বিটকয়েন: ‘বিটকয়েন’ বর্তমানে আলোচিত একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি (Cryptocurrency)। ‘ক্রিপ্টো’ মানে অদৃশ্য, গোপন, সিক্রেট। কারেন্সি মানে মুদ্রা। সহজে বললে এমন একটি মুদ্রা, যা  অদৃশ্য, সংকেত বা নাম্বারের মাধ্যমে প্রকাশ পায়, এর না আছে নিজস্ব বস্তুগত কোন আকার, না তা স্পর্শযোগ্য। তেমনিভাবে এর না আছে নিজস্ব কোন মূল্যমান বা ফায়দা (Intrinsic Value)।

আর ‘বিটকয়েন’-এ bit শব্দের অনেক অর্থ। যেমন, টুকরো, ছোট অংশ, অল্প, কিছুক্ষণ। এর আরেক অর্থ, কম্পিউটারে ব্যবহৃত সংক্ষিপ্ততম তথ্য। এখানে শেষোক্ত অর্থই উদ্দেশ্য। যেহেতু এটি কম্পিউটারের ক্ষুদ্র তথ্যকে ব্যবহার করে তৈরি হয়, তাই একে ‘বিটকয়েন’ বলা হয়।

ইন্টারনেটে ক্রিপ্টোকারেন্সি অনেক আছে। যেমন, Ripple, Ethereum ইত্যাদি। এসবের মধ্যে বর্তমানে ‘বিটকয়েন’ সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে আলোচিত ক্রিপ্টোকারেন্সি। এসব ক্রিপ্টোকারেন্সির কিছু কমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এবং কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা কারেন্সির প্রস্তুতকারীগণ নির্ণয় করে থাকেন। আমাদের বক্ষ্যমাণ আলোচনা কেবল বিটকয়েন নিয়ে, যার সাথে অন্যগুলোর কিছু পার্থক্য আছে, এবং যা শরঈ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা জরুরী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিটকয়েন মূলত একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি, যা ভার্চুয়াল মুদ্রা। এর শারীরিক(Physical) বৈশিষ্ট্য নেই। স্পর্শযোগ্য নয়। নিজস্ব কোন মূল্যও (Intrinsic Value) নেই।

এটি বিশেষ হার্ডওয়্যার দ্বারা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সংকেত আকারে তৈরি হয়। অন্য কথায়, এটি একটি ভার্চুয়াল টোকেন, যাকে এর প্রস্তুতকারীগণ বিনিময়ের মাধ্যম বা মুদ্রা হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তৈরি করেছেন। অন্য যে কোনো পন্যের ন্যায় বিটকয়েনেরও চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে অন্যান্য ফেইথ (Faite) মুদ্রার সাথে এর মূল্যমান কম-বেশি হয়ে থাকে।

২০০৮ইং সনের নভেম্বরে এক অজ্ঞাত সংস্থা বা ব্যক্তি কর্তৃক একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়।

যার ছদ্ম নাম ‘সাতোশী নাকামোতো (Satoshi Nakamoto)’। এই আর্টিকেলের ভিত্তিতে ২০০৯ইং সনের জানুয়ারীতে প্রথম বিটকয়েনের ঘোষণা দেয়া হয়। ধারণা করা হয় এই ছদ্মনাম বিশিষ্ট ব্যক্তি সর্বোচ্চ ২১ মিলিয়ন বিটকয়েনের মধ্যে মাত্র ৫% উৎপন্ন করেছে। এটি করা হয়েছে মাইনিং পদ্ধতি ব্যবহার করে।

cryptocurrency-ripple-bitcoin

যেভাবে বিটকয়েন তৈরি হয়

কাগুজে মুদ্রা তৈরি হয় টাকা ছাপানোর মেশিনে। সরকার একে অনুমোদন করে। নিয়ন্ত্রন করে। এভাবে এতে সৃষ্টি হয় ক্রয়-ক্ষমতা (Purchasing power)। কিন্তু বিটকয়েন তৈরি হয় সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। এটি তৈরির প্রধান উৎস-‘ব্লক চেইন (Block chain) নামক এক উন্নত প্রযুক্তি। প্রযুক্তিটি আবিষ্কার হয়েছে ১৯৯১ইং সনে।

