সফলতার চার ধাপ – সূরা আল-আসর এর আলোকে

682
আল আসর

এই জীবনে আমরা সবাই কিছু না কিছু পাওয়া বা সফলতার পিছনে ছুটি।  সেই কিছু কে পাওয়ার জন্য জীবনে চারটি মাত্র বিষয়ে মনোযোগী হতে হয়। এই চারটি বিষয় আয়ত্ত করতে পারলে যে কোন মানুষই সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠতে পারবে – ইহকালে এবং পরকালেও। সূরা ‘আসরের দ্বিতীয় আর তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ ﷻ এই চারটি বিষয় আমাদের বলে দিয়েছেন। আসুন সেই চারটি ব্যাপার দেখা নেয়া যাক:

১) বিশ্বাস রাখো:  “ঈমান” শব্দের অর্থ হলো বিশ্বাস। মৃত্যু পরবর্তী জীবনে সফলতা চাইলে এক আল্লাহ ﷻ, তাঁর রাসূল ﷺ এবং রাসূল ﷺ এর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিশ্বাস রাখতে হবে। আর এই জীবনে সাফল্য অর্জন করতে হলে আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে – “আমি পারবই ইনশা’ আল্লাহ”। হাল ছেড়ে দিলে চলবে না।

ওয়াল ‘আসর ইন্নাল ইনসা-না লাফিই খুসর। ইল্লাল্লাযিনা আ-মানু … (সূরা ‘আসর ১-২)

অর্থ: সময়ের শপথ, নিশ্চয়ই মানুষ চরম ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। তারা ছাড়া, যারা ঈমান এনেছে …

২)  যা করা দরকার তা করে যাও: অনেক সময় আমাদের এমন হয় যে – নামাজ পড়তে ইচ্ছা করে না, যিকর করতে মন চায় না, কোরআন মজিদ পড়ারও আগ্রহ পাওয়া যায় না – তবু যেহেতু আল্লাহ ﷻ  ও তাঁর রাসূল ﷺ  এই রিচুয়ালগুলো আমাদের করতে বলেছেন – তাই এগুলো করে যেতে হবে। একইভাবে, দুনিয়াতে সাফল্য পাওয়ার জন্যও কিছু রুটিন ওয়ার্ক আছে, সেগুলি আমাদের করে যেতে হবে। যেদিন ভালো লাগবে সেদিনও একজন ছাত্রকে পড়তে বসতে হবে, যেদিন ভালো লাগবে না সেদিনও তাকে পড়তে বসতে হবে; একজন চাকুরিজীবির যেদিন কাজে মন বসবে সেদিন অফিসের কাজ করতে হবে, আবার কাজে মনোযোগ না বসলেও জোর করে অফিসের কাজ করে যেতে হবে। যা করা উচিত তা করতে থাকতে হবে, আজ বা আগামীকাল এর ফল চোখে না দেখা গেলেও, পরশু এর ফল ঠিকই পাওয়া যাবে।

ওয়া ‘আমিলুস স্বয়ালিহ্বা-তি  … (সূরা ‘আসর ৩)

অর্থ: যারা ভালো কাজ করে

৩)  নতুন কিছু শেখো: আল্লাহ ﷻ কোরআন মাজিদের সূরা ফাতির এর ২৮ নং আয়াতে বলেছেন “আল্লাহর ﷻ বান্দাদের মধ্যে  শুধু তারাই তাঁকে ভয় করে যাদের জ্ঞান আছে”। ইসলাম সম্পর্কে আপনি যত জানবেন ততই রুটিন ইবাদতগুলো আপনার কাছে অর্থবহ হয়ে উঠবে। নামাজ-রোজাকে আপনার কাছে রবোটিক কোন ব্যাপার বলে মনে হবে না, বরং তখন আপনি এই ইবাদতগুলোর মধ্যে ঈমানের মিষ্টি স্বাদ আস্বাদন করতে পারবেন।

পার্থিব জীবনেও সেই ব্যক্তি তত সফল, যে অন্য মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশী অবদান রাখতে পারে।  আর অন্যের উপকারে আসতে চাইলে, আগে নিজের উন্নয়ন করতে হবে।  ভালো কথা অন্যকে বলতে হলে আগে নিজেকে ভালো কথা শিখতে হবে।

ওয়াতা ওয়া- সাওবিল হাক্কি … (সূরা ‘আসর ৩)

