8.3 C
New York
Friday, October 24, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 18

আল্লামা আতহার আলী রহ., চেতনার বাতিঘর এক মহান পুরুষ

যুবায়ের আহমাদঃ একটি জাতির পরিবর্তনের জন্য দরকার একজন নেতা। মুসা আ. বনি ইসরাঈলে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, ইবরাহিম আ. নমরূদের মসনদে আঘাত হেনে আল্লাহর বড়ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তেমনি একজন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্ব মানবতার ভাগ্যে পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় মুহাম্মদ বিন কাসিম তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে এই উপমহাদেশের মানুষকে আত্মিক মুক্তির সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। একজন তিতুমীরের ডাকে বাংলার নিপীড়িত মজলুম জনতা ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো।

মানুষ শিক্ষিত হয় মানুষের জন্য। জ্ঞানার্জনের পরই একজন মানুষ স্বজাতির কাছে ঋণী হয়। পথহারা মানুষের পাশে দাঁড়াতে। বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশ ও জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ পরলৌকিক মুক্তির পথকে সুগম করার সামাজিক দায়বদ্ধতা চেপে বসে শিক্ষিত মানুষের ঘাড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশে যে ক’জন মনিষী এ ঋণ নিঃস্বার্থভাবে শোধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাদেরই একজন মাওলানা আতহার আলী রহ.।

ইতিহাসের এ কিংবদন্তি ১৮৯১ সালে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার ঘুঙ্গাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই গ্রামের মক্তবে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। প্রাথমিক শিক্ষা ঝিঙ্গাবাড়ি আলিয়া মাদরাসা ও বেশ ক’জন বুজুর্গ আলেমের কাছে সম্পন্ন করে মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য ভারতে যান। মাদরাসায়ে কাসেমিয়া শাহি মুরাদাবাদ, মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর এবং সর্বশেষ মাদরাসায়ে আলিয়া রামপুরে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন এবং অত্যন্ত কৃতিত্যের সঙ্গে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। তার শিক্ষকদের মধ্যে যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী ও শাইখুল ইসলাম আল্লামা শিব্বির আহমাদ উসমানী রহ. অন্যতম।

শিক্ষা সমাপনান্তে মাওলানা আতহার আলী রহ. আত্মশুদ্ধি লাভের জন্য হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবীর রহ. পবিত্র হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। মুরশিদের সান্নিধ্যে থেকে কঠোর পরিশ্রম ও মুজাহাদার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির স্তরসমূহ অতিক্রম করে খুব অল্প সময়ে তার খেলাফত লাভে ধন্য হন।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী এ মহান আলেম স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর নিজ গ্রামে ইলমে হাদিস শিক্ষাদান শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যে যোগ্যতার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে তিনি সিলেট জেলার প্রাচীন ও বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঝিঙ্গাবাড়ি আলিয়া মাদরাসার প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। দেশের বিভিন্ন মাদরাসা থেকে তাঁর কাছে আমন্ত্রণ আসতে থাকে। অবশেষে কুমিল্লা জামিয়া মিল্লিয়াতে মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি যেমন ছিলেন দক্ষ ও সুযোগ্য তেমনি তার ব্যক্তিত্ব ছিলো বিশাল ও গুরুগম্ভীর। এ কারণেই ছাত্রসমাজে তিনি যেমন ছিলেন প্রিয়পাত্র, মাদরাসার ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছেও ছিলেন সম্মানিত।

পরে স্বীয় মুরশিদের নির্দেশে কিশোরগঞ্জের বৌলাই জমিদার বাড়িতে শুভাগমন করে তথায় দাওয়াত ও আত্মশুদ্ধির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তৎকালীন সময়ে বৌলাই জমিদার বাড়ি ছিলো ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র। পরবর্তিতে কিশোরগঞ্জের হয়বতনগরের জমিদার মরহুম দেওয়ান মান্নান দাদ খানের অনুরোধে হয়বতনগর তাশরিফ আনেন এবং দাওয়াত ও দীনি কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখেন। অল্প সময়েই সর্বজন শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু এখানে একটি অনৈসলামিক কাজ সংঘটিত হওয়ায় তিনি মর্মাহত হয়ে নিজ বাড়ির দিকে রওয়ানা করেন। পথিমধ্যে তার কিছু ভক্তের অনুরোধে কিশোরগঞ্জ শহরের পুরান থানা মসজিদে সাময়িক অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য নিজ মুরশিদ বরাবর পত্র লিখেন এবং মুরশিদের নির্দেশে এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। এখান থেকেই তার কর্মবহুল জীবনের সূত্রপাত ঘটে।

কিশোরগঞ্জবাসীর অনুরোধে তিনি পুরান থানার যে মসজিদটির ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তা ছিলো অত্যন্ত ছোটো। তার আগমনে মুসল্লিদের মধ্যেও অভূতপূর্ব সাড়া পড়লো। তাঁর ইবাদত, জাগরণ এবং শেষ রাতের কান্নাকাটি এতদঞ্চলে এক আশ্চর্যজনক প্রভাব ফেললো। ভ্রান্ত বিশ্বাসের অনুসারীরাও সঠিক পথের সন্ধান পেতে লাগলো। সূচনা হলো এক বিপ্লবের। মাত্র দশ টাকা পুঁজি নিয়েই তিনি পুরান থানা মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করেন। পাল্টে যায় মসজিদের চেহারা,বিশাল এক মসজিদে রূপ নেয় পুরানথানা মসজিদ। এ মসজিদ কেন্দ্রিক এ এলাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। পরবর্তিতে উগ্র হিন্দুরা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে মূর্তিসহ মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তওহিদি জনতা মসজিদের মর্যাদা রক্ষার্থে বাধা দেন। ওই সময় পুলিশের গুলিতে একাধিক মুসল্লি শহিদ হন। তখন থেকে এ মসজিদ শহিদী মসজিদ নামে খ্যাতি লাভ করে।

মসজিদকেন্দ্রিক চতুর্দিকে আতহার আলীর রহ. খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো। তিনি একটি আধুনিক দীনি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের সংকল্প করলেন। নিঃসন্তান এক ব্যাক্তি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা দান করেন এবং নিজ খরচে রেজিষ্ট্রিকরে দেন। অল্প দিনের মধ্যেই আল্লাহ তাকে সন্তানের পিতা হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন।

১৯৪৫ সালের নভেম্বর মাসে তাঁর প্রধান খলিফা মাওলানা আহমদ আলী খানকে রহ. প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করে জামিয়া ইমদাদিয়া নিয়ে আরেক সংগ্রাম শুরু করেন। তার ইঙ্গিতে হাজারো জনতা মাদরাসা-মসজিদের জন্য জান-মাল কুরবানি দেয়াকে গৌরবের বিষয় মনে করতে লাগলো। গ্রামে-গঞ্জে ব্যাপক সাড়া পড়লো। মাওলানা আতহার আলীর রহ. কথা বললে দূর-দূরান্তের মানুষও বস্তা ভর্তি ধান, জমির ফসল,বাঁশ সাধ্যমতো দিতে শুরু করলো। যার ফলশ্রুতিতে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নতিও পরিলক্ষিত হলো। বিভিন্ন দালান কোঠার কাজ এতো দ্রুতগতিতে শুরু হলো যে, মানুষ অনুমান করতে পারছিলো না এসব কী হচ্ছে!

পাল্টে গেলো কিশোরগঞ্জ শহরের চিত্র। শহরের প্রাণকেন্দ্রে শোভা পাচ্ছিলো বিশাল বিশাল অট্টালিকা। দক্ষিণ পার্শ্বের বিল্ডিংটি ছিলো শহরের মূল সড়ক ঘেঁষে; যা এতো দ্বীর্ঘ ও উঁচু ছিলো যে বহুদিন পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ শহরে এর নজির ছিলো না। চারতলা বিশিষ্ট বিল্ডিং-এর ঠিক মাঝখানে ছিলো তাফসির ক্লাসের জন্য পঞ্চম তলা। তাঁর উদ্দেশ্য যেহেতু শুধু একটি মাদরাসা স্থাপনেই সীমাবদ্ধ ছিলো না তাই অল্প দিনের ব্যবধানেই তিনি এই ছোট্ট মাদরাসাটিকে ‘জামিয়া’ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করেন।  একটি দীনি মহাকেন্দ্র হিসেবে রূপদিতে ভবনের চেয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর প্রয়োজনও যেহেতু কম নয় তাই তিনি জাহেরি নির্মণকাজের পাশাপাশি বিখ্যাত,স্বনামধন্য, যোগ্যতাসম্পন্ন, নানা বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষক সংগ্রহে ব্রতী হোন।

যেখানেই কোনো অভিজ্ঞ শিক্ষকের সন্ধান পেতেন সেখানেই তাঁর প্রতিনিধি পাঠিয়ে তাকে জামিয়ায় আনার চেষ্টা করতেন। এমনকি দারুল উলুম দেওবন্দ, জামিয়া ইসলমিয়া করাচীতে অধ্যয়নরত মেধাবী, যোগ্য ছাত্রদেরকে পড়াশুনা শেষে জামিয়াতে পাঠিয়ে দেবার অনুরোধ করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় সায়্যিদ আবদুল আহাদ কাসেমী রহ.,মাওলানা আশরাফ আলী (কুমিল্লা), মাওলানা কুতুব উদ্দিন (সিলেট), মাওলানা খলিলুর রহমান (বরিশাল), মাওলানা মুহিবক্ষুর রহমান (সিলেট), মাওলানা আবদুর রব (সিলেট), মাওলানা রহমতুল্লাহ (সিলেট), মাওলানা কাজী মু‘তাসিম বিল্লাহ (বর্তমানে মালিবাগ), মাওলানা যুবায়ের, মাওলানা আবদুল হক-এর মতো অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর সমাবেশ ঘটেছিলো জামিয়ায়।

জাতীয় জীবনে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে আজ আমরা যেসব বিষয় নিয়ে ভাবছি মাওলানা আতহার আলী রহ. অর্ধশতাব্দী আগেই সেসব বিষয়ে চিন্তা করেছিলেন এবং কাজ শুরু করেছিলেন। জামিয়াকে বিভিন্ন বিভাগে সাজিয়েছিলেন। কর্মমূখী শিক্ষার কথা চিন্তা করে লেখাপড়া শেষে ছাত্ররা যেনো আত্মকর্মসংস্থান করতে পারে সেজন্য তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তন্মধ্যে অনুবাদ ও রচনা বিভাগ। এ বিভাগের অধীনে লেখালেখিতে আগ্রহী শিক্ষকমণ্ডলী ও যোগ্য ছাত্রদেরকে অনুবাদ ও রচনার সুযোগ করে দেয়া হয়।

পৃথক দাওয়াত ও তাবলিগ বিভাগের মাধ্যমে বাংলা এবং উর্দু ভাষায় পৃথক  দ্বিমাসিক পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। বস্ত্রশিল্প বিভাগ। জ্ঞানার্জনের পর শিক্ষার্থীরা যেনো জীবিকার নির্বাহে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠতে পারে সেজন্য এ বিভাগের আওতায় শিক্ষার্থীদেরকে উইভিং, নিটিং, টেইলারিং, বাইন্ডিংসহ বিভিন্ন প্রকারের কাপড় তৈরি ও সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো।

চিকিৎসা বিভাগ। ১৯৫৯ সালে ইসলামি চিকিৎসার মানোন্নয়নে এ বিভাগ খোলা হয়। পরিসংখ্যান বিভাগ। ভূমি জরিপ (আমিনশীপ) ও বিভিন্ন জরিপ শেখােেনা হতো এ বিভাগের মাধ্যমে। টেলিগ্রাম ও টাইপরাইটিং বিভাগ। তৎকালীন সময়ে যেহেতু কম্পিউটারের অস্তিত্ব ছিলো না তাই এ বিভাগটি আধুনিক বিষয়সমূহের অন্যতম ছিল। ব্যাপক চাহিদা থাকায় এ মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন সহজ ছিলো।

কিন্তু স্বাধীনতার পর কারিগরি ও হস্তশিল্পের অধিকাংশ বিভাগ বন্ধ হয়ে যায়।

আতহার আলী রহ. শহিদী মসজিদের পাঁচতলা মিনারার একেক তলাকে একেকটি কাজের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন। ১৩৬৪(বাংলা) সালের ৮ কার্তিক শহিদী মসজিদের ৫তলা বিশিষ্ট বিশাল মিনারা স্থাপন করা হয়। এর ১ম তলা লাইব্রেরি, ২য় তলা পাঠাগার, ৩য় তলা রচনালয়, ৪র্থ তলা সুধীর আসরের জন্য নির্ধারণ করেন। আজও সেই সুউচ্চ মিনার তাঁর অমর কীর্তির বিমূর্ত প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

তৎকালীন পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রণালয়ের উপদেষ্ঠা আবদুল হক ফরিদী বলেছিলেন আমি আমার চাকুরী জীবনে অনেক দীনি মাদরাসা দেখেছি, কিন্তু নিছক দীনি শিক্ষার পাশাপাশি জাগতিক শিল্প কারিগরির সংমিশ্রণ, যা এ প্রতিষ্ঠানে দেখেছি তা অন্য কোথাও আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি।’

কোনো মতবাদকে প্রতিষ্ঠা গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আজ আমরা পদে পদে তা অনুভব করছি, কিন্তু আতহার আলী রহ. সে প্রয়োজনীয়তা অর্ধশতাব্দী আগেই তা অনুভব করেছেন। তিনি সে সময়ে দৈনিক নাজাত ও সাপ্তাহিক নেজামে ইসলাম নামে দুটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন।

শহিদী মসজিদকে কেন্দ্র করে যখন তিনি ধর্মীয় ও সংস্কার কাজে ব্যস্ত ঠিক তখনই পাকিস্তান আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে তিনি স্বীয় শিক্ষক আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানীর রহ. নির্দেশে এ মসজিদ থেকেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করেন। ১৯৫৩ সালে দেশের খ্যাতনামা আলেম ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে ‘নেজামে ইসলাম’ নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এ মসজিদ থেকেই ইসলামি আন্দোলনের ফর্মূলা তৈরি হতো এবং তা দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছাতো। এখান থেকেই তিনি প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের এমএনএ এবং এমপি নির্বাচিত হন।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষকপ্রজা পার্টি  ও নেজামে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ নির্বাচনে নেজামে ইসলাম জাতীয় এ্যসেম্বলীতে ৪টি এবং প্রাদেশিক এ্যসেম্বলীতে ৩৬টি আসন লাভ করে ১৯৫৪-৫৬ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেন্দ্রীয় এ্যসেম্বলীর স্পীকার ও ১জন মন্ত্রী  এবং প্রাদেশিক এ্যসেম্বলীর ৩জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী নিযুক্ত হন নেজামে ইসলাম পার্টি থেকে। আতহার আলী রহ. নিজে মন্ত্রী না হয়ে অনেককেই মন্ত্রীত্বের আসনে বসিয়েছেন। ১৯৫৬ সালে সংবিধানে যে ইসলামি ভাবধারা সৃষ্টি হয়েছিলো তা তাঁরই চেষ্টার ফল ছিলো।

তিনি জামিয়ায় বাংলা ভাষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে মাতৃভাষা শিক্ষার ওপর এতোই জোর দিয়েছিলেন যে, অনেকে ভুল ধারণায় তাঁকে এমন দোষারোপও করছিলেন, তিনি জামিয়াকে কলেজে রূপান্তর করে ফেলেছেন!

১৯৫২ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ  কিশোরগঞ্জের হয়বতনগরে অনুষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ঐতিহাসিক সম্মেলনে যেসব প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছিল তার অন্যতম ছিলো, ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হোক।’শুধু দাবি হিসেবেই সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং করাচীতে পশ্চিম পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টি গঠনের সময় পার্টির সংবিধানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আদর্শগত ঘোষণা সংযোজন করেছিলেন। ফলে এটাই সত্য প্রমাণিত হয় যে,তিনিই ছিলেন অবিভক্ত পাকিস্তানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপনকারী প্রথম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

আতহার আলীকে রহ. আধুনিক কিশোরগঞ্জের স্থপতি বললেও ভুল হবে না। কিশোরগঞ্জ শহরের বিদ্যুৎ, পানি, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও পাকা রাস্তা ঘাটের ভিত্তিপ্রস্তর তাঁরই অমর কীর্তির নিদর্শন। জামিয়া ইমদাদিয়া পোস্ট অফিসও তার এক কীর্তি।

তৎকালীন সময়ে কওমি মাদরাসার সংখ্যা ছিলো প্রায় ত্রিশ হাজার। তিনিই সর্বপ্রথম মাদরাসাগুলোর ঐক্য, পাঠ্য তালিকায় সমন্বয় ও উদ্দেশ্য সফল করার লক্ষ্যে ব্যাপক তৎপরতা চালান। তাঁর ডাকে ১৯৬২ সালে ‘মু‘তামারে মাদারিসে ইসলামিয়া কওমিয়া,পুর্ব পাকিস্তান’ নামে একটি বোর্ড গঠন করেন। যার সদর দপ্তর ছিলো জামিয়া ইমদাদিয়ায়। সংগঠনটি কিছুদিন পর নানা সমস্যার কারণে কার্যক্রমহীন হয়ে পড়ে। এ স্বপ্নের ফলশ্রুতিতেই পরে দাঁড় হয় বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ।

জীবনের শেষভাগে ময়মনসিংহ শহরের চরপাড়া মোড়ের দারুল উলুম নামের ছোট্ট প্রতিষ্ঠানকে খুব অল্প সময়েই জামিয়া (বিশ্ববিদ্যালয়) স্তরে উন্নীত করে কয়েক কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেন। বিদ্যুৎ বেগে চলে কাজ; কয়েক লক্ষ টাকার কাজ হতে না হতেই চির বিদায়ের ডাক এসে পড়ে তাঁর। ইসলামি শিক্ষা ও আন্দোলনের এ পুরোধা ১৯৭৬-এর ৬ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন।

আল কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

কোয়ান্টাম মেথড ঈমান বিধ্বংসী মতবাদ – মুফতী মনসূরুল হক দা.বা.

মুফতী মনসূরুল হক দা.বা. আল্লাহকে পাওয়ার জন্য, আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করার জন্য মুরাকাবা বা ধ্যান ইসলামে একটি স্বীকৃত বিষয়। অন্য ধর্মের ধর্মগুরুরাও নিজ আত্মার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ধ্যান করে থাকে। হিন্দুদের যোগধ্যান ও বৌদ্ধদের বিপাসনধ্যান এর অন্যতম। তবে ইসলামের মুরাকাবা বা ধ্যান এবং অন্য ধর্মের পন্ডিতদের ধ্যানের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে। কারণ ইসলামের মুরাকাবার উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভ করা, আর হিন্দু যোগী বা বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের ধ্যানের উদ্দেশ্য হলো, আত্মার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুনিয়াবী কিছু ফায়দা হাসিল করা।

পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা মুরাকাবার মৌলিক বিষয়গুলোর উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখতে পেলেন যে, ধ্যানের মাধ্যমে অন্তরে যে বিষয় গেঁথে দেওয়া হয়, সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্তরের বিশ্বাস অনুযায়ী সে বিষয়ে সাড়া দেয়। 

তারা ৬০/৭০ দশকে ধ্যানের উপর ব্যাপকভাবে গবেষণা করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, মানসিক ও শারীরিক উভয় রোগের নিরাময়ে ধ্যান কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এই প্রকারের ধ্যানকে তারা ‘মেডিটেশন’ বলে আখ্যায়িত করেন। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশেই রোগ নিরাময়ের জন্য মেডিটেশন করার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশের কোয়ান্টাম মেথড ব্যতিক্রমধর্মী মেডিটেশনের কথা বলছে। মেডিটেশনের উৎপত্তি হয়েছিল মানসিক ও শারীরিক রোগ মুক্তির লক্ষে অথচ কোয়ান্টাম মেথড রোগ নিরাময়ের গন্ডি থেকে বেরিয়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে। রোগ নিরাময়ের বিশ্বাসের স্থানে তারা মুক্ত বিশ্বাস নামে বিভিন্ন ধরণের কুফরী আকীদার প্রচার শুরু করেছে।

কোয়ান্টাম মেথডের প্রধান গুরুজী শহীদ আল বোখারী মহাজাতক প্রথমে জ্যোতিষী ছিলেন। তিনিই কোয়ান্টাম মেথডের ব্যতিক্রমধর্মী মেডিটেশনের উদ্ভাবক। তিনি মূলত এ জাতীয় মেডিটেশনের মূল আবিষ্কারক ডা. বেনসন বা ডা. ডীন অরশীন এর বাতলানো ফর্মুলা থেকে সূত্র গ্রহণ করে নিজের গবেষণালব্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন দর্শন যোগ করে কোয়ান্টাম এর এই বিশেষ মেডিটেশন আবিষ্কার করেন।

তার আবিষ্কৃত এই নতুন ধরণের মেডিটেশনের প্রতি সব ধর্মের মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষত হিন্দু ও বৌদ্ধদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন রীতি-নীতি, ও আকীদা বিশ্বাসের মিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। তাই কোয়ান্টাম মেথড পশ্চিমা দেশে প্রচলিত মেডিটেশন নয়। বরং এটি একটি জীবন ব্যবস্থা ও মতবাদ, যেখানে বিজ্ঞান ও সব ধর্মের মিশ্রণে জীবনের সর্বক্ষেত্রে নতুন দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, ঠিক যেমনটি করেছিল বাদশা আকবার ভ্রান্ত দ্বীনে ইলাহী আবিষ্কার করে।

শহীদ বোখারীর এই প্রচেষ্টা শুরু হয় প্রায় তিন যুগ আগে ১৯৭৩ সালে তদানীন্তন ‘মাসিক ঢাকা ডাইজেস্ট’ পত্রিকায় অতন্দ্রীয় বিষয়ে লেখালেখির মাধ্যমে। ১৯৭৫ সালে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রায়’ এ বিষয়ে অনেকগুলো লেখা প্রকাশ করা হয়। ১৯৮০ সালে তারা ঢাকার শান্তি নগরে অফিস খোলে। ১৯৮৩ সালে এই মেডিটেশনকে ব্যাপকভাবে মানুষের মধ্যে ছড়ানোর জন্য ‘যোগ্য মেডিটেশন কেন্দ্র’ স্থাপন করা হয়। ১৯৮৬ সালে এই কেন্দ্র ‘যোগ্য ফাউন্ডেশন’ নামে পরিচালিত হয়।

এদিকে মহাজাতক মানুষের মধ্যে পরিচিতির জন্য এই মেডিটেশন সম্পর্কে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে লিখতে থাকেন। এভাবে লেখালেখির এক পর্যায়ে যখন তিনি গণমানুষের মধ্যে এ ব্যাপারে আগ্রহ লক্ষ করলেন তখন মেডিটেশন কোর্স চালু করা হয়। ১৯৯৩ এর ৭ জানুয়ারী মেডিটেশন এর সর্বপ্রথম কোর্স অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে কোয়ান্টাম মেথড নামে এরা মেডিটেশন কোর্স চালিয়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত তারা ৩০০ এর অধিক কোর্স সমাপ্ত করেছে। মানুষ তার কাছে যায় রোগ নিরাময়ের আশায়, কিন্তু তিনি নিরাময়ের নামে তাদের বাদশাহ আকবরের দ্বীনে ইলাহীর মতো সর্বধর্মের সমন্নয়ে গঠিত নতুন এক মতবাদ শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন, আর অবুঝ মুসলমানদের ঈমান হরণ করছেন। (তথ্যসূত্র, মাসিক আল-আবরার ফেব্রুয়ারী ২০১২)

আমাদের দেশের মুসলমানরা ধর্ম সম্পর্কে যতটা আবেগী ততটা জ্ঞানী নয়। ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানও রাখে না এই ধরণের মুসলমানের সংখ্যাও কম নয়। মুসলমানদের ধর্মীয় জ্ঞানের দৈন্যতাকে পুঁজি করে যুগে যুগে অনেকেই মুসলমানদের ঈমান-আকীদা ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। বর্তমান কোয়ান্টাম মেথড সেই একই পথ অবলম্বন করে খুব কৌশলে মুসলমানদের ঈমান-আকীদা ধ্বংস করে যাচ্ছে। নিম্নে আমরা কোয়ান্টাম এর এমন কিছু মতবাদ তুলে ধরছি, যা বিশ্বাস করলে মুসলমানদের ঈমানই নষ্ট হয়ে যাবে।

এক
ইসলাম কুফরের মধ্যে পার্থক্য হলো কিছু আকীদা-বিশ্বাস ও আমলের। তবে কেউ যদি ঈমান-আকীদা ঠিক রাখে আর আমল নাও করে, তবু সে একদিন না একদিন জান্নাতে যাবে। কিন্তু ঈমান-আকীদার মধ্যে যদি গলদ থাকে, তাহলে সারা জীবন নেক আমল করলেও জান্নাতে যাওয়া যাবে না।

কোয়ান্টাম মেথড মুসলমানদের অমূল্যধন ঈমান  ধ্বংস করার পায়তারা চালাচ্ছে। কোয়ান্টাম মেথডের কোর্সে ভর্তির পর সর্ব প্রথম একটি প্রত্যয়ন পাঠ করা হয়, এই প্রত্যয়নই তাদের মূল চালিকা শক্তি। প্রত্যয়নটি এই, ‘ অসীম শক্তির অধিকারী আমার মন, যা চাই তাই পাবো যা খুশি তাই নেব’ তাদের এই প্রত্যয়নটি সম্পূর্ণরূপে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী। কেননা কুরআনের অনেক আয়াত আর অনেক হাদীস দ্বারা একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই অসীম শক্তির অধিকারী। তিনি ছাড়া আসমান-যমীনে যা কিছু আছে সবকিছুর শক্তিই সসীম। অতএব মানুষের মনকে অসীম শক্তির অধিকারী বলা স্পষ্ট কুফরী কথা। তাছাড়া ‘যা চাই তাই পাবো’ এই বিশ্বাসে আল্লাহর উপর ভরসার হুকুম স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে।

কুরআন শরীফে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে যেকোনো কাজে আল্লাহর উপর ভরসা করতে বলেছেন। যেমনঃ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অতঃপর আপনি যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করুন। আল্লাহ ভরসাকারীদের ভালোবাসেন। (সূরা আল ইমরানঃ১৫৯, আরো দ্রষ্টব্য, সূরা তাওবাঃ৫১, সূরা তাগাবুনঃ১৩, সূরা ইউসুফঃ৬৭, সূরা আল ফুরকানঃ৫৮ ইত্যাদি) অথচ কোয়ান্টামের এই কথা ‘যা চাই তাই পাবো’ এর মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। হ্যাঁ তারা যদি কথাটা এভাবে বলতো, ‘যা চাই তাই পাবো যদি আল্লাহ চান’ তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না।

দুই 
‘যা চাই তাই পাবো’ এখন প্রশ্ন হলো দিবে কে? এই প্রশ্নের জবাব কোয়ান্টাম কণিকা ২৩৯ পৃ. দেওয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, ‘কোয়ান্টামের মতে আল্লাহ/গড/ ভগবান/ প্রকৃতি যে কেউ দাতা হতে পারে।’ অথচ কুরআন সুন্নাহর আলোকে প্রকৃত দাতা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। গড/প্রকৃতি/ভগবান এসবকে দাতা মানার অর্থই হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্যকে শরীক করা। আর শিরক দ্বারা ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। অতএব কোয়ান্টামের এই মতবাদ সম্পূর্ণ ঈমান বিধ্বংসী মতবাদ।

তাছাড়া ‘যা চাই তাই পাবো’ একথা সম্পূর্ণ বাস্তবতা বিবর্জিত। কারণ চাওয়ার সাথে পাওয়ার শতভাগ সংযোগ হবে জান্নাতে। এই পৃথিবীতে শতভাগ চাওয়া পাওয়ায় পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। তাইতো আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেছেন ‘মানুষ যা চায় তাই কি পায়?’ (সূরা আন নাজাম ২৪) যদি পৃথিবীতেই মানুষের শতভাগ চাওয়া পাওয়ায় রূপান্তরিত হতো, তাহলে তো পৃথিবীই জান্নাত হয়ে যেতো। মানুষের শতভাগ চাওয়া তথা আশা-আকাঙ্ক্ষা শুধুমাত্র জান্নাতেই পুরা করা হবে, এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তোমরা সেখানে যা চাবে তাই পাবে’ (সূরা হামীম সেজদাঃ৩১)

তিন
কোয়ান্টামের মতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইসলাম মোটকথা সব ধর্মের মৌলিক শিক্ষাই এক। কাজেই যেকোনো ধর্ম পালনই যথেষ্ট। কোয়ান্টামের মতে সকল ধর্মই গ্রহণযোগ্য। (কোয়ান্টাম উচ্ছ্বাস পৃ.৯)

ইসলামে পূর্বের সকল নবী-রাসূল ও আসমানী গ্রন্থসমূহকে স্বীকৃতী প্রদান করা হয়েছে। এই স্বীকৃতীর অর্থ এই নয় যে, কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পরও যদি কেউ নিজ ধর্ম অনুযায়ী আমল করে, তাহলে সে মুক্তি পেয়ে যাবে। বরং এই স্বীকৃতী অর্থ এই যে, পূর্বের নবী-রাসূলগণ বাস্তবেই সত্য নবী-রাসূল ছিলেন এবং তাদের যমানায় তাদের কিতাবও সত্য ছিল। কিন্তু কুরআন অবতীর্ণ হওয়ায় পূর্বের সমস্ত আসমানী কিতাব রহিত হয়ে গেছে। তাইতো আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্ট ভাষায় কুরআনে বলে দিয়েছেন ‘যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম পালন করবে কস্মিনকালেও তা তার থেকে গ্রহণ করা হবে না, আর আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা আল ইমরানঃ৮৫)

যেখানে কুরআনে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হলো, ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়, সেখানে কোয়ান্টাম মেথড কীভাবে অন্য ধর্মকেও গ্রহণযোগ্যতার সনদ দিতে পারে? কোয়ান্টামের কী অধিকার আছে যে সে অন্য ধর্মকে গ্রহণযোগ্যতার সনদ দিবে? একই সময়ে একাধিক ধর্মকে গ্রহণযোগ্য বলা যুক্তি বিরুদ্ধ কথাও বটে। কেননা ধর্ম হলো মানুষের জীবনযাপনের আসমানী সংবিধান। একই দেশে একই সময়ে একাধিক সংবিধান যেমন কার্যকর নয়, তেমনিভাবে আল্লাহর এই পৃথিবীতে একই সময়ে একাধিক ধর্ম বা সংবিধান কার্যকর হওয়া বা গ্রহণযোগ্য হওয়া সম্ভব নয়। ইসলাম যেহেতু সর্বশেষ আসমানী সংবিধান তথা আল কুরআন নিয়ে এসেছে, তাই কুরআন নাযিল হওয়ার পর অন্যসব সংবিধান তথা ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থ রহিত ও অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে। এটাই হলো যুক্তির দাবি।

কোয়ান্টাম মেথড অন্য ধর্মকে গ্রহণযোগ্য বলে নিজের ঈমান যেমন ধ্বংস করেছে, তেমনিভাবে অন্য মুসলমানদেরকে এই মতবাদে দীক্ষিত করে অন্যদের ঈমানও নষ্ট করে যাচ্ছে।

চার 
কোয়ান্টামের উদ্ভাবিত জীবনদৃষ্টির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘কোয়ান্টাম হচ্ছে সেই সায়েন্স অব লিভিং যা বলে দেয় জীবনটাকে কীভাবে সুন্দর করা যায়। ভুল থেকে কীভাবে দূরে থাকা যায়। পাপ কত কম করা যায়। ভাল বা কল্যাণ কত বেশি করা যায়। কোয়ান্টামের শিক্ষা এ ক্ষেত্রে নবী-রাসূলদের যে শিক্ষা, ওলী-বুযুর্গদের যে শিক্ষা, মুনি-ঋষিদের যে শিক্ষা, তা থেকে আলাদা কিছু নয়। হাজার বছর ধরে তারা যে শিক্ষা দিয়ে এসেছেন, কোয়ান্টাম সে কথাগুলোই বলছে। শুধু ভাষাটা আধুনিক। (হাজারো প্রশ্নের জবাব, মহাজাতক ১/৩০১)

এখানে স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করা হলো যে, কোয়ান্টামের শিক্ষা হলো, নবী-রাসূলদের তাওহীদী বাণী ও মুনি-ঋষিদের কুফরী মতবাদের সমন্বিত একটি রূপ। অতএব সাবধান হে মুসলিম ভাই! কোয়ান্টামে দীক্ষা লাভ করে নিজের ঈমান খোয়াবেন না।

নবীজী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আনিত জীবন ব্যবস্থার উপর সন্তুষ্ট হতে না পারা কোয়ান্টামের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। নিজের বুদ্ধিমতে সকল ধর্মের নির্যাস আর বিজ্ঞানের থিউরি মিশ্রণে সফলতার সূত্র আবিষ্কার সবচেয়ে বড় ভুল। মুমিন-মুসলমান হতে হলে সর্বাবস্থায় কুরআন সুন্নাহর মাঝে নিজের সকল সমস্যার সমাধান, সকল প্রশ্নের উত্তর আর সকল চাহিদা পূরণের দিকনির্দেশনা খুঁজে পাওয়ার বিশ্বাস রাখতে হবে। কুরআন-সুন্নাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থায় তুষ্ট থাকতে হবে এবং মনে-প্রাণে তার পূর্ণাঙ্গ অনুসরণে নিজেকে সঁপে দিতে হবে।  বিধাতা হিসেবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার উপর আস্থাশীল হতে হবে।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শকে একমাত্র পালনীয় বিশ্বাস করতে হবে। কোয়ান্টামের আবিষ্কৃত জীবন-যাপনের বিজ্ঞানের অনুসরণ করা যাবে না। যার ভিত্তি রাখা হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত জীবনের সংজ্ঞা আর রুশ দার্শনিক লিওটলস্টয় এর কিছু মন্তব্যের উপর। মুসলমানদেরকে ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান বা তাদের স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী  জীবন যাপনের বিজ্ঞান পালন করতে হবে কেন? মুসলমানদের জন্য ইসলামের বিধি-বিধান ও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শই কি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থারূপে যথেষ্ট নয়। যারা ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা মানবে না, তারা কুরআনের স্পষ্ট আয়াত ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম পরিপূর্ণ করে দিলাম। (সূরা মায়িদাঃ৩) অস্বীকার করায় কাফের হয়ে যাবে।

কোয়ান্টাম মেথড নতুন জীবনদৃষ্টির কথা বলে মূলতঃ ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা অস্বীকার করছে। তাই যারা না বুঝে ইতিমধ্যে কোয়ান্টামে ঢুকে পড়েছেন অথবা যারা এখন ঢুকতে চাচ্ছেন তারা এখনই সর্তক হোন, তাওবা করে সঠিক ইসলামের পথে ফিরে আসুন এবং পূর্ণাঙ্গরূপে ইসলাম ধর্ম মেনে চলুন। চৌদ্দশত বছর আগেই আল্লাহ তা‘আলা আপনার সব সমস্যার সমাধান কুরআন ও সুন্নাহর মাঝে দিয়ে রেখেছেন।

অতএব অন্য কোনো দিকে না যেয়ে আপনার ধর্ম ইসলামকে আঁকড়ে ধরুন। যারা পূর্ণাঙ্গরূপে ইসলাম ধর্ম মেনে চলবে তাদের জন্য আখিরাতে চির শান্তির জীবন তো অপেক্ষা করছেই, দুনিয়াতেও আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য প্রশান্তিময় জীবনের ওয়াদা করেছেন। তাই আসুন আমরা কোয়ান্টামসহ অন্যান্য সব বাতিলকে পরিত্যাগ করি এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামকে চর্চা করি।  আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

বি. দ্র. কোয়ান্টাম মেথডের আরো অনেক মতবাদ কুরআন-হাদীস সাংঘর্ষিক। পারচার সংক্ষিপ্ত পরিসরে এর চেয়ে বেশি আলোচনা সমীচীন নয়। তাই যারা এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী তারা ব্রাউজ করুনঃ

http//:monthlyalabrar.wordpress.com

-মুফতী মনসূরুল হক দা.বা.
প্রধান মুফতী ও শাইখুল হাদীস,
জামিয়া রহমানিয়া,মুহাম্মাদপুর,ঢাকা।

আব্বাসাকে নিয়ে বিভ্রান্তি ও জাফর হত্যার রহস্যের খোঁজে

( আব্বাসা। খলীফা হারুনুর রশিদের বোন। তাকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। বলা হয় তার সাথে উযির জাফর বারমাকির প্রনয় ছিল। জাফরের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। শর্ত ছিল তারা যৌন সম্পর্ক করতে পারবে না। কিন্তু তারা যৌন সম্পর্ক করে এবং তাদের একটি সন্তান হয়। ফলে খলীফা ক্রুদ্ধ হয়ে জাফরকে হত্যা করেন। জাফরকে হত্যা করা হয়েছে আব্বাসার কারনেই। এই গল্পের সত্যমিথ্যা কতটুকু ? আসলেই কি আব্বাসার সাথে জাফরের বিয়ে হয়েছে ? জাফরকে হত্যার প্রকৃত কারনই বা কী ? কী বলছে ইতিহাস গ্রন্থগুলো? এসব প্রশ্নের জবাব নিয়েই এই লেখা)

 

বারামেকা পরিবার

 

বারামেকা পরিবার। আব্বাসী সাম্রাজ্যের ইতিহাস আলোচনায় যাদের কথা বলতেই হয়। আব্বাসী সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে প্রায় পঞ্চাশ বছর (১৩৬ হিজরী-১৮৭ হিজরী) এই পরিবারের সদস্যরা অত্যন্ত সুনাম ও খ্যাতির সাথে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে। বলতে গেলে সাম্রাজ্য পরিচালনার চাবিকাঠি ছিল তাদের হাতেই। তাদের হাতেই বাগদাদ হয়ে উঠে সুশোভিত। বারামেকাদের স্বর্নযুগ ধরা যায় হারুনুর রশিদের শাসনামল। আবার তাদের পতনও হয় হারুনের হাতেই। বারামেকাদের আদী বাসস্থান ছিল বলখে। সেখানে এক বিশাল অগ্নিকুন্ড ছিল। স্থানীয়রা এই অগ্নিকুন্ডের উপাসনা করতো । ৩১ হিজরীতে (৬৫১ খ্রিস্টাব্দ) মুসলমানদের হাতে বলখ বিজয়ের পর অগ্নিকুন্ড নিভিয়ে ফেলা হয়। কিছুকাল পরে আবার এই অগ্নিকুন্ড জ্বালানো হয়। ৮৬ হিজরীতে (৭০৫খ্রিস্টাব্দ) কুতাইবা বিন মুসলিম আবারো বলখ দখল করেন এবং একে ইসলামী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।

এই সময় অগ্নিপূজকদের একটি অংশ ইসলাম গ্রহণ করে দামেশকে চলে যায়। ১৩৩ হিজরীতে যখন দারুল খিলাফাহ দামেশক থেকে বাগদাদে সরিয়ে নেয়া হয় তখন তারাও বাগদাদ গমন করে।। এ সময় থেকে রাজদরবারে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। অগ্নিপূজক এই সম্প্রদায়ের নাম ছিল বারমাক। বারমাকের বহুবচন বারামেকা। খালেদ বারমাকি, ইয়াহইয়া বারমাকি, জাফর বারমাকি, ফজল বারমাকি এই পরিবারের গ্রুত্বপূর্ন ব্যক্তিত্ব। বারমাকিরা আব্বাসি সাম্রাজ্যের উন্নয়নে নানা ধরনের অবদান রেখেছে। বিশেষ করে, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রচার প্রসারে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। ইয়াহইয়া বারমাকি ভারতবর্ষে দূত প্রেরন করে এখানকার বেশকজন পন্ডীতকে বাগদাদ নিয়ে যান। তিনি অনুবাদক নিয়োগ করে ভারতবর্ষে রচিত চিকিতসাশাস্ত্র ও জ্যোতিষশাস্ত্রের বেশকিছু বই অনুবাদ করান। (১)

ইয়াহইয়া বারমাকি বাগদাদে ইলমী বিতর্কের আয়োজন করতেন। পরে খলীফা মামুনের আমলে এর আরো বিস্তৃতি লাভ করে। প্রশাসনিক দক্ষতার পাশাপাশি সাহিত্য ও কাব্যরচনায় বারামেকাদের পারদর্শীতা ছিল। ফজল বারমাকি বাগদাদে কাগজের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। (২)

প্রশাসনিক পদোন্নতি ও খলিফার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারনে বারামেকারা বিপুল অর্থবৈভব ও প্রভাব প্রতিপত্তির মালিক হয়। বাগদাদের আবাদী জমির বেশিরভাগ তাদের দখলে চলে যায়। এসময় তারাই পর্দার আড়াল থেকে হয়ে উঠে খেলাফতের নিয়ন্ত্রক। প্রকাশ পেতে থাকে তাদের স্বেচ্ছাচারিতা। গুরুত্বপুর্ণ পদ্গুলো তাদের দখলে চলে আসে। ইবনে খালদুনের মতে , তারা কোষাগারের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে। অনেকসময় খলিফা হারুনুর রশিদ প্রয়োজনে পড়ে কোষাধ্যক্ষের কাছে অর্থ চেয়েও পেতেন না। (৩)

নানাকারনে বারামেকাদের অনেক শত্রু তৈরী হয়। এদের একজন খলীফা হারুনুর রশিদের প্রাসাদের প্রধান পাহারাদার (হাজেব) ফজল ইবনে রবী। ফজল তার পদমর্যাদাবলে খলীফার কাছে বারামেকাদের বিরুদ্ধে নানা কথা বলেন। তার মনকে বিষিয়ে তোলেন। খলিফাকে বলা হয় বারামেকারা বনু আব্বাসের পতন ঘটানোর ষড়যন্ত্র করছে। ফজল ইবনে রবির অভিযোগ ও ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতার কারনে খলিফা বারামেকাদের উপর ক্রুদ্ধ হন। ১৮৭ হিজরীর (৮০৩ খ্রিস্টাব্দ) একরাতে খলীফা আদেশ দিলেন উযির জাফরকে হত্যা এবং জাফরের পিতা ইয়াহইয়া ও ভাই ফজলকে গ্রেফতার করতে। একইসাথে বারামেকাদের সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দেয়া হলো। খলিফার অনুচর মাসরুরের মাধ্যমে জাফরের হত্যাকান্ড সম্পন্ন হলো। বারামেকাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলো। ইয়াহইয়া বারমাকি ও অন্যদের রাক্কা শহরে বন্দী করা হয়।

প্রথম এক বছর তাদেরকে কোনো কষ্ট দেয়া হয় নি। তাদের সুখ স্বাচ্ছ্যন্দের দিকেও খেয়াল রাখা হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে আব্দুল মালিক ইবনে সালেহ ও তার পুত্র খলীফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করে গ্রেফতার হন। অভিযোগ উঠে বারামেকারা এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত ছিল। এবার খলিফা বন্দী বারামেকাদের উপর ক্রুদ্ধ হন এবং সকল সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দেন। ১৯০ হিজরীতে বৃদ্ধ ইয়াহইয়া বারমাকি কারাগারে মৃত্যুবরন করেন। মামুন ক্ষমতায় এলে বারামেকাদের মুক্তি দেন এবং তাদের সম্পদও ফিরিয়ে দেন। (৪) কিন্তু বারামেকারা আর তাদের হারানো জৌলুস ফিরে পায় নি।

সাইয়েদ সোলাইমান নদভীর মতে, খলীফা হারুনুর রশিদ যদি বারামেকাদের উপর খড়গহস্ত না হতেন , তাহলে হয়তো আব্বাসী সাম্রাজ্যের ইতিহাসই বদলে যেত। (৫)

জাফর বারমাকি

ইয়াহইয়া বারমাকির ছেলে জাফর বারমাকির জন্ম ১৫১ হিজরীতে (৭৬৮ খ্রিস্টাব্দ)। খলিফা আবু জাফর মানসুরের শাসনকালে। বাল্যকালেই জাফরের জন্য বিভিন্ন শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। জাফর ফিকহ পড়েন কাজি আবু ইউসুফের কাছে। আবু ইউসুফ ছিলেন নানা শাস্ত্রে দক্ষ। শিক্ষাজীবন শেষে জাফর সাহিত্য, ফিকহ, দর্শন ও জ্যোতিষশাস্ত্রে দক্ষ হয়ে উঠেন। মুহাম্মদ বিন রাশেদ ইসহাক মসুলির বর্ননামতে, জাফর বাগদাদের আলেমদের অন্যতম ছিলেন। প্রশাসনিক কাজে জাফর কখন নিযুক্ত হন তার কোনো বিশুদ্ধ বর্ননা পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন ঘটনাবলি থেকে এটা বুঝা যায়, হারুনুর রশিদ খলিফা হওয়ার এক বছর পর জাফরকে উযির নিযুক্ত করেন। ১৭৫ হিজরীতে (৭৯১ খ্রিস্টাব্দ) জাফরকে মিসরের শাসক নিযুক্ত করা হয়।

১৭৭ হিজরীতে (৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ) তার পরিবর্তে ইসহাক বিন সুলাইমান কে পাঠানো হয়। ১৮০ হিজরীতে জাফরকে পাঠানো হয় শামের বিদ্রোহ দমন করতে। কিছুকাল তাকে খোরাসান ও সিজিস্তানে পাঠানো হয়। এরপর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বাগদাদে অবস্থান করেন। খলিফার সাথে তার অত্যন্ত ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। জাফরের পিতা ইয়াহইয়া ছিলেন হারুনের শিক্ষক। খলীফা নিজের যে কোনো কাজে জাফরকে সাথে রাখতেন। নিজের জন্য যা পছন্দ করতেন জাফরের জন্যও তা পছন্দ করতেন। প্রায়ই তাকে ভাই বলে ডাকতেন। উযির হিসেবে জাফর ছিলেন দুরদর্শী, বিচক্ষণ ও কৌশলী। (৬)

জাফর বারমাকি
জাফর বারমাকি। হারুনুর রশিদের প্রধানমন্ত্রী
জাফর হত্যার স্বরুপ সন্ধান
জাফরকে হত্যা করা হয় ১৮৭ হিজরীতে। পুরো ব্যপারটিই ছিল আকস্মিক। এমনকি হত্যার দিনে সারাদিন খলিফা জাফরকে নিজের সাথে রেখেছেন। শেষ বিকেলে খলীফা বললেন, ‘জাফর,আমি তোমাকে এতটাই ভালোবাসি, আজ তোমার থেকে পৃথক হতে ইচ্ছে করছে না। যদি আজ স্ত্রীর কাছে না যেতাম, তাহলে সারারাত তোমার সাথে গল্প করতাম’ ।সে রাতে খলীফা মাসরুরকে নির্দেশ দিলেন, জাফর বারমাকিকে হত্যা করো। ইয়াহইয়া বারমাকি ও ফজল বারমাকিকে গ্রেফতার করো। একইসাথে বারমাকিদের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করো। (৭)
খলীফার আদেশমতে সেরাতেই জাফরকে হত্যা করা হয়। ঐতিহাসিকরা এ হত্যার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। বক্ষমান আলোচনায় পুরো ঘটনার বিবরণ দেয়ার সুযোগ নেই। আমরা আপাতত এ হত্যাকান্ডের কারন সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের বর্ননা তুলে ধরবো।

ইবনে খালদুন লিখেছেন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা বারামেকাদের হাতে চলে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই খলিফা কার্যত অসহায় হয়ে পড়েন। এছাড়া বারামেকাদের বিরোধী পক্ষ তাদের ব্যাপারে খলিফার কান ভারী করতে থাকে। ফলে জাফরের ছোট ছোট দোষও খলিফার চোখে বড় হয়ে দেখা দেয়। একারনে খলিফা জাফর ও তার পরিবারের উপর রুষ্ট হন (৮) অন্যত্র তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে বারামেকাদের পতনের যথার্থ কারন তাদের অযথা হস্তক্ষেপের মধ্যে নিহিত ছিল। (৯)

ইবনে কাসীর এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি বর্ননা এনেছেন। এর মধ্যে একটি হলো, খলিফা জাফরকে বলেছিলেন, ইয়াহইয়া বিন আব্দুল্লাহ বিন হাসানকে নিজের ঘরে বন্দী রাখতে। জাফর তাকে মুক্ত করে দেয়। খলীফা প্রথমে এই সংবাদ বিশ্বাস করেন নি। পরে জাফর স্বীকার করলে খলীফা ক্রুদ্ধ হন এবং তিনি কসম খেয়ে বলেন, জাফরকে আমি অবশ্যই হত্যা করবো। খলীফা জাফরের উপর আরো কয়েকটি কারনে ক্রুদ্ধ হন। তিনি যে এলাকায় যেতেন দেখতেন সেখানের সব ভালো জমি জাফরের দখলে। এছাড়া জাফর প্রচুর অর্থব্যায়ে একটি ঘর নির্মাণ করে। এতেও খলিফা রাগান্বিত হন। (১০)

ইবনে আসীর জাফরের নির্মিত বিলাসবহুল গৃহের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি আরেকটি বর্ননা এনেছেন, তা হলো, একদিন ইয়াহইয়া বারমাকি খলিফার বিনা অনুমতিতে ঘরে প্রবেশ করে। খলিফা তখন সামনে উপবিষ্ট শাহী চিকিতসককে বলেন, তোমাদের এলাকায় কি লোকজন অনুমতি ছাড়া ঘরে চলে আসে ? এ কথা শুনে ইয়াহইয়া লজ্জিত হন। মূলত এ সময় থেকেই খলিফা বারামেকাদের উপর ক্ষিপ্ত হতে শুরু করেন। ইবনে আসীর এ হত্যাকান্ডের কারন হিসেবে তাবারীর বর্ননাটিও উল্লেখ করেছেন, যা থেকে আব্বসাকে নিয়ে বিভ্রান্তির সূচনা। (১১)

হাফেজ শামসুদ্দিন যাহাভী জাফরের ঘর নির্মাণের বর্ননা বেশ গুরত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। তিনি বারামেকাদের উপর সুলতানের ক্ষিপ্ত হওয়ার আরেকটি কারন বর্ননা করেছেন। ইয়াহইয়া বারমাকি দরবারে প্রবেশ করলে গিলমানরা তাকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতো। বিষয়টি খলিফা অপছন্দ করেন। তিনি মাসরুরকে আদেশ দেন, গিলমানদের সম্মান জানাতে নিষেধ করতে। হাফেজ জাহাভীও অন্যান্য বর্ননার সাথে তাবারীর বর্ননাটি এনেছেন। (১২)

ইবনে খাল্লিকান উপরোক্ত কারনসমূহ উল্লেখের পাশাপাশি তাবারীর ভিত্তিহীন বর্ননাটিও এনেছেন।(১৩)
ইবনুল জাওযি ইয়াহইয়া বিন আব্দুল্লাহ বিন হাসানের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া তিনি আবু বকর সুলির একটি বর্ননা এনেছেন। সুলি বলেন খলিফার বোন আলিয়া তাকে প্রশ্ন করেছিল, আপনি কেন জাফরকে হত্যা করেছেন। খলিফা জবাব দিলেন, যদি আমি টের পাই আমার জামা এই হত্যার কারন জানে তাহলে আমি জামাকেও পুড়িয়ে ফেলবো। ইবনুল জাওযি বিস্ময়ের সাথে তাবারির বর্ননাটিও উল্লেখ করেছেন। (১৪)

মুহম্মদ রেজা-ই-করীম লিখেছেন, সম্ভবত আব্বাসীয় দরবারে বারমাকিদের ইরানি প্রভাব আরব সভাসদবর্গের ঈর্ষার কারণ হইয়া দাড়াইয়াছিল এবং উহা হইতে মুক্তি লাভ করিবার জন্য তাহারা খলিফাকে কুমন্ত্রণা দিয়াছিল । (১৫)

উপরোক্ত আলোচনা থেকে ইবনে খালদুনের বক্তব্যই শক্তিশালী মনে হয়। বারামেকাদের প্রভাব প্রতিপত্তি ও অন্যায় হস্তক্ষেপ খলিফাকে বিষিয়ে তোলে।
তাবারীর বর্ননায় কী আছে?

জাফরের হত্যাকান্ডের সাথে আব্বাসাকে জড়িয়ে যে গল্প চালু হয়েছে তার মূল উৎস ইবনে জারির তাবারির একটি বর্ননা। যারাই জাফরের হত্যাকান্ডের সাথে আব্বাসাকে জড়িয়েছেন সবাই এই বর্ননা থেকেই রসদ নিয়েছেন। পরে গল্প উপন্যাসের কল্যানে এই গল্প ডালপালা মেলেছে। চালু হয়েছে নানা কিসিমের মুখরোচক গল্প। দেখা যাক, তাবারীর বর্ননায় কী আছে?

তারীখে তাবারীতে বারামেকাদের পতনের কারন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তাবারি বর্ননা করেন,

আমাকে যুহাইর বর্ননা করেছেন, তাকে তার চাচা যহির বিন হারব বলেছেন, বারামেকাদের পতনের জন্য জাফর ও আব্বাসার বিবাহ দায়ি। খলিফা হারুনুর রশিদ , জাফর ও আব্বাসা দুজনকেই খুব ভালোবাসতেন। তাদেরকে দেখা ছাড়া থাকতে পারতেন না। খলিফা চাইতেন মদপানের মজলিসে দুজনই উপস্থিত থাকুক। এজন্য খলিফা জাফরকে বললেন, তুমি আব্বাসাকে বিবাহ করো। তাহলে আর পর্দার সমস্যা হবে না। তবে তার সাথে যৌন সম্পর্ক করতে পারবে না। এই শর্তে খলিফা জাফরের সাথে আব্বাসার বিবাহ দেন। পরে মদ্যপ অবস্থায় জাফর আব্বাসার সাথে যৌন সম্পর্ক করে এবং তাদের একটি সন্তান হয়।

এ সংবাদ খলিফা থেকে গোপন করে শিশুটিকে মক্কায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু আব্বাসার সাথে মনোমালিন্যের জের ধরে জনৈক দাসি একথা খলিফাকে জানিয়ে দেয়। খলিফা সেবছর হজ্বের সফরে শিশুটির ব্যাপারে নিশ্চিত হন। তিনি শিশুটিকে হত্যা করেন এবং জাফরকেও হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন(১৬)

তাবারির বর্ননা এটুকুই। আব্বাসাকে নিয়ে বিভ্রান্তির শুরুও এখান থেকেই। অথচ তাবারী স্বীয় অভ্যাসমতে অন্যান্য বর্ননার সাথে এটিকেও এনেছেন এবং কোনোটিকেই তিনি তারজিহ বা প্রাধান্য দেন নি। তবে তাবারির পরে অন্যান্যরা এ গল্পকে আরো বড় করেছেন। রঙ চড়িয়েছেন। বিশেষ করে ঐতিহাসিক মাসউদি মারুজুজ জাহাব গ্রন্থে এক দীর্ঘ গল্প এনেছেন। সেসব দীর্ঘ গল্পের দিকে না গিয়ে সরাসরি তাবারির বর্ননা নিয়েই আলোচনা করা যাক।

প্রথমদিকের ঐতিহাসিকদের মধ্যে তাবারী উল্লেখযোগ্য। তার রচিত ইতিহাসগ্রন্থটিও আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। তবে তাবারীর সব বর্ননাই নির্ভুল কিংবা গ্রহনযোগ্য বিষয়টা এমন নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি লোকমুখে শ্রুত ও প্রচলিত অনেক ঘটনাও উল্লেখ করেছেন, যার কোনো ভিত্তি নেই। এসব বর্ননা তিনি উল্লেখ করেছেন অন্যান্য বর্ননার পাশাপাশি, এবং এগুলোর কোনো একটিকে প্রাধান্য দেয়া ব্যতিতই।

শুধু তাবারী একা নন, ঐতিহাসিকদের অনেকেই এমনকিছু ভিত্তিহীন বর্ননা এনেছেন , যার দ্বারা পরবর্তীকালে রচিত হয়েছে অনেক ভিত্তিহীন গল্প। কাজি ইয়াহইয়া ইবনে আকসামের মদপান, মামুনের প্রেমের গল্প, এসব এমনই ভিত্তিহীন গল্পের অংশ। ইবনে খালদুন এ ব্যাপারে বলেন, ঐতিহাসিকদের অনেকেই কল্পিত বর্ননা ও মিথ্যা কাহিনীর সংযোজন করেছেন। পরে অনেকেই এগুলো অক্ষুন্ন রেখেছেন এবং এই অতিরঞ্জিত বিবরণই আমাদের কাছে এসে পৌছেছে। এখানে অনুসন্ধানের চেষ্টা নেই। বিচার বিশ্লেষন করে ঘটনাবলীকে কলুষমুক্ত করার চেষ্টা নেই। (১৭)

তাবারীর বর্ননার দূর্বলতা

। তাবারীর বর্ননায় যুহাইর ও তার চাচা যাহের আছেন। এই দুজন মুতাজিলী ছিল। তাদের কেউই জাফরের হত্যাকান্ডের সময় উপস্থিত ছিল না। তাবারী নিজেই জাফরের হত্যাকান্ডে জড়িতদের নামের তালিকা দিয়েছেন সেখানে এই দুজনের নাম নেই। এছাড়া অন্য ঐতিহাসিকরাও এ দুজনের নাম দেন নি। সর্বশেষ বর্ননাকারী যাহের নিজেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না।

। হারুনুর রশিদের নামে মদপানের যে অপবাদ দেয়া হয়েছে তা রীতিমত বিস্ময়কর ও ভিত্তিহীন। ইবনে খালদুন আফসোস করে লিখেছেন, ঐতিহাসিকগন সম্রাট হারুনের সুরাসক্তি ও অন্তরংগদের সাথে সুরাপানের আসর বসানোর যে অবমাননার কাহিনি বর্ননা করেছেন, আল্লাহ ক্ষমা করুন, তার সম্পর্কে অনুরুপ দুর্মতির কোনো জ্ঞানই আমাদের নেই। খেলাফতের উত্তরসূরী, ধর্ম ও ন্যায়পরায়নতার প্রতিভূ সম্রাট হারুনের পক্ষে এটা কীভাবেই বা সম্ভব । তিনি সর্বদা জ্ঞানীগুনি ও আধ্যাত্মিক মনিষীদের সাহচর্যে থাকতেন।

ফুজাইল ইবনে আয়াজ, ইবনে সামাক, উমরির ন্যায় গুনিদের সাথে আলচনা করতেন। সুফিয়ান সাউরির ন্যায় মনিষীর সাথে তার পত্রালাপ চলতো। (১৮) মদের ব্যাপারে খলিফার অনাসক্তি বুঝতে এটাই যথেষ্ট যে, খলীফা মদপানের কারনে কবি আবু নাওয়াসকে গ্রেফতার করেন এবং মদপান ত্যাগ করার আগে তাকে মুক্তি দেয়া হয় নি। অবশ্য খলিফা আঙ্গুরের রস পান করতেন। কিন্তু একে মদ বলা ভুল। খলিফা মদের আসর বসাতেন এর কোনো বিশ্বস্ত বর্ননা পাওয়া যায় না। যেখানে মদের আসরই প্রমানিত নয় সেখানে শুধু এই আসরের জন্যই জাফর ও আব্বাসার বিবাহের গল্প কীভাবে সত্য হতে পারে।

। বারামেকাদের পতনের পর আবু নাওয়াস ও অন্যান্য কবিরা যেসকল কবিতা রচনা করেছেন, তাতে এই বিবাহের কোনো আভাসও নেই। তাবারী ছাড়া আর কারো কাছেই যেন এ বিবাহের সংবাদ পৌছে নি।

। হারুনুর রশীদ একজন আব্বাসী। তিনি কী করে তার বোনকে অনারব মুক্ত ক্রীতদাসের সাথে বিবাহ দিবেন? ইবনে খালদুন তাই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, জাফর ইবনে ইয়াহইয়ার সাথে আব্বাসার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন কী করে সম্ভব হতে পারে? একজনের পূর্বপুরুষ রাসুলের (সা) পিতৃব্য ও কোরায়শ বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত আর অন্যজনের পিতৃব্য অনারব পারস্যবাসী। আব্বাসিয়রাই বারমাকিদের ক্রীতদাসের কলংক থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার উচ্চাসনে সমাসীন করেন। চিন্তাশীল পাঠক যদি বিষয়টি নিয়ে ভাবেন তাহলে তার বিবেক কিছুতেই এই কথা সমর্থন করবে না যে, আব্বাসা নিজ বংশের দ্বারা মুক্তিপ্রাপ্ত একজনের সাথে এ প্রকার সম্পর্কে রাজী হবেন। (১৯)

। আব্বাসার বিয়ে সম্পর্কে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও গ্রহনযোগ্য বক্তব্য দিয়েছেন আবু মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম ইবনে কুতাইবা দিনাওয়ারি। তার জন্ম ২১৩ হিজরীতে । অর্থাৎ, জাফরের হত্যাকান্ডের ২৬ বছর পরে। জীবনের এক দীর্ঘ সময় তিনি বাগদাদে অবস্থান করেন। সেসময় বাগদাদে বারমাকিদের অনেকেই বেচে ছিল যারা জাফর হত্যাকান্ডের পূর্বাপর জানতো। যদি বারমাকিরা জাফর হত্যার জন্য আব্বাসার সাথে জাফরের বিবাহের গল্প বলতো তাহলে আবু আবদুল্লাহ অবশ্যই সে তথ্য উল্লেখ করতেন। কিন্তু আব্বাসা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, আব্বাসার প্রথম বিবাহ হয় মুহাম্মদ বিন সোলায়মান বিন আলি বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের সাথে। মুহাম্মদ মারা গেলে পরে ইবরাহীম বিন সালেহ বিন আলি বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের সাথে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। (২০)

 

আব্বাসার জন্ম হয় ১৫৪ হিজরীতে, কুফায়। ১৭২ হিজরীতে মুহাম্মদ বিন সোলায়মানের সাথে তার বিয়ে হয়। মুহাম্মদ বিন সোলায়মান ছিলেন বসরার গভর্ণর। ১৭৪ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। পরে আব্বাসার বিয়ে হয় ইবরাহীম বিন সালেহর সাথে। আবু আব্দুল্লাহ দিনাওয়ারি ছাড়াও এই বিয়ের উল্লেখ করেছেন সালেহ হিন্দী। তিনি হারুনুর রশীদের রাজ চিকিতসক ছিলেন। একবার ইবরাহিম বিন সালেহ প্রচন্ড অসুস্থ হলে তিনি চিকিতসা করেন। ইবরাহিম সুস্থ হলে আব্বাসার সাথে তার বিয়ে হয়। সময়কাল ১৭৬ হিজরী। (২১) ইবরাহীমকে মিসরের গভর্ণর নিযুক্ত করা হয়। তিনি ও আব্বাসা মিসরেই ইন্তেকাল করেন। (২২)

। খলিফা আব্বাসাকে সারাক্ষন নিজের কাছে রাখতে চাইতেন এই গল্পও নাকচ হয়ে যায়। কারন আব্বাসা প্রথম বিবাহের পর বসরা এবং দ্বিতীয় বিবাহের পর মিসরে চলে যান।

(প্রখ্যাত উর্দু উপন্যাসিক সাদিক হোসাইন সিদ্দিকী তার রচিত ‘শাহজাদী আব্বাসা’ গ্রন্থে বেশ জোরের সাথে বলেছেন, প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর আব্বাসা আর বিবাহ করেন নি। তবে নির্ভরযোগ্য মত হলো আব্বাসার দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছিল)

তথ্যসূত্র :
১। আরব ও হিন্দ কে তাআল্লুকাত, (৬১-৬৫ পৃষ্ঠা) — সাইয়েদ সুলাইমান নদভী। মশাল বুকস, লাহোর।
২। আল বারামেকা , (১২৮,১২৯ পৃষ্ঠা) — মুনশী আব্দুর রাজ্জাক কানপুরী। নামী প্রেস, কানপুর।
৩। আল মুকাদ্দিমা , (১ম খন্ড,১০০ পৃষ্ঠা) — আল্লামা ইবনে খালদুন। দার ইয়ারাব। দামেশক।
৪। হিস্ট্রি অব সারাসিনস, (১৭৬,১৭৭ পৃষ্ঠা)– সৈয়দ আমীর আলী। বাংলা সংস্করণ, বাংলা একাডেমী।
৫।আরব ও হিন্দ কে তাআল্লুকাত, ৬৫ পৃষ্ঠা — সাইয়েদ সুলাইমান নদভী। মশাল বুকস, লাহোর।
৬। আল বারামেকা, (১৪৮-১৫৫ পৃষ্ঠা)– মুনশী আব্দুর রাজ্জাক কানপুরী। নামী প্রেস, কানপুর।
৭। কিতাবুল উযারা, (১৫০, ১৫১ পৃষ্ঠা)– আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ জাহশায়ারি। দারুল ফিকরিল হাদিস, বৈরুত।
৮। তারীখে ইবনে খালদুন , (৩য় খন্ড, ২৭৯ পৃষ্ঠা) — আল্লামা ইবনে খালদুন। দারুল ফিকর।
৯। আল মুকাদ্দিমা, (১ম খন্ড, ১০০ পৃষ্ঠা)– ইবনে খালদুন। দার ইয়ারাব। দামেশক।
১০। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, (১০ম খন্ড,১৮৯-১৯১ পৃষ্ঠা)— হাফেজ ইমাদুদ্দিন ইবনে কাসির। মাকতাবাতুল মাআরিফ। বৈরুত।
১১। আল কামেল ফিত তারিখ (৫ম খন্ড, ৩২৭-৩৩০ পৃষ্ঠা)– ইবনুল আসির জাযারি। দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত।
১২। তারীখুল ইসলাম (১২শ খন্ড, ২২-২৭ পৃষ্ঠা)– হাফেজ শামসুদ্দিন জাহাভী। দারুল কিতাবিল আরাবি, বৈরুত।
১৩। ওফায়াতুল আইয়ান (১ম খন্ড, ৩২৯,৩৩০ পৃষ্ঠা) –ইবনে খাল্লিকান। দারু সাদের, বৈরুত।
১৪। আল মুন্তাজাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম (৯ম খন্ড, ১২৬-১৩৩)– ইবনুল জাওযি। দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত।
১৫। আরব জাতীর ইতিহাস (২২৭ পৃষ্ঠা)– মুহম্মদ রেজা-ই-করীম। বাংলা একাডেমী।
১৬। তারীখে তাবারী (৮ম খন্ড, ১৯৪ পৃষ্ঠা)– আবু জাফর মুহাম্মদ বিন জারির তাবারী। দারুল মাআরিফ, কায়রো।
১৭। আল মুকাদ্দিমা (১ম খন্ড, ৯৫ পৃষ্ঠা) –ইবনে খালদুন। দার ইয়ারাব। দামেশক।
১৮। আল মুকাদ্দিমা (১ম খন্ড, ১০২ পৃষ্ঠা) –ইবনে খালদুন। দার ইয়ারাব। দামেশক।
১৯।আল মুকাদ্দিমা (১ম খন্ড, ১০০ পৃষ্ঠা) –ইবনে খালদুন। দার ইয়ারাব। দামেশক।
২০। আল মাআরিফ (৩৯৪ পৃষ্ঠা)– আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ দিনাওয়ারি। উর্দু সংস্করণ। কিরতাস পাবলিকেশন্স, করাচী।
২১। উয়ুনুল আনবা ফি তবাকাতিল আতিব্বা (৩২৪ পৃষ্ঠা)– ইবএন আবি উসাইবা। মাকতাবাতুল হায়াত, বৈরুত।
২২। আল বারামেকা , (২৭৭ পৃষ্ঠা) — মুনশী আব্দুর রাজ্জাক কানপুরী।নামী প্রেস, কানপুর।

