মহরম মাসে করণীয় ও বর্জনীয় – শায়খ আহমাদুল্লাহ

284

সম্মানিত মাস হিসেবে মহরমের যেসব করণীয়-বর্জনীয় বিষয় আছে, তার বাইরে মহরম মাসের একটি বিশেষ আমল রয়েছে। আর তা হলো, এ মাসে অধিক পরিমাণে নফল রোজা রাখা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের পর সবচেয়ে সেরা রোজা হলো আল্লাহর মাস মহরমের রোজা।’ (মুসলিম)। সুতরাং মোমিনের উচিত মহরমজুড়ে যত বেশি সম্ভব নফল রোজা রাখার চেষ্টা করা

হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহরম। মহরম অর্থ সম্মানিত। ইসলামের দৃষ্টিতে এ মাসের বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। রয়েছে কিছু করণীয় ও বর্জনীয়ও। কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারোটি, আসমানগুলো ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তার মধ্যে চারটি সম্মানিত।’ (সূরা তওবা : ৩৬)।

এ আয়াতে হিজরি বর্ষের যে চারটি মাসকে সম্মানিত বলে অভিহিত করা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বোখারিতে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘চারটি সম্মানিত মাসের তিনটি হলো ধারাবাহিক। যথাÑ জিলকদ, জিলহজ ও মহরম। আর অপর মাসটি হলো রজব।’

কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘(হে রাসুল) তারা আপনাকে সম্মানিত মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করে। আপনি বলে দিন, সেসব মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া বড় পাপ।’ (সূরা বাকারা : ২১৭)।

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ‘অতএব তোমরা সেসব মাসে নিজেদের প্রতি নিজেরা অবিচার করো না।’ (সূরা তওবা : ৩৬)। তফসিরে ইবনে কাসিরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এ আয়াতে নিজের প্রতি অবিচার করা বলতে পাপকার্যে লিপ্ত হওয়াকে বোঝানো হয়েছে। সুতরাং সম্মানিত মাসগুলোতে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হওয়া নিষিদ্ধ এবং এ মাসগুলোয় পাপের পথ মাড়ানো অন্য মাসে পাপকার্যে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে বেশি জঘন্য।

এছাড়াও আল্লাহ ঘোষিত সম্মানিত মাসের সম্মান রক্ষার্থে এ মাসগুলোতে সাধারণ পুণ্যের কাজগুলোও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে করা উচিত।

মহরম মাস শুধু সম্মানিত চার মাসের একটিই নয়; বরং এ মাসটি সম্মানিত চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে সেরা। এছাড়াও মহরম মাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, মুসলিমের এক বর্ণনায় এ মাসটিকে রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর মাস বলে অভিহিত করেছেন। সব মাস, দিন ও ক্ষণই আল্লাহর সৃষ্টি। তবু মহরমকে আল্লাহর প্রতি সম্পর্কে করা, মাসটির বিশেষ তাৎপর্যের প্রতিই ইঙ্গিত বহন করে।

অষ্টম শতাব্দীর জগদ্বিখ্যাত আলেম আল্লামা ইবনে রজব (রহ.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বিশেষ বিশেষ সৃষ্টিকেই শুধু নিজের সঙ্গে সম্পর্ক করে উক্তি করে থাকেন। যেমন সব মানুষ আল্লাহর বান্দা হওয়া সত্ত্বেও কোরআনে মুহাম্মদ (সা.), ইবরাহিম (আ.), ইয়াকুব (আ.) ও ইউসুফ (আ.)সহ অনেক নবী-রাসুলকে আল্লাহর বান্দা বলে অভিহিত করা হয়েছে। তেমনি অন্য সব সময় ও মাস আল্লাহর সৃষ্টি হলেও মহরম মাসটি আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার কারণে এ মাসকে আল্লাহর মাস বলা হয়েছে, যা থেকে মহরম মাসের মর্যাদা পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে।’

সম্মানিত মাস হিসেবে মহরমের যেসব করণীয়-বর্জনীয় বিষয় আছে, তার বাইরে মহরম মাসের একটি বিশেষ আমল রয়েছে। আর তা হলো, এ মাসে অধিক পরিমাণে নফল রোজা রাখা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের পর সবচেয়ে সেরা রোজা হলো আল্লাহর মাস মহরমের রোজা।’ (মুসলিম)। সুতরাং মোমিনের উচিত মহরমজুড়ে যত বেশি সম্ভব নফল রোজা রাখার চেষ্টা করা।

মহরম মাসের ১০ তারিখকে বলা হয় আশুরা। আশুরা হলো বছরের অন্যতম সেরা একটি ফজিলতপূর্ণ দিন। ইসলামপূর্ব যুগেও এ দিনটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। মদিনার ইহুদিরা এবং মক্কার কোরাইশরাও এ দিনটিতে রোজা রাখত। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরতে পর সেখানকার ইহুদিদের আশুরার দিনে রোজা রাখতে দেখে তাদের কাছে এ দিনে রোজা রাখার কারণ জানতে চাইলে তারা বলল, কারণ হল এ দিনে নবী মুসা (আ.) ও তার সম্প্রদায়কে আল্লাহ তায়ালা অত্যাচারী ও অবাধ্য ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করেছেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীকে সমুদ্রে নিমজ্জিত করেছেন।

আর তারই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি প্রতি বছর এ দিনে রোজা রাখতেন; তাই আমরাও তার অনুকরণে এ দিনে রোজা রাখি। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমরা (তোমাদের চেয়ে) মুসার অনুকরণের বেশি হকদার।’ (বোখারি-মুসলিম)। এরপর থেকে তিনি আশুরার দিনে রোজা রাখতেন এবং সাহাবিদের নির্দেশ দিতেন। রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা নফল হিসেবে গণ্য হয়।

আশুরার রোজার ফজিলত প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে আমার আশা হলো আশুরার দিন রোজার বিনিময়ে তিনি এক বছর আগের গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ (মুসলিম)। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, ‘অন্য কোনো নফল রোজার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) কে এত বেশি যতœশীল দেখা যেত না, যত বেশি যত্নশীল থাকতেন আশুরার রোজা রাখার ব্যাপারে।’ বোখারি ও মুসলিমের এক বর্ণনায় মহিলা সাহাবি রুবাইয়ি (রা.) বলেছেন, ‘আমরা আমাদের ছোট শিশুদেরও আশুরার দিনে রোজা রাখতে উদ্বুদ্ধ করতাম।’

মুসলিমদের আশুরার রোজার মধ্যে ইহুদিদের রোজা থেকে যেন বিশেষ স্বাতন্ত্র্য থাকে; সেজন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরা উপলক্ষে দুটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যথা, মহরমের নয়-দশ, অথবা দশ-এগারো তারিখ। তবে এক বর্ণনায় তিনি বলেছেন, আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি, তাহলে মহরমের নয় ও দশ তারিখ রোজা রাখব। সে হিসাবে এ দুই দিন রাখাই সবচেয়ে উত্তম।

ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল আশুরার দিনের মূল পরিচয় হলো এটি আল্লাহর নবী মুসা (আ.) ও তার সম্প্রদায় বনি ইসরাইলের মুক্তির দিবস। তবু নবী (সা.) এর ওফাতের প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর একই দিনে তাঁরই প্রিয় দৌহিত্র হুসাইন (রা.) সপরিবারে ইরাকের কারবালায় এজিদ বাহিনীর হাতে অত্যন্ত নির্মমভাবে শহীদ হন। মুসলিম মাত্রই এ ঘটনায় ব্যথিত ও মর্মাহত হতে বাধ্য। তবে আশুরার দিনে ঘটে যাওয়া কারবালার নির্মম ঘটনাটির কথা স্মরণ করতে গিয়ে আমরা যেন এ দিনের মূল ও হাদিসে বর্ণিত [মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলের মুক্তির] ইতিহাস ভুলে না যাই।

পরিতাপের বিষয়, আশুরার দিনের গুরুত্বপূর্ণ করণীয় রোজা রাখার ব্যাপারে আমরা বেশিরভাগ লোক উদাসীন। এ দিন ঘটা করে তাজিয়া বা শোক মিছিল বের করার কোনো গ্রহণযোগ্য ভিত্তি কোরআন বা হাদিসে নেই।
সুতরাং আসুন, সম্মানিত মাস হিসেবে মহরম মাসের সম্মান বজায় রাখা এবং বেশি বেশি নফল রোজা রাখার চেষ্টা করি এবং সব বেদাত ও কুসংস্কার পরিহার করি।

লেখক : প্রিচার ও ট্রান্সলেটর, পশ্চিম দাম্মাম ইসলামিক সেন্টার, সৌদি আরব

Facebook Comments