সুরা আসর – আকারে ছোট হলেও লাইফের সব নির্দেশনা আছে।

233

একটা জিনিস খুব করে মন থেকে চাচ্ছেন, “ওহ আল্লাহ! আমাকে এ জিনিসটা মিলিয়ে দাও, আমার জন্য এ কাজটা সহজ করে দাও।”

কিন্তু কই! আল্লাহ তো দিলেন না! এত দিন ধরে মনের একান্ত আবেগ-অনুভুতি মিশিয়ে আল্লাহর কাছে চেয়েছি আল্লাহ তো দিলেন না!

দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে সবর করেই আছি কিচ্ছুই তো হচ্ছেনা, অবস্থা তো পরিবর্তন হচ্ছেনা! আল্লাহ তো আমার দিকে দেখছেন না! আমাকে দয়া করছেন না! আমার দিকে তাঁর রহমত, করুনার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন না!

আমাদের সবার জীবনে এমন কিছু না কিছু আছেনা? অবশ্যই আছে। এটাই জীবন। কেন পাইনা? আল্লাহ কৃপণ? – নাহ!
তাহলে আমি যা চাই দিয়ে দিলে ক্ষতি কি?
-তিনি কি আল-‘আলীম (ভুত-ভবিষ্যত সর্বজ্ঞাতা) নন?

দিয়ে দিলেই যদি সব ঝামেলা চুকে যেত তবে তাঁর ক্ষতি কি! কিন্তু তিনি তো জানেন কোনটা কখন কিভাবে আমার জন্য কল্যাণকর। আমার মা-বাবাও তো আমাকে এমন কিছু দিবেন না যেটা আমার জন্য অকল্যাণকর। যেদিন মা পড়াশোনার জন্য বাসা থেকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিলেন সেদিন মাকে মনে মনে শত্রুই মনে হলো।

তিনি আমার ভালো চান না! কেন আমাকে হোস্টেলে পাঠালেন! ঐখানে পাঠিয়ে তিনি মনে হয় আপদ বিদায় করতে চাচ্ছেন! এরা কেউ আমার ভালো চায়না! আজ পদে পদে বুঝি সেদিনের মায়ের ডিসিশান আমার অপছন্দ হলেও আজ সেটা আমার জন্য কত বড় কল্যাণ বয়ে এনেছে! আল্লাহু আকবর! মায়ের সিদ্ধান্তে যদি এইরকম সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকে তাহলে আমার রব যিনি আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাঁর সিদ্ধান্ত আমার জন্য কত বড় কল্যাণকর সেটা আমরা কেন ভুলে যাই!

আজ আমি যা পাবার জন্য ‘দাও, দাও’ করে দুনিয়া মাথায় তুলছি, আল্লাহর কাছে তা কল্যাণকর হলে কিসে রব্বে কারীমকে আটকাতো আমার উপর নিয়ামতের বৃষ্টি বর্ষণ করতে? আমি তো তার উপর ঈমান এনেছি হয়তো প্রিয় বান্দা হতে পারি নাই কিন্তু তিনি তো আমাকে আমার ঐ মায়ের তুলনায় অনেক অনেক বেশি ভালোবাসেন যিনি এক মূহুর্তের জন্যও আমার ক্ষতি হোক এমন কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না, মানতে পারেন না! ‘

বছরের পর বছর কিংবা মাসের পর মাস যে নিয়ামাহ খুঁজে খুঁজে সবরের বাঁধ ভেঙে পড়ছে; একটি বার কি চিন্তা করে দেখেছি-
হয়ত আমার আকাঙ্ক্ষা আকুতি রব্বের কাছে প্রিয়জনের বুলির মত মধুর। এই আকুতির ভালবাসায় তিনি বৃষ্টির মত অঝোর ধারায় ঢেলে দিতে চান কল্যাণ….

কেবল সময়ের অপেক্ষা। বান্দা আর কিছুটা সময় কাটাক না আকুতি মাখা বিনয়ে। এ যে আল-ওয়াদুদের সাথে ছোট্ট মাখলুকের এক গভীর বন্ধন।

আমরা তো বড়ই অকৃতজ্ঞ; পেয়ে গেলাম তো ভুলে গেলাম! এর চেয়ে এটা কি উত্তম না যে, এমন জিনিস যেটা আল্লাহ দেননি তার জন্য আমি আল্লাহর আরো কাছাকাছি যেতে পেরেছি, কান্নাকাটি করে বুঝতে শিখেছি দুনিয়াই সব পাওয়ার জায়গা নয়। এখানে পেয়ে গেলাম তো ভুলে গেলাম। তার চাইতে এখানে না পাওয়া সব একত্রে জমা থাক যেদিন আল্লাহ এখানকার সব চাওয়া পাওয়া গুনে গুনে বহগুণে বাড়িয়ে দিবেন। সেদিন আমার কোন ইচ্ছাই তিনি অপূর্ণ রাখবেন না।

আমার রব দয়াময়। তিনি তো চাইলেই দিয়ে দিতে পারতেন। তিনি ইচ্ছা করা মাত্রই তা হয়ে যেত। তার আগে আমার নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার,
“আমি কি আমার ইখলাস(নিষ্ঠা), আমলে, আখলাকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছি আমার রবকে?” হয়তোবা আল্লাহ আরো একটু সময় দিচ্ছেন, তিনি আমাকে আরেকটু কাছে চান, তাঁর আরো কাছে আমার যায়গা তিনি পছন্দ করেছেন। হয়তোবা আমার আরো আকুলতা, আরেকটু অশ্রু ঝরানো আমাকে তার কাছে পোঁছে দিতে সাহায্য করবে! আমাকে তাঁর প্রিয় করে তুলবে! তিনি যে বান্দার অশ্রুমাখা প্রার্থনা বড্ড বেশি ভালোবাসেন!

যখন কিছু না-পাওয়ার আকুতি ভেতরকে পেরেশান করে তোলে, তখন চাওয়ায় তীব্রতা আরো বেশি বাড়ে।বাড়ে ইখলাসও, অন্তর থেকে উঠে আসা আকুতিগুলো দুয়ার রূপ নেয়, বুকের গভীর থেকে উঠে আসা আক্ষেপগুলো অশ্রুতে রূপ নেয়……..

আপনি যখন সুখে থাকবেন দেখবেন আল্লাহর কাছে জানানো তখনকার মনের আকুতিগুলো আর যখন দুঃখে কষ্টে থাকবেন তখনকার দুয়াগুলোর আকুতি-আন্তরিকতা কখনো এক নয়!
দুঃখের দিনের দু’আগুলো হয় বাদশাহের কাছে নি:স্ব অসহায় ভিখারী প্রজার মত।

রব্বে কারীমের সাথে এটাই বড় বন্ধন। আমরা তো রব্বের সাথে এই বাঁধনে বাঁধা।

আল্লাহর রাসুল (সা) দুনিয়ার জীবনে এক মূহুর্তের জন্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে প্রাধান্য দেন নাই!
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ সুখ-সমৃদ্ধি-সম্পদের পাহাড় দিতে চেয়েছিলেন। তিনি বেছে নিয়েছিলেন ক্ষুধার্ত-শোকসংকুল জীবন। এক বেলা খাওয়া তো আরেক বেলা উপবাসের জীবন আর না হয় খাদ্যের অভাবে আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট হয়ে রোজা থেকে কাটিয়ে দেওয়া জীবন।

আয়িশা রাযি. বলেন, আল্লাহর রাসুলের জীবদ্দশায় একটানা তিন বেলা কখনো পেট ভরে খেতে পায়নি। সুবহানআল্লাহ! এ ছিল দুনিয়া এবং আখিরাতের বাদশার জীবন! চাইলে তো উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহ তাঁকে দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন!

আল্লাহর রাসুল (সা) এভাবেই আল্লাহর প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন,
“সে প্রেমময় রব্ব, আমি একদিন কিছু খেয়ে তৃপ্ত হয়ে তোমার শোকরে লুটিয়ে পড়ব, অন্যদিন ক্ষুধায় কাতর হয়ে সব দু:খ-ব্যথা বুকে নিয়ে সবর করব।

আমি তোমারই নিষ্ঠাবান বান্দা ছিলাম, তেমনি আছি। অভাব দুর্দশা আমাকে তোমার থেকে পৃথক করেনি।”
-এটাই কি প্রকৃত ভালবাসা নয়? বান্দার সাথে রবের প্রেমময় আকুতি নয়?

আমরা কেন বুঝিনা যে, আমাদের রব চাচ্ছেন আমাদের আরেকটু এগিয়ে নিতে। তিনি পথ খুলে দিচ্ছেন এভাবে তাই একটু সময় লাগছে। তিনি চান আরেকবার রাতের শেষ প্রহরে নির্জনে আমি তাঁর সাথে একান্তে কথা বলি, আরেকটু বিশ্বাসের বাঁধন গভীর হোক। আরো একবার আকুতি করে বলি “ইয়া কারীম, তুমি দাও। ইয়া রহমান, তুমি সহজ করো”।

একটু অপেক্ষা, আরো কিছুটা সময় সবর করাটা খুব নিন্দনীয় কিছু মনে হচ্ছে? যদি একটু সবরের বিনিময়ে জান্নাতের পথে একটু একটু অগ্রসর হই! তারপরও আমি অনুশোচনায় ভুগবো, ডিপ্রেশনে থাকব? উঁহু না। কখনোই না!

একেক টুকরা সবরের বিনিময় জান্নাত! একেক টুকরা জান্নাত। নিয়ামতে ডুবে জান্নাত কিনে নেয়া এত সহজ ছিল না। ফেরআউন পারেনি। আসিয়া (আ) পেরেছেন! দাম্ভিক আবু জাহেল পারেনি, ক্রীতদাস বিলাল (রদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তা কিনে নিয়েছেন।’

একেকটা দিনের সবর, একেকটা যুদ্ধ, ময়দানে হোঁচট খাওয়া প্রত্যেকটা আঘাত আল্লাহ দেখছেন। তিনি ফেলে দেবেন না। আপনার প্রতিটা দীর্ঘশ্বাসের ব্যাপারে যিনি খবর রাখেন তিনি আল্লাহ। তিনি কি আপনাকে এর বিনিময় দিবেন না? তা কি করে হয়! কাফিরদেরও তিনি দুনিয়ার শান-শওকত ভোগ করাচ্ছেন আর আপনি তো তার উপরই ঈমান এনেছেন। তাকেই রব হিসাবে মেনে নিয়েছেন। নিজের দুঃখ অস্থিরতা তার সমীপেই নিবেদন করেছেন।

আল্লাহ বলছেন “যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কার নষ্ট করি না।” (সূরা কাহফ:30)

কে কত পেয়েছে, কে কত সম্পদের পাহাড় বানিয়েছে, কে কত কম সময়ে পুরস্কার জিতেছে, নিয়ামতের বন্যায় ডুবে গেছে …এগুলো চেয়ে চেয়ে দেখা আর টুক করে আক্ষেপের শ্বাস ফেলার জন্য আল্লাহ আপনাকে আমাকে সিলেক্ট করেননি। আপনার পজিশন ইউনিক। তিনি নির্ধারণ করেই রেখেছেন। চলুন, সম্পর্কটা আরেকটু এগিয়ে নিই, আরেকটু কাছে।

ফেরাউনের অসহনীয় অত্যাচারে প্রাণ দিয়ে বিনিময়ে আল্লাহর ‘কাছে’ জান্নাতে একটা ঘর চাইতে হয়, একজন তো তা-ই দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। কি ছিল তাঁর?
আগলে রাখার মত নেককার স্বামী, নাকি ধার্মিক ফ্যামিলি সাপোর্ট; নাকি এজুকেশনাল/প্রফেশনাল কোয়ালিফিকেশন, নাকি গোটা চারেক সদকায়ে জারিয়া সন্তান??
উঁহু না! এসবের কিচ্ছুই ছিল না তাঁর!

আমরা সবকিছু সহজ চাই। না পেলে তড়পাই। অন্যেরটা দেখে মিইয়ে যাই।
দুনিয়া এজন্য নয়। ডিফিকাল্টি ইজ লাইফ, লাইফ ইজ ডিফিকাল্টি।
কে কয়টা ধাপ পার করছে তা মেপে মেপে বিনিময় দেয়া হবে হাশরে। ডিফিকাল্টিগুলো তাকওয়া(আল্লাহভীতি) আর তাওয়াক্কুল(ভরসা) দিয়ে হ্যান্ডেলিং এ কে কত চৌকস, সাকসেস এর মানদণ্ড তাতেই নির্ধারিত হয় আল্লাহর কাছে এবং শেষবেলায়(আখিরাতে)।

টার্গেট আল্লাহর রাসুল (সা) আর তাঁর সাথীদের মিসকীনের জীবন নাকি দুনিয়ার বিলাসিতা, ভোগ, আর দাম্ভিকতায় পরিপূর্ণ এক জিল্লাতের জীবন?

কিসে আপনি সন্তুষ্ট? গোলামীর জীবনে নাকি সিনা টান টান করে মাথা উঁচু করে গায়রেতের সাথে বেঁচে থাকার জীবনে! তাগুতের ভয়ে হককে গোপন করা জীবন নাকি তাগুতের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে চলা সেই কন্টাকীর্ন জীবন যা বেছে নিয়েছেন যুগে যুগে নবী রাসুল আর তাদের সঙ্গী-সাথিরা!

“কালের শপথ!
নিশ্চই মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ।
কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের।” (সুরা আছর)

সুবহানআল্লাহ! সুরা আসর নামের ছোট্ট সুরার ৩টা মাত্র আয়াতে লাইফের সব নির্দেশনা আছে। একদম সব। একজন মুমিনের পুরো জীবনের গাইডলাইন।

আজ থেকে আমরা যেনো অন্তরে এ জিনিসগুলা সেট করে নেই, “পরিস্থিতি যাই হোক না কেন আমি হক্বের উপর থাকবো, সবর করব, সৎকর্মে এগিয়ে যাবো ইন শা আল্লাহ। আমি শুধু জানি, ‘কি আমার চাই’ কিন্তু আল্লাহ তো জানেন আসলেই আমার জন্য কখন কি দরকার। আমাদের রব তো এমন নন যে, বান্দা তাঁর কাছে আসতে চাইবে আর তিনি তা কঠিন করে দিবেন।

Facebook Comments