মাযহাব একটি হলেই তো হয়, মাযহাব একাধিক হল কেন? সব মুসলমান একই মাযহাবের অনুসারী হত এবং মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও একতা ঠিক থাকতো।
এর জবাব হলো, স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছাই হয়তো এমন ছিল যে, মাযহাব একাধিক সৃষ্টি হোক। তাই তিনি কুরআনের শব্দগুলি এমনভাবে অবতীর্ণ করেছেন যে, সেখান থেকে একাধিক অর্থ বুঝার সুযোগ রেখে দিয়েছেন। এমনিভাবে নবীজী ﷺ এর ইচ্ছাও এমন ছিল যে, একাধিক মাযহাব সৃষ্টি হোক।
তাই অনেক হাদীসের শব্দ এমনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সেখান থেকে একাধিক অর্থ নেওয়া যায়। উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
কুরআনের উদাহরণঃ
কুরআন শরীফে আল্লাহ তা‘আলা তালাকপ্রাপ্তা মহিলাদের ইদ্দতের আলোচনায় বলেনঃ
وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوء
‘তালাকপ্রাপ্তা মহিলারা তিন “কুরু” ইদ্দত পালন করবে’। (সূরা: বাকারা:২২৮) قُرُوء (কুরু) শব্দের অর্থ আরবী অভিধানে হায়েয ও পবিত্রতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ কুরু শব্দের অর্থ যেমনিভাবে হায়েয হয় তেমনিভাবে পবিত্রতাও হয়। আর এই দুই অর্থের সমর্থনে হাদীসও পাওয়া যায়।
যেমন হযরত আয়েশা, ইবনে আব্বাস, যায়েদ বিন সাবেতসহ আরো অনেক সাহাবি রাযি. থেকে কুরু শব্দের অর্থ পবিত্রতা বর্ণিত আছে। আবার হযরত আবূ বকর সিদ্দীক, উমর ফারূক, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ সহ আরো অনেক সাহাবা রাযি. ও তাবেঈন থেকে কুরু এর অর্থ হায়েয বর্ণিত আছে। একই শব্দের বিপরীতমুখী অর্থের কারণে এখানে এই মাসআলায় দুই মাযহাব সৃষ্টি হয়েছে। ইমাম মালেক ও শাফেয়ী কুরু এর অর্থ পবিত্রতা গ্রহণ করে বলেন, এমন তালাকপ্রাপ্তা মহিলা যে ঋতুবর্তী (গর্ভবতী নয়) সে তিন পবিত্রতা ইদ্দত পালন করবে।
এটা পড়ুন একটি সরল মূল্যায়ন: কুরআন-সুন্নাহ থাকতে মাযহাব কেন ?
আর ইমাম আবূ হানীফা ও আহমাদ বিন হাম্বল রহ., কুরু এর অর্থ হায়েয গ্রহণ করে বলেছেন, ঋতুবতী তালাকপ্রাপ্তা মহিলা তিন হায়েয ইদ্দত পালন করবে। (বিস্তারিত জানতে তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা বাকারা:২২৮)
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সর্বময় জ্ঞানের অধিকারী, তাই তিনি অবশ্যই জানতেন যে, কুরআনের এই কুরু শব্দ নিয়ে একাধিক মত বা মাযহাব সৃষ্টি হবে। আল্লাহ তা‘আলা যদি ইসলামী শরী‘আতের মধ্যে একাধিক মাযহাবের সৃষ্টি না চাইতেন, তাহলে এখানে কুরু শব্দ ব্যবহার না করে তুহুর-হায়েয বা এ জাতীয় অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করে একাধিক অর্থ গ্রহণের সম্ভাবনা বন্ধ করে দিতে পারতেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা সব কিছু জানা সত্ত্বেও তা করেননি। এর দ্বারা একথাই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, একাধিক মাযহাব সৃষ্টি হওয়ার মধ্যে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
হাদীসের একটি উদাহরণঃ
খন্দক যুদ্ধ চলাকালীন ইয়াহুদী গোত্র বনী কুরাইযা মুসলমানদের সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে গাদ্দারী করে। তাই খন্দক যুদ্ধ শেষে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে বনী কুরাইযার সাথে জিহাদ করার হুকুম আসে। হুকুম আসামাত্র নবীজী ﷺ সাহাবা রাযি. কে খুব দ্রুত বনীকুরাইযার এলাকায় পৌঁছার হুকুম দেন। সেই হুকুমের শব্দটি ছিল এরূপঃ
لا يصلين أحد العصر إلا في بني قريظة
