প্রবৃত্তি

549
প্রচন্ড সংঘর্ষ চলছে। ঈমান আর কুফরের সংঘর্ষ। আদর্শের চিরন্তন দ্বন্দ্বে আরেকবার রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে ময়দান। এবার উহুদের ময়দান।
শত্রুর সংখ্যাধিক্য বা নিজেদের সরঞ্জামাদির দৈন্যতা মুমিনদের টলায় না, তাদের নেতৃত্বে যে আছেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ মুহাম্মাদ ﷺ । তাছাড়া এর আগেও বদরে সংখ্যালঘু তো তাঁরাই ছিলেন, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তবুও এসেছিল বিজয়। তরবারির ঝনঝনানি বিদীর্ণ করছে মরুর বুক, ঢেলে দিচ্ছে তাজা রক্ত। এমন সময় হঠাৎ…
হঠাতই খবর এল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে ﷺ শহীদ করে দিয়েছে কাফির-মুশরিকরা! যুদ্ধের ময়দানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের এক চরম মুহুর্ত, এমন সময়ই কিনা তিনি ﷺ চলে গেলেন!!… এখন কী হবে?
মুহুর্তেই মনোবল ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল অধিকাংশ মুসলিমের। বিষাদের মেঘ অন্ধকারে ছেয়ে ফেলল তাঁদের মনের আকাশগুলো।
“আর মুহাম্মাদ ﷺ তো একজন রাসূল বৈ কিছু নন! তাঁর পূর্বেও অতিবাহিত হয়ে গেছেন বহু সংখ্যক রাসূল…” কিছুক্ষণ আগে এই কথাগুলোই আওড়াতে আওড়াতে মুশরিকদের হাতে শহীদ হয়ে যান মুসআব ইবন উমাইর (রদিআল্লাহু আ’নহু)। একই সময় পাশেই ঘেরাও হয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহও ﷺ। তাতেই গুজব রটে যায় যে মুহাম্মাদ ﷺ শহীদ হয়ে গিয়েছেন। সেই গুজব ধূলিস্যাৎ হয়ে পরিস্থিতি যখন রাসূলুল্লাহর ﷺ নিয়ন্ত্রণে এল, তখন তিনভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন সাহাবাগণ।
একদল হতাশার যন্ত্রণায় অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছে, একদল গিয়ে অবস্থান নিয়েছে মুনাফিকদের সাথে। আর শেষদল থেকেছে অটল, চালিয়ে গিয়েছে যুদ্ধ।
‘আল্লাহর নবী মৃত্যুবরণ করে থাকলে তিনি তাঁর দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। তিনি যে উদ্দেশ্যে প্রাণ দিলেন, সেই একই উদ্দেশ্যে আমৃত্যু লড়তে থাকব… ’ এই উপলব্ধিতেই নিজেদের পর্বতসম অটল, অবিচল রেখেছিল সেই ক্ষুদ্র দল। সেসময় এই ক্ষুদ্রদলের সমর্থনেই মুসআব ইবনে উমাইরের কথাগুলো পূর্ণ করে আয়াতস্বরূপ নাযিল করে দিলেন স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন। আর কিয়ামত পর্যন্ত কথাগুলো বিশ্বাসীদের শিক্ষাস্বরূপ স্থান করে নিল শেষ আসমানি কিতাব আল-কুরআনে।
“আর মুহাম্মাদ একজন রাসূল বৈ কিছু নন। তাঁর পূর্বেও অতিবাহিত হয়ে গিয়েছেন বহু সংখ্যক রাসূল। অতএব তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন, তবে কি তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে?…” (সূরা আল-ইমরান, ১৪৪)
যে মানবীয় দুর্বলতা নিয়ে আজ লিখছি তা এতই মারাত্নক যে একজন মানুষের বিশ্বাস-আদর্শ সব তছনছ করে দিয়ে ওপারের অনন্তকে নিঃস্ব করে দিতে পারে অনায়াসেই। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হল – এই দুর্বলতা এতই সহজাত, এতই নীরব ঘাতক যে বহু মানুষকে তা যুগের পর যুগ বিভ্রান্ত করেছে, এখনও করে চলেছে। আর মানুষের প্রকৃত সফলতা – তার রব্বের সন্তুষ্টি – থেকে করেছে বঞ্চিত। লিখাটি পড়ার পর যেই কারণে দ্বিমত সৃষ্টি হয়ে যাবে… সেই কারণও হল ঐ একই মানবীয় দুর্বলতা। আল্লাহ আমাদের জন্য সহজ করুন।
আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন মানুষকে নানাভাবে হিদায়াত দেন। নিজের রব্বের সন্তুষ্টির জন্য, অনন্তের কল্যাণের জন্য বান্দা ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ এ চলার গুরুত্ব উপলব্ধি করে। সেই উপলব্ধি তাকে কঠিন কিন্তু সরল এই সিরাতুল মুস্তাকিমেই সারাজীবন হাঁটার অনুপ্রেরণা যোগায়। দ্বীনের প্রতি প্রথম এমন ভালবাসা সৃষ্টি হল প্রাথমিক হিদায়াত। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন রকম ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় এই ভালবাসা – যা বান্দার অন্তরের ইখলাস থেকে লালিত আল্লাহর এক বিশেষ নিআমত।।
সিরাতুল মুস্তাকিমের গুরুত্ব উপলব্ধির পর একজন বান্দা যখন সেপথে হাঁটতে চায়, তখন তার আবশ্যক হয় কিছু পাথেয়। সেসব পাথেয়গুলোর প্রথম সারিতে থাকে প্রাথমিক ই’লম, দ্বীনদার সঙ্গী, নিয়মিত নাসীহা বা রিমাইন্ডার প্রভৃতি। আর প্রায় সবসময়ই যাদের মাধ্যমে দ্বীনকে গুরুত্ব দেওয়ার শুরু হয়, তাদের কেন্দ্র করেই অন্য বিষোয়গুলো অর্থাৎ প্রাথমিক ই’লম, নাসীহা, দ্বীনি আলোচনা ইত্যাদি আবর্তিত হয়ে থাকে। এছাড়া প্রাথমিক ই’লমের জন্য কোন আলেমদের বই পড়া হবে, কোন আলেমদের লেকচার শোনা ইত্যাদিও হয় নিজেদের সার্কেলভিত্তিক।
আর জাহিলিয়াত ত্যাগ করে নিজের এক নতুন জীবন গঠনের এই পর্যায়ে এসে অধিকাংশই এক সহজাত মানবীয় দুর্বলতার ধোঁকা খেতে শুরু করে, যা কারও কারও স্থায়ী হয়ে যায় সারাজীবন। একই ধোঁকা; শুধু সময়ে সময়ে রূপের, মাত্রার, আচরণের বিভিন্নতা থাকে সেখানে। সে ধোঁকার নাম নাফস, খায়েশাত বা প্রবৃত্তির ধোঁকা।
একমাত্র ‘আল্লাহর রাহে’ ‘আল্লাহর দ্বীন’ পালন না করে কোন ‘প্রবৃত্তিজাত কারণে’ ‘প্রবৃত্তি উৎসরিত’ মনগড়া বা নিজ সার্কেলের দ্বীন পালন করা।

এক.

মানুষের নানাকারণে কারও জন্য ভাললাগা সৃষ্টি হতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে অগাধ ভক্তি। কারও ভাল আচরণ, জীবনঘনিষ্ঠ কোনো লিখা বা বই, আবেগঘন কথাবার্তা বা লেকচার ইত্যাদি বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা গড়ে তোলে। এমনকি জাহিল গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমার যেগুলো জীবনঘনিষ্ঠ বা আবেগসৃষ্টিকারী হয়, সেগুলোর লেখক-নির্মাতাদের প্রতি সাধারণের ভাললাগা তৈরি হতে দেখা যায়। প্রবৃত্তির এই সহজাত বিষয়টিই উপলব্ধির বাহিরে চলে যায় যখন তা দ্বীনকেন্দ্রিক হয়। অর্থাৎ,যখন কোনো দাঈ’ বা আলেমের জীবনঘনিষ্ঠ বা আবেগঘন কোনো লেকচার বা বই পড়ে সেই অনুভূতিতাড়িত ভক্তি ‘আল্লাহর রাহে’,‘আল্লাহর দ্বীনের রাহে’-র নিয়্যাতকে ছাপিয়ে যায়, তখন তা খেয়াল রাখা বাস্তবিকই কষ্টকর হয়ে পড়ে।
যখন কথাবার্তায় আল্লাহ সুবহানাহু, আখিরাত, সাহাবাদের ঈমানদীপ্ত কোনো ঘটনা থাকে তখন এই ব্যক্তি দ্বীনি বিষয়াদিতে ভুল করতে পারেন না বা জেনেশুনে দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ আরও বিষয়াদি গোপন করতে পারেন না এমনসব চিন্তা মনে জেঁকে বসে অবচেতনভাবেই। কোনো নির্দিষ্ট দল বা মানহাজের অন্ধপ্রীতি শুরু হয় প্রবৃত্তির এমনসব অবচেতন অনুসরণ থেকেই। অথচ এমন হতেই পারে যে যাদের থেকে দ্বীন গ্রহণ করা হচ্ছে তারা দ্বীনের প্রাথমিক, ব্যক্তিগত ইবাদাত আর তাযকিয়্যাহর মত বিষয়ে জীবনঘনিষ্ঠ কথাবার্তা বললেও তাগুত বর্জন, ওয়াজিব তাকফির, হারাম তাকফিরের মত অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ন্যুনতম সঠিক আকিদাহই পোষণ করেন না, হারাম তাকফির করা খুরুজদের সাথে ওয়াজিব তাকফির করা মুজাহিদিনদের তালগোল বাঁধিয়ে ফেলেন। এবং বাস্তবতা এটাই যে বেশিরভাগ দাঈ আলেম ও সাধারণ দাঈরা স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধাহীনতার স্বার্থে, বিপদহীনতার রাহে এইসমস্ত স্পর্শকাতর বিষয়ে সালাফদের মানহাজের সম্পূর্ণ উল্টো অবস্থান নিয়ে নেন।
কিন্তু বান্দার সমস্যা হল, এমনসব গর্হিত বিচ্যুতি দেখার পরও ঐ যে কিছু কথা বান্দাকে আবেগতাড়িত করেছিল আর সেকারণে অন্ধভক্তি জন্মিয়েছিল তা থেকে সে অন্ধ অনুসরণও শুরু করে দেয়। তখন আর খেয়াল থাকে না যে রাসূলুল্লাহ ﷺ উলামাদেরকে নবী রাসূলগণের উত্তরাধিকারী যেমন বলেছেন, তেমনি উম্মাতের জন্য উলামায়ে সু’ আর দরবারি উলামাদের দাজ্জালের ফিতনাহ থেকেও বেশি ভয় করেছেন। তাই আবেগ অনুভূতির মত প্রবৃত্তিজাত অনুসরণ থেকে বেঁচে থেকে কেবলমাত্র আল্লাহর রাহেই কাউকে অনুসরণের নাসীহাস্বরূপ আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন নাযিল করেছিলেন আয়াত, “আর মুহাম্মাদ একজন রাসূল বৈ কিছু নন। তাঁর পূর্বেও অতিবাহিত হয়ে গিয়েছেন বহু সংখ্যক রাসূল। অতএব তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন, তবে কি তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে?…”
এই ব্যাপারটি এতই ভয়ঙ্কর যে একই আয়াতের প্রায় একই ধরনের আরেকটি প্রেক্ষাপট ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। আর তা হল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর ﷺ সত্যিই ওফাত হওয়ার পর চরম বেসামাল পরিস্থিতিতে আবু বকর (রদিআল্লাহু আ’নহু) এর মুখে আয়াতটির তিলাওয়াত। রাসূলুল্লাহর ﷺ মৃত্যুর পর অনেকে যখন মুষড়ে পড়েছিলেন, অনেকে যখন দ্বীন ত্যাগ করে ফেলছিলেন, এমনকি উমারও (রদিয়াল্লাহু আ’নহু) যখন আবেগতাড়িত হয়ে রাসূলের ﷺ মৃত্যুর বাস্তবতা মেনে নিতে পারছিলেন না, তখন সাহাবাদের ঐ একই আয়াত দিয়েই শান্ত করেছিলেন আবু বকর (রদিয়াল্লাহু আ’নহু)। কুরআনের হাফিজ হওয়া সত্ত্বেও তখন উমার (রদিয়াল্লাহু আ’নহু) বলেছিলেন, “যেন আয়াতটি আমি প্রথমবারের মত শুনছি!”
প্রকৃতপক্ষে মানুষের আখলাক, শব্দচয়ন, বলার ভঙ্গি ইত্যাদি অন্যদের স্বাভাবিকভাবেই আকৃষ্ট করে। আর আমাদের রাসূল ﷺ এসব মানবীয় গুণে ছিলেন অতুলনীয়, অনুকরণীয়, সমগ্র মানবজাতির আদর্শ। যে রাসূলের ﷺ আচরণে সাহাবারা সাধারণভাবেই মনে করে বসতেন যে তিনি ﷺ নিশ্চিতরূপে আমাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, সেই মানুষটির আচরণের নিদারুণ প্রভাব থাকাই স্বাভাবিক। আর রাসূলুল্লাহর ﷺ কথায়, আচরণে মুগ্ধ হয়ে দ্বীনে আসা থেকে শুরু করে কুস্তিতে হেরে গিয়ে পর্যন্তও দ্বীনে আসার নমুনা রয়েছে। কিন্তু জাহিলিয়্যাত থেকে দ্বীনে আসার বিভিন্ন কারণ থাকলেও তাতে অটল থাকা যেন অন্য কোনো প্রবৃত্তিজাত না হয়ে কেবল আল্লাহর রাহেই হয় সেকারণে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন উপরোক্ত আয়াতের প্রায় একই ধরনের দুই দুইটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা মু’মিনদের জন্য ইতিহাসে খোদাই করে দিলেন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহর ﷺ জন্য ভালবাসাও আল্লাহর গোলামি থেকে উৎসরিত হতে হবে, রাসূলুল্লাহর ﷺ প্রতি সহজাত প্রবৃত্তিজাত ভালবাসা থেকে আল্লাহর গোলামি চলবে না। খেয়াল করলে দেখা যায়, দ্বিতীয়টির বাড়াবাড়ি থেকে অনেক ভ্রান্ত ফিরকাও ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে।
তাহলে দ্বীনে প্রবেশের পর স্বয়ং রাসূলুল্লাহর ﷺ প্রতি সহজাত অনুভূতি থেকেও দ্বীন পালন যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে শরীয়াহ কায়েম, তাকফির ইত্যাদির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুস্পষ্ট বিচ্যুতির পরও নিজেদের পছন্দের উলামাদের জীবনঘনিষ্ঠ কথায় মুগ্ধ হয়ে, আবেগতাড়িত হয়ে সেইসব গোমরাহির মানহাজে শক্ত হয়ে জমে থাকা, নিজের দ্বীনে আসার সার্কেলের বা জামাতের কাটছাঁট করা দ্বীন পালন তো প্রবৃত্তির দাসত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। জাহিলিদের গানবাজনায় মজে থাকা, দুর্গাপূজা-ক্রিসমাসে সমারোহে একাত্নতা ঘোষণা, মাজারে গিয়ে শির্ক করে বেড়ানো ইত্যাদি যেমন প্রবৃত্তির দাসত্ব, তেমনি বাহ্যিক এসব জাহিলিয়াত ত্যাগ করে আসা দ্বীনদারদেরও উম্মতের এহেন পরিস্থিতিতে তাগুত বর্জন, আবশ্যক তাকফির, শরীয়াহ, কিতাল ইত্যাদির মত ফারজিয়্যাতে উদাসীনতা আর উদাসীন আলেম ও দাঈ’দের অন্ধ অনুসরণও প্রবৃত্তির আরেক প্রকার দাসত্ব। কিন্তু পার্থক্য হল, দ্বিতীয় প্রকারের মানুষ মনে করে যে তারা মিল্লাতু ইব্রাহিমে, সিরতল মুস্তাকিমে অটল রয়েছে। একারণে পরবর্তী এইপ্রকার প্রবৃত্তি-দাসত্ব এক নীরব ঘাতক, অতি মারাত্নক।
“আপনি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছেন, যে তার প্রবৃত্তিকে স্বীয় উপাস্য স্থির করেছে? আল্লাহ জেনেশুনেই তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তার কান ও অন্তরে মোহর এঁটে দিয়েছেন এবং তার চোখের উপর রেখেছেন পর্দা। অতএব, আল্লাহর পর কে তাকে পথ প্রদর্শন করবে? তোমরা কি চিন্তাভাবনা কর না?” (সূরা জাসিয়া, ২৩)

দুই.

