নামাজে মনোযোগ বাড়ানোর ৭টি প্র্যাক্টিকাল টিপস

412

আদনান ফয়সাল এই লেখায় আমি নামাজে মনোযোগ বৃদ্ধির কিছু টিপস শেয়ার করব যেগুলোর মাধ্যমে আমি আমার নামাজে মনোযোগ বাড়াতে সক্ষম হয়েছি । এই টিপসগুলো আমাকে একজন বেনামাজী থেকে কিছুটা হলেও মনোযোগী নামাজী হতে সাহায্য করেছে।

১। নামাজের গুরুত্ব জানুনমহান আল্লাহ আলকোরআনে একটিমাত্র ইবাদতকে ঈমান এর সমার্থকরূপে ব্যবহার করেছেনআর তা হলো নামাজ। ঘটনাটি ছিল এরকম – প্রিয়নবী মুহাম্মদ(সাএর নবুয়তীর প্রথম দিকে সাহাবারা বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ পড়তেন। হিজরতের পরে আল্লাহ কিবলা পরিবর্তন করে যখন কা’বা শরীফের দিকে করে দিলেন তখন অনেক সাহাবা প্রশ্ন করতে লাগলেন যে তাদের আগের নামাজগুলির কি হবেসেগুলির জন্য কি সওয়াব পাওয়া যাবে নাউত্তরে আল্লাহ নিচের আয়াত নাজিল করেন:

আর আল্লাহ এরূপ নন যে তিনি তোমাদের ঈমানকে ব্যর্থ করবেন”। (সূরা বাকারাহ:১৪৩ এর অংশবিশেষ)

উপরের আয়াতে আল্লাহ নামাজকে ঈমানের সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। এই আয়াত দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যেনামাজ না পড়লে ঈমান থাকে না। এছাড়া রাসূলুল্লাহ(সাতিরমিযীআবু দাউদইবনে মাজাহ এর একাধিক হাদিসে বলেছেনযে নামাজ না পড়ল সে কুফরী করল। ইমাম আহমাদ ইবনে হানবাল,শাইখ মুহাম্মাদ আল উসাইমিন সহ বহু আলেম মনে করেনযে ব্যক্তি নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত আদায় না করে সে কাফের এবং পরকালে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে।

” ‘কিসে তোমাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছে‘? তারা বলবে, ‘আমরা নামাজীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না‘ ” (সূরা মুদ্দাসসির:৪২৪৩)

২। কোয়ান্টিটি নয়কোয়ালিটিতে মনোযোগী হোনতাড়াহুড়া করে পড়া নামাজ আল্লাহ কবুল করেন না। কাজেইফরজসুন্নাতনফল সব নামাজকে টার্গেট না করে আগে শুধু ফরজ নামাজটাকে ধীরে ধীরে খুশু‘ (বিনয় ও নম্রতাএর সাথে আদায় করুন।

কাজেই দুর্ভোগ সেই নামাজীদের যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে অমনোযোগী”। (সূরা মাউন:)

সারাদিন মাত্র ১৭ রাকআত নামাজ আদায় করা ফরজএই নামাজগুলো আগে ধীরতার সাথে পড়া আয়ত্ব করুন। সুন্নাত সহ ১০ রাকআত যোহর নামাজ যে সময়ে পড়েন সেই সময়ে ধীরে ধীরে ৪ রাকআত ফরজ নামাজটুকু পড়ুন। যখন ফরজ নামাজে ধীরতা আয়ত্ব করে ফেলবেন তারপর সুন্নাত নামাজগুলো যদি আবার চালু করেন তাহলে অবচেতনভাবে সেগুলোও আপনি ধীর ভাবেই পড়বেন।

পৃথিবীর উপরে যা কিছু আছে তার সবকিছু আমি এর জন্য শোভা করেছি মানুষকে পরীক্ষার জন্য যে তাদের মধ্যে কে কর্মে উত্তম”। (সূরা কাহফ:)

লক্ষ্য করুনএখানে আল্লাহ বলেননি তিনি পরীক্ষা করবেন কে সবচেয়ে বেশী আমল করেবরং তিনি বলেছেন কে সবচেয়ে উত্তম আমল করে। কাজেইআমাদের উচিত হবে নামাজসহ সকল ইবাদতের কোয়ান্টিটি নয়কোয়ালিটির দিকে গুরুত্ব দেয়া।

অবশ্যই বিশ্বাসীগণ সফল হয়েছেযারা নিজেদের নামাজে বিনয়নম্র” (সূরা মুমিনুন:)

৩। সিজদায় নিজের ভাষায় দুআ করুন: আমরা অনেকেই জানি নারুকুতে সিজদায় আরবীর ট্র্যাডিশনাল দুআ গুলোর বাইরে নিজের ভাষায় দুআ করা যায়। আমার এখনো মনে আছিএই বিধানটা যেদিন জেনেছিলাম সেদিন থেকেই আমার নামাজ কেমন বদলে গিয়েছিল। আগে নামাজ পড়তাম এই ভেবে যে কখন নামাজ শেষ হবে আর মুনাজাতে যেয়ে আল্লাহর কাছে কিছু চাইবআর এখন জানতে পারলাম নামাজের মধ্যেই আল্লাহর কাছে চাওয়া যায় – দারুন ব্যাপার তোসিজদায় নিজের ভাষায় দুআ করলে অনুভব করতে পারি আল্লাহর সাথে যেন কথা সরাসরি বলছি – নামাজের অনুভূতিটা ঠিক যেরকম হওয়া উচিত।

রাসূলুল্লাহ(সাবলেছেনতোমরা তোমাদের রবের সবচেয়ে কাছে আসো যখন সিজদায় থাকো। কাজেই তোমরা সিজদারত অবস্থায় বেশী করে দুআ কর। [মুসলিম ও আহমাদ]

৪। কোরআনীয় আরবী শিখুনপয়েন্টটা পড়ে মনে হতে পারেওরে বাবাআরবী শিখবএত অনেক কঠিন কাজ। আসলে ব্যাপারটা মোটেই তা নয়কেনকারণএটা আল্লাহর ওয়াদা।

অবশ্যই আমি কোরআনকে বুঝার ও মুখস্থ করার জন্য সহজ করে দিয়েছি। (সূরা ক্বমর:১৭ আয়াতাংশ)

আল্লাহর এই ওয়াদা কতটুকু সত্য – আসুন তলিয়ে দেখা যাক । কোরআনীয় আরবী আর স্পোকেন আরবী এক জিনিস নয়। কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা একই শব্দ বহুবার রিপিট করেছেনফলে খুব অল্প কিছু শব্দ আর বেসিক গ্রামার শিখে নিলেই আমরা নামাজে নিয়মিতভাবে সে সূরা ও দুআ গুলো পড়ি সেগুলোর অর্থ বোঝা সম্ভব হবে। আরো স্পেসিফিকভাবে বলতে গেলেমাত্র ১২৫টি হাইফ্রিকোয়েন্সী আরবী শব্দ যদি আপনি শিখে নেন তাহলে ৬০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ের ৫০শব্দই আপনি বুঝতে পারবেন!পৃথিবীর ইতিহাসে শেখার জন্য এর চেয়ে সহজ বই বোধ করি আর দুইটা নাই।


এটা পড়ুন  আলীমুল গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞানী


 

