9.4 C
New York
Friday, October 17, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 29

প্রকৃত দায়ী

দাওয়াত এমন হওয়া চাই । এক দেশের এক ইমামের কথা। ইমামের বড় ছেলেটার বয়স দশ বছর। ইমাম সাহেব করতো কী, প্রতি জুমা’বার দিন, জুমার পরে তাঁর দশ বছরের ছেলেটাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন দাওয়া’র কাজে। বাবা-ছেলে মিলে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে, মানুষের বাসায় গিয়ে গিয়ে তারা ইসলামিক বইপত্র, ম্যাগাজিন বিলি করতো। সেসব বইপত্রে আল্লাহর পরিচয়, সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর অপার অনুগ্রহ, রহমত ইত্যাদির বর্ণনা থাকতো।

তখন শীতকাল। দেশে তুষারবৃষ্টি হচ্ছে। যেহেতু প্রতি জুমা’বারেই তারা দাওয়া’র কাজে বের হয়, সেদিনও তাদের বের হবার কথা।
ছোট্ট ছেলেটা শীতের গরম কাপড়-চোপড় পরিধান করে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে তাঁর বাবার কাছে এসে বললো,- ‘আব্বু, আমি রেডি…’

যেহেতু বাইরে তীব্র তুষারপাত, তাই ইমাম সাহেব ঠিক করে রেখেছিলেন যে আজ তিনি দাওয়া’র কাজে বের হবেন না। কিন্তু ছেলেকে এভাবে প্রস্তুত দেখে জিজ্ঞেস করলেন,- ‘কোথায় যাবে?’
ছেলেটা অবাক হয়ে বললো,- ‘আব্বু, আজকে তো দাওয়া’র কাজে বের হবার দিন। মনে নেই তোমার?’
বাবা বললেন,- ‘সোনা, আজকে বাইরে খুব বেশিই ঠান্ডা। দেখছো না বাইরে তুষার বৃষ্টি হচ্ছে?’
ছেলে বাবার দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। বললো,- ‘আব্বু, বৃষ্টি হচ্ছে বলে কী মানুষ জাহান্নামে যাওয়া থেকে মুক্ত হয়ে গেছে?’
ছেলের গাম্ভীর্যপূর্ণ প্রশ্নে বাবা কপাল কুঁচকালেন। বললেন,- ‘দেখো, আজকে আমি বের হচ্ছিনা, ব্যস! আর কিছু বলবে?’

বাবার এই কথার বিপরীতে ছোট্ট ছেলেটা বললো,- ‘আব্বু, আজ তুমি দাওয়া’র কাজে যেতে না চাইলে যেওনা। তবে, আমি কী যেতে পারি?’
বাবা কিছুটা অবাক হলেন। হালকা ইতস্ততবোধ করলেন। এরপর বললেন,- ‘ঠিক আছে। যাও। ওইদিকে দাওয়া’র বই এবং ম্যাগাজিনগুলো রাখা আছে। ব্যাগে নিয়ে নাও। আর শোন, সাবধানে যেও কিন্তু। খুব বেশিক্ষণ বাইরে থেকো না। দেখতেই পাচ্ছো বাইরের আবহাওয়া খারাপ…’

ছেলেটা মনোযোগ দিয়ে বাবার কথাগুলো শুনলো। টেবিলে রাখা বইপত্র এবং ম্যাগাজিনগুলো ব্যাগে ভরে নিয়ে বাবাকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে পড়লো দাওয়া’র কাজে। আজ তার সাথে তার বাবা নেই। আজ সে একা।

এরকম তুষারপাতের মধ্যে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে সে দাওয়াতের বই এবং লিফলেটগুলো বিলাতে লাগলো মানুষের কাছে। যাকেই পাচ্ছে, তার হাতে একটি করে কপি ধরিয়ে দিচ্ছে।
এভাবে কাটলো দুই ঘণ্টা। বরফ, শীত আর ঠান্ডা হাওয়ায় ছেলেটার শরীর যেন জমে আসছে। হাত-পা অবশ হয়ে আসার মতো অবস্থা। এই মূহুর্তে তার হাতে আর মাত্র একটি বই। কিন্তু, দেওয়ার মতো কাউকেই সে রাস্তায় খুঁজে পাচ্ছে না। রাস্তায় কেউ আর অবশিষ্ট নেই বললেই চলে।
সে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো। যদি কেউ একজন আসে। কিন্তু না। কেউই এলো না।
সে মোড় ঘুরে যেই দিকে ফিরলো, তার সোজাসুজি একটা বাসাটা দেখা যাচ্ছে। সেই বাড়িটার কাছে এসে দাঁড়ালো সে। শীতে তখন সে থরথর করে কাঁপছে। সে বাসাটার কলিংবেল বাজালো। একবার… দুইবার… তিনবার…।
উহু। কারো কোন সাড়াশব্দ নেই। সে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। আরো কয়েকবার কলিংবেল বাজালো। দরজায় কড়া নাড়লো। কিন্তু কোন সাড়া শব্দই মিললো না। হতাশ হয়ে সে চলে আসার জন্য সামনে পা বাড়ালো। কিন্তু, কী এক অদ্ভুত টানে যেন সে আবার কলিংবেলটার কাছে এলো। এসে আবার সে কলিংবেলটা বাজাতে লাগলো এবং দরজায় ধাক্কা দেওয়া শুরু করলো। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, ভেতরে কেউ আছে।

একটুপরে, ভিতর থেকে আস্তে করে দরজাটা কেউ একজন খুললো। ছেলেটা দেখলো, তার সামনে একজন মধ্য বয়স্কা ভদ্র মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাকে দেখেই ছেলেটা ফিক করে হেসে দিলো। যেন শীতে শরীর জমে যাওয়ার সমস্ত কষ্ট সে মূহুর্তেই ভুলে গেছে।
মহিলার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা হাসি হাসি মুখ করে বললো,- ‘আন্টি, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য খুবই দুঃখিত আমি। আসলে, আমি আপনাকে যে কথাটা জানাতে এসেছি সেটা হলো, আর কেউ আপনাকে ভালো বাসুক বা না বাসুক, পৃথিবীর আর কেউ আপনার কেয়ার করুক বা না করুক, আপনার খোঁজ করুক বা না করুক, আমাদের রব, মহান আল্লাহ সুবাহান ওয়া’তালা আপনাকে ভালোবাসেন। আপনার কেয়ার করেন এবং আপনার প্রতি তিনি অবশ্যই রহমশীল। এই যে দেখুন, আমার হাতে থাকা এটিই শেষ বই। এই বইটি পড়লে আপনি আপনার রবের ব্যাপারে জানতে পারবেন। নিন, এই যে ধরুন…!’
মহিলা মুখ ফুটে কিছুই বললো না। ছেলেটা মহিলার হাতে বইটি দিয়েই দৌঁড় দিলো।

পরের জুমা’বার। ইমাম সাহেব নামাজের পর খুচরা বক্তব্য দিলেন। এরপর প্রতিবারের ন্যায় জিজ্ঞেস করলেন,- ‘কারো কী কোন ব্যাপারে কোন জিজ্ঞাসা আছে?’
মহিলাদের সাইড থেকে হিজাবে আবৃত একজন মধ্য বয়স্কা মহিলা স্পীকারের সামনে দাঁড়ালেন। তিনি সালাম দিয়ে বললেন,- ‘এখানে যারা যারা আছেন, তাদের কেউই আমাকে আমাকে চিনেন না। চেনার কথাও না। গত জুমা’বার অবধিও আমি ছিলাম একজন অমুসলিম। আমার স্বামী বছর দু’য়েক আগে মারা যায়। স্বামী মারা যাবার পর আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে উঠে। আমার আপনজনরাই আমাকে পর করে দেয়। আমাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করে। আমার দুনিয়াটা এতোই বিষাদময় হয়ে উঠেছে যে, আমার মনে হচ্ছিলো আমি জীবিত থেকেও মৃত। সিদ্ধান্ত নিলাম- আত্মহত্যা করবো।

দরজা বন্ধ করে, ফ্যানের সাথে দড়ি ঝুলিয়ে তখন আমি আত্মহত্যার জন্য সবরকম প্রস্তুতি সেরে ফেলেছি।

একটু পরেই আমি বিদায় নিবো এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে, যে পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই, কেউ না।
যেই আমি চেয়ারে উঠে আত্মহত্যার জন্য চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে যাবো, অমনি হঠাৎ আমার বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। সিদ্ধান্ত নিলাম- দরজা খুলবো না। কিন্তু খেয়াল করলাম, আমার কলিংবেলটা অনর্গল বেজেই চলছে, বেজেই চলছে। কোন থামাথামি নেই। একটু পর দরজা ধাক্কার শব্দ পেলাম। ভাবলাম, কে হতে পারে? সাতপাঁচ ভেবে এসে দরজা খুললাম। দরজা খুলতেই দেখি, একটি ফুটফুটে ফেরেশতার মতো ছোট্ট ছেলে আমার দরজার বাইরে দাঁড়ানো। আমি বুঝতে পারছিলাম বাইরের হাঁড় কাপানো কনকনে ঠান্ডায় সে খুব কষ্ট পাচ্ছে। তবুও, আমাকে দেখে সে মিষ্টি একটা হাসি দিলো। এরপর বললো,- ‘আন্টী, পৃথিবীর কেউ আপনাকে ভালো না বাসলেও, একজন আছেন যিনি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসেন। আপনার কেয়ার করেন’। এরপর আমার হাতে একটি বই ধরিয়ে দিয়ে সে বিদায় নিলো।

সে চলে যাবার পরে আমি বইটি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। আমার টাঙানো দড়ি তখনও ফ্যানের সাথে ঝুলছিলো। আমি আগ্রহবশঃত বইটা উল্টালাম। খুব মনোযোগ দিয়ে বইটির প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত পড়ে ফেললাম।এরপর?
এরপর আমি লাথি দিয়ে আমার আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুত করা চেয়ারটাকে ভেঙে ফেললাম। হেঁচকা টানে ফ্যান থেকে দড়িটা ছিঁড়ে নিলাম। সেসবের আমার আর দরকার নেই। কারণ- খুব ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট উপকরণের সন্ধান ততোক্ষণে আমি পেয়ে গেছি। সেদিনই আমি কালেমা পাঠ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি।
মহিলা বলে যেতে লাগলো,- ‘মুহতারাম! ছোট্ট ছেলেটার দিয়ে যাওয়া বইটার পেছনে আমি এই মসজিদের ঠিকানাটা পেয়েছি। তাই আজ এখানে ছুটে এসেছি আমি। আমি কেবল সেই ছোট্ট ছেলেটাকে একবার কপালে চুমু খেয়ে একটা ধন্যবাদ দিতে চাই, এজন্য যে, একদম ঠিক সময়ে, সবকিছু শেষ হয়ে যাবার ঠিক একটু আগেই সে আমাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচিয়ে দিলো…’

ঘটনা শুনে উপস্থিত জনতা ‘হু হু’ করে কাঁদতে শুরু করলো। ইমাম সাহেবের সামনের আসনেই ছোট্ট ছেলেটা বসে ছিলো। ইমাম সাহেব অঝোর ধারায় কান্না শুরু করলেন এবং সামনে বসে থাকা তাঁর দশ বছরের ছোট্ট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে চুমু খেতে লাগলেন। মনে হচ্ছে, এমন গর্বিত পিতা বোধকরি পৃথিবীতে আর একটিও নেই…

মোরাল অফ দ্য স্টোরিঃ (সিচুয়েশান যতো প্রতিকূলই হোক না কেনো, দ্বীনের দাওয়াত থেকে যেন আমরা কোনভাবেই গাফেল না হই)

=============================

লেখকঃ আরিফ আজাদ

ব্ল্যাকহোল ! কুরআন ও সাইন্স কি পরস্পর বিরোধী ?

নাস্তিক প্রশ্ন: কুরআন অনুসারে আল্লাহ এই মহাবিশ্ব তৈরি করেছেন কোন ধরণের অসঙ্গতি বা ফাঁটল ব্যতিত(Quran 67:3)! তিনি কি ব্ল্যাকহোলের (Black Hole) ব্যাপারে কিছু জানতেন না?

উত্তরঃ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ

الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا ۖ مَّا تَرَىٰ فِي خَلْقِ الرَّحْمَٰنِ مِن تَفَاوُتٍ ۖ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَىٰ مِن فُطُورٍ
অর্থঃ যিনি স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান।রহমানের{দয়াময় আল্লাহ} সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত দেখতে পাবে না।তুমি আবার তাঁকিয়ে দেখ, কোন খুঁত দেখতে পাও কি?
(কুরআন, মুলক ৬৭:৩)

কোন কোন অনুবাদক فُطُورٍ শব্দকে ‘ফাঁটল’ অনুবাদ করেছেন।আবার কেউ কেউ ‘ত্রূটি ’, ‘অসামঞ্জস্যতা’ অনুবাদ করেছেন।

ব্ল্যাক হোল কি ত্রূটি , বা ফাঁটলজাতীয় কিছু? মোটেও না।

১৯৬৯ সালে আমেরিকান বিজ্ঞানী জন হুইলার(John Wheeler) সর্বপ্রথম Black Hole(কৃষ্ণগহ্বর) কথাটি ব্যবহার করেন। এ জিনিসটি সম্পর্কে এরও পূর্বে, ১৮৮৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন মিচেল(John Mitchell) ধারণা প্রদান করেন। তিনি বলেন, একটি নক্ষত্র বা তারকায়(Star) যদি যথেষ্ট ভর ও ঘনত্ব থাকে, তাহলে তার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এত শক্তিশালী হবে যে, আলো সেখান থেকে নির্গত হতে পারবে না।সেই তারকার পৃষ্ঠ থেকে নির্গত আলো বেশি দূর যাওয়ার আগেই তারকাটির প্রবল মহাকর্ষীয় আকর্ষণ তাকে পেছনে টেনে নিয়ে আসবে।এরকম বহুসংখ্যক তারকা রয়েছে বলে মিচেল ধারণা করেছিলেন।ঐ সব তারকা থেকে আলো আসতে পারে না বলে আমরা এদের দেখতে পাই না।তবে এদের মহাকর্ষ আকর্ষণ আমাদের বোধগম্য হয়। এই সমস্ত বস্তুপিণ্ডকে বলা হয় ব্ল্যাক হোল।

কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ব্ল্যাক হোল হচ্ছে নক্ষত্র বা তারকার একটি অবস্থা বা পর্যায় যে পর্যায়ে এ থেকে আলো নির্গত হতে পারে না। কুরআনের সুরা মুলকের ৬৭নং আয়াতে বলা হচ্ছে—“…রহমানের{দয়াময় আল্লাহ} সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত দেখতে পাবে না।তুমি আবার তাঁকিয়ে দেখ, কোন খুঁত/ফাঁটল দেখতে পাও কি?” প্রসঙ্গসহ পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায় যে এখানে নিখুঁতভাবে সৃষ্ট আকাশমণ্ডলীর কথা বলা হচ্ছে এবং এই সৃষ্টিতে যে কোন খুঁত নেই সে কথা বলা হচ্ছে।

ব্ল্যাক হোল কোন ফাঁটল নয়, কিংবা এটি আল্লাহর সৃষ্টির কোন ত্রূটি নয়। বরং এটি আল্লাহর সৃষ্টিকুলেরই একটি উপাদান।

‘বিজ্ঞানমনস্ক’(!) হবার দাবিদার যেসব মানুষ এই আয়াত থেকে বৈজ্ঞানিক ভুল খুঁজতে যায়, তারা যে আসলে বিজ্ঞান সম্পর্কে কতটা অজ্ঞ, তাদের দাবি থেকেই সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়।


এটা পড়তে পারেন – কুরআনে বিজ্ঞান- কাকতালীয় না বাস্তবতা?

কুরআন কি সকল অমুসলিম হত্যা করতে বলে ?

নাস্তিক প্রশ্ন ঃ ভবিষ্যতে যদি কখনো মুসলিমরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে আর কুরআন (Quran 4:89) এর নির্দেশ অনুসারে সকল অমুসলিমদের হত্যা করে তবে সেটা কোনভাবেই অন্যায় বলে গণ্য হবে না (Quran 3:157, 3:169) ! আপনার কি এরপরেও মনে হয় ইসলাম কোন সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত ধর্ম হতে পারে?

উত্তরঃ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ

তারা চায় যে, তারা যেমন অবিশ্বাসী, তোমরাও তেমনি অবিশ্বাসী হয়ে যাও, যাতে তোমরা এবং তারা সমান হয়ে যাও। অতএব, তাদের মধ্যে কাউকে আওলিয়া(পৃষ্ঠপোষক/অভিভাবক/বন্ধু)রূপে গ্রহণ করো না, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে চলে আসে। অতঃপর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে তাদেরকে পাকড়াও কর এবং যেখানে পাও সংহার কর। তাদের কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না এবং সাহায্যকারী বানিও না।
কিন্তু তাদেরকে নয়, যারা এমন সম্প্রদায়ের সাথে মিলিত হয় যে তাদের সঙ্গে তোমরা চুক্তিবদ্ধ অথবা তোমাদের কাছে এভাবে আসে যে, তাদের অন্তর তোমাদের সাথে এবং তাদের কওমের সাথে যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক।
(কুরআন, নিসা ৪:৮৯-৯০)

আর তোমরা যদি আল্লাহর পথে নিহত হও কিংবা মৃত্যুমুখে পতিত হও, তোমরা যা কিছু সংগ্রহ করে থাকো আল্লাহর ক্ষমা ও করুণা সে সবকিছুর চেয়ে উত্তম। (কুরআন, আলি ইমরান ৩:১৫৭)

আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের প্রভুর নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত।”
(কুরআন,আলি ইমরান ৩:১৬৯)

 

প্রশ্নকর্তাগণ যে আয়াতের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন, সেই আয়াত(নিসা ৪:৮৯) প্রসঙ্গে সাহাবী ইবন আব্বাস(রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, মক্কায় এমন কিছু লোক ছিল যারা ইসলামের কালিমা পাঠ করেছিল।কিন্তু এরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের সাহায্য করত। {অর্থাৎ এরা মদীনা ইসলামী রাষ্ট্রে শত্রূর এজেন্ট হিসাবে কাজ করত} তাদের বিশ্বাস ছিল যে মুহাম্মাদ(ﷺ) এর সাহাবীগণ তাদেরকে কোন বাধা প্রদান করবেন না কেননা তারা প্রকাশ্যে ইসলামের কালিমা পাঠ করেছিল।

এদের ব্যাপারে কী করা হবে, তা নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে মতানৈক্য হয়েছিল।রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এ ব্যাপারে নিরব থাকলেন।অতঃপর আলোচ্য আয়াত(নিসা ৪:৮৯) নাজিল হল এবং ঐসব শত্রূর চরের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে ফয়সালা এলো।
[তাবারী ৯/১০ এবং ইবন কাসির, নিসা ৪:৮৯ এর তাফসির দ্রষ্টব্য]

পরবর্তী আয়াতে(নিসা ৪:৯০) এটাও পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয়া হল যেঃ এই ফয়সালা তাদের জন্য নয় যারা মুসলিমদের সাথে চুক্তিবদ্ধ কোন সম্প্রদায়ের নিকট যায় কিংবা যারা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক নয়। ঐ আদেশ শুধু তাদের ব্যাপারে যারা মুসলিমদের মধ্যে শত্রুর চর হিসাবে কাজ করছিল।

কোথায় শত্রূ গুপ্তচরে প্রতি শাস্তির নির্দেশ আর কোথায় সকল অমুসলিমকে হত্যা করা!!!

বরাবরের মতই কুরআনের বিধানকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে ও বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে আলোচ্য প্রশ্নটি উত্থাপন করা হয়েছে।আমরা জানি যে বর্তমানে পৃথিবীর সকল সেকুলার রাষ্ট্রেও শত্রুর গুপ্তচরের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়।নাস্তিক-মুক্তমনাদের কিন্তু কখনো এসবের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায় না।প্রকৃতপক্ষে, রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধণকারী শত্রুর গুপ্তচরের বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নেওয়া দরকার, এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলবার কোন সুযোগই কারো নেই। আর একারণেই কুরআনের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলবার জন্য এর আয়াতকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করার প্রয়োজন হয়েছে নাস্তিকদের। পরকাল আর স্রষ্টার বিচারে যাদের বিশ্বাস নেই, তাদের কাছ থেকে আর কতটু্কু সত্যবাদিতাই বা আমরা আশা করতে পারি?

প্রশ্নকর্তাদের উল্লেখিত অপর আয়াতদ্বয় আলি ইমরান ৩:১৫৭ ও আলি ইমরান ৩:১৬৯ এ শহীদগণের মর্যাদা বর্ণণা করা হয়েছে। আল্লাহর পথে লড়াই করে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিগণ শহীদ। আর আল্লাহর পথে যে লড়াই হয় তা সবসময়েই ন্যায়সঙ্গতভাবে হয়।একটি আয়াতেও “সকল অমুসলিমদের হত্যা করা”র নির্দেশ নেই। কুরআনে জিহাদের লক্ষ্য ও উদ্যেশ্য খুব পরিষ্কারভাবে বর্ণণা করা আছে। ফিতনা দূর করা ও আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা(সুরা আনফাল ৮:৩৯ দ্রষ্টব্য) ও মুসলিমদের জুলুম-নির্যাতন থেকে রক্ষা করা(নিসা ৪:৭৫ দ্রষ্টব্য)।কুরআন কস্মিণকালেও সকল অমুসলিমকে হত্যা করতে বলে না কিংবা কোন মানুষের উপর জুলুম করতে বলে না। বরং এর বিপরীত কথাই কুরআনে পাওয়া যায় [কয়েকটি নমুনার জন্য সুরা মুমতাহিনা ৬০:৮-৯, আনকাবুত ২৯:৪৬, মায়িদাহ ৫:৮-৯, আনআম ৬:১৫১-১৫২ দেখা যেতে পারে]।

হাদিসে বলা হয়েছে—

রাসূলূল্লাহ(ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন কারণ ব্যতিত মু’আহিদ(ইসলামী রাষ্ট্রে চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম) কোন ব্যক্তিকে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।
[সুনান আবু দাউদ; জিহাদ অধ্যায় ১৫, হাদিস ২৭৬০(সহীহ)]

মুতার যুদ্ধে রওনার সময় রাসূলুল্লাহ(ﷺ) তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দেন :

‘তোমরা কোনো নারীকে হত্যা করবে না, অসহায় কোনো শিশুকেও না; আর না অক্ষম বৃদ্ধকে। আর কোনো গাছ উপড়াবে না, কোনো খেজুর গাছ জ্বালিয়ে দেবে না। আর কোনো গৃহও ধ্বংস করবে না।’
[মুসলিম : ১৭৩১]

“… আমি তোমাদের কয়েকটি উপদেশ দিয়ে প্রেরণ করছি : (যুদ্ধক্ষেত্রে) তোমরা বাড়াবাড়ি করবে না, ভীরুতা দেখাবে না, (শত্রুপক্ষের) কারো চেহারা বিকৃতি ঘটাবে না, কোনো শিশুকে হত্যা করবে না, কোনো গির্জা জ্বালিয়ে দেবে না এবং কোনো বৃক্ষও উৎপাটন করবে না।’’
[মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক : ৯৪৩০]

যুদ্ধের ময়দানেও এভাবে ইসলাম ন্যায়-ইনসাফের নির্দেশ দিয়েছে। মোটেও “সকল অমুসলিমদের হত্যা করা”র নির্দেশ দেয়নি।

যারা বলতে চায় ইসলাম “সকল অমুসলিমকে হত্যা করা”র নির্দেশ দেয়, তারা এক মারাত্মক নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয়। সকল অমুসলিমকে যদি হত্যাই করা হয়, ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হবে কাকে বা ইসলামের বিস্তার হবে কিভাবে?

সব শেষে প্রশ্নকর্তা নাস্তিক-মুক্তমনাবৃন্দের উদ্যেশ্যে বলতে চাইঃ আপনারা এহেন রেফারেন্স উল্লেখ করে {সেই সাথে অপ্রাসঙ্গিক ও বিকৃত ব্যাখ্যা করে} প্রশ্ন তুলেছেন কী করে ইসলাম সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত ধর্ম হতে পারে। আমার প্রশ্নঃ আপনারা কি আদৌ কোন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন? যে সৃষ্টিকর্তাকে আপনারা বিশ্বাসই করেন না, তখন কিভাবে আপনারা “সৃষ্টিকর্তার ধর্ম”র ব্যাপারে আস্তিকদের কাছে প্রশ্ন করেন? এটা কি কপটতা নয়? আর সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত ধর্ম কীরকম হওয়া উচিত বলে আপনারা মনে করেন? আপনাদের কি কোন প্রস্তাবনা আছে? আপনারা কি আসলেই স্রষ্টায় অবিশ্বাস করেন, নাকি নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ(বা উপাসনা) করে নিজেদের মনমত স্রষ্টার কল্পনা করেন?

“তুমি কি তাকে দেখো না, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি তুমি তার যিম্মাদার হবে?”
(কুরআন, ফুরকান ২৫:৪৩)

মুহাম্মাদ(স) কি সন্তান জন্মে নারীর ভূমিকার ব্যাপারে অজ্ঞ ছিলেন?

নাস্তিক প্রশ্ন: কুরআন বার বার উল্লেখ হয়েছে পুরুষের নির্গত বীর্য থেকে সন্তানের জন্ম হয় (Quran 86:5-6, 76:2, 23:13-14, 53:45-46, 80:19, 2:223) ! কিন্তু স্ত্রীর ডিম্বাণুর যে ভুমিকা সে ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি! এটা কি মুহাম্মাদের(স) অজ্ঞতা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে? [নাউযুবিল্লাহ, নাসতাগফিরুল্লাহ]

উত্তরঃ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ
إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنسَانَ مِن نُّطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَّبْتَلِيهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا
অর্থঃ আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সংমিশ্রিত শুক্রবিন্দু থেকে, তাকে আমি পরীক্ষা করব এইজন্য তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন।
(কুরআন, দাহর(ইনসান) ৭৬:২)

উপরের আয়াতে نُّطْفَةٍ أَمْشَاجٍ বা “সংমিশ্রিত শুক্রবিন্দু” দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে? প্রাচীন তাফসিরকারকরা কিভাবে কুরআনের এই আরবি বুঝতেন? তাঁরা কি এই আয়াতের ক্ষেত্রে এটা বুঝতেন যে – মানবসৃষ্টিতে নারীর ডিম্বাণুর কোন ভূমিকাই নেই যেমনটি অভিযোগকারীরা দাবি করে থাকে? চলুন দেখি।
.
ইমাম তাবারী(র) কুরআনের সব থেকে প্রাচীন তাফসিরকারকদের একজন।
সুরা দাহরের ৭৬নং আয়াতের তাফসিরে ইমাম তাবারী(র) বলেনঃ

আল্লাহ মানুষকে এমন অবস্থায় সৃষ্টি করেছেন যে তার নিকৃষ্টতা ও দুর্বলতার কারণে সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না।তিনি তাকে পুরুষ ও নারীর মিলিত শুক্রের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন এবং বিভিন্ন অবস্থায় পরিবর্তিত করার পর তাকে বর্তমান রূপ ও আকৃতি দান করেছেন।
(তাবারী ২৪/৮৯)
[সূত্রঃ তাফসির ইবন কাসির(হুসাইন আল মাদানী প্রকাশনী, মার্চ ২০১৪ সংস্করণ), ৮ম খণ্ড, সুরা দাহর(ইনসান) এর ২নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৬৮৫]

 

এখানে নর ও নারীর মিশ্র বীর্য বোঝানো হয়েছে।অর্থাৎ মানুষের সৃষ্টি পুরুষ ও নারীর দু’টি আলাদা বীর্য দ্বারা হয়নি {অর্থাৎ আলাদা আলাদাভাবে ২টি বীর্য থেকে হয়নি}। বরং দু’টি বীর্য সংমিশ্রিত হয়ে যখন একটি হয়ে গিয়েছে, তখন সে সংমিশ্রিত বীর্য থেকে মানুষের সৃষ্টি হয়েছে।এটিই অধিকাংশ তাফসিরকারকের মত।
[বাগভী, কুরতুবী, ইবন কাসির,ফাতহুল কাদির]
[সূত্রঃ কুরআনুল কারীম(বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির), ড.আবু বকর জাকারিয়া, ২য় খণ্ড, সুরা দাহরের ২নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ২৭৩৭-২৭৩৮]

এখানে আমরা বেশ কয়েকজন প্রাচীন তাফসিরকারকের মতামত দেখলাম। তাঁরা সকলেই এই আয়াতে نُّطْفَةٍ أَمْشَاجٍ বা “সংমিশ্রিত শুক্রবিন্দু” দ্বারা এটা বুঝতেন যে পুরুষ ও নারীর মিলিত বীর্য থেকে মানবসৃষ্টির সূচনা হয়। অভিযোগকারীরা এরিস্টল, গ্যালেনের অভিমত ও প্রাচীন ভারতীয় ভ্রূণবিদ্যার কথা উল্লেখ করেন এবং বলেন যে কুরআনে মানবসৃষ্টিতে নারীর ডিম্বাণুর ভূমিকা উল্লেখ করা হয়নি।অথচ আমরা দেখছি যে কুরআনের প্রাচীন তাফসিরকারকরা মোটেও প্রাচীন ভ্রূণবিদ্যার ভুল তত্ত্বগুলোর ন্যায় ডিম্বাণুর কথা অস্বীকার করেননি বরং কুরআনের আলোচ্য আয়াত দ্বারা এটাই বুঝেছেন যে নারী ও পুরুষের সংমিশ্রিত বীর্য থেকে মানবসৃষ্টির সূচনা হয়, অর্থাৎ মানবসৃষ্টিতে পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বাণু উভয়েরই ভূমিকা রয়েছে।

অভিযোগকারীরা দাবি করেন মানবসৃষ্টিতে স্ত্রীর ডিম্বাণুর ভুমিকার ব্যাপারে নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) নাকি অজ্ঞ ছিলেন।আমরা বলব—মুহাম্মাদ(ﷺ) অজ্ঞ ছিলেন না, বরং অভিযোগকারীরাই অজ্ঞ।

মুসাদ্দাদ (র) ……… উম্মে সালামা (রা) থেকে বর্ণিত যে, উম্মে সুলায়ম (রা) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)! আল্লাহ সত্য প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করেন না । মেয়েদের স্বপ্নদোষ হলে কি তাদের উপর গোসল ফরয হবে ? তিনি বললেন, হ্যাঁ। যখন সে বীর্য দেখতে পারবে।
এ কথা শুনে উম্মে সালামা (রা) হাসলেন এবং বললেন, মেয়েদের কি স্বপ্নদোষ হয় ?
তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তা না হলে সন্তান তার সদৃশ হয় কিভাবে।
[সহীহ বুখারী, অধ্যায়: নবী ও রাসুলগন | অনুচ্ছেদ: আদম (আ) ও তাঁর সন্তানাদির সৃষ্টি; হাদিস : ৩৩২৮]
আরেকটি বর্ণণায় আছে, রাসূলুল্লাহ্‌ (ﷺ) বললেনঃ (তা না হলে) তাঁর সন্তান তাঁর আকৃতি পায় কিরূপে? [সহীহ বুখারী,অধ্যায়: ইলম | অনুচ্ছেদ: ‘ইলম শিক্ষা করতে লজ্জাবোধ করা’; হাদিস : ১৩০]

আলোচ্য হাদিসগুলোতে আমরা দেখছি যে নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে মানবশিশুর জন্মের ব্যাপারে নারীর ভূমিকার কথা বলছেন।

এছাড়া কুরআনে আরো বিভিন্ন জায়গায় মানবসৃষ্টির প্রক্রিয়া আলোচনা করা হয়েছে এবং শুক্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সেসব জায়গায় ডিম্বাণুর কথা সরাসরি না এলেও মোটেও ডিম্বাণুর কথা অস্বীকার করা হয়নি। “চিনি থেকে সরবত তৈরি হয়”—এই কথা বলার অর্থ এই নয় যে সরবত তৈরিতে পানির ভূমিকা অস্বীকার করা হচ্ছে।

প্রস্রাবের পর হাঁটাহাঁটি করার হুকুম কি?

প্রস্রাবের পর ঢিলা বা টিস্যু ব্যবহার ও তা নিয়ে হাটাহাটি করার হুকুম কি?

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

ইস্তিঞ্জা দ্বারা মূল উদ্দেশ্য হল নাপাক পরিস্কার হওয়া। যেভাবে তা পরিপূর্ণ পরিস্কার হয় সেভাবেই তা পরিস্কার করা উচিত। আর এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে পেশাবের ফোটা যেন শরীরে না লাগে। কারণ হাদীসে এসেছে অধিকাংশ মানুষের কবরের আজাব হয়ে থাকে পেশাবের ফোটার কারণে।

সেই হিসেবে যেহেতু পানির দ্বারা নাপাক বেশি পরিস্কার হয়, তাই পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা সুন্নত। আর ঢিলা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা জায়েজ। {তিরমিজী-১/২৯, মুসতাদরাকে হাকেম-১/১৫৫, হেদায়া-১/৪৮, শরহে নুকায়া-১/৪৮, শরহে বেকায়া-১২৭}

عَطَاءُ بْنُ أَبِي مَيْمُونَةَ قَالَ: سَمِعْتُ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ، يَقُولُ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «إِذَا خَرَجَ لِحَاجَتِهِ، أَجِيءُ أَنَا وَغُلاَمٌ، مَعَنَا إِدَاوَةٌ مِنْ مَاءٍ، يَعْنِي يَسْتَنْجِي بِهِ»

আতা বিন আবী মাইমুনা বলেন, আমি শুনেছি আনাস বিন মালিক রাঃ বলেছেন, রাসূল সাঃ যখন প্রয়োজন সম্পন্ন [টয়লেটে যাবার জন্য] করার জন্য বের হতেন, তখন আমি ও আরেক ছেলে আসতাম। আমাদের সাথে পানির পাত্র থাকতো। অর্থাৎ এ দিয়ে রাসূল সাঃ ইস্তিঞ্জা করতেন। {বুখারী, হাদীস নং-১৫০}

হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-

وَمَنْ اسْتَجْمَرَ فَلْيُوتِرْ، مَنْ فَعَلَ فَقَدْ أَحْسَنَ، وَمَنْ لَا فَلَا حَرَجَ،

যে ব্যক্তি ঢিলা ব্যবহার করে সে যেন বেজোড় ব্যবহার করে। যে তা করবে সে উত্তম কাজ করল, আর যে করেনি তাতে কোন সমস্যা নেই। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৩৫}

ঢিলা হাতে হাটাহাটি করা

আসলে ঢিলা হাতে হাটাহাটি করা জরুরী বিষয় নয়। এটি দেখতেও সুন্দর দেখায় না। কিন্তু ইস্তিঞ্জার ক্ষেত্রে আবশ্যক হল পেশাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। এটি আবশ্যকীয়।

ভাল করে বুঝে নেই। ঢিলা হাতে হাটাহাটি কোন জরুরী বিষয় বা সুন্নত নয়। কিন্তু পেশাবের ফোটা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা আবশ্যকীয় বিষয়। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এ বিষয়ে আমরা দু’টি হাদীস লক্ষ্য করি-

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: مَرَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِقَبْرَيْنِ، فَقَالَ: ” إِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ، وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ، أَمَّا أَحَدُهُمَا: فَكَانَ لَا يَسْتَنْزِهُ مِنَ البَوْلِ – قَالَ وَكِيعٌ: مِنْ بَوْلِهِ – وَأَمَّا الْآخَرُ: فَكَانَ يَمْشِي بِالنَّمِيمَةِ “.

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূল সাঃ দু’টি কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম হচ্ছিলেন। বললেন, এ দু’টি কবরে আযাব হচ্ছে। কোন বড় কারণে আজাব হচ্ছে না। একজনের কবরে আজাব হচ্ছে সে পেশাব থেকে ভাল করে ইস্তিঞ্জা করতো না। আরেকজন চোগোলখুরী করতো। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৯৮০, বুখারী, হাদীস নং-১৩৬১}

عَنْ عِيسَى بْنِ يَزْدَادَ الْيَمَانِيِّ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِذَا بَالَ أَحَدُكُمْ فَلْيَنْتُرْ ذَكَرَهُ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ»

হযরত ঈসাব বিন ইয়াযদাদ আলইয়ামানী তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যখন তোমাদের কেউ পেশাব করে, তখন সে যেন তার লজ্জাস্থানকে তিনবার ঝেড়ে নেয় বা পবিত্র করে নেয়। {সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৩২৬}

যেহেতু পেশাব এমন বস্তু। যার ছিটা শরীরে লাগলে কবরের আযাব হয়ে থাকে। আর হাদীসেও লজ্জাস্থানকে ঝেড়ে পবিত্র করার কথা এসেছে। তাই যাদের পেশাব করার পর পেশাবের ছিটা ফোটা ফোটা করে পড়ে, তাদের উচিত কিছুক্ষণ হেটে তা পবিত্র করা। নতুবা পেশাবের ছিটা শরীরে লাগার দরূন মারাত্মক গোনাহ হবে। যা কবরের আযাবের কারণ হবে। সেই সাথে কাপড় থাকবে নাপাক। আর নাপাক কাপড় দিয়ে নামায হয় না।

এ দৃষ্টিকোণ থেকে যাদের পেশাবের ফোটা পেশাব শেষ করার পর পড়ে না। তাদের পানি দিয়ে ইস্তিঞ্জা করলেই যথেষ্ট। কিন্তু যাদের বের হয় তাদের কবরের আযাব থেকে রক্ষা পাবার আশায় কিছুক্ষণ হেটে হলেও তা থেকে পবিত্রতা অর্জন করে নেয়া জরুরী।

والله اعلم بالصواب

কুরআনে কি অসম্পূর্ণ পানিচক্রের বিবরণ আছে ?

কুরআনে পানিচক্র………………

নাস্তিক প্রশ্ন: কুরআনের প্রতিটা আয়াত (Quran 7:57, 13:17, 15:22, 23:18, 24:43, 25:48-49, 30:24, 30:48, 35:9, 39:21, 45:5, 50:9-11, 56:68, 78:14-15) নির্দেশ করে, বৃষ্টিপাত হয় সরাসরি আকাশ থেকে নয়তো আল্লাহ থেকে! সূর্যতাপে পানি বাষ্প হয়ে ঊর্ধ্বাকাশে ঘনিভূত হয়ে যে মেঘ ও পরবর্তীতে বৃষ্টি তৈরি হয় তা কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে! এর থেকে কি কুরানের রচয়িতার অজ্ঞতা প্রকাশিত হয় না?

উত্তরঃ পানিচক্রের ধাপগুলো হচ্ছে—

১) বাষ্পীভবন
২)মেঘ উপন্ন হওয়া
৩)বৃষ্টিপাত হওয়া
৪) বৃষ্টির পানি ভূমিতে আসা ও ভূমি কর্তৃক এই পানি ধারণ

এরপর আবার প্রথম থেকে প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি হয়। এভাবে প্রক্রিয়াগুলোর চক্রাকারে পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে পানিচক্র চলতে থাকে। অভিযোগকারীরা বলেছেন যেঃ পানি বাষ্প হয়ে ঊর্ধ্বাকাশে ঘনীভুত হয়ে যে মেঘ ও পরবর্তীতে বৃষ্টি তৈরি হয় তা কুরআনে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। চলুন দেখি তাদের অভিযোগ কতটুকু সত্য।

আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু পরিচালনা করি অতঃপর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি, এরপর তোমাদেরকে তা পান করাই। বস্তুতঃ তোমাদের কাছে এর ভাণ্ডার নেই।(কুরআন, হিজর ১৫:২২)

——–>>> আলোচ্য আয়াতে বৃষ্টিপাতের পূর্বে “বৃষ্টিগর্ভ বায়ু” পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এমন বায়ু যা বৃষ্টিকে ধারণ করে। এটি নিঃসন্দেহে বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ার নির্দেশক।

অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছেঃ
“শপথ আসমানের, যা ধারণ করে বৃষ্টি।” (কুরআন, তারিক ৮৬:১১)

এই আয়াতের তাফসিরে ইমাম শাওকানী(র) এর ‘ফাতহুল কাদির’ গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ “বৃষ্টিকে প্রত্যাবর্তনকারী বলার আর একটি কারণ এটাও হতে পারে পৃথিবীর সমুদ্রগুলো থেকে পানি বাষ্পের আকারে উঠে যায়। আবার এই বাষ্পই পানির আকারে পৃথিবীতে বর্ষিত হয়।”
[সূত্রঃ কুরআনুল কারীম(বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির), ড.আবু বকর জাকারিয়া, ২য় খণ্ড, সুরা তারিকের ১১নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ২৮০৭]

পানিচক্রে বাষ্পীভবনের পরবর্তী ধাপ হচ্ছে তা থেকে মেঘ উৎপন্ন হওয়া। এরপর ঘনীভুত মেঘ থেকেবৃষ্টিপাত হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

“তিনিই বৃষ্টির পূর্বে সুসংবাদবাহী বায়ু পাঠিয়ে দেন। এমনকি যখন বায়ুরাশি পানিপূর্ন মেঘমালা বয়ে আনে, তখন আমি এ মেঘমালাকে মৃত শহরের দিকে হাঁকিয়ে দেই। অতঃপর এ মেঘ থেকে বৃষ্টিধারা বর্ষণ করি। অতঃপর পানি দ্বারা সব রকমের ফল উৎপন্ন করি। এমনি ভাবে মৃতদেরকে বের করব – যাতে তোমরা চিন্তা কর।”
(কুরআন, আ’রাফ ৭:৫৭)

“আল্লাহই বায়ু প্রেরণ করেন, অতঃপর সে বায়ু মেঘমালা সঞ্চারিত করে। অতঃপর আমি তা মৃত ভূখণ্ডের দিকে পরিচালিত করি। অতঃপর এর দ্বারা সে ভূখণ্ডকে তার মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করে দেই। এমনিভাবে হবে পুনরুত্থান।” (কুরআন, ফাতির ৩৫:৯)

আয়াতে বলা হচ্ছে -‘সুসংবাদবাহী’ বায়ু মেঘমালা সঞ্চারিত করে পানিচক্রের ২য় ধাপ মেঘ উৎপন্ন হওয়ার ব্যাপারেও কুরআন এভাবে আলোচনা করেছে। শুধু তাই নয়, মেঘ উৎপন্ন হওয়া, শিলা তৈরি ও বৃষ্টিপাতের ব্যাপারে কুরআন এমন অসামান্য সব তথ্য দিয়েছে যা সম্পর্কে দেড় হাজার বছর আগের বিজ্ঞান ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

“তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন, অতঃপর তাকে পুঞ্জীভূত করেন, অতঃপর তাকে স্তরে স্তরে রাখেন; অতঃপর তুমি দেখ যে, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। আর তিনি আকাশস্থিত শিলাস্তূপ থেকে শিলা বর্ষণ করেন। এবং তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা সরিয়ে দেন। তার বিদ্যুৎঝলক যেন তার দৃষ্টিশক্তিকে বিলীন করে দিতে চায়।”
(কুরআন, নুর ২৪:৪৩)

আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে যে—ছোট মেঘখণ্ডকে বাতাস যখন ধাক্কা দেয় তখন Cumulonimbus বা “বৃষ্টিবাহী মেঘপুঞ্জ” নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে তৈরি হতে শুরু করে।ছোট ছোট মেঘখণ্ড একসাথে মিলিত হয়ে বড় মেঘমালায় পরিণত হয়। [১]

যখন ছোট ছোট মেঘখণ্ড একত্রে মিলিত হয় তখন তা উঁচু হয়ে যায়। উড্ডয়মান বাতাসের গতি মেঘের আকার বৃদ্ধি করে মেঘকে স্তূপীকৃত করতে সাহায্য করে। এই মেঘের ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে মেঘটি বায়ুমণ্ডলের অধিকতর ঠাণ্ডা স্থানের দিকে বিস্তৃতি লাভ করে সেখানে পানির ফোটা ও বরফের সৃষ্টি করে এবং তা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। এরপর যখনই এগুলো অধিক ওজন বিশিষ্ট হয়ে যায় তখন বাতাস আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে, মেঘমালা থেকে তা বৃষ্টি ও শিলা হিসেবে বর্ষিত হয়। [২] মহাকাশ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, cumulonimbus তথা বৃষ্টিবাহী মেঘপুঞ্জ, যা থেকে শিলা-বৃষ্টি বর্ষিত হয়— তার উচ্চতা ২৫০০০ থেকে ৩০০০০ ফুট (৪.৭ থেকে ৫.৭ মাইল) পর্যন্ত হয়ে থাকে। [৩] তাকে পাহাড়ের মতই দেখায় যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজিদে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ বলেন: ﴿وَيُنَزِّلُ مِنَ السَّمَاءِ مِنْ جِبَالٍ﴾ অর্থাৎ “আর তিনি আকাশস্থিত পাহাড় (শিলাস্তূপ) থেকে শিলা বর্ষণ করেন।”

মেঘ উৎপন্ন হওয়া ও বৃষ্টিপাত—পানিচক্রের এই দু’টি ধাপ আমরা কুরআন থেকে দেখলাম।বৃষ্টির পানি ভূমিতে আসা ও ভূমি কর্তৃক এই পানি ধারণ সম্পর্কে কুরআন যা বলে—

“আমি[আল্লাহ] আকাশথেকে পানি বর্ষণ করে থাকি পরিমিতভাবে; অতঃপর আমি তা মাটিতে সংরক্ষণ করি এবং আমি তা অপসারণও করতে সক্ষম।”
(কুরআন, মু’মিনুন ২৩:১৮)

“তিনি তোমাদের জন্যে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন। এই পানি থেকে তোমরা পান কর এবং এ থেকেই উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়, যাতে তোমরা পশুচারণ কর।”
(কুরআন, নাহল ১৬:১০)

তুমি কি দেখোনি যে আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, অতঃপর সে পানি যমীনের ঝর্ণাসমূহে প্রবাহিত করেছেন, এরপর তদ্দ্বারা বিভিন্ন রঙের ফসল উৎপন্ন করেন, অতঃপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তোমরা তা পীতবর্ণ দেখতে পাও। এরপর আল্লাহ তাকে খড়-কুটায় পরিণত করে দেন। নিশ্চয় এতে বুদ্ধিমানদের জন্যে (কুরআন, যুমার ৩৯:২১)

“তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত করেন। ফলে উপত্যকাসমূহ তাদের পরিমাণ অনুযায়ী প্লাবিত হয় এবং প্লাবন তার উপরের আবর্জনা বহন করে। এরূপে আবর্জনা উপরে আসে যখন অলঙ্কার বা তৈজসপত্র নির্মাণের উদ্যেশ্যে কিছুকে আগুনে উত্তপ্ত করা হয়। এভাবে আল্লাহ সত্য ও অসত্যের দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকেন। যা আবর্জনা তা ফেলে দেয়া হয় এবং যা মানুষের উপকারে আসে তা জমিতে থেকে যায়। এভাবে আল্লাহ উপমা দিয়ে থাকেন।”
(কুরআন, রা’দ ১৩:১৭)

কুরআনের আয়াতগুলো থেকে আমরা দেখতে পেলাম যে পানিচক্রের সবগুলো ধাপই অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। অতএব যারা দাবি করে কুরআনে অসম্পূর্ণ পানিচক্র বর্ণণা করা হয়েছে, তাদের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হল। সপ্তম শতকের মানুষ তাদের উপযোগী শব্দমালা থেকে এই আয়াতগুলো থেকে জ্ঞানলাভ করেছে; বর্তমান যুগের বিজ্ঞান জানা মানুষ দেড় হাজার বছর আগের একটি গ্রন্থে পানিচক্রের এমন বিবরণ দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে কুরআনের অসাধারাণত্ব স্বীকার করে নিচ্ছে।

‘বিজ্ঞানমনষ্ক’(?) হবার দাবিদার কুরআন-বিরোধীদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, সপ্তম শতাব্দীতে যখন কুরআন নাযিল হয়, তখন পানিচক্র নিয়ে মানুষের নানা ভ্রান্ত ধারণা ছিল। এ বিষয়ে ২জন বিশেষজ্ঞ জি গাসটানী ও বি ব্লাভোক্স বিশ্বকোষে (ইউনিভার্সালিস এনসাইক্লোপিডিয়া) প্রাচীনকালের পানিচক্র বিষয়ক মতবাদগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন।
তারা বলেছেন – প্লেটো বিশ্বাস করতেন যে মাটির নিচে কোন গভীর সুরঙ্গপথ(টারটারাস) দিয়ে পানি মাটির নিচ থেকে সাগরে ফিরে যায়।অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এ মতবাদের অনেক সমর্থক ছিলেন এবং তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন ডেসকার্টেস। এরিস্টোটল মনে করতেন যে, মাটির নিচের পানি বাষ্প হয়ে পাহাড়ী এলাকার ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে ভূগর্ভে হ্রদ সৃষ্টি করে থাকে এবং সেই পানিই ঝর্ণার আকারে প্রবাহিত হয়ে থাকে। এ মতবাদ সেনেকা(১ম শতাব্দী) ও ভলগার এবং আরো অনেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত পোষণ করতেন। ১৫৮০ সালে বার্নার্ড পালিসি পানির গতিচক্র সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা গঠন করেন। তিনি বলেন যে, মাটির নিচে যে পানি আছে তা উপর থেকে বৃষ্টির পানি চুঁইয়ে আসা। সপ্তদশ শতকে ম্যারিওট এবং পি পেরোন্ট এ মতবাদ সমর্থন ও অনুমোদন করেন।
আল কুরআনে বর্ণিত আয়াতগুলোতে মুহাম্মাদ (ﷺ) এর সময়ে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাগুলোর লেশমাত্রও নেই।


এটা পড়ুন-  ব্ল্যাকহোল ! কুরআন ও সাইন্স কি পরস্পর বিরোধী ?

তথ্যসূত্রঃ

[১] দেখুন, The Atmosphere, Anthes and others, p. 268-269, এবং Elements of Meteorology, Miller, and Thompson, p. 141.
[২] দেখুন, The Atmosphere, Anthes and others, p. 269, এবং Elements of Meteorology, Miller and Thompson, pp. 141-142.
[৩] Elements of Meteorology, Miller, and Thompson, p. 141.

আরও দেখুন – Ahle Haq media

প্রবৃত্তি

প্রচন্ড সংঘর্ষ চলছে। ঈমান আর কুফরের সংঘর্ষ। আদর্শের চিরন্তন দ্বন্দ্বে আরেকবার রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে ময়দান। এবার উহুদের ময়দান।
শত্রুর সংখ্যাধিক্য বা নিজেদের সরঞ্জামাদির দৈন্যতা মুমিনদের টলায় না, তাদের নেতৃত্বে যে আছেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ মুহাম্মাদ ﷺ । তাছাড়া এর আগেও বদরে সংখ্যালঘু তো তাঁরাই ছিলেন, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তবুও এসেছিল বিজয়। তরবারির ঝনঝনানি বিদীর্ণ করছে মরুর বুক, ঢেলে দিচ্ছে তাজা রক্ত। এমন সময় হঠাৎ…
হঠাতই খবর এল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে ﷺ শহীদ করে দিয়েছে কাফির-মুশরিকরা! যুদ্ধের ময়দানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের এক চরম মুহুর্ত, এমন সময়ই কিনা তিনি ﷺ চলে গেলেন!!… এখন কী হবে?
মুহুর্তেই মনোবল ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল অধিকাংশ মুসলিমের। বিষাদের মেঘ অন্ধকারে ছেয়ে ফেলল তাঁদের মনের আকাশগুলো।
“আর মুহাম্মাদ ﷺ তো একজন রাসূল বৈ কিছু নন! তাঁর পূর্বেও অতিবাহিত হয়ে গেছেন বহু সংখ্যক রাসূল…” কিছুক্ষণ আগে এই কথাগুলোই আওড়াতে আওড়াতে মুশরিকদের হাতে শহীদ হয়ে যান মুসআব ইবন উমাইর (রদিআল্লাহু আ’নহু)। একই সময় পাশেই ঘেরাও হয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহও ﷺ। তাতেই গুজব রটে যায় যে মুহাম্মাদ ﷺ শহীদ হয়ে গিয়েছেন। সেই গুজব ধূলিস্যাৎ হয়ে পরিস্থিতি যখন রাসূলুল্লাহর ﷺ নিয়ন্ত্রণে এল, তখন তিনভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন সাহাবাগণ।
একদল হতাশার যন্ত্রণায় অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছে, একদল গিয়ে অবস্থান নিয়েছে মুনাফিকদের সাথে। আর শেষদল থেকেছে অটল, চালিয়ে গিয়েছে যুদ্ধ।
‘আল্লাহর নবী মৃত্যুবরণ করে থাকলে তিনি তাঁর দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। তিনি যে উদ্দেশ্যে প্রাণ দিলেন, সেই একই উদ্দেশ্যে আমৃত্যু লড়তে থাকব… ’ এই উপলব্ধিতেই নিজেদের পর্বতসম অটল, অবিচল রেখেছিল সেই ক্ষুদ্র দল। সেসময় এই ক্ষুদ্রদলের সমর্থনেই মুসআব ইবনে উমাইরের কথাগুলো পূর্ণ করে আয়াতস্বরূপ নাযিল করে দিলেন স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন। আর কিয়ামত পর্যন্ত কথাগুলো বিশ্বাসীদের শিক্ষাস্বরূপ স্থান করে নিল শেষ আসমানি কিতাব আল-কুরআনে।
“আর মুহাম্মাদ একজন রাসূল বৈ কিছু নন। তাঁর পূর্বেও অতিবাহিত হয়ে গিয়েছেন বহু সংখ্যক রাসূল। অতএব তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন, তবে কি তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে?…” (সূরা আল-ইমরান, ১৪৪)
যে মানবীয় দুর্বলতা নিয়ে আজ লিখছি তা এতই মারাত্নক যে একজন মানুষের বিশ্বাস-আদর্শ সব তছনছ করে দিয়ে ওপারের অনন্তকে নিঃস্ব করে দিতে পারে অনায়াসেই। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হল – এই দুর্বলতা এতই সহজাত, এতই নীরব ঘাতক যে বহু মানুষকে তা যুগের পর যুগ বিভ্রান্ত করেছে, এখনও করে চলেছে। আর মানুষের প্রকৃত সফলতা – তার রব্বের সন্তুষ্টি – থেকে করেছে বঞ্চিত। লিখাটি পড়ার পর যেই কারণে দ্বিমত সৃষ্টি হয়ে যাবে… সেই কারণও হল ঐ একই মানবীয় দুর্বলতা। আল্লাহ আমাদের জন্য সহজ করুন।
আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন মানুষকে নানাভাবে হিদায়াত দেন। নিজের রব্বের সন্তুষ্টির জন্য, অনন্তের কল্যাণের জন্য বান্দা ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ এ চলার গুরুত্ব উপলব্ধি করে। সেই উপলব্ধি তাকে কঠিন কিন্তু সরল এই সিরাতুল মুস্তাকিমেই সারাজীবন হাঁটার অনুপ্রেরণা যোগায়। দ্বীনের প্রতি প্রথম এমন ভালবাসা সৃষ্টি হল প্রাথমিক হিদায়াত। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন রকম ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় এই ভালবাসা – যা বান্দার অন্তরের ইখলাস থেকে লালিত আল্লাহর এক বিশেষ নিআমত।।
সিরাতুল মুস্তাকিমের গুরুত্ব উপলব্ধির পর একজন বান্দা যখন সেপথে হাঁটতে চায়, তখন তার আবশ্যক হয় কিছু পাথেয়। সেসব পাথেয়গুলোর প্রথম সারিতে থাকে প্রাথমিক ই’লম, দ্বীনদার সঙ্গী, নিয়মিত নাসীহা বা রিমাইন্ডার প্রভৃতি। আর প্রায় সবসময়ই যাদের মাধ্যমে দ্বীনকে গুরুত্ব দেওয়ার শুরু হয়, তাদের কেন্দ্র করেই অন্য বিষোয়গুলো অর্থাৎ প্রাথমিক ই’লম, নাসীহা, দ্বীনি আলোচনা ইত্যাদি আবর্তিত হয়ে থাকে। এছাড়া প্রাথমিক ই’লমের জন্য কোন আলেমদের বই পড়া হবে, কোন আলেমদের লেকচার শোনা ইত্যাদিও হয় নিজেদের সার্কেলভিত্তিক।
আর জাহিলিয়াত ত্যাগ করে নিজের এক নতুন জীবন গঠনের এই পর্যায়ে এসে অধিকাংশই এক সহজাত মানবীয় দুর্বলতার ধোঁকা খেতে শুরু করে, যা কারও কারও স্থায়ী হয়ে যায় সারাজীবন। একই ধোঁকা; শুধু সময়ে সময়ে রূপের, মাত্রার, আচরণের বিভিন্নতা থাকে সেখানে। সে ধোঁকার নাম নাফস, খায়েশাত বা প্রবৃত্তির ধোঁকা।
একমাত্র ‘আল্লাহর রাহে’ ‘আল্লাহর দ্বীন’ পালন না করে কোন ‘প্রবৃত্তিজাত কারণে’ ‘প্রবৃত্তি উৎসরিত’ মনগড়া বা নিজ সার্কেলের দ্বীন পালন করা।

এক.

মানুষের নানাকারণে কারও জন্য ভাললাগা সৃষ্টি হতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে অগাধ ভক্তি। কারও ভাল আচরণ, জীবনঘনিষ্ঠ কোনো লিখা বা বই, আবেগঘন কথাবার্তা বা লেকচার ইত্যাদি বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা গড়ে তোলে। এমনকি জাহিল গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমার যেগুলো জীবনঘনিষ্ঠ বা আবেগসৃষ্টিকারী হয়, সেগুলোর লেখক-নির্মাতাদের প্রতি সাধারণের ভাললাগা তৈরি হতে দেখা যায়। প্রবৃত্তির এই সহজাত বিষয়টিই উপলব্ধির বাহিরে চলে যায় যখন তা দ্বীনকেন্দ্রিক হয়। অর্থাৎ,যখন কোনো দাঈ’ বা আলেমের জীবনঘনিষ্ঠ বা আবেগঘন কোনো লেকচার বা বই পড়ে সেই অনুভূতিতাড়িত ভক্তি ‘আল্লাহর রাহে’,‘আল্লাহর দ্বীনের রাহে’-র নিয়্যাতকে ছাপিয়ে যায়, তখন তা খেয়াল রাখা বাস্তবিকই কষ্টকর হয়ে পড়ে।
যখন কথাবার্তায় আল্লাহ সুবহানাহু, আখিরাত, সাহাবাদের ঈমানদীপ্ত কোনো ঘটনা থাকে তখন এই ব্যক্তি দ্বীনি বিষয়াদিতে ভুল করতে পারেন না বা জেনেশুনে দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ আরও বিষয়াদি গোপন করতে পারেন না এমনসব চিন্তা মনে জেঁকে বসে অবচেতনভাবেই। কোনো নির্দিষ্ট দল বা মানহাজের অন্ধপ্রীতি শুরু হয় প্রবৃত্তির এমনসব অবচেতন অনুসরণ থেকেই। অথচ এমন হতেই পারে যে যাদের থেকে দ্বীন গ্রহণ করা হচ্ছে তারা দ্বীনের প্রাথমিক, ব্যক্তিগত ইবাদাত আর তাযকিয়্যাহর মত বিষয়ে জীবনঘনিষ্ঠ কথাবার্তা বললেও তাগুত বর্জন, ওয়াজিব তাকফির, হারাম তাকফিরের মত অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ন্যুনতম সঠিক আকিদাহই পোষণ করেন না, হারাম তাকফির করা খুরুজদের সাথে ওয়াজিব তাকফির করা মুজাহিদিনদের তালগোল বাঁধিয়ে ফেলেন। এবং বাস্তবতা এটাই যে বেশিরভাগ দাঈ আলেম ও সাধারণ দাঈরা স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধাহীনতার স্বার্থে, বিপদহীনতার রাহে এইসমস্ত স্পর্শকাতর বিষয়ে সালাফদের মানহাজের সম্পূর্ণ উল্টো অবস্থান নিয়ে নেন।
কিন্তু বান্দার সমস্যা হল, এমনসব গর্হিত বিচ্যুতি দেখার পরও ঐ যে কিছু কথা বান্দাকে আবেগতাড়িত করেছিল আর সেকারণে অন্ধভক্তি জন্মিয়েছিল তা থেকে সে অন্ধ অনুসরণও শুরু করে দেয়। তখন আর খেয়াল থাকে না যে রাসূলুল্লাহ ﷺ উলামাদেরকে নবী রাসূলগণের উত্তরাধিকারী যেমন বলেছেন, তেমনি উম্মাতের জন্য উলামায়ে সু’ আর দরবারি উলামাদের দাজ্জালের ফিতনাহ থেকেও বেশি ভয় করেছেন। তাই আবেগ অনুভূতির মত প্রবৃত্তিজাত অনুসরণ থেকে বেঁচে থেকে কেবলমাত্র আল্লাহর রাহেই কাউকে অনুসরণের নাসীহাস্বরূপ আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন নাযিল করেছিলেন আয়াত, “আর মুহাম্মাদ একজন রাসূল বৈ কিছু নন। তাঁর পূর্বেও অতিবাহিত হয়ে গিয়েছেন বহু সংখ্যক রাসূল। অতএব তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন, তবে কি তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে?…”
এই ব্যাপারটি এতই ভয়ঙ্কর যে একই আয়াতের প্রায় একই ধরনের আরেকটি প্রেক্ষাপট ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। আর তা হল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর ﷺ সত্যিই ওফাত হওয়ার পর চরম বেসামাল পরিস্থিতিতে আবু বকর (রদিআল্লাহু আ’নহু) এর মুখে আয়াতটির তিলাওয়াত। রাসূলুল্লাহর ﷺ মৃত্যুর পর অনেকে যখন মুষড়ে পড়েছিলেন, অনেকে যখন দ্বীন ত্যাগ করে ফেলছিলেন, এমনকি উমারও (রদিয়াল্লাহু আ’নহু) যখন আবেগতাড়িত হয়ে রাসূলের ﷺ মৃত্যুর বাস্তবতা মেনে নিতে পারছিলেন না, তখন সাহাবাদের ঐ একই আয়াত দিয়েই শান্ত করেছিলেন আবু বকর (রদিয়াল্লাহু আ’নহু)। কুরআনের হাফিজ হওয়া সত্ত্বেও তখন উমার (রদিয়াল্লাহু আ’নহু) বলেছিলেন, “যেন আয়াতটি আমি প্রথমবারের মত শুনছি!”
প্রকৃতপক্ষে মানুষের আখলাক, শব্দচয়ন, বলার ভঙ্গি ইত্যাদি অন্যদের স্বাভাবিকভাবেই আকৃষ্ট করে। আর আমাদের রাসূল ﷺ এসব মানবীয় গুণে ছিলেন অতুলনীয়, অনুকরণীয়, সমগ্র মানবজাতির আদর্শ। যে রাসূলের ﷺ আচরণে সাহাবারা সাধারণভাবেই মনে করে বসতেন যে তিনি ﷺ নিশ্চিতরূপে আমাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, সেই মানুষটির আচরণের নিদারুণ প্রভাব থাকাই স্বাভাবিক। আর রাসূলুল্লাহর ﷺ কথায়, আচরণে মুগ্ধ হয়ে দ্বীনে আসা থেকে শুরু করে কুস্তিতে হেরে গিয়ে পর্যন্তও দ্বীনে আসার নমুনা রয়েছে। কিন্তু জাহিলিয়্যাত থেকে দ্বীনে আসার বিভিন্ন কারণ থাকলেও তাতে অটল থাকা যেন অন্য কোনো প্রবৃত্তিজাত না হয়ে কেবল আল্লাহর রাহেই হয় সেকারণে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন উপরোক্ত আয়াতের প্রায় একই ধরনের দুই দুইটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা মু’মিনদের জন্য ইতিহাসে খোদাই করে দিলেন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহর ﷺ জন্য ভালবাসাও আল্লাহর গোলামি থেকে উৎসরিত হতে হবে, রাসূলুল্লাহর ﷺ প্রতি সহজাত প্রবৃত্তিজাত ভালবাসা থেকে আল্লাহর গোলামি চলবে না। খেয়াল করলে দেখা যায়, দ্বিতীয়টির বাড়াবাড়ি থেকে অনেক ভ্রান্ত ফিরকাও ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে।
তাহলে দ্বীনে প্রবেশের পর স্বয়ং রাসূলুল্লাহর ﷺ প্রতি সহজাত অনুভূতি থেকেও দ্বীন পালন যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে শরীয়াহ কায়েম, তাকফির ইত্যাদির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিচ্যুতির পরও নিজেদের পছন্দের উলামাদের জীবনঘনিষ্ঠ কথায় মুগ্ধ হয়ে, আবেগতাড়িত হয়ে সেইসব গোমরাহির মানহাজে শক্ত হয়ে জমে থাকা, নিজের দ্বীনে আসার সার্কেলের বা জামাতের কাটছাঁট করা দ্বীন পালন তো প্রবৃত্তির দাসত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। জাহিলিদের গানবাজনায় মজে থাকা, দুর্গাপূজা-ক্রিসমাসে সমারোহে একাত্নতা ঘোষণা, মাজারে গিয়ে শির্ক করে বেড়ানো ইত্যাদি যেমন প্রবৃত্তির দাসত্ব, তেমনি বাহ্যিক এসব জাহিলিয়াত ত্যাগ করে আসা দ্বীনদারদেরও উম্মতের এহেন পরিস্থিতিতে তাগুত বর্জন, আবশ্যক তাকফির, শরীয়াহ, কিতাল ইত্যাদির মত ফারজিয়্যাতে উদাসীনতা আর উদাসীন আলেম ও দাঈ’দের অন্ধ অনুসরণও প্রবৃত্তির আরেক প্রকার দাসত্ব। কিন্তু পার্থক্য হল, দ্বিতীয় প্রকারের মানুষ মনে করে যে তারা মিল্লাতু ইব্রাহিমে, সিরতল মুস্তাকিমে অটল রয়েছে। একারণে পরবর্তী এইপ্রকার প্রবৃত্তি-দাসত্ব এক নীরব ঘাতক, অতি মারাত্নক।
“আপনি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছেন, যে তার প্রবৃত্তিকে স্বীয় উপাস্য স্থির করেছে? আল্লাহ জেনেশুনেই তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তার কান ও অন্তরে মোহর এঁটে দিয়েছেন এবং তার চোখের উপর রেখেছেন পর্দা। অতএব, আল্লাহর পর কে তাকে পথ প্রদর্শন করবে? তোমরা কি চিন্তাভাবনা কর না?” (সূরা জাসিয়া, ২৩)

দুই.

অন্তরের আরেকটি সহজাত প্রবৃত্তি হল, মানুষ তা-ই বিশ্বাস করে যা সে বিশ্বাস করতে চায়; অধিকাংশ মানুষ সেই দলিলই গ্রহণ করে যা সে আগে থেকেই খুঁজে বেড়ায়। অন্তরের ইখলাস থেকে প্রমাণ আর দলিলাদি গ্রহণের মানসিকতা, নিজ মতের বিরুদ্ধে গেলেও সত্য মেনে নেওয়ার মানসিকতা খুব কম বান্দারই থাকে, অথচ অন্তরের এমন পবিত্রতা না থাকলে প্রবৃত্তির এইপ্রকার ধোঁকা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। কারণ সত্যান্বেষী ইখলাসের খবর একমাত্র আল্লাহই ভাল জানেন আর একমাত্র আল্লাহই পারেন বান্দার অন্তরের সেই ইখলাসের ভিত্তিতে তা সত্যের দিকে ঘুরিয়ে দিতে।
এই ব্যাপারটি এতই তাৎপর্যপূর্ণ যে, যতপ্রকার ইরজা আর গুলুহ রয়েছে তার সবই এই বিষয়ে বিচ্যুতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমনঃ সাহাবি আবু বাসিরের (রদিআল্লাহু আ’নহু) আক্রমণগুলোকে পূর্বের শত শত ইমাম আর সালাফগণ জিহাদ-ফি-সাবিলিল্লাহ বললেও একই ঘটনায় যুগের ব্যবধানে জিহাদ না হওয়ার আজব যুক্তিও চলে আসে, কাফির-মুশরিকদের আর স্থানীয় তাগুতদের ওয়াজিব তাকফিরের স্থানে নিষিদ্ধ তাকফিরের সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়, আবার বায়াহ না দিলে সবাইকে তাকফির আর মুজাহিদিন হত্যারও গোঁজামিল দলিল দেখা যায়। আসলে দ্বীনের এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর সহীহ জ্ঞানার্জন করে হক অবস্থান নেওয়ার নিয়্যাতে নয়, বরং আগে থেকেই নেওয়া নিজেদের অবস্থানের আর কাজের বৈধতার দলিল খুঁজতে গিয়েই সাহাবাদের আর সলফে-সলেহীনদের বোঝা দ্বীনের সম্পূর্ণ উল্টো, প্রবৃত্তি উৎসরিত এমনসব যুক্তিগুলোর উত্থান হয়। ফলে দলিলের যেই ব্যাখ্যা প্রবৃত্তিকে শান্ত করে সেটাই বান্দা গ্রহণ করে নেয়। কোনটা হক, কোনটা বাতিল তা নিয়ে অল্পই ভ্রূক্ষেপ করে।
আর মানুষ যে তা-ই বিশ্বাস করে যা সে বিশ্বাস করতে চায় – এই বিষয়টার ব্যাপকতাও একেবারে নাস্তিকতা থেকে দ্বীনদার সকল জায়গাতেই ব্যাপৃত। যেমনঃ নাস্তিক্য সিস্টেম নির্গত নাস্তিক্যবাদী বিজ্ঞানীরা জীবনের উৎপত্তি ব্যাখ্যায় ডারউইনিয়ান ইভল্যুশন থিউরি ব্যবহার করে থাকে। ইভোল্যুশন থিউরির বিরাট সব ছিদ্রের কথা বাদ দিলেও মহাবিশ্বের উৎপত্তি ব্যাখ্যাতেও সৃষ্টিকর্তা ছাড়াই ডারইউনিয়ান ব্যাখ্যার পথ খোঁজা হয় অর্থাৎ, মহাবিশ্ব নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়ে যাবার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাবার সদা চেষ্টা করা হয়। এই প্রয়াসে জন্ম হয়েছে মাল্টিভার্স থিউরির যেটায় হাল আমলের নাস্তিক্য মহল মাত্রই ‘বিশ্বাসী’ আর তারা আশাবাদী যে একসময় এই থিউরির পক্ষে প্রমাণাদি আসবে। অথচ সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের ‘প্রমাণ’ নেই বলে ফ্যানা তোলা হলেও এই মহাবিশ্ব ছাড়া অন্য মহাবিশ্ব প্রমাণ তো দূরের কথা, পর্যবেক্ষণও সম্ভব নয় সেদিকে আর মহামান্যদের নজর থাকে না। [১]
বনী ইসয়াঈলসহ পূর্ববর্তী কিতাবধারীদের এক জঘন্য সীমালঙ্ঘন ছিল কিতাববিকৃতির মাধ্যমে নিজেদের প্রবৃত্তিজাত দ্বীন বানিয়ে নেওয়া। কিন্তু কুরআনকে স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু কিছুদিন আগ পর্যন্তও ছিল জাল হাদিস বানাবার হিড়িক। এখন যদিও তা অনেকটা বন্ধ হয়েছে তবুও জঘন্য বিদআতিদের সহীহ হাদিস বাদ দিয়ে দুর্বল, অতি দুর্বল আর একেবারে জাল হাদিসও আমল থেমে থাকে নি। এগুলো প্রবৃত্তির অনুসরণের উদাহরণ। কিন্তু আরও একপ্রকার দ্বীনবিকৃতি যে রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা দুর্লভ। আর তা হল সহীহ হাদিসেরও মনগড়া আর অশ্রুতপূর্ব সব ব্যাখ্যা দিয়ে সাহাবায়ে কেরাম আর সালাফদের ব্যাখ্যা করা দ্বীনের বিকৃতি। কুফরি গণতন্ত্রের হালালিকরণ, জামানার কুফর সম্রাট আমেরিকা ইসরাঈলের সাথে মিত্রতা ও সহাবস্থান, স্থানীয় তাগুত শাসকদের মুসলিম হওয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদি জঘন্য ব্যাপারগুলোও যে সুস্পষ্ট ‘দ্বীনবিকৃতি’ তা অল্পই অনুধাবণ করতে পারে।
পৃথিবীতে প্রকৃত শরীয়ত যেখানে অনুপস্থিত, যেখানে শরীয়ত কায়েমের প্রচেষ্টারত উলামাগণ, তাগুত সরকারের সাথে ভিন্নমত পোষণকারী উলামাগণ পদে পদে লাঞ্ছিত হন, গ্রেপ্তার হন সেখানে দ্বীন বিকৃত করে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় তাগুতদের বৈধতা দিয়ে বেড়ানো অল্পকিছু খালাফেরা নিজেদের স্বীয় প্রবৃত্তির উপাসনা করতে থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এমন খালাফদের দাওয়াতি জীবনে আসে না কোনো লাঞ্ছনা। মিলিয়ন মিলিয়ন ভক্তকূলের জন্য একের পর এক লেকচার আর বই আসে এদের। আর বেদুঈনদের দ্বীন পালন করা অধিকাংশ মুসলিমদের কাছে দুনিয়াবি বিপদবিহীন এমন দাওয়াত আর তার দাঈরা পায় জনপ্রিয়তা। এদের দলিলগুলোও দেখলে দেখা যায় সহীহ হাদিস, সীরাতের সহীহ ঘটনা। কিন্তু ব্যাখ্যাগুলো সাহাবাদের বুঝ, সালাফদের ঐক্যমত্য থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। দুনিয়া বুলেটপ্রুফ রেখে প্রবৃত্তি উৎসরিত বিকৃত দ্বীন পালনের এক অনবদ্য সিস্টেম। আহলে কিতাবদের দ্বীন বিকৃতির আয়াতগুলো এদের ক্ষেত্রেও যেন সমভাবে প্রযোজ্য হয়ে যায়।
“আরও দিয়েছিলাম তাদেরকে ধর্মের সুস্পষ্ট প্রমাণাদি। অতঃপর তারা জ্ঞান লাভ করার পর শুধু পারস্পরিক জেদের বশবর্তী হয়ে মতভেদ সৃষ্টি করেছে। তারা যে বিষয়ে মতভেদ করত, আপনার পালনকর্তা কেয়ামতের দিন তার ফয়সালা করে দেবেন।
এরপর আমি আপনাকে রেখেছি ধর্মের এক বিশেষ শরীয়তের উপর। অতএব, আপনি এর অনুসরণ করুন এবং অজ্ঞানদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করবেন না। (সূরা জাসিয়া, ১৮-১৯)

তিন.

দ্বীনের পথে ইরজা, গুলুহ আর মধ্যমপন্থা এই তিন শ্রেণির মানুষ দেখা যায়। ইরজা হল ছাড়াছাড়ি, গুলুহ বাড়াবাড়ি আর মধ্যমপন্থা হল উপরোক্ত দুই প্রান্তিকতা মুক্ত হক মানহাজ। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হল, নিজেদের মনগড়া বা খেয়াল-খুশিমত ব্যাখ্যামাত্রই মধ্যমপন্থা নয়। অধিকাংশই মনে করে তারা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করছে কিন্তু আসলে তারা এখানেও প্রবৃত্তির ছোবলে মনগড়া মানহাজই অনুসরণ শুরু করে, তা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না। এই বিষয়ে পদস্খলন হয় মূলত ‘প্রান্তিকতা থেকে মধ্যমপন্থা নির্ণয়’ এর ভুল প্রয়াসে। এই বিষয়টা একটু আলোচনা করা যাক।
এক লোক বাজারে গিয়ে আপেল কিনতে গিয়ে দেখলো বিক্রেতা দর ১০০ টাকা চাইছে। এই দর ক্রেতার কাছে বেশি মনে হওয়ায় সে ৮০ টাকা রাখতে বলল। কিছুক্ষণ দর কষাকষি করে শেষমেশ দু’জন সিদ্ধান্ত নিল, ৮০ আর ১০০ এর মধ্যম দাম ৯০ টাকায় তারা লেনদেন করবে। এখানে লক্ষণীয়, ১০০ এবং ৮০ এর হিসেবে ৯০ মধ্যসংখ্যা হলেও এইভাবে মধ্যপন্থা নির্ণয় সঠিক দিশা দেয় না। কারণ এখানে আগে প্রান্তিক সংখ্যা দু’টো আগে মনের খেয়ালে বেছে নেওয়া হয়েছে। আর তা থেকে মধ্যম নির্ধারণ করা হয়েছে। যদি বিক্রতা প্রথমে ১০০ টাকা না বলে ১২০ টাকা বলতো, তবে তো মধ্যসংখ্যা ১০০ হতো। অথবা ক্রেতা ৮০ না বলে ৬০ টাকা দরদাম করলে ৮০ই মধ্যসংখ্যা হতো। মনের খেয়াল খুশিমত প্রান্তিকতা নির্ধারণ করে মধ্যপন্থা নির্ণয় করতে চাইলে তাই প্রবৃত্তিজাত মধ্যম অবস্থাই পাওয়া যায়, কিন্তু আদতে তা প্রকৃত মধ্যপন্থা হয় কিনা সে নিশ্চয়তা থাকে না।
দ্বীনের ক্ষেত্রে তাই এটা বাড়াবাড়ি আর ওটা ছাড়াছাড়ি, সুতরাং মধ্যমপন্থা হল এই – এভাবে মধ্যমপন্থা নির্ণয় গ্রহণযোগ্য নয়। বরং আগে দ্বীনের অপরিবর্তনীয় ও মৌলিক বিষয়াদি থেকে মধ্যমপন্থা ও সিরতল মুস্তাকিম ব্যাখ্যা করা হয়। এরপর সেই মধ্যমপন্থা থেকে ছাড়াছাড়ি করলে ইরজা’ আর বাড়াবাড়ি করলে তা গুলুহ বলে বিবেচনা করা হয়।
বাস্তবতা হল এই যে, একদল মানুষ জিহাদ ফি-সাবিলিল্লাহ বলতেই নাখোশ হয়ে পড়ে আর যারাই কিতালের ইবাদাতের কথা বলে, তারাই গুলুহ বা বাড়াবাড়ির মধ্যে রয়েছে – এমনটা বিবেচনা করে ফেলে। তাদের বুঝে আসে না যে, কবীরাহ গুনাহ বা বায়াত না দিলেই নিষিদ্ধ তাকফির করা খুরুজরা ছাড়াও যে ওয়াজিব তাকফির করা হকপন্থী মানহাজ থাকতে পারে। এরা আবার সলাত, সিয়াম, হালাল-রুজি ইত্যাদি ব্যক্তিগত পর্যায়ের ফারজিয়্যাতে ছাড়াছাড়ি করা মানুষদের ইরজাগ্রস্থ মনে করে। মোটকথা, এই কাজগুলো গুলুহ আর এই কাজগুলো ইরজা সুতরাং মধ্যমপন্থা হল এই – এভাবে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে দুই প্রান্তিকতা থেকে মধ্যমপন্থা চিহ্নিত করা হয় যা পদ্ধতির ভ্রান্তির কারণে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং দ্বীনের অপরিবর্তনীয় ও মৌলিক বিষয়াদি থেকে উৎসরিত হয় সত্যিকার মধ্যমপন্থী ও হক মানহাজ যা থেকে ছাড়াছাড়ি করলে ইরজা’ আর বাড়াবাড়ি করলেই হয় গুলুহ। অর্থাৎ ওয়াহীর আলোকে প্রথমে মধ্যমপন্থা চিহ্নিত করা হয়, তারপর সেই মধ্যমপন্থা থেকে প্রান্তিকতা চিহ্নিত করা হয়।
তাওহিদ, ঈমান ও কুফর, আকিদাহ, ফারজিয়্যাত, ওয়াজিব তাকফির ইত্যাদি হল দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি যেগুলোর ওপর ভিত্তি করে থেকে পুরো দ্বীনের বুঝ প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বীনের এই মৌলিক বিষয়গুলো সরাসরি ওয়াহী থেকে উৎসরিত। এগুলোতে কোনো তাকলিদ নেই এবং এই বিষয়গুলোর ই’লম অর্জন ফরজ।
.
মোটা দাগে চিহ্নিত করলে দেখা যায়, দ্বীনে প্রবেশের পর একদল উম্মাহর এহেন পরিস্থিতিতেও বসে থাকা মানহাজের অনুসারী, ব্যক্তিগত পর্যায়ের ও সর্বোচ্চ কিছু সামাজিক ইবাদাতেই নিজেদের সীমাবদ্ধকারী। নিষিদ্ধ তাকফিরের ভয়ে ওয়াজিব তাকফির তরককারী, দুনিয়াবি লোকসানের ভয়ে ঈমানের সাথে কুফরেরর সঠিক সংজ্ঞা, প্রয়োগ ইত্যাদিতে অযুহাতপেশকারী। এছাড়াও কিতাল-ফি-সাবিলিল্লাহ ও সমজাতীয় ফারজিয়্যাত সরাসরি বা কৌশলে অস্বীকারকারী। অথচ –
[১] যারা আল্লাহর ও আল্লাহর রাসূলের করা তাকফির অনুযায়ীও তাকফির করে না তাদের জন্য পুরো দ্বীনই সংশয়পূর্ণ হয়ে যায়। কারণ এটা হল সরাসরি ঈমান ও কুফরের সংজ্ঞার প্রয়োগ এবং দ্বীনের সর্বপ্রথম মাসআলাগুলোর একটি যা থেকে দ্বীনের অন্যান্য বহু বিষয়াদি নির্ভরশীল হয়। যেমনটা শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ উল্লেখ করেছেন,
“মনে রাখবেন, কাফের বা ফাসেক আখ্যাদানের মাসআলাসমূহ হল নাম ও বিধান আরোপ সংক্রান্ত এমন মাসআলা, যার সাথে পরকালে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি ও জাহান্নামের সতর্কবাণী এবং দুনিয়াতে বন্ধুত্ব, শত্রুতা, হত্যা, নিরাপত্তা লাভ ইত্যাদি বিধি-বিধান সম্পর্ক রাখে।
কেননা আল্লাহ তায়া’লা মুমিনদের জন্য জান্নাত রেখেছেন আর কাফেরদের জন্য তা হারাম করেছেন। এটা হল সর্বসময় এবং সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য সামগ্রীক বিধি-বিধানের অন্তর্ভূক্ত।” [২]
নেতৃত্ব সংক্রান্ত বিধানাবলি, বন্ধুত্ব ও শত্রুতা সংক্রান্ত বিধানাবলি, বিবাহ সংক্রান্ত বিধানাবলি, রক্ত ও কিসাস সংক্রান্ত বিধানাবলি, যুদ্ধ সংক্রান্ত বিধানাবলি সহ দ্বীনই গড়ে উঠে এই চরম স্পর্শকাতর কিন্তু আবশ্যক তাকফিরের মাসআলার উপর। ঈমান ও কুফরের প্রায়োগিক এই নীতিতে বহু লোকের দুই ধরনের সীমালঙ্ঘন হয়েছে যুগে যুগে। একদল মুসলিমদেরই কাফির আখ্যায়িত করে বসেছে তো আরেকদল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ﷺ করা ওয়াজিব তাকফির থেকে বিরত থেকে কাফির ও তাগুতদেরই বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে।
এছাড়া দ্বীন ইসলামের কত বিপুল পরিমাণ বিষয় এর উপর নির্ভরশীল তা বর্ণনাতীত। যেমন মুসলিম শাসকদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা, তাদের সাহায্য করা ও তাদের আনুগত্য করা ওয়াজিব। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা স্পষ্ট কুফর প্রকাশ না করে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে বের হওয়া ও তাদের সাথে যুদ্ধ করা জায়েয নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ইসলামের গন্ডির ভেতর থাকে ও আল্লাহর শরীয়ত অনুযায়ী শাসন পরিচালনা করে, বিচার ফয়সালা করে, ততক্ষণ তাদের পিছনে নামায পড়া ও তাদের সঙ্গে মিলে জিহাদ করা শরীয়তে বৈধ; তারা নেককার হউক বা বদকার হউক। আবার যে সমস্ত মুসলিমদের অভিভাবক নেই, মুসলিম শাসক তাদের অভিভাবক। পক্ষান্তরে, কাফির ও তাগুত শাসকের বাইআত করা, তার সাহায্য করা, তার সাথে সখ্যতা করা বা তার সহযোগিতা করা জায়েয নেই। তার পতাকাতলে যুদ্ধ করা, তার পিছনে নামায পড়া বা তার কাছে বিচার ফয়সালা কামনা করা বৈধ নয়। মুসলিমদের উপর তার কর্তৃত্ব বৈধ নয়। মুসলিমদের উপর তার আনুগত্য আবশ্যক নয়। বরং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, অপসারণের চেষ্টা করা, তাকে প্রতিহত করার জন্য কাজ করা এবং তার স্থানে একজন মুসলিম শাসক বসানোর চেষ্টা করা ওয়াজিব।
স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের তাকফির –
আর যারাই সেই আইন দ্বারা বিচার করবে না যেগুলো আল্লাহ প্রেরণ করেছেন, তবে তারাই হল কাফির” (সূরা মায়িদাহ, ৪৪)
তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তাদেরকে বন্ধু বানাবে, সে তাদেরই মধ্যে গণ্য হবে।” (মায়িদাহ, ৫১)
সুতরাং, স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন আর রাসূলুল্লাহর ﷺ সংজ্ঞায় যারা কাফির তাদেরকেও চিনতে ভুল করে বসে থাকা মানহাজ কখনো হক তো হতে পারেই না, বরং সম্পূর্ণ দ্বীনই তাদের নিকট সংশয়পূর্ণ। যেসমস্ত দরবারি উলামাদের ব্যাপারে, উলামায়ে সু’-দের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সতর্ক করে গিয়েছেন তাদের থেকেই আয়েশী আর শাসকের মন রাঙানো দ্বীন পালনের মানহাজ তো প্রকৃত মধ্যমপন্থা নয়, বরং উদারপন্থা। তাই মনগড়া প্রান্তিকতা থেকে মনগড়া মধ্যমপন্থা না খুঁজে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের আদিষ্ট ও রাসূলের দেখানো প্রকৃত মধ্যমপন্থাই অনুসরণীয়।
ঈমান-কুফরের সংজ্ঞা যেমনটা রাসূলুল্লাহর ﷺ শিক্ষা ছিল, যেমনটা সাহাবাদের বুঝ ছিল, পরবর্তী সলফে সলেহীনদের ঐক্যমত ছিল সেভাবেই গ্রহণ ও তদানুযায়ী আমল বাঞ্চনীয়। তাকফির সম্পর্কে আরও জানতে শায়খ আসিম আল মাকদিসির (হাফিজাহুল্লাহ) ‘তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি থেকে সতর্কীকরণ প্রসঙ্গে ত্রিশা পুস্তিকা’ পঠিতব্য। [৩]

চার.

দ্বীনের মূল বিষয়াদিতে তাকলিদ নেই। তাই এসব ক্ষেত্রে অমুক উলামারা এমন বলেছেন, তমুকেরা অমন বলেছেন আর সেকারণে আমি দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েছি এমন অনুযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। উলামাদের মধ্যে কারা অনুসরণযোগ্য, কারা বর্জনীয় আর কারা সতর্কতার সাথে গ্রহণীয় সে বিচার করতে হবে দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদির প্রতি তাদের অবস্থান দেখে। উলামায়ে সু’ ও শাসকের দরবারে যাওয়া উলামাদের লিখা, কথা ইত্যাদি যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন তা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। দ্বীনের পথে আসার সময় তাযকিয়্যাহ বা ব্যক্তিগত আমল প্রভৃতি বিষয়ে আবেগ টেনে আনা কথায়, কাজে প্রলুব্ধ হয়ে তাওহীদ, ঈমান-কুফর, এগুলোর প্রয়োগ ইত্যাদি মৌলিক বিষয়াদিতে তাকলিদ করা যাবে না। কিন্তু তবুও দেখা যায়, তাগুত শাসকের মন মানানো কাজ করে যাওয়া দাঈ’ ও আলেমদের থেকে ভাললাগার বিষয়গুলো গ্রহণ করতে করতে মৌলিক বিষয়গুলোতেও অন্ধ তাকলিদ শুরু হয়ে যায়।
রাসূলুল্লাহর ﷺ হাদিস ও সলফে সলেহীনদের কউলগুলো আমাদেরকে একশ্রেণির উলামা থেকে সতর্ক করে দেয় –
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “শাসকদের দরজার ব্যাপারে সতর্ক থাকো। যে ই শাসকদের নিকট গমন করে, সেই পরীক্ষার মধ্যে পতিত হয়।” [৪]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রদিআল্লাহু আ’নহু) বলেছেন, “একজন ব্যক্তি যে তার দ্বীনকে সাথে নিয়ে কোন শাসকের নিকট যায়, সে (শাসকের কাছ থেকে) বের হয়ে আসে তার সাথে কোন কিছু না নিয়েই।” (অর্থাৎ দ্বীন রেখে আসে) [৫]
হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রদিআল্লাহু আ’নহু) বলেন,
قال حذيفة رضى الله عنه : إياكم ومواقف الفتن . قيل : وما هي ؟ قال : أبواب الأمراء ، يدخل أحدكم على الأمير فيصدقه بالكذب ، ويقول ما ليس فيه
“তোমরা ফিতনার বিষয়গুলো থেকে সতর্ক থাকো।” বলা হলোঃ “সেটা কি?” তিনি বললেন, “শাসকদের দরজা। তোমাদের কেউ শাসকদের কাছে যাবে, তার মিথ্যা কথাকে সত্যায়ন করবে, তারপর বলবে, এটাতে কোন সমস্যা নেই।”
তিনি আরো বলেন, “অবশ্যই, তোমরা কখনো শাসকদের দিকে এক বিঘত পরিমাণও অগ্রসর হয়ো না।” [৬]
ইমাম সুফিয়ান সাওরি (রহিমাহুল্লাহ) বলেন,
قَالَ سُفْيَانُ الثَّوْرِيُّ: ” إِذَا رَأَيْتَ الْقَارِئَ يَلُوذُ بِالسُّلْطَانِ فَاعْلَمْ أَنَّهُ لِصٌّ وَإِذَا رَأَيْتَهُ يَلُوذُ بِالْأَغْنِياءِ فَاعْلَمْ أَنَّهُ مُرَاءٍ (شعب الإيمان)
“যখনই তুমি কোন আলেমকে দেখবে শাসকদের কাছে গমন করতে, জেনে রাখো, সে হচ্ছে একজন চোর। আর যদি তাকে ধনী লোকদের কাছে আনাগোনা করতে দেখো, তাহলে জেনে রেখো, যে মানুষকে দেখানোর জন্য কাজ করে।” [৭]
সুফিয়ান সাওরি (রহিমাহুল্লাহ) বলেন আরও বলেন,
إِنْ دَعَوْكَ أَنْ تَقْرَأَ عَلَيْهِمْ: قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ , فَلَا تَأْنَفْهُمْ (شعب الإيمان)
“তোমরা সেখানে যেও না, এমনকি তারা যদি তোমাদেরকে শুধুমাত্র ‘কুল-হুয়াল্লাহু আহাদ’ পাঠ করার জন্যও ডাকে।” [৮]
তাগুত শাসকদের থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে এত সতর্কবাণী থাকতেও যেসকল দরবারি আলেমরা তাদের সাথে গিয়ে মিশে, তাদের তো আসলে ঈমান আর কুফরের সংজ্ঞাই ঠিক থাকে না। তানাহলে তো যারা আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্যসব আইন দিয়ে শাসনকার্য চালায়, সেসব নিকৃষ্ট তাগুতদের বর্জনে প্রথম যুগের মুসলিমদেরই অনুসরণ করতেন। ইমাম আবু হানিফা যেখানে জেলে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করেছেন সেখানে আজ কত হানাফি আলেমই না শাসকের ধরনা দেওয়াকে নিয়মিত রুটিনে পরিণত করেছেন!
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إن الله لعن الكافرين وأعد لهم سعيرا * خالدين فيها أبدا لا يجدون وليا ولا نصيرا * يوم تقلب وجوههم في النار يقولون يا ليتنا أطعنا الله وأطعنا الرسولا * وقالوا ربنا إنا أطعنا سادتنا وكبراءنا فأضلونا السبيلا * ربنا آتهم ضعفين من العذاب والعنهم لعنا كبيرا
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ কাফেরদেরকে তাঁর রহমত থেকে বিতাড়িত করেছেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন জ্বলন্ত আগুন। তাতে তারা সর্বদা এভাবে থাকবে যে, তারা কোন অভিভাবক পাবে না এবং সাহায্যকারীও না।
যেদিন আগুনে তাদের চেহারা ওলট-পালট হয়ে যাবে, তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম এবং রাসূলের কথা মানতাম! এবং বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের নেতৃবর্গ ও আমাদের গুরুজনদের আনুগত্য করেছিলাম, তারা আমাদেরকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করেছে।
হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদের প্রতি এমন লানত করুন, যা হবে অতি বড় লানত। (আহযাব: ৬৪-৬৮)
এই বিষয়ে আয়াত রয়েছে আরও অনেক।

পাঁচ

অবচেতনভাবে কি প্রবৃত্তির দাসত্ব সম্ভব?
আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা বলেন,
قل هل ننبئكم بالأخسرين أعمالا الذين ضل سعيهم في الحياة الدنيا وهم يحسبون أنهم يحسنون صنعا
“বলে দাও, আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব, কর্মে কারা সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? তারা সেই সব লোক, পার্থিব জীবনে যাদের সমস্ত দৌড়-ঝাপ সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, অথচ তারা মনে করে, তারা খুবই ভাল কাজ করছে।” (সূরা কাহফ, ১০৪)
তিনি সুবহানাহুতা’লা আরো বলেন,
إنهم اتخذوا الشياطين أولياء لهم من دون الله ويحسبون أنهم مهتدون
“নিশ্চয়ই তারা আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে আর তারা মনে করছে যে, তারা সরল পথে প্রতিষ্ঠিত আছে।” (সূরা আ’রাফ, ৩০)
সিরতল মুস্তাকিমে অনেক ধূলাবালি উড়ছে তাই পথ দেখা যাচ্ছে না অন্তরের একেবারেই পবিত্র নিয়্যাতে তারা বসে রয়েছেন। তারা বুঝতেই পারছেন না কোন মানহাজ সত্য। আসলে তারা সংশয় সন্দেহে পতিত থাকতে চায় বলেই সংশয়ে ডুবে থাকে। কারণ কিয়ামত পর্যন্ত যে একদল হকের পথে বাতিলের বিরুদ্ধে কিতাল করে যাবে সেবিষয়ে সুস্পষ্ট সহিহ হাদিসগুলো থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, হকের উপর প্রতিষ্ঠিত সেই মানহাজ বসে থাকা এই মানহাজ নয়।
أَخْبَرَنَا أَحْمَدُ بْنُ عَبْدِ الْوَاحِدِ، قَالَ حَدَّثَنَا مَرْوَانُ، – وَهُوَ ابْنُ مُحَمَّدٍ – قَالَ حَدَّثَنَا خَالِدُ بْنُ يَزِيدَ بْنِ صَالِحِ بْنِ صَبِيحٍ الْمُرِّيُّ، قَالَ حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ أَبِي عَبْلَةَ، عَنِ الْوَلِيدِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْجُرَشِيِّ، عَنْ جُبَيْرِ بْنِ نُفَيْرٍ، عَنْ سَلَمَةَ بْنِ نُفَيْلٍ الْكِنْدِيِّ، قَالَ كُنْتُ جَالِسًا عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَذَالَ النَّاسُ الْخَيْلَ وَوَضَعُوا السِّلاَحَ وَقَالُوا لاَ جِهَادَ قَدْ وَضَعَتِ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا فَأَقْبَلَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِوَجْهِهِ وَقَالَ ‏ “‏ كَذَبُوا الآنَ الآنَ جَاءَ الْقِتَالُ وَلاَ يَزَالُ مِنْ أُمَّتِي أُمَّةٌ يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ وَيُزِيغُ اللَّهُ لَهُمْ قُلُوبَ أَقْوَامٍ وَيَرْزُقُهُمْ مِنْهُمْ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ وَحَتَّى يَأْتِيَ وَعْدُ اللَّهِ وَالْخَيْلُ مَعْقُودٌ فِي نَوَاصِيهَا الْخَيْرُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُوَ يُوحَى إِلَىَّ أَنِّي مَقْبُوضٌ غَيْرَ مُلَبَّثٍ وَأَنْتُمْ تَتَّبِعُونِي أَفْنَادًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ وَعُقْرُ دَارِ الْمُؤْمِنِينَ الشَّامُ
সালামাহ ইবন নুফাইল আল-কিন্দি বলেন, আমি একবার রাসূলুল্লাহর ﷺ সাথে বসে ছিলাম যখন একজন লোক আসলো এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! লোকেরা তাদের ঘোড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এবং তাদের অস্ত্রগুলো নামিয়ে ফেলেছে, আর তারা বলছে আর জিহাদ নেই, এবং যুদ্ধ সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ ঐ ব্যক্তির দিকে ফিরলেন এবং বললেন, ওরা মিথ্যা বলছে, জিহাদ তো কেবল শুরু হল। আমার উম্মাতের মধ্যে একাংশ থাকবে যারা সবসময়ই হক্বের জন্য জিহাদ করতে থাকবে, যাদের জন্য আল্লাহ কিছু মানুষকে গোমরাহ করে দিবেন আর ওদের থেকে খোরাক যোগাবেন, যতক্ষণ না কিয়ামত চলে আসে আর আল্লাহর ওয়াদা পূর্ণ হয়।
ঘোড়ার অগ্রচুলের সাথে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত কল্যাণ বাঁধা রয়েছে। আমার নিকট এটা জানানো হয়েছে যে আমি মৃত্যুবরণ করব এবং বেশিদিন থাকব না, আর তোমরা এক দলের পর আরেক দল আমাকে অনুসরণ করবে, একে অপরের গর্দানে মারতে থাকার মাধ্যমে।
আর মুমিনদের জন্য নিরাপদ জায়গা হল আশ-শাম। [৯]
حَدَّثَنَا الْوَلِيدُ بْنُ شُجَاعٍ، وَهَارُونُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، وَحَجَّاجُ بْنُ الشَّاعِرِ، قَالُوا حَدَّثَنَا حَجَّاجٌ، – وَهُوَ ابْنُ مُحَمَّدٍ – عَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ، قَالَ أَخْبَرَنِي أَبُو الزُّبَيْرِ، أَنَّهُ سَمِعَ جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ، يَقُولُ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ” لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ – قَالَ – فَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ صلى الله عليه وسلم فَيَقُولُ أَمِيرُهُمْ تَعَالَ صَلِّ لَنَا . فَيَقُولُ لاَ . إِنَّ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ أُمَرَاءُ . تَكْرِمَةَ اللَّهِ هَذِهِ الأُمَّةَ “
আল ওয়ালীদ ইবন শুজা, হারুন ইবন আবদুল্লাহ ও হাজ্জাজ ইবন শাইর (রহিমাহুল্লাহ)… জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রদিআল্লাহু আ’নহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে ﷺ বলতে শুনেছি,
কিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মাতের একদল হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে বাতিলের বিরুদ্ধে কিতাল করতে থাকবে এবং অবশেষে হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম) অবতরণ করবেন। মুসলমানদের আমির বলবেন, আসুন, নামাযে আমাদের ইমামতি করুন! উত্তর দিবেনঃ না, আপনাদেরই একজনকে অন্যদের জন্য আমির নিতে হবে। এ হল এ উম্মাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত সম্মান। [১০]
وَحَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى، وَمُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ، قَالاَ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ، حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، عَنْ سِمَاكِ بْنِ حَرْبٍ، عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ قَالَ ” لَنْ يَبْرَحَ هَذَا الدِّينُ قَائِمًا يُقَاتِلُ عَلَيْهِ عِصَابَةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ ” .
মুহাম্মদ ইবন মুসান্না ও মুহাম্মদ ইবন বাশশার (রহিমাহুল্লাহ)……জাবির ইবন সামুরা (রদিআল্লাহু আ’নহু) থেকে বর্ণিত যে, নবী ﷺ বলেছেন, “এই দ্বীন (ইসলাম) সর্বদা কায়েম থাকবে। মুসলমানদের একটি দল এর পক্ষে কিতাল করতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। [১১]
حَدَّثَنِي هَارُونُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، وَحَجَّاجُ بْنُ الشَّاعِرِ، قَالاَ حَدَّثَنَا حَجَّاجُ بْنُ مُحَمَّدٍ، قَالَ قَالَ ابْنُ جُرَيْجٍ أَخْبَرَنِي أَبُو الزُّبَيْرِ، أَنَّهُ سَمِعَ جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ، يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ” لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ “
হারুন ইবন আব্দুল্লাহ ও হাজ্জাজ ইবন শাঈর (রহিমাহুল্লাহ)… জাবির ইবন আব্দুল্লাহ রদিআল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহকে ﷺ বলতে শুনেছি, আমার উম্মাতের একটি জামায়াত সর্বদাই সত্যের স্বপক্ষে কিতাল করতে থাকবে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত। [১২]
.
وَحَدَّثَنِي إِسْحَاقُ بْنُ مَنْصُورٍ، أَخْبَرَنَا كَثِيرُ بْنُ هِشَامٍ، حَدَّثَنَا جَعْفَرٌ، – وَهُوَ ابْنُ بُرْقَانَ – حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ الأَصَمِّ، قَالَ سَمِعْتُ مُعَاوِيَةَ بْنَ أَبِي سُفْيَانَ، ذَكَرَ حَدِيثًا رَوَاهُ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم لَمْ أَسْمَعْهُ رَوَى عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم عَلَى مِنْبَرِهِ حَدِيثًا غَيْرَهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ وَلاَ تَزَالُ عِصَابَةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ عَلَى مَنْ نَاوَأَهُمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ “
ইসহাক ইবন মানসূর (রহিমাহুল্লাহ)… ইয়াযিদ ইবন আসাম বলেন, আমি মুয়াবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান (রদিআল্লাহু আ’নহু)-কে এমন একটি হাদিস নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করতে শুনেছি যা ছাড়া নবী ﷺ এর বরাতে অন্য কোন হাদিস মিম্বরের উপর থেকে বলতে তাঁকে আমি শুনিনি । তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দীনের বুৎপত্তি দিয়ে থাকেন এবং মূসলামনদের একটি দল সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে কিতাল করবে। যারা তাদের প্রতি বিরুপ, ভাব পোষণ করবে তাদের বিরুদ্ধে থাকার তারা তাদের উপর বিজয়ী থাকবে। কিয়ামত অবধি এভাবে চলতে থাকবে।” [১৩]
ইবন উমার বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে ﷺ বলতে শুনেছি, যখন তোমরা আই’নাহতে (রিবাহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসা বা লেনদেন) লিপ্ত হয়ে যাবে, আর তোমরা গরুর লেজ ধরে থাকবে আর কৃষিকাজে তৃপ্ত হয়ে যাবে, এবং যখন তোমরা জিহাদকে ছেড়ে দিবে, তখন আল্লাহ তোমাদের লাঞ্ছিত করবেন আর তা তোমাদের উপর থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে না যতক্ষণ না তোমরা দ্বীনে ফিরে যাও। [১৪]
حَدَّثَنِي أَحْمَدُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ وَهْبٍ، حَدَّثَنَا عَمِّي عَبْدُ اللَّهِ بْنُ وَهْبٍ، حَدَّثَنَا عَمْرُو بْنُ الْحَارِثِ، حَدَّثَنِي يَزِيدُ بْنُ أَبِي حَبِيبٍ، حَدَّثَنِي عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ شُمَاسَةَ الْمَهْرِيُّ، قَالَ كُنْتُ عِنْدَ مَسْلَمَةَ بْنِ مُخَلَّدٍ وَعِنْدَهُ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ إِلاَّ عَلَى شِرَارِ الْخَلْقِ هُمْ شَرٌّ مِنْ أَهْلِ الْجَاهِلِيَّةِ لاَ يَدْعُونَ اللَّهَ بِشَىْءٍ إِلاَّ رَدَّهُ عَلَيْهِمْ . فَبَيْنَمَا هُمْ عَلَى ذَلِكَ أَقْبَلَ عُقْبَةُ بْنُ عَامِرٍ فَقَالَ لَهُ مَسْلَمَةُ يَا عُقْبَةُ اسْمَعْ مَا يَقُولُ عَبْدُ اللَّهِ . فَقَالَ عُقْبَةُ هُوَ أَعْلَمُ وَأَمَّا أَنَا فَسَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ” لاَ تَزَالُ عِصَابَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى أَمْرِ اللَّهِ قَاهِرِينَ لِعَدُوِّهِمْ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَالَفَهُمْ حَتَّى تَأْتِيَهُمُ السَّاعَةُ وَهُمْ عَلَى ذَلِكَ ” . فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ أَجَلْ . ثُمَّ يَبْعَثُ اللَّهُ رِيحًا كَرِيحِ الْمِسْكِ مَسُّهَا مَسُّ الْحَرِيرِ فَلاَ تَتْرُكُ نَفْسًا فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنَ الإِيمَانِ إِلاَّ قَبَضَتْهُ ثُمَّ يَبْقَى شِرَارُ النَّاسِ عَلَيْهِمْ تَقُومُ السَّاعَةُ
আহমাদ ইবন আবদূর রাহমান ইবন ওহাব (রহিমাহুল্লাহ) … আবদুর রাহমান ইবন শামাসাহ (রদিআল্লাহু আ’নহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি মাসলামা ইবন মুখাল্লাদ (রদিআল্লাহু আ’নহু)-এর কাছে বসা ছিলাম। তখন আব্দুল্লাহ (রদিআল্লাহু আ’নহু) বললেন, কিয়ামত কেবল তখনই কায়েম হবে যখন নিকৃষ্টতম লোকরা থাকবে। ওরা জাহেলিয়াত সম্প্রদায়ের লোকদের চাইতেও নিকৃষ্টতর হবে। তারা আল্লাহর কাছে যে বস্তুর জন্যই দোয়া করবে তিনি তা প্রত্যাখান করবেন।
তারা যখন এ আলোচনায় ছিলেন এমন সময় উকনা ইবন আমির (রদিআল্লাহু আ’নহু) সেখানে এলেন। তখন মাসলামা (রদিআল্লাহু আ’নহু) বললেন, হে উকবা, শুনুন, আব্দুল্লাহ কি বলেছেন?
তখন উকবা (রদিআল্লাহু আ’নহু) বললেনঃ, তিনি তা ভাল জানেন। তবে আমি রাসুলুল্লাহকে ﷺ বলতে শুনেছি যে, আমার উম্মাতের একটি দল আল্লাহর বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে কিতাল করে যাবে। তারা তাদের শক্রদের মোকাবিলায় অত্যন্ত বজ্র কঠোর হবে। যারা বিরোধিতা করবে, তারা তাদের কোন অনিষ্ট করতে পারবে না। এভাবে চলতে চলতে তাদের নিকট কিয়ামত এসে যাবে আর তাঁরা এর উপরই প্রতিষ্ঠিত থাকবে।” আব্দুল্লাহ (রদিআল্লাহু আ’নহু) বললেন, হ্যাঁ। তারপর আল্লাহ একটি বায়ু প্রবাহ প্রেরণ করবেন, সে বায়ু প্রবাহটি হবে কারীর সূঘ্রাণের ন্যায়। [১৫]
এত এত সহীহ হাদিস সেদিকটাতেই নির্দেশ করে যে সংশয় সন্দেহের দোহাই দিয়ে বসে থাকা মানহাজ হক দল হতে পারে না। আর এই হাদিসগুলো কুরআনের জিহাদসংক্রান্ত আয়াতগুলোরও সাধারণভাবে কিয়ামত পর্যন্ত প্রযোজ্য হওয়ার নির্দেশক। কুরআনেই আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন উল্লেখ করেছেন –
হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, অচিরেই আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি হবে কঠোর। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী, মহাজ্ঞানী।” (সূরা মায়িদাহ, ৫৪)
তাই আসলে এই ব্যাপারে পবিত্র ইখলাসের মানুষেরা বসে থাকতে পারেন না। তাদের ইখলাস পবিত্র হলে তো আল্লাহ তাদের বসিয়ে রাখতেন না। বরং তারা সংশয় সন্দেহে ডুবে থাকতে চায়, দ্বীনে প্রবেশ করেও প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে চায় বলেই আল্লাহ তাদের অন্তরের ব্যাধিকে বাড়িয়ে দেন।
এবং যাতে তাদেরকে শনাক্ত করা যায়, যারা ছিল মুনাফিক। আর তাদেরকে বলা হল এসো, আল্লাহর রাহে কিতাল কর কিংবা (অন্তত) শত্রুদিগকে প্রতিহত কর। তারা বলেছিল, আমরা যদি একে লড়াই বলেই জানতাম, তাহলে অবশ্যই তোমাদের সাথে থাকতাম। সেদিন তারা ঈমানের তুলনায় কুফরীর কাছাকাছি ছিল। যা তাদের অন্তরে নেই তারা নিজের মুখে সে কথাই বলে বস্তুতঃ আল্লাহ ভালভাবে জানেন তারা যা কিছু গোপন করে থাকে।” (সূরা আল-ইমরান, ১৬৭)
তারা কি জাহেলী আইন ও শাসন চায়? বিশ্বাসী কওমের জন্য আল্লাহর আইন ও শাসনের চেয়ে আর কার আইন ও শাসন উত্তম হতে পারে?” (আল- মায়েদাহ: ৫০)
বস্তুতঃ যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, তাদেরকে আপনি দেখবেন, দৌড়ে গিয়ে তাদেরই মধ্যে প্রবেশ করে। তারা বলেঃ আমরা আশঙ্কা করি, পাছে না আমরা কোন দুর্ঘটনায় পতিত হই। অতএব, সেদিন দুরে নয়, যেদিন আল্লাহ তা’আলা বিজয় প্রকাশ করবেন অথবা নিজের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ দেবেন-ফলে তারা স্বীয় গোপন মনোভাবের জন্যে অনুতপ্ত হবে। (সূরা মায়িদাহ, ৫২)
আর যদি তারা বের হবার সংকল্প নিত, তবে অবশ্যই কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করতো। কিন্তু তাদের উত্থান আল্লাহর পছন্দ নয়, তাই তাদের নিবৃত রাখলেন এবং আদেশ হল বসা লোকদের সাথে তোমরা বসে থাক।” (সূরা তাওবা, ৪৬)
ছয়.
সুস্পষ্ট এই দ্বীনে প্রবৃত্তির ধোঁকায় পতিত হয়ে মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হয়। আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের দেওয়া কিছু ভয়ঙ্কর নিআ’মত রয়েছে। এই নিআ’মতগুলো জায়েজ তো বটেই কখনও আবার ওয়াজিব পর্যায়েরও বটে। যেমনঃ মা-বাবা, স্ত্রী সন্তানদের ভালবাসা ও তাদের হক আদায় ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো ভয়ঙ্কর নিআ’মত একারণেই যে স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনই কুরআনে বারবার এই নিআ’মতগুলো সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। সতর্ক করে দিয়েছেন কারণ এগুলো জায়েজ বিষয় বলেই মানুষকে খুব সহজেই আরো বড় ফারজিয়্যাত থেকে গাফেল করে রাখতে পারে।
আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন বলেন –
“মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা মুনাফিকুন, )
“(হে নবী আপনি) বলে দিন, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, সন্তান, ভাই, পত্নী, গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, ব্যবসা যা তোমরা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান-যাকে তোমরা পছন্দ কর – আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়েত করেন না।” (সূরা তাওবাহ, ২৪)
সুবহান-আল্লাহ! লক্ষ্য করুন স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামীন যে বিষয়গুলো থেকে সাবধান করছেন তার কোনোটিই নাজায়েজ কিছু নয়। কিন্তু তিনি সীমারেখা দিয়ে দিলেন। আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে প্রিয় হওয়া যাবে না কোনোকিছুই, আর বিশেষ করে উপরোক্ত আয়াতের আটটি বিষয় যেগুলো কিনা জায়েজ বিষয়াদি! কত মানুষই না দ্বীনে আসার পরও প্রবৃত্তির ছলনায় এমনসব জায়েজ ফিতনায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে! আর উম্মতের এহেন পরিস্থিতেতেও ব্যক্তিগত পর্যায়ের ইবাদাতে সীমাবদ্ধ থেকে ‘বসে থাকা’ মানহাজেই সন্তুষ্ট হয়ে পড়েছে! অবাক হই, ১৪০০ বছরের আগের কুরআন কি অবিকলভাবে মানুষের এমন স্বভাবগুলো বর্ণনা করে –
আপনি কি সেসব লোকদের দেখেন নি, যাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তোমরা নিজেদের হাতকে সংযত রাখ, নামায কায়েম কর এবং যাকাত দিতে থাক? অতঃপর যখন তাদের প্রতি জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হল, তৎক্ষণাৎ তাদের মধ্যে একদল লোক মানুষকে ভয় করতে আরম্ভ করল, যেমন করে ভয় করা হয় আল্লাহকে। এমন কি তার চেয়েও অধিক ভয়। আর বলতে লাগল, ‘হায় পালনকর্তা, কেন আমাদের উপর যুদ্ধ ফরজ করলে! আমাদেরকে কেন আরও কিছুকাল অবকাশ দান করলে না।’
(হে রাসূল) তাদেরকে বলে দিন, পার্থিব ফায়দা সীমিত। আর পরহেযগারদের জন্য তো আখিরাতই উত্তম। আর তোমাদের প্রাপ্য এক সুতা পরিমাণও খর্ব করা হবে না।”
(সূরা নিসা, ৭৭)

শেষকথা

যে পদস্খলনগুলো নিয়ে আলোচিত হল তা মুমিনদের দ্বীনে আসার পরের ফিতান, যেগুলোর সবগুলোই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রবৃত্তি উৎসরিত। কিন্তু দ্বীনে প্রবেশের পর যাদের মাধ্যমে দাওয়াত পাওয়া, নিজেদের সার্কেল-জামাতের বা ভাললাগা শায়খদের অন্ধভক্তি, জায়েজ কিন্তু ভয়ঙ্কর নিআমতগুলোর ফিতানে ডুবে থেকে অবচেতনভাবেই পদস্খলন হয়ে যায়। একমাত্র ‘আল্লাহর রাহে’ ‘আল্লাহর দ্বীন’ পালন না করে কোন ‘প্রবৃত্তিজাত কারণে’ ‘প্রবৃত্তি উৎসরিত’ মনগড়া দ্বীন পালন করা হয় অহরহ। আর যারা জেনেশুনেও দ্বীনের বাছাই করে নেওয়া অংশগুলো পালন করে যায় তারা তো ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গিয়েছে।
তারা কি জাহেলি আইন ও শাসন চায়? বিশ্বাসী কওমের জন্য আল্লাহর আইন ও শাসনের চেয়ে আর কার আইন ও শাসন উত্তম হতে পারে? (আল-মায়িদাহ, ৫০)
হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ মান্য কর এবং শোনার পর তা থেকে বিমুখ হয়ো না। আর তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা বলে যে, আমরা শুনেছি, অথচ তারা শোনেনা।” (সূরা আনফাল, ২০-২১)
আল্লাহ আমাদের হিদায়াতকে বৃদ্ধি করে দিন। আমাদেরকে প্রবৃত্তির যাবতীয় ধোঁকা থেকে হিফাজত করে সিরতল মুস্তাকিমে, মিল্লাতু ইবরাহিমে অটল থাকার তাওফিক দিন। আল্লাহ আমাদের সত্য বোঝার, মেনে নেওয়ার ও মেনে চলার তাওফিক দিন। আল্লাহ আমাদের তাঁর সর্বোত্তম বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করুন এবং শাহাদাতের সফলতা অর্জনের তাওফিক দিন।।
টিকা ও রেফারেন্স –
[১] আরও বিস্তারিত জানার জন্য অপ্রমাণ্যের প্রমাণ পঠিতব্য।
[২] মাজমূউল ফাতওয়া, ১২/২৫১
[৩] বইটির লিঙ্ক পেলে অ্যাড করে দেওয়া হবে ইন-শা-আল্লাহ। শায়খের বইটির সংক্ষেপিত রূপ ‘তাকফিরঃ প্রচলিত ভুলসমূহ’ ও প্রাথমিক জ্ঞানের জন্য উত্তম হতে পারে।
[৪] আবু দাউদ, নং-২৮৫৯, সুনান তিরমিযী নং-২২৫৬
[৫] ইমাম বুখারী (রদিআল্লাহু আ’নহু) কর্তৃক ‘আত-তারিখ’ গ্রন্থে সংকলিত
[৬] ইবনে আবী শাইবাহ কর্তৃক সংগৃহীত
[৭] শুয়াবুল ঈমান, ৪৯৭২, জামি লি আখলাকির রাওয়ী ওয়া আদাবীস সামী, পৃ. ১৪। ইমাম যাহাবী (র.) এর সনদকে সহীহ বলেছেন। দেখুন সিয়ারাল আলামুন নুবালা ১৩/৫৮৬। এছাড়াও সালিম হিলালী একে সহীহ বলেছেন।
[৮] শুয়াবুল ঈমান, ইমাম বাইহাকী
[৯] সুনান আন-নাসাঈ ৩৫৬১, বই ২৮, হাদিস নং ১
[১০] সহিহ মুসলিম, বই ১, হাদিস নং ২৯৩/ ২৯২ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
[১১] সহিহ মুসলিম, বই ২০, হাদিস নং ৪৭১৭/ ৩৮০১ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
[১২] সহিহ মুসলিম, বই ২০, হাদিস নং ৪৭১৮/ ৪০৮২ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
[১৩] সহিহ মুসলিম, বই ২০, হাদিস নং ৪৭২০/ ৪৮০৩ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
[১৪] আবু দাঊদ ৩৪৬২, আলবানি (রহিমাহুল্লাহ) হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন
[১৫] সহিহ মুসলিম, বই ২০, হাদিস নং ৪৭২১/ ৪৮০৪ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
লেখক-তানভীর আহমেদ

সংঘর্ষ তত্ত্ব

খ্রিস্টেরও জন্মের ৩৫০ বছর আগের গ্রিস। সেসময়ে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু। জ্ঞান গরিমায় পর পর সক্রেটিস, প্লেটোর পর গ্রিসে জ্ঞানচর্চায় আরেকটি নাম ধ্বনিত হচ্ছে, অ্যারিস্টটল। দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, পৌরনীতি সব… সবকিছুতেই যেন অ্যারিস্টটলের কিছু না কিছু বলার আছে।
সাধারণ মানুষের খেটে খাওয়া জীবনে জ্ঞানচর্চার সময় অপ্রতুল, ইচ্ছে থাকলেও খরচাপাতির কারণে সেটা যেন উচ্চবিত্তদের জন্যই বরাদ্দ। কিন্তু জ্ঞানীদের ধ্যানধারণার খোঁজখবর তারা রাখে। অ্যারিস্টটল জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে টলেমি আর প্লেটোর সাথে মিল রেখে নিজের মতামত ব্যক্ত করলেন। আর তা হলঃ পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে, সূর্যসহ অন্যান্য গ্রহ আর মহাজাগতিক বস্তু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।
প্রথম শতাব্দী, চলছে বাইবেলের সংকলনের কাজ। এখনও দাপটের সাথে টিকে আছে গ্রিক জ্ঞানগরিমা। এতই দাপট যে গ্রিক ভাষাই তখন সভ্য পৃথিবীর ভাষা। তাই প্রাচীন হিব্রুতে না করে গ্রিক ভাষাতেই নতুন সংকলন চলছে। বাইবেলে চলে এল জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে প্লেটো-অ্যারিস্টটলদের ‘জিওসেন্ট্রিক’ মতবাদ অর্থাৎ, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে রয়েছে সেকথা। তাও একটি দু’টি জায়গায় নয়। রীতিমত চার-পাঁচ জায়গায়। (Chronicles 16:30, Psalm 93:1, Psalm 96:10, Psalm 104:5, Ecclesiastes 1:5) .
ষষ্ঠ শতাব্দীর আরব।
মরুভূমির ভেতর একজন দাবি করলেন সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে সর্বশেষ নবুওয়্যাতের। নাম মুহাম্মাদ ﷺ বাইবেল সংকলকদের মত লেখাপড়া জানা মানুষ নন। কিন্তু তিনি বলছেন অশ্রুতপূর্ব সব বাণী… আরবি জেনেও আরবরা মুগ্ধ। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত শেষ আসমানি কিতাব ‘আল-কুরআন’ নিয়ে এসেছেন তিনি।
আল কুরআনে খ্রিস্টানদের কিতাব বিকৃতির কথা এল। অর্থাৎ, খ্রিস্টানরা তাদের জন্য প্রেরিত কিতাবে নিজ থেকে মনগড়া গল্প, সংযোজন, বিয়োজন যা পেরেছে করেছে। পূর্ববর্তী নবী রাসূল আর ঈমানদারদের ঘটনার পাশাপাশি মানব সৃষ্টিরহস্য, মহাবিশ্বের সৃষ্টিরহস্য সবকিছু নিয়েই আয়াত এল। কিন্তু সেই গল্প আরেকটু পর হলেই বরং উত্তম।
প্রায় সহস্র বছর পরের কথা। ১৬৩৩ সাল। ক্যাথোলিক চার্চ থেকে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ এল ইতালিয়ান পলিম্যাথ, জ্যোতির্বিদ ও বিজ্ঞানী গ্যালেলিও গ্যালেলির নামে, যাকে আগে কয়েকবার সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল।
১৬০৯ এ বিজ্ঞানী কেপলারের Astronomia nova প্রকাশিত হয়। সেখানে বাইবেলের শিক্ষার বিরুদ্ধে গিয়ে বিজ্ঞানী কোপার্নিকাসের দেওয়া ‘হেলিওসেন্ট্রিক থিউরি’ এর পক্ষে ছিল সমর্থন। ঠিক পরের বছরই বের হয় গ্যালেলিওর Sidereus Nuncius, যেখানে ছিল গ্যালেলিওর নিজের বানানো টেলিস্কোপের প্রাথমিক অবজারভেশনগুলো। বইটিতে কেবল ইঙ্গিতেই সীমাবদ্ধ থাকলেও এর পরপরই বিজ্ঞানী গ্যালেলিও কোপার্নিকাসের হেলিওসেন্ট্রিক মতবাদের প্রতি জোরালো সমর্থন শুরু করেন। কেবলই মতবাদ নয়, বরং তা সত্য হিসেবে প্রচার শুরু করেন। . এদিকে চার্চগুলো স্রেফ হাইপোথিসিস হিসেবে এতকাল হেলিওসেন্ট্রিক থিউরির তেমন বিরোধিতা না করলেও ফ্যাক্ট হিসেবে প্রচার দেখেই তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। এর মূল কারণ ছিল বাইবেলের সেই আয়াতগুলো যেগুলো ‘পৃথিবী কেন্দ্রে আর সূর্যসহ অন্যান্য গ্রহগুলো পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে’ তথা জিওসেন্ট্রিক মতবাদকেই সমর্থন করে। . ক্যাথলিক চার্চ তাদের অবস্থান, ক্ষমতা ও অহমিকা প্রমাণ করেছিল ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে আরেক বিজ্ঞানী জিওর্দানো ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। সেই একই কারণে… ব্রুনোও বলেছিল পৃথিবী নয় বরং সূর্যই কেন্দ্রে রয়েছে। জ্ঞানচর্চার যুগে বাইবেলের অনুসারীরাও যে কমবেশি রিজনিং আর কম্পেয়ার বেসড প্রচার-প্রসারে মেতে উঠেছিল তারই ফল ছিল এই ঘটনা। কেননা গ্রিক ভাষায় সংকলনের সময় সলিড ফ্যাক্ট হিসেবে জানা জিওসেন্ট্রিক মতবাদ সমর্থন করে এমনসব ভার্স ঢুকিয়ে পরবর্তীতে ফায়দা লুটা হয়েছিল অনেক। ‘এই দেখ বাইবেল আধুনিক জ্ঞান সম্মত’ ধরনের প্রচারণায় উক্ত ভার্সগুলো হরহামেশাই আনা হতো। তাই গ্যালেলিও যখন আগের শতাব্দীতে কোপার্নিকাসের দেওয়া ‘হেলিওসেন্ট্রিক মতবাদ’ নতুন করে ফ্যাক্ট হিসেবে প্রচার শুরু করেছিলেন, তখন তা এড়িয়ে যাবার উপায় ছিল না মোটেও। কেননা সাধারণেরাও দিব্যি জানতো যে তা বাইবেলের শিক্ষার বিরোধী হয়ে যাচ্ছে। . এমতাবস্থায় গ্যালেলিও যখন আবারও হেলিওসেন্ট্রিক মতকে সত্য প্রচারে নামেন তখন ক্যাথলিক চার্চের মাথা বিগড়ে যায়। ঘটনাক্রমে গ্যালেলিও নিজ ছাত্র Benedetto Castelli কে একটি চিঠি লিখেন যেখানে বাইবেলের ব্যাপারে ‘গ্যালেলিওর দৃষ্টিভঙ্গি’ উল্লেখ ছিল। পরবর্তীতে ১৬১৫ সালে এসে “Letter to The Grand Duchess Christina” নামে একটি খোলাচিঠি লিখেন যেখানে গ্যালেলিও নিজের মতামত শক্ত করে ব্যক্ত করার পাশাপাশি নিজেকে একজন ক্যাথলিক ধর্মভীরু হিসেবেও উল্লেখ করেন। সাথে তিনি বাইবেলের ভার্সগুলোর ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকবার সম্ভাবনাও উল্লেখ করেন। এই চিঠির ব্যাপারটি রাতারাতি দিগ্বিদিক ছড়িয়ে যায়। . সেই চিঠির পরই মূলত গ্যালেলিওর উপর ক্যাথলিক চার্চের খড়গ নেমে আসে। গ্যালেলিওকে হেলিওসেন্ট্রিক মতবাদ প্রচার থেকে কড়াভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। সেই সাথে নিষিদ্ধ করা হয় কোপার্নিকান সকল লিখা ও বই। ১৬১৬ সালে ক্যাথলিক চার্চ হেলিওসেন্ট্রিজমকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। . এমনসব ঘটনার পর গ্যালেলিও রোমে চলে যান এবং এসব বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করতে থাকেন। কিন্তু কালক্রমে ১৬২৩ সালে পোপ পরিবর্তন হয়ে নতুন পোপ Pope Urban VIII আসে, যে কিনা গ্যালেলিওর ভক্ত ও অনুরাগী ছিলেন। তাই গ্যালেলিও এই সুযোগে আরেকটি বই লিখেন যা ১৬৩৩ সালে প্রকাশিত হয়। বইটির নাম “Dialogue Concerning the Two Chief World Systems” যেখানে তিনজন ব্যক্তির আলাপচারিতা আকারে টলেমি আরিস্টটলদের জিওসেন্ট্রিজমের অসাড়তা ও কোপার্নিকান হেলিওসেন্ট্রিজমের যৌক্তিকতা উল্লেখ করা হয়। বইটির তিনটি চরিত্রের একটি চরিত্র ছিল টলেমি-আরিস্টটলদের জিওসেন্ট্রিজমে বিশ্বাসী, আরেকটি চরিত্র ছিল হেলিওসেন্ট্রিজমে বিশ্বাসী আর শেষ চরিত্রটি ছিল নিরপেক্ষ জ্ঞানী। . পরোক্ষভাবে এইরূপ প্রচারেও গ্যালেলিওর শেষ রক্ষা হয় নি। ক্যাথলিক চার্চ থেকে এবার ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ এনে গ্যালেলিওকে আজীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। তবে শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে গৃহবন্দী করে রাখার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়। গৃহবন্দী অবস্থাতেই ১৬৪২ সালের জানুয়ারিতে গ্যালেলিও মারা যান।
ক্যাথলিক চার্চের সাথে বিজ্ঞানী গ্যালেলিও গ্যালিলির সংঘর্ষময় ঘটনাপ্রবাহ ‘Galileo affair’ নামে পরিচিত। একইসাথে এটি পরবর্তী বিজ্ঞানচর্চাকারী ও বিজ্ঞান অনুরাগীদের এক অনুপ্রেরণা হয়ে উঠে। কিন্তু কোপার্নিকাস, কেপলার আর গ্যালেলিওদের মতবাদে সূর্যকে কেন্দ্রে মনে করার বিষয়টি থাকলেও সূর্যকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র ও স্থির হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। . আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন বলেন, “তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিন এবং সূর্য ও চাঁদ। সমস্তকিছুই আপন আপন কক্ষপথে বিচরণ করে।” (সূরা আম্বিয়া, ২১: ৩৩) . উক্ত আয়াতে ‘বিচরণ করা’ অর্থে ব্যবহৃত শব্দটি হল ‘ইয়াসবাহুন’ যা কিনা ‘সাবাহা’ শব্দটি থেকে এসেছে। আর ‘সাবাহা’ শব্দটি Motion বা Change in Position অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অর্থাৎ, শব্দটি কোন মাটিতে চলা ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলে বুঝতে হবে সে হাঁটছে অথবা দৌঁড়াচ্ছে। শব্দটি পানিতে থাকা কোন লোকের ক্ষেত্রে বলা হলে এর অর্থ এই না যে লোকটি ভাসছে, বরং বুঝতে হবে লোকটি সাঁতার কাটছে। অর্থাৎ সে তার অবস্থানের পরিবর্তন করছে। আর শব্দটি কোন মহাজাগতিক বস্তুর (Celestial body) ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হয় তা স্থির নেই, বরং গতিশীল! . এছাড়াও আল্লাহ রব্বুল আলামীন বললেন ‘সমস্তকিছু’! অর্থাৎ, সমস্ত মহাজাগতিক বস্তু (celestial body) – পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য, অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ, অন্যান্য নক্ষত্ররাজি, গ্যালাক্সিসমূহ কোনোকিছুই বাদ নয়। আজ ক্লাস নাইন টেনের সায়েন্স স্টুডেন্টরাও জানে পরম স্থিতি বা পরম গতি বলতে কিছু নেই কারণ মহাবিশ্বের সকল কিছুই প্রকৃতপক্ষে গতিশীল। অতি সাম্প্রতিক গবেষণায় সূর্যের নিজ অক্ষে ঘূর্ণন ও কক্ষপথ দিয়ে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে আবর্তনের ব্যাপারটি স্পষ্ট। সূর্য প্রায় ২৫ দিনে নিজ অক্ষে ঘূর্ণন সম্পন্ন করে আর প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২৫১ কি.মি. বেগে মোট ২২৫ থেকে ২৫০ মিলিয়ন বছরে Milkyway Galaxy এর কেন্দ্রের চারদিকে আবর্তিত হয়। আবার Milkyway Galaxy ও নিকটতম Andromeda galaxy ও স্থির নেই। উভয়ই দুর্দান্ত গতিতে নিকটতম Virgo Cluster বা গ্যলাক্সিপুঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। . কুরআনের কোথাও ‘পৃথিবী স্থির’ একথা বলা হয় নাই। অথচ বাইবেলের প্রায় পাঁচটি জায়গায় সুস্পষ্টভাবে ‘পৃথিবী স্থির’ ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু কুরআনের এই মু’জিযা আগেও আলোচিত হয়েছে বহুবার। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর চেয়েও চিন্তা উদ্রেককারী গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার আড়ালেই থেকে গেছে বারবার। সেই সাথে অধিকাংশ সময় আড়ালেই থেকে গেছে আমাদের জ্ঞানচর্চার কিছু মূলনীতি। .

Conflict Thesis

Conflict Thesis হল ধর্ম ও বিজ্ঞানের মৌলিক চিন্তাগত সংঘর্ষকে আবশ্যক ধরে নিয়ে করা ইতিহাসভিত্তিক পর্যালোচনা। শব্দগতভাবে নতুন হলেও ব্যাপারটি নাস্তিক্য ও সেক্যুলার সমাজে অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং New Atheism এর ভিত্তিতে পরিণত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর (১৮০১-১৯০০) দ্বিতীয়ার্ধে প্রাণসৃষ্টির ব্যপারে খ্রিস্টীয় পাদ্রীদের সাথে বিজ্ঞানমহলের নতুন করে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১৮৭০ এর দিকে সেই দ্বন্দ্ব তুঙ্গে উঠে। এমতাবস্থায় John William Draper নামে একজন বিজ্ঞানী সেই পুরনো Galileo affair কে ভিত্তি বানিয়ে এক থিসিস লিখে ফেলেন যা ১৮৭৪ এThe Warfare of Science নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। ‘প্রাণসৃষ্টি’-কে কেন্দ্র করা এবারের দ্বন্দ্বে ডারউইনের ইভল্যুশন সমর্থনকারীরা প্রমাণ, গবেষণা ও যৌক্তিকতায় না হেঁটে ক্যাথলিক চার্চের ঐতিহাসিক নির্যাতনের আলোচনায় মোড় ঘুরিয়ে দেয়। জনপ্রিয় হয় Conflict Thesis. আর ‘Apeal To Emotion’ ফ্যালাসির ফাঁদে পা দিয়ে জন্ম হয় সায়েন্টিজমের। . সূর্যকে কেন্দ্রে ধরা হলেও একইসাথে ‘স্থির’ ও ক্ষেত্রবিশেষে ‘মহাবিশ্বেরই কেন্দ্রে’ দাবি করে কোপার্নিকাস, ব্রুনো আর গ্যালিলিওরা ডাহা ভুল করেছিলেন। কিন্তু তবুও তাদের অবদান কেন এতটা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা? অনেকে ভাবতে পারেন সেই সময়ে আরও আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে অবজারভেশন সম্ভব হয় নি। এটা সত্য হলেও মূল কারণ ছিল না। মূল কারণ ছিল এই বিজ্ঞানীদের ত্যাগ স্বীকারের ব্যাপারটি। ক্যাথলিক চার্চ থেকে অকথ্য নির্যাতনের সম্ভাবনার কথা জেনেও নিজেদের বিশ্বাসের প্রতি তারা অটল ছিলেন। জিওদার্নো ব্রুনোকে তো The Martyr of Science নামেও অভিহিত করা হয়। একারণে সুর্য স্থির বলে ভুল করলেও বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান চর্চাকারী ও অনুরাগীদের অনুপ্রেরণা হয়ে যান ব্রুনো-গ্যালেলিওরা। কিন্তু সত্য খোঁজার অনুপ্রেরণা না হয়ে ব্যাপারটিকে ‘ধর্ম ও বিজ্ঞানের চিরন্তন বিদ্বেষ’ এ নিয়ে যাওয়া তো স্পষ্ট বাড়াবাড়ি, স্পষ্ট ভ্রান্তি। . Conflict Thesis এ Galileo affair এর পর ক্রমে ক্রমে Flat Earth vs Spherical Earth দ্বন্দ্ব এবং শেষে Evolutionism vs Creationism এর আলোচনা করা হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় কয়েকটি। . এক. রোমান ক্যাথলিক চার্চের সাথে হওয়া ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বগুলোর বরাত দিয়ে ‘সকল ধর্মের’ সাথেই বিজ্ঞানের চিরন্তন দ্বন্দ্বের এক নীলনকশা আঁকা হয়েছে। এমনকি Draper এর সর্বপ্রথম থিসিসেও ইসলামের কথা বাদ যায় নি। . দুই. কোনোবিষয়ে বিজ্ঞান ও ধর্মের অমিল হলে সিস্টেমনির্গত বিজ্ঞানীদেরকেই সর্বদা সত্য আর বিজ্ঞানকে সুপিরিয়র বলে চালিয়ে দেওয়ার এক মানসিকতা রচনা করা হয়েছে। এবং আজ অবধি তা চালু রয়েছে। Hollywood এর সিনেমা থেকে শুরু করে দেশীয় জাফর ইকবালদের ‘একটুখানি বিজ্ঞান’ সমস্ত মাধ্যমেই তা স্পষ্ট হয়। . তিন. যেহেতু এক শ্রেণীর আস্তিকদের সাথেই দ্বন্দ্ব হয়েছিল, তাই আস্তিকতার দিকে যায় এমনসব বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ফলাফল কঠোরভাবে দমন করা শুরু হল। আর নাস্তিক্যবাদী হাইপোথিসিসগুলোকে বৈজ্ঞানিক সত্য বলে প্রচার করা শুরু হল। গ্লোবাল সায়েন্টিফিক কমিউনিটিগুলোই ধীরে ধীরে নাস্তিকতার সিস্টেমে পড়ে গেল।
ধর্ম ও বিজ্ঞানের সংঘর্ষ লাগিয়ে রাখার ব্যাপারটি কি সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে? সায়েন্টিফিক কমিউনিটিগুলোর এখনকার অবস্থাই বা কেমন? বিজ্ঞানীদের কেউ কি এখনও বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন? এই প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এবং এগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলেই পাওয়া যায় গ্লোবাল সিস্টেমের আসল রূপ। . Dr. Richard Von Sternberg হলেন Molecular Evolution এবং Theoritical Biology তে আলাদাভাবে Phd করা একজন বিজ্ঞানী। ৩০ টিরও উপর Peer Reviewed সায়েন্টিফিক বই ও জার্নালে তার লিখা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়। এতকাল কোনো সমস্যা না হলেও ২০০৪ সালের আগস্টে তার দায়িত্বে আরেকটি Peer Reviewed Article প্রকাশিত হয়। আর্টিকেলটির মূল লেখক ছিলেন Stephen C. Meyer যিনি নিজেও কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে PhD করা এবং Discovery Institute এর একজন সিনিয়র ডিরেক্টর। আর্টিকেলটির নাম ছিল “The Origin of Biological Information and the Higher Taxonomic Categories”। সেখানে প্রাণসৃষ্টির আণবিক গঠন অত্যন্ত জটিল বলে ডারউইনিইয়ান ইভোল্যুশন এর বদলে “intelligent design” এর সম্ভাবনার কথা হয়েছিল আর বিজ্ঞানী Sternberg এর হাত ধরেই তা প্রকাশিত হয়েছিল। . কিন্তু আর্টিকেলটি প্রচারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই Smithsonian Institution যা কিনা ওই জার্নালটির ফান্ডিং করতো, সেখানকার সিনিয়র বিজ্ঞানীরা ড. Sternberg কে অযোগ্য, ধর্মান্ধ নানা ভাষায় অপদস্থ করা শুরু করেন। বিজ্ঞানী Sternberg কে টাকা খেয়ে একাজ করেছেন, খ্রিস্টীয় স্লিপার সেল অপারেটিভ – নানারকম অপবাদ দেওয়া হয়। Creationism এর পক্ষে যায় – কেবল এমন আর্টিকেলের অনুমতি দেওয়াতেই বিজ্ঞানী Sternberg এর উপর সায়েন্স কমিউনিটিগুলোর খড়গ নেমে আসে। (১) . ইংল্যান্ডের Southampton থেকে Cell Biology তে PhD করা Dr. Caroline Crocker ভার্জিনিয়ার George Mason বিশ্ববিদ্যালয়ে Cell Biology এর কোর্স করাতেন। তার লেকচারে কোষের জটিল গঠন নিয়ে বলতে গিয়ে “intelligent design” এর সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন মাত্র। পাবলিকলি নিজ মত প্রকাশ করায় তিন বছর কন্ট্রাক্ট থাকা সত্ত্বেও আর্থিক অযুহাত দেখিয়ে Dr. Caroline Crocker কে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কন্ট্রাক্ট শেষ হয়ে যাবার দাবি করা হয়। পরবর্তীতে তিনি আবিষ্কার করেন, চাকরির ক্ষেত্রে তিনি রীতিমত ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে গিয়েছেন। সর্বশেষ প্রকাশিত Free To Think বইয়ে তিনি ব্যাপারগুলো বর্ণনা করেছেন। (২) . ইভোলুশনিস্টদের গোঁয়ার্তুমি নিজেদের দিকেই ব্যাকফায়ার করার দৃষ্টান্তও রয়েছে। ২০০৮ সালে Professor Michael Reiss শিক্ষার্থীদের Creationism সম্পর্কেও পড়াবার মত প্রকাশ করার পরের সপ্তাহেই ব্রিটেনের Royal Society থেকে পদত্যাগ করেন। মজার ব্যাপার হল, Professor Reiss নিজেও একজন ডারউইনিস্ট। তিনি Creationism নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্রমাগত প্রশ্নগুলো ধামা চাপা না দিয়ে এটাও আরেকটা ওয়ার্ল্ড ভিউ হিসেবে আর ভুল – অন্তত এমনটা বলবার কথা বলেছিলেন। আর তাতেই কিনা তাকে Royal Society থেকে পদত্যাগ করতে হয়। (৩) . বায়োলোজিস্ট, নিউরোসায়েন্টিস্ট, জোতির্বিদ, পদার্থবিজ্ঞানী যারাই নিজেদের গবেষণাক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়াদির Cause হিসাবে Intelligent Design এর সম্ভাবনার কথা বলেছেন তাঁরাই নিগৃহীত হয়েছেন। Ben Stein পরিচালিত Expelled: No Intelligence Allowed নামক ডকুমেন্টারিতে Intelligent Design এর প্রস্তাবক অনেকের উপর নির্যাতনের বিবরণ ফুটে উঠেছে। (৪) বলাই বাহুল্য, নাস্তিকদের এই ডকুমেন্টারি পছন্দ হয় নাই। অথচ ডকুমেন্টারির ইতি টানা হয়েছিল বিজ্ঞানী ও গবেষকদের নিজস্ব ধারণা কোনোরকম জুলুম ছাড়া প্রকাশ করবার দাবি জানিয়ে। ঠিক যেমনটা Galileo affair এর পর চাওয়া হয়েছিল। . Conflict Thesis এর বর্তমান আলোচিত বিষয়গুলো Evolution vs Intelligent Design যা প্রাণসৃষ্টির ব্যাপারে দুই ওয়ার্ল্ড ভিউয়ের সংঘর্ষকে আলোকপাত করে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, Multiverse vs Intelligent Design যা মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারে দুই ওয়ার্ল্ড ভিউয়ের সংঘর্ষকে আলোকপাত করে। আজগুবি ইভোল্যুশন না বলে যেসব গবেষক ও বিজ্ঞানীরা ‘বুদ্ধিমান সত্ত্বা’ বলছেন তাদের উপরই বর্তমান সায়েন্স কমিউনিটিগুলোর নির্যাতনের ব্যাপারটি যেন ক্যাথলিক চার্চের সেই নির্যাতনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। অবশ্য নাস্তিক্যবাদী মহল নির্যাতন করবে নাই বা কেন… এখন Intelligent Design ই প্রমাণ হয়ে যাওয়া মানে তো সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বই প্রমাণ হয়ে যাওয়া। তখন তো আর বস্তুবাদী নাস্তিকতা চলবে না!
ক্যাথলিক যুগে ব্রুনো গ্যালেলিওর উপর নির্যাতনের ঘটনা থেকে ঢালাওভাবে ‘সকল ধর্মই একইরকম’ উপসংহারে চলে আসা সত্যিই হাস্যকর। “Conflict Thesis” বা বিজ্ঞান আর ধর্মের দ্বন্দ্ব কিন্তু মূলত ধর্মগ্রন্থে ভুল থাকাকে রেফার করে। আর কুরআনে অনেক আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল যে খ্রিস্টানরা তাদের কিতাব বিকৃতি করেছে। সুতরাং, ওদের কিতাবে ভুল থাকা তো আশ্চর্যের কিছু নয়। তাই বর্তমানের প্রতিষ্ঠিত সত্যের সাথে সহজেই ভুল থাকা বাতিল ধর্মগ্রন্থগুলোর অমিল থাকা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যাটা শুরু হয় যখন কুরআনকেও ওই ধর্মগ্রন্থগুলোর সাথে একই কাতারে আনা হয়। . সর্বশেষ আসমানি কিতাব কুরআনে কোনো ভুল নেই। এছাড়াও ১৪০০ বছরের আগের কুরআনের সাথে কোনোকিছু সংযোজন-বিয়োজন হয় নি। ড. মরিস বুকাইলির বিখ্যাত ঘটনা আরেকবার আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। Conflict Thesis থেকে আরেকটি যে উপসংহার টানা হয়, তা হল ধর্মগ্রন্থগুলো মুক্তচিন্তার পথে বাধা দেয়। সেটাও খ্রিস্টানদের ক্যাথলিক নির্যাতনের রেফারেন্স থেকে জেনারালাইজ করে বলা হয়। ইসলামী বিশ্বে এমন একটি উদাহরণও তারা দেখাতে পারে না। বরং ইমাম আবু হানিফা (রহ), ইমাম আহমাদ (রহ) দের শত নির্যাতনেও নিজেদের অবস্থানে, ঈমানে অটল থাকবার ঘটনা কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। . আল্লাহ রব্বুল আলামীন কুরআনকে ‘চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন’ করেছেন। কিন্তু একইসাথে এই নাস্তিক্য যুগে আমরা মুসলিমরা যেটা ভুলে যাই তা হল কুরআন মূলত সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘পথনির্দেশক’। তাই ইসলামী স্বর্ণযুগেও ক্যাথলিক চার্চের মত নির্যাতনের খবর পাওয়া যায় না। কারণ মুসলিমরা কুরআনে সময়ে সময়ে মু’জিযা দেখলেও জীবন গঠনেই ফোকাস করতো। মু’জিযার খোঁজে পড়ে রইতো না। আর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর ﷺ শিক্ষাও এই। . বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল। ‘আধুনিক বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে যায়’ এমন আয়াত-হাদিস দেখলে আমরা সবর করি এবং আমরা জানি যে বরং বিজ্ঞানই ভুল বলছে। যেমন, ১৯৩০ এর আগে পৃথিবী জানতো না যে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল। বিজ্ঞান তখন মনে করতো মহাবিশ্ব স্থির। ব্যাপারটি তখন কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। সেসময়ের কোনো বিজ্ঞান অনুরাগীকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলতো যে কুরআন ভুল বলছে। কিন্তু কুরআন পরিবর্তন হয় নাই। এখন বিজ্ঞান নিজের পূর্বের মত বাদ দিয়ে কুরআনের বক্তব্যেই এসে থেমেছে। তাই মুসলিমদের আধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে দুশ্চিন্তার কখনো কিছু ছিল না বিজ্ঞানের পরিবর্তনশীল প্রকৃতির কারণেই। কিন্তু মানবীয় ছোঁয়া পাওয়া অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের কথা ভিন্ন। . তবে ‘জ্ঞান পরিবর্তনশীল আর ভবিষ্যতে অধিকতর সঠিকটা জানা যাবে’ বিজ্ঞান সম্পর্কে এমন ধারণা রেখে বিজ্ঞানকেই সুপিরিয়র মনে করা কিছু মানুষ রয়েছে। এমন দর্শন উপজীব্য করে বেঁচে থাকা অবিশ্বাসীদের বলি, আমরাও কিন্তু একই কথাই বলে যাই সবসময় –
“না, সত্ত্বরই তারা জানতে পারবে। অতঃপর না, সত্বর তারা জানতে পারবে।” (সূরা নাবা, ৪-৫) .
. রেফারেন্সঃ
.
.
.

রোম সম্রাটের প্রতি রাসুলুল্লাহর(স) দাওয়াত

রোম সম্রাটের প্রতি রাসুল সাঃ দাওয়াত ও আবু সুফিয়ানের সত্যতা ।

সপ্তম হিজরি, ৬২৯ খ্রিস্টাব্দ। মক্কার কাফেরদের কুরাইশ দের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হুদায়বিয়ার সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়েছে । যে ইসলামের নাম শুনলে জ্বলে উঠত কুরাইশদের গা, আজ সেই কুরাইশগণ স্পষ্টত: স্বীকৃতি দিল ইসলামকে একটি শক্তিশালী ধর্ম হিসাবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নদীর মোহনায় এসে তাঁর সাধনার স্রোতধারায় শুনতে পেলেন মহাসাগরের কল্লোল। তাই তিনি মনস্থ করলেন বিশ্বের শক্তিশালী রাজা-বাদশাহদের নিকট ইসলামের সুমহান বার্তা পৌঁছাতে। তৎকালীন বিশ্বের বুকে রোম ও পারস্য ছিল সবচেয়ে ক্ষমতাধর শক্তিশালী সাম্রাজ্য। রোমান সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা ছিলেন সম্রাট হিরাক্লিয়াস।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রখ্যাত সাহাবী দেহিয়া কালবী রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে ইসলামের দাওয়াত পত্র তাঁর কাছে প্রেরণ করেন। সম্রাট হিরাক্লিয়াস ঐ সময় জেরুজালেমে অবস্থান করছিলেন। এদিকে কুরাইশ নেতা আবূ সুফিয়ান (তখনও তিনি মুসলমান হননি) ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়াতে অবস্থান করছিলেন। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তাকে আবূ সুফিয়ান বিন হারব সংবাদ দিয়েছেন যে, একদা রোম সম্রাট হিরাকিলয়াস তাঁকে একদল কুরাইশ সহ ডেকে পাঠালেন। তখন তাঁরা ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়াতে অবস্থান করছিলেন।

এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবূ সুফিয়ান ও কুরাইশদের সাথে হুদায়বিয়ার সন্ধি-সূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। সম্রাট হিরাকিলয়াস তাঁর অমাত্যবর্গ পরিবৃত অবস্থায় ঈলিয়া বা জেরুসালেমে অবস্থানকালে তাঁরা সম্রাটের দরবারে আগমন করলেন। সম্রাট হিরাকিলয়াস তাঁদেরকে স্বীয় মজলিসে ডেকে নিলেন। তখন তাঁর চতুষপার্শ্বে ছিলেন রোমান প্রধানগণ।

অতঃপর তিনি কুরাইশগণকে এবং তাঁর দোভাষীকে আহবান জানিয়ে বললেন, যে লোকটি তোমাদের মধ্যে নবী বলে দাবী করছেন বংশগতভাবে তোমাদের মধ্যে কে তাঁর অধিক নিকটবর্তী? আবূ সুফিয়ান বললেন, তখন আমি বললাম, ‘বংশগতভাবে আমিই তাঁর নিকটতম ব্যক্তি। সম্রাট হিরাকিলয়াস নির্দেশ দিলেন যে, তাকে আমার নিকটবর্তী করো এবং তাঁর সঙ্গী- সাথীগণকেও ডেকে এনে তাঁর পেছনে উপস্থিত কর। অতঃপর সম্রাট তার দোভাষীকে বললেন, তুমি তাদেরকে বল, আমি এই লোকটিকে তাঁর [রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করব। যদি সে আমার সাথে কোন মিথ্যা কথা বলে, তবে তোমরা যেন তাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণ করো।

আবূ সুফিয়ান বলেন, ‘আল্লাহ্‌র কসম! লোকেরা আমার উপর মিথ্যা আরোপ করবে বলে যদি আমার লজ্জার ভয় না হত, তাহলে তখন আমি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলতাম। সম্রাট সর্বপ্রথম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, যিনি নবী বলে দাবী করছেন তাঁর বংশ কেমন?

আবূ সুফিয়ান: তিনি আমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশগত।

সম্রাট: তাঁর পূর্বে তোমাদের মধ্য হতে কোন ব্যক্তি কখনও এমন কথা বলেছে কি?

আবূ সুফিয়ান: না।

সম্রাট: তাঁর পিতৃপুরুষগণের মধ্যে কেউ বাদশাহ ছিলেন কি?

আবূ সুফিয়ান: না।

সম্রাট: প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর অনুসরণ করছে, না দুর্বল লোকেরা?

আবূ সুফিয়ান: দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণীর লোকগুলো।

সম্রাট: তাদের সংখ্যা কি দিন দিন বাড়ছে, না কমছে?

আবূ সুফিয়ান: না, বরং বাড়ছে।

সম্রাট: তাদের মধ্যে কেউ কি সেই দ্বীনে প্রবেশ করার পর তার দ্বীনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তা ত্যাগ করে থাকে?

আবূ সুফিয়ান: না।

সম্রাট: সে নবুঅত লাভের পূর্বে কি তোমরা তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে অপবাদ দিতে?

আবূ সুফিয়ান: না।

সম্রাট: তিনি কখনো কোন অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন কি?

আবূ সুফিয়ান: না। তবে আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তার সাথে এক সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি, জানি না এ সময়ের মধ্যে তিনি কি করবেন?

আবূ সুফিয়ান (পরবর্তীতে) বলেন, এই কথাটি ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে অন্য কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

সম্রাট: তোমরা কি তাঁর সাথে কোন যুদ্ধ করেছ?

আবূ সুফিয়ান: হ্যাঁ।

সম্রাট: যুদ্ধের ফলাফল কি?

আবূ সুফিয়ান: তাঁর ও আমাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত যুদ্ধের ফলাফল হল বালতিতে পালাক্রমে পানি তোলার ন্যায়। অর্থাৎ কোনটায় তিনি জয় লাভ করেন এবং কোনটায় আমরা।

সম্রাট: তিনি তোমাদেরকে কি নির্দেশ দিয়ে থাকেন?

আবূ সুফিয়ান: তিনি বলেন, তোমরা একমাত্র আল্লাহ্‌র ইবাদত কর। তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করোনা । আর তোমরা তোমাদের বাপ-দাদারা যা বলে বেড়াত, তা পরিত্যাগ কর। তিনি আমাদেরকে ছালাত প্রতিষ্ঠা করতে, সর্বদা সত্য কথা বলতে, অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকতে এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখতে বলেন।

সম্রাট হিরাক্লিয়াস দোভাষীকে বললেন, তুমি তাকে বল, আমি তোমাকে তাঁর বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি। তুমি উত্তরে বলেছ, তিনি তোমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশজাত। প্রকৃতপক্ষে নবী-রাসূলগণ তাঁদের কওমের সম্ভ্রান্ত পরিবারে প্রেরিত হয়ে থাকেন। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তোমাদের মধ্যে কেউ কি এ কথা (নবী হওয়ার কথা) বলেছেন? তুমি উত্তরে বলেছ, না। আমি বলতে চাই- যদি তাঁর পূর্বে কেউ এ কথা বলত, তবে অবশ্যই আমি বলতে পারতাম, তিনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি পূর্বের কথার পুনরাবৃত্ত করেছেন।

আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁর পিতৃপুরুষগণের মধ্যে কোন বাদশাহ ছিলেন কি? তুমি উত্তরে বলেছ, না। আমি বলতে চাই- যদি তাঁর পিতৃপুরুষগণের মধ্যে কোন বাদশাহ থাকতে, তাহলে আমি বলতাম, তিনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করতে ইচ্ছুক। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তোমরা তাঁর নবুঅত লাভের পূর্বে তার প্রতি কোন মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলে কি? তুমি উত্তরে বলেছ, না। কাজেই আমি বুঝতেছি, তিনি এমন ব্যক্তি নন, যিনি মানুষের ব্যাপারে মিথ্যারোপ করবেন এবং আল্লাহ্‌র উপর মিথ্যারোপ করবেন।আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি যে, প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর অনুসরণ করছে, না নিরীহ-দুর্বল লোকগুলো? তুমি উত্তরে বলেছ, নিরীহ-দুর্বল লোকেরাই তাঁর অনুসরণ করছে।আসলে নিরীহ-দুর্বল লোকেরাই নবী-রাসূ্ল গণের অনুসারী হয়ে থাকে।

আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তারা সংখ্যায় বৃদ্ধি প্রাপ্ত হচ্ছে, না হ্রাস পাচ্ছে? তুমি উত্তরে বলেছ, বৃদ্ধি হচেছ।ঈমানের ব্যাপারটি পূর্ণতা লাভের সময় পর্যন্ত এরূপই হয়ে থাকে।আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ তার দ্বীনে প্রবেশ করে বীতশ্রদ্ধ হয়ে আবার সে দ্বীন পরিত্যাগ করেছে কি? তুমি উত্তরে বলেছ, না। আসলে ঈমানের দীপ্তি ও সজীবতা অন্তরের সাথে মিশে গেলে এরূপই হয়ে থাকে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি কোন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন কি? তুমি উত্তরে বলেছ, না। নবী-রাসূ্ল গণ এরূপই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।

আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি তোমাদেরকে কি নির্দেশ প্রদান করেন? তুমি উত্তরে বলেছ, তিনি তোমাদেরকে একমাত্র আল্লাহ্‌র ইবাদত করার ও তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক না করার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি তোমাদেরকে মূর্তিপূজা করতে নিষেধ করেন এবং তোমাদেরকে ছালাত প্রতিষ্ঠা করার, সত্য কথা বলার ও পূত-পবিত্র থাকার নির্দেশ প্রদান করেন।

তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তবে তিনি অত্যন্ত অল্পকালের মধ্যেই আমার এ পদদ্বয়ের নিম্নবর্তী স্থানের (সিরিয়ার) মালিক হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবেন। আমি নিশ্চিত জানতাম, তার আবির্ভাব হবে; কিন্তু তিনি যে তোমাদের মধ্য হতে হবেন, একথা ভাবতে পারিনি।

আমি যদি যথাযথভাবে তাঁর নিকট পৌছাতে পারব বলে জানতে পারতাম, তাহলে আমি তাঁর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সম্ভাব্য সর্ব প্রকার কষ্ট স্বীকার করতাম। আর আমি যদি তাঁর নিকট থাকতাম, তাহলে অবশ্যই আমি তাঁর পা ধুয়ে দিতাম। অতঃপর সম্রাট হিরাক্লিয়াস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পত্রখানা আনতে বললেন, যে পত্রখানা দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবী দেহিয়া কালবী রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে বসরার শাসনকর্তার নিকট পাঠিয়েছিলেন। বসরার অধিপতি হারেস পত্রখানা সম্রাট হিরাকিলয়াসকে প্রদান করলে তিনি তা পাঠ করলেন। পত্রটি ছিল নিন্ম রূপ-

❝পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্‌র নামে শুরু করছি। আল্লাহ্‌র বান্দা ও তদীয় রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হতে রোম সম্রাট হিরাকিলয়াসের প্রতি। যারা সঠিক পথের অনুসারী, তাঁদের উপর শান্তি বর্ষিত হৌক। অতঃপর, আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, নিরাপদে থাকতে পারবেন। আল্লাহ্‌ আপনাকে দ্বিগুণ পুরস্কারে ভূষিত করবেন। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহলে সকল প্রজার পাপ আপনার উপর বর্তাবে।

‘হে আহলে কিতাব! ” يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْاْ إِلَى كَلَمَةٍ سَوَاء بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلاَّ نَعْبُدَ إِلاَّ اللّهَ وَلاَ نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلاَ يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضاً أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللّهِ فَإِن تَوَلَّوْاْ فَقُولُواْ اشْهَدُواْ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ ‘তোমরা একটি কথার দিকে চলে আস, যে কথাটি আমাদের ও তোমাদের মধ্যে অভিন্ন, আমরা যেন আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করি, তাঁর সাথে অন্য কোন কিছুকে শরীক না করি এবং আমাদের কেউ যেন আল্লাহ্‌ ছাড়া অপর কাউকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ না করি। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তাদের বলে দাও, তোমরা সাক্ষী থাক যে, আমরা মুসলিম ❞ (সুরা আল ইমরান ০৩:৬৪) ।

আবূ সুফিয়ান বলেন, যখন সম্রাট হিরাক্লিয়াস তাঁর বক্তব্য ও পত্রখানা পাঠ শেষ করলেন, তখন তাঁর সম্মুখে শোরগোল ও চীৎকার চরম আকার ধারণ করল এবং আমাদেরকে বের করে দেয়া হল। তখন আমি আমার সঙ্গী-সাথীদেরকে বললাম, আবূ কাবশার (মুহাম্মাদ) ছেলের বিষয় তো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, বনু আছফার (রোম)-এর বাদশাহও তাকে ভয় পাচ্ছে। তখন থেকে আমি বিশ্বাস করতাম যে, তিনি শীঘ্রই জয়ী হবেন। অবশেষে মহান আল্লাহ্‌ আমাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফীক্ব দিলেন
**(সহীহ বুখারী হা/৭, ‘অহির সূচনা’অধ্যায়, অনুচেছদ-৬, সহিহ মুসলিম হা/১৭৭৩, মিশকাত হা/৫৮৬১)।

সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) কি আসলেই ৩টি সুরাকে কুরআনের অংশ বলে মানতেন না?

কুরআন সংকলন ও সংরক্ষণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে খ্রিষ্টান মিশনারী, নাস্তিক-মুক্তমনা ও ইসলাম বিদ্বেষী প্রাচ্যবিদরা যেসব অভিযোগ করে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—প্রখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) এর মুসহাফে(লিপিবদ্ধ পূর্ণ কুরআন) ১১১টি সুরা ছিল। তিনি সুরার প্রচলিত কুরআনের ৩টি সুরা অন্তর্ভুক্ত করেননি। অতএব আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা)এই ৩টি সুরাকে কুরআনের অংশ হিসাবে মানতেন না এবং তাঁর কুরআন ছিল উসমান(রা) কর্তৃক সংকলিত কুরআন তথা বর্তমানে প্রচলিত কুরআন থেকে ভিন্ন!!! —এই হচ্ছে তাদের অভিযোগ।
এই নোটে ইসলামবিদ্বেষীদের দাবির পোস্টমর্টেম করে তাদের ভ্রান্ত অভিযোগের স্বরূপ উন্মোচন করা হবে ইন শা আল্লাহ।

জালালুদ্দিন সুয়ুতি(র)এর উলুমুল কুরআন সম্পর্কিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল ইতকান’ এ একটি রেওয়ায়েত আছে যাতে বলা হয়েছে যে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) এর মুসহাফে তিনটি সুরা ছিল না। যথাঃ সুরা ফাতিহা ও মুয়াওয়িযাতাইন(সুরা ফালাক ও সুরা নাস) অর্থাৎ ১,১১৩ ও ১১৪নং সুরা। [১]
এই লেখায় প্রকৃত সত্য উন্মোচনের জন্য সুরা ফাতিহা ও মুয়াওয়িযাতাইন(সুরা ফালাক ও নাস) এর ব্যাপারে সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) এর অবস্থান পৃথক পৃথকভাবে দলিল-প্রমাণসহ আলোচনা করা হবে।

সুরা ফাতিহার ব্যাপারে ইবন মাসউদ(রা) এর অবস্থানঃ
‘ফাতিহা’ মানে হচ্ছে সূচনা, ভূমিকা কিংবা সূত্রপাত করা।এর পুরো নাম “ফাতিহাতুল কিতাব” বা কিতাবের(অর্থাৎ কুরআনের) সূচনা।সুরা ফাতিহার বিষয়টি এমন যে এই সুরার অস্তিত্বের ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর সন্দেহের দূরতম সম্ভাবনাও নেই। প্রতিদিনের ৫ ওয়াক্ত সলাতের প্রত্যেক রাকাতেই এই সুরাটি আবশ্যকীয়ভাবে পড়তে হয়।সলাত(নামাজ) আদায়কারী মুসলিমমাত্রই একে আল কুরআনের অংশ হিসাবে জানেন।
সুরা ফাতিহার অস্তিত্বের স্বীকৃতি দিচ্ছে স্বয়ং কুরআনঃ
وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعًا مِنَ الْمَثَانِي وَالْقُرْآنَ الْعَظِيمَ
“ আমি তোমাকে[মুহাম্মাদ(স)] সাতটি বার বার পঠিতব্য আয়াত এবং মহান কুরআন দিয়েছি।”
(কুরআন, হিজর ১৫:৮৭)
এখানে ‘সাতটি বার বার পঠিতব্য আয়াত’ দ্বারা সুরা ফাতিহাকে নির্দেশ করা হচ্ছে।

ইবন জারির তাবারী(র)কে উদ্ধৃত করে জালালুদ্দিন সুয়ুতি(র)নিম্নোক্ত রেওয়ায়েতটি বর্ণণা করেনঃ
عن ابن مسعود في قوله: {ولقد آتيناك سبعا من المثاني} قال: فاتحة الكتاب
ইবন মাসউদ(রা) থেকে আল্লাহর বাণীর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, “ আমি তোমাকে[মুহাম্মাদ(স)] সাতটি বার বার পঠিতব্য আয়াত এবং মহান কুরআন দিয়েছি।” তিনি বলেনঃ এ হচ্ছে ফাতিহাতুল কিতাব(সুরা ফাতিহা)। [২]

এখানে দেখা যাচ্ছে যে স্বয়ং আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) কুরআনের আয়াত হিসাবে সুরা ফাতিহার কথা কুরআন থেকে বর্ণণা করছেন।এই বিবরণ থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) সুরা ফাতিহাকে কুরআনের অংশ বলে বিশ্বাস করতেন, ঠিক যেভাবে অন্য সকল মুসলিম বিশ্বাস করত।

ইবন মাসউদ(রা) কেন সুরা ফাতিহাকে তাঁর মুসহাফে অন্তর্ভুক্ত করলেন না? :
ইবন মাসউদ(রা) যদি সুরা ফাতিহাকে কুরআনের অংশ বলেই বিশ্বাস করতেন, তাহলে কেন তিনি একে তাঁর মুসহাফে অন্তর্ভুক্ত করলেন না? তাঁর নিজ বক্তব্যেই এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়।
আবু বকর আল আনবারী(মৃত্যু ৩০৪ হিজরী) উল্লেখ করেছেন, বর্ণিত আছে যে–
قيل لعبد الله بن مسعود: لم لم تكتب فاتحة الكتاب في مصحفك؟ قال: لو كتبتها لكتبتها مع كل سورة. قال أبو بكر: يعني أن كل ركعة سبيلها أن تفتتح بأم القرآن قبل السورة المتلوة بعدها، فقال: اختصرت بإسقاطها، ووثقت بحفظ المسلمين لها
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা)কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কেন তিনি সুরা ফাতিহাকে তাঁর মুসহাফে উল্লেখ করেননি।তিনি জবাবে বলেছিলেন, “যদি লিপিবদ্ধ করতামই, তাহলে আমি একে প্রত্যেক সুরার আগে লিপিবদ্ধ করতাম।”


এটা পড়তে পারেন – সংঘর্ষ তত্ত্ব


আবু বকর আল আনবারী এই কথার ব্যাখ্যায় বলেন, প্রত্যেক রাকাত(নামাজে) শুরু হয় সুরা ফাতিহার দ্বারা এবং এর পরে অন্য সুরা তিলাওয়াত করা হয়।ইবন মাসউদ(রা) এর বক্তব্য ছিল ঠিক এই বক্তব্যের ন্যায়ঃ “আমি সংক্ষিপ্ততার জন্য একে বাদ দিয়েছি এবং মুসলিমদের দ্বারা এর সংরক্ষণের ব্যাপারে আস্থা রাখছি।” [৩]

এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে, কোন একটি অংশ মুসহাফে উল্লেখ না করার অর্থ এই নয় যে এটিকে তিনি কুরআনের অংশ বলে মনে করেন না।এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট যা পাঠকদের মনে রাখবার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।

মুয়াওয়িযাতাইন(সুরা ফালাক ও নাস) এর ব্যাপারে ইবন মাসউদ(রা) এর অবস্থানঃ
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) যে সুরা ফালাক ও সুরা নাসকে কুরআনের অংশ বলে বিশ্বাস করতেন—এই কথার পেছনে বেশ কিছু শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে।

১।স্বয়ং ইবন মাসউদ(রা) থেকে মুয়াওয়িযাতাইন এর বিবরণঃ
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) থেকে সুরা ফালাক ও সুরা নাস এর মর্যাদার বর্ণণা পাওয়া যায়।
عن ابن مسعود قال: استكثروا من السورتين يبلغكم الله بهما في الآخرة المعوذتين

ইবন মাসউদ(রা) থেকে বর্ণিতঃ “দুইটি সুরা বেশি করে পড়ো, আল্লাহ এর জন্য আখিরাতে তোমাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন।আর তারা হচ্ছেঃ আল মুয়াওয়িযাতাইন(সুরা ফালাক ও সুরা নাস)।” [৪]
এটা কী করে সম্ভব হতে পারে যে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) সুরা ফালাক ও সুরা নাসের মর্যাদা বর্ণণা করবেন, অথচ এই সুরাদ্বয়কে কুরআনের অংশ বলে মনে করবেন না তথা এদের অস্তিত্ব অস্বীকার করবেন? সুবহানাল্লাহ; ইসলামবিরোধীদের অভিযোগের অসারতা এই রেওয়ায়েতের দ্বারা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে।

২। ইবন মাসউদ(রা) থেকে বর্ণিত সকল কিরাতে মুয়াওয়িযাতাইন এর উপস্থিতিঃ
প্রাচীন যুগ থেকেই কুরআন সংরক্ষণের প্রধানতম মাধ্যম ছিল হাফিজগণের স্মৃতি। আল্লাহ তা’আলা প্রিয় নবী (ﷺ)কে বলেনঃ
وأنزلت عليك كتابا لا يغسله الماء
“আমি তোমার উপর কিতাব নাজিল করেছি যা পানি দ্বারা ধুয়ে যাওয়া সম্ভব নয়” [৫]
{{ পানি দ্বারা সেই জিনিস ধুয়ে যাওয়া সম্ভব যা কাগজের উপর কালি দ্বারা লেখা হয়। যা স্মৃতিতে সংরক্ষিত থাকে, তার পক্ষে ধুয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।}}
মুসলিম কিরাত বিশেষজ্ঞগণ সবসময়েই কুরআনকে অবিচ্ছিন্ন বর্ণণাক্রম দ্বারা হিফাজত করেছেন যা স্বয়ং রাসুল(ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছেছে।মুতাওয়াতির কিরাতগুলো কুরআনের সংরক্ষিত থাকবার একটি বড় প্রমাণ।

সকল মুতাওয়াতির কিরাতের মধ্যেই সুরা ফালাক ও সুরা নাস বিদ্যমান(এবং অবশ্যই সুরা ফাতিহাও সেগুলোতে রয়েছে।)।এই কিরাতগুলোর মধ্যে চারটি কিরাত রয়েছে, যেগুলোর বর্ণণাক্রম আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) থেকে রাসুল(ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছেছে।
নিম্নে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) থেকে বর্ণণাকৃত কিরাতগুলোর ব্যাপারে সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করা হল।

ক) আসিম এর কিরাতঃ এর বর্ণণাক্রম যির থেকে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) থেকে মুহাম্মাদ(ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছেছে।
উল্লেখ্য যে, উক্ত আসিম(মৃত্যু ১২৮ হিজরী) এবং যির(মৃত্যু ৮৩ হিজরী) মুসনাদ আহমাদ এর বর্ণণাকারীদের অন্তর্ভুক্ত।এই বর্ণণাকারীগণ থেকে এমন বিবরণ পাওয়া যায় যাতে বলা হয়েছে যে ইবন মাসউদ(রা) তাঁর মুসহাফে সুইটি সুরা(ফালাক ও নাস) উল্লেখ করেননি। অথচ তাঁদের থেকেই আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) এর সূত্রে যে কিরাত বর্ণিত হয়েছে, তাতে সুরা ফালাক ও সুরা নাস বিদ্যমান, আলহামদুলিল্লাহ।অতএব স্বয়ং বর্ণণাকারীগণ থেকে প্রমাণিত হল যে, মুসহাফে উল্লেখ না করলেও আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) এই সুরাদ্বয়কে কুরআনের অংশ হিসাবে তিলাওয়াত করতেন। [৬]
খ) হামজা এর কিরাতঃ এর বর্ণণাক্রম আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা)এর সূত্রে নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছেছে। [৭]
গ)আল কিসাই এর কিরাতঃ এর বর্ণণাক্রমও আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) থেকে মুহাম্মাদ(ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছেছে। [৮]
ঘ) খালাফ এর কিরাতঃ এর বর্ণণাক্রমও আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) থেকে মুহাম্মাদ(ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছেছে। [৯]
এই মুতাওয়াতির কিরাতগুলোর বর্ণাক্রমের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) রয়েছেন এবং কিরাতগুলোর প্রত্যেকটিতে সুরা ফাতিহা, সুরা ফালাক ও সুরা নাস রয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।এর ফলে সামান্যতম সন্দেহেরও আর অবকাশ রইলো না যেঃ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) সুরা ফাতিহা, সুরা ফালাক ও সুরা নাসকে আল কুরআনের অংশ হিসাবে তিলাওয়াত করতেন।

কিছু বিপরীত বর্ণণা সম্পর্কে আলোচনাঃ
এবার আমরা কিছু রেওয়ায়েতের পর্যালোচনা করব যেগুলো ব্যবহার করে ইসলামবিরোধিরা অপপ্রচার চালায়।

বর্ণণা ১:
আবদাহ এবং আসিম যির থেকে বর্ণণা করেছেন, তিনি বলেনঃ
قلت لأبي: إن أخاك يحكهما من المصحف، قيل لسفيان: ابن مسعود؟ فلم ينكر
“আমি উবাই(রা)কে বলেছি, “আপনার ভাই ইবন মাসউদ(রা) সেগুলোকে(সুরা ফালাক ও নাস) তাঁর মুসহাফ থেকে মুছে ফেলেছেন”, এবং তিনি এতে কোন আপত্তি করলেন না।” [১০]

বিভ্রান্তি অপনোদনঃ
আমরা এই বর্ণণাটিতে দেখছি যে, ইবন মাসউদ(রা) সুরাগুলো মুছে ফেলেছেন শুনেও কুরআনের আলিম সাহাবী উবাই বিন কা’ব(রা) কোন আপত্তি বা প্রতিবাদ করছেন না।অথচ ইসলামের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত আকিদা হচ্ছেঃ কেউ যদি কুরআনের একটি আয়াতও অস্বীকার করে, তাহলে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় এবং কাফির হিসাবে পরিগণিত হয়।অতএব ইবন মাসউদ(রা) যদি আসলেই সুরাদ্বয়কে কুরআনের অংশ হিসাবে মানতে অস্বীকার করতেন, তাহলে উবাই(রা) অবশ্যই কোন না কোন প্রতিক্রিয়া দেখাতেন। অথচ তিনি তেমন কিছুই করেননি।এ থেকে সুপষ্টভাবে প্রতিভাত হচ্ছে যেঃ উবাই(রা) এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে ইবন মাসউদ(রা) উক্ত সুরাদ্বয়কে কুরআনের অংশ হিসাবে মানতে অস্বীকার করছেন না। শুধুমাত্র নিজ মুসহাফে উল্লেখ করেননিমাত্র।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছেঃ যে আসিম ও যির এই রেওয়ায়েতের বর্ণণাকারী, তাঁরা স্বয়ং আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) এর সূত্রে বর্ণিত কিরাত থেকে সুরা ফালাক ও সুরা নাস পাঠ করেছেন।

বর্ণণা ২:
عن عبد الرحمن بن يزيد، قال: كان عبد الله، ” يحك المعوذتين من مصاحفه، ويقول: إنهما ليستا من كتاب الله “
আব্দুর রহমান বিন ইয়াজিদ বর্ণণা করেছেনঃ ইবন মাসউদ(রা) মুয়াওয়িযাতাইন(সুরা ফালাক ও সুরা নাস)কে তাঁর মুসহাফ থেকে মুছে ফেলেছেন এবং বলেছেন এগুলো কুরআনের অংশ নয়।
একই বিবরণ ইমাম তাবারানী(র) এর মু’জামুল কাবিরেও এসেছে। [১২]

বিভ্রান্তি অপনোদনঃ
এই বর্ণণাটি সত্য হতে পারে না কেননা এটি একটি শাজ বা বিচ্ছিন্ন বর্ণনা যা শুধুমাত্র আব্দুর রহমান বিন ইয়াজিদ বর্ণণা করেছেন।হাদিস শাস্ত্রে মুতাওয়াতিরের বিপরীতে বিচ্ছিন্ন বর্ণণা দ্বারা কোন বিষয় প্রমাণিত হয় না।এমনকি ঐ বর্ণণার সনদ সহীহ হলেও।এক্ষেত্রে একে মু’আল্লাল বা ত্রুটিপূর্ণ বর্ণণা বলে। [১৩]

বিপরীত বর্ণণাগুলো সম্পর্কে উলামাগণের অভিমতঃ
ইমাম নববী(র) বলেনঃ
أجمع المسلمون على أن المعوذتين والفاتحة من القرآن وأن من جحد منها شيئا كفر وما نقل عن ابن مسعود باطل ليس بصحيح.
“এ ব্যাপারে মুসলিমগণের ইজমা রয়েছে যে মুয়াওয়িযাতাইন ও সুরা ফাতিহা কুরআনের অংশ এবং যে তা অস্বীকার করে সে কাফির হয়ে যায়।আর এ ব্যাপারে ইবন মাসউদ(রা) থেকে যা বর্ণিত আছে তা মিথ্যা এবং সহীহ নয়।”[১৪]
আবু হাফস ইবন আদিল আল হাম্বালী(র) লিখেছেনঃ
هذا المذهب عن ابن مسعود نقل كاذب باطل
“ইবন মাসউদ(রা) এর থেকে বর্ণিত এই অভিমতটি মিথ্যা ও বানোয়াট।” [১৫]
আল খিফাজী(র) বলেনঃ
وما نقل عن ابن مسعود رضي الله عنه من أنّ الفاتحة والمعوّذتين ليست من القرآن لا أصل له
“আর, ইবন মাসউদ(রা) থেকে সুরা ফাতিহা ও মুয়াওয়িযাতাইন কুরআনের অংশ নয় মর্মে যা বর্ণিত হয়েছে তার কোন ভিত্তি নেই।” [১৬]
এছাড়া ইমাম ইবন হাজম(র) থেকেও অনুরূপ বর্ণিত আছে। [১৭]
ইমাম সুয়ুতি(র) আবু বকর আল বাকিলানী(র) থেকে উদ্ধৃত করেছেনঃ
لم يصح عنه أنها ليست من القرآن ولا حفظ عنه. إنما حكها وأسقطها من مصحفه إنكارا لكتابتها لا جحدا لكونها قرآنا لأنه كانت السنة عنده ألا يكتب في المصحف إلا ما أمر النبي صلى الله عليه وسلم بإثباته فيه ولم يجده كتب ذلك ولا سمعه أمر به.
“এটি মোটেও তাঁর{ইবন মাসউদ(রা)} থেকে প্রমাণিত নয় যে এই সুরাদ্বয় কুরআনের অংশ নয়।কুরআনের অংশ হিসাবে অস্বীকার করে তিনি এই সুরাদ্বয়কে তাঁর মুসহাফ থেকে মোছেননি বা বাদ দেননি।তাঁর নিকট বিষয়টি এরূপ ছিল যে, তিনি নবী(ﷺ) এর নির্দেশ ব্যতিত কিছুই মুসহাফে লিখতেন না।এবং তিনি এ ব্যাপারে কিছু লিখিত পাননি বা এ ব্যাপারে কোন নির্দেশ শোনেননি। ” [১৮]

অতএব, উপরিউক্ত আলোচনা ও দলিল-প্রমাণ দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হল যেঃ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) এর বিরুদ্ধে ৩টি সুরাকে(ফাতিহা, ফালাক ও নাস) কুরআনের অংশ হিসাবে না মানার যে অভিযোগ তোলা হয় তা থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত এবং এই সম্মানিত সাহাবী অন্য সকল মুসলিমের ন্যায় একই কুরআন পাঠ করতেন।সেই সাথে উসমান(রা) কর্তৃক সংকলিত কুরআনের বিরুদ্ধে ইসলামবিদ্বেষীদের অভিযোগও মিথ্যা প্রমাণিত হল।
এবং আল্লাহ ভালো জানেন।

 

quran কুরআন

তথ্যসূত্রঃ
[১] আস সুয়ুতি, আল ইতকান ফি উলুমিল কুরআন,(কায়রোঃ আল হাইয়া আল মিসরিয়্যাহ, ১৯৭৪) খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৭
[২] আস সুয়ুতি, দুরর মানসুর ফি তাফসির বিল মাসুর, (বৈরুতঃ দারুল ফিকর) খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৯৪
[৩] কুরতুবী, জামি লি আহকাম আল কুরআন, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১১৫(কায়রোঃ দারুল কুতুব আল মিসরিয়্যাহ, ১৯৬৪)
[৪] আলী আল মুত্তাকী, কানজুল উম্মাল, (বৈরুতঃ আর রিসালাহ পাবলিকেশন্স, ১৯৮১) হাদিস নং ২৭৪৩
[৫] মুসলিম, আস সহীহ, (রিয়াদঃ মাকতাবা দারুস সালাম, ২০০৭) হাদিস ৭২০৭
[৬] আল জাযরী, আন নাশর ফি কিরাআত আল ‘আশার, (কায়রোঃ মাকতাবা আত তিজারিয়াহ আল কুবরা) খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৫৫
[৭] প্রাগুক্ত; খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৬৫
[৮] প্রাগুক্ত; খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৭২
[৯] প্রাগুক্ত; খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৮৫
[১০] আহমাদ বিন হাম্বাল, আল মুসনাদ, (বৈরুতঃ আর রিসালাহ পাবলিকেশনস, ২০০১) হাদিস নং ২১১৮৯
[১১] আহমাদ বিন হাম্বাল, আল মুসনাদ, হাদিস নং ২১১৮৮
[১২] আত তাবারানী, মু’জামুল কাবির, (কায়রোঃ মাকতাবা ইবন তাইমিয়া, ১৯৯৪) হাদিস নং ৯১৫০
[১৩] মু’আল্লাল বা ত্রুটিপূর্ণ বর্ণণার ব্যাপারে জানতে দেখতে পারেনঃ Ibn as-Salah, An Introduction to the Science of Hadith, Translated by Dr. Eerik Dickinson (Berkshire: Garnet Publishing Ltd., 2006) page 57 & 67
[১৪] আস সুয়ুতি, আল ইতকান, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৭১
[১৫] ইবন আদিল আল হাম্বালী, আল বাব ফি উলুমুল কিতাব, (বৈরুতঃ দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৮) খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৪৯
[১৬] আল খিফাজী, ইনায়া আল কাযি ওয়া কিফায়া আর রাজি ‘আলা তাফসিরুল বাইযাওয়ি, (বৈরুত, দারুস সদর) খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৯
[১৭] ইবন হাজম, আল মুহাল্লা(বৈরুতঃ দারুল ফিকর) খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩২
[১৮] আস সুয়ুতি, আল ইতকান, (কায়রো: হাইয়া আল মিসরিয়্যাহ, ১৯৭৪) খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৭১
সহায়ক ওয়েবসাইটঃ
http://www.icraa.org/
http://www.letmeturnthetables.blogspot.com/…