বিয়ের প্রকৃত বয়স – হালাল সম্পর্ক অনাবিল সুখের আঁধার

589
বিয়ের বয়স
“কী করলে তুমি বিশ্বাস করবা যে আমি তোমাকে সত্যিই ভালবাসি?” নাস্তা খেতে যাওয়ার সময় রাস্তার একপাশে মোবাইলে কথা বলতে থাকা ছেলেটার কথা কান এড়িয়ে গেল না। ছেলেটার কণ্ঠে বিরক্তি আর উৎকণ্ঠা। ভাবলাম, কতটা Insecurity তে ভুগলে একটা মেয়ে একটা ছেলেকে এমন কথা বলতে পারে! আর ছেলেটাও যে কতটা মানসিক অশান্তিতে ভুগলে পছন্দের মানুষটিকেও এমন বিরক্তির সুরে কথা শোনাতে পারে!
এমন Insecurity তে ভুগবার ঘটনা কিন্তু হারাম সম্পর্কের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। কারণ কি মেয়েরা স্বভাবগতভাবেই আরেকজন মানুষকে এতটা বিশ্বাস করতে ভয় পায়? কারণটা কি ছেলেরা একটু উড়নচণ্ডী স্বভাবের হয়? অনেকে অনেক কারণ বললেও আসল কারণটা কিন্তু আড়ালেই থেকে যায়। সেটা হল হারাম সম্পর্কগুলোতে আল্লাহর রহমত থাকে না।
আর আপনার বিয়ের আগের প্রেমের সম্পর্কে আপনি সৎ থাকলেও, বিয়ের জন্য একেবারে খাঁটি নিয়্যাত রাখলেও আর অনেক সুখে থাকলেও কিন্তু হারাম হারামই থেকে যায়। সেটা হালাল হয়ে যায় না। [১]
আবার আপনার এমন বয়স হয়েছে যে কারও সাথে সুখ, দুঃখগুলো ভাগাভাগি করে নিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে এমন কাউকে খুঁজে পেতে যে আপনাকে বুঝবে, ভালবাসবে, সাহায্য করবে, উৎসাহ দিবে। বাবা-মা আর বন্ধুদের মত করে না। সহজকথায়, আপনার প্রেম করতে ইচ্ছে করে। আর এই ইচ্ছে হওয়াতে দোষের কিছু নেই কারণ বয়সটাই এমন। দোষ হবে যদি আপনার এই ইচ্ছে মেটাতে আপনার রব্বের দ্বারা নিষিদ্ধ কিছুতে জড়ান। তাহলে নিষিদ্ধ নয় কী? উত্তরটা সবার জানা, শুধু হয় না মানাঃ বিয়ে
কিন্তু পরিবার, সমাজ সভ্যতা আজ যুগের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে বেতাল হয়ে গেছে। তাদের মতে, আপনার বিয়ের বয়সই হয় নি। আপনি হারাম থেকে বেঁচে থাকতে চাইছেন সেটা যেন তারা বুঝতেই চায় না। তারা বলছে, অন্যরা তো তোমার মত এমন বিয়ে বিয়ে করে লাফালাফি করছে না। অথচ তারা বুঝতে চাইছে না যে অন্যরা হালাল-হারামের তোয়াক্কা করে না; তারা বয়ফ্রেন্ড, গার্ল্ফ্রেন্ড, জাস্ট-ফ্রেন্ডসহ নানাপদের সম্পর্ক তৈরি করে নিয়ে মানসিক চাহিদা মিটিয়ে চলেছে।
আবার রাসূল ﷺ বলেছেন ‘সামর্থ্য’ হলেই বিয়ে করে ফেলতে। এই সামর্থ্য কেবল মানসিক আর শারীরিক সামর্থ্য নয়। আর্থিকও যে তার অন্তর্ভুক্ত তা অনেকসময় আমরা মানতে চাই না। কোনো এক দ্বীনি ভাইয়ের বা বোনের আপনারই মত বয়সে একেবারে স্বপ্ন সত্য হওয়ার মত করে বিয়ে হয়ে গিয়েছে, আমরা শুধু সেই উদাহরণ টেনে আনতে চাই। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সেইসব ভাইবোনদের সাথে আপনার পরিস্থিতি মোটেই একরকম নয়। হয়তো তাদের বাবা-মা রাজি হয়ে গিয়েছিলেন বা কোনও একটি কারণে আল্লাহ সহজ করে দিয়েছেন। হতে পারে তিনি আল্লাহ সুবহানাহুর কাছে অনেক বেশি দুয়া করেছিলেন।
