সমাজতন্ত্রের প্রবর্তক কাল মার্কস, লেলিন ও কমিনিজমের চেতনা যার ঈমানের প্রদীপকে ঢেকে রেখেছিল। বিপ্লবী ‘চে’ যার স্বত্তা জুড়ে । ফিদেল কাস্ত্রকে সে তার পথ প্রর্দশক মনে করতো। সামাজতান্ত্রিক বিপ্লবকেই সে মানবতার একমাত্র সমাধান মনে করতো । তার ইসলাম বিরোধী একটি বক্তব্য শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম ।
কি বলে ছেলেটা !!!
প্রথম দেখা হয়েছিল শাহবাগের আজিজ মার্কেটে। ভাল বক্তা ও আবৃত্তিকার। এক আবৃত্তির অনুষ্টানে পরিচয়। লিটলম্যগ নিয়ে কাজ করত। অতঃপর ওর সাথেই বন্ধুত্ব। দুই মেরুর দুজন। আড্ডাতে তর্কের ঝড় উঠতো।
আমি আমার বন্ধু জাবেদ নওশাদ এর কথা বলছি। ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা ভার্সিটি শাখার নেতা সে।
এভাবেই চলে গেল একযুগ। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দে দুজনের সম্পর্কের টানান পোড়ন। বেশ কয়েক বছর ধরে জাবেদের সাথে দেখা নেই।
আমি তাবলীগের কাজে লেগে যাওয়ার পর একবার জাবেদের সাথে দেখা করতে তার অফিসে গিয়েছিলাম । সে তখন বড়ো কর্পোরেট ব্যবসায়ী। দাওয়াত দিলাম । অনেক কথা হল । সে এক দীর্ঘশ্বাস আর কান্নার কথা। মনে হলো প্রদীপটা এখন একেবারে নিভেই গেছে । আমার মতো দুর্বল ঈমানওয়ালার দ্বারা দোয়া আর চোখের পানি ফেলা ছাড়া কিছুই করার ছিল না।
গতবছর হঠাৎ একদিন জাবেদের ফোন। দোস্ত আমি জাবেদ। তোদের হবিগঞ্জে আছি। পারলে একবার দেখে যাবি। আমি জানতে চাইলাম কোথায় আছিস, তোদের পাটির কাজে নাকি? বলল, তুই হবিগঞ্জের চৌধুরী বাজার এসে কল দিস। এটা আমার নাম্বার । বললাম , আমার বাসাতে বেড়িয়ে যা।বললো, তুর ভাবি সাথে । ইচ্ছে থাকার পরেও সম্ভব হবে না ।
আজ প্রিয় বন্ধু জাবেদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বুকের ভেতর ছিল চাপা কষ্ট । কান্নার নদী। চৌধুরী বাজার খোয়াই মুখ গিয়ে কল দিলাম , দোস্ত আমি এসেছি, তুই কই। ওপাশ থেকে বললো , দাড়া আমি আসছি ।
তিন চার মিনিট পরেই, লম্বা সফেদ জুব্বা, বুক পকেটে কলম ও মেসওয়াক, হাতে তাসবিহ , মাথাতে সাদা পাগরী , মুখ ভর্তি চমৎকার কালো দাড়ি। এক যুবক এসে আমাকে সালাম করে জড়িয়ে ধরলো। মোসাফাহ ও মোয়ানাকা করতে করতে ডুকরে কেঁদে উঠলো ।
আমি জাবেদকে চিনতে পেরে চমকে উঠলাম।মনে হলো আমি স্বপ্ন দেখছি!
আমি বাকরোদ্ধ!!
অমার অজান্তেই তার এই বিপ্লবিক পরির্বতন !!!
আশ্চর্য হলাম । কোন সে জিয়ন কাঠির পরশে আমার দোস্ত জাবেদ আজ আলোর দিকে ।
স্বর্গের পথে।
তার হাত ধরে চললাম ।
যেতে যেতে বললো ঐ মসজিদে আছি। মাস্তুরাত সহ জামাত নিয়ে এসেছি। আম্মা ও তুর ভাবি সাথে আছেন। মসজিদের ভেতর পৌছে যা শুনলাম ,এই জামাতের আমীর জাবেদ নওশাদ-ই।
সাথীরা আমীর সাহেবের বন্ধু হিসাব অনেক একরাম করলেন।
বললাম , আমীর সাহেব কী ভাবে এখানে? এই পথে?
জাবেদ বললো , আমি বিয়ে করেছি দুবছর হলো। তোর ভাবির বাসা উত্তরাতে । সে বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছে বছর তিনেক আগে এর পরেই বিয়ে। সে প্রায়ই আমাদের বাসার পাশে এক মহিলা গাইনী ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য যায় । খুব নামকরা চিকিৎসক । ঢাকা মেডিকেলে একসময় বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। তিনি আমার স্ত্রীকে প্রায়ই দাওয়াত দিতেন । আখেরাতের কথা বলতেন। সে তার কথা শুনে প্রভাবিত হতে থাকে। একদিন উনার সাথে মেয়েদের সাপ্তাহিক তালিমে চলে যায়। ঐ তালিমের পয়েন্ট আমি যে বিল্ডিং এ থাকি এর চতুর্থ তলাতে। সেই থেকে তার লাইফ স্টাইলে একটা পরিবর্তন আসতে থাকে। চাকুরির চেষ্টা করছিল। সেই ইচ্ছেটাও বাদ দেয়। আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে সে প্রতি সপ্তাহে তালিমে যাচ্ছিল । এক সময় নামাজ পড়তে থাকে । টিভি দেখা ছেড়ে দেয় । বাহিরে বের হওয়ার আগ্রহ কমে যায় ।
এনিয়ে দুজনের মাঝে দুরত্ব বাড়তে থাকে। আমি এসব একদম সহ্য করতে পারতাম না। তুই জানিস ধর্মকর্ম আমি একদম সহ্য করতে পারতাম না । এসব দেখলে গায়ে জ্বালা দিয়ে উঠতো। কোন হুজুর দেখলেই মাথা গরম হয়ে উঠতো।
ভাবতাম আমাদের অগ্রগতি আর উন্নতির পথে যতো বাধা- এই ধর্মের নামে নষ্টামি।
কিন্তু স্ত্রীর ঈমানের র্স্পশে আমার ভেতরেও এক সময় প্রভাব পড়তে থাকলো। ওর কৌশলের কাছে আমি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম। বিনা তর্কেই সে ইসলামকে আমার সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করছিল । একদিকে তার হেকমতের দাওয়াত অপর দিক ভালবাসা। এক সময় তোর ভাবির দোয়া , কান্নাকাটি ও ফিকির আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায় ।
আমি ওর প্রেম ও ভালবাসার কাছে পরাজিত হতে থাকলাম। কেবল ওর মন রক্ষার্তে প্রথম তিন দিন। সেখান থেকেই আমার চোখের পর্দাটা সরে গেল। রঙ্গিন ধোকার চশমাটা চোখ থেকে খসে পড়লো। তোর ভাবি এরপর মেহনত আরো বাড়িয়ে দিল । এসব ছিল ওর তালিমে শেখে আসা কৌশল। আমি পুরোপুরি দ্বীনের এই পরশে বদলে যেতে থাকলাম । এ বছরই চিল্লাতে বের হলাম। পরের বছর একত্রে তিন চিল্লা। নিজামুদ্দীন মারকাজে দুমাস দিয়ে আসি। মাস্তুরাতে ১৫দিনের জন্য এলাম । আজ দুবছর ধরে এপথেই আছি। জীবনের সব ভুলের মাশুল দিতে চাই এই পথে জান মাল ব্যয় করে। এটাই এখন আমার একমাত্র প্রধান কাজ। ছোট ভাইকে ব্যবসা বূঝিয়ে দিয়েছি । সেও চিল্লা দিয়েছে । মাঝে মধ্যে আমিও বসি।
ঈমানদীপ্ত এই যামানার দুই মহীয়সী নারীর সফল দাওয়াতী মেহনতের কারগুজারী শুনে চোখের পানি ফেললাম । শুকরিয়া স্বরূপ দুরাকাত নামাজ পড়লাম । যোহরের পর সে কথা রাখলো মিম্বরে বসে । যা বললো নিজর কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না । জাবেদের ভেতর থেকে ঈমানের বারুদ যেন ঝড়ে পড়ছিল শ্রুতাদের মাঝে । অনেক শ্রোতা কেঁদে দিলেন ওর ঈমানদীপ্ত বয়ানে।
মাত্র দুবছরের ঈমানী মেহনত!
একজন মানুষকে কী করতে পারে ?
কোথায় পৌছে দিতে পারে ?
রূপকথার গল্পকে হার মানানো এই দিন বদলের গল্প আমাদের কী শিক্ষা দেয়? ভালবাসা না জাবেদদের ঘৃনা ভরে দূরে ঠেলে দিব আমরা নাস্তিক,নাস্তিক বলে। কেউ কেউ ধর্মের নামে বিকৃত চিন্তায় চাপাতি চালাবে জাবেদদের গর্দানে।
আল্লাহর অসংখ্য বান্দারা ঠিকই কাজের কাজটি প্রতি মুহুর্তে আঞ্জাম দিয়ে যাবেন এসমাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জাবেদদের আমূল বদলে দিতে। প্রতিটি মসজিদে হর রোজ চলবে দায়ীদের ফিকির, দাওয়াত তালীম ইস্তেকবালের আমল।
মহল্লায় মহল্লায় চলবে গাশত তালীম ও প্রতিদিন আড়াই ঘন্টা থেকে আট ঘন্টার ফিকির। ঘরে ঘরে চলবে মাস্তুরাতের বদলে দেয়া তালীম ও নিরব ফিকির। কোন সে শক্তি আছে বিশ্বব্যপী উম্মাহর এই নিরব বিপ্লবকে স্তব্দ করে দেয়?
একজন নারী বদলে দিল জাবেদ নওশাদকে।
কৃতজ্ঞ নওশাদ ভাবি আপনার কাছে। আমরা হাজার যুবক যা পারিনি আপনি তা করে দেখালেন, কিভাবে সমাজকে বদলে দিতে হবে। আল্লাহ আপনার মেহনতের উত্তম প্রতিদান দিবেন। দুনিয়ার কোটি কোটি জাবেদ নওশাদদের জন্য এই ধরনীতে আপনার মতো দরদী ফিকিরমন্দ লোকের বড়ই প্রযোজন।
জাবেদ নওশাদরাতো আমাদের অবুঝ ভাই । একটু ঈমানী পরশ পেলেই এরা দলে দলে বদলে যাবে।
কবুল করো আমাদের, হে দয়াময়। সকল ওয়াসওয়াসা ও ফেতনা থেকে হেফাজত করো এই মেহনতকে। আমীন।
এটা পড়তে পারেন —এ যুগের ইব্রাহিম আদহাম
=======================
সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ.