এক মিসরি ভাইয়ের জীবনের গল্প ও একটি হাহাকারের সুন্দর পরিসমাপ্তি !

229
মানুষের সৃষ্টি

বিয়ের পর তিন বছর কেটে গেছে। সন্তান হয়নি। একটা সন্তানের জন্য আমরা দুজনেই হন্যে গেলাম। যেখানে যে চিকিৎসা পেয়েছি, আঁকড়ে ধরতে পিছপা হইনি। যে যা বলেছে, নির্দ্বিধায় বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছি।

হোমিও এলোপ্যাথি-কবিরাজি,ইউনানি কিছুই বাদ রাখিনি। কিছুতেই ফল মিলল না। প্রায় নিরাশ হয়ে পড়েছি। এমতাবস্থায় একদিন কুরআন কারীম করতে গিয়ে একটা আয়াত চোখে পড়ল। আরোও কতবার আয়াতটা পড়েছি, সেদিনের মতো চোখে লাগেনি। বারবার আয়াতটা পড়তে লাগলাম !

لَخَلۡقُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ اَکۡبَرُ مِنۡ خَلۡقِ النَّاسِ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ
মানুষের সৃষ্টি অপেক্ষা নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের সৃষ্টি কঠিনতর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বোঝে না।  (সূরা গাফির)

আয়াতটা পড়তে পড়তেই মাথায় চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল, মানুষ সৃষ্টিরর চেয়েও আসমান ও যমীন সৃষ্টি বেশি কঠিন। এত কঠিন কাজ যিনি পারেন ও করেন,তিনি কি একটা ভ্রণ সৃষ্টি করতে পারেন না?

আমাদেরকে একটা সন্তান দিতে পারেন না? অবশ্যই পারেন! স্ত্রীকেও আয়াতটা পড়ে শোনালাম! সেও ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল! দু’জনে আয়াতটার কথা বলে বলে নতুন করে দু’আ করতে শুরু করলাম! আলহামদুলিল্লাহ! কিছুদিন পরই আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ফুটফুটে একটি সন্তান দান করেছেন।

-মহসিন ফুয়াদ,আলজেরিয়া।

এক মিসরি ভাইয়ের জীবনের গল্প

বিয়ে হয়েছে বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। পড়াশোনা শেষ করার আগেই বিয়ে করেছিলাম। তাই প্রথম প্রথম সন্তান কেন হচ্ছে না, এটা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা ছিল না। আমার স্ত্রীও তখন ছাত্রী। আব্বু দু’জনেরই খরচ চালাতেন। আমাকে গুনাহ থেকে বাঁচানোর জন্যে পঁচিশ বছর বয়েসেই বিয়ে করিয়ে দিয়েছেন। আগের মতো খরচাপাতি দিয়ে গেছেন পড়াশোনা শেষ হওয়া পর্যন্ত।
চাকুরি নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ালাম। ছেলেপিলে হচ্ছে না দেখে দু’জনেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হলাম। দুআ‘-তদ্বির করলাম। আমার স্ত্রী একদিন বলল:
-আপনি কি একটা ব্যপার লক্ষ করেছেন!
-কোন ব্যাপার?
-ছেলেসন্তানও আল্লাহর দেয়া একপ্রকার রিযিক! অন্যতম শ্রেষ্ঠ রিযিক। কুরআন কারীমে যেখানেই এই সন্তানের রিযিকের কথা এসেছে, সেখানে হেবাহ (‏الهبة) শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে।

(১) ইবরাহীম আ. আল্লাহর কাছে দুআ করলেন:
رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এমন পুত্র দান করুন (هَبْ), যে হবে সৎলোকদের একজন (সাফফাত ১০০)।
আল্লাহ তা‘আলা এর জবাবে বললেন:
فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ
সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম

(২) পিতার সাথে মতের অমিল হল। ইবরাহীম আ. বাড়িঘর ছেড়ে সরে পড়লেন। আল্লাহ তা‘আলা তখন বললেন: আমি তাকে ইসহাক ও ইয়া‘কুবকে (وَهَبْنَا لَهُ) দান করলাম (মারইয়াম ৪৯)।

(৩) বৃদ্ধ বয়সে সন্তান করেছেন ইবরাহীম। মনটা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে এসেছে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়েসে ইসমাইল ও ইসহাককে (وَهَبَ لِي) দান করেছেন (ইবরাহীম ৩৯)।