বিষয়টা যাই হোক না কেন, এমন ভাইবোনেরা অণুপ্রেরণা হতে পারেন, কিন্তু উদাহরণ নয়। কারণ পরিবার-সমাজ আজ অসুস্থতায় ভুগছে একথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। তাহলে আমাদের কী করা উচিত? সমাজের মুণ্ডুপাত করার আগে আসুন আগে নিজেদের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো শুধরে নেওয়ার আর নিজেদের করণীয়গুলো ঠিকভাবে করবার চেষ্টা করি ইনশাআল্লাহ। অনেক ভাই বিভিন্ন সময়ে এই বিষয়ে নাসীহা চান, তাই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই লিখাটি লিখা। আল্লাহ কবুল করুন।
প্রথমত,
আল্লাহর কাছে বেশি বেশি করে দুআ করা যেন তিনি বিষয়টি সহজ করে দেন। আর একইসাথে তাঁর উপর এই বিষয়ে ভরসা রাখা যে তিনি সুবহানাহুতা’লা কখনও কোনও বান্দাকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না। প্রায় সকলেই সূরা ফুরকান এর ৭৪ নং আয়াতে স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের শেখানো দুয়া জানেন। তবুও আরেকবার উল্লেখ করে দিচ্ছি ইনশাআল্লাহঃ
وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
অর্থঃ এবং যারা বলে, “ইয়া রব, আমাদের স্ত্রী-সন্তানদের পক্ষ থেকে আমাদের চোখে শীতলতা দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য আদর্শস্বরূপ করুন। (সূরা ফুরকান, ৭৪)
পরিচিত এক দ্বীনি ভাই ভার্সিটির ৩য় বছরেই বিয়ে করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার কাছে অন্যান্যরা এই সাফল্যের রহস্য জিজ্ঞাসা করায় তিনি সোজা উত্তর দিয়েছিলেন যে তিনি নাকি আল্লাহর কাছে অনেক দুআ করেছেন। আর অবশেষে আল্লাহ তার দুয়া কবুল করেছিলেন। তাই দুআকে কখনোই অবহেলা করবেন না। দুয়া তো মু’মিনের অস্ত্রস্বরূপ।
দ্বিতীয়ত,
রোযা রাখা। রাসূলুল্লাহর ﷺ সামর্থ্য হলেই বিয়ের হাদিসটির দ্বিতীয় অংশটি হল ‘না পারলে রোযা রাখ’ অর্থাৎ যদি কোনো কারণে বিয়ে করতে না পার তাহলে রোযা রাখা। আর অবস্থাভেদে এই রোযা লাগাতারও হতে পারে। এতে করে কামনা-বাসনা আর দৃষ্টি হিফাজতে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
তৃতীয়ত,
(এই বিষয়টি বিশেষ করে ভাইদের জন্য) আর্থিক সামর্থ্য অর্জনের হালাল চেষ্টা করা ও আল্লাহর সাহায্য চাওয়া। এই বিষয়ে অনেক ভাইদেরকেই উদাসীন হতে দেখা যায়। অথচ এই সমস্যার সমাধান হলেই দেখা যায় অনেক পরিবার আর না করে না। যদিও আসলে অভিভাবকদেরই উচিত ছিল সন্তানদের বিয়ের বয়স হলেই বিয়ের ব্যবস্থা করা ও সাহায্য করা আর তা না হলে আল্লাহর কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে, তবুও ফিতনা এড়াবার জন্য জাহিল অভিভাবকদের থেকে এ আশা না করাই উত্তম।
নিজের বিয়ের খরচাপাতিগুলো নিজে বহন করা আর বিয়ের পরে স্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এর সমাধান না হলে বিয়ের আগের ফিতনার চেয়ে বিয়ের পরের ফিতনাই আরও মারাত্নক আকার ধারণ করতে পারে। অনেক ভাইকে দেখেছি পরিবার বিয়ের খরচ দিচ্ছে বলে অপ্রয়োজনীয় বাজে খরচে ভাইদের বাধ্য করেছে যদিও রাসূল ﷺ বলেছেন যে সেই বিয়েই সবচেয়ে বরকতপূর্ণ যে বিয়েতে খরচ করা হয় সবচেয়ে কম। অর্থাৎ হাল আমলের লাইটিং-ফাইটিং টাইপেরও বাজে খরচ করা হয় না। গানবাজনা, গায়ে হলুদ, মেহেদি নাইটের মত জাহিলি সংস্কৃতি তো দূরের কথা। আর্থিক দৃঢ়তার অভাবে ভাইয়েরা জানা সত্ত্বেও পরিবারের চাপে এসব কাজে আর না করতে পারেন নাই। আল্লাহ ক্ষমা করুন।
