাহারিদের জন্য সাহায্যের হাত প্রসারিত করে না কেন? মূলত বিভিন্ন দিবসের প্রচলনের মাধ্যমে যুবক-যুবতীদের চরিত্র নষ্ট করে দিতেই তাদের এহেন প্রয়াস।

যে কারণে তারা সেদিন ছুটে যায় না হাসপাতালের বেডে পড়ে থাকা একজন রোগীর সেবায়, রেল লাইন কিম্বা ফুটপাতে শুয়ে থাকা শীতার্ত মানুষের শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করে দিতে উদ্যোগ গ্রহণ করে না। তারা শুধু শেখায় কিভাবে অশ্লীলতার চর্চা করতে হবে। যুগলবন্দি হয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরা, অবাধ মেলামেশাই যে ভালোবাসার সাধারণ দৃশ্য। এর মাধ্যমে আমাদেরকে ফ্রি সেক্স, লিভিং টুগেদারে উৎসাহিত করাই টার্গেট। তাদের ভালোবাসার টার্গেট একমাত্র তরুণ-তরুণী। সরকার যদি ঘোষণা করে যে, এবারের ভ্যালেন্টইন ডে-তে ১০ থেকে ৪০ বছর বয়সী কোনো মহিলা ভ্যালেন্টাইন ডেতে পার্ক বা বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে যেতে পারবে না তাহলেই এ কথিত ভালোবাসা উধাও হয়ে যাবে।

 

বাণিজ্যিক ভালোবাসার দিবসটির কোনো ভিত্তি কি আমাদের সংস্কৃতিতে আছে? না। সংস্কৃতির উৎস হচ্ছে তিনটি- ১. ধর্ম, ২. দেশ, ৩. মাতৃভাষা। ইসলাম নামক শান্তির একমাত্র জীবন বিধানে কি এর কোনো ভিত্তি আছে? আজকে যে সব মিডিয়াকর্মী বিজ্ঞাপন পাওয়া কিংবা অন্য কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এ দিবসটিকে ছড়াতে উঠেপড়ে লেগেছেন তারাও কি প্রমাণ করতে পারবেন যে, ভ্যালেন্টাইন ডে আমাদের বাংলাদেশীয় সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত? তাদেরকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, ভালোবাসা দিবসকে তারা পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আমদানি করেছেন।

আমাদের মাতৃভাষা বাংলার সঙ্গেও এর কোনো সম্পর্ক নেই। তাই, এ ভালোবাসা দিবস আমাদের সংস্কৃতি নয়; বরং তাদের সংস্কৃতি, যাদের সমাজে কুমারি মাতা হওয়াকে স্বাভাবিক মনে করা হয়। যে জাতি তাদের কৃষ্টি-কালচার ও ধর্মীয় চেতনাকে বাদ দিয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতিকে লালন করে তারা কখনো স্বকীয়তা নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। ভ্যালেন্টাইনস ডের প্রেমিকরা কি একবারো তা চিন্তা করেছেন যে, এর মাধ্যমে আমাদের জাতীয় স্বকীয়তা তার অস্তিত্ব হারাতে চলেছে। হারাবো অনেক কিছু; পাবো না কিছুই। হ্যাঁ, ফুল, কার্ড মদ ব্যবসায়ীদের এতে বাণিজ্য করে লাভবান হবার সুযোগ হলেও সাধারণ মানুষের জন্য এতে পাবার নেই কিছুই। আছে শুধুই হারাবার। আপনার পুত্র-কন্যা হারাবে তাদের মহামূল্যবান চরিত্র।

একজন যুবক হয়তো মনে মনে ভাববেন, আজো লটারির মাধ্যমে এক বছরের জন্য যৌনসঙ্গী পাওয়া গেলে তা অসমর্থনের কী! হে যুবক ভাই, তাহলে তো আপনার যুবতী বোনকেও তো কেউ না কেউ পণ্যের মতো লটারির মাধ্যমে ১ বছর ভোগ করত। তা কি আপনি সমর্থন করতেন?
আমাদের ছোট্ট বাংলাদেশে হত্যা, গুম, ধর্ষণ, ছিনতাই যেখানে বেড়েই চলেছে; ইয়াবার মতো মারাত্মক মাদকের লাগাম টেনে রাখা যাচ্ছে না; এইডসের মতো মহামারি ছড়াচ্ছে দ্রুত; সেখানে কেন এই অপরাধ উস্কে দেয়ার এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন? নিজেদের ফাইভ স্টার হোটেল, নাইট ক্লাব কিম্বা বিনোদন কেন্দ্রগুলোর রমরমা ব্যবসা জমাতে কেন বছরের কিছু দিনে অশ্লীলতার অবৈধতাকে বৈধ করে দেয়ার অপচেষ্টা? 

অনেকেই হয়তো ভাবছেন, বিজাতীয় সংস্কৃতি হোক না, আমাদের সন্তানরা একটু আনন্দ করবে এতে সমস্যা কোথায়? আপনাকে মনে রাখতে হবে আপনার সন্তান প্রথম মাদক গ্রহণের পূর্বে কিন্তু আপনার অনুমতি নেবে না। আপনার কলিজার টুকরা সন্তান হয়তো ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপন করতে যেয়েই জীবনের প্রথম মাদকের বিষাক্ত ছোবলে অক্রান্ত হবে। আপনার সব স্বপ্ন মিশে যাবে মাটির সাথে। একটি রাত কিম্বা দিনই হবে আপনার পুরো জীবনের কান্নার কারণ। তাই, এখনই সতর্ক হতে হবে। নিজেদের সন্তানকে বিরত রাখতে হবে কথিত ভালোবাসার চর্চা থেকে।
ভালোবাসার কোনো দিন-ক্ষণ নেই। ভালোবাসা বিশেষ কোনো দিনের ফ্রেমে বন্দি না হয়ে উন্মুক্ত থাকুক। পবিত্র থাকুক, অবারিত হোক এর চিরন্তন ধারা। আমাদের মধ্যে চর্চা হোক শুদ্ধ সংস্কৃতির; বিলুপ্ত হোক ভ্যালেন্টাইনস ডে অপসংস্কৃতি।

এই লেখাটিও পড়তে পারেন-ভালবাসা-ও-দুটি-বাস্তবতা

============

লেখক– যুবায়ের আহমাদ

Facebook Comments