অন্তরের আরেকটি সহজাত প্রবৃত্তি হল, মানুষ তা-ই বিশ্বাস করে যা সে বিশ্বাস করতে চায়; অধিকাংশ মানুষ সেই দলিলই গ্রহণ করে যা সে আগে থেকেই খুঁজে বেড়ায়। অন্তরের ইখলাস থেকে প্রমাণ আর দলিলাদি গ্রহণের মানসিকতা, নিজ মতের বিরুদ্ধে গেলেও সত্য মেনে নেওয়ার মানসিকতা খুব কম বান্দারই থাকে, অথচ অন্তরের এমন পবিত্রতা না থাকলে প্রবৃত্তির এইপ্রকার ধোঁকা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। কারণ সত্যান্বেষী ইখলাসের খবর একমাত্র আল্লাহই ভাল জানেন আর একমাত্র আল্লাহই পারেন বান্দার অন্তরের সেই ইখলাসের ভিত্তিতে তা সত্যের দিকে ঘুরিয়ে দিতে।
এই ব্যাপারটি এতই তাৎপর্যপূর্ণ যে, যতপ্রকার ইরজা আর গুলুহ রয়েছে তার সবই এই বিষয়ে বিচ্যুতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমনঃ সাহাবি আবু বাসিরের (রদিআল্লাহু আ’নহু) আক্রমণগুলোকে পূর্বের শত শত ইমাম আর সালাফগণ জিহাদ-ফি-সাবিলিল্লাহ বললেও একই ঘটনায় যুগের ব্যবধানে জিহাদ না হওয়ার আজব যুক্তিও চলে আসে, কাফির-মুশরিকদের আর স্থানীয় তাগুতদের ওয়াজিব তাকফিরের স্থানে নিষিদ্ধ তাকফিরের সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়, আবার বায়াহ না দিলে সবাইকে তাকফির আর মুজাহিদিন হত্যারও গোঁজামিল দলিল দেখা যায়। আসলে দ্বীনের এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর সহীহ জ্ঞানার্জন করে হক অবস্থান নেওয়ার নিয়্যাতে নয়, বরং আগে থেকেই নেওয়া নিজেদের অবস্থানের আর কাজের বৈধতার দলিল খুঁজতে গিয়েই সাহাবাদের আর সলফে-সলেহীনদের বোঝা দ্বীনের সম্পূর্ণ উল্টো, প্রবৃত্তি উৎসরিত এমনসব যুক্তিগুলোর উত্থান হয়। ফলে দলিলের যেই ব্যাখ্যা প্রবৃত্তিকে শান্ত করে সেটাই বান্দা গ্রহণ করে নেয়। কোনটা হক, কোনটা বাতিল তা নিয়ে অল্পই ভ্রূক্ষেপ করে।
আর মানুষ যে তা-ই বিশ্বাস করে যা সে বিশ্বাস করতে চায় – এই বিষয়টার ব্যাপকতাও একেবারে নাস্তিকতা থেকে দ্বীনদার সকল জায়গাতেই ব্যাপৃত। যেমনঃ নাস্তিক্য সিস্টেম নির্গত নাস্তিক্যবাদী বিজ্ঞানীরা জীবনের উৎপত্তি ব্যাখ্যায় ডারউইনিয়ান ইভল্যুশন থিউরি ব্যবহার করে থাকে। ইভোল্যুশন থিউরির বিরাট সব ছিদ্রের কথা বাদ দিলেও মহাবিশ্বের উৎপত্তি ব্যাখ্যাতেও সৃষ্টিকর্তা ছাড়াই ডারইউনিয়ান ব্যাখ্যার পথ খোঁজা হয় অর্থাৎ, মহাবিশ্ব নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়ে যাবার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাবার সদা চেষ্টা করা হয়। এই প্রয়াসে জন্ম হয়েছে মাল্টিভার্স থিউরির যেটায় হাল আমলের নাস্তিক্য মহল মাত্রই ‘বিশ্বাসী’ আর তারা আশাবাদী যে একসময় এই থিউরির পক্ষে প্রমাণাদি আসবে। অথচ সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের ‘প্রমাণ’ নেই বলে ফ্যানা তোলা হলেও এই মহাবিশ্ব ছাড়া অন্য মহাবিশ্ব প্রমাণ তো দূরের কথা, পর্যবেক্ষণও সম্ভব নয় সেদিকে আর মহামান্যদের নজর থাকে না। [১]
বনী ইসয়াঈলসহ পূর্ববর্তী কিতাবধারীদের এক জঘন্য সীমালঙ্ঘন ছিল কিতাববিকৃতির মাধ্যমে নিজেদের প্রবৃত্তিজাত দ্বীন বানিয়ে নেওয়া। কিন্তু কুরআনকে স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু কিছুদিন আগ পর্যন্তও ছিল জাল হাদিস বানাবার হিড়িক। এখন যদিও তা অনেকটা বন্ধ হয়েছে তবুও জঘন্য বিদআতিদের সহীহ হাদিস বাদ দিয়ে দুর্বল, অতি দুর্বল আর একেবারে জাল হাদিসও আমল থেমে থাকে নি। এগুলো প্রবৃত্তির অনুসরণের উদাহরণ। কিন্তু আরও একপ্রকার দ্বীনবিকৃতি যে রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা দুর্লভ। আর তা হল সহীহ হাদিসেরও মনগড়া আর অশ্রুতপূর্ব সব ব্যাখ্যা দিয়ে সাহাবায়ে কেরাম আর সালাফদের ব্যাখ্যা করা দ্বীনের বিকৃতি। কুফরি গণতন্ত্রের হালালিকরণ, জামানার কুফর সম্রাট আমেরিকা ইসরাঈলের সাথে মিত্রতা ও সহাবস্থান, স্থানীয় তাগুত শাসকদের মুসলিম হওয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদি জঘন্য ব্যাপারগুলোও যে সুস্পষ্ট ‘দ্বীনবিকৃতি’ তা অল্পই অনুধাবণ করতে পারে।
পৃথিবীতে প্রকৃত শরীয়ত যেখানে অনুপস্থিত, যেখানে শরীয়ত কায়েমের প্রচেষ্টারত উলামাগণ, তাগুত সরকারের সাথে ভিন্নমত পোষণকারী উলামাগণ পদে পদে লাঞ্ছিত হন, গ্রেপ্তার হন সেখানে দ্বীন বিকৃত করে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় তাগুতদের বৈধতা দিয়ে বেড়ানো অল্পকিছু খালাফেরা নিজেদের স্বীয় প্রবৃত্তির উপাসনা করতে থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এমন খালাফদের দাওয়াতি জীবনে আসে না কোনো লাঞ্ছনা। মিলিয়ন মিলিয়ন ভক্তকূলের জন্য একের পর এক লেকচার আর বই আসে এদের। আর বেদুঈনদের দ্বীন পালন করা অধিকাংশ মুসলিমদের কাছে দুনিয়াবি বিপদবিহীন এমন দাওয়াত আর তার দাঈরা পায় জনপ্রিয়তা। এদের দলিলগুলোও দেখলে দেখা যায় সহীহ হাদিস, সীরাতের সহীহ ঘটনা। কিন্তু ব্যাখ্যাগুলো সাহাবাদের বুঝ, সালাফদের ঐক্যমত্য থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। দুনিয়া বুলেটপ্রুফ রেখে প্রবৃত্তি উৎসরিত বিকৃত দ্বীন পালনের এক অনবদ্য সিস্টেম। আহলে কিতাবদের দ্বীন বিকৃতির আয়াতগুলো এদের ক্ষেত্রেও যেন সমভাবে প্রযোজ্য হয়ে যায়।
“আরও দিয়েছিলাম তাদেরকে ধর্মের সুস্পষ্ট প্রমাণাদি। অতঃপর তারা জ্ঞান লাভ করার পর শুধু পারস্পরিক জেদের বশবর্তী হয়ে মতভেদ সৃষ্টি করেছে। তারা যে বিষয়ে মতভেদ করত, আপনার পালনকর্তা কেয়ামতের দিন তার ফয়সালা করে দেবেন।
এরপর আমি আপনাকে রেখেছি ধর্মের এক বিশেষ শরীয়তের উপর। অতএব, আপনি এর অনুসরণ করুন এবং অজ্ঞানদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করবেন না। (সূরা জাসিয়া, ১৮-১৯)

তিন.

দ্বীনের পথে ইরজা, গুলুহ আর মধ্যমপন্থা এই তিন শ্রেণির মানুষ দেখা যায়। ইরজা হল ছাড়াছাড়ি, গুলুহ বাড়াবাড়ি আর মধ্যমপন্থা হল উপরোক্ত দুই প্রান্তিকতা মুক্ত হক মানহাজ। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হল, নিজেদের মনগড়া বা খেয়াল-খুশিমত ব্যাখ্যামাত্রই মধ্যমপন্থা নয়। অধিকাংশই মনে করে তারা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করছে কিন্তু আসলে তারা এখানেও প্রবৃত্তির ছোবলে মনগড়া মানহাজই অনুসরণ শুরু করে, তা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না। এই বিষয়ে পদস্খলন হয় মূলত ‘প্রান্তিকতা থেকে মধ্যমপন্থা নির্ণয়’ এর ভুল প্রয়াসে। এই বিষয়টা একটু আলোচনা করা যাক।
এক লোক বাজারে গিয়ে আপেল কিনতে গিয়ে দেখলো বিক্রেতা দর ১০০ টাকা চাইছে। এই দর ক্রেতার কাছে বেশি মনে হওয়ায় সে ৮০ টাকা রাখতে বলল। কিছুক্ষণ দর কষাকষি করে শেষমেশ দু’জন সিদ্ধান্ত নিল, ৮০ আর ১০০ এর মধ্যম দাম ৯০ টাকায় তারা লেনদেন করবে। এখানে লক্ষণীয়, ১০০ এবং ৮০ এর হিসেবে ৯০ মধ্যসংখ্যা হলেও এইভাবে মধ্যপন্থা নির্ণয় সঠিক দিশা দেয় না। কারণ এখানে আগে প্রান্তিক সংখ্যা দু’টো আগে মনের খেয়ালে বেছে নেওয়া হয়েছে। আর তা থেকে মধ্যম নির্ধারণ করা হয়েছে। যদি বিক্রতা প্রথমে ১০০ টাকা না বলে ১২০ টাকা বলতো, তবে তো মধ্যসংখ্যা ১০০ হতো। অথবা ক্রেতা ৮০ না বলে ৬০ টাকা দরদাম করলে ৮০ই মধ্যসংখ্যা হতো। মনের খেয়াল খুশিমত প্রান্তিকতা নির্ধারণ করে মধ্যপন্থা নির্ণয় করতে চাইলে তাই প্রবৃত্তিজাত মধ্যম অবস্থাই পাওয়া যায়, কিন্তু আদতে তা প্রকৃত মধ্যপন্থা হয় কিনা সে নিশ্চয়তা থাকে না।
দ্বীনের ক্ষেত্রে তাই এটা বাড়াবাড়ি আর ওটা ছাড়াছাড়ি, সুতরাং মধ্যমপন্থা হল এই – এভাবে মধ্যমপন্থা নির্ণয় গ্রহণযোগ্য নয়। বরং আগে দ্বীনের অপরিবর্তনীয় ও মৌলিক বিষয়াদি থেকে মধ্যমপন্থা ও সিরতল মুস্তাকিম ব্যাখ্যা করা হয়। এরপর সেই মধ্যমপন্থা থেকে ছাড়াছাড়ি করলে ইরজা’ আর বাড়াবাড়ি করলে তা গুলুহ বলে বিবেচনা করা হয়।
বাস্তবতা হল এই যে, একদল মানুষ জিহাদ ফি-সাবিলিল্লাহ বলতেই নাখোশ হয়ে পড়ে আর যারাই কিতালের ইবাদাতের কথা বলে, তারাই গুলুহ বা বাড়াবাড়ির মধ্যে রয়েছে – এমনটা বিবেচনা করে ফেলে। তাদের বুঝে আসে না যে, কবীরাহ গুনাহ বা বায়াত না দিলেই নিষিদ্ধ তাকফির করা খুরুজরা ছাড়াও যে ওয়াজিব তাকফির করা হকপন্থী মানহাজ থাকতে পারে। এরা আবার সলাত, সিয়াম, হালাল-রুজি ইত্যাদি ব্যক্তিগত পর্যায়ের ফারজিয়্যাতে ছাড়াছাড়ি করা মানুষদের ইরজাগ্রস্থ মনে করে। মোটকথা, এই কাজগুলো গুলুহ আর এই কাজগুলো ইরজা সুতরাং মধ্যমপন্থা হল এই – এভাবে প্রবৃত্তির অনুসরণ করে দুই প্রান্তিকতা থেকে মধ্যমপন্থা চিহ্নিত করা হয় যা পদ্ধতির ভ্রান্তির কারণে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং দ্বীনের অপরিবর্তনীয় ও মৌলিক বিষয়াদি থেকে উৎসরিত হয় সত্যিকার মধ্যমপন্থী ও হক মানহাজ যা থেকে ছাড়াছাড়ি করলে ইরজা’ আর বাড়াবাড়ি করলেই হয় গুলুহ। অর্থাৎ ওয়াহীর আলোকে প্রথমে মধ্যমপন্থা চিহ্নিত করা হয়, তারপর সেই মধ্যমপন্থা থেকে প্রান্তিকতা চিহ্নিত করা হয়।
তাওহিদ, ঈমান ও কুফর, আকিদাহ, ফারজিয়্যাত, ওয়াজিব তাকফির ইত্যাদি হল দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি যেগুলোর ওপর ভিত্তি করে থেকে পুরো দ্বীনের বুঝ প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বীনের এই মৌলিক বিষয়গুলো সরাসরি ওয়াহী থেকে উৎসরিত। এগুলোতে কোনো তাকলিদ নেই এবং এই বিষয়গুলোর ই’লম অর্জন ফরজ।
.
মোটা দাগে চিহ্নিত করলে দেখা যায়, দ্বীনে প্রবেশের পর একদল উম্মাহর এহেন পরিস্থিতিতেও বসে থাকা মানহাজের অনুসারী, ব্যক্তিগত পর্যায়ের ও সর্বোচ্চ কিছু সামাজিক ইবাদাতেই নিজেদের সীমাবদ্ধকারী। নিষিদ্ধ তাকফিরের ভয়ে ওয়াজিব তাকফির তরককারী, দুনিয়াবি লোকসানের ভয়ে ঈমানের সাথে কুফরেরর সঠিক সংজ্ঞা, প্রয়োগ ইত্যাদিতে অযুহাতপেশকারী। এছাড়াও কিতাল-ফি-সাবিলিল্লাহ ও সমজাতীয় ফারজিয়্যাত সরাসরি বা কৌশলে অস্বীকারকারী। অথচ –
[১] যারা আল্লাহর ও আল্লাহর রাসূলের করা তাকফির অনুযায়ীও তাকফির করে না তাদের জন্য পুরো দ্বীনই সংশয়পূর্ণ হয়ে যায়। কারণ এটা হল সরাসরি ঈমান ও কুফরের সংজ্ঞার প্রয়োগ এবং দ্বীনের সর্বপ্রথম মাসআলাগুলোর একটি যা থেকে দ্বীনের অন্যান্য বহু বিষয়াদি নির্ভরশীল হয়। যেমনটা শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ উল্লেখ করেছেন,
“মনে রাখবেন, কাফের বা ফাসেক আখ্যাদানের মাসআলাসমূহ হল নাম ও বিধান আরোপ সংক্রান্ত এমন মাসআলা, যার সাথে পরকালে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি ও জাহান্নামের সতর্কবাণী এবং দুনিয়াতে বন্ধুত্ব, শত্রুতা, হত্যা, নিরাপত্তা লাভ ইত্যাদি বিধি-বিধান সম্পর্ক রাখে।
কেননা আল্লাহ তায়া’লা মুমিনদের জন্য জান্নাত রেখেছেন আর কাফেরদের জন্য তা হারাম করেছেন। এটা হল সর্বসময় এবং সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য সামগ্রীক বিধি-বিধানের অন্তর্ভূক্ত।” [২]
নেতৃত্ব সংক্রান্ত বিধানাবলি, বন্ধুত্ব ও শত্রুতা সংক্রান্ত বিধানাবলি, বিবাহ সংক্রান্ত বিধানাবলি, রক্ত ও কিসাস সংক্রান্ত বিধানাবলি, যুদ্ধ সংক্রান্ত বিধানাবলি সহ দ্বীনই গড়ে উঠে এই চরম স্পর্শকাতর কিন্তু আবশ্যক তাকফিরের মাসআলার উপর। ঈমান ও কুফরের প্রায়োগিক এই নীতিতে বহু লোকের দুই ধরনের সীমালঙ্ঘন হয়েছে যুগে যুগে। একদল মুসলিমদেরই কাফির আখ্যায়িত করে বসেছে তো আরেকদল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ﷺ করা ওয়াজিব তাকফির থেকে বিরত থেকে কাফির ও তাগুতদেরই বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে।
এছাড়া দ্বীন ইসলামের কত বিপুল পরিমাণ বিষয় এর উপর নির্ভরশীল তা বর্ণনাতীত। যেমন মুসলিম শাসকদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা, তাদের সাহায্য করা ও তাদের আনুগত্য করা ওয়াজিব। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা স্পষ্ট কুফর প্রকাশ না করে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে বের হওয়া ও তাদের সাথে যুদ্ধ করা জায়েয নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ইসলামের গন্ডির ভেতর থাকে ও আল্লাহর শরীয়ত অনুযায়ী শাসন পরিচালনা করে, বিচার ফয়সালা করে, ততক্ষণ তাদের পিছনে নামায পড়া ও তাদের সঙ্গে মিলে জিহাদ করা শরীয়তে বৈধ; তারা নেককার হউক বা বদকার হউক। আবার যে সমস্ত মুসলিমদের অভিভাবক নেই, মুসলিম শাসক তাদের অভিভাবক। পক্ষান্তরে, কাফির ও তাগুত শাসকের বাইআত করা, তার সাহায্য করা, তার সাথে সখ্যতা করা বা তার সহযোগিতা করা জায়েয নেই। তার পতাকাতলে যুদ্ধ করা, তার পিছনে নামায পড়া বা তার কাছে বিচার ফয়সালা কামনা করা বৈধ নয়। মুসলিমদের উপর তার কর্তৃত্ব বৈধ নয়। মুসলিমদের উপর তার আনুগত্য আবশ্যক নয়। বরং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, অপসারণের চেষ্টা করা, তাকে প্রতিহত করার জন্য কাজ করা এবং তার স্থানে একজন মুসলিম শাসক বসানোর চেষ্টা করা ওয়াজিব।
স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের তাকফির –
আর যারাই সেই আইন দ্বারা বিচার করবে না যেগুলো আল্লাহ প্রেরণ করেছেন, তবে তারাই হল কাফির” (সূরা মায়িদাহ, ৪৪)
তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তাদেরকে বন্ধু বানাবে, সে তাদেরই মধ্যে গণ্য হবে।” (মায়িদাহ, ৫১)
সুতরাং, স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন আর রাসূলুল্লাহর ﷺ সংজ্ঞায় যারা কাফির তাদেরকেও চিনতে ভুল করে বসে থাকা মানহাজ কখনো হক তো হতে পারেই না, বরং সম্পূর্ণ দ্বীনই তাদের নিকট সংশয়পূর্ণ। যেসমস্ত দরবারি উলামাদের ব্যাপারে, উলামায়ে সু’-দের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সতর্ক করে গিয়েছেন তাদের থেকেই আয়েশী আর শাসকের মন রাঙানো দ্বীন পালনের মানহাজ তো প্রকৃত মধ্যমপন্থা নয়, বরং উদারপন্থা। তাই মনগড়া প্রান্তিকতা থেকে মনগড়া মধ্যমপন্থা না খুঁজে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের আদিষ্ট ও রাসূলের দেখানো প্রকৃত মধ্যমপন্থাই অনুসরণীয়।
ঈমান-কুফরের সংজ্ঞা যেমনটা রাসূলুল্লাহর ﷺ শিক্ষা ছিল, যেমনটা সাহাবাদের বুঝ ছিল, পরবর্তী সলফে সলেহীনদের ঐক্যমত ছিল সেভাবেই গ্রহণ ও তদানুযায়ী আমল বাঞ্চনীয়। তাকফির সম্পর্কে আরও জানতে শায়খ আসিম আল মাকদিসির (হাফিজাহুল্লাহ) ‘তাকফিরের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি থেকে সতর্কীকরণ প্রসঙ্গে ত্রিশা পুস্তিকা’ পঠিতব্য। [৩]

চার.

দ্বীনের মূল বিষয়াদিতে তাকলিদ নেই। তাই এসব ক্ষেত্রে অমুক উলামারা এমন বলেছেন, তমুকেরা অমন বলেছেন আর সেকারণে আমি দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েছি এমন অনুযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। উলামাদের মধ্যে কারা অনুসরণযোগ্য, কারা বর্জনীয় আর কারা সতর্কতার সাথে গ্রহণীয় সে বিচার করতে হবে দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদির প্রতি তাদের অবস্থান দেখে। উলামায়ে সু’ ও শাসকের দরবারে যাওয়া উলামাদের লিখা, কথা ইত্যাদি যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন তা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। দ্বীনের পথে আসার সময় তাযকিয়্যাহ বা ব্যক্তিগত আমল প্রভৃতি বিষয়ে আবেগ টেনে আনা কথায়, কাজে প্রলুব্ধ হয়ে তাওহীদ, ঈমান-কুফর, এগুলোর প্রয়োগ ইত্যাদি মৌলিক বিষয়াদিতে তাকলিদ করা যাবে না। কিন্তু তবুও দেখা যায়, তাগুত শাসকের মন মানানো কাজ করে যাওয়া দাঈ’ ও আলেমদের থেকে ভাললাগার বিষয়গুলো গ্রহণ করতে করতে মৌলিক বিষয়গুলোতেও অন্ধ তাকলিদ শুরু হয়ে যায়।
রাসূলুল্লাহর ﷺ হাদিস ও সলফে সলেহীনদের কউলগুলো আমাদেরকে একশ্রেণির উলামা থেকে সতর্ক করে দেয় –
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “শাসকদের দরজার ব্যাপারে সতর্ক থাকো। যে ই শাসকদের নিকট গমন করে, সেই পরীক্ষার মধ্যে পতিত হয়।” [৪]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রদিআল্লাহু আ’নহু) বলেছেন, “একজন ব্যক্তি যে তার দ্বীনকে সাথে নিয়ে কোন শাসকের নিকট যায়, সে (শাসকের কাছ থেকে) বের হয়ে আসে তার সাথে কোন কিছু না নিয়েই।” (অর্থাৎ দ্বীন রেখে আসে) [৫]
হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রদিআল্লাহু আ’নহু) বলেন,
قال حذيفة رضى الله عنه : إياكم ومواقف الفتن . قيل : وما هي ؟ قال : أبواب الأمراء ، يدخل أحدكم على الأمير فيصدقه بالكذب ، ويقول ما ليس فيه
“তোমরা ফিতনার বিষয়গুলো থেকে সতর্ক থাকো।” বলা হলোঃ “সেটা কি?” তিনি বললেন, “শাসকদের দরজা। তোমাদের কেউ শাসকদের কাছে যাবে, তার মিথ্যা কথাকে সত্যায়ন করবে, তারপর বলবে, এটাতে কোন সমস্যা নেই।”
তিনি আরো বলেন, “অবশ্যই, তোমরা কখনো শাসকদের দিকে এক বিঘত পরিমাণও অগ্রসর হয়ো না।” [৬]
ইমাম সুফিয়ান সাওরি (রহিমাহুল্লাহ) বলেন,
قَالَ سُفْيَانُ الثَّوْرِيُّ: ” إِذَا رَأَيْتَ الْقَارِئَ يَلُوذُ بِالسُّلْطَانِ فَاعْلَمْ أَنَّهُ لِصٌّ وَإِذَا رَأَيْتَهُ يَلُوذُ بِالْأَغْنِياءِ فَاعْلَمْ أَنَّهُ مُرَاءٍ (شعب الإيمان)
“যখনই তুমি কোন আলেমকে দেখবে শাসকদের কাছে গমন করতে, জেনে রাখো, সে হচ্ছে একজন চোর। আর যদি তাকে ধনী লোকদের কাছে আনাগোনা করতে দেখো, তাহলে জেনে রেখো, যে মানুষকে দেখানোর জন্য কাজ করে।” [৭]
সুফিয়ান সাওরি (রহিমাহুল্লাহ) বলেন আরও বলেন,
إِنْ دَعَوْكَ أَنْ تَقْرَأَ عَلَيْهِمْ: قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ , فَلَا تَأْنَفْهُمْ (شعب الإيمان)
“তোমরা সেখানে যেও না, এমনকি তারা যদি তোমাদেরকে শুধুমাত্র ‘কুল-হুয়াল্লাহু আহাদ’ পাঠ করার জন্যও ডাকে।” [৮]
তাগুত শাসকদের থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে এত সতর্কবাণী থাকতেও যেসকল দরবারি আলেমরা তাদের সাথে গিয়ে মিশে, তাদের তো আসলে ঈমান আর কুফরের সংজ্ঞাই ঠিক থাকে না। তানাহলে তো যারা আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্যসব আইন দিয়ে শাসনকার্য চালায়, সেসব নিকৃষ্ট তাগুতদের বর্জনে প্রথম যুগের মুসলিমদেরই অনুসরণ করতেন। ইমাম আবু হানিফা যেখানে জেলে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করেছেন সেখানে আজ কত হানাফি আলেমই না শাসকের ধরনা দেওয়াকে নিয়মিত রুটিনে পরিণত করেছেন!
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إن الله لعن الكافرين وأعد لهم سعيرا * خالدين فيها أبدا لا يجدون وليا ولا نصيرا * يوم تقلب وجوههم في النار يقولون يا ليتنا أطعنا الله وأطعنا الرسولا * وقالوا ربنا إنا أطعنا سادتنا وكبراءنا فأضلونا السبيلا * ربنا آتهم ضعفين من العذاب والعنهم لعنا كبيرا
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ কাফেরদেরকে তাঁর রহমত থেকে বিতাড়িত করেছেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন জ্বলন্ত আগুন। তাতে তারা সর্বদা এভাবে থাকবে যে, তারা কোন অভিভাবক পাবে না এবং সাহায্যকারীও না।
যেদিন আগুনে তাদের চেহারা ওলট-পালট হয়ে যাবে, তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম এবং রাসূলের কথা মানতাম! এবং বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের নেতৃবর্গ ও আমাদের গুরুজনদের আনুগত্য করেছিলাম, তারা আমাদেরকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করেছে।
হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদের প্রতি এমন লানত করুন, যা হবে অতি বড় লানত। (আহযাব: ৬৪-৬৮)
এই বিষয়ে আয়াত রয়েছে আরও অনেক।

পাঁচ

অবচেতনভাবে কি প্রবৃত্তির দাসত্ব সম্ভব?
আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা বলেন,
قل هل ننبئكم بالأخسرين أعمالا الذين ضل سعيهم في الحياة الدنيا وهم يحسبون أنهم يحسنون صنعا
“বলে দাও, আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব, কর্মে কারা সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? তারা সেই সব লোক, পার্থিব জীবনে যাদের সমস্ত দৌড়-ঝাপ সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, অথচ তারা মনে করে, তারা খুবই ভাল কাজ করছে।” (সূরা কাহফ, ১০৪)
তিনি সুবহানাহুতা’লা আরো বলেন,
إنهم اتخذوا الشياطين أولياء لهم من دون الله ويحسبون أنهم مهتدون
“নিশ্চয়ই তারা আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে আর তারা মনে করছে যে, তারা সরল পথে প্রতিষ্ঠিত আছে।” (সূরা আ’রাফ, ৩০)
সিরতল মুস্তাকিমে অনেক ধূলাবালি উড়ছে তাই পথ দেখা যাচ্ছে না অন্তরের একেবারেই পবিত্র নিয়্যাতে তারা বসে রয়েছেন। তারা বুঝতেই পারছেন না কোন মানহাজ সত্য। আসলে তারা সংশয় সন্দেহে পতিত থাকতে চায় বলেই সংশয়ে ডুবে থাকে। কারণ কিয়ামত পর্যন্ত যে একদল হকের পথে বাতিলের বিরুদ্ধে কিতাল করে যাবে সেবিষয়ে সুস্পষ্ট সহিহ হাদিসগুলো থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, হকের উপর প্রতিষ্ঠিত সেই মানহাজ বসে থাকা এই মানহাজ নয়।
أَخْبَرَنَا أَحْمَدُ بْنُ عَبْدِ الْوَاحِدِ، قَالَ حَدَّثَنَا مَرْوَانُ، – وَهُوَ ابْنُ مُحَمَّدٍ – قَالَ حَدَّثَنَا خَالِدُ بْنُ يَزِيدَ بْنِ صَالِحِ بْنِ صَبِيحٍ الْمُرِّيُّ، قَالَ حَدَّثَنَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ أَبِي عَبْلَةَ، عَنِ الْوَلِيدِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْجُرَشِيِّ، عَنْ جُبَيْرِ بْنِ نُفَيْرٍ، عَنْ سَلَمَةَ بْنِ نُفَيْلٍ الْكِنْدِيِّ، قَالَ كُنْتُ جَالِسًا عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَذَالَ النَّاسُ الْخَيْلَ وَوَضَعُوا السِّلاَحَ وَقَالُوا لاَ جِهَادَ قَدْ وَضَعَتِ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا فَأَقْبَلَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِوَجْهِهِ وَقَالَ ‏ “‏ كَذَبُوا الآنَ الآنَ جَاءَ الْقِتَالُ وَلاَ يَزَالُ مِنْ أُمَّتِي أُمَّةٌ يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ وَيُزِيغُ اللَّهُ لَهُمْ قُلُوبَ أَقْوَامٍ وَيَرْزُقُهُمْ مِنْهُمْ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ وَحَتَّى يَأْتِيَ وَعْدُ اللَّهِ وَالْخَيْلُ مَعْقُودٌ فِي نَوَاصِيهَا الْخَيْرُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُوَ يُوحَى إِلَىَّ أَنِّي مَقْبُوضٌ غَيْرَ مُلَبَّثٍ وَأَنْتُمْ تَتَّبِعُونِي أَفْنَادًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ وَعُقْرُ دَارِ الْمُؤْمِنِينَ الشَّامُ
সালামাহ ইবন নুফাইল আল-কিন্দি বলেন, আমি একবার রাসূলুল্লাহর ﷺ সাথে বসে ছিলাম যখন একজন লোক আসলো এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! লোকেরা তাদের ঘোড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এবং তাদের অস্ত্রগুলো নামিয়ে ফেলেছে, আর তারা বলছে আর জিহাদ নেই, এবং যুদ্ধ সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ ঐ ব্যক্তির দিকে ফিরলেন এবং বললেন, ওরা মিথ্যা বলছে, জিহাদ তো কেবল শুরু হল। আমার উম্মাতের মধ্যে একাংশ থাকবে যারা সবসময়ই হক্বের জন্য জিহাদ করতে থাকবে, যাদের জন্য আল্লাহ কিছু মানুষকে গোমরাহ করে দিবেন আর ওদের থেকে খোরাক যোগাবেন, যতক্ষণ না কিয়ামত চলে আসে আর আল্লাহর ওয়াদা পূর্ণ হয়।
ঘোড়ার অগ্রচুলের সাথে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত কল্যাণ বাঁধা রয়েছে। আমার নিকট এটা জানানো হয়েছে যে আমি মৃত্যুবরণ করব এবং বেশিদিন থাকব না, আর তোমরা এক দলের পর আরেক দল আমাকে অনুসরণ করবে, একে অপরের গর্দানে মারতে থাকার মাধ্যমে।
আর মুমিনদের জন্য নিরাপদ জায়গা হল আশ-শাম। [৯]
حَدَّثَنَا الْوَلِيدُ بْنُ شُجَاعٍ، وَهَارُونُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، وَحَجَّاجُ بْنُ الشَّاعِرِ، قَالُوا حَدَّثَنَا حَجَّاجٌ، – وَهُوَ ابْنُ مُحَمَّدٍ – عَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ، قَالَ أَخْبَرَنِي أَبُو الزُّبَيْرِ، أَنَّهُ سَمِعَ جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ، يَقُولُ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ” لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ – قَالَ – فَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ صلى الله عليه وسلم فَيَقُولُ أَمِيرُهُمْ تَعَالَ صَلِّ لَنَا . فَيَقُولُ لاَ . إِنَّ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ أُمَرَاءُ . تَكْرِمَةَ اللَّهِ هَذِهِ الأُمَّةَ “
আল ওয়ালীদ ইবন শুজা, হারুন ইবন আবদুল্লাহ ও হাজ্জাজ ইবন শাইর (রহিমাহুল্লাহ)… জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রদিআল্লাহু আ’নহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে ﷺ বলতে শুনেছি,
কিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মাতের একদল হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে বাতিলের বিরুদ্ধে কিতাল করতে থাকবে এবং অবশেষে হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম) অবতরণ করবেন। মুসলমানদের আমির বলবেন, আসুন, নামাযে আমাদের ইমামতি করুন! উত্তর দিবেনঃ না, আপনাদেরই একজনকে অন্যদের জন্য আমির নিতে হবে। এ হল এ উম্মাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত সম্মান। [১০]
وَحَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى، وَمُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ، قَالاَ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ، حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، عَنْ سِمَاكِ بْنِ حَرْبٍ، عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ قَالَ ” لَنْ يَبْرَحَ هَذَا الدِّينُ قَائِمًا يُقَاتِلُ عَلَيْهِ عِصَابَةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ ” .
মুহাম্মদ ইবন মুসান্না ও মুহাম্মদ ইবন বাশশার (রহিমাহুল্লাহ)……জাবির ইবন সামুরা (রদিআল্লাহু আ’নহু) থেকে বর্ণিত যে, নবী ﷺ বলেছেন, “এই দ্বীন (ইসলাম) সর্বদা কায়েম থাকবে। মুসলমানদের একটি দল এর পক্ষে কিতাল করতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। [১১]
حَدَّثَنِي هَارُونُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، وَحَجَّاجُ بْنُ الشَّاعِرِ، قَالاَ حَدَّثَنَا حَجَّاجُ بْنُ مُحَمَّدٍ، قَالَ قَالَ ابْنُ جُرَيْجٍ أَخْبَرَنِي أَبُو الزُّبَيْرِ، أَنَّهُ سَمِعَ جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ، يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ” لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ “
হারুন ইবন আব্দুল্লাহ ও হাজ্জাজ ইবন শাঈর (রহিমাহুল্লাহ)… জাবির ইবন আব্দুল্লাহ রদিআল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহকে ﷺ বলতে শুনেছি, আমার উম্মাতের একটি জামায়াত সর্বদাই সত্যের স্বপক্ষে কিতাল করতে থাকবে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত। [১২]
.
وَحَدَّثَنِي إِسْحَاقُ بْنُ مَنْصُورٍ، أَخْبَرَنَا كَثِيرُ بْنُ هِشَامٍ، حَدَّثَنَا جَعْفَرٌ، – وَهُوَ ابْنُ بُرْقَانَ – حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ الأَصَمِّ، قَالَ سَمِعْتُ مُعَاوِيَةَ بْنَ أَبِي سُفْيَانَ، ذَكَرَ حَدِيثًا رَوَاهُ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم لَمْ أَسْمَعْهُ رَوَى عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم عَلَى مِنْبَرِهِ حَدِيثًا غَيْرَهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ وَلاَ تَزَالُ عِصَابَةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ عَلَى مَنْ نَاوَأَهُمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ “
ইসহাক ইবন মানসূর (রহিমাহুল্লাহ)… ইয়াযিদ ইবন আসাম বলেন, আমি মুয়াবিয়া ইবন আবু সুফিয়ান (রদিআল্লাহু আ’নহু)-কে এমন একটি হাদিস নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করতে শুনেছি যা ছাড়া নবী ﷺ এর বরাতে অন্য কোন হাদিস মিম্বরের উপর থেকে বলতে তাঁকে আমি শুনিনি । তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দীনের বুৎপত্তি দিয়ে থাকেন এবং মূসলামনদের একটি দল সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে কিতাল করবে। যারা তাদের প্রতি বিরুপ, ভাব পোষণ করবে তাদের বিরুদ্ধে থাকার তারা তাদের উপর বিজয়ী থাকবে। কিয়ামত অবধি এভাবে চলতে থাকবে।” [১৩]
ইবন উমার বলেন, আমি রাসূলুল্লাহকে ﷺ বলতে শুনেছি, যখন তোমরা আই’নাহতে (রিবাহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসা বা লেনদেন) লিপ্ত হয়ে যাবে, আর তোমরা গরুর লেজ ধরে থাকবে আর কৃষিকাজে তৃপ্ত হয়ে যাবে, এবং যখন তোমরা জিহাদকে ছেড়ে দিবে, তখন আল্লাহ তোমাদের লাঞ্ছিত করবেন আর তা তোমাদের উপর থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে না যতক্ষণ না তোমরা দ্বীনে ফিরে যাও। [১৪]
حَدَّثَنِي أَحْمَدُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ وَهْبٍ، حَدَّثَنَا عَمِّي عَبْدُ اللَّهِ بْنُ وَهْبٍ، حَدَّثَنَا عَمْرُو بْنُ الْحَارِثِ، حَدَّثَنِي يَزِيدُ بْنُ أَبِي حَبِيبٍ، حَدَّثَنِي عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ شُمَاسَةَ الْمَهْرِيُّ، قَالَ كُنْتُ عِنْدَ مَسْلَمَةَ بْنِ مُخَلَّدٍ وَعِنْدَهُ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ إِلاَّ عَلَى شِرَارِ الْخَلْقِ هُمْ شَرٌّ مِنْ أَهْلِ الْجَاهِلِيَّةِ لاَ يَدْعُونَ اللَّهَ بِشَىْءٍ إِلاَّ رَدَّهُ عَلَيْهِمْ . فَبَيْنَمَا هُمْ عَلَى ذَلِكَ أَقْبَلَ عُقْبَةُ بْنُ عَامِرٍ فَقَالَ لَهُ مَسْلَمَةُ يَا عُقْبَةُ اسْمَعْ مَا يَقُولُ عَبْدُ اللَّهِ . فَقَالَ عُقْبَةُ هُوَ أَعْلَمُ وَأَمَّا أَنَا فَسَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ” لاَ تَزَالُ عِصَابَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى أَمْرِ اللَّهِ قَاهِرِينَ لِعَدُوِّهِمْ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَالَفَهُمْ حَتَّى تَأْتِيَهُمُ السَّاعَةُ وَهُمْ عَلَى ذَلِكَ ” . فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ أَجَلْ . ثُمَّ يَبْعَثُ اللَّهُ رِيحًا كَرِيحِ الْمِسْكِ مَسُّهَا مَسُّ الْحَرِيرِ فَلاَ تَتْرُكُ نَفْسًا فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنَ الإِيمَانِ إِلاَّ قَبَضَتْهُ ثُمَّ يَبْقَى شِرَارُ النَّاسِ عَلَيْهِمْ تَقُومُ السَّاعَةُ
আহমাদ ইবন আবদূর রাহমান ইবন ওহাব (রহিমাহুল্লাহ) … আবদুর রাহমান ইবন শামাসাহ (রদিআল্লাহু আ’নহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি মাসলামা ইবন মুখাল্লাদ (রদিআল্লাহু আ’নহু)-এর কাছে বসা ছিলাম। তখন আব্দুল্লাহ (রদিআল্লাহু আ’নহু) বললেন, কিয়ামত কেবল তখনই কায়েম হবে যখন নিকৃষ্টতম লোকরা থাকবে। ওরা জাহেলিয়াত সম্প্রদায়ের লোকদের চাইতেও নিকৃষ্টতর হবে। তারা আল্লাহর কাছে যে বস্তুর জন্যই দোয়া করবে তিনি তা প্রত্যাখান করবেন।
তারা যখন এ আলোচনায় ছিলেন এমন সময় উকনা ইবন আমির (রদিআল্লাহু আ’নহু) সেখানে এলেন। তখন মাসলামা (রদিআল্লাহু আ’নহু) বললেন, হে উকবা, শুনুন, আব্দুল্লাহ কি বলেছেন?
তখন উকবা (রদিআল্লাহু আ’নহু) বললেনঃ, তিনি তা ভাল জানেন। তবে আমি রাসুলুল্লাহকে ﷺ বলতে শুনেছি যে, আমার উম্মাতের একটি দল আল্লাহর বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে কিতাল করে যাবে। তারা তাদের শক্রদের মোকাবিলায় অত্যন্ত বজ্র কঠোর হবে। যারা বিরোধিতা করবে, তারা তাদের কোন অনিষ্ট করতে পারবে না। এভাবে চলতে চলতে তাদের নিকট কিয়ামত এসে যাবে আর তাঁরা এর উপরই প্রতিষ্ঠিত থাকবে।” আব্দুল্লাহ (রদিআল্লাহু আ’নহু) বললেন, হ্যাঁ। তারপর আল্লাহ একটি বায়ু প্রবাহ প্রেরণ করবেন, সে বায়ু প্রবাহটি হবে কারীর সূঘ্রাণের ন্যায়। [১৫]
এত এত সহীহ হাদিস সেদিকটাতেই নির্দেশ করে যে সংশয় সন্দেহের দোহাই দিয়ে বসে থাকা মানহাজ হক দল হতে পারে না। আর এই হাদিসগুলো কুরআনের জিহাদসংক্রান্ত আয়াতগুলোরও সাধারণভাবে কিয়ামত পর্যন্ত প্রযোজ্য হওয়ার নির্দেশক। কুরআনেই আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন উল্লেখ করেছেন –
হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, অচিরেই আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি হবে কঠোর। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী, মহাজ্ঞানী।” (সূরা মায়িদাহ, ৫৪)
তাই আসলে এই ব্যাপারে পবিত্র ইখলাসের মানুষেরা বসে থাকতে পারেন না। তাদের ইখলাস পবিত্র হলে তো আল্লাহ তাদের বসিয়ে রাখতেন না। বরং তারা সংশয় সন্দেহে ডুবে থাকতে চায়, দ্বীনে প্রবেশ করেও প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে চায় বলেই আল্লাহ তাদের অন্তরের ব্যাধিকে বাড়িয়ে দেন।
এবং যাতে তাদেরকে শনাক্ত করা যায়, যারা ছিল মুনাফিক। আর তাদেরকে বলা হল এসো, আল্লাহর রাহে কিতাল কর কিংবা (অন্তত) শত্রুদিগকে প্রতিহত কর। তারা বলেছিল, আমরা যদি একে লড়াই বলেই জানতাম, তাহলে অবশ্যই তোমাদের সাথে থাকতাম। সেদিন তারা ঈমানের তুলনায় কুফরীর কাছাকাছি ছিল। যা তাদের অন্তরে নেই তারা নিজের মুখে সে কথাই বলে বস্তুতঃ আল্লাহ ভালভাবে জানেন তারা যা কিছু গোপন করে থাকে।” (সূরা আল-ইমরান, ১৬৭)
তারা কি জাহেলী আইন ও শাসন চায়? বিশ্বাসী কওমের জন্য আল্লাহর আইন ও শাসনের চেয়ে আর কার আইন ও শাসন উত্তম হতে পারে?” (আল- মায়েদাহ: ৫০)
বস্তুতঃ যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, তাদেরকে আপনি দেখবেন, দৌড়ে গিয়ে তাদেরই মধ্যে প্রবেশ করে। তারা বলেঃ আমরা আশঙ্কা করি, পাছে না আমরা কোন দুর্ঘটনায় পতিত হই। অতএব, সেদিন দুরে নয়, যেদিন আল্লাহ তা’আলা বিজয় প্রকাশ করবেন অথবা নিজের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ দেবেন-ফলে তারা স্বীয় গোপন মনোভাবের জন্যে অনুতপ্ত হবে। (সূরা মায়িদাহ, ৫২)
আর যদি তারা বের হবার সংকল্প নিত, তবে অবশ্যই কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করতো। কিন্তু তাদের উত্থান আল্লাহর পছন্দ নয়, তাই তাদের নিবৃত রাখলেন এবং আদেশ হল বসা লোকদের সাথে তোমরা বসে থাক।” (সূরা তাওবা, ৪৬)
ছয়.
সুস্পষ্ট এই দ্বীনে প্রবৃত্তির ধোঁকায় পতিত হয়ে মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হয়। আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের দেওয়া কিছু ভয়ঙ্কর নিআ’মত রয়েছে। এই নিআ’মতগুলো জায়েজ তো বটেই কখনও আবার ওয়াজিব পর্যায়েরও বটে। যেমনঃ মা-বাবা, স্ত্রী সন্তানদের ভালবাসা ও তাদের হক আদায় ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো ভয়ঙ্কর নিআ’মত একারণেই যে স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনই কুরআনে বারবার এই নিআ’মতগুলো সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। সতর্ক করে দিয়েছেন কারণ এগুলো জায়েজ বিষয় বলেই মানুষকে খুব সহজেই আরো বড় ফারজিয়্যাত থেকে গাফেল করে রাখতে পারে।
আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন বলেন –
“মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা মুনাফিকুন, )
“(হে নবী আপনি) বলে দিন, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, সন্তান, ভাই, পত্নী, গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, ব্যবসা যা তোমরা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান-যাকে তোমরা পছন্দ কর – আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়েত করেন না।” (সূরা তাওবাহ, ২৪)
সুবহান-আল্লাহ! লক্ষ্য করুন স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামীন যে বিষয়গুলো থেকে সাবধান করছেন তার কোনোটিই নাজায়েজ কিছু নয়। কিন্তু তিনি সীমারেখা দিয়ে দিলেন। আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে প্রিয় হওয়া যাবে না কোনোকিছুই, আর বিশেষ করে উপরোক্ত আয়াতের আটটি বিষয় যেগুলো কিনা জায়েজ বিষয়াদি! কত মানুষই না দ্বীনে আসার পরও প্রবৃত্তির ছলনায় এমনসব জায়েজ ফিতনায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে! আর উম্মতের এহেন পরিস্থিতেতেও ব্যক্তিগত পর্যায়ের ইবাদাতে সীমাবদ্ধ থেকে ‘বসে থাকা’ মানহাজেই সন্তুষ্ট হয়ে পড়েছে! অবাক হই, ১৪০০ বছরের আগের কুরআন কি অবিকলভাবে মানুষের এমন স্বভাবগুলো বর্ণনা করে –
আপনি কি সেসব লোকদের দেখেন নি, যাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তোমরা নিজেদের হাতকে সংযত রাখ, নামায কায়েম কর এবং যাকাত দিতে থাক? অতঃপর যখন তাদের প্রতি জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হল, তৎক্ষণাৎ তাদের মধ্যে একদল লোক মানুষকে ভয় করতে আরম্ভ করল, যেমন করে ভয় করা হয় আল্লাহকে। এমন কি তার চেয়েও অধিক ভয়। আর বলতে লাগল, ‘হায় পালনকর্তা, কেন আমাদের উপর যুদ্ধ ফরজ করলে! আমাদেরকে কেন আরও কিছুকাল অবকাশ দান করলে না।’
(হে রাসূল) তাদেরকে বলে দিন, পার্থিব ফায়দা সীমিত। আর পরহেযগারদের জন্য তো আখিরাতই উত্তম। আর তোমাদের প্রাপ্য এক সুতা পরিমাণও খর্ব করা হবে না।”
(সূরা নিসা, ৭৭)

শেষকথা

যে পদস্খলনগুলো নিয়ে আলোচিত হল তা মুমিনদের দ্বীনে আসার পরের ফিতান, যেগুলোর সবগুলোই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রবৃত্তি উৎসরিত। কিন্তু দ্বীনে প্রবেশের পর যাদের মাধ্যমে দাওয়াত পাওয়া, নিজেদের সার্কেল-জামাতের বা ভাললাগা শায়খদের অন্ধভক্তি, জায়েজ কিন্তু ভয়ঙ্কর নিআমতগুলোর ফিতানে ডুবে থেকে অবচেতনভাবেই পদস্খলন হয়ে যায়। একমাত্র ‘আল্লাহর রাহে’ ‘আল্লাহর দ্বীন’ পালন না করে কোন ‘প্রবৃত্তিজাত কারণে’ ‘প্রবৃত্তি উৎসরিত’ মনগড়া দ্বীন পালন করা হয় অহরহ। আর যারা জেনেশুনেও দ্বীনের বাছাই করে নেওয়া অংশগুলো পালন করে যায় তারা তো ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গিয়েছে।
তারা কি জাহেলি আইন ও শাসন চায়? বিশ্বাসী কওমের জন্য আল্লাহর আইন ও শাসনের চেয়ে আর কার আইন ও শাসন উত্তম হতে পারে? (আল-মায়িদাহ, ৫০)
হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ মান্য কর এবং শোনার পর তা থেকে বিমুখ হয়ো না। আর তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা বলে যে, আমরা শুনেছি, অথচ তারা শোনেনা।” (সূরা আনফাল, ২০-২১)
আল্লাহ আমাদের হিদায়াতকে বৃদ্ধি করে দিন। আমাদেরকে প্রবৃত্তির যাবতীয় ধোঁকা থেকে হিফাজত করে সিরতল মুস্তাকিমে, মিল্লাতু ইবরাহিমে অটল থাকার তাওফিক দিন। আল্লাহ আমাদের সত্য বোঝার, মেনে নেওয়ার ও মেনে চলার তাওফিক দিন। আল্লাহ আমাদের তাঁর সর্বোত্তম বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করুন এবং শাহাদাতের সফলতা অর্জনের তাওফিক দিন।।
টিকা ও রেফারেন্স –
[১] আরও বিস্তারিত জানার জন্য অপ্রমাণ্যের প্রমাণ পঠিতব্য।
[২] মাজমূউল ফাতওয়া, ১২/২৫১
[৩] বইটির লিঙ্ক পেলে অ্যাড করে দেওয়া হবে ইন-শা-আল্লাহ। শায়খের বইটির সংক্ষেপিত রূপ ‘তাকফিরঃ প্রচলিত ভুলসমূহ’ ও প্রাথমিক জ্ঞানের জন্য উত্তম হতে পারে।
[৪] আবু দাউদ, নং-২৮৫৯, সুনান তিরমিযী নং-২২৫৬
[৫] ইমাম বুখারী (রদিআল্লাহু আ’নহু) কর্তৃক ‘আত-তারিখ’ গ্রন্থে সংকলিত
[৬] ইবনে আবী শাইবাহ কর্তৃক সংগৃহীত
[৭] শুয়াবুল ঈমান, ৪৯৭২, জামি লি আখলাকির রাওয়ী ওয়া আদাবীস সামী, পৃ. ১৪। ইমাম যাহাবী (র.) এর সনদকে সহীহ বলেছেন। দেখুন সিয়ারাল আলামুন নুবালা ১৩/৫৮৬। এছাড়াও সালিম হিলালী একে সহীহ বলেছেন।
[৮] শুয়াবুল ঈমান, ইমাম বাইহাকী
[৯] সুনান আন-নাসাঈ ৩৫৬১, বই ২৮, হাদিস নং ১
[১০] সহিহ মুসলিম, বই ১, হাদিস নং ২৯৩/ ২৯২ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
[১১] সহিহ মুসলিম, বই ২০, হাদিস নং ৪৭১৭/ ৩৮০১ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
[১২] সহিহ মুসলিম, বই ২০, হাদিস নং ৪৭১৮/ ৪০৮২ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
[১৩] সহিহ মুসলিম, বই ২০, হাদিস নং ৪৭২০/ ৪৮০৩ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
[১৪] আবু দাঊদ ৩৪৬২, আলবানি (রহিমাহুল্লাহ) হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন
[১৫] সহিহ মুসলিম, বই ২০, হাদিস নং ৪৭২১/ ৪৮০৪ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
লেখক-তানভীর আহমেদ
Facebook Comments