8.3 C
New York
Friday, October 24, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 14

সন্তান লাভের আমল ও দোয়া

জিজ্ঞাসা–: আসসালামুয়ালাইকুম। আমাদের বিয়ে হয়েছে তিন বছরের বেশী হয়েছে কিন্তু কোন সন্তান হচ্ছে না। তাই আমাদেরকে সন্তান হওয়ার আমল ও তদবীরগুলো বলে দিন।

জবাব: وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

এক. প্রিয় দীনিবোন, সন্তান-সন্তুতি দানের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তা’আলার। আল্লাহ যাকে সন্তান দান করেন, কোন রোগ, কোন দুর্বলতা বা কোন সমস্যাই তার জন্য বাঁধা হয়ে দাড়ায় না । আর আল্লাহ যাকে সন্তান দান করেন না, অতি তুচ্ছ কারণেই সে সন্তান লাভ করতে ব্যর্থ হয় । আল্লাহ তাআলা বলেন, يَهَبُ لِمَن يَشَآءُ إِنَٰثٗا وَيَهَبُ لِمَن يَشَآءُ ٱلذُّكُورَ  أَوۡ يُزَوِّجُهُمۡ ذُكۡرَانٗا وَإِنَٰثٗاۖ وَيَجۡعَلُ مَن يَشَآءُ عَقِيمًاۚ ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন, যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন অথবা ছেলে-মেয়ে উভয়ই দান করেন। আবার যাকে ইচ্ছে বন্ধ্যা করেন।’ (সূরা আশ্শূরা ৫০)

সুতরাং আল্লাহর কাছে চাওয়ার কোন বিকল্প নেই । আপনি নিবিষ্ট মনে আপনার মত করে নিজের ভাষায় তাঁরই কাছে নেক সুস্থ ও সুন্দর সন্তান কামনা করে দোয়া করতে থাকুন। তিনি আপনার ডাকে সাড়া দিলে অবশ্যই আপনি সন্তান লাভ করবেন।

দুই. দেখুন, জাকারিয়া আ. বুড়ো বয়সেও নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, আল্লাহ তাআলা মৌসুম ছাড়াই মারইয়াম আ.-কে ফল দান করে রিজিকের ব্যবস্থা করেন। তখন তাঁর মনে সন্তানের জন্য সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল। তিনি ভাবলেন যে, যে আল্লাহ বিনা-মৌসুমে ফল দিতে পারেন, সে আল্লাহ বৃদ্ধদম্পতিকেও সন্তান দান করতে পারেন। তাই তিনি আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন– رَبِّ هَبْ لِي مِن لَّدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً إِنَّكَ سَمِيعُ الدُّعَاء হে, আমার পালনকর্তা! আপনার নিকট থেকে আমাকে পুত-পবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী। (সূরা আল-ইমরান ৩৮)

সুতরাং আপনিও দোয়াটি করতে পারেন। ইনশা-আল্লাহ আল্লাহ আপনাকে নেক সন্তান দান করবেন।

তিন সুরা সাফফাতে এসেছে, বৃদ্ধ বয়সে ইবরাহিম আ. আল্লাহ তাআলার নিকট দোয়া করেছিলেন সৎ পুত্র সন্তানের জন্য। আল্লাহ তাআলা তার দোয়া কবুল করলেন। তাঁকে নেক পুত্র সন্তান দান করলেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা শিক্ষা দিয়েছেন, যাতে বান্দা এ দোয়ার মাধ্যমে তাঁর নিকট সন্তান কামনা করতে পারে। দোয়াটি এই- رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ ‘হে আমার পরওয়ারদেগার! আমাকে এক সৎপুত্র দান করুন।’ (সূরা সাফফাত ১০০)

চারকোরআনে বর্ণিত এ দোয়াটিও করতে পারেন; ইনশা-আল্লাহ আল্লাহ আপনাকে সন্তান দিয়ে সুখী করবেন- رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا’হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের জীবনসঙ্গীর পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ দান করুন।’ (সূরা ফুরকান ৭৪)

পাঁচসূরা আম্বিয়ার ৮৯ নং আয়াতের এ অংশ  বেশি করে পড়ুন; ইনশা-আল্লাহ সন্তান হবে- رَبِّ لَا تَذَرْنِي فَرْدًا وَأَنتَ خَيْرُ الْوَارِثِينَ ‘হে আমার পালনকর্তা আমাকে সন্তানহীন ছেড়ে দিবেন না। আর আপনিই তো সর্বোত্তম ওয়ারিস।’

ছয়হাসান বসরি রহ. থেকে বর্ণিত, তাঁকে এক ব্যক্তি বলল, আমি সম্পদশালী, কিন্তু নিঃসন্তান, আমাকে এমন আমল বলে দিন,যাতে আমার সন্তান হয়। তখন তিনি লোকটিকে বললেন, عليك بالاستغفار ‘তুমি ইস্তেগফারকে আবশ্যক করে নাও।’ ফলে লোকটি নিয়মিত ইস্তেফারের আমল করতে লাগল। এমনকি দৈনিক ৭০০ বার সে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়ত। এ আমলের বরকতে আল্লাহ তাকে একে একে দশ সন্তান দান করেছিলেন। তারপর লোকটি একদিন হাসান বসরি রহ.কে এই আমলের রহস্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বলেন, তুমি কি হুদ আ.-এর ঘটনায় আল্লাহর বাণী দেখনি? আল্লাহ অধিক ইস্তেফারের ফলাফল বলতে গিয়ে বলেছেন, وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إلى قُوَّتِكُمْ ‘তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন।’ (সূরা হুদ ৫২) এবং নূহ আ.-এর ঘটনায় আল্লাহর বাণী দেখনি? সেখানে তিনি বলেছেন, وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ ‘তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ত তি বাড়িয়ে দিবেন।’ (সূরা নূহ ১২)

প্রিয় দীনি বোন, সুতরাং আপনিও বেশি করে ইস্তেগফার করুন; ইনশা-আল্লাহ আপনার সন্তান না হওয়ার পেরেশানি থাকবে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

مَنْ لَزِمَ الاِسْتِغْفَارَ جَعَلَ اللَّهُ لَهُ مِنْ كُلِّ ضِيقٍ مَخْرَجًا وَمِنْ كُلِّ هَمٍّ فَرَجًا وَرَزَقَهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِب

যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের সংস্থান করে দেবেন। (আবূদাউদ ১৫২০)

সাত. বাকের রহ.-এর কাছে এক বৃদ্ধ এসে বললেন, আমার বয়স ষাট বছর; কিন্তু এখনও নিঃসন্তান। তখন তিনি তাকে বললেন, ‘প্রত্যেক ফরয-নামাজের পর سبحان الله (সুবহানাল্লাহ) ৭০ বার এবং أستغفر الله ( আস্তাগফিরুল্লাহ) ৭০ বার পড়বেন। তারপর তেলাওয়াত করবেন সূরা নূহ-এর ১০,১১, ১২ নং আয়াত অর্থাৎ, 

اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا يُرْسِلِ السَّمَاء عَلَيْكُم مِّدْرَارًا  وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَارًا

‘তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দিবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ত তি বাড়িয়ে দিবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন।’

এ আয়াতগুলো তেলাওয়াত করবেন। আমলটি তিন দিন করবেন। তৃতীয় দিনে স্ত্রী-সহবাস করবেন। ইনশা-আল্লাহ আল্লাহ আপনাকে নেক সন্তান দান করবেন।’

লোকটি বলেন, আমি এই আমল করলাম, ফলে  এক বছর পূর্ণ না হতেই আল্লাহ আমাকে আমার চোখের শীতলতা পুত্র সন্তান দান করেছেন। (তিব্বুল আইম্মাহ ১৩০)

প্রিয় দীনি বোন, আপনি এবং আপনার স্বামী আমলটি করে দেখুন। ইনশা-আল্লাহ কাজ হবে।

আটসহবাসের সময় দোয়া পড়ুন; ইনশা-আল্লাহ এতেও আপনার সন্তান লাভের মনোবাসনা পূরণ হতে পারে। দোয়াটি এই-

بِسْمِ اللَّهِ ، اللَّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ ، وَجَنِّبْ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا

‘হে আল্লাহ! আপনার নামে শুরু করছি, আপনি আমাদের নিকট হতে শয়তানকে দূরে রাখুন। আমাদের এ মিলনের ফলে যে সন্তান দান করবেন, তা হতেও শয়তানকে দূরে রাখুন।’

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ  বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ আপন স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার ইচ্ছা করে তখন উক্ত দোয়া পড়ে যেন মিলিত হয়। এ মিলনে যদি তাদের কিসমতে কোনো সন্তান আসে, সে সন্তানকে শয়তান কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। (বুখারি ৬৩৮৮)

নয়আলেমদের অনেকে বলেছেন, যে ব্যক্তি স্ত্রী সহবাসের পূর্বে আল্লাহ তাআলার পবিত্র গুণবাচক নাম (اَلْمُتَكَبِّرُ) ‘আল-মুতাকাব্বিরু’- ১০ বার পাঠ করবে; আল্লাহ তাআলা তাকে সৎ সন্তান দান করবেন।

আর যে ব্যক্তি স্ত্রী সহবাসের পূর্বে এ পবিত্র গুণবাচক নাম ১০০ বার পাঠ করবে; আল্লাহ তাআলা তাকে ভাগ্যবান সুসন্তান দান করবেন।

আর যে ব্যক্তির ছেলে-মেয়ে না থাকে ওই ব্যক্তি ৪০দিন পর্যন্ত একাধারে ৪০ বার আল্লাহ তাআলার পবিত্র গুণবাচক নাম (اَلْاَوَّلُ) ‘আল-আউয়ালু’ পাঠ করলে তার সন্তান লাভের মনোবাসনা পূর্ণ হবে।

দশহযরত আলী রাযি. তাঁর অসিয়তনামায় লিখেছেন যে, সহবাসের ইচ্ছে হলে এই নিয়তে সহবাস করতে হবে যে, আমি ব্যভিচার থেকে দূরে থাকবো। আমার মন এদিক ওদিক ছুটে বেড়াবে না আর জন্ম নেবে নেককার ও ভালো সন্তান। এই নিয়তে সহবাস করলে তাতে সওয়াব তো হবেই সাথে সাথে উদ্যেশ্যও পূরণ হবে, ইনশাআল্লাহ।

পরিশেষে আমরা আপনার জন্য দোয়া করি, আল্লাহ আপনাকে নেক সুস্থ সুন্দর সন্তান দান করুন। আমীন।

والله اعلم بالصواب
উত্তর দিয়েছেন
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী নকশবন্দী

আজানের মধুর ধ্বনিতে ইসলামের ছায়াতলে এক খ্রিস্টান নারী : রাহুল আমীন

তাটিনা ফাতিমা, স্লোভাকিয়ায় জন্ম নেয়া একজন খ্রিস্টান নারী। বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ানো ছিল তার শখ। এভাবে বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ানোর পথে মসজিদ ও মুসলিমদের সান্নিধ্যে আসেন তিনি।
আজানের সুমধুর ধ্বনি, একত্রে মুসলিমদের নামায আদায়, মুসলিম সংহতি, আরবি ভাষা তাকে দারুণভাবে বিমোহিত করে। এরপর থেকেই মহান আল্লাহর প্রতি তার ভালোবাসা ও বিশ্বাস জন্মাতে থাকে।
তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয় তাকে তার ইঙ্গিত দেখাবেন। তার এ দৃঢ় বিশ্বাস তাকে একসময় সফল করে। দেখা পান আল্লাহর কাক্সিক্ষত সেই নিদর্শন। যে নিদর্শন তার জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। মুসলিম হওয়ার জন্য তীব্র আকাক্সক্ষা অনুভব করেন এবং আল্লাহ তার এ আকাঙ্ক্ষাকে কবুল করেন।

তাটিনা ফাতিমার ইসলামের পথের যাত্রার কাহিনীর বাকিটা শুনুন তার মুখেই- আল্লাহর প্রতি আমার যথার্থ ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে লক্ষ লক্ষ শব্দের ব্যবহারও আমার কাছে যথেষ্ট মনে হয় না।
নামাযের মধ্য দিয়ে আমি আমার প্রভুর সাথে কথা বলি। এটি হচ্ছে আমার গভীর, আন্তরিক অনুভূতি যা আমার হৃদয়ের গভীর থেকে আসে এবং তা আমার শরীরের প্রতিটি অংশে প্রবাহিত হয়। আমার প্রতি আল্লাহর অসীম দয়া এবং আমাকে একজন মুসলিম হওয়ার সুযোগদানে তার প্রতি আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আমার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য আমাকে আমার সমস্ত জীবনে তার প্রশংসা এবং তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে।
ইসলামের পথে আমার যাত্রা শুরু হয় অনেকটা অগোচরে এবং সাদামাটাভাবে। শুরুর কথা মনে হলে আমার এখনো হাসি পায়।

আমি আমার পিতামাতার সঙ্গে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ  করতে পছন্দ করতাম। আমি আমার বাবা-মায়ের সাথে বিভিন্ন মুসলিম দেশে ভ্রমণ করেছি। মিশর ছিল আমাদের ভ্রমণের সর্বশেষ একটি দেশ। মিশরের সবকিছু, বিশেষকরে তার সংস্কৃতি দারুণভাবে আমার মনযোগ আকর্ষণ করে। মিশরে গিয়ে প্রথমবারের মত আমি মসজিদের সান্নিধ্যে আসি। কিন্তু তখনো আমি মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করিনি। আমি কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম-একজন অমুসলিম হিসেবে আমি এর ভিতরে প্রবেশ করতে পারি কিনা না।