‘তোমাদের কেউ যেন বনী কুরাইযায় পৌঁছার আগে আসরের নামায না পড়ে’। (বুখারী হা.নং ৩৮৩৯) এই নির্দেশ পেয়ে সাহাবায়ে কেরাম রাযি. বনী কুরাইযা অভিমুখে নিজেদের সাধ্যমত দ্রুত ছুটলেন। কিন্তু চেষ্টা সত্ত্বেও আছরের ওয়াক্তের মধ্যে বনী কুরাইযায় পৌঁছতে পারলেন না। এদিকে পথিমধ্যেই আসরের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার অবস্থা। তখন সাহাবা কেরাম রাযি. দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেলেন। একদল নবীজী ﷺ এর কথার বাহ্যিক অর্থ ধরে বললেন, যেহেতু নবীজী ﷺ বনী কুরাইযায় না পৌঁছে আসর পড়তে নিষেধ করেছেন, তাই আমরা বনী কুরাইযায় পৌঁছেই মাগরিবের ওয়াক্তে আসর পড়ব।
আরেক দল যারা নবীজী ﷺ কথার মর্ম বুঝেছিলেন তাঁরা বললেন, নবীজী ﷺ এর ঐ কথার উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত বনী কুরাইযায় পৌঁছা। আমরা যেহেতু সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেও আসরের ওয়াক্তে বনী কুরাইযায় পৌঁছতে পারিনি, তাই আমরা আসর কাযা না করে এখনই আসর পড়ে তারপর বনী কুরাইযায় পৌঁছবো। উভয় দল নিজেদের মতানুযায়ী আমল করলেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রাযি. বলেন, বনী কুরাইযার যুদ্ধ শেষে যখন এই ঘটনা নবীজী ﷺ কে বলা হলো, তখন তিনি কোনো দলের কাজকেই ঠিক বা ভুল বলেননি। (সহীহ বুখারী হা.নং ৩৮৩৯)
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, নবীজী ﷺ এর বাণী ‘তোমাদের কেউ যেন বনী কুরাইযায় পৌঁছার আগে আসরের নামায না পড়ে’ এই বাণীর দুই রকম অর্থ সাহাবায়ে কেরাম বুঝলেন এবং দুই ভাবে আমলও করলেন। আর নবীজী ﷺ ও কোনো দলের সিদ্ধান্তকে ঠিক আর কোনো দলের সিদ্ধান্তকে ভুল বললেন না। এর দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, নবীজী ﷺ এর ইচ্ছাও এমন ছিল যে, শরী‘আত মানার ক্ষেত্রে একাধিক মত ও পথ তৈরি হোক।
কেননা যদি নবীজী ﷺ এর ইচ্ছা এমনটি নাই হতো, তাহলে তিনি অবশ্যই সাহাবায়ে কেরামের দুই দলের এক দলকে বলতেন ‘তোমাদের কাজ ঠিক হয়নি, তোমরা আমার কথা বুঝতে পারনি’। কিন্তু তিনি এমনটি বলেননি। আর তিনি হুকুমটাও এমনভাবে করেছেন যে, তা থেকে দুই রকম অর্থ বোঝার সুযোগও ছিল। অথচ তিনি কথাটা ওভাবে না বলে এভাবেও বলতে পারতেন যাতে দুই রকম অর্থ বুঝার সম্ভাবনা সৃষ্টি হত না । যেমন তিনি এভাবে বলতে পারতেনঃ ‘আসর কাযা করতে হলেও তোমরা বনী কুরাইযায় গিয়েই আসর পড়বে।’ এভাবে বললে সাহাবা কেরাম দুই রকম অর্থ বুঝতেন না। আর দুই মতেরও সৃষ্টি হত না।
যাই হোক কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হলো যে, শরী‘আত মানার ক্ষেত্রে একাধিক মাযহাব সৃষ্টি হওয়া স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা ও নবীজী ﷺ এর ইচ্ছা ছিল। তাই এই প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর যে, ইসলামে এত দল, এত মত কেন? সাথে সাথে মুসলিম উম্মাহকে যে কোনো এক মত বা মাযহাবের উপর ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করাও আল্লাহ তা‘আলার মর্জির খেলাফ।
সালফে সালেহীন মাযহাবের এই ইখতিলাফকে রহমত বলে অভিহিত করেছেন। এবং তারা মুসলিম উম্মাহকে একই মাযহাবের উপর আমল করতে উদ্বুদ্ধ করার প্রচেষ্টারও বিরোধিতা করেছেন। নিম্নে এ ব্যাপারে সালফে সালেহীনের কয়েকটি উক্তি উল্লেখ করা হচ্ছেঃ
১. কাসেম বিন মুহাম্মাদ বিন আবূ বকর সিদ্দীক রহ. বলেনঃ ‘আমলের মধ্যে সাহাবায়ে কেরামের ইখতিলাফের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা এই উম্মতের কল্যাণ করেছেন। এখন যে কেউ কোনো আমল করতে চাইলে সে এ ব্যাপারে প্রশস্ত পথ পেয়ে যায়। সে দেখে যে, তার থেকে উত্তম ব্যক্তি এই আমল করে গেছেন।’ (জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি:২/৮০)
২. হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ. বলেছেন: ‘সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর মধ্যে ইখতিলাফ না হওয়াটা আমার নিকট পছন্দনীয় নয়। কারণ, যদি ইখতিলাফ না হত, শরী‘আত মানার পথ একটিই হত, তাহলে এর দ্বারা এক ধরণের সংকীর্ণতা সৃষ্টি হত। অথচ সাহাবায়ে কেরাম যেহেতু প্রত্যেকেই অনুসরণীয় তাই (তাদের মধ্যে ইখতিলাফ হওয়ার ফলে এখন) যে কারো যে কোনো সাহাবীর মতানুযায়ী আমল করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’
৩. একদা হযরত ইমাম মালেক রহ. কে তখনকার মুসলিম জাহানের খলীফা আবূ জা‘ফর মানসূর বললেন, আমি চাচ্ছি আপনার সংকলিত এই ইলম (মুআত্তা মালেক) কে একমাত্র অনুসরণীয় করবো এবং সেনাবাহিনী ও বিচারক সবাইকে এই অনুযায়ী আমল করতে বলব। অতঃপর কেউ এটার বিরোধিতা করলে তার গর্দান উড়িয়ে দিব। ইমাম মালেক রহ. বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! একটু ভেবে দেখুন। নবীজী ﷺ এমন অবস্থায় উম্মতের মধ্য থেকে বিদায় নিলেন যখন মাত্র কয়েকটি এলাকা ইসলামের অধিনে এসেছে।
এরপর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. এর সময়ও ইসলাম তেমন ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়নি। হযরত উমর ফারূক রাযি. এর সময় ইসলাম পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়লো। অনেক দেশ মুসলমানদের করতলগত হল। তখন তিনি বিজিত এলাকার মুসলমানদের ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার জন্য বিভিন্ন সাহাবায়ে কেরামকে বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করতে বাধ্য হলেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত সেসব এলাকায় ঐসব সাহাবায়ে কেরামের ইলম চর্চা হতে লাগল যাদেরকে ঐ এলাকার মুআল্লিম হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছিল। এখন আপনি যদি সেসব লোককে এমন কোনো বিষয় মানতে বাধ্য করেন যা তাদের নিকট সংরক্ষিত ইলমের পরিপন্থী, তাহলে তারা এটাকে কুফরী মনে করবে। অতএব, আপনি দয়া করে প্রত্যেক শরহবাসীকে তাদের নিকট যে ইলম সংরক্ষিত আছে, সে ইলম অনুযায়ী আমল করতে বলুন। আর আপনার পছন্দ হলে এই কিতাব আপনি নিজের জন্য নিতে পারেন। একথা শুনে খলীফা বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। এই কিতাব আপনি আমার ছেলে মুহাম্মাদের জন্য লিখে দিন।’ (আদাবুল ইখতিলাফ পৃ.৩৬)
৪. ইমাম মালেক রহ. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘ফুকাহা কেরামের ইখতিলাফ এই উম্মতের জন্য আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে রহমত স্বরূপ।’ (আদাবুল ইখতিলাফ পৃ.৩৯)
উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হলো যে, শরী‘আত মানার ক্ষেত্রে একাধিক পথ সৃষ্টি হওয়া কোনো দোষণীয় বিষয় নয়। বরং এটা এই উম্মতের জন্য রহমত এবং এটা উম্মতে মুহাম্মাদীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
অতএব, একাধিক মাযহাব নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা এবং যে এলাকায় যে মাযহাব প্রচলিত আছে সেই এলাকার লোকদেরকে তাদের মাযহাব পরিপন্থী কোনো কিছু মানার আহ্বান করা কুরআন-সুন্নাহ ও সালফে সালেহীনের আমলের পরিপন্থী। তাই যারা এ কাজ করছে, তাদের উচিত আরো একটু গভীরভাবে ভেবে দেখা। তারা কি আসলেই মুসলিম উম্মাহর খায়েরখাহী করছে নাকি মুসলিম উম্মাহকে ফেতনা-ফাসাদ ও সংঘর্ষের পথে নিয়ে যাচ্ছে।
ইমাম মালেক রহ. নিজের মাযহাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার মোক্ষম সুযোগ পেয়েও তিনি সেই সুযোগ গ্রহণ করলেন না, বরং খলীফার কাছে আবেদন করলেন প্রত্যেক এলাকাবাসীকে নিজেরদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বর্তমানে যারা হানাফী মাযহাব মাননেওয়ালা মুসলিমদেরকে মাযহাব বিমুখ করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত তারা কি নিজেদেরকে ইমাম মালেক থেকেও বেশি সমঝদার মনে করেন যে, তারা হানাফী মুসলিমদেরকে নিজেদের মনগড়া মাযহাবের প্রতি আহ্বান করে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে চলছেন? আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন।
প্রধান মুফতী ও শাইখুল হাদীস,
জামিয়া রহমানিয়া,মুহাম্মাদপুর,ঢাকা।