মহানবী সাঃ-এর বহুবিবাহ হৃদ্যতা ও প্রজ্ঞার দীপ্ত বহিঃপ্রকাশ

0
470
বহুবিবাহ

আলী হাসান উসামা ইসলামপূর্ব যুগে পৃথিবীর সর্বত্র একাধিক ( বহুবিবাহ ) বিবাহের প্রচলন ছিলো ব্যাপকভাবে। কোনো সভ্যতাই একে  দোষণীয় জ্ঞান করতো না ; বরং তা ছিলো ব্যক্তির বীরত্বের প্রতীক। ফলে যার ব্যত্যয় ঘটেনি যুগ শ্রেষ্ঠ নবীগণের ক্ষেত্রেও। বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে, “সোলায়মান আ.-এর সাতশো স্ত্রী ছিলো, যারা ছিলো রাজপরিবারের মেয়ে; এছাড়া তার তিনশো উপস্ত্রী তথা দাসী ছিলো।” [বাদশাহনামা-১১/৪] দাউদ আ. -এর স্ত্রী ছিলো নিরানব্বইজন, ইবরাহীম আ. -এর তিনজন, ইয়াকুব এবং মূসা আ. এর চারজন করে। [পয়দায়েশ – ২৯/৩০]

অধুনাও একাধিক বিবাহের ( বহুবিবাহ ) প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে পারেনি কেউ। ইউরোপ আমেরিকার প্রসিদ্ধ খ্রিস্টান গবেষকগণও একাধিক বিবাহকে উত্তম ও যথাযোগ্য বিধান বলে অভিহিত করেছেন। খ্রিস্টান গবেষক মিস্টার ডিউন পোর্ট একাধিক বিবাহের পক্ষে ইনজিলের বিভিন্ন আয়াত উল্লেখ করে বলেন, “এসব আয়াতের আলোকে এ কথা সুস্পষ্ট প্রতিভাত হয়, একাধিক বিবাহ শুধু এক উত্তম আমল নয়; বরং তাতে বিধাতার বিশেষ এক রহমত আছে।” অনুরূপ কথা পাদ্রি ফক্স, নেক্সন, জান মিলটন এবং এ্যাইজাক টেলরও বলেছেন। এখানে একটি কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, ইসলামপূর্ব যুগে একাধিক বিবাহের (বহুবিবাহ) কোনো সীমারেখা ছিলো না ফলে এক পুরুষের বিবাহে শতাধিক নারীও ছিলো এমনকি কোনো কোনো খ্রিস্টান পাদ্রি হাজারের অধিক নারীকে বিবাহ করেছেন, বিশেষত জার্মানিতে ষোল শতাব্দীর পূর্বে এর ব্যাপক প্রচলন ছিলো। তখনও কোনো ধর্ম এর বিরোধিতা করেনি,  ফলে সে যুগে নারীরা তাদের যথার্থ মর্যাদা থেকে বঞ্চিত ছিলো। তারা ছিলো শুধু পুরুষের ইন্দ্রিয় বাসনা চরিতার্থ করার বৈধ পাত্র। সমাজে ছিলো না তাদের কোনো মূল্যায়ন!

এরপর পৃথিবীর আকাশে যখন ইসলামের সূর্য উদিত হয়, তখন মানব প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে মহামহিম আল্লাহ একাধিক বিবাহের (বহুবিবাহ) অনুমতি দেন। নারীজাতিকে মর্যাদার আসনে সমাসীন রাখতে এর সংখ্যাও তিনি নির্ধারণ করে দেন। মহাপবিত্র ঐশীগ্রন্থ আল-কুরআনে যার বর্ণনা এরূপ- “নারীদের মধ্যে যাদেরকে তোমাদের পছন্দ হয় তাদেরকে বিবাহ করো দুই-দুইজন, তিন-তিনজন অথবা চার-চারজনকে। অবশ্য যদি আশংকা বোধ করো যে , তোমরা তাদের মধ্যে সুবিচার করতে পারবে না তবে এক স্ত্রীতে ক্ষান্ত থাকো। এ পন্থায় তোমাদের অবিচারে লিপ্ত না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। [সূরা নিসা – ৩]

দুই
পবিত্র ইসলাম একাধিক বিবাহকে সমর্থন করার বেশ কিছু যৌক্তিকতা আছে। এখানে সংক্ষেপে তার কয়েকটি তুলে ধরছি-

১. ইসলামী শরীয়তে একাধিক বিবাহের বৈধতা এজন্য যে, যাতে কেউ ইন্দ্রিয় বাসনা চরিতার্থ করার মানসে অপাত্রে লালায়িত না হয়। সমাজে সুস্থ সবল এমন বহু পুরুষ আছে যাদের জন্য শুধু এক নারী যথেষ্ট নয়। এখন যদি তাদেরকে একাধিক বিবাহ থেকে বারণ করা হয় তবে তাদের গুনাহে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। শরীয়ত তাই এমন লোকদেরকে একাধিক বিবাহের (বহুবিবাহ) অনুমতি দিয়েছে। সমাজ-সংসার যাতে সুস্থ ও সুন্দর থাকে, ব্যভিচারের ঘৃণ্য পাপে তা যাতে কলুষিত না হয়।

২. ঋতু চলাকালে নারীরা সহবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং এ সময়ে তাদের সাথে সহবাস করা শরীয়তের দৃষ্টিতেও অবৈধ ও ঘৃণিত। সুস্থ-সবল পুরুষেরা যাতে স্ত্রীদের ঋতুচলাকালে অন্য নারীর কাছে প্রত্যাগমন না করে, এ জন্য শরীয়ত একাধিক বিবাহের অনুমতি দিয়েছে। তদ্রুপ সন্তান গর্ভে থাকাকালীন নবজাতকের সুস্থতার প্রতি লক্ষ রেখে পুরুষদেরকে সহবাস থেকে বিরত থাকতে হয়। এমতাবস্থায় জৈবিক চাহিদায় তাড়িত হয়ে তারা যাতে অন্য নারীর দ্বারস্থ না হয়, এজন্য শরীয়ত একাধিক বিবাহের (বহুবিবাহ) অনুমতি দিয়েছে।

৩. স্ত্রী যদি বন্ধ্যা হয় ও সন্তান প্রসবে অক্ষম হয় তবে বংশধারা রক্ষা করতে গিয়ে স্বামী যাতে তাকে তালাক দিয়ে, সম্পর্কের অটুট বন্ধন ছিন্ন করে অন্যত্র প্রস্তাব পাঠাতে বাধ্য না হয়; বরং স্ত্রীকে তার স্থানে রেখে, যথাযথ মর্যাদা, ভরণ-পোষণ ও অন্যান্য খরচাদি দিয়ে স্বামী যাতে দ্বিতীয় কাউকে ঘরে তুলতে পারে এবং সকলে মিলে সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচনা করে সুন্দর এক পৃথিবী বিনির্মাণ করতে পারে এজন্য শরীয়ত একাধিক বিবাহের (বহুবিবাহ) অনুমতি দিয়েছে।

৪. অভিজ্ঞতা ও আদমশুমারির আলোকে দেখা গেছে, বিশ্বে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। নারী অপেক্ষা পুরুষের জন্ম স্বল্প হয়। অপরদিকে বিভিন্ন গোলযোগ ও দুর্ঘটনায় পুরুষের মৃত্যু বেশি হয়; এহেন পরিস্থিতিতে শরীয়ত যদি একাধিক বিবাহের অনুমতি না দেয় তবে বহু নারী জীবনে কখনো পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে না। প্রবৃত্তির চাহিদা মেটাতে তারা তখন বেছে নিবে বেশ্যাবৃত্তির পথ। অর্থের যোগান না থাকায় তারা আক্রান্ত হবে ভীষণ দারিদ্রে। বিশ্ব-বসুন্ধরা তখন হারিয়ে যাবে আঁধারের অতল গহবরে।

তিন
মোহাম্মাদে আরাবী সা. ছিলেন সত্য পথের দিশারী, গাঢ় অমানিশা বিদূরকারী। তার চরিত্রে ছিলো না কদর্য, ছিলো না কোনো পঙ্কিলতা। তার মর্যাদা সুউচ্চ সপ্ত আকাশের চেয়েও বহু ঊর্ধ্বে। বিন্দু পরিমাণ ত্রুটি নেই তার আদর্শ জীবনীতে। তিনি ছিলেন এক মহামানব, যার তুলনা কখনো মিলবে না নীল আকাশের নীচে! তার আলোকিত জীবন বিশ্ব-মানবতার আদর্শ, ধ্বংসের অতল গহ্বর থেকে মুক্তি ও উত্তরণের পথ। মহামহিম আল্লাহ বলেন, “অতি অবশ্যই রাসূলুল্লাহর জীবনীতে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ [সূরা আহযাব : ২১]

রাসূলুল্লাহর সা. -এর একাধিক (বহুবিবাহ) মাঝে সুপ্ত ছিলো বহু প্রজ্ঞা।  আরশের স্রষ্টা আল্লাহর নির্দেশেই তিনি এ মহৎ কাজ সম্পাদন করেছেন। আবূ সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ততক্ষণ আমি কোনো নারীকে বিবাহ করিনি এবং আমার মেয়েদেরকে অন্য কারো কাছে বিবাহ দেইনি যতক্ষণ না আমার প্রভুর পক্ষ থেকে জিবরাঈল আ. বিবাহের আদেশ সম্বলিত বার্তা না এনেছেন। [উয়ুনুল আছার – ২/৩০০, শরহে মাওয়াহিব – ৩/২১৯]

অধুনা ধরিত্রীর আধাঁরপ্রিয় জনগোষ্ঠী ইসলামের অনুসারীদের চোখে তাদের নবীর চরিত্র কলুষিত করতে বড় তৎপর মিডিয়াকে অবলম্বন করে মহানবীর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে তারা। রাসূলের সমুন্নত অতুলনীয় চরিত্রে কালিমা লেপন করতে বড় প্রয়াসী তারা! কিছুকাল যাবৎ মিডিয়ার সাহায্যে তারা ঢালাওভাবে প্রচার করছে, “ইসলামের নবী লম্পট ও কামুক। কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার উদ্দেশেই এগারোজন নারীকে তিনি বিবাহ করেছেন। যদিও উম্মতের কামুক ব্যক্তিদের জন্য বিধান করেছেন সর্বোচ্চ চার নারীকে বিবাহ করার বৈধতা।

সুস্পষ্ট ও প্রোজ্জ্বল একটি সত্য তাদের ধীশক্তি আয়ত্ত করতে না পারার কারণেই এহেন অশোভনীয় সংলাপ রটনার হঠকারিতা প্রদর্শন করতে তারা উদ্যত হয়েছে। কারণ সুস্থ বিবেকসম্পন্ন সকলেরই অবগতি আছে যে,

মানবজাতির যৌবনের সময়সীমা চল্লিশ বছর। মহানবী সা. যৌবনের মুকলিত প্রাংগণে বিবাহ করেছেন এক প্রৌঢ়া রমণীকে। এরপর তার সাথে ঘর করেছেন সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর। এ সময়ে তিনি দ্বিতীয় কোনো নারীকে বিবাহ করেননি।

রাসূল সা. যদি প্রকৃত অর্থে কামুকই হতেন (নাউযুবিল্লাহ) তবে যৌবনের দীপ্ত দিনগুলোতে অবশ্যই তিনি অন্য বহু নারীকে স্ত্রী অথবা উপস্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতেন; তদ্রপ আয়েশা রা. ব্যতীত রাসূলের অন্য সব স্ত্রীগণ ছিলেন বয়স্কা ও বিধবা। এর দ্বারাও প্রমাণিত হয়, তার বিবাহের উদ্দেশ্য কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা ছিলো না;  ছিলো অন্য কিছু। এজন্যই সে যুগের পাপিষ্ঠ কাফিরেরা- যারা ছিলো রাসূলের চরম শত্রু, রাসূলকে হত্যা করতে ও তার বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা করতে যারা ছিলো বদ্ধপরিকর ও সদা প্রয়াসী- রাসূল সা.-কে তারা কবি, যাদুকর আখ্যায়িত করেছে ঠিকই;  কিন্তু তাদের কেউই তার সুমহান চরিত্রের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয় প্রকাশ করেনি কভু! যা করছে অধুনা আলোর শত্রু অর্বাচীনেরা; বরং তাদের সকলেই বিনাবাক্যে স্বীকার করেছে, মোহাম্মাদ এক মহামানব, তার কোনো তুলনা নেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও! পবিত্র ঐশীগ্রন্থে তার সুমহান চরিত্রের প্রশংসা বিবৃত হয়েছে এভাবে, ‘নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী।’ [সূরা নূন- ৪]

পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে মহানবীর বহু বিবাহের (বহুবিবাহ) মাঝে সুপ্ত অসংখ্য প্রজ্ঞার কয়েকটি তুলে ধরছি।

১. মহানবী সা. যখন পঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ় তখন তার প্রিয় সহধর্মিনী মহিয়সী খাদীজা রা. প্রয়াত হন। মহানবীর জন্য সংসারের হাল ধরা তখন বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কাঁধে তার নবুওয়াতের গুরুদায়িত্ব, আবার সংসার পরিচালনা ও কোমলমতি শিশুদের দেখাশোনা! বংশের নারীরা তখন মহানবীকে দ্বিতীয় বিবাহের পরামর্শ দেন। আরবে তখন একাধিক বিবাহের প্রচলন ছিলো এবং তা ছিলো তাদের আভিজাত্যের প্রতীক।

মহানবী সা. দ্বিতীয় বিবাহের পক্ষে সম্মতি প্রদান করলে খাওলা বিনতে হাকীম রা. জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসূল, কিন্তু কার কাছে প্রস্তাব পাঠাবো? রাসূল সা. বললেন, খাওলা, তুমি কার কাছে প্রস্তাব পাঠানো সমীচিন মনে করো?  খাওলা রা. বললেন, যদি বিধবা কোনো রমণীকে বিবাহ করতে চান তবে আপনার প্রতি ঈমান আনয়নকারী ও আপনার অনুগত সাওদা অতুলনীয়। আর কুমারী মেয়েদের মধ্যে সবচে’ উত্তম হবে আপনার সুহৃদ আবু বকরের কন্যা আয়েশা। তখন রাসূল সা. বললেন, তবে উভয় ঘরেই প্রস্তাব পাঠানোর ব্যবস্থা করো। [শরহে মাওয়াহিব – ৩/২২৭] মহিয়সী খাদীজা রা.-এর প্রয়াণের এক মাস পরে নবুওয়াতের দশম বছরের শাওয়াল মাসে মহানবী সা. সাওদা বিনতে যাম’আকে গার্হস্থ্য কাজ পরিচালনার জন্য বিবাহ করেন।

২. খাদীজা ও হাফসা রা. ব্যতীত অবশিষ্ট নয়জন স্ত্রীকে মহানবী সা. আল্লাহর নির্দেশে  মোট তিনটি স্বার্থে বিবাহ করেছেন; ধর্মীয় স্বার্থে, রাজনৈতিক স্বার্থে ও কারো মনোরঞ্জনের স্বার্থে।

৩. রাসূলের কথা ও কাজ সবই শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত। কেননা তিনি আপন অন্তরপ্রসূত কোন কথা বলতেন না। যা কিছু বলতেন, যা কিছু করতেন সবই মহামহিম আল্লাহর নির্দেশে। ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রবৃত্তিতাড়িত হয়ে তিনি কোনো কথা বলেন  না। তার সব কথাই প্রভুকর্তৃক অবতীর্ণ ওহী।’ [সূরা নজম – ২, ৩]

মহানবী সা. সাহাবীগণের মজলিসে যে সকল কথা বলতেন, যে সকল কাজ করতেন সাহাবীগণ গুরুত্বসহকারে তার সবগুলোই সংরক্ষণ করতেন। কিন্তু গৃহের অভ্যন্তরে যা সকল অমীয় বাণী মহানবীর পবিত্র মুখ থেকে নিঃসৃত হতো এবং যে সকল কাজ তার থেকে প্রকাশ পেতো তা সংরক্ষণ করার মতো কেউ ছিলো না। কারণ এক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিলো প্রবল ধীশক্তিসম্পন্ন বুদ্ধিমতী এক নারীর উপস্থিতি। সাওদা রা. অধিক বয়স্কা হওয়ায় তার পক্ষে এ সুকঠিন দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়া প্রকৃত অর্থেই অসম্ভব ছিলো। মহামহিম আল্লাহ তাই এর জন্য সুন্দর ব্যবস্থা করেন। রাসূল সা. স্বপ্নযোগে আয়েশা রা.কে বিবাহ করার নির্দেশপ্রাপ্ত হন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, “রাসূল সা. একদিন আমাকে সম্বোধন করে বললেন, বিয়ের আগে তোমায় আমি দু’বার স্বপ্ন দেখেছি। একজন ফেরেশতাকে দেখেছি একটি অতি উজ্জ্বল রেশমি কাপড় নিয়ে আমার কাছে আসলেন। আমি তাকে বললাম, এটা উন্মোচিত করুন। তিনি তা উন্মোচিত করলেন। তখন দেখলাম তুমি তা থেকে বের হয়ে আসছো! তখন সেই ফেরেশতাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, যদি এ নির্দেশ আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় তবে অতি অবশ্যই তিনি তা কার্যকর করবেন।” [বুখারি – ৭০১২]

বিধাতার পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে মহানবী সা. নবুওয়াতের একাদশ বছরের শাওয়াল মাসে আয়েশা রা.-কে বিবাহ করেন। সম্পূর্ণ ধর্মীয় স্বার্থে তিনি তাকে বিবাহ করেন।

৪. জাহেলি যুগে আরবজাতির মাঝে একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস প্রচলিত ছিলো। তারা জ্ঞান করতো, পালক পুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং শরীয়তে তা অননুমোদিত ও নিষিদ্ধ। এ ভ্রান্ত বিশ্বাস সমাজ থেকে বিদূরিত করা ছিলো ইসলামের দাবী।  মহানবী সা. তার ফুফাত বোন যায়নাব বিনতে জাহাশ রা.কে বিয়ে দেন আপন পালক পুত্র যায়েদ বিন হারেসা রা -এর সাথে। যায়েদ রা. ছিলেন মহানবীর আযাদকৃত দাস; পক্ষান্তরে যায়নাব রা. ছিলেন উন্নত বংশের মেয়ে। তাই কোনোভাবেই তাদের মাঝে বনিবনা হচ্ছিলো না। শেষে অনন্যোপায় হয়ে যায়েদ রা. তাকে তালাক দেন। পৃথিবীতে নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য যেহেতু সকল আঁধার তাড়িয়ে তমসাচ্ছন্ন বিশ্বকে আলোকিত করা তাই মহামহিম আল্লাহর নির্দেশে মহানবী সা. যায়নাব বিনতে জাহাশ রা.কে বিয়ে করেন। যাতে মানবসমাজ থেকে একটি ভ্রান্তি বিতাড়িত হয় এবং পৃথিবী নামক গ্রহ সত্যের দীপ্তিতে শুভ্রোজ্জ্বল হয়। সূরা আহযাবের ৩৭ নং আয়াতে এ ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ বর্ণিত হয়েছে।

৫. মহানবী সা. ও তার সাহাবীগণ যখন কুরাইশের চোখে ধূলো দিয়ে সুদূর মদীনায় হিজরত করলেন। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ তখন ক্ষোভের অনলে দগ্ধ হয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্রের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দিলো। ফন্দি করে তারা মদীনাবাসীর কাছে এই মর্মে পত্র পাঠালো যে, ইসলাম গ্রহণকারী যে সব লোককে তোমরা আশ্রয় দিয়েছো তাদের থেকে দ্রুত তোমাদের আশ্রয় প্রত্যাহার করো এবং অনতিবিলম্বে তাদেরকে আমাদের হাতে সমর্পণ করো। নইলে আচমকা হামলা করে তোমাদের সকলকে মৃত্তিকার সাথে মিশিয়ে দেবো।

কুরাইশ নেতৃবৃন্দের চিঠির জবাবে মদীনাবাসী কোনো চিঠি পাঠায়নি।  ফলে তাদের হৃদয়ের নিভৃত গহীনে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠলো ক্ষোভের অনল। রণপ্রস্তুতি নিতে শুরু করলো তারা। যুদ্ধাস্ত্র ক্রয়ের জন্য আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে সিরিয়ার পথে যাত্রা করলো কুরাইশের এক কাফেলা। কাফেলাটি যখন সুদূর সিরিয়া থেকে যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে ফিরছিলো মুসলমানগণ তখন গোপন সূত্রে তা সম্পর্কে অবগত হলেন। দ্রুত রণপ্রস্তুতি নিয়ে পথিমধ্যে বাঁধ সাধলেন তারা।

খবর পেয়ে কুরাইশ কাফেলা বিকল্প পথে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে এগিয়ে চললো। মক্কায় অবস্থানকারী অবশিষ্ট কুরাইশরা যখন মুসলমানদের এহেন ধৃষ্টতার কথা জানতে পারলো বিরাট যুদ্ধবাজ সৈন্যদল নিয়ে তারা মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। এটাই ছিলো ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ। এরপর মুসলিম জাতিকে দমন করতে আরো তৎপর হয়ে ওঠলো তারা। অস্ত্রসজ্জিত বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে নিরীহ মুসলমানদের ওপর এভাবেই ক্রমাগত হামলা করছিলো যুদ্ধবাজ কাফিরেরা।

আলো-আঁধারের সে সকল যুদ্ধে ভবলীলা সাঙ্গ হচ্ছিলো নিরীহ বহুজনের। মহানবী সা. এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজছিলেন। তিনি ছিলেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আধার।  তার সব কাজেই ঘটতো প্রজ্ঞার দীপ্ত বহিঃপ্রকাশ।  বদর ব্যতীত অন্য সব যুদ্ধে কুরাইশ সৈন্যবাহিনীর প্রধান সেনাপতির ভূমিকায় ছিলো আবু সুফিয়ান। তার এক মেয়ে উম্মে হাবীবা মহানবী সা. -এর প্রতি ঈমান এনেছিলো ও নবীর নির্দেশে তার স্বামী উবাইদুল্লাহ বিন জাহাশের সাথে হাবশায় হিজরত করেছিলো। অকস্বাৎ সেখানেই তার স্বামী মারা গেলো। রাসূলের কানে এ সংবাদ পৌঁছলে বার্তাবাহকের মাধ্যমে হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশির কাছে উম্মে হাবীবা রা. কে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠালেন। বাদশাহ উম্মে হাবীবার কাছে মহানবীর বিয়ের প্রস্তাব দিলে প্রফুল্ল চিত্তে তিনি তাতে সম্মতি প্রদান করেন।

সপ্তম হিজরীর মুহাররম মাসে চারশ দিনার মোহর ধার্য করে মহানবী সা. কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবীবা রা.কে বিয়ে করলেন। রাসূলের এই রাজনৈতিক কৌশল বেশ ফলপ্রসু হয়েছিলো। এই বিয়ের পরে আবু সুফিয়ান একেবারে চুপসে গেলো। মদীনার মুসলমানদের ওপর হামলা করতে আর কখনো অগ্রসর হয়নি সে। কয়েকদিনের মধ্যেই তার মাঝে আমূল পরিবর্তন ঘটতে শুরু করলো। হৃদয় গহিনে তার ইসলামের ব্যপারে গভীর ভাবনার উদ্রেক হলো। অবশেষে ঈমানের দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হলো তার অন্তরাত্মা। মক্কা বিজয়ের পরে মহানবী সা. এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে ঈমানের সুশীতল বৃক্ষের ছায়াতলে আশ্রয় নিলো সেই আবু সুফিয়ান। রাসূলের প্রজ্ঞাপূর্ণ একটি বিবাহ মক্কাবাসীর সাথে দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ ও যুদ্ধকে প্রতিরোধ করেছিলো, বুকের তপ্ত খুন ঝরানোর মহড়াকে বিস্ময়করভাবে রোধ করেছিলো।


এটা পড়ুন – মহানবীর ﷺ বিছানা – যেমন বিছানায় ঘুমাতেন রাসুল সাঃ ।


৬। মহানবী সা. যখন নবুওয়াত প্রাপ্ত হলেন, সত্যের দীপ্ত মশাল হাতে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন সর্বত্র। পুণ্যের আলো ইহুদি গোষ্ঠী তখন বেঁকে বসলো, আপন মুখের ফুৎকারে নববী সেই আলোকে নিভিয়ে দিতে উদ্যত হলো। যেহেতু তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিলো শেষ নবী হবে তাদেরই গোষ্ঠীর কেউ। পরবর্তীতে যখন নবীরূপে আত্মপ্রকাশ করলেন ইসমাঈল আ. -এর বংশের মোহাম্মাদ, তখন তারা তাওরাতে শেষ নবীর ব্যাপারে বর্ণিত সুস্পষ্ট সকল প্রমাণাদি অস্বীকার করে বসলো ও বিরামহীনভাবে মহানবীর বিরোধিতা করতে লাগলো। তার চরম শত্র“তে পরিণত হলো। নবীর জীবনের যবনিকাপাত করার বাসনা লালন করছিলো তারা তাদের হৃদয়গহিনে। খায়বার যুদ্ধে মুসলমানদের সাথে লড়াইয়ে অন্যান্যদের সাথে নিহত হয়েছিলো বনু নাযীর গোত্রের শীর্ষ দুই ইহুদি নেতা হুয়াই ইবনে আখতাব ও কিনানা ইবনে আবুল হুকায়ক। বন্দি হয়েছিলো আরো অনেকে। বন্দিদের মধ্যে হুয়াই কন্যা ও কিনানা পত্নী সুফিয়া রা.ও ছিলেন। প্রথম স্বামী ইবনে মিশকামের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পরে সুফিয়া রা. কিনানাকে বিবাহ করেছিলেন। খায়বার যুদ্ধে বাবা ও স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি; ভাসছিলেন শোকসাগরে। প্রজ্ঞার আধার রাসূল সা. সুফিয়া রা. এর সাথে অন্যান্য বন্দিদের মতো আচরণ করেননি। এক সর্দারের কন্যা ও অপর সর্দারের স্ত্রী সুফিয়া রা. এর যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করেছেন তিনি। অবশেষে মহামহিম আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে ইহুদি গোষ্ঠীর সাথে সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচনা করার উদ্দেশে, জামাই হয়ে তাদের মাঝে ইসলামের আলো প্রচার করার স্বার্থে সপ্তম হিজরীতে সুফিয়া রা.কে বিবাহ করেন। বহুবিবাহ

৭. হযরত ওমর রা.এর মেয়ে হাফসা রা. তার প্রথম বিবাহ হয়েছিলো খুনাইস বিন হুযাফা রা.এর সাথে। খুনাইস রা. ছিলেন বদরী সাহাবী। বদর যুদ্ধের কিছুকাল পরে মদীনায় তার ইন্তেকাল হয়। হাফসা রা.কে নিয়ে তখন ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান ওমর রা। তার জন্য যোগ্য পাত্র নির্বাচন করতে ভাবনার সাগরে ডুবে পড়েন তিনি। অবশেষে প্রস্তাব নিয়ে উপস্থিত হন ওসমান রা. এর কাছে। ওসমান রা. বললেন, আমাকে কয়েকদিন ভাবনার অবকাশ দিন। কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পরে পুনরায় সাক্ষাৎ করেন ওমর রা। ওসমান রা. তখন বললেন, বর্তমান অবস্থায় নতুন কোনো বিবাহের আগ্রহ আমার নেই। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এলেন ওমর রা.  মাথায় যেনো ভেঙ্গে পড়েছে ততক্ষণে সুউচ্চ আকাশ। এরপর বিবাবের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন, আবু বকর রা.এর কাছে। প্রস্তাব শুনে নীরবতা অবলম্বন করলেন তিনি। সম্মতি কিংবা অসম্মতি কোনোটাই প্রকাশ করলেন না। এতে ওমর রা. ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লেন এবং অন্তরে পেলেন ভীষণ আঘাত। যেহেতু তার সাথে আবু বকর রা.এর বেশ হৃদ্যতা ছিলো তাই প্রস্তাব প্রদানের পরে আবু বকর রা.এর অপ্রত্যাশিত অবস্থাদৃষ্টে ওমর রা.এর বুক ছমছম করে ওঠলো।

বেদনার্ত হৃদয় নিয়ে সেদিন তিনি ফিরেছিলেন আপন গৃহে। এর কিছুদিন পরে রাসূল সা. হাফসা রা.কে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠালেন ওমর রা.এর কাছে। প্রস্তাব শুনে আনন্দের দ্যুতি বয়ে যায় ওমর রা.এর মুখাবয়বে। অতিরিক্ত কালক্ষেপণ না করে দ্রুত বিবাহের কাজ সম্পন্ন করেন তিনি। বিবাহের কয়েকদিন পরে আবু বকর রা. একান্তে সাক্ষাৎ করেন ওমর রা.এর সাথে। তখন ওমর রা.কে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, যখন তুমি হাফসার বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে এসেছিলে আর আমি নীরবতা অবলম্বন করেছিলাম তখন কি তুমি রাগ করেছিলে? ওমর রা. বলেন, সত্যি তখন আমার ভীষণ রাগ হয়েছিলো! আবু বকর রা. বললেন, তবে তোমাকে আমি তার রহস্য জানাচ্ছি।

রাসূল সা. হাফসাকে ঘরে তোলার ব্যাপারে আমার সাথে পরামর্শ করেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, আমি যখন তোমার মেয়ে আয়েশাকে বিয়ে করি তারপর থেকে লক্ষ করছি ওমরের বুকের নদীতে জোয়ার বইছে, হৃদয়গগনে তার কালো মেঘের আনাগোনা! তার মর্মবেদনা আমি অনুভব করেছি। তাই ঠাহর করেছি, বধুরূপে হাফসাকে ঘরে তোলবো। এ ব্যাপারে তোমার কী পরামর্শ? তখন আমি বলেছিলাম, অবশ্যই, এহেন পরিস্থিতিতে হাফসার স্বামীও যেহেতু পরলোকগমন করেছে আর ওমরের চুপসে যাওয়া বেদনা আবারো তাজা হচ্ছে তাই আপনার এ সিদ্ধান্ত আশা করি বড়ই উপকার বয়ে আনবে। আপনার সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ওমরের বেদনার্ত হৃদয়ে প্রশান্তির স্নিগ্ধ সমীরণ বইবে। ওমর ! হাফসার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যখন তুমি আমার কাছে এসেছিলে তখন রাসূলের গোপন ইচ্ছা প্রকাশ করার বাসনা আমার হয়নি বিধায় চুপ থেকেছি পরবর্তীতে রাসূল সা. যদি হাফসাকে বিয়ে না করতেন তবে আমার দৃঢ় ইচ্ছা ছিলো, আমি ওকে বিয়ে করবো। অনুরূপ বাক্যালাপ ওসমান রা.এর সাথেও ওমর রা.এর হয়েছিলো। সারকথা রাসূল সা. ওমর রা. এর মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যেই হাফসা রা.কে তৃতীয় হিজরীর শাবান মাসে বিবাহ করেন।

৮. অনুরূপ মনোরঞ্জনের উদ্দেশেই রাসূল. উম্মে সালামা রা.কে বিয়ে করেছিলেন। তার জীবন ছিলো বড় বেদনাবিধুর! পদে পদে সয়েছেন অবর্ণনীয় নিপীড়ন। তার বেদনাবিধুর জীবনী পাথর হৃদয়কেও অশ্রুর সাগরে ভাসায়! মহানবী সা.-এর নির্দেশে উম্মে সালামা আপন স্বামী আবু সালামা রা.-এর সাথে সুদূর হাবশায় হিজরত করেছিলেন। মক্কার পিশাচদের হাত থেকে নিজের ঈমানকে রক্ষা করতে অচেনা এক দেশে স্বামীর হাত ধরে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এরপর সেখান থেকে পুনরায় মক্কায়। অবশেষে স্বামীর সাথে হিজরত করেন প্রিয়নবীর শহর মদীনায়।  সেখানেই চতুর্থ হিজরীতে আবু সালামা রা. উম্মে সালামা রা.কে বিধবা করে পরলোকগমন করেন। পরিবার-পরিজন, ঘর-বাড়ি, ধনসম্পদ ও প্রাণেশকে হারিয়ে অকুল পাথারে ভাসতে থাকেন তিনি। আবার অবরুদ্ধ অবচেতনের ঢাকনা খুলে গেলে উদগ্র বাসনা কালো কেউটের মতো সর্পিলতায় পাক দিয়ে ফণা তোলে- এই মানুবজীবনের স্বভাব-প্রকৃতি। রাসূলের কানে এ খবর পৌঁছলে এহেন ভাবনায় তার দু’চোখ সাশ্রু হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় করুণার আধার রাসূল সা. উম্মে সালামা রা-এর বেদনা ভুলিয়ে দিতে এবং তার ভগ্ন হৃদয়ে সান্ত্বনার প্রলেপ লাগাতে, তার সাশ্র“ নয়নের অশ্র“ মুছে দিতে এবং সহায়-সম্বলহীন এক নারীর জীবনতরী এগিয়ে নিতে ওই বছরই শাওয়াল মাসে তাকে বিবাহ করেন।

৯. যয়নাব বিনতে খুযায়মা রা.। তিনি ছিলেন অনাথ মাতা নামে পরিচিতা। তার স্বভাব-বৈশিষ্ট্য ছিলো, প্রচণ্ড ভুখ থাকা সত্বেও সহাস্য বদনে নিজের আহার তুলে দিতেন অনাহারীর মুখে। তার স্বামী ছিলেন মহানবীর ফুফাত ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ.। উহুদের যুদ্ধে কাফির গোষ্ঠীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন তিনি। তার অংগ-প্রত্যঙ্গ কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে দয়াহীন অভিশপ্ত কাফিরেরা। বিরহের যাতনায় যায়নাব রা. -এর চোখ তখন সদা জলে-ছলছল। বাস্তবতার চপেটাঘাতে তার হৃদয়রাজ্যে তখন খলখল সর্বনাশা বান। এহেন পরিস্থিতিতে যায়নাব রা.-এর মনোরঞ্জনের উদ্দেশে রাসূল সা.  তাকে বিবাহ করেন।

১০. জুওয়াইরিয়া রা. বনু মুসতালিক গোত্রের সর্দার হারিসের মেয়ে। তার প্রথম বিবাহ হয়েছিলো মুসাফি’ ইবনে সাফওয়ানের সাথে। মুরায়সীর যুদ্ধে তার স্বামী নির্মমভাবে নিহত হয় এবং জুওয়াইরিয়া রা.সহ বনু মুসতালিকের একশ পরিবার, যাতে ছিলো সাত শতাধিক পুরুষ ও নারী মুসলমান সৈন্যবাহিনীর হাতে বন্দি হন। যুদ্ধলব্ধ সম্পদের সাথে বন্দিদেরকেও মুজাহিদদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হয়। জুওয়াইরিয়া রা. তখন সাহাবী সাবিত ইবনে কায়স রা.-এর ভাগে পড়েন। সর্দার কন্যার জন্য সাধারণ সাহাবীর দাসত্ব বরণ করা খুবই অপমানজনক ছিলো। জুওয়াইরিয়া রা. তাই নয় উকিয়া স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে সাহাবী সাবিত রা. এর দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তি লাভের চুক্তি করেন। কিন্তু চুক্তি পূরণের মতো সামর্থ্য যুদ্ধবন্দি জুওয়াইরিয়া রা.-এর ছিলো না। তাই তিনি এসে সহায়তা চাইলেন রাসূল সা.-এর কাছে। রাসূল সা.ও ভাবলেন তার দুরাবস্থার কথা। চুক্তির সকল অর্থ তিনি পরিশোধ করে দিলেন। এরপর পঞ্চম কিবা ষষ্ঠ হিজরীতে দূরদর্শী রাসূল সা. জুওয়াইরিয়া রা.-এর সম্মতিক্রমে তাকে বিবাহ করেন। রাসূলের বরকতপূর্ণ এ বিবাহের পরে সাহাবীগণ রা. তাদের অধীনস্ত বনু মুসতালিকের যুদ্ধবন্দি সকল দাসদাসীকে মুক্ত করে দেন। এভাবেই চরিত্রের মাধুর্য ও আত্মার উদারতা দিয়ে জনমানবের হৃদয়রাজ্য জয় করেন মহানবী সা.। যার ফলশ্রুতিতে কিছুকাল পরেই ধরিত্রীর সর্বত্র পতপত করে উড়তে শুরু করে ইসলামের হিলালী নিশান।
সারকথা, মহৎ সব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই প্রোঢ় হয়েও দশ দশটি বিবাহ করেন মোহাম্মাদে আরাবী সা.।  তার প্রজ্ঞাপূর্ণ এ সকল বিবাহ শান্তির বার্তা ছড়িয়েছিলো বিভিন্ন জনপদে, প্রশান্তির সমীরণ বইয়ে দিয়েছিলো ইসলামের ঘোর শত্রুদের হৃদয়রাজ্যে। মহামহিম আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়েই এ মহৎ কাজ সম্পন্ন করেন রাসূল সা.। কাম চরিতার্থ করার কোনও বাসনাই ছিলো না এই মহামানবের।

৫. ইসলামের আকাশে সদা জ্বলজ্বল করে জ্বলব নবীপত্নীদের অবদান। পারিবারিক জীবনযাপনে ইসলামের নীতিমালা তাদের মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়েছে। হাদীসের বিশুদ্ধ গ্রন্থাবলীতে তাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা দুই হাজার আটশ বাইশ। ইসলামী উম্মাহ কখনো শোধ করতে পারবে না নবীপতœীদের এই ঋণ। তারা সদা স্মৃতি হয়ে থাকবে মুসলমানদের হৃদয়ের মানসপটে। বহুবিবাহ

লেখক আলী হাসান উসামা
ইতিহাস গবেষক, দারুল উলূম দেওবন্দ, ইউপি, ভারত।

Facebook Comments

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here