এটা পড়ুন – সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার বা তওবার শ্রেষ্ঠ দোয়া


আমি মসজিদটি থেকে আজানের সুমধুর ধ্বনি শুনতে পেলাম। এটি শোনা মাত্রই আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে এবং আমি আবেগাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। আমি মিনার থেকে ভেসে আসা এ সুমধুর ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাইনি। আজান আমাকে পুরাপুরি বিমোহিত করে তোলে। মসজিদে জমায়েত হওয়া এবং একসঙ্গে নামায আদায়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে সংহতি আমি দেখেছি তা আমাকে বিমুগ্ধ করে এবং এই মধুর দৃশ্য আমার স্মৃতিতে চিরভাস্বর হয়ে আছে।
সেখান থেকে ফিরে আসার সময় আমার কাছে কেবলই মনে হয়েছে আমি আমার খুব ঘনিষ্ঠ কোনো কিছু রেখে যাচ্ছি। ওই সময় ইসলাম সম্পর্কে আমি সামান্য কিছু জানতাম। কিন্তু এখন যতটুকু জানি সে তুলনায় সেটি ছিল একেবারেই নগণ্য।

আরবি ভাষা আমাকে এতটাই আকর্ষণ করে যে, বাড়িতে ফিরে আসার পর আরবি শেখার জন্য আমার মনে ব্যাকুলতা শুরু হয়। এটিকে আমার কাছে মনে হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভাষাগুলোর মধ্যে শ্রেয়।’ কিন্তু আমার শহরের স্কুল-কলেজগুলোতে আরবি ভাষা শিক্ষার কোনো কোর্স ছিল না। এখানে শুধু ইংরেজি এবং জার্মান কোর্স শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে।

যাই হোক, আমাদের এক শিক্ষক আরবি ভাষা শিক্ষা দেয়ার একটা ব্যবস্থা প্রায়ই সম্পন্ন করেছিল। কিন্তু তা শুরু হওয়ার পূর্বেই বাতিল হয়ে যায়। এটি ছিল রমজান মাস শুরু হওয়ার কিছু পূর্বে এবং আমাদের শিক্ষক তার বাড়ি  চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ফলে আরবি শেখার জন্য আমার ভিতর যে তীব্র উত্তেজনা কাজ করছিল নিমেষেই তা হতাশায় পরিণত হয়।

এভাবে কিছু সময়  অতিবাহিত হয় এবং আমি ধীরে ধীরে ইসলামের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করি।
আমি বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ইসলাম সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখা পড়তে শুরু করি। আমি ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের টিভি প্রোগ্রাম দেখতে থাকি। আমি ইন্টারনেটে মুসলিম মহিলাদের একটি আলোচনা ফোরাম অনুসরণ করি। আমি তাদের এই আলোচনা ফোরাম হতে অনেক কিছু শিখেছি।

সেখানে আলোচকদের মধ্যে কিছু স্লোভাক নারীও ছিল। স্লোভাকিয়ার কসিস থেকে এক বোন আমাকে জানান যে, সেখানে আরবি এবং কুরআন শেখার ব্যবস্থা আছে। তার নামটি আমার কাছে পরিচিত ছিল। এর এক মাস আগে একটি টকশোতে অন্যান্য মুসলিম নারীদের সাথে আমি তাকেও দেখেছি।

আমি এই পাঠগুলোতে উপস্থিত থাকতে চেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাকে একটি ইমেইল করি এবং এরপর তিনি তার জবাব দেন। আমরা এক সপ্তাহ পরে সাক্ষাৎ করি। তিনি ছিলেন মহৎ ও খুবই ভাল একজন নারী। তার প্রতি আমার অনুভূতি ছিল বিস্ময়কর। তার সান্নিধ্যে আমি প্রশান্তি এবং নিরাপদ অনুভব করি।

কাউকে নিয়ে কিংবা কোনো কিছুর ব্যাপারে আমার কোনো পক্ষপাত ছিল না। এ কারণে নতুন কিছু শেখাটা আমার জন্য কঠিন ছিল না। আমরা একসাথে আরবি এবং কুরআন পাঠের তালিম নেই এবং সেই সাথে আমি অন্যান্য মুসলিম মেয়ে এবং নারীদের সাথে পরিচিত হই।
আমি পাঠগুলোতে নিয়মিত উপস্থিত ছিলাম এবং এরিমধ্যে কুরআন পাঠ আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে এবং আমি কয়েকটি সুরাও শিখে ফেলি। সেখানে আমি একজন অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও, সবাই ছিল আমার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সহনশীল।

কয়েক মাস পর আমাদের আরবির পাঠ শেষ হয়। কিন্তু এরপরেও আমরা সবাই একত্রিত হয়েছি। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ আলোচনা করতাম। তাদের জীবনধারা প্রত্যক্ষ করার উদ্দেশ্যেই আমি বেশি বেশি তাদের সাথে মিশতে চাইতাম।
আমি একজন মুসলিম হতে চেয়েছি কিনা তা আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না। আমি আমার বিশ্বাস পরিবর্তন করাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতাম না। আমার কাছে যে জিনিসটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটি হলো আল্লাহ সম্পর্কে জানা এবং তাকে ভালোবাসা।

আমি আমার মুসলিম বোনদের কাছে  জানতে চাইলাম- কিভাবে আমি আল্লাহর ইঙ্গিত পেতে পারি। তারা সবসময়  আমাকে বলত, ‘তোমার বিশ্বাস অবশ্যই তোমাকে এক দিন আল্লাহর ইঙ্গিত দেখাতে সহায়তা করবে। আর সেটি হবে নির্দিষ্ট একটি অনুভূতি যাকে কোনো কিছু দ্বারা বিভ্রান্ত করা যাবে না। ’
আমিও তাই অপেক্ষায় থাকি ..।

আমার পরিবার খ্রিস্টান হলেও ধর্মের ব্যাপারে আমাকে কেউ কোনো নির্দেশনা দেয়নি। আমার মা আমাকে বলত যে, আমি এই ক্ষেত্রে পুরাপুরি স্বাধীন। তিনি আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপারে কখনো বাধ্য করতেন না। আমরা গির্জায় না গেলেও  সবাই ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু আমি সবসময় এটি অনুভব করতাম যে, আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের চেয়ে আমি আল্লাহর সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ।

এভাবে সময় অতিক্রম হতে থাকে এবং একসময় সবকিছু শান্ত হয়ে আসে। বলা যায়, এটি আগ্রহের একটি স্বল্পমেয়াদী ঘাটতি। যেন আমি আমার পূর্বের জীবনে ফিরে এসেছি। এ সময়ের মধ্যে কেবল একবারের জন্য মুসলিম নারীদের সাথে আমার দেখা হয়। এমনকি এ নিয়ে আমি বাসায় খুব বেশি পড়াশোনাও করিনি।
এ কারণে আমি যতটা সম্ভব মন থেকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি এবং তার কাছে চেয়েছি তিনি যেন আমাকে তার নিদর্শন দেখান এবং তার ইচ্ছায় তিনি যেন আমাকে একজন মুসলিম হওয়ার সুযোগ দেন।
গ্রীষ্মের ছুটিতে আমি আমার নানুর সাথে কিছু সময় অতিবাহিত করি। নানুর বাড়ি হতে বাড়ি ফেরার পর আমার হৃদয়ে পালাবদল শুরু হয়। আমি এক বিশেষ অনুভূতি অনুভূত করতে পারি। এটি হঠাৎ করেই এবং অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই এসেছিল।

তখন আমি আমার মুসলিম বোনদের কথা স্মরণ করি। কেননা তারা আমাকে বলেছিল, ‘তুমি একদিন এটি অনূভব করতে পারবে। আল্লাহ তোমাকে তার নিদর্শন নিশ্চয় দেখাবে। ’
আমি এই অনুভূতির কথা কখনো ভুলতে পারব না। শিশুরা যেমন কোনো কিছু পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, এরপর আমিও অনেকটা শিশুদের মত হয়ে যাই। আমি মুসলিম হওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা অনুভব করি। আমি তখন অনুভব করতে পারি যে, আমার প্রতিটি চিন্তা, আমার প্রতিটি কাজের মধ্যে আল্লাহ রয়েছেন। আমি আল্লাহর সত্যকে এবং তার ক্ষমতায় বিশ্বাস করি, যা তিনি হযরত মুহাম্মদ সা. এর মাধ্যমে পাঠিয়েছেন।
হঠাৎ করেই আমার সব অবিশ্বাস দূর হয়ে যায়। আমি জানতাম আমার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল এবং আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন কেন? আমি এটির সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না। আপনি কেবল এটি জেনে রাখেন, আমি আমার সত্যকে খুঁজে পেয়েছি।

আমি আমার প্রিয় বন্ধু, আমার মুসলিম বোন যার সাথে আমি প্রথম সাক্ষাৎ করি এবং যিনি আমাকে অন্য সবার চেয়ে বেশি সহায়তা করেছে, তাকে বিষয়টি অবহিত করি। ওই একই দিনে আমি তার এবং অন্য মুসলিম মহিলার উপস্থিতিতে কালেমা শাহাদাত পাঠ করার ঘোষণা দেই।

আমার এই ঘোষণায় তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমার কাছে মনে হল যেন নতুন কোনো ব্যক্তি আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। যেন আমি আমার অতীতের সবকিছু ধুয়ে-মুছে, পূত-পবিত্র হয়ে পুনরায় নতুন করে জন্ম নিয়েছি এবং কুরআন ও নবীর সুন্নাহর আলোকে জীবন পরিচালিত করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গেছি।
যদি কয়েক বছর আগে কেউ আমাকে এ সর্ম্পকে বলত, হয়ত আমি এটি বিশ্বাস করতাম না। একজন মুসলিম হিসেবে জীবন পরিচালনার কথা হয়ত কল্পনাও করতে পারতাম না। এখন আমি ইসলাম ছাড়া ভিন্ন কোনো জীবন ব্যবস্থার কথা এক মুহূর্তের জন্যও কল্পনা করতে পারি না।

ইসলাম গ্রহণের শুরুতে আমি অনুভব করলাম এখানে জানার মত অনেক কিছুই আছে যা আমি জানতাম না। আমি একজন অমুসলিম হিসাবে যখন মুসলমানদের জীবন পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করতাম, আমি তখন বুঝতে পারতাম না মুসলিমরা কতটা বেশি জানে। সম্ভবত এর কারণ ছিল আমি তাদের একটি সম্পূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচনা করতাম।

ধর্মান্তরিত হওয়ার পর আমার মনে অনেক প্রশ্ন ছিল। আমি ইসলামের শুরু থেকে সবকিছু জানতে চেয়েছি। ইসলাম সর্ম্পকে অধ্যয়ন এবং এ সর্ম্পকে শেখার ব্যাপারে আমার তীব্র আকাক্সক্ষা রয়েছে। ইসলাম আমাকে জাগ্রত করেছে। ইসলাম আমার জীবনকে উদ্বুদ্ধ করেছে।

আমি ইসলাম সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য নিয়ে গবেষণা এবং এ মহান ধর্মের ইতিহাসের সাথে নিজেকে পরিচিত করতে চাই এবং আমার অর্জিত জ্ঞান অন্যদের সম্মুখে তোলে ধরতে চাই।
নামায পড়ার জন্য আমার প্রথম প্রচেষ্টা ছিল খুবই আনাড়ি। কিন্তু আমি বলতে পারি এটি আমার আত্মার গভীর হতে আসত কারণ এটি সম্পর্কে আমার প্রবল আগ্রহ ছিল। নামায পড়ার জন্য প্রথমে আমি এর যাবতীয় নিয়ম-কানুন ও এর জন্য প্রয়োজনীয় সুরা একটি নোট খাতায় লিখে নেই এবং তা পড়ে মুখস্থ করি।
আমি সবসময়ই আল্লাহর সাথে কথা বলি এবং তার কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাকে এ ব্যাপারে আরো উন্নতি করতে সহায়তা করে। প্রায় তিন সপ্তাহ পরে আমি এই নোট খাতার সহায়তা ছাড়াই নামায পড়তে সক্ষম হই।

ইসলাম একটি মহান ধর্ম। এতে আমাদের জীবন পরিচালনা করার যাবতীয় বিষয় বলে দেয়া হয়েছে। আমরা এক আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া কখনো পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারি না। কেননা তিনি আমাদের দেখিয়েছেন তিনি কেবলই একজন যিনি সর্ব বিষয়ে পরিপূর্ণ।
আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য আমাদের তার নির্দেশিত পথে চলতে হবে। তিনি যা নিষেধ করেছেন তা অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে। এটি পালন করা আমাদের দায়িত্ব। আজানের ধ্বনি
সূত্র : অনলাইন অবলম্বনে