অ্যান আপীল টু কমন সেন্স

আরিফ আজাদঃ অনেকেই মনে করে থাকে, বিজ্ঞানের যতো উন্নতি হচ্ছে, ধর্ম মনে হয় ততোটাই কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানের নতুন নতুন সব আবিষ্কার, গবেষণার সাথে ধর্মটা বুঝি আর পেরে উঠলো না। অনেক নাস্তিকও এমন ধারণা পোষণ করে মনে মনে তৃপ্তি পায়। আদতে, ব্যাপারটা যেরকম ভাবা হয় বা যেরকম করে ভাবানো হয়, ঠিক তার উল্টো। বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং আধুনিকায়নের সাথে ধর্মের আসলে কোন সংঘাত নেই।

প্রথমে সাধারণ কমনসেন্স দিয়েই ভাবা যাক। একটা সুপার কম্পিউটারের কথাই ধরুন। মানব সভ্যতার অন্যতম প্রধান আবিষ্কারগুলোর মধ্যে কম্পিউটার সম্ভবত একেবারে প্রথম সারির আবিষ্কার। এই কম্পিউটার আমাদের দৈনিক জীবন থেকে শুরু করে আমাদের জীবনের সবকিছুকে একদম ‘ডালভাত’ বানিয়ে ফেলেছে। এই কম্পিউটার দিয়ে আমি যেমন ফেইসবুক ব্রাউজ করি, ঠিক তেমনি এই কম্পিউটার দিয়েই হাজার আলোকবর্ষ মাইল দূরের কোন গ্রহ বা নক্ষত্রের অবস্থান, আকৃতি, কার্যকলাপ নিখুঁতভাবে নির্ণয় করে ফেলি। আচ্ছা, এই কম্পিউটার কে তৈরি করেছে? নিশ্চয়ই কোন বুদ্ধিমান প্রাণী। সাম্প্রতিক বিজ্ঞান আমাদের জানাচ্ছে যে, সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী সুপার কম্পিউটারের চেয়েও মানুষের ব্রেইন দশগুণ বেশিই শক্তিশালী। আপনাকে যখন জিজ্ঞেস করি, ‘কম্পিউটার কে বানিয়েছে?’ আপনি অকপটে উত্তর দেন, – বুদ্ধিমান মানুষ। আবার, সেই আপনাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়,- সেই বুদ্ধিমান মানুষ, যিনি দশটি সুপার কম্পিউটারের সমান, তাকে কে সৃষ্টি করেছে?

আপনি তখন কমন সেন্সের ঘাঁড়,মাথা সবকিছু খেয়ে বলেন, – বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগে কিছু রাসায়নিক পদার্থ নিজ থেকে, স্ব-উদ্যোগে একত্রিত হয়ে প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হয়। আপনাকে যদি আবার বলা হয়, বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগের সেই জ্বালাও-পোঁড়াওময় আবহাওয়ায় কেনো কিছু রাসায়নিক পদার্থের মনে হলো যে তারা একত্রিত হয়ে প্রাণ তৈরি করবে? আর, তাদের মনই বা কোথা থেকে এলো? আপনি তখন কিছু বস্তবাদী বৈজ্ঞানিক ‘থিওরি’ কপচাতে কপচাতে কমনসেন্স, লজিক থেকে বের হয়ে ‘বিচার মানি কিন্তু তালগাছ আমার’ নীতিতে চলে যান। সুপার কম্পিউটার আবিষ্কারের পেছনে একজন বুদ্ধিমান সত্ত্বার হাত আছে, থাকতে হবেই- এটা আপনি বিশ্বাস করেন। কিন্তু ওই সুপার কম্পিউটারের চাইতেও অনেক বেশি শক্তিশালী ‘Human Brain’ এর ব্যাপারে আপনার ধারণা হলো কিছু আবর্জনা, রাসায়নিক পদার্থ ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যমে এটা নিজে নিজে তৈরি হয়ে গেছে। এর পেছনে কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বার হাত নেই বা থাকতে নেই। হোয়্যাট অ্যা কমনসেন্স!

আবার, সেই আপনাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়,- সেই বুদ্ধিমান মানুষ, যিনি দশটি সুপার কম্পিউটারের সমান, তাকে কে সৃষ্টি করেছে? আপনি তখন কমন সেন্সের ঘাঁড়,মাথা সবকিছু খেয়ে বলেন, – বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগে কিছু রাসায়নিক পদার্থ নিজ থেকে, স্ব-উদ্যোগে একত্রিত হয়ে প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হয়।

আমরা সকলেই জানি, বিগ ব্যাংয়ের সময়ে সেই মহা বিস্ফোরণের ফলেই আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টি। বিগ ব্যাং মানে কি? মহা বিস্ফোরণ। আচ্ছা, কখনো কি কোথাও বিস্ফোরণ হতে দেখেছেন? পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণের কথাই ধরুন। আপনাকে প্রশ্ন করি, আমেরিকা যখন জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা ফেলে, সেটাকে আমরা কি বিস্ফোরণ বলতে পারি? আচ্ছা, যদি সেটা বিস্ফোরণ হয়, তাহলে সেই বিস্ফোরণের ফলাফল কি ছিলো? হিরোশিমা নাগাসাকি শহর কি তছনছ হয়ে গিয়েছিলো নাকি আগের চেয়েও সুন্দর, মনোহর, অপরূপ হয়ে উঠেছিলো?

আমরা সবাই জানি যে, হিরোশিমা-নাগাসাকি সেই পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণের পরে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। সেই পারমানবিক বিস্ফোরণের তেজস্ক্রীয়তা এতোই বেশি ছিলো যে, সেই তেজস্ক্রীয়তার ভয়াবহতা এখনো ভোগ করে সেই অঞ্চলের লোকজন। এখনো হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পঙ্গু-বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম নেয়। পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণের সেই রেশ এখনো গর্ভবতী মায়ের পেটে সন্তানের শারীরিক বিকৃতি ঘটায়। এই যে বিস্ফোরণ, এটা কি ক্ষতিকর না উপকারি? আমি জানি সবাই একবাক্যে বলবে- ক্ষতিকর। দুনিয়ায় এমন একটা বিস্ফোরণের নজির কেউ দেখাতে পারবেনা যেখানে কোন বিস্ফোরণ ভালো কিছু সৃষ্টি করেছে, নতুন কিছু সৃষ্টি করেছে যা আগের চেয়ে সুন্দর, মনোহর, উপকারি। নট অ্যা সিঙ্গেল ইনসিডেন্ট। বিগ ব্যাংয়ের সাথে তুলনা করলে হিরোশিমা-নাগাসাকির সেই বিস্ফোরণ কয়েক কোটি ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগও হবেনা। অথচ, বিগ ব্যাংয়ের মতো এতো বিশাল বিস্ফোরণের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে পৃথিবীর মতো লাইফ সাপোর্টেড একটা গ্রহ যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব রক্ষার সকল উপাদান, সকল উপকরণ একেবারে সমান অনুপাতে আছে। একটু বেশিও না, একটু কমও না। আপনার কি মনে হয় এটা নিছক কো-ইনসিডেন্ট?

 

মহাবিশ্বে চারটা ফোর্স (শক্তি) এর অস্তিত্ব স্বীকার্য। সেগুলো হচ্ছে, Strong Nuclear Force, Weak Nuclear Force, Electromagnatic Force, Gravitional Force.
এই চারটা জিনিস মহাবিশ্বের জন্মলগ্ন থেকে একেবারে ঠিক সেই অনুপাতেই আছে, যে অনুপাতে হলে আমাদের মহাবিশ্ব অস্তিত্বে আসতে পারে। Strong Nuclear Force ঠিক যে পরিমাণে আছে, যদি তার চেয়ে এক পার্সেন্ট কম বা বেশি থাকতো, তাহলে হয়তো আমাদের মহাবিশ্বে শুধু হাইড্রোজেন থাকতো, অথবা একেবারে হাইড্রোজেন ছাড়া হয়ে যেতো। এমতাবস্থায়, সেই মহাবিশ্বে কোনভাবেই প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব হতো না।

মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে Weak Nuclear Force এর পরিমাণ এখন যা আছে যদি তারচেয়ে একটু কম বা একটু বেশি হতো, তাহলে হয়তো মহাবিশ্বে খুব বেশি পরিমাণে হিলিয়াম গ্যাস তৈরি হতো, অথবা একেবারে হিলিয়াম গ্যাস বিহীন একটা মহাবিশ্ব আমরা পেতাম। এমনটা হলে কি হতো জানেন? কোন গ্রহই মহাবিশ্বে অস্তিত্ব লাভ করতো না।
Electromagnatic Force যদি যে পরিমাণ আছে তারচেয়ে সামান্য পরিমাণ কম থাকতো, তাহলে মহাবিশ্বের সব ইলেক্ট্রণ হাওয়ায় মিলিয়ে যেতো এবং এখানে কোন ধরণের অণুই অস্তিত্ব লাভ করতে পারতো না। আবার, Electromagnatic Force যদি যে পরিমাণ আছে, তারচেয়ে সামান্য পরিমাণ বেশি থাকতো, তাহলে পরমাণু কোন ইলেক্ট্রণকেই কনসিস্ট করতে পারতো না। ফলে তখনই কোন প্রকার অণুর অস্তিত্ব লাভ করা সম্ভব হতো না।

এরপর আসা যাক Gravitional Force এর কথায়। এটা যদি যে পরিমাণ আছে, তারচেয়ে সামান্য একটু বেশি থাকতো, তাহলে কি হতো জানেন? গ্রহগুলো মাত্রাতিরিক্ত গরম থাকতো এবং সারাজীবন ধরে দাহ্য হতেই থাকতো। জীবন ধারণের জন্য কোনভাবেই উপযোগি হতোনা। আবার, Gravitional Force যদি সামান্য একটু কম হতো, তাহলে কি হতো? গ্রহগুলোর দাহ্যশক্তি এতোই কম হতো যে সেগুলো ঠান্ডা হয়ে পড়তো। এরকম গ্রহও কোনভাবে জীবন ধারণের জন্য উপযোগি হতো না।

আচ্ছা, বিগ ব্যাংয়ের মতো এরকম মহা বিস্ফোরণের ফলে এই জিনিসগুলো ঠিক সেই অনুপাতে মিলে যাওয়া, যে অনুপাত হলেই জীবন ধারণ এবং তার বিস্তৃতি ঘটার উপযোগি হয়- এটা কি নিছক কাকতালীয়? এই উপাদানগুলোর এরকম অবিশ্বাস্য অনুপাতে ‘মিলে যাওয়া’ কে প্রয়াত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং এভাবে বলেছেন, – “The remarkable fact is that the values of these numbers seem to have been very finely adjusted to make possible the development of Life.’
এই যে জীবনের উপযোগিতার জন্য এই জিনিসগুলোর এরকম নিঁখুতভাবে মিলে যাওয়া, এটার পেছনে কি কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বার হাত নেই? কমনসেন্স কি বলে?


এটাও পড়ুন  যুক্তি নয় বিশ্বাস- আল্লাহ কী সব সংশয়ের উত্তর দিতে বাধ্য ?


উহু, কাহিনী এখানেই শেষ নয়। শুধু যে Strong Nuclear Force – Weak Nuclear Force এবং Electromagnatic Force আর Gravitional Force মিলেমিশে একটা লাইফ সাপোর্টেড মহাবিশ্ব আমরা পেয়ে গেছি তাই নয়। এই উপাদানগুলোর এরকম ‘জাস্ট মিলে যাওয়া’র জন্য দরকার ছিলো একদম সঠিক সময়ে একটা বিগ ব্যাংয়ের, অর্থাৎ একটা মহা বিস্ফোরণের। ঠিক যে সময়টায় এবং যে গতি নিয়ে বিগ ব্যাং ঘটেছিলো, যদি তারচেয়ে একটু কম গতিতে বিগ ব্যাং ঘটতো, তাহলে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ মাত্রা (Expanding Rate) ধীর হয়ে যেতো। ফলে, মহাবিশ্বের অভিকর্ষ বলও ধীর হয়ে পড়তো। যদি এমনটা হতো, তাহলে আমাদের মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের বদলে নিজের মধ্যে গুটিয়ে আবার একটি বিন্দুতে এসে পরিণত হতো। বিজ্ঞানীরা এটাকে বলে ‘Big Crunch’. যদি এমনটা হতো, তাহলে এই যে আপনি, আমি, এই মহাবিশ্ব, গ্রহ-নক্ষত্র, তারকামালা এর কোনকিছুই জন্মাতো না। কিছুই না। আবার, ঠিক যে সময়টায় বিগ ব্যাং ঘটেছিলো, যদি তারচেয়ে একটু সময় পরে ঘটতো এবং যে গতিতে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ শুরু হয়েছিলো, যদি গতির মাত্রা তারচেয়ে একটু বেশি হতো, কি হতো জানেন? মহাবিশ্ব এতো দ্রুতই দৌঁড়াতো যে, আমাদের বসবাস উপযোগি কোন গ্যাস, কোন গ্যালাক্সি কোনকিছুই তৈরি হবার সুযোগ থাকতো না।

শুধু এসবই না। আমাদের ছোট্ট পৃথিবীটাই আগাগোড়া একটা মিরাকল। সূর্য থেকে আমাদের পৃথিবীর এখন যে দূরত্ব, সেটা যদি তারচেয়ে একটু বেশি হতো কি হতো জানেন? আমাদের পুরো পৃথিবীটাই ঠান্ডা বরফে ঢেকে যেতো। পুরো পৃথিবীই হয়ে উঠতো এন্টার্কটিকা মহাদেশ যেখানে কেবল পেঙ্গুইন ছাড়া আর কোন প্রাণীই থাকতে পারতো না।
আবার, পৃথিবীর অবস্থান যদি বর্তমানের চেয়ে আরেকটু নিকটে হতো, তাহলে সব তো কবেই পুঁড়ে কাঠ-কয়লা হয়ে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যেতো।

আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা Magnetic Field এবং সূর্য থেকে ধেয়ে আসা অতি বেগুনী রশ্মি থেকে আমাদের রক্ষাকারী বায়ুমন্ডলের ‘ওজোন স্তর’ এর কথা নাহয় বাদই দিলাম। এই যে এতো এতো উপাদান, উপকরণ ঠিক সেই অনুপাতে ‘মিলে যাওয়া’ টা কি নিছক কোন একসিডেন্ট? এর পেছনে কি সত্যিই কোন মহা পরিকল্পকের হাত নেই? আপনার অবচেতন মনকে প্রশ্ন করুন।

আমরা পদার্থবিদ্যার যে সূত্রগুলো ব্যবহার করি, সেগুলো কেনো ঠিক সেরকম যেরকমটা প্রকৃতির দরকার? কেনো E = mc2 হলো? কেনো ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই বিপরীত প্রতিক্রিয়া’ থাকতে হবে? শক্তির নিত্যতা সূত্র, থার্মোডাইনামিক্সের সূত্রগুলো কেনো ঠিক সেরকম যেরকম আমাদের দরকার? এর ব্যতয় নেই কেনো কোথাও? আমরা এসব সূত্রের কাজ সম্পর্কে জানি। কিন্তু এসব সূত্র ঠিক কোত্থেকে এসেছে? ঠিক এই প্রশ্নটাই রেখেছেন এক সময়কার সবচেয়ে ইনফ্লুয়েন্সিভ নাস্তিক Antony Flew. তিনি বলেছেন, – ‘Then, who wrote the laws of nature?’

সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং প্রশ্ন আসলে এটাই। বিজ্ঞান আমাদের সূত্রগুলোর কাজ জানাতে পারে, কিন্তু এর উৎসমূল সম্পর্কে জানাতে পারেনা। আরো চ্যালেঞ্জিং প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের অস্তিত্ব। বিজ্ঞান মহলে সুবিদিত চ্যালেঞ্জিং প্রশ্নটাই হচ্ছে,- Why there is something rather than nothing?’ কেনো ‘কোনকিছু’ না থাকার বদলে ‘কোনকিছু’ আছে? এই পৃথিবী, এই মহাবিশ্ব, এই গ্রহ, নক্ষত্র, তারকা, সাগর-মহাসাগর এসব তো সৃষ্টি না হলেও পারতো। কেনো হলো? এর পেছনে রহস্য কি? আপাত এই সাধারণ প্রশ্নটাই যুগ যুগ ধরে ‘অমীমাংসিত’ অবস্থায় থেকে গেছে।

‘বিবর্তনবাদ তত্ত্ব’ এসে মাঝখান দিয়ে বিজ্ঞানের অন্দরমহল থেকে ধর্ম আর স্রষ্টাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিতে চাইলো। চার্লস ডারউইন এসে বললেন যে, আমরা আসলে কোন নির্দিষ্ট মানব-মানবী থেকে জন্মাইনি। আমাদের আদিপুরুষ একটি এককোষী ব্যাকটেরিয়া মাত্র। সেই একটি এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকে বিবর্তিত হতে হতে আমরা আজকের আধুনিক মানুষে এসে ঠেকেছি।

টু বি অনেস্ট, বিজ্ঞান জগতে এই ‘বিবর্তনবাদ তত্ত্ব’র মতো ধোঁকাবাজিপূর্ণ, গোঁজামিলে ভরা কোন তত্ত্ব বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে আর একটিও নেই। বিজ্ঞান জগতের ঠুঁটি চেপে ধরা বস্তুবাদী বিজ্ঞান দর্শনের মূলনীতিই হলো- স্রষ্টাতত্ত্বকে কোনভাবেই তারা বিজ্ঞান মহলে প্রবেশ করতে দিবে না। ফলে, যখনই কোন বিজ্ঞানী, কোন গবেষক বিবর্তনবাদ তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বা করেছে, তাকে বরণ করে নিতে হয় অপমান-লাঞ্চনা আর চাকরি থেকে বহিঃস্কার। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা জার্মানির বিজ্ঞানী গুনটার বেকলিই তার উদাহরণ।

বিবর্তনবাদ তত্ত্বে চার্লস ডারউইন অসাড় প্রমাণ হয়েছে অনেক আগেই। তার প্রস্তাবিত ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ পদ্ধতিকে স্বয়ং ডারউইনিস্টরাই অনেক আগে ছুঁড়ে ফেলেছে। ডারউইনকে ত্যাগ করে ‘নিও-ডারউইনিজম’ পদ্ধতির বিবর্তনবাদকে ব্যাখ্যার যে ক’টা ফর্মুলা তারা দাঁড় করিয়েছে, তার কোনটার সাথেই আসল বিজ্ঞানের বিন্দুমাত্র যোগসাজেশ নেই। যা আছে তা অর্ধসত্য, বিকৃত।
[ এ ব্যাপারে আমি আমার দ্বিতীয় বই ‘আরজ আলী সমীপে’ তে একটি অধ্যায়ে সবিস্তার আলোচনা করেছি। আর, কিছুদিনের মধ্যে আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যে বিবর্তনিবাদ গেলানো হয়, সেই বিষয়ে একটি এ্যাকাডেমিক লেভেলের বই প্রকাশ হতে যাচ্ছে, ইন শা আল্লাহ ]

সুতরাং, বিজ্ঞান কখনোই ধর্মবিরোধি হয় না,না প্রকৃত ধর্ম কখনো বিজ্ঞান বিরোধি হয়। বিজ্ঞান নির্ভর করে প্রকৃতির উপর। প্রকৃতি চলে তার সুনির্দিষ্ট ‘ল’ অনুসারে। আর প্রকৃতির সেই ‘ল’ গুলো তো মহান আল্লাহ তাআলা’রই সৃষ্টি। তাহলে, এতে কি করে বিরোধ হতে পারে?

যারা আপনার সামনে বিজ্ঞানকে ধর্মের বিপক্ষে হাজির করে, তারা আপনাকে অর্ধসত্য বিজ্ঞান শেখায়। এরা না নিজেরা সঠিক কিছু জানে, না এরা সঠিক কোনকিছু জানাতে পারে। বিজ্ঞান এবং স্রষ্টার ব্যাপারে বলতে গিয়ে আধুনিক জীব বিজ্ঞানের জনক লুই পাস্তুর বলেছেন,- ‘The more I study science the more I think about God’.
বিজ্ঞান চর্চা কখনোই কাউকে ধর্মবিরোধি করে তোলে না। যারা বিজ্ঞানের ধোঁয়া তুলে ধর্মবিরোধি সাজে, এরা মূলত নিজেদের ‘নফস’ কে প্রাধান্য দেয়। ধর্মের অধীন হতে হলে তাকে কিছু ‘রুলস এন্ড রেগুলেশন’ এর মধ্য দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ভোগবাদী দুনিয়ার মোহে সে এসব রুলস এন্ড রেগুলেশন মানতে রাজি নয়। সে অবশ্যই বিশ্বাস করে যে, তার চারপাশের প্রকৃতি, তার দৃষ্টিগোচরের সবকিছুই একটা নিয়ম, রুলস মেনে চলে। তার কমনসেন্স তাকে এটাও বলে যে, যেখানেই কোন ‘রুলস’ থাকে, ‘নিয়ম’ থাকে, ‘ল’ থাকে, সেখানেই একজন ‘ল গিভার’ থাকাও আবশ্যক। সে জানার পরও অস্বীকার করে। কারণ, তারা নিজেদের প্রবৃত্তিকেই নিজেদের ‘রব’ বানিয়ে নিয়েছে।

হালাল হারাম পরিচয় । ইসলামে হালাল উপার্জনের এত গুরুত্ব কেন ?

