বিশ্বস্ত বন্ধুত্বের পথে ৪ টি পদক্ষেপ

380

যখন আমরা বিশ্বস্ত বন্ধুর কথা ভাবি, তখন আমরা কেবল সর্বকালের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু আবু বকর আস-সিদ্দীক্ব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর কথাই ভাবতে পারি। তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে রাসূল (ﷺ)  বলেন, “আমি যার কাছেই ইসলাম পেশ করেছি, সে-ই ইসলাম গ্রহণের পূর্বে নিজে নিজে বিবেচনা করেছে, একটু চিন্তিত হয়েছে কিংবা আমার নবুওয়াতের প্রমাণ চেয়েছে। কিন্তু আবু বকরকে ইসলাম পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে নিঃসংকোচে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে।” সুবহান আল্লাহ! কী অপূর্ব তাদের বন্ধুত্বের ভীত। নবী (ﷺ) তাঁকে এতোটাই বিশ্বাস করতেন যে, তিনি তাঁকে ‘আস-সিদ্দিক্ব’ উপাধি দিয়েছিলেন, কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিলো দৃঢ় ও অটল, আর তাঁর বন্ধুত্ব ছিলো পাথরের মতো কঠিন যার কারণে তিনি অনেকবারই নবীজির (ﷺ) বাণীকে সমর্থন করতে গিয়ে বিসর্জন দিয়েছেন নিজের সম্পদ ও নিরাপত্তা।

বন্ধুত্ব
যে সকল বন্ধু আপনাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে ।

ভালো বন্ধুর একটি মৌলিক উপাদান হলো একমাত্র আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা। একটি চমৎকার হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, যারা পরস্পরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে কিয়ামতের দিন তারা আল্লাহর আরশের ছায়ায় থাকবে। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, সাত প্রকার লোককে আল্লাহ তা’আলা হাশরের ময়দানে নিজের আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন। যখন সে ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। তাদের মধ্যে রয়েছেন সেই  দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবাসেন এবং সেই মহব্বতের জন্যই তারা একত্রিত হন। এবং সেই মহব্বতের কথা স্মরণ রেখেই পরস্পর থেকে পৃথক হন, [বুখারী], যা আমাদের দেখায় জীবন চলার পথে ভালো সাহচর্যের মাধ্যমে কতো সুউচ্চ মর্যাদায় আমরা উন্নিত হতে পারি।

বন্ধুত্বকে অনেকটা সেই পথিকের সাথে তুলনা করা যায়, যে কিনা একটি চূড়ান্ত গন্তব্যের পথে যাত্রা করেছে; যেমনটা একজন লেখক লিখেছেন,
“একাকী ভ্রমণ অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু একজন অভিজ্ঞ পথিক জানেন, ভ্রমণই হচ্ছে তার জীবন আর মানব জীবনে সঙ্গী অপরিহার্য এক অঙ্গ। ‘সঙ্গী’ মানে তারাই, যারা এক পাতে খাবার খায়। তারাই প্রকৃত সুখী, যারা ভেবে নিতে পারে যে, তারা সর্বদা পথেই আছে এবং যাত্রাপথে যাদের সাথেই তাদের সাক্ষাত ঘটে, প্রত্যেককেই তারা নিজেদের কাঙ্ক্ষিত সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে। উত্তম পথিকেরা তাদের বিরক্তিকর সঙ্গীদের দিকে খেয়াল রাখে। তাদের সঙ্গীরা কখন মনোবল হারাচ্ছে, তারা ঠিক ঠিক তা বুঝতে পারে। তারা যেভাবে তাদের খুঁজে পায়, সেভাবেই তাদের গ্রহণ করে নেয়, তাদের কথা শুনে। বুদ্ধিমত্তার সাথে, নম্রভাবে, সর্বোপরি ভালবাসার সাথে তারা তাদের সামনে এগিয়ে যেতে এবং যাত্রাপথের আনন্দ ফিরে পেতে উৎসাহ যোগায়।”

একবার এক ‘আলিম পরস্পরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার জন্য ভালোবাসার এই সুন্দর ধারণাটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেনঃ
“একটি বন্ধুত্বকে আল্লাহর জন্য বলে মোহরাঙ্কিত করা সেই সম্পর্কটি কেবল আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও বিশ্বাসের উপর গড়ে তোলার বাধ্যবাধকতাই নির্দেশ করে, এই বন্ধুত্বটি কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলারই স্বার্থে। এটি আরো নির্দেশ করে যে এক্ষেত্রে কেবল সাধারণ ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়; বরং এর দ্বারা বোঝায় সেই ভালোবাসা যা গড়ে ওঠে মৈত্রীর উপর। যা উন্মেষ ঘটায় সহযোগীতা, সম্মান ও শ্রদ্ধার। অর্থাৎ আপনি যাদের ভালোবাসেন কথা ও কাজ উভয় ক্ষেত্রেই তাদের সাথে থাকা। আল্লাহর স্বার্থে অনুগত হওয়ার প্রকৃত অর্থ হলো আল্লাহকে ভালোবাসা ও তাঁর দ্বীনের কল্যাণে কাজ করা; তাদের ভালোবাসা যারা আল্লাহ আয্‌যাওয়াজাল-এর প্রতি অনুগত ও তাদের সাহায্য করা।”

