হতাশায় ভুগছেন? নবীজির মুখে শুনুন ফিরে আসার গল্প

161
হতাশা

বুখারি ও মুসলিম শরীফে হযরত আবু সাঈদ ইবনে মালেক ইবনে সিনান আল-খুদরী রা. থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, নবী কারীম সা. পূর্ব যুগের এক তাওবাকারির ঘটনা বর্ণনা করে বলেন-
كَانَ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكُم رَجُلٌ قَتَلَ تِسْعَةً وَ تِسْعِيْنَ نَفْساً، فَسَأَلَ عَنْ أَعْلَمِ أَهْلِ الأَرْضِ، فَدُلَّ عَلَى رَاهِبٍ. فَأتَاهُ فَقَالَ : إنَّهُ قَتَلَ تِسْعَةً وَ تِسْعِيْنَ نَفْساً فَهَلْ لَهُ مِنْ تَوْبَةٌ؟ فَقَالَ : لا. فَقَتَلَهُ فَكَمَّلَ بِهِ مِئَةَ، ثُمَّ سَألَ عَنْ أعْلَمِ أهْلِ الأرْضِ، فَدُلَّ عَلى رَجُلٍ عَالِمٍ فَقَالَ: إنَّهُ قَتَلَ مِئَةَ نَفْسٍ فَهَلْ لَهُ مِنْ تَوْبَةٍ ؟ فَقَالَ : نَعَمْ، وَمَنْ يَحُوْلُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ التَّوْبَةِ ؟ اِنْطَلِقْ إلَى أرْضِ كَذَا وَكَذَا فإنَّ بِهَا أُنَاسًا يَعْبُدُوْنَ الله َ تَعَالَى فَاعْبُدِ الله َ مَعَهُمْ، وَلَا تَرْجِعْ إلَى أَرْضِكَ فَإنَّهَا أرْضُ سُوْءٍ. فَانْطَلَقَ حَتَّى إذَا نَصَفَ الطَّرِيْقَ أَتَاهُ المَوْتُ فَاخْتَصَمَتْ فِيْهِ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ وَمَلَائِكَةُ العَذَابِ. فَقَالَتْ مَلاَئِكَةُ الرَّحْمَةِ : جَاءَ تَائِباً مُقْبِلاً بِقَلْبِهِ إِلَى الله ِ تَعَالى! وَقَالَتْ مَلاَئِكَةُ العَذَابِ : إِنَّهُ لَمْ يَعْمَلْ خَيْراً قَطُّ. فَاتَاهُمْ مَلَكٌ فِي صُوْرَةِ آدَمِيٍّ فَجَعَلُوهُ بَيْنَهُمْ -أيْ حَكَماً- فَقَالَ قِيْسُوا مَا بَيْنَ الأرْضَيْنِ، فَإلَى أَيَّتِهِمَا كَانَ أَدْنَى فَهُوَ لَهُ، فَقَاسُوا فَوَجَدُوه أَدْنَى إلَى الأرْضِ الَّتِي أَرَادَ، فَقَبَضْتُهُ مَلاَئِكَةُ الرَّحْمَةِ. متفق عليه.
وفي رواية في الصحيح : فَكَانَ إلَى القَرْيَةِ الصَّالِحَةِ أقْرَبَ بِشِبْرٍ فَجُعِلَ مِنْ أَهْلِهَا.
وفي رواية في الصحيح : فَاَوْحَى الله ُ تَعَالى إِلَى هَذِهِ أنْ تَبَاعَدِي وَإلىَ هَذِهِ أَنْ تَقَرَّبِي. وَقَالَ قِيْسُوا ماَ بَيْنَهُمَا، فَوَجَدُوهُ إلَى هَذِه أَقْرَبَ بِشِبْرٍ فَغُفِرَ لَهُ.

“তোমাদের পূর্বের এক যুগে এক ব্যক্তি নিরানব্বই জন মানুষকে হত্যা করল। এরপর সে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আলেমের অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। তাকে এক পাদ্রীকে দেখিয়ে দেয়া হল। সে তার কাছে গিয়ে বলল, সে নিরানব্বই জন মানুষকে হত্যা করেছে, তার জন্য তাওবার কোন সুযোগ আছে কি না? পাদ্রী উত্তর দিল, নেই। এতে লোকটি ক্ষিপ্ত হয়ে পাদ্রীকে হত্যা করে একশত সংখ্যা পুরণ করল।

এরপর আবার সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলেম সম্পর্কে জানতে চাইল। তাকে এক আলেমেকে দেখিয়ে দেয়া হল। সে আলেমের কাছে যেয়ে জিজ্ঞাসা করল, সে একশত মানুষকে খুন করেছে, তার তাওবা করার কোন সুযোগ আছে কি? আলেম বললেন, হ্যাঁ, তাওবার সুযোগ আছে।

এ ব্যক্তি আর তাওবার মধ্যে কি বাধা থাকতে পারে? তুমি অমুক স্থানে চলে যাও। সেখানে কিছু মানুষ আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী করছে। তুমি তাদের সাথে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করতে থাকো। আর তোমার দেশে ফিরে যেও না। সেটা খারাপ স্থান। লোকটি নির্দেশিত স্থানের দিকে পথ চলতে শুরু করল। যখন অর্ধেক পথ অতিক্রম করল তখন তার মৃত্যুর সময় এসে গেল। তার মৃত্যু নিয়ে রহমতের ফেরেশ্‌তা ও শাস্তির ফেরেশ্‌তাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হল।

রহমতের ফেরেশ্‌তাগন বললেন, এ লোকটি আন্তরিকভাবে তাওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছে। আর শাস্তির ফেরেশ্‌তাগন বললেন, লোকটি কখনো কোন ভাল কাজ করেনি। তখন এক ফেরেশ্‌তা মানুষের আকৃতিতে তাদের কাছে এল। উভয় দল তাকে ফয়সালাকারী হিসাবে মেনে নিল। সে বলল, তোমরা উভয় দিকে স্থানের দূরত্ব মেপে দেখ। যে দুরত্বটি কম হবে তাকে সে দিকের লোক বলে ধরা হবে। দূরত্ব পরিমাপের পর যে দিকের উদ্দেশ্যে সে এসেছিল তাকে সে দিকটির নিকটবর্তী পাওয়া গেল। এ কারণে রহমতের ফেরেশ্‌তাগণই তার জান কবজ করল।” (বুখারী ও মুসলিম)

বুখারীর অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, সে ভাল মানুষদের স্থানের দিকে মাত্র অর্ধহাত বেশী পথ অতিক্রম করেছিল, তাই তাকে তাদের অন্তর্ভূক্ত বলে ধরা হয়েছে। বুখারীর আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ যমীনকে নির্দেশ দিলেন, যেন ভাল দিকের অংশটা নিকটতর করে দেয়। আর খারাপ দিকের অংশটার দুরত্ব বাড়িয়ে দেয়। পরে সে বলল, এখন তোমরা উভয় দুরত্ব পরিমাপ করো। দেখা গেল সে মাত্র অর্ধ হাত পথ বেশী অতিক্রম করেছে। এ কারণে আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দিলেন।

শিক্ষা ও সংশ্লিষ্ট মাসায়েল :

১. ওয়াজ, বক্তৃতা ও শিক্ষা প্রদানে বাস-ব উদাহরণ পেশ করার অনুপম দৃষ্টান- রেখেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

২. যার ইবাদত কম কিন্তু ইলম বেশী, সে শ্রেষ্ঠ ঐ ব্যক্তির চেয়ে, যার ইবাদত বেশী ইলম কম। যেমন এ হাদীসে দেখা গেল যে ব্যক্তি ফতোয়া দিল যে তোমার তাওবা নেই সে আলেম ছিল না, ছিল একজন ভাল আবেদ। তার কথা সঠিক ছিল না। আর যে তাওবার সুযোগ আছে বলে জানাল, সে ছিল একজন ভাল আলেম। তার কথাই সঠিক প্রমাণিত হল।