ইসলামি শরীয়াতে হালাল ও হারাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পৃথিবীর সব আসমানি গ্রন্থেই হালাল-হারামের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে। হালাল-হারামের বিষয়গুলো নির্ধারিত করার ইখতিয়ার শুধুমাত্র আল্লাহর বিধায় বাস্তবজীবনে হালাল কাজ করা আর হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকার নামই হচ্ছে ইবাদত। ইসলামের মূলমন্ত্রই হলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহ পাকের হুকুম বা আদেশ মানা আর রাসূলুল্লাহ সা. এর তরীকায় জীবন যাপন করা। শুধু মাত্র লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ দ্বীন ইসলাম নহে অথবা শুধু মাত্র মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ দ্বীন ইসলাম নহে। উভয়ের সমম্বয়েই কালেমা বা দ্বীন ইসলাম।

ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল-হারাম
ক. হালাল : কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে যে সব বিষয়কে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে, ইসলামি শারীয়াতের পরিভাষায় তা হালাল বা বৈধ। অন্য কথায়- হালাল অর্থ বৈধ, উপকারী ও কল্যাণকর বস্তুসমূহ। মানুষের জন্য যা কিছু উপকারের ও কল্যাণকর ঐ সমস্ত কর্ম ও বস্তুকে আল্লাহ পাক মানুষের জন্য হালাল করেছেন। যেমন: নামায, রোযা , হজ্জ, যাকাত, পর্দা, ছাগল মাংস ভক্ষণ, আল্লাহ নির্দেশিত ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি। একজন মুসলিমের উচিত সর্বদা হালাল বা বৈধ পদ্ধতি অবলম্বন করা।

(২) হারাম : কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে যে সব বিষয়কে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে, ইসলামি শারীয়াতের পরিভাষায় তা হারাম বা অবৈধ। অন্য কথায়, হারাম অর্থ অবৈধ, ক্ষতিকারক, অকল্যাণকর কর্ম ও বস্তুসমূহ: যা মানুষের জন্য অপকারের বা ক্ষতির কারণ। ঐ সমস্ত কর্ম বা বস্তকে আল্লাহ পাক হারাম করেছেন। যেমন: শুকরের মাংস মানুষের জন্য ক্ষতিকারক, সুদ, ঘুষ, বেনামাজী, বেপর্দা এবং সকল পাপ কর্ম ইত্যাদি। হারাম কাজ করলে আল্লাহর শাস্তি নির্ধারিত বিধায় এ ধরনের কাজ বর্জন করাও বাধ্যতামূলক। যেমন: সুদ খাওয়া, গীবত করা বা অপবিত্র কিছু খাওয়া  বা অবৈধ ব্যবসা বাণিজ্য করা।

হালাল ও হারাম বিধানের উদ্দেশ্য-
বিশ্বমানবতার কল্যাণ সাধন এবং অকল্যাণ ও ক্ষতি থেকে রক্ষা করা। হালাল বিধান পালনেই বান্দার জন্য রয়েছে- আত্মার কল্যাণ, দেহের কল্যাণ এবং বিবেক-বুদ্ধির সুস্থতা। যা দ্বীন-ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এতে আল্লাহ বান্দার প্রতি নাযিল করেন রহমত ও বরকত। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি হারাম কাজ করে তার অন্তর-আত্মা নষ্ট হয়ে যায়, দেহের ক্ষতি হয় এবং বিবেক বুদ্ধি লোপ পায়। যা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বহন করে। এক কথায় তাকে গোনাহগার বানিয়ে দেয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য সব ধরনের কঠোরতা তুলে নিয়ে ইসলামের হালাল ও হারামের বিধান মানুষকে অশান্তির শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে নিষ্কৃতি দান করেছেন। হালাল-হারামের বিধান নির্ধারণে আল্লাহ বলেন- ”যারা অনুসরণ করে সেই রাসূলকে (যিনি) নবী, উম্মী, যাঁকে তারা পায় উল্লিখিত তাদের কাছের তওরাতে ও ইঞ্জীলে, আর যিনি তাদের নির্দেশ দেন সৎকাজের ও তাদের নিষেধ করেন অসৎকাজ থেকে, আর তাদের জন্য বৈধ করেন ভালো বিষয়বস্তু ও তাদের জন্য নিষেধ করেন মন্দ জিনিসগুলো, আর যিনি তাদের থেকে দূর করে দেন তাদের বোঝা ও বন্ধন যা তাদের উপরে ছিল। অতএব যারা তাঁতে বিশ্বাস করে ও তাঁকে মান্য করে ও তাঁকে সাহায্য করে আর অনুসরণ করে সেই আলো যা তাঁর সঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে, — এরা নিজেরাই হচ্ছে সফলকাম। [সূরা আরাফ : আয়াত ১৫৭]

হালালের উদাহরন
(১) মুসলমানদের গরু, ছাগল খাওয়ার হুকুম আল্লাহ পাক দান করেছেন। কিন্তু উহা যদি আল্লাহু আকবার তথা আল্লাহর নামে বলে কিন্তু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তরীকায় জবেহ করা না হয় তবে উহা মুসলমানের জন্য হারাম হয়ে যাবে। কারন গরু বা ছাগল খাওয়া আল্লাহ পাকের হুকুম আছে কিন্তু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নুরানী সুন্নত তরীকা না থাকার কারনে উহা হারাম হয়ে যাবে। কিন্তু উহা যদি আল্লাহ পাকের নাম নিয়ে সুন্নত তরীকায় জবেহ করা হয় তখন উহা হালাল হবে। তেমনি শরীয়তের সমস্ত কাজ যখন আল্লাহ পাকের হুকুম ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তরীকায় পালিত হবে তখন উহা হালাল বা বৈধ এবং এবাদতে গন্য হবে নচেৎ নয়।

হারামের উদাহরন
(১) আল্লাহ পাক শুকর খাওয়াকে হারাম করেছেন। কিন্ত কেউ যদি শুকরকে সুন্নত নিয়মে জবেহ করে তবুও উহা হালাল হবে না বরং হারাম হবে। এখানে আল্লাহ পাকের হুকুম নেই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তরীকা লাগালেও উহা বৈধ বা হালাল এবং এবাদতে গন্য হবেনা। তেমনি আল্লাহ পাক যে সমস্ত কাজ বা বস্ত হারাম করেছেন যেমন: শুকর, সুদ , ঘুস, বেপর্দা, হারাম ব্যবসা ইত্যাদি  সককিছুই হারাম হবে। এ গুলো ইবাদতে গণ্য হবে না।
হালাল হারামহারাম পথে উপার্জনগুলো কী : সাধারণত যেসব অবৈধ উপায়ে আয়ের পন্থা সমাজে চালু রয়েছে সেসবের মুধ্যে ঘুষ, সুদ, হারাম পণ্যসামগ্রীর ব্যবসা, কালোবাজারী, চোরাকারবারী, নাচ-গান, ফটকবাজারী, সব ধরনের প্রতরণা, পতিতাবৃত্তি, সমস্ত প্রকারের লটারী, জুয়া প্রভৃতিই প্রধান। রাসূল (সা.) এসব হারাম ও অনৈতিক পথে উপার্জন কঠোরভাবে রোধ করেছেন। তৎকালীন সময়েই শুধু নয়, বর্তমান যুগেও অন্য কোনও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এত ব্যাপকভাবে অবৈধ ও অশ্লীল উপায়ে উপার্জন ও ভোগের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়নি। একারণেই সেসব মতাদর্শে সামাজিক দুর্নীতি ও অনাচারের সয়লাব বয়ে যাচ্ছে।

হারাম উপার্জন নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ : ইসলামে যা কিছু বৈধ ঘোষণা দেয়া হয়েছে বা অবৈধ করা হয়েছে, তার অবশ্যই কতগুলো কারণ আছে । হতে পারে অনেক সময় সেগুলো প্রত্যক্ষভাবে আমাদের চোখে ধরা পড়ে, আবার অনেক সময় পড়ে না । ইসলামবেত্তাগণের মতে, ইসলামে হারাম উপার্জন নিষিদ্ধ হবার কয়েকটি কারণ রয়েছে । যেমন-

এক. হারাম উপার্জন একটি জুলুম : অবৈধ আয়ের উদ্দেশ্যে জনগণের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুলুম করা হয়। হয়রানী করে বা কৌশলে প্রতারণা করে অথবা বাধ্য করে লোকদের নিকট থেকে ব্যক্তিবিশেষ বা অনেক সময় শ্রেণিবিশেষ উপার্জন করে থাকে। এতে জনগণ যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয় তেমনি সমাজে সৃষ্টি হয় অসন্তোষ। দরিদ্র ও সাধারণ লোক তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার হতে হয় বঞ্চিত। উপরন্ত কলহ, বিশৃঙ্খলা বিদ্বেষ ও বিভেদ সৃষ্টির পথ প্রশস্ত হয়। অনেক সময়ে ব্যক্তিবিশেষও উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অবৈধ অর্থ ব্যয় করে থাকে। যেমন ঘুষ। বিশ্বের সর্বত্রই এটা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বহু দেশে সামরিক আইন পর্যন্ত চালু করা হয়েছে ঘুষ উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকেই ঘুষ নিতে দেখা গেছে। ঘুষ বা উপরি আয় আজ অন্য আর দশটা উপায়ে আয়ের মতোই খুব সহজ ও স্বাভাবিক বলে স্বীকৃত হচ্ছে। কিন্তু যারা ঘুষ নেয় বা দেয় তাদের উদ্দেশ্যে রাসূলে (সা.) সতর্ক করে দিয়ে বলেন- ঘুষ গ্রহণকারী ও ঘুষ প্রদানকারী উভয়েরই উপর আল্লাহর অভিসম্পাত। [বুখারী, মুসলিম]

দুই. হারাম উপার্জন নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী : চারিত্রিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী বিষয় যেমন- নৃত্য সঙ্গীত, মদ, বেশ্যাবৃত্তিসহ সবধরনের অশ্লীল কাজ ইসলামী সমাজে নিষিদ্ধ। এসবের ব্যবসা করাও তাই নিষিদ্ধ। সমাজে এসব কাজের এতটুকুও প্রশ্রয় দিলে অশ্লীলতা, বেহায়াপনার কলুষতা ছড়িয়ে পড়বে। এর বিষবাষ্প প্রবেশ করবে সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ফলে চরিত্রহননের সীমা থাকবে না। গোটা সমাজ পাপ-পংকিলতায় নিমজ্জিত হবে। সে জন্যেই এসব জিনিসের ভোগ শুধু নিষিদ্ধই নয়, এসবের শিল্প-কারখানা তৈরি করা ও ব্যবসা করা অর্থাৎ এ সমস্ত উৎস হতে উপার্জন করাও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

তিন. অবৈধ কাজে ব্যয় : অবৈধ উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদ সাধারণত অবৈধ কাজে ব্যয় হয়। অবৈধ কাজে ব্যয়ের অর্থই হচ্ছে সামাজিক অনাচার ও পঙ্কিলতার পরিমাণ বৃদ্ধি করা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, অবৈধ ও অসৎ উপায়ে যারা আয় করে থাকে তারা সে আয় নানা সমাজবিরোধী তথা ইসলামী অনুশাসনবিরোধী কাজে ব্যয় করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ নাচ-গান, সিনেমা, নানা রং তামাশা, বিলাস-ব্যসন, মদ্যসক্তি, বেশ্যাগমন, ব্যয়বহুল, প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি প্রভৃতির উল্লেখ করা যেতে পারে। এর যে কোনো একটিই সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। যদি এর সবগুলিই কোন সমাজ বা জাতির মধ্যে ক্রমে ক্রমে অনুপ্রবেশ তাহলে গোটা সমাজ ও জাতির চূড়ান্ত সর্বনাশ হবে। এ জন্যই রাসূল (সা.) কঠোরভাবে বলেছেন- অবৈধ উপায়ের উপার্জনে তৈরি রক্তমাংস দোযখের খোরাক হবে। [সুনানে তিরমিজি]

চার. অপব্যায় বৃদ্ধি পায় : হারাম উপার্জন সহজলভ্য হওয়ার ফলে উপার্জিত অর্থের প্রতি স্বাভাবিক টান মানুষের থাকে না । ফলে অপব্যয় ও অপচয় বৃদ্ধি পায় । আর অপব্যয়ের ছিদ্রপথেই সংসারে আসে অভাব-অনটন। সমাজে আসে অশান্তি। অশান্তি আর অনটন হতে রক্ষা পেতে হলে মিতব্যয়ীতাই হওয়া উচিৎ আদর্শ। কৃপণতা যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত অপব্যয়ও তেমনি অনভিপ্রেত। এ দুয়ের মধ্যবর্তী পথই হচ্ছে উত্তম পথ। অর্থাৎ, মিতব্যয়ীতাই উত্তম পথ। এ ব্যাপারে আল কুরআনে এরশাদ হয়েছে-

وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا

অর্থ : তারাই আল্লাহর নেক বান্দা যারা অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে না অপচয় ও বেহুদা খরচ করে, না কোনরূপ কৃপণতা করে। বরং তারা এ উভয় দিকের মাঝখানে মজবুত হয়ে চলে। [সূরা ফুরকান, আয়াত ৬৭]

পাঁচ. জুয়ার শক্তিবৃদ্ধি : হারাম আয়ের বড় একটি উৎস হলো জুয়া। আজ যেমন সর্বত্র নানা ধরণের জুয়া চলছে, তেমনি অতীতেও এর প্রচলন ছিলো । জুয়ার ইতিহাস বহু প্রাচীন। জুয়ার কবলে পড়ে কত  পরিবার যে সর্বস্বান্ত হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। শিল্প বিপ্লবের পর জুয়ার আরও চমকপ্রদ ও নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে। পূর্বে জুয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তীর ও পাশার খেলা। পরবর্তীতে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঘোড়াদৌড়, তাসের বিভিন্ন খেলা, হাউজী, রুলেতে, শব্দচয়ন, লটারী প্রাইজবন্ড ইত্যাদি নানা ধরনের ও কৌশলের জুয়া। জুয়াকে তাই ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

অর্থ : হে মুমিনগণ, জেনে রাখ, মদ জুয়া মূর্তি এবং (গায়েব জানার জন্যে) পাশা খেলা, ফাল গ্রহণ ইত্যাদি অতি অপবিত্র জিনিস ও শয়তানের কাজ। অতএব, তোমরা তা পরিত্যাগ কর। তবেই তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে। [সূরা মায়েদা, আয়াত ৯০]

ছয়.  ফটকাবাজির প্রসার : এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফটকাবাজারী। ফটকাবাজারী সম্পূর্ণভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবদান। শেয়ার মার্কেটে সম্ভাব্য মুনাফার চটকদার হিসেব দেখিয়ে ও অন্যান্য অপকৌশলের মাধ্যমে শেয়ার বিক্রির ফলে কত পরিবার যে রাতারাতি নি:স্ব হয়েছে তার হিসেব নেই। বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট তার জাজ্জ্বল্যমান নজীর। ধোঁকাবাজী বা প্রতারণার ঘোর শত্রু  ইসলাম। রাসূল (সা.) বলেছেন- যে ব্যক্তি ধোঁকাবাজী করে সে আমার দলভূক্ত লোক নয়। [আবু দাউদ]

হারাম থেকে বেঁচে থাকার জন্যে করণীয় : বাস্তবিকই ব্যক্তি ও সমাজ জীবন তথ্য সামগ্রিক অর্থনৈতিক জীবনে আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে সততা ও মধ্যম পন্থা অনুসরণ করে চললে সুষ্ঠু ও সাবলীল উন্নতি হতে পারে। বস্তুত: পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক অবক্ষয় ও ক্রমবর্ধমান সামাজিক অনাচার ও পাপাচারের মুখ্য কারণ অপব্যয় ও অবৈধ পন্থায় ব্যয়। এজন্যেই রাসূল (সা.) এর মূলোচ্ছেদ করেছিলেন। ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারের দায়িত্বের কথাও উল্লেখযোগ্য। ব্যক্তি মানুষের অপরাধ প্রবণতা যদি আল্লাহর ভয়ে ও রাসূল (সা.)-এর সন্তষ্টি অর্জনের জন্যে স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে সংশোধিত না হয় তাহলে সরকার অবশ্যই ইসলামী আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ন্যূনতম ব্যবস্থা হচ্ছে, যাদের হাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ-সম্পদ রয়েছে তাদের সেসব সম্পত্তি বৈধ বা জায়েজ পথে অর্জিত হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করা। এ উদ্দেশ্যেই মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) এর নির্দেশে হিসবাহ নামে একটি দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দপ্তরটির কাজ ছিল অবৈধ উপায়ে আয় রোধ করা, একাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা। অবৈধভাবে গ্রহণ করে থাকলে তা মূল মালিকের কাছে প্রত্যর্পণ করা। যদি তা সম্ভব না হয় বা সেভাবে আয় না হয়ে থাকে তবে তা বায়তুল মালেই জমা দেওয়া হতো।

পরিশেষে…
আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি তিনি যেন তাঁর বান্দাদের হালাল ও হারামের পরিচয় লাভ করার পর এর বিধান পালনের তাওফিক দান করেন। কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক আমলি জিন্দেগি যাপন করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার তাওফিক দান করেন এবং পরকালে মুক্তি দান করেন। আমিন।


এটা পড়ুন – সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ এর ব্যবসায়ীরা


[সূত্র :  ১. অর্থনীতিতে রাসুল (সা.)-এর দশদফা, শাহ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান।, ২. ব্যবসা-বাণিজ্য : করণীয় বর্জণীয়, জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের। ৩। হালাল-হারামের পরিচয় ও বিধান,মাওলানা আব্দুস সাত্তার]

যাকাত ও সদকা-সম্পর্কিত নির্বাচিত আয়াত

١٧٧  لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَىٰ حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا ۖ وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ ۗ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ
১। সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার। [সূরা বাকারা :  ১৭৭]

٢١٥  يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ ۖ قُلْ مَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۗ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ
২। তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, কি তারা ব্যয় করবে? বলে দাও-যে বস্তুই তোমরা ব্যয় কর, তা হবে পিতা-মাতার জন্যে, আত্নীয়-আপনজনের জন্যে, এতীম-অনাথদের জন্যে, অসহায়দের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে। আর তোমরা যে কোন সৎকাজ করবে, নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত ভালভাবেই আল্লাহর জানা রয়েছে। [সূরা বাকারা : ২১৫]

                                      مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ أَضْعَافًا كَثِيرَةً ۚ وَاللَّهُ يَقْبِضُ وَيَبْسُطُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
৩। এমন কে আছে যে, আল্লাহকে করজ দেবে, উত্তম করজ; অতঃপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন। আল্লাহই সংকোচিত করেন এবং তিনিই প্রশস্ততা দান করেন এবং তাঁরই নিকট তোমরা সবাই ফিরে যাবে।[সূরা বাকারা : আয়াত ২৪৫]

٢٤٧  وَقَالَ لَهُمْ نَبِيُّهُمْ إِنَّ اللَّهَ قَدْ بَعَثَ لَكُمْ طَالُوتَ مَلِكًا ۚ قَالُوا أَنَّىٰ يَكُونُ لَهُ الْمُلْكُ عَلَيْنَا وَنَحْنُ أَحَقُّ بِالْمُلْكِ مِنْهُ وَلَمْ يُؤْتَ سَعَةً مِنَ الْمَالِ ۚ قَالَ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَاهُ عَلَيْكُمْ وَزَادَهُ بَسْطَةً فِي الْعِلْمِ وَالْجِسْمِ ۖ وَاللَّهُ يُؤْتِي مُلْكَهُ مَنْ يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
৪। আর তাদেরকে তাদের নবী বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তালূতকে তোমাদের জন্য বাদশাহ সাব্যস্ত করেছেন। তারা বলতে লাগল তা কেমন করে হয় যে, তার শাসন চলবে আমাদের উপর। অথচ রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার ক্ষেত্রে তার চেয়ে আমাদেরই অধিকার বেশী। আর সে সম্পদের দিক দিয়েও সচ্ছল নয়। নবী বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর তাকে পছন্দ করেছেন এবং স্বাস্থ্য ও জ্ঞানের দিক দিয়ে প্রাচুর্য দান করেছেন। বস্তুতঃ আল্লাহ তাকেই রাজ্য দান করেন, যাকে ইচ্ছা। আর আল্লাহ হলেন অনুগ্রহ দানকারী এবং সব বিষয়ে অবগত।[সূরা বাকারা : আয়াত ২৪৭]

٢٥٤  يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لَا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خُلَّةٌ وَلَا شَفَاعَةٌ ۗ وَالْكَافِرُونَ هُمُ الظَّالِمُونَ
৫। হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছি, সেদিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় কর, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারিশ কিংবা বন্ধুত্ব। আর কাফেররাই হলো প্রকৃত যালেম।[সূরা বাকারা : আয়াত ২৫৪]

      مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ ۗ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ ۗ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
৬।  যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ। [ সূরা বাকারা : আয়াত ২৬১]

٢٦٣  قَوْلٌ مَعْرُوفٌ وَمَغْفِرَةٌ خَيْرٌ مِنْ صَدَقَةٍ يَتْبَعُهَا أَذًى ۗ وَاللَّهُ غَنِيٌّ حَلِيمٌ
৭। যে দানের পর ক্লেশ দেওয়া হয় তা অপেক্ষা ভাল কথা ও ক্ষমা শ্রেয়। আল্লাহ অভাবমুক্ত, পরম সহনশীল। [সূরা বাকারা : আয়াত ২৬৩]


এটা পড়ুন – একাকী সফর ও নি:সঙ্গ রাত্রি যাপন সুন্নাতের খেলাফ।


٩٧  مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَىٰ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً ۖ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
৮। মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকর্ম করবে তাকে আমি নিশ্চয়ই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব। [সূরা নাহল : আয়াত ৯৭]

١٨  إِنَّ الْمُصَّدِّقِينَ وَالْمُصَّدِّقَاتِ وَأَقْرَضُوا اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا يُضَاعَفُ لَهُمْ وَلَهُمْ أَجْرٌ كَرِيمٌ
৯।  নিশ্চয় দানশীল ব্যক্তি ও দানশীলা নারী, যারা আল্লাহকে উত্তমরূপে ধার দেয়, তাদেরকে দেয়া হবে বহুগুণ এবং তাদের জন্যে রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার। [সূরা হাদীদ : আয়াত ১৮]

٢٠  إِنَّ رَبَّكَ يَعْلَمُ أَنَّكَ تَقُومُ أَدْنَىٰ مِنْ ثُلُثَيِ اللَّيْلِ وَنِصْفَهُ وَثُلُثَهُ وَطَائِفَةٌ مِنَ الَّذِينَ مَعَكَ ۚ وَاللَّهُ يُقَدِّرُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ ۚ عَلِمَ أَنْ لَنْ تُحْصُوهُ فَتَابَ عَلَيْكُمْ ۖ فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ ۚ عَلِمَ أَنْ سَيَكُونُ مِنْكُمْ مَرْضَىٰ ۙ وَآخَرُونَ يَضْرِبُونَ فِي الْأَرْضِ يَبْتَغُونَ مِنْ فَضْلِ اللَّهِ ۙ وَآخَرُونَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۖ فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ ۚ وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَقْرِضُوا اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا ۚ وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ مِنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللَّهِ هُوَ خَيْرًا وَأَعْظَمَ أَجْرًا ۚ وَاسْتَغْفِرُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
১০। আপনার পালনকর্তা জানেন, আপনি এবাদতের জন্যে দন্ডায়মান হন রাত্রির প্রায় দু’তৃতীয়াংশ, অর্ধাংশ ও তৃতীয়াংশ এবং আপনার সঙ্গীদের একটি দলও দন্ডায়মান হয়। আল্লাহ দিবা ও রাত্রি পরিমাপ করেন। তিনি জানেন, তোমরা এর পূর্ণ হিসাব রাখতে পার না। অতএব তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমা পরায়ন হয়েছেন। কাজেই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে সহজ, ততটুকু আবৃত্তি কর। তিনি জানেন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হবে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশে-বিদেশে যাবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জেহাদে লিপ্ত হবে। কাজেই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে সহজ ততটুকু আবৃত্তি কর। তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। তোমরা নিজেদের জন্যে যা কিছু অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে এবং পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে। তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।[সূরা মুয্যম্মিল : আয়াত ২০]

٩٢  لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّىٰ تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ ۚ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ
১১।  কস্মিণকালেও কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে তোমরা ব্যয় না কর। আর তোমরা যদি কিছু ব্যয় করবে আল্লাহ তা জানেন। [সূরা আলে- ইমরান : আয়াত ৯২]

٣٦  إِنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ ۚ وَإِنْ تُؤْمِنُوا وَتَتَّقُوا يُؤْتِكُمْ أُجُورَكُمْ وَلَا يَسْأَلْكُمْ أَمْوَالَكُمْ ٣٧  إِنْ يَسْأَلْكُمُوهَا فَيُحْفِكُمْ تَبْخَلُوا وَيُخْرِجْ أَضْغَانَكُمْ
১২। পার্থিব জীবন তো কেবল ক্রীড়া-কৌতুক, যদি তোমরা ঈমান আন, তাকওয়া অবলম্বন কর, আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের পুরস্কার দিবেন এবং তিনি তোমাদের ধন- সম্পদ চান না। তোমাদের নিকট হতে তিনি তা চাইলে ও তজ্জন্য তোমাদের উপর চাপ দিলে তোমরা তো কার্পণ্য করবে এবং তখন তিনি তোমাদের বিদ্বেষভাব প্রকাশ করে দিবেন।  দেখ, তোমরাই তো তারা যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে বলা হয়েছে অথচ তোমাদের অনেকে কৃপণতা করতেছে। যারা কার্পণ্য করে তারা তো কার্পণ্য করে নিজেদেরই প্রতি। আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং তোমরা অভাবগ্রস্ত। যদি তোমরা বিমুখ হও, তিনি অন্য জাতিকে তোমাদের স্থলবর্তী করবেন, তারা তোমাদের মত হবে না। [সূরা মুহাম্মদ : আয়াত ৩৬-৩৮]

٧  مَا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِ مِنْ أَهْلِ الْقُرَىٰ فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ ۚ وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
১৩।  আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রসূলের, তাঁর আত্নীয়-স্বজনের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্যে, যাতে ধনৈশ্বর্য্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়। রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা। [সূরা হাশর : আয়াত ৭]

রেফারেন্স – http://www.quranwow.com

মাদরাসা – ইতিহাসে ফিরে দেখা

ইমরান রাইহান  ১. আমি ছিলাম। এখনো আছি। আমি তোমাদের আলো দেই। জ্ঞানের আলো। সূর্যের আলোর চেয়েও মহান সে আলো। আমি তোমাদের শিক্ষা দেই। আলোকিত করি। গড়ে তুলি নববী আদর্শে। তোমরা সবাই জানো আমার পরিচয়। আমি মাদরাসা।

…. আমার আগেও বিভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। সবার জন্যে নয়, অভিজাতদের জন্য। এরিস্টটল মহিলা ও গোলামদের শিক্ষার অনুমতি দেন নি। ভারতে মনু বিরোধিতা করেছেন শুদ্রদের শিক্ষার। শুদ্র বেদ পড়লে তার কানে ঢোকানো হতো গলিত সীসা। পৌনে দুইশ বছর আগে, ১৮৩৪ সালেও দক্ষিণ ক্যারোলিনাতে আইন ছিল কোনো কালো মানুষকে শিক্ষা দেয়া যাবে না। শুরু থেকেই আমি এসব ভেদাভেদ থেকে মুক্ত। আমার খেজুর পাতার চাটাইয়ে সবাইকেই স্বাগতম। আমার জন্ম দারুল আরকামে। সেই থেকে পথচলা শুরু।

২. ইসলামের শুরুর দিকে বাচ্চাদের পড়াশোনা ঘরেই হতো। হযরত উমর (রা) স্বীয় খেলাফতকালে মদীনায় তিনটি মকতব প্রতিষ্ঠা করেন। এসব মকতবে কুরআন তিলাওয়াত, হস্তলিপি ও অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তীর চালনা, অশ্বারোহণ, তরবারী চালনা ইত্যাদি শেখানো হতো। রাসুল (সা) এর যুদ্ধের ঘটনাবলী পড়ানো এবং মুখস্থ করানো হতো। শিক্ষকদের মাসিক ভাতা ছিল পনেরো দিরহাম।

এক পত্রে হযরত উমর (রা) শামের মুসলমানদের লিখেন, ‘তোমরা সন্তানদের তীর চালনা ও অশ্বারোহণ শিক্ষা দাও’ হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা) তার সন্তানদের পাশে বসে তাদেরকে যুদ্ধের ঘটনাবলী শোনাতেন। সেগুলো মুখস্থকরণে উৎসাহ দিতেন। মদীনায় উরওয়াহ বিন যুবায়েরের দরসগাহতে মাগাজী বিষয়ক বর্ণনা পড়ানো হতো। এই দরসগাহ প্রসিদ্ধ ছিল ‘কুত্তাবে উরওয়াহ’ নামে। খলীফা হিশাম বিন আব্দুল মালেক তার সন্তানের শিক্ষক সুলাইমান কালবিকে বলেছিলেন, ‘তাকে (শাহজাদাকে) হালাল, হারাম শিক্ষা দাও এবং বয়ান ও যুদ্ধে পারদর্শী করে তোলো’

৩. আমি আগেও ছিলাম। ছিলাম পুরো মুসলিম বিশ্ব জুড়ে। তখন আমার কোনো নিজস্ব ভবন ছিলো না। ছিলো না প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। মসজিদের প্রশস্ত প্রাঙ্গণে, খানকাহগুলোর সংকীর্ণ কুঠুরিতে, কিংবা কোনো আলেমের বাসভবনে, ছিলো আমার অবস্থান। নিজের জন্য একটা আলাদা ভবন পেয়েছি অনেক পরে। কবে ?? এখন সেসব মনে নেই। অনেকদিন আগের কথা কিনা। অনেকেই বলে নিজামুল মুলক তুসি যখন ৪৫৮ হিজরীতে জামেয়া নিজামিয়া বাগদাদ প্রতিষ্ঠা করেন সেটাই ছিল আমার প্রথম নিজস্ব ভবন। ইবনে খাল্লিকানও এই মতের সমর্থন করেন। তবে জালালুদ্দীন সুয়ুতী বলেন অন্যকথা। তিনি লিখেছেন ৪০০ হিজরীতে মিসরে আমার জন্য নির্মাণ করা হয় আলাদা ভবন। ওয়াকফ করা হয় লাইব্রেরী। নিয়োগ দেয়া হয় শিক্ষক।

এটা পড়ুন – ভারতবর্ষের কাগজ


৪১০ হিজরীতে মাথুরা বিজয়ের পর সুলতান মাহমুদ গজনভী গজনীতে একটি মাদ্রাসা নির্মান করেন। সেই মাদরাসার লাইব্রেরীতে অনেক ভাষার বই ছিলো’ লিখেছেন কাসিম ফিরিশতা। এমনকি হাকিম নাসির খসরু যখন নিশাপুর পৌছান, ৪৩৮ হিজরীতে, সেখানেও তিনি দেখেন একটি মাদ্রাসা। যা নির্মিত হয়েছে তুগরিল বেগের আদেশে।

জামে আয যাইতুনা। আফ্রিকায় জ্বেলেছিল ইলমের প্রদীপ
জামেয়া মুস্তানসিরিয়া
আব্বাসী খলীফা মুস্তানসির বিল্লাহ চাইলেন তার নামে একটি মাদরাসা হোক। জন্ম নিল জামেয়া মুস্তানসিরিয়া

৪. ভারতবর্ষেও আমি ছিলাম। আমার আলাদা কাঠামো ছিলো। ছিলো নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা। এমনকি আমার জন্য নির্ধারিত ভবনও ছিলো। অনেকদিন পর্যন্ত আল্লামা শিবলী মনে করতেন, ভারতবর্ষে আমার আলাদা কাঠামো ছিলো না। পরে অবশ্য তিনি সে বক্তব্য থেকে ফিরে এসেছিলেন। ভারতবর্ষে আমি কোথায় ছিলাম?? প্রথমদিকে আমি ছিলাম মসজিদের প্রশস্ত আঙিনায়। দিল্লী, আগ্রা, লাহোর, জৌনপুর, আহমেদাবাদ, গুজরাট ও অন্যান্য শহরের প্রাচীন মসজিদগুলোতে আজো ছোট ছোট কক্ষ দেখা যায়। এগুলো ছিল আমার ছাত্রাবাস। সেকালের খানকাহগুলোতেও ছিলো আমার সরব উপস্থিতি। সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে খানকাহগুলোকে যে অর্থ দেয়া হতো তার বেশিরভাগই খরচ হতো আমার জন্য। আবার কখনো কখনো, বুজুর্গ কিংবা সম্রাটদের কবরের পাশে নির্মাণ করা হতো ছোট ছোট কক্ষ। শুরু হতো দরস ও তাদরিস। জন্ম নিতাম আমি। মাদরাসা।

কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ, দিল্লী।
কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ, দিল্লী।

দিল্লীতে সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির কবরের পাশে ছিল একটি মাদরাসা। এ মাদরাসা কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের সাথে সংযুক্ত ছিল। মাদরাসার ভবন আজো বিদ্যমান।

৫৮৭ হিজরীতে আজমির জয় করার পর শিহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী বেশকিছু মাদরাসা নির্মান করেন। ৬০৭ হিজরীতে সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ বাদায়ুনে একটি মসজিদ ও মাদরাসা নির্মান করেন। তার সন্তান নাসিরুদ দুনিয়া ওয়াদ দ্বীন শাহজাদা মাহমুদ দিল্লীতে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদরাসার নাম ছিল নাসিরিয়্যাহ। তবাকাতে নাসিরির লেখক আবু ওসমান মিনহাজুদ্দিন ছিলেন এই মাদরাসার প্রধান শিক্ষক। মুহাম্মদ বিন তুঘলক কেল্লা খুররমাবাদ নির্মানকালে ভেতরে মসজিদ ও মাদরাসা নির্মান করেন। আকবরের শাসনামলে মাহিম বেগম পুরনো কেল্লার পশ্চিম দরজার পাশে একটি মসজিদ ও মাদরাসা নির্মান করেন। মাদরাসার নাম খাইরুল মানাযিল। নির্মাণকাল ৯৬৯ হিজরী।৫. ‘মোল্লা নিজামুদ্দীন কেনো প্রসিদ্ধ হলেন ?? তিনি কিছু বই লিখেছেন, কিন্তু এটাই তার খ্যাতিলাভের মূল কারণ নয়। সে যুগে বড় বড় অনেক আলেমই ছিলেন। যেমন, মোল্লা মুহিব্বুল্লাহ বিহারী, মোল্লা জিয়ুন, মীর গোলাম আলী আহমদ। তারাও বিভিন্ন শাস্ত্রে বই লিখেছেন। তবু অন্যদের চেয়ে মোল্লা নিজামুদ্দীনের প্রসিদ্ধি বেশী। আজ সারা ভারতবর্ষেই তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হচ্ছে। এসবই হচ্ছে তার প্রণীত নেসাব তথা পাঠ্যক্রমের অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে। পিতা মোল্লা কুতুবুদ্দীনের দেখানো পথেই হেটেছেন পুত্র নিজামুদ্দীন। পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেছেন তিনি। তার প্রণীত নেসাবের বৈশিষ্ট্য ছিলো :

১. এই নেসাবেই প্রথম ভারতীয় উলামায়ে কেরামের লিখিত বইপত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

   যেমন, নুরুল আনোয়ার, রশিদিয়াহ, শামসে বাযেগাহ ইত্যাদি।
২. প্রত্যেক শাস্ত্রের ওই বই নির্বাচন করা হয় যার চেয়ে কঠিন বই ওই শাস্ত্রে নেই।
৩. অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে মানতেক ও ফালসাফার বইপত্র ছিলো বেশী।
৪. হাদিসের শুধু একটি কিতাব পড়ানো হতো। মিশকাত।
৫. আদব পড়ানো হতো খুবই কম। একজন মাঝারী মেধার ছাত্রও ১৬/১৭ বছর বয়সের মধ্যেই এই নেসাব সমাপ্ত করে ফারেগ হতে পারতো। ফিরিঙ্গী মহলের অধিকাংশ ওলামাগন এই বয়সেই ফারেগ হয়েছেন। মোল্লা নিজামুদ্দীনের এই নেসাব ‘বাহরুল উলুম’ আব্দুল আলী কিংবা মোল্লা কামালের মতো আলেম তৈরি করেছে । মোল্লা নিজামুদ্দীনের ছাত্ররা পুরো ভারতবর্ষে এই নেসাবের প্রচার প্রসার করেছেন। সহেলী আর বালাগ্রামের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলও হয়ে উঠেছে ইলমের মারকায। মোল্লা নিজামুদ্দীনের সেই দরসগাহ এখনো আছে। আমি ১৮৯৬ সালে সেই দরসগাহ পরিদর্শন করতে যাই। বাদশাহ আলমগীর প্রদত্ত সেই অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। এই অট্টালিকাই ছিলো আমাদের ভারতবর্ষের কেমব্রিজ।- (আল্লামা শিবলী নোমানীর মাকালাত থেকে)
তথ্যসূত্র:
১. তাদবীনে সিয়ার ওয়া মাগাজী— আল্লামা কাজী আতহার মোবারকপুরী
২. খাইরুল কুরুন কি দরসগাহে — আল্লামা কাজী আতহার মোবারকপুরী
৩. হিন্দুস্তান মে মুসলমানো কা নেজামে তালীম ও তরবিয়ত — সাইয়েদ মানাজির আহসান গিলানী
৪. মাকালাতে শিবলী (৩য় খন্ড)– আল্লামা শিবলী নোমানি
৫. তারিখে ফেরেশতা – মুহাম্মদ কাসিম ফেরেশতা।
৬. জামিয়া নিজামিয়া বাগদাদ কা ইলমি ওয়া ফিকরি কিরদার, এক তাহকিকি জায়েযা – ড. সুহাইল শফীক

৭. হিন্দুস্তান কী কদিম ইসলামী দরসগাহে — আবুল হাসানাত নদভী

মাদরাসা নিয়ে এটা পড়ুন – এটি হাদীস নয়: ‘মাদরাসা রাসূলের ঘর’

মৃত্যু দিবস পালন : শরয়ী দৃষ্টিকোণ

মুফতী পিয়ার মাহমুদঃ জন্মদিবস পালনের মত মৃত্যুদিবস পালনও এখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। খ্রিস্টীয় মাসের যে তারিখে লোকটি মৃত্যুবরণ করেছিল প্রতি বছর সে তারিখ এলেই শুরু হয় মরহুমের আত্মীয়-স্বজন দৌড়-ঝাঁপ। গরু-খাশি জবাই করে বিশাল ডেকোরেশন করে আয়োজন করা হয় পোলাও-কোরমা, বিরিয়ানি, তেহারি, জর্দা ইত্যাদির।

গরীব হলে অন্তত মোরগ-মুরগি এবং পোলাও, সাদা ভাত ইত্যাদির। যেন প্রচলিত কোন বিয়ের আয়োজন। এই ভোজসভায় নিমন্ত্রণ করা হয় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষকে। অনেক সময় আবার মৃত্যুর তিন দিন, সাত দিন, চল্লিশ দিন পর আয়োজন করা হয় এ জাতীয় ভোজসভার। এতে খরচ করা হয় অকৃপণ হাতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ সকল অনুষ্ঠানে কুরআন খতম, তিলাওয়াত, দুআ-দুরুদ ইত্যাদি হয়ে থাকে এবং এর বিনিময়ে টাকা-পয়সা দেওয়া হয় বা খাওয়ানো হয়।

কিন্তু বড় আর্শ্চযের ব্যাপার হলো, কুসংস্কার আর রুসুম-রেওয়াজে নিমজ্জিত মুসলিম উম্মাহ একবারও ভেবে দেখে না যে, এই যে এতো টাক খরচ করলাম, এতো ঘাম ঝরালাম, এর দ্বারা মরহুম কতটুকু উপকৃত হলো আর আমরাই বা কি উপকার পেলাম এবং এ ব্যাপারে ইসলামই বা কী বলে! এতটুকু খবর নেয়া বা রাখার সময়-সুযোগ আমাদের নেই।

ছোট্ট একটি উদাহারণ দেই। গত ২৬. ৮. ২০১৬ তারিখে শুক্রবার আমার এক পরিচিত ব্যক্তি ফোন করে বললেন, হুজুর, আমার আব্বার মাগফিরাতের জন্য আজ রাতে খাওয়া-দাওয়ার ইন্তিজাম করেছি। আপনাকেও তাতে আসতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মাইয়িতের উপলক্ষে আয়োজিত দাওয়াতে অংশগ্রহণ করাকে অপছন্দ করি। তারপরও এক রকম অপারগ হয়েই বললাম, ভাই! খাওয়ার পর কি দুআ করতে হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, দুআ করতে হবে। তখন আমি বললাম, ভাই! মাসআলা অনুযায়ী তো খেলে বা বিনিময় গ্রহণ করলে দুআ করা যাবে না। আর দুআ করলে কোন বিনিময় গ্রহণ করা যাবে না। যদি এমন করা হয়, তাহলে আমরা সবাই গুনাহগার হব। তাই এক কাজ করি, শুধু দুআ করি বা শুধু খাবার খাই। দু’টোর একটা করি। তিনি এটা মানতে নারাজ। তখন আমি বললাম, আমি এলে আমার কথা মানতে হবে। নতুবা আমি আসব না। এ কথা শুনে তিনি বললেন, আচ্ছা হুজুর, ঠিক আছে। তাহলে আপনাকে আরেক দিন আনব।

এখানে ভাবার বিষয় হলো, টাকা খরচ করে এভাবে ইন্তিজাম করলে সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হবে, এ কথা জানার পরও সামাজিক রুসুম-রেওয়াজ ও মেকি প্রথার কারণে টাকা খরচ করেও সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ করতে রাজি কিন্তু সামাজিক মেকি প্রথা ছাড়তে রাজি নয়। এমন হাজারও উদাহারণ দেয়া যাবে।

এ ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হলো, মৃত্যুদিবস, তিন দিনা, সাত দিনা, চল্লিশা ইত্যাদি আচার-অনুষ্ঠান পালন সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। শরিয়তে এগুলোর কোনও ভিত্তি নেই। এ সকল আয়োজন নিছক মনগড়া ও বিজাতীয় কুসংস্কার। তাই মৃত্যুদিবস, তিন দিনা, সাত দিনা, চল্লিাশা ইত্যাদি উপলক্ষে কাউকে খাওয়ানো কিংবা আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা বিদআত ও নাজায়িয এবং এ উপলক্ষে খতম ইত্যাদির বিনিময়ে টাকা-পয়সা দেয়া-নেয়া এবং খাওয়া-খাওয়ানো সবই বিদআত ও হারাম।

কারণ এ ক্ষেত্রে তিলাওয়াত ও দুআকারী নিজেই সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহগার হয়, সুতরাং মরহুমকে সে সওয়াব পৌঁছাবে কিভাবে? মরহুমকে ইসালে সওয়াব করতে হলে প্রথমত তিলাওয়াত ও দুআকারীর সওয়াব পেতে হবে, এরপর না সে সওয়াবটা অন্যের জন্যে পাঠাবে। বিনিময় গ্রহণ করার কারণে যখন সে নিজেই সওয়াব থেকে মাহরুম হচ্ছে তখন অন্যের জন্য ইসালে সওয়াবের তো প্রশ্নই আসে না। এ ব্যাপারে জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন, আমরা দাফনের পর মৃতের বাড়িতে একত্র হওয়া এবং খাবারের আয়োজন করাকে ‘নিয়াহাহ’ অর্থাৎ মৃতের শোকে বিলাপের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করতাম। [মুসনাদে আহমাদ : হাদীস ৬৯০৫] [বিলাপ করাকে হাদীস শরীফে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে]


এটা পড়ুন – মৃতের একাধিক জানাজা কি জায়েজ ?


এ কথার দ্বারা হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রা.-এর উদ্দেশ্য হলো, নিয়াহাহ যেভাবে নিষিদ্ধ, মৃতের বাড়িতে খাবারের আয়োজন করাও সেভাবে নিষিদ্ধ। প্রসিদ্ধ ফকীহ আল্লামা শামী রহ. বলেন, মৃতের পরিবারের পক্ষ থেকে ভোজসভার আয়োজন এবং তাতে অংশগ্রহণ মাকরুহে তাহরীমী ও জঘন্য বিদআত। কারণ ভোজসভার আয়োজন শরিয়তে অনুমোদিত হয়েছে আনন্দ-খুশির বেলায়; শোকের বেলায় নয়। এভাবে ইন্তিকালের প্রথম দিন, তৃতীয় দিন বা এক সপ্তাহ পর খাবারের আয়োজন করা এবং কুরআন পাঠের বিনিময়ে সেই দাওয়াত কবুল করা এবং তাতে নেককার ও কুরআন খতমকারীগণের অংশগ্রহণ বা সূরা আনআম, সূরা ইখলাছ পাঠের জন্য উপস্থিত হওয়া মাকরুহে তাহরীমী ও জঘন্য বিদআত। একটু অগ্রসর হয়ে তিনি আরও বলেন, মাইয়িতের জন্য কুরআন তিলাওয়াত, যিকর ইত্যাদি করে বিনিময় গ্রহণ করা যা হাল-যামানায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত তা হারাম হওয়া এবং এ জাতীয় ওসিয়ত বাতিল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। [আর-রদ্দুল মুখতার: ৩/১৩৮-১৩৯ আরও দেখুন, বাযযাযিয়া আলা হামিশিল হিন্দিয়া:৪/৮১]

তিনি আরও বলেন, মৃতের জন্য কুরআন তিলাওয়াতকারী যদি বিনিময় নিয়ে তিলাওয়াত করে, তাহলে তার নিজেরই সওয়াব হয় না; সুতরাং মাইয়িতকে সে কি পৌঁছাবে? এরপর তিনি বলেন, মৃতের পক্ষ হতে মৃত্যুর পর ভোজসভার আয়োজনের ওসিয়ত এবং তার জন্য কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল ইত্যাদি পাঠ করে বিনিময় গ্রহণ করা বিদআত, মুনকার, বাতিল ও হারাম। পাঠকারীরা দুনিয়ার উদ্দেশ্যে পাঠ করার কারণে গুনাহগার হবে। [আর-রদ্দুল মুখতার: ৯/৭৮]

উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুফতী ফকীহুল আছর রশীদ আহমাদ লুধয়ানবী রহ. আহসানুল ফাতওয়াতে বলেন, মৃতের জন্য ইসালে সওয়াব করে বিনিময় দেয়া-নেয়া উভয়টাই হারাম। তিনি আরও বলেন, উল্লিখিত কারণে ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে প্রচলিত কুরআনখানি নাজায়িয; বরং এটি মাইয়িতের আযাবের কারণ হওয়ারও যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছ। এ জন্য উলামায়ে কিরাম লিখেছেন যে, প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরজ মৃত্যুর পূর্বে এ জাতীয় অনৈসলামিক পন্থায় ইসালে সওয়াব করতে নিষেধ করে যাবে। [আহসানুল ফাতওয়া: ৭/২৯৬-২৯৭ আরও দেখুুন: ফাতওয়া রহীমিয়া: ২/১১৬-১১৭]

তবে নির্দিষ্ট দিন-তারিখ জরুরী মনে না করে এবং কোন বিনিময়ের আদান-প্রদান ব্যতীত কেবলমাত্র ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরআন খতম, যিকির-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, ফকীর-মিসকিনকে খাওয়ানো, দান-খয়রাত ইত্যাদি করা জায়িয এবং এতে মৃতের অশেষ উপকার হয় এবং ইসালে সওয়াবকারীও লাভবান হয়। বরং কবরস্থ ব্যক্তিরা সর্বদা এই অপেক্ষায় থাকে যে, দুনিয়াতে রেখে যাওয়া তার প্রিয়ভাজনরা তার জন্য কখন ইসালে সওয়াব করবে? ইসালে সওয়াব করা হলে এটি তাদের নিকট দুনিয়া ও দুনিয়ার সমুদয় বস্তু হতেও প্রিয় হয়।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসর রা. থেকে বর্ণিত, সূত্রে রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন- ‘কবরস্থ প্রতিটি  ব্যক্তি তার বাবা-মা, ভাই-বেরাদর ও বন্ধু-বান্ধবের প হতে দুআ ইস্তিগফারের জন্য এভাবে অপো করতে থাকে যেভাবে পানিতে ডুবন্ত ব্যক্তি অন্যের সাহায্য কামনা করে। যখন সে দুআ প্রাপ্ত হয় তখন এই দুআ তার নিকট দুনিয়া ও দুনিয়ার সমুদয় বস্তু হতেও প্রিয় হয় এবং আল্লাহ তাআলা দুনিয়াবাসীর দুআর বদৌলতে তাকে দান করেন পাহাড়সম প্রতিদান। আর মৃত্যুদের জন্য জীবিতদের হাদিয়া হলো, তাদের জন্য দুআ ইস্তিগফার করা। [শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস, ৭৫২৭]

অন্য এক বর্ণনায় হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষ যখন মারা যায় তখন তার সকল প্রকারের আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিন প্রকার আমলের সওয়াব তখনও পৌঁছতে থাকে। ১. সদকায়ে জারিয়া, ২. উপকারী ইলম, ৩. নেক সন্তান। [মুসলিম : হাদীস ১৬৩১] তিরমিযী শরীফের এক বর্ণনায় ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এক  ব্যক্তি [হযরত সাদ রা.] রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা ইন্তিকাল করেছেন, আমি যদি তার জন্য সদকা করি তাতে কি তিনি উপকৃত হবেন এবং এর সওয়াব তিনি প্রাপ্ত হবেন? জবাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ, তিনি উপকৃত হবেন এবং এর সওয়াব তিনি প্রাপ্ত হবেন। একথা শুনে সাহাবী বললেন, আমার একটি বাগান আছে। আমি আপনাকে সাী রেখে বলছি, আমার উক্ত বাগানটি আমার মায়ের জন্য সদকা করে দিলাম। [তিরমিযী: ১/৮৫] উসমান ইবনে আফ্ফান রা. বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোন মাইয়েতের দাফনকার্য সম্পন্ন করতেন তখন সেখানে অবস্থান করতেন এবং বলতেন, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ইস্তিগফার কর এবং তার জন্য অবিচলতার দুআ কর। কারণ এখন তাকে সওয়াল-জওয়াব করা হবে। [আবু দাউদ: ১/৭৫]

উপরিউক্ত হাদীসগুলোর দ্বারা একথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইসালে সওয়াব তথা কোন আমলের সওয়াব কোন মৃত ব্যক্তির জন্য পৌঁছালে তা সে প্রাপ্ত হয় এবং এর দ্বারা সে অনেক উপকৃত হয় ও তার কবরের আযাব-গযব মাফ হয়। শুধু তাই নয়, একাধিক হাদীসে একথাও আছে যে, ইসালে সওয়াব করলে ইসালে সওয়াবকারী নিজেও উপকৃত হয় এবং অফুরন্ত পুণ্যের অধিকারী হয়। যেমন হযরত আলী রা.-এর বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোন কবরস্থানের পাশ দিয়ে অতিক্রম কালে ১১ বার সূরা ইখলাছ পাঠ করে মৃতদের বখশে দেয় তাকে মৃতদের সংখ্যা পরিমাণ সওয়াব দেয়া হয়।  সূরা ইয়াসিন পাঠ করে বখশে দিলেও এমন সওয়াব পাওয়া যায়।’ [দারাকুতনী ও তাবরানী শরীফ সূত্রে ফাতওয়া শামী: ১/৮৪৪; তাহতাবী আলাল মারাকী: ৩৪২]

আবু হুরায়রার রা. সূত্রে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কবরস্থানে গিয়ে সূরা ফাতিহা, সূরা ইখলাছ ও সূরা তাকাছুর পাঠ করে তার সওয়াব কবরস্থ মুমিন নর-নারীর জন্য ইসালে সওয়াব করে তার জন্য এ সকল কবরবাসী সুপারিশকারী হবে।’ [দারাকুতনী : ৪/৮২] হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ইরশাদ করেন ‘যে ব্যক্তি স্বীয় মা-বাবার প থেকে হজ করে সে তাদের প থেকে তো হজ আদায় করলই পাশাপাশি তাকে অতিরিক্ত দশটি হজের সওয়াব দেয়া হবে।’ [দারাকুতনী সূত্রে ফাতওয়া শামী: ২/৬০৭] শেষোক্ত হাদীসের দ্বারা একথা প্রমাণিত হয় ইসালে সওয়াব করলে অনেক সময় মৃত ব্যক্তির চেয়ে ইসালে সওয়াবকারী নিজে বেশি উপকৃত ও লাভবান হয়।
স্মর্তব্য : ইসালে সওয়াবের নির্দিষ্ট কোন পন্থা বা পদ্ধতি নেই। কুরআন খতম, সূরা ইয়াসিন, ইখলাছ, তাকাছুর ইত্যাদি যে কোন সূরা পাঠ করে কিংবা দুরূদ, নফল নামায, রোযা, যাকাত, সদকা, হজ ইত্যাদিসহ যে কোন নফল ইবাদতের মাধ্যমেই ইসালে সওয়াব করা যায়। [আর-রদ্দুল মুখতার: ১/৮৪৪; হিন্দিয়া:৫/৩৯৪; মিরকাত: ৪/৮২; ফাতওয়া রহীমিয়া: ৭/৯৪-৯৫]

লেখক : গ্রন্থ প্রণেতা, ধর্মীয় গবেষক ও মুহাদ্দিস
জামিয়া মিফতাহুল উলুম, নেত্রকোনা

ঈসালে সওয়াবের কতিপয় সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি!

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান:  ‘ঈসালে সওয়াব’ ফারসী শব্দ। আরবীতে হবে ‘ঈসালুস সাওয়াব’ (তবে এ ক্ষেত্রে আরবীতে অন্য শব্দ বেশি ব্যবহৃত হয় যেমন ‘ইহদাউস সাওয়াব’)। এর আভিধানিক অর্থ হল সওয়াব পৌঁছানো। পরিভাষায় ঈসালে সওয়াব হল কোনো নেক আমল করে এর সওয়াব মৃত ব্যক্তিকে দান করা।

ঈসালে সওয়াবের প্রেরণা

কষ্টার্জিত আমলের সওয়াব যে কাউকে দান করা হয় না। এ সাধারণত তাকেই দান করা হয় যার প্রতি মহব্বত ও আন্তরিকতা আছে। প্রিয়জন আখেরাতের পথিক হয়ে গেলে তার জন্য এমন কিছু করা মানুষের স্বভাবজাত আগ্রহ, যা তার শান্তি-সফলতার পক্ষে সহায়ক হবে, তার জন্য আল্লাহর রহমত ও করুণার উপায় হবে। ফলে তিনি তার গোনাহ মাফ করে দিবেন, মর্যাদা উঁচু করবেন এবং সুখে-শান্তিতে ভরিয়ে তুলবেন।

এই মহব্বতের একটি অনুষঙ্গ হল আত্মীয়তা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ঈমান, সৎকর্ম ও সদ্ব্যবহার। এজন্য পিতা-মাতা, দাদা-দাদী প্রমুখের জন্য যেমন ঈসালে সওয়াব করা হয়, তেমনি উস্তাদ-মুরব্বী, আলেম-উলামা, ওলী-বুযুর্গ ও নবী-রাসূলগণের জন্যও করা হয়; বরং ঈমান, সৎকর্ম ও সদাচারে যারা অগ্রগামী তাদের জন্যই বেশি ঈসালে সওয়াব করা হয়। আর তাতে সহযোগিতার চেয়ে সৌভাগ্য ও সাআদাত অর্জনের মনোভাবই কাজ করে বেশি। কোনো নেক লোকের সঙ্গে ঈসালে সওয়াবের সম্পৃক্ততাও সৌভাগ্য বৈকি?

এ কারণে সবার গুরুত্ব ও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত ঈমান, সৎকর্ম ও  উত্তম আচার-ব্যবহারে অগ্রগামিতা এবং তা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা।

মূল বিষয়টি সম্পূর্ণ স্বীকৃত

জীবিতদের দান করা আমল মৃতদের জন্য কল্যাণকর হওয়া আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর কাছে একটি স্বীকৃত বিষয়। মৌলিক দিক থেকে তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই; মতভেদ শুধু বিস্তারিত ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে। তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু মুতাযিলা সম্প্রদায় তা অস্বীকার করেছে। এদের মতে জীবিতদের দান করা কোনো আমলই মৃত ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর নয়, দুআ-ইস্তিগফার ও সদকাও নয়।

এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট কুরআন, সুন্নাহ ও উম্মাহর ইজমা-বিরুদ্ধ। এজন্য এর উপর কোনো মন্তব্য না করে সরাসরি ঈসালে সওয়াবের পদ্ধতিগুলো আলোচনা করা হল।

ঈসালে সওয়াবের কিছু পদ্ধতি

এক. দুআ

ইবাদতের সারনির্যাস হচ্ছে আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ সমর্পণ এবং চূড়ান্ত বিনয় ও মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ। আর এটা দুআর মধ্যে সর্বোত্তমরূপে প্রকাশিত হয়। দুআ অর্থ ডাকা। নিজেকে অসহায় ও নিঃস্ব মনে করে কারো সামনে দু’হাত প্রসারিত করার চেয়ে বিনয় ও সমর্পণ আর কী হতে পারে? তাই দুআর মর্যাদা ও গুরুত্ব অসীম। হাদীসে দুআকে ইবাদত বরং ইবাদতের মগজ বলা হয়েছে।

ইসলামী ভ্রাতৃত্বের একটি সাধারণ হক হল, আপনপর জীবিত-মৃত নির্বিশেষে সকল মুসলিম ভাইয়ের জন্য দুআ করা। আর যারা না-ফেরার জগতে পাড়ি জমিয়েছেন তারা যেহেতু কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন এবং আমাদের আগে ঈমান এনেছেন তাই তাদের জন্য বিশেষভাবে কাম্য। দুআ জীবিত-মৃত সকলের জীবনে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। এ কুরআন ও হাদীস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। নিম্নে কিছু আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করছি।

১. কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে,

وَ الَّذِیْنَ جَآءُوْ مِنْۢ بَعْدِهِمْ یَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَ لِاِخْوَانِنَا الَّذِیْنَ سَبَقُوْنَا بِالْاِیْمَانِ وَ لَا تَجْعَلْ فِیْ قُلُوْبِنَا غِلًّا لِّلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا رَبَّنَاۤ اِنَّكَ رَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ۠ .

এবং (ফাই-এর সম্পদ তাদেরও প্রাপ্য আছে ) যারা তাদের (অর্থাৎ মুহাজির ও আনসারদের) পরে এসেছে। তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! ক্ষমা করুন আমাদের এবং আমাদের সেই ভাইদেরও যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছে এবং আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের প্রতি কোনো  হিংসা-বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি অতি মমতাবান, পরম দয়ালু। Ñসূরা হাশর (৫৯) : ১০

এখানে পূববর্তী মুমিনদের জন্য (যাতে জীবিত ও মৃত সকলই আছেন) দুআ করার প্রশংসা করা হয়েছে। দুআ যদি তাদের জন্য উপকারী না হয়, তবে এ প্রশংসার কী অর্থ থাকে?

হাফেয সাখাবী রহ. (৯০২হি.) বলেন, এখানে পূর্ববর্তীদের জন্য দুআ করায় তাদের প্রশংসা করা হয়েছে। বোঝা গেল যে, দুআ উপকারে আসে। Ñকুররাতুল আইন পৃ. ১২৩

২. অন্যত্র ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এ দুআ বর্ণিত হয়েছে,

رَبَّنَا اغْفِرْ لِیْ وَ لِوَالِدَیَّ وَ لِلْمُؤْمِنِیْنَ یَوْمَ یَقُوْمُ الْحِسَابُ.

হে আমার প্রতিপালক! যেদিন হিসাব প্রতিষ্ঠিত হবে, সেদিন আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সকল ঈমানদারকে ক্ষমা করুন। Ñসূরা ইবরাহীম (১৪) : ৪১

৩. অন্য জায়গায় নূহ আলাইহিস সালামের এ দুআ বর্ণিত হয়েছে,

رَبِّ اغْفِرْ لِیْ وَ لِوَالِدَیَّ وَ لِمَنْ دَخَلَ بَیْتِیَ مُؤْمِنًا وَّ لِلْمُؤْمِنِیْنَ وَ الْمُؤْمِنٰتِ  وَ لَا تَزِدِ الظّٰلِمِیْنَ اِلَّا تَبَارًا۠.

হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করে দিন এবং আমার পিতা-মাতাকেও এবং যে ঈমান অবস্থায় আমার ঘরে প্রবেশ করেছে আর সমস্ত মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীকেও। Ñসূরা নূহ (৭১) : ২৮

৪. সূরা মুহাম্মদ-এ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে,

فَاعْلَمْ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا اللهُ وَ اسْتَغْفِرْ لِذَنْۢبِكَ وَ لِلْمُؤْمِنِیْنَ وَ الْمُؤْمِنٰتِ وَ اللهُ یَعْلَمُ مُتَقَلَّبَكُمْ وَ مَثْوٰىكُمْ.

জেনে রেখো, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই এবং ক্ষমাপ্রার্থনা কর নিজ ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য এবং মুসলিম নর-নারীদের জন্যও। Ñসূরা মুহাম্মদ (৪৭) : ১৯

৫. অন্যত্র ফিরিশতাদের এ দুআ বর্ণিত হয়েছে,

اَلَّذِیْنَ یَحْمِلُوْنَ الْعَرْشَ وَ مَنْ حَوْلَهٗ یُسَبِّحُوْنَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَ یُؤْمِنُوْنَ بِهٖ وَ یَسْتَغْفِرُوْنَ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا  رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَیْءٍ رَّحْمَةً وَّ عِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِیْنَ تَابُوْا وَ اتَّبَعُوْا سَبِیْلَكَ وَ قِهِمْ عَذَابَ الْجَحِیْمِ رَبَّنَا وَ اَدْخِلْهُمْ جَنّٰتِ عَدْنِ ِالَّتِیْ وَعَدْتَّهُمْ وَ مَنْ صَلَحَ مِنْ اٰبَآىِٕهِمْ وَ اَزْوَاجِهِمْ وَ ذُرِّیّٰتِهِمْ اِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ وَ قِهِمُ السَّیِّاٰتِ  وَ مَنْ تَقِ السَّیِّاٰتِ یَوْمَىِٕذٍ فَقَدْ رَحِمْتَهٗ  وَ ذٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِیْمُ.

যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা তার চারপাশে আছে, তারা তাদের প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে তাঁর তাসবীহ পাঠ করে ও তাঁর প্রতি ঈমান রাখে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য মাগফিরাতের দুআ করে, হে আমাদের  প্রতিপালক! তোমার রহমত ও জ্ঞান সমস্ত কিছু জুড়ে ব্যাপ্ত। যারা তাওবা করেছে ও তোমার পথ অনুসরণ করেছে তাদের ক্ষমা করে দাও এবং জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে দাখিল কর স্থায়ী জান্নাতে, যার ওয়াদা তুমি তাদের সাথে করেছ এবং তাদের পিতা-মাতা, স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে যারা নেক তাদেরকেও। নিশ্চয়ই তুমিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। এবং তাদের সকল অকল্যাণ থেকে রক্ষা কর। সে দিন তুমি যাকে অকল্যাণ থেকে রক্ষা করবে তার প্রতি তো তুমি দয়াই করবে। আর এটাই মহাসাফল্য। Ñসূরা মুমিন (৪০) : ৭-৯

এ দুআগুলোতে জীবিত-মৃতের পার্থক্য ছাড়া সাধারণ মুমিনদের জন্য দুআ করা হয়েছে।

৬. দুআ মৃতের পক্ষে কল্যাণকর হওয়ার সবচেয়ে বড় দলীল হল জানাযার নামায। জানাযার নামায বস্তুত সালাতরূপ দুআ। জানাযার নামাযে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব দুআ পড়তেন সেগুলো থেকেই তা পরিষ্কার। এজন্য নিষ্ঠার সাথে দুআ করা কাম্য।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

إذا صليتم على الميت فأخلصوا له الدعاء.

তোমরা যখন মাইয়িতের নামায পড়বে তখন তার জন্য নিষ্ঠার সাথে দুআ করবে। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩১৯৯

এখানে জানাযার নামাযের দু-একটি দুআ উল্লেখ করা যেতে পারেÑ

اللهم اغفر لحينا وميتنا، وشاهدنا وغائبنا، وصغيرنا وكبيرنا، وذكرنا وأنثانا، اللهم من أحييته منا فأحيه على الإسلام، ومن توفيته منا فتوفه على الإيمان.

ইয়া আল্লাহ, আপনি আমাদের জীবিত-মৃতদের মাফ করুন। আমাদের উপস্থিত ও অনুপস্থিত, ছোট ও বড়, পুরুষ ও নারী সকলকে মাফ করুন। ইয়া আল্লাহ, আপনি আমাদের মধ্যে যাকে জীবিত রাখেন তাকে ইসলামের উপর জীবিত রাখুন আর যাকে মৃত্যু দেন তাকে ঈমানের উপর মৃত্যু দিন। Ñমুসনাদে আহমদ, হাদীস ৮৮০৯

اللهم اغفر له وارحمه، وعافه واعف عنه، وأكرم نزله، ووسع مدخله، واغسله بالماء والثلج والبرد، ونقه من الخطايا كما نقيت الثوب الأبيض من الدنس، وأبدله دارا خيرا من داره، وأهلا خيرا من أهله، وزوجا خيرا من زوجه، وأدخله الجنة، وأعذه من عذاب القبر.

