8.3 C
New York
Friday, October 24, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 10

সেপালকার ইন লাভ ! মুহাম্মদ আতিকুল্লাহ

বৈরুত। নামটা ফিনিশিয়দের দেয়া। অর্থ: কূপ। পাঁচ হাজার বছরের পুরনো শহর। প্রাচ্যের পারিস বলা হয় এ-শহরকে। প্রাচ্যের সুন্দর শহরগুলোর মধ্যে বৈরুতের অবস্থান প্রায় শীর্ষে। এখন অবশ্য সুন্দর এই বন্দরনগরী নরককুণ্ডে পরিণত হয়েছে। ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে। শুরু হয়েছে সেই ১৯৭৫ সালে। চলবে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের ধাক্কায় এই রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ থামবে। ভয়ংকর এই গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল বহু গোষ্ঠী।
.
বৈরুতের রাস্তায় একলোক হাঁটছে। জীর্ণ পোশাক। শীর্ণ দেহ। উস্কুখুস্কু চুল। দীর্ঘদিনের অধোয়ার কারনে দাঁড়িগুলো জট পাকিয়ে আছে। নগ্ন পা। হাঁটছেও ধুঁকে ধুঁকে। এর ওর কাছে হাত পাতছে। সবাই দূর থেকে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কারন মানুষটা গা দিয়ে সারাক্ষণ বোটকা গন্ধ বের হয়। নাকে হাত চাপা দিয়েও পার পাওয়া যায় না। গোসল করেছে কতদিন হয়েছে, কে জানে! গায়ে চাপানো কোটটার আসল রঙ সেই কবে হারিয়ে গেছে! ময়লার পুরু আস্তরণ জমাট বেঁধে আছে।
.
বৈরুতের কেউ লোকটাকে কখনো কথা বলতে দেখেনি। জিজ্ঞেস করলেও উত্তর মেলে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টিটাও কেমন যেন! খ্যাপাটে পাগলাটে ধরনের! ঘোলা ঘোলা। অস্থির। তবে এ-অবস্থা সব সময় থাকে না। লোকজন দয়া করে দান করছে। পাগল হলেও লোভী নয়। কেউ দান করলে, তার যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু গ্রহণ করছে। নিতান্ত বাধ্য না হলে গ্রহণ করছে না। কেউ দু’টি রুটি দিলে একটি গ্রহণ করছে। কারন তার একটা দরকার। লোকজন এই নির্মোহ ফকিরের প্রতি সশ্রদ্ধ না হয়ে পারে না। মানুষের মনই এমন; ব্যতিক্রমী কিছু চায়। স্বাভাবিকের বাইরে কিছু পেলে লুপে নেয়। বিস্মিত হয়। আগ্রহী হয়ে ওঠে। সবকিছু চাপিয়ে মানুষটার একটা বৈশিষ্ট্য সবাইকে আকৃষ্ট করে- লোকটার হাসি। পরিধেয় যেমনই হোক, চলনবলন যাই হোক, পাগলামিকে চাপিয়ে, মানুষটার মুখে একটা স্মিত হাসি লেগে আছেই। ছোটবড় সবার সাথে অত্যন্ত ভদ্র আচরণ করে। কথা না বললেও, অসৌজন্যমূলক কিছু করে না। বাচ্চা-কাচ্চা দেখলে করুন চোখে তাকিয়ে থাকে। খাওয়ার কিছু থাকলে শিশুদের দিকে বাড়িয়ে দেয়! ছোটাছুটি করতে গিয়ে কোনও শিশু ব্যথা পেলে, দৌড়ে গিয়ে উঠিয়ে দেয়। রক্ত বের হলে কোলে করে ছুটে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সাথে একটা বেড়ালছানাও থাকে প্রায় সময়। শহরে যত বেড়াল আছে, সবগুলোর সাথেই তার সখ্য। ছোট ছেলেমেয়েদের সাথেও। শুধু একটাই সমস্যা, কথা বলে না। আগে বেশি পীড়াপীড়ি করলে, লিখে উত্তর দিত। এখন তাও দেয় না। দেয়ার প্রয়োজনও পড়ে না। সবাই জানে, পাগলটা সম্পর্কে। তাদের জীবনের এক অভ্যস্ত অনুষঙ্গ হয়ে গেছে পাগলটা। একদিন না দেখলে খোঁজখবর করতে শুরু করে দেয়। তার খাওয়া-দাওয়া হল কি না, চিন্তা করে।
.
তার বিরুদ্ধে কারো কোনও অভিযোগ ছিল না। নিজের কাছে খাবার থাকলে ছোটদেরকে দেয়। রাস্তার কাককে খাওয়ায়। কুকুরকে বসে বসে খাওয়ায়। বেড়ালকে খাওয়ায়। তার বাহ্যিক অবয়ব সুন্দর না হলেও, শিশুরা তাকে ভয় পেত না। সে কখনো মহিলাদের দিকে চোখ তুলে তাকাত না। সারাদিন এদিক সেদিক হাঁটার উপর থাকত। যেখানে রাত হত, মাটিতেই শুয়ে পড়ত।
লোকটার কোটের পকেটে একটা জীর্ণ ছেঁড়াপাতার ডায়েরি থাকে। লেখা থেকে বোঝা যায়, একজন নারী ছিল এই ডায়েরীর মালিক। ডায়েরীর মধ্যে অস্পষ্ট ঝাপসা একটা স্টিল ফটোগ্রাফও আছে। বিবর্ণ মলিন। একটা পরিবারের ছবি। শাদাকালো। কারো চেহারাই পরিষ্কার বোঝা যায় না। পাগলটা সময় পেলেই চবিটার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। একটু পর পর ঝাপসা হয়ে আসা চোখ মোছে। তার চোখে পানি দেখে, আশপাশ থেকে কৌতূহলভরে তাকিয়ে থাকা মানুষজনেরও দু’চোখও ভিজে ওঠে! আহা বেচারা! সবাইকেই বোধ হয় হারিয়েছে!
.
প্রথম দিকে পাগলটা কাউকে তার ডায়েরি পড়তে দিত না। দেখ তেও দিত না। কেউ জানতোও না ডায়েরিটার কথা। একদিন হঠাৎ করে বের হয়ে পড়ল। তখনো পাগলটা সর্বজন প্রিয় হয়ে ওঠেনি। দুষ্ট ছেলের দল পাগলকে দৌড়ানি দিয়েছে, পাগলটাও ইট-পাথরের আঘাত থেকে আত্মরক্ষা করতে মরিয়া হয়ে ছুটে যাচ্ছে। রাস্তার কোনে উঠে থাকা ইটের সাথে হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। তখনি কোটের পকেট থেকে একটা ডায়েরি বের হয়ে এল। ছেলেরা ডায়েরি নিয়ে ছুট দিল। বড়রা ভীষণ অবাক হয়ে দেখল ডায়েরিতে অনেক কিছু লেখা। পুরোটা পড়ে, যতটুকু জানা গেল:
= পাগলটার বাড়ি ফিলিস্তীনে। ইহুদিদের কারাগারে বন্দী ছিল। তার একমাত্র বোন ইহুদিদের নির্যাতনের জ্বালা সইতে না পেরে, রাতের আঁধারে পালিয়ে এসেছে। খবর পাওয়া গেছে, সে বৈরুতের কোথাও আছে। ইহুদিরা পরিবারের বাকি সবাইকে মেরে ফেলেছে! কারাগারে টর্চারের কারণে, চিৎকার করতে করতে গলা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বের হয় না। মাথাও সব সময় ঠিক থাকে না। পৃথিবীতে বোনই একমাত্র জীবিত আত্মীয়।
.
এর মধ্যে যুদ্ধ লেগে গেল। লোকজন প্রচণ্ড উদ্বেগর মধ্যেও ঠিকই পাগলটার দিকে নজর রেখেছে। পাগলটা নির্বিকার! ইসরাঈলি বোমা পড়ছে, বিভিন্ন দলের নানামুখি রক্তক্ষয়ী সংঘাত চলছে। সে আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মসজিদে গীর্জায় সিনাগগে সর্বত্র। পাগলটার ধর্ম নিয়ে শুরুর দিকে একটু ধোঁয়াশা ছিল। পরে ডায়েরি পড়ার পর কেটে গেছে। সে একজন ফিলিস্তীনি খ্রিস্টান। জেরুজালেমের ওল্ডসিটিতে তাদের চৌদ্দপুরুষের নিবাস। বৈরুতে এসেছে বোনের খোঁজে! ঘটনার শুরু আরও আগে!
.
গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, বৈরুত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। চতুর্মুখি যুদ্ধে বিধ্বস্ত অবস্থা। এরমধ্যে ইসরাঈলি বাহিনীও এসে যোগ দিয়েছে। কয়েক দিক থেকে তারা হামলা শুরু করেছে। প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলা হল তাদের বিরুদ্ধে। ইহুদিরা পাল্টা আঘাত হানতে নির্বিচারে বিমান হামলা শুরু করল। ইহুদি স্নাইপাররাও ওঁৎ পেতে থেকে হত্যা করল অসংখ্য মুসলিম যোদ্ধাকে। হিংস্র ইহুদিরা ঘটাল সাবরা-শাতিলায় ভয়ংকরতম বর্বর হত্যাকান্ড! অসহায় উদ্বাস্তু ফিলিস্তীনি মানুষগুলো বেঘোরে মারা পড়ল!
.
এতকিছুর পরও পাগল বহাল তবিয়তেই আছে। ঘুরছে ফিরছে। রাস্তায় রাস্তায়। অলিতে গলিতে। এখানে ওখানে। যুদ্ধ তার গতিবিধিতে কোনও পরিবর্তন আনতে পারে নি। সে আছে নিজের মত করে। কেউ কেউ চেষ্টা করেছিল তাকে নিরাপদ বাংকারে লুকিয়ে রাখতে। তাদের সাথে সানন্দে যায়। কিছুক্ষণ থেকে আবার কোন ফাঁকে বেরিয়ে চলে আসে বাংকার থেকে। আটকে রাখা যায় না। ইসরায়েলি সেনারা বৈরুতের পশ্চিমাংশে অবস্থান নিল। লোকজন হায় হায় করে উঠল। পাগলটার আনাগোনা যে ওদিকটাতেই বেশি! নির্ঘাৎ মারা পড়বে। সবাই চিন্তিত! কী হবে অসহায় পাগলটার? ইসরায়েলি পশুগুলোর মনে কি দয়ামায়া বলে কিছু আছে?
.
উৎসাহী দরদি কয়েকজন মানুষ গাগলটার খোঁজে এল। মুহূর্মূহ বিমান হামলা চলছে। ইসরায়েলি কনভয় সাবরা-শাতিলায় গণহত্যা শেষ করে এদিকেই আসছে। পাগলের খোঁজে আসা লোকজন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। একটা বহুতল ভবনের ভগ্নাবশেষের আড়ালে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, পাগলটা রাস্তার পাশে বসে আছে। ইহুদি বাহিনী এগিয়ে আসছে! থেমে থেমে ব্রাশ ফায়ার করে রাস্তা নিরাপদ করছে! যাতে কেউ কাছে ঘেঁষতে না পারে! আহ! বেচারাকে বুঝি বাঁচানো গেল না! তাকে রাস্তার কোল ঘেঁষে বসে থাকতে দেখেই গুলি করবে ইহুদিরা! ভাববে, ফিলিস্তীনি ফিদাঈ! পাগলের ছদ্মবেশে ওঁৎ পেতে আছে!
.
ইসরায়েলি কনভয়ের প্রথম গাড়িটা পাগলটার ঠিক সামনে এসে ব্রেক কষল। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেল পুরো কনভয়। একজন পদস্থ অফিসার তড়াক করে জীপ থেকে নেমে সটান স্যালুট হাঁকাল। ব্যাজ দেখে কর্নেল মনে হয়! পাগলটা পিটপিট করে তাকাল। তারপর সীনা টান করে দাঁড়িয়ে হাতকে সামান্য তুলে স্যালুটের জবাব দিল। আশেপাশ থেকে উঁকি মারা লোকেরা তাজ্জব পাগলের ফিটনেস দেখে। অথচ এতদিন লোকটা কী ভীষণ কুঁজো হয়ে ধুঁকে ধুঁকে হাঁটত। ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানত না। অফিসারটি পাগলের মুখে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিল। নিজেই লাইটার জ্বালাল ফস করে। অগ্নিসংযোগ করে দিল। পাগল বলল:
-আবিপ, তোমরা পাঁচ মিনিট দেরি করে ফেলেছ!
-এক জায়গায় এমবুশে পড়েছিলাম! স্যার! আর দেরি করা যাবে না! আপনার পরিচয় ফাঁস হয়ে গেছে!
-কিভাবে?
-আপনার বোন!
-তার ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম?
-তাকে পাইনি, তবে মূলব্যক্তিকে পেয়েছি! ব্যবস্থা নিয়েছি!
-গুড! চলো!
পাগলকে সসম্মানে উঠিয়ে নিয়ে পুরো কনভয় আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল! লোকজনের বিস্ময়ে ঠিকরে বের হওয়ার উপক্রম চোখের সামনে দিয়ে!
এক. আমাদের দেশে এমন পাগল কয়জন আছে?
দুই. আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চ পদগুলোতে এমন পাগলের সংখ্যা কত?
তিন. পোশাকাশাকে পাগলটার মত না হলেও, ধোপদুরস্ত সুস্থ পাগলের সংখ্যা মুসলিম দেশগুলোতে কত হবে?
.
খ্রিস্টানদের কাছে সবচেয়ে পবিত্রতম গীর্জা হল ‘কানীসাতুল কিয়ামাহ’। হোলি সেপালকার চার্চ। পুরোনো জেরুযালেমে। খ্রিস্টানদের বিশ্বাসমতে এখানে একটা পাথর আছে, তার উপরেই যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। এখানেই যিশুকে কবর দেয়া হয়েছিল। এ-গীর্জার পাশেই আছে মসজিদে উমার। বায়তুল মুকাদ্দাস জয়ের পর আমীরুল মুমিনীন এখানেই দু’রাকাত সালাতে ফাতহ আদায় করেছিলেন। তার নামাজের জায়গাতেই গড়ে উঠেছে মসজিদ।
সালাহুদ্দীন আইয়ুবি রহ. যখন কুদস জয় করেন, তখন এই গীর্জার দখল খ্রিস্টানদের বিভিন্ন দলের মধ্যে সংঘাত লেগে যায়। আর্মেনিয়ান চার্চ, রোমান ক্যাথলিক ও অন্যান্য দল নিজেরা এ গীর্জার ধারকবাহক হতে উঠেপড়ে লাগে। কারো কারো মতে, তখন সালাহুদ্দীনের সরাসরি হস্তক্ষেপে বিবাদ মেটে। তিনি খ্রিস্টানদের সম্মতিক্রমে এক প্রতিবেশি মুসলিম পরিবারের হাতে গীর্জার চাবি তুলে দেন। সে থেকেই ‘আলে জাওদাহ’ পরিবার বংশানুক্রমে প্রতিদিন গীর্জা খোলে ও বন্ধ করে।
.
বর্তমানে গীর্জার চাবিদার হলেন আবেদ জাওদা। তার বাবা ও দাদাও এই দাায়িত্ব পালন করে গেছেন। জাওদা বংশেরই এক সন্তান আলি জাওদাহ। দাদার হাত ধরে আলিও মাঝেমধ্যে গীর্জার দ্বার খুলতে আসে। গীর্জায় কখন কারা পূজা করতে আসবে তার সময় ভাগ করে দেয়া আছে। প্রথমেই আসে ‘আর্মেনিয়ান খ্রিস্টানরা’। তারপর আসবে আরেক মতাবলম্বী খ্রিস্টান। এভাবে চলে আসছে।
আজ বৃহস্পতিবার। বিশেষ পূজা হবে সেপালকারে। পুরোহিতদের সাথে সাধারণ মানুষও অংশ নেয়। ভোর চারটা বাজে। আজও বাইবেল পাঠ হয়েছে। বিশেষ পদ্ধতিতে প্রণাম-পূজা হচ্ছে। যাজকদের সাথে অল্প কয়েকটা আর্মানি পরিবার এসেছে। তীর্থযাত্রীদের একজনকে দেখে মনে হচ্ছে, তার আগ্রহ পূজাপাটের চেয়ে অন্য কোনও দিকে। গীর্জার পূজা-পাট অংশ না নিলেও, জাওদা পরিবারের চাবিরক্ষক গীর্জার অভ্যন্তরে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে তীক্ষœ নজর রাখেন। নানা দল নিয়ে কাজ কারবার। হিংসাবশত কেউ উল্টাপাল্টা কিছু করে রেখে গেল, তার দায় চাপবে চাবিধারীরও উপর। এজন্য কড়া পাহারা রাখতে হয়। এরা তাদের পবিত্রতম স্থানে এলেও আসার সময় মনটা পবিত্রতম করে আনতে পারে না। খালি অন্য দলের বিরুদ্ধে বিষোদগার করবে। তারাই যিশুরু সাচ্চা অনুসারী, বাকিরা ভ-! জাওদা পরিবারকে এসব অহরহ শুনে যেতে হয়। শুনতে শুনতে তাদের কান পচে গেছে।
দাদা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। ভোর চারটায় একা একা আসতে পারেন না। সাথে নাতিদের কেউ আসে। দাদার হয়ে গীর্জার দরজা খুলে দেয়। দাদাকে সঙ্গ দেয়। কথা বলে। পূণ্যার্থীদের আনোগোনা দেখে। চৌকান্না থাকে। আলি জাওদা দাদাকে বসিয়ে এদিক-ওদিক নজর রাখছে। তার চোখ পড়ল, এক সন্নাসীসির উপর। কালো আলখেল্লায় আপাদমস্তক আবৃত। প্রবেশ করার সময় এ কোথায় ছিল? দেখা গেল না যে? সবাই পূজায় ব্যস্ত, সন্নাসিনী দেয়ালের কাছ ঘেঁষে হাঁটছে আর গভীর অভিনিবেশে কী যেন খুঁটে খুঁটে দেখছে। কী দেখছে? নান হয়ে কাজে ফাঁকি? আলি এগিয়ে গেল! তাকে দেখে নানা একটু চমকে উঠল। সাথে সাথে অবশ্য মিষ্টি হাসিতে চোখমুখ উজ্জল। সপ্রতিভ ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল:
-আপনি বুঝি দরজার তালা খুলেছেন?
-জ্বি না, আমার দাদাজির কাছে চাবি থাকে! আমি তার সাথে এসেছি! তার বয়েস হয়ে গেছে কি না! একা একা খুলতে পারেন না!
-কিছু মনে না করলে, আমি আসলে বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছি! আপনাকে বলব?
-আমি গীর্জার কেউ নই!
-জানি। আমার প্রয়োজনটা গীর্জা সংশ্লিষ্ট নয়!
-তাহলে?
– কি আপনাদের পারিবারিক লাইব্রেরীটা একটু দেখতে পারি?
-অবশ্যই পারেন! কিন্তু সেখানে আপনার কী প্রয়োজন? আপনি সেটার কথা কিভাবে জানতে পারলেন?
-আমি খলীল (হেবরন) ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। ইতিহাস আমার সাবজেক্ট। হোলি সেপালকার সহ এখানকার প্রাচীন গীর্জাগুলো নিয়ে একটু পড়াশোনা করব। আমি শুনেছি, সেই সালাদীনের আমল থেকেই আপনাদের পরিবার এখানে দায়িত্ব পালন করে আসছে। যুগে যুগে তাদের কাছে অনেক স্মৃতি অনেক ঐতিহাসিক বস্তু জমা হয়েছে। আমার মনে হয়, লাইব্রেরিটা আমাকে একটু দেখতে দিলে, আমার গবেষণায় অনেক সহযোগিতা হবে। আমার আব্বুও এমনটা মনে করেন। আব্বুই আমাকে আপনাদের পারিবারিক সংগ্রহশালার কথা জানিয়েছেন!
-ও, আপনি তাহলে পেশাদার নান নন?
-পেশাদার না হলেও, অপেশাদারও নই!
-মানে?
-আমরা যারা এখানে আর্মেনিয়ান আছি, তারা পালাক্রমে বংশানুক্রমে যিশুর ঐতিহ্য রক্ষা করে আসছি! পড়াশোনা শেষ করে হয়তো এসে নান হিশেবে যোগও দিতে পারি!
-কিন্তু এমন কথা তো আপনাদের প্রায় সব দলই বলে বেড়ায়! নিজেদেরকে যিশুর আসল অনুসারী বলে!
-অন্যরা কে কী বলে সেটা আমার জানার দরকার নেই! আমাদের আর্মেনিয়ান চার্চই যিশুরু প্রকৃত অনুসারী!
-আচ্ছা আচ্ছা থাক, আমার প্রতি রাগ করার দরকার নেই! আমি নিজ থেকে একথা বলিনি! অন্যরা আমাদের কাছে নালিশ দেয় বলেই কথাটা পেড়েছি!
-এখন বলুন, আমার পক্ষে কি লাইব্রেরিটা ব্যবহার করা সম্ভব?
-এটা আমি বলতে পারব না। দাদু বলতে পারবেন। চলুন আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাই!
.
এটা ছিল সূচনা! তারপরের ঘটনাগুলো ছাড়া ছাড়াভাবে ডায়েরিতে তারিখসহ লেখা আছে:
৩রা মার্চ, ১৯৭৩
আজ এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছে। হোলি চার্চে গিয়েছি ভোর চারটায়। উত্তেজনায় সারারাত একফোঁটা ঘুমুতে পারিনি। কখন তিনটা বাজবে, আমরা কখন রওয়ানা দেব। চার্চে যাব। আমার অবশ্য চার্চের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই, আমার পরম আরাধ্য বিষয় হল, জাওদা পরিবারের লাইব্রেরিটা। আমার স্যারই এটার সন্ধান দিয়েছেন। তিনি মুসলমান এবং পুরুষ। তিনি যেভাবে লাইব্রেরিতে প্রবেশের অনুমতি নির্বিঘেœ পেয়ে গেছেন, আমি কি পাব? ভাইয়া অবশ্য অভয় দিয়ে বলেছেন:
-তারা শত শত বছর ধরে গীর্জার চাবির দায়িত্ব পালন করে আসছে। তোকে অবশ্যই অনুমতি দিবে। তুই নিশ্চিত থাক, খুশি মনেই পড়তে দিবে! যদি না দেয়, সে দেখা যাবেখন!
.
আমি শুধু শুধুই আশংকা করছিলাম। তারা খুবই ভাল মানুষ। বিশেষ করে আলি। তার সাথে চার্চের করিডোরে দেখা হয়ে যাওয়াটাও বড় ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী ভদ্র আর মার্জিত ছেলে! বৈরুতে পড়াশোনা করে। বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। একদিনেই মনে হয়েছে তাকে চিনে ফেলেছি। সে আমাকে বুড়ো দাদুর কাছে নিয়ে গিয়েছে। তিনি খুশি মনেই অনুমতি দিয়েছেন। আলির ঘাড়েই দায়িত্ব চাপিয়েছেন, আমাকে সহযোগিতা করার জন্যে।
আলি নিজে সাথে থাকতে না পারলেও, তার মা আমাকে বলতে গেলে সারাক্ষণ সঙ্গ দিয়েছেন। কুদসের মুসলিম পরিবারগুলো এত মিশুক হয়, আগে জানতাম না তো! আমার সাথে অসংখ্য মুসলিম ছেলে পড়ে। তাদের সাথে কখনো প্রয়োজনের বেশি কথা হয়নি। তবে সবাইকে ভদ্র হিশেবেই দেখেছি। কিন্তু একান্ত ঘরোয়া পরিবেশে কখনো যাওয়া হয়নি। আফসোস হচ্ছে, আগে থেকেই কেন পরিবেশটার সাথে পরিচিত হলাম না!
.
১০-ই মার্চ, ১৯৭৪
উফ! গত কয়েকটা দিন কী ছটফটানিইনা গিয়েছে। ভাইয়াকে পইপই করে বলে দিলাম, আমাকে নিয়ে যেতে, তার সময় হলে তো! তিনি কি সব আন্দোলন করে বেড়াচ্ছেন! আজ তাকে আর নিস্তার দিইনি। একদম সাত সকালে উঠেই তার ঘাড়ে চেপে বসেছি। আজকাল জেরুযালেমে এতদূর পথ একা একা যাওয়া যায়? সাথে পুরুষ কেউ থাকলে তবেই ভরসা পাওয়া যায়। যেখানে যাব তার আশেপাশে সবাই মুসলিম। একটু ভয় ভয় করে! পথে পড়ে কয়েকটা ইহুদি পাড়া! গা কেমন ছমছম করে! এই বুঝি আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল!
আমার মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিল, আজ আলির সাথে দেখা হবে। তার সাথে বৈরুতের পড়াশোনা নিয়ে কথা বলব। আমিও সেখানে যেতে পারি কি না, যাচাই করে দেখব! তা আর হল কই! তার মা বলল, সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায়! রাত হলে ডেরায় ফেরে! ভোর হলে আবার চম্পট! দাদুর সাথে গীর্জায়ও যেতে চায় না! তার নাকি গীর্জায় যেতে ভাল লাগে না। শুধু দাদুর কষ্টের কথা ভেবেই যাওয়া!
আমার পড়াশোনা ভালই এগুচ্ছে। আরবি কবিতার প্রতি আমার আজন্ম ভালবাসা! আব্বুর প্রিয় কবি হলেন আখতাল। তিনি বনু উমাইয়া যুগের সেরা তিন কবির একজন। খ্রিস্টান হয়েও তিনি মুসলমানদের মাঝে থেকে কাব্যলক্ষীর চর্চা করে গিয়েছেন। তার কবিতা আব্বুর লাইন কে লাইন মুখস্থ। কিন্তু ঘরে তার দীওয়ান ছিল না। শুনেছি বৈরুত থেকে তার দীওয়ান (কাব্যসমগ্র) ছাপা হয়েছে। আলির সাথে আরেকবার দেখা হলে ভাল হয়। একটা দীওয়ানে আখতাল সংগ্রহ করতাম।
আম্মুও কাব্যরসিক! তার প্রিয় কবি হলেন ‘মী যিয়াদাহ’। ১৮৮৬-১৯৪১। আম্মু নারী বলেই হয়তো তার প্রিয় কবিও একজন নারী। মি যিয়াদাহ প্রিয় হওয়ার আরও একটা কারন, তিনি লেবাননের কবি হলেও, কবির মা একজন ফিলিস্তিনী। আম্মুও নাকি একসময় স্বপ্ন দেখতেন, তার প্রিয় কবির যিয়াদার মত জীবনে বিয়ে করবেন না। কাব্যসাধনা করেই জীবন কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু তা আর হল কই! আমি আাম্মুর কথা শুনি আর হাসি! তাকে রাগানোর জন্যে বলি:
-মী যিয়াদাহ কুমারি থাকার একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে! তোমারও কি তেমন কোনও কারণ আছে?
-কী সব আজেবাজে কথা বলিস!
-তুমি জান না, যিয়াদা একজনকে পছন্দ করত?
-কাকে?
-কেন খলীল জিবরানকে? বিশ বছর চিঠি লিখেছে, একজন আরেকজনকে। মজার ব্যাপার হল জীবনে একবারও তাদের দেখা হয়নি। ভাগ্যিশ তোমার এমন দুর্মতি হয়নি! নইলে আমি এত সুন্দর পৃথিবীর দেখা পেতাম না!
.
ঈশ্বর তার দাসের সব খবর রাখেন। আমি যে বহুদিন ধরে দীওয়ানে আখতাল খুঁজছি, এটা ঈশ্বর ছাড়া আর কে জানে? কেউ জানে না! আজ আলিদের কুতুবখানায় গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়ল একটা ভলিউমের উপর। জ্বলজ্বল করছে: দীওয়ানে আখতাল। আমি ভীষণ চমকে গেছি! এ-বাড়িতে কাব্যচর্চা কে করে? দৌড়ে আলির আম্মুর কাছে গেলাম। তিনি বোধহয় মিষ্টি হাসি আর আদর ছাড়া কথাই বলতে পারেন না।
-এ-বাড়িতে আখতালের কবিতা কে পড়ে?
-কেন সবাই পড়ে! আলির দাদু পড়ে, আলি পড়ে! আমি পড়ি!
-সবাই কবিতা পড়ে দেখছি! কুতুবখানায় কার কার কবিতা আছে?
-আরবের বড় বড় প্রায় সব কবির দীওয়ানই আমাদের সংগ্রহে আছে। তোমার শুনে ভাল লাগবে, আন্দালুসের নাসারা কবিদেরও কয়েকটা পান্ডুলিপিও এখানে আছে।
-কিভাবে সংগহ হল সেগুলো?
-গ্রানাডার পতনের পর, সেখান থেকে পালিয়ে আসা কিছু ইহুদি পরিবার এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের কাছ থেকেই আমাদের পূর্বপুরুষরা কিনে নিয়েছেন সেগুলো। তোমার বুঝি কবিতা ভাল লাগে?
-জ্বি, খুবই ভাল লাগে। আম্মু-আব্বুও কবিতা ভাল বাসেন!
.
২০-ই মার্চ, ১৯৭৪
কিভাবে যে দিনগুলো হু হু করে চলে যায়, টেরটিও পাওয়া যায় না। দশটা দিন জীবন থেকে হারিয়ে গেল। বড্ড দোটানার মধ্যে আছি, আমি কি আরবী কবিতা পড়ব নাকি চার্চের ইতিহাস পড়বো? আর অল্প সময়ের জন্যে গিয়ে কিছুই পড়া যায় না। আম্মুর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছিলাম। যদি ও-বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা থাকে, আমি থেকে যাব। একটা ব্যাগে করে কিছু জামা-কাপড়ও নিয়ে এসেছি! আলির আম্মুকে গতবার আকারে ইঙ্গিতে বলেছিলাম। তিনি রীতিমত লুফে নিয়েছেন আমার ইচ্ছাকে!
-থাকতে পারবে মানে? কেন পারবে না! এটা তোমার ঘর! তোমার মত পড়–য়া মেয়ে পেলে আমার খানাপিনাও লাগবে না। সারাক্ষণ কথা বলার মানুষ পাওয়া যাবে! ছেলেটাকে কাছে পাই না। ওর বাবা নেই জানো তো!
-জানি না তো! তার কী হয়েছে?
-তিনি ৬৭র যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আলিই আমার একমাত্র সন্তান। তাকে নিয়েই আমার সবকিছু আবর্তিত।
.
আমি এখন আলিদের বাসায় আছি। গত দু’দিন ধরে। ভাইয়া একবার নিতে এসেছিলেন, আমি পড়ার কাজ শেষ হয়নি বলে তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি। প্রতিদিনই খুশিমনে ঘুম থেকে উঠি, আজ বুঝি আলির সাথে দেখা হবে! কিন্তু গিয়ে দেখি, সে নেই। ফজরের নামাজ পড়তে গিয়ে আর আসেনি। প্রায় দিনই আসে না। কোথায় যায়, কী করে, মাকে কিছু বলে না। মা শুধু আক্ষেপ করেন, আমি বিধবা হয়েছি, শহীদের স্ত্রী হয়েছি। এবার বোধ হয় শহীদের মা হতে যাচ্ছি।
পরিবারটা অনেক বড়। অনেক সদস্য। সবাই আমাকে খুবই আদর করে। আগ্রহের সাথে সময় দেয়। এ-বংশের মেয়েরা স্কুল-কলেজে যায় না, কিন্তু তারা আমার মত বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়াদেরকে পড়াতে পারবে। আগে মনে করতাম, তারা পড়ে না। এখন দেখি সম্পূর্ণ উল্টো। আমরা খ্রিস্টানরাই পড়ি না। তারা কী পরম মমতায় কুরআন তিলাওয়াত করে। আমরা কি এত যতœ করে বাইবেল পড়ি?
আমার কী হয়েছে কী জানি! লাইব্রেরিতে পড়ার চেয়ে আলি আম্মুর সাথে কথা বলতে বেশি ভাল লাগে। তার সাথে অল্পসময় কথা বললে, কয়েকটা বই পড়ার চেয়েও বেশি কিছু জানতে পারি! আমার চেয়ে বয়সে ছোট মেয়েরাও অনেক কিছু জানে। অথচ তারা জীবনেও স্কুলের গ-ী মাড়ায়নি।
.
২৮রা মার্চ, ১৯৭৪
আজ গিয়ে শুনি আলি চলে গেছে। বুকটা ছাঁৎ করে উঠল। কেন? একবার মাত্র কথা বলা মানুষের প্রতি আমার এত আগ্রহ কেন? আর যে মানুষটা আমাকে এড়িয়ে চলেছে দিনের পর দিন, আমি কথা বলতে গিয়েছি, নানা অজুহাতে পাশ কাটিয়ে গেছে! তার জন্যে আমার মন কেন উতলা হবে? কোনও যুক্তি আছে?
.
বাড়িটাকে আমি বড় ভালবেসে ফেলেছি। আদব-আখলাক, চাল-চলন সবই ভাল লাগে। তাদের দেখাদেখি আমারও এখন মুখ খুলে বের হতে লজ্জা লাগে। সংকোচ বোধ হয়। আলির আম্মু একটা অদ্ভুত কথা বলেছেন:
-তুমি আখতালের কবিতা পছন্দ কর! ইমরাউল কায়সকে খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়, খলীল জিবরান ও তার বান্ধবী মী যিয়াদার কবিতাও পড়! তুমি কি জানো, এর চেয়েও সুন্দর কবিতা আরবীতে আছে?
-জ্বি না, তিনি কে?
-আমি যে সাহিত্যের কথা বলছি, সেটা ঠিক কবিতা নয়, তবে পড়লে কবিতার চেয়েও হাজারগুণ বেশি আনন্দ পাবে! তৃপ্তি পাবে! তুমি আগ্রহী থাকলে ‘ইনশাদ’ (আবৃত্তি) করে শোনাতে পারি! ভাল না লাগলে শুনবে না!
-ভাল লাগবে না কেন? আপনার মুখে আমার দুনিয়ার সবচেয়ে অস্ন্দুর কথাটাও সুন্দর লাগবে!
-হুম! আখতালের কবিতা পড়ে পড়ে তোমার দেখি প্রশংসায় ‘ইতরা’(বাড়াবাড়ি) করার অভ্যেস হয়ে গেছে!
-জ্বি না। আপনাকে আমার কেন যে এত ভাল লেগে গেছে, বুঝতে পারছি না। দেখেন না, আমি এখন এ-বাড়িতে এলে কুতুবখানার চেয়ে আপনার কাছেই বেশি সময় কাটাই! মনে হতে থাকে, কী হবে নীরস কাগজের খসখসে পাতা উল্টিয়ে? তার চেয়ে আপনার জীবনঘেঁষা টসটসে কথাগুলোই আমাকে বড্ড বেশি টানে!
.
আলির আাম্মু আমাকে কুরআন কারীম থেকে তিলাওয়াত করে শোনালেন। কী আর বলব! এত সুন্দর! এত সুন্দর! শুধু কথাগুলোই নয়, তার গলাটাও খুউব সুরেলা, কথা বলার সময় টের পাইনি। আমি তার মুখ থেকে কুরআন শুনে বিমোহিত! আমি ছোট বেলা থেকে জেনে এসেছি, কুরআনে শুধু আমাদেরকে ধরে ধরে যবাই করার কথা আছে! আর কিছু নেই! কিন্তু সূরা ত্বহা না কী যেন পড়লেন! এত সুন্দর করে কোনও মানুষ বলতে পারবে না। লিখতে পারবে না। আমি আরবী সাহিত্যের সেই প্রাচীন যুগ থেকে এ পর্যন্ত বহু কবির কবিতা পড়েছি। শুধু কুরআনটাই পড়া বাকি ছিল। ভয়ে ও ঘৃণায় পড়া হয়নি। ভুল হয়েছে! বড় ভুল হয়েছে!
.
১লা মে, ১৯৭৪
অনেকদিন পর লিখতে বসলাম। ভার্সিটিতে পরীক্ষা ছিল। আব্বু অস্স্থু। ভাইয়ার সাময়িক নিরুদ্দেশ অবস্থান। ভাইয়াটা দিনদিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। সব সময় ইহুদিদের সাথে তার ওঠাবসা! আম্মুও ভাইয়াকে সমর্থন করেন। আব্বু অবশ্য ইহুদিদেরকে দু’চোখে দেখতে পারে না। কিন্তু আম্মু মনে ব্যথা পাবেন বলে কিছু বলেন না। আম্মু কেন যে ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতিশীল,বুঝতে পারি না। তার পরদাদু ইহুদি ছিলেন বলে? কী জানি! যাক, সবমিলিয়ে সময়গুলো খুবই ব্যস্ততায় কেটেছে! অন্য কিছু ভাবার ফুরসত ছিল না। সামনে লম্বা ছুটি। মনের সুখ মিটিয়ে পড়াশোনা করা যাবে। আম্মু আমাকে আলিদের বাড়িতে যেতে দিতে চান না। আমি নাকি কেমন হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। আব্বু কৌতুক ভরে জানতে চাইলেন:
-কেমন হয়ে যাচ্ছে মানে?
-আমিও সেটা বুঝতে পারছি না। আগের মতো হৈ হুল্লোড় করে না। প্রতিবেশি খালাত ভাইদের সাথে মেশে না। ঘরের বাইরে যায় না। অগের তুলনায় কেমন যেন ভারিক্কি চালচলন!
-এতে তুমি খারাপের কী দেখলে?
-ভারিক্কি ভাব আসা ভাল! কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, তার উপর মুসলমানদের প্রভাব পড়ে গেল কি না? আমার মনে হয় তার ওদিকে না যাওয়াই নিরাপদ!
-সে কি ছোট খুকি? তার একটা বুঝ-সমঝ নেই!
.
আচ্ছা কথা তো! আমি কি আসলেই বদলে গেছি? কই না তো! কিন্তু ভার্সিটির বন্ধু-বান্ধবরাও তাই বলল! থাক এসব অপ্রয়োজনীয় চিন্তা। আমাকে যে করেই হোক সে বাড়িতে যেতেই হবে। উফ! কত দিন যাই না! মনে হচ্ছে যুগ-যুগান্তর পেরিয়ে গেছে! আজ যাবোই! ও বাড়ি আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে!
.
৫-ই এপ্রিল ১৯৭৪
আজকাল লিখতে ভাল লাগে না। ঘরে থাকতে ভাল লাগে না। সারাক্ষণ মনে হতে থাকে, আমার মধ্যে কী যেন নেই! আলিদের বাড়িতে গেলে, সেই নেই নেই ভাবটা উধাও হয়ে যায়! কেন? আলি এসেছিল এরমধ্যে একবার! ভেবেছিলাম কথা হবে! কিন্তু তার ভাব-গম্ভীর অবস্থা দেখে, নিজেরই কথা বলার মতি হল না। আর ও-বাড়িতে নারী-পুরুষ সামনা-সামনি কথা বলে না। আমি কেন নিয়ম ভাঙবো। তবে গীর্জা নিয়ে পড়াশোনা কত কী হয়েছে জানি না, আমি এখন কুরআন পড়ছি! আলির আম্মুর কাছে! ভার্সিটির নাম করে, গীর্জার নাম করে, তার কাছে ছুটে আসি। কুরআন পড়তে, গল্প করতে। কবিতাও পড়া হয়। আলির আম্মুই আমাকে একদিন হুট করে বললেন:
-বৈরুত যাবে?
-বৈরুত! কেন?
-না, এমনিতেই!
-আপনি কারণ ছাড়া কোনও কথা বলার মানুষ নন!
-আসলে, প্রশ্নটা আমার নয়, আলির!
-আলির? তিনি আমাকে নিয়ে ভাবেন? ভাবার সময় পান? আমার কথা তার মনে আছে?
-কেন মনে থাকবে না। অবশ্যই মনে আছে! তোমার ভালমন্দ নিয়ে সে অনেক ভাবে!
-কখনো বলেনি তো!
-প্রয়োজন হয়নি, তাই বলেনি। এখন তার মনে হয়েছে, তোমার এখানে থাকার চেয়ে বাইরে থাকা বেশি ভাল, তাই বলেছে! তোমার আব্বু রাজি হলেও, তোমার আম্মু ও ভাই রাজি হবে না!
-ভাইয়া কেন রাজি হবে না?
-তুমি তোমার ভাইকে কতটুকু চেন?
-ইদানীং তার চলাফেরা কিছুটা সন্দেহজনক হলেও, মানুষ হিশেবে তিনি খুবই ভাল!
-তুমি বোন হিশেবে তাকে ভালো বলবে, এতে দোষের কিছু নেই! কিন্তু তার আসল পরিচয় কি, সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তুমি কি জানো, তোমার ভাই আলিকে হন্যে হয়ে খুঁজছে?
-কই না তো!


৬-ই এপ্রিল ১৯৭৪
গতকাল আলির আম্মুর কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম! ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে গভীর ভাবনায় ডুবে গেলাম! ভাইয়া আলিকে খুঁজছে? কই ভাইয়া কখনোই আমার কাছে আলি সম্পর্কে জানতে চায়নি। সে যে আলিকে চেনে, তার ভাবভঙ্গিতেও আভাস পাইনি। আলির আম্মু বোধ হয়, হঠাৎ মুখ ফস্কে ভাইয়ার প্রসঙ্গ এনে ফেলেছিলেন। আমি পাল্টা প্রশ্ন করতেই তিনি সম্বিত ফিরে পেয়ে মুখ বন্ধ করে ফেলেছেন। শুধু এটুকু বলেছেন, সময় হলে আমাকে সব বলবেন। তাহলে কি ভাইয়ার অন্য কোনও পরিচয় আছে! যা আলিদের জন্যে বপদজনক? খোঁজ নিতে হতে হবে! ভাইয়া টের না পায় মত করে!
.
আলি কেন আমি বৈরুত যাব কি না জানতে চাইল? সে কি চায় আমি বৈরুত যাই! ওখানে উচ্চতর পড়াশোনা করি! ওখানে আমার এমনিতেই যাওয়া হবে! বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে আব্বু পড়েছেন, দাদু পড়েছেন! ভার্সিটিতে দাদুর বন্ধু ছিলেন বিখ্যাত ইতিহাস ও প্রাচ্যবিদ ফিলিপ খুরি হিট্টি (১৮৮৬-১৯৭৮)। হিস্ট্রি অব আরব-এর লেখক! দাদু বন্ধুর বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করেছেন। আব্বুও হলে সিট পাওয়ার আগে হিট্টি দাদুর বাড়িতে ছিলেন। তার বাড়ি ছিল বৈরুত থেকে পঁচিশ কিমি দূরে। শেমলানে। আব্বু যখন বৈরুতে পড়াশোনা করতে দিয়েছিলেন, তখন হিট্টি দাদু আমেরিকায়! প্রিন্সটন আর হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। তিনি না থাকলে কী হবে, দুই পরিবারের সম্পর্কটা দৃঢ় একটা ভিতের প্রতিষ্ঠিত ছিল। আমি বৈরুতে গেলে, ওখানেই উঠব! দেখা যাক কী হয়!
একটা বিষয় আমার কাছে বেশ অবাক লাগে, আমরা হলাম আর্মেনিয়ান চার্চের অনুসারী। অর্থোডক্স খ্রিস্টান। আর ফিলিপ দাদুরা হলেন ম্যারোনাইট। তার মানে ক্যাথলিক খ্রিস্টান! দাদুদের সেই আমলে দুই দলের মধ্যে চরম রেষারেষি বিদ্যমান ছিল! তবুও তাদের বন্ধু হতে সমস্যা হয় নি।
.
৭-ই এপ্রিল ১৯৭৪
গতকাল আলিদের বাড়ি যেতে পারিনি। আব্বু আমাদের সবাইকে এক আন্টির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। নাসিরায় (الناصرة) ইংরেজিতে নাজারেথ!। পাশাপাশি মা মেরি ও যেসাস ক্রাইস্টের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো আবার ঘুরে ফিরে দেখাও উদ্দেশ্য ছিল। নাজারেথে আন্টির নানাবাড়ি! শহরটা আগের মত নিরিবিলি নেই। সারা বিশ^ থেকে সব মতবাদের খ্রিস্টানরা দলে দলে শহরটা দেখতে আসে। মুসলিমরাও শহরটাকে পছন্দ করে। তাদের কোরানেও এ-শহরের ঘটনা আছে। এঞ্জেল গ্যাব্রিয়েল মা মেরিকে এখানেই পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিয়েছিলেন! আরও নানা ঘটনা!
.
আন্টি অনেক বড় মানুষ! রোজমেরি সাঈদ। তিনি থাকেন আমেরিকায়। বড় ভাই এডওয়ার্ড সাঈদের মতোই গুণী। ইংরেজি ও আরবী উভয় ভাষাতেই তাদের লেখা বুদ্ধিজীবীমহলে সমাদৃত। তাদের মূল বাড়ি ফিলাস্তীনে হলেও, পিতার সূত্রে মার্কিন নাগরিক। তাদের বাবা সাঈদ ওয়াদী‘ অনেক আগে থেকেই আমেরিকায় বাস করে আসছেন। রোজমেরি আংটি মাঝেমধ্যে দাদার বাড়ি ও নানার বাড়িতে বেড়াতে আসেন।
আব্বু মূলত সাঈদ আঙ্কলের ক্লাশফ্রেন্ড। কুদসের বিখ্যাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ‘আলমুতরানে’ দু’জনে একসাথে পড়াশোনা করেছেন। সে সূত্রেই আন্টির সাথে পরিচয়। আন্টিও ‘মুতরানে’ ভর্তি হয়েছিলেন।
দাদুর সূত্র ধরে আমাদের সাথে লুবনানের একটা ভাল সম্পর্ক ছিল। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। রোজমেরি আন্টির আম্মুর জন্মে নাজারেথে হলেও, তার পূর্ব পুরুষ এসেছিলেন লুবনান থেকে। এজন্য আন্টির আম্মু আমার আব্বুকে খুবই স্নেহ করতেন। তিনি বলতেন:
-ওর শরীরে আমার বাবার বাড়ির গন্ধ লেগে আছে! তাকে দেখলে পূর্বপুরুষদের কথা মনে পড়ে!
আব্বু আর আন্টির মধ্যে চমৎকার একটা সম্পর্ক আছে! আম্মুর মধ্যে এ-নিয়ে চাপা ‘কুনকুনি’ আছে বোধ হয়! আন্টি যদি আমেরিকা চলে না যেতেন, তাহলে আন্টি হয়তো আমার মা হতেন। এখনো তিনি আমাকে কাছে পেলে যেভাবে গভীর আবেশে আদর করেন, তাতে মনে হয়, আমি তার গর্ভের সন্তানের চেয়ে কোনও অংশে কম নই! রোজমেরি আন্টি আমেরিকা চলে গেলেও, বিয়ে করেছেন একজন ফিলাস্তীনিকে। টনি যাহলান। তার বাড়ি এখানেই। হাইফায়।
.
এডওয়ার্ড সাঈদ আঙ্কেলের সাথে আব্বুর নিয়মিত যোগাযোগ হয়। চিঠিতে। ফোনে। আব্বুর মধ্যে চাপা গর্বও কাজ করে, তার ছোটবেলার বন্ধু আর বান্ধবীকে আজ বিশ্বজোড়া মানুষ এক নামে চেনে। আমাদের কাছে তাদের কত গল্প শোনান। আঙ্কেলের ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বইটা বলতে গেলে আব্বুর একপ্রকার মুখস্থ! বন্ধুর প্রতি এমন ঈর্ষাহীন শ্রদ্ধা সচরাচর দেখা যায় না! আব্বু আমাকে ছোটবেলায় বলতেন, তোকে আন্টির মত হতে হবে! আম্মু ঝামটা দিয়ে বলে উঠতেন, দরকার নেই আন্টির মত হওয়ার। আমার মেয়ে হবে আমার মেয়ের মতোই! আন্টি কিছুদিন বৈরুতের আমেরিকা ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেছেন। আব্বুও চাইতেন আমি ভালভাবে পড়াশোনা করে ওখানে লেকচারার পদে সুযোগ লাভ করি! বারবার শুনতে শুনতে আমার মধ্যেও এ-ধরনের একটা স্বপ্ন চারিয়ে গিয়েছিল! আমাদের পরিবারের একান্ত চাওয়ার বিষয়টাই যখন আলির চাওয়ার সাথে মিলে গেল, সেজন্য চমকে গিয়েছিলাম। অবশ্য আলির চাওয়া আর আমাদের পরিবারের চাওয়া বোধ হয় এক নয়! সে কেন আমার বৈরুত যাওয়ার কথা জানতে চাইল? ওর সাথে একবার সরাসরি কথা বলতে পারলে ভাল হত! কিন্তু তার টিকিটির নাগাল পাওয়াই তো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে!
.
আজ আলিদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ ছিলাম। আলি আমার জন্যে খলীল জিবরানের অনেকগুলো বই এনেছে। তার প্রিয় কবি আহমাদ শাওকীর ‘দীওয়ান’ এনেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে আম্মুর প্রিয় কবি ‘মী যিয়াদা’ (مي زيادة)-র কবিতার বই এনেছে! কী মনে করে খলীল জিবরানকে লেখা মী যিয়াদার চিঠির একটা সংকলনও এনেছে! উপহারের স্থানে আম্মুকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে:
‘‘একজন গুণী মানুষের বই, আরেকজন গুণী পাঠকের জন্যে’’!
আম্মু মন্তব্যটা পছন্দ করেছেন। আলাদা করে জানতে চেয়েছেন আলি সম্পর্কে। আমার জন্যে নিয়ে আসা ‘শাওকিয়্যাতে’ আলি লিখেছে:
যিয়াদাহ!
“তোমার অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতটা বেশি আলোকিত হোক, দিনদিন তোমার আলো ‘যিয়াদাহ’ হোক’’!
মন্তব্যটা আম্মুর চোখে পড়েছে! তিনি পড়ার পর ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ কী যেন ভেবেছেন! আমার দিকেও আড়চোখে তাকিয়েছেন! তিনি কি কিছু একটা সন্দেহ করছেন? আমার মনেও একটা প্রশ্ন কুনকুন করছে, আলি কি কিছুর দিকে ইঙ্গিত করে কথাটা লিখেছে? তার সবকিছুই কেমন যেন হেঁয়ালী ভরা! আমার সাথে কথা বলে না, দেখা করে না, অথচ আমার সব খবর তার নখদর্পনে! তার সাথে পরিচয়টা এত সুন্দরভাবে হল! সেটা আরো কত সুন্দরভাবে এগিয়ে যেতে পারত! অথচ তার কোনও হেলদোলই নেই! কেমন গা ছাড়া ভাব।
.
কবিতার বই আর চিঠির সংকলনটা পেয়ে আম্মুর আনন্দ আর ধরে না। চিঠিগুলো বারবার পড়ছেন। আব্বু চান আমি ভার্সিটির অধ্যাপক হই! আম্মু চান, আমি যেন তার প্রিয় কবির মত এক পরিপূর্ণ কবি হই! আমার নাম রাখা নিয়েও আব্বু-আম্মুর সে কি মন কষাকষি! আব্বু চেয়েছিলেন, আমার নাম হবে ‘রোজমেরি’! সঙ্গত কারণেই আাম্মু রেগে কাঁই! আব্বু বুদ্ধিমান মানুষ! আপোষের পথে হাঁটলেন! আম্মু তার প্রিয় কবির নামেই আমার নাম রেখেছেন। নামটা আমারও বেশ পছন্দের! আব্বু যখন আমাদেরকে নিয়ে নাজারেথে গেলেন, রোজমেরি আন্টির বাসায়, আম্মু সেখানে যেতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। শুধু ভদ্রতা রক্ষার্থে গেলেন। আম্মুর আগ্রহ অন্যখানে! মী যিয়াদার বাড়ির দিকেই আম্মুর আগ্রহ! কবির বাড়িও এ পবিত্র শহর নাজারেথেই! আম্মুর মধ্যে বোধ হয় এক ধরনের হতাশা কাজ করে, তার মধ্যেও কবি হওয়ার প্রবণতা ছিল। সেটা চরিতার্থ করতে না পেরে, অন্যের মাঝে ও মেয়ের মাঝে সে প্রতিচ্ছবি খুঁজে বেড়ান!
.
১০-ই এপ্রিল ১৯৭৪
প্রতিজ্ঞা করি প্রতিদিনই দিনলিপিতে কিছু না কিছু লিখব! সেটা আর হয়ে ওঠে না। লিখতে বসলেই রাজ্যের ঘুম এসে দু’চোখে ভর করে। নানা কাজের কথা মনে পড়ে যায়! লেখার চেয়ে লেখার বিষয় নিয়ে ভাবতেই ভাল লাগে! নেশা নেশা লাগে! এই যে গতকাল আলিদের ওখানে গিয়েছিলাম। অপ্রত্যাশিত অনেক কিছুই ঘটেছে। কত্তদিন পর দেখলাম আলিকে! আলির আম্মু বলেছেন:
-আলি আর এখানে আসতে পারবে না। তুমি লুবনানে যাবে বলেছিলে না! তুমি গেলে তার ভাল লাগবে! তোমার কোনও সহযোগিতা লাগলেও সে করতে পারবে! ভার্সিটিতে ভর্তি ও থাকা-খাওয়ার সুন্দর বন্দোবস্ত করে দিতে পারবে! তুমি চাইলে মুসলিম বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিবে, খ্রিস্টান বাড়িতেও করে দিতে পারবে!
-আমার থাকার ব্যবস্থা আছে!
-সেই ফিলিপ খুরীদের বাড়িতে? আলি বলেছে, তাদের বাড়ি শেমলানে। বৈরুত থেকে ২৫ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে! এতদূর আসা-যাওয়া করতে পারবে নিয়মিত? তোমার কষ্ট হয়ে যাবে না? এজন্যই আলি ভিন্ন ব্যবস্থার কথা ভেবেছে!
-আচ্ছা, আমি এ-বিষয়ে পরে জানাব! আলি এখানে আসতে পারবে না কেন?
-নিরাপত্তাজনিত কারণে। তাকে ইহুদি গোয়েন্দারা খুঁজছে! বৈরুতেও তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়!
-আলি কি গোপন কিছুর সাথে জড়িত?
-যাদের পিতা বা কোনও আত্মীয় ইসরায়েল বিরোধী যুদ্ধে শহীদ হয়েছে, তাদের একটা তালিকা আছে। এদেরকে সব সময় দেখে দেখে রাখা হয়। তারা প্রতিশোধমূলক কিছু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে কি না, যাচাই করে দেখা হয়। তা ছাড়াও আলির স্বাধীনচেতা যুবক! তার চিন্তা আমাদের পরিবারের বাকি দশজনের চেয়ে আলাদা! সবাই যেখানে ইহুদিদের সাথে আপোষ করে থাকতে আগ্রহী, আলি সেখানে ইহুদিদেরকে একচুল ছাড় দিতে নারাজ! এজন্যই তার দাদা তাকে বৈরুত পাঠিয়ে দিয়েছে! এখানে থাকলে বেঘোরে বুলেটের আঘাতে মারা পড়ে! কিন্তু ওখানে পাঠিয়ে হিতে বিপরীত হয়েছে! যে ভয় থেকে বাঁচার জন্যে তাকে বৈরুত পাঠানো হয়েছে, সেখানে ভয়টা আরো বেশি করে দেখা দিয়েছে! সে এখন আত্মগোপন করে থাকে! লুকিয়ে থেকেই সে অনেক কাজ করে! এখনো পর্যন্ত গোয়েন্দারা তার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য পায়নি! শুধু সন্দেহ করে! নইলে আরো আগেই ধরে ফেলতো! এসব কথা এখন থাক। আলি তার দু’টো ইচ্ছার কথা আমাকে বলেছে। তোমাকে বলতে বলেছে!
-কী ইচ্ছা?
-একটা ইচ্ছা হল, তুমি এখনই বৈরুত না গিয়ে আরো কিছুদিন পরে যাবে! ততদিন নিয়মিত আমাদের বাড়িতে আসার চেষ্টা করবে! আমাদের সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে যাবে! পাশাপাশি পড়াশোনাও করবে!
-এটা তো এখনো করছি! আলাদা করে ইচ্ছাটা কেন প্রকাশ করল?
-তোমার প্রশ্নের উত্তরটা আলির দ্বিতীয় ইচ্ছের মধ্যে আছে!
-দ্বিতীয় ইচ্ছেটা কী?
-সেটা এখন বলা যাবে না! সময় সুযোগমত পরে বলব! অথবা বলার প্রয়োজন হবে না! তুমিই বুঝে নেবে!
-ঠিক আছে!
.
০৯ জুন ১৯৭৪
আমি এখন বৈরুতে। গতকাল এসে পৌঁছেছি। পরিবারের সবাই এসেছে। ভেবেছিলাম ভাইয়া আসবে না। ধারনা ভুল প্রমাণ করে তিনিও এসেছেন। বৈরুতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছি। গত দু‘মাস তুমুল যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গেছে। ঘরে বাহিরে উভয় স্থানে। মুসলমানদের সাথে ইসরায়েলি সেনাদের সংঘর্ষে পরিস্থিতি আগুনের মতো হয়ে গিয়েছিল। নিয়মিত আলির আম্মুর কাছে যেতে পারি নি। গত একমাস ঘর থেকেই বের হতে দেননি আব্বু-আম্মু। ভাইয়া তাদেরকে কী বুঝিয়েছেন কে জানে! তারা আমাকে ও বাড়িতে যেতে দেন নি। দ্রুত বৈরুত আসার তোড়জোড় করেছেন । মনটা বড় বেশি জ¦লছে, আলির মায়ের সাথে দেখা করে আসতে পারলাম না। বিদায় নিয়ে আসতে পারলাম। অনেক অসম্পূর্ণ কথার পূর্ণতা দিতে পারলাম না। আলি প্রথম ইচ্ছানুযায়ী আমি তার মায়ের সাথে থেকেছি! কখনো কখনো রাতেও থেকেছি। বাড়িতে মিথ্যা বলতে হয়েছে মাঝেমধ্যে। কিন্তু এছাড়া উপায় ছিল না। মহিলার মধ্যে মা মা ভাব ছাড়াও এমন একটা কিছু ছিল, চুম্বকের মতো টানতো! যে কয়দিন যেতে পেরেছি, তিনি আমাকে গল্পচ্ছলে অনেক কথা বলেছেন। কুরআন পড়ে শুনিয়েছেন। মুখস্থ! অবাক কা-! তার পুরো কুরআনই কণ্ঠস্থ! আমি বাইবেলের দুয়েকটা লাইন ছাড়া বেশি কিছু পারি না! অল্প ক’দিনের মধ্যে তিনি আমার কাছে পুরো ইসলাম তুলে ধরেছেন। খ্রিস্টবাদ ও ইসলামের তুলনামূলক পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন। আশ্চর্য, একটা মানুষ সারাজীবনে পর্দার আড়ালে থেকে, এত কিছু কিভাবে জানলেন! কিভাবে শিখলেন? প্রশ্নটা করেছিলাম তাকে! তিনি মিষ্টি হেসেছেন! কিছু বলেননি। পরে একদিন বলেছিলেন, স্বামী শহীদ হওয়ার পর অনেক প্রস্তাব এসেছিল, তিনি গ্রহণ করেননি। সন্তানের পেছনেই বাকি জীবন ব্যয় করবেন বলে ঠিক করেছেন। পড়াশোনা করবেন, এতীম শিশুদের শিক্ষার জন্যে কাজ করবেন। মসজিদুল আকসায় মেয়েদের কুরআন বিষয়ক হালকা হয়, সেগুলোতে সময় দেবেন। এর সবগুলোই তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। আমার কাছে অবাক লেগেছে, মেয়েদেরও কুরআনী হালকা হয়?
-কেন হবে না! কুরআন শিক্ষা করা, ইসলামে নারী ও পুরুষ উভয়ের উপর সমানভাবে ফরয!
-আমি দেখতে যেতে পারব?
-নিয়ে যাব একদিন তোমাকে!
-আপনাদেরকে কে পড়ান?
-কেউ পড়ায় না! আমরাই পড়ি! ওখানে যারা আসেন, সবাই শিক্ষিত! পুরুষদেরকে অনেক সময় ইহুদি সেনারা প্রবেশ করতে দেয় না, তাই নারীরাই মসজিদে আকসায় কুরআন শিক্ষার ধারা অব্যাহত রেখেছে! তাদের কারো কারো কুরআনি জ্ঞান দেখলে হয়রান হয়ে যাবে! আমাদের প্রামান্য যুগের বড় বড় তাফসীরের কিতাব তাদের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মুখস্থ! একটা আয়াত বললে, সেটার তাফসীর, কয়েকটা কিতাব থেকে মুখস্থ বলে দেয়।
-আমাদের বাইবেল নিয়ে এমন কিছু কল্পনাও করা যায় না।
.
তিনদিন পর মসজিদে আকসায় গেলাম। ভেবেছিলাম এত বাধা ডিঙিয়ে ক’জনই-বা আসবে! ওখানে গিয়ে দেখি মহিলা গিজগিজ করছে। সবার হাতে কুরআন শরীফ আর খাতা। একটা আয়াত পড়া হচ্ছে, বিভিন্ন তাফসীরের কিতাবে আয়াতটা সম্পর্কে যা লেখা আছে, যার যার সাধ্য অনুযায়ী বলে দিচ্ছে। মুখস্থ। আলি আম্মুকে দেখলাম অনেকগুলো তাফসীর থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন। কেউ মুখস্থ বলার সময় ভুল করলে, সংশোধন করে দিচ্ছেন! তাদের মুখ থেকে শুনতে শুনতে অনেক কিতাবের নাম মুখস্থ হয়ে গেছে! পুরো সময় জুড়ে শুনছিলাম আর ভাবনার অতলে ডুবে যাচ্ছিলাম, এদের মধ্যে এত জ্ঞানচর্চা, তবুও পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে কেন? ঘোরের মধ্যে সেদিনের কুরআনি হালকা শেষ হলো। ভীষণ অতৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফিরলাম। ভেতরের ফটফটানি দেখে বুঝতে পারলাম, আমাকে আবার যেতে হবে ওই অপার্থিব জ্ঞানচর্চার হালকায়! মহিলারাও নিজ ধর্ম সম্পর্কে এত এত জানে? এতকিছু মুখস্থ রাখা সম্ভব? এত সুন্দর করে বিতর্ক করা যায়? রাগারাগি না করে? গলার স্বর উঁচু না করে? কেউ নিজের জ্ঞান জাহির করতে চায় না। পারলে বিনয়ের সাথে বলে দেয়, না পারলে অন্যের কাছ থেকে শুনে নোটবইতে টুকে নেয়। এরা কেন এত গুরুত্ব দিয়ে পড়ছে? পরীক্ষা দিবে? নাহ! এটা নিখাদ জ্ঞানচর্চা! অহেতুক গল্পগুজব আড্ডা নয়। অবশ্য ফাঁকে ফাঁকে চা-পানের বিরতি হয়! তখন গল্প-গুজব হয়। অকাজের নয় কথা নয়, সবই কাজের! এতদিন আলির আম্মুর কাছে গল্প শুনে ইসলামের প্রতি আমার যতটা দুর্বলতা তৈরী হয়েছিল, এখানে কুরআনি হালকায় একদিন এসেই তার চেয়ে বহুগুণ বেশি দুর্বলতা তৈরী হয়েছে। নিজের চিন্তা-বিশ্বাসকে অসার ঠুনকো আর খেলো মনে হতে লাগল!
.
বিপদ দেখা দিল দ্বিতীয় দিন। হালকা থেকে ফেরার সময় ভাইয়া আমাকে দেখে ফেলেছে। তারপর থেকেই আমি একপ্রকার ঘরবন্দী! তার রেশ ধরেই এখন বৈরুতে! কুরআনি হালকার মিষ্টি আমেজে আমি আলির কথাও ভুলতে বসেছিলাম। দু’দিন হালকায় বসে, যা যা শুনেছিলাম, বেশিরভাগ মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কী সুন্দর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ! খটমটে রসকষহীন কোনও জোর-যবরদস্তিমূলক চাপিয়ে দেয়া মতামত নয়! ভদ্রমহিলাদের প্রতিটি কথাই যুক্তিসঙ্গত আর গ্রহনযোগ্য লেগেছে! ত্রিত্ববাদের ধাঁধাঁলো কুহেলিকার লেশমাত্র নেই!
.
১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪
ভার্সিটিতে ভর্তির কাজ শেষ হয়েছে সেই কবে! যখনই বাইরে বের হয়েছি, দু’চোখ শুধু একজনকে খুঁজে বেরিয়েছে! এত লোকের ভীড়ে কাউকে পাওয়া কি সম্ভব? ভার্সিটিতেও কতজনকে জিজ্ঞেস করেছি। আমাদের ফিলিস্তীনের অনেক ছেলে মেয়ে পড়ে। তাদের কাছে আলির কথা জানতে চেয়েছি, কেউ চেনে না। দিনগুলো পানসে হয়ে কাটছে। প্রতিদিনই আশায় বুক বাঁধি, আজ বোধ হয় দেখা হবে! দিন শেষ হয়ে যায়! আবার নতুন আশা নিয়ে ভোর আসে। এখন দিন তারিখের হিশেব থাকে না। আজ ঘরে ফিরছিলাম! বাসে নিজে আসনে বসে আছি! জানলা দিয়ে একটা কাগজ এসে কোলের উপর পড়ল। চমকে উঠলাম! খুলে দেখি, আলি হাতের লেখা! বুকের রক্ত ছলকে উঠল! মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল! দ্রুত মাথা বের করে দেখলাম! তেমন কাউকে চোখে পড়ল না! কাগজটাতে পরিচিত হস্তাক্ষর জ¦লজ¦ল করছে:
‘‘দ্বিতীয় ইচ্ছেটা কি আপনি বুঝতে পেরেছেন? পারলে আগামি আঠাশ তারিখে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে আসবেন! শেষ গন্তব্য পর্যন্ত বাসে বসে থাকবেন’’
পুরো রাস্তা জুড়ে উথাল-পাতাল চিন্তা! দ্বিতীয় চিন্তা কি বিয়ে নাকি মুসলমান হওয়া? অথবা উভয়টা? যেটাই হোক, আমি সবটাতে রাজি! সেই কবে থেকে! আলির আম্মুকে সবকিছু খুলে বলার সুযোগ না পেলেও, তিনি আভাসে-ইঙ্গিতে অনেক কিছুই ধরতে পেরেছেন। কিছু বিষয় জিজ্ঞেস করেও জেনেছেন। আমার মধ্যে দ্বিধার কিছু ছিল না। আরেকবার কুরআনি হালকায় যেতে পারলে, এতদিন অপেক্ষা করতে হত না। আরো কয়েকমাস আগেই অনেক কিছুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে যেতাম! এখন শুধু প্রতীক্ষা!
.
৪-ই নভেম্বর ১৯৭৪
দীর্ঘদিন পর কলম নিয়ে বসলাম! স্মৃতিগুলো ধরে রাখা যাক! চিরকুট পাওয়ার রাতে শুয়ে ঘুম আসছিল না! এমন প্রতীক্ষার রাতে কারো ঘুম আসে! এপাশ ওপাশ করে রজনি কেটে গেল। ভোরে উঠেই মনে হল, এখুনি বেরিয়ে পড়ি! আবেগ দমন করতে হল! এত আগে বের হয়ে কী লাভ! যেতে হবে তো ভার্সিটির পর! একেকটা সেকেন্ড যেন একেক ঘণ্টা! ফুরোতেই চায় না! সময়মত বাসে উঠে বসলাম! চোরা চোখে আশেপাশে দেখছি! না, তেমন কেউ নেই! সবাই ভার্সিটির প্রতিদিনের যাত্রী! মনে হয়, শেষ স্টপেজেই আমার অপেক্ষা করবে! বাস চলছে! থামছে! আমাদের বাসে যাত্রী ওঠে না, শুধু নামে! শেষের দিকে বাস প্রায় খালি হয়ে গেল! পুরো বাসে গুটিকয়েক ছাত্র-ছাত্রী। বাস থামল! একজন ছাত্র নামবে! কোত্থেকে যেন কাগজের একটা দলা এসে পড়ল! দ্রুত খুলে ফেললাম:
‘‘ মেয়েটির সাথে চলে আসুন’’
কোন মেয়ে? বাসে সবমিলিয়ে আছে তিনটি মেয়ে! এদের কারো সাথে? বাস আবার ছেড়ে দিয়েছে! হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছি! যা হওয়ার হবে! আরো তিনটা স্টপেজ বাকি আছে! অন্যমনস্ক হয়ে বসে বসে ভাবছি! বৈরুত এখনো আমার কাছে নতুন! জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছি! বাস আবার থামল! কে একজন বলল:
-যিয়াদাহ, নেমে পড়!
কথাটা কে বলল সেটা দেখার অপেক্ষা করলাম না! নেমে গেলাম! উত্তেজনার পাশাপাশি অন্য রকম এক আনন্দ হচ্ছিল! এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে! কত কতদিন পর তাকে দেখব! তার সাথে কথা বলব! মুখোমুখি হব অদ্ভুত মানুষটার! অপরিচিত থেকে অতি আপনজনে পরিণত হবে! বাস থেকে নামতে নামতেই মাথায় এসব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল! বাস চলে গেছে! বোরকা পরা এক মহিলা এসে, মৃদুস্বরে প্রশ্নের ভঙ্গিতে উচ্চারণ করল:
-যিয়াদাহ?
-জি¦!
আমি উত্তর দেয়ার আগেই, আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল! একটু পর হাত ছেড়ে দিয়ে আপন গতিতে হাঁটতে লাগল! যেন আমাকে চেনেই না। আমার ভারি আমোদ হচ্ছিল! কেমন গোয়েন্দা গোয়েন্দা ভাব! নানা পথ পাড়ি দিয়ে একটা ঘরে প্রবেশ করলাম! বোরকা পরা মেয়েটা আমাকে দ্রুত পোষাক বদলে নিতে বলল! একটা বোরকা দিল! পরে নিলাম! সবকিছু একদম মাপমত হয়েছে! মনে পড়ল, আলি মা আমার জামা-কাপড়ের মাপ নিয়েছিলেন একবার! সেটা তাহলে এজন্য! ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলাম:
-আলি কোথায়?
-আছে! একটু পরেই দেখা হবে!
বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে আবার বের হয়ে এলাম। আবার দীর্ঘক্ষণ হাঁটার পর, একটা ঘরে এসে হাজির হলাম। গাঢ় অন্ধকার! হাতড়ে হাতড়ে হাঁটলাম। কেউ একজন এসে আমার হাতটা কোমলভাবে ধরল! সুন্দর করে সাজানো-গোছানো একটা কামরায় প্রবেশ করলাম! উজ্জ্বল আলোতে দেখলাম, অত্যন্ত মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ে আমার হাত ধরে রেখেছে! সোপায় বসলাম। একে একে অনেক মহিলা এলেন। আমাকে এত আদর করে আপ্যায়ন করলেন, মনে হল আমি একজন রানী। আমার চেয়ে বয়েসে একটু বড় একজন আমাকে কালিমা পড়ালেন। সবাই মিলে দু‘আ করলেন। আলির সাথে বিয়েতে আমার সম্মতি আছে কি না, জানতে চাইল! মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম! আলির সাথে বিয়ে হলে, কী কী সমস্যা হতে পারে, তার একটা ফিরিস্তি তুলে ধরল!
-বাবা-মায়ের সাথে বাকী জীবন দেখা হওয়া অনিশ্চিত!
-ইসলাম গ্রহণ করার পর, এমনিতেই সেটা অনিশ্চিত হয়ে গেছে!
-সব সময় গোপন জীবন যাপন করতে হবে!
-সেটা বিয়ে না করলেও হবে!
এমনি আরও কিছু আশংকা তুলে ধরল। আমি জানালাম এসব আমাকে আগেই আলির আম্মু বলেছেন। আমার দিক থেকে কোনও দ্বিধা নেই। এমনকি আমি যে কোনও সময় বিধবা হতে পারি, সেটাও আলির আম্মু বলেছেন!
.
আমি অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলাম আসল মানুষটার জন্যে। তারই যে দেখা নেই! অবশেষে অবসান ঘটল। তিনি এলেন। তাকে দেখে কানায় কানায় ভরে উঠল। যেন অনেক দিন পিপাসার্ত থাকার পর, পানি পান করলাম! প্রচণ্ড গরম থেকে আরামদায়ক শীতল কক্ষে প্রবেশ করলাম! সালাম দিলেন। উত্তর দিলেন। সবার কথা জানতে চাইলেন। এতদূর হেঁটে আসতে কোনও হয়েছে কি না, বারবার জানতে চাইলেন। জানালেন, তাকে ইহুদিরা হন্যে হয়ে খুঁজছে! আমার ভাইয়ের কীর্তি শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম! সে নাকি রীতিমতো হোমরাচোমড়া গোছের সিক্রেট এজেন্ট। খ্রিস্টান হয়েও ইহুদিদের হয়ে কাজ করে। মোটা বেতনে।
.
আলি এরপর মূল প্রসঙ্গে চলে এল। তার কিছু সমস্যা তুলে ধরল। বললাম এসব আমি আগে থেকে জানি। নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। বিয়ে হয়ে গেলে, আমরা একে অপরের সমব্যথী হয়ে যাব! জীবনসাথী হয়ে যাব! একে অপরের দুঃখ-কষ্ট ভাগাভাগি করে নেব! প্রয়োজনে জীবনেরও পরোয়া করব না!
.
বিকেলে বিয়ে হল আমাদের। রাতেই আমরা আরেকটা বাড়িতে চলে গেলাম। ঠিক হল আমরা কিছুদিনের জন্যে সিরিয়া চলে যাব! এদিকের পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরে আসব। আলিদের গোয়েন্দারা খবর দিল, আমি যে বাড়িতে বোরকা পরার জন্যে থেমেছিলাম, সেখানে কারা যেন দরজা ভেঙে ঢুকেছে! শুরু হল আমাদের লূকোচুরির জীবন। খারাপ লাগছিল না। আলি পাশে আছে! এত ঝুঁকির মধ্যেও আলিরা তাদের ইসরাঈল বিরোধী কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সীমান্ত চৌকিতে অতর্কিতে হামলা অব্যাহত রেখেছে। আমাকে সে সব কিছু খুলে বলত না। আমি আগে বেড়ে জানতে চাইতাম না। আমি শুধু চাইতাম, আলি যেন আমার কাছে যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ সুখে থাক। নিশ্চিন্তে থাক! আরামে থাক!
.
১৭ নভেম্বর ১৯৭৪
আগে ছিলাম একজন। নিজের মত থাকতাম। এখন দু’জন। দু’জনের মতো থাকতে হয়। আলি এমন মানুষ, তার সাথে থাকতে কারোরই বিশেষ বেগ পেতে হবে না। অন্যের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি তার খুব মনোযোগ! আমি বাবা-মা ছেড়ে এসেছি, তার অভাব বোধ করার সুযোগ পাইনি। আলিদের একটা দল আছে। এদের বেশিরভাগই ফিলাস্তীনি। তাদের নিজস্ব একটা জগত আছে। সমাজ আছে। গোপনে এরা অনেক কাজ করে। লেবানন সরকারকে লুকিয়ে। সামরিক প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে, গৃহস্থালি কাজ পর্যন্ত এখানে সেখানো হয়। ছেলেমেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকেই যোগ্য করে গড়ে তোলা হয়। যাতে তারা মসজিদুল আকসার জন্যে লড়তে পারে। ইহুদিদের হাত থেকে কুদসকে মুক্ত করতে পারে। ইহুদি গোয়েন্দারা আলিদের গোপন দল সম্পর্কে আবছা আবছা জানত। তাই তারা হন্যে হয়ে খুঁজত! কিন্তু আলিদের অতি গোপনীয়তার কারণে ইহুদিরা তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারত না। এদিকে বৈরুতের অবস্থা দিনদিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। বিভিন্ন দলের মধ্যে যুদ্ধ লাগে লাগে অবস্থা। এই ঘোলাটে পরিস্থিতিতে আমাদের একটা লাভ হয়েছে, নিরাপত্তা সংকট কিছুটা হলেও কমেছে। কিন্তু দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা, বৈরুতের খ্রিস্টান ও শী‘আরা ফিলীস্তিনীদের সহ্য করতে পারছে না। বিশেষ করে খ্রিস্টান মিলিশিয়ারা নানাভাবে মুহাজিরদেরকে উত্যক্ত করছে! আলি মনে করছে আপাতত কিছুদিনের জন্যে বৈরুত ছেড়ে বাইরে থাকা নিরাপদ হবে!

১১ মার্চ ১৯৭৫
অনবরত ছোটাছুটি মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। বৈরুতে আর থাকা যাবে না। আপাতত সিরিয়াতে যাওয়া হবে। গৃহযুদ্ধ প্রায় লেগে যাচ্ছে! সীমান্ত পার হওয়া কঠিন কিছু নয়। আলি যেতে চাচ্ছে না। কিন্তু তার উর্ধতন মহল বলছে, সিরিয়াতে গেলে কিছু কাজ হবে। অবস্থার প্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, বৈরুতে ফিলাস্তীনিদের উপর ভয়াবহ হামলা হবে। চুতুর্দিক থেকে। তার জন্যে সিরিয়া থেকেও বাড়তি সাহায্য লাগবে। আলি গেলে, কাজটা সহজ হবে।

৪ মে ১৯৭৫
কোথাও থিতু হওয়া যাচ্ছে না। আজ হামায় তো কাল হালাবে। পরশু দিমাশকে। এভাবে চরকির মত ঘুরপাক খেতে হচ্ছে। আলি আমাকে কোথাও রেখে যেতে চেয়েছিল। আমি রাজি হইনি। আমিও তার সাথে থেকে মেয়েদের মধ্যে কাজ করতে পারব! আর আমাদের নতুন মেহমান আসবে। এ-সময়টা তার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই না। এমন কিছু হবে, সেটা আগে থেকেই জানা ছিল। আমার মনে তো এমন আশংকাও ছিল, হয়তো তার সাথে বাসরও হবে না। আল্লাহ তা‘আলা তার এই অসহায় বান্দীর প্রতি অনেক দয়া করেছেন। আমাদের জীবনধারাই এমন, দু’জনে একটু নিরালায় বসে কথা বলব, সে ফুরসতও মেলে না। শুধু বিয়ের পরে ক’টা দিন নিরালায় ছিলাম। তাও আলি সারাদিন কোথায় কোথায় চলে যেত। সে চেষ্টা করত রাতটুকু পুরোপুরি আমাকে দিতে। সিরিয়াতে আসার পর, দিনরাত কোন ফাঁকে যে চলে যায়, টেরও পাওয়া যায় না। আমার কাজ হল, বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে কথা বলা। বিভিন্ন দেশে অসহায়ভাবে তাঁবুতে বাস করা, ফিলিস্তীনিদের জন্যে অর্থকড়ি সংগ্রহ করা। আলির কাজ হল, যোদ্ধা সংগ্রহ করা। এর মধ্যেই সময় করে দু’জন একান্ত সময় কাটাই।

৮ আগস্ট ১৯৭৫
গত এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে বৈরুতে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। অসহায় ফিলিস্তীনিরা চতুর্মুখি আক্রমণের শিকার! পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে। কষ্টে বুক ফেটে চায়। আলি মাঝে মধ্যে অস্থির হয়ে পড়ে! ছুটে যেতে চায় সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিতে। কিন্তু তাকে বারবার বাইরের দায়িত্ব দেয়া হয়। যুদ্ধ করার লোক তো আছে। আলি যেভাবে নতুন সদস্য সংগ্রহ করতে পারে, অন্যরা সেভাবে পারে না। এবার তাকে জর্ডান যেতে হবে। আমাকে সাথে নেবে না বলছে! দেখা যাক!

২১ অক্টোবর ১৯৭৫
আমি এখন দামেশকে থাকি। মুখাইয়ামে ইয়ারমুকে! বিশাল একটা এলাকা জুড়ে অসহায় ফিলিস্তীনিরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের মধ্যে শিক্ষার অভাব। অর্থের অভাব। অনেক কাজ করতে হয়। আলি আমাকে রেখেই আম্মানে গেছে। সেখানেও শিশুদের স্কুলগুলোর বেহাল অবস্থা। আমি গেলে ভাল হয়। আমারও ইচ্ছা, ওখানে যাই। আমার ছোট খালা থাকেন সেখানে। আমাকে খুবই আদর করতেন। কী জানি এখন কিভাবে গ্রহণ করবেন।

১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭৬
ডায়েরিটা ভুলে রেখে গিয়েছিলাম। আলি বলেছিল ক’দিন পরেই আবার দিমাশকে ফিরে আসব। তাই প্রয়োজনীয় জামা-কাপড় ছাড়া আর কিছু নিইনি। আম্মানের দিনগুলো ছিল বৈচিত্র্যময়। এই প্রথম একজন রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে দেখা হল। ছোটখালা আশাতীত ভালোবাসা দেখিয়েছেন দু’জনের প্রতি। খ্রিস্টান হয়েও নিজের অলংকার খুলে সাহায্য করেছেন অসহায় মুহাজিরদের জন্যে। নিয়মিতই কিছু দান করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। সুন্দর কিছু সময় কেটেছে তার কাছে।
.
৪ অক্টোবর ১৯৮২
এতবড় বিপর্যয়ের পর, দুনিয়াটাকে পানসে মনে হয়! কিন্তু আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া গুনাহ। কী হবে লিখে? কী লাভ! জীবনের মূল্যই যদি না থাকল! তবুও বাচ্চাদের জন্যে হলেও কিছু কথা লিখে রাখতে হবে। তারা ভবিষ্যতে জানবে! তাদের আব্বু-আম্মু কেমন ছিলেন। উম্মাহর জন্যে কতোটা ত্যাগ করেছেন। হাঁ, আমাদের আপাতত দুই সন্তান! আরেক জনের জন্যে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি!
.
মানুষ যেটাকে ভাল মনে করে, সেটা তার জন্যে ভাল নাও হতে পারে। আম্মানে খালার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়াও তেমন একটা ঘটনা। ওটা ছিল মারাত্মক ভুল। খালার কাছ থেকে খবর চলে গিয়েছিল বাড়িতে। দিমাশকের সুনির্দিষ্ট ঠিকানা বলতে না পারলেও, মুখাইয়ামে ইয়ারমুকে থাকি, এটুকু তথ্য বাড়িতে পৌঁছেছিল। খালা হয়তো খারাপ কিছু ভেবে বলেন নি। আম্মুকে সান্ত¡না দেয়ার জন্যেই বলেছিলেন: আমি ভাল আছি। সুখে আছি। ভাইয়ার কাছে আমার অবস্থান ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। এতদিনের গোপনীয়তা উদোম হয়ে গেল। এটা জেনেছি দুর্ঘটনা ঘটার পরে। আগে জানতে সতর্ক হওয়া যেত।
.
আম্মান থেকে ফিরে এসে দিমাশকে আগের ডেরায় উঠেছি। একটা স্কুলে পড়াই। আলি আগের মতো দৌড়াদৌড়ির মধ্যে থাকে। অবাক লাগে একটা মানুষ এতটা আত্মত্যাগ করতে পারে? কোনও লোভ ছাড়া। নিজের জন্যে কোনও উচ্চাশা করা ছাড়া! বুকটা গর্বে ভরে যায়! আল্লাহর কাছে অসংখ্য শুকরিয়া আদায় করি। ভাগ্যিশ সেদিন ভোরে চার্চে গিয়েছিলাম। নইলে কি এমন সোনার হরিণ এসে ধরা দিত! আলি বলে উল্টো কথা! সেই নাকি সৌভাগ্যবান! তার ভাগ্য, সেদিন দাদুর সাথে এসেছিল! নইলে এমন একটা ‘রত্ন’ সে কোথায় পেত! সে এমনভাবে বলে, শুনে মনটা অপার প্রাপ্তিতে ভরে যায়! নাইবা হল স্থায়ী ঠাঁই! নাইবা হল নিরাপদ একটি নীড়! একসাথে স্বামীর ভালোবাসা আর উম্মাহর জন্যে কিছু করতে পারা, এটার কোনও তুলনা হয়!
.
আমাদের বড় ছেলে, ইউসুফ। প্রতিদিন মাদরাসায় যায় সবার সাথে। সেদিন আর ফিরল না। আলি তখন হালাবে গেছে। চারদিক খুঁজেও পাওয়া গেল না। মনটা ভেঙে পড়তে চাইলেও, কষে শক্ত করলাম। এভাবে একটা ছেলে হারিয়ে যাবে! আলি থাকলে সে আরও বেশি করে খোঁজ-খবর করতে পারত! প্রায় দশদিন পর একটা চিঠি এল। ভাইয়া লিখেছে! ইউসুফ তার নানীর কাছে আছে। আমি ফিরে না গেলে, তাকে আর পাব না। শত কষ্টের মাঝেও এটুকু প্রবোধ মিলল, যাক ছেলেটা খারাপ থাকবে না। কিন্তু আমার ফেরা সম্ভব নয়। সবাই হয়রান হয়ে গেল, তাকে কিভাবে নিয়ে গেল? ভাইয়া তাহলে, আমাদের পেছনে লেগেই ছিল এতদিন!
.
আলিকে লোক মারফতে জানালাম সবকিছু। আলি বলল, তাহলে এখানে থাকা আর নিরাপদ নয়। ঠিকানা বদলাতে হবে। নতুন কোথাও। আলিরও এখানে আসা ঠিক হবে না। উপরের নির্দেশে আমরা আবার ফিরলাম বৈরুতে। বৈরুত তখন বারুদের বাক্স। কে নেই এখানে? খ্রিস্টান মিলিশিয়া, শী‘আ, সুন্নী, ফিলিস্তীনি, লুননানের সরকারী বাহিনী, ফ্রান্স, আমেরিকা! বাকি ছিল ইসরায়েল! তারাও শেষে এসে যোগ দিয়েছে! মরছে অসহায় ফিলাস্তীনি ভাইবোনেরা!
.
বৈরুতের দিনগুলো কাটছিল, সব সময় মৃত্যুকে হাতে নিয়ে। আলি ফিলিস্তীনিদের সাথে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আমাকেও থাকতে হয়েছে পাশে পাশে। মাঝেমধ্যে যুদ্ধফ্রন্ট ছেড়ে অন্য দিকেও কাজ করতে হয়েছে। আহতদের সেবা দিতে হয়েছে।
ইহুদি সেনারা এসে হিংস্র হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়েছে ফিলিস্তীনিদের উপর। সাথে আছে খ্রিস্টান সন্ত্রাসীরা। স্মরণকালের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে সাবরা-শাতিলায়! হাজার হাজার অসহায় মানুষকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে, তিনদিন ধরে একনাগাড়ে হত্যা করে গেছে! এভাবে নিরপরাধ মানুষের উপর গণহত্যা চালানো, পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল! আমরা সবাই কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলাম!
.
সাবরার গণহত্যার আগের দিন, মানে ১৫-ই সেপ্টেম্বর, আমাদের বাসার সামনে একটা পাগলকে, ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম। প্রথম দিকে চোখে পড়েনি। এক পাগলটার প্রশংসা করার পর, আলাদা করে নজরে এল। দেখেই কেমন চমকে উঠলাম! পোশাক-পরিচ্ছদ ময়লা আর মুখটা দাঁড়িগোঁফে ভর্তি হলেও চেহারাটা কেমন চেনা চেনা লাগল! আমি কাছে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম! আমাকে কাছে যেতে দেখে, পাগলটা কেমন একটা অন্যমনস্ক ভঙ্গি করে উল্টো দিকে এলোমেলোভাবে হাঁটতে শুরু করল। আমি তার পিছু নেয়া সমীচিন মনে করলাম না। পরে বুঝতে পেরেছি, ওটা ছিল আমার জীবনের দ্বিতীয় বড় ভুল! প্রথম ভুলটা ছিল খালার বাসায় যাওয়া!
পাগলটার পিছু নিলে জানতে পারতাম, ওটা আর কেউ নয়, আমার ভাই! আমাদেরকে ট্রেস করার জন্যে এসেছিল। চিনেছি কী করে? রাতে আলিকে পাগলটার কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, তাকে চেনে। মানে দেখেছে! কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার মাথায় এল, এই লোক হাঁটার ভঙ্গিটা ভাইয়ার সাথে মিলে যায়! তারপরও নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলা ঠিক নয়। কী মনে করে আলিকে আশংকার কথা বললাম! আলি শোনার সাথে সাথে শোয়া থেকে উঠে গেল! চিন্তিতভাবে একটু পায়চাারি করে বলল, আমাদের আর এই বাসায় থাকা এক মুহূর্তও নিরাপদ নয়। ইশ এ-আশংকার কথাটা যদি আসার সাথে সাথে বলতে! চলো চলো, দেরী করা যাবে না!
.
আমার হাতে ছোট্ট একটা ব্যাগ দিয়ে, মুহাম্মাদকে আলি কোলে নিল! আরেকটা ব্যাগে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল! বের হওয়ার আগে সব সময় যা করি, বাতি নিভিয়ে আলি জানলা দিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে তাকাল! সাথে সাথে লাফিয়ে ঘরে ঢুকল! অত্যন্ত ব্যস্ত স্বরে বলল!
-যিয়াদাহ, তুমি মুহাম্মাদকে কোলে করে পেছনের দরজা দিয়ে দ্রুত বের হয়ে যাও! আমি একটু পরে আসছি! বের হয়ে আমার অপেক্ষা করবে না! সোজা ‘দ্বিতীয় বাড়িতে’ চলে যাবে! আল্লাহ চাহেন তো ওখানে আমাদের দেখা হবে! ইনশাআল্লাহ! নইলে……
-নইলে কি?
– না কিছু না, তুমি যাও! দেরী করো না! তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে!
-আমি একা যাব না!
-একা কোথায়, মুহাম্মাদ আছে, আরেকজন মেহমান কিছুদিন পরেই আসছে ইনশাআল্লাহ!
-তুমিও আমার সাথে চল!
-যিয়াদাহ! তুমি কি পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারছ না? কেউ একজনকে এখানে থাকতে হবে! ওদের এখানেই ঠেকাতে হবে! নইলে কেউই বের হতে পারবে না!
.
আহা, এমন পরিস্থিতিতে কখনো পড়বো, কল্পনাও করিনি। বড় সন্তান থেকেও নেই। এখন স্বামীকেও….! চিন্তার সময় নেই! আলি আমাদেরকে একপ্রকার ধাক্কাতে ধাক্কাতেই পেছন দরজার কাছে নিয়ে এল! মুহাম্মাদকে কোলে তুলে চুমু খেল! যাওয়ার আগে বলে গেল;
-অনেক করে চেয়েছিলাম, তোমাকে সুখী করতে! চেষ্টার কমতি করিনি! স্বামীর হক আদায়ে ভুল হলে দয়া করে মাফ করে দিও! আমাকে ভালবেসে তুমি পার্থিব অনেক বড় বড় প্রাপ্তিকেও তুচ্ছ করেছ! তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই! তোমার মত একজন মহীয়সী পাশে না থাকলে, আমার এ-পথে টিকে থাকা দুরূহ হয়ে যেতে! বাচ্চাদেরকে সঠিক দ্বীন শিক্ষা দিও! বায়তুল মুকাদ্দাস জয়ের জন্যে গড়ে তোল! ওদের আব্বুর কথা তাদেরকে বলো! ইউসুফের সাথে যদি কখনো তোমার দেখা হয়, তাকে আমার ভালোবাসা জানিও!
.
নয়মাসের আসন্নপ্রসবা একজন নারীর একা একা হাঁটাই কষ্টকর, তার উপর মুহাম্মাদকেও কোলে নিতে হয়েছে! বড় কষ্ট হচ্ছিল! কিন্তু আমাকে হাঁটতেই হবে! গলিটা পার হতেই পেছন থেকে ব্রাশ ফায়ারের কর্কশ ধ্বনি ভেসে এল! সাথে সাথে গ্রেনেড বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ! না থেমে চলতে থাকলাম! থমকে গেলে চলবে না! এগিয়ে যেতে হবে আরো বহুদূর! আমাদের সন্তানদের বাঁচাতে হবে! বাবার রেখে যাওয়া পতাকা তাদের হাতে তুলে দিতে হবে! কুদসকে মুক্ত করতে হবে!


Ayrıca Muroosmm.com ile instagram hesapların için satın alabileceğiniz ucuz takipçi paketlerini sipariş et!


türk takipçi satın al

তাকদির বনাম স্বাধীন ইচ্ছা – স্রষ্টা কি এখানে বিতর্কিত ?

সাজিদের ব্যাগে ইয়া মোটা একটি ডায়েরি থাকে সবসময়। ডায়েরিটা প্রাগৈতিহাসিক আমলের কোন নিদর্শনের মতো। জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া।ছেঁড়া জায়গার কোনটাতে সূতো দিয়ে সেলাই করা, কোন জায়গায় আঁটা দিয়ে প্রলেপ লাগানো, কোন জায়গায় ট্যাপ করা।

এই ডায়েরিতে সে তার জীবনের নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো লিখে রাখে।এই ডায়েরির মাঝামাঝি কোন এক জায়গায় সাজিদ আমার সাথে প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটিও লিখে রেখেছে।তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় টি.এস.সি তে।

সে আমার সম্পর্কে লিখে রেখেছে,-
‘ভ্যাবলা টাইপের এক ছেলের সাথে সাক্ষাৎ হলো আজ।দেখলেই মনে হবে, জগতের কঠিন বিষয়ের কোনকিছুই সে বুঝেনা।কথা বলার পরে বুঝলাম, এই ছেলে অত্যন্ত বুদ্ধিমান,কিন্তু বোকা।ছেলেটার নাম- আরিফ।’
নিচে তারিখ দেওয়া- ‘০৫/০৩/০৯

এই ডায়েরিতে নানান বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথাও লিখা আছে।

একবার কানাডার টরেণ্টোতে সাজিদ তার বাবার সাথে একটি অফিসিয়াল ট্যুরে গিয়েছিলো।সেখানে অনেক সেলেব্রিটির সাথে বিলগেটসও আমন্ত্রিত ছিলেন।বিলগেটস সেখানে দশ মিনিটের জন্য বক্তৃতা রেখেছিলেন।সে ঘটনাটি লিখা আছে।

জাফর ইকবালের সাথে সাজিদের একবার বই মেলায় দেখা হয়ে যায়। সেবারের বইমেলায় জাফর স্যারের বই ‘একটুখানি বিজ্ঞান’ এর দ্বিতীয় কিস্তি ‘আরো একটুখানি বিজ্ঞান’ প্রকাশিত হয়। সাজিদ জাফর স্যারের বই কিনে বের হওয়ার পথে জাফর স্যারের সাথে তার দেখা হয়ে যায়।সাজিদ স্যারের একটি অটোগ্রাফ নিয়ে, স্যারের কাছে হেসে জানতে চাইলো,- ‘স্যার, ‘একটুখানি বিজ্ঞান’ পাইলাম।এরপর পাইলাম ‘আরো একটুখানি বিজ্ঞান’। এটার পরে, ‘আরো আরো একটুখানি বিজ্ঞান’ কবে পাচ্ছি?’

সেদিন নাকি জাফর স্যার মিষ্টি হেসে বলেছিলেন,- ‘পাবে।’

নিজের সাথে ঘটে যাওয়া এরকম অনেক ঘটনাই ঠাঁই পেয়েছে সাজিদের ডায়েরিটাতে।

সাজিদের ডায়েরির আদ্যোপান্ত আমার পড়া ছিলো। কিন্তু, সেমিষ্টার ফাইনাল সামনে চলে আসায় গত বেশ কিছুদিন তার ডায়েরিটা আমার আর পড়া হয়নি।অবশ্য, ডায়েরিটা আমি লুকিয়ে লুকিয়েই পড়ি।

সেদিন থার্ড সেমিষ্টারের শেষ পরীক্ষাটি দিয়ে রুমে আসলাম। এসে দেখি সাজিদ ঘরে নেই। তার টেবিলের উপরে তার ডায়েরিটা পড়ে আছে খোলা অবস্থায়।

ঘর্মাক্ত শরীর। কাঠফাটা রোদের মধ্যে ক্যাম্পাস থেকে হেঁটে বাসায় ফিরেছি।এই মূহুর্তে বসে ডায়েরিটা উল্টোবো, সে শক্তি বা ইচ্ছে কোনটাই নেই।

কিন্তু ডায়েরিটা বন্ধ করতে গিয়ে একটি শিরোনামে আমার চোখ আটকে যায়। আমি সাজিদের টেবিলেই বসে পড়ি। লেখাটির শিরোনাম ছিলো,-

‘ভাগ্য বনাম স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি- স্রষ্টা কি এখানে বিতর্কিত?’

বেশ লোভনীয় শিরোনাম।শারীরিক ক্লান্তি ভুলেই আমি ঘটনাটির প্রথম থেকে পড়া শুরু করলাম।ঘটনাটি সাজিদের ডায়েরিতে যেভাবে লেখা, ঠিক সেভাবেই আমি পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি-

‘কয়েকদিন আগে ক্লাশের থার্ড পিরিয়ডে মফিজুর রহমান স্যার এসে আমাকে দাঁড় করালেন।বললেন,- ‘তুমি ভাগ্যে,আই মিন তাকদির এ বিশ্বাস করো?’
আমি আচমকা অবাক হলাম। আসলে এই আলাপগুলো হলো ধর্মীয় আলাপ। মাইক্রোবায়োলজির একজন শিক্ষক যখন ক্লাশে এসে এসব জিজ্ঞেস করেন, তখন খানিকটা বিব্রত বোধ করাই স্বাভাবিক। স্যার আমার উত্তরের আশায় আমার মুখের দিকে চেয়ে আছেন।

আমি বললাম,- ‘জ্বি, স্যার। এ্যাজ এ্যা মুসলিম, আমি তাকদির – এ বিশ্বাস করি। এটি আমার ঈমানের মূল সাতটি বিষয়ের মধ্যে একটি।’
স্যার বললেন,- ‘তুমি কি বিশ্বাস করো যে, মানুষ জীবনে যা যা করবে তার সবকিছুই তার জন্মের অনেক অনেক বছর আগে তার তাকদিরে লিখে দেওয়া হয়েছে?’
– ‘জ্বি স্যার’- আমি উত্তর দিলাম।
– ‘বলা হয়, স্রষ্টার ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটি ক্ষুদ্র পাতাও নড়েনা, তাই না?’
– ‘জ্বি স্যার।’
– ‘ধরো, আজ সকালে আমি একজন লোককে খুন করলাম। এটা কি আমার তাকদিরে পূর্ব নির্ধারিত ছিলো না?’
– ‘জ্বি, ছিলো।’
– ‘আমার তাকদির যখন লেখা হচ্ছিলো, তখন কি আমি জীবিত ছিলাম?’
– ‘না, ছিলেন না।’
– ‘আমার তাকদির কে লিখেছে? বা, কার নির্দেশে লিখিত হয়েছে?’
– ‘স্রষ্টার।’
– ‘তাহলে, সোজা এবং সরল লজিক এটাই বলে- ‘আজ সকালে যে খুনটি আমি করেছি, সেটি মূলত আমি করি নি। আমি এখানে একটি রোবট মাত্র। আমার ভেতরে একটি প্রোগ্রাম সেট করে দিয়েছেন স্রষ্টা।সেই প্রোগ্রামে লেখা ছিলো যে, আজ সকালে আমি একজন লোককে খুন করবো।সুতরাং, আমি ঠিক তাই-ই করেছি, যা আমার জন্য স্রষ্টা পূর্বে ঠিক করে রেখেছেন।এতে আমার কোন হাত নেই।ডু ইউ এগ্রি,সাজিদ?’
– ‘কিছুটা’- আমি উত্তর দিলাম।

স্যার এবার হাসলেন।হেসে বললেন,- ‘আমি জানতাম তুমি কিছুটাই একমত হবে,পুরোটা নয়।এখন তুমি আমাকে নিশ্চই যুক্তি দেখিয়ে বলবে,- স্যার, স্রষ্টা আমাদের একটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন।আমরা এটা দিয়ে ভালো-মন্দ বিচার করে চলি,রাইট?’
– ‘জ্বি স্যার।’
– ‘কিন্তু সাজিদ, এটা খুবই লেইম লজিক,ইউ নো? ধরো, আমি তোমার হাতে বাজারের একটি লিষ্ট দিলাম।লিষ্টে যা যা কিনতে হবে, তার সবকিছু লেখা আছে।এখন তুমি বাজার করে ফিরলে।তুমি ঠিক তাই তাই কিনলে যা আমি লিষ্টে লিখে দিয়েছি।এবং তুমি এটা করতে বাধ্য।’
এতটুকু বলে স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন,- ‘বুঝতে পারছো?’
আমি বললাম,- ‘জ্বি স্যার।’
– ‘ভেরি গুড! ধরো, তুমি বাজার করে আসার পর, একজন জিজ্ঞেস করলো, সাজিদ কি কি বাজার করেছো? তখন আমি উত্তর দিলাম,- ‘ওর যা যা খেতে মন চেয়েছে, তা-ই তা-ই কিনেছে। বলতো, আমি সত্য বলেছি কিনা?’
আমি বললাম,- ‘নাহ, আপনি মিথ্যা বলেছেন।’
স্যার চিৎকার করে বলে উঠলেন,- ‘এক্সাক্টলি। ইউ হ্যাভ গট দ্য পয়েণ্ট,মাই ডিয়ার। আমি মিথ্যা বলেছি। আমি লিষ্টে বলেই দিয়েছি তোমাকে কি কি কিনতে হবে।তুমি ঠিক তা-ই তা-ই কিনেছো যা আমি কিনতে বলেছি। যা কিনেছো সব আমার পছন্দের জিনিস। এখন আমি যদি বলি,- ‘ওর যা যা খেতে মন চেয়েছে,সে তা-ই তা-ই কিনেছে’, তাহলে এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা,না?’
– ‘জ্বি,স্যার।’
– ‘ঠিক স্রষ্টাও এভাবে মিথ্যা বলেছেন।দুই নাম্বারি করেছেন। তিনি অনেক আগে আমাদের তাকদির লিখে তা আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন।এখন

আমরা সেটাই করি, যা স্রষ্টা সেখানে লিখে রেখেছেন।আবার, এ্যাট দ্য এন্ড অফ দ্য ডে, এই কাজের জন্য কেউ জান্নাতে যাচ্ছে, কেউ জাহান্নামে।কিন্তু কেনো? এখানে মানুষের তো কোন হাত নেই।ম্যানুয়ালটা স্রষ্টার তৈরি। আমরা তো জাষ্ট পারফর্মার।স্ক্রিপ্ট রাইটার তো স্রষ্টা।স্রষ্টা এরজন্য আমাদের কাউকে জান্নাত,কাউকে জাহান্নাম দিতে পারেন না। যুক্তি তাই বলে,ঠিক?’
আমি চুপ করে রইলাম। পুরো ক্লাশে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে তখন।
স্যার বললেন,- ‘হ্যাভ ইউ এ্যানি প্রপার লজিক অন দ্যাট টিপিক্যাল কোয়েশ্চান,ডিয়ার?’
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।
স্যার মুচকি হাসলেন। মনে হলো- উনি ধরেই নিয়েছেন যে, উনি আমাকে এবার সত্যি সত্যিই কুপোকাত করে দিয়েছেন।বিজয়ীর হাসি।
আমাকে যারা চিনে তারা জানে, আমি কখনো কারো প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নিই না।আজকে যেহেতু তার ব্যতিক্রম ঘটলো, আমার বন্ধুরা আমার দিকে ড্যাব ড্যাব চোখ করে তাকালো।তাদের চাহনি দেখে মনে হচ্ছিলো, এই সাজিদকে তারা চিনেই না।কোনদিন দেখে নি।
আর, ক্লাশে আমার বিরুদ্ধ মতের যারা আছে, তাদের চেহারা তখন মূহুর্তেই উজ্জ্বল বর্ণ ধারন করলো।তারা হয়তো মনে মনে বলতে লাগলো,- ‘মোল্লার দৌঁড় অই মসজিদ পর্যন্তই।হা হা হা’।

আমি মুখ তুলে স্যারের দিকে তাকালাম।মুচকি হাসিটা স্যারের মুখে তখনও বিরাজমান।

আমি বললাম,- ‘স্যার, এই ক্লাশে কার সম্পর্কে আপনার কি অভিমত?’

স্যার ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন। স্যার জিজ্ঞেস করেছেন কি আর আমি বলছি কি।

স্যার বললেন,- ‘বুঝলাম না।’

– ‘মানে, আমাদের ক্লাশের কার মেধা কি রকম, সে বিষয়ে আপনার কি ধারনা?’

– ‘ভালো ধারনা। ছাত্রদের সম্পর্কে একজন শিক্ষকেরই তো সবচেয়ে ভালো জ্ঞান থাকে।’
আমি বললাম,- ‘স্যার, আপনি বলুন তো, এই ক্লাশের কারা কারা ফাষ্ট ক্লাশ আর কারা কারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে?’
স্যার কিছুটা বিস্মিত হলেন। বললেন,- ‘আমি তোমাকে অন্য বিষয়ে প্রশ্ন করেছি।তুমি ‘আউট অফ কনটেক্সট’ এ গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করছো,সাজিদ।’

– ‘না স্যার, আমি কনটেক্সটেই আছি। আপনি উত্তর দিন।’

স্যার বললেন,- ‘এই ক্লাশ থেকে রায়হান, মমতাজ, ফারহানা, সজীব, ওয়ারেশ, ইফতি, সুমন,জাবেদ এবং তুমি ফাষ্ট ক্লাশ পাবে। আর বাকিরা সেকেন্ড ক্লাশ।’

স্যার যাদের নাম বলেছেন, তারা সবাই ক্লাশের ব্রিলিয়্যাণ্ট ষ্টুডেণ্ট।সুতরাং, স্যারের অনুমান খুব একটা ভুল না।
আমি বললাম,- ‘স্যার, আপনি এটা লিখে দিতে পারেন?’

– ‘Why not’- স্যার বললেন।

এই বলে তিনি খচখচ করে একটা কাগজের একপাশে যারা ফাষ্ট ক্লাশ পাবে তাদের নাম, অন্যপাশে যারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে,তাদের নাম লিখে আমার হাতে দিলেন।

আমি বললাম,- ‘স্যার, ধরে নিলাম যে আপনার ভবিষ্যৎবাণী সম্পূর্ণ সত্য হয়েছে।মানে, আপনি ফাষ্ট ক্লাশ পাবে বলে যাদের নাম লিখেছেন,তারা সবাই ফাষ্ট ক্লাশ পেয়েছে,আর যারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে লিখেছেন, তাদের সবাই সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে।’

– ‘হুম, তো?’

– ‘এখন, স্যার বলুন তো, যারা ফাষ্ট ক্লাশ পেয়েছে, আপনি এই কাগজে তাদের নাম লিখেছেন বলেই কি তারা ফাষ্ট ক্লাশ পেয়েছে?’

– ‘নাহ তো।’

– ‘যারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে, তারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে বলে আপনি এই কাগজে লিখেছেন বলেই কি তারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে?’
স্যার বললেন,- ‘একদম না।’

– ‘তাহলে মূল ব্যাপারটি কি স্যার?’

স্যার বললেন,- ‘মূল ব্যাপার হলো, আমি তোমাদের শিক্ষক। আমি খুব ভালো জানি পড়াশুনায় তোমাদের কে কেমন। আমি খুব ভালো করেই জানি, কার কেমন মেধা। সুতরাং, আমি চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারি কে কেমন রেজাল্ট করবে।’

আমি হাসলাম। বললাম,- ‘স্যার, যারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে, তারা যদি আপনাকে দোষ দেয়? যদি বলে, আপনি ‘সেকেন্ড ক্লাশ’ ক্যাটাগরিতে তাদের নাম লিখেছেন বলেই তারা সেকেন্ড ক্লাশ পেয়েছে?’

স্যার কপালের ভাঁজ লম্বা করে বললেন,- ‘ইট উড বি টোট্যালি বুলশিট! আমি কেন এর জন্য দায়ী হবো? এটা তো সম্পূর্ণ তাদের দায়। আমি শুধু তাদের মেধা,যোগ্যতা সম্পর্কে ধারনা রাখি বলেই অগ্রিম বলে দিতে পেরেছি যে কে কেমন রেজাল্ট করবে।’
আমি আবার জোরে জোরে হাসতে লাগলাম। পুরো ক্লাশ আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।

আমি থামলাম।বললাম,- ‘স্যার, তাকদির তথা ভাগ্যটাও ঠিক এরকম। আপনি যেমন আমাদের মেধা, যোগ্যতা,ক্ষমতা সম্পর্কে ভালো ধারনা রাখেন, স্রষ্টাও তেমনি তার সৃষ্টি সম্পর্কে ধারনা রাখেন।আপনার ধারনা মাঝে মাঝে ভুল হতে পারে, কিন্তু স্রষ্টার ধারনায় কোন ভুল নেই। স্রষ্টা হলেন আলিমুল গায়েব। তিনি ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব জানেন।

আপনি যেরকম আমাদের সম্পর্কে পূর্বানুমান করে লিখে দিয়েছেন যে, আমাদের মধ্যে কারা কারা ফাষ্ট ক্লাশ পাবে, আর কারা সেকেন্ড ক্লাশ।এর মানে কিন্তু এই না যে, আপনি বলেছেন বলে আমাদের কেউ ফাষ্ট ক্লাশ পাচ্ছি, কেউ সেকেন্ড ক্লাশ।

স্রষ্টাও সেরকম পূর্বানুমান করে আমাদের তাকদির লিখে রেখেছেন।তাতে লেখা আছে দুনিয়ায় আমরা কে কি করবো।এর মানেও কিন্তু এই না যে, তিনি লিখে দিয়েছেন বলেই আমরা কাজগুলো করছি। বরং, এর মানে হলো এই- তিনি জানেন যে, আমরা দুনিয়ায় এই এই কাজগুলো করবো। তাই তিনি তা অগ্রিম লিখে রেখেছেন তাকদির হিসেবে।

আমাদের মধ্যে কেউ ফাষ্ট ক্লাশ আর কেউ সেকেন্ড ক্লাশ পাবার জন্য যেমন কোনভাবেই আপনি দায়ী নন, ঠিক সেভাবে, মানুষের মধ্যে কেউ ভালো কাজ করে জান্নাতে, আর কেউ খারাপ কাজ করে জাহান্নামে যাবার জন্যও স্রষ্টা দায়ী নন। স্রষ্টা জানেন যে, আপনি আজ সকালে একজনকে খুন করবেন।

তাই তিনি সেটা আগেই আপনার তাকদিরে লিখে রেখেছেন।এটার মানে এই না যে- স্রষ্টা লিখে রেখেছে বলেই আপনি খুনটি করেছেন।এর মানে হলো- স্রষ্টা জানেন যে,আপনি আজ খুনটি করবেন।তাই সেটা অগ্রিম লিখে রেখেছেন আপনার তাকদির হিসেবে।

স্যার, ব্যাপারটা কি এখন পরিষ্কার?

স্যারের চেহারাটা কিছুটা ফ্যাকাশে মনে হলো। তিনি বললেন,- ‘হুম।’

এরপর স্যার কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর বললেন,- ‘আমি শুনেছিলাম তুমি ক’দিন আগেও নাস্তিক ছিলে।তুমি আবার আস্তিক হলে কবে?’
আমি হা হা হা করে হাসলাম। বললাম,- ‘এই প্রশ্নটা কিন্তু স্যার আউট অফ কনটেক্সট।’

এটা শুনে পুরো ক্লাশ হাসিতে ফেঁটে পড়লো।

পিরিওডের একদম শেষদিকে, স্যার আবার আমাকে দাঁড় করালেন।বললেন,- ‘বুঝলাম স্রষ্টা আগে থেকে জানেন বলেই লিখে রেখেছেন। তিনি যেহেতু আগে থেকেই জানেন কে ভালো কাজ করবে আর কে খারাপ কাজ করবে, তাহলে পরীক্ষা নেওয়ার কি দরকার? যারা জান্নাতে যাওয়ার তাদের জান্নাতে, যারা জাহান্নামে যাওয়ার তাদের জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেই তো হতো,তাই না?’

আমি আবার হাসলাম। আমার হাতে স্যারের লিখে দেওয়া কাগজটি তখনও ধরা ছিলো।আমি সেটা স্যারকে দেখিয়ে বললাম,- ‘স্যার, এই কাগজে কারা কারা ফাষ্ট ক্লাশ পাবে, আর কারা কারা সেকেন্ড ক্লাশ পাবে, তাদের নাম লেখা আছে। তাহলে এই কাগজটির ভিত্তিতেই রেজাল্ট দিয়ে দিন।বাড়তি করে পরীক্ষা নিচ্ছেন কেনো?’

স্যার বললেন,- ‘পরীক্ষা না নিলে কেউ হয়তো এই বলে অভিযোগ করতে পারে যে,- ‘স্যার আমাকে ইচ্ছা করেই সেকেন্ড ক্লাশ দিয়েছে। পরীক্ষা দিলে আমি হয়তো ঠিকই ফাষ্ট ক্লাশ পেতাম।’

আমি বললাম,- ‘একদম তাই,স্যার। স্রষ্টাও এইজন্য পরীক্ষা নিচ্ছেন,যাতে কেউ বলতে না পারে- দুনিয়ায় পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলে আমি অবশ্যই আজকে জান্নাতে থাকতাম। স্রষ্টা ইচ্ছা করেই আমাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছে।’

ক্লাশের সবাই হাত তালি দিতে শুরু করলো। স্যার বললেন,- ‘সাজিদ, আই হ্যাভ এ্যা লাষ্ট কোয়েশ্চান।’
– ‘ডেফিনেইটলি, স্যার।’- আমি বললাম।
– ‘আচ্ছা, যে মানুষ পুরো জীবনে খারাপ কাজ বেশি করে,সে অন্তত কিছু না কিছু ভালো কাজ তো করে,তাই না?’
– ‘জ্বি স্যার।’
– ‘তাহলে, এই ভালো কাজগুলোর জন্য হলেও তো তার জান্নাতে যাওয়া দরকার,তাই না?’

আমি বললাম,- ‘স্যার, পানি কিভাবে তৈরি হয়?’

স্যার আবার অবাক হলেন। হয়তো বলতে যাচ্ছিলেন যে, এই প্রশ্নটাও আউট অফ কনটেক্সট, কিন্তু কি ভেবে যেন চুপসে গেলেন।বললেন,- ‘দুই ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেনের সংমিশ্রণে।’

আমি বললাম,- ‘আপনি এক ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন দিয়ে পানি তৈরি করতে পারবেন?’

– ‘কখনোই না।’
– ‘ঠিক সেভাবে, এক ভাগ ভালো কাজ আর এক ভাগ মন্দ কাজে জান্নাত পাওয়া যায়না। জান্নাত পেতে হলে হয় তিন ভাগই ভালো কাজ হতে হবে, নতুবা দুই ভাগ ভালো কাজ, এক ভাগ মন্দ কাজ হতে হবে। অর্থাৎ, ভালো কাজের পাল্লা ভারি হওয়া আবশ্যক।’
সেদিন আর কোন প্রশ্ন স্যার আমাকে করেন নি।’

এক নিশ্বাঃসে পুরোটা পড়ে ফেললাম। কোথাও একটুও থামিনি। পড়া শেষে যেই মাত্র সাজিদের ডায়েরিটা বন্ধ করতে যাবো, অমনি দেখলাম, পেছন থেকে সাজিদ এসে আমার কান মলে ধরেছে।সে বললো,- ‘তুই তো সাংঘাতিক লেভেলের চোর।’

আমি হেসে বললাম,- ‘হা হা হা। স্যারকে তো ভালো জব্দ করেছিস ব্যাটা।’

কথাটা সে কানে নিলো বলে মনে হলো না।নিজের সম্পর্কে কোন কমপ্লিমেন্টই সে আমলে নেয় না। গামছায় মুখ মুছতে মুছতে সে খাটের উপর শুয়ে পড়লো।

আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম। বললাম,- ‘সাজিদ……’
– ‘হু’
– ‘একটা কথা বলবো?’
– ‘বল।’

– ‘জানিস, একসময় যুবকেরা হিমু হতে চাইতো।হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে, মরুভূমিতে গর্ত খুঁড়ে জ্যোৎস্না দেখার স্বপ্ন দেখতো।দেখিস,এমন একদিন আসবে, যেদিন যুবকেরা সাজিদ হতে চাইবে। ঠিক তোর মতো……’

এই বলে আমি সাজিদের দিকে তাকালাম।দেখলাম, ততক্ষণে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। অঘোর ঘুম……..


türk gerçek takipçi satın al

প্রেমিক-প্রেমিকা : চোখের মণি থেকে চোখের বালি

দোস্ত, তোরা প্রেম করিস না ভালোই আছিস। প্রেম করলে বুঝতি, কী যে প্যারা!

প্রেমিক বন্ধুগুলো তাদের ‘অপ্রেমিক’ বন্ধুদেরকে প্রায় সময়ই এই কথাগুলো বলে। কথাগুলো যে তাদেরকে প্রেম না করার জন্য সতর্ক করার জন্য বলে এমন না। বরং নিজের বুকের চাপা নিশ্বাস থেকে কথাগুলো বলে।

আসলেই যদি সতর্ক করার জন্য তারা কথাগুলো বলতো, তাহলে তো প্রথমে নিজেদের বেলায়ই বলতো, That’s end.

যে প্রেমিক-প্রেমিকার রাতপ্রহরের কথোপকথনগুলো ভোর অব্ধি গড়াতো, চ্যাটলিস্টের প্রথম সাড়িতে যার নাম থাকতো, বিশেষ দিনগুলোতে তাকে ছাড়া চিন্তাও করা যেতো না সেই মানুষটা ব্রেকাপের পর ফেসবুকে তার ব্লকলিস্টে চলে যায়, তার নাম্বার চলে যায় ব্লাক লিস্টে।

জান থেকে সে হয়ে যায় জানোয়ার আর কিউটী থেকে সে হয়ে যায় কুত্তী!

একসময়ের প্রেমিক পুরুষ তখন হয়ে যায় পৃথিবীপৃষ্ঠের সবচেয়ে ঘৃণিত পুরুষ, আর সেই সুন্দরীতমা হয়ে যায় নিকৃষ্টতম লোভাতুর।

যে মানুষটা একসময় ‘চোখের মণি’ ছিলো হুট করে সে কেন ‘চোখের বালি’ হয়ে যায় এই বিষয়টা ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) খুব সুন্দর করে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,

“When people help one another in sin and transgression, they finish by hating each other.”
মানুষ যখন একে অন্যকে পাপ কাজে সাহায্য করে তখন তাদের সম্পর্কের শেষ হয় একে অন্যকে ঘৃণা করার মাধ্যমে।

রাতবিরাতের প্রেমালাপ আর ডেটিংয়ের সময় চোখ, হাত-পা সবকিছু লিপ্ত হয় নিজ নিজ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যিনায়। এরকম পাপ কাজে সাহায্য করা মানুষটির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার পর তো আপনাআপনিই ঘৃণা জন্মাবে।

পছন্দের মানুষকে পছন্দ করার পর থেকে মন আনচান করে, নানারকম প্রশ্ন মনে উদয় হয়। আচ্ছা তার কি বয়ফ্রেন্ড আছে? তাকে কি প্রপোজ করেই ফেলবো? সে যদি রিজেক্ট করে?

এইসব প্রশ্নবাণে মন অস্থির হয়ে উঠে। তারপর যখন সে প্রপোজাল এক্সেপ্ট করে ফেলে তখন আরেক ধরণের উদ্বেগ শুরু হয়। তার ফোন ওয়েটিং এ ক্যান? সে কি আমাকে প্রায়োরিটি দিচ্ছেনা? তার বাবা-মা তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন, সে কি তাহলে তাদের পছন্দমতো বিয়ে করে ফেলবে?

প্রশ্নগুলোর সমাপ্তি এখানেই নয়। তারপর যদি ব্রেকাপ হয়ে যায় তাহলে কষ্ট তো আছেই, এই কষ্টের পরিণতি এক সময় রূপ নেয় নিজের হাত-পা কাটা থেকে শুরু করে আত্মহত্যায়। বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ আত্মহত্যার কারণ খুঁজলে দেখা যাবে তার মেক্সিমামই লাভ-কেইস।

প্রিয় মানুষকে পাবার আগে, পাবার পর এবং হারানোর পর দেবদাস হবার যে কষ্ট সেটা একপ্রকার শাস্তি।

ইবনুল কায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বিষয়টা বেশ গুছিয়ে বলেছেন এভাবে,

“যে ভালোবাসা আল্লাহর জন্য হবে না তাতে তিনটি শাস্তি অবশ্যই থাকবে। যতক্ষণ না সে তা না পাচ্ছে ততক্ষণ সে কষ্ট পাবে। যখন পাবে তখন কষ্টে থাকবে কয়েক ধরনের, তা হারানোর, তা চলে যাবার, নষ্ট হওয়ার কিংবা তার বিরুদ্ধে যাওয়ার ইত্যাদি। তারপর যখন তা হাতছাড়া হবে তার কষ্ট বহু গুণ বেড়ে যাবে। এ হচ্ছে দুনিয়ার বুকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুকে ভালোবাসার তিন শাস্তি।”

এতো গেলো কষ্টের কথা। অনেক সময় এমনও হয়, প্রিয় মানুষকে পেতে গিয়ে কেউ ধর্মচ্যুত-মুরতাদ হয়ে যায়। যে ছেলেটা একসময় নামাজ পড়তো, আল্লাহর যিকির করতো সেও দেখা যায় সবকিছু বাদ দিয়ে প্রিয়তমার গুণগানে লিপ্ত। প্রিয়তমার চুলের ঘ্রাণ নিয়ে কবিতা লিখছে, তার রূপের কাছে চাঁদও যেনো হার মানে এইসব কম্পলিমেন্ট করে তার হাসির ঝিলিক দেখছে।

যে অন্তর একসময় লিপ্ত ছিলো আল্লাহর গুণগানে, সেই অন্তর তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রিয়তমার রূপের প্রশংসায়।

এর পরিণতি সম্পর্কে ইবনুল কায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
“If a heart becomes attached to anything other than Allah, Allah makes him dependent on what he is attached to. And he will be betrayed by it.”

যখন কোনো হৃদয় আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, আল্লাহ তাকে সেই জিনিসের মুখাপেক্ষী করে দেন এবং এর দ্বারা সে প্রতারিত হয়।

প্রতারিত হবার এমন দুঃখজনক একটা ঘটনা হাসান আল-বাসরী (রাহিমাহুল্লাহ) বর্ণনা করেন।

একজন লোক সবসময় আল্লাহর ইবাদত করতো। আল্লাহর ইবাদতে বাধা হয়ে না ধারায় এজন্য সে দুনিয়াবি ভোগবিলাস থেকে বিমুখ হয়।

একদিন মসজিদে যাবার সময় সে এক সুন্দরী মেয়েকে দেখলো। মেয়েটি ছিলো খ্রিস্টান। মেয়েকে বিয়ের প্রপোজাল দিলে মেয়েটি জানালো, “যদি সে সত্যিই তাকে বিয়ে করতে চায়, তাহলে তাকে খ্রিস্টান হতে হবে।”

লোকটি মেয়ের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে মসজিদের দিকে রওয়ানা দিলো। কিন্তু মনের মধ্যে সেই সুন্দরী মেয়েকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সে পরাজিত হলো এবং মেয়ের কথামতো খ্রিস্টান হয়ে তাকে বিয়ে করলো।

কিছুদিন পর সেই খ্রিস্টান মেয়েটি এসে তাকে বললো, “তুমি আল্লাহর প্রিয় একজন বান্দা ছিলে।
তোমার মনের লিপ্সা পূরণের জন্য তুমি সেই ধর্ম ত্যাগ করলে, যে ধর্ম তোমার ইহকাল এবং পরকালের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।

তুমি যেমন তোমার ধর্মত্যাগ করেছো, আমিও এখন আমার ধর্মত্যাগ করছি। তবে তোমার মতো নিজের কামনা চরিতার্থ করার জন্য নয়, বরং সেই সুখময় জীবনের জন্য, যার কোনো শেষ নাই।”

এই বলে খ্রিস্টান মেয়েটি সূরা ইখলাস তেলাওয়াত করলো।

খ্রিস্টান মেয়ের মুখে আল্লাহর পরিচয় বিশিষ্ট এই সূরা শুনে লোকটির চোখ যেনো কপালে উঠলো। সে অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এটা শিখলে কিভাবে?”

এবার মেয়েটি বললো, “আমাকে স্বপ্নে জাহান্নাম দেখানো হয়েছে এবং জাহান্নামে যেখানে থাকবো সেই জায়গাটুকুও। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তখন মালিক (জাহান্নামের পাহারাদার ফেরেশতা) আমাকে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না, আল্লাহ তোমাকে এই জায়গা থেকে বাঁচিয়েছেন এবং জাহান্নামের তোমার এই জায়গাটুকু তোমার স্বামীর জন্য নির্ধারণ করেছেন।’ এই বলে মালিক আমার হাত ধরে আমাকে জান্নাতে আমার ঘরে নিয়ে যান। সেখানে আমি একটা লেখা দেখলাম :

يَمْحُوا اللَّهُ مَا يَشَآءُ وَيُثْبِتُ ۖ وَعِندَهُۥٓ أُمُّ الْكِتٰبِ

আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন মিটিয়ে দেন এবং যা ইচ্ছা করেন স্থির রাখেন, আর তাঁর কাছেই রয়েছে মূল কিতাব।” (সূরা আর রা’দ ১৩:৩৯)

তারপর মেয়েটা ইসলাম গ্রহণ করলো আর ধর্মত্যাগের কারণে লোকটাকে হত্যা করা হলো।
[Glimpse From The Life Of Righteous People, Page 53-55]

যে প্রেম আল্লাহর স্মরণ থেকে মানুষকে ভুলিয়ে দেয়, চারিদিকে শুধু সেই প্রেমের প্রচারণা। অথচ সেই প্রেমে না সুখী প্রেমিক, না সুখী প্রেমিকা। দিনশেষে দুজনই ‘অপরাধী’।

আর সেই অপরাধের পথে আমরা হাত-পা বাড়াচ্ছি…


লেখক – আরিফুল ইসলাম,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।

türk takipçi satın al

আদর্শ, সুখি দাম্পত্য জীবন গড়তে রাসূল সা. এর নির্দেশনা ।

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাঁর বান্দাদেরকে এতটা ভালবাসেন, এতটা ক্ষমা করেন। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্ললাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর যিনি তাঁর উম্মাতকে ভালবেসেছেন, ভালবাসতে শিখিয়েছেন।

বর্তমানে আমাদের সমাজে ডিভোর্স বা বিবাহ বিচ্ছেদের হার আশংকাজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ’ (এমএসভিএসবি) শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়েছে। এ বিচ্ছেদ করার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি এগিয়ে।

অথচ আমরা যদি রাসুল সাঃ এর দাম্পত্য জীবন সম্পর্কিত নির্দেশনা মেনে চলতাম তাহলে এই বিচ্ছেদের মিছিল অনেকাংশে কমে যেত । দেখা নেওয়া যাক সেগুলো –

মুহাব্বত (ভালবাসা) বা দাম্পত্য জীবন সুখি করার রাসুল (সাঃ) এর সুন্নাত তরিকাঃ একজন স্বামী এবং স্ত্রী পরস্পর তিনটি চাহিদাকে কেন্দ্র করে একে অপরের সাথে জড়িয়ে থাকে।

  • ১→শারীরীক চাহিদা,
  • ২→মানসিক চাহিদা এবং
  • ৩→আধ্যাত্মিক চাহিদা।

এর কোন একটির ঘাটতি বয়ে আনতে পারে অসন্তুষ্টি। আর তাই বিয়ের আগ মুহূর্তে সুন্নাহ মোতাবেক পারিবারিক জীবন অতিবাহিত করার একটা রাফ প্ল্যান করে নিতে পারেন। কিছু বিষয় হাইলাইট করে যদি সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা যায় তবে প্রতিটি ঘর হয়ে উঠবে প্রশান্তিময়। বিয়ে পরবর্তী (দাম্পত্য জীবন – এ) রোমান্স/ ভালবাসা যেনো আমৃত্যু টিকে থাকে এজন্য নিম্নের সুন্নাতি বিষয়গুলোতে আসুন সকল পুরুষরা একটু চোখ বুলিয়ে নেইঃ

১) সহধর্মিণীর হৃদয়ের ভাষা বুঝুনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) একবার আ’ইশাকে (রা) বললেন, হে আ’ইশা! আমি অবশ্যই জানি কখন তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাক আর কখন অসন্তুষ্ট হও। আ’ইশা জিজ্ঞেস করলাম, তা আপনি কিভাবে জানেন? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, যখন তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাক, তখন তুমি এরূপ বল,‘মুহাম্মাদের রবের কসম, আর যখন তুমি অসন্তুষ্ট হও তখন বল, ‘ইবরাহীমের রবের কসম’! আ’ইশা (রা) বললেন, জী হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আল্লাহর শপথ! (রাগের সময়) আমি কেবল আপনার নামটাই বাদ দেই। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, আল্লাহর রাসুল (সা) তাঁর সহধর্মিণীর হৃদয়ের অনুভূতি কতোটা গভীরভাবে বুঝতেন। আসলে স্বামী এবং স্ত্রীর সম্পর্ক তো এমনই হওয়া উচিত। একে অপরের সুখদুঃখ যতো বেশী বুঝতে পারবে ততো তাদের মাঝে প্রশান্তি বিরাজ করবে।

২) স্ত্রী দুঃখ পেলে সান্ত্বনা দেয়াঃ আল্লাহর রাসুল (সা) এর প্রিয় সহধর্মিণী সাফিয়াহ (রা) ইসলাম গ্রহনের পুর্বে ইহূদী ছিলেন। তো রাসুলুল্লাহ (সা) একবার হযরত সাফিয়াহর (রা) গৃহে গিয়ে দেখলেন, তিনি কাঁদছেন । কারণ জিজ্ঞেস করলে, তিনি বললেন- আ’ইশা এবং যায়নাব বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহর স্ত্রী এবং গৌরবের দিক হতে একই রক্তধারার অধিকারিণী । সুতরাং আমরাই শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। একথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন, তুমি কেন বললে না যে, ‘আমি আল্লাহর নবী হযরত হারুণের বংশধর ও হযরত মুসার ভ্রাতুষ্পুত্রী এবং রাসুলুল্লাহ (সা) আমার স্বামী ।

অতএব তোমরা কোন দিক হতে আমার চাইতে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হতে পার ?’ অতঃপর আল্লাহর রাসুল (সা) তাঁর নিজ হাত দিয়ে সাফিয়াহর (রা) চোখ মুছে দিলেন। বিয়ের পর একটি দম্পতির মাঝে অবশ্যই এই গুনটি বিরাজ করতে হবে। আপনার বেটার হাফ (সহধর্মীনি) সবসময় হাস্যজ্জ্বল থাকবে এমন ভাবাটা বোকামী। এসময় একে অপরকে সান্ত্বনা দিয়ে তাদের কাছে টানতে হবে।

৩) স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে শোয়াঃ আল্লাহর রাসুল (সা) প্রায় সময় উম্মুল মু’মিনীন খাদিজা (রা) এর কোলে মাথা রাখতেন, এবং তাঁর মৃত্যুর পর আ’ইশা (রা) এর উরুর উপর মাথা রেখে শুতেন। যখন আ’ইশা (রা) ঋতুবর্তী অবস্থায় উপনীত হতেন, তখন নবী (সা) তাঁর উরুর উপর শুয়ে কোর’আন তিলাওয়াত করতেন। একজন পুরুষ তার বৈবাহিক জীবনে কতোবার এভাবে স্ত্রীর উরুতে মাথা রেখে শুয়েছেন??

একটাবার ভাবুন, মহিলাদের এই সেন্সেটিভ সময়ে আপনার একটু সুক্ষ্ম আহ্লাদ তার মনের দুঃখ নিমিষেই ভুলিয়ে দিতে পারে। একবার মাথা রেখে দেখুনই না স্ত্রী সব উজাড় করে দিয়ে দিবে, প্রমিজ। এক্ষেত্রে একজন স্ত্রীরও উচিত স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে নিজের কথাগুলো শেয়ার করা। নিশ্চিত স্বামী বেচারা পরদিন আস্ত গোলাপ বাগান নিয়ে আসতেও কুন্ঠাবোধ করবেন না।

৪) একে অপরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিনঃ উম্মুল মু’মিনীন আ’ইশা (রা) প্রায় সময় রাসুলুল্লাহর (সা) মাথার চুল আচড়ে দিতেন। এমনকি তিনি রাসুলুল্লাহ (সা) এর মাথা ধৌত করে দিতেন। আমি তো মনে করি, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাছাকাছি আসার এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, একে অপরের মাথায় সিম্পলি হাত বুলিয়ে দেয়া বা একে অপরের চুল আচড়ে দেয়ার মাধ্যমে যে ভালোবাসা – র  আদানপ্রদান হবে তা অবিশ্বাস্য।

৫) একই পাত্র হতে খাওয়ার অভ্যেস শুরু করুনঃ যখন উম্মুল মু’মিনীন আ’ইশা (রা) গ্লাসে করে পানি খেতেন, আল্লাহর রাসুল (সা) ঠিক প্রিয় সহধর্মিণীর ঠোট লাগা অংশে ঠোট লাগিয়ে পানি পান করতেন। যখন আ’ইশা (রা:) গোশত খেতেন, তখন আল্লাহর রাসুল (সা:) আ’ইশা হতে গোশতটা টান দিয়ে নিয়ে নিতেন, এবং ঠিক আ’ইশা (রা:) যেদিকটায় ঠোঁট লাগিয়ে খেয়েছেন, একই স্থান থেকে নবী (সা:) খাওয়া শুরু করতেন। অফিস থেকে আসতে দেরী হোক আর যাই হোক, স্ত্রীর সাথে আজ হতে মাঝে মাঝে একই প্লেটে, একই গ্লাসে খাওয়া শুরু করুন। (প্রতিদিন করতে বলবো না, না হয় নেকামি ভেবে বৌ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব জেগে উঠতে পারে)। এতে হৃদতা, ভালোবাসা বাড়বে। খেতে খেতে দু’জনার হৃদয় হতে এমন ফ্রেগ্রেন্স বের হবে, আহ! শুধু সুকুন আর সুকুন।

৬) লজ্জা ফেলে মুসাহাফা করুনঃ আল্লাহর রাসুল (সা) প্রায় সময় স্ত্রীদের চুমু খেতেন। তাঁদের সাথে আদর আহ্লাদ করতেন। যখন রাসুলুল্লাহ (সা) সিয়াম রাখতেন, ঠিক তখন তিনি স্ত্রীদের চুমু দিয়েছেন এমন কথাও হাদিসে পাওয়া যায়। স্ত্রীর চোখে চোখ রাখা, তার কাজের মধ্যখান দিয়ে হুট করে চুমু দিয়ে আসা, আপনার ভালোবাসার গভীরতাকে আপনার স্ত্রীর অন্তরে পৌছঁতে সাহায্য করবে। ভালোবাসা লুকোনোর বিষয় নয়, তা প্রকাশ করার মাধ্যম ইসলাম শিখিয়েছে আমাদের। লজ্জা ভুলে একে অপরের সম্মুখে ভালোবাসা প্রকাশ করা শুরু করুন। একে অপরের সাথে মিলিত হন, কাছে টানুন। নিশ্চই স্বামী স্ত্রীর পবিত্র মিলন সাদাকাহ হিসেবে আল্লাহ তা’য়লা কবুল করেন।

আর তোমাদের প্রত্যেকে আপন স্ত্রীর সাথে সহবাস করাও হচ্ছে সদকাহ্। তারা (সাহাবীরা)জিজ্ঞাসা করেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে কেউ যখন যৌন আকাঙ্খা সহকারে স্ত্রীর সাথে সম্ভোগ (মিলন) করে, তাতেও কি সওয়াব হবে? তিনি বলেন: তোমরা কি দেখ না, যখন সে হারাম পদ্ধতিতে তা করে, তখন সে গোনাহ্গার হয় কিনা! সুতরাং অনুরূপভাবে যখন সে ঐ কাজ বৈধভাবে করে তখন সে তার জন্য প্রতিফল ও সওয়াব পাবে। [মুসলিম: ১০০৬]

৭) একে অপরের মুখে হাত তুলে খাইয়ে দিনঃ ভালোবাসা প্রদর্শনের উত্তম মাধ্যম হলো এই ক্ষুদ্র কাজটি। নিজ হাতের উপার্জন স্ত্রীর মুখে তুলে দেয়াও সওয়াবের কাজ। ভালোবাসার অস্তমিত সুর্যকে নতুন করে জাগিয়ে তুলতে এর তুলনা নেই। আল্লাহর রাসুল (সা) বলেন, ‘…তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্যেশ্যে যা ব্যয় করবে তার উত্তম প্রতিদান পাবে। এমনকি স্বীয় স্ত্রীর মুখে তুলে দেওয়া লোকমার বিনিময়েও’।

৮) স্ত্রীর হাতের কাজে সাহায্য করুনঃ আসওয়াদ (রহ) বলেন, আমি আ’ইশা (রা)-কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুলুল্লাহ (সা) ঘরে কী কাজ করতেন? তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা) ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকতেন অর্থাৎ গৃহস্থালির কাজে পরিবার-পরিজনের সহযোগিতায় থাকতেন। যখন নামাজের সময় হতো নামাজে চলে যেতেন। স্ত্রীর ঘরের কাজে সাহায্য করা আল্লাহর রাসুল (সা) এর সুন্নাহ। নিশ্চই এই সুন্নাহর ব্যাপারে পুরুষদের সজাগ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। সারাদিন গৃহস্থালি কাজ করতে করতে স্ত্রী যখন হাপিয়ে উঠে, বন্ধের দিন গুলোতে পুরুষদের উচিত তাদের কাজে সাহায্য করা। এতে ভালোবাসা বাড়বে বৈ কমবে না।

৯) স্ত্রীর সাথে গল্প করতে ভুলবেন নাঃ বাসায় স্ত্রীর সাথে যে মুহূর্তগুলো কাটাবেন, ঠিক এসময়গুলো চেষ্টা করবেন প্রিয় মানুষের সাথে গল্প-গুজব করে কাটাতে। মাঝে মাঝে হাস্যরস এবং দুষ্টুমি করবেন। এতে আপনাদের মাঝে ভালোবাসা বাড়বে। আল্লাহর রাসুল (সা) প্রায় সময় তাঁর স্ত্রীদের গল্প শোনাতেন। আ’ইশা (রা) কে তিনি উম্মে যারাহ এর বিখ্যাত গল্প শুনিয়ে বলেছিলেন যে, ‘হে আ’ইশা আমি তোমাকে আবু যারাহ এর মতো ভালোবাসি, যেভাবে সে উম্মে যারাহ কে ভালোবাসতো’।

মাঝে মাঝে বিবিদের সাথে বসে বিভিন্ন ঘটনা, কাহিনী ও আন্যান্য আলোচনা করতেন। এক এক বিবি নতুন নতুন কিসসা শুনাতেন, তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে নিজেও কিসসা শুনাতেন। আম্মাজান হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মধ্যে এমনভাবে হাসতেন, কথা বলতেন ও বসে থাকতেন, আমাদের মনেই হতো না যে তিনি একজন মহান পয়গাম্বর। (উসওয়ানে রাসূলে আকরাম) প্রতিদিন বাইরে যে কর্মব্যস্ত সময়ে কাটে তা প্রিয় সহধর্মিণীকে শেয়ার করতে পারেন, এতে আপনার উপর তার বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে জন্মাবে।

 

১০) স্ত্রীকে নিয়ে তার প্রিয় জায়গায় ঘুরতে যানঃ একবার ইথিওপিয়া থেকে কিছু লোক এসে মাসজিদ আন নববীতে তরবারি খেলা দেখাচ্ছিল। আ’ইশা (রা:) রাসূল (সা:) কে বললেন তিনি খেলা দেখতে চান। এমন অবস্থায় আমরা হলে কী বলতাম? “হ্যাঁ!! উম্মাহর এই অবস্থা আর তুমি চাও খেলা দেখতে!! ছি! যাও যাও কুরআন পড়…তাফসীর পড়…” অথচ রাসূল(সা) আ’ইশাকে নিয়ে গেলেন এবং তাঁকে আড়াল করে সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন। আ’ইশা (রা) রাসূলুল্লাহর পিছনে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে লাগলেন।

এত দীর্ঘ সময় তিনি খেলা দেখলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বারবার এক পা থেকে আরেক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন। তিনি আ’ইশা(রা) কে জিজ্ঞেস করলেন যে তাঁর দেখা শেষ হয়েছে কিনা। আ’ইশা বললেন তিনি আরো দেখতে চান। কোন আপত্তি না করে রাসূল (সা) সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। দীর্ঘক্ষণ পর আ’ইশা(রা) নিজেই ক্লান্ত হয়ে বললেন যথেষ্ট হয়েছে। এরপর রাসূল(সা) তাঁকে বাসায় নিয়ে আসলেন। কি শ্রেষ্ঠ ভালোবাসাই না ছিলো আল্লাহর রাসুল (সা) এবং তাঁর সহধর্মিণীদের মাঝে! আপনিও একই সুন্নাহ অনুসরন করুন, ভালোবাসায় টুইটম্বুর অবস্থা হবে।

১১) স্ত্রীর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করুনঃ আ’ইশা (রা) তখন হালকা গড়নের ছিলেন। রাসূল (সা) কোন এক সফর থেকে ফিরছিলেন। সাথে ছিলেন আ’ইশা। তিনি সাহাবীদেরকে বললেন সামনে এগিয়ে যেতে। তাঁরা চোখের আড়াল হলে রাসূল (সা) আ’ইশাকে দৌড় প্রতিযোগীতায় আহ্বান করলেন। আয়েশা জিতে গেলেন সেইবার। এর কয়েক বছর পর পুনরায় দৌঁড় হলে হযরত আয়েশা (রাঃ) হেরে যান।

অতঃপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আয়েশা! আজ আমি তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি, তুমি আমার সঙ্গে পার নি। এটা প্রথম প্রতিযোগিতায় তুমি জিতে যাওয়ার বদলা। (আবু দাউদ শরীফ, হাদীস নং-২২১৪) আমাদের দেশের পুরুষরা কি স্ত্রীর সাথে এমন প্রতিযোগিতা করেছে কখনো? আপনি শুরু করুন। রাসুল (সা) কে ভালোবেসে আপনি যদি একই ভাবে আপনার স্ত্রীকেও ভালোবাসতে থাকেন, এর চেয়ে উত্তম আর কিছু হতে পারে না।

১২) সহধর্মিণীকে প্রিয় নামে ডাকুনঃ আ’ইশাকে (রা:) নবী (সা:) আদর করে ডাকতেন হুমায়রা বলে। হুমায়রা অর্থ ‘লাল বর্ণের রমনী’। রাসুলুল্লাহ (সা:) এর আদর মাখা ডাক শুনে আ’ইশা (রা:) কাছে আসতেন তাকে জড়িয়ে ধরতেন, এরপর কবিতা পাঠ করে আল্লাহর রাসুলকে (সা:) শোনাতেন। এমনও হয়েছে আল্লাহর রাসুল (সা:) একবার আ’ইশার (রা:) দিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলেন, ‘তোমার চক্ষুদ্বয় কত্ত সাদা’! প্রিয় সহধর্মিণীকে এমন ভালো অর্থবোধক নামে ডাকতে পারেন, এতে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। একে অপরকে যতো বেশী কম্পলিমেন্ট দেয়া যায়, ঠিক ততো একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ধরে রাখতে সুবিধা হবে।

১৩) প্রিয় মানুষের জন্য নিজেকে সাজানঃ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন,‘আমি যেমন আমার জন্য স্ত্রীর সাজগোজ কামনা করি, অনুরূপ তার জন্য আমার নিজের সাজগোজও পছন্দ করি।’ অর্থাৎ যাবতিয় সাজসজ্জা যেনো কেবল প্রিয় মানুষকে খুশি করার জন্যই করা হয়, এতে পস্পরের প্রতি আগ্রহ জন্মাবে এবং একে অপরকে আরো অধিকভাবে কাছে টানতে পারবে। আমাদের দেশের নারীরা তো এক্ষেত্রে বলা চলে স্বামীর সামনে ছেঁড়া পুরোনো কাপড়ই পরিধান করে। অথচ এক্ষেত্রে উচিত সবচেয়ে বেস্ট পোশাক একে অপরের জন্য পরিধান করা।

১৪ সুগন্ধী ব্যবহার করাঃ আ’ইশা (রা) এর কাছে যেসব সুগন্ধি থাকত, সেগুলো থেকে উত্তম সুগন্ধি হজরত আ’ইশা (রা) রাসুলুল্লাহ (সা) কে লাগিয়ে দিতেন। সুগন্ধী আল্লাহর রাসুল (সা) এর প্রিয় ছিলো। তাই স্বামীদের উচিত তাদের স্ত্রীদের সম্মুখে সুগন্ধী ব্যবহার করা, এবং স্ত্রীদের উচিত তাদের স্বামীদের সম্মুখে নিজেকে রঙ দিয়ে সাজানো যা তাকে আকৃষ্ট করে।

 

১৫) বৈবাহিক সম্পর্কের গোপনীয়তা রক্ষা করাঃ সাংসারিক সমস্যা নিয়ে অন্যদের সাথে আলোচনা না করাই শ্রেয়। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে উপভোগ্য বিষয়গুলো গোপন করা। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে সর্ব-নিকৃষ্ট ব্যক্তি সে, যে নিজের স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় এবং যার সাথে তার স্ত্রী মিলিত হয়, অতঃপর সে এর গোপনীয়তা প্রকাশ করে বেড়ায়’। তাই এব্যাপারে খুব সতর্কতার সাথে ডিল করতে হবে। ভুলেও যেনো একে অপরের গোপনীয় কথা অন্যকে না বলা হয়। আমাদের সমাজে অধিকাংশ বিয়ে ভেঙ্গে যায় কেবল এই বিষয়ে অবহেলার কারনে।

১৬ স্ত্রীর পরিবার এবং আত্মীয়ের খবর নেয়াঃ নবীজি (সা) মাঝে মাঝে একটা ভেড়া জবাই করে বলতেন, “এই ভেড়ার মাংস খাদিজার বান্ধবীদের জন্য পাঠিয়ে দাও।” লক্ষ্য করুন, নবীজি যে কেবল খাদিজার জীবিত অবস্থায় এমন করেছেন তা নয় বরং তিনি তো খাদিজা (রা) মারা যাবার পরেও তাঁর বান্ধবীদের সাথে সৌহার্দ্য বজায় রেখেছেন। এটা তিনি করতেন খাদিজার প্রতি ভালোবাসা থেকে। আবু বকর (রা) একবার বলছিলেন, আমি তিনটি বিষয় খুব পছন্দ করি, এর মাঝে একটি হল-‘আমি মুহাম্মদের শ্বশুর…’ উক্ত কথা দ্বারা এটাই প্রমান করে আল্লাহর রাসুল (সা) শ্বশুর বাড়ির লোকেদের কেমন মহব্বত করতেন, এবং কতোটা আপন করে নিয়েছিলেন। তাই স্বামীদের উচিত স্ত্রী পক্ষের আত্মীয়ের এবং পরিবারের দেখাশোনা করা, এবং স্ত্রীর উচিত স্বামীর পরিবারের এবং আত্মীয়ের দেখভাল করা। তবেই একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পাবে এবং ভালোবাসা অটুট থাকবে। # রসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম যে তার স্ত্রীর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে। আমি আমার স্ত্রীদের সাথে সবার চাইতে ভাল ব্যবহার করি। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং-১০৮২)

১৭) দোষ না ধরা: খাবারের ব্যপারে দোষ ধরতেন না, পছন্দ হলে খেতেন,না হলে রেখে দিতেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো বিছানার ব্যাপারে দোষ ধরতেন না, যা পেতেন তার উপরই শুয়ে থাকতেন। (আদাবু নবী)

১৮) সালাম বিনিময় করা আয়েশা (রাঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত খুশি মনে মুচকি হাসতে হাসতে গৃহে প্রবেশ করতেন এবং হৃদয়পূর্ণ সালাম দিতেন। (উসওয়ায়ে হাসানাহ)

১৯) কোমলতা প্রদর্শন আয়েশা (রাযিঃ) থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “নিশ্চয় আল্লাহ দয়ালু, তিনি কোমলতাকে পছন্দ করেন। তিনি কোমলতার বিপরীতে দেন যা তিনি সহিংসতার বিপরীতে দেন না, কোমলতা ব্যতীত অন্য কিছুর বিপরীতে দেন না।” [সহীহ মুসলিম] আয়েশা (রাযি:) থেকে আরেকটি হাদিসে এসেছে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “নিশ্চয় আল্লাহ কোমলতাপূর্ণ, তিনি সকল বিষয়ে কোমলতাকে পছন্দ করেন।” বুখারি ও মুসলিম। জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযি:) থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, “যাকে কোমলতা থেকে বঞ্চিত করা হল তাকে সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত করা হল।” [সহীহ মুসলিম]

 

 

নবিজি বিবিদের ভৎসনা, তিরস্কার করতেন না এবং তাদের সাথে রুক্ষ্ম ভাষায় কথা বলতেন না। বরং মায়া জড়ানো, মন জুড়ানো আকর্ষণীয় কথা ও ভাবভঙ্গি দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন। তাদের কোন কথা মনের বিপরীত হলে তাদের সে কথা থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে অন্য চিন্তা করতেন । ইমাম আহমদ আয়েশা (রাযি:) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার তাকে খেতাব করে বলেছেন, হে আয়েশা! তুমি কোমলতা অবলম্বন করো; কেননা আল্লাহ তাআলা যখন কোনো পরিবারের কল্যাণ চান তখন তাদেরকে কোমলতার পথ দেখান, অন্য এক বর্ণনা মতে- আল্লাহ যখন কোনো পরিবারের কল্যাণ চান, তিনি তাদের মধ্যে কোমলতার প্রবেশ ঘটান।” [মুসনাদে আহমদ]

উক্ত সুন্নাতি কাজগুলো যদি বিয়ের পুর্বে একজন পুরুষ এবং নারী চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন, তবে বিয়ের পরবর্তী মুহূর্তগুলো কাটবে চমকপ্রদ। আমৃত্যু সুকুনের সাথে বসবাস করে যেতে পারবেন, যার শেষ গন্তব্য হবে আল-জান্নাত। আল্লাহ আমাদের আমলগুলোকে আরো সুন্দর করে দিক, এবং আমাদের মাঝে যারা অবিবাহিত তাদের দ্রুত বিবাহ সম্পাদিত হওয়ার তৌফিক দিক। আমিন।

বিঃদ্রঃ — অনেক স্বামী ও স্ত্রী বলে থাকেন ভালোবাসা মনের ব্যপার প্রকাশ করতে হবে কেন??? তারা বলেন ভালোবাসা প্রকাশ করা নাকি বোকামি ও ন্যাকামি, ভালোবাসা একে অপরের মধ্য প্রকাশ করলে নাকি দাম বেড়ে যায় ও ভালোবাসা কমে যায়। যারা এই ধরনের কথা বলেন তাদের বলবো তাদের ইসলামিক জ্ঞানের অভাব।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালেবাসা বৃদ্ধির জন্য নবিজি নিজেই ভালোবাসা প্রকাশ করতে বলেছেন ও বাস্তবে করে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। বিয়ের আগে প্রেমিক ও প্রেমিকারা এতোই বেশী ভালোবাসা প্রকাশ করে, আবার সেই প্রেমিক ও প্রেমিকা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে বা তারা অন্য কাউকে বিয়ে করলে আর ভালোবাসা প্রকাশ করার ইচ্ছা থাকে না। তখন দাম্পত্য জীবনে প্রকৃত সুখ অর্জিত হয় না। কারন বিয়ের পর ভালোবাসা প্রকাশ আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও রহমত অর্জিত হয়।

আর বিয়ের আগে ভালোবাসা প্রকাশ আল্লাহর অভিশাপ, অসন্তুষ্টি ও ক্রোধ অর্জিত হয়। একারনে বিয়ের আগে পুরুষ ও নারীর হারাম সম্পর্কের ভালোবাসা প্রথমে বাড়লেও পরবর্তীতে স্থায়ীত্ব লাভ করতে সক্ষম হয় না। এটা হলো বাস্তব ও পরীক্ষিত সত্য।

সেই প্রেমিক ও প্রেমিকারা যখন বিয়ে করে বিয়ের পর তখন ভালোবাসা প্রকাশ না করার কারনে ও টান না থাকার কারনে ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকে ও বলে থাকে আগেতো অনেক ভালোবাসার কথা বলতে এখন আমাকে বলো না,এখন আমাকে ভালোবাসো না।

যখন কোন ছেলে-মেয়ে বিয়ের আগে চরিত্র নষ্ট করে নাই ও প্রেমে কখনো জড়ায় নাই। বিয়ের পর তাদের (প্রেমে জড়ায় নাই ছেলে-মেয়ের ) ভালোবাসার সাথে বিয়ের আগে প্রেমে জড়িত ছেলে-মেয়ের ভালোবাসার সাথে মিলে না। আমাদের বিবাহিত বোন-ভাইদের তৌফিক দান করুন । আর যারা বিয়ে করে নাই তাদের কে বিবাহিত হওয়ার তৌফিক দান করুন । আমীন ।


garantili takipçi satın al


türk instagram takipçi satın al

আযানের পাঁচ সুন্নাহ – একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে: ৩

একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে:৩
আযানের পাঁচ সুন্নাহ

এক: আযান দেয়া অনেক বড় ফযীলতপূর্ণ সুন্নাত। এটা শুধু মুয়াযযিনদের ওপরই সুন্নাত নয়, সবার জন্যেই এই সুন্নাত।

দুই: আযানের ধ্বনি কানে এলে, প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে পাঁচটা আমল করার সুযোগ তৈরী হয়।
এক: আযানের উত্তর দেয়া। নবিজী (সা.) বলেছেন:
-তোমরা যখন আযান শুনবে, মুয়াযযিন যা বলে, সাথে সাথে তোমরাও তা বলো।
= তবে হাইয়া আলাস-সালাহ ও হাইয়া আলাল ফালাহ-এর উত্তরে ‘লা হাওলা ওয়ালা কুউয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলতে হবে।

দুই: আযান শেষ হলে, নবিজীর (সা.) ওপর দুরূদ পাঠ করাও সুন্নাত। নবিজী (সা.) বলেছেন:
-অতঃপর তোমরা আমার ওপর দুরূদ পাঠ করো। কেননা যে আমার ওপর একবার দুরূদ পাঠ করে, আল্লাহ তা‘আলা তার ওপর দশবার দুরূদ পাঠ করেন।

তিন: নবিজীর (সা.) জন্যে উসীলা চাওয়া। তিনি বলেছেন:
-অতঃপর তোমরা আমার জন্যে আল্লাহর কাছে উসীলা প্রার্থনা করো। কেননা তা জান্নাতের একটি মনযিল। সেই মনযিলে শুধুমাত্র আল্লাহর এক নির্দিষ্ট বান্দাই যেতে পারবে। আর আশা করি, আমিই সেই বান্দা। যে আমার জন্যে উসীলা চাইবে, তার জন্যে সুপারিশ করা আমার জন্যে জরুরি হয়ে পড়বে।

চতুর্থ: কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করা। আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি আমাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করা। নবিজী (সা.) বলেছেন:
-যে আযান শুনে বলবে: আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু। রাদীতু বিল্লাহি রাব্বাওঁ ওয়া বিমুহাম্মাদিন রাসূলান ওয়া বিলইসলামি দীনান
=তার গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।

পাঁছ: আমরা ইচ্ছেমতো দু‘আ করবো। আল্লাহ চাহেন তো এই দু‘আ কবুল হবে। এক লোক বললো:
-ইয়া রাসুলাল্লাহ! মুয়াযযিনারাতো আমাদের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে!
-তারা যা বলে, তুমিও তাই বলো। যখন সবকিছু বলা শেষ করবে, আল্লাহর কাছে চাও, তোমাকে দিয়ে দেয়া হবে।

আমাদের শি‘আর (স্লোগান) হলো:
– ইন তুতীঊহু তাহতাদু (وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا): যদি তার (নবিজীর) অনুসরণ করো, হিদায়াত পেয়ে যাবে (নূর:৫৪)।

=ইয়া আল্লাহ! আমল করার তাওফীক দান করুন। অামীন।

================
লেখক – শাইখ মুহাম্মদ আতিক উল্লাহ্‌
শিক্ষক – মাদরাসাতুল কুরআনিল কারীম,
শ্যামলী,ঢাকা।


একটি সুন্নাহকে বাঁচাব বলে সিরিজ

পর্ব ০১ – তাহলীলের সুন্নাহ
পর্ব ০২ –অন্যকে আহার করানো
পর্ব ০৩ – আযানের পাঁচ সুন্নাহ
পর্ব ০৪ – ইলম তলব করা
পর্ব ০৫ – মিলিয়ে দেয়া
পর্ব ০৬ – দ্রুত ইফতার করা

 

 


Ayrıca Muroosmm.com ile instagram hesapların için satın alabileceğiniz instagram ucuz takipçi paketlerini sipariş et!


türk takipçi satın al instagram


yeni eskisehir escort bayanlar

নবী নামের প্রতি সম্মান ঈমানের অংশ

আল্লাহর বান্দাদের উপর আল্লাহর নবী খাতামুন্নাবিয়ীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক হক রয়েছে। সবচেয়ে বড় হক হল তাঁর প্রতি অন্তর থেকে ঈমান আনা এবং পিতামাতা, সন্তান-সন্ততি এমনকি নিজ প্রাণের চেয়েও অধিক তাঁর প্রতি মহববত রাখা। তাঁর যথাযথ সম্মান করা এবং অনুসরণ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল দ্বীনী আকীদাকে অন্তর থেকে বিশ্বাস করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতি সত্যিকারের মহববত আর যথাযথ তা‘জীম ও সম্মান হচ্ছে ঈমানের জন্য অপরিহার্য।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু শিক্ষার নিছক অনুসরণ ঈমানদারীর জন্য যথেষ্ট নয়। পশ্চিমা দুনিয়াও তাদের পার্থিব স্বার্থে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক শিক্ষা অনুসরণ করে থাকে। এমন অনুসরণ কখনো যথেষ্ট নয়। বরং তাঁর শর্তহীন আনুগত্য মেনে নেওয়া, তাঁর আদব-ইহতিরাম এবং মহববত ও ভালোবাসা হচ্ছে ফরয এবং ঈমানের অপরিহার্য অংশ। এটা ছাড়া ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়।

এ প্রসঙ্গে মনে রাখার মতো একটি সংক্ষিপ্ত কথা এই যে, আল্লাহকে ভালোবাসার মানদন্ড আল্লাহ নিজেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বানিয়েছেন। কেউ যদি আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে চায় তবে এর একমাত্র পথ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মহববত রাখা এবং তাঁর আনুগত্য অবলম্বন করা। এ মানদন্ডে উত্তীর্ণ হওয়া ছাড়া আল্লাহকে ভালোবাসার দাবি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ

মুমিনের হৃদয়ে নবী-মহববত কী পরিমাণ থাকা উচিত-এ প্রশ্নের উত্তর খোদ কুরআন মজীদে এসেছে-

النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ

অর্থাৎ নবীর সঙ্গে ঈমানদারের প্রাণেরও অধিক সম্পর্ক। তিনি তাদের সত্তা থেকেও তাদের কাছে অগ্রগণ্য। (সূরা আহযাব : ৬)

মুমিনের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মুমিনের যে সম্পর্ক তার প্রকৃতিই ভিন্ন, মাহাত্ম্যই আলাদা। এই সম্পর্কের সঙ্গে পার্থিব কোনো সম্পর্কের কোনো তুলনাই হতে পারে না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানদারের জন্য তার পিতামাতার চেয়েও অধিক মেহেরবান আর তার নিজের চেয়েও অধিক কল্যাণকামী।

উম্মতের ঈমানী ও রূহানী অস্তিত্ব নবীর রূহানিয়াতেরই অবদান। যে মমতা ও প্রতিপালন নবীর পক্ষ থেকে উম্মত লাভ করেছে এর কোনো নমুনা গোটা সৃষ্টি-জগতের মধ্যেও পাওয়া যাবে না। পিতামাতা এর দৃষ্টান্ত হতে পারেন না। পিতার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে দান করেছেন দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন আর নবীর মাধ্যমে হাসিল হয় চিরস্থায়ী ‘হায়াত’।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের এরূপ সহানুভূতি ও কল্যাণকামিতার সঙ্গে প্রতিপালন করে থাকেন যে সহানুভূতি ও কল্যাণকামিতা আমাদের নিজ সত্তার পক্ষেও সম্ভব নয়। স্ত্রী-সন্তান এমনকি পিতামাতাও অজ্ঞতা বা অসচেতনতার কারণে কখনো আমাদের ক্ষতির কারণ হতে পারে, ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে, কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে সর্বদা ওই পথই দেখিয়ে থাকেন, যে পথে রয়েছে তাদের প্রকৃত সফলতা।

মানুষ নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করে, নির্বুদ্ধিতার কারণে নিজের ক্ষতি সাধন করে, কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে ওই নির্দেশই দান করেন যাতে বাস্তবিকই তার কল্যাণ রয়েছে। এজন্য উম্মতের উপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হক্ব প্রতিষ্ঠিত যে, তাঁকে নিজের পিতামাতা, স্ত্রীসন্তান এবং প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবাসবে। নিজের মতামতের উপর তাঁর মতামতকে এবং নিজের সিদ্ধান্তের উপর তাঁর সিদ্ধান্তকে অগ্রগণ্যতা দেবে। আর তাঁর আদেশকে শিরোধার্য করবে।

আমাদের জান-মাল সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এরূপ অধিকার রয়েছে, যা পৃথিবীতে আর কারো নেই। শাহ আব্দুল কাদের দেহলভী রহ.-এর ভাষায়- ‘নবী আল্লাহর নায়েব। ব্যক্তির জান-মালের উপর তার নিজেরও অতখানি কর্তৃত্ব নেই যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রয়েছে। নিজেকে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা বৈধ নয়, কিন্তু নবী যদি আদেশ দেন তবে তা ফরয হয়ে যায়।’

উল্লেখিত আয়াতে কারীমার মর্মবাণী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে এভাবে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা ও সন্তানের চেয়ে, সকল মানুষের চেয়ে, এমনকি তাঁর প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয় না হই। -সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৬৩২; সহীহ মুসলিম ১/৪৯

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তা‘জীম

বড়কে সম্মান করা একটি স্বতঃসিদ্ধ এবং সর্বজনস্বীকৃত বিষয়। ইসলামও বড়দের সম্মান করার এবং আলিমদের শ্রদ্ধা করতে গুরুত্বের সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছে। তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যাঁকে আল্লাহ সৃষ্টিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের মাকাম দান করেছেন দুনিয়াতে এবং আখিরাতে, আর যাঁকে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামসহ সকল বনী আদমের সাইয়েদ ও সরতাজ বানিয়েছেন, রাববুল আলামীনের পর জগৎবাসীর উপর যাঁর অনুগ্রহই সর্বাধিক, স্বয়ং রাববুল আলামীন যাঁকে রাহমাতুল্লিল আলামীন ও খাতামুন নাবিয়ীন উপাধীতে ভূষিত করেছেন তাঁর তা‘জীম ও সম্মান যে গোটা মানবজাতির জন্য ফরয ও অপরিহার্য হবে তা তো বলাই বাহুল্য।

এখানে যে কথা বলতে চাই তা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সম্মান ও তা‘জীমের বিষয়কে আল্লাহ তাআলা শুধু বড়দের সম্মান করার সাধারণ আদেশের মধ্যেই ছেড়ে দেননি; বরং তাঁর তা‘জীম-সম্মানের বিষয়ে বিশেষ বিশেষ বিধান নাযিল করেছেন। তাঁর আদব-ইহতেরাম আল্লাহ এমন অপরিহার্য করেছেন যে, এটা ছাড়া কারো ঈমান তাঁর দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়।

এমন সকল কথা-কাজ, আচার-আচরণ আল্লাহ তাআলা হারাম করেছেন এবং লা‘নত ও অভিশাপের কারণ সাব্যস্ত করেছেন যা নবীকে কষ্ট দেয়। আদব-ইহতিরামের যে বিষয়গুলোতে মানুষ কখনো অসচেতন হতে পারে সেগুলো সম্পর্কে কুরআনী আয়াতে স্পষ্ট নির্দেশ দান করেছেন আর তা পালনে যত্নবান হতে আদেশ করেছেন। আর সাবধান করে দিয়েছেন, এর অন্যথা হলে আশঙ্কা রয়েছে যে, সকল আমল বিনষ্ট হবে।’ -সূরা আ‘রাফ ১৫৭; সূরা ফাত্হ ৯; সূরা হুজুরাত ১-৫; সূরা নূর ৬৩; সূরা আহযাব ৫৩, ৫৬-৫৮; সূরা তাওবা ৬১; সূরা বাক্বারা ১০৪; সূরা নিসা ৪৭

মহববত এবং তা‘জীমের বিষয়টি শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহববত ও তা‘জীমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাঁর সঙ্গে যাদের বিশেষ সম্পর্ক আর যে জিনিসগুলো তাঁর সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত তাদের সঙ্গেও মুমিনের ভালোবাসার সম্পর্ক হওয়া জরুরি। প্রেম-ভালোবাসার ধর্ম হচ্ছে প্রিয়জনের যা কিছু প্রিয় তার সঙ্গেও ভালোবাসা হবে। তাহলে নবীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সকল কিছুর সঙ্গে মহববতের সম্পর্ক কায়েম হওয়া নবী-

মহববতের স্বাভাবিক দাবি, আর শরীয়তও এর তাকীদ করেছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামের তা‘জীম

যে কোনো মানুষের নামই তার স্বত্তার পরিচয় বহন করে থাকে। সে নাম ধরেই তাকে স্মরণ করা হয় আবার সে নামেই সে পরিচিতি লাভ করে। এ জন্য কারো নাম তার সত্তা থেকে ভিন্ন কিছু নয়। নামের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন মূলত ব্যক্তির প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন। অনুরূপভাবে কারো নামের প্রতি বিরূপভাব ও অবজ্ঞা প্রকাশ মূলত ব্যক্তিরই প্রতি বিরূপ ও অবজ্ঞার শামিল।

শরীয়ত যে কোনো বস্ত্ত বা ব্যক্তির নাম সম্পর্কে বহু আহকাম প্রদান করেছে। এ সম্পর্কে কুরআনে হাকীমের একাধিক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। আর হাদীসের কিতাবসমূহে তো এ সম্পর্কে এক বড় ও স্বতন্ত্র অধ্যায়ই বিদ্যমান রয়েছে। নাম সম্পর্কিত শরয়ী আহকামসমূহের মধ্যে একটি হলো এই যে, কোনো নামেরই বিকৃতি ঘটানো যাবে না এবং তা নিয়ে বিদ্রূপও করা যাবে না। তবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামের ব্যাপারটি সাধারণ এ হুকুম থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও বহু ঊর্ধ্বে।

কেননা, তাঁর নামের বিষয়টি হলো সরাসরি দ্বীন ও ঈমানের বিষয় এবং ইসলামের শিআর ও নিদর্শন। এ নামের তা‘জীম করেছেন স্বয়ং আল্লাহ রাববুল আলামীন, তাঁর ফেরেশতাগণ এবং তিনি নিজেই এ নামের তা‘জীমের নির্দেশ প্রদান করেছেন।

আর এর চেয়ে বড় কথা আর কী হতে পারে যে, আল্লাহ তাআলা কালেমায়ে তাওহীদ, কালেমায়ে শাহাদাত, যা ঈমানের কালেমা ও শিআরে ইসলাম, তাতে নিজের নামের সঙ্গে রাসূলের নাম যুক্ত করেছেন। আযানে ও নামাযের তাশাহহুদে প্রিয়তমের নামও শামিল করেছেন। সূরা ‘আলাম নাশরাহ’-এর আয়াতের

وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

‘আর আমি আপনার আলোচনা সমুচ্চ করেছি’ এই ইলাহী ইকরামের কথা বলা হয়েছে। আমরা কি কখনো ভেবেছি, প্রতিদিন পাঁচবার কত লক্ষ মসজিদের মিনারে মিনারে ধ্বনিত হয় ‘আল্লাহু আকবার’। আর তারই সঙ্গে ধ্বনিত হয় ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’র সুমধুর ধ্বনি। কিংবা এভাবেও কি ভেবেছি যে, যে নামের কালেমা পাঠ করে মানুষ ঈমানদার হয় আর যে নামের কালেমা অস্বীকার করে ঈমান হারায় তার মাহাত্ম্য কতখানি। এ নামের সঙ্গে সামান্যতম বেআদবী কত বড় অপরাধ। বলাবাহুল্য, এটা এমন কোনো অস্পষ্ট বিষয় নয় যা বোঝানোর প্রয়োজন হতে পারে।

আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম মোবারকের তা‘জীমের আরেকটি দৃষ্টান্ত এই যে, তাঁর নাম উচ্চারিত হলে দরূদ পাঠের আদেশ করেছেন এবং জিব্রীলের আ. যবানীতে এই বদদুআ করিয়েছেন যে, ‘যার সামনে হাবীবে পাকের আলোচনা হয়, অথচ সে দরূদ পড়ে না তার বিনাশ হোক।’

এরপর বদদুআর উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবানে আমীন বলিয়েছেন। -সহীহ ইবনে খুযাইমা, সহীহ ইবনে হিববান, দেখুন আলকাওলুল বাদী পৃ. ২৯২-২৯৮

আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের কোথাও তাঁর হাবীবকে নাম ধরে সম্বোধন করেননি। অন্য বান্দাদের আদেশ করেছেন, তারা যেভাবে নিজেদের মধ্যে একে অপরকে নাম ধরে কিংবা পারিবারিক, বংশীয় বিভিন্ন সম্পর্কের ভিত্তিতে সম্বোধন করে থাকে।’ সেভাবে যেন রাসূলকে সম্বোধন না করে।-সূরা নূর : ৬৩

আর এটা বাস্তব যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা সম্পর্কে তিনিই সবচেয়ে বেশি অবগত, যিনি তাঁর স্রষ্টা এবং যিনি তাঁকে এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছেন। রাসূলের উম্মতী যতই তাঁর মাহাত্ম্য বয়ান করুক শেষে অক্ষমতা স্বীকার করে বলতে হয়-

دامن نگہ تنگ وگل حسن تو بسيار

گلچيں تو از تنگئى دامن گلہ دارد

ভাবনার আস্তীন খাটো কিন্তু সৌন্দর্যের ফুল অনেক, কিংবা বলতে হবে-

بعد از خدا بزرگ توئى قصہ مختصر

খোদার পরেই তোমার মকাম।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু’টি নাম

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেকগুলো গুণবাচক নাম রয়েছে। তবে তাঁর ব্যক্তি নাম দু’টি। ‘মুহাম্মাদ’ ও ‘আহমদ’। উভয় নামের মূল ধাতু এক, ‘হামদ’। এটি প্রশংসা, সম্মান, শোকর ইত্যাদি অর্থ প্রকাশ করে।

এ বিষয়গুলোর প্রকৃত হক্বদার হলেন আল্লাহ তাআলা। সকল প্রশংসা একমাত্র তাঁরই জন্য। যে সব গুণ  বা বৈশিষ্ট্যের উপর কারো প্রশংসা করা হয় তা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই প্রশংসা। কেননা, আল্লাহই তাঁকে নিজ অনুগ্রহে সে কাজের তাওফীক দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলার ‘আসমায়ে হুসনা’র মধ্যে একটি হচ্ছে ‘হামীদ’। এরও মূল ধাতু  ‘হামদ’। অর্থাৎ যে সত্তা চির প্রশংসিত, যিনি সকল প্রশংসার প্রকৃত অধিকারী, যেখানে যারই প্রশংসা করা হোক তা তাঁরই প্রশংসা।

আল্লাহ তাআলা তাঁর পাক নাম ‘হামীদ’ থেকে নির্গত দুই নাম ‘মুহাম্মাদ’ ও ‘আহমদ’কে তার হাবীবের নাম বানিয়েছেন। ‘মুহাম্মাদ’ অর্থ ‘অতি প্রশংসিত’। আর ‘আহমদ’ শব্দের অর্থ দু’টি-এক অর্থ অনুযায়ী তা ‘মুহাম্মাদ’-এর সমার্থক অর্থাৎ অতি প্রশংসিত। আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে ‘সর্বাধিক প্রশংসাকারী’।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম ‘মুহাম্মাদ’ কেন? এজন্য যে, তিনি আল্লাহর কাছে প্রশংসিত, ফেরেশতাদের মাঝে প্রশংসিত, পৃথিবীবাসীর নিকটে প্রশংসিত, যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে তাদের কাছে প্রশংসিত, এমনকি যারা ঈমান আনেনি তাদের কাছেও তিনি তাঁর গুণ ও মাহাত্ম্যের, চরিত্র ও মহানুভবতার কারণে প্রশংসিত। সৃষ্টির মধ্যে যাঁর প্রশংসা সবচেয়ে বেশি করা হয়েছে আর জগৎ-সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে আজ পর্যন্ত যাঁর প্রশংসা অব্যাহত রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে তিনি হলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর নাম ‘মুহাম্মাদ’ তিনি প্রশংসিত। আর প্রশংসা, হামদের সঙ্গেই তাঁর চিরন্তন সম্পর্ক। ময়দানে হাশরে যে স্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি শাফায়াত করবেন সে স্থানের নাম ‘মাকামে মাহমূদ’। সেদিন ‘লিওয়ায়ে হামদ’- প্রশংসার ঝান্ডা তাঁর মুবারক হস্তেই উড্ডীন থাকবে।

তিনি মুহাম্মাদ, কুল মাখলুক তাঁর প্রশংসাকারী। তিনি আহমদ, স্রষ্টার প্রশংসায় সবার চেয়ে অগ্রগামী। মরুভূমির বালুকারাশি আর আসমানের মেঘমালা যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত তার চেয়েও অধিক বিস্তৃত করেছেন তিনি রাববুল আলামীনের হামদ ও ছানা। (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মানিত নামসমূহের ব্যাখ্যা ও মর্ম জানার জন্য দেখুন ‘রহমাতুল লিল আলামীন’ মাওলানা মুহাম্মাদ সুলায়মান মানসুরপুরী, খ. ৩ পৃ. ১৪-১৫, ১৭৮-১৯৮)

এ নামের সঙ্গে উম্মতের প্রীতি ও ভালোবাসা

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগে আরব ভূখন্ডে কিংবা পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে কারো নাম ‘আহমদ’ রাখা হয়নি। মুহাম্মাদ নামটিও তাঁর আগমনের আগে প্রসিদ্ধ ছিল না। তাঁর আবির্ভাবের নিকটবর্তী সময়ে তাঁর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণীর ভিত্তিতে কেউ কেউ তাদের সন্তানের নাম ‘মুহাম্মাদ’ রেখেছিল। এদের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে পাঁচ-সাত জন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর লোকেরা আদরের সন্তানের নাম মুহাম্মাদ বা আহমদ রাখা সৌভাগ্যের বিষয় মনে করেছে। মুহাম্মাদ নামের অনেক মানুষের নাম-ধাম, কীর্তি ও অবদান ইতিহাসের পাতায় এখনো সংরক্ষিত রয়েছে। উম্মতের যে শ্রেণী ইলমে দ্বীনকে ধারণ করেছেন ও বর্ণনা করেছেন তাদের জীবন ও কর্মের ইতিহাস সংরক্ষণ করার জন্য মুসলিমগণ এমন এক ‘শাস্ত্র’ উদ্ভাবন করেছেন, যা কমবেশি চল্লিশটি শাখায় বিস্তৃত।

এ শাস্ত্রের নাম ‘ইলমু আসমাইর রিজাল’। এ শাস্ত্রের অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ হচ্ছে, ‘তাকরীবুত তাহযীব’। এতে সাহাবী যুগ থেকে হিজরী তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালের হাজারো মনীষীদের মধ্য থেকে একটি সংক্ষিপ্ত জামাতের আলোচনা স্থান পেয়েছে। এতে ‘মুহাম্মাদ’ নামের সাতশ’রও অধিক আর ‘আহমদ’ নামের শতাধিক ব্যক্তির আলোচনা এসেছে। এরা সবাই ছিলেন কুরআন-সুন্নাহর আলিম। তাঁদের অনেকেই হলেন সাহাবী, তাবেয়ী এবং উম্মাহর বিশিষ্ট ইমাম।

ইমাম বুখারী রহ. (১৯৪-২৫৬ হিজরী)-এর ‘আততারীখুল কাবীর’ হচ্ছে ইলমু আসমাইর রিজালের মাঝারি মাপের গ্রন্থ, তাতে ‘মুহাম্মাদ’ নামের আটশত একাত্তর জন ব্যক্তির আলোচনা রয়েছে। ইমাম বুখারী রহ. এ কিতাবের ভূমিকায় লেখেন, ‘এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের নাম আমি বিন্যস্ত করেছি বর্ণানুক্রমিকভাবে। তবে নিয়মের ব্যতিক্রম করে ‘মুহাম্মাদ’ নামের ব্যক্তিদের আমি সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছি। কেননা, এ নাম আমাদের নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম।’

وإنما بدئ بمحمد من حروف ا، ب، ت ، ث، لحال النبي صلى الله عليه وسلم، لأن اسمه محمد صلى الله عليه وسلم، فإذا فرغ من المحمدينابتدئ في الألف ثم الباء.

এটা শুধু ইমাম বুখারী রহ.-এরই নীতি নয়, আরো অনেক গ্রন্থকার তাঁদের গ্রন্থ বর্ণানুক্রমিক বিন্যস্ত করার পরও ‘মুহাম্মাদ’ ও ‘আহমদ’ এই দুই নামের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করেছেন এবং এ দুই নামকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন।

হিজরী অষ্টম শতাব্দীর প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুয়াররিখ (জীবনীকার) আব্দুল কাদের কুরাশী (৭৭৫ হি.) ‘আলজাওয়াহিরুল মুযীআ’তে লেখেন, ‘সমরকন্দের শহর ‘জাকরদীযাহ’তে একটি কবরস্থান আছে যার নাম ‘তুরবাতুল মুহাম্মাদীন’। অর্থাৎ ‘মুহাম্মাদ নামীয় উলামা-ফুকাহার কবরস্থান’। এখানে এমন চারশ উলামা-ফুকাহা সমাহিত আছেন যাঁদের প্রত্যেকের নাম মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ।’ অর্থাৎ তাঁর নামও মুহাম্মাদ, পিতার নামও মুহাম্মাদ।

হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ইমাম আবুল হাসান আলমারগিনানী (৫৯৩ হি.) যাঁর রচিত গ্রন্থ ‘আলহিদায়া’ সুবিখ্যাত ও সর্বজনসমাদৃত, ইন্তেকালের পর তাঁকে সমাহিত করার জন্য ওই কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু কবরস্থানের দায়িত্বশীলরা বিনয়ের সঙ্গে বলে দেন যে, ‘হযরতের নাম তো মুহাম্মাদ নয়।’ পরে নিকটবর্তী একস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

মোটকথা, এ নামের সঙ্গে মুসলমানের হৃদয়ের সম্পর্ক সাহাবী-যুগ থেকে আর তা কিয়ামত পর্যন্ত অটুট থাকবে ইনশাআল্লাহ। অনেক ভাগ্যবান পিতা রয়েছেন যারা তাদের সকল

সন্তানের নাম ‘মুহাম্মাদ’ রেখেছেন। এরপর পার্থক্যের জন্য নামের সঙ্গে আওয়াল (প্রথম) ছানী (দ্বিতীয়) যোগ করেছেন।

পাক-ভারত-বাংলা অঞ্চলের মুসলিমদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম থেকে বরকত হাসিলের দু’টি পন্থা প্রচলিত আছে। সন্তানের নাম মুহাম্মাদ রাখা কিংবা অন্য নাম রাখা হলেও নামের শুরুতে ‘মুহাম্মাদ’ শিরোধার্য করা। আমাদের এ অঞ্চলে দ্বিতীয় পদ্ধতিই অধিক প্রচলিত।

ইসলামের দুশমনদের এ নামের প্রতি দুশমনী

মুসলিম সমাজে ক্রমবর্দ্ধমান ঈমানী দুর্বলতার কারণে যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহববতের হক আদায় হয় না। তবুও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তারা নবী মুহাম্মাদ-এর মুহাববত অন্তরে ধারণ করেন। এই মহববতেরই বহিঃপ্রকাশ যে, তারা বরকতের জন্য নবীয়ে পাকের পবিত্র নাম তাদের নামের সঙ্গে শিরোধার্য করেন। যদিও সামান্য তবুও তা রাসূলের সঙ্গে সম্পর্ক। এ সম্পর্কটুকুও একশ্রেণীর ইসলামবিদ্বেষীর গাত্রদাহের কারণ হয়ে যায়। এই পাক নামের চর্চা ও প্রচলন তাদের মর্মপীড়া উৎপাদন করে। কিন্তু ইলাহী ঘোষণা যখন এই-

وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

তখন তাদের সকল বিদ্বেষ যে শুধু তাদেরকেই দগ্ধ করে যাবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

দু’মাস আগে একটি দৈনিক  পত্রিকার সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে যে কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল তা ওই বিদ্বেষ ও অন্তর্জবালারই একটি দৃষ্টান্ত। সে সময় ওই কাজের উপর চতুর্দিক থেকে সমালোচনা হয়েছে এবং সকল শ্রেণীর মানুষ এর প্রতিবাদ করেছেন। ওই পত্রিকার কর্তৃপক্ষ ক্ষমাপ্রার্থনা করতে বাধ্য হয়েছে। সে সময় জুমার বয়ানে এবং বিভিন্ন প্রশ্নকারীর প্রশ্নের উত্তরে যা বলা হয়েছিল তার মধ্যে থেকে কিছু কথা আলকাউসারের পাঠকদের সামনে পেশ করছি।

১. শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘শাআয়েরে ইসলামে’র বিষয় অত্যন্ত সংবেদনশীল। এ বিষয়গুলোর সম্মান ঈমানের প্রধান দাবিগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর মধ্যে কোনো একটি সম্পর্কেও সামান্য তাচ্ছিল্য ও অসম্মান ঈমান নষ্ট করে দেয়। কেননা, এ বিষয়টি সর্বসম্মত যে, ‘শাআইর’-এর সম্মান ঈমানের পরিচায়ক আর তার কোনো একটির সামান্য অসম্মান, তাচ্ছিল্য মুনাফিকী ও ইসলামবিদ্বেষের দলীল। শাআয়েরের মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ক. কুরআনে কারীম

খ. রাসূলে কারীম

গ. কালেমায়ে ইসলাম

ঘ. ইসলামের ইবাদতসমূহ। যথা : নামায, হজ্ব, রোযা, যাকাত, দুআ, দরূদ ইত্যাদি।

ঙ. বিশেষ ফযীলতপূর্ণ স্থানসমূহ। যথা : বায়তুল্লাহ, মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী, মসজিদে আকসা অতঃপর অন্যান্য মসজিদসমূহ।

২.  আমলে শিথীলতা অবশ্যই অপরাধ কিন্তু যদি ঈমান-আকীদা বিশুদ্ধ হয়, ‘শাআয়েরে ইসলামে’র সম্মান করে, গুনাহ হয়ে গেলে নিজেকে অপরাধী মনে করে তবে এই অপরাধ আল্লাহ তওবা ছাড়াও মাফ করতে পারেন। গাফলতী ও অলসতার কারণে যদি কোনো ফরয ছুটে যায় তবুও মানুষ ঈমানের গন্ডি থেকে খারিজ হয় না, কিন্তু অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের বিষয়টি অতি মারাত্মক। ফরয আমলের কথা তো বলাই বাহুল্য, কেউ যদি দ্বীনের কোনো মুস্তাহাব আমল, কোনো ছোট খাট বিষয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো ছোট সুন্নতের দিকেও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকায়, সে সম্পর্কে কোনো অবজ্ঞাসূচক বাক্য ব্যবহার করে কিংবা এমন কোনো আচরণ করে, যা অবজ্ঞা প্রকাশক তাহলে এটা সুস্পষ্ট কুফরী। এ থেকে প্রমাণ হয়, ওই লোকের অন্তরে ঈমান নেই, তার অন্তর দ্বীনের মাহাত্ম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহববত থেকে একেবারে শূন্য।

আর শাআয়েরে ইসলামের মধ্যে সামান্য কোনো বিষয়ের সঙ্গেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য যে ইরতেদাদ বা ইসলাম থেকে খারিজ হওয়ার কারণ তা সর্বজনবিদিত। ‘শাআয়েরে ইসলামে’র মর্যাদাহানী, ইসলামের নবীর সঙ্গে মশকরা, তার নামের সঙ্গে ঠাট্টা-বিদ্রূপ, ইসলামের কেন্দ্র বায়তুল্লাহর সঙ্গে বিদ্রূপ এরপর আবার ইসলামের দাবি!

৩. সে সময় যখন চারদিক থেকে প্রতিবাদ হচ্ছিল তখন একজন সাদাসিধা ভাল মানুষ বললেন যে, কাফের, মুশরিক, ইয়াহুদী, নাসারা এবং বেদ্বীন লোকেরা তো এমন করবেই, তাদের তো আর আমাদের নবীর প্রতি ঈমান নেই!

তাকে বলেছিলাম, বিষয়টি এমন নয় যেকোনো জাতি বা ধর্মে যে ব্যক্তিত্বগণ সম্মানিত তাদের সম্পর্কে অবজ্ঞাসূচক বাক্য ব্যবহার না করা, সাধারণ মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। সকল জাতি, ধর্ম ও মতবাদ- সে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী হোক কি নাস্তিক্যবাদী, সবার কাছেই বিষয়টি স্বীকৃত। যেকোনো ধর্মের বা গোষ্ঠীর সম্মানিত ব্যক্তিত্বের মানহানী, অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য আন্তর্জাতিক আইনেও অপরাধ। এজন্য এই কথা ঠিক নয় যে, বদদীন ও বেদ্বীন লোকেরা তো এমন করবেই! প্রশ্ন হল, কেন করবে? আল্লাহ তাআলার কাছে ‘শাআয়েরে ইসলাম’ বিশেষত ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদার বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলার বিধানে ‘মুয়াহিদ’ ও ‘আহলে যিম্মা’র সঙ্গে (অর্থাৎ মুসলিম রাষ্ট্রে অবস্থানকারী অমুসলিম জনগণ, যারা বিশেষ অঙ্গীকারসূত্রে ইসলামী রাষ্ট্রে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিয়ে বসবাস করে) চুক্তি ও অঙ্গীকার ততক্ষণ পর্যন্তই বহাল থাকে যে পর্যন্ত তারা ‘শাআয়েরে ইসলাম’ ও নবীয়ে ইসলামের প্রতি কোনোরূপ তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞা প্রদর্শন থেকে বিরত থাকে।

(আহকামু আহলিয যিম্মা, ইবনুল কাইয়েম, আসসারিমুল মাসলূল আলা শাতিমির রাসূল, ইবনে তাইমিয়া)

৪. ওই দৈনিকে যে ক্ষমাপ্রার্থনা সে সময় প্রকাশিত হয়েছিল তার মধ্যে সর্বশেষ বক্তব্য এখানে সংরক্ষণের  জন্য উল্লেখ করে দিচ্ছি-

আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী

মতিউর রহমান

গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘আলপিন’-এ প্রকাশিত একটা অনাকাঙ্ক্ষিত, অগ্রহণযোগ্য কার্টুন-কাহিনী প্রকাশের জন্য আমরা আবারও দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি। পাশাপাশি বিষয়টিকে ভুল হিসেবে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য সবার প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।

ওই কার্টুন-কাহিনী সংবলিত আলপিনসহ ১৭ সেপ্টেম্বরের পত্রিকা ছাপা হয়ে বাজারে চলে যাওয়ার পর ধরা পড়ে যে, একটা বড় অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল হয়ে গেছে। এ এমন একটা ভুল, যার পক্ষে কোনো যুক্তিই যথেষ্ট নয়। প্রথম আলো সব সময়ই ইসলাম ধর্ম ও ধর্মীয় আবেগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পাঠক ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের আবেগ ও অনুভূতিতে যাতে আঘাত না লাগে, সে ব্যাপারে আমরা সব সময় সচেতন এবং তা রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, এত সতর্কতা, এত চেষ্টার ভেতরও কী করে এ রকম একটা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য কার্টুন ছাপা হয়ে গেল? বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম আলো ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। সিদ্ধান্ত নেয়, নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাওয়া হবে এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত যে সহসম্পাদকের বিবেচনায় এই ভুল ধরা পড়েনি, তাঁকেও অপসারণ করা হবে।

প্রথম আলোর পাঠকদের অনেকেই ফোন করে জানিয়েছেন, এই কার্টুনটি তাঁদের আহত করেছে। আমরা তাঁদের সমব্যথী। প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতির একটি হলো- ভুল যাতে না হয় সেজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা, তারপরও ভুল হয়ে গেলে তা বোঝার বা জানার সঙ্গে সঙ্গে সংশোধনী ছাপানো ও দুঃখ প্রকাশ করা। কারণ যে পত্রিকাটি প্রায় ২৫ লাখ পাঠকের কাছে প্রতিদিন যায়, তাতে একটা ভুল হলে তার নেতিবাচক প্রভাবও হয় ব্যাপক। অনেকে এ জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন, অনেকে মানসিকভাবে আহত হতে পারেন।

এই নীতি অনুসরণ করে গত ১৮ সেপ্টেম্বর পত্রিকার মাধ্যমে প্রথম আলো ওই কার্টুন-কাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯ সেপ্টেম্বর ওই প্রদায়ক কার্টুনিস্টের আর কোনো লেখা বা কার্টুন পত্রিকায় না ছাপার সিদ্ধান্ত নেয়। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহসম্পাদককে অপসারণের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয় পাঠকদের। প্রথম আলো পর পর দুই দিন সবার কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ ও নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে। প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় এই আবেদন প্রকাশিত হয়। গতকাল ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। অনিচ্ছাকৃত ভুলটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন।’

সরকারও গত বুধবার আলপিনের ১৭ সেপ্টেম্বরের সব কপি বাজেয়াপ্ত করে এবং প্রদায়ক কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। এ রকম একটা অনাকাঙ্ক্ষিত কার্টুন প্রকাশিত হওয়ার জন্য আজও প্রথম আলো দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করছে

আন্তরিকভাবে। কারণ এই ভুলটি একেবারেই অনিচ্ছাকৃত ও অসাবধানতাবশত। ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুলের পুনারাবৃত্তি না করার ব্যাপারে সতর্ক থাকার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে এই পত্রিকা। একই সঙ্গে ১৩ জন সম্পাদকের গতকালকের বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত।

প্রথম আলো আশা করছে, সবাই বিষয়টা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। -প্রথম আলো ২১ সেপ্টেম্বর ২০০৭

৫. কোনো কোনো দৈনিকে উপরোক্ত ক্ষমাপ্রার্থনাকে ‘তাওবা’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত এটা তাওবা নয়, এটা তো দুঃখ প্রকাশ মাত্র। একে যদি ‘তাওবা’  বলা হয় তবে তা হবে একটি রাজনৈতিক তাওবা, দ্বীনী ও ঈমানী তাওবা এটা নয়। তাওবার জন্য অপরিহার্য হল, আবার নতুন করে ঈমান আনয়ন করা, কালেমা পড়া, যে কুফরী কাজ করা হয়েছে তা কুফরী কাজ বলে জেনে তা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর নামের সঙ্গে মুহাববত, হৃদ্যতা ও সম্মান প্রদর্শনের ঘোষণা প্রদান করা। এশর্তগুলো পূরণ হলে দুনিয়ার ইসলামী আদালত বলবে, সে ‘তাওবা’ করেছে। এর কারণে রিসালাতের মানহানী ও শাআয়েরে ইসলামের অবজ্ঞার শাস্তি মওকুফ হবে কি না সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আর আল্লাহর কাছে তওবা কবুল হওয়ার জন্য একাজগুলো অন্তর থেকে হতে হবে। শুধু মৌখিক স্বীকারোক্তি যথেষ্ট নয়। আল্লাহর কাছে বাহ্য-অবাহ্য সব কিছু সমান। কোনো কিছুই তার কাছে

গোপন নয়।

৬. সে সময় কিছু বেদ্বীন ভাবাদর্শ সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, ‘এই কার্টুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে অবমাননাকর কিছু বলা হয়নি।’

একেই বলে চুরি আবার সীনাজুরি। যারা এই ঘৃণ্য কাজ করেছে তারা একে মানহানীকর বিষয় বলে স্বীকার করে বার বার দুঃখ প্রকাশ করছে এবং ক্ষমা চাচ্ছে। তাদের পক্ষ থেকে অন্যান্য ক্ষমাপ্রার্থনাকারীরাও একে মানহানীকর বলে স্বীকার করছে আর এরা বলছে যে, এটা মানহানীকর নয়। কারো নামকে পশুর জন্য ব্যবহার করা মানহানীকর নয় তো সম্মান প্রদর্শন? স্পষ্ট ভাষায় অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা প্রকাশের চেয়ে ইশারা-ঈঙ্গিতে প্রকাশ আরো মারাত্মক। কেননা, এখানে কুফরের সঙ্গে মুনাফিকীও রয়েছে। ‘আল কিনায়াতু আবলাগু মিনাস সারীহ’ সব ভাষাতেই স্বীকৃত।

মনে রাখা উচিত যে, অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সাধারণত নিয়ম এটাই যে, এতে ইশারা-ইঙ্গিত এবং স্পষ্ট বক্তব্য সবগুলোর বিধান এক। এরপর শাআয়েরে ইসলাম ও নবীয়ে ইসলামের বিষয়তো আরো সংবেদনশীল।

ইসলাম অবশ্যই উদারতার ধর্ম, কিন্তু তারও আগে ইসলাম স্পষ্টবাদিতা, সত্যবাদিতা ও আমানতদারীর ধর্ম। শিথিলতা ও মুনাফিকী কোনোক্রমে ইসলামে সহনীয় নয়।

দুনিয়াবী বিষয়ে কার্টুন বানিয়ে কৌতুক করার বিধান কী এ বিষয়ে আলিমদের কাছে জেনে নেবেন, কিন্তু দ্বীন ও ঈমান, শরীয়ত ও সুন্নাহ এবং শাআয়েরে ইসলামের মতো সংবেদনশীল বিষয়কে কৌতুকের বিষয় বানানো যে একে তুচ্ছতায় নামিয়ে আনা তা খুব সামান্য চিন্তাতেই বোঝা যায়।

‘কৌতুক’ বিষয়টির মূল কথাই হল হাস্যরস আর ঈমান ও ঈমানিয়াত, ইসলাম ও ইসলামিয়াত বিশেষত শাআয়েরে ইসলামের বিষয়গুলো ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয় যা অত্যন্ত সংবেদনশীল। এসব বিষয়কে যারা হাস্যরসের বিষয় বস্ত্ততে পরিণত করে আল্লাহর কাছে তারা অবিশ্বাসী হিসেবে পরিগণিত। ঈমান থেকে খারিজ হওয়ার জন্য সংকল্প করে কুফরী কাজ করা জরুরি নয়; বরং কথা বা আচার-আচরণের কুফরও অনেক সময় অধিক মারাত্মক হিসেবে পরিগণিত হয়।

৭. এ প্রসঙ্গে মুসলমানের করণীয় কী- এ প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে,

১. সরকারের কর্তব্য হল, তারা আলোচিত পত্রিকা এবং এ ধরনের যেসব পত্র-পত্রিকা ইসলাম-বিদ্বেষ ও মুসলিম-বিদ্বেষের মানসিকতা নিয়ে কাজ করে সবগুলোর প্রকাশনা বন্ধ করা এবং ডিক্লারেশন বাতিল করা। দেশ ও জাতির দুশমনদেরকে দুশমনী চরিতার্থ করার কোনো সুযোগই না দেওয়া।

২. সরকারের আরো কর্তব্য হচ্ছে, ‘শাআয়েরে ইসলাম’ সম্পর্কে পরিষ্কার আইন সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা। আর তা ওই আইনই হতে হবে যা ইসলামের আইন। যে বিষয়গুলো ‘ইরতেদাদে’র কারণ সেগুলোর শাস্তিবিধানের আইন এবং শক্ত হাতে তা

বাস্তবায়িত হওয়া মুসলিম জনপদে বসবাসকারী মুসলিমদের একটি সামান্য অধিকার। এই অধিকার পূরণ করা সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

৩. মুসলিম জনগণের করণীয় হল তারা যৌক্তিক ও শান্তিপূর্ণ  উপায়ে সরকারকে করণীয় সম্পর্কে সচেতন করবেন এবং এই দ্বীনী অধিকার তাদের কাছ থেকে আদায় করবেন।

৪. মুসলমানদের জন্য সবসময়ের, বিশেষত এ সময়ের করণীয় হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্য, গুণ ও মাহাত্ম্য অধিক পরিমাণে চর্চা করা, তার পূর্ণাঙ্গ ও অতুলনীয় শিক্ষা প্রচার-প্রসার করা, তাঁর সুন্নত ও আদর্শকে নিজের মধ্যে ও পরিবারের সবার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা। আর এহইয়ায়ে সুন্নত ও মহববতে রাসূলের পরিবেশ সৃষ্টি করা। যেখানে জীবনের সকল ক্ষেত্রে নবী-আদর্শ প্রতিষ্ঠিত থাকবে সেখানে কোনো বেদ্বীন প্রকাশ্যে ‘শাআয়েরে ইসলাম’ ও নবীয়ে ইসলামের অবজ্ঞা করতে অবশ্যই কুণ্ঠাবোধ করবে।

৫. প্রত্যেক ইসলাম-বিদ্বেষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, তা দেশি হোক  বা বিদেশি, সম্পর্ক ছিন্ন করা আর তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সবধরনের সহযোগিতা পরিত্যাগ করা।

৬. আকাইদে ইসলামের সঠিক ইলম হাসিল করে সে অনুযায়ী নিজের আক্বীদা-বিশ্বাস দুরস্ত করা এবং তার উপর অবিচল থাকা।

৭. ‘শাআয়েরে ইসলাম সম্পর্কিত শরয়ী বিধানের ইলম হাসিল করা এবং সেগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শাআয়েরে ইসলাম ও নবীয়ে ইসলামের মাহাত্ম্য অনুধাবন করার তাওফীক দিন এবং নবী আদর্শকে জীবনের সকল অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করার তাওফীক দিন। আমীন।

টীকা-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুবারক নামসমূহের মর্ম ও ব্যাখ্যার জন্য দেখুন ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ মাওলানা মুহাম্মাদ সুলায়মান মনসুরপুরী খ. ৩ পৃ. ১৪-১৫, ১৭৮-১৯৮


মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক,
আমীনুত তালীম,
গবেষণামূলক উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া ঢাকা

অন্যকে আহার করানো – একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে: ২

একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে –  ০২


অন্যকে আহার করানো
=======================
এক: অবদুল্লাহ বিন উমার (রা.) বর্ণনা করেছেন:
-এক লোক নবিজীকে (সা.) প্রশ্ন করেছে:
-কোন ইসলাম উত্তম ?
-তুমি আহার দান করবে। চিনে হোক না চিনে হোক, সালাম দিবে।

দুই: পরিবারের প্রয়োজন পুরো করার পর, উদ্বৃত্ত খাবার থাকলে তবেই অন্যকে আহার করাবে। যেমন: আশেপাশের গরীবকে, বাড়িতে আসা ভিক্ষুককে, মহল্লা পাহারা দেয়া প্রহরীকে, বাড়ির ঠিকা কাজের লোককে।
আবার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, সহকর্মীও এর আওতাভুক্ত হতে পারে।

তিন: হাদীসে গরীব মানুষকেই খাওয়াতে হবে এমনটা বলা হয়নি। বড়লোককে খাওয়ানোও সুন্নাত। হাদীসের মূল সুর হলো, পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করা।

চার: সালাম দ্বারাও পরস্পর মিল-মহব্বত সৃষ্টি হয়। উভয় সুন্নাতের মাঝে একটা অদৃশ্য যোগসূত্র আছে।

আমাদের শি‘আর (স্লোগান) হলো:
– ইন তুতীঊহু তাহতাদু (وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا): যদি তাঁর (নবিজীর) অনুসরণ করো, হিদায়াত পেয়ে যাবে। (নূর:৫৪)

================
লেখক – শাইখ মুহাম্মদ আতিক উল্লাহ্‌
শিক্ষক – মাদরাসাতুল কুরআনিল কারীম,
শ্যামলী,ঢাকা।


একটি সুন্নাহকে বাঁচাব বলে সিরিজ

পর্ব ০১ – তাহলীলের সুন্নাহ
পর্ব ০২ –অন্যকে আহার করানো
পর্ব ০৩ – আযানের পাঁচ সুন্নাহ
পর্ব ০৪ – ইলম তলব করা
পর্ব ০৫ – মিলিয়ে দেয়া
পর্ব ০৬ – দ্রুত ইফতার করা

 


Ayrıca Muroosmm.com ile instagram hesapların için satın alabileceğiniz instagram türk aktif takipçi paketlerini sipariş et!


ucuz takipçi al


eskişehir escort kızlar

তাহলীলের সুন্নাহ – একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে: ১

একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে : ০১
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
এক: আমরা পুরো মুসলিম উম্মাহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এমনটা যে হবে, নবিজী (সা.) তার জীবদ্দশাতেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন। মুসলিম সমাজ আজ নানা দল-উপদলে বিভক্ত। বিভিন্ন বাদ-মতবাদ নিয়ে ব্যস্ত। প্রত্যেক দলই মনে করে করে, তারাই একমাত্র সঠিক দল, অন্যরা সবাই ভ্রান্ত!

দুই: এই যে সমস্যা, তার সমাধানও নবিজী (সা.) দিয়ে গেছেন:
= ইরবাদ বিন সারিয়া বর্ণনা করেছেন:
– নবিজী একদিন আমাদেরকে নসীহত করলেন। ফজরের পর। ভাষণটা ছিল অত্যন্ত সারগর্ভ। উপস্থিত শ্রোতাদের দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল। সবার হৃদয় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। একজন তো বলেই বসল:
-এটা তো বিদায়ী ভাষণ!
নবীজি আমাদেরকে কী নির্দেশনা দিয়েছিলেন?
– আমি তোমাদেরকে তাকওয়া অবলম্বনের আদেশ দিচ্ছি। আমি তোমাদেরকে (নেতার আদেশ) শোনা ও মানার আদেশ দিচ্ছি। সে নেতা হাবশী গোলাম হলেও তাকে মানবে। কেননা তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে, তারা অনেক ঝগড়া-বিরোধ দেখবে।
-তোমরা নিত্য-নতুন (বিদআত) বিষয়াবলী থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা সেগুলো ভ্রান্ত। তোমরা যারা সে সময়টা পাবে, তারা যেন আমার সুন্নাহ আঁকড়ে ধরে। আমার হিদায়াতপ্রাপ্ত সুবু্িদ্ধসম্পন্ন খলীফাদের পথ আঁকড়ে ধরে। তোমরা তাদের পথকে মযবুতভাবে কামড়ে ধরে রাখবে।

তিন: নবিজীর (সা.) কথায় বোঝা গেল, সুন্নাতের অনুসরণের মাঝেই আমাদের মুক্তি নিহিত।

চার: আমরা এই সিলসিলায় চেষ্টা করবো, ফিকহি ও মাযহাবি ইখতিলাফ-মতভেদমুক্ত সুন্নাতসমূহ হাযির করতে। যাতে সবাই মানতে পারে। আমল করতে পারে।

পাঁচ: এই সফরে, আমাদের শে‘আর (স্লোগান) হবে:
-ইন তুতীঊহু তাহতাদু (وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا): যদি তার (নবিজীর) অনুসরণ করো, হিদায়াত পেয়ে যাবে (নূর:৫৪)।
————————–————————–————————–——-
তাহলীলের সুন্নাহ
এক: তাহলীল মানে হলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়া।

দুই: আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন:
-যে ব্যক্তি দিনে একশ বার: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু, লাহুল-মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর’
.
( لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ،)
.
.
বলবে, তার জন্যে আছে:
ক: দশটা গোলাম আযাদ করার সওয়াব।
খ: তার জন্যে একশটা নেকি লেখা হবে।
গ: তার একশটা গুনাহ মাফ করা হবে।
ঘ: তার জন্যে সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত শয়তান থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা হবে।
ঙ: সেদিন তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আমলদার আর কেউ থাকবে না। তবে অন্য কেউ যদি এই আমলটা একাধিকবার করে, তার কথা আলাদা। (বুখারি ও মুসলিম)

তিন: এটি একটি অতীব মর্যাদাবান সুন্নাত। এটার অপরিমেয় প্রতিদানের কথা কল্পনাও করা যায় না। আরেকটা হাদীসের ভাবও এমন:
-আমি (নবিজী) ও অন্য নবীগণ যেসব কথা বলেছি, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ কথা হলো উপরোক্ত দু‘আ।

চার: এই সুন্নাত আদায় করতে বড়জোর মিনিট দশেক সময় লাগবে। কিন্তু তার প্রাপ্তি অসাধারণ।

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
================
লেখক – শাইখ মুহাম্মদ আতিক উল্লাহ্‌
শিক্ষক – মাদরাসাতুল কুরআনিল কারীম,
শ্যামলী,ঢাকা।


একটি সুন্নাহকে বাঁচাব বলে সিরিজ

পর্ব ০১ – তাহলীলের সুন্নাহ
পর্ব ০২ –অন্যকে আহার করানো
পর্ব ০৩ – আযানের পাঁচ সুন্নাহ
পর্ব ০৪ – ইলম তলব করা
পর্ব ০৫ – মিলিয়ে দেয়া
পর্ব ০৬ – দ্রুত ইফতার করা


Ayrıca Muroosmm.com ile instagram hesapların için satın alabileceğiniz ucuz takipçi instagram paketlerini sipariş et!


takipçi satın al instagram


eskişehir escort kadınlar

বিবাহ সম্পর্কিত নির্বাচিত আয়াত

ইসলামে নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের একমাত্র বৈধ পন্থা হল বিবাহ। পরিবার গঠন, সংরক্ষণ ও বংশ-বিস্তারের জন্যই বিয়ে ছাড়া আর কোন বিধি সম্মত পথ নেই। এর মাধ্যমেই ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন পবিত্র ও কলুষমুক্ত হয়ে নৈতিকতার সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত হতে পারে।

এ জন্যই ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করলে আল্লাহ্‌র চিরাচরিত বিধান এবং নবী – এর সুন্নাত হিসেবে বিয়ে করা ফরয আর এ অবস্থায় অর্থনৈতিক দিক থেকে সমর্থ না হলে সওম পালন করার বিধান দেয়া হয়েছে। আবার শারীরিক দিক থেকে সমর্থ হলে আর ব্যভিচারে লিপ্ত হবার আশঙ্কা না থাকলে বিয়ে করা মুসতাহাব। আর জৈবিক চাহিদা শূন্য হলে বিয়ে করা মুবাহ্‌। আবার এ অবস্থায় যদি মহিলার পক্ষ থেকে তার বিয়ের উদ্দেশ্যই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে এরূপ স্বামীর শারীরিকভাবে সমর্থ নারীকে বিয়ে করা মাকরূহ।

কিন্তু যদি কেউ সার্বিক দিক থেকে সমর্থ হওয়া সত্ত্বেও রসূলের সুন্নাতের প্রতি অনীহা ও অবিশ্বাসের কারণে বিয়ে পরিত্যাগ করে, তাহলে সে রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) – এর তরীকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
وَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تُقْسِطُوا فِي الْيَتَامَىٰ فَانْكِحُوا مَا طَابَ لَكُمْ مِنَ النِّسَاءِ مَثْنَىٰ وَثُلَاثَ وَرُبَاعَ ۖ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَلَّا تَعُولُوا
১।  আর যদি তোমরা ভয় কর যে, এতীম মেয়েদের হক যথাথভাবে পুরণ করতে পারবে না, তবে সেসব মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন, কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায় সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে, একটিই অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে; এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা। [সূরা নিসা : আয়াত ৩]

وَلَا تَنْكِحُوا الْمُشْرِكَاتِ حَتَّىٰ يُؤْمِنَّ ۚ وَلَأَمَةٌ مُؤْمِنَةٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكَةٍ وَلَوْ أَعْجَبَتْكُمْ ۗ وَلَا تُنْكِحُوا الْمُشْرِكِينَ حَتَّىٰ يُؤْمِنُوا ۚ وَلَعَبْدٌ مُؤْمِنٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكٍ    وَلَوْ أَعْجَبَكُمْ ۗ أُولَٰئِكَ يَدْعُونَ إِلَى النَّارِ ۖ وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَى الْجَنَّةِ وَالْمَغْفِرَةِ بِإِذْنِهِ ۖ وَيُبَيِّنُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ
২। আর তোমরা মুশরেক নারীদেরকে বিয়ে করোনা, যতক্ষণ না তারা ঈমান গ্রহণ করে। অবশ্য মুসলমান ক্রীতদাসী মুশরেক নারী অপেক্ষা উত্তম, যদিও তাদেরকে তোমাদের কাছে ভালো লাগে। এবং তোমরা (নারীরা) কোন মুশরেকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ো না, যে পর্যন্ত সে ঈমান না আনে। একজন মুসলমান ক্রীতদাসও একজন মুশরেকের তুলনায় অনেক ভাল, যদিও তোমরা তাদের দেখে মোহিত হও। তারা দোযখের দিকে আহ্বান করে, আর আল্লাহ নিজের হুকুমের মাধ্যমে আহ্বান করেন জান্নাত ও ক্ষমার দিকে। আর তিনি মানুষকে নিজের নির্দেশ বাতলে দেন যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। [সূরা বাকারা : আয়াত ২২১]

وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ النِّسَاءِ إِلَّا مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۖ كِتَابَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ ۚ وَأُحِلَّ لَكُمْ مَا وَرَاءَ ذَٰلِكُمْ أَنْ تَبْتَغُوا بِأَمْوَالِكُمْ مُحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ ۚ فَمَا اسْتَمْتَعْتُمْ بِهِ مِنْهُنَّ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً ۚ وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا تَرَاضَيْتُمْ بِهِ مِنْ بَعْدِ الْفَرِيضَةِ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا
৩। এবং নারীদের মধ্যে তাদের ছাড়া সকল সধবা স্ত্রীলোক তোমাদের জন্যে নিষিদ্ধ; তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যাদের মালিক হয়ে যায়-এটা তোমাদের জন্য আল্লাহর হুকুম। এদেরকে ছাড়া তোমাদের জন্যে সব নারী হালাল করা হয়েছে, শর্ত এই যে, তোমরা তাদেরকে স্বীয় অর্থের বিনিময়ে তলব করবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য-ব্যভিচারের জন্য নয়। অনন্তর তাদের মধ্যে যাকে তোমরা ভোগ করবে, তাকে তার নির্ধারিত হক দান কর। তোমাদের কোন গোনাহ হবে না যদি নির্ধারণের পর তোমরা পরস্পরে সম্মত হও। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিজ্ঞ, রহস্যবিদ। [সূরা নিসা : আয়াত ২৪]

৪। ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারিণী নারী অথবা মুশরিকা নারীকেই বিয়ে করে এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী অথবা মুশরিক পুরুষই বিয়ে করে এবং এদেরকে মুমিনদের জন্যে হারাম করা হয়েছে। [সূরা নূর : আয়াত ৩]

 

حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ أُمَّهَاتُكُمْ وَبَنَاتُكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ وَعَمَّاتُكُمْ وَخَالَاتُكُمْ وَبَنَاتُ الْأَخِ وَبَنَاتُ الْأُخْتِ وَأُمَّهَاتُكُمُ اللَّاتِي أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ مِنَ الرَّضَاعَةِ وَأُمَّهَاتُ نِسَائِكُمْ وَرَبَائِبُكُمُ اللَّاتِي فِي حُجُورِكُمْ مِنْ نِسَائِكُمُ اللَّاتِي دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَإِنْ لَمْ تَكُونُوا دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ وَحَلَائِلُ أَبْنَائِكُمُ الَّذِينَ مِنْ أَصْلَابِكُمْ وَأَنْ تَجْمَعُوا بَيْنَ الْأُخْتَيْنِ إِلَّا مَا قَدْ سَلَفَ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَحِيمًا

৫। তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতা, তোমাদের কন্যা, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, ভ্রাতৃকণ্যা; ভগিনীকণ্যা তোমাদের সে মাতা, যারা তোমাদেরকে স্তন্যপান করিয়েছে, তোমাদের দুধ-বোন, তোমাদের স্ত্রীদের মাতা, তোমরা যাদের সাথে সহবাস করেছ সে স্ত্রীদের কন্যা যারা তোমাদের লালন-পালনে আছে। যদি তাদের সাথে সহবাস না করে থাক, তবে এ বিবাহে তোমাদের কোন গোনাহ নেই। তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রী এবং দুই বোনকে একত্রে বিবাহ করা; কিন্তু যা অতীত হয়ে গেছে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাকরী, দয়ালু। [সূরা নিসা : আয়াত ২৩]

 


এটা পড়ুন – ভালোবাসার বানিজ্য- কয়েকটি অপ্রিয় সত্যকথন


৬। যে নারীকে তোমাদের পিতা-পিতামহ বিবাহ করেছে তোমরা তাদের বিবাহ করো না। কিন্তু যা বিগত হয়ে গেছে। এটা অশ্লীল, গযবের কাজ এবং নিকৃষ্ট আচরণ। [সূরা নিসা : আয়াত ২২]

৭। আর যদি তোমরা আকার ইঙ্গিতে সে নারীর বিয়ের পয়গাম দাও, কিংবা নিজেদের মনে গোপন রাখ, তবে তাতেও তোমাদের কোন পাপ নেই, আল্লাহ জানেন যে, তোমরা অবশ্যই সে নারীদের কথা উল্লেখ করবে। কিন্তু তাদের সাথে বিয়ে করার গোপন প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখো না। অবশ্য শরীয়তের নির্ধারিত প্রথা অনুযায়ী কোন কথা সাব্যস্ত করে নেবে। আর নির্ধারিত ইদ্দত সমাপ্তি পর্যায়ে না যাওয়া অবধি বিয়ে করার কোন ইচ্ছা করো না। [সূরা নিসা : আয়াত ২৩৫]

৮। আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশীমনে। তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর। [সূরা নিসা : আয়াত ৪]

৯। অনন্তর তাদের মধ্যে যাকে তোমরা ভোগ করবে, তাকে তার নির্ধারিত হক দান করবে। তোমাদের কোন গোনাহ হবে না যদি নির্ধারণের পর তোমরা পরস্পরে সম্মত হও। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিজ্ঞ, রহস্যবিদ। [সূরা নিসা : আয়াত ২৪]

১০। তোমাদের জন্যে হালাল সতী-সাধ্বী মুসলমান নারী এবং তাদের সতী-সাধ্বী নারী, যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তোমাদের পূর্বে, যখন তোমরা তাদেরকে মোহরানা প্রদান কর। [সূরা মাইদাহ : আয়াত ৫]

১১। তোমরা এই নারীদেরকে প্রাপ্য মোহরানা দিয়ে বিবাহ করলে তোমাদের অপরাধ হবে না। [সূরা মুমতাহিনা : আয়াত ১০]

১২। সেসব মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন, কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায় সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে, একটিই অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে; এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা। [সূরা নিসা : আয়াত ৩]

মহরম মাসে করণীয় ও বর্জনীয় – শায়খ আহমাদুল্লাহ

সম্মানিত মাস হিসেবে মহরমের যেসব করণীয়-বর্জনীয় বিষয় আছে, তার বাইরে মহরম মাসের একটি বিশেষ আমল রয়েছে। আর তা হলো, এ মাসে অধিক পরিমাণে নফল রোজা রাখা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের পর সবচেয়ে সেরা রোজা হলো আল্লাহর মাস মহরমের রোজা।’ (মুসলিম)। সুতরাং মোমিনের উচিত মহরমজুড়ে যত বেশি সম্ভব নফল রোজা রাখার চেষ্টা করা

হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহরম। মহরম অর্থ সম্মানিত। ইসলামের দৃষ্টিতে এ মাসের বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। রয়েছে কিছু করণীয় ও বর্জনীয়ও। কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারোটি, আসমানগুলো ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তার মধ্যে চারটি সম্মানিত।’ (সূরা তওবা : ৩৬)।

এ আয়াতে হিজরি বর্ষের যে চারটি মাসকে সম্মানিত বলে অভিহিত করা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বোখারিতে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘চারটি সম্মানিত মাসের তিনটি হলো ধারাবাহিক। যথাÑ জিলকদ, জিলহজ ও মহরম। আর অপর মাসটি হলো রজব।’

কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘(হে রাসুল) তারা আপনাকে সম্মানিত মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করে। আপনি বলে দিন, সেসব মাসে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া বড় পাপ।’ (সূরা বাকারা : ২১৭)।

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ‘অতএব তোমরা সেসব মাসে নিজেদের প্রতি নিজেরা অবিচার করো না।’ (সূরা তওবা : ৩৬)। তফসিরে ইবনে কাসিরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এ আয়াতে নিজের প্রতি অবিচার করা বলতে পাপকার্যে লিপ্ত হওয়াকে বোঝানো হয়েছে। সুতরাং সম্মানিত মাসগুলোতে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হওয়া নিষিদ্ধ এবং এ মাসগুলোয় পাপের পথ মাড়ানো অন্য মাসে পাপকার্যে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে বেশি জঘন্য।

এছাড়াও আল্লাহ ঘোষিত সম্মানিত মাসের সম্মান রক্ষার্থে এ মাসগুলোতে সাধারণ পুণ্যের কাজগুলোও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে করা উচিত।

মহরম মাস শুধু সম্মানিত চার মাসের একটিই নয়; বরং এ মাসটি সম্মানিত চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে সেরা। এছাড়াও মহরম মাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, মুসলিমের এক বর্ণনায় এ মাসটিকে রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর মাস বলে অভিহিত করেছেন। সব মাস, দিন ও ক্ষণই আল্লাহর সৃষ্টি। তবু মহরমকে আল্লাহর প্রতি সম্পর্কে করা, মাসটির বিশেষ তাৎপর্যের প্রতিই ইঙ্গিত বহন করে।

অষ্টম শতাব্দীর জগদ্বিখ্যাত আলেম আল্লামা ইবনে রজব (রহ.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বিশেষ বিশেষ সৃষ্টিকেই শুধু নিজের সঙ্গে সম্পর্ক করে উক্তি করে থাকেন। যেমন সব মানুষ আল্লাহর বান্দা হওয়া সত্ত্বেও কোরআনে মুহাম্মদ (সা.), ইবরাহিম (আ.), ইয়াকুব (আ.) ও ইউসুফ (আ.)সহ অনেক নবী-রাসুলকে আল্লাহর বান্দা বলে অভিহিত করা হয়েছে। তেমনি অন্য সব সময় ও মাস আল্লাহর সৃষ্টি হলেও মহরম মাসটি আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার কারণে এ মাসকে আল্লাহর মাস বলা হয়েছে, যা থেকে মহরম মাসের মর্যাদা পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে।’

সম্মানিত মাস হিসেবে মহরমের যেসব করণীয়-বর্জনীয় বিষয় আছে, তার বাইরে মহরম মাসের একটি বিশেষ আমল রয়েছে। আর তা হলো, এ মাসে অধিক পরিমাণে নফল রোজা রাখা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের পর সবচেয়ে সেরা রোজা হলো আল্লাহর মাস মহরমের রোজা।’ (মুসলিম)। সুতরাং মোমিনের উচিত মহরমজুড়ে যত বেশি সম্ভব নফল রোজা রাখার চেষ্টা করা।

মহরম মাসের ১০ তারিখকে বলা হয় আশুরা। আশুরা হলো বছরের অন্যতম সেরা একটি ফজিলতপূর্ণ দিন। ইসলামপূর্ব যুগেও এ দিনটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। মদিনার ইহুদিরা এবং মক্কার কোরাইশরাও এ দিনটিতে রোজা রাখত। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরতে পর সেখানকার ইহুদিদের আশুরার দিনে রোজা রাখতে দেখে তাদের কাছে এ দিনে রোজা রাখার কারণ জানতে চাইলে তারা বলল, কারণ হল এ দিনে নবী মুসা (আ.) ও তার সম্প্রদায়কে আল্লাহ তায়ালা অত্যাচারী ও অবাধ্য ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করেছেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীকে সমুদ্রে নিমজ্জিত করেছেন।

আর তারই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি প্রতি বছর এ দিনে রোজা রাখতেন; তাই আমরাও তার অনুকরণে এ দিনে রোজা রাখি। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমরা (তোমাদের চেয়ে) মুসার অনুকরণের বেশি হকদার।’ (বোখারি-মুসলিম)। এরপর থেকে তিনি আশুরার দিনে রোজা রাখতেন এবং সাহাবিদের নির্দেশ দিতেন। রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা নফল হিসেবে গণ্য হয়।

আশুরার রোজার ফজিলত প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে আমার আশা হলো আশুরার দিন রোজার বিনিময়ে তিনি এক বছর আগের গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ (মুসলিম)। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, ‘অন্য কোনো নফল রোজার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) কে এত বেশি যতœশীল দেখা যেত না, যত বেশি যত্নশীল থাকতেন আশুরার রোজা রাখার ব্যাপারে।’ বোখারি ও মুসলিমের এক বর্ণনায় মহিলা সাহাবি রুবাইয়ি (রা.) বলেছেন, ‘আমরা আমাদের ছোট শিশুদেরও আশুরার দিনে রোজা রাখতে উদ্বুদ্ধ করতাম।’

মুসলিমদের আশুরার রোজার মধ্যে ইহুদিদের রোজা থেকে যেন বিশেষ স্বাতন্ত্র্য থাকে; সেজন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরা উপলক্ষে দুটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যথা, মহরমের নয়-দশ, অথবা দশ-এগারো তারিখ। তবে এক বর্ণনায় তিনি বলেছেন, আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি, তাহলে মহরমের নয় ও দশ তারিখ রোজা রাখব। সে হিসাবে এ দুই দিন রাখাই সবচেয়ে উত্তম।

ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল আশুরার দিনের মূল পরিচয় হলো এটি আল্লাহর নবী মুসা (আ.) ও তার সম্প্রদায় বনি ইসরাইলের মুক্তির দিবস। তবু নবী (সা.) এর ওফাতের প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর একই দিনে তাঁরই প্রিয় দৌহিত্র হুসাইন (রা.) সপরিবারে ইরাকের কারবালায় এজিদ বাহিনীর হাতে অত্যন্ত নির্মমভাবে শহীদ হন। মুসলিম মাত্রই এ ঘটনায় ব্যথিত ও মর্মাহত হতে বাধ্য। তবে আশুরার দিনে ঘটে যাওয়া কারবালার নির্মম ঘটনাটির কথা স্মরণ করতে গিয়ে আমরা যেন এ দিনের মূল ও হাদিসে বর্ণিত [মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলের মুক্তির] ইতিহাস ভুলে না যাই।

পরিতাপের বিষয়, আশুরার দিনের গুরুত্বপূর্ণ করণীয় রোজা রাখার ব্যাপারে আমরা বেশিরভাগ লোক উদাসীন। এ দিন ঘটা করে তাজিয়া বা শোক মিছিল বের করার কোনো গ্রহণযোগ্য ভিত্তি কোরআন বা হাদিসে নেই।
সুতরাং আসুন, সম্মানিত মাস হিসেবে মহরম মাসের সম্মান বজায় রাখা এবং বেশি বেশি নফল রোজা রাখার চেষ্টা করি এবং সব বেদাত ও কুসংস্কার পরিহার করি।

লেখক : প্রিচার ও ট্রান্সলেটর, পশ্চিম দাম্মাম ইসলামিক সেন্টার, সৌদি আরব