অলস লোক ও সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা
আমাদের সবারই সামর্থ্য ও সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ নির্দিষ্ট করা আছে। যদি আশা করি আমাদের কাজ অন্য কেউ করে দিবে তাহলে আমাদের দুর্দশার জন্য আমরাই দায়ী থাকব। নিজের কাজ যথাযথভাবে করার চেয়ে বড় দায়িত্ব আর কিছুই নেই। যদি আমাদের কাজ ঠিকঠাকভাবে না করে সবকিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি তাহলে আমাদের উপর যে ভোগান্তি নেমে আসবে সেটার জন্য আমরাই দায়ী থাকব। এখানে সেই গল্পটাই বলা হয়েছে।
অনেকদিন আগের কথা। এক গ্রামে একজন অলস লোক বাস করত। লোকটা ছিল খুবই অলস, কোনো কাজ করত না সে। কীভাবে সবচেয়ে সহজে খাবার যোগাড় করা যায় সেই চেষ্টা করত।
লোকটা একদিন দুপুরে বের হয়েছে খাবারের সন্ধানে। সে দেখল একটা ফলের বাগান। যখন দেখল কেউই ফলের বাগান পাহারা দিচ্ছে না এবং আশেপাশে কেউ নেই, সে বাগান থেকে ফল চুরি করার সিদ্ধান্ত নিল।
লোকটা বাগানে ঢুকে একটা গাছ থেকে ফল পাড়তে শুরু করল। কিন্তু দূর থেকে বাগানের মালিক সেইদিকে লক্ষ্য রাখছিল। লোকটাকে ফল পাড়তে দেখে তাকে ধরার জন্য সে হন্তদন্ত হয়ে সেদিকে ছুটে আসল।
অলস লোকটা যখন দেখল দূর থেকে বাগানের মালিক লাঠি হাতে তার দিকে আসছে, সে দ্রুত বাগান থেকে বের হয়ে আসল। ফল বাগান থেকে একটু দূরে, গ্রামের পাশেই ছিল একটা বন। সে লুকানোর জন্য ওই বনে গিয়ে ঢুকল।
হঠাৎ সে খেয়াল করল সে আসলে বনের ভিতরে অনেক গভীরে চলে এসেছে। সে তখন বন থেকে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল। বনের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে লোকটা একটু অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। সে দেখল একটা শিয়াল, কিন্তু তার সামনের দুটি পা নাই। দুটি পা ছাড়াই শিয়ালটি খুশি মনে গড়িয়ে গড়িয়ে সামনে আগাচ্ছে। লোকটা চিন্তা করল এই বনের মধ্যে সামনের দুটি পা ছাড়াই শিয়ালটি কীভাবে বেঁচে আছে। শিয়ালটি দৌড়াতে পারে না, সে কীভাবে নিজের খাদ্য যোগাড় করে, অন্য প্রাণিদের হাত থেকে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করে বেঁচে আছে!
লোকটা হঠাৎ দেখল একটা সিংহ মুখে বড় একটা মাংসের টুকরা নিয়ে সেদিকে আসছে। বনের অন্য প্রাণিরা ভয়ে যে যার মত যেদিকে পারে ছুটে পালাচ্ছে। লোকটাও তখন প্রাণভয়ে দ্রুত কাছের একটা গাছে উঠে পড়ল। শুধুমাত্র সেই খোঁড়া শিয়ালটি সে জায়গায়ই রয়ে গেল, কারণ তার আর পালিয়ে কোথাও যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না।
এর পরের ঘটনা লোকটাকে আরো বিস্মিত করল। সে দেখল, সিংহটা তার মুখের সেই মাংস থেকে একটা টুকরা শিয়ালটার জন্য রেখে গেল।
এই দৃশ্য দেখে লোকটা খুবই খুশি হল। সে মনে মনে ভাবল পৃথিবীর সব প্রাণির জন্যই দয়ালু স্রষ্টার একটা পরিকল্পনা আছে। তিনি তার মত করে সবার যত্ন নেন। তার মনে হল, সৃষ্টিকর্তার অবশ্যই তার নিজের জন্যও একটা পরিকল্পনা আছে। সে এই কথা মনে করে গাছ থেকে নামল, বন থেকে বের হয়ে আসল। এরপর গ্রামের ভিতরে একটা জায়গায় গিয়ে একা একা চুপচাপ বসে রইল, আর মনে মনে আশা করতে থাকল কেউ নিশ্চয়ই তার জন্য খাবার নিয়ে আসবে। সময় যতই যেতে থাকল, সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল কারো আশায়। কিন্তু দুইদিন পার হয়ে গেল, সে ওই একই জায়গায় বসে রইল, কিন্তু কেউই আসল না। অবশেষে, দুই দিন অভুক্ত থাকার পরে সে আর খিদার জ্বালা সহ্য করতে পারল না, সে ওই জায়গা ছেড়ে উঠে আসল।
গ্রামের রাস্তায় তার একজন বৃদ্ধ প্রাজ্ঞ ব্যক্তির সাথে দেখা হল। সেই লোকটি তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার জন্য বিখ্যাত ছিল। অলস লোকটা তখন তাকে সবকিছু খুলে বলল। এতক্ষণ পর্যন্ত যা যা হয়েছে তা শোনার পরে বৃদ্ধ লোকটা প্রথমে তাকে খাবার ও পানি দিল। খাওয়া শেষ হওয়ার পরে অলস লোকটা তখন সেই বৃদ্ধ লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা জ্ঞানী ব্যক্তি, আপনিই বলুন, সৃষ্টিকর্তা ওই খোঁড়া শিয়ালটির প্রতি দয়া দেখাল, কিন্তু আমার প্রতি নিষ্ঠুর থাকল কেন?
বৃদ্ধ লোকটা তখন স্মিত হেসে উত্তর দিল, তুমি ঠিকই চিন্তা করেছ। জগতের সবার জন্যই সৃষ্টিকর্তার কিছু না কিছু পরিকল্পনা আছে। তুমিও সেই পরিকল্পনার অংশ। তবে বৎস্য, তুমি সৃষ্টিকর্তার ইশারাকে ভুলভাবে পাঠ করেছ। তিনি চান নি তুমি শিয়ালটার মত হও, তিনি চেয়েছেন তুমি ওই সিংহটার মত হও।
কার আসলে সাহায্য প্রয়োজন এবং কার নিজের দায়িত্ব নিজে পালন করা উচিৎ এবং কাউকে সাহায্য করা উচিৎ সেটা বুঝতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ। যার যার অবস্থান অনুযায়ী তার তার নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কাজ রয়েছে। সেই কাজ ও দায়িত্ব বাদ দিয়ে সব সময় সহজ রাস্তা খুঁজলে, ভাগ্যের উপর বা অন্যের উপর নির্ভর করলে নিজের উপর ভোগান্তি নেমে আসতে পারে।
সহজ রাস্তার চেয়ে সঠিক রাস্তা সবসময়ই বেশি কার্যকর।