23.7 C
New York
Thursday, July 3, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog

লিঙ্গ পরিবর্তনের ভয়াবহ পরিণতি – রুপান্তরকামী

আমার নাম ক্লো। আমি একজন মেয়ে। কিন্তু একটা সময় আমি নিজেকে ভাবতাম রুপান্তরকামী

আমার বয়স যখন বারো বছর, তখন মনে হলো আমার কী যেন ঠিক নেই। আমি আসলে মেয়ে না। ভুল শরীরে আটকে পড়া একজন মানুষ, একজন ছেলে। আমি ছেলে হতে চাই, মেয়ে হতে চাই নি কখনো।

কেন এমনটা ভাবতাম আমি? আমার শরীরটা ছিল আগাগোড়া মেয়েদের মতো। আমার বয়স যখন নয় তখন আমার বয়োঃসন্ধি হয়। ঝামেলাটা তখন থেকেই শুরু। আমি নিজেকে নিয়ে সুখী হতে পারছিলাম না।

আমার বয়োঃসন্ধি একটু আগে হওয়ায় আমি আমার সমবয়সী মেয়েদের থেকে একটু লম্বা ছিলাম, ছেলেদের সাথে টেক্কা দিতে পারতাম – যেটা নিয়ে আমি মনে মনে বেশ অহংকার করতাম। আমার মনে হতো আমি ঠিক মেয়েদের মতো না, ছেলেদের সাথেই বরং আমি বেশি যাই। কিন্তু একটা পর্যায়ে ছেলেগুলো যখন ‘আরো ছেলে’ হয়ে উঠলো, তখন একটা মেয়ে হিসেবে কী আর ওদের মতো হওয়া যায়? বিষয়টা আমাকে যন্ত্রণা দিত। যে কারণে একাও হয়ে গেলাম, মেয়ে বন্ধুদের হারাতে থাকলাম।

মেয়ে হয়েও নিজেকে ছেলে ভাবার, বা হতে চাওয়ার অন্য একটা কারণও ছিল। যে সমাজে আমি বড় হয়েছি, সেখানে মেয়েরা নিজেদের ‘লুকস’ নিয়ে প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন থাকে। বয়োঃসন্ধি হবার আগ থেকেই আমি খুব করে চাইতাম আমি খুব সুন্দরী হবো, ‘বটম-হেভি’, ‘কার্ভি’ শরীরে আবেদন থাকবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হলো না। আমি হলাম শুকনো-টিঙটিঙে। এগারো বছর বয়সে ফোন হাতে পেয়ে আমি ইন্সটাগ্রামের অ্যাকাউন্ট খুললাম। ইন্সটাগ্রাম এর জগতটাই শো-অফ। ছেলেদের অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য মেয়েরা পাগলের মতো কন্টেন্ট বানায়।

এ ধরণের কন্টেন্টে যন্ত্রণা বেড়েই চললো। কিন্তু এসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখার মতো অবস্থাও আমার ছিল না। আমি তো চেয়েছিলাম চোখে-লাগার মতো একটা মেয়ে হতে, কিন্তু প্রতিযোগিতায় পেরে উঠার মতো সুন্দরী আমি ছিলাম না। আশে-পাশের মেয়েদের দেখতাম, তাদের সাথে নিজেকে তুলনা করে নিজের ভেতরকার ইনসিকিউরিটি কেবল বেড়েই চললো।

আমার যন্ত্রণায় হাওয়া দিল নারীবাদীদের চিন্তাভাবনা। এরা নারীসুলভ বিষয়গুলোকে এত ঘৃণার চোখে দেখে! মাসিক হওয়া, গর্ভবতী হওয়া, সংসার, বাচ্চা-কাচ্চা সামলানো – এসব বিষয়কে তারা এমনই ভয়ংকর আর বাজেভাবে উপস্থাপন করে যে এসবের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা জন্মে গেলো। ওদের কথাবার্তা শুনে আমার মনে হতো সংসার-বাচ্চাকাচ্চা এসব করে হবেটা কী!

সত্যি বলতে, এরকম একটা চাওয়া নিয়ে যে আমি বড় হবো, সেরকমটা ভাবতেই তো আমাকে শেখানো হয় নি। তার উপর আমি ছিলাম বাড়ির ছোটো মেয়ে, একা একা থাকতাম, সংসারের কোনো দায়িত্বই আমার উপর ছিল না। আমার মা-বোন ওরা আমাকে বলতো আমি নাকি ‘টমবয়’ টাইপের। এসবের মাঝে বড় হয়ে আমার নিজেকে মেয়ে হিসেবে ভাবতে ভালোও লাগতো না।

একটা মেয়ে হিসেবে খুশি হওয়ার মতো কোনো কারণই আমি খুঁজে পেলাম না।

সে সময়ে আমি ট্রান্স কমিউনিটির বিভিন্ন মানুষের সাথে আমার পরিচয় হতে লাগলো। আমি আবিষ্কার করলাম আমার মতো অনেক মেয়ে আছে যারা নিজেদের ‘নারী’ পরিচয় নিয়ে নিজের মনের মধ্যে কুস্তি খেলছে। জানলাম মনের লিঙ্গই আসল লিঙ্গ। ওরা একজন আরেকজনকে অনেক সাপোর্ট দিত। আমার সেটা দেখে বেশ ভালো লাগতো। মনে হতো আমিও যদি এরকম সাপোর্ট পেতাম খুব ভালো হতো।

আমি নিজের মধ্যে কিছু পুরুষালি বৈশিষ্ট্য দেখতে চাইতাম। নারীসুলভ ব্যাপারগুলো ভালো লাগতো না।

এক পর্যায়ে ভাবতে শুরু করলাম, আমি বুঝি ছেলে। আমাকে ছেলেই হতে হবে।

আমি একজন রুপান্তরকামী – আগাগোড়া নারীর শরীরে আটকে পড়া পুরুষ।

আমার বয়স যখন বারোয় ঠেকলো, আমার সত্যি সত্যিই মনে হলো আমি মেয়ে না, আমি একটা ছেলে। আমার কাছের কিছু বন্ধুবান্ধবদের বিষয়টা বললাম। আমার বাবা-মাকে সরাসরি বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না, তাই চিঠি লিখে জানালাম।

‘তোমাদের ক্লো তোমাদের ছেলে।

আজ থেকে তোমরা আমাকে এই নামে ডেকো না, নতুন নামে ডেকো।’

ওরা প্রচণ্ড ধাক্কা খেলো। ধাক্কা খাওয়ারই কথা ছিল। ওরা এসব বুঝতো না। তবে ওরা আমাকে সাহায্য করতে চাইলো। ভাবলো কোনো বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ করবে, থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যাবে। আমি যার কাছে প্রথমে গেলাম, সে আমার কাছে কোনো কিছু ঠিকমতো জানতেও চাইলো না।

আমার হিস্ট্রি, আমি কেমন কী বোধ করি – কিছুই না। আর আমিও আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম ছেলে হতে চাওয়ার জন্য যা যা করার তাই করবো। আমার এই চাওয়াটা কতটুকু ঠিক, এটা কি আমার আবেগী মনের খেয়াল নাকি কোনো মানসিক সমস্যা – এই ব্যাপারে সে কোনো কিছু বোঝার বা বোঝানোর চেষ্টাও করেনি। দ্বিতীয় আরেকজনের কাছে গেলাম, সেও একই রকম। সবকিছুতেই ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ করতো।

আমি আমার বাবা-মাকে জানালাম, আমি ছেলে, আমি ছেলে হতে চাই, আমার শরীরকে মেডিক্যাল ট্রানজিশনের মাধ্যমে ছেলেদের মতো বানাতে হবে। ওরা প্রথমে আপত্তি করলো। আমি খুব করে চাপাচাপি করতে লাগলাম। আমার বয়স তখন তেরো বছর। ডাক্তার আমার বাবা-মাকে বললো, আমার সুস্থতার জন্য একটা রাস্তাই খোলা আছে আর সেটা হচ্ছে মেডিক্যাল ট্রানজিশনের মাধ্যমে ছেলে হয়ে যাওয়া।

আমার ‘মন’ বলছে আমি ছেলে, আমার শরীর বলছে আমি মেয়ে। এই সমস্যার নাম জেন্ডার ডিসফোরিয়া। ওরা বললো এর একমাত্র সমাধান ছেলেদের হরমোন প্রয়োগ এবং সার্জারির মাধ্যমে আমার মেয়েলি শরীরকে পুরুষের শরীরে রুপান্তর করা। শরীর আর মনকে এক সমতলে আনতে এটাই করণীয়।

আমার সমস্যা ছিল মানসিক, ওরা বললো সার্জারি করলে ঠিক হয়ে যাবে। আমার বাবা-মা জানতে চাইলো এই পদ্ধতিতে গেলে এমন কি হতে পারে যে আমি পরে আমার রুপান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়ে আফসোস করছি? ওরা কথাটাকে উড়িয়ে দিলো। তারা বোঝালো আমি এই ট্রানজিশন সার্জারির মাধ্যমে সত্যিকারের পরিচয়, সত্যিকারের ‘আমি’কে খুঁজে পাবো। ‘জেন্ডার আইডেন্টিটি’ নিয়ে আমার কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না। তারা ভয়ও দেখালো যদি আমি এই সার্জারি না করি তাহলে আমি সুইসাইড করে বসতে পারি। তারা অভয় দিল, আমার দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, হতাশা – এসব সমস্যা কেটে যাবে।

শেষ পর্যন্ত আমার ট্রানজিশন সার্জারিতে বাবা-মা রাজি হল। একজন এনডক্রিনোলজিস্টের সাথে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। সে বললো আমার এটা করা ঠিক হবে না। সেজন্যই সম্ভবত অন্য আরেক এনডক্রিনোলজিস্টের কাছে আমাকে রেফার করা হলো। সে কোনো আপত্তি করলো না, আমাকে একটা কনসেন্ট ফর্মে সাক্ষর করতো বললো এই মর্মে যে হরমোন নেওয়ার ব্যাপারে আমার আপত্তি নেই। আমি আর আমার মা সাক্ষর করলাম। কনসেন্ট ফর্মে হরমোনের সাইড ইফেক্ট এর ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্যই ছিল না। আর আমিও এসব পাত্তা দিই নি।

আমি হরমোন নেওয়া শুরু করলাম। হরমোনের প্রভাবে স্বাভাবিকভাবেই বাহ্যত আমার শরীরে বেশ কিছু পুরুষালি ভাব প্রকাশ পেতে থাকলো। নিজেকে খুব চমৎকার দেখাচ্ছিল তা নয়, তবে প্রথম প্রথম আমার ভালোই লাগছিল। মনে হচ্ছিল যেন নিজের শরীরের ওপর শেষ পর্যন্ত বুঝি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি!

এই যে প্রথম প্রথম ভালো লাগা — এটা ছিল টেস্টোস্টেরনের সাময়িক প্রভাব। ড্রাগ যেমন শরীরে একটা উত্তেজনা তৈরি করে, টেস্টোস্টেরনের প্রভাবটাও তেমন। খুব উৎফুল্ল বোধ করতাম এবং সেটাকে স্বাভাবিক ‘পুরুষালি অনুভূতি’ মনে করে ভেবেছি আমি বোধহয় সুস্থতার দিকে এগোচ্ছি। শরীরে অ্যান্ড্রোজেন হরমোন নিতে শুরু করলাম, যে কারণে আমার যৌন চাহিদা এতটাই যে আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারছিলাম না এবং এক পর্যায়ে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ি।

আমার বন্ধুরা অনেকেই রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে, আর আমি আমার ‘জেন্ডার আইডেন্টিটি’ নিয়ে প্রচণ্ড সংকটে। বাধ্য হয়ে ডেটিং অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খুললাম কাউকে পাবার আশায়। আমার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেল। আমি হয়তো কাউকে চাচ্ছি, কিন্তু স্ক্রিনের অপরপাশে যে আছে সে আমার নিতান্তই ইন্টিমেট ছবি দেখতে চাইছে – বোঝার উপায় নেই আসলেই কী সে আমায় চায়? আমার মনে বিষাদের ছায়া আরো গাঢ় হলো।

যেহেতু আমি ‘ছেলে’, তাই মাসিক বন্ধ করার জন্য ‘পিরিয়ড ব্লকার’ নিতে শুরু করলাম। সে সময়টা প্রচণ্ড অবসন্নতায় ভুগতাম। টেস্টোস্টেরন নেওয়ার আগ পর্যন্ত সেরকম থাকতাম। টেস্টোস্টেরন নেওয়ার পর আবার শরীরে শক্তি ফিরে পেতাম। কিন্তু সেটা ছিল সাময়িক। মনের মধ্যে কোনো স্বস্তি ছিল না। এক বছর ধরে হরমোন নেওয়ার পর মানসিক সমস্যার সাথে যুক্ত হলো শারীরিক নানা সমস্যা। প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশন হয়ে গেল। বারবার টয়লেটে যেতাম, ঠিকমত প্রস্রাব পরিষ্কার হতো না, কখনও কখনো রক্তপাতও হতো। টেস্টোস্টেরন নেওয়া বন্ধ করলাম, অবস্থা আরো খারাপের দিকে গেলো। যারা আমাকে বলেছিল রুপান্তরিত হলে আমার সমস্যাগুলো চলে যাবে, তারা এসবের কথা আমাকে কিছুই বলে নি, সেই ‘কনসেন্ট ফর্মে’ এসবের কিছুও লেখা ছিল না।

আমি ‘ছেলে’তে রুপান্তরিত হবার চেষ্টা তখনও করে যাচ্ছিলাম। মা-কে বললাম বাইন্ডার কিনে দিতে, যেন আমার বুক দেখে বোঝা না যায় আমি একটা মেয়ে। প্রচণ্ড টাইট এই জিনিসটা বুকে পরতে হয় যেন বুকটা চ্যাপ্টা হয়ে থাকে। সারাদিন এটা পরে থাকতে আমার খুবই অসুবিধা হতো, কিন্তু এটাও চাইতাম না কেউ আমাকে দেখে মেয়ে ভাবুক। কারণ আমার মন তো বলছে ‘আমি ছেলে।’

এক পর্যায়ে অতিষ্ট হয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ডবল ম্যাসেকটমি করাবো – আমার স্তন কেটে ফেলে দেব, পুরোদস্তুর ছেলেদের মতো হয়ে যাবো। ম্যাসেকটমি করা হয় ব্রেস্ট ক্যান্সারের সেসব রোগীদের যাদের ক্যান্সার সর্বশেষ পর্যায়ে ঠেকেছে। আমি একজন জেন্ডার স্পেশালিস্ট এর শরণাপন্ন হলাম। আমাকে বুঝিয়ে বলা হলো ম্যাসেকটমি সার্জারি কীভাবে করে জেন্ডার ডিসফোরিয়া নিরাময় করে। এসব ছিল ওদের প্রপাগান্ডা যেটা তখন বুঝতে পারিনি। হাসপাতালে দেখলাম আমার মতো আরো অনেকে এই সার্জারি করার জন্য এসেছে। তাদের দেখে আমি ভাবলাম, আচ্ছা আমি তো একা না, অনেকেই তো আমার মতো আছে।

আমার বয়স পনেরো হলো। ততদিনে প্রায় দুই বছর ধরে আমি শরীরে ছেলেদের হরমোন নিচ্ছি। আমার মেয়েলী শরীরের স্থানে স্থানে পুরুষালী ভাব। দীর্ঘদিন ধরে বাইন্ডিং পরার কারণে আমার স্তনের আকার নষ্ট হয়ে গেছে। আমার শরীরকে নিয়ে আমার নিরাপত্তাহীনতার বোধ তখন চরমে পৌঁছলো। আমি ম্যাসেকটমি করে স্তন কেটে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। আমি জানতাম এটা করলে আমি কখনো বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারবো না। কিন্তু তাতে কী? আমি তো ভাবতাম আমি বাচ্চাকাচ্চা নেব না, আমি ছেলে, স্তন দিয়ে করবোটা কী! আসলে কী সমস্যা হতে পারে সেসব বোঝার মতো অবস্থা আমার ছিলই না।

যাই হোক, আমি ম্যাসেকটমি করালাম, আমার মনে তখন বিজয়ের অনুভূতি – আমাকে ওরা বোঝালো আমি অনেক বড় কিছু অর্জন করেছি।

‘রুপান্তর’ সফল হয়েছে। ট্রান্স কমিউনিটি থেকে অনেক বাহবা পেলাম।

তবে কিছুদিন পর আমি বাস্তবতায় ফিরতে শুরু করলাম। আমার নিজের শরীর নিয়ে অস্বস্তি লাগছিল, কেমন যেন অদ্ভূত অনুভূতি। ওরা কিছুদিন পর স্টিচ খুললো, আমার বুকে তখন কালো ক্ষতের দাগ, চামড়াগুলো যেন পুড়ে গেছে, কীসব ফ্লুইড বের হচ্ছে। ওরা আমার ‘লুকস’ ছেলেদের মতো বানানোর জন্য অজস্র কাঁটাছেঁড়া করলো। নিজেই নিজেকে দেখে পাগল হয়ে গেলাম, উফ, এত বীভৎস! সহ্য করতে পারছিলাম না…

কয়েক মাস পর মনে হতে লাগলো, আমি তো আগেই ভালো ছিলাম, সুন্দরী ছিলাম। আমার আগের সেই নরম মেয়েলী শরীরটাই তো আমি চাই। কিন্তু ততদিনে আমি আর আগের সেই নেই, ‘ছেলেদের মতো’ হয়ে গেছি। আমি খুব করে চাচ্ছিলাম আমি আবার আগের মতো হয়ে যাই। যখন বাসায় কেউ থাকতো না, আমি স্কার্ট পরে মেয়েদের মতো সাজগোজ করে নিজেকে দেখতাম, ভালো লাগতো। আমার দুঃখ কেবল বাড়তেই লাগলো।

সার্জারির এগারো মাস পর আমি নিশ্চিত হলাম আমি ভুল করেছি। আমি একটা মেয়ে, আমি আসলে মেয়েই হতে চাই। আমি সাইকোলজি নিয়ে কিছু পড়াশোনা করলাম। বাচ্চাদের ব্যাপারে, প্যারেন্টিং নিয়ে কিছু জানলাম। আমি আবিষ্কার করলাম, সার্জারি করে শরীর থেকে যে অঙ্গটি আমি ফেলে দিয়েছি, সেটা স্রেফ শরীরে একটা অঙ্গ না। আমি একটা বাচ্চাকে আদর আর ভালোবাসা দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও হারিয়েছি। এত কষ্ট লাগছিল আমার!

এক রাতে কাঁদতে কাঁদতে আমি ভেঙ্গে পড়লাম। আমার মা-কে টেক্সট করে আমার কাছে আসতে বললাম। আমি স্বীকারও করতে পারছিলাম না এতদিন ধরে যা করেছি সব পাগলামি করেছি। আমার খুব খারাপ লাগছিল এই ভেবে যে আমি আমার বাবা-মায়ের সম্মান, সময়, লাখ লাখ টাকা-নষ্ট করে সব হারিয়েছি, কিছুই পাইনি।

সেদিনের পর থেকে আমি হরমোন নেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিই। কিন্তু সেই হরমোনের প্রভাবে আমি আজ পর্যন্ত ভুগে চলেছি। কিন্তু আমি যা হারিয়েছি তা আর কখনোই ফিরে পাবো না। প্রতিদিন আমার বুকে ক্ষতস্থানে আমাকে ব্যান্ডেজ পরতে হয়। আমার প্রস্রাবের সমস্যাও আজো রয়ে গেছে, খানিকবাদেই টয়লেটে যেতে হয়। এসবের কোনো চিকিৎসাও নেই।

আমার বয়স আজ আঠারো, অথচ আমি সেক্সুয়ালি ডিসফাংশনাল। শারীরিকভাবে এমন কিছু সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেসব সমস্যা চল্লিশ পেরোনো মেনোপজ মহিলাদের হয়।

আমি পাগলামির বয়সটায় আমি জানতাম না একদিন আমি মা হতে চাইবো।

আমি আজ চাই, কিন্তু জানিনা মা হতে পারবো কিনা।

ওরা বলেছিল মেয়ে থেকে ছেলেতে ‘রুপান্তর’ হলে আমি একদম ঠিক হয়ে যাবো।

কিন্তু ‘রুপান্তর’ আমাকে ভেঙ্গেচুরে শেষ করে দিয়েছে।

যারা আমাকে এই পথে ঠেলে দিয়েছিল, বাহবা দিয়েছিল, তারা কেউ আমার পাশে নেই।

‘রুপান্তরকামী’ হয়ে আমি আজ আমি শরীর খুইয়েছি, মন হারিয়েছি।

আমি একটা মেয়ে হতে চাই। ছেলের মতো নয়, মেয়ের মতো মেয়ে।

(লেখাটি অ্যামেরিকান অ্যাক্টিভিস্ট ক্লো কোল– যিনি একজন ডি-ট্রানজিশনার, তার একটি পডকাস্টের আলোচনা থেকে অনুলিখন করা হয়েছে।)

কার্টেসি: Zim Tanvir

ভালো কাজ – জান্নাতের সিঁড়ি

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একবার পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন সাহাবিদের সাথে, এমন সময় রাস্তার ধারে দেখতে পেলেন একটা পশু মরে পড়ে আছে, সেই মৃত পশুটিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন “এটা কেউ ক্রয় করতে চায় কিনা”। উত্তরে সাহাবিরা বললেন “এটা কিনে কি করব, কারণ এই মৃত পশুতো আমাদের কোনও উপকারে আসবেনা”। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সবার উদ্দেশ্যে বললেন “তোমাদের কাছে যেমন এই পশুটির কোনও মূল্য নেই, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে এই দুনিয়ার মূল্য মৃত পশুটির থেকেও নগণ্য”।

দুনিয়ার জীবন আমাদের খুবই কম সময়ের, সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে মৃত্যুর সঙ্গী হয়ে। এরপর একদিন আখিরাতে কিয়ামতের ময়দানে দাঁড়াতে হবে আল্লাহর সামনে নিজের সমস্ত কাজের দায়ভার নিয়ে।

আমাদের দুনিয়াবি জীবনের আত্মতুষ্টির গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এগিয়ে যেতে হবে সেই সীমানার দিকে, যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের জন্য রেখেছেন অনন্ত আনন্দ।

তাই আমরা হয়ত আকাশ ধরতে পারব যদি আমাদের কাছে অত লম্বা সিঁড়ি থাকে, তবে যদি ভাল কাজের সিঁড়ি থাকে তাহলে আকাশ কেন জান্নাত ও ধরতে পারব একদিন…ইনশাআল্লাহ, আর সেখানেই শুধুমাত্র পাওয়া যাবে সত্যিকারের আত্মতুষ্টি। আসুন তাহলে এখন থেকেই ভাল কাজের সিঁড়ি তৈরির চেষ্টা করি।

এই স্বল্প সময়ের পৃথিবীতে যেন আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে বিদায় নিতে পারি সেই প্রার্থনা আমার সবার জন্য রইলো। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন, সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। সঠিক পথ তো সে-ই পায়, যে তার জন্য স্বপ্ন দেখে, চেষ্টা করে, হৃদয় যার লালায়িত থাকে মুক্তির প্রত্যাশায়……


লেখাটি নেওয়া হয়েছে  – আমার স্পন্দন ব্লগ থেকে

‘ ইখলাস ‘ যে কোন ইবাদাতের মৌলিক শর্ত ।

যে কোন ইবাদাতের মৌলিক শর্ত ‘ইখলাস’। ইখলাস মানে কেবলই আল্লাহর জন্যে হওয়া। মানুষ এর বাহবা, প্রশংসা কুড়ানো, ফেসবুকে লাইক কামানো, যশ খ্যাতির লালসা দ্বারা মিশ্রিত না হওয়া। ইখলাসের সাথে কাজ করলে যেমন এর ফায়দা রয়েছে, তেমনি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্যে না হয়ে দুনিয়া কামাই বা যশ খ্যাতির জন্যে হলে তার শাস্তিও রয়েছে।

হাদিসের ভাষ্যমতে, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম জাহান্নামের সিদ্ধান্ত হবে সেসব আলেম, মুজাহিদ, দানশীলদের উপর। যারা ইলম শিখেছে আলেম শাইখ উপাধি পাওয়ার জন্যে, জেহাদ করেছে বীর খেতাব অর্জনের জন্যে, দান করেছে যশ খ্যাতির জন্যে।

ইখলাস ও নিয়তের ব্যাপারে যত্নশীল ও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সালাফে সালেহীন ইখলাস এর ব্যাপারে ধারণাতীত যত্নবান ছিলেন । এমনই কিছু ঘটনা নিয়ে আজকের লেখা।

১- আব্দুর রহমান আবী লাইলা (ইন্তেকাল ৮৩ হি) রহ.০ একদিন গোপনে তার বাড়িতে নফল নামাজ আদায় করছিলেন। হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেলেন। নামাজ সেরে জলদি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। যেন তিনি ঘুমুচ্ছেন। এরপর আগন্তক প্রবেশ করল। যখন দেখল তিনি ঘুমিয়ে আছেন তখন বলল ‘এই লোকের ঘুমের কি কোন বিরতি নেই? বেশিরভাগ সময়ই দেখি বিছানায় শুয়ে ঘুমোয়।’ অথচ তিনি প্রচুর নফল নামাজ পড়তেন ও তাদের থেকে গোপন করতেন।

২- মুহাম্মদ বিন আ’ইউন। আব্দুল্লাহ বিন মুবারাক (ই- ১৮১ হি.) রহ. এর সফরের সঙ্গী। তার বর্ণনা, ‘আমরা রোমের সৈন্যদের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত ছিলাম। রাত হলো। আব্দুল্লাহ বিন মুবারক বিছানায় চলে গেলেন। মাথা রাখলেন বিছানায়। আমাকে দেখানোর জন্যে যে তিনি ঘুমিয়ে গেছেন। আমিও বর্শায় মাথা এলিয়ে দিলাম।

বোঝাতে চাইলাম আমিও ঘুমিয়ে গেছি। মুহাম্মদ বিন আ’ইউন বলেন, আব্দুল্লাহ বিন মুবারক মনে করলেন আমি বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছি। তিনি উঠে পড়লেন। নামাজ শুরু করলেন। এভাবেই নামাজে মাশগুল হয়ে রইলেন ফজর পর্যন্ত। পুরো সময়টা আমি তাকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। ফজর এর সময় হলে তিনি আমাকে জাগিয়ে তুললেন এই ধারণায় যে আমি ঘুমন্ত। তিনি ডাকলেন ‘মুহাম্মদ উঠো!’ আমি বললাম, আমি ঘুমাই নি। যখন তিনি এটা শুনলেন, আমার এই ঘুমের ভান করাকে তিনি পছন্দ করলেন না। এরপর থেকে আমার সাথে তিনি আর কথা বলেন নি। সে যুদ্ধে আমি তাকে প্রফুল্ল দেখি নি। এই ঘটনা তার ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত আমি প্রকাশ করি নি। আর আমি তার মত আর কাউকে নিজের আমল এতটা গোপন করতে দেখি নি।

৩- দাউদ বিন আবী হিন্দ (ই-১৩৯ হি) রহ. ৪০ বছর রোজা রেখেছেন অথচ ঘরের মানুষও তা জানতে পারে নি। তিনি যখন বের হতেন খাবার নিয়ে যেতেন সাথে করে। পরিবারের লোকেরা ভাবত তিনি আহার করতে খাবার নিয়েছেন। কিন্তু দাউদ বিন আবী হিন্দ সে খাবার রাস্তায় গিয়ে সদকা করে দিতেন। অতঃপর সন্ধ্যায় ফিরতেন ও পরিবারের সাথে খানা খেতেন।

৪- প্রখ্যাত হাফিজুল হাদিস আইয়ুব সাখতিয়ানী (ই-১৩১ হি) রহ. সারারাত নিঃশব্দে ইবাদাতে কাটিয়ে দিতেন। তারপর ভোর হলে ইচ্ছে করে গলার স্বর উচু করতেন, যেন মাত্রই জেগেছেন।

৫- সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ রহ, বলেন মুতাররিফ বিন আব্দুল্লাহ (৯৫ হি) এই দুয়া করতেন ‘ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাই এই জন্যে যে আমি ভেবেছি এই কাজ কেবল আপনার সন্তুষ্টির জন্যেই করেছি, অথচ অজ্ঞাতসারে আমার নিয়তে অন্য কিছুর মিশ্রণ ঘটে গেছে।
মুতাররিফ রহ. যখন হালাকায় বসে হাদিসের দরস দিতেন। হাদিস বর্ণনা করার পর প্রবলভাবে কাঁদতেন। আর পাগড়ি দিয়ে মুখ চোখ ঢেকে রাখতেন। কান্না থামলে এই বলে পাগড়ি দিয়ে চোখ মুছতেন ‘মারাত্মক সর্দি হয়েছে, এত বেশি সর্দি..’ অর্থাৎ সর্দি মছার ভাণ করে চোখের অশ্রু লুকাতে চাইতেন।

৬- ‌আলী বিন হুসাইন যাইনুল আবিদীন (৯৫ হি) রহ. খুব উদার ও দানশীল ছিলেন। তিনি রাতের বেলায় সদকা ও খাদ্যসামগ্রী নিজ কাধে বহন করে নিয়ে যেতেন। মদীনার বিধবা আর গরীবদের ঘরে রাতের আধারে সেসব রেখে আসতেন, কেও টেরও পেত না। এমনকি খাদেম ও গোলাম থাকা সত্তেও তিনি তাদেরকে সংগে নিতেন না। এ কারণে যে তারা জেনে যাবে তার দান এর কথা। এভাবে বহু বছর কেটে গেল। এত দীর্ঘ সময়েও বিধবা আর গরীব জানতে পারল না এই খাদ্য ও অর্থ কোথা থেকে আসে। তারপর যখন যাইনুল আবেদিন রহ. ইন্তেকাল করলেন, লোকজন তার পিঠে কালো দাগ দেখতে পেল। তখন তারা বুঝতে পারল অধিক পরিমাণে বস্তা বহনের ফলে পিঠে দাগ পরে গেছে। যাইনুল আবেদীন রহ এর ইন্তেকাল এর পর তার দানের কথা মানুষ জানতে পারে।

৭- মুহাম্মদ বিন কাসিম, যিনি অত্যন্ত উঁচু মাপের মুত্তাকী আলেম ও মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি বলেন, আমি মুহাম্মদ বিন আসলামের সান্নিধ্যে ছিলাম প্রায় ২০ বছর যাবত। তিনি বারবার কসম করে বলতেন, ‘আমি যদি এভাবে নফল ইবাদত করতে সক্ষম হতাম যে, আমার দু ফেরেশতাও তা দেখতে পারবে না। তবে ‘রিয়া’ থেকে নির্ভয় হতে তাই করতাম।’ (রিয়া মানে আল্লাহ ছাড়া কাউকে দেখানোর উদ্দেশ্যে কোন নেক আমল করা)।

ইবনে কাসিম বলেন, মুহাম্মদ বিন আসলাম যখন তার ঘরে প্রবেশ করতেন। দরজা বন্ধ করে দিতেন। জানার কোন উপায় ছিল না, বদ্ধ ঘরে তিনি কী করছেন? একদিন দেখি, তার ছোট ছেলেটা বাবার কান্নার বিবরণ দিচ্ছে। বাচ্চার মা তাকে বারণ করছে বাবার কান্নার কথা কাউকে বলতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? বাচ্চার মা জানালো, আবুল হাসান (মুহাম্মদ বিন আসলাম) যখন এই ঘরটিতে প্রবেশ করে। তিনি তেলাওয়াত করেন ও প্রচুর কাঁদেন। বাচ্চা সেটা শুনতে পেয়ে তার বিবরণ দিচ্ছিল।

মুহাম্মদ বিন আসলাম তার আমল শেষে যখন বের হতেন, পুরো চেহারা ধুয়ে নিতেন। চোখে সুরমা দিতেন। যাতে দেখলে বোঝা না যায় তিনি রাব্বে কারীমের দরবারে উদ্বাহু হয়ে অশ্রুর বাধ ভেংগেছেন।
মুহাম্মদ বিন আসলাম ছিলেন একজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, হাফেজে হাদিস ও ইমামে রাব্বানী। পুরো নাম, মুহাম্মদ বিন আসলাম বিন সালেম বিন ইয়াজিদ আল খুরাসানী
তিনি এমন বুজুর্গ ওয়ালী ছিলেন, যার থেকে হাদিস বর্ণনার সময় ইবনে খুজাইমাহ রহ. বলতেন ‘হাদ্দাসানা মান লা তারা আইনায়া মিছলাহু’ (আমাকে হাদিসটি এমন ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, যার মত ব্যক্তিত্ব আমার দু নয়ন কখনো দেখে নি।)

মুহাম্মদ বিন কাসিম বলেন, ইবনে আসলামের ইন্তেকাল এর ৪ দিন আগে আমি তার ঘরে প্রবেশ করলাম। তিনি আমাকে দেখে বললেন ‘আবু আব্দুল্লাহ, এসো। আমি তোমাকে সুসংবাদ দিব যে, রাব্বে কারীম আমার জন্যে জন্যে কল্যাণের ফয়সালা করেছেন। আমার মৃত্যু সন্নিকটে। আল্লাহ তায়ালা আমার উপর মেহেরবানি করেছেন যে, আমার এমন কোন অর্থকড়ি নেই যার জন্যে আল্লাহ আমার হিসাব নিবেন।’

এরপর তিনি দরজা বন্ধ করার আদেশ করলেন। বললেন ‘কাউকে প্রবেশের অনুমতি দিয়ো না, যতক্ষণ না আমার মৃত্যু হয়। জেনে রাখো! আমি দুনিয়া থেকে এই অবস্থায় বিদায় নিচ্ছি। আমার রেখে যাওয়া কোন মীরাস নেই। কেবল এই পোশাক, পশমের কাপড়টি, আর এই উজুর পাত্র ছেড়ে যাচ্ছি।’

মুহাম্মদ বিন কাসেম বলেন, তার কাছে একটা মুদ্রার থলে ছিল। তাতে প্রায় ৩০ দিরহামের মত রয়েছে। ইবনে আসলাম বললেন, ‘এই মুদ্রাগুলো আমার ছেলের। তার কোন আত্মীয় তাকে হাদিয়া দিয়েছে। আমি জানি না, আমাত জন্যে এর চেয়ে হালাল কিছু আছে কিনা।

কারণ নবীজী সা. বলেন, ‘তুমি ও তোমার সম্পদ তোমার বাবার জন্যে। অন্য হাদিসে আছে, ‘মানুষ তার উপার্জন থেকে যা খায় সেটাই বেশি উত্তম। আর সন্তানও তার এক উপার্জন।’ ইবনে আসলাম বললেন, ‘তোমরা এই অর্থ দিয়ে আমার কাফনের ব্যবস্থা করো। যদি দশ দেরহামেই এপরিমাণ কাপড় কেনা সম্ভব হয় যা দ্বারা আমার সতরটুকু ঢাকে তবে ১৫ দেরহাম খরচ করো না। জানাযার সময় আমার লাশের উপর এই পশমের কাপড়টি বিছিয়ে দিয়ো। আর এই পোশাক দিয়ে ঢেকে দিয়ো। আমার যে পানির পাত্রটা দেখছ, সেটা কোন মিসকীনকে দিয়ে দিয়ো।…. ইয়া আবু আব্দুল্লাহ! আজকাল সবাই কুরআন সুন্নাহ অধ্যয়ন করছে, কিন্তু এই ব্যাপারে ফিকির করছে না যে তাদের মধ্যে দুনিয়ার মোহাব্বত প্রবল হয়ে গেছে।”

(সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৯/৫৪২, হিলয়াতুল আউলিয়া ৯/২৪৩)
আল্লাহ তায়ালা, লেখককে ও এ লেখার পাঠককে সর্বোপরি উম্মাহর খেদমতে নিয়োজিত সকল খাদেমে দ্বীনকে ‘পরিপূর্ণ ইখলাসের’ তাওফিক দিন। আমীন!

সেক্যুলারিজম এবং নৈতিকতা

সেক্যুলারিজম এবং নৈতিকতা

সততা, সত্যবাদীতা, বিশ্বস্ততা, সচ্চরিত্র, সতীত্ব এর মতো মূল্যবোধগুলো ফিতরাতী (Natural disposition) বা সহজাত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষের অন্তরে এগুলো গেঁথে দিয়েছেন। অতঃপর তিনি তাঁর রসূলগণকে (আলাইহিমুস সালাম) এমন দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন যা এ ফিতরাহ বা সহজাত মূল্যবোধগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

“তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে এই ধর্মে প্রতিষ্ঠিত করো। এটা আল্লাহর প্রকৃতি; যার ভিত্তিতে তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহর প্রকৃতির কোনো পরিবর্তন নেই, এটাই সরল ধর্ম, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না।” (সূরা আর-রূম :৩০)

একজন মুমিন এ নৈতিকতা ও মূল্যবোধগুলোকে মেনে চলে কারণ ঈমানের দ্বারা সুদৃঢ় হওয়া তাঁর ফিতরাহ তাঁকে এদিকে প্রভাবিত করে। এবং তাঁর ধর্ম তাঁকে বলে সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করতে এবং এর জন্য আখিরাতে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়। অন্যদিকে নৈতিকতার এ দুটি ভিত্তিতেকে সেক্যুলারিজম নষ্ট করে ফেলে। এটা সব ধরণের সেক্যুলারিজমের ক্ষেত্রে সত্য। রাজনৈতিক জীবন থেকে ধর্মকে আলাদা করা এবং আইন প্রনয়ণের ভিত্তি হিসেবে ধর্ম ও মানুষের এই স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রত্যাখ্যান করা সেক্যুলারিযমের তুলনামূলকভাবে নিরীহ যে রূপ, সেটার ক্ষেত্রেও একথা সত্য। আর সেক্যুলারিযমের চরমপন্থী নাস্তিকতার যে রূপ, সেটা এদুটো ভিত্তিকে পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করে সেখানে মানবীয় খেয়ালখুশিকে বসায়। সেটা হতে পারে স্বৈরতন্ত্রের অধীনে গুটিকয়েক নেতার খেয়ালখুশি, অথবা গণতন্ত্রের অধীনে সংখ্যাগুরুর খেয়ালখুশি।

“তুমি কি তাকে দেখনি, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহরূপে গ্রহণ করেছে? তবুও কি তুমি তার যিম্মাদার হবে?”(২৫:৪৩)
.
যেহেতু খেয়াল-খুশি এবং কামনা-বাসনা প্রকৃতিগতভাবেই নিত্য পরিবর্তনশীল, তাই সেগুলোকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং আচরণও পরিবর্তনশীল হবে এটাই স্বাভাবিক। আজ যেটাকে অন্যায় মনে করা হচ্ছে, যার জন্য কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দেয়া হচ্ছে, কাল হয়তো সেটাই বৈধ কিংবা প্রশংসনীয় কাজে পরিণত হবে। এবং কাল যখন কেউ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে সে ‘পলিটিকালি ইনকারেক্ট’ হয়ে যাবে। মানুষের অন্তর্নিহিত ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে সমাজের বিচ্ছিন্নতার কারণে বারবার অবস্থান ও মূল্যবোধ বদলে ফেলার এ ব্যাপারটা ঘটে।
.
ট্র্যাডিশানাল সমাজ যতোই অজ্ঞ হোক না কেন, এর সদস্যদের মধ্যে একটা নূন্যতম পরিমাণ সহজাত বৈশিষ্ট্য কিংবা ফিতরাতী মূল্যবোধ টিকে থাকে। কিন্তু একটা সমাজে সেক্যুলারিজম যতো বৃদ্ধি পায় ততোই এধরনের মানুষ ও মূল্যবোধ কমতে থাকে, কমতে থাকে সমাজে তাদের প্রভাবও। এবং এক পর্যায়ে পুরো সমাজ ঐ অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে যা একসময় তারা সযত্নে লালন করতো। বিভিন্ন ট্র্যাডিশানাল জাহেলি সমাজে কিছু কিছু ফিতরাতী মূল্যবোধ টিকে থাকার পেছনে আরেকটি সম্ভাব্য কারণ আছে। তারা কিছু মূল্যবোধ আকড়ে থাকে কারণ সেগুলো তাদের ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাদের খেয়ালখুশির সাথে সাঙ্ঘর্ষিক না।

“ওদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ এবং তার রাসুলের দিকে ওদেরকে আহ্ববান করা হলে,ওদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়।সিদ্বান্ত ওদের স্বপক্ষে হবে মনে করলে,ওরা বিনীতে ভাবে রসুলের নিকট ছুটে আসে।(২৪:৪৮-৪৯)
.
সত্যের সাথে তাদের সম্পর্কটা অনেকটা শয়তানের মতো। আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে শয়তান আয়াতুল কুরসি পড়ার কথা জানিয়েছিল। একথা শোনার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, সে তোমাকে সত্য বলেছে যদিও সে এক চরম মিথ্যাবাদী।
.
জাহেলি সভ্যতার এ ক্রমপরিবর্তনশীল, স্ববিরোধী চেহারার সবচেয়ে স্পষ্ট দৃষ্টান্ত হল এখন পশ্চিমা সেক্যুলার সমাজগুলো। একদিকে এরা সংস্কৃতি এবং এর অন্তর্নিহিত মূল্যবোধকে আপেক্ষিক ও পরিবর্তনশীল মনে করে। অন্যদিকে কিছু কিছু মূল্যবোধকে এরা সর্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ ঘোষণা করে, এগুলোর লঙ্ঘন মারাত্মক অপরাধ মনে করে এবং লঙ্ঘনকারীকে কঠিন শাস্তি দেয়।
.
এ স্ববিরোধীতার উৎস হল এমন দুটি মৌলিক নীতি যেগুলোকে আধুনিক গণতান্ত্রিক সেক্যুলার সমাজগুলো তাদের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে।

প্রথমটি হল, সংখ্যাগুরুর মতকে ভালো-মন্দ নির্ধারনের মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করা।

দ্বিতীয়টি, হল ব্যাক্তিস্বাধীনতার মূলনীতি।

এ দুটি মূলনীতি অবধারিতভাবে পরস্পর সাংঘর্ষিক হবে, যদি না তৃতীয় কোন মূলনীতির অধীনস্ত করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করা হয়।
.
সেক্যুলারিজম সহজাতভাবে ধর্মকে অস্বীকার করে, আর মানবজাতির জন্য কোনটা উপকারী আর কোনটা ক্ষতিকর সেটা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ফিতরাহকে (সহজাত মূল্যবোধ) পশ্চিমা সেক্যুলারিজম গোণায় ধরে না। তাই কোন আচরণগুলো বৈধ ও উপযুক্ত তার ঠিক করার পরম মানদন্ড হিসেবে সংখ্যাগুরুর মত আর ব্যাক্তি-স্বাধীনতার মূলনীতিকে গ্রহণ করা ছাড়া সেক্যুলার সমাজের অন্য কোন উপায় থাকে না। সেক্যুলার সমাজে এ দুটো নীতির সাংঘর্ষিকতা সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যু থেকে স্পষ্ট। এসব সমাজে একদল মানুষ সমকামীতাকে মেনে নেয়ার কথা বলে। সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে এরা সমকামীদের সমান অধিকারের কথা বলে। গত কয়েক দশকে তারা এসব লক্ষ্য অর্জনে ব্যাপকভাবে সফলও হয়েছে। তাদের এ দাবির ভিত্তি হল ব্যাক্তি স্বাধীনতা তথা ব্যাক্তি অধিকারের মূলনীতি। তাদের কথা হল, অন্য কারো অধিকার নেই তাদের ‘যৌনতা’ নিয়ে কথা বলার।
.
অন্যদিকে গর্ভপাতের পক্ষেও একদল ঠিক একই যুক্তি দেয়। আপনি দেখবেন গর্ভপাতের পক্ষে এরা যুক্তি দেবে – ‘আমার ব্যাক্তিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা আমার। আমার শরীরের কী হবে, সেটা আমি ঠিক করবো। অন্যদের এখানে কথা বলার কোন অধিকার নেই।’ এ কথার বিপরীতে বিরোধী পক্ষ কেবল এটুকুই বলতে পারে যে, এধরনের আচরণ সমাজের অধিকাংশ মানুষের মূল্যবোধের পরিপন্থী। যদিও বাস্তবতা হল তাদের অনেকেই গর্ভপাতের বিরোধীতা করে নৈতিক ও ধর্মীয় জায়গা থেকে। কিন্তু সেক্যুলার সমাজের সেক্যুলার সদস্য হিসেবে তারা সেটা মুখ ফুটে বলতে পারে না। কারণ সেক্যুলার সমাজ কখনো সেটা মেনে নেবে না। সেক্যুলার সমাজে নৈতিকতা ও ধর্মের কোন স্থান নেই।
.
যদি আমরা আমরা মেনে নেই যে সংখ্যাগুরুর মত আর ব্যাক্তি-স্বাধীনতা ছাড়া মূল্যবোধের অন্য কোন ভিত্তি নেই, তাহলে মূল্যবোধগুলো ক্রমশ বদলানোই স্বাভাবিক। সমাজ আর সময় ভেদে মূল্যবোধগুলো তো বদলাবেই। যার অর্থ হল নিয়ত পরিবর্তনশীল বিভিন্ন সেক্যুলার মূল্যবোধের সাথে মানুষের সামাজিক ও আত্মিক উন্নতির কোন সম্পর্ক নেই। একটি কোন সেক্যুলার মূল্যবোধগুলোকে গ্রহণ করলো আর কোনগুলো বর্জন করলো, তাতে আসলে কিছু যায় আসে না। কারণ সবগুলোই সমানভাবে সঠিক, যেহেতু সবকিছু আপেক্ষিক।

কাজেই আজকের সেক্যুলার সমাজে যেসব আচরণকে জঘন্য মনে করা হচ্ছে – যেমন ধরুন ধর্ষন কিংবা শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন – এগুলোকে ঘৃণ্য অপরাধ মনে করার কারণ হল এগুলোর ব্যাপারে মানুষের বর্তমান মনোভাব। কিন্তু এ মনোভাবে কালকে বদলে যেতে পারে। যেমন ব্যভিচার, বহুগামীতা ও সমকামীতার ব্যাপারে তাদের মনোভাব বদলেছে। আর যখন মনোভাব বদলে যাবে তখন আর এ কাজগুলোকে ঘৃণ্য অপরাধ মনে করা হবে না। বরং বৈধ কিংবা প্রশংসনীয়ও ভাবা হতে পারে। অর্থাৎ ব্যাক্তি স্বাধীনতার মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে ভয়ংকর সব অপরাধও এক সময় সামাজিক ও আইনী বৈধতা পেতে পারে।
.
এসব নিয়ে প্রশ্ন করলে সেক্যুলাররা কনফিউযড হয়ে যায়, কারণ ধর্ষন কিংবা শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের মতো অপরাধগুলোর প্রতি তার ঘৃণার ভিত্তি আসলে এ দুটোর মূলনীতি (সংখ্যাগুরুর মত, ব্যাক্তিস্বাধীনতা) না। তাদের ঘৃণার মূল কারণ হল সেক্যুলারিযম সত্ত্বে এখনো তাদের মধ্যে অবশিষ্ট থাকা আল্লাহ প্রদত্ত ঐ সহজাত মূল্যবোধের ছিটেফোঁটা।
.
কেন তুমি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করো, কেন তুমি সংখ্যাগুরুর মতকে অন্য সব মূল্যবোধ ও আচরণের মাপকাঠি বানিয়েছো? – এ প্রশ্নগুলো করলে একজন সেক্যুলারিস্ট হয়তো আরো কনফিউযড হয়ে যাবে। সে জবাব দিতে পারে যে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি এ শ্রদ্ধার কারণ হল তার ব্যাক্তিগত অনুরক্তি ও আদর্শিক অবস্থান। অথবা সে বলতে পারে, সে মনে করে গণতান্ত্রিক সেক্যুলার সমাজই সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ। এখন আরেকজন যদি তার ব্যাক্তিগত অনুরক্তি, আদর্শিক অবস্থান ও মতের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক অবস্থান গ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে সেক্যুলারিস্টের জবাব কী হবে? এক্ষেত্রে উপযুক্ত কোন জবাব সেকুলারিস্টের থাকবে না।
.
সেক্যুলার সমাজগুলোর এ নড়বড়ে ভিত্তির কারণে, আজ যা কিছুকে মূল্যবান মনে করে তারা আকড়ে ধরছে কালই হয়তো সেটার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। এছাড়া এ মূলনীতিগুলো দখলদারিত্ব ও উপনিবেশবাদের দিকে সেক্যুলার সমাজের অধঃপতনের পথ সুগম করে দেয়। কারণ এ থেকে বিরত থাকার ভালো কোন কারণ তাদের আদর্শ দেয় না। একজন দাঁড়িয়ে বলবে, ‘অমুক দেশ আক্রমণ করলে আমাদের দেশ ও অর্থনীতির এই এই লাভ হবে’ –তার সহ-নাগরিকদের অনেকেই একথা বিশ্বাস করে তার পক্ষে নেবে। যদি সংখ্যাগুরু নাগরিক তার পক্ষ নেয় তাহলে তার ব্যাক্তিগত বিশ্বাস, রাষ্ট্রীয় পলিসিতে পরিণত হবে। কিন্তু আদতে এর কোন নৈতিক ভিত্তি নেই। এর পেছনে একমাত্র কারণ হল লোভ। ইতিহাসের সব সীমালঙ্ঘনের পক্ষে বারবার এ যুক্তিই দেয়া হয়েছে। এক পশুকে আরেক পশুকে এ যুক্তিতেই আক্রমণ করে।
.
বাস্তবতা হল ব্যাক্তি স্বাধীনতা এবং সংখ্যাগুরুর মত, সেক্যুলার সংস্কৃতির মৌলিক ভিত্তি না। কারণ স্বাধীনতার ফলাফল হল সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা। কিন্তু স্বাধীনতা সিদ্ধান্ত নেয়ার মাপকাঠি না। অর্থাৎ কাউকে যদি সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা দেয়াও হয় তবুও প্রশ্ন থাকে যে সে কীসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে? তাই স্বাধীনতা থাকলেও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে একটি মাপকাঠির প্রয়োজন হয়। একইভাবে সংখ্যাগুরুর মত কোন মাপকাঠি হতে পারে না। সংখ্যাগুরুর মত হল বিভিন্ন ব্যাক্তির নেয়া সিদ্ধান্তের সামস্টিক ফল। কিন্তু এই ব্যাক্তিরা কিসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? তাদের মাপকাঠি কী?

সেক্যুলার ব্যবস্থায় স্বাধীন সমাজ, স্বাধীন ব্যাক্তিদের সিদ্ধান্ত নেয়ার মাপকাঠি কী?
.
নিঃসন্দেহে এ মাপকাঠি হল তাদের খেয়ালখুশি ও কামনাবাসনা, যেগুলোকে তারা নিজেদের ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
.
মূল – শায়খ জাফর শেইখ ইদ্রীস [Secularism & Moral Values]
অনুবাদক – নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের কৃতিত্ব

মানুষের মর্যাদা

আবহমানকাল ধরে দুনিয়ার ভাগ্য মানুষেরই ভাগ্যের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এ দুনিয়ার উন্নতি ও অবনতি, সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের সম্পর্ক মানুষেরই অস্তিত্বের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তাই তো যদি দুনিয়ায় সঠিক মানব যিন্দা থাকে, আর দুনিয়ার যাবতীয় মূল্যবান জিনিস, ধন-দৌলত ও বিলাস-সামগ্রী শেষ হয়ে যায়, তবুও তেমন উল্লেখযোগ্য কোন বিপর্যয় দেখা দিবে না এবং দুনিয়াটি যে একেবারেই মহাসংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়বে তাও না। বরং মানুষের মতো মানুষের উপস্থিতিই অন্যসব বস্তুর ঘাটতির যথাযথ পরিপূরক। সমস্ত বঞ্চনার প্রতিকার এবং হরেক শ্রান্তির এটিই উত্তম বিনিময় সাব্যস্ত হবে। মানুষ তার কর্ম-তৃপ্তি, উদ্দীপনা এবং শ্রম ও নিপুণতা দিয়ে সেসব লুপ্ত দ্রব্য পুনঃস্থাপন করে দিতে সক্ষম হবে।

এটুকুই নয় শুধু, বরং হারানো সেসব জিনিস অপেক্ষা অত্যধিক কল্যাণকর জিনিস সঞ্চিত করে দেখিয়ে দিতেও প্রয়াসী হবে। যদি দুনিয়ার কোন ক্ষমতাসীনকে এ অধিকার দেওয়া হয় যে, তিনি হয়তো নির্বাচন করবেন দুনিয়া ছেড়ে মানুষকে, নয়তো নির্বাচন করবেন মানুষ ছেড়ে দুনিয়াটিকে (আর তিনি এ নির্বাচনে সুবুদ্ধি ও আল্লাহ প্রদত্ত বিবেকশক্তিকে যথাযথ খাটাবেন) তাহলে এটা অনিবার্য যে, তিনি মানুষকেই গ্রহণ ও নির্বাচন করে নিবেন। এতে তিনি কোন প্রকার দ্বিধা-সংশয়ের পক্ষপাতী হবেন না। কারণ দুনিয়া সৃষ্টি করা হয়েছে একমাত্র মানুষেরই নিমিত্ত। এ দুনিয়ার মান-মর্যাদা মানুষকে দিয়েই।

এ পৃথিবীতে দুর্ভাগ্য ও অবক্ষয়ের জন্য অস্ত্রশস্ত্র, বৈষয়িক উপকরণাদি এবং অন্যান্য দ্রব্য-সামগ্রীর অবর্তমানতা দায়ী নয়। বরং ওসব বৈষয়িক উপকরণাদি ও অস্ত্রশস্ত্রের যথোচিত ও যথাস্থানে ব্যবহার না করারই এই পরিণতি। এ পৃথিবীর সুদীর্ঘ ও ঘটনাপ্রবাহে ভরা ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, এতে যতসব বিপর্যয় আমদানি হয়েছে, সবগুলোরই উৎস মানুষের পথভ্রষ্টতা এবং সুপথ ও মৌল স্বভাব থেকে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়া বৈ কিছু নয়। উপকরণ ও মেশিনাদি তো মানুষের হাতে থাকে বাকহীন ও নিষ্কলঙ্ক সম্বল হিসেবে। ওগুলো মানুষের কথায় চলে এবং মানুষেরই কামনা পূরণ করে থাকে। এ মেশিনাদির যদি কোন ত্রুটি থেকে থাকে, তাহলে বিপদের সময় চলার পথে বোঝা ও কষ্ট বাড়িয়ে তোলে।

মানব প্রকৃতিতে গুপ্ত তথ্য ও রহস্যাবলী

এ বিশাল ভূমণ্ডল তথ্য ও রহস্য এবং নানাবিধ বিস্ময়কর জিনিস এবং অদ্ভুত লীলায় এতোই পরিপূর্ণ, যার রং ও রূপ বিবেককে বিব্রত করে তোলে এবং বিবেক ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।

কিন্তু মানব প্রকৃতির গুপ্ত রহস্যসমূহ, বিস্ময়কর বিষয়াদি এবং এর সম্ভাব্য ফসল এবং লুপ্ত সব প্রতিভা হৃদয়ের প্রসারতা ও গভীরতার সামনে অন্যসবের তো তুলনাই চলে না। মানুষের চিন্তা-শক্তির ঊর্ধ্বারোহণ, মানুষের দিগন্তের সুবিশালতা, মানবাত্মার রোমান্টিকতা, এর মধ্যে পুঞ্জীভূত আশা-আকাঙ্ক্ষা, এর সাহসিকতা ও উচ্চাভিলাষ (যা অসীম ও যা শত জয়, শত আনন্দ, বিশাল রাজ্য ও রাজত্ব এবং প্রাচুর্য ও প্রশান্তির পরও তৃপ্ত হয় না) – এর বিভিন্নমুখী ও বিপরীতধর্মী যে অগণিত ও অসংখ্য প্রক্রিয়া রয়েছে, তা যদি দুনিয়ার অবশিষ্ট তথ্য ও রহস্যসমূহের সাথে পরখ করা হয়, তখন এ সুবিশাল ভূমন্ডল ও সৃষ্টিকুলের তুলনায় সাগরের পাশে এক ফোঁটা পানি কিংবা মুরুভূমির পাশে একটি বালুর কণার মতো বিবেচিত হবে।

সারা বিশ্ব যদিও দেখতে এতো প্রকাণ্ড, কিন্তু মানব মনের প্রসারতা ও গভীরতায় তা নিক্ষেপ করলে এমনিভাবে নিমজ্জিত হয়ে যাবে, যেমনি সাগরের অতলতলে একটি ছোট্ট পাথরের টুকরো নিক্ষেপ করলে নিমজ্জিত হয়ে যায়।

মানব মনের ঈমানী সুদৃঢ়তা ও অবিচলতার কাছে পাহাড়ের অস্তিত্ব তুচ্ছ। এর জ্বলন্ত প্রেমের আকর্ষণের প্রখর স্ফুলিঙ্গের কাছে আগুনকে মনে হবে শীতল কিংবা ঈষৎ উষ্ণ। আল্লাহ’র ভয়ে কিংবা আর্তের সমবেদনায় অথবা পাপের অনুশোচনায় প্রবাহিত এক ফোঁটা অশ্রু এক সাগরের পানির উপর ছেড়ে দিলে তখন তা নিজ ধারণ ক্ষমতার অপারকতার জন্য মাতম তুলবে। এমনকি নিজ সংকীর্ণতার জন্য শোকাতুর হতে বাধ্য হবে।

মানব চরিত্রে বিরাজমান মাধুর্য, চারিত্রিক উৎকর্ষ এবং প্রেম-প্রকৃতির মায়ামুখর সৌন্দর্যের যদি প্রস্ফুটন ঘটতো, তাহলে এ বসুন্ধরায় রং-বেরঙের বৈচিত্র্য ও মায়াজালের লীলাখেলা ঠাণ্ডা হয়ে যেতো আর সৃষ্টিকূলের রূপ শোভাকে হারিয়ে দিতো। মানুষের অস্তিত্বই নিখিল ধারার লক্ষ্যমণি এবং মহাকাব্য ছন্দের পরম উৎস। বিশ্বস্রস্টার কুদরত লীলার সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কুদরতের বাস্তব নকশা মানব জাতি, যে জাতিকে তিনি সুশোভিত করেছেন সর্বোত্তম সৌন্দর্যাকৃতি ও সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্র এবং কাঠামো দিয়ে।

মানুষের তুল্য অন্য কিছুর মূল্য হতে পারে না

পৃথিবীর যাবতীয় খনিজ দ্রব্য, গুপ্ত ধনভাণ্ডার এবং মাল ও দৌলত রাজকীয় মর্যাদা মানবিক সে দৃঢ় প্রত্যয় ও আকিদার তুল্য হতে পারে না, যা দ্বিধা-সংশয়ের বহু ঊর্ধ্বে। তুল্য হতে পারে না সে প্রগাঢ় ভালোবাসার, যা বৈষয়িক লাভ ও উন্নতির দোহাই মানে না। সে আকর্ষণের সমতুল্যও হবে না, যা কারো বিধি-নিষেধকে পরোয়া করে না একটুও। এসব বস্তু মানুষের সেই একনিষ্ঠতার বরাবর হতে পারে না মোটেও, যা স্বার্থপরায়ণতার ছোঁয়াচ থেকে মুক্ত। মানুষের মহান চরিত্রের সেই মহানুভবতার তুল্য আর কিছু হতে পারে না, যা বিনিময় ও সুযোগ সন্ধানের কালিমা থেকে পবিত্র। হতে পারে না সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সে নিঃস্বার্থ সেবার সমতুল্য, যা কারো প্রতিদান কিংবা কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের তোয়াক্কা করে না।

মানুষ যদি নিজেকে ঠিক ঠিকভাবে জেনেশুনে তার যথোচিত বিনিময়ের সন্ধানী হয়, তাহলে সমস্ত দুনিয়াবাসী তার সেই বিনিময় পেশ করতে অপারক হয়ে বসবে। যদি তার অস্তিত্ব একটু বিস্তৃতি খুঁজে নেয় এবং নিজ দৃঢ়তা ও নৈপুণ্যের বলগা স্বাধীন করে দেয়, আর এর সাথে সাথে তার স্বভাব-প্রকৃতিকে আপন গতিকে ছুড়ে দেওয়া হয়, তখন এ পৃথিবীটি তার কাছে নেহায়েতই ক্ষুদ্রায়িত হয়ে আসবে এবং সংকীর্ণ হয়ে দীপ্তিহীন বায়ুর পিঞ্জিরায় পরিণত হতে বাধ্য হবে।

পতিত হলে মাত্র এক মুষ্টি মাটি – এ মানব জাতি,
উত্থিত হলে আবার ধরবে না উভয় জাহানেও এ মানব জাতি।

মানব প্রকৃতির গভীরতাকে জরিপ দেওয়া যেমনি দুষ্কর, তেমনি তার শেষ প্রান্তকে অতিক্রম করাও অসম্ভব। তার গুপ্ত রহস্যাবলী আয়ত্তে আনাও যাচ্ছে না, আবার এর তত্ত্বও এবং মূল হাকিকতের সন্ধানটুকুও মিলছে না। এ মানব জাতির বিস্ময়কর এবং বৈচিত্র্যময় যোগ্যতা, জ্ঞান ও সহনশীলতা, ভদ্রতা ও বিনয়ী ভাব, দয়া ও ভালোবাসা, অনুগ্রহ ও দান এবং সূক্ষ্ম দৃষ্টি ও অনুভূতির তীক্ষ্ণতায় হতবাক হতে হয়। যতো বড় ধী-শক্তিধরই হোক না কেন, হতবুদ্ধিতার পরিচয় দিতে হয়। অস্থিরতার সৃষ্টি হয়, যখন চিন্তা করা হয় মানুষের মাঝে দুনিয়ার মোহের প্রতি বিরাগ ও মানুষের ত্যাগ সামর্থ্য, মানুষের আত্মমর্যাদা ও নম্রতা, মাওলার পরিচিতি লাভের উপযোগিতা এবং তার জন্য আত্মত্যাগের বাসনা নিয়ে চিন্তা করলে তো বিব্রত না হয়ে পারা যায় না। এই গোষ্ঠীটির মাঝে পুঞ্জিত জনসেবার প্রেরণা এবং জটিল ও কঠিন নতুন নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুরাগ সম্পর্কে যখন ভাবা হয়, তখনও বিস্মিত হতে হয়।

মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের কৃতিত্ব
মানুষের অস্তিত্বই মূলত যাবতীয় মঙ্গল ও কল্যাণকামিতা এবং সৌভাগ্য ও অগ্রগতির চাবিকাঠি। সমস্ত বৈষম্য ও সংকটের প্রকৃত সমাধানকারী এই মানুষই। এই মানুষের গঠনে যখন বক্রতা চলে আসে আর বিনষ্ট হয়ে উঠে তার কৃষ্টি-কালচার, তখন মানুষের মতো মানুষ মেলা বিরল ও দুর্লভ হয়ে পড়ে। মানুষ তৈরি করার নীতি ও পদ্ধতি তখন আর টিকে থাকে না। মানুষ তৈরি করাই সর্বযুগে নুবওয়াতের প্রধান লক্ষ্যমূল হয়ে আসছে। নবীগণ সবাই নিজ যুগে এ সমস্যাটি নিয়ে জনসমাজে আবির্ভূত হয়েছেন।

মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের কৃতিত্ব এটুকু যে, এই নবুওয়াতের মাধ্যমে এমন কিছু অতুলনীয় গুণ ও অবর্ণনীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষ গড়ে উঠেছে, যাদের নজীর ইতিহাসের চোখে কোনদিন ধরা পড়েনি এবং আসেনি এমন অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত সৌর দৃষ্টির সামনে। তারা গ্রথিত মুক্তার মালা, সীসা ঢালা প্রাচীর এবং জামাআত ও সম্প্রদায়ে সুসংগঠিত হলেন, যার ফলশ্রুতিতে তারা একটি ঐক্যবদ্ধ উদ্দেশ্য ও বিশ্বাসের লক্ষ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার অটুট সূত্র স্থাপন করে ফেললেন। নবুওয়াতে মুহাম্মাদির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুপম কৃতিত্ব আর মহা অলৌকিকতা তো এটিই।

মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই সুদূর প্রান্ত থেকে মানুষ তৈরি ও মনুষ্যত্বের পুনঃ জাগরণের কাজে হাত দেন, যেখান থেকে আর কোন নবী কিংবা সংস্কারও করতে হয়নি। তারা কেউ এই দায়িত্বে আদিষ্টও হোননি। কেননা, অন্যান্য নবীর সামাজিক পরিবেশ আরবের বর্বরতার যুগ থেকে বহু উচ্চমানের ছিল। তদুপরি, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহান কাজকে নিয়ে এতখানি উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে সফলকাম হলেন, যতখানি অন্য কোন নবীর কর্মধারা পৌঁছেনি।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাশবিকতার চরম সীমা থেকে কর্মনীতি পরিচালনা করলেন। অথচ মানবতার প্রশিক্ষণের সেটিই ছিল প্রাথমিক বিন্দু। তারপর পৌঁছে দিলেন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষকে মনুষ্যত্বের ঊর্ধ্ব শিখরে, যার ঊর্ধ্বে নবুওয়াতের একটি সোপান ছাড়া কোন সোপান আর অবশিষ্ট রয়নি। এই কৃতিত্বের চিরন্তন শিরোপা অর্জন করেন যে মহামানব, তিনিই নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

আসল বাস্তবটি ধারণাতীত চিত্তাকর্ষক
উম্মতে মুহাম্মাদির প্রতিটি সদস্যই নবুওয়াতের অলৌকিকতার একটি স্বতন্ত্র নিদর্শন এবং নবুওয়াতের শাশ্বত কামিয়াবী এবং মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্ব ও মহানত্বের উজ্জ্বল প্রমাণ। কোন শিল্পী তার তুলির রেখায় কিংবা কল্পনার আকাশে এর চেয়ে সুন্দর কিছু আঁকতে পারে না। পারে না তাদেরকে সেভাবে তুলে ধরতে, যে মনোহর আলোকে তারা বাস্তব ক্ষেত্রে ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল রয়েছেন।

কোন কবির তার প্রাণবন্ত খেয়াল, আনন্দঘন মন ও কবিত্ব শক্তিকে পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করেও মানব সত্তায় বিরাজমান কোমল গুণাবলী, নিখুঁত চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিকগুলোর কাল্পনিক নকশা তৈরি করা সম্ভব না। এমনকি সমস্ত সাহিত্যিক সমবেত হলেও মানবতার কোন একটি দিক মাত্রের প্রসারতার বাহ্যিক নমুনা পেশ করার চেষ্টা করা ব্যর্থতার নামান্তর বৈ কিছু নয়।

যারা ছিলেন নবুওয়াতের কোলে লালিত, যারা মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষায়তনে প্রশিক্ষণ লাভ করে বের হয়েছিলেন, তাদের মজবুত ঈমান, গভীর ইলম আর ন্যায়পরায়ণ মনের কোন তুলনাই হয় না। তাদের জীবন ছিল ভাওতাবাজি, লোক-দেখানো মনোবৃত্তি, মুনাফিকী এবং দাম্ভিকতা থেকে বিলকুল মুক্ত। তাদের আল্লাহ-ভীতি, সাধুতা, পবিত্রতা, আতিথেয়তা এবং অনুগ্রহের ধরণের উদাহরণ অন্যসব উম্মতের মধ্যে বিরল।

এদিকে আবার তারা ছিলেন বীরত্ব ও নিপুণতা, ইবাদাতের অনুপ্রেরণা এবং শাহাদাতের ব্রতে সদাব্রতী। দিন তাদের কাটতো বীরের বেশে এবং রাত কাটিয়ে দিতেন তারা আল্লাহ’র ইবাদাতে। পার্থিব আরাম-আয়েশ ও ভোগ বিলাসের প্রতি বৈরাগ্যের ফলে তারা ছিলেন শ্রেষ্ঠ। ইনসাফ প্রতিষ্ঠা, জনদরদ, রাতে প্রজাদের কুশলাদির খবর নেওয়া এবং নিজের আরামকে হারাম করে জনগণকে শান্তি পৌঁছানোর অভিব্যক্তিতে তাদের তুলনা বিরল।

জীবনের বিভিন্ন ধাপে ও বিভিন্ন ময়দানে নিষ্ঠাবান মনীষা

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাওয়াত ও রিসালাতের মাধ্যমে তৈরি করলেন এমন এমন মনীষা, যারা আল্লাহ’র উপর অগাধ বিশ্বাস স্থাপনকারী, তার গ্রেফতার সম্পর্কে নিতান্তই ভীত, দ্বীনদার, আমানতদার, দুনিয়ার উপর আখিরাতকে প্রাধান্যদাতা এবং জড়বস্তুর রঙ্গমঞ্চের প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন ছিলেন। জড় বস্তুকে তারা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা দিয়ে কাবু করে নিতেন।

তাদের প্রাণভরা আস্থা এটি ছিল যে, দুনিয়াকে তাদেরই জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে আর তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে আখিরাতের জন্য। এজন্যই ব্যবসা ক্ষেত্রে তারা পরিচিত হতেন নিষ্ঠাবান ও আমানতদার ব্যবসায়ী হিসেবে। অভাব-অনটনের সম্মুখীন হলে তারা পরিচিত হতেন ভদ্র ও মেহনতী মানুষ হিসেবে। শুভাকাঙ্ক্ষী শাসনকর্তা ও কঠোর পরিশ্রমীরূপে তারা চিহ্নিত হতেন যখন কোন অঞ্চলের শাসনের দায়িত্ব নিতেন। তাদের হাতে যখন অর্থ ভাণ্ডার আসতো, তখন অতুলনীয় করুনা ও সমবেদনার সাথে এর সদ্ব্যবহার করে থাকতেন।

ন্যায়পরায়ণতায় অনুরাগী ও বাস্তবানুরাগী হিসেবে তারা প্রমাণিত হতেন, যখন তারা বিচার ও আদালতের এজলাসে সমাসীন হতেন। তারা কোথাও গভর্নর হিসেবে নিয়োজিত হলে একনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত হিসেবে আখ্যায়িত হতেন। নেতৃত্বের অঙ্গনে তারা বিনয়ী, অন্তরঙ্গ এবং সমবেদনা প্রদর্শনকারী নেতারূপে প্রতীয়মান হতেন। জনসাধারণের অর্থ-তহবিলের দায়িত্ব পেলে তারা ভক্ষক না হয়ে বুদ্ধিমান রক্ষক হিসেবে খ্যাত হতেন।

যেসব বুনিয়াদি জিনিস দিয়ে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করলো

উল্লিখিত আদর্শসমূহের ইট দ্বারা ইসলামী সমাজের প্রাচীরটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলো। সেসব জিনিসকে নির্ভর করেই ইসলামী হুকুমাত একদিন দাঁড়িয়েছিলো। সে সমাজ ও রাষ্ট্র প্রকারান্তে সে সকল মনীষীরই চারিত্রিক ও মানসিক অবস্থার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। তাদেরই ন্যায় তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সমাজটি ছিল আমানতের পথিকৃৎ। ইহকালের উপর পরকালকে প্রাধান্য প্রদানকারী ছিল সেই সমাজটি। বস্তু কর্তৃক প্রভাবান্বিত না হয়ে বস্তুর প্রশাসক হতেন তারা।

এ সমাজের নেতৃত্বে এক ব্যবসায়ীর সততা ও আমানত, এক নিঃস্বের সারল্য ও দৈন্য, এক শাসনকর্তার পরিশ্রম ও শুভ কামনা, একজন ধনবানের বদান্যতা ও হিত কামনা এবং বিচারকর্তার ন্যায়পরায়ণতা ও বিচক্ষণতার যৌথ মিশ্রণ বিদ্যমান ছিল। এ সমাজ প্রতিষ্ঠায় একজন গভর্নরের একনিষ্ঠতা ও বিশ্বস্ততা, একজন নেতার বিনয়ী ভাব ও দয়া, একজন কৃতজ্ঞ সেচ্ছাসেবকের সার্বিক প্রয়াস এবং একজন আমানতদার প্রহরীর অতন্দ্রপ্রহরা ও সতর্ক দৃষ্টির সমাবেশ ঘটেছিলো।

রাষ্ট্রটি ছিল দাওয়াত ও হিদায়াতের পতাকাবাহী। এ রাষ্ট্র আকিদার জগতকে বাহ্যিক লাভ-লোকসানের উপর প্রাধান্য দিতো। এ রাষ্ট্র অর্থ সংগ্রহ ও ট্যাক্স তহশীলের উপর জনগণকে হিদায়াত দান ও সুপথ প্রদর্শনকে প্রাধান্য দিয়ে সে সমাজের প্রভাব ও প্রচলন এবং তার রাষ্ট্রীয় প্রভাবে জনজীবনে ঈমান, সুকর্ম, সততা, একনিষ্ঠতা, জিহাদ ও ইজতেহাদ, লেনদেন, ন্যায় ও সাম্য এবং পারস্পরিক ইনসাফ কায়েমের দৃশ্যই একমাত্র গোচরীভূত হতো।

পরীক্ষা এবং অভিজ্ঞতার যাচাইয়ে নিষ্ঠাবানদের সফলকামিতা

সেসব নিষ্ঠাবানই এমন এমন কঠিন পরীক্ষা ও যাচাইয়ের সম্মুখীন হয়েছেন, যেসব পরীক্ষায় মানবিক দুর্বল দিকগুলো আর গুপ্ত ব্যাধিসমূহের বহিঃপ্রকাশ না ঘটে পারে না। অথচ তারা সে কঠিন অগ্নিপরীক্ষার জ্বলন্ত চুল্লী থেকে অকৃত্রিম ও নির্ভেজাল হীরকের মতো বের হয়ে এসেছেন। তার মধ্যে কিঞ্চিৎ ভেজাল কিংবা অন্য কিছুর মিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়নি। সমস্ত নাযুক পরিস্থিতিতে তারা ঈমানী শক্তি, অভিপ্রেত ক্ষমতা আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশিক্ষণের আদর্শকে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। নিজ সততা, দায়িত্ববোধ, আমানত, আত্মনির্ভরশীলতা আর আত্মবিসর্জনের বুলন্দ নমুনা তারা পেশ করতেন। পরবর্তী যুগের মনোবিজ্ঞানী, চরিত্র বিশেষজ্ঞ এবং ঐতিহাসিক ও প্রকৃতিবিদগণের ধারণাতীত নজীর স্থাপন করে গেছেন তারা।
সেসব নাযুক পরিস্থিতিগুলো হতে বেশী নাযুক পরিস্থিতি হচ্ছে আমীর ও শাসকের পদটি। তিনি পৃথিবীর কারো কাছে জবাবদিহি করার নন, নেই তার পিছনে কোন প্রকার গুপ্তচর নিয়োজিত, তাকে কোন কমিটি কিংবা আদালতের সম্মুখীন হওয়ারও নেই – অথচ তিনি নিজের জন্য অনেক অনেক বৈধ জিনিসের ব্যাপারেও সংযমী থাকতেন। নিজের ব্যক্তিগত সম্পদের দিক থেকেও উদাসীনতা প্রদর্শন করতেন। এমনকি সামান্য সম্পদেরও ধার ধারতেন না তিনি। অথচ সেগুলোর ব্যবহার শরীয়তের পক্ষ থেকে একান্তই বৈধ। সাধারণ সমাজেও তা ব্যবহার্য আর সর্বযুগেই তা তুচ্ছ ও নগণ্যের ফিরিস্তিতে শামিল রয়েছে।

শাসকদের দুনিয়া সম্পর্কে অনীহা ভাব ও তাদের সারল্য
এ প্রেক্ষিতে সবচেয়ে উত্তম দৃষ্টান্ত হচ্ছে, খলিফাতুল মুসলিমীন আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু’র মহীয়সী পত্নীর একদিন মিষ্টান্ন খাওয়ার অভিপ্রায়ের ঘটনাটি। এজন্য তিনি তার দৈনন্দিন খরচ থেকে কিছু কিছু বাঁচিয়ে রেখে সঞ্চয় করেছিলেন। সিদ্দীকে আকবর ব্যাপারটি সম্পর্কে অবহিত হলে তিনি সে সঞ্চিত টাকাগুলো বায়তুলমালে জমা তো দিয়ে দিলেনই, সাথে সাথে দৈনন্দিনের নির্ধারিত ভাতা থেকে সে পরিমাণ কেটে কমিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, এ কথা বোঝার আর বাকি নেই যে, এ পরিমাণ ভাতা এ যাবত অতিরিক্ত আসছিলো। আর বললেন, নির্ধারিত ভাতার চেয়ে কমেও তো আবু বকরের জীবন যাপন সম্ভব। মুসলমানদের বায়তুল মাল তো এজন্য নয় যে, এর দ্বারা প্রশাসকের পরিবার-পরিজন বিলাসবহুল জীবন যাপনের সুযোগ গ্রহণ করবে। আর আহারে-বিহারে তারা অত্যধিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যময়ী হয়ে পড়বে।
এ প্রসঙ্গে খিলাফতে রাশিদার শাসনামলের একটি সত্য ছবি আমি তুলে ধরছি। আর এটি হছে তদানীন্তন বৃহত্তর সাম্রাজ্যের শৌর্যশালী একজন প্রশাসকের সরকারী সফরকে কেন্দ্র করে। তা ছিল এমন একজন প্রতাপশালী প্রশাসকের সফর, যার নাম শোনামাত্র জনমনে কম্পন সৃষ্টি হতো তারা বর্ণনাকারী সফরসঙ্গী ছিলেন বিধায়। তার প্রত্যক্ষ বর্ণনাটিই তার সাহিত্যের অলংকারে অলংকৃত করে যেভাবে বর্ণনা দিতে প্রয়াসী হয়েছিলেন, আমি ঠিক সেভাবে পেশ করার চেষ্টা করবো। ইবনে কাসির বর্ণনা করেন –
“উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে একটি মেটে রঙের উটের উপর সওয়ার হয়ে রওয়ানা দিলেন। খুব রৌদ্র তাপ। তার মাথায় নেই লৌহ-শিরস্ত্রাণ, নেই পাগড়ি। উটের পিঠের হাওদার উপর বসে বসে তিনি পা দুটো দুদিকে ঝুলিয়ে রাখছেন। পা দুটো রাখার জন্য দুটো রেকাবও ছিল না। উটের উপর ছিল একটি মোটা পশমী কাপড়। মাঝেমধ্যে উট থেকে নেমে তিনি সেটি বিছাতেন। তৃণলতায় ভরা তার চামড়ার অথবা পশমের একটি পুটলি ছিল। যখন উটের উপর থাকতেন তখন সেটিতে হেলান দিতেন, নেমে সেটি দিয়ে বালিশের কাজ করতেন। পরনের জামাটি ছিল খুবই মোটা। সুতি বস্ত্র। তাও কাঁধের তলদেশ দিয়ে ছেঁড়া ছিল।
খলিফার আদেশক্রমে লোকজন তথাকার সর্দারকে ডাকতে গেলো। জুলুমুসকে ডাকতে গেলো। তারপর খলীফা তার পরনের জামাটি ধুয়ে ছেঁড়া জায়গায় একটি তালি লাগিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন এবং ধার হিসেবে ক্ষণিকের জন্য একটি কাপড় কিংবা জামার ব্যবস্থা করতে বললেন। একটি রেশমী জামা উপস্থাপিত করা হলো। তিনি দেখামাত্র বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন – এটা কি ? লোকজন বললেন- রেশম। তিনি জানতে চাইলেন যে, রেশম কি জিনিস ? লোকজন তা বুঝিয়ে দিলে তিনি পরনের জামাটি খুলে গোসল করে নিলেন। ইত্যবসরে তার তালি দেওয়া জামাটি হাযির করা হলে তিনি রেশমী জামাটি খুলে সেটিই পরিধান করে নিলেন।
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু’র খেদমতে জুলুমুস পরামর্শ হিসেবে আবেদন জানালো যে, আপনি আরবের বাদশাহ। এখানকার লোকজনের মধ্যে উটের কোন গুরুত্ব নেই। এই হেতু আপনি মর্যাদাপূর্ণ পোশাক পড়ে ঘোড়ায় আরোহণ করে নিলে রোমানদের মনে প্রভাব সৃষ্টি করবে। এ আবেদনের প্রেক্ষাপটে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন – আমরা সেই জাতি, আল্লাহ পাক যাদের সম্মান বৃদ্ধির মাধ্যম নির্ধারণ করেছেন একমাত্র ইসলামকেই, তাই আল্লাহ পাকের নির্ধারিত সম্মান মাধ্যমকে উপেক্ষা করে অন্য কিছুকে মাধ্যম হিসেবে আমরা গ্রহণ করতে পারি না মোটেই।
একটি ঘোড়া আনা হলো। তিনি তার চাদরটি রেখে দিলেন ঘোড়াটির উপর। লাগাম লাগালেন না আর রেকাবও সংযোগ করলেন না, বরং এমনিতেই সওয়ার হয়ে গেলেন ঘোড়াটির উপর। কিন্তু কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই তিনি বলে উঠলেন – থামো, থামো, আমি এর আগে কাউকে আর শয়তানের উপর সওয়ার হতে দেখিনি। এরপর তার উটটি আনা হলে তিনি সেটাতেই সওয়ার হয়ে গেলেন।” (১)
ইতিহাসবেত্তা তাবারীও অনুরূপ একটি ঘটনা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু’র একটি ভ্রমণ বিবরণীতে বর্ণনা করেছেন –
“একসময় উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু ভ্রমণে বের হলেন। স্থলাভিষিক্ত করে রেখে গেলেন তিনি মদীনায় আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে। কয়েকজন সাহাবায়ে কিরামও তার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। তিনি লোহিত সাগরের তীরে ইবিল্লার দিকে যাচ্ছিলেন। ইবিল্লার সন্নিকটে এসে পাশ কেটে তিনি সামনে বেড়ে গেলেন এবং গোলামকে তার পিছনে রেখে দিলেন। এরপর তিনি ইস্তিঞ্জা করে নিলেন। ইস্তিঞ্জা হাতে প্রত্যাবর্তন করে তিনি গোলামের সওয়ারীটির উপর সওয়ার হয়ে গেলেন। নিজের সওয়ারীটি দিয়ে দিলেন তার গোলামকে। এরপর সেখানকার জনগণের প্রথম দলটি এসে তাকে জিজ্ঞেস করলো – আমিরুল মুমিনীন কোথায়? উত্তরের তিনি বললেন – তিনি তোমাদের সামনেই। অতএব, জনগণ সামনে বেড়ে গেলেন। ইবিল্লা পৌঁছে খলীফা বললেন – আমিরুল মুমিনীন ইবিল্লা পৌঁছল, যদ্দরুন জনগণ তাকে চিনে নিতে আর ভুল করলো না এবং সবাই তার দিকে ঝুঁকে পড়লো।” (২)

মানবতার আদর্শ নমুনা
খুলাফায়ে রাশিদা ও সাহাবায়ে কিরামগণের জীবনচরিতে দুনিয়ার প্রতি বিরাগ ভাব, নম্রতা, কুরবানী, সমবেদনা, ন্যায়পরায়ণতা ও নিপুণতা, প্রজ্ঞা ও সততার উজ্জ্বল আদর্শ এতো অধিক পাওয়া যায়, যেগুলোকে কোন ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, মনোবিজ্ঞানী বা চরিত্র বিশেষজ্ঞ যদি একত্র করে গুছিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনচিত্র অংকনের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে অবশ্যই মানব মণ্ডলে তা একটি অনুপম আদর্শ ও নিখুঁত ব্যক্তিত্বরূপে প্রতিভাত হবে। পরিণত হবে তা দিয়ে মানবতার মহাজাগরণের অ্যালবাম। মানবতার বিশ্বজনীন প্রদর্শনীতে তা আদৃত হবে এক অপূর্ব শোভার নিদর্শন হিসেবে।
কিন্তু পরিতাপের সাথে বলতে হয়, আমরা সে মনোনীত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জামাআতটির পূর্ণাঙ্গ এবং যথাযথ গুণাবলী ও চিত্র কোন গ্রন্থে খুঁজে পাচ্ছি না। তা অবশ্য তাদের জীবনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুকোমল সংস্পর্শে ও সুস্নিগ্ধ দীক্ষার ফলশ্রুতি হিসেবেই বিদ্যমান ছিল। তা থেকে মাত্র গুটিকয়েক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছুটা আলো, কিছু সাহিত্য সুষমামণ্ডিত রচনা এবং চরিত্র চিত্রণ গ্রন্থাবলীতে সংরক্ষিত হয়ে গেছে। কেননা, আরববাসীগণ আবহমান কাল ধরে স্বীয় পাণ্ডিত্য, বাগ্মিতা, শিল্প নিপুণতা এবং যথোচিত ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে শিরোপা অর্জন করে আসছে। তাদের সে সাহিত্য-প্রজ্ঞা ও শিল্প-নিপুণতার বদৌলতেই আমরা নববী সংস্পর্শের প্রভাব ও ফলাফল এবং সফলতা ও অনুপমতা সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আঁচ করতে সক্ষম হচ্ছি এবং সে সুপ্রতিষ্ঠিত মহতী সমাজটির নমুনা অবলোকন করার সুযোগ পাচ্ছি।
তাদের সে আদর্শমাখা সমাজটিকে দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযা হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য নিয়ে দৃষ্টিলোকে উদ্ভাসিত হয়ে আছে। তার মধ্যে একটি দৃশ্য আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে নিয়ে, যা ভাব ও সাহিত্যিকতার নিরিখে অতীব রসালো। সে চিত্রটি তার প্রভাব ও তাৎপর্য বিচারে বস্তুবাদী ও আধ্যাত্মিক সাহিত্য জগতের এক অনুপম উপজীব্য হওয়ার দাবী রাখে।
একদিন আমীরে মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র একজন ঘনিষ্ঠ সহচর যিরার ইবন যামরাকে আবেদন জানালেন, তিনি যেন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র কিছু গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন। যিরার ইবন যামরার খুবই কাছে থেকে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সোহবত নেওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। আমীরের আবেদন অনুযায়ী যিরার বলতে লাগলেন –
“আল্লাহ’র শপথ, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন উচ্চ সাহসিকতাসম্পন্ন, সুঠাম দেহের অধিকারী একজন বীর কেশরী। তার ফয়সালা যে কোন বিষয়ে চূড়ান্ত বলে গণ্য হতো। ন্যায়পরতার উপর প্রতিষ্ঠিত হতো তার ফয়সালা। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র প্রতিটি কাজ থেকে জ্ঞানের প্রস্রবণ উৎসরিত হতো। দুনিয়া ও দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি ছিল তার নিঃস্পৃহতা। রাতে একাকী অন্ধকারে তিনি বেশী বেশী সময় কাটাতেন।
আমি আল্লাহ’র শপথ করে বলছি, অত্যধিক আহাজারী ও কান্নাকাটি, অবর্ণনীয় চিন্তা-সাধনাই ছিল তার সার্বক্ষণিক ও অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য। তিনি তার হাতের তালু নিজের দিকে ফিরিয়ে সম্বোধন করতেন নিজেই নিজেকে। অতীত কর্মের হিসাবও নিতেন নিজেই। মোটা কাপড় ও সাধারণ পানাহার পছন্দ করতেন। আমাদের মধ্যে থাকতেন তিনি আমাদেরই মতো হয়ে। আবার যখন কোন কথা জানতে চাইতাম, তা প্রশান্তচিত্তে বুঝিয়ে দিতেন তিনি। আমরা তার কাছে আসলে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করতেন। তাকে আমরা দাওয়াত করলে চলে আসতেন অকুণ্ঠ চিত্তে। কিন্তু তার নজিরবিহীন অন্তরঙ্গতা ও বিনয়ী ভাব এবং সারল্য সত্ত্বেও আমরা তার প্রতি সৃষ্টি ভীতিমাখা শ্রদ্ধার ফলে বেশী কিছু বলার হিম্মত হারিয়ে ফেলতাম। এমনকি আমাদের পক্ষ থেকে কোন কিছু বলার সূচনা করার সাহসটুকুও হতো না। মৃদু হাসিটুকু যখন দিতেন তিনি, মুক্তামালার মতো দাঁতগুলো চকচক করতো। দ্বীনদারদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং সহায়-সম্বলহারাদের সমবেদনা প্রদর্শনই ছিল তার জীবনের মৌল আদর্শ। যতটুকু প্রতাপশালী ব্যক্তিই হোক না কেন, তাকে দিয়ে কোন প্রকার অন্যায়ের পক্ষপাতিত্বের আশাটুকু করতো না। কোন আর্ত ও দুর্বল মানুষ তার ন্যায়পরায়ণতা থেকে বঞ্চিত ও বিমুখ হতো না।
আমি আবারো আল্লাহ’র শপথ করে বলছি, আমি অনেক সময় আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’কে এমন অবস্থায় দেখেছি যে, রাত শেষ হতে চলেছে, তারকারাজি অস্তপ্রায়, তিনি তখন তার দাড়িগুলো ধরে মসজিদের মিহরাবে সর্পে দংশিত মানুষের মতো অস্থির ও সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছেন কিংবা নিতান্তই বিষাদগ্রস্ত হয়ে কাঁদছেন।
আমি তাকে এ কথা বলতে শুনতাম – হে দুনিয়া, তুই কি আমাকে যাবতীয় বিপর্যয়ের লক্ষ্যস্থল নির্ণীত করতে চাস ? আমাকে আকৃষ্ট করার জন্যই কি তোর এসব অভিমান ও ছলনা ? দূর হো, তুই দূর হো। তোর প্রতারণা আমার এখানে না, অন্যখানে। আমি তোকে এমনভাবে তালাক দিয়েছি যে, তোর দিকে প্রত্যাবর্তন করা আর সম্ভব না। তোকে নিয়ে জীবনকাল নেহায়েতই সাময়িক। তোকে দিয়ে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অকিঞ্চিৎ। অথচ পরিণাম তার কতোই না ধ্বংসাত্মক। আহ ! চলার পথের পাথেয় এতো সামান্য, অথচ ভ্রমণ কতো দীর্ঘ, পরন্তু পথ কতোই কণ্টকাকীর্ণ।”

প্রথম ইসলামী সমাজ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠিত সে সমাজটি মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ হিসেবে নন্দিত ও স্বীকৃত। এটি একমাত্র তারই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুপম তারবিয়াতের ফসল। সে সমাজটি যেমনি ছিল হৃদয়গ্রাহী তেমনি মানবিক সমস্ত গুণের সঞ্চিত ভান্ডার। সে সমাজটির সঠিক রূপরেখাটি ফুটে উঠেছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক বিশ্বস্ত সহচর আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু’র একটি বর্ণিত হাদিস দিয়ে, যা নিতান্তই সাহিত্য রসালো, সংক্ষিপ্ত, তাৎপর্য, বিশালত্ব, গাম্ভীর্য এবং ভাববোধক শব্দে উচ্চারিত হয়েছে। তিনি বলেন, “সাহাবায়ে কিরাম অপরাপরের মাঝে ছিলেন পূত হৃদয়ের অধিকারী, গভীর প্রজ্ঞাময়। তাদের জীবনে লৌকিকতা বা কৃত্রিমতা খুবই কম পরিলক্ষিত হতো। তারা ছিলেন সেসব মনীষী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বরকতময় সান্নিধ্য লাভের এবং দ্বীনের ঝাণ্ডা বুলন্দ ও মদদের নিমত্ত স্বয়ং আল্লাহ পাক যাদেরকে নির্বাচন করেছিলেন।” (৩)
যখন সেই মহতী সমাজটিকে অন্য কোন সমাজের সাথে তুলনা করা হবে, তো সমষ্টিগতভাবে সেটির পাল্লা বহু ভারী প্রতীয়মান হবে। আর তাদের দুর্বলতার দিক (যা থেকে সৃষ্টিমাত্রই মুক্ত নয়) এদের গুণাবলী ও আদর্শাবলীর তুলনায় একেবারেই নগণ্য ও অধর্তব্য সাব্যস্ত হবে। তাদের চরিত্র মাধুরীর দৃষ্টান্ত তো মানব ইতিহাসে বিরল। এই প্রেক্ষিতে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ’র সাহিত্য অলংকারমন্ডিত সুদৃঢ় বাণীটি প্রণিধানযোগ্য মনে করি –
“সাহাবায়ে কিরামগণই ছিলেন এই উম্মতের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তিবর্গ। কেননা, হিদায়াত ও দ্বীনের পথে উম্মতের মধ্যে তাদের চেয়ে অগ্রগামী অন্য কেউ হয়ে উঠেনি। মতভেদ ও মতানৈক্য থেকে তারাই তুলনামূলক বেশী মুক্ত ছিলেন। আর যদি কোথাও তাদের সাথে কোন ত্রুটির সংযুক্তি ঘটেছে, তা অন্যদের তুলনায় নিতান্তই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। অনুরূপ এ উম্মতের ত্রুটিগুলো অন্য সমাজগুলোর নিরিখে হিসাব করলে তা তুচ্ছ ও উপেক্ষণীয় বলে বিবেচিত হবে। তা দেখে যারা সাহাবায়ে কিরামগণ সম্পর্কে ভিত্তিহীন অপপ্রচারে মত্ত হয়েছে, তাদের উদাহরণ হচ্ছে, যেন তারা ফটিকের মতো শুভ্র কাপড়ের একটি তিলককে প্রকট করে দেখানোর অপচেষ্টা করছে। তারা অন্যান্য সমাজের কালো কাপড়গুলো দেখছে না, যার ভিতরে শুভ্রতার বিন্দুমাত্র দেখা যায় না। এ ধরেনর সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত জুলুম ও অজ্ঞতার পরিণতি বৈ কিছু নয়।” (৪)

পরবর্তী বংশধরগণের উপর মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রিসালাতের প্রভাব
নববী দাওয়াত, তালীম ও সুমহান আদর্শ, যা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামের জীবন-চরিতের রূপ-রঙে উপস্থাপন করেছিলেন, তা শুধু সে যমানার জন্যই সীমিত ছিল তা নয়, বরং পরবর্তী উত্তরসূরিদেরকেও শিক্ষাদানের দিকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুপ্রাণিত করেছেন।

কেননা, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সনাতন আদর্শ সকল দেশ এবং সকল পরিবেশের জন্য শাশ্বত আদর্শ। তাই তা চলার পথের দীপ্ত প্রদীপ এবং চিরন্তন পথিকৃৎ। আর এজন্যই এমন জিনিস তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রেরিত সমাজটিতে শুধু সীমাবদ্ধ থাকার নয়। বরং তা সেই জ্যোতিষ্মান সূর্যের মতো যার আলো ও তাপে প্রতিটি যুগে প্রতিটি স্থানে ফসল ও ফল-ফলাদি পরিপক্বতা লাভ করছে। এটি এমন শাশ্বত সূর্য, যেটি আপন সৌরমণ্ডলে অবস্থান করছে বটে, কিন্তু তার মৃদু সোনালি মাখা সঞ্জীবনী কিরণ এ বসুন্ধরাকে প্রতিনিয়ত প্রেরণ করছে। কাছে হোক কিংবা দূরে থাকুক, প্রতিটি প্রাণী তা থেকে লাভ করছে সজীবতা।

আল্লাহ তাআলা আর আখিরাতের উপর ঈমান আনার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত , আল্লাহ’র মেহেরবানীর প্রতি তার (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐকান্তিকতা, তার অসন্তুষ্টি ও গ্রেফতারীর ভয়, প্রতিদান ও সওয়াবের প্রত্যাশা, জাহান্নামের ভীতি, জান্নাতের প্রেরণা, পার্থিব জিনিসের প্রতি নিঃস্পৃহতা, আখিরাতের পাথেয়র অনুসন্ধান, অত্যধিক সারল্য, নিজ ও নিজ সন্তান-সন্ততি অপেক্ষা অন্যদেরকে প্রাধান্য দেওয়া, অনাত্মীয়ের জন্য ত্যাগ, তাদেরকে আত্মীয়দের চেয়েও নিকটতম ভাবার মানসিকতা ইত্যাদি এক বিশ্বজয়ী সার্বজনীন শিক্ষণীয় পাঠ্যসূচী হিসেবে গণ্য। শুধু তাই নয়, বরং জিহাদ, উৎসর্গীকরণ ও আত্মবিসর্জনের মতো জীবন-পরীক্ষায় একান্ত আপনজনদেরকে সামনে বাড়িয়ে দেওয়া বিভিন্ন চরিত্র মাধুরী ও সূক্ষ্ম অনুভূতি চালিত উজ্জীবন বিশ্বজনীন প্রশিক্ষণই বিষয়বস্তু হিসেবে বিবেচ্য।

মোটকথা, তা দিয়ে পরবর্তীকালে বংশ পরম্পরায় মানব সন্তানগণ আদর্শবান হচ্ছিলো। উলামা, নেতৃবর্গ, রাজা-বাদশা, শাসক-প্রশাসক, আবিদ-জাহিদ সকলেই এ ফোয়ারা থেকে স্বচ্ছ ও পবিত্র হয়ে আসছে। চরিত্র ও মানবতার প্রথম সবক নিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছে এ শিক্ষা পাদপীঠ থেকে, যার ফলে স্বীয় চরিত্র মাধুরীর উৎকর্ষ, তীক্ষ্ণ অনুভূতি, সূক্ষ্ম দৃষ্টি, আমানতদারী, বিলাস-সামগ্রী, ধনাগারের চাবি, প্রশাসন ভাব এবং সমাজের ভবিষ্যৎ নিজের হাতে নিয়ন্ত্রিত থাকা সত্ত্বেও তারা দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত ছিলেন। তারা আল্লাহ’র ইবাদাতে যুগের পথিকৃৎ ছিলেন।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শে দীক্ষিত মনীষীগণ স্থান ও কালের দুস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও নবুওয়াতের ফসল, ইসলামী দাওয়াতের ফল এবং মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রিসালাতেরই কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের নিদর্শন হয়ে রয়েছেন। এদের চরিত্রে যে আকর্ষণ পরিদৃষ্ট হচ্ছে, এসব তো নবুওয়াতে মুহাম্মাদিরই (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিচ্ছবি। এই আকিদা-বিশ্বাস ও চরিত্র বিকাশে তাদের পিতা-মাতা, পরিবেশ এবং নিজস্ব মেধার তেমন কোন ভুমিকা নেই। কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে দাওয়াত ও তালীম না হলে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও অনুশীলনের প্রেরণা জাগ্রত হয়ে ইসলামের অবদানে তারা ধন্য না হলে, হয়তো তারা আকিদাগত দিক দিয়ে হতো মূর্তিপূজারী, হতো হিংস্র পশুর তুল্য। তাওহীদ যদি না হতো, আল্লাহ-ভীতি আসতো না। দুনিয়ার প্রতি অনীহা ও ত্যাগ না হলে ক্ষমা ও উদারতার মহানুভবতা তারা পেতো না। কোন মহৎ অনুপ্রেরণাও আসতো না, ফলে তাদের চরিত্র মাধুর্যও দেখা যেতো না।

বিশ্বজনীন ও শাশ্বত মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদর্শ নিকেতনের কিছু খ্যাতিমান শিষ্য এবং তাদের সুমধুর চরিত্র ও জীবনের কিছু দৃষ্টান্ত সেই আদর্শ শিক্ষা নিকেতন থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত এমন একজনকেই সামনে রাখুন, যিনি ইসলামের মূল দোলনা তথা আরব উপদ্বীপ থেকে সুদূরবর্তী এক জায়গায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রিসালাতের সময়কাল পেরিয়ে যাওয়ার বহু পরে এ মনীষীর আবির্ভাব ঘটে। জন্ম ও বংশগত দিক দিয়ে যার রক্তমাংস ছিল অনারবীয়। সে মনীষী সুলতান সালাহুদ্দীন কুর্দি আজমী।

ইসলামের ইতিহাসে তিনিই সালাহুদ্দীন আইয়ুবী নামে বিখ্যাত। ষষ্ঠ হিজরিতে তার আবির্ভাব। তার সম্পর্কে তারই একজন বিশ্বস্ত সহচর (সেক্রেটারি) ইবন শাদ্দাদের বক্তব্য নিন্মরূপঃ
“পক্ষান্তরে তার শাসনামলে দেশ কি উন্নতি লাভ করেনি ? তদুপরি মৃত্যুকালে রেখে যান তিনি সর্বমোট মাত্র সাতচল্লিশটি নার্সেরী রৌপ্য মুদ্রা আর একটি স্বর্ণ মুদ্রা। ওজনের দিক দিয়ে তা কতটুকু ছিল তা আমার জানা নেই। আমি তাকে একবার বায়তুল মুকাদ্দাসে বিভিন্ন প্রতিনিধি দলের মাঝখানে দেখেছিলাম। তিনি তখন দিমাশক যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেসব প্রতিনিধি দলকে দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না তার কোষাগারে। আমি তখন এ বিষয়ে তার সাথে আলোচনা করছিলাম। পরিশেষে তিনি বায়তুল মালের কিছু সামগ্রী বিক্রি করে সব প্রতিনিধি দলের মাঝে বণ্টন করে দিলেন। একটি রৌপ্য মুদ্রাও অবশিষ্ট রইলো না।
প্রাচুর্যের সময় যেভাবে তিনি প্রাণ খুলে দান করতেন, দৈন্যের সময়ও ঠিক অনুরূপ উদারচিত্তে তা অব্যাহত রাখতেন। যদ্দরুন তার কোষাধ্যাক্ষগণ অনেক সময় তার অজান্তে কিছু মাল লুকিয়ে রাখতেন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য। কারণ সুলতান যখনই কোন দ্রব্য সম্পর্কে জ্ঞাত হতেন, তখনই তা চেয়ে নিতেন। কথা প্রসঙ্গে একদিন তিনি বলেছিলেন – এমনও কিছু মানুষ আছে, যারা ধন-সম্পদকে মাটির মতো ভেবে থাকে। উক্তিটি দিয়ে যেন তিনি নিজেকেই উদ্দেশ্য করছিলেন। সর্বদাই তিনি সাহায্য প্রার্থীর আশারও ঊর্ধ্বে দান করে থাকতেন।” (৫)

এমন একজন মহান সম্রাট, যার সাম্রাজ্য সিরিয়ার উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিনে নওবা মরুভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, ইহধাম ছেড়ে চলেছেন, অথচ তার নিজের কোষাগারে দাফন-কাফনের পয়সাটুকুও ছিল না।

ইবন শাদ্দাদ বলেন –
“এরপর তাকে গোসল দেওয়া ও কাফনের প্রস্তুতি চলছিল যখন, তখন আমাদের তার ব্যবস্থা এভাবে গ্রহণ করতে হয়েছিলো যে, সাধারণ ও তুচ্ছ জিনিস পর্যন্ত ধার করে আনতে হয়েছিলো। এমনকি কবরে রাখার জন্য ঘাসের আঁটি পর্যন্ত যোগাড় করতে হয়েছিলো ধার করে। যোহরের নামাযের পর একটি সাধারণ খাটে আবৃত করে তার জানাযা আনা হলো। কাফনের কাপড় সবটুকুও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন কাযী ফাযিল।” (৬)

সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি সম্পর্কে ইউরোপীয় জীবনীকার লেনপুন (Stanely Lanepool) তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “সালাহুদ্দিন” (পৃষ্ঠা ২০৫) এ লিপিবদ্ধ করেন, “সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবির ভদ্রতা ও সুপরিসর মানসিকতার অবগতি সম্পর্কে একটি ঘটনার অবতারণই যথেষ্ট, যা ঘটেছিল বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের সময়। এ বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয় ও পুনরুদ্ধারের সময় তিনি খৃষ্টান শত্রুদের যে অতুলনীয় সদাচরণ দেখিয়েছিলেন, তা ছাড়া যদি আর কোন কিছুই তার সম্পর্কে না জানা যায়, তবুও এটুকুই এটা প্রকাশের জন্য যথেষ্ট হবে যে, তা ব্যক্তিত্ব, চারিত্রিক মহত্ত্ব, শৌর্যবীর্য ও পৌরষের শ্রেষ্ঠত্বে তার সমকক্ষ সেখানে আর কেউ ছিল না। বরং এসব ক্ষেত্রে যেন তিনি সর্বকালের মানুষের শীর্ষে অবস্থান করেছেন।”

এ মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের প্রভাব নিজ শক্তি, প্রেরণা ও সম্ভাবনাময় পরিপূর্ণতা নিয়ে প্রতিটি যুগে সক্রিয় রয়েছে। এমনকি এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে সেসব ইসলামী রাষ্ট্র থেকে সুদূরে এক প্রান্তে অবস্থিত রাষ্ট্রসমূহেও। প্রকাশ পেয়েছে সেসব নতুন নতুন সমাজ ও ব্যক্তিবর্গের মাঝেও, যারা ইসলামের প্রথম সারির মনীষীদের সাথে ভাষা, বংশ ও শিল্পগত দিক দিয়ে আদৌ সম্পৃক্ত ছিল না। তাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে এমন হয়েছিলো যে, তারা প্রথম ইসলামী দাওয়াতদাতা কিংবা আধ্যাত্মিক পীরের হাতে মুসলমান হতেন।

পরে তাদেরই বংশে কোন বাদশাহ কিংবা শাহী মর্যাদার এমন আল্লাহ-ভীরু কামিল ওয়ালীর আবির্ভাব ঘটতো, যার মধ্যে আল্লাহ-প্রীতি, তাকওয়া, ইনসাফ, সাম্য, সমবেদনা ও সহানুভূতি, দয়া-দাক্ষিণ্য, আল্লাহ’র তুষ্টি ও একনিষ্ঠতা, সততা ও সরলতার এমন প্রতীক সাব্যস্ত হতো, যা অন্য সমাজের হিবর, রাহিব, পোপ এবং পাদরীদের মধ্যেও হতো না। তাদের রাজা ও মহারাজাদের তো প্রশ্নই উঠে না।

আমি উপমহাদেশের দীর্ঘ ইসলামী ইতিহাসে এ জাতীয় সমৃদ্ধ বহু ঘটনার এমন একটি উদাহরণ পেশ করছি, যেটির অভূতপূর্ব আকর্ষণ, অকৃত্রিমতা যতদিনই অতিবাহিত হোক না কেন, যতবারই তা শোনা যাক না কেন, হ্রাস পায়নি কিঞ্চিৎও।

গুজরাটের বাদশাহ মুজাফফর হালীম (মৃত্যু ৯৩২ হিজরি) আর তার সমসাময়িক মান্ডোর শাসনকর্তা সুলতান মাহমুদ খিলজীর মাঝখানে বহুদিন যাবত রাজনৈতিক মতপার্থক্য চলছিলো। সুলতান খিলজী তার রণচাতুর্যের দরুন উপর্যুপরি আক্রমণ অব্যাহত রাখতেন। ফলে সুলতান মুজাফফর হালীমকেও প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হতো। ভাগ্যের পরিহাস, কালের পট পরিবর্তন হলো, পতন আসতে লাগলো মাহমুদের শৌর্য-বীর্যে।

পরিশেষে পরাক্রমশালী সুলতান মাহমুদকে একজন আশ্রয় প্রার্থী হিসেবে তার পুরনো ঘোর শত্রুর দ্বারে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হলো। কেননা তার ওয়াযীর মুন্ডলী রায় তার রাজ্যে জবর দখল করে বসেছে।

সুলতান মাহমুদ সাহায্য প্রার্থনার জন্য সুলতান মুজাফফর হালীমের সহানুভূতি ও সাহায্য কামনা ছাড়া ইসলামী মর্যাদাবোধের দৃষ্টিতে অন্য কোথাও তার আশ্রয়ের স্থল খুঁজে পেলো না। তাই তিনি পরিশেষে সুলতান মুজাফফরকেই স্বীয় সাহায্য-সহানুভূতি, মদদ ও সহযোগিতার যোগ্য পাত্র মনে করলেন। জাহিলী সংকীর্ণতায় আক্রান্ত কোন ব্যক্তির পক্ষে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিছুতেই সম্ভব হতো না, পারতো না কোন জড়বাদী দর্শনের অনুসারী এভাবে শত্রুকেই যথার্থ আশ্রয়স্থল বলে ভাবতে। আবার এদিকে সুলতান মুজাফফর হালীম সে সুযোগটুকুর সদ্ব্যবহারের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলেন না। একটু কটাক্ষও তিনি করলেন না প্রাণের শত্রুকে। বরং একমাত্র আল্লাহ’র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আর নাফস ও শয়তানের ভেলকী নস্যাৎ করার এটিকে একটি সুবর্ণ সুযোগ মনে করে নিলেন।

দেরী না করে সুলতান মুজাফফর এক বিরাট সেনাবাহিনী সাথে নিয়ে মান্ডোর দিকে যাত্রা করলেন। তিনি যে তার শত্রু রাষ্ট্রের (রাজনৈতিক) সমস্যাকে নিজের রাষ্ট্রের সমস্যার তুল্য ভেবেছিলেন তাই নয়, বরং তার চেয়েও অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং একটি ইসলামী রাষ্ট্রের আযাদীর সংরক্ষণ ও ইসলামের শান-শওকতের পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে নিজের রাষ্ট্রের আযাদী ও নিরাপত্তাকে জলাঞ্জলি দিতে কুণ্ঠাবোধ করলেন না। ওদিকে কাফির সেনা ও শিরক শক্তিগুলো তাদের মিত্র রাষ্ট্র মান্ডোর সাহায্যের উদ্দেশ্যে রণক্ষেত্রে একত্রিত হতে শুরু করলো। ফলে সংঘটিত হয় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সে যুদ্ধে শত শত মৃতদেহের বিরাট স্তুপ হলো। রাজপথগুলোয় প্রবাহিত হলো রক্তধারা। পরিশেষে সুলতান মুজাফফরেরই বিজয় হলো, শত্রুপক্ষ পরাজয় বরণ করলো। রাজপুত রাজাদের চিরাচরিত প্রথানুযায়ী রাজপুত ও সম্রাজ্ঞীগণ জহরব্রত পালনের প্রাচীন রীতি সমাপন করলো। অবশেষে এ রাষ্ট্র ইসলামী শাসনের আওতাভুক্ত হলো।

এখানে মানবিক ভদ্রতা ও ইসলামী আদর্শের আরো একটি উত্তম নমুনা প্রতিভাত হচ্ছে। তা হচ্ছে এই – সুলতান মুজাফফর হালীমের কিছু সামরিক উপদেষ্টা তাকে এই পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, এ মনোরম উর্বর ভূমিটি বাদশাহ যেন হাতছাড়া না করেন। কেননা, সুন্দর সুন্দর স্থাপত্য, দুর্ভেদ্য দুর্গে আর পরিপূর্ণ কোষাগারে এই দেশটির তুলনা উপমহাদেশে আর একটি নেই। যা দুর্বল ও পথভ্রষ্ট বাদশার অদূরদর্শিতার কারণে জীর্ণ হয়ে আসছিলো। তাদের যৌক্তিকতা ছিল এই যে, বাদশাহ যেহেতু এই মান্ডোকে নব অভিযানের মাধ্যমে জয় করলেন, সুতরাং তিনি-ই এই বিজিত রাষ্ট্রের অধিকারী। বলাবাহুল্য, রাষ্ট্র তো শক্তি ও বিজয়েরই ফসল। আর বিজিত দেশকে সাধারনত বিজেতারই হক ও অধিকার ভাবা হয়।

সুলতান মুজাফফর হালীম সেনানায়কদের এ অভিপ্রায় সম্পর্কে অবহিত হলে সাথে সাথে তিনি সুলতান মাহমুদকে নির্দেশ দিলেন যে, তার সৈনিকদের কাউকে যেন নগরীতে প্রবেশ করতে না দেওয়া হয়। সুলতান মাহমুদ কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বাদশাহ মুজাফফরকে মাত্র কিছুক্ষণ সময় দুর্গে অবস্থান করে বিশ্রাম নেওয়া আর গোসল ইত্যাদি করার জন্য আহবান জানালে সুলতান মুজাফফর শুকরিয়ার সাথে তাও প্রত্যাখ্যান করলেন। তার সৈনিকদেরকে আহমদাবাদ আর নিজ নিজ ঠিকানায় প্রত্যাবর্তনের জন্য হুকুম দিলেন। আর সুলতান মাহমুদকে বললেন, আমি এই দেশে এসেছি একমাত্র আল্লাহ’র সন্তুষ্টি অর্জনের নিমত্ত, তার সওয়াবের আশায় আর তার হুকুম পালন করার উদ্দেশ্যে।

“….. তারা যদি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সহায়তা কামনা করে, তবে তোমাদের জন্য অপরিহার্য হবে তাদের সাহায্য করা …..” (সূরাহ আল-আনফাল, ৮ : ৭২)

“একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানের ভাই। এক ভাই অপর ভাইকে শত্রুর কাছে সোপর্দ করতে পারে না আর অপমানিত করতেও পারে না।” (হাদিস)

উপরোক্ত উক্তি দুটো পেশ করে সুলতান মুজাফফর বললেন, এখন আমার নিয়ত পুরা হয়েছে। আল্লাহ পাক আমাকে, আপনাকে আর ইসলামকে সফল করেছেন। আমি আমার সঙ্গী-সাথীদের থেকে এমন কিছু উক্তি ও যুক্তি পেয়েছি, যেগুলোয় আমি কান দিলে আমার সব আমল বিনষ্ট হতো, জিহাদ বরবাদ হতো। মূলত এ ব্যাপারে আমার কোন অবদান নেই। অবদান তো সবটুকু আপনার। আমাকে এ শুভ কাজের সুবর্ণ সুযোগ প্রদান করেছেন তো আপনি। আপনি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। এখন আমি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে ইচ্ছা করেছি। আমি আমার আমলকে মূল্যহীন করতে চাইনি। ভালোর সাথে মন্দের ভেজাল দিতে আমি রাযী নই।
বাদশার এ ভাবগম্ভীর বক্তব্য শুনে তার বিজয়ী সেনাদল আনন্দ হিল্লোলে মেতে উঠলো। আহমদাবাদের দিকে ইচ্ছার বলগাকে ফিরিয়ে দিলেন নিপুণ অশ্বারোহীগণ। একটি স্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলে গেলেন তারা নিজ দেশে।

সুলতান মুজাফফর মান্ডো বিজয়ের সময় যখন বিজয়ীর বেশে সসম্ভ্রমে নগরীর দিকে প্রবেশ করছিলেন, তখন সুলতান মাহমুদ তার মনোরঞ্জনের জন্য তাকে ধনাগার ও প্রাচুর্যগুলো পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে সঙ্গে নিয়ে নিলেন। মান্ডোর প্রতিটি জিনিস ছিল নেহায়েত চিত্তাকর্ষক ও বৈচিত্র্যময়। নগরীটি এক দীর্ঘকাল ব্যাপী সৌন্দর্য, সজীবতা, সম্পদ ও স্থপতি, রূপসী দাসী ও মহিলাদের মীনা বাজারের খ্যাতি লাভ করে আসছিলো। অথচ সুলতান মুজাফফর মাথা নিচু করে সেসব থেকে দৃষ্টি এড়িয়ে পথ অতিক্রম করে আসছিলেন। বিজয়ী নেতার অভিনন্দন জ্ঞাপনার্থে হাসিমুখে প্রতীক্ষারত দাস-দাসী ও সেচ্ছাসেবী ছাউনি অতিক্রমকালে সুলতান মাহমুদ তার লাজুক ও সংকুচিত সহযাত্রী সুলতান মুজাফফরকে নিবেদন জানালেন – জনাবে আলী, ব্যাপার কি ? আপনি যে মাথা উঠাচ্ছেন না আর এমন নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলো একটু লক্ষ্যও করছেন না ?

সুলতান মুজাফফর বললেন – আমার জন্য তা জায়েয না। আল্লাহ পাক বলেছেন –
“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে …….”(সূরাহ আন-নূর, ২৪ : ৩০)

সুলতান মাহমুদ বললেন – এরা তো আমারই দাসী, এদিকে আমি আপনার এমন একজন গোলাম, যাকে আপনার অফুরন্ত করুনা আজীবনের জন্য কিনে নিয়েছে। তাই এরা নীতিগতভাবেই আপনার দাস-দাসী।
কিন্তু সুলতান মুজাফফরকে এ যুক্তি স্বস্তি যোগাতে ব্যর্থ হয়। তার নিশ্চিত প্রত্যয় এই ছিল যে, আল্লাহ পাক যা হারাম করেছেন, তা অন্য কেউ হালাল করার নেই। (৭)

এভাবে আল্লাহ-প্রেমিক মুত্তাকী বাদশাহ তার ভদ্রতা, অন্তরের পবিত্রতা, ইসলামের প্রতি মজবুত আকর্ষণ আর ইসলামী চরিত্রের বুলন্দ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এগুলো কৃত্রিম ছিল না। বরং এগুলোতেই তার প্রকৃতি গড়ে উঠেছিলো। নিক্তিতেই গড়া ছিল তার দৈনন্দিন জীবন প্রণালী। অথচ একজন আদর্শের দিশারী বাদশার বংশধারা দুই তিন পুরুষ পূর্বে গিয়ে অমুসলিম হিন্দু বংশের পেশাধারী নর্তকীদের সাথে মিশে যায়। এমন একটি বংশের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি যখন ইসলামের সম্মানে বিভূষিত হলেন, এক বিরাট সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনে সফল হয়ে গেলেন। ইতিহাসবেত্তাগণ তার পিতামহের উপরে গিয়ে ইসলামী নাম আর খুঁজে পাচ্ছেন না। ফিরোজশাহ তুগলকের শাসনকালে তারা অষ্টম হিজরীতে ইসলাম কবুল করেছিলেন। তাই এর পূর্বে গিয়ে ইসলামী নাম না এসে ভারতীয় নাম আসতে থাকে। তাই তাদের ইসলামী বংশের ধারাবাহিক পরিচিতি শত তল্লাশী চালিয়েও মিলেনি।

এ অতুলনীয় ভদ্রতা ও আল্লাহ-ভীতি তিনি পেলেন একমাত্র মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদর্শের শিক্ষানিকেতন থেকেই। তিনি সে শিক্ষানিকেতনের একজন একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন মাত্র। তিনি ইসলামের নিয়ামত এবং মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইহসান ও অবদানকে পুঙ্খানুপুঙ্খ সদ্ব্যবহার করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। দ্বীনের সাথে তার সম্পৃক্তি নিতান্তই আন্তরিক ও শ্রদ্ধাপূর্ণ ছিল।

যে শাশ্বত ও মুবারক শিক্ষা নিকেতনের কৃতিত্ব সার্বজনীন ও সর্বকালীন
এ সুষমামণ্ডিত ও নয়নাভিরাম শিক্ষা পাদপীঠ থেকে যে কতো কৃতী সন্তান সারা বিশ্বে কারণে আওয়াল সাহাবা যুগ, তাবেয়ীনদের যুগ আর পরবর্তী যুগসমূহে বের হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সেসব খ্যাতিমান সন্তানদের কতোই না কৃতিত্ব, বিজয় সম্মান ও শ্রদ্ধাঞ্জলী বসুন্ধরার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে।

এ পাদপীঠের প্রশিক্ষণ ও এর প্রতিষ্ঠার প্রভাব কখনো প্রতিফলিত হয়েছে মহাবীর তারেকের দুঃসাহসিকতায়, মুহাম্মাদ ইবন কাসিমের অসীম বীরত্বে এবং মুসা ইবন নাসীরের আজেয় মনোবলে। আবার কখনো তা প্রতিফলিত হয়েছে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম শাফেঈ’র মেধা ও তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তিতে। কখনো তা ধরা দিয়েছে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল, ইমাম মালিকের দৃঢ়তা ও অটলতার আকৃতিতে। আবার কখনো এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নুরুদ্দীন যঙ্গী’র দয়া-দাক্ষিণ্যের ধরণ নিয়ে। আবার কখনো সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি’র অধ্যবসায় ও সাধনার রঙে রঞ্জিত হয়ে তা প্রদর্শিত হয়েছে। ইমাম গাযযালির দর্শনের বেশে সামনে এসেছে কখনো, আবদুল কাদির জিলানির সংস্কার ও আধ্যাত্মিকতার রক্তে রঞ্জিত হয়ে এসেছে কখনো।

মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষা নিকেতনের সে প্রভাব ইবন জাওযীর মাধ্যমে কখনো বিকশিত হয়েছে, আবার কখনো তা মুহাম্মাদ ফাতিহের তরবারী সেজেছে। সুলতান মাহমুদ গযনভীর রণস্পৃহা নিয়ে কখনো চমকিত হয়েছে, কখনো নিজামুদ্দীন আউলিয়ার করুনা ও বিনয়রূপে তা প্রমাণিত হয়েছে। একবার রূপ ধারণ করেছে ফিরোয শাহ খিলজীর উচ্চ মানসিকতায় ভূষিত হয়ে আবার তা ইমাম তাইমিয়ার সুগভীর ইলমী প্রজ্ঞার ধাঁচে ধরা দিয়েছে। সামনে এসেছে তা কখনো শেরশাহ সূরীর দূরদৃষ্টির বেশে, কখনো সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের লৌহ মনোবলের বেশে।

এ মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষাগারেও তার প্রতিষ্ঠাতার প্রেরণা প্রতিফলিত হয়েছে কোন কোন সময় শরফুদ্দীন ইয়াহয়া মুনীরার মারিফাত ও দর্শনে, কখনো মুজাদ্দিদে আলফেসানীর তীর্যক লেখনী ও অভিযানে। আবার তা কোন কোন সময় প্রস্ফুটিত হয়েছে আবদুল ওয়াহহাব নাজদীর দাওয়াতের কলিতে। কখনো শাহ ওয়ালী উল্লাহর দর্শনরূপে প্রকাশিত হয়েছে, আবার কখনো উত্তরসূরি দাওয়াতদাতা উলামায়ে রাব্বানীয়ীনদের অনুপম খিদমতের চমক নিয়ে বিকশিত হয়েছে।

এসব খ্যাতিমান মনীষীর ইলমী ও আমলী খিদমতের সূত্রধারা সেই মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষাগারের প্রশিক্ষণের সাথে জুড়ে রয়েছে, যা ছিল এ ধারার প্রাথমিক স্বর্ণযুগ। আর এটিই ছিল সে যুগ, যে যুগে মানবতার সর্বোৎকৃষ্ট সম্ভাবনাগুলো উৎসরিত হচ্ছিলো। আর তা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের মাধ্যমেই সূচিত হয়। সে যুগেই ওসব যোগ্যতার সদ্ব্যবহার করার মতো যোগ্য পাত্র পরিদৃষ্ট হচ্ছিলো।

মুহাম্মাদি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ শিক্ষানিকেতন কালের শত অবজ্ঞা এবং জনগণের জানাবিধ অনীহা সত্ত্বেও ইতিহাসে কতো নজীরবিহীন ব্যক্তিবর্গকে সৃষ্টি করে আসছে আল্লাহ’র মহিমায় নিজ ফসল ও _ দ্বারা তারা মানবতার শুন্য কোটাটিকে পরিপূর্ণ করে আসছে। এ অনুপম শিক্ষাগারটি সেসকল একনিষ্ঠ নেতৃবর্গ আর রাব্বানী আলিমকুলের বদৌলতে অব্যাহত রেখেছে মানবতা ও ন্যায়পরায়ণতা অনুসন্ধানের পথটুকু। যারা কুরআনের ভাষায় বিঘোষিত হয়েছে –

“…… ঈমানদারদের সামনে তারা নিতান্তই বিনয়ী, কাফিরদের বেলায় বজ্রকঠোর; আল্লাহ’র পথে জিহাদ করে, অথচ তারা বিদ্রুপকারীদের কিঞ্চিৎও পরোয়া করে না ……” (সূরাহ আল-মাইদাহ, ৫ : ৫৪)
এদিকে এ গায়েবী আওয়াজে প্রতিনিয়ত শ্রুত হচ্ছে –

“…… আর যদি এ কুরআনের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে, তাহলে আমি এর জন্য এমন এক সমাজকে নির্ধারণ করবো, যারা তা অস্বীকার করবে না।” (সূরাহ আল আনআম, ৬ : ৮৯)


©???? The Greatest Nation

অহংকার পতনের মূল….

অহংকার পতনের মূল..
___________
বিনয় যেমন মাটির মানুষকে আকাশের উচ্চতায় উঠিয়ে নেয়, ঠিক এর বিপরীতে যশ-খ্যাতি, সম্মান, অর্থসম্পদ, প্রভাবপ্রতিপত্তি, বিদ্যাবুদ্ধি ইত্যাদি যে কোনো ক্ষেত্রে কেউ যখন সফলতার চূড়া স্পর্শ করে অহংকার করতে থাকে তখন তা তাকে নিক্ষেপ করে আকাশের উচ্চতা থেকে সাত জমিনের নিচে।

এক আরবী গল্পে অহংকারের উপমা খুব চমৎকার ফুটে উঠেছে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কেউ যখন নিচে তাকায়, তখন সবকিছুই তার কাছে ছোট ছোট মনে হয়। নিজের দুই চোখ দিয়ে হাজারো মানুষকে সে ছোট করে দেখে। আবার যারা নিচে আছে তারাও তাকে ছোটই দেখে। তবে দুই চোখের পরিবর্তে এক হাজার মানুষের দুই হাজার চোখ তাকে ছোট করে দেখছে। অর্থাৎ অহংকার করে একজন যখন সবাইকে তুচ্ছ মনে করে তখন এ অহংকারীকেও অন্য সবাই তুচ্ছ মনে করে।


এই অহংকার হচ্ছে সকল পাপের মূল। একে আরবীতে বলা হয় ‘উম্মুল আমরায-সকল রোগের জননী’। বরং বলা যায়, এ জগতের প্রথম পাপই হচ্ছে অহংকার।

সৃষ্টিজগতের প্রথম মানব আমাদের পিতা আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের আদেশ করেছিলেন-তোমরা আদমকে সিজদা কর। এই আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার পূর্বে আল্লাহ তাআলা যখন ফেরেশতাদেরকে তাঁর মানব-সৃষ্টির ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন তখন তারা বলেছিল-আপনি আমাদেরকে রেখে এমন কোনো জাতি সৃষ্টি করবেন, যারা নৈরাজ্য ঘটাবে, একে অন্যের রক্ত ঝরাবে, অথচ আমরা তো আপনার সার্বক্ষণিক ইবাদতে মগ্ন! মনে মনে তারা এও ভেবেছিল-আল্লাহ তাআলা কিছুতেই এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন না, যে আমাদের চেয়ে বেশি জানে এবং তাঁর নিকট আমাদের তুলনায় অধিক সম্মানিত হবে।

এসবের পরও ফেরেশতাদেরকে যখন আল্লাহ বললেন, তোমরা আদমকে সিজদা কর, সকলেই সিজদায় লুটিয়ে পড়ল। এই তো ফেরেশতাদের পরিচয়-তাদেরকে যা আদেশ করা হয় তারা তা-ই করে। কিন্তু ফেরেশতাদের মাঝে বেড়ে ওঠা শয়তান মাটি আর আগুনের যুক্তি হাজির করল। সে আগুনের তৈরি বলে মাটির তৈরি মানুষকে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানাল। আল-কুরআনের ভাষায়, “সে অস্বীকৃতি জানাল এবং অহংকার করল। আর সে ছিল কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরাহ বাকারা, আয়াত : ৩৪)
.
এই হল প্রথম অহংকারের ইতিহাস। কুরআনে কারীমে বর্ণিত প্রথম পাপের বিবরণ। এ পাপের দরুণ শয়তান অভিশপ্ত হল, জান্নাত থেকে বিতাড়িত হল, মানুষের শত্রুতার ঘোষণা দিয়ে পৃথিবীতে এল। কত শক্ত শপথ সেদিন সে করেছিল, “সে বলল, আপনি যেহেতু আমাকে পথচ্যুত করেছেন তাই আমি অবশ্যই তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকব। এরপর আমি অবশ্যই তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, তাদের পেছন থেকে, তাদের ডান দিক থেকে এবং তাদের বাম দিক থেকে। আর আপনি তাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ পাবেন না।” (সূরা আ‘রাফ, আয়াত : ১৬-১৭)
.
এই যে শয়তানের শপথ এবং এ শপথের শক্তিতে সে বিভ্রান্ত ও পথহারা করে যাচ্ছে বনী আদমকে, এর মূলে তো সেই অহংকার। অহংকার তাই বিবেচিত হয় সবচেয়ে ভয়ংকর আত্মিক রোগ হিসেবে।
.
বর্তমান সময়ের একটি ভয়ংকর রোগ হচ্ছে ক্যান্সার। এ রোগ কিছুদিন মানুষের শরীরে লুকিয়ে থেকে একসময় প্রকাশ পায়। রোগ প্রকাশ পাওয়া, রোগীর শরীরে বিভিন্ন আলামত ফুটে ওঠাও এক প্রকার নিআমত। কারণ এর মাধ্যমেই রোগীর চিকিৎসার পথ উন্মোচিত হয়। কিন্তু অহংকার রোগটি এমন, মানুষ মনেই করে না-তার মধ্যে অহংকার আছে। রোগের অনুভূতিই যখন না থাকে তখন এর চিকিৎসার কথা ভাববে কে?
.
অহংকার কী-এ প্রশ্নের সরল উত্তর হচ্ছে, কোনো বিষয়ে নিজেকে বড় মনে করে অন্য মানুষকে তুচ্ছ মনে করার নামই অহংকার। শক্তিতে, সামর্থ্য,বয়সে, অভিজ্ঞতায় ত্রিশ বছরের যুবক যতটা সমৃদ্ধ, বার বছরের একটি ছেলে তো সবক্ষেত্রেই তার তুলনায় হবে রিক্তহস্ত। তার ছোট হওয়া এবং তাকে ছোট মনে করা এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা। বাস্তবেই যে ছোট তাকে ছোট মনে করা অহংকার নয়। বরং অহংকার হচ্ছে, সে ছোট বলে তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। কাড়ি কাড়ি টাকা যার ব্যাংক একাউন্টে সঞ্চিত, সে তো যে দিন এনে দিন খায় তাকে অর্থবিত্তে ছোট মনে করতেই পারে। এটা অহংকার নয়। অহংকার হচ্ছে তাকে তাচ্ছিল্য করা, গরীব বলে তাকে হেয় করা।
.
এ অহংকার একটি ঘাতক ব্যাধি। পবিত্র কুরআনে নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে এই ঘাতক ব্যাধির কথা। ঘাতক ব্যাধি বললাম, কারণ তা মানুষের অন্তর্জগৎকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। আর এর পরকালীন ক্ষতি তো রয়েছেই। যে অহংকার শয়তানকে ‘শয়তানে’ পরিণত করেছে, অভিশপ্ত করে দিয়েছে, রহমতবঞ্চিত করেছে, সে অহংকারের মন্দ দিক সম্পর্কে আর কিছু না বললেও চলে।

এরপরও আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার প্রকাশ করে তাদেরকে অবশ্যই আমি আমার নিদর্শনাবলি থেকে বিমুখ করে রাখব।” (সূরা আ‘রাফ, আয়াত : ১৪৬)

“তোমাদের মাবুদ এক মাবুদ। সুতরাং যারা আখেরাতে ঈমান রাখে না তাদের অন্তরে অবিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেছে এবং তারা অহংকারে লিপ্ত। স্পষ্ট কথা, তারা যা গোপনে করে তা আল্লাহ জানেন এবং যা প্রকাশ্যে করে তাও। নিশ্চয়ই তিনি অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” (সূরাহ নাহল, আয়াত : ২২-২৩)

উদ্ধৃত আয়াতগুলো থেকে আমরা মোটা দাগের যে শিক্ষা পাই তা এমন-

● অহংকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ তাঁর নিদর্শন থেকে বিমুখ করে রাখেন। তার অন্তর ও চোখকে তিনি সত্য অনুধাবন এবং সঠিক পথ অবলম্বন থেকে ‘অন্ধ’ করে দেন। পবিত্র কুরআনের কত জায়গায় আল্লাহ জ্ঞানীদের বলেছেন তার নির্দশনাবলি নিয়ে চিন্তা করার কথা।

এ চিন্তা মানুষের সামনে আল্লাহ পাকের বড়ত্ব কুদরত এবং আমাদের ওপর তাঁর সীমাহীন অনুগ্রহ ফুটিয়ে তোলে। তখন স্বাভাবিকভাবেই মহান প্রভুর কাছে সে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে সঁপে দিতে প্রস্তুত হয়ে ওঠে; কৃতজ্ঞতায় সিজদাবনত হয়। তাই আল্লাহ যদি কাউকে তাঁর ওসব নিদর্শন থেকে বিমুখ করে রাখেন তাহলে সে যে দ্বীনের মূল ও সরল পথ থেকেও ছিটকে যাবে তা তো বলাবাহুল্য।

● আল্লাহ তাআলার প্রতি যার বিশ্বাস নেই, পরকালে বিশ্বাস নেই, অহংকার তো কেবল তারাই করতে পারে।

● অহংকারীকে আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন না। কী ইহকাল আর কী পরকাল, একজন মানুষের অশান্তি, লাঞ্ছনা আর সমূহ বঞ্চনার জন্যে এর পরে কি আর কিছু লাগে? ‘আল্লাহ সর্বশক্তিমান’ এ বিশ্বাস যাদের আছে তাদেরকে এ কথা মানতেই হবে-প্রকৃত সম্মান পেতে হলে আল্লাহ তাআলার প্রিয়ভাজন হতেই হবে।

আলোর দিশারী আমাদের প্রিয় নবী ﷺ। মানবজীবনের কোন্ দিকটি এমন, যেখানে তাঁর কোনো নির্দেশনা পাওয়া যাবে না! অহংকারের ভয়াবহতা তিনি অনেক হাদীসেই স্পষ্ট করে বলেছেন। বিভিন্ন শব্দে বলেছেন; বিভিন্ন প্রসঙ্গে বলেছেন। একটি হাদীস লক্ষ করুন-রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “তিল পরিমাণ অহংকার যার অন্তরে আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না, আর তিল পরিমাণ ঈমান যার অন্তরে আছে সে দোজখে যাবে না।” -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৯৮

এখানেও দুটি বিষয় লক্ষণীয়ঃ

● অহংকারী ব্যক্তি জান্নাতে যেতে পারবে না। জান্নাতে যেতে হলে আল্লাহ তাআলার কাছে উপস্থিত হতে হবে অহংকারমুক্ত ‘কলবে সালীম’ নিয়ে।

● এই হাদীসে জান্নাতের বিপরীতে দোজখের কথা যেমন বলা হয়েছে, এর পাশাপাশি ঈমানের বিপরীতে উল্লেখিত হয়েছে অহংকারের কথা। অথচ ঈমানের বিপরীত তো কুফ্র। বোঝাই যাচ্ছে, হাদীসে কত ভয়াবহরূপে অহংকারকে চিত্রিত করা হয়েছে-বিন্দু পরিমাণ অহংকার নিয়েও কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না!

অহংকার যে মানুষকে কতটা অন্ধ ও বাস্তবতাবিমুখ করে তোলে-সেই দৃষ্টান্তও রয়েছে পাক কুরআনে। মানুষ হিসেবে যে যত পাপ করেছে, ফেরাউন ও নমরুদের সঙ্গে কি কারও কোনো তুলনা চলে! তারা যে অবাধ্যতার সব রকম সীমা লঙ্ঘন করেছিল এর মূলেও এই অহংকার।

অহংকারের ফলে যখন নিজেকে বড় আর অন্যদের তুচ্ছ ভাবতে শুরু করল, এরই এক পর্যায়ে নিজেকে ‘খোদা’ দাবি করে বসল! আল্লাহ তাআলার সঙ্গে যখন কেউ কোনো কিছুকে শরীক করে, হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী সেটা সবচেয়ে বড় কবিরা গোনাহ। কুরআনে বলা হচ্ছে-এ শিরকের গোনাহ আল্লাহ ক্ষমা করবেন না! এ তো অন্যকে আল্লাহর সঙ্গে শরীক করলে। তাহলে কেউ যদি নিজেকেই খোদা বলে দাবি করে, সে অপরাধ কতটা জঘন্য-তা কি বলে বোঝানো যাবে?

মক্কার মুশরিকরা যে রাসূলুল্লাহ ﷺ কে নবী হিসেবে মানতে পারেনি-এর মূলেও তো একই অহংকার। বরং এই অহংকারের কারণেই পূববর্তী নবীগণকেও অস্বীকার করেছিল তাদের স্ব স্ব গোত্রের বিত্তবান লোকেরা। মক্কার মুশরিকদের কথা পবিত্র কুরআনে এভাবে আলোচিত হয়েছে, “তারা বলে, এই কুরআন কেন দুই এলাকার কোনো মহান ব্যক্তির ওপর অবতীর্ণ হল না!” (সূরা যুখরুফ, আয়াত : ৩১)

অহংকার থেকে মুক্ত থাকতে হলে কী করতে হবে-সে পথও বাতলে দিয়েছে আমাদের পবিত্র কুরআন। সে পথ শোকর ও কৃতজ্ঞতার পথ। বান্দা যখন শোকর আদায় করবে, কৃতজ্ঞতায় সিজদাবনত হবে, সবকিছুকেই আল্লাহর নিআমত বলে মনে-প্রাণে স্বীকার করবে তখন তার কাছে অহংকার আসবে কোত্থেকে? শোকর করার অর্থই তো হল-আমার যা প্রাপ্তি, সবই আল্লাহর নিআমত ও অনুগ্রহ। এখানে আমার কোনোই কৃতিত্ব নেই। এ ভাবনা যার মনে সদা জাগরুক থাকে, অহংকার তার মনে বাসা বাঁধতে পারে না।

সূরা কাহ্ফে দুই ব্যক্তির উপমা দেয়া হয়েছে এভাবে-(তরজমা) তুমি তাদের সামনে দুই ব্যক্তির উপমা পেশ কর, যাদের একজনকে আমি আঙ্গুরের দুটি বাগান দিয়েছিলাম এবং সে দুটিকে খেজুর গাছ দ্বারা ঘেরাও করে দিয়েছিলাম আর বাগান দুটির মাঝখানকে শস্যক্ষেত্র বানিয়েছিলাম। উভয় বাগান পরিপূর্ণ ফল দান করত এবং কোনোটিই ফলদানে কোনো ত্রুটি করত না।

আমি বাগান দুটির মাঝখানে একটি নহর প্রবাহিত করেছিলাম। সেই ব্যক্তির প্রচুর ধনসম্পদ অর্জিত হল। অতঃপর সে কথাচ্ছলে তার সঙ্গীকে বলল : আমার অর্থসম্পদও তোমার চেয়ে বেশি এবং আমার দলবলও তোমার চেয়ে শক্তিশালী। নিজ সত্তার প্রতি সে জুলুম করেছিল আর এ অবস্থায় সে তার বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল, আমি মনে করি না-এ বাগান কখনো ধ্বংস হবে। আমার ধারণা, কিয়ামত কখনোই হবে না। আর আমাকে আমার প্রতিপালকের কাছে যদি ফিরিয়ে নেয়া হয় তবে আমি নিশ্চিত, আমি এর চেয়েও উৎকৃষ্ট স্থান পাব।

তার সঙ্গী কথাচ্ছলে তাকে বলল-‘তুমি কি সেই সত্তার সঙ্গে কুফরি আচরণ করছ, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, তারপর শুক্র থেকে এবং তারপর তোমাকে একজন সুস্থসবল মানুষে পরিণত করেছেন? আমার ব্যাপার তো এই যে, আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহই আমার প্রভু এবং আমি আমার প্রভুর সঙ্গে কাউকে শরিক মানি না। তুমি যখন নিজ বাগানে প্রবেশ করছিলে, তখন তুমি কেন বললে না-মা-শা-আল্লাহ, লা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ (আল্লাহ যা চান তা-ই হয়, আল্লাহর তৌফিক ছাড়া কারও কোনো ক্ষমতা নেই)! …’ (সূরাহ কাহফ, আয়াত : ৩২-৩৯)

এই তো শোকর ও কৃতজ্ঞতার তালিম-তুমি তোমার বাগান দেখে কেন বললে না, ‘আল্লাহ যা চান তা-ই হয়’!

মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ রাহ. ছিলেন বিখ্যাত এক বুযুর্গ। মুহাল্লাব নামক এক লোক তার পাশ দিয়ে রেশমি কাপড় পরে দম্ভভরে হেঁটে যাচ্ছিল। বুযুর্গ তাকে বললেন : এভাবে হাঁটছ কেন? সে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়-আপনি জানেন, আমি কে? মুতাররিফ রাহ. উত্তরে যা বলেছিলেন তা প্রতিটি মানুষের মনে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত।

তিনি বলেছিলেন, “তোমার সূচনা পুঁতিগন্ধময় বীর্যে, সমাপ্তি গলিত লাশে আর এ দুয়ের মাঝে তুমি এক বিষ্ঠাবাহী দেহ।” (তাফসীরে কুরতুবী, সূরা মাআরিজের ৩৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)

এ সত্য অস্বীকার করবে কে! এই তো আমাদের হাকীকত। তাই অহংকারের সুযোগ কোথায়? আপনি কাড়ি কাড়ি অর্থের মালিক? কী নিশ্চয়তা আছে যে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা আপনার হাতে থাকবে? আজ যিনি ক্ষমতার কুরসিতে আসীন, যার দাপটে পুরো এলাকা কম্পমান, এই ক্ষমতা ও দাপটের স্থায়িত্বের গ্যারান্টি দেবে কে? ‘সকাল বেলার ধনীরে তুই ফকির সন্ধ্যা বেলা’-এ তো আমাদের চারপাশের দেখা বাস্তবতা। যাকে তুচ্ছ করছেন, হেয় মনে করছেন, ভবিষ্যত যে আপনাকে তার অধীন করে দেবে না-এর কী বিশ্বাস?

চলমান উদাহরণ দিই-আমাদের প্রতিবেশী দেশ বিশাল ভারতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতার অধিকারী যিনি, নরেন্দ্র মোদি, তিনি তো ছেলেবেলায় ফেরি করে চা বিক্রি করতেন। আর ওখানকার নতুন প্রেসিডেন্ট হলেন সংখ্যালঘু দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। বর্ণবাদ যেখানে চরমে, সেই আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের ওপর দাপটের সঙ্গে টানা আট বছর শাসন চালিয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ ওবামা। এ-ই যখন দুনিয়ার বাস্তবতা, তাহলে অহংকার কীসে?

আর যদি পরকালের প্রসঙ্গে বলি, সেখানেও একই কথা। আপনি অনেক বড় আবেদ, চারদিকে আপনার সুখ্যাতি, অনেক ইলমের অধিকারী আপনি, সবাই আপনাকে আল্লামা বলে, কিংবা দুহাত ভরে আপনি দান-সদকা করেন, চারদিকে ‘হাতেম তাঈ’ বলে আপনি পরিচিত, অথবা দ্বীন ইসলামের একনিষ্ঠ খাদেম হিসেবে আপনি সুপরিচিত, তাই বলে কি অহংকারের সুযোগ আছে? বাস্তবেই যে আপনার চেয়ে দুর্বল, ইবাদত-বন্দেগিতে, ইলমে-আমলে সর্বক্ষেত্রে, তাকে কোনোরূপ তাচ্ছিল্য করার সুযোগ আছে? না, নেই। আমাদের মনে রাখতেই হবে, পরিমাণ আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় নয়, তিনি দেখবেন ‘মান’।

কুরআনের ভাষায়, “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সে-ই, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মুত্তাকী।” (সূরাহ হুজুরাত, আয়াত : ১৩)

তাই বাহ্যত যে দুর্বল, কে জানে-তাকওয়ার শক্তিতে আল্লাহ তাআলার দৃষ্টিতে সে সবল হয়ে উঠেছে কিনা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “কত এলোকেশী এমন, যাকে দরজায় দরজায় তাড়িয়ে দেয়া হয়, অথচ সে যদি আল্লাহর নামে কোনো কসম করে বসে, আল্লাহ তা পূর্ণ করে দেন!” (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬২২)
▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂

লেখাঃ শিব্বীর আহমদ (আল্লাহ্‌ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!)

একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে, শায়খ আতিক উল্লাহ্‌

মানুষের জন্য প্রয়োজন আদর্শ ও নমুনা। আল্লাহ তাআলা মানুষের স্বভাবের মাঝে একটি শূন্যতা যেমন রেখেছেন তেমনি রেখেছেন পূর্ণতার একটি উপকরণ। শূন্যতাটি হচ্ছে, কোনো নমুনা ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। আর পূর্ণতার উপকরণটি হচ্ছে অনুকরণের যোগ্যতা। স্বভাবগতভাবেই মানুষ অনুকরণপ্রিয়। অনুকরণের তার প্রয়োজনও আছে। স্বভাবের এই চাহিদা ও প্রয়োজনটি তখনই যথার্থরূপে পূরণ হয় যখন মানুষ জীবন ও কর্মের একটি উত্তম নমুনা খুঁজে পায় এবং তার অনুকরণ ও অনুসরণের তাওফীক-প্রাপ্ত হয়।

আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য সেই নমুনা বানিয়েছেন শেষ নবী, শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। তাঁর জীবন ও কর্ম, শিক্ষা ও আদর্শ মানবজাতির জন্য আসমানী নমুনা, যার অনুসরণ-অনুকরণের মধ্যেই মানুষের দো’জাহানের মুক্তি ও সাফল্য।

আল্লাহ তাআলা মানবজাতির হেদায়েতের জন্য যেমন আলকুরআনুল কারীম নাযিল করেছেন তেমনি কুরআনের শিক্ষা ও বিধানের বাস্তব রূপ হিসেবে দান করেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও উসওয়া। কুরআন মাজীদের শিক্ষা ও বিধানকে যখন সুন্নাহ ও উসওয়ার আলোকে জানা হবে ও মানা হবে তখন সেটাই হবে আল্লাহ তাআলার যথার্থ ফরমাবরদারী। এ ফরমাবরদারীর মাধ্যমেই মানুষের জীবন হয়ে উঠতে পারে সফল ও সুন্দর, নির্মল ও জ্যোতির্ময়।

জীবনের কোনো ক্ষেত্রই এই অন্বেষণ-অনুসরণের গণ্ডির বাইরে নয়। আমাদের চেতনা-বিশ্বাস, জীবন-দর্শন, জীবন বোধ, উৎসব-উপাসনা, পারস্পরিক সম্পর্ক, বিয়ে-শাদী, লেনদেন, নীতি-নৈতিকতা, আইন-বিচার, সবকিছুই এই অন্বেষণ-অনুসরণের গণ্ডির ভিতরে।

একটি সুন্নাহকে বাঁচাব বলে সিরিজের সকল পর্ব

পর্ব ০১ – তাহলীলের সুন্নাহ
পর্ব ০২ –অন্যকে আহার করানো
পর্ব ০৩ – আযানের পাঁচ সুন্নাহ
পর্ব ০৪ – ইলম তলব করা
পর্ব ০৫ – মিলিয়ে দেয়া
পর্ব ০৬ – দ্রুত ইফতার করা
পর্ব ০৭ – প্রভাতী যিকির !
পর্ব ০৮ – খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ
================
লেখক – শাইখ মুহাম্মদ আতিক উল্লাহ্‌
শিক্ষক – মাদরাসাতুল কুরআনিল কারীম,
শ্যামলী,ঢাকা।

মৃতদেরকে কেন্দ্র করে যে খানা খাওয়ানো হয় তা অন্তরকে মৃত বানিয়ে দেয়

এটা হাদীস নয় : طعام الميت يميت القلوب
অর্থাৎ মৃতদেরকে কেন্দ্র করে যে খানা খাওয়ানো হয় তা অন্তরকে মৃত বানিয়ে দেয়।’ এটা একটা উক্তি, যার অর্থ হচ্ছে, মৃতদের ঈসালে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে খতমে কুরআন বা খতমে তাহলীল করা হয় এবং উপস্থিত লোকদের জন্য খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয় যেহেতু ঈসালে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে কোনো আমল করে তার বিনিময়ে খানা খাওয়া বা খাওয়ানো জায়েয নয় এজন্য এই খাবারের দিকে আগ্রহ লোভ-লালসার পরিচায়ক, যা অন্তরকে প্রাণহীন করে দিতে পারে।

একই কথা কারো মৃত্যুর সময় জিয়াফতের খাবার প্রসঙ্গেও। জিয়াফত আনন্দের সময় করা হয়ে থাকে, দুঃখ-মুসীবতের সময় নয়। এই সময় জিয়াফতের কোনো বৈধতা শরীয়তে নেই। এজন্য এ ধরনের খানা নূরহীন ও বরকতহীন হয়ে থাকে। বলাবাহুল্য, এ ধরনের খাবার অন্তরকে ক্লেদাক্ত করা খুবই স্বাভাবিক। এজন্য বুযুর্গরা বলেছেন, মৃতের খাবার অন্তরকে মৃত বানিয়ে দেয়। এটা বুযুর্গদের উক্তি, হাদীস নয়। কেউ কেউ একে হাদীস মনে করে থাকেন। তাদের ধারণা ঠিক নয়। (ফাতাওয়া আযীযিয়্যাহ, শাহ আবদুল আযীয দেহলভী পৃ. ২০২)

উল্লেখ্য, গরীব-মিসকীনকে আহার করানো অনেক বড় ছওয়াবের কাজ এবং তা ঈসালে ছওয়াবের উদ্দেশ্যেও হতে পারে। তবে শর্ত এই যে, হালাল পয়সায় হতে হবে, নিজের সম্পদ দ্বারা হতে হবে, অবন্টিত মীরাছের সম্পদ থেকে না হতে হবে, প্রচলিত তারিখগুলোতে (তৃতীয়, দশম, চল্লিশতম দিনে, শবে বরাত ইত্যাদিতে) না হতে হবে।

সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় এই যে, কাউকে খানা খাওয়ালে ওই সময় খতম পড়াবে না, আর যদি খতম পড়ানো হয় তাহলে খানা খাওয়াবে না এবং কোনো হাদিয়াও দিবে না। এরপর অন্যের মাধ্যমেই ঈসালে ছওয়াব করাতে হবে- এরই বা কী অপরিহার্যতা? প্রত্যেকে নিজেই ঈসালে ছওয়াব করতে পারে। কিছু দান-সদকা করা হল, নফল নামায পড়া হল, সূরা ইখলাস তিনবার পড়া হল, আল্লাহর দরবারে তাদের ক্ষমার জন্য দুআ করা হল-এই সবগুলোই ঈসালে ছওয়াব হিসেবে গণ্য হতে পারে। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।

খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ – একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে

একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে: ৮ – খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ !
এক: খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া সুন্নাত। আমর বিন আবু সালামাহ বলেছেন:
-আমি নবিজীর কোলে মানুষ হয়েছি। একদিন খেতে বসে আমার হাত খাবারের থালায় এদিক সেদিক ঘুরছিল। নবিজী বললেন:
-বালক! বিসমিল্লাহ পড়ো। ডানহাত দিয়ে খাও। তোমার সামনে থেকে খাও।

দুই: খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ ভুলে গেলে, তার সংশোধনীরও সুযোগ আছে। নবিজী তার সমাধান দিয়ে দিয়েছেন:
-তোমরা যখন খাবার খাবে, বিসমিল্লাহ পড়বে। (শুরুতে) ভুলে গেলে, পড়বে:
= বিসমিল্লাহি ফি আউয়ালিহি ওয়া আ-খিরিহি।

তিন: বিসমিল্লাহ পড়লে, শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শক্তি সঞ্চয় হয়। খাবারে বরকত হয়।

*** ইয়া রাব! আমাদেরকে এই সুন্দর সুন্দর, মজার মজার সুন্নাহগুলো নিয়মিত আমলে নিয়ে আসার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আমাদের শি‘আর (স্লোগান) হলো:
– ইন তুতীঊহু তাহতাদু (وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا): যদি তার (নবিজীর) অনুসরণ করো, হিদায়াত পেয়ে যাবে (নূর:৫৪)।

================
লেখক – শাইখ মুহাম্মদ আতিক উল্লাহ্‌
শিক্ষক – মাদরাসাতুল কুরআনিল কারীম,
শ্যামলী,ঢাকা।


একটি সুন্নাহকে বাঁচাব বলে সিরিজের সকল পর্ব – এখানে

অর্থ : আল্লাহর নামে তাঁর বরকতের প্রত্যাশায় শুরু করলাম।

সূত্র : রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু বকর ও ওমর (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে আবুল হাইসাম (রা.)-এর বাড়িতে গেলেন। তিনি তাঁদের কাঁচা-পাকা খেজুর ও পানি দিয়ে আপ্যায়ন করেন। তখন তিনি বলেন, তোমাদের সামনে যখন এমন খাবার পরিবেশন করা হয় এবং তোমরা তা হাতে ধরো, তখন এ দোয়া বলবে।

(মিরকাতুল মাফাতিহ : ৮/১৫৪)। যদি খাবারের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে ভুলে যায়, তাহলে বলবে, ‘বিসমিল্লাহি ফি আওয়ালিহি ওয়া আখিরিহি। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩২৬৪)

নামাযের পর এই অসম্ভব সুন্দর দু’আটি পড়তে কখনো ভুলবেন না।

প্রথমে দু’আটির প্রেক্ষাপট জেনে নেওয়া যাক, তাহলে আমল করতে আগ্রহ বাড়বে ইনশাআল্লাহ্।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অত্যন্ত প্রিয় একজন সাহাবি ছিলেন মু’আয ইবনু জাবাল (রা.)। তাঁকে তিনি অন্য এলাকায় ইমাম হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, নওমুসলিমদের ইমামতি করার জন্য। সেই মু’আয (রা.) বলেন, (একদিন) রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার হাত ধরে বলেন, “মু’আয! আমি তোমাকে ভালোবাসি।…মু’আয! আমি তোমাকে ওসিয়ত করছি, প্রত্যেক সালাতের পর এ দু’আটি বলা কখনো বাদ দিয়ো না।”

দু’আটি হলো-

اللّٰهُمَّ أَعِنِّيْ عَلٰى ذِكْرِكَ، وَشُكْرِكَ، وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ.

(মোটামুটি উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আ’ইন্নি ‘আলা যিকরিকা, ওয়া শুকরিকা, ওয়া হুসনি ‘ইবাদাতিকা)
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার যিকর করতে, শুকরিয়া আদায় করতে ও আপনার ইবাদত উত্তমরূপে করতে আমাকে সাহায্য করুন।
[আবু দাউদ: ১৫২২, হাকিম: ৬৭৭, সহিহ আত-তারগিব: ২/২১৯; হাদিসটি সহিহ]

প্রথমত, হাদিসটির বর্ণনা খুবই সুন্দর। নবীজি খুবই স্নেহ করে মু’আয (রা.)-কে দু’আটি শিখিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, তিনি এটা ওসিয়ত করেছেন, নামাযের পরে পড়তে। সাধারণ কথা আর ওসিয়তের মধ্যে পার্থক্য অনেক। মানুষ খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেই কেবল ওসিয়ত করে থাকে।
তৃতীয়ত, দু’আটির অর্থও খুবই সুন্দর ও ব্যাপক।

আসুন! নিজেরা আমল করি, অন্যকেও আমল করতে বলি।

 সালাম ফিরানোর পরপর তিনবার “আসতাগফিরুল্লাহ” পড়বেন (আসতাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ, আম্তাগফিরুল্লাহ এভাবে)।
এরপর পড়বেন-
اللهم أَنْتَ السَّلَامْ، وَمِنْكَ السَّلَامْ، تَبَارَكْتَ يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ.
(আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম, ওয়া মিনকাস সালাম, তাবারাকতা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম)
[সহিহ মুসলিম: ৫৯১]

 অতপর পড়তে পারেন আয়াতুল কুরসি (সূরা বাকারার ২৫৫ নাম্বার আয়াত)। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি প্রত্যেক সালাতের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে, তার জান্নাতে প্রবেশের পথে মৃত্যু ব্যতীত অন্য কোন বাধা থাকবে না।” [নাসাঈ: ৬/৩০, আত-তারগিব: ২/৪৪৮, হাদিসটি হাসান (সহিহ)]

 এরপর পড়বেন এই পোস্টে উল্লেখিত প্রথম দু’আটি, যা মু’আয (রা.)-কে পড়ার জন্য নবীজি ওসিয়ত করে গেছেন।

 আরো পড়বেন- সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার, আলহামদুলিল্লাহ ৩৩ বার ও আল্লাহু আকবার ৩৪ বার। বেশি বেশি মনে হলে এগুলো ১০ বার করেও পড়তে পারেন। হাদিসে দুইভাবেই এসেছে।

 আরো অনেক দু’আ ও যিকর এসেছে, সালাতের পরে পড়ার জন্য। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।