ভালো সঙ্গী খুঁজে পেতে আমরা বিশ্বাসের বীজ বপন করছি যাতে আমাদের বন্ধুত্ব বিশ্বাসের উপর গড়ে ওঠে, আর প্রত্যেকের বিশ্বাস যেনো তাকে ভালো বন্ধু পেতে উৎসাহ যোগায়।


আরও পড়ুন – আল্লামা আতহার আলী রহ., চেতনার বাতিঘর এক মহান পুরুষ


ভালো সহচর পাওয়ার ব্যবহারিক কৌশল

উপর্যুক্ত বন্ধুদের মতো কিছু বিশ্বস্ত বন্ধু খুঁজে পেতে আপনাকে সাহায্য করার জন্যই এখানে কিছু ব্যবহারিক কৌশলের কথা উল্লেখ করা হলো যেগুলো আপনি কাজে লাগাতে পারেনঃ

১. আন্তরিক হোন এবং নিজে থেকে শুরু করুনঃ

ভালো বন্ধু খুঁজে পাওয়ার চাবিকাঠি হলো সকল ইসলামিক কার্যকলাপের পাশাপাশি নিয়্যাতের ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া, আর উপর্যুক্ত গুণাবলী ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো নিজের মধ্যে বিকাশ ঘটানো যা আমরা ভালো বন্ধুদের মাঝে দেখতে চাই।

২. খারাপ বন্ধু ত্যাগ করুনঃ

আমি জানি খারাপ বন্ধু ত্যাগ করার সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা খুব সহজ নয়, কিন্তু মনে রাখবেন আপনি যদি কোনো কিছু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার জন্য ত্যাগ করেন তবে তিনি এর পরিবর্তে অনেক উত্তম কিছু দান করবেন। তার মানে এই নয় যে একসাথে সব খারাপ বন্ধুকেই ত্যাগ করতে হবে, বরং তাদের ভালো কাজ করার উপদেশ দিন, তাদের ভেতর পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্য অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হোন এবং তাদের জন্য দু’আ করুন।

৩. ন্যায়পরায়ণ বন্ধুর খোঁজ করুনঃ

এটা সম্ভব কেবল জ্ঞানী লোকদের মজলিশে উপস্থিত থাকার মাধ্যমে, যারা তাদের সত্যবাদীতা, ন্যায়পরায়ণতা ও উত্তম সাহচর্যের জন্য বিশেষ পরিচিত। সঠিক জায়গায় যান। ঈমান বৃদ্ধির জন্য আমাদের উচিত সে সকল স্থানে যাওয়ার লক্ষ্য স্থির করা যেখানে গেলে ভালো মানুষদের পাওয়া যাবে (মসজিদ, ইসলামিক হালাকা [Study Circle], কিংবা আপনি OIEP/ICD থেকেই শুরু করতে পারেন) এবং ক্ষতিকর স্থান এড়িয়ে চলা।

লক্ষ করুন এ ব্যাপারে নবী (ﷺ) কী বলেছেনঃ

সৎ সহচর ও অসৎ সহযোগীর দৃষ্টান্ত হলোঃ একজন কস্তুরীর (সুগন্ধি) ব্যবসায়ী, অন্যজন হাপর চালানকারী (অর্থাৎ কামার)। কস্তুরীর ব্যবসায়ী হয় তোমাকে বিনামূল্যে কস্তুরী দেবে অথবা তুমি তার কাছ থেকে তা কিনে নেবে। যদি এ দু’টির একটিও না হয়, তবে তুমি অন্তত তার কাছ থেকে এর সুঘ্রাণটা পাবে। আর হাপর চালানকারী হয় তোমার কাপড় পুড়ে ফেলবে অথবা তুমি তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে।
[বুখারী ও মুসলিম]


৪. আল্লাহর কাছে দু’আ করুনঃ

সবসময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে দু’আ করুন যাতে তিনি আপনাকে উত্তম সাহচার্যের দিকে পরিচালিত করেন, আর নিজের পাশাপাশি বন্ধুদের জন্যও দু’আ করুন যাতে আল্লাহ সকলের দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে সর্বোত্তম কল্যাণ দান করেন।

এই ৪ টি কৌশলই আপনার ভালো বন্ধুর অনুসন্ধানে সাহায্য করবে যারা আপনাকে সহায়তা করবে ন্যায়পরায়নতার বীজ বপনে। আর সবশেষে দু’আ করি আমরা সবাই যেনো আখিরাতের বিশ্বস্ত বন্ধুদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি। আমীন।

Facebook Comments