ন্যায় বিচার / মুবাশ্বিরাহ্ শর্মা

251

মাঝেমধ্যে খুব ভয় হয়! কিসের ভয় জানেন? ঈমান হারানোর ভয়। আমি আবার দুনিয়ার মোহে জড়িয়ে আমার রাব্বে কারীমকে ভূলে যাচ্ছি না তো? তবে সাহাবী এবং খলিফাগণদের জীবনীগুলো পড়লেই অন্তরটা শীতল হয়ে যায়। মনের মধ্যে প্রশান্তি অনুভব করি। তেমনই একটা ঘটনা লেখার চেষ্টা করলাম..

সিরিয়ার একটি শহরের নাম রাকা। সেখান থেকে খলিফা হারুন অর রশিদের নিকট চিঠি আসলো। চিঠিতে লেখা ছিল, শহরের বিচারক এক মাস যাবত অসুস্থ, বিচার কাজ স্থবির হয়ে আছে । খলিফা যেন দ্রুত ব্যবস্থা করেন।

খলিফা চিঠির জবাব পাঠালেন। আগামী সপ্তাহের মধ্যে নতুন বিচারক আসবেন। এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন বিচারক এসে যোগ দিলেন।

বিচার কাজ শুরু হয়েছে। স্থানীয় প্রহরীরা একজন বৃদ্ধা মহিলাকে আসামী হিসেবে দরবারে হাজির করলেন। তার অপরাধ, তিনি শহরের এক রেস্তারাঁ থেকে কিছু রুটি আর মধু চুরি করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন ।

বিচারক: আপনি চুরি করেছেন ?

– জ্বি

– আপনি কি জানেন চুরি করা কতো বড় অপরাধ ও পাপ ?

– জ্বি

– জেনেও কেন চুরি করলেন ?

– কারণ আমি গত এক সপ্তাহ যাবত অভুক্ত ছিলাম। আমার সাথে এতিম দু’নাতিও না খেয়ে ছিল। ওদের ক্ষুধার্থ চেহারা ও কান্না সহ্য করতে পারিনি তাই চুরি করেছি। আমার আর এ ছাড়া কোন উপায় ছিল না হুজুর।

বিচারক এবার পুরো দরবারে চোখ বুলালেন। বললেন কাল যেন নগর, খাদ্য, শরিয়া, পুলিশ প্রধান ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যাক্তিগন সবাই উপস্থিত থাকেন। তখন এর রায় দেওয়া হবে।

পরদিন সকালে সবাই হাজির হলেন। বিচারক ও যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে রায় ঘোষণা করলেন,
‘বৃদ্ধা মহিলার চুরির অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৫০টি চাবুক, ৫০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা আর অনাদায়ে এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া করা হলো। তবে অকপটে সত্য বলার কারণে হাত কাটা মাফ করা হলো।’

বিচারক প্রহরীকে চাবুক আনার নির্দেশ দিয়ে নিচে নেমে ঐ বৃদ্ধা মহিলার পাশাপাশি দাঁড়ালেন।

বিচারক বললেন, ‘যে নগরে একজন ক্ষুধার্ত বৃদ্ধ মহিলা না খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় চুরি করতে বাধ্য হয়, সেখানে তো সবচেয়ে বড় অপরাধী সে দেশের খলিফা। আর আমি এসেছি খলিফার প্রতিনিধি হয়ে। আমি যেহেতু তাঁর অধীনে চাকরি করি তাই ৫০টি চাবুকের ২০টি আমার হাতে মারা হউ আর এটাই হলো বিচারকের আদেশ।’

বিচারক আরো বললেন, ‘আদেশ যেন পালন করা হয় এবং বিচারক হিসাবে আমার উপর চাবুক মারতে যেন কোনো রকম করুণা বা দয়া দেখানো না হয়।’

বিচারক হাত বাড়িয়ে দিলেন। দুই হাতে পর পর ২০টি চাবুক মারা হলো। চাবুকের আঘাতের ফলে হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পরছে। ঐ অবস্থায় বিচারক পকেট থেকে একটি রুমাল বের করলেন। কেউ একজন বিচারকের হাত বাঁধার জন্য এগিয়ে গেলে বিচারক নিষেধ করলেন।

এরপর বিচারক বললেন, ‘যে শহরে নগর প্রধান, খাদ্য গুদাম প্রধান ও অন্যান্য সমাজ হিতৈষীরা একজন অভাব গ্রস্থ মহিলার ভরন-পোষণ করতে পারেন না, সেই নগরে তারাও অপরাধী। তাই বাকি ৩০টি চাবুক সমান ভাবে তাদেরকে মারা হোক।’

এরপর বিচারক নিজ পকেট থেকে বের করা রুমালের উপর ৫০টি রৌপ্য মুদ্রা রাখলেন। তারপর বিচারপতি উপস্থিত সবাইকে বললেন, ‘যে সমাজ একজন বৃদ্ধ মহিলাকে চোর বানায়, যে সমাজে এতিম শিশুরা উপবাস থাকে, সে সমাজের সবাই অপরাধী। তাই উপস্থিত সবাইকে ১০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা জরিমানা করা হলো।’

এবার মোট ৫০০দিনার রৌপ্য মুদ্রা থেকে ১০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা জরিমানা বাবদ রেখে বাকি ৪০০টি রৌপ্য মুদ্রা থেকে ২০টি চুরি যাওয়া দোকানের মালিককে দেওয়া হলো। বাকি ৩৮০টি রৌপ্য মুদ্রা বৃদ্ধা মহিলাকে দিয়ে বিচারক বললেন, ‘এগুলো আপনার ভরণ পোষণের জন্য আর আগামী মাসে আপনি খলিফা হারুন অর রশিদের দরবারে আসবেন। খলিফা হারুন অর রশিদ আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থী।’

একমাস পরে বৃদ্ধা খলীফার দরবারে গিয়ে দেখেন খলীফার আসনে বসা লোকটিকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে।

মহিলা ভয়ে ভয়ে খলীফার আসনের দিকে এগিয়ে যান। কাছে গিয়ে বুঝতে পারেন লোকটি সেদিনের সেই বিচারক।

খলীফা চেয়ার থেকে নেমে এসে বললেন, ‘আপনাকে ও আপনার এতিম দু’নাতিকে উপোস রাখার জন্য সেদিন বিচারক হিসেবে ক্ষমা চেয়েছিলাম। আজ দরবারে ডেকে এনেছি প্রজা অধিকার সমুন্নত করতে না পারা অধম এই খলীফাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। আপনি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করুন।

একেই বলে ন্যায় বিচার। সমাজে এই ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যই ইসলাম এসেছে। আর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছে অসংখ্য নবী রাসুল। আসুন, নবী রাসুলের দেখানো পথে সমাজে এমন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমাদের সাধ্যানুযায়ী প্রচেষ্টা চালাই। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন।

ন্যায় বিচার / মুবাশ্বিরাহ্ শর্মা

Facebook Comments