কুরআনে কি আসলেই স্ববিরোধিতা আছে ? (এক)

575

নাস্তিক প্রশ্নঃ আল্লাহর একদিন মানুষের কয়দিনের সমান? – ১০০০ বছর (কুরআন ২২:৪৭) নাকি ৫০০০০ বছর (কুরআন ৭০:৪) !

উত্তরঃ সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো নিচে উল্লেখ করা হল।

“তারা তোমাকে[মুহাম্মাদ(ﷺ)] আযাব ত্বরান্বিত করতে বলে। অথচ আল্লাহ কখনও তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। তোমার প্রভুর কাছে একদিন তোমাদের গণনার হাজার বছরের সমান। ”
(কুরআন, হাজ্জ ২২:৪৭)

” তিনি আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত কর্ম পরিচালনা করেন, অতঃপর তা তাঁর কাছে পৌছবে এমন এক দিনে, যার পরিমাণ তোমাদের গণনায় হাজার বছরের সমান। “
(কুরআন, সাজদা ৩২:৫)

“ফেরেশতাগণ এবং রূহ তাঁর(আল্লাহর) দিকে উর্ধ্বগামী হয় এমন এক দিনে, যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর।”
(কুরআন, মাআরিজ ৭০:৪)

আরবি ভাষায় يَوْمِ [উচ্চারণঃ ইয়াওম; বহুবচনঃ أَيَّامٍ (আইয়াম)] শব্দটি ব্যাপকার্থে ব্যবহৃত হয়।আরবিতে শব্দটি দিন, পর্যায়কাল, সময়কাল ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। [১]

সুরা হাজ্জ ২২:৪৭ ও সাজদা ৩২:৫ তে হাজার বছরের দিন এবং সুরা মাআরিজ ৭০:৪ এ ৫০ হাজার বছরের দিনের কথা উল্লেখ আছে। উল্লেখ্য যে, হাজ্জ ২২:৪৭ ও সাজদা ৩২:৫তে أَلْفَ سَنَةٍ বা ‘হাজার বছর’ এর দিনের কথা উল্লেখ আছে; যা দ্বারা যেমন নির্দিষ্টভাবে ১০০০ বছর বোঝাতে পারে, আবার ‘হাজার বছর’ তথা বিশাল দৈর্ঘ্যের একটি সময়কালকেও বোঝাতে পারে।

এ ছাড়া সুরা ক্বফ ৫০:৩৮ এ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী তৈরির প্রক্রিয়া ছয় ‘আইয়াম’ এ সংঘটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে শব্দটির ব্যবহারের এই বৈচিত্র্য দ্বারাই বোঝা যাচ্ছে যে– يَوْمِ (ইয়াওম) শব্দটির অর্থ ব্যাপক; এ দ্বারা যে কোন সময়কালের দিনই বোঝাতে পারে। আরবি ভাষায় এ দ্বারা ২৪ঘণ্টা, ১ হাজার বছর, ৫০,০০০ বছর এমনকি হাজার বছর বা বিশাল দৈর্ঘ্যের একটি সময়কালকেও বোঝাতে পারে। মোট কথা, শব্দটি দ্বারা যে কোন time period বা পর্যায়কাল/সময়কাল বোঝাতে পারে।

সুরা হাজ্জ ২২:৪৭ এ বলা হয়েছেঃ “তোমার প্রভুর কাছে একদিন তোমাদের গণনার হাজার বছরের সমান।” আখিরাতের ১দিন সার্বক্ষণিকভাবে দুনিয়ার ১০০০ বছরের সমান হবার পক্ষে বিভিন্ন হাদিসের সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেন, নিঃস্ব মুসলিমগণ ধনীদের থেকে অর্ধেক দিন ৫০০ বছর পূর্বে জান্নাতে যাবে। (তিরমিযি ২৩৫৩, ২৩৫৪) সুতরাং আয়াতের অর্থ হবেঃ বান্দাদের ১০০০ বছর সমান হচ্ছে আল্লাহর ১ দিন। [২]

সুরা মা’আরিজের ৪নং আয়াতের ব্যাখ্যায় অধিকাংশ মুফাসসির বলেছেনঃ এখানে কিয়ামত দিবসের পরিমাণই উদ্যেশ্য নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ উল্লেখিত আযাব সেই সংঘটিত হবে, যে দিনের পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর। আর এই মতটির পক্ষে হাদিস রয়েছে। বিভিন্ন হাদিসে কিয়ামত দিবসের পরিমাণ ৫০,০০০ বছর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, যাকাত না প্রদানকারীর শাস্তির মেয়াদ বর্ণনার হাদিসে বলা হয়েছেঃ “তার এ শাস্তি চলতে থাকবে এমন এক দিনে যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছর, তারপর তার ভাগ্য নির্ধারণ হবে হয় জান্নাতের দিকে না হয় জাহান্নামের দিকে।” (মুসলিম ৯৮৭, আবু দাউদ ১৬৫৮, নাসাঈ ২৪৪২, মুসনাদ আহমাদ ২/৩৮৩)
[কুরতুবী]
তা ছাড়া অন্য হাদিসে “যে দিন সমস্ত মানুষ দাঁড়াবে সৃষ্টিকূলের রবের সামনে” [সুরা মুত্তাফফিফীন ৬] এ আয়াতের তাফসিরে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেন, “তা হবে এমন এক দিনে যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছর, তারা তাদের কান পর্যন্ত ঘামে ডুবে থাকবে।” (মুসনাদ আহমাদ ২/১১২)

সুতরাং এখানে কিয়ামত দিবসের পরিমাণই বর্ণণা করা হয়েছে। তবে তা লোকভেদে ভিন্ন ভিন্ন বোধ হবে। কাফিরদের নিকট পঞ্চাশ হাজার বছর বলে মনে হবে। কিন্তু ঈমানদারদের জন্য তা এ দীর্ঘ হবে না। হাদিসে এসেছে, সাহাবায়ে কিরাম রাসুলুল্লাহ(ﷺ)কে এই দিনের দৈর্ঘ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ “আমার প্রাণ যে সত্তার হাতে, তাঁর শপথ করে বলছি এই দিনটি মু’মিনের জন্য একটি ফরয সলাত আদায়ের সময়ের চেয়েও কম হবে।” (মুসনাদ আহমাদ ৩/৭৫)
অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে, “এই দিনটি মু’মিনদের জন্য যোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ের মত হবে।” (মুসতাদরাকে হাকিম ১/১৫৮, নং ২৮৩)

কিয়ামত দিবসের দৈর্ঘ্য ১০০০ বছর না ৫০,০০০ বছর? আলোচ্য আয়াতে (মা’আরিজ ৭০:৪) কিয়ামত দিবসের পরিমাণ ৫০,০০০ বছর এবং অন্য আয়াতে হাজার বছর বা ১০০০ বছর বলা হয়েছে {হাজ্জ ২২:৪৭ ও সাজদা ৩২:৫ দ্রষ্টব্য}। বাহ্যত আয়াতগুলোর মধ্যে বৈপরিত্য আছে বলে মনে হয়। উপরে যে হাদিসগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, তা দ্বারা এটি পরিষ্কার হয়ে গেছে যে সেই দিনের দৈর্ঘ্য আমল অনুসারে বিভিন্ন মানুষের জন্য বিভিন্ন রকমের হবে। কাফিরদের জন্য এটি ৫০,০০০ বছর এবং মুমিনদের জন্য এর সময়ের পরিমাণ অনেক কম হবে। তাদের মাঝখানবে কাফিরদের বিভিন্ন দল থাকবে।

অস্থিরতা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দে সময় দীর্ঘ ও খাটো হওয়া প্রসিদ্ধ ও সুবিদিত। অস্থিরতা ও কষ্টের এক ঘণ্টা মাঝে মাঝে মানুষের কাছে এক দিন বরং এক সপ্তাহের চেয়েও বেশি মনে হয় এবং সুখ ও আরামের দীর্ঘতর সময়ও সংক্ষিপ্ত মনে হয়। [ফাতহুল কাদির দ্রষ্টব্য]