(৪) যাকারিয়্যা আ.-এর সন্তান হচ্ছে না। বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। আল্লাহর কাছে অনবরত দু‘আ করে যাচ্ছেন। ইয়া রাব, আমাকে আপনার পক্ষ হতে পবিত্র সন্তান (هَبْ لِي) দান করুন (আলে ইমরান ৩৮)।

(৫) নিজের বন্ধ্যা স্ত্রীর কথা জানিয়ে ফরিয়াদ করছেন যাকারিয়্যা। তার মৃত্যুর পর দাওয়াতী কাজের উত্তরাধিকারী হওয়ার মত কেউ নেই। ইয়া আল্লাহ! আমাকে আপনার পক্ষ থেকে একজন উত্তরাধিকারী (هَبْ لِي) দান করুন (মারইয়াম ৫)।

(৬) আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন আইয়ুব আ.। অবিশ^াস্য সবর ধরলেন তিনি। আল্লাহ তা‘আলা আইয়ুবের সবরে খুশি হলেন। আগের মতো সব ফিরিয়ে দিলেন। বললেন: আমি তাকে (وَوَهَبْنَا لَهُ) দান করলাম তার পরিবারবর্গ এবং তার সাথে অনুরূপ আরও (সোয়াদ ৪৩)।

(৭) দাউদ আ.-কেও আল্লাহ তা‘আলা সন্তান দান করলেন। আল্লাহ তা‘আলা বললেন: আমি দাউদকে (وَوَهَبْنَا) দান করলাম সুলাইমান (সোয়াদ ৩০)।

(৮) স্বামী নেই। তবুও কিভাবে গর্ভবতী হলেন? মারইয়াম এমন অদ্ভুত ঘটনার ভীষণ অবাক! সীমাহীন অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। ইহুদিদের অপবাদের জ¦ালা সইবেন কী করে? সবার অগোচরে দূরের এক স্থানে চলে এলেন। এমন দিশেহারা অবস্থায় জিবরাঈল এসে বললেন: আমি আপনার প্রতিপালকের প্রেরিত (ফিরিশতা)। আমি এসেছি আপনাকে এক পবিত্র পুত্র সন্তান (لِأَهَبَ لَكِ) দান করার জন্যে (মারইয়াম ১৯)।

(৯) সূরা ফুরকানে আল্লাহ তা‘আলা কিছু বান্দার প্রশংসা করেছেন। সর্বশেষ প্রশংসা করেছেন, যারা বলে: ইয়া রাব, আমাদেরকে আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের পক্ষ হতে (هَبْ لَنَا) দান করুন নয়নপ্রীতি (৭৪)।

(১০) সূরা শুরায় বলা হয়েছে:
يَهَبُ لِمَن يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَن يَشَاءُ الذُّكُورَ
তিনি যাকে চান কন্যা দান করেন এবং যাকে চান পুত্র দান করেন (৪৯)।

শরীয়তের পরিভাষায়, হেবাহ (‏الهبة) বলা হয়, বিনিময়হীন দানকে। কোনও ধরনের বিনিময় ছাড়া কাউকে কোনও কিছু মালিক বানিয়ে দেয়া।

আল্লাহ তা‘আলা চাইলে আমাদেরকে সন্তান দান করতে পারেন। এবং সেটা কোনও বিনিময় ছাড়াই। আমরা দু’জনে কুরআন কারীমের উক্ত আয়াতগুলোর অর্থ ও ভাব মাথায় রেখে, নবীগনের কষ্ট ও প্রাপ্তির বিষয়টা স্মরণে রেখে গভীর মনোযোগের সাথে দু‘আ করে গেলে, আল্লাহ তা‘আলা নিশ্চয়ই শুনবেন! আমরা আল্লাহর দরবারে রিযিক হেবাহ চাইব! সন্তানের রিযিক।
.
স্ত্রীর কথামত আমরা দু’জনেই নিয়মিত কুরআন কারীমের আয়াতগুলো আলোচনা করতে শুরু করলাম। নবীগনের আদর্শ সামনে রেখে দু‘আয় মশগুল হয়ে গেলাম। আলহামদুলিল্লাহ! একমাসের মাথায় রাব্বে কারীম আমাদের ডাকে সাড়া দিলেন। আমার আহলিয়া মেয়ের নাম পছন্দ করেছে ‘মারইয়াম ফারিস’। আমার নাম ফারিস।

==================================

Facebook Comments