৩. বিভিন্ন ওয়াজ, নসীহত, বক্তৃতা, লেখনীতে পূর্ববর্তী জাতিদের ঘটনা তুলে ধরা যেতে পারে। তবে তা যেন কুরআন-সুন্নাহ বা ইসলামী কোন আকীদার পরিপন্থী না হয়।

৪. গুনাহ বা পাপ যত মারাত্নকই হোকনা কেন, তা থেকে তাওবা করা সম্ভব।

৫. দাঈ অর্থাত ইসলামের দাওয়াত-কর্মীদের এমন কথা বার্তা বলা দরকার যাতে মানুষ আশান্বিত হয়। মানুষ নিরাশ হয়ে যায়, এমন ধরনের কথা বলা ঠিক নয়।

৬.  সর্বদা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা আর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করা আলেম ও দায়ীদের একটি বড় গুণ।

৭. অসৎ ব্যক্তি ও অসুস্থ সমাজের সঙ্গ বর্জন করা। এবং সৎ ব্যক্তি ও সৎ সমাজের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করা কর্তব্য।

৮. ফেরেশতাগন বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করতে পারেন।

৯. যে আল্লাহর পথে চলার চেষ্টা করে আল্লাহর রহমত তার দিকে এগিয়ে আসে। তাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন এবং পথ চলা সহজ করে দেন।

১০. আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের ক্ষমা করে দেয়ার দিকটা  প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

১১. আল্লাহ তাআলা পরাক্রমশালী হওয়া সত্বেও আদল ও ইনসাফ পছন্দ করেন। তাই দু দল ফেরেশতার বিতর্ক একটি ন্যায়ানুগ পন্থায় ফয়সালা করার জন্য অন্য ফেরেশতা পাঠালেন।

১২. হাদীসটি দিয়ে বুঝে আসে, যে মানুষ হত্যা করার অপরাধে অপরাধী আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন যদি সে তাওবা করে। অথচ অন্য অনেক সহীহ হাদীস স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে যে, আল্লাহ মানুষের অধিকার হরণকারীকে ক্ষমা করেন না। অতএব যে কাউকে হত্যা করল সে তো অন্য মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করে নিল। আল্লাহ তাকে কিভাবে ক্ষমা করবেন?

এর উত্তর হল : যে ব্যক্তি কোন মানুষকে হত্যা করল সে তিন জনের অধিকার ক্ষুন্ন করল। ১. আল্লাহর অধিকার বা হক। কারণ আল্লাহ মানুষ হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। মানুষকে নিরাপত্তা দিতে আদেশ করেছেন।

হত্যাকারী আল্লাহর নির্দেশ লংঘন করে সে তাঁর অধিকার ক্ষুন্ন করেছে। ২. নিহত ব্যক্তির অধিকার। তাকে হত্যা করে হত্যাকারী তার বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করেছে। ৩. নিহত ব্যক্তির আত্নীয়-স্বজন, পরিবার ও সন্তানদের অধিকার। হত্যাকারী ব্যক্তিকে হত্যা করে তার পরিবারের লোকজন থেকে ভরণ-পোষণ, ভালোবাসা-মুহব্বাত, আদর-স্নেহ পাবার অধিকার থেকে চিরতরে বঞ্চিত করেছে।

হত্যাকারী এ তিন ধরণের অধিকার হরণের অপরাধ করেছে। আল্লাহর কাছে তাওবা করলে আল্লাহ শুধু প্রথম অধিকার -যা তাঁর নিজের সাথে সংশ্লিষ্ট- নষ্ট করার অপরাধ ক্ষমা করবেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অপরাধ ক্ষমা করবেন না। এ হাদীসে প্রথম ধরনের অপরাধ ক্ষমা করার কথা বলা হয়েছে। (শরহু রিয়াদিস সালেহীন মিন কালামি সায়্যিদিল মুরসালীন)

Facebook Comments