তা ছাড়া যে আয়াতে ১০০০ বছরের কথা আছে, সেই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কোন কোন মুফাসসির বলেন, সেই আয়াতে পার্থিব ১ দিন বোঝানো হয়েছে। এই দিনে জিব্রাঈল(আ) ও ফেরেশতাগণ আকাশ থেকে পৃথিবীতে এবং পৃথিবী থেকে আকাশে যাতায়াত করে এত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেন যা মানুষ অতিক্রম করলে এক হাজার বছর লাগতো।ফেরেশতাগণ এই দূরত্ব খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে অতিক্রম করেন। সে হিসাবে বলা যায় সুরা মা’আরিজে বর্ণিত ৫০,০০০ বছর সময় কিয়ামতের দিনের সাথে সংশ্লিষ্ট, যা পার্থিব দিন অপেক্ষা অনেক বড়। এর দৈর্ঘ্য ও সংক্ষিপ্ততা বিভিন্ন লোকের জন্য তাদের অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্নরূপ অনুভূত হবে। আর সুরা আস সাজদাহতে বর্ণিত ১০০০ বছর সময় আসমান ও যমিনের মধ্যকার চলাচলের সময় বর্ণিত হয়েছে। সুতরং আয়াতগুলোতে কোন বৈপরিত্য নেই। [৩]

প্রখ্যাত দাঈ ড. জাকির নায়েক এ আয়াতগুলোতে স্ববিরোধিতা আছে কিনা এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে—এখানে আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে যে, মহান আল্লাহর নিকট সময়ের গণনা পৃথিবীর সময়ের গণনার সাথে তুলনাযোগ্য নয়। মানুষের নিকট যা হাজার হাজার বছর, আল্লাহ তা’আলার নিকট এগুলো অতি ক্ষুদ্র পরিমাণের সময়।
ধরা যাক, কারো দুবাই থেকে আবু ধাবিতে যেতে ১ ঘণ্টা লাগলো। এবং দুবাই থেকে নিউ ইয়র্কে যেতে ৫০ ঘণ্টা লাগলো। এই তথ্যে কি কোন স্ববিরোধিতা বা বৈপরিত্য আছে? মোটেও না। কেননা এখানে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন সময়ের কথা বলা হচ্ছে। একইভাবে কুরআনের আলোচ্য আয়াতগুলোতেও ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন সময়ের কথা বলা হয়েছে।
কাজেই এ আয়াতগুলোতে কোন প্রকারের স্ববিরোধিতা নেই। [৪]

এবং আল্লাহ ভালো জানেন।

===
তথ্যসূত্রঃ

[১] “Translation and Meaning of yawm ( day, period ) in English Arabic Terms Dictionary”
http://www.almaany.com/…/di…/ar-en/yawm+%28+day,+period+%29/
[২] ইবন কাসির;
কুরআনুল কারীম(বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির), ২য় খণ্ড, ড.আবু বকর জাকারিয়া, সুরা হাজ্জের ৪৭নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ১৭৮২
[৩] দেখুনঃ ফাতহুল কাদির, সুরা আস সাজদাহ, আয়াত নং ৫; তাবারী, সুরা আস সাজদাহ আয়াত নং ৫;
কুরআনুল কারীম(বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির), ২য় খণ্ড, ড.আবু বকর জাকারিয়া, সুরা মা’আরিজের ৪নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ২৬৮৩-২৬৮৪

[৪]  Re: Allahs Days Equal to 1000 Years or 50,000 Years ? [Dr. Zakir Naik]
https://m.youtube.com/watch?v=EcJhBpHwGUY
 One day = 1000 year or 50000 years Contradictions in the Quran [Dr. Zakir Naik]

https://m.youtube.com/watch?v=YoK4VBCFwg0

Facebook Comments