ইয়া আল্লাহ, তাকে মাফ করে দিন, তার প্রতি রহম করুন, তাকে নিরাপদে রাখুন, তার ভুলত্রুটি মার্জনা করুন। তার সম্মানজনক আপ্যায়ন করুন, তারা প্রবেশস্থলকে প্রশস্ত করে দিন। তাকে পানি, বরফ ও বৃষ্টি দ্বারা ধুয়ে-মুছে দিন এবং গোনাহ থেকে এমনভাবে পরিষ্কার করে দিন যেমন ময়লা থেকে সাদা কাপড় পরিষ্কার করেছেন। তাকে দান করুন তার ঘরের চেয়ে উত্তম ঘর, তার পরিবারের চেয়ে উত্তম পরিবার এবং তার স্ত্রীর চেয়ে উত্তম স্ত্রী । তাকে জান্নাতে স্থান দিন, কবরের আযাব থেকে রক্ষা করুন। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৬৩

৭. মৃত্যুর পরে বেশ কটি মনযিল রয়েছে। আর প্রত্যেকটি মনযিলই ভয়াবহ। প্রথম মনযিল হল কবর। এখানে দাফনপর্ব শেষে মাইয়িতের ‘সুয়াল-জওয়াব’ হয়। তাই এ সময় তার জন্য দুআ করা বিশেষভাবে কাম্য, যাতে আল্লাহ তাআলা তার ‘সুয়াল-জওয়াব’ সহজ করে দেন।

উসমান ইবনে আফফান রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃতের দাফনকার্য সম্পন্ন করে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলতেনÑ

استغفروا لأخيكم، وسلوا له بالتثبيت، فإنه الآن يسأل.

তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা কর এবং সে যেন সুদৃঢ় থাকতে পারে সে দুআ কর। কারণ এখনই তাকে ‘সুয়াল’ করা হবে। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩২২১

৮. কবর যিয়ারত আখেরাতের স্মরণে সহায়ক হওয়ায় হাদীসে এর প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে এবং যিয়ারতকারীর এক বড় করণীয় সাব্যস্ত করা হয়েছে মৃতের জন্য দুআ ও ইস্তিগফার। এ ক্ষেত্রে হাদীসে বেশ কিছু দুআ বর্ণিত হয়েছে। একটি দুআ এ রকমÑ

السلام على أهل الديار من المؤمنين والمسلمين، ويرحم الله المستقدمين منا والمستأخرين، وإنا إن شاء الله بكم للاحقون.

এই কবরস্থানের বাসিন্দা মুসলিম-মুমিনদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের প্রতি আল্লাহ রহম করুন। ইনশাআল্লাহ আমরাও আপনাদের সাথে মিলিত হব। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৭৪

৯. জানাযার নামায ও কবর যিয়ারতের বাইরেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত ব্যক্তির জন্য দুআ করেছেন। উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সালামাকে দেখতে এলেন, তখন তার চোখ খোলা ছিল। তিনি চোখ বন্ধ করে দিয়ে বললেন, যখন রূহ কবয করা হয় তখন চোখ তার অনুসরণ করে। এ কথা শুনে লোকেরা কান্না শুরু করে দিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা ভালো ছাড়া অন্য কিছু বলাবলি করো না। কারণ, তোমরা যা কিছু বল ফিরিশতারা তার উপর আমীন বলেন। তারপর তিনি এভাবে দুআ করলেন,

اللهم اغفر لأبي سلمة، وارفع درجته في المهديين، واخلفه في عقبه في الغابرين، واغفر لنا وله يا رب العالمين، وافسح له في قبره، ونور له فيه.

হে আল্লাহ! আপনি আবু সালামাকে ক্ষমা করে দিন, হেদায়েতপ্রাপ্তদের মধ্যে তার মর্যাদা উঁচু করুন, তার পরিবারের অভিভাবক হয়ে যান। হে জগতসমূহের প্রতিপালক! তাকে ও আমাদেরকে মাফ করে দিন। তার কবরকে প্রশস্ত ও নূরানী করে দিন। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ৯২০

একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু আমের রা.-কে এক যুদ্ধে আমীর নিযুক্ত করে পাঠিয়েছিলেন। একটি তীরের আঘাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তার আগে ভাতিজা আবু মূসা আশআরী রা.-কে বলে গেছেন, তিনি যেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তার সালাম পৌঁছান এবং তার জন্য মাগফিরাতের দুআ করতে বলেন। আবু মূসা আশআরী রা. তা-ই করলেন। অতপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানি আনিয়ে অযু করলেন এবং দু’হাত প্রসারিত করে দুআ করলেনÑ

اللهم اغفر لعبيد أبي عامر، اللهم اجعله يوم القيامة فوق كثير من خلقك أو من الناس.

হে আল্লাহ! আপনি আবু আমেরকে মাফ করে দিন। তাকে কিয়ামতের দিন আপনার বহু সৃষ্টির উপর (বর্ণনাকারী বলেন, অথবা বলেছেন, মানুষের উপর) মর্যাদা দিন। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৯৮

এই আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, দুআ জীবিত ও মৃত সকলের জন্য কল্যাণকর।


এটাও পড়ুন – আপনি কি ধূমপায়ী ? আপনার জন্য সুখবর !


দুই. সদকা

আল্লাহ তাআলা নিজ ইলম ও হিকমতের ভিত্তিতে কাউকে করেছেন সচ্ছল, কাউকে অসচ্ছল। তবে সবার রিযিকের দায়িত্ব তাঁর হাতে। কিন্তু তা বান্দা পর্যন্ত পৌঁছার উপায় সকলের ক্ষেত্রে এক নয়; বরং বয়স, ব্যক্তি, পরিবেশ ও পরিস্থিতির বিভিন্নতায় তা বিভিন্ন হয়ে থাকে। একটি উপায় হল সদকা বা দান-খায়রাত। এটা অনেক ফযীলত ও সওয়াবের কাজ। তবে এর একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে সামান্য সদকাও মূল্যবান। আর অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বিশাল সদকাও মূল্যহীন।

এই সদকা জীবিতদের মত মৃতদের জন্যও করা যায় এবং এর সওয়াব তাদের কাছে পৌঁছে। এ বহু হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এখানে কিছু হাদীস পেশ করা যেতে পারে।

১. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, সাদ ইবনে উবাদা রা.-এর অনুপস্থিতিতে তার মা ইন্তেকাল করেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার অনুপস্থিতিতে আমার মা মারা গেছেন। আমি যদি তার পক্ষ থেকে সদকা করি, তবে কি তার কোনো উপকারে আসবে? বললেন, হাঁ। সাদ রা. বললেন, আমি আপনাকে সাক্ষী রাখছি যে, আমার ‘মিখরাফ’ নামক বাগানটি আমার মা’র জন্য সদকা। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ২৭৫৬

عن ابن عباس رضي الله عنهما: أن سعد بن عبادة رضي الله عنه توفيت أمه وهو غائب عنها، فقال: يا رسول الله! إن أمي توفيت وأنا غائب عنها، أينفعها شيء إن تصدقت به عنها؟ قال: نعم. قال: فإني أشهدك أن حائطي المخراف صدقة عليها.

২. আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, একলোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, আমার মা হঠাৎ মারা গেছেন, কোনো অসিয়ত করে যেতে পারেননি। আমার মনে হয়, তিনি যদি কথা বলতে পারতেন, তাহলে সদকা করে যেতেন। আমি তার পক্ষ থেকে সদকা করলে কি তিনি এর সওয়াব পাবেন?  বললেন, হাঁ। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১০০৪

عن عائشة أن رجلا أتى النبي صلى الله عليه وسلم فقال: يا رسول الله! إن أمي افتلتت نفسها ولم توص، وأظنها لو تكلمت تصدقت، أفلها أجر، إن تصدقت عنها؟ قال: نعم.

৩. আবু হুরায়রা. থেকে বর্ণিত, একব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, আমার পিতা ইন্তেকাল করেছেন এবং ধন-সম্পদ রেখে গেছেন কিন্তু অসিয়ত করে যাননি। আমি যদি তার পক্ষ থেকে সদকা করি, তবে কি তার (গোনাহের) কাফফারা হবে? বললেন, হাঁ। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৩০

عن أبي هريرة أن رجلا قال للنبي صلى الله عليه وسلم: إن أبي مات وترك مالا، ولم يوص، فهل يكفر عنه أن أتصدق عنه؟ قال: نعم.

৪. আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, আস ইবনে ওয়ায়েল জাহেলীযুগে একশো উট যবাহ করার মানত করেছিল। অতপর (তার ছেলে) হিশাম তার পক্ষ থেকে ৫০টি উট যবাহ করে। (বাকি ৫০টি অপর ছেলে আমর যবাহ করতে চান।) এ ব্যাপারে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, তোমার পিতা যদি তাওহীদ স্বীকার করত আর তুমি তার পক্ষ থেকে রোযা রাখতে বা সদকা করতে, তবে এ তার কাজে আসত। Ñমুসনাদে আহমদ, হাদীস ৬৭০৪

عن عمرو بن شعيب، عن أبيه، عن جده، أن العاص بن وائل نذر في الجاهلية أن ينحر مائة بدنة، وأن هشام بن العاص نحر حصته خمسين بدنة، وأن عمرا سأل النبي صلى الله عليه وسلم عن ذلك؟ فقال: أما أبوك فلو كان أقر بالتوحيد، فصمت وتصدقت عنه، نفعه ذلك.

এ হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত হল যে, সদকার সওয়াব মৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে।

মৃত ব্যক্তির জন্য দুআ ও সদকা কল্যাণকর হওয়া উম্মাহর সর্বসম্মত মত। এতে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর কোনো দ্বিমত নেই।

ইমাম নববী রহ. (৬৭৬হি.) إذا مات الإنسان -এ হাদীসটির ব্যাখ্যায় লেখেন,

وفيه أن الدعاء يصل ثوابه إلى الميت، وكذلك الصدقة، وهما مجمع عليهما.

এ থেকে প্রমাণ মেলে যে, দুআর সওয়াব মৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে। এমনিভাবে সদকার সওয়াবও। এ দুটি সর্বসম্মত বিষয়। Ñশরহু সহীহ মুসলিম ১১/৮৫

অন্যত্র এক প্রসঙ্গে লিখেছেন,

ৃمن أراد بر والديه فليتصدق عنهما، فإن الصدقة تصل إلى الميت وينتفع بها، بلا خلاف بين المسلمين، وهذا هو الصواب، وأما ما حكاه أقضى القضاة أبو الحسن الماوردي البصري الفقيه الشافعي في كتابه >الحاوي< عن بعض أصحاب الكلام من أن الميت لا يلحقه بعد موته ثواب، فهو مذهب باطل قطعا، وخطأ بين مخالف لنصوص الكتاب والسنة وإجماع الأمة، فلا التفات إليه ولا تعريج عليه.

…যে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে চাই সে যেন তাদের পক্ষ থেকে সদকা করে। সদকা মাইয়িতের কাছে পৌঁছে এবং তার উপকারে আসে। এতে কোনো দ্বিমত নেই। আর এটাই সঠিক। আর মাওয়ারদী কতক ‘আহলে কালাম’ থেকে যে কথা বর্ণনা করেছেন যে, মাইয়িতের কাছে কোনো সওয়াব পৌঁছে না, সেটা সম্পূর্ণ বাতিল ও ভুল। কিতাব-সুন্নাহ ও উম্মাহর ইজমা বিরুদ্ধ। সুতরাং তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। Ñশরহু সহীহ মুসলিম ১/৮৯-৯০

আবুল হাসান আলী ইবনে মুহাম্মদ আলখাযিন (৭৪১হি.) উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. ও ইবনে আব্বাস রা.-এর হাদীস দুটি উল্লেখ করে বলেন,

وفي الحديثين الآخرين دليل على أن الصدقة عن الميت تنفع الميت ويصله ثوابها. وهو إجماع العلماء.

وكذلك أجمعوا على وصول الدعاء وقضاء الدين، للنصوص الواردة في ذلك.

হাদীস দুটিতে এ কথার প্রমাণ আছে যে, সদকা মৃতের উপকারে আসে এবং এর সওয়াব তার কাছে পৌঁছে। এটা আলেমদের সর্বসম্মত মত। এমনিভাবে তারা এ ব্যাপারেও একমত পোষণ করেন যে, দুআ ও ঋণ পরিশোধের সওয়াবও পৌঁছে। কারণ এ ব্যাপারে বিভিন্ন হাদীস রয়েছে। Ñতাফসীরে খাযিন ৪/২১৩

আরো দেখুন : ইকমালুল মুলিম ৩/৫২৪; আলআযকার, নববী পৃ. ১৫১; শরহে মিশকাত, তীবী ১/৩৬২; কিতাবুর রূহ পৃ. ১৩২; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৭/৪৪০; সুবুলুস সালাম ২/১৬৯; তাসহীলুল ইলমাম বি ফিকহি আহাদীসি বুলূগিল মারাম ৪/২৯৪

যেভাবে বিজিত হল ইস্তাম্বুল!

ইবনে নসীব: আজও তুরষ্কের অনেক পিতামাতা আদরের সন্তানের নাম ‘মুহাম্মাদ ফাতিহ’ রেখে থাকেন। কেননা এ নামটি ইসলামী ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। খিলাফতে উছমানিয়ার সপ্তম খলীফা সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রাহ. ছিলেন একজন মুজাহিদ সুলতান, যাঁর মাধ্যমে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে।

মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কুস্ত্তনতীনিয়া জয় করেন।

১৬ মুহররম ৮৫৫ হিজরী মোতাবেক ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৪৫ খৃষ্টাব্দে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রাহ. খিলাফতে উছমানিয়ার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র বাইশ বছর, কিন্তু অসম সাহস, অতুলনীয় প্রজ্ঞা, নিপুণ রণকৌশল ও গভীর ঈমানী জযবায় অল্প সময়েই তিনি তাঁর পূর্বসূরীদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।

দীর্ঘ ত্রিশ বছর তিনি খিলাফত পরিচালনা করেছেন। তাঁর শাসনামলে যেমন ইসলামের বিজয়াভিযানে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছিল তেমনি সকল শ্রেণী ও ধর্মের মানুষ ন্যায়বিচার, জানমালের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় ও মানবিক অধিকার লাভ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল ইসলামী শাসনব্যবস্থার সুফল।

সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রা.-এর শাসনামল বিভিন্ন দিক থেকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তবে যা তাঁকে উম্মাহর হৃদয়ে অমর করে রেখেছে তা হচ্ছে কুস্ত্তনতীনিয়া বিজয়।

ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক দিক থেকে কুস্ত্তনতীনিয়া ছিল পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। খৃষ্টীয় তৃতীয় শতক থেকেই তা ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ নগরী।

কুস্ত্তনতীনিয়া নগরীর তিন দিকে জল একদিকে স্থল। পশ্চিমে বসফরাস প্রণালী, দক্ষিণে গোল্ডেন হর্ণ ও উত্তরে মারমারা উপসাগর। তাই ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে একে তৎকালীন বিশ্বের সুরক্ষিত নগরীগুলোর মধ্যে গণ্য করা হত। এছাড়া নগরীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। গোটা নগরীর চারপাশে ছিল একাধিক দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও সার্বক্ষণিক সশস্ত্র প্রহরা। এসব কারণে কুস্ত্তনতীনিয়া ছিল সে সময়ের বিচারে এক অজেয় দুর্গ।

এখানে মনে রাখতে হবে যে, সে যুগটা মিসাইল ও যুদ্ধবিমানের যুগ ছিল না। তাই উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলোই তখন নগরীর সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট ছিল।


এটা পড়ুন ভারতবর্ষের কাগজ


 কুস্ত্তনতীনিয়া জয়ের জন্য সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রাহ. তৎকালীন বিশ্বের সর্বাধুনিক রণপ্রস্ত্ততি গ্রহণ করেছিলেন। সে সময়ের সবচেয়ে দূর পাল্লার কামান তিনিই তৈরি করিয়েছিলেন। প্রস্ত্ততি সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি অভিযান আরম্ভ করেন। তার স্থলবাহিনী নগরীর পূর্ব দিকে অবস্থান নিলে এবং নৌবাহিনীর জাহাজগুলো বসফরাস প্রণালীতে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু বসফরাস প্রণালী থেকে ‘গোল্ডেন হর্ণে’ প্রবেশ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। কেননা গোল্ডেন হর্ণের মুখ লোহার শিকল দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং বাইজেন্টাইন রণতরীগুলো সেখানে অবস্থান নিয়ে গোলা নিক্ষেপ করছিল।

প্রচন্ড যুদ্ধের পরও উছমানী নৌবহর গোল্ডেন হর্ণ পদানত করতে সক্ষম হল না। অন্যদিকে বন্দর সুরক্ষিত থাকায় বাইজেন্টাইন বাহিনী তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল পূর্ব দিকে, সুলতানের স্থল বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য। তাই তাদের শক্তিকে বিভক্ত করার জন্য এবং দুই দিক থেকে একযোগে আক্রমণ পরিচালনার জন্য উছমানী নৌবহরের গোল্ডেন হর্ণে প্রবেশ করা ছিল অপরিহার্য। প্রায় দুই সপ্তাহ অবিরাম যুদ্ধের পরও নৌপথে বিজয়ের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। এই সময়ই সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রা. তাঁর সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেছিলেন, যার কোনো দৃষ্টান্ত সমকালীন যুদ্ধের ইতিহাসে ছিল না। ইংরেজ ঐতিহাসিক গীবন একে ‘মিরাক্ল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রাহ. মুজাহিদদের আদেশ দিলেন রণতরীগুলো ডাঙ্গায় তুলে দশ মাইল পথ অতিক্রম করে গোল্ডেন হর্ণে নামাতে হবে। এই দীর্ঘ পথ পুরোটাই ছিল পাহাড়ী উঁচুনিচু ভূমি। এর উপর দিয়ে রণতরীগুলো টেনে নিয়ে যাওয়া ছিল এককথায় অসম্ভব। কিন্তু সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। পুরো পথে কাঠের পাঠাতন বিছানো হল, তাতে চর্বি মাখিয়ে পিচ্ছিল করা হল এবং এর উপর দিয়ে রণতরীগুলো টেনে নিয়ে যাওয়া হল। এভাবে টিলা ও পাহাড়ের উপর দিয়ে এক রাতের মধ্যে পঞ্চাশটি রণতরী তিনি গোল্ডেন হর্ণে প্রবেশ করাতে সক্ষম হলেন।

সকালে গোল্ডেন হর্ণের মুখে প্রহরারত বাইজেন্টাইন নৌ সেনারা বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে দেখল যে, উছমানী রণতরীগুলো মৃত্যুদূতের মতো তাদের পিছন দিক থেকে ধেয়ে আসছে। এই ঘটনা থেকে একটি প্রবাদ তৈরি হল, যার তরজমা : ‘যখন পানির জাহাজ ডাঙ্গায় চলবে তখন বুঝবে কুস্ত্তনতীনিয়ার পতন অত্যাসন্ন!’

চূড়ান্ত আক্রমণের আগে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রাহ. বাইজেন্টাইন সম্রাট কুস্ত্তনতীনকে নগরী সমর্পণের পয়গাম পাঠালেন এবং নগরবাসীর জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিলেন, কিন্তু সম্রা্ট তা গ্রহণ করলেন না। সুলতান চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্ত্ততি নিলেন।

ঐতিহাসিক লেখেন, আক্রমণের আগে ‘সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রাহ. বাহিনীর অধিনায়কদের তলব করে সকল মুজাহিদকে এই পয়গাম পৌঁছে দেওয়ার আদেশ করলেন যে, কুস্ত্তনতীনিয়ার বিজয় সম্পন্ন হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হবে এবং তাঁর একটি মু’জিযা প্রকাশিত হবে। অতএব কারো মাধ্যমে যেন শরীয়তের কোনো বিধান লঙ্ঘিত না হয়। গীর্জা ও উপাসনালয়গুলোর যেন অসম্মান না করা হয়, পাদ্রী, মহিলা, শিশু এবং অক্ষম লোকদের যেন কোনো ধরনের কষ্ট না দেওয়া হয় …।’

৮৫৭ হিজরীর ২০ জুমাদাল উলার রজনী মুজাহিদগণ দুআ ও ইবাদতের মধ্যে অতিবাহিত করলেন। ফজরের পর সুলতান চূড়ান্ত আক্রমণের আদেশ দিলেন এবং ঘোষণা করলেন যে, ‘ইনশাআল্লাহ আমরা যোহরের নামায সেন্ট সুফিয়ার গীর্জায় আদায় করব।’

আল্লাহ তাআলা তাঁর মুজাহিদ বান্দার কথাকে সত্য করেছেন। জোহরের সময় সুলতান মুহাম্মাদ ফাতেহ রাহ. বিজয়ীর বেশে কুস্ত্তনতীনিয়া নগরীতে প্রবেশ করলেন। ইংরেজি তারিখ হিসাবে দিনটি ছিল ২৯ মে ১৪৫৩ ঈ.। সেন্ট রোমান্সের উপর (বর্তমান নাম ঞঙচ কঙচণ) উছমানী পতাকা উড়ছিল। সুলতান ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে সিজদায় পড়ে গেলেন।নগরীর অধিকাংশ খৃষ্টান সেন্ট সোফিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। সুলতান তাদেরকে অভয় দিলেন এবং তাদের জানমালের নিরাপত্তা দান করলেন।

এরপর আযান দেওয়া হল। সাড়ে এগারো শত বছর যাবৎ যেখানে ‘তিন খোদা’র উপাসনা হচ্ছিল সেখানে আজ তাওহীদের ধ্বনি উচ্চারিত হল। সকল ছবি ও মূর্তি সরিয়ে ফেলা হল। মুসলিম বাহিনী জোহরের নামায সেন্ট সোফিয়ায় আদায় করল।

সুলতান ফাতিহ রাহ. একে মসজিদে পরিণত করার ফরমান জারি করলেন। কেননা, প্রথমত কুস্ত্তনতীনিয়ার সম্রাট আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল তাই সুলতান এই গীর্জাকে পূর্বাবস্থায় বহাল রাখতে বাধ্য ছিলেন না। তদুপরি এটি ছিল অর্থডোকস খ্রিষ্টানদের কেন্দ্রীয় গীর্জা। তাই এর সঙ্গে বহু কুসংস্কার ও অলৌকিকতার বিশ্বাস জড়িত হয়ে গিয়েছিল। এই কুসংস্কারের মূলোৎপাটন প্রয়োজন ছিল।

কুস্ত্তনতীনিয়া বিজয়ের পর সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ রাহ. নগরীর খৃষ্টান অধিবাসীদের জান-মালের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করেন এবং তাদেরকে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেন।

কুস্ত্তনতীনিয়া বর্তমানে ইস্তাম্বুল নামে পরিচিত এবং বর্তমান তুরষ্কের অন্তর্গত।