সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. অত্যন্ত অল্প বয়সে ঈমান আনেন। যখন মাত্র ১৭ বছর বয়স তখন তিনি মুসলমান হন। তিনি ছিলেন ১৭ তম ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তি। ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম তীরন্দাজ।

তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তাঁর মা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর নিজের পিতা-পিতামহের ধর্মে প্রত্যাবর্তনের জন্য চাপ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি পানাহার ছেড়ে দেন। যতক্ষণ না সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস ইসলাম ত্যাগের ঘোষণা দিচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি মৃত্যু হলেও জলস্পর্শও করবেন না জানিয়ে দেন।

ক্রমে তার স্বাস্থ ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন, এমনকি তিনি ঠিকমত কথাও বলতে পারছিলেন না। তার পুত্র তাকে বারংবার বুঝিয়েও ব্যর্থ হলেন। শেষাবধি দৃঢ়তার সাথে বললেন, যদি তোমার দেহে একশ জীবনও সঞ্চারিত হয়। আর তা এক এক করে মৃত্যু বরণ করে তবুও আমি আমার ঈমান ত্যাগ করব না।

ছেলের এই দৃঢ়তায় তাঁর মা নিরাশ হয়ে অনাহার ভঙ্গ করতে বাধ্য হয়। আরেকদিন যখন সাদ ঘরে নামাজ পড়ছিলেন, তাঁর মা হামনা সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে প্রতিবেশিদের ডেকে সাদকে প্রহার করতে বলে, যতক্ষণ না সাদ ঈমান আনে কিম্বা মারা যায়!

একজন মা নিজ সন্তানকে নির্যাতনের জন্য লোক ডেকে আনছে, এই ঘটনা বিস্ময়কর। ইসলামের মোকাবেলায় ইসলামের শত্রুরা বরাবরই এইরকম বিস্ময়কর চরিত্র নিয়ে আজও হাজির।

একবার আবু দাব্ব উপত্যকায় সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস, সা’দ ইবনে যায়িদ, খাব্বাব ইবনে আরাত আল তামিমি, আম্মার বিন ইয়াসির, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. নামাজ আদায় করছিলেন। এটা কোনোভাবে আবু সুফিয়ান, আল আখনাস বিন শুরাইক্ব জানতে পেরে সদলবলে সেখানে উপস্থিত হয়ে সাহাবাদের উপর হামলা করে।

ইসলাম সেখানে ছিল নবীন। নবুওয়্যাতের তৃতীয় বর্ষ ছিল সেটা। এত কম সংখ্যক ছিলেন তারা যে, কেবল সংখ্যালঘু শব্দের দ্বারাই তাদের সংখ্যা তখন চিহ্নিত করা যায় না। ইসলামগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল কেবলমাত্র হাতেগোণা। এই সময়ে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্তাপন করলেন তারা। মুসলমানগণ পাল্টা প্রতিহত করল।

সা’দ আবি ওয়াক্কাস কাছেই দেখতে পান মাটিতে একটা উটের চোয়ালের হাড় পড়ে আছে তিনি তা তীর ছোঁড়ার মত ছুঁড়ে মারেন। একজন মুশরিকের কপাল গিয়ে এমনভাবে তা আঘাত করে যে, কপাল চিড়ে মাথা ফেটে যায়। এই দৃশ্য দেখে বাকিরা দৌড়ে পালিয়ে গেল। এটা ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রতিরোধের প্রথম ঘটনা। প্রথম কোনও রক্তপাত।

এত স্বল্পসংখ্যক হয়েও যে অদম্য সাহস ও স্পৃহায় আত্মরক্ষার যে মৌল মানবাধিকারের চর্চা সম্ভবত দুনিয়ার ইতিহাসে তা নজির বিহীন। কোনও আদর্শের এত অল্পসংখ্যক লোক সংখ্যাগরিষ্ঠের এত বড়ো নেতা ও তাঁর দলের সঙ্গে এভাবে প্রতিরোধ ও বিজয় অর্জন করেছে পৃথিবীর ইতিহাসে এঁর আর কোনও নজির আছে বলে আমার জানা নেই।

সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস ইসলামের জন্য কেবল প্রথম রক্তই ঝরান নি, তিনি ছিলেন ইসলামের জন্য প্রথম তীর নিক্ষেপকারী। বদরের যুদ্ধে তিনি ও তাঁর ভাই উমায়ের অংশ নেন। উমায়েরের বয়স কম ছিল বলে রাসুল অনুমতি দেন নি, কিন্তু অত্যধিক আগ্রহ আর কান্নাকাটির মুখে তাঁকে অনুমতি দেওয়া হয়।

যে চৌদ্দ জন সাহাবা বদরে শহীদ হন, উমায়ের ছিলেন তাঁদের একজন। সাদ এবং উমায়ের দুইভাই একসাথে বদরপ্রান্তে রওয়ানা হয়েছিলেন, ফেরার সময় প্রিয়তর ছোটভাইকে রেখে একা একা ফিরতে হয়েছে তাঁকে। এই ইসলাম কত ত্যাগের মাধ্যমে আমাদের হাতে পৌঁছেছে!

উহুদের যুদ্ধে যখন মুসলমানরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল, যে পনেরোজন সাহাবা তখনও অকুতোভয় লড়ছিলেন রাসুলের পাশে থেকে তাঁর মধ্যে সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. ছিলেন অন্যতম। তিনি নিজের দেহ দিয়ে রাসুলের দেহকে আড়াল করে রাখছিলেন। মানবঢাল তৈরি করেছিলেন।

তিনি তীর নিক্ষেপ করে যাচ্ছিলেন একের পর এক। এগিয়ে আসা শত্রুদল তাঁর তীরের ঝড়ে ক্রমে ধ্বসে যেতে থাকে। রাসুল নিজে তাঁর জন্য তীর কুড়িয়ে দিয়েছেন সে যুদ্ধে। এমনকি রাসুল তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমার জন্য আমার পিতা, মাতা কুরবান হউক’। আলী রা. বলেন, রাসুল আর কোনও ব্যক্তি স্বমন্ধে কখনোই এমনটি বলেন নি।

উহুদের যুদ্ধে কোনও কোনও বর্ণনামতে, তিনি একাই এক হাজার তীর নিক্ষেপ করেছেন। সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. বিদায় হজ্বের সময় রাসুলের সাথে ছিলেন। উমার রা. এঁর আমলে তিনি এক লক্ষ মুসলিম সেনার সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। এঁর মধ্যে তিনি ৩৫ হাজার সৈন্যকে বেছে নিয়েছিলেন পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে।

কাদেসিয়ায় সেই যুদ্ধ চলাকালীন তিনি ছিলেন সায়াটিকায় আক্রান্ত। তাঁর কোমরের উপরের অংশ থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত এই স্নায়বিক ব্যথা ছিল। ঘোড়ায় চড়া এমনকি নাড়াচাড়াও হয়ে উঠেছিল ছিল অসম্ভব। এইরকম অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি যুদ্ধের কম্যান্ড নিজ হাতে রাখেন।

পারস্যের সহকারী সম্রাট ও যৌথ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক রুস্তমের নেতৃত্বে আসা হস্তি, অশ্বারোহী, পদাতিক বাহিনীর ১ লক্ষ বিশ হাজার সৈন্যকে তাঁর বাহিনী পরাস্ত করে। কিংবদনন্তী সেনাপতি রুস্তম নিহত হয়। ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম এই বিজয় সম্পন্ন হবার দুইমাসের মাথায় পারস্যের রাজধানী মাদায়েনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। ততদিনে সেনাপতি সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

মাদায়েন দজলা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। নদীর দুইপাশেই শহর গড়ে উঠেছিল। দজলা নদীর পশ্চিমাংশের নাম ছিল ‘বাহুরাসীর’ ইংরেজিতে যাকে ‘Seleucia’ এবং সিরিয়ান আরবিতে ‘সালিক্ব’ বলা হয়। অপর অংশ যা ছিল দজলার পূর্ব তীরে এর নাম ছিল ‘তায়সাফুন’, ইংরেজিতে একে ‘Ctesiphon’ বলা হয়।

এর বর্তমান নাম সালমান পাক, যা ইরাকের রাজধানী বাগদাদের জিরো পয়েন্ট থেকে প্রায় পনেরো মাইল উত্তরে। আধুনিক ইরাকের বাগদাদ প্রদেশেই সে সময়কার মাদায়েন অবস্থিত ছিল।

সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. পশ্চিম মাদায়েন জয় করেন। দুই মাস শহর অবরোধ করা হয়। এরপর স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধ হয়, যুদ্ধে মুসলমানগণ বিজয়ী হয়। তারা শহরে প্রবেশ করে দেখল, শহর খালি করে সবাই পূর্ব মাদায়েনে চলে গেছে। পশ্চিম মাদায়েনে পৌঁছার পর মুসলমানদের চোখে পারস্য সম্রাটের ‘সাদা প্রাসাদ’ দৃশ্যমান হয়।

মুসলিম সেনাদল সেখানে যাওয়ার জন্য নৌকার খোঁজ করল। দেখা গেল, সব নৌকা পূর্ব মাদায়েনের নদী বন্দর ফিরাযে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সমস্ত সংযোগ সেতু ভেঙে ফেলা হয়েছে। সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. চিন্তিত হয়ে পড়লেন পার হওয়ার ব্যাপারে।

এ বছর অকস্মাৎ নদীতে বন্যা হল। বন্যায় পানি ফেনিল আর কালো হয়ে নদীর বিস্তৃতি প্রায় আধ মাইল ব্যাপ্ত হয়ে গেল। বর্তমানের দজলা অনেক অগভীর হলেও তখন ছিল যথেষ্ট নাব্যতা। সেই সময় এক রাতে সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. স্বপ্নে দেখলেন, ঘোড়া নিয়ে মুসলমানগণ নদী পার হচ্ছেন।

তিনি পরদিন সকালেই সৈন্য সমাবেশে স্বপ্নের কথা জানিয়ে তা বাস্তবায়নের ইচ্ছে প্রকাশ করলেন এবং স্বেচ্ছায় নদী পার হতে কে কে চায় সে কথা জানতে চাইলেন। আসিম ইবনু আমর রা. এবং তাঁর সাথে আরও ছয়শো সৈন্য দাঁড়াল। তিনি তাঁদের নিয়ে একটা ব্যাটালিয়ন গঠন করলেন, এর নাম দেওয়া হল আল আহওয়াল অর্থাৎ ভয়ঙ্কর।

উদ্দেশ্য ছিল তারা প্রথমে নদী পার হবে এবং হামলা চালিয়ে শত্রুদের ভীত করে তুলবে। কা’কা বিন আমরের নেতৃত্বে আরও একটি ব্যাটালিয়ন গঠন করা হল ‘খারসা’ নামে। যার অর্থ ‘বোবা, নিঃশব্দ’। এই নামকরণের উদ্দেশ্য ছিল তারা কিছুটা অগ্রসর হয়ে নদী পার হবে ব্যাক-আপ ফোর্স হিসেবে এবং ভিন্ন দিক দিয়ে শত্রুর উপর নিঃশব্দে আক্রমণ চালাবে।

এই দুই ব্যাটালিয়নের অধিনায়কেরাই ছিলেন বনু তামিম গোত্রের। আল আহওয়াল ব্যাটালিয়ন যখন ঘোড়া দিয়ে নদী পার হল, তখন ইরানি সৈন্যরা বলল, এরা দানব কিম্বা জিন। প্রকৃতই সৈন্যরা ভীতির মধ্যে পড়ে গেল। পরে যখন পাশ থেকে খারসা ব্যাটালিয়ন আক্রমণ করল তখন ফিরায নদী বন্দরের নিয়োজিত সৈন্যরা এই দুই ব্যাটালিয়নে গড়ে উঠা মাত্র এক বিগ্রেড সৈন্যের হাতে পরাজয় বরণ করল।

বন্দরের নিয়ন্ত্রণ মুসলমানদের হাতে আসলে সেনাপতি সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস সকল অশ্বারোহীকে নদীতে নেমে গেলেন। নদী এমনভাবে গল্প করতে করতে তারা পার হচ্ছিলেন যে, যেন তারা ডাঙ্গায় ঘোড়া নিয়ে চলছেন। বর্ষীয়ান সাহাবী সালমান ফার্সী রা. বলেন, আমরা এমনভাবে নদী অক্ষত অবস্থায় পার হই যে, কারো হাত থেকে একটা রশিও হারায় নি।

