গল্পটি ইসলামের শুরুর দিকের। প্রিয়নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে ডাকলেন। বললেন, ‘কোনো কারণে আজ আমি অনেক বেশি আনন্দিত৷ এ উপলক্ষ্যে তুমি আমার কাছে যা চাইবে, তা-ই দেব। বল, কী চাও তুমি?হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ভাবনায় পড়ে গেলেন। হঠাৎ করে এমন কী চাইবেন! তাছাড়া মনে যা-ই আসে, তা তো আর চাইতে পারেন না তিনি! যদি কোনো ভুল আবদার করে বসেন! ভয় হয় তার। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি ভুল আবদারে কষ্ট পেয়ে যান?
এমন অনেক প্রশ্নই তাঁর মনে জাগতে লাগলো।বহু সময় পর হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি কী আব্বুর কাছ থেকে একটা পরামর্শ নিতে পারি?’ প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমতি দিলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি তোমার আব্বুর পরামর্শ নিয়েই আমার কাছে চাও।’
হজরত আয়েশা রাদিল্লাহু আনহা তার পিতা হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে গেলেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর বিশ্বনবির পুরো ঘটনাটি তাঁকে বললেন। অতঃপর পরামর্শ চাইলেন।হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘নবীজির কাছে যখন কিছু চাইবেই, তখন মিরাজের রাতে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে তাঁর যেসব গোপন কথা হয়েছিলো, সেসব জানতে চাইতে পারো। তবে আমায় কথা দাও, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলবেন, তা সর্বপ্রথম আমাকেই জানাবে।’পরামর্শ পেয়ে হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা উৎফুল্ল হলেন। বাবাকে কথা দিলেন সবার আগে বিষয়টি তাঁকেই জানাবেন।
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলেন। অতঃপর মিরাজের রাতের এমন একটি গোপন কথা জানতে চাইলেন, যা প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখনও কাউকে বলেননি। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুচকি হাসলেন। সহধর্মিনীর এমন আবদারে অবাক হলেন। বললেন, ‘সেইসব কথা বলে দিলে আর গোপন থাকে কী করে! একমাত্র আবু বকরই পারেন এমন বিচক্ষণ প্রশ্ন করতে।`
এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আয়েশা! আল্লাহ আমাকে মিরাজের রাতে বলেছেন, হে মুহাম্মদ! তোমার উম্মতের মাঝে যদি কেউ কারো ভেঙে যাওয়া মন জোড়া লাগিয়ে দেয়, তাহলে আমি তাকে বিনা হিসেবেই জান্নাত দান করব।
(সুবহানাল্লাহ!)প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার পিতা হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে এসে সালাম দিয়ে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে শোনা কথাগুলো শোনালেন।
হজরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তো কথাগুলো শুনতেই কাঁদতে আরম্ভ করলেন৷ হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বাবার এমন (কান্নার) আচরণে বেশ অবাক হলেন! বললেন, ‘আব্বু! আপনি তো শত শত ভাঙা মন জোড়া লাগিয়েছেন৷ আপনার জন্য তো সরাসরি জান্নাতে যাওয়ার সুসংবাদ এটি, তবে কাঁদছেন কেন?
হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘হে আয়েশা! কথাটির উল্টো দিক নিয়ে খানিকটা চিন্তা কর। কারো ভাঙা মন জোড়া লাগালে যেমন আল্লাহ তাআলা জান্নাত দান করবেন, তেমনি কারো মন ভাঙলে আল্লাহ যদি সোজা জাহান্নামে দিয়ে দেন? নিজের অজান্তেই না জানি কত জনের মন ভেঙেছি আমি। আল্লাহ যদি আমাকে জাহান্নামে দিয়ে দেন, সেই চিন্তায় আমি কান্নায় ভেঙে পড়ছি।
এ হলো ইসলাম ও তার অনুসারীদের কাহিনী। কোনো কারণে দুনিয়ায় থেকে জান্নাতের সুসংবাদ লাভের পরও এভাবে ওই বিষয়ের উল্টা দিকও চিন্তা করতেন সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম। এভাবেই ইসলাম আমাদেরকে শিক্ষা দেয় কাউকে কষ্ট না দিতে; মানুষকে মানুষের বিপদাপদে পাশে দাঁড়াতে৷ প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, ‘তুমি গোস্ত রান্না করলে ঝোলের জন্য এক গ্লাস জল বেশি দাও, যেনো তোমার গরিব প্রতিবেশীকেও খানিকটা দিতে পারো। আর যদি না দিতে চাও, তাহলে এমন সময় রান্না করো, যখন প্রতিবেশীর বাচ্চা ঘুমিয়ে থাকে।
গোস্তের সুঘ্রাণ পেয়ে তারা যেন বাবা-মাকে গোস্ত খাওয়ার কথা বলতে না পারে। কারণ গরিব বাবা-মা হয়ত তাদের গোস্ত কিনে খাওয়াতে পারবে না, তখন তারা হয়তো মনে অনেক কষ্ট পাবে।’ইসলাম মানুষকে এভাবেই মানবতার শিক্ষা দিয়েছে। নিজেদের জীবনেও প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমও আমাদেরকে বাস্তবজীবনে মানবতা স্বরূপ শিক্ষা দিয়েছেন।
তাঁরাই আমাদেরকে বলেছেন মানুষের মন না ভাঙতে, মানুষকে কষ্ট না দিতে।কিন্তু আজ খোদ আমরাই ইসলাম ও মুসলমানের সুরে সুর মেলাই৷ দাবি করি খাঁটি মুসলমান৷ ইসলামের নামে গাই কত শত গান। শত নীতি বাক্যে স্লোগানে স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তুলি। কিন্তু বাস্তবে কাজ করি কীসের? হায়! কবে যে বোধোদয় হবে আমাদের!
ইসলামই একমাত্র মানবতার শ্রেষ্ঠ কথা বলে৷ ইসলামই একমাত্র সত্য ও সাম্যের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা দেয়৷ কিন্তু আমরা মুসলমান হয়েও কী সেই শিক্ষা ধারণ করতে পেরেছি! আফসোস! কবে যে পূর্ণভাবে নিজেদের রাঙিয়ে তুলবো প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বোত্তম আদর্শে! কবে যে মুসলিম উম্মাহ হবে সাহাবায়ে কেরামের মতো উত্তম ও শ্রেষ্ঠ চরিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী!
লেখক- শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত