অনুপ্রেরণা… ভীষণ অভাব অনটনের মাঝেও একজন জোবায়ের-এর সফল হওয়ার গল্প…

275
অনুপ্রেরণা

অনুপ্রেরণা…
ভীষণ অভাব অনটনের মাঝেও
একজন জোবায়ের-এর সফল হওয়ার গল্প…

অভাবের দিনগুলো। ২০০০ সন।
আমার মা তখন প্রেগন্যান্ট। মায়ের পেটে আমাদের গোল্ডেন সিস্টার আদুরে ছোট বোন আফসানা।আফসানা এই পর্যন্ত তিনটা গোল্ডেন জিপিএ ৫ পাওয়ায় তার এই নাম। মা খুব অসুস্থ ছিলেন তখন। আমাদের অভাবও তুঙ্গে। বাবা তখন বেকার। ঘরে বাজার নেই, চাল, ডাল, তেল, নুন কিছুই নেই। একটা নীরব হাহাকার এর ভিতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি।

আমার এক কাকা তখন থাকতেন কুমিল্লা শহর এর নানুয়া দিঘীর দক্ষিণ পাড়ে শরীফ মঞ্জিলে। তিনি কুয়েতএ থাকতেন। অনেক টাকা উনার তখন। দেশে আসার পর আম্মা আমাকে নিয়ে উনার বাসায় গেলেন। ২০০০ টাকা ধার চাইলেন। মা অনেক কাকুতি মিনতি করলেন। আমরা না খেয়ে আছি। মা এর শরীরটা ভাল না। এইসব বুঝালেন। কাকা মাথা নাড়লেন। আমি ও মা একটা আশা নিয়ে রাত কাটালাম উনার বাসায়।

পরের দিন আসার সময় আমার হাতে উনি ২০ টাকার দুইটা নোট ধরিয়ে দিলেন। উনার বাসা থেকে টমছম ব্রিজ এর রিক্সা ভাড়া ছিল ৫ টাকা। বাসে টমছম ব্রিজ থেকে বলাকা বাসে বরুড়া হয়ে আড্ডা বাজার এর ভাড়া ছিল ১৭ টাকা। দুইজনের ৩৪ টাকা লাগল। উনি আমাদের ১ টাকা বেশি দিয়েছিলেন।

আমার মা বাস জার্নি করতে পারেন না। মোশন সিক্নেস এর জন্য উনি বমি করে অস্থির হয়ে যান। অনেক আশা নিয়ে কাকার বাসায় গিয়েছিলেন মা। আমরা যখন বাড়ি ফিরি, তখন অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি ও মা এর কান্না একাকার হয়ে ঝরছিল। সেদিন এর কথা আজো ভুলিনি।

আমি তখন ক্লাশ টেনের ছাত্র।
প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে জ্বর। সাথে বমি, খাবারে অরুচি, মাথা ব্যাথা। লেখাপড়া করতে পারছিলাম না। স্কুলে যেতে পারি না। জ্বর বেশি আসলে মা মাথায় পানির ঝর্ণা দিত। একটু একটু পানি মাথায় কপালে পড়ত, শান্তি লাগত। খেতে পারছিলাম না। হঠাৎ নাবিস্কোর ৫ টাকা দামের গ্লুকোজ বিস্কুট খেতে ইচ্ছে হল খুব। আমার মাকে সেদিন ৫ টাকা কেহ ধার দেয়নি।

আমার সেই কাকা শহর থেকে বাড়ি আসলেন। কাকা সাদা শার্টের সামনের পকেটে ৫০০ টাকার অনেকগুলো নোট রেখেছিলেন। টাকা দেখিয়ে বেড়ানো বড়লোকদের বিরাট ব্যাপার। আমার মরহুম দাদী কাকাকে আমাদের নাজুক অবস্থার কথা বলে আমাকে দেখে যেতে বললেন। কিছু সাহায্য করতে অনুরোধ করেছিলেন।
কাকা সেদিন বলেছিলেন, যে যেমন ইনকাম করবে, তার বাচ্চারা তেমন খাবে। ইনকাম না করতে পারলে না খেয়ে থাকবে। নাবিস্কোর গ্লুকোজ বিস্কুট খেতে না পারার সেই দিনটির কথা আজো ভুলিনি।

ঢাকায় ঘুরতে যাওয়াঃ
ক্লাশ টেনে পড়ার সময় আমার বন্ধু সরোয়ার এর সাথে ঢাকায় ঘুরতে গেলাম। উঠলাম বন্ধুর ভাই এর বাসায়।
রোজার মাস ছিল। বন্ধুকে নিয়ে বড় মুখ করে গেলাম মিরপুরের পাইক পাড়ায় বড়লোক খালার বাসায়।
৫ তলার বাসায়। সেদিন খালা বাসায় ছিলেন না। ইফতার এর সময় আসন্ন ছিল তখন। খালাত ভাই এর বউ ফোনে খালার সাথে কানেক্ট করে দিলেন। খালা
ইফতার করে চলে যেতে বল্লেন। আমি বললাম, খালাম্মা আমাকে ১০০ টাকা দেন। আমার কাছে টাকা নেই।
সেদিন ১০০ টাকা না পেয়ে বন্ধুর কাছে আর মুখটা বড় থাকেনি। অনেক টা মলিন হয়ে গিয়েছিল।

বন্ধুকে নিয়ে গেলাম গাজীপুর এর মামার বাসায়।
সেহেরী খেতে খেতে মামার কাছে ১০০ টাকার আবদার করেছিলাম। মামা মামীর কাছে জিজ্ঞেস করল আমাকে ১০০ টাকা দিবেন কিনা। মামীর উত্তর ছিল ‘উনি কি ব্যাংক নাকি? আমার বাবা কি উনার ব্যাংকে ১০০ টাকা জমা রাখছেন নাকি? যে আমাকে এখন টাকা দিবেন।
সেদিন মামার বাসায় ও ১০০ টাকা পাইনি। ভুলিনি সেই দিনের কথা।

২০০১ সন। এসএসসি পাশের পর।
আমি আমার স্কুলের ফাস্ট বয় ছিলাম। এসএসসিতে জিপিএ পেলাম ৪.২৫। আমরা গ্রেডিং এর ফাস্ট ব্যাচ হওয়াতে স্যারেরাই বোঝত না গ্রেডিং। না হলে পয়েন্ট আরো বেশি হত।

আমার খালা আমার এসএসসি পাশের খবর পেয়ে আমার মাকে বললেন: আমাকে কলেজে না পড়িয়ে অটোমোবাইল এর ওয়ার্কশপ এ ভর্তি করে দিতে। কাজ শিখা অবস্থায় ৫০০০ টাকা পাব। কাজ শিখে ফেললে বেতন ১০,০০০/ টাকা হবে। আমিও চলতে পারবো। মায়ের সংসারের হাল ও ধরতে পারব। ভুলিনি সেইদিনের খালার দরদী পরামর্শ।

কলেজে পড়ার সময় আমি ফাস্ট ইয়ার ফাইলাম এক্সাম না দিয়ে ঢাকা চলে গিয়েছিলাম। একদিন ছিলাম খালার বাসায়। আমরা গরীব বলে আমাকে খাটে শুতে দিলেন না। ড্রয়িং রুমে বিছানা করে দিলেন। তখন শীতকাল ছিল।খালা আমাকে খুব আদর করতেন। তাই কনকনে শীতের রাতে আমাকে একটা লেপ দিয়েছিলেন। আমার তখন ভাল কোন শার্ট ছিল না। খালার কাছে দুইটা পুরাতন শার্ট চাইলাম। খালা বললো: এখন ত বাসায় পুরাতন শার্ট নেই। সব ফকিরদের দান করে দিয়েছি। আচ্ছা তোর ভাইয়েরা শার্ট ফেলে দিলে ফকিরকে না দিয়ে তোদের জন্য রাখব। সেদিন বুঝেছিলাম খালা আমাদের ফকির ভাবে।

খালার চার সন্তান এর বিয়েতে আমাদেরকে দাওয়াত দেয়নি। কারন আমরা ফকির। আমাদের ভাল জামা নেই। বড় লোকের বিয়েতে কি কাপড় পরে যাব আমরা?
খালার একটা প্রেস্টিজ আছে না? বিয়েতে অন্য আত্নীয়রা যখন আম্মার কথা জিজ্ঞেস করত, তখন খালা বলত: আম্মা অসুস্থ তাই যেতে পারেননি।

১৯৯৬ সাল। ক্লাস সিক্সে পড়ি।
আমার খালাত ভাই এর ট্রাভেল এজেন্সি ছিল। আমার আব্বাকে মালয়েশিয়া পাঠাবেন বলে আমাদের জমি বিক্রির ৪০,০০০/টাকা নিয়েছিলেন। পরে আমার বাবাকে বিদেশ ও পাঠাননি এবং আমাদের টাকাও ফেরত দেন নি। আমার মা নীরবে অশ্রু ফেলতেন।
আমার খালা আমাদের টাকা মেরে দিলেন। বাবা প্রায়শই এই টাকা নিয়ে মায়ের সাথে ঝগড়া করে ভাত না খেয়ে থাকতেন। একটা দুর্বিষহ মানসিক যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে আমাদের কৈশোর কেটেছে।

১৯৯৮ সন। চারদিকে বন্যা।
সব কিছুর চড়া দাম। দিনে এক বেলা খাওয়াও কঠিন।
বাজার থেকে ১/২ কেজি চাউল পলিথিনে ভরে হাতে করে আনতাম। গরম ভাত এর সাথে একটা পেয়াজ ও গুড়ো মরিচ। আহ কি স্বাদ। ভাতের সাথে মাছ মাংস খাব কল্পনাও করা সম্ভব ছিল না। কুরবানির ঈদ ছাড়া আমরা গরুর মাংস চোখে দেখতাম না। মা মাঝে মাঝে খেসারী ডালের বড়া বানাতেন। খেসারীর ডাল সস্তা ছিল। গরীবের ডাল। এক প্লেট গরম ভাত। সাথে দুই টা খেসারীর ডালের বড়া। মাঝে মধ্যে একটা ডিম পেয়াজ দিয়ে বিরাম করে চার ভাগের একভাগ জনপ্রতি।
একদিন বড় বোন স্কুল থেকে এসে ভাতের সাথে পেয়াজ ও গুড়ো মরিচ দেখে না খেয়ে ভাতের প্লেটটা মেলা মেরে ফেলে দিয়েছিলেন। সেই উড়ন্ত গরমভাতের প্লেটের ছবিটা আজো ভুলিনি।

১৯৯৯ সন।
আমরা তখন নানার বাড়িতে থাকতাম। মামা পুরো বাড়ি বিক্রি করে ঢাকায় চলে গেছেন ১৯৯৪ সালে। তখন আমরা কিছু অংশ কিনে রেখেছিলাম। অনেকটা পানির দরে এই বাড়ি বিক্রি করে আমরা দাদাবাড়ি ফিরলাম।
আমাদের বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে বিদেশ গেল আমার ছোট কাকা। ছোট কাকার ঘরে থাকতেন দাদা দাদী।
আমার মা ছোট চাচার ঘরে ৫ কেজি চাউল আনতে গেছিলেন। দাদা ভাই এর জমির চাল। চাচী সেদিন চাউল না দিয়ে বললেছিলেন, ওনাদের ঘরে চাউলের জন্য গেলে আমার মায়ের পা ভেঙ্গে দিবেন। ঘরে ফিরে মায়ের অশ্রুভেজা চোখটা আজো ভুলিনি।

২০০৩ সন।
আব্বা তখন স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপে স্টোর কীপার এর একটা চাকুরী পেলেন। ঢাকা থেকে বাড়ি এসে দেখেন আম্মা বাড়ি নেই। আমার বড় বোন ঘরের সামনে বসে কাঁদছে।
আফসানার তখন তিন বছর। আব্বাকে দেখে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আব্বার কোলে উঠল। তারপর বলল দুই দিন ভাত খাইনি আব্বা। চিনি দিয়ে পানি গুলে খাইছি।
মাছ দিয়ে ভাত খাবো আব্বা। কয়েকদিন আগে আব্বা এই কথা বলে কেঁদে দিয়েছেন।

এইস এস সি পরীক্ষার ফরম ফিলাপ শুরু হইছে। আমার সাথের অনেকেরই ফরম ফিলাপ শেষ। আব্বা খুব টেনশনে আছেন। আমার আরেক কাকা বিদেশ থেকে আসলেন। তিনি বললেন, আমার ফরম ফিলাপের জন্য তিনি ৩০০০ টাকা দিবেন। আর একদিন বাকী।
সকালে কাকা বললেন আমি হাজীগঞ্জ যাচ্ছি, বিকালে এসে টাকা দিব। কাকা বিকেল গড়িয়ে রাতেও আর ফিরে আসেননি বাড়িতে। আমি কলেজের ফাস্ট বয় ছিলাম। শামীম কাকা, যিনি আমার বাবার চাচাতো ভাই, প্রিন্সিপাল স্যারকে বলে বিনা টাকায় আমার ফরম ফিলাপের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আমার নিজের আপন কাকা তিন দিন পর বাড়ি ফিরে খুব স্বস্থি পেয়েছিলেন। যাক বাবা বুদ্ধি করে তিন দিন পর বাড়ি আসাতে ৩০০০/ টাকা বেঁচে গেল। সেই দিনের কথাও ভুলিনি।

মেডিকেল কোচিং
আমি ডাক্তার হতে চাইনি। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হবার খুব ইচ্ছে ছিল। বায়োলজি ছিল অপশনাল। আমি বায়োলজি পড়িনি বাবার উপর রাগ করে। এই সাব্জেক্ট পাল্টাতে আমি অনেক চেষ্টা করেছি। আমার বাবা পরীক্ষার পর একটা সমিতি থেকে সুদে ১০০০০/ টাকা এনে আমাকে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা দিলেন। রেটিনা কোচিং এ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
বাবা শুধু বলেছিলেন, আমার বিশ্বাস, দিলে টানে তুমি মেডিকেলে চান্স পাবে। ঠিকমত লেখাপড়া করবে।

পড়ার টেবিল এ বসলেই বাবার চেহারাটা ভেসে উঠত।
মেসে থাকতাম পূর্ব রাজা বাজারে। একদিন সকালে বুয়া আসেনি। নাস্তা কই খাবো। নগদ টাকা নেই। সেদিন আমার মেসের রুম মেট শাকিল ভাই ১২ টাকার নাস্তা ফ্রি করিয়েছিলেন। সেই ১২ টাকার স্নেহের কথা ভুলিনি।
ঢাকায় আমার খালার বাসা। মামার বাসা। কারো বাসায় যাইনি।

২০০৪ সন। ১০ এপ্রিল।
আমি সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৪২তম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে মেডিকেল জীবনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করি। আমার বাবার বিশ্বাসটা বাস্তব হয়েছিল। সেই দিন থেকেই আমি আমার পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলাম।

অভাবের দিনগুলি-২য় পর্ব।
অতীত কে ভুলা যায়না। অতীত এর শক্তিশালী স্মৃতি সামনে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দেয়। আম্মা বলতেন উনার জীবনের কষ্টগাঁথা লিখলে হাজারো পৃষ্ঠার উপন্যাস হয়ে যাবে। আমার মা, বাবা আমাদেরকে এমন একটা পৃথিবীতে বড় করেছেন যেখানে আমাদের মামা ছিল না। খালা ছিল না। চাচা জেঠা কেউ ছিল না। আমাদের কোন আত্মীয় ছিল না। বেড়ানোর কোন জায়গা ছিল না।
আমার জীবনে রক্তের সম্পর্কের মানুষদের কোন ভুমিকা নেই। কোন স্নেহের স্মৃতি নেই। এই যে আমি লেখাপড়া করে ডাক্তার হয়েছি। ক্লাসে ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করেছি। বৃত্তি পেয়েছি। কেহ কোন দিন আদর করে ১ টাকা দিয়ে উৎসাহ দিয়েছেন বলতে পারবে না। মানুষ দাদাবাড়িতে বঞ্চিত হলেও নানা বাড়িতে আদর পায়। আমরা কোথাও পাইনি।

দাদীর স্মৃতি ও ভালবাসাঃ
আমার দাদা ভাই হজ্জে গেলেন। কুরবানির ঈদের পর গরুর চামড়া বিক্রির ১২০০ টাকা আমার দাদি আমাকে দিয়েছিলেন। কাগজ কলম কেনার জন্য। সেই ১২০০ টাকা দেওয়ার অপরাধে আমার দাদি অন্য চাচীদের তোপের মুখে পড়েছিলেন। দাদী অপমানে কেঁদেছিলেন।
সেই দিনকে ভুলা যায় না। আমাদেরকে খুব ভালবাসতেন দাদী। বাবা ছিলেন দাদীর কলিজা। কিন্ত ৬ ছেলে ২ মেয়ে এর বিশাল সংসারে দাদি ছিলেন অসহায়।
আমাদেরকে দেবার মত শুধু ভালবাসা ও দোয়া ছাড়া আর কিছু ছিলনা উনার।

এস এস সি এক্সাম এর সময়ে আমার বড় বোনের এক জোড়া জুতা ছিল না। সে দাদির কাছে বায়না ধরল, এক জুড়া জুতার টাকার জন্য। দাদী দাদার আলমারি থেকে চুরি করে ২৫০ টাকা এনে দিয়েছিলেন। সেইদিন দাদির মুখে একটা সুখের ছায়া দেখেছিলাম। আমাদের বায়না ধরার এই একটা জায়গা ছিল। আম্মাকে দাদি মাঝে মাঝে ২০/৫০ টাকা এনে দিতেন সাবান, লবন, ডাল কেনার জন্য।

২০০০ সালে আমাদের ঘরের সবার চিকেনপক্স হল।
বাবার এত বেশী হয়েছিল, এখন মনে করলেও ভয় লাগে। সেদিন দাদী একটা ছাগল সদকা দেওয়ার মানত করেছিলেন, বিনিময় আল্লাহ যেন বাবাকে সুস্থ করে দেন।

দাদী গরুর মাংস খুব পছন্দ করতেন। আমি মেডিকেলে চান্স পাবার পর যতদিন বাসায় গিয়েছি, যাওয়ার সময় দাদির জন্য গরুর মাংস নিয়ে যেতাম। দাদীর গরুর মাংস খাওয়ার দৃশ্যটা আজো ভুলিনি।

মৃত্যুর কয়েক বছর আগে দাদী আমাদের উপর খুব নির্ভর হয়ে গেলেন। আমাদের ঘরে ঢুকে নিজ হাতে খাবার নিয়ে খেয়ে দাদাভাই এর জন্য নিয়ে যেতেন।
এই স্বাধীনতা অন্য কোথাও ছিল না।

আমরা যেদিন ১১ সেপ্টেম্বর ২০১১ তে কুমিল্লা শহরে চলে আসি সেদিন দাদী ও দাদাভাই খুব কেঁদেছিলেন।
বলেছিলেন আমাদেরকে কার কাছে রেখে যাচ্ছো তোমরা। আমরা যখন চলে আসি, অশ্রুসিক্ত দাদির আমাদের পথ পানে চেয়ে থাকাটা আজো ভুলিনি।
ভালবাসার মানুষ এর অশ্রুজল এর কথা ভুলতে নেই।
দাদি ইন্তেকাল করেন ২৫ জানুয়ারি ২০১২ এর বিকেল বেলা। আমি তখন ফেনীর কসমোপলিটন হাসপাতাল এর Resident Medical Officer. ছুটি ম্যানেজ করে পরদিন ভোরে গ্রামে ফিরি। দাদির কাফন দাফনের সব খরচ আমি দেই। একটি টাকাও উনার সন্তানদের লাগেনি। ভালবাসি দাদিকে। কিছু ভালবাসা ফিরিয়ে দিতে পারায় মন হাল্কা লাগছে।

দাদার স্মৃতিঃ
আমার দাদাভাই প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা আব্দুল মান্নান ওয়াজেদী ছিলেন আমাদের এলাকায় সু-পরিচিত এক ইসলামী ব্যক্তিত্ব। হাজারো আলেমের উস্তাদ তিনি।
অন্য ছেলেদের বিরোধিতায় তিনি আমাদের জন্য খুব বেশি ভুমিকা রাখতে না পারলেও দোয়া দিয়ে গেছেন প্রাণভরে। উনি প্রতি মুনাজাতে বলতেন: আল্লাহ যেন আমাকে উনার বংশের প্রদীপ বানিয়ে দেন। এই দোয়া আমি ভুলি কীভাবে?

দাদীর ইন্তেকাল এর পর আব্বা বাড়ি গেলেন উনাকে দেখতে। টাকা দিলেন। তখন আমি ব্যাংককে Australian Medical Council CaT 1 দিতে।
আব্বা দাদাভাই কে বললেন, জোবায়ের এর জন্য দোয়া করবেন। দাদাভাই বললো: তার দোয়া চাইতে হবে না।
দোয়া যে পৌঁছে তা কি টের পাচ্ছো না? আমাদের জীবনে দাদাভাই এর দোয়ার ভুমিকা বিশাল। দাদাভাইকে যখন ল্যাব এইড এর আইসিইউতে নিয়ে যাই তখন এম্বুলেন্স চলতে শুরু করার পর দাদাভাই গাড়ি থামিয়ে আব্বাকে আবার ডাকলেন।
আব্বার হাত ধরে বলেছিলেন “সফর যদি সংক্ষিপ্ত হয় তাহলে তোমার সাথে দেখা হবে, আর যদি সফর দীর্ঘ হয় তাহলে হাশর এর মাঠে দেখা হবে”। দাদার সফর দীর্ঘ হয়ে গিয়েছিল।

কুমিল্লা মেডিকেল সেন্টারে দাদাভাই এর টেস্ট এর টাকা দেওয়ার লোক ছিল না সেদিন। যারা উনার সব সম্পদ গিলে খেয়েছে তারা কেহ দেয়নি। আমাদের তখন ক্রাইসিস। আমি ব্যাংকক থেকে ফিরছি মাত্র। বেকার। মাত্র ৫০০০/= টাকা ছিল। আমি আব্বার হাতে দিয়ে বললাম আমার কাছে আর ১ টাকাও নেই। দাদাভাইয়ের সময় আর বেশি নেই। এটা উনার হাতে দেন। দাদাভাই মৃত্যুর আগে আমার দেওয়া টাকা ই হাতে নিলেন। আর কারো সেই সৌভাগ্য হয়নি।

ল্যাব এইডে যখন দাদাভাইকে ভেন্টিলেটরে দেওয়া হয় তখন তিনি আমার হাতে ধরে বলেছিলেন, তোদের অনেক বঞ্চিত করেছি, তোদের জন্য মায়া হয়। রাতে ফ্লোরে ঘুমিয়ে দাদার অন্তিম সময়ে সেবা করে পাশে থেকে যে দোয়া পেয়েছি, তার জন্যই আজকের এই আলোময় জীবন।

অভাবের দিনগুলিতে খাবারের পাশাপাশি কাপড় চোপড়েও আমরা অনেক কষ্ট পেয়েছি। আম্মার একটা কাপড় ছিল। দিনে গোসল করতেন না। রাতে গোসল করে পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে ঘুমাতেন। ভেজা কাপড়টা শুকালে সকালে পড়তেন। ১৫ দিন পর আব্বা বেতন পাওয়ার পর দুইটা জনি প্রিন্টের কাপড় এনেছিলেন। সেই দিন ভুলতে পারবো না। তাই এখন আমি যতবার কুমিল্লায় যাই আম্মার জন্য আড়ং থেকে কাপড় কিনে নিয়ে যাই। আজকে যখন আম্মাকে বল্লাম সেই দিনের কথা, আম্মা বললেন: সেইদিন কাপড় ছিল না বলে আজ শুধু আড়ং এর ৫০ টা কাপড়, আলহামদুলিল্লাহ।

একদিন বিকেল বেলা সবাই ঘুমাচ্ছে। আমি উঠে দেখি সকালে যেই কাপড়টা সিলেট থেকে নিয়েছি সেটা
একা একা গায়ে জড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছেন।
আমি চুপিচুপি পুরো ব্যাপারটা খেয়াল করলাম।
যদিও সকালে কাপড় টা নেওয়াতে খুব রাগ দেখালেন। মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য লেকচার দিলেন। বাবা মা এর জন্য আমি আজীবন অপচয় করব। সেই দৃশ্য যে কতটা সুখের তা আমি জানি।

১৯৯৩ সালে কুয়েত গিয়ে ১৯৯৬ সালে বাবা দেশে চলে আসেন। আমি তখন সিক্স এ পড়ি। ১৯৯৬ থেকে ২০০৪ এই আট বছর আব্বা বেকার ছিলেন। আমাদের জীবনের বেশি নিষ্ঠুরতা এসেছিল এই সময়টাতে।
অভাব আস্তে আস্তে আমাদের গ্রাস করে নিল। আব্বা ১৯৯৬ সালে একটা লুঙ্গি কুয়েত ফেলে এসেছিলেন। ৪ বছর পর জেঠা ২০০০ সালে দেশে আসার সময় এই লুঙ্গিটা নিয়ে এসে উনি বাড়িতে তিন মাস পরেন। যেদিন উনি আবার বিদেশ গেলেন সেদিন আম্মা সেই লুঙ্গি এনে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে আব্বাকে দেন। আব্বা সেই লুঙ্গি এক বছর পরেছিলেন। সেই মলিন লুঙ্গির চেহারা আজো ভুলতে পারিনি। কত টা খারাপ ছিল সেই সময়। গত বছর শুধু আব্বার কাপড় রাখার জন্য আমি ৪৬হাজার টাকা দিয়ে হাতিল থেকে একটা আলমারি দেই।

আমি যখন এস এস সি পরীক্ষা দেই। তখন আমার একটা প্যান্ট ছিল না। আমি আমার বাবার একটা পুরাতন প্যান্ট ছোট করে পড়েছিলাম। আমি ক্লাস এইটে যেই প্যান্ট বানিয়েছিলাম সেটা ক্লাস 10 এ গিয়ে ছোট হয়ে গেল। সেটা পরলে ক্লাসের বান্ধবীরা হাসাহাসি করত। স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে এস এস সি এক্সাম দিয়েছি।
এক জোড়া জুতা ছিল না। কাপড়চোপড় এর কষ্টগুলো আমি নিতে পারি না। যখন এইস এস সি এক্সাম দেই তখন পুরো পরীক্ষা একটা ৪০ টাকার বাঘ এর চিত্র আঁকা টি শার্ট পড়ে দিয়েছি। আজ আমার জামা কাপড় অনেক মানুষ গায়ে দেয়, আলহামদুলিল্লাহ। অনেককে আমি জামা কাপড় কিনে দেই। কিন্ত সেই দিনের কথাগুলো কেম্নে ভুলিব। প্রথম ও ২য় লেখার প্রতিটি শব্দ আগের লিখা পড়ে যারা অশ্রুসিক্ত হয়েছেন, সেই অশ্রুজল এর মত পবিত্র ও সত্য। এটা আমাদের নিষ্ঠুর যাপিত জীবনের কিছু খন্ড চিত্র।

অভাবের দিনগুলি। তৃতীয় পর্ব।

আমি যখন টিউমার ছিলামঃ
আমার বাবা তখন বি এ তে পড়েন। ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। খুব ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। একদিন পড়ার টেবিলে দাদি গিয়ে বাবাকে বিয়ের সুখবর দিলেন। তখনো তিনি আমার বাবা হননি। সুখবর শুনে মানুষের চোখে মুখে আনন্দ চিকচিক করে। কিন্ত উনি মুখ গোমরা করে ফেললেন। দাদি গিয়ে দাদাকে জানালেন উনার রিয়েকশন। আমার বাবা উনার বাবাকে যতটুকু সম্মান, মর্যাদা দিয়েছেন এতটুকু হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা খুব কম সন্তান তাদের বাবাকে দিয়ে থাকেন।
বাবা মা এর বিরুদ্ধাচরণ ইহজীবনে করেন নি। দাদা ভাই আমার বাবাকে সাথে নিয়ে গেলেন জৈনপুর এর পীরসাহেব হযরত মাওলানা এমরান আহমেদ সিদ্দিকী এর খানকায়। হুজুর বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। আমাদের এতদাঞ্চলে উনার খুব সুখ্যাতি ছিল। হুজুর সব শুনলেন, আব্বাকে স্নেহ করতেন। দাদাকে বললেন, আমি ইস্তিখারা করে এক সপ্তাহ পর সিদ্ধান্ত দিব।

এক সপ্তাহ পর দাদাভাই বাবাকে নিয়ে হাজির হলেন।
হুজুর হঠাৎ ঘোষণা দিলেন নুরুল আমিন (আমার বাবা) এর বিয়ে আমি পড়াব। আমার বাবার আর না করার সুযোগ থাকল না। জৈনপুরের পীরসাহেব হুজুর উনার পুরো জীবনে দুইটা বিয়ে পড়িয়েছিলেন। এর মধ্যে আমার বাবা মা এরটা একটা।

বছর ঘুরে আমার মা এর কোল জুড়ে বড় বোন আসে।
প্রথম সন্তান যার কন্যা, সেই বাবা ভাগ্যবান। ছয় মাস পর আম্মা একদিন আব্বাকে জানালেন উনার পেটে কি যেন একটা চাকা নড়ে। অনেকটা টিউমার এর মত। মা খুব ঘাবড়ে গেলেন। আব্বা আম্মাকে নিয়ে গ্রাম থেকে পিজিতে হাজির। তখন পিজির গাইনী বিভাগের সম্ভবত রেজিস্টার ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডাঃ শায়লা খাতুন।

ম্যাডাম আম্মাকে চেকআপ করে আব্বাকে নিশ্চিত করলেন আপনারা যেটাকে টিউমার ভাবছেন, সেটা টিউমার নয়। ম্যাডাম মিষ্টি খেতে চাইলেন। ১৯৮৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বিকাল বেলায় সেই টিউমার আমার বাবা মা এর দ্বিতীয় সন্তান ও বড় ছেলে হিসেবে এই ধরনী তে ল্যান্ড করে। আমার মা খুব মায়া নিয়ে গালে চুমু দিয়ে প্রায়ই উনার সেই টিউমারকে আদর করেন এবং টিউমার এর ডাক্তার হয়ে উঠা নিয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে উঠেন।

আমার মায়ের অতীতের পাড়ি দেওয়া দুঃখ নদীর কাছে আমি শিখেছি অনেক কিছু। ঢেউ জানা নদীর কাছে শিখার আছে অনেক কিছু। আমার মা একজন নির্লোভ ও নরম মনের সাহসী নারী। কোন চাওয়া পাওয়া, কোন অভিযোগ তখনো ছিল না। আজো নেই।

আম্মাকে প্রশ্ন করলাম কেমন সুখে আছেন? মায়ের উত্তর সুখের শেষ নেই। জীবনে এমন সুখের দিন আসবে সেটা উনার কল্পনাতীত ছিল। উনি বিশ্বাস রেখেছেন নিজ লক্ষ্যে। কি পেয়েছেন, কি খেয়েছেন, কি পরেছেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি। একটাই স্বপ্ন ছিল ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করে মানুষ হয়ে মানুষ এর পাশে দাঁড়াবে।

আমরা কুমিল্লা শহরে যেই ফ্লাটে ভাড়া থাকি, অনেকেই বলে কাজের লোকের অভাব। কিন্ত মা এর কাজের লোকের অভাব হয় না। যে একবার মা এর মায়া পেয়েছে সে আর যেতে চায় না। এইবার কুরবানিতে দেখলাম অনেকগুলো ছোট ছোট প্যাকেট করেছেন। আমি বললাম কাকে দিবেন? অনেকগুলো কাজের লোকের নাম বললেন।

সেই মা ই আমার শক্তি। আমার সাহস এর বাতিঘর।
মা এর পাওয়া সব কষ্টগুলো ই আমার সম্পদ। এগুলো আমাদের আজকের এই সময়ে নিয়ে আসতে প্রেরণা দিয়েছে এবং দিয়ে যাবে।

পাতা কুড়ানো সেই দিনগুলো।
আমি রান্না ঘরে গেলেই আমার স্মৃতিতে পড়ে কত কষ্ট করে মা রান্নার লাকড়ি/পাতা সংগ্রহ করতেন। সেদিন আমার ডাঃ নাবিলাকে অটো গ্যাস স্টোভ কিনে দিয়ে বললাম মায়ের পাতা কুড়ানোর কথা। একদিন আমি কলেজ থেকে দুপুরে বাড়ি এসেছি। এসে দেখি মা ঘর্মাক্ত কিন্ত মন ভীষণ খারাপ। জিজ্ঞেস করাতে ছোট বোন মিনা বললো, আম্মা দুই পুকুর এর ভিতর থেকে পাতা কুড়িয়ে বড় উঠানে রোদে দিয়েছেন শুকাতে, এক মহান চাচা খুব চিল্লাফাল্লা করেছেন। বলছেন, এগুলো তাড়াতাড়ি না সরালে উনি ফেলে দিবেন। আমাদেরকে তো সহ্য করতেন না-ই, আমার মায়ের কুড়ানো পাতাকেও উনারা সহ্য করতেন না। আজ আর মাকে পাতা কুড়াতে হয় না।

ফ্রিজ কেনার গল্পঃ ২০১০ সাল।
আমি তখন সিওমেক এ ইন্টার্নী ডাক্তার। একদিন সকালে বাড়ি পৌঁছে দুপুরে আমাদের আড্ডা বাজারে গেলাম। ফিরলাম সন্ধ্যায়। আসার পর গোল্ডেন সিস্টার আফসানা বলল। আম্মা আজকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে বিকালে। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করাতে বললো বেয়াল (খালের উপর বাশ ফেতে মাছ ধরার গ্রামীণ পদ্ধতি) থেকে অনেকগুলো কই ও টেঙরা মাছ কিনে আনছে আম্মা। কিছু আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই সোহাগ এর জন্য ফ্রিজে রাখতে গেছিল, কিন্ত কারো ফ্রিজে জায়গা দেয়নি কেহ। সেদিন আমি আবার রাতে বাজারে গেলাম। তারপর আমাদের ইউনিয়ন এর সাবেক চেয়ারম্যান বাদল কাকা এর গোল্ডেন সমবায় সমিতি থেকে এক বছর এর কিস্তি তে HAIER এর একটা ফ্রিজ কিনে আনি। আজকের দিনগুলোতে যতবার ফ্রিজ খুলি ততবার সেই কথা মনে পড়ে।

সোহাগের কথাঃ
আমরা তিন ভাই এর দ্বিতীয় হল সোহাগ। সোহাগ যখন ক্লাস ১০ এ পড়ত তখন আমার এক চাচাত ভাইকে প্রাইভেট পড়াত। মাসে ১০০ টাকা। প্রথম মাস পড়ানোর পর টাকা দেওয়ার দিন চাচী বলল, সোহাগ তোর আম্মার কাছে ১০০ টাকা পাই। তোর এই মাসের বেতন দিয়ে সেই টাকা পরিশোধ হয়ে গেল। তার সেই দিনের চাপা কান্না ও কষ্টটা আমি ভুলিনি। আজ সোহাগ NSU থেকে বায়োটেকনোলজিতে মাস্টার্স শেষ করে USA তে PhD করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই চাচাত ভাই কতদূর আগালো, সেটা আর নাই বা বললাম।

অভাবের দিনগুলি। শেষ পর্ব।।
একটা মন খারাপের স্মৃতি থেকে লেখাটি লিখেছিলাম।
আমাদের জীবনের বিষাদময় নিষ্ঠুরতার কিছু খন্ড চিত্র দেখে আপ্নারা অনেকেই অশ্রুজলে সিক্ত হয়েছেন। আপনাদের আবেগ ও হৃদয় এর হাহাকার জানিয়ে আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন যা আগামীর পথ চলায় সাহস যোগাবে।

প্রাদোষে প্রাকৃতজন বই টা যারা পড়েছেন সেখানে একটা প্রশ্ন করা হয় ‘এটা কি মানুষ এর জীবন? সুখ নেই, স্বস্থি নেই। এই জীবন কি যাপন করা যায়?
আমাদের জীবনটা তেমনই ছিল। এত করুণ ও নিষ্ঠুর যা কল্পনার অতীত। আমার নানী মাকে সাহস দিতেন, ধৈর্য্য রাখো, একদিন সুখ আসবে। নানী একবার উনার বাবার বাড়ি শ্রীরামপুর গেলে আম্মার মামীরা বললো, এই যে আপনার ছোট মেয়ে এত কষ্টে আছে, আপনার বড়লোক মেয়েকে অনুরোধ করতে পারেন না ওকে সাহায্য করতে? নানী উত্তর দিয়েছিলেন, যতক্ষণ বান্দার ঠ্যাং এ ধরব, ততক্ষণ আল্লাহ এর কাছে বলব। একদিন আল্লাহকে আমার কথা শুনতে হবে। আল্লাহ রেস্পন্স করেছেন নানীর দোয়ায়।

নানীকে ১৯৯৪ থেকে ২০১৭ আমাদের কাছেই ছিলেন।
মাঝে কিছুদিন ঢাকায় মামা ও খালার বাসায়। নানী ছিল মায়ের সাহস এর বাতিঘর। সব অবস্থায় আমার বাবা মা শুধু আল্লাহ এর উপর ভরসা করেছিলেন।

আল্লাহ এমন দুইজন লোককে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য পাঠিয়েছেন যা আমরা কল্পনাও করিনি।
একজন আমার প্রিয় বুয়েট এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. দেলোয়ার হোসেন কাকা।
উনি আমার মায়ের সংগ্রামকে সম্মান দিয়ে বোন বলে ডেকেছেন। মায়া ও ভালবাসায় আমাদের জীবন উনি ভরিয়ে দিয়েছেন। উনি আমার এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
উনি আমাদের রক্তের কেহ না। কিন্ত আমাদের হৃদয় মাঝখানেই উনি বসবাস করেন। উনি যখন হাসি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতেন পিঠ চাপড়ে সাহস দিতেন তখন সবকষ্ট ভুলে যেতাম। এত ব্যস্ততার মাঝেও মেডিকেলে পড়াকালীন উনি প্রতি মাসে আমার কাছে চিঠি লিখতেন। আজো সেই চিঠি গুলো যত্নে রেখে দিয়েছি। এখনো মন খারাপ এর রাতে এগুলো পড়ি।

২০০৪ সাল। মেডিকাল ভর্তি পরীক্ষার পর প্রথম কলটা আম্মাকে দেই। আমাদের মোবাইল ছিল না। ছোট চাচীর মোবাইলে কল দিয়ে আম্মাকে জানাই। আমি ঢাকায় বসে বুঝতে পেরেছি মায়ের অশ্রুঝরা। দ্বিতীয় কল দিয়েছিলাম ড. দেলোয়ার কাকাকে। উনি আমাকে উনার বুয়েটের অফিসে ডাকলেন। তারপর আমার শিক্ষার সব দায়িত্ব উনি নিয়ে নিলেন পাশাপাশি আমার পরিবারে জন্য উনি সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। আমাদের সব চাওয়া পাওয়ার কেন্দ্র হয়ে উঠলেন কাকা।

২০০৫ সাল। আম্মার পিত্তথলিতে পাথর। প্রায়শই ব্যাথা হয়। সাথে Dysfunctional Uterine Bleeding.
একসাথে দুইটা অপারেশন দরকার। আম্মা অপারেশন এর কথা শুনার পর থেকেই মানুষিক ভাবে ভেঙে পড়লেন। আমি তখন মেডিকেলের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।
আমি গেলাম দেলোয়ার কাকার বাসায়। উনি আমাকে দেখে হাসি দিলেন। তারপর সব শুনে বুয়েট এর Teachers Associations থেকে ১ লক্ষ টাকা লোন তুলে আমাকে দিলেন। সেই অবদান ভুলার নয়।
আমাদের পরিবারের সারা বছর এর চাউল উনি কিনে দিয়েছেন। ড. দেলোয়ার কাকার একদিন আমাকে বললেন জীবনে সুখী হতে চাও, কারো কাছে কিচ্ছু প্রত্যাশা করবে না। এটা জীবনে সুখী হওয়ার সুত্র।
প্রতিদান প্রত্যাশা না করেই উনি আমাদের জীবন মায়ায় ভরিয়ে দিয়েছেন। অফুরন্ত ভালবাসা ও সম্মান প্রিয় ড. দেলোয়ার কাকার জন্য।

শামীম কাকার কথাঃ
২০০১ সালঃ এস এস সি পাশ করেছি। কলেজে কীভাবে ভর্তি হব এই চিন্তায় মগ্ন। একরাশ হতাশা ঘিরে ছিল।
একদিন পড়ন্ত বিকেল বেলা আব্বা আমাকে নিয়ে গেলেন শামীম কাকার কাছে। তখন কাকা গ্রামে এসেছেন। উনি আব্বার চাচাত ভাই। SQ GROUP এর চেয়ারম্যান। কাকা আব্বার সব কথা শুনলেন। সাথে দাদী বসা ছিলেন। সব শুনে হতবিহ্বল হয়ে গেলেন উনারা। আমরা কেন কষ্টে থাকব এটা উনারা কুল কিনারা করতে পারলেন না? দাদী তদন্ত করলেন। মরহুম হাবিব উল্লাহ দাদাভাই ও আমাদের ইউনিয়ন এর সাবেক চেয়ারম্যান আব্বার চাচা মরহুম খালেক দাদাভাই উনাদের বিস্তারিত জানালেন। একদিন দাদি ঢাকা থেকে খবর পাঠালেন, আব্বা যেন শামীম কাকার সাথে দেখা করে। আব্বা গেলেন। কাকা আমাকে আড্ডা কলেজে ভর্তি হতে বললেন। ২০ হাজার টাকা পরিবারে দিলেন।
আমি আড্ডা কলেজ এ পড়েছি দুই বছর। হোস্টেল এ থাকা ও খাওয়া, প্রাইভেট পড়ার স্যারদের সম্মানি, কলেজ এর বেতন, ফরম ফিলাপের জন্য আমার ১ টাকাও লাগেনি। সব কাকার অবদান।

আব্বা ২০০৪ এ আবার কুয়েত গেলেন। প্লেন এর টিকেট ভাড়ার জন্য কাকা ৩০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
ড. দেলোয়ার কাকার পাশাপাশি শামীম কাকাও আমাকে মেডিকেল এর ৫ বছর ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট দিয়েছেন।
আমি এক কাকার টাকায় নিজে চলতাম। আরেকজন এর টাকায় ভাইবোনকে সাপোর্ট দিতাম। নিজে কোচিং ও টিউশন এর টাকা মা এর জন্য পাঠাতাম। এই দুইজন মানুষ এর কাছে আমরা চিরঋণী।

ডাক্তার হওয়ার পর ২০১০ সাল থেকে পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমি নিজ কাঁধে নিয়ে নেই। ভাইবোনগুলো লেখাপড়া করে অনেক দূর আগালো। আমার মায়ের দুই মেয়ে মাস্টার্স এ পড়ে। সোহাগ PhD প্রোগ্রাম এর প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। গোল্ডেন সিস্টার আফসানা কলেজ এ।
আমার বড় বোনের টুইন বাচ্চা ইরফান কুমিল্লা জিলা স্কুল এ ক্লাস সেভেন এ, আর ইন্তিহা মর্ডান স্কুলে।
বাবাকে হজ্জ করিয়ে আনলাম গতবছর। ২০১১ সাল থেকে আমরা কুমিল্লা শহরে থাকি।

আমি একজন সেল্ফ এম্পলয়েড ডাক্তার। নিজের প্রজেক্ট ডাঃ জোবায়ের মেডিকেয়ার সেন্টার এ কাজ করছি। অনেক ভাল আছি। বিসিএস আমাকে আকর্ষণ করতে পারেনি। যেতে হবে বহু দূর। আমাকে যদি প্রশ্ন করেন “সুখ কি? আমার উত্তর মা-বাবার মুখের হাসি।

লেখক: Dr. Jobayer Ahmed
ওযায়ের আমীন সম্পাদিত। লেখাটা ভীষণ অনুপ্রেরণার। তাই ঈষৎ সেচ্ছা সম্পাদনা করে প্রকাশ করলাম। ডাক্তার জোবায়ের অাহমদ। তোমার প্রতি শুভকামনা অবিরাম। তোমার মা-বাবার প্রতি দোয়া রইলো। কেউ অনুপ্রাণিত হলে সার্থক অনুভব করবো।

Facebook Comments