আহা, এ কবর যদি আমার হত !

627
কবর হলো জান্নাতের বাগানসমূহের মধ্যে একটি বাগান,অথবা জাহান্নামের গর্তসমূহের মধ্যে একটি গর্ত

সাহাবী সিরিজ-১

ক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি স্থানে মুযায়না গোত্রের লোকজন বসবাস করত। মুযায়না গোত্রেরই যুবক আবদুল উয্যা ইবন নুহাম আল মুযায়নি। তার পিতা ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে। যুবকের বয়স ছিল তখন ষোলবছর। তখন পর্যন্ত তার চাচাই তাকে লালন-পালন করে আসছিল।

চাচা অত্যন্ত ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিল। সে তার এ এতিম ভাতিজার সব চাহিদা পূরণ করত। উত্তম খাবার, উত্তম পোশাক, ভালো থাকার ব্যবস্থা ইত্যাদি সবকিছু। আবদুল উয্যা যা কিছু চাইত চাচা এনে দিত। তার জন্য বিশেষভাবে অন্যান্য এলাকা থেকে উন্নতমানের পোশাক অর্ডার দিয়ে আনা হত। কারণ স্থানীয়ভাবে তৈরি পোশাক আবদুল উয্যার পসন্দ ছিল না। এভাবে বন্ধুমহলে তার একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি হয়ে গিয়ে ছিল। আলাদাভাবে দেখা হত তাকে।

আবদুল উয্যার বস্তির লোকেরা ছিল মূর্তিপূজক। তাদের সবার আলাদা আলাদা মূর্তি ছিল। সেগুলোকে সামনে রেখে তারা তাদের প্রয়োজন প্রার্থনা করত। এটা ছিল ঠিক তখনকার কথা যখন মুসলমানরা মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনা চলে যাচ্ছিল। যেহেতু আবদুল উয্যার বস্তি তখন শহরের মধ্যে ছিল, তাই যাতায়াতকারী কাফেলাসমূহ সেই বস্তিতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার উদ্দেশ্যে অবস্থান করত।

কোনো কোনো কাফেলা তো এখানে রাত্রি যাপনও করত। কাফেলাগুলোর জন্য সবচেয়ে সুবিধার বিষয় ছিল এই, এখানে সহজে পানি পাওয়া যেত। অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো সমস্যা হত না। একদা আবদুল উয্যার ভাগ্য খুলে যায়।

কিছু মুসলমান মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনা যাচ্ছিলেন। তারা তার বস্তিতে অবস্থান করেন। আবদুল উয্যাকে ইসলামের দাওয়াত দেন তারা। আবদুল উয্যা ছিল খুবই সরলমনা যুবক। সে সাথে সাথে ইসলাম কবুল করে নিল। সাহাবিরা তাকে ইসলামের জরুরি শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করেন। পবিত্র কুরআনের কিছু আয়াত শিখিয়ে দেন। আয়াতগুলো সে তাৎক্ষণিক মুখস্ত করে নেয়। তারপর ওই সাহাবিরা মদিনার দিকে রওয়ানা দেন।

পবিত্র কুরআন খুব পসন্দ হয় আবদুল উয্যার। সে আল্লাহর কালাম মুখস্ত করা আরম্ভ করে। যে মুসলমানের সাথেই দেখা হত, সে তার কাছ থেকে কুরআন করিম শিখত এবং নিজের সুললিত কন্ঠে তা তিলাওয়াত করত। অত্যন্ত বুদ্ধিমান যুবক ছিল সে। উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় সে তার ইসলামগ্রহণের বিষয়টা গোপন রাখে। কাউকে কিছুই বলেনি।

আবদুল উয্যা কাফেলার প্রতীক্ষায় থাকত। কখন আসবে কোনো কাফেলা?! আর সে তাদের কাছ থেকে কুরআন শিখবে। আগত সাহাবিদের সে অনুরোধ করত, যেন তারা তার বস্তিতে আরো কিছুদিন অবস্থান করে। যাতে আরো কিছু বেশি কুরআন শিখতে পারে।

মক্কার কুরাইশ সর্বত্র তাদের গুপ্তচর ছড়িয়ে দিয়েছিল। কোথাও যদি কোনো মুসলমান পাওয়া যায় তাহলে তাকে ধরে যেন ফিরিয়ে নিয়ে আসে। আবদুল উয্যার চাচাও ইসলামের ঘোর বিরোধী ছিল।
সম্মানিত পাঠক! এভাবে প্রায় তিন বছর কেটে যায়। হিজরতের চতুর্থ বছর শুরু হয়ে গিয়েছিল।

একবার কাফেলার এক মুসলমান আবদুল উয্যাকে বলে দিল,
-তুমি এখানে কি করছ? হিজরত করছ না কেন?
আবদুল উয্যা বলল,
-তোমার কথা তো ঠিক। কিন্তু আমি আমার প্রিয় চাচাকে কিভাবে ছেড়ে যাই? তখনই আমি হিজরত করব যখন আমি আমার চাচার হাত ধরে তাকে রাসূলুল্লাহ সা.এর দরবারে পেশ করতে পারব।

আবদুল উয্যা ইবাদত করার জন্যে মরুভূমিতে চলে যেত। যখন সে নিশ্চিত হত, এখন কেউ আর তাকে দেখছে না, তখনই সে নামায আদায় করত। চাচার সাথে সাক্ষাত হলে অত্যন্ত ভালোবাসা ও কৌশলের সাথে বলত,
-চাচাজান! ইয়সরিবে মুহাম্মদ নামের এক লোক সম্পর্কে আমি শুনেছি, সে নাকি এমন এমন কথা বলে।
সে চাচাকে কুরআন করিমের আয়াতগুলো শোনাত। এদিকে তার চাচার মধ্যে এর কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা যেত না। জবাবে সে কিছুই বলত না। এই টানাপোড়েনে সময় দ্রুত অতিবাহিত হচ্ছিল।

একদা তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। সে অত্যন্ত ভালোবাসা দিয়ে বলল চাচাকে, –
-প্রিয়চাচা! দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করেছি। আমার ধারণা ছিল, আপনি ইসলাম কবুল করে নিবেন। কিন্তু আপনি ইসলাম কবুল করেননি। এখন আপনাকে এ কথা বলার সময় এসে গেছে যে, আমি আক্বিদায়ে তাওহিদ কবুল করেছি। আর (أشهد أن لا إله إلا الله وأشهد أن محمدا رسول الله) স্বীকার করে নিচ্ছি। অতএব রাসূলল্লাহ সা.এর বিরহ আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তাই আমি হিজরত করে মদিনা চলে যাচ্ছি। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, আপনিও আমার সঙ্গে যাবেন।

প্রথম প্রথম তো চাচার বিশ্বাসই হয়নি। যখন ভাতিজার ইসলাম সম্পর্কে নিশ্চিত হয়, খুব রাগান্বিত হল। বলল,
-“আমি তোমার লালন-পালন করেছি। তোমাকে আদর-যত্ন করেছি। পৃথিবীর সবধরনের নেয়ামত ও সুযোগ-সুবিধা তোমার জন্য ব্যবস্থা করেছি। আমি তোমাকে নির্দেশ করছি, এক্ষণি তুমি ইসলামের পথ ছেড়ে ফিরে এসো।”
-“আমি তো কখনো ইসলাম ত্যাগ করার কল্পনাও করতে পারি না।” আবদুল উয্যা উত্তর দিল।

-তাহলে তো প্রতিটি নিয়ামত, প্রতিটি জিনিস যেসবের তুমি মালিক হয়েছ, সব ছাড়তে হবে তোমাকে। আমি তোমার আরামের সকল বস্তু ও সুযোগ-সুবিধা ফিরিয়ে নেব। শোন! প্রতিটি জিনিস এমনকি তোমার শরীরের কাপড়-চোপড় পর্যন্ত খুলে নেয়া হবে। 

আবদুল উয্যা বলল,
– চাচাজান! আপনার যা ইচ্ছা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.এর মোকাবেলায় কোনো কিছুকেই গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিতে পারব না। আমি রাসূলুল্লাহ সা.এর বিনিময়ে প্রতিটি নেয়ামতকে প্রত্যাখ্যান করছি। আপনার ইচ্ছা হলে আমার কাছ থেকে প্রতিটি বস্তুই ফিরিয়ে নিন।
রাগে-ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল চাচা। আবদুল উয্যার কাপড়-চোপড় ধরে ছিড়ে ফেলল। টুকরো টুকরো করে একদিকে ছুটে মারল।

আবদুল উয্যা প্রায় বিবস্ত্র হয়ে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা দুই টুকরো ছালা দেখতে পেল সে। দ্রুত একটি টুকরো নিয়ে সে তার লজ্জাস্থান ঢেকে নিল। আরেক টুকরো তার কাঁধের উপর রাখল।

প্রিয় পাঠক! আজকালের মুসলমান তো রুখসত তথা ইসলামপ্রদত্ত সুযোগের জন্য পাগলপারা। দৃঢ়তা ও সাহসিকতার কাহিনী পড়তে হলে তো সাহাবায়ে কেরাম রা.এর জীবনী অধ্যয়ন করতে হবে, কিভাবে তারা ইসলামের জন্য কুরবানি দিয়েছেন, বিসর্জন দিয়েছেন। 

এক বর্ণনায় রয়েছে, আবদুল উয্যা ওই অবস্থায় নিজের মায়ের নিকট যান। তার কাছে সহযোগিতা চাইলে সে ছালার একটি টুকরা ছেলের দিকে নিক্ষেপ করে। ঐ টুকরো দিয়ে আবদুল উয্যা তার লজ্জাস্থান ও কাঁধ ঢেকে নেন। মাও পরিস্কারভাবে জবাব দিয়ে দিল,
-আমি এর চাইতে বেশি কিছু তোমার জন্য করতে পারব না।

আবদুল উয্যা তখন মদিনাতুর রাসূলের দিকে রওয়ানা দেন। যেখানে মানবজগতের সবচেয়ে বেশি স্নেহ ও ভালোবাসা দেয়ার শ্রেষ্ঠ মানুষটি অবস্থান করছিলেন। যার উন্নত চরিত্রের দ্বিতীয় কোনো নজির নেই দুনিয়ার ইতিহাসে। আবদুল উয্যা আজ পর্যন্ত আল্লাহ রাসূল সা.কে দেখেনি। পায়ে হেঁটেই তিনি মদিনা পৌঁছলেন। তাঁর মত অসহায় মুহাজিরদের জন্য একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল মসজিদ নববি। এই আবদুল উয্যাই পরবর্তীতে আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন নামে পরিচিতি লাভ করেন ইতিহাসে।

আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন যখন মদিনা পৌঁছেন তখন রাত। তাই মসজিদে নববিতেই শুয়ে পড়েন তিনি। রাত পেরিয়ে ভোর হয়। আল্লাহর রাসূল সা. এসে ফজরের নামায পড়ালেন। নামায শেষে সাহাবায়ে কেরামের দিকে যখন তাকান, তাদের মাঝে এক অপরিচিত মুখের উপর তাঁর দৃষ্টি পড়ে। মসজিদে নববিতে আসহাবে ছুফ্ফার ছাউনিতে যুবককে দেখতে পেলেন তিনি। বয়স আনুমানিক ২১ বছর।

রাসূলল্লাহ সা. প্রশ্ন করলেন,
(من أنت؟)
-“তুমি কে?”
উত্তর দিলেন,
(أنا عبد العزى)
-“আমি আবদুল উয্যা।”
জিজ্ঞাসা করলেন,
-“পরিধানে ছালা কেন?”
আবদুল উয্যা রাসূলুল্লাহ সা.কে তার পুরো কাহিনী বর্ণনা করে বললেন,
-আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.কে নির্বাচন করেছি এবং দুনিয়ার সকল নেয়ামতকে ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করে এসেছি।

আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর সেই নতুন সাথীকে সাহস দিলেন। বললেন,
-“আজ থেকে তোমার নাম আবদুল উয্যা নয়; বরং আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন।” যুল বাজাদাইন শব্দের অর্থ হচ্ছে দুই টুকরো ছালা বিশিষ্ট। রাসূলুল্লাহ সা.এর পবিত্র মুখ থেকে বের হওয়া এ নামই তার পরিচয় হয়ে গেল। আবদুল্লাহ তাতে খুব খুশি হলেন।

আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন তখন থেকে মসজিদে নববিতে অবস্থান করতে থাকেন। খুব উচ্চস্বরে পুরো জোশের সাথে তিনি কুরআন করিম তেলাওয়াত করতেন। তিনি কুরআন করিম শিখতেন এবং তা খুব পড়তেন। এভাবে পবিত্র কুরআনের অনেকাংশ তার পড়া হয়ে যায়। কুরআন করিম অত্যন্ত ভালোবাসতেন তিনি।

আল্লাহর রাসূল সা. তাকে বলেছিলেন,
(فالتزم بابي)
-“আমার দরজার কাছে কাছে থেকো।”
আর বাস্তবেই আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন রাসূলুল্লাহ সা.এর দারওয়ানে পরিণত হয়ে যান। সর্বদা তিনি তাঁর খেদমতের জন্য উপস্থিত থাকতেন।
আবদুল্লাহ খুবই উচ্চস্বরে যিকির-আযকার করতেন। একবার হযরত উমর রা. বললেন,
(أمراء هو؟)
– “সে কি লোকদেখানোর জন্য এমন উচ্চস্বরে পড়ে নাকি?”
রাসূলুল্লাহ সা. উত্তর দিলেন,
(دعه عنك فإنه أحد الأواهين)
– “নাহ, বরং সেতো আল্লাহর দরবারে আহাজারিকারীদের একজন।”

আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন মসজিদেই পড়ে থাকতেন। উচ্চস্বরে কুরআন করিম তেলাওয়াত করতেন। একদা হযরত উমর রা. রাসূলুল্লাহ সা.কে আরজ করেন,
(ألا تسمع إلى هذا الأعرابي يرفع صوته بالقرآن)
-এই বেদুইনকে দেখুন তো, কত উঁচু আওয়াজে সে কুরআন মজিদ তেলাওয়াত করছে। তার কারণে অন্য মানুষের কুরআন তেলাওয়াত করতে সমস্যা হয়। আল্লাহর রাসূল সা. বললেন,
(دعه يا عمر فإنه خرج مهاجرا إلى الله ورسوله)
-“উমর! তাকে ছেড়ে দাও (কিছু বলো না)। সেতো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি হিজরত করতে গিয়ে সবকিছু ত্যাগ করেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।”

সম্মানিত পাঠক! একটু চিন্তা করুন। আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন হচ্ছেন একজন সাধারণ মানুষ। মদিনায় তার কোনো পরিবার-পরিজন নেই, কোনো গোত্র নেই। ধন-সম্পদের মালিকও নয়। তারপরও আল্লাহর রাসূল সা. তাকে তাঁর নিকটস্থ সাথীদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। একেই বলে উন্নত চরিত্র। তার সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, তিনি আল্লাহর রাসূল সা.কে আর আল্লাহর রাসূল তাকে ভালোবাসেন।

সময় অতিবাহিত হতে বেশি দিন লাগেনি। কয়েক বছর কেটে যায়। নবম হিজরিতে আল্লাহর রাসূল সা. গাযওয়ায়ে তাবূকের উদ্দেশ্যে রাওয়ানা হন। বিরাট সৈন্যবাহিনী ছিল। ইসলামের অন্যান্য মুজাহিদদের সঙ্গে আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইনও শামিল হন।

শাহাদাতের জযবায় আপ্লুত আপ্লূত হয়ে তিনি রাসূলুল্লাহ সা.এর দরবারে উপস্থিত হলেন। অনুরোধ করলেন তাঁকে,
-হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য দুআ করুন যাতে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যুদ্ধে শাহাদাতের নেয়ামতে ভূষিত করেন।
আল্লাহর রাসুল সা. তার জন্য দুআ করলেন,
(اللهم إني أحرم دمه على الكفار)
-“হে আল্লাহ! কাফিরদের জন্য আমি তার রক্ত হারাম করছি।”
তিনি আরজ করলেন,
-হে আল্লাহর রাসূল! আমার উদ্দেশ্য তো এটা ছিল না। আমি তো শাহাদাত প্রত্যাশী।
রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করলেন,
-“যুল বাজাদাইন! তুমি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের লক্ষ্যে বের হয়েছ। তোমার যদি জ্বর হয় এবং জ্বরের কারণে তোমার মৃত্যু হয়, তাহলেও তুমি শহীদ।”

আল্লাহর রাসূল সা. তাবূক পৌঁছে গেলেন। পাঠকমহল! আপনারা ভালো করেই জানেন, এ যুদ্ধে রোমানদের বিরুদ্ধে কোনে সংঘর্ষ হয়নি। তাবূকে অবস্থানকালেই আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন একদিন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। শরীরের অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকে। একসময় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.এর জন্য ঘর-বাড়ি এবং আরাম-আয়েশে ভরা জীবন পরিত্যাগকারী এ আবদুল্লাহ ইনতিকাল করেন।

দয়ালু নবীকে অবহিত করা হয়। আল্লাহর রাসূল সা. আবু বকর ও উমর রা.কে সঙ্গে নিয়ে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করতে লাগলেন। তখন ছিল শীতের রাত। এদিকে রাসূলুল্লাহ সা.এর আরেক সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রা.ও সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যিনি দেহের দিক দিয়ে দুর্বল ও কৃশকায় তবে ঈমানের দিক দিয়ে সবল ছিলেন। মধ্য রাতে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।

খাটো আকৃতির আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রা. আল্লাহর রাসূল সা.কে যারপারনাই ভালোবাসতেন। প্রথম দিকের মুসলমান ছিলেন। তিনি যখন রাসূলুল্লাহ সা.এর বিছানার দিকে তাকান। দেখলেন, বিছানা খালি পড়ে আছে। তারপর আবুবকর ও উমর রা.এর বিছানা দেখলেন, তাও খালি। খুব অবাক হলেন। মনে মনে চিন্তা হল, কোথাও কোনো বিপদ আসে নি তো? দাঁড়িয়ে চারিদিকে চোখ বুলালেন।

মধ্য রাতের সময়। চতুর্দিকে গভীর অন্ধকার। ফের একদিকে আবছা আলো নজরে পড়ে। আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রা. সেই আলোর দিকে চললেন। যেতে যেতে মুসলমানদের তাবুর এক কোণায় বিস্ময়ভরা এক দৃশ্য অবলোকন করলেন তিনি। দেখলেন, বেলাল ইবন হারেস একটি ছোট বাতি ধরে দাঁড়িয়ে আছে, যার আলোতে একটি কবর খনন করা হয়েছে। আবু বকর ও উমর রা. এর হাতে কার যেন লাশ। আল্লাহর রাসূল সা. নেমেছেন কবরে ।

তার মনে হল, এটা আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইনের লাশ। আল্লাহর রাসূল সা. ইরশাদ করছেন,
(أدليا إلى أخاكما)
– “তোমাদের ভাইকে কাছে আনো।”
আবু বকর ও উমর রা. যুল বাজাদাইনের লাশ আল্লাহর রাসূল সা.এর হাতে তুলে দিচ্ছেন। আর আল্লাহর রাসূল সা. বলছেন,
(رفقا بأخيكم)
“তোমাদের ভাইকে আস্তে করে তোল।”
(رفقا بأخيكم)
“আদর করে, নরমভাবে এবং মহব্বতের সাথে ধরো।” কারণ, (إنه كان يحب الله ورسوله) “সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.কে ভালোবাসত।”

আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর প্রিয় সাথীকে নিজ পবিত্র হাতে উঠালেন এবং অত্যন্ত মহব্বত ও ভালোবাসার সাথে তাকে কবরে রাখলেন। অত:পর রাসূলুল্লাহ সা.এর চারিত্রিক মাহাত্ম্য দেখুন। তিনি নিজ হাত আসমানের দিকে তুলে আল্লাহর কাছে দুআ করলেন,
(اللهم إني أمسيت عنه راضيا)
-“হে আল্লাহ! আমি তোমাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত যুল বাজাদাইনের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলাম।” (فارض عنه) “হে আল্লাহ! তুমিও তার উপর রাজি ও সন্তুষ্ট হয়ে যাও।”

এক বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর নিজ হাতে তাকে দাফন করেছেন এবং বললেন, (اللهم ارحمه إنه كان قارئا للقرآن محبا لرسول الله…)
-“হে আল্লাহ! তার উপর রহমত করো। সে কুরআন করিমের তেলাওয়াতকারী ছিল। আল্লাহর রাসূলকে মহব্বত করত।”

আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রা. স্বচক্ষে দেখা ঘটনা আমাদের বর্ণনা করছেন। সেই সাধারণ সাহাবির সম্মান ও মর্যাদা দেখেছেন। তাকে যে আল্লাহর রাসূল সা. কী পরিমাণ ভালোবাসতেন তাও লক্ষ করেছেন। এসব দেখার পর তিনি নির্দ্বিধায় বলেন,
(يا ليتني كنت صاحب اللحد)
-“আহ, এ কবরে যদি আমি হতাম!” .. .. এ কবরটা যদি আমার হত !”

=====================

লেখক- ড. সাদিক হুসাইন

Facebook Comments