এছাড়া একজন মেয়ে তার নিজ পরিবার ছেড়ে যখন স্বামীর ঘরে এসে সংসার করতে আসে, তখন একবুক স্বপ্ন নিয়ে আসে। হয়তো তার দ্বীনের কোনো একটি বিষয় নিজ পরিবারে অনেক কঠিন হয় বা হয়তো এক অপূর্ণ ইচ্ছা যা সে স্বামীর সান্নিধ্যে এসে সহজ হবে বোধ করছিল। এছাড়া স্ত্রী এলে আপনি নিজেও হয়তো অনেক বিষয় সহজ হবে বলে আশা করেন, কিন্তু শেষমেশ আসলে পুরুষকেই এগুলো সামলাতে হয়।
তাই ভাইদের জন্য এটা একটা পরীক্ষা। আর বহু ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বিষয়টা অনেকখানি সহজ হতে পারে কেবল ভাইদের আর্থিক অবস্থার দৃঢ়তা। তাই ব্যবসা বা চাকরি যাই আপনার জন্য সহজসাধ্য মনে হয় তাই তাওয়াক্কুল করে চেষ্টা করতে থাকুন। এক্ষেত্রে আবশ্যক, আয়ের উৎস হালাল হচ্ছে কিনা আশেপাশের অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিন। আল্লাহ আমাদের জন্য সহজ করুন।
চতুর্থত,
নিজের পরিবারকে যথাসম্ভব সুন্দর আচরণে বোঝানো আর তাদের হিদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করা। আল্লাহর ইচ্ছায় শুধুমাত্র পরিবারের সাপোর্ট থাকলেই বিয়ের বিষয়টা অনেক সহজ হতে পারে। পরিবারকে বোঝানোর জন্য তাদেরকে সুন্নাহ মেনে বিয়ের উপকারিতা, তাতে খরচ কীভাবে কমানো যায় আর সেটাই যে আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়, বর্তমান সমাজের অসুস্থতার দিকে ইঙ্গিত আর বিয়েই যে তার উত্তম সমাধান, জীবনসাথীর ক্ষেত্রে দ্বীনদারিতাই যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়াদি গুরুত্ব পেতে পারে ইনশাআল্লাহ। এই বিষয়টার খিয়ানত বোনদের পরিবারের ক্ষেত্রে বেশি হয়ে থাকে। তাই এবিষয়ে অনেক আগে থেকেই ধীরে ধীরে জোর দেওয়া উচিত ইনশাআল্লাহ।
পঞ্চমত,
নফল ইবাদাত বাড়িয়ে দিন আর আশেপাশের হারামে মজে থাকা মানুষগুলোর দিকে নজর না দিয়ে সিরতল মুস্তাকিমে যুদ্ধরত বান্দাদের দিকে নজর দিন। শয়তান যেন আপনাকে হতাশার ধোঁকায় ফেলতে না পারে। কিছু নফল ইবাদাত হতে পারে রাতের শেষাংশের কিয়ামুল-লাইল, চাশতের সলাত, সকাল-সন্ধ্যার জিকির, কুরআন তিলাওয়াত, নতুন নতুন দুআ ও যিকির শেখা, আমল করা ইত্যাদি।
আল্লাহ আমাদের নিয়্যাতগুলো পবিত্র করে দিন এবং আমাদের আমল ও চেষ্টাগুলোকে কবুল করুন। এই লিখাটির সমস্ত সার্থকতা আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং তিনিই একমাত্র প্রশংসার মালিক। একইসাথে সমস্ত ভুলত্রুটি কেবলই আমার এবং আমিই দায়ী। আল্লাহ আমায় ক্ষমা করুন।
বিঃদ্রঃ এই নোটটি লিখার সময় লেখক অবিবাহিত ছিলেন। তাই আমাদের কষ্ট বুঝবেন না… ইত্যাদি অভিযোগ ভিত্তিহীন।
ধৈর্য্য ধরে পড়বার জন্য জাঝাকাল্লাহ। আল্লাহ আপনার চেষ্টাগুলো কবুল করুন ও আপনার জন্য অর্ধেক দ্বীন পূর্ণ করা সহজ করে দিন।
[১] নিয়্যত ভাল হলেও এমন ভালবাসাগুলো সম্পর্কে আরও জানতে পারবেন ‘ভালবাসা ও দু’টি বাস্তবতা’ লেখাটিতে।
===================
লেখক — তানভীর আহমেদ
Facebook Comments