ইসলাম ও নারীবাদ বা ফেমিনিজম

612
ইসলাম-নারীবাদ
Feminism বা নারীবাদ এর সংজ্ঞায়নে স্বয়ং ফেমিনিস্টরা নিজেরাই এত মত পথ বের করেছে যে তাদেরকে সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করলে একেকজন একেকরকম উত্তর দেয়। বিশেষ করে ফেমিনিজমের পুরনো সংজ্ঞা যা মূলত ‘নারীদের সমঅধিকার’ কেন্দ্রিক – সেটাকে যুক্তিতর্ক দিয়ে এতই নাজেহাল করা হয়েছে যে স্বয়ং ফেমিনিস্টরাই ফেমিনিজমের সংজ্ঞা নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে বাধ্য হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে এসেছে Neo-Feminism যা মূলত ফেমিনিস্টদের Gender Wage Gap আর Choice নিয়ে আবর্তন করে। আর যদিও বাঙ্গাল ফেমিনিস্টদের বেশিরভাগই এখনও এতদূর যায় নি, তবুও শেষে Neo-Femisnism সম্পর্কেও প্রয়োজনীয় আলোচনা থাকবে ইন-শা-আল্লাহ। কারণ ইন্টারনেট-স্মার্টফোনের যুগে ইতোমধ্যেই Neo-Femisnism এর বাতাসে কেউ কেউ অসুস্থ হয়েছে আর কিছুদিনের মধ্যেই যে তা পুরোদমে মহামারীতে রূপ নেবে তাও মোটামোটি নিশ্চিত।

‘সম’ সংশয়

প্রথমে আভিধানিক সংজ্ঞাতেই চোখ বুলানো যাক। Oxford ডিকশনারীর সংজ্ঞা অনুযায়ী Feminism হল, “The advocacy of women’s rights on the ground of the equality of the sexes.” আর Cambridge এর সংজ্ঞা হল “the belief that women should be allowed the same rights, power, and opportunities as men and be treated in the same way, or the set of activities intended to achieve this state:”
অর্থাৎ, ফেমিনিজম গড়েই উঠেছে নারীদের ‘সম’ অধিকার প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে। লক্ষ্যণীয়, এখানে আগেই ধরে নেওয়া হয়েছে যে ‘সম’ মানেই হল ‘সঠিক’। আসলে কি তাই? নারী-পুরুষ সব জায়গায় সমান সমানভাবে থাকবে, সব জায়গায় সমান সমান অধিকার ভোগ করবে সেটাই কি ন্যায়? আদতে বাস-ট্রাক চালানো, গলা ফাটিয়ে হেল্পারি করাসহ ভারী ভারী যত কাজ রয়েছে – সেসব বিষয় সামনে নিয়ে এলে ফেমিনিস্টদের তোলা ‘সম’ অধিকারের আস্ফালন আর শোনা যায় না। কেবল অফিস-আদালতে এসির বাতাস খেতে খেতে ভাবমারা কর্পোরেট জব করার সময় সমধিকারের যত বুলি আওড়ানো হয়।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, একটা কন্সট্রাকশন সাইটে কাজের জন্য দিন-মজুর নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে লাইনে কিছু পুরুষ আর মহিলা দাঁড়ালো। লোক নিয়োগ শেষে দেখা গেল, পুরুষ বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আর মহিলা কম। মহিলাদের যেসব কাজ দেওয়া হয়েছে তাও অপেক্ষাকৃত কম কষ্টের, মজুরিও নির্ধারণ করা হয়েছে সে অনুযায়ী। এখন ফেমিনিস্টদের অবস্থা হল এমন – তারা দাবি করছে তারাও পুরুষদের সমান সংখ্যায় কাজ করবে, আর একই সময় পরিমাণ কাজ করার পরিবর্তে তাদেরকে একই পরিমাণ মজুরি দিতে হবে। এই হল তাদের সংজ্ঞার ‘সমঅধিকারের’ প্রায়োগিক রূপ। অথচ তারা নিজেরাও জানে একাজে তারা চাইলেও পুরুষদের সমান আউটপুট দিতে পারবে না।
বাস্তবতা হল এই যে, কিছু কাজ রয়েছে যা পুরুষদের জন্য, আবার কিছু কাজ রয়েছে যা মহিলাদের জন্য। স্বয়ং আল্লাহর নির্ধারণ করে দেওয়া এই বাস্তবতাকে যারা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না, নিজেদের এই ফিতরাতবোধ যারা নষ্ট করে ফেলেছে তারাই সম অধিকারের অসাড় আস্ফালন করে থাকে। তাই নারীবাদীরা যতদ্রুত সত্য মেনে নিতে পারবে, ততই তাদের মঙ্গল। আর ‘সম’ মানেই সত্য নয়, সঠিক নয়। বরং যে যেখানে উপযুক্ত সেখানেই সে সঠিক, সত্য।

The Gender Wage Gap Myth

ফেমিনিস্টদের ব্যবহৃত এক কল্পনাপ্রসূত অসাড় যুক্তি হল Gender Wage Gap বা চাকরি বাকরিতে ‘বেতন বৈষম্য’ যা Neo-feminism এর মূল ভিত্তি। অর্থাৎ, ভারী সব কাজ বাদ দিয়ে ফেমিনিস্টরা যেসব জায়গায় নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে চায় সেখানে তারা নাকি তারা অধিকার(!) আর বেতন বৈষম্যের শিকার হয়। খতিয়ে দেখা যাক। (ইসলামের দৃষ্টিকোণ কিছুক্ষণ পরে আলোচিত হবে, প্রথমে সেক্যুলার দৃষ্টিকোণ থেকেই আলোচিত হল)
আমেরিকায় করা বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী তথাকথিত বেতন-বৈষম্যের পরিমাণ ২৩ পার্সেন্ট। অর্থাৎ, প্রতি একজন কর্মজীবী সাধারণ পুরুষ ১০০ ডলার আয় করলে প্রতি একজন কর্মজীবী সাধারণ নারী আয় করে ৭৭ ডলার। নিও-ফেমিনিস্টদেরকে প্রায় সবসময়ই এইধরনের মুখস্ত তথ্য ব্যবহার করতে দেখা যায়। অথচ একইসাথে এসব জরিপ আর রিসার্চে উল্লেখিত Wage Gap এর যেসমস্ত কারণগুলো উল্লেখ করা হয় সেগুলো আর বলতে শোনা যায় না। বাস্তবতা হল, পুরুষ আর নারীদের Wage Gap এর পিছনে কিছু ফ্যাক্টর কাজ করে যার প্রথমেই রয়েছে নারীদের Choice. এমনকি American Association of University Women, যা কিনা একটা ফেমিনিস্ট সংস্থা, এর দেওয়া রিপোর্টেও বলা হয়েছে বিদ্যমান এই Wage Gap বা বেতন বৈষম্যের প্রধান কারণগুলো হল পেশা, পদবি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, কাজের ঘণ্টা ইত্যাদির ক্ষেত্রে পুরুষ আর নারীর ভিন্ন ভিন্ন পছন্দ। [১] সেখানে বলা হয়েছে, নারীরা নিজেরাই পড়ালেখা করার সময় এমনসব বিষয়াদি বেছে নেয় যার বাজারমূল্য কম আর তাছাড়া কর্মক্ষেত্রেও তাদের পদবি, দায়িত্ব, সংসারের জন্য ওভারটাইম না করা ইত্যাদি কারণে এমন বেতন-ফারাক সৃষ্টি হয়েছে যা অতি স্বাভাবিক।
আর এই বিভিন্ন ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনা করলে Wage Gap এসে দাঁড়ায় মাত্র ৬.৬% এ. আর এরও কারণ শুধুমাত্র নারী-পুরুষের পছন্দ করে নেওয়ার বিভিন্নতা। একজন নারী তাঁর সংসার সামলানোর জন্য যেখানে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে উদ্যত হন, সেখানে একজন পুরুষ সেই সংসারের জন্যই ওভারটাইম কাজ করতেও দ্বিধা করেন না। অর্থাৎ, Individual Career Choice এর বিভিন্নতার কারণেই এই Gap সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এইকথাগুলো কিন্তু ফেমিনিস্টদের একদমই পছন্দ না। ২০০৯ সালে U.S. Department of Labor এর পাবলিশ করা ‘An Analysis of Reasons for the Disparity in Wages Between Men and Women’ রিপোর্টেও একই তথ্য পাওয়া গিয়েছিল যা কিনা ৫০ টিরও বেশি Peer Review Study থেকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। সেখানেও বলা হয়েছে বিদ্যমান Wage Gap এর ক্ষেত্রে পার্সোনাল চয়েস বিবেচনা করলে রীতিমত কোনো গ্যাপই আর বিবেচ্য থাকে না। সেগুলো নিয়ে আন্দোলন আর উচ্চবাচ্য করা তো হাস্যকর ব্যাপার। [২]
বাস্তবে দেখা যায়, দুইজন পুরুষ সমপোস্টে সমান সমান শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কাজ করলেও একজনের আগে আগে পদোন্নতি হয়ে যায়। এটা অতি স্বাভাবিক একটা বিষয়। কর্মক্ষেত্রে পারফরমেন্স অনুযায়ী ইভালুয়েশন হয়। এখন নিজেদের Choice এর কারণে অল্প আউটপুট দিয়েও যদি কিছু অপদার্থ একই পরিমাণ বেতন দাবি করে তা তো বোকামি আর অন্যায় দাবি ছাড়া কিছু নয়। তাছাড়া –
এক. যদি একই পরিমাণ আউটপুট দিয়েও নারীদের বেতন কম হতো তাহলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর ইন্ডাস্ট্রিগুলো একই পোস্টে সব পুরুষ বদলে নারী বসায় না কেন? খরচ বাঁচানো ব্যবসাগুলোর একটা অন্যতম লক্ষ্য আর যেহেতু একইকাজে সব নারী নিয়োগ দিলে প্রতি ১০০ ডলারে ২৩ ডলার বেঁচে যায়, তাহলে কেন তারা সব নারী নিয়োগ দিয়ে খরচ কমিয়ে ফেলছে না? আদতে বাস্তবতা হল, বেশি অর্থ দিয়ে হলেও যোগ্যদেরকেই কাজ দেওয়া হয়। এখন অযোগ্য কেউ এসে যোগ্যদের সমান সমান সবকিছু পেতে চাইলেই তা ন্যায় হয়ে যায় না, বরং চরম অন্যায় হয়।
দুই. একটা প্রতিষ্ঠানের কোন পোস্টে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, কত বেতন দেওয়া হবে সেগুলো অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ব্যাপার। যাদেরকে যোগ্য মনে করা হয়, তাদেরকেই নিয়োগ দেওয়া হয় আর যত বেতনের যোগ্য মনে করা হয় তত বেতনেই নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিযোগিতার এই যুগে অযোগ্যরা যোগ্যদের জায়গা দখল করে বেতন ভোগ করতে থাকলে সব ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান আর অর্থনীতির বিপর্যয় ঘটবে এতো ক্লাস ফাইভের বাচ্চারাও বোঝে।
একে তো ফেমিনিস্টদের ‘সম মানেই সঠিক’ এই রেথোরিকেই রয়েছে গলদ এর উপর সমস্ত রিপোর্টের তথ্যও যায় তাদের বিপরীত। একই রিপোর্টের একাংশ নিজেদের প্রয়োজনানুযায়ী ব্যবহার করে কারণগুলো লুকিয়ে লাফালাফি আর আন্দোলন করা অপরিণত মস্তিষ্কের পরিচয়ই বহন করে।

Choice leads to Consent Dilemma

নারী স্বাধীনতার ফসল Consent আর Rape এর ডিলেমার কথা জানেন? খুব সহজ ভাষায় সংক্ষেপে বলি। সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজম, পশ্চিমা সমাজে যার সূত্রপাত গত শতাব্দীর ষাট এর দশকে, ক্রমান্বয়ে তার মূল প্রতিপাদ্য হয়ে উঠে এমন – নারীরা যেভাবে খুশি সাজবে, যখন খুশি বিছানায় যাবে কেউ তাদের এসব একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাবে না, সহজকথায় Freedom of Choice বা নিজপছন্দের অবাধ স্বাধীনতা। রেইপ বা যৌন হয়রানির ডিলেমাটা এখানেই। একজন নারী কারও সাথে স্বেচ্ছায় বিছানায় গেল, কিন্তু পরবর্তীতে সে রেইপড হয়েছে দাবি করলে পুরুষ বেচারার নিজের পক্ষে তেমন প্রমাণই থাকে না। তাহলে বুঝা যাবে কী করে, নারী কি নিজের মতেই গিয়েছিল নাকি আসলেই ধর্ষিত হয়েছে?

নারী কাজ বাহির

সত্য নাকি ভিক্টিম সাজা?
হার্ভিরা প্রত্যেক সমাজের পরতে পরতে আছে। দু’এক জন সাহস করে নিজেদের হয়রানির কথা বলার পর হ্যাশট্যাগ me_too এর বন্যা বয়ে যায়। প্রশ্ন হল, এতদিন পর কেন হে ভগিনী! ওসব ঘটনায় তোমার যে কন্সেন্ট ছিল না তা এক হ্যাশট্যাগ স্ট্যাটাস বা টুইটেই তো প্রমাণ হয়ে যায় না। আসল কথা হল, ওরা নিজেরাই দেহ বিকিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিল। ক্যারিয়ারের স্বার্থেই ঘটনার পর পর নিজেরা চুপ থাকতো। ‘বাহিরে মেয়েদের নিজেদেরকে প্রমাণ করতেই হবে’ প্রথমে এই বুলিতে ঘোল খেয়ে প্রমাণ করতে গিয়ে এরপর মান-স্মমান সব খুইয়ে আসে। তুমি তো সেদিনই নিজেকে অপদস্থ করেছো যেদিন নেকড়েদের কাছে নিজেকে উজাড় করে প্রমাণ করতে গিয়েছিলে।

শিশুহত্যার লাইসেন্স ও নাস্তিক্যবাদী ইউটোপীয়া

নারী স্বাধীনতা থেকে অবাধ স্বাধীনতা…এরপর?
সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজম ভয়াল রূপ নেয় আরও কয়েক বছর পরে এসে। ‘নিজের শরীর, নিজের অধিকার’ এর প্রতিপাদ্যে চলে আসে ব্যাভিচার করে ইচ্ছেমতো অ্যাবরশন করার অধিকার চাওয়া! অর্থাৎ শিশুহত্যার লাইসেন্স! ইউরোপ আমেরিকায় এসব নিয়ে আন্দোলন লেগেই থাকে। এগুলোই হচ্ছে ফেমিনিস্টদের শেষদিকের কার্যকলাপ।
Freedom of Choice এর কন্সেপ্ট আরও একটু বিস্তৃত হয়ে সমকামিদের সমর্থনও ফেমিনিস্টরা আত্নস্থ করেছে। নিজেদের বাহিরে কাজ করাকে ধ্রুবক রেখে শিশুদের প্রয়োজনে ডে-কেয়ারে পাঠানো, অবাধ স্বাধীনতায় শিশু হত্যার লাইসেন্স জায়াজ করা, LGBT দের সমর্থন এভাবে করেই ফেমিনিস্টরা স্রষ্টার বিধিবিধান অস্বীকার করা নাস্তিক্যবাদী সমাজব্যাবস্থার দিকে এগিয়ে যায়।

ফেমিনিজম নদী অসারতা থেকে উৎপন্ন হয়ে নাস্তিক্যবাদের সাগরে গিয়ে মেশে।

ইসলামের দৃষ্টিতে ফেমিনিজম

পদে পদে অপদস্থ হওয়া ফেমিনিস্টরা দেখল, কিছু ধর্মভীরু নারী রয়েছে বিশেষ করে মুসলিমাহরা, তারা আপন ঘরে থেকে নিজেদের আব্রু রক্ষা করে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে জীবনযাপন করছে। অতএব তাদেরও ঘর থেকে বের করে আনতে হবে। নেকড়েরা মিটিমিটি হাসে। আর নারীবাদীরা নিজেদের পরবর্তী দুরাবস্থার কথা ঢেকে রেখে মুসলিমাদের পুরনো ঘোল দেয়া শুরু করে – ফার্স্ট ওয়েভ ফেমিনিজমের কথাবার্তা যেসব কথায় তারা প্রথমে ধোঁকা খেয়েছিল। আগে বের হয়ে তো আসুক! প্রথমে নিকাব থেকে, এরপর হিজাব থেকে, এরপর ঘর থেকে, এরপর… আর কেউ কেউ নিকাব-হিজাব সহই নিজেদের উজাড় করে দিয়ে প্রমাণ (!) করতে ব্যস্ত হয়। অন্যের কাছে প্রমাণ করতে গিয়ে যে তারা দাসত্বই করে যায়, তা আর টের পায় না।
অনেকে ফেমিনিজম বলতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করা পর্যন্তই বোঝে। আর ইসলাম যেহেতু নারীকে সম্মানিত করেছে, তাই ‘ইসলাম একটা ফেমিনিস্ট ধর্ম’ বলে বলে প্রচার করতে থাকে। আদতে তারা ফেমিনিজমের মূলকথা বোঝে নি অথবা ইসলাম সম্পর্কে এখনও অজ্ঞ। ফেমিনিজমকে ভাল টাইপের কোনো আদর্শ বলে মনে করে। এই ধারণা পুরোপুরি ভুল ও মিথ্যা। আসল কথা হল, ইসলামে নারীর যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এরপরেও যে অন্যকোনো আদর্শে খায়ের বা কল্যাণ খুঁজে সে প্রকাশ্যে বা গোপনে ধরে নেয় যে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন নারীদের যথেষ্ট সম্মান দেয় নি। নাউযুবিল্লাহ।

আনুগত্যঃ

আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন বলেন তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক অবগত আর তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য নারীদের উপর কর্তৃত্ব আর কর্তব্য নির্ধারণ করেছেন আর বান্দীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যথাযথ পর্দা করতে ও প্রয়োজন ব্যতীত ঘরে থাকতে। তাদের ভরণপোষণ থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুর দায়িত্ব পুরুষদের দেওয়া হয়েছে। এখন কেউ আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের দেওয়া নির্দেশ মেনে নিবে, অথবা অস্বীকার করবে। দু’টো একসাথে চলতে পারে না।
ٱلرِّجَالُ قَوَّٲمُونَ عَلَى ٱلنِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ ٱللَّهُ بَعۡضَهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٍ۬ وَبِمَآ أَنفَقُواْ مِنۡ أَمۡوَٲلِهِمۡ‌ۚ فَٱلصَّـٰلِحَـٰتُ قَـٰنِتَـٰتٌ حَـٰفِظَـٰتٌ۬ لِّلۡغَيۡبِ بِمَا حَفِظَ ٱللَّهُ‌ۚ وَٱلَّـٰتِى تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَٱهۡجُرُوهُنَّ فِى ٱلۡمَضَاجِعِ وَٱضۡرِبُوهُنَّ‌ۖ فَإِنۡ أَطَعۡنَڪُمۡ فَلَا تَبۡغُواْ عَلَيۡہِنَّ سَبِيلاً‌ۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلِيًّ۬ا ڪَبِيرً۬ا (٣٤)
পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোক চক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাযত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সবার উপর শ্রেষ্ঠ। [সূরা নিসা, ৩৪]
এই হল আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের আয়াত – তিনি একজনকে আরেকজনের উপর বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছেন, আর একারণেই পুরুষদেরকে করেছেন কর্তৃত্বশীল। স্বামীর আনুগত্যের ব্যাপারে উদাসীনতার কারণেই বেশিরভাগ নারী জাহান্নামীদের অন্তর্ভূক্ত হবে বলে স্বয়ং রাসূলুল্লাহই ﷺ বলে গিয়েছেন।
রাসূল ﷺ বলেন, “আমাকে জাহান্নাম দেখানো হয়েছিল। আমি এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছুই কখনো দেখিনি। আর আমি দেখলাম এখানকার বেশিরভাগই হচ্ছে নারী। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করল, “এমনটা কেন? ইয়া রাসূলুল্লাহ!”
তিনি ﷺ বললেন, “তাদের অকৃতজ্ঞতার কারণে।” প্রশ্ন করা হলো, “তারা কি আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ?”
তিনি ﷺ উত্তর দিলেন, “তারা হচ্ছে তাদের স্বামীর প্রতি অকৃতজ্ঞ। তারা অকৃতজ্ঞ তাদের স্বামীর সদাচারণের প্রতি। তুমি সারাজীবন তাদের প্রতি মমতা দেখিয়ে যাবে, কিন্তু এর পর সে যদি কখনো তোমার মধ্যে (অপ্রত্যাশিত) কিছু দেখতে পায়, তবে বলবে, “আমি তোমার মধ্যে কখনোই ভালো কিছু দেখিনি।”
[সহিহ বুখারি, ১০৫২]
তাহলে কীভাবে একজন নারী একইসাথে আল্লাহর কিতাবে বিশ্বাস স্থাপনের কথা বলতে পারে, আবার শরীয়তসম্মত কারণ ছাড়া পিতা-স্বামীর অবাধ্য হতে পারে? প্রকৃতপক্ষে ‘ইসলামী ফেমিনিস্ট’ একটা Oxymoron ছাড়া কিছুই না, আর প্রকৃত মুসলিমাহরা ইসলাম ব্যাতীত অন্যকোনো আদর্শে খায়ের খোঁজেও না আলহামদুলিল্লাহ।

পথের দাবিঃ

وَلَا يَضۡرِبۡنَ بِأَرۡجُلِهِنَّ لِيُعۡلَمَ مَا يُخۡفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ‌ۚ وَتُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ (٣١)
তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। [সূরা আন নূর, ৩১]
সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতের বিস্তারিত আলোচনা নারীদের বিনা প্রয়োজনে বাহিরে না যাবার দিকটা স্পষ্ট করে। অথচ আজ আমাদের সমাজে হিজাব করা বোনেরাও সুঠাম ক্যারিয়ার গড়তে চায়। আসলে তাদের যে দ্বীন অন্তরে প্রবেশ করে নাই তাই সুস্পষ্ট হয়ে যায়।

নারীর অধিকার নিয়ে এ লেখাটি পড়তে পারেন ইসলামে নারীর সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার


একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবাদের বললেন, “তোমরা পথে বসা হতে বিরত থাক।”
সাহাবিগণ আরজ করলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের প্রয়োজনীয় কথার জন্য পথে বসার যে বিকল্প নেই।” রদিআল্লাহু আনহুম।
রাসূলুল্লাহ ﷺ তখন বললেন, “যদি তোমাদের একান্তই বসতে হয়, তাহলে রাস্তার হক আদায় কর।”
তখন সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া আল্লাহর রাসূল! রাস্তার হক কী?” তিনি ﷺ উত্তর দিলেন, “দৃষ্টি অবনত করা, কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা, সালামের উত্তর প্রদান করা, সৎকাজের আদেশ দেওয়া আর মন্দ কাজে বাধা দেওয়া।”
[সহিহ বুখারি, ৬২২৯]
সুবহান-আল্লাহ! অপ্রয়োজনে বা অসার প্রয়োজনে সেই সাহাবাদের যুগেও পথে বসতে সাবধান করা হল… তাও পুরুষদের। আর নারীদের কণ্ঠও যেখানে সতরের অন্তর্ভূক্ত সেখানে তাদের অপ্রয়োজনে ক্যারিয়ারিস্ট হওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। আর ক্যারিয়ারিস্ট হওয়া তো ‘দুনিয়াবি’ হওয়ার আরেক ভার্সন, যা পুরুষদের জন্যও অকল্যাণকর। রাসূলের ﷺ, সাহাবাদের (রদিয়াল্লাহু আনহুম), সালাফদের যুহদ নিয়ে তো কিতাবাদির অভাব নেই।
নারী-কাজ-বাহির
কোনো উপায় না বুঝে বাধ্য হয়ে থাকলে পর্দা করে নারীদের বাহিরে কাজ করার অনুমতি থাকলেও আমাদের উচিত এইসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আল্লাহ রব্বুল আলামীনকে যথার্থরূপে ভয় করা। এইধরনের সিদ্ধান্তগুলো দীর্ঘমেয়াদি হয়ে যায় আর সচরাচর পরবর্তীতে গুনাহের দরজা খুলে দেয়।
মনে রাখা প্রয়োজন, যা কিছু যাদের জন্য ফরজ করা হয় নি তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ফিতনাহে পতিত হওয়া বা ফিতনাহ ছড়ানো আল্লাহর ক্রোধকে আমন্ত্রণ জানানো বৈ কিছু নয়।
.

স্বয়ং আল্লাহর ভারসাম্যকরণ

 [১] পুরুষের দায়িত্বের মূল্য
কোনোকিছুই মূল্য ছাড়া আসে না। আর পুরুষদেরকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটাও চরম মূল্য ছাড়া আসে নাই। আর সেই মূল্য হল, আখিরাতে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা। দায়িত্বের মধ্যে থাকা নারীদের প্রতি সুবিচার না করলে, সঠিক দ্বীনের শিক্ষা না দিলে, বেহায়াপনা করতে দিলে যে আখিরাতে দাইয়্যুস হয়ে বা গুনাহগার হয়ে চরম মূল্য দিতে হবে পুরুষকে সেসব কথা কিন্তু ফেমিনিস্টরা এড়িয়ে যায়। তারা শুধু দুনিয়াতে তাদের উপর কর্তৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারগুলোই বলে যায়। অথচ আখিরাতের হিসাব ছাড়া সবকিছুই অপূর্ণ। এছাড়া স্বয়ং আল্লাহর দেওয়া বিধান নিয়ে প্রশ্ন করা তো শয়তানের চরম ধোঁকা।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “পূর্ণ মুমিন সেই যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর। আর তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।”
[সুনানে তিরমিযী ১১৬২; মিশকাত ৩২৬৪]
রাসূলুল্লাহ ﷺ আরও বলেন, “তোমরা নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই, তোমরা তাদেরকে আল্লাহর থেকে ওয়াদাস্বরূপ নিয়েছ, আর তাদের সাথে সহবাস হালাল হয়েছে আল্লাহর কালাম দ্বারাই।”
[সহিহ মুসলিম, সুনানে বায়হাকি ৮৮৪৯]
এভাবেই করেই দ্বীন ইসলাম নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে এবং পুরুষদেরকে নিজেদের অধীনস্থ নারীদের সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়েছে। আরও অনেক আয়াত ও হাদিস উল্লেখ করা যাবে যেগুলো নারীদের ব্যাপারে পুরুষদের আল্লাহকে ভয় করার সবক দেয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজে ছিলেন তাঁর স্ত্রীদের নিকট সর্বোত্তম। পুরুষেরা এভাবেই আল্লাহর নিকট দায়বদ্ধ থাকে, আর আল্লাহভীরু পুরুষেরা তো নারীদের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করতে পারে না। কিন্তু আজ তো নারী অধিকার হয়ে গিয়েছে ইচ্ছেমতো বেহায়াপনা করার অধিকার যেসবে গাফিলতি করলে পুরুষদেরও দাইয়্যুস হয়ে জাহান্নামে যেতে হবে। আল্লাহ আমাদের ভুলত্রুটি সংশোধনের ও নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে আদায়ের তাওফিক দিন।

[২] নারীর মর্যাদা ও দ্বীন সহজীকরণ

স্বামীর আনুগত্য, মাহরাম ছাড়া ভ্রমণের নিষেধ নফল রোযা রাখতে স্বামীর অনুমতির হাদিস – কারণ আল্লাহ পুরুষদের কামনা-বাসনা বেশি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন ইত্যাদি যারা অস্বীকার করতে চায় তারা আসলে আল্লাহর দেওয়া ফিতরাতকেই অস্বীকারের মাধ্যমে দ্বীন থেকেই নিজের অজান্তে বেরিয়ে পড়ে। অথচ একজন নেক নারী মা হলে সেই মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত, তাদের জন্য যে মাত্র কয়েকটি বিষয় ঠিক করলেই নিশ্চিত জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে, হাজ্জ করে আব্রু রক্ষা করে চলতে পারলে তা জিহাদের সমতুল্য করা হয়েছে সেসব কথা কিন্তু অব্যক্তই থেকে যায়। মোটকথা আখিরাতের পুরস্কারগুলোর কথা বাদ দিয়ে যখন কেবল দুনিয়ার সুযোগসুবিধা নিয়ে আলোচনা করা হয়, তখনই শয়তানের ওয়াসওয়াসার জন্য তাদের অন্তর উন্মুক্ত হয়ে যায়। আর ফলাফলস্বরূপ তারা ফেমিনিজমে ধাবিত হয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত সলাত আদায় করে, আপন লজ্জাস্থান হিফাজত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, তাকে বলা হবে – যে দরজা দিয়ে ইচ্ছে তুমি জান্নাতে প্রবেশ কর।”
[ইবনে হিব্বান ৪১৬৩, সহিহ আল জামি’ ৬৬০]
عن عائشة أم المؤمنين رضي الله عنها استأذنت النبي صلى الله عليه وسلم في الجهاد، فقال : جهادكن الحج.
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রদিআল্লাহু আনহা) বলেন, আমি (অন্য রেওয়ায়াতে আছে, আমরা) রাসূলুল্লাহর ﷺ কাছে জিহাদের অনুমতি চাইলাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, “তোমাদের জিহাদ হল হাজ্ব।”
[সহীহ বুখারী, ২৮৭৫]
আল্লাহু আকবার! এভাবেই আল্লাহ রব্বুল আলামীন মুসলিমাহদের জন্য জান্নাতে যাওয়া সহজ করে দিলেন। কিন্তু কিছু অভাগা কেবল পার্থিব বিষয়াদি গণনা করতে গিয়ে দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই হারিয়ে বসে। কতই না বোকামিপূর্ণ তাদের চিন্তাগুলো!

পরিশেষ

আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে ইসলাম দিয়ে সম্মানিত করেছেন, আর ইসলাম ছাড়া অন্য যেকোনো আদর্শে যেই কল্যাণ খুঁজতে যাবে সে অপদস্থ হবেই। দুঃখজনক হল, স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর বান্দীদের সম্মানিত করলেও এই উম্মতের কিছু অভাগা ফেমিনিজমে খায়ের খুঁজে অপদস্থ হওয়ার পথই বেছে নিয়েছে। আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন ভাল কাজে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যেতে বলেছিলেন, আর সেখানে ইসলামের বেশ ধরেও অন্তরে ইসলামবিদ্বেষ পোষণ করে বা অন্তত কিছু আয়াত ও হাদিসের বিরোধিতা করে কিছু মানুষ নাস্তিক্যবাদী ফেমিনিজম আলিঙ্গন করেছে। আর নিজেদের জন্য খরিদ করেছে লাঞ্ছনা ও আগুন।
আজ তাই শতকোটি পুরুষদেরকেও লজ্জা দেওয়া নুসাইরা বিনতি কা’বদের (রদিআল্লাহু আ’নহা) দেখা যায় না। আজ দেখা যায় না, সালাহউদদীন আল-আইয়ূবিদের জন্ম দেওয়া মায়েদের। আল্লাহ আমাদের সহীহ বুঝ দান করুন এবং ইসলামভিন্ন অন্যসব আদর্শের ধোঁকা থেকে ভাই ও বোনদের হিফাজত করুন।
.
টিকাঃ
Facebook Comments