ফাতিহ্‌ সুলতান মুহাম্মাদ

রাসূল মুহাম্মদ ﷺ আরব মরুভূমিতে তাঁর অনুসারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে একদিন তারা তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর এবং কিংবদন্তি নগরী কনস্ট্যান্টিনোপোল (বাইজেন্টাইন [পূর্ব রোমান] সাম্রাজ্যের রাজধানী) জয় করবে। তবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি মুসলিমদের জন্য অধরাই থেকে গিয়েছিল। কনস্ট্যান্টিনোপোল (বর্তমানে তুরস্কের রাজধানী “ইস্তানবুল”) বিজয় মনে হচ্ছিল যেন এক অসম্ভব কাজ। শহরটি ছিল খুবই সুরক্ষিত। উপদ্বীপ হওয়াতে একদিকে বসফরাস প্রণালী দ্বারা জলবেষ্টিত এবং অন্য দিক দিয়ে সুবিশাল দেয়াল শহরটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে করে তুলেছিল অপ্রতিরোধ্য, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কনস্ট্যান্টিনোপোল বিজয়ের স্বপ্নে বিভোর সকল বিজেতাদেরকে নিরস্ত ও নিবৃত্ত করে এসেছিল। উমাইয়া খিলাফতের সময় মুসলিম সেনাবাহিনী কনস্ট্যান্টিনোপোল অবরোধ করেছিল, তবে সেই অবরোধগুলো শহরটির অতিকায় দেয়ালগুলোকে ঘায়েল করতে পারেনি।

১৪শ শতকের শুরুর দিকে পশ্চিম আনাতোলিয়ার এক ছোট বেইলিক হিসেবে ওসমানী সাম্রাজ্যের উত্থান হওয়ার পর এটি বাইজেন্টাইন (পূর্ব রোমান) সাম্রাজ্য এবং এর রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপোলের নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ সিংহাসনে আরোহণের সময়ে ওসমানীরা ইতিমধ্যে কনস্ট্যান্টিনোপোলের চারদিকে ইউরোপ ও এশিয়া উভয় মহাদেশের ভূখণ্ডেই নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছে। সুলতান হওয়ার মুহূর্তেই সুলতান মুহাম্মাদ এই কিংবদন্তি নগরী বিজয়কে নিজের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি বসফরাস প্রণালীতে কনস্ট্যান্টিনোপোলের উত্তরদিকে একটি দুর্গ নির্মাণের উদ্যোগ নেন যাতে শহরটিতে আসা-যাওয়া করা জাহাজগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়া যায়। রাসূল মুহাম্মাদ ﷺ ঘোষণা দিয়েছিলেন যে মুসলিমরা একদিন কনস্ট্যান্টিনোপোল বিজয় করবে। তাই রাসূল ﷺ এর সম্মানে সুলতান মুহাম্মাদ এমনভাবে দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন যেন উপর থেকে দেখলে দুর্গটিকে আরবী “মুহাম্মাদ” (محمد) বানান এর মতো দেখা যায়।

বর্তমানে ইস্তানবুল

১ এপ্রিল, ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ। সুলতান মুহাম্মাদ এবং তাঁর এক লক্ষাধিক সৈন্যবিশিষ্ট ওসমানী সেনাবাহিনী কনস্ট্যান্টিনোপোল নগরীর প্রাচীরের সামনে এসে পৌঁছায়। তাঁরা সেখানে গিয়ে যে দৃশ্য দেখেছিলেন তা নিশ্চয়ই আতঙ্কজনক ছিল। কনস্ট্যান্টিনোপোলের প্রাচীরের ভেতরের অংশের দেয়াল ছিল ৫ মিটার পুরু এবং ১২ মিটার উঁচু। ভেতরের দেয়াল থেকে ২০ মিটার দূরে ছিল বাহিরের দেয়াল, যেটা ২ মিটার পুরু এবং ৮.৫ মিটার উঁচু। এই দেয়ালগুলো ইতিহাসে কোনদিনই বিজিত হয়নি। ইতিপূর্বে ওসমানীদের অনেকগুলো অবরোধ পরাস্ত হয়েছিল বারবার, এবং ৭ম শতকে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর আমলেও উমাইয়াদের অবরোধ ব্যর্থ হয়েছিল।

দুর্ভেদ্য দেয়ালগুলোর পাশাপাশি শহরের “গোল্ডেন হর্ন” এ স্থাপন করা ছিল একটি অতিকায় লোহার শিকল। গোল্ডেন হর্ন হচ্ছে কনস্ট্যান্টিনোপোলের উত্তরদিকে অবস্থিত এক ছোট খাল। লোহার শিকলের মাধ্যমে গোল্ডেন হর্নে জাহাজ আগমন নিয়ন্ত্রণ করা যেত। যার ফলে বহিঃআক্রমণের বিরুদ্ধে তুলনামূলকভাবে কম সুরক্ষিত শহরের উত্তর উপকূলটিও যথেষ্ট নিরাপদ ছিল। এই শিকলের কারণে যেকোন নৌবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করা যেত। যার ফলে যুদ্ধ শুরুর আগেই বাইজেন্টাইনরা পরিষ্কারভাবে প্রতিরক্ষার দিক দিয়ে অনেক বেশী সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। তাই ওসমানীদের তুলনায় লোকবলে ও অস্ত্রশস্ত্রে অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও বাইজেন্টাইনরা সুনিশ্চিত ছিল তাদের “আসন্ন বিজয়” এর ব্যাপারে। বিশেষ করে ইতালির জেনোয়া থেকে সাহায্য হিসেবে অতিরিক্ত যোদ্ধা ও সেনাপতি পাওয়ার পর তাদের আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে গিয়েছিল।

তৎকালীন কনস্ট্যান্টিনোপোলের মানচিত্র। শহরের উত্তরদিকে গোল্ডেন হর্ন এবং লোহার শিকল চিহ্নিত রয়েছে।

সুলতান মুহাম্মাদ বাইজেন্টাইনদেরকে আত্মসমর্পণ করার সুযোগ দেন এবং আত্মসমর্পণ করলে সকলের জীবন, অর্থ-সম্পদ ও পরিবারের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেন। তবে বাইজেন্টাইন সম্রাট ১১তম কনস্ট্যান্টিন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ফলশ্রুতিতে, সুলতান মুহাম্মাদ এপ্রিল মাসের ৬ তারিখে কনস্ট্যান্টিনোপোল আক্রমণ শুরু করেন। ওসমানী সৈন্যদের সর্বোত্তম প্রচেষ্টা এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় কামানের গোলাবর্ষণ সত্ত্বেও কনস্ট্যান্টিনোপোল কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিরোধ চালিয়ে যায়। গোল্ডেন হর্নের লোহার শিকলের কারণে যেহেতু শহরটির দুর্বল প্রান্তে আক্রমণ করা যাচ্ছেনা, তাই ২২ এপ্রিল সুলতান মুহাম্মাদ ওসমানী নৌবাহিনীকে নির্দেশ দেন ভূমির উপর দিয়ে জাহাজগুলো বয়ে গোল্ডেন হর্নে নিয়ে যেতে। এক রাতেই, ৭২ টি জাহাজ ভূমির উপর দিয়ে বহন করে গোল্ডেন হর্নে নিয়ে যাওয়া হয় এবং শহরের উত্তরদিক থেকে চাপ প্রয়োগ করা হয়।

গোল্ডেন হর্ন এবং বসফরাস প্রণালী

যেহেতু ওসমানীরা ইতিমধ্যে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে তাই মনে হচ্ছিল শহরের যুদ্ধটি শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে। ২৮ মে তে সুলতান মুহাম্মাদ তাঁর আক্রমণ স্থগিত করেন এবং সেনাবাহিনীকে নিয়ে গোটা দিন আল্লাহ্‌র কাছে বিজয়ের জন্য দোয়া করেন। পরের দিন ২৯ মে ওসমানী বাহিনী শহরের দেয়ালে চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু করে এবং সকাল শেষ হবার আগেই কনস্ট্যান্টিনোপোলের অজেয় দেয়ালগুলো জয় করে নিয়ে কনস্ট্যান্টিনোপোল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

সম্ভবত এই ঐতিহাসিক ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল পরাজিত বাইজেন্টাইনদের সাথে সুলতান মুহাম্মাদের আচরণ। তিনি শহরের অধিবাসীদের হত্যা করেননি, বরং কর পরিশোধ থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাদেরকে কনস্ট্যান্টিনোপোলে থেকে যেতে উৎসাহিত করেন। কনস্ট্যান্টিনোপোলের গ্রীক অর্থোডক্স বিশপকে তিনি শহরে থেকে যেতে অনুরোধ করেন এবং তাঁর হয়ে শহরের খ্রিস্টানদের শাসন করার ব্যাপারে জোর প্রদান করেন। অন্যদিকে ইউরোপের অন্যান্য প্রান্তে “ধর্মীয় সহিষ্ণুতা” ছিল এক অপরিচিত এবং বিদেশী ধারণা। অমুসলিমদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে সুলতান মুহাম্মাদ ইসলামী নিয়ম-নীতির অনুসরণ করেন এবং কনস্ট্যান্টিনোপোলের খ্রিস্টানদেরকে তাদের নিজ ধর্ম পালনের অধিকার ও স্বাধীনতা প্রদান করেন। যুদ্ধ পরিচালনায় তাঁর দক্ষতা ও পারঙ্গমতা এবং একইসাথে ন্যায়পরায়ণ গুণাবলীসমূহের কারণে তিনি লাভ করেছেন الفاتح (“আল-ফাতিহ্‌”, ইংরেজিঃ the Conqueror, বাংলায় “বিজেতা”) উপাধি, যে নামে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।

অনুবাদ করা হয়েছেঃ Mehmed II and the Prophet’s Promise আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদকঃ সাদাত ইফতেখার

Sources:

Freely, J. (2009). The Grand Turk. New York: Overlook Press.

Ochsenwald, W., & Fisher, S. (2003). The Middle East: A History. (6th ed.). New York: McGraw-Hill.

Facebook Comments