একজনের একটা পাত্র হারিয়ে গেলে, যখন সে তা খুঁজতে লাগল, দেখা গেল নদীর স্রোত তা তাঁর কাছে ফেরত নিয়ে এসেছে। সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. এই অবস্থাদৃষ্টে বললেন, ‘আল্লাহ্‌র কসম, ততদিন মুসলামান বিজয়ী হবে, আল্লাহর সাহায্য পাবে, আল্লাহ্‌ তাদের জন্য যথেষ্ট হবেন, যতদিন মুসলমানের মধ্যে এমন পাপ না থাকবে যা সওয়াবকে অতিক্রম করে’।

এই যে, আজকে মুসলমানদের দুনিয়াজোড়া পতন, পদে পদে লাঞ্ছিত হওয়া, মার খাওয়া তাঁর কারণ সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. এঁর এই উক্তির মধ্যে নিহিত আছে। এমনকি মুসলমানের বিজয়ের সূত্রও বুনা আছে এর মাঝে। পতনের কারণ আমাদের গুনাহর পাল্লা আমাদের সওয়াবের পাল্লাকে অতিক্রম করে ভারী হয়ে যাওয়া।

আর এই পতন থেকে মুক্তির উপায় একমাত্র এটাই, এই গুনাহের পথ থেকে তওবা করে সওয়াবের দিকে ধাবিত হওয়া। নেক কাজের প্রতি ঝুঁকে যাওয়া। অন্য কিছুই আমাদের বিজয়ী করতে পারবে না, না অর্থ, না জ্ঞান-বিজ্ঞান, না সমর শক্তি, না সংখ্যা। এই যে, ফিলাস্তিন থেকে আরাকান, মুসলমান মার খাচ্ছে, এই হত্যা এই পরাজয়ের ভাগীদার তো আমিও।

এই সবই তো আমাদের গুনাহের ফসল। আমাদের রব এ থেকে আমাদের প্রত্যাবর্তনের তাওফিক দিন।

আমরা প্রিয়জনদের জন্য কত গুনাহর দিকে পা বাড়াই, কখনো বন্ধুদের সাথে মিলে, কখনো প্রেমের জন্য, এইসবই সম্পর্কের নামে করি আমরা। অথচ ইসলামের জন্য সম্পর্ককে কী করে উপেক্ষা করতে হয়, এমনকি নিজের মাকেও- সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস আমাদের দেখিয়ে গেছেন।

ক্রিকেটে কেউ ইনজুরি নিয়ে খেললে, সেটাকে বীরত্ব অবহিত করে কতজনই তো কত অনুপ্রাণিত হই- অথচ সিভিয়ার ইনজুরি নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা এই সাহাবির আদর্শের ফ্যান আমরা কতজন হতে পেরেছি? আজ এই না হওয়া, এই না পারা, এই অনুসরণ না করাই উম্মাহর পতনের কারণ।

জিমে গিয়ে পছন্দের তারকার মত শরীর বানায় কতজন! সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. ছিলেন সুঠাম ও সুগঠিত দেহের অধিকারী। চওড়া কাঁধ, পেশিবহুল দেহের, কোঁকড়ানো ঘন কালো চুলের এক মহান দীর্ঘদেহী পুরুষ! কেন আমাদের অনুসরণে সেইসব দুশ্চরিত্র লোকেরা চলে আসে, কেন তারা আইকন হয়, আশারায়ে মুবাশশরার অন্যতম সা’দ বিন ওয়াক্কাসের মত অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বাদ রেখে।

যে তারুণ্য আমাদের গুনাহতে ডুবিয়ে দেয়, মুসলমান হয়েও ইসলাম থেকে দূরে সরায়। সে তারুণ্যই সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসকে মূর্তি পূজা থেকে ইসলামের দিকে নিয়ে এসেছিল। ইসলামকে তাঁর দ্বারা শক্তিশালী করেছিল। আর আমাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে চলেছে। আফসোস!


সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস
লেখক – আরজু আহমদ

Facebook Comments