নামাজে ব্যবহৃত সূরা ও দুআগুলির অর্থ যখন আপনি জানবেন এবং বুঝে বুঝে নামাজ পড়বেনতখন আপনার নামাজ সম্পূর্ণরূপে বদলে যেতে বাধ্য। স্কলারেরা বলেননামাজ হলো আল্লাহর সাথে বান্দার কথোপকথন। নামাজে যখন আমরা কোরআন তেলাওয়াত করি তখন আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন,আর যখন আমরা দুআ করি তখন আমরা আল্লাহর সাথে কথা বলি। আপনি যখন নামাজের সূরাগুলিদুআ গুলি অর্থ বুঝে পড়বেনতখনই কেবল অনুধাবন করতে পারবেন দিনে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা একটি কন্টিনিউয়াল লাইফ ইম্প্রুভমেন্ট প্রোগ্রাম।

৫। নতুন সূরা ও দুআ মুখস্থ করুনআমরা যখন আমাদের গৎবাঁধা একই সূরা আর দুআ দিয়ে নামাজ পড়তে থাকি তখন নামাজ একটা রোবাটিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়চিন্তা করার আগেই আমাদের ঠোঁটের আগায় একেকটা আয়াত চলে আসেফলে আমাদের মনোযোগ নামাজ থেকে অন্যত্র চলে যায়। প্রতি মাসে ১/২টা নতূন সূরাকিছু নতুন আয়াত বা দুআ শিখুনতারপর সেগুলো নামাজে ব্যবহার করুন। নতুন আয়াতগুলো যেহেতু আপনাকে সচেতনভাবে মনে করে করে পড়তে হবেকাজেই আপনি বাধ্য হবেন নামাজে মনোযোগী হতে।

উদাহরণস্বরুপ বলা যায় – রুকু‘ থেকে উঠার পর আমরা সবাই জানি যে বলতে হয় “রাব্বানা লাকাল হামদ”। কিন্তু এর সাথে অতিরিক্ত আরেকটি দুআ আছে যেটি হলো – “হামদান কাসিরান তাইয়িবান মুবারাকান ফি”। ছোটবেলায় আমরা যখন নামাজ শিখেছি তখন আমাদের হুজুর এটা শিখাননিকারণ তিনি বেশীরভাগ ক্ষেত্রে যেটুকু না পড়লেই নয় সেটুকু শিখিয়েছিলেন। আমরা আমাদের জ্ঞানের এই সীমাবদ্ধতাকে পজিটিভ দৃষ্টিতে দেখে নতুন নতুন সূরা ও দুআ মুখস্থ করে যদি নামাজে ব্যবহার করি তাহলে আল্লাহ চাইলে নামাজে আমাদের মনোযোগ বাড়বে।

৬। তাজউইদ শিখুনদুই বন্ধুর মধ্যে কথা হচ্ছে। দুজনেই কোরআন আরবীতে পড়তে পারেকিন্তু একজন তাজউইদ (উচ্চারণের বিধিবিধানভালমত জানেআরেকজন জানে না।

১ম বন্ধুএই তুই কোরআন পড়তে পারিস?

২য় বন্ধুহ্যাঁপারি।

১ম বন্ধুআচ্ছা এটা পড়ে দেখাতোঠিক করে উচ্চারণ করবি। বাংলা শব্দের মত করে পড়বি নাআরবীর মত করে উচ্চারণ করবি।

২য় বন্ধুকোন্‌ শব্দটা পড়তে হবে – এইটাফাজলামী করিস আমার সাথেআমাদের প্রভুর নাম আরবীতে পড়তে পারে না এরকম কোন মুসলিম আছে নাকিএটা হলো “আল্‌ লা হু”।

১ম বন্ধুহয়নি। আরবীতে لَ এর উচ্চারণ সবখানে হাল্কা “লা” হয়শুধু এই শব্দটাতেই এটা ভারী ও লম্বা “লঅ” হয়ইংরেজী Law শব্দটার মত। কাজেইএর সঠিক উচ্চারণ হবে “আল্‌ লঅ হু”।

২য় বন্ধুতাই নাকিজানতাম না তো!