ব্লকচেইন (Block chain) একটি প্রযুক্তিগত ফ্রেমওয়ার্ক, যার ওপর বিটকয়েন তৈরি করা হয়েছে। ব্লক চেইন একটি চমৎকার প্রযুক্তি। সংক্ষেপে তার বিবরণ দেয়া হল।

ব্লক চেইন প্রযুক্তিঃ সাধারণত আমরা আরেক জনের কাছে টাকা পাঠাই তৃতীয় কোন মাধ্যমে। যেমন, ব্যাংক, পোস্ট অফিস ইত্যাদি। তদ্রুপ জমির মালিকানা হস্তান্তর করি ভূমি অধিদপ্তরের মধ্যস্থতায়। এসব তৃতীয় পক্ষ লেনদেনে মধ্যস্থতা করার পাশাপাশি অর্থ-সম্পদের নিরাপত্তাও প্রদান করে।

আমাদের লেনদেনের যাবতীয় তথ্য তাদের নিকট সংরক্ষিত থাকে। এই মাধ্যমগুলো ব্যবহারের অনেক সুবিধার মাঝে তিনটি অসুবিধাও আছে। যথা-এক. অতিরিক্ত ফি দিতে হয়। দুই. লেনদেন সম্পন্ন হতে অতিরিক্ত সময় ক্ষেপণ হয়। তিন.তৃতীয় পক্ষের নিকট সকল ডাটা চলে যায়। মূলত এই অসুবিধাগুলো দূর করতে আবিস্কৃত হয়েছে ইন্টারনেট ভিত্তিক এক বিশেষ ব্লক চেইন প্রযুক্তি। এর দুটি অংশ। যথা-

ক.Open Ledger বা উন্মুক্ত খাতা।

ইন্টারনেটে ব্লক চেইন প্রযু্িক্ত ব্যবহার করে যখন কেউ কারো নিকট অর্থ বা অন্য কোন তথ্য পাঠায়, তখন ব্লক চেইন নেটওয়ার্কে যারা লেজার মেইন্টেইন করে তাদের লেজারে সেই ডাটাগুলো ব্লক হয়ে  যুক্ত হয়। যেমন-A-b-C-d-e-F। ধরা যাক A ১০০ টাকা পাঠিয়েছে b এর নিকট। তদ্রুপ b কিছু পাঠিয়েছে C এর নিকট। এভাবে প্রত্যেকে তার পরের জনের নিকট কিছু অর্থ পাঠিয়েছে। এই পাঠানো তথ্যগুলো জমা হবে তাদের নিকট যারা লেজার মেইন্টেইন করে।

এখানে বড় হাতের ইংরেজী অক্ষর হল সেই লেজার মেইন্টেইনকারী। পরিভাষায় তাদেরকে Minersও বলা হয়। মনে রাখতে হবে, এখানে যে লেনদেনগুলো হল, এগুলো করার সাথে সাথে পূর্ণতায় পৌঁছে না। তথা সাথে সাথে বাস্তবেই অর্থ স্থানান্তর হয় না। বরং লেনদেনটি করা মাত্রই একটি ব্লক তৈরি হয়। উক্ত ব্লকে প্রতি দশ মিনিটের মধ্যে যেসব ট্রাঞ্জাকশন হয়, তা রেকর্ড হয়ে যায়।

খ. Distributed Ledger।

উক্ত ব্লক তৈরি হওয়ার পর সেটা ব্লক চেইন নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে যায়, এবং পৃথিবীজুড়ে হাজারো কপি তৈরি হয়। তখন সেটা উপরোক্ত প্রত্যেক মাইনারের লেজারে ব্লক হিসেবে এসে যায়। কিন্তু এতেই উক্ত ট্রাঞ্জাকশন Validate হয়নি। অর্থাৎ বাস্তবেই অর্থ স্থানান্তর হয়নি। এখন তাকে Validate করার জন্য সকল মাইনার একযোগে ঐ ব্লক নিয়ে কাজ শুরু করে। তাকে সল্ভ করতে চেষ্টা করে। তাদের কেউ যখন সেটা সল্ভ করে ফেলে তখন ট্রাঞ্জাকশনটি Validate হয়। অর্থাৎ তখন বাস্তবেই যার কাছে টাকা পাঠানো হল সে সেটা পেয়ে যায়। এই সমাধিত ব্লকটি একটি ফাইনাল ব্লক।

এবার এই ব্লকটি প্রত্যেকে মাইনারের নিকট রেকর্ডকৃত পূর্বের সমাধিত ব্লকের সাথে জুড়ে যায়। অনেকটা চেইনের মত। একটির পেছনে আরেকটি জুড়ে। এজন্য একে ব্লক চেইন বলা হয়।

উল্লেখ্য, প্রতিটি সমাধিত ব্লকে তিনটি বিষয় থাকে। যথা-ডাটা, হ্যাশ ও পূর্বের ব্লকের হ্যাশ। হ্যাশ হল, বিশেষ অ্যালগরিদম বা বিশেষ ম্যাথ জাতীয় বিষয়। সেই ম্যাথ সলূশন করা হলে তাকে হ্যাশ বলে। এই হ্যাশটা পূর্বের সমাধিত ব্লকের সাথে মিলতে হবে। তবেই ফাইনাললি ব্লকটি সমাধিত হবে। সর্বপ্রথম যে মাইনর সমাধান করতে পারবে সে বিটকয়েন লাভ করবে।

এসব কাজের মধ্য দিয়েই তার জন্য অটো  বিটকয়েন ক্রিয়েট হয়ে যাবে। বর্তমানে প্রায় প্রতি দশ মিনিটে একটি ব্লক সল্ভ হয়ে যায়। এসব মাইনিং-এর জন্য বেশ পাওয়ারফুল কম্পিউটার ও বিশেষ মেশিনের প্রয়োজন হয়। অনেক বিদ্যুৎ খরচ হয়। মোটা অংকের টাকা এসব খাতে ইনভেষ্ট করতে হয়।

blockchain bitcoin

বিটকয়েন ও একটি উদাহরণ

আমাদের দেশে বিভিন্ন শপিং মলে এরূপ প্রচলন আছে যে, কোন পণ্য ক্রয় করা হলে একটি পয়েন্ট দেয়া হয়। এটি একটি সংখ্যা। ভার্চুয়াল টোকেন। এই পয়েন্ট যখন একটি নির্ধারিত পরিমাণে পৌঁছে, তখন তা দিয়ে ঐ দোকান থেকে কোন কিছু ক্রয় করা যায়। এর অর্থ এই ভার্চুয়াল পয়েন্টকে একটি বিনিময়ের মাধ্যমের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বিটকয়েন  কনসেপ্ট অনেকটাই এরূপ। একটি সংখ্যা। যা মাইনিং করার পর মাইনর পেয়ে থাকে। মাইনিং-এ উদ্বুদ্ধ করার জন্য এই  ভার্চুয়াল টোকেনকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে একটি বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। যার মূল্য ডিমান্ড অনুযায়ী বাড়ে-কমে।

ব্লক চেইনের বিস্তৃতিঃ ব্লক চেইট প্রযুক্তি মূলত সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তৈরি হয়েছে। যেমনটি আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। তাই এ প্রযুক্তি শুধু বিটকয়েন উৎপন্নে ব্যবহৃত হচ্ছে বিষয়টা এমন নয়। জমির দলিল সংরক্ষণের জন্যও এর ব্যবহার চিন্তা করা হচ্ছে। এমনটিক এর মাধ্যমে যাকাত সংগ্রহ ও আদায়ের চিন্তাও চলমান।

নিরাপত্তাঃ উক্ত প্রযুক্তিতে সকল ডাটা অগণিত মাইনিংকারীদের লেজারে সংরক্ষিত থাকে। ফলে সেটা হ্যাক করতে হলে একই সময় অগণিত কম্পিউটার হ্যাক করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব। এজন্য বলা হয়, এটি সেন্ট্রালাইজড মাধ্যম থেকেও নিরাপদ।

তবে হ্যাক হওয়াটা অবাস্তব নয়। ইতোমধ্যে কয়েকবার বিভিন্ন বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ বা ওয়ালেট হ্যাক হয়েছে, ফলে হাজারো বিটকয়েন মজুদকারী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। অপরদিকে পুরো পৃথিবীর মাইনারদের নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকটি বড় মাইনিং প্রতিষ্ঠান, যারা ৫০% এর বেশি

মাইনিং করে থাকে। অনেকে তাদেরকে বিটকয়েনের সেন্ট্রাল ব্যাংক বলে অভিহিত করে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তারা একত্রিত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে তা অসম্ভব নয়।

বলাবাহুল্য, বিটকয়েন একটি ভার্চুয়াল মুদ্রা, যা সংরক্ষিত থাকে ভার্চুয়াল ওয়ালেটে। কাজেই ওয়ালেটের নিরাপত্তা সংরক্ষণের উপরও ব্যক্তির সংগৃহীত বিটকয়েনের নিরাপত্তা নির্ভর করে।

বিটকয়েন মাইনিংঃ Mining শব্দের মূল অর্থ: মাটি খুঁড়ে মূল্যবান সম্পদ বের করা বা আবিষ্কার করা। এখানে বিশেষ এ্যলগরিদম সল্ভ করার মাধ্যমে মূল্যবান বিটকয়েন লাভ হয়। তাই একে মাটি খুঁড়ে মূল্যবান সম্পদ বের করার সাথে তুলনা করে ‘মাইনিং’ বলা হয়েছে। যারা এই কাজটি করেন, তাদেরকে বলা হয়-‘মাইনর’(Miner)।

বিটকয়েন মাইনিং এর প্রধান উদ্দেশ্য হল, দু’জন লেনদেনকারীর মালিকানা যথাযথভাবে ট্রান্সফার করাকে নিশ্চিত করা। এই নিশ্চিতকরণটা পূর্বোক্ত পন্থায় যে আগে করতে পারবে সেই  কিছু বিটকয়েন লাভ করবে।

এভাবে ২১ মিলিয়ন বিটকয়েন একক তৈরি করা যাবে। এভাবেই উক্ত প্রযুক্তির প্রোগ্রাম সেট করা আছে। এরপর আর নতুন করে বিটকয়েনের কোন একক তৈরি করা সম্ভব হবে না। (অর্থাৎ তখন আক্ষরিক অর্থেই মাইনিং বন্ধ হয়ে যাবে)। তবে উক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্থ লেনদেনের সত্যায়নের কাজ মাইনিংকারীরা করে যাবে আগের মতই। তখন বিটকয়েনের বহু ক্ষুদ্র একককে কাজে লাগানো হবে। বিশেষজ্ঞরা তাই বলছেন।

বিটকয়েন সংগ্রহঃ বিটকয়েন মূলত দুটি পন্থায় সংগ্রহ করা হয়। যথা-এক. মাইনিং করে। এর বিবরণ পূর্বে দেয়া হয়েছে। দুই.ক্রয় করে। যার কাছে বিটকয়েন আছে সেটা কাগুজে মুদ্রায় ক্রয় করা। বিটকয়েন সংগ্রহের জন্য দ্বিতীয়টিই এখন পর্যন্ত বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম। একেই বলা হয় ‘বিটকয়েন

ইনভেষ্ট’। বলা বাহুল্য, বিটকয়েন সংগ্রহের দুটি মাধ্যমই বেশ প্রতারণাপূর্ণ। বহু মানুষের টাকা খোয়া গেছে।

বিটকয়েন সংরক্ষণঃ ইলেক্সট্রনিক বিশেষ পন্থা তথা E-Wallet এর মাধ্যমে বিটকয়েন সংরক্ষণ করা হয়। এর মাধ্যমে বিটকয়েন বেচা-কেনাও করা হয়।  কয়েকটি প্রসিদ্ধ ই-ওয়ালেট হল-Computer Wallets: এর মাধ্যমে বিটকয়েন প্রেরণ করা, গ্রহণ করা সবই সম্ভব। Phone Wallets: এটি অনেকাংশেই প্রথমটির মত। এর মাধ্যমে ঘঋঈ (NFC (Near field communication) টেকনোলজি ব্যবহার করে ক্রয়কৃত বিভিন্ন পণ্যের দামও শোধ করা যায়। Web wallets: বিটকয়েন ব্যবহারকারী এর মাধ্যমে নির্ধারিত সাইটে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করতে হয়।
এটি অনেকটা ই-মেইল খোলার মত। এরপর নির্ধারিত একাউণ্ট খোলে তাতে বিটকয়েন সংরক্ষণ করা হয়। Hardware wallets: এটি ছোট একটি মেশিন জাতীয়। যার কাজই হল বিটকয়েন সংরক্ষণ করা। অন্য কোন কাজ নয়। এতে অন্য কোনও প্রোগ্রাম আপলোড করা যায় না। ইলেক্ট্রনিক চুরির ক্ষেত্রে এটি পূর্বের সকল পন্থার চেয়ে অনেক বেশি নিরাপত্তা দান করে।

বিটকয়েন ও অবৈধ কার্যকলাপ: বিটকয়েন সেন্ট্রালাইজড না হওয়ায় এর মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ অনেক সহজ। ব্লকচেইন প্রযুক্তিটি প্রতিটি তথ্য অজ্ঞাতনামে সংরক্ষণ করে, ফলে বিটকয়েনের প্রেরক ও প্রাপক কে তা নির্দিষ্ট করা যায় না।
সুতরাং অর্থপাচার, (Money laundering), টেক্স/কর ফাঁকি দেয়া, ফটকাবাজী (Speculations), শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি-রপ্তানি (Smuggling), অস্ত্রের ব্যবসা ইত্যাদি যাবতীয় রাষ্ট্রীয় আইন বহির্ভূত  ও শরীয়াহ্ পরিপন্থী কার্যকলাপ অনায়েসেই করা যায়।

ইসলামিক ইকনোমিক ফোরাম তাদের বিটকয়েন বিষয়ক গবেষণায় লিখেছে-অস্ট্রেলিয়ার জনৈক গবেষক তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আইন বহির্ভূত কার্যকলাপ (অস্ত্রের ব্যবসা ইত্যাদি) এর হার ৫০%।

বিটকয়েন bitcoin

বিটকয়েনের শরঈ পর্যালোচনা

ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মানের কয়েকটি ইসলামিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিটকয়েন বিষয়ে শরঈ পর্যালোচনা পেশ করা হয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হল, তুরস্কের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রনালয়, মিশরের কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগ, ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগ, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিদ্যাপিঠ দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়া বিভাগ ও ইসলামিক ইকনোমিক ফোরাম নামক শারিয়াহ স্কলারদের একটি অনলাইন গ্রুপ।

শেষোক্ত ফোরাম এ বিষয়ে ফকীহদের নিয়ে মতবিনিময় মজলিস অনুষ্ঠিত করেছে। এরপর ফোরামের পক্ষ থেকে বিটকয়েন বিষয়ে যৌথ শরঈ পর্যালোচনা পেশ করা হয়েছে। ৩১ পৃ. ব্যাপী তাঁদের গবেষণামূলক যৌথ শরঈ পর্যালোচনাটি আরবী ভাষায় গত ১১/১/২০১৮ইং তারিখে ‘ইন্টারন্যাশনাল শরীয়াহ্ রিসার্চ একাডেমী ফর ইসলামিক ফিন্যান্স (ISRA)’ মালয়েশিয়ার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে (https://www.isra.my/) ও অনলাইন ভিত্তিক  ‘ইসলামিক ইকনোমিকস এন্ড ফিন্যান্স পিডিয়া’-এর ওয়েব সাইটে (http://iefpedia.com/arab/?p=40129) প্রকাশ হয়েছে।

উক্ত গবেষণাটি ইসলামী অর্থনীতি জগতে এ বিষয়ে বিশদ প্রথম সম্মিলিত শরঈ আলোচনা । বক্ষ্যমাণ লেখার একটি প্রধান উৎস উক্ত গবেষণা।

উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে বিভিন্ন ভাষায় গবেষণাটির অনুবাদের কাজ চলছে। আমাদের জানামতে এর মূল আরবীর উপর নির্ভর করে প্রথম অনুবাদটি সম্পন্ন হয়েছে বাংলা ভাষায় । অনুবাদটি করেছে বাংলাদেশের ইসলামিক ফাইন্যান্স একাডেমি এন্ড কনসালটেন্সি (আই. এফ. এ. সি.)।

বর্তমান পর্যন্ত বিটকয়েন বিষয়ে শরঈ যে মতামতগুলো প্রকাশিত হয়েছে, এগুলো মোট তিন ধরনের। যথা-

ক. বিটকয়েনের ব্যবহার বৈধ নয়, ঠিক নয়। (যথাক্রমে মিশরের কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগ, দেওবন্দের ফতোয়া ও তুরস্কের ধর্ম মন্ত্রনালয়) কেউ হারামও বলেছেন (ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয় ফতোয়া বিভাগ)
খ. বিটকয়েনের ব্যবহার শর্তসাপেক্ষে মৌলিকভাবে বৈধ। (ইসলামিক ইকনোমিক ফোরামের পূর্বোক্ত গবেষণায় অজ্ঞাতভাবে নাম ছাড়া এ মতামত উল্লেখ করা হয়েছে)
গ. এর থেকে বেঁচে থাকাই সতর্কতা। (এটি মালেকী মাযহাবের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের কতকের মত)

উপরোক্ত শরঈ পর্যালোচনায় বিটকয়েনের যে প্রসঙ্গগুলো গুরুত্বের সাথে আলোচনায় এসেছে, সংক্ষেপে তা হল-
১.বিটকয়েন প্রকাশকের অজ্ঞতা।
২.এর ভবিষ্যত বিষয়ে অজ্ঞতা।
৩.এর প্রাতিষ্ঠানিক কোন প্রকাশক নেই। যিম্মাদারও নেই।
৪.রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণ নেই।
৫.এতে ব্যাপকভাবে স্প্যাকুলেশন হয়। এর মূল্য স্থীর থাকে না।
৬.আইন বহির্ভূত কাজে অধিক ব্যবহার হওয়া।
৭.উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি শরীয়তের দৃষ্টিতে মূল্যমান বিশিষ্ট (মালে মুতাকাওয়্যিম) হবে কি না।

যারা একে নাজায়েয বলেন, তাদের মতে বিটকয়েনে উপরোক্ত ১-৬টি বৈশিষ্ট্য থাকায় সেটি শরীয়তের দৃষ্টিতে মূল্যমান বিশিষ্ট (মালে মুতাকাওয়্যিম)   কিছু নয়। তাই এটি জায়েয নয়। বর্তমান পর্যন্ত এ মতের প্রবক্তার সংখ্যাই অধিক।

আরো সংক্ষেপে বললে, তাঁদের আলোচনায় বিটকয়েন শরঈভাবে নিষিদ্ধ হওয়ার মৌলিক কারণ তিনটি। যথা-
১.গারার (Uncertainty), জাহালাহ (অজ্ঞতা) ও গ্যামব্লিং। মূলত বিটকয়েনের প্রকাশকের অজ্ঞতা, এর ভবিষ্যত বিষয়ে অজ্ঞতা, এটি সেন্ট্রালাইজড না হওয়া, তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণ না হওয়া থেকেই এসব গারার ও জাহালাহ-এর সৃষ্টি।
২. নিষিদ্ধ কাজের মাধ্যম হওয়া।
৩.উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের কারণে শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি মূল্যমান বিশিষ্ট সম্পদ না হওয়া।

অপরদিকে যারা বিটকয়েনকে বৈধ বলতে চান, তাঁদের মূল যুক্তি হল-

১.প্রত্যেক জিনিষের মূল হল মুবাহ হওয়া।
২.বিটকয়েনের মাধ্যমে কেনা-বেচা হয়। এর মাধ্যমে অন্যান্য পণ্যের মালিকানা অর্জন হয়। সুতরাং এটি শরীয়তের দৃষ্টিতে মূল্যমান বিশিষ্ট (মালে মুতাকাওয়্যিম) হবে।
৩.এর মধ্যে সাধারণ কারেন্সি হওয়ার যে গুণ থাকা দরকার তা আছে। যদিও তা সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত নয়।

প্রথমোক্ত বক্তব্যের জবাবে তারা বলেন, এসব মৌলিক সমস্যা নয়। নিষিদ্ধ কাজ অন্যান্য কারেন্সির মাধ্যমেও হতে পারে। আর সরকারের তত্ত্বাবধান ও সেন্ট্রালাইজড-এর মূল লক্ষ্য হল, নিরাপত্তা দান। ব্লক চেইন প্রযুক্তি এক্ষত্রে সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

আমাদের দৃষ্টিতে এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হল, বিটকয়েন শরঈ দৃষ্টিতে কারেন্সি কি না। অর্থনীতিবিদ ও ফকীহদের দৃষ্টিতে মুদ্রার চারটি বৈশিষ্ট্য ও অর্থনৈতিক কাজ (Economic  Activities) রয়েছে। যথা-

১। Medium of Exchange: এর সারকথা হল, যে জিনসটি মুদ্রা হবে তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে-যেকোন কিছু ক্রয়-বিক্রয়ে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে তা কাজ করবে।

২। Widely Acceptable: এর সারকথা হল, যে জিনিষটি মুদ্রা হবে সেটার জন্য জরুরী হল-তা ব্যাপকভাবে কোনও প্রকার দলীল-প্রমাণ ছাড়া গ্রহণযোগ্য হওয়া। এর বিপরীতে কাংখিত বস্তু দিতে প্রস্তুত হওয়া। এর জন্য একটি অন্যতম শর্ত হল, দেশীয় আইনে তা অস্বীকার না করা।

৩। Standard of Value/Measure of Value: এর সারকথা হল, কাপড়ে দীর্ঘতা মিটার বা গজে মাপা হয়। চাউল-গমের পরিমাণ ওযনের মাধ্যমে জানা যায়। তেমনি এসব বস্তুর ভেল্যু পরিমাপ করার মাধ্যম হল মুদ্রা। অর্থাৎ যে জিনিষটি মুদ্রা হবে  তার মধ্যে এই গুণ থাকতে হবে যে, এর মাধ্যমে বস্তুসমূহের ভ্যল্যু সহজেই নির্ণয় করা সম্ভব হবে।  যেমন, বলা হয় ঘড়িটির মূল্য দুইশত টাকা। বইটির মূল্য তিনশত টাকা।

৪। Store of Value: এর সারকথা হল, মানুষ সম্পদ সঞ্চয় করে। ভবিষ্যতে তা কাজে আসে। সম্পদ সঞ্চয়ের জন্য এমন কিছু দরকার, যার মূল্যমান সাধারণত হ্রাস হবে না। নষ্ট হবে না। এর দ্বারা নিজ সম্পদের ভ্যাল্যু সংরক্ষণ করা যাবে। এটি করার মাধ্যম হল-মুদ্রা। এক লক্ষ টাকা আপনার কাছে থাকার অর্থই হল, এ পরিমাণ সম্পদের ভ্যাল্যু আপনার কাছে আছে। অর্থাৎ যে জিনিষটি মুদ্রা হবে  তার মধ্যে এই গুণ থাকতে হবে যে, এর মাধ্যমে বস্তুসমূহের ভ্যাল্যু সহজেই সংরক্ষণ করা যায়।

সারকথা, এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, কোন কিছুকে মুদ্রা বলতে হলে আগে দেখতে হবে তার মধ্যে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো আছে কি না। কোন একটা বৈশিষ্ট্য না থাকলে সেটা মুদ্রা হবে না।
আলোচিত বিটকয়েনে-অন্তত আমাদের দেশে-দ্বিতীয় গুণটি নেই। কারণ এটি ব্যাপকভাবে গৃহিত নয়। সরকারীভাবেও অনুমোদিত নয়।  সুতরাং একে আমাদের দেশে শরঈ ও অর্থনীতি কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই কারেন্সি বা মুদ্রা বলা যায় না।

বিশেষত সরকারীভাবে এর লেনদেন আমাদের দেশে নিষিদ্ধ। শরীয়তের মাসয়ালা হল, বৈধ বিষয়ে রাষ্ট্রের আনুগত্য করা ওয়াজিব। এর জন্য রাষ্ট্র ইসলামী হওয়া জরুরী নয়।  এছাড়া দেশের প্রতিটি নাগরিকই বক্তব্য বা কর্মে একথার স্বীকারোক্তি দিয়েছে যে, সে বৈধ বিষয়ে সরকারের আইন  মানবে।

অতএব উপরোক্ত দুই কারণে, যতক্ষণ অবৈধ কাজে বাধ্য না করা হবে ততক্ষণ সরকারী আইন মানা জরুরী। (দেখুন, বুহুস,১:১৬৩/১৬৮,শরহু সিয়ারিল কাবীর, ১/১৬৮;তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম ৩/৩২৩)

সুতরাং বিটকয়েনের লেনদেন থেকে বিরত থাকা উচিত। যদি কখনো তাতে পূর্বোক্ত দ্বিতীয় গুণটি পাওয়া যায়, তবে তখন সেটা কারেন্সির মর্যাদা পাবে। ডলার ও টাকার মত এটিও স্বতন্ত্র একটি মুদ্রা হিসেবে বিবেচিত হবে। এর সাথে ডলার/টাকার কমবেশি লেনদেন বৈধ হবে। যেমন, টাকার সাথে ডলারের লেনদেন কমবেশিতে বৈধ।

এছাড়া যে কাজগুলো বিটকয়েনে সবসময়ই নিষিদ্ধ ও নাজায়েয, তা হল-ফরেক্সের মত ফিউসার বা ফরওয়ার্ড সেল এতে করা যাবে না। বিটকয়েন হ্যাকিং করা জায়েয নয়। এটি চুরির নামান্তর। বাকিতে বিটকয়েন ক্রয় করা হলে, আদায়ের দিন যে মূল্য হবে সেটা পরিশোধ করবে।


লেখক

মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম

প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক,আই এফ একাডেমী এন্ড কনসালটেন্সি,

সহকারী মুফতি,ফতোয়া বিভাগ,জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ ঢাকা।

Facebook Comments