অর্থ: একে অপরকে সঠিক উপদেশ দেয়

৪) মানুষের উপকারে আসো: নবী হওয়ারও আগে রাসূলুল্লাহ ﷺ ছিলেন মক্কার সবচেয়ে বিশ্বস্ত আর পরোপকারী মানুষ। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর সমস্ত জীবন ব্যয় করেছেন অন্য মানুষদের ভাগ্য উন্নয়নে। আমরাও যত অল্প টাকাই পারি না কেন তা দিয়ে মানুষকে সাহায্য করব, যত অল্প শ্রমই হোক না কেন তা দিয়ে মানুষের উপকার করব, যত অল্পই শিখি না কেন, তা অন্যদের সাথে শেয়ার করব। পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশীদের সহ সমস্ত মানুষকে উপকারের চেষ্টা করব। কারো কাছ থেকে প্রতিদান চাইবো না, প্রতিদান চাইবো শুধুই আল্লাহর কাছে।

মানুষকে উপকার করার এই পথ মধুর না, বন্ধুর। অনেক সমালোচনা-গালমন্দ শুনব, অনেক অকৃতজ্ঞ মানুষের দেখা পাবো, অনেক সময় আর্থিক বা সামাজিক সংকটে পর্যন্ত পড়ে যেতে পারি – তবু ধৈর্য্য ধরব। যত অল্পই হোক না কেন, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কন্ট্রিবিউট করব। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন – খেজুরের অর্ধেকটা দান করে হলেও নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও (বুখারী)।

ওয়াতা ওয়া- সাওবিস সবর। (সূরা ‘আসর ৩)

অর্থ: একে অপরকে ধৈর্য্যের উপদেশ দেয়।  

দ্বিতীয়-তৃতীয় আয়াতে বর্ণিত এই চারটি কাজ যদি আমরা না করি তাহলে আমরা মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে ডুবে যাবো।  এই ক্ষতির ভয়াবহতা যে কতটা চরম তা বুঝাতে আল্লাহ ﷻ এই কাজগুলোর উপর চারভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

এক: প্রথম আয়াতে আল্লাহ ﷻ সময়ের কসম নিয়েছেন। আল্লাহ ﷻ কোন কিছু কসম নেয়ার অর্থ হচ্ছে তার পরের কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ন।

দুই: আল্লাহ ﷻ “ইন্না” দিয়ে বাক্য শুরু করে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। “ইন্না” শব্দের অর্থ হলো “নিশ্চয়ই”।

তিন: আল্লাহ ﷻ “ইন্নাল ইনসানা ফি খুসর” (নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে), না বলে “ফি” এর আগে “লা” যুক্ত করেছেন। এই “লা” এর অর্থ হলো “অবশ্যই”। সুতরাং আল্লাহ ﷻ যখন বললেন “ইন্নাল ইনসানা লাফি খুসর”, এর অর্থ দাঁড়ায় “নিশ্চয়ই অবশ্যই মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে”।

চার: আল্লাহ ﷻ তৃতীয় বাক্য শুরু করলেন “ইল্লা” (“শুধু তারা বাদে” বা Except) দিয়ে। ইল্লা দিয়ে কোন বাক্য শুরু করা হলে সেটা পূর্ববর্তী বাক্যের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। যেমন – কোন ক্লাসের ১০০ জন ছাত্রের মধ্যে যদি ৯৫ জন ফেইল করে তাহলে টিচার বলবেন – “এই ক্লাসের ছাত্ররা ফেল করেছে, শুধু কয়েকজন বাদে”, অর্থাৎ ফেল করাটাই যেন স্বাভাবিক ঘটনা, পাশ করাটা হলো ব্যতিক্রম। একইভাবে, আল্লাহও ﷻ বলতে চাইছেন যে, অধিকাংশ মানুষই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, শুধু গুটিকয় আছে যারা সঠিক পথে আছে।

আমাদের অফিসের কোন বিশ্বস্ত কলিগ যদি এক বা দুইবার নয়, চার চারবার ফোন করে বলে – “বন্ধু, মহাখালীর রাস্তায় এক্সিডেণ্ট হয়েছে, বিরাট জ্যাম, ভুলেও ঐ পথে যেও না, ঘুরে যাও” – তাহলে আমরা বাসায় ফিরতে নিশ্চিত মহাখালীর রাস্তা নিব না। আর, আমাদের পালনকর্তা প্রভু যখন আমাদের একই আয়াতে চারবার সতর্ক করে কোন কিছু করতে আদেশ করেন তখন আমরা কত অনায়াসে সেই আদেশ অমান্য করে দিনাতিপাত করতে থাকি!

ইমাম শাফেঈ’ বলেছেন – লোকে যদি শুধু এই সূরা (সূরা ‘আসর) নিয়ে চিন্তা করত, সেটাই তাদের জন্য যথেষ্ট হত।

রেফারেন্স:

  1. Khutbah- The Role of a Muslim in a Non-Muslim Society (Based on Sura ‘Asr) ~ Dr. Yasir Qadhi
  2. Meaning of Surat Al-‘Asr – Understand Quran Academy

সফলতার সুত্র পড়তে পারেন দুইটি স্বর্ণালী সূত্র

Facebook Comments