১ম বন্ধুআচ্ছা এই বাক্যটা এবার পড়ে শুনা।

২য় বন্ধুদোস্ত এটা তো সবাই পারেকোরআনের সূরা তাওবা বাদে প্রত্যেকটা সূরাই এই বাক্য দিয়ে শুরু হয়। এর উচ্চারণ হলোদাঁড়া একটু চিন্তা করে নেই। ও আচ্ছাلَ কে ভারী করে পড়তে হবে – এই তো?কাজেই এটাকে পড়তে হবে “বিসমিল্‌ লআ হির রাহমাআ নির্‌ রাহিইম”

১ম বন্ধুএটাও হয়নি রে। এখানে لَ হাল্কা হবে অর্থাৎ “লঅ” না হয়ে “লা” হবে। আর رَ এর উচ্চারণ সবসময়ই “র” হয় (ইংরেজী Raw এর মত), এর উচ্চারণ কখনো “রা” হয় না। এছাড়া حَ কেও ভারী করে পড়তে হবে। কাজেই বাক্যটার উচ্চারণ হলো “বিসমিল্‌ লাআ হির্‌ রহ‘ মাআনির্‌ রহিইম”

উপরের ঘটনার পর তাজউইদ শেখার গুরুত্ব নিয়ে নিশ্চয় আর কিছু বলার দরকার নেই। আপনি যখন সঠিক উচ্চারণ চিন্তা করে করে নামাজে কোরআন তেলাওয়াত করবেন তখন এমনিতেই আপনার মনোযোগ নামাজে চলে আসবে। তাজউইদ শেখার জন্য Understand Quran Academy এর পেইড কোর্স Read Quranকরতে পারেনআর ফ্রি কোর্স চাইলে শেইখ ইয়াসির কাদির “The Noble Emissaries” (ইউটিউবে পাবেনকোর্সটি করতে পারেন।

৭। শাইখ হুসসারি এর তেলাওয়াত শুনুনলক্ষ্য করুন আমি বলিনি যে কোন ক্বারীর কোরআন তেলাওয়াত শুনতেআমি নির্দিষ্ট একজনের নাম বলেছি। কেনকারণশাইখ খলিল আলহুসসারি (Khalil Al-Hussary) এর তেলাওয়াত একটা খুব বিশেষ কিছু। তিনি প্রতিটা হরফপ্রতিটা হরকত অত্যন্ত ধীরে ধীরেস্পষ্টভাবে তাঁর দরাজ কন্ঠে তেলাওয়াত করে যান। তাঁর তেলাওয়াত শুনলে মনে হয় কোরআনের প্রত্যেকটা অক্ষরের প্রতি তাঁর সে কি মায়াপ্রত্যেকের উপরে তিনি কন্ঠ দিয়ে যেন পরশ বুলিয়ে যাচ্ছেন,প্রত্যেক অক্ষরকে তিনি প্রাপ্য এটেনশন দিবেনএতটুকু কৃপণতা বা বাহুল্য করবেন না।

নামাজে যে সূরাগুলি আপনি পড়েন সেগুলি শাইখ হুসসারি এর কন্ঠে ডাউনলোড নিন (গুগল করলেই mp3পাবেন), মোবাইলে বা গাড়ির সিডিতে কপি করে নিয়ে বার বার শুনুন। এর ফলে আপনি যখন নামাজে ঐ সূরা পড়তে যাবেন তখন নিজের অজান্তেই শাইখ হুসসারি এর ধীরগতির আবৃত্তি আপনার কানে বাজতে থাকবে। ফলেআপনার মনে তাড়াহুড়া করে নামাজ পড়ার কুইচ্ছা থাকলেও শাইখ হুসসারি এর দরাজ কন্ঠ আপনাকে তা করতে দেবে না। আমরা অনেকেই বেঁচে থেকেও মরে আছিআর শাইখ হুসসারি কবরে শুয়ে শুয়েও আমাদের শিখিয়ে যাচ্ছেন কিভাবে কোরআনকে মর্যাদা দিতে হয়!

Facebook Comments