কুৎসিত যুবক: হুরদের কাড়াকাড়ি- এহসান বিন মুজাহির

রাসূলুল্লাহ সা. পবিত্র মসজিদে নববীতে বসা ছিলেন। হঠাৎ করে মসজিদে নববীতে এক যুবকের আগমন। যুবকের মুখে বসন্তের কালো দাগ। চেহারাও খুব কালো। শরীরের গঠনপ্রণালীও অসুন্দর।
যুবক রাসূলুল্লাহ সা. কে সালাম দিয়ে রাসূলের কাছেই বসলো। রাসূলে কারীম সা. সালামের জবাব দিয়ে দরদমাখা কন্ঠে যুবকের অবস্থা জানতে চাইলেন, হে যুবক! কেমন আছ? কি তোমার পরিচয়? রাসূলের আদরমাখা কথায় যুবকের হৃদয়ে প্রাণ ফিরে এলো। যুবক নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে কাঁদতে শুরু করলো। রাসূল সা. তাঁর এ অবস্থা দেখে তাকে শান্তনা দিয়ে কাছে টেনে নিলেন। তখন যুবক কেঁদে কেঁদে প্রশ্নের জবাব দেয়া শুরু করলো। হে আল্লাহর রাসূল!  আমি বনু সুলাইম গোত্রের সাঈদ সুলাইমি।
আমি খুব দরিদ্র। দেখতে কুৎসিত। চেহারায় বসন্তের দাগ ও গরীবের গঠনপ্রণালী অসুন্দরের কারণে  কেউ আমাকে পছন্দ করে না। আমার মন চায় রাসূলের সুন্নত (নিকাহ) সম্পাদন করতে।
কিন্তু আমি হতদরিদ্রের কাছে কে দেবে তার আদরের দুলালীকে? আমাকে কোনো মেয়ের পিতা জামাতা হিসেবে মেনে নিবে কি? স্বামী হিসেবে কেউ গ্রহণ করবে কি? এই কথাগুলো বলে যুবক আবারও কাঁদতে শুরু করলো। রাহমাতুল্লিল আলামিন যুবকের কথাগুলো এতক্ষণ খুব গুরুত্ব ও মনযোগসহকারে শুনছিলেন। এবার যুবককে জিজ্ঞাসা করলেন, হে যুবক! তোমার আর কিছু বলার আছে কি? তোমার কথা কি এখানে শেষ? তিনি হ্যাঁ সুচক জবাব দিলেন। তখন নবীয়ে রহমা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি কাউকে পছন্দ হয়েছে? তুমি কোন ধরনের মেয়েকে বিয়ে করতে চাও? যুবক বললো, আমার  কোন পছন্দ নেই। তখন রাসূল সা. যুবককে বললেন,  হে যুবক!  এখনকার সময়ে মদীনার সবচেয়ে সুন্দর ও ধনবতী যুবতী কে? তিনি জবাব দিলেন তা তো আমার জানা নেই।
তখন রাসূল সা. বললেন,  হে সাঈদ সুলাইমি! তুমি না জানলেও আমি জানি। আমর বিন ওয়হ্হাবই মদীনার মধ্যে সবচেয়ে বেশী সম্পদশালী এবং তাঁর মেয়েই মদীনার সর্বাধিক সুন্দরী। হে সাইদ সুলাইম!
তুমি আমরের বাড়িতে যাও। গিয়ে তাকে বলবে যে, আমি তাঁর মেয়েকে সাইদ সুলাইমির সঙ্গে বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়ে তোমাকে পাঠিয়েছি। এ কথা শুনে যুবক হতবাক। এটা কি করে সম্ভব! কুৎসিত ও হতদরিদ্রের কাছে এত সম্পদশালী ও মদীনার সর্বাধিক সুন্দরী মেয়েকে তুলে দেয়া!

কিছুক্ষণ নিরবতা ও ভাবনার পর যুবক ভাবলেন এটা তো আমার কথা নয়, বরং বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা. মুখ নিঃসৃত কথা। রাসূলের নির্দেশকে কিভাবে অমান্য করবো? তা হতেই পারে না। রাসূলের প্রস্তাব নিয়ে তিনি আমরের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। বাড়ি থেকে আমর বেরিয়ে এসে সালাম কুশলাদী জিজ্ঞেস করলেন। পরিচয় পর্ব শেষে সাইদ সুলাইমি কন্যার বাবার কাছে রাসূলের প্রস্তাব পেশ করলেন। সাইদ সুলাইমির প্রস্তাব শুনার পরই আমর ক্ষুব্ধ হয়ে তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। যুবক নিরাশ হয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মসজিদে নববীর পথ ধরলেন। এ দিকে ঘরের ভেতর থেকে আমর বিন ওয়াহ্হাবের মেয়ে বাড়ির বাহিরে সাইদ সুলাইমি ও আমরের উচ্চস্বরের কথাবার্তা মনযোগ দিয়ে শুনেছিলেন। সাইদ সুলাইমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আমরের মেয়ে তাঁর বাবাকে বললো, আব্বাজান! মনে হয় আপনি ভুল করে ফেলেছেন; কারণ এই দুনিয়াতো মাত্র ক’দিনের। এর সুখ-শান্তি ধনসম্পদ সাময়িক। এগুলো অস্থায়ি। সাময়িক সুখ-শান্তি, আনন্দের মোহে পড়ে পরকালীন চিরস্থায়ী জগতকে ভুলে গেলে চলবে না। এগুলো আমাদেরকে পরকালে শান্তি দিবে না। সুখ-শান্তি পেতে হলে পরিপূর্ণ দ্বীন মানতে হবে।

মনের  ভেতরে সামান্য অহঙ্কার সারাজীবনের আমলকে ধ্বংস করে দেয়। ধনী-গরীব, সাদা-কালো এগুলোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ইসলামে সবাই সমান। সুন্দর অসুন্দর সব দয়াময় আল্লাহ তাআলারই সৃষ্টি। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে ধনী বানান আবার যাকে ইচ্ছে ফকির বানান। কাজেই আল্লাহর ওপর ভরসা করে রাসূলের সেই প্রস্তাবকে আমি সন্তুষ্টচিত্তে  মেনে নিলাম। আল্লাহর রাসূল এই হতদরিদ্র ও কুৎসিত যুবককে পছন্দ করেছেন, আমি কেন তাকে অপছন্দ করবো। আমি মনেপ্রাণে গরীব ও কুৎসিত যুবককে আমার স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছি। এছাড়া রাসূল সা. যাকে স্বয়ং মনোনীত করেছেন এবং আপনার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন তাঁর প্রস্তাব কিভাবে আপনি ফিরিয়ে দিলেন? রাসূলের নির্দেশ ফিরিয়ে  দেয়া মানেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি অর্জন করা। মেয়ে এপর্যন্ত বলে থেমে  গেল। এবার তিনি হতাশ হয়ে গেলেন। আর চিন্তা করতে লাগলেন আমি সাইদকে ফিরিয়ে দিয়েছি, রাসূলের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছি এটা আমার জন্য কল্যাণকর হয়নি। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। রাসূলের অন্তরে কষ্ট দিয়েছি। সাঈদ সুলাইমিও ব্যথিত হয়েছেন।

রাসূল আমাকে ক্ষমা করবেন তো? তাই তিনি কালবিলম্ব না করে রাসূলের দরবারে গিয়ে উপস্থিত।
তিনি প্রথমেই নিজের অনাকাক্সিক্ষত ভুল স্বীকার করে এজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। সাথে সাথে খুশির খবর (বিয়ের প্রস্তাব কবুল) এটাও সুস্পষ্ট জানিয়ে দিলেন। তিনি বলেন, আমার মেয়ে সাইদ সুলাইমিকে স্বামী হিসেবে পছন্দ করেছে। তার পছন্দই আমার পছন্দ। এছাড়া আপনি যাকে পছন্দ করেছেন তা আমরা কীভাবে অপছন্দ করবো! কাজেই আমরা তাকে জামাতা হিসেবে মনেপ্রাণে মেনে নিতে আর কোন আপত্তি নেই। রাসূল সা. আমরের অনাকাক্সিক্ষত ভুল মার্জনা করে তার জন্য দোআ করলেন এবং এই আনন্দের সংবাদ শুনে  শোকরিয়া আদায় করত: আলহামদুলিল্লাহ বলে ওঠলেন।

সাইদ সুলাইমিও অপ্রত্যাশিত সংবাদ শুনে শোকরিয়া আদায় করলেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে আখিযুগল সিক্ত হয়ে ওঠলো। (এই অশ্রু ছিল আনন্দের)
তখন সাইদ সুলাইমীকে হযরত উসমান রা. কাছে ডেকে নিয়ে বললেন- সাইদ এই নাও এ থলি; এতে দুহাজার দিরহাম আছে। আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন এদিরহাম  তোমাকে দিতে।

সাইদ দুহাজার দিরহাম নিয়ে রাসূলের দরবারে হাজির। রাসূলের সাথে সাক্ষাতের পর তিনি তাকে নির্দেশ দিলেন যাও এ দিরহাম নিয়ে বাজারে গিয়ে বিবাহের পোষাক বানাও। বিয়ের জন্য  তৈরি হও। প্রয়োজনীয় খরচ কর। সাইদ সুলাইমি সুখময় জীবনের স্বপ্ন বুনতে বুনতে বাজার পথে চলছেন। সেই কাক্সিক্ষত রাজরাণীর কল্পনা করতে করতে এগিয়ে চলছেন বাজারের দিকে। এভাবে দ্রুতই চলে আসলেন বাজারে। বাজারে মানুষের শোরগোল ও হৈহুল্লোড় তার কানে আটকাতে পারেনি ঘোষকের ঘোষণা।

হঠাৎ তার কানে আওয়াজ এলো  কে যেন  ঘোষণা করছে ‘আর রাহিল, আর রাহিল’ বলে।
তখন সাইদ একটু সম্মুখপানে অগ্রসর হয়ে এক ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলেন কী হয়েছে?
জবাব এলো মদীনা মুনাওয়ারায় মক্কার কাফেররা আক্রমণ করেছে। এখন প্রয়োজন এমুহুর্তে রণপ্রস্তুতির। যুদ্ধের জন্য তৈরি হওয়ার। জিহাদে শরীক হওয়ার। তখন সাইদ ভুলে গেলেন তাঁর বিয়ের কথা। তিনি বিয়ের পোষাকের পরিবর্তে এবার খুঁজতে লাগলেন ঘোড়া ও তলোয়ার। কারণ তিনি সিদ্ধান্ত বদল করে নিয়েছেন। দুহাজার দিরহাম দিয়ে ভালো একটি ঘোড়া ও ধারালো তলোয়ার ক্রয় করে সোজা গিয়ে যুদ্ধের ময়দানে হাজির। তখন যুদ্ধময়দানে উভয়দলের সৈন্যবাহিনী লড়াইয়ের জন্য পূর্ণ পস্তুত। শুধু দলনেতাদের নির্দেশের অপেক্ষায়। মুসলিম সৈন্যবাহিনীর সামনে রাসূল সা. বক্তব্য রাখছেন। রাসূলের বক্তব্য চলাকালীন সময়ে ময়দানে সুনসান নিরবতা। প্রত্যেকেই একাগ্রতার সাথে খুব মনযোগসহকারে রাসূলের গূরুত্বপূর্ণ বক্তব্য শুনছেন। বক্তব্যের শেষ মুহুর্তে, যুদ্ধের শুরুলগ্নে হঠাৎ সকলের দৃষ্টি পড়লো হিজাব পরিহিত এক সওয়ারির দিকে। উপস্থিত সৈন্যরা কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালেন নেকাব পরিহিত সওয়ারির দিকে। তারা দেখলেন সওয়ারিটি মুসলিম সৈন্যবাহিনীর দিকে এগিয়ে আসছে। এসেই উচ্চ স্বরে আল্লাহু আকবার ধ্বনি তুললো। মুসলিম সৈন্যবাহিনীরা তাঁর তাকবীরের জবাব দিলেন। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সওয়ারিটি কাফির বাহিনীর ওপর সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
তাঁর অতর্কিত হামলার প্রতিরোধে প্রস্তুত ছিল না কাফের বাহিনী। তাঁর অতর্কিত আক্রমণের ফলে কাফের বাহিনীদের মাঝে প্রচন্ড ভয় ঢুকে গেল।

এক হামলায় তিনি কাফের বাহিনীর অনেক সৈন্যদের চিরতরে দুনিয়া থেকে নিঃশেষ করে দিলেন। নেকাব পরিহিত যুবকটি ছিল একা। তাঁর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে এসে যখন অনেকে নিহত হল তখন কাফেরদের মাঝে প্রতিশোধের আগুণ দাউদাউ করে জ্বলে ওঠলো। কাফির বাহিনীর শক্তিশালী কয়েকজন সৈন্য তাঁর ওপর একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো। অনেক তীর এসে যুবকটির শরীরে বিদ্ধ হল। কয়েকটি তীর তাঁর গায়ের একদিকে প্রবিষ্ট হয়ে অপরদিকে বেরিয়ে গেল। ফলে যুবক রক্তক্ষরণ হয়ে যন্ত্রণায় যমীনে লুটিয়ে পড়লো। এ নির্মম দৃশ্য প্রত্যক্ষ্য করে মুসলিম সৈন্যরা নিজেদেরকে সংবরণ করতে না পেরে সবাই ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে শাহাদতের দৃপ্ত শপথ নিয়ে কাফির বাহিনীর ওপর সম্মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রতিশোধের দৃপ্ত শপথ নিয়ে তারা কাফের বাহিনীর ওপর প্রতিশোধ নেয়া শুরু করল। শাহাদতের চেতনায় উজ্জিবীত হয়ে ঈমানের বলে বলিয়ান হয়ে লড়াই করার ফলে কাফির বাহিনীর সৈন্যরা পিছপা হতে লাগলো। এই যুদ্ধে কাফেরদের পরাজয় এবং মুসলমানদের বিজয় এসেছিলো। এবার লড়াই শেষ। বিজয়ের পর মুসলমানরা প্রচুর গণীমতের মাল অর্জন করেন।

রাসূল সা. ধীরে ধীরে নেকাব পরিহিত যুবকের কাছে এগিয়ে গেলেন। নিজ হাতে নেকাব সরালেন। চেহারা দেখার পর রাসূলের চোঁখ যুগল অশ্রু সিক্ত হয়ে গেল। এ যুবকটি তো আর কেউ নয়, আমার অত্যন্ত প্রিয় সাঈদ সুলাইমি। রাসূলের দু’চোখের পানি টপটপ করে যমীনে পড়তে লাগলো।

রাসূল সা. বললেন এই যুবকের বিয়ে ঠিকঠাক করে আমি কিছু দেরহাম দিয়ে বিয়ের খরচের জন্য বাজারে পাঠিয়েছিলাম, আর সে বাজারে এসে ঘোষকের কাছে থেকে যুদ্ধের আহব্বান শুনে, বিয়ের পোশাকের পরিবর্তে যুদ্ধের পোষাক কিনে, যুদ্ধে এসে সশরীরে শরীক হয়ে, শাহাদতের অমিয় পেয়ালা পান করলো। তারমত সৌভাগ্যবান যুবক আর কে হতে পারে! তখন রাসূল সা. অন্যান্য সাহাবীদের নিয়ে তার কাফন দাফনের ব্যবস্থা করলেন। লাশ নিয়ে দাফনের জন্য সবাই এগিয়ে চলছেন।

রাসূলও হেঁটে হেঁটে চলছেন সবার সঙ্গে। রাসূল সা. তাঁর জুতা খুলে পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে হাঁটছেন। জানাযা সমাপ্ত। রাসূল সা. নিজ হাতে সাঈদ সুলাইমির লাশ কবরে রাখলেন। এখনও লাশ কবরে ভালোভাবে রাখা হয়নি। প্রিয়নবী মুচকি হেঁসে কবর থেকে মাথা ওঠালেন। কিছু সময় পর আবারও মাথা ঝুকিয়ে লাশ ভাল করে কবরে রাখেন। লাশ দাফন শেষে সাহাবায়ে কেরামগণ রাসূলের কাছে জানতে চাইলেন- মুচকি হাসার কারণ। প্রতি উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন সাঈদের জানাযার সাথে এতবেশি ফেরেশতা চলছিল যে, মাটিতে পা রাখার জন্য যমীনের একটু জায়গাও খালি ছিল না। অপরদিকে জান্নাত থেকে হুরের কাফেলা নেমে এসেছিল তাকে স্বাগত জানাবার লক্ষ্যে।

হুরের দলের একজন তার হাত প্রসারিত করে বলছিল, হে রাসূল! এ বরকে (জামাই) আমার কোলে তুলে দিন।
আর এ কারণেই আমি পায়ের জুতা খুলে আঙ্গুল দিয়ে হাটছিলাম এবং লাশ কবরে রেখে মুচকি হাসছিলাম। (সুবহানাল্লাহ)
এই হতদরিদ্র ও কুৎসিত যুবককে নিয়ে জান্নাতের হুররা তাদের হাতকে প্রসারিত করে দিল। আল্লাহর রাসূল এই যুবকের জন্য অশ্রুসিক্ত করলেন। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাঁর ওপর সন্তুষ্ট, জান্নাতের হুরদের তার সেবায় নিয়োজিত রাখলেন।
এ ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। ইসলামে সাদা-কালো উচুঁ-নিচু, ধনী-গরীব সকলেই সমান। সুশ্রী-কুশ্রী সব আল্লাহর সৃষ্টি। কুশ্রী ও দরিদ্র বলে কাউকে হেয় পতিপন্ন বা হিংসা করা যাবে না। অসুন্দর বা গরীব হওয়ার কারণে কাউকে ঘৃণা করা যাবে না।

কারণ মানুষের আসল সৌন্দর্য হল তাঁর ‘নেক আমল’। যার আমল যত বেশি, যার ঈমান-আমল যত মজবুত সে মহান রবের কাছে ততই প্রিয়। হোক সে কুৎসিত, হোক না সে হতদরিদ্র; কিন্ত এতে কি আসেযায়! তার নেক আমলের মাধ্যমে তো সে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হয়ে যাবে।
নেক আমল নিয়ে প্রতিযোগিতা জরুরি। ধন-সম্পদ, অবয়বের  সৌন্দর্য দিয়ে নয়। অর্থকড়ি ও সৌন্দর্য আছে বলেই লাফ দেয়া যাবে না। আহঙ্কার বা হিংসা করা যাবে না।

কারণ অহঙ্কারই পতনের মূল। যার ভেতরে সামান্য অহঙ্কার থাকবে তার কোন আমল আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। ঐগুলো তো সবই আল্লাহর দান। কাজেই এগুলোর জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা অপরিহার্য কর্তব্য। অল্প ক’দিনের জিন্দেগীর সুখ-শান্তি পেয়ে অনন্তকালের জিন্দেগীর কথা ভুলে যাওয়া নিছক বোকামি বৈকি। দুনিয়ার আরাম-আয়েশ মাত্র ক’দিনের। হঠাৎ করে তা শেষ হয়ে যাবে। এর কোন গ্যারান্টি নেই। কাজেই দুনিয়া দুনিয়া বলে এর  পেছনে সময় নষ্ট করা বুদ্ধিমান মুমিনের কাজ নয়। বুদ্ধিমান মুমিন তারাই যারা আখেরাতের জন্য সঞ্চয় (প্রস্তুতি গ্রহণ) করে। বিয়ে-শাদী,ব্যবসা-বাণিজ্য সবক্ষেত্রেই ইসলামকে প্রাধান্য দিতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মুসলিম বাণিজ্য অভিযাত্রা

‘বিশ্ব ইতিহাসে বাণিজ্যকে আর কোনো ধর্ম এতটা বিকশিত করেনি, যতটা ইসলাম করেছে’— কথাটি ইতিহাসবিদ রিচার্ড ফোলজের। আর আরবদের ইতিহাস বিষয়ে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম পণ্ডিতদের একজন অ্যালবার্ট হাউরানি তার আ হিস্ট্রি অব দি আরব পিপলসে লিখেছেন, “ইসলামী যুগের তৃতীয় ও চতুর্থ শতকে (খ্রিস্টীয় নবম ও ১০ম শতক) ‘ইসলামী দুনিয়া’ বলে স্বীকৃত একটি দুনিয়ার আবির্ভাব ঘটে। এ দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে একজন পর্যটক মুসলমান শাসিত এবং মুসলমান অধ্যুষিত একটি ভূখণ্ডে সে কী দেখেছে, শুনেছে, সেটা বর্ণনা করতে শুরু করল। এটা সম্ভব হয়েছিল মানুষের চলাচলের মাধ্যমে। রাজত্ব এবং তাদের সেনাবাহিনীর চলাচল, ভারত মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগর দিয়ে বণিকদের চলাচল, শাসক ও ধনীদের পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষ কারুশিল্পীদের বিভিন্ন শহরে গমনের কারণে।

ইসলামী দুনিয়া থেকে আমদানি করা ও রফতানি হওয়া বিভিন্ন পণ্য, যেমন— বই, ধাতু নির্মিত সামগ্রী, সিরামিকস, বোনা কাপড় প্রভৃতির নকশা বা ধরনের মাধ্যমে এ দুনিয়ার একটি চিহ্ন পৌঁছে যাচ্ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে।” উল্লেখ্য, অ্যালবার্টের বইটি সম্পর্কে মধ্যপ্রাচ্যের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছেন, ‘অবশেষে সত্যি সত্যি আরবদের নিয়ে পাঠযোগ্য সংবেদনশীল একটি ইতিহাস আমাদের হাতে এসেছে।’ বিশিষ্ট ইতিহাসবিদদের প্রায় সবাই একমত যে, ইসলাম ও বাণিজ্যের বিকাশ হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। আধুনিক বাণিজ্যের অনেক রীতিনীতিকে আরবের মুসলমানরাই প্রতিষ্ঠা করেছিল।

বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে মুসলমানদের আধিপত্য ইসলামীকরণ বা ইসলামের বিকাশে সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রভাবক হিসেবে কাজ  করেছে। একজন ব্যবসায়ী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তিনি মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-চুক্তিতে বিশেষ সুবিধা পাবেন— এটা সবাই বুঝতেন। মুসলিম কর্মকর্তারা তাদের সম্প্রদায়ের জন্য যে বিশেষ সুবিধা দিতেন, তাও পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকত। অন্যদিকে ইসলামী আইন থেকেও কিছু সুবিধা মিলত। মুসলিম শাসন, বাণিজ্য ও ধর্মান্তরের মধ্যে এ সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ থেকে এটা বলা যায় যে, ইসলামীকরণ মূলত শুরু হয়েছিল সিল্ক রুটসংলগ্ন শহরাঞ্চলে। পরবর্তীতে তা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামাঞ্চলে। এরপর মধ্য এশিয়ার যাযাবর তুর্কিদের ইসলামের পতাকার তলে আসা শুরু হয় ১০ম শতকে। রেশম রাস্তায় বাণিজ্যে নেমে তুর্কিদের এ পরিবর্তন হয়েছিল।

উমায়য়েদের মুদ্রা,

অষ্টম শতকেই আরবের মুসলিম শাসকরা পূর্বদিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন। খলিফার রাজধানী দামাস্কাস থেকে বাগদাদে স্থানান্তর করা হলো। ৮২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ খলিফার বার্ষিক রাজস্ব বাইজানটিয়ান সাম্রাজ্যের পাঁচ গুণ দাঁড়ায়। ব্রদেলের মতে, মুসলিম দুনিয়া ‘পুঁজিবাদী’ একটি বাণিজ্যিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বিরাট সম্পদ ও সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছিল। ব্যবস্থাটি তখনকার সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রসর ছিল। এ বাণিজ্যিক ব্যবস্থাটি চীন, ভারত, পারস্য উপসাগর, ইথিওপিয়া, লোহিত সাগর, ইফরিকায়া ও আন্দালুসিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। ‘পুঁজিবাদী’ শব্দটি এক যুগের শব্দকে আরেক যুগে ব্যবহার বলে মনে করার কারণ নেই বলে মত দিয়েছেন ব্রদেল। ইসলামী দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত গুপ্তচররা বণিজ্য নিয়ে ঝুঁকি নিত।
একজন আরব লেখক ও বণিক হারিরি লিখেছিলেন,

‘আমি পারস্যের জাফরান চীনে পাঠাতে চাই, শুনেছি সেখানে ভালো দাম পাওয়া যায়। চীনা পোর্সেলিন জাহাজে করে পাঠাব গ্রিসে। গ্রিসের জরি পাঠাব ভারতে আর ভারতের লোহা আলেপ্পোতে, আলেপ্পোর কাচ ইয়েমেনে আর ইয়েমেনের ডোরাকাটা বস্তু পাঠাব পারস্যে।’

বিখ্যাত ফরাসি ইতিহাসবিদ ফার্নান্দ ব্রদেল মত প্রকাশ করেছেন, সে সময় বসরা বন্দরে বণিকদের মধ্যে যে সমঝোতা হতো, সেটা আজকের যুগের বন্দরের ক্লিয়ারিং সিস্টেম। ( ইসলামী খেলাফত কালের মুদ্রা দেখুন এখানে )

মুসলিম সাম্রাজ্যের গড়ে ওঠা এবং পরবর্তী সময়ে সেই ভূখণ্ডে অনেক রাষ্ট্রের তৈরি হওয়া বৃহৎ নগরের বিকাশের পথ করে দেয়। এসব শহরে ধনিক শ্রেণী ও সরকারের সম্পদ ও ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য খাদ্য, উৎপাদনের কাঁচামাল এবং বিলাসদ্রব্যের দরকার হয়ে পড়ে। নগরজীবনের এ পরিবর্তন ও জটিলতা ক্ষমতাবান বা বিদেশীদের নতুন ফ্যাশন অনুসরণের তাড়না জোগায়। নগরের নতুন চাহিদা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি দূরপথের বাণিজ্যকে (যা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল) নতুন পথ ও পদ্ধতির সন্ধান দেয়। দূরপথের বাণিজ্যের জন্য ভারী ও স্তূপাকারের মালপত্র উপযুক্ত ছিল না। শহরগুলোর খাদ্য চাহিদা পূরণ হতো নিকটবর্তী গ্রামাঞ্চল থেকে। কিছু পণ্যের মুনাফা এতটাই বেশি ছিল যে, অনেক দূরের পথে সেগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়াটাও ছিল ব্যবসার জন্য লাভজনক। মরিচ, অন্যান্য মসলা, মূল্যবান পাথর, মিহি কাপড়, পোর্সেলিন আসত ভারত ও চীন থেকে। পশমি কাপড় আসত উত্তরের দেশগুলো থেকে। এসবের বিনিময়ে আরব থেকে রফতানি হতো হাতির দাঁত, প্রবাল ও বোনা কাপড়। মধ্য-পূর্ব শহরগুলো শুধু ভোক্তাই ছিল না, তাদের নিজেদের ব্যবহার ও রফতানির জন্য বিভিন্ন কারখানাজাত পণ্যও উৎপাদন করত। কিছু উৎপাদন হতো বড় আকারে, যেমন— যুদ্ধের উপকরণ প্রস্তুত হতো রাষ্ট্রীয় অস্ত্র কারখানায়। এছাড়া তৈরি হতো প্রাসাদের জন্য মিহি কাপড়। চিনি পরিশুদ্ধকরণ ও কাগজ তৈরির কারখানাও ছিল। তবে এসব উৎপাদনের বেশির ভাগ হতো ছোট ছোট কারখানায়।

আধুনিক যুগে রেলগাড়ি, তারপর মোটরকার তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত স্থলপথের চেয়ে জলপথে পরিবহন অপেক্ষাকৃত সস্তা, দ্রুত ও নিরাপদ ছিল। অধিবাসীদের খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য এ সময় বড় শহরগুলো অবশ্যই কোনো সাগরের কাছে বা নদীপথের পাশে গড়ে উঠত। দীর্ঘপথের নৌ-বাণিজ্য এ সময় পরিচালিত হতো সাগরপথে, বিশেষত ভারত মহাসাগরে। আব্বাসীয় আমলে এ পথের বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল ইরাকের বসরা এবং পারস্য উপসাগরের ইরান উপকূলের সিরাত। এ দুটো স্থানই ছিল আব্বাসীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণে এবং রাজধানীর চাহিদা পূরণে অনুকূল অবস্থানে। ১০ম শতকে নৌ-বাণিজ্য পারস্য উপসাগর থেকে সরে লোহিত সাগরে চলে যায়। আর এর পেছনে ছিল বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে কায়রোর উত্থান। কায়রোর উত্থানের পেছনে ছিল ইতালির বাণিজ্য শহরগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদা। কিন্তু এটা ছিল মাত্র শুরু।

বিশ্রামরত মুসলিম কাফেলা

একসময় তারা চীনেও পৌঁছে যায়। তবে ১০ম শতকের পর তারা দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার বন্দরগুলো পেরিয়ে আর কোথাও যেত না। তারা দক্ষিণ ও পশ্চিম আরব ও পূর্ব আফ্রিকায় যেত। বসরা থেকে নদীপথে মালপত্র যেত বাগদাদে, বাগদাদ থেকে সিরিয়ার মরুপথ ধরে সিরিয়া এবং মিসর ও আনাতোলিয়ার মধ্য দিয়ে যেত কনস্টান্টিনোপল, ত্রেবিজোন্ডে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ ছিল বাগদাদ থেকে উত্তর-পূর্ব ইরানের নিশাপুর এবং সেখান থেকে মধ্য এশিয়া ও চীন। লম্বা দূরত্বে মালপত্র পরিবহন করা হতো উটের পিঠে আর কম দূরত্বে খচ্চর বা গাধার পিঠে। ইসলামী সাম্রাজ্যের পত্তনের পর নিকট-পূর্বের এলাকাগুলো থেকে চাকাযুক্ত পরিবহন যান অদৃশ্য হয়ে যায় এবং উনিশ শতকের আগ পর্যন্ত সেগুলো আর এ অঞ্চলে ফিরে আসেনি। এর পেছনে বিভিন্ন কারণকে দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেমন— রোমানদের পথগুলো ক্ষয়ে গিয়েছিল, আরব শাসকদের উট পালনে আগ্রহ ছিল, উটের পিঠে পণ্য পরিবহন চাকার গাড়ির তুলনায় বেশি সস্তা ছিল।

শুরুর দিকে ভূমধ্যসাগরে বাণিজ্য ছিল বেশ বিপজ্জনক এবং এর পরিসর ছিল সীমিত। পশ্চিম ইউরোপে তখনো রফতানি করার মতো উদ্বৃত্ত পণ্য উৎপাদন বা নিজেদের অধিক ভোগের সক্ষমতা অর্জন হয়নি। বাইজানটাইন সাম্রাজ্য চেষ্টা করছিল আরব নৌশক্তি ও নৌবাণিজ্যকে গণ্ডিবদ্ধ করে রাখার। দক্ষিণ উপকূল ধরে বাণিজ্য চলত স্পেন, মাগরিবের সঙ্গে— সিরিয়া ও মিসরকে যুক্ত করে। এক্ষেত্রে তিউনিসিয়া এক ধরনের বাজারই ছিল বলা যায়। এ পথ ধরে বণিকরা বিশেষত ইহুদি বণিকরা স্প্যানিশ সিল্ক, পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আনা স্বর্ণ এবং ধাতু ও অলিভ অয়েলের বাণিজ্য সৃষ্টি করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১০ম শতকে ভেনিস ও আমালফির সঙ্গে বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে।

বাণিজ্য মানে শহর, নগর। বসরা, কায়রো, দামাস্কাস, তিউনিস, কর্ডোবাসহ আরো অনেক ছোট ছোট নগর গড়ে ওঠে। অ্যালবার্ট মুসলিম দুনিয়ায় বড় বড় শহর গড়ে ওঠার পেছনে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভূমিকা ব্যাখ্যা করেছেন, “কৃষক ও যাযাবররা তাদের নিজেদের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি উৎপাদন করতে পারতেন। কৃষকরা তাদের নিজেদের ঘর নিজেরাই কাঁদা-ইট দিয়ে তৈরি করতে পারতেন। কম্বল ও কাপড় বুনতে পারতেন ঘরের নারীরা। আর ধাতুর কাজ করে দিতেন ভ্রাম্যমাণ কারিগররা। যাহোক, তাদের উৎপাদনের উদ্বৃত্ত অন্যান্য জিনিসের জন্য
বিনিময় করার প্রয়োজন হতো। এক্ষেত্রে তাদের উৎপাদনের উদ্বৃত্তের সঙ্গে বিনিময় হতো গ্রামাঞ্চলের অন্যান্য অংশের উৎপাদন বা দক্ষ কারিগরদের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্য, তাঁবু, আসবাব, পশুর প্রয়োজনীয় সামগ্রী, রান্নার সরঞ্জাম এবং অস্ত্রের। এগুলো তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল।

কৃষিভিত্তিক জেলাগুলোর সংযোগস্থলের কোনো সহজগম্য ও সর্বজনসম্মত সমাবেশস্থলে নিয়মিত বাজার বসত। সম্ভবত এগুলো সপ্তাহে একবার বসত, যেমন জানা যায় সুক আল-আরবা বা বুধবারের বাজারের কথা। এছাড়া বার্ষিক বাজারও ছিল, যেগুলোর জন্য বার নির্ধারিত হতো কোনো ‘স্রষ্টার প্রিয়’ মানব বা মানবীর মাজারের সংশ্লিষ্ট কোনো দিন অনুসারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব বাজারের কোনো কোনোটি স্থায়ী বসতি বা শহরের রূপ নেয়। শহরে কারিগরদের নিজেদের খাদ্য উৎপাদনের প্রয়োজন না থাকায় তারা তাদের পণ্য তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন। এসব বাজারনির্ভর শহরগুলো ছিল ছোট আকারের, প্রকৃতপক্ষে কোনো কোনো সময় কিছু গ্রামের চেয়েও ছোট। এসব শহরে থাকত কয়েকশ থেকে হাজারখানেক অধিবাসী, শহরে থাকত একটি কেন্দ্রীয় বাজার এবং একটি মূল সড়ক, যেখানে বিভিন্ন দোকান ও কারখানা থাকত। আশপাশের গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে এসব শহরের কোনো সুনির্দিষ্ট বিভেদরেখা ছিল না। শহরের কিছু মূল অধিবাসী ছাড়া অন্যরা পরিস্থিতি অনুযায়ী এসব শহর ও গ্রামের মধ্যে স্থানান্তরিত হতো। বড় শহর থেকে দূরবর্তী ছোট শহর বা মরূদ্যানের শহরের নিয়ন্ত্রণ থাকত সংশ্লিষ্ট এলাকার নিকটবর্তী গোত্রের শেখ বা স্থানীয় প্রভুদের হাতে। গোত্র বা গ্রামের জায়গিররা বাজারে ব্যবসা করত না। কারিগর ও বণিকদের গোত্রের রীতিনীতির বাইরে রাখা হতো। গোত্রের সদস্যদের কোড অব অনার বা গোত্রের প্রতিশোধের বাইরে রাখা হতো এদের।

তবে যা-ই হোক, কিছু শহর বাজারভিত্তিক শহরের চেয়ে বেশি কিছু ছিল। সেসব শহর ছিল বিভিন্ন ধরনের কৃষিভিত্তিক জেলার মিলনকেন্দ্র। এসব শহরে পণ্যের বিনিময় হতো ব্যাপকভাবে এবং এর বিনিময় প্রকৃতি ছিল জটিল। যেমন— উত্তর সিরিয়ার আলেপ্পো ছিল এমন এক মিলনস্থল, যেখানে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ সমতলে উৎপাদিত শস্য, উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে বন এবং ফলদ বৃক্ষের ফল, পাহাড়ে পালিত মেষ ও সিরিয়ার মরুভূমিতে পালিত উট ক্রয়-বিক্রয় হতো। শহরগুলোর আশপাশের জেলাগুলোয় খুব সহজে শহরের বাজারে আনা যায় এমন যথেষ্ট উদ্বৃত্ত খাদ্য ও কাঁচামাল উৎপাদন হলে সেসব শহর দক্ষ কারিগরদের কেন্দ্রে পরিণত হতো। আর এমন শহর যদি সাগর, নদী বা মরুভূমির পথের পাশে অবস্থিত হতো, একই ধরনের অন্য শহরগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকত, তাহলে সেই শহর মূল্যবান পণ্যের দূরগামী বাণিজ্যের সংগঠিত কেন্দ্র বা বন্দরে পরিণত হতো। আর এ বাণিজ্যে লাভ এতই বেশি হতো যে, বণিকরা সেই দূরযাত্রার ঝুঁকি ও খরচ দুটোই নিতে রাজি হতেন।

এ ধরনের পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকত এবং জীবনযাত্রা দশক বা শতাব্দীজুড়ে স্থিতিশীল থাকত, তাহলে সেখানে বড় নগর গড়ে উঠত। ইসলামী সাম্রাজ্য বিস্তৃত হওয়ায় এবং ইসলামী সমাজের বিকাশ ঘটায় ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং ইসলাম দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দালুসের কর্ডোভা, সেভিয়া ও গ্রানাডা; মরক্কোর ফেজ, মারাকেশ; তিউনিসিয়ার কেরাওয়ান (পরবর্তী সময়ে তিউনিস); মিসরের ফুসতাত এবং পরে কায়রো; সিরিয়ার দামাস্কাস, আলেপ্পো; পশ্চিম আরবের মক্কা, মদিনা; ইরাকের বসরা, মসুল, বাগদাদ ও ইরানের শহর ট্রানজোক্সানিয়া (মারওয়াননাহার) এবং উত্তর ভারত পর্যন্ত এক সারি বড় শহরের আবির্ভাবের উপযোগী শর্ত সৃষ্টি হয়। ইসলামের সূচনার আগেই এসব শহরের মধ্যে অনেকগুলো গড়ে উঠেছিল, অন্যগুলো ইসলামের বিজয় অভিযান বা তার পরবর্তী সাম্রাজ্যের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল। এসব শহরের বেশির ভাগই ছিল স্থলভাগে, সমুদ্রতীর থেকে বেশ ভেতরে। ভূমধ্যসাগরের মুসলিম নিয়ন্ত্রিত উপকূল অনিরাপদ ছিল এবং বন্দরগুলো সাগর থেকে শত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাযুক্ত ছিল।

দশম ও একাদশ শতকে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর বড় বড় শহর দুনিয়ার পশ্চিমাংশের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল। আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের শাসনামলে বাগদাদের জনসংখ্যা ছিল ১০ লাখ বা তার বেশি। সংখ্যাটা অবশ্যই অনেক বেশি। তবে এটা ছিল আয়তনে কায়রোর সমতুল্য শহর। ১৩০০ সাল নাগাদ এ শহরের ব্যাপক ক্ষয় হয় এবং এর কারণ ছিল পারিপার্শ্বিক শহরতলি এলাকার সেচ ব্যবস্থা ধসে পড়া এবং মোঙ্গলদের হাতে শহরের পতন। স্পেনের কর্ডোভাও প্রায় একই আকারের ছিল। পঞ্চদশ শতক নাগাদ আলেপ্পো, দামাস্কাস ও তিউনিসের জনসংখ্যা ছিল ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ। পশ্চিম ইউরোপে সে সময় কায়রোর সমআয়তনের কোনো শহর ছিল না। ফ্লোরেন্স, ভেনিস, মিলান ও প্যারিসের লোকসংখ্যা ছিল খুব সম্ভব ১ লাখ। আর ইংল্যান্ডের শহর, জার্মানি ও মধ্য ইউরোপের শহরগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট।”

শহরের প্রভাবশালী ও সম্পদশালী মানুষ ছিলেন বণিকরা। তারা গ্রামাঞ্চল থেকে কাঁচামাল ও খাদ্য শহরে আনতেন, আবার অনেকে মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী দূরবর্তী স্থানে রফতানি করতেন। সে সময় এ বাণিজ্যের মূল পণ্য ছিল টেক্সটাইলস, কাচ, চীন থেকে সংগৃহীত বাসনপত্র এবং এসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আনা মসলা। ইসলামের প্রাথমিক কালে এসব পণ্য আনা হতো উপসাগর, সিরাফ ও বসরার বন্দরগুলোয়। এসব বন্দর থেকে পণ্য পাঠানো হতো লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে মিসরের বন্দরে এবং সেখান থেকে কায়রোতে। আর এই কায়রো থেকেই পণ্য পুরো ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে পাঠানো হতো। এসব পণ্য হয় স্থলপথে অথবা সাগরপথে দামিয়েত্তা, রোসেটা ও আলেকজান্দ্রিয়া থেকে পরিবাহিত হতো। ইথিওপিয়া থেকে নীল নদে করে স্বর্ণ আনা হতো এবং তারপর ক্যারাভানে করে কায়রোতে পৌঁছানো হতো। নাইজার নদীসংলগ্ন এলাকা থেকে মাগরিবে স্বর্ণ আনা হতো সাহারার মধ্য দিয়ে। সুদান, ইথিওপিয়া ও স্লাভ অঞ্চল থেকে দাস আনা হতো।

তবে সব বাণিজ্যই মুসলিম বণিকদের হাতে ছিল এমনটা নয়। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার পণ্য পরিবহন বাণিজ্যের একটি বিরাট অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন ইউরোপের বণিক এবং তাদের জাহাজ। এসব ইউরোপীয় বণিকের মধ্যে শুরুর দিকে ছিলেন অ্যামালফি এবং তারপর জেনোয় ও ভেনিসের বণিকরা। পঞ্চদশ শতকে ফরাসি ও ইংরেজ বণিকদের আবির্ভাব ঘটে। মুসলিম শহরের বণিকরা মাগরিব, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার স্থলবাণিজ্য পথ এবং ভারত মহাসাগরের রুট নিয়ন্ত্রণ করতেন। অবশ্য পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে এসে পর্তুগিজরা কেপ অব গুড হোপ রুটটি চালু করে। আরবের বেশির ভাগ বণিক ছিলেন মুসলিম। যেমন— করিমি বণিকরা একটা সময় পর্যন্ত মসলা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বাগদাদ, কায়রো ও মাগরিবের ইহুদিদের সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে যোগাযোগ ছিল ইতালি, উত্তর ইউরোপ, বাইজানটিয়ান সাম্রাজ্যের। বড় শহরের এসব বণিক বাদে বিভিন্ন ছোট স্থানে অনেক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত জোট ছিল, যারা বিভিন্ন নির্দিষ্ট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন (আধুনিককাল পর্যন্ত এ ধারা বজায় ছিল। মাগরিবে শেষের দিকে এ ধরনের জোট ছিল তিউনিসিয়ার উপকূলের জারবা দ্বীপ, মজাব মরূদ্যান ও দক্ষিণ মরক্কোর সুস জেলায়)।

সিল্ক রুট

ব্যবসায়ের উদ্যোগ ছিল দুই ধরনের। একটি হলো অংশীদারি, যেখানে অনেক সময় একই পরিবারের সদস্যরা ব্যবসায়ে যুক্ত হতেন। এক্ষেত্রে কোনো পরিবারের দুই বা আরো বেশি সদস্য যুক্ত হতেন এবং ব্যবসায়ের ঝুঁকি ও মুনাফা তাদের বিনিয়োগের হার অনুসারে বুঝে নিতেন। অন্যটি ছিল কমেনডা (মুদারাবা)। এ পদ্ধতিতে একজন বিনিয়োগকারী বিশ্বস্ত কাউকে পণ্য অথবা পুঁজি জোগান দিতেন এবং সেই ব্যক্তি ব্যবসা করে বিনিয়োগকারীকে শর্তমতো মুনাফার অংশ ও মূল পুঁজি ফেরত দিতেন। এক শহরের বণিকের অন্য শহরে এজেন্ট থাকত। সুসংগঠিত ব্যাংক ব্যবস্থা না থাকলেও দূরবর্তী স্থানে ঋণ দেয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি ছিল। যেমন— রসিদের মাধ্যমে। ব্যবসায়ের মূল ভিত্তি ছিল মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বাস ও স্বীকৃত মূল্যবোধ।

বড় শহরগুলোয় স্থানীয় বাজারের জন্যও বিভিন্ন পণ্য উৎপাদিত হতো— টেক্সটাইল, ধাতব জিনিস, মাটির তৈরি জিনিস, চামড়াজাত পণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য। আর একটু বৃহৎ আকারের বাজার ধরার জন্য তৈরি হতো বেশ উন্নত মানের পণ্য, যেমন— সূক্ষ্ম ও মিহি কাপড়। প্রমাণ আছে, একাদশ শতক এবং তার পরবর্তী সময়ে মুসলিম দুনিয়ার বাইরের বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এর পরিবর্তে চীন, ভারত ও পশ্চিম ইউরোপে উৎপাদিত পণ্যের পরিবহন ব্যবসা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর কারণ ছিল ইউরোপে শহুরে জীবনের পুনরুজ্জীবন এবং বিশেষত ইতালিতে কাপড় তৈরির কারখানার বিকাশ।

সাধারণভাবে উৎপাদনের ইউনিট ছিল ছোট। একজন কারিগরের কয়েকজন শ্রমিক ও শিক্ষানবিশ থাকতেন। বড় আকারের কারখানা ছিল শাসক ও সেনাবাহিনীর জন্য উৎপাদন কাজে— অস্ত্র উৎপাদন কারখানা ও কাপড় উৎপাদনের রাজকীয় কারখানা এবং মিসর ও অন্যান্য অঞ্চলের চিনির কারখানা। তবে শহরের সঙ্গে মিশে থাকা একমাত্র গোষ্ঠী কিন্তু শুধু এ বণিকরাই নন। কারিগর ও দোকানিরা শহরে একটি শ্রেণী তৈরি করেছিলেন। কর্মকৌশল বংশপরম্পরায় পিতা থেকে পুত্রে প্রবাহিত হতো। দোকান অথবা কারখানার মালিকানা বংশপরম্পরায় রক্ষিত থাকত, তবে দোকান বা কারখানার সংখ্যা সীমিত থাকত জায়গার অভাব অথবা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের কারণে। একজন আধুনিক ইতিহাসবিদ দেখিয়েছেন, মূল বাজারের আকার, অবস্থা ও কারখানাগুলোর আকার নিয়ে লিও আফ্রিকানাস (১৪৮৫-১৫৫৪) ষোড়শ শতকে যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, বিশ শতকের শুরুতেও অবস্থাটা প্রায় তেমনই ছিল। এ কারিগর ও দোকানদাররা আয়ের দিক থেকে বড় বণিকদের তুলনায় পিছিয়ে ছিলেন। কারিগরি দক্ষতা আর খুচরা ব্যবসা করে মূল্যবান দ্রব্যের দূরপথের বণিকদের মতো উজ্জ্বল ভাগ্য তৈরি করা যেত না। অনেক কারিগরেরই যথেষ্ট পুঁজি ছিল না। কায়রোর একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, সে সময় অনেক দোকান ও কারখানার মালিক ছিল বড় বণিক ও ধর্মীয় ফাউন্ডেশন। কারিগররা সম্মান পেতেন। জনসংখ্যা বেশ স্থিতিশীল থাকায় সততার জন্য নির্দিষ্ট সাধারণ নিয়ম ও যথাযোগ্য কারিগরি দক্ষতাসহকারে সম্মানজনক বাণিজ্য অব্যাহত ছিল। কারিগরদের সম্মানের ক্ষেত্রে একটি ক্রম ছিল— মূল্যবান ধাতু ব্যবহারকারী কারিগর, কাগজ ও সুগন্ধি কারিগরদের সম্মান বেশি ছিল আর অপরিষ্কার কাজ, যেমন— কসাইয়ের কাজ, রঙের কাজ ও চামড়ার কারিগরদের সম্মান ছিল কম।

ইসলাম আফ্রিকায় সম্প্রসারণ হয়েছে মিসরের পথ ধরে। নীল নদের তীরবর্তী এ শহর ছিল আরব ও আফ্রিকার সংযোগস্থল। পূর্ব আফ্রিকায় মুসলিম বণিকরা আজকের দিনের সুদানে পৌঁছেছিলেন। আরব মুসলিম বণিকদের কাছ থেকে সুবিধা পেতে আফ্রিকার অনেক শাসকই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে মুসলিম বণিকরা আফ্রিকার দক্ষিণে এগোলেন এবং উপকূলীয় অঞ্চলের অভিজাত পরিবারের নারীদের বিয়ে করলেন। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়, অভিজাতদের মধ্যে একতাও বিস্তৃত হয়। এভাবে ইসলাম আরবের অভিজাত সম্প্রদায়ের ধর্ম হয়ে ওঠে। এ বাণিজ্যের মাধ্যমে আফ্রিকার পশ্চিমাংশে আফ্রিকা, আরব ও ইসলামী সংস্কৃতির মিলনে নতুন সামাজিক, রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভব ঘটে। অঞ্চলটি বর্তমানের তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া ও মরক্কো। পশ্চিম সাব-সাহারা অঞ্চলে ব্যবসায়ীদের আকর্ষণ ছিল লবণ ও স্বর্ণ। মুসলিম বণিকরা তাদের বিভিন্ন গুণাবলি ও পরামর্শ দিয়ে স্থানীয় শাসকদের মুগ্ধ করেন। আফ্রিকার পশ্চিমাংশে বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল ঘানা। স্থানীয় শাসকরা ঘোড়া এবং আরো কিছু প্রয়োজনে উত্তর আফ্রিকার ওপর নির্ভর করতেন। তাই বাণিজ্যের সুবিধায় ঘানার শাসকরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এভাবে ইসলামী দুনিয়া বাণিজ্য সম্পর্কের মাধ্যমে এশিয়ার সঙ্গে আফ্রিকাকে যুক্ত করেছিল। চীনে তৈরি একটি কম্বল এক বছরের মধ্যেই আলজেরিয়ায় পৌঁছে দেয়া সম্ভব ছিল। চীনে আবিষ্কৃত সুতা কাটার চরকা ইসলামী বাণিজ্যপথ ধরে ইউরোপে হাজির হয়।

এ বাণিজ্যপথের আরেকটি মূল্যবান অবদান ছিল বইয়ের স্থানান্তর। অর্থাৎ বইয়ের বাণিজ্যও বিকশিত হয়েছিল। বাগদাদ ও পারস্যে অনূদিত, লিখিত গ্রিক ও আরব দর্শনের বইপত্র বাণিজ্যপথ ধরেই ইউরোপে হাজির হয়। এসব গ্রন্থ ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তার বিকাশে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।

ইসলামী দুনিয়ায় অনেক ক্যারাভান রুট একে অন্যকে ছেদ করেছিল। ঐতিহ্যবাহী পুরনো পথগুলোর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন শহরের মধ্যে যোগাযোগের জন্য চাকাওয়ালা যান চলাচলের উপযোগী রাস্তা তৈরি হয়। ক্যারাভানের মূল চালিকাশক্তি ছিল উট। একটি ক্যারাভানে পাঁচ হাজার উটও থাকত। বিখ্যাত রেশমপথের যাত্রা পূর্বপ্রান্তে শুরু হতো চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজধানী জিয়ানে। সেখানে সুদৃশ্য মসজিদের দেখা পাওয়া যায়। এ পথ এশিয়ার সমরখন্দ, বুখারা, মের্ভ হয়ে পারস্য থেকে বাগদাদে যেত। আরেকটা পথ এশিয়ার মধ্য দিয়ে কৃষ্ণ সাগরের বন্দরে পৌঁছত। রাশিয়ার মধ্য দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত একটি পথ ছিল, যার মাধ্যমে ইসলামী দুনিয়ায় বিভিন্ন পণ্যের চালান আসত। আরেকটি ক্যারাভান চলার পথ ছিল বাগদাদ থেকে আরবের মরুভূমির মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগর পর্যন্ত।


এটা পড়ুন – বিটকয়েন — পরিচিতি ও শরঈ পর্যালোচনা


সড়কপথের পাশাপাশি নৌপথের মুসলিম বণিকরা তাদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। ভারত মহাসাগর ছিল ইসলামী দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য নৌপথ। নৌবাণিজ্য অপেক্ষাকৃত সহজ ও নিরাপদ ছিল। স্থানীয় নৌবাণিজ্য হতো নদীপথে। আর বণিকদের বড় বড় জাহাজ পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর, ভূমধ্যসাগর ও ভারত মাহসাগর হয়ে আফ্রিকার উপকূলে চলাচল করত। আরেকটি জলপথ ছিল শ্রীলংকা থেকে চীনের দক্ষিণাঞ্চলের গুয়াংঝৌ পর্যন্ত। সাগরের মৌসুমি বায়ু পূর্ব আফ্রিকা থেকে ভারত, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এ বাণিজ্য যোগাযোগকে সহজ করে দিয়েছিল।

ইসলামী দুনিয়ায় বাণিজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রা ব্যবস্থাপনাও নিজস্ব আকার ধারণ করতে থাকে। ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আবদ আল-মালিক পুরনো বাইজানটিয়ান ও সাসানিয়ার মুদ্রার পরিবর্তে নতুন মুদ্রার প্রচলন করেন। আগের মুদ্রায় শাসকদের প্রতিকৃতি বা ঐতিহ্যবাহী চিত্র অংকিত থাকত। কিন্তু ইসলামে চিত্রের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার কারণে কোরানের বাণীসংবলিত ক্যালিগ্রাফি দিয়ে মুদ্রা প্রচলিত হয়। মুসলমানদের প্রথম মুদ্রা ছিল স্বর্ণের দিনার। রোমানদের রৌপ্যমুদ্রা দিনারিয়াস থেকে এ নাম এসেছিল। মুসলমান বণিকরা বাণিজ্যে মূলত ব্যবহার করতেন রৌপ্যমুদ্রা বা দিরহাম। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বর্তমান ইউক্রেন, চীন ও জিম্বাবুয়েতে মধ্যযুগের প্রচুর দিরহাম খননের মাধ্যমে উদ্ধার করেছেন।

ক্রিস হারম্যান আ পিপলস হিস্টরি অব দি ওয়ার্ল্ড গ্রন্থে মুসলিমদের বাণিজ্য বিস্তারের একটি বিশেষ অর্জন সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বাণিজ্যের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছিল। এ ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রধান দপ্তর ছিল বাগদাদে আর শাখাগুলো বিস্তৃত ছিল ইসলামী দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে। এ ব্যবস্থায় চেক ও লেটার অব ক্রেডিটের প্রচলন ছিল। এর ফলে বণিকদের দূরযাত্রায় স্বর্ণ বা অর্থ নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলো না। বাগদাদ থেকে চেক নিয়ে মরক্কো, কর্ডোবা বা চীনে ভাঙানোর সুযোগ সৃষ্টি হলো। অনেক গবেষক মনে করেন, প্রক্রিয়াটি ছিল আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার একটি রেপ্লিকা। সাসানিয়ান ব্যাংকিং মডেল থেকে এ ব্যবস্থা প্রেরণা পেয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

 

তথ্যসূত্র:


আ হিস্ট্রি অব দি আরব পিপলসঅ্যালবার্ট হাউরানি
আ হিস্টরি অব সিভিলাইজেশনফার্নান্দ ব্রদেল
রিলিজিয়নস অব দ্য সিল্ক রোডরিচার্ড ফোলজ
আ পিপলস হিস্টরি অব দি ওয়ার্ল্ডক্রিস হারম্যান
ট্রেড অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ইন দ্য মেডিয়েভাল ইসলামিক ওয়ার্ল্ড (প্রবন্ধ), ব্রাডলি এ. স্কিন

মহানবী সাঃ-এর বহুবিবাহ হৃদ্যতা ও প্রজ্ঞার দীপ্ত বহিঃপ্রকাশ

আলী হাসান উসামা ইসলামপূর্ব যুগে পৃথিবীর সর্বত্র একাধিক ( বহুবিবাহ ) বিবাহের প্রচলন ছিলো ব্যাপকভাবে। কোনো সভ্যতাই একে  দোষণীয় জ্ঞান করতো না ; বরং তা ছিলো ব্যক্তির বীরত্বের প্রতীক। ফলে যার ব্যত্যয় ঘটেনি যুগ শ্রেষ্ঠ নবীগণের ক্ষেত্রেও। বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে, “সোলায়মান আ.-এর সাতশো স্ত্রী ছিলো, যারা ছিলো রাজপরিবারের মেয়ে; এছাড়া তার তিনশো উপস্ত্রী তথা দাসী ছিলো।” [বাদশাহনামা-১১/৪] দাউদ আ. -এর স্ত্রী ছিলো নিরানব্বইজন, ইবরাহীম আ. -এর তিনজন, ইয়াকুব এবং মূসা আ. এর চারজন করে। [পয়দায়েশ – ২৯/৩০]

অধুনাও একাধিক বিবাহের ( বহুবিবাহ ) প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে পারেনি কেউ। ইউরোপ আমেরিকার প্রসিদ্ধ খ্রিস্টান গবেষকগণও একাধিক বিবাহকে উত্তম ও যথাযোগ্য বিধান বলে অভিহিত করেছেন। খ্রিস্টান গবেষক মিস্টার ডিউন পোর্ট একাধিক বিবাহের পক্ষে ইনজিলের বিভিন্ন আয়াত উল্লেখ করে বলেন, “এসব আয়াতের আলোকে এ কথা সুস্পষ্ট প্রতিভাত হয়, একাধিক বিবাহ শুধু এক উত্তম আমল নয়; বরং তাতে বিধাতার বিশেষ এক রহমত আছে।” অনুরূপ কথা পাদ্রি ফক্স, নেক্সন, জান মিলটন এবং এ্যাইজাক টেলরও বলেছেন। এখানে একটি কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, ইসলামপূর্ব যুগে একাধিক বিবাহের (বহুবিবাহ) কোনো সীমারেখা ছিলো না ফলে এক পুরুষের বিবাহে শতাধিক নারীও ছিলো এমনকি কোনো কোনো খ্রিস্টান পাদ্রি হাজারের অধিক নারীকে বিবাহ করেছেন, বিশেষত জার্মানিতে ষোল শতাব্দীর পূর্বে এর ব্যাপক প্রচলন ছিলো। তখনও কোনো ধর্ম এর বিরোধিতা করেনি,  ফলে সে যুগে নারীরা তাদের যথার্থ মর্যাদা থেকে বঞ্চিত ছিলো। তারা ছিলো শুধু পুরুষের ইন্দ্রিয় বাসনা চরিতার্থ করার বৈধ পাত্র। সমাজে ছিলো না তাদের কোনো মূল্যায়ন!

এরপর পৃথিবীর আকাশে যখন ইসলামের সূর্য উদিত হয়, তখন মানব প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে মহামহিম আল্লাহ একাধিক বিবাহের (বহুবিবাহ) অনুমতি দেন। নারীজাতিকে মর্যাদার আসনে সমাসীন রাখতে এর সংখ্যাও তিনি নির্ধারণ করে দেন। মহাপবিত্র ঐশীগ্রন্থ আল-কুরআনে যার বর্ণনা এরূপ- “নারীদের মধ্যে যাদেরকে তোমাদের পছন্দ হয় তাদেরকে বিবাহ করো দুই-দুইজন, তিন-তিনজন অথবা চার-চারজনকে। অবশ্য যদি আশংকা বোধ করো যে , তোমরা তাদের মধ্যে সুবিচার করতে পারবে না তবে এক স্ত্রীতে ক্ষান্ত থাকো। এ পন্থায় তোমাদের অবিচারে লিপ্ত না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। [সূরা নিসা – ৩]

দুই
পবিত্র ইসলাম একাধিক বিবাহকে সমর্থন করার বেশ কিছু যৌক্তিকতা আছে। এখানে সংক্ষেপে তার কয়েকটি তুলে ধরছি-

১. ইসলামী শরীয়তে একাধিক বিবাহের বৈধতা এজন্য যে, যাতে কেউ ইন্দ্রিয় বাসনা চরিতার্থ করার মানসে অপাত্রে লালায়িত না হয়। সমাজে সুস্থ সবল এমন বহু পুরুষ আছে যাদের জন্য শুধু এক নারী যথেষ্ট নয়। এখন যদি তাদেরকে একাধিক বিবাহ থেকে বারণ করা হয় তবে তাদের গুনাহে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। শরীয়ত তাই এমন লোকদেরকে একাধিক বিবাহের (বহুবিবাহ) অনুমতি দিয়েছে। সমাজ-সংসার যাতে সুস্থ ও সুন্দর থাকে, ব্যভিচারের ঘৃণ্য পাপে তা যাতে কলুষিত না হয়।

২. ঋতু চলাকালে নারীরা সহবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং এ সময়ে তাদের সাথে সহবাস করা শরীয়তের দৃষ্টিতেও অবৈধ ও ঘৃণিত। সুস্থ-সবল পুরুষেরা যাতে স্ত্রীদের ঋতুচলাকালে অন্য নারীর কাছে প্রত্যাগমন না করে, এ জন্য শরীয়ত একাধিক বিবাহের অনুমতি দিয়েছে। তদ্রুপ সন্তান গর্ভে থাকাকালীন নবজাতকের সুস্থতার প্রতি লক্ষ রেখে পুরুষদেরকে সহবাস থেকে বিরত থাকতে হয়। এমতাবস্থায় জৈবিক চাহিদায় তাড়িত হয়ে তারা যাতে অন্য নারীর দ্বারস্থ না হয়, এজন্য শরীয়ত একাধিক বিবাহের (বহুবিবাহ) অনুমতি দিয়েছে।

৩. স্ত্রী যদি বন্ধ্যা হয় ও সন্তান প্রসবে অক্ষম হয় তবে বংশধারা রক্ষা করতে গিয়ে স্বামী যাতে তাকে তালাক দিয়ে, সম্পর্কের অটুট বন্ধন ছিন্ন করে অন্যত্র প্রস্তাব পাঠাতে বাধ্য না হয়; বরং স্ত্রীকে তার স্থানে রেখে, যথাযথ মর্যাদা, ভরণ-পোষণ ও অন্যান্য খরচাদি দিয়ে স্বামী যাতে দ্বিতীয় কাউকে ঘরে তুলতে পারে এবং সকলে মিলে সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচনা করে সুন্দর এক পৃথিবী বিনির্মাণ করতে পারে এজন্য শরীয়ত একাধিক বিবাহের (বহুবিবাহ) অনুমতি দিয়েছে।

৪. অভিজ্ঞতা ও আদমশুমারির আলোকে দেখা গেছে, বিশ্বে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। নারী অপেক্ষা পুরুষের জন্ম স্বল্প হয়। অপরদিকে বিভিন্ন গোলযোগ ও দুর্ঘটনায় পুরুষের মৃত্যু বেশি হয়; এহেন পরিস্থিতিতে শরীয়ত যদি একাধিক বিবাহের অনুমতি না দেয় তবে বহু নারী জীবনে কখনো পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে না। প্রবৃত্তির চাহিদা মেটাতে তারা তখন বেছে নিবে বেশ্যাবৃত্তির পথ। অর্থের যোগান না থাকায় তারা আক্রান্ত হবে ভীষণ দারিদ্রে। বিশ্ব-বসুন্ধরা তখন হারিয়ে যাবে আঁধারের অতল গহবরে।

তিন
মোহাম্মাদে আরাবী সা. ছিলেন সত্য পথের দিশারী, গাঢ় অমানিশা বিদূরকারী। তার চরিত্রে ছিলো না কদর্য, ছিলো না কোনো পঙ্কিলতা। তার মর্যাদা সুউচ্চ সপ্ত আকাশের চেয়েও বহু ঊর্ধ্বে। বিন্দু পরিমাণ ত্রুটি নেই তার আদর্শ জীবনীতে। তিনি ছিলেন এক মহামানব, যার তুলনা কখনো মিলবে না নীল আকাশের নীচে! তার আলোকিত জীবন বিশ্ব-মানবতার আদর্শ, ধ্বংসের অতল গহ্বর থেকে মুক্তি ও উত্তরণের পথ। মহামহিম আল্লাহ বলেন, “অতি অবশ্যই রাসূলুল্লাহর জীবনীতে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ [সূরা আহযাব : ২১]

রাসূলুল্লাহর সা. -এর একাধিক (বহুবিবাহ) মাঝে সুপ্ত ছিলো বহু প্রজ্ঞা।  আরশের স্রষ্টা আল্লাহর নির্দেশেই তিনি এ মহৎ কাজ সম্পাদন করেছেন। আবূ সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ততক্ষণ আমি কোনো নারীকে বিবাহ করিনি এবং আমার মেয়েদেরকে অন্য কারো কাছে বিবাহ দেইনি যতক্ষণ না আমার প্রভুর পক্ষ থেকে জিবরাঈল আ. বিবাহের আদেশ সম্বলিত বার্তা না এনেছেন। [উয়ুনুল আছার – ২/৩০০, শরহে মাওয়াহিব – ৩/২১৯]

অধুনা ধরিত্রীর আধাঁরপ্রিয় জনগোষ্ঠী ইসলামের অনুসারীদের চোখে তাদের নবীর চরিত্র কলুষিত করতে বড় তৎপর মিডিয়াকে অবলম্বন করে মহানবীর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে তারা। রাসূলের সমুন্নত অতুলনীয় চরিত্রে কালিমা লেপন করতে বড় প্রয়াসী তারা! কিছুকাল যাবৎ মিডিয়ার সাহায্যে তারা ঢালাওভাবে প্রচার করছে, “ইসলামের নবী লম্পট ও কামুক। কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার উদ্দেশেই এগারোজন নারীকে তিনি বিবাহ করেছেন। যদিও উম্মতের কামুক ব্যক্তিদের জন্য বিধান করেছেন সর্বোচ্চ চার নারীকে বিবাহ করার বৈধতা।

সুস্পষ্ট ও প্রোজ্জ্বল একটি সত্য তাদের ধীশক্তি আয়ত্ত করতে না পারার কারণেই এহেন অশোভনীয় সংলাপ রটনার হঠকারিতা প্রদর্শন করতে তারা উদ্যত হয়েছে। কারণ সুস্থ বিবেকসম্পন্ন সকলেরই অবগতি আছে যে,

মানবজাতির যৌবনের সময়সীমা চল্লিশ বছর। মহানবী সা. যৌবনের মুকলিত প্রাংগণে বিবাহ করেছেন এক প্রৌঢ়া রমণীকে। এরপর তার সাথে ঘর করেছেন সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর। এ সময়ে তিনি দ্বিতীয় কোনো নারীকে বিবাহ করেননি।

রাসূল সা. যদি প্রকৃত অর্থে কামুকই হতেন (নাউযুবিল্লাহ) তবে যৌবনের দীপ্ত দিনগুলোতে অবশ্যই তিনি অন্য বহু নারীকে স্ত্রী অথবা উপস্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতেন; তদ্রপ আয়েশা রা. ব্যতীত রাসূলের অন্য সব স্ত্রীগণ ছিলেন বয়স্কা ও বিধবা। এর দ্বারাও প্রমাণিত হয়, তার বিবাহের উদ্দেশ্য কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা ছিলো না;  ছিলো অন্য কিছু। এজন্যই সে যুগের পাপিষ্ঠ কাফিরেরা- যারা ছিলো রাসূলের চরম শত্রু, রাসূলকে হত্যা করতে ও তার বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা করতে যারা ছিলো বদ্ধপরিকর ও সদা প্রয়াসী- রাসূল সা.-কে তারা কবি, যাদুকর আখ্যায়িত করেছে ঠিকই;  কিন্তু তাদের কেউই তার সুমহান চরিত্রের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয় প্রকাশ করেনি কভু! যা করছে অধুনা আলোর শত্রু অর্বাচীনেরা; বরং তাদের সকলেই বিনাবাক্যে স্বীকার করেছে, মোহাম্মাদ এক মহামানব, তার কোনো তুলনা নেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও! পবিত্র ঐশীগ্রন্থে তার সুমহান চরিত্রের প্রশংসা বিবৃত হয়েছে এভাবে, ‘নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী।’ [সূরা নূন- ৪]

পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে মহানবীর বহু বিবাহের (বহুবিবাহ) মাঝে সুপ্ত অসংখ্য প্রজ্ঞার কয়েকটি তুলে ধরছি।

১. মহানবী সা. যখন পঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ় তখন তার প্রিয় সহধর্মিনী মহিয়সী খাদীজা রা. প্রয়াত হন। মহানবীর জন্য সংসারের হাল ধরা তখন বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কাঁধে তার নবুওয়াতের গুরুদায়িত্ব, আবার সংসার পরিচালনা ও কোমলমতি শিশুদের দেখাশোনা! বংশের নারীরা তখন মহানবীকে দ্বিতীয় বিবাহের পরামর্শ দেন। আরবে তখন একাধিক বিবাহের প্রচলন ছিলো এবং তা ছিলো তাদের আভিজাত্যের প্রতীক।

মহানবী সা. দ্বিতীয় বিবাহের পক্ষে সম্মতি প্রদান করলে খাওলা বিনতে হাকীম রা. জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসূল, কিন্তু কার কাছে প্রস্তাব পাঠাবো? রাসূল সা. বললেন, খাওলা, তুমি কার কাছে প্রস্তাব পাঠানো সমীচিন মনে করো?  খাওলা রা. বললেন, যদি বিধবা কোনো রমণীকে বিবাহ করতে চান তবে আপনার প্রতি ঈমান আনয়নকারী ও আপনার অনুগত সাওদা অতুলনীয়। আর কুমারী মেয়েদের মধ্যে সবচে’ উত্তম হবে আপনার সুহৃদ আবু বকরের কন্যা আয়েশা। তখন রাসূল সা. বললেন, তবে উভয় ঘরেই প্রস্তাব পাঠানোর ব্যবস্থা করো। [শরহে মাওয়াহিব – ৩/২২৭] মহিয়সী খাদীজা রা.-এর প্রয়াণের এক মাস পরে নবুওয়াতের দশম বছরের শাওয়াল মাসে মহানবী সা. সাওদা বিনতে যাম’আকে গার্হস্থ্য কাজ পরিচালনার জন্য বিবাহ করেন।

২. খাদীজা ও হাফসা রা. ব্যতীত অবশিষ্ট নয়জন স্ত্রীকে মহানবী সা. আল্লাহর নির্দেশে  মোট তিনটি স্বার্থে বিবাহ করেছেন; ধর্মীয় স্বার্থে, রাজনৈতিক স্বার্থে ও কারো মনোরঞ্জনের স্বার্থে।

৩. রাসূলের কথা ও কাজ সবই শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত। কেননা তিনি আপন অন্তরপ্রসূত কোন কথা বলতেন না। যা কিছু বলতেন, যা কিছু করতেন সবই মহামহিম আল্লাহর নির্দেশে। ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রবৃত্তিতাড়িত হয়ে তিনি কোনো কথা বলেন  না। তার সব কথাই প্রভুকর্তৃক অবতীর্ণ ওহী।’ [সূরা নজম – ২, ৩]

মহানবী সা. সাহাবীগণের মজলিসে যে সকল কথা বলতেন, যে সকল কাজ করতেন সাহাবীগণ গুরুত্বসহকারে তার সবগুলোই সংরক্ষণ করতেন। কিন্তু গৃহের অভ্যন্তরে যা সকল অমীয় বাণী মহানবীর পবিত্র মুখ থেকে নিঃসৃত হতো এবং যে সকল কাজ তার থেকে প্রকাশ পেতো তা সংরক্ষণ করার মতো কেউ ছিলো না। কারণ এক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিলো প্রবল ধীশক্তিসম্পন্ন বুদ্ধিমতী এক নারীর উপস্থিতি। সাওদা রা. অধিক বয়স্কা হওয়ায় তার পক্ষে এ সুকঠিন দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়া প্রকৃত অর্থেই অসম্ভব ছিলো। মহামহিম আল্লাহ তাই এর জন্য সুন্দর ব্যবস্থা করেন। রাসূল সা. স্বপ্নযোগে আয়েশা রা.কে বিবাহ করার নির্দেশপ্রাপ্ত হন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, “রাসূল সা. একদিন আমাকে সম্বোধন করে বললেন, বিয়ের আগে তোমায় আমি দু’বার স্বপ্ন দেখেছি। একজন ফেরেশতাকে দেখেছি একটি অতি উজ্জ্বল রেশমি কাপড় নিয়ে আমার কাছে আসলেন। আমি তাকে বললাম, এটা উন্মোচিত করুন। তিনি তা উন্মোচিত করলেন। তখন দেখলাম তুমি তা থেকে বের হয়ে আসছো! তখন সেই ফেরেশতাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, যদি এ নির্দেশ আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় তবে অতি অবশ্যই তিনি তা কার্যকর করবেন।” [বুখারি – ৭০১২]

বিধাতার পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে মহানবী সা. নবুওয়াতের একাদশ বছরের শাওয়াল মাসে আয়েশা রা.-কে বিবাহ করেন। সম্পূর্ণ ধর্মীয় স্বার্থে তিনি তাকে বিবাহ করেন।

৪. জাহেলি যুগে আরবজাতির মাঝে একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস প্রচলিত ছিলো। তারা জ্ঞান করতো, পালক পুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং শরীয়তে তা অননুমোদিত ও নিষিদ্ধ। এ ভ্রান্ত বিশ্বাস সমাজ থেকে বিদূরিত করা ছিলো ইসলামের দাবী।  মহানবী সা. তার ফুফাত বোন যায়নাব বিনতে জাহাশ রা.কে বিয়ে দেন আপন পালক পুত্র যায়েদ বিন হারেসা রা -এর সাথে। যায়েদ রা. ছিলেন মহানবীর আযাদকৃত দাস; পক্ষান্তরে যায়নাব রা. ছিলেন উন্নত বংশের মেয়ে। তাই কোনোভাবেই তাদের মাঝে বনিবনা হচ্ছিলো না। শেষে অনন্যোপায় হয়ে যায়েদ রা. তাকে তালাক দেন। পৃথিবীতে নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য যেহেতু সকল আঁধার তাড়িয়ে তমসাচ্ছন্ন বিশ্বকে আলোকিত করা তাই মহামহিম আল্লাহর নির্দেশে মহানবী সা. যায়নাব বিনতে জাহাশ রা.কে বিয়ে করেন। যাতে মানবসমাজ থেকে একটি ভ্রান্তি বিতাড়িত হয় এবং পৃথিবী নামক গ্রহ সত্যের দীপ্তিতে শুভ্রোজ্জ্বল হয়। সূরা আহযাবের ৩৭ নং আয়াতে এ ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ বর্ণিত হয়েছে।

৫. মহানবী সা. ও তার সাহাবীগণ যখন কুরাইশের চোখে ধূলো দিয়ে সুদূর মদীনায় হিজরত করলেন। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ তখন ক্ষোভের অনলে দগ্ধ হয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্রের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দিলো। ফন্দি করে তারা মদীনাবাসীর কাছে এই মর্মে পত্র পাঠালো যে, ইসলাম গ্রহণকারী যে সব লোককে তোমরা আশ্রয় দিয়েছো তাদের থেকে দ্রুত তোমাদের আশ্রয় প্রত্যাহার করো এবং অনতিবিলম্বে তাদেরকে আমাদের হাতে সমর্পণ করো। নইলে আচমকা হামলা করে তোমাদের সকলকে মৃত্তিকার সাথে মিশিয়ে দেবো।

কুরাইশ নেতৃবৃন্দের চিঠির জবাবে মদীনাবাসী কোনো চিঠি পাঠায়নি।  ফলে তাদের হৃদয়ের নিভৃত গহীনে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠলো ক্ষোভের অনল। রণপ্রস্তুতি নিতে শুরু করলো তারা। যুদ্ধাস্ত্র ক্রয়ের জন্য আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে সিরিয়ার পথে যাত্রা করলো কুরাইশের এক কাফেলা। কাফেলাটি যখন সুদূর সিরিয়া থেকে যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে ফিরছিলো মুসলমানগণ তখন গোপন সূত্রে তা সম্পর্কে অবগত হলেন। দ্রুত রণপ্রস্তুতি নিয়ে পথিমধ্যে বাঁধ সাধলেন তারা।

খবর পেয়ে কুরাইশ কাফেলা বিকল্প পথে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে এগিয়ে চললো। মক্কায় অবস্থানকারী অবশিষ্ট কুরাইশরা যখন মুসলমানদের এহেন ধৃষ্টতার কথা জানতে পারলো বিরাট যুদ্ধবাজ সৈন্যদল নিয়ে তারা মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। এটাই ছিলো ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ। এরপর মুসলিম জাতিকে দমন করতে আরো তৎপর হয়ে ওঠলো তারা। অস্ত্রসজ্জিত বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে নিরীহ মুসলমানদের ওপর এভাবেই ক্রমাগত হামলা করছিলো যুদ্ধবাজ কাফিরেরা।

আলো-আঁধারের সে সকল যুদ্ধে ভবলীলা সাঙ্গ হচ্ছিলো নিরীহ বহুজনের। মহানবী সা. এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজছিলেন। তিনি ছিলেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আধার।  তার সব কাজেই ঘটতো প্রজ্ঞার দীপ্ত বহিঃপ্রকাশ।  বদর ব্যতীত অন্য সব যুদ্ধে কুরাইশ সৈন্যবাহিনীর প্রধান সেনাপতির ভূমিকায় ছিলো আবু সুফিয়ান। তার এক মেয়ে উম্মে হাবীবা মহানবী সা. -এর প্রতি ঈমান এনেছিলো ও নবীর নির্দেশে তার স্বামী উবাইদুল্লাহ বিন জাহাশের সাথে হাবশায় হিজরত করেছিলো। অকস্বাৎ সেখানেই তার স্বামী মারা গেলো। রাসূলের কানে এ সংবাদ পৌঁছলে বার্তাবাহকের মাধ্যমে হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশির কাছে উম্মে হাবীবা রা. কে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠালেন। বাদশাহ উম্মে হাবীবার কাছে মহানবীর বিয়ের প্রস্তাব দিলে প্রফুল্ল চিত্তে তিনি তাতে সম্মতি প্রদান করেন।

সপ্তম হিজরীর মুহাররম মাসে চারশ দিনার মোহর ধার্য করে মহানবী সা. কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবীবা রা.কে বিয়ে করলেন। রাসূলের এই রাজনৈতিক কৌশল বেশ ফলপ্রসু হয়েছিলো। এই বিয়ের পরে আবু সুফিয়ান একেবারে চুপসে গেলো। মদীনার মুসলমানদের ওপর হামলা করতে আর কখনো অগ্রসর হয়নি সে। কয়েকদিনের মধ্যেই তার মাঝে আমূল পরিবর্তন ঘটতে শুরু করলো। হৃদয় গহিনে তার ইসলামের ব্যপারে গভীর ভাবনার উদ্রেক হলো। অবশেষে ঈমানের দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হলো তার অন্তরাত্মা। মক্কা বিজয়ের পরে মহানবী সা. এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে ঈমানের সুশীতল বৃক্ষের ছায়াতলে আশ্রয় নিলো সেই আবু সুফিয়ান। রাসূলের প্রজ্ঞাপূর্ণ একটি বিবাহ মক্কাবাসীর সাথে দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ ও যুদ্ধকে প্রতিরোধ করেছিলো, বুকের তপ্ত খুন ঝরানোর মহড়াকে বিস্ময়করভাবে রোধ করেছিলো।


এটা পড়ুন – মহানবীর ﷺ বিছানা – যেমন বিছানায় ঘুমাতেন রাসুল সাঃ ।


৬। মহানবী সা. যখন নবুওয়াত প্রাপ্ত হলেন, সত্যের দীপ্ত মশাল হাতে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন সর্বত্র। পুণ্যের আলো ইহুদি গোষ্ঠী তখন বেঁকে বসলো, আপন মুখের ফুৎকারে নববী সেই আলোকে নিভিয়ে দিতে উদ্যত হলো। যেহেতু তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিলো শেষ নবী হবে তাদেরই গোষ্ঠীর কেউ। পরবর্তীতে যখন নবীরূপে আত্মপ্রকাশ করলেন ইসমাঈল আ. -এর বংশের মোহাম্মাদ, তখন তারা তাওরাতে শেষ নবীর ব্যাপারে বর্ণিত সুস্পষ্ট সকল প্রমাণাদি অস্বীকার করে বসলো ও বিরামহীনভাবে মহানবীর বিরোধিতা করতে লাগলো। তার চরম শত্র“তে পরিণত হলো। নবীর জীবনের যবনিকাপাত করার বাসনা লালন করছিলো তারা তাদের হৃদয়গহিনে। খায়বার যুদ্ধে মুসলমানদের সাথে লড়াইয়ে অন্যান্যদের সাথে নিহত হয়েছিলো বনু নাযীর গোত্রের শীর্ষ দুই ইহুদি নেতা হুয়াই ইবনে আখতাব ও কিনানা ইবনে আবুল হুকায়ক। বন্দি হয়েছিলো আরো অনেকে। বন্দিদের মধ্যে হুয়াই কন্যা ও কিনানা পত্নী সুফিয়া রা.ও ছিলেন। প্রথম স্বামী ইবনে মিশকামের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পরে সুফিয়া রা. কিনানাকে বিবাহ করেছিলেন। খায়বার যুদ্ধে বাবা ও স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি; ভাসছিলেন শোকসাগরে। প্রজ্ঞার আধার রাসূল সা. সুফিয়া রা. এর সাথে অন্যান্য বন্দিদের মতো আচরণ করেননি। এক সর্দারের কন্যা ও অপর সর্দারের স্ত্রী সুফিয়া রা. এর যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করেছেন তিনি। অবশেষে মহামহিম আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে ইহুদি গোষ্ঠীর সাথে সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচনা করার উদ্দেশে, জামাই হয়ে তাদের মাঝে ইসলামের আলো প্রচার করার স্বার্থে সপ্তম হিজরীতে সুফিয়া রা.কে বিবাহ করেন। বহুবিবাহ

৭. হযরত ওমর রা.এর মেয়ে হাফসা রা. তার প্রথম বিবাহ হয়েছিলো খুনাইস বিন হুযাফা রা.এর সাথে। খুনাইস রা. ছিলেন বদরী