রাজার দেওয়া বীজ

445

অনেক অনেক দিন আগে এক দেশে এক রাজা বাস করতো। তার রাজ্যটি ছিলো খুব সুন্দরসুখী ও সমৃদ্ধশালী। কিন্তু একটি ব্যাপারে রাজা ছিলেন কিছুটা চিন্তিত। তিনি প্রায় বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু তখনো পরবর্তী রাজা নির্বাচন করতে পারেননি। নিজের সহকারী কিংবা সন্তান-সন্ততিদের মধ্য থেকে রাজা নির্বাচন না করে তিনি চাইছিলেন নতুন কিছু করতে। তাই একদিন তিনি তার রাজ্যের সকল তরুণ ও যুবকদের একত্রিত করে ঘোষণা করলেন, “বয়সতো আমার অনেক হলো। তাছাড়া পরবর্তী রাজা নির্বাচিত করার সময়ও এসে গেছে। তাই আমি ঠিক করেছি তোমাদের মধ্য থেকেই পরবর্তী রাজা নির্বাচিত করবো।

রাজার কথায় সবাই অবাক হয়ে গেলো! কিন্তু তিনি তার কথা চালিয়ে গেলেন, “আজ আমি তোমাদের সবাইকে একটি করে বীজ দেবো। আর বীজটি এক বিশেষ প্রজাতির। আমি চাই তোমরা এই বীজটি রোপন করে নিয়মিত পানি দাও ও এর পরিচর্যা করো। আর আজকের দিন থেকে ঠিক এক বছর পর তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে বীজ থেকে কে কী উৎপাদন করেছো তা নিয়ে। তারপর তোমাদের আনা গাছগুলো পরীক্ষা করেই আমি ঠিক করবো কে হবে আমাদের পরবর্তী রাজা।”

 

মাহমুদ নামে এক বালকও সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলো। অন্য সবার মতো সেও একটি বীজ পেয়েছিলো। বাড়ি ফিরে গিয়ে সে তার মাকে ঘটনাটির কথা জানালো। তিনি খুব আগ্রহের সাথে মাহমুদকে বীজটি রোপন করার জন্য একটি টব ও অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করে দিলেন। তারপর সে খুব যত্নের সাথে বীজটি রোপন করলো এবং তাতে পানি দিলো। সে নিয়মিত তার যত্ন নিতে থাকলো এবং খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতো কোনো চারা জন্মাচ্ছে কিনা। এভাবে প্রায় তিন সপ্তাহ কেটে গেলো। তারপর কিছু বালক বলাবলি করতে লাগলো তাদের বীজ থেকে চারা গজিয়েছে এবং সেগুলো খুব ভালোভাবে বেড়েও উঠছে।

মাহমুদ নিয়মিত দেখতে লাগলো কিন্তু কোনো চারা গজানোর লক্ষণ সে দেখলো না। তিন সপ্তাহ, চার সপ্তাহ, পাঁচ সপ্তাহ করে এভাবে অনেক দিন কেটে গেলো। কিন্তু কোনো কিছুই ঘটলো না। অন্য সব ছেলেরা তাদের গাছ নিয়ে আলোচনা করতে থাকলো কিন্তু মাহমুদের বীজ থেকে কোনো চারাই জন্মালো না। ছয় মাস পরও মাহমুদের টবটি শুরুতে যেমন ছিলো তেমনই রইলো। তাই সে মনে করতে লাগলো সে তার বীজটি মেরে ফেলেছে।

মাহমুদ ছাড়া সব ছেলের কাছেই একটি করে গাছ ছিলো এবং সেগুলো অনেক বেড়েও উঠেছিলো। তাই মাহমুদ কারো সাথে কথা বলতো না। সবসময় তার বীজ থেকে চারা গজানোর আশায় বসে থাকতো।

এভাবে পুরো এক বছরই কেটে গেলো। তাই রাজ্যের সব ছেলে রাজ দরবারের সামনে উপস্থিত হলো রাজাকে তাদের গাছ দেখানোর জন্য। মাহমুদ তার মাকে বললো সে খালি টব নিয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু তার মা তাকে বুঝালো, “মাহমুদ, এতে লজ্জিত হবার কিছু নেই। কারণ তুমি তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছো। তাই তোমার উচিত রাজার সামনে গিয়ে সত্য কথাটা বলা।”যা ঘটে গেলো তার জন্য কিছুটা লজ্জিত হলেও মাহমুদ বুঝতে পারলো তার মায়ের কথাই ঠিক। সে তার খালি টব নিয়েই রাজ দরবারে গেলো। রাজদরবারে পৌঁছে মাহমুদ অন্যান্য ছেলেদের আনা বিভিন্ন জাতের ও আকারের গাছ দেখে খুব অবাক হলো। সে তার টবটি নিচে রেখে দিলো। কেউ কেউ তাকে দেখে হাসাহসি করতে লাগলো। কেউ কেউ আবার তার চেষ্টার জন্য তাকে সহমর্মিতাও জানালো।


এ গল্পটি পড়ুন- তিনস্তরের ছাঁকনী


উপস্থিত হয়ে রাজা পুরো কক্ষটি ঘুরে দেখলেন এবং সকল বালককে মুবারকবাদ জানালেন। আর মাহমুদ সর্বদা রাজার দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করছিলো। রাজা বলে উঠলেন, “তোমরা সকলেই চমৎকার গাছ ও ফুল উৎপাদন করেছো! আজ তোমাদের মধ্য থেকেই আমাদের পরবর্তী রাজা নির্বাচিত হবে!” তারপর হঠাৎ তিনি মাহমুদ ও তার খালি টবটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন এবং প্রহরীদের বললেন তাকে সামনে নিয়ে আসতে। এতে মাহমুদ খুব ভয় পেয়ে গেলো এবং মনে মনে ভাবতে লাগলো“রাজা জেনে গেছেন আমি ব্যর্থ হয়েছি। হয়তো তিনি আমাকে হত্যার আদেশ দিবেন।”

সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মাহমুদকে রাজা তার নাম জিজ্ঞেস করলো। জবাবে সে বললো, “আমার নাম মাহমুদ।” আর সাথে সাথে সকল ছেলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করলো। রাজা সকলকে চুপ করার নির্দেশ দিলেন। তিনি মাহমুদের দিকে তাকালেন এবং জনতার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন, “তোমাদের নতুন রাজাকে সম্মান দেখাও! তার নাম মাহমুদ!” মাহমুদের যেনো কিছুই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তার বীজ তো অঙ্কুরিতই হয়নি। কিন্তু তারপরও কীভাবে সে রাজা নির্বাচিত হলো? রাজা বললেন, “ঠিক এক বছর আগে আজকের এই দিনে আমি তোমাদের প্রত্যেককেই একটি করে বীজ দিয়েছিলাম। আমি তোমাদের বলেছিলাম বীজটি রোপন করে নিয়মিত পরিচর্যা করতে এবং তা আজ আমার কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু আমি তোমাদের দিয়েছিলাম সিদ্ধ করা বীজ যা থেকে চারা গজাতে পারে না। মাহমুদ ছাড়া তোমরা সকলেই চারা, গাছ কিংবা ফুল নিয়ে এসেছো। যখন তোমরা দেখলে আমার দেয়া বীজটি থেকে চারা গজাচ্ছে না, তোমরা সেটির জায়গায় অন্য আরেকটি বীজ রোপন করলে। একমাত্র মাহমুদই সাহস ও সততার সাথে আমার দেয়া বীজ ও খালি টব নিয়ে এসেছে। আর এ কারণেই সে হবে তোমাদের পরবর্তী রাজা।”

সত্যবাদীতার গুরুত্ব সম্পর্কে নবী করীম (ﷺ) বলেছেনঃ

 

সত্য নেকীর দিকে পরিচালিত করে আর নেকী জান্নাতের দিকে পৌছায়। আর মানুষ সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে অবশেষে সিদ্দীকের দরজা লাভ করে। আর মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যায়, পাপ তাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। আর মানুষ মিথ্যা কথা বলতে বলতে অবশেষে আল্লাহর কাছে মহামিথ্যাবাদী রূপে সাব্যস্ত হয়ে যায়।

[সহীহ বুখারী :: খন্ড ৮ :: অধ্যায় ৭৩ :: হাদিস ১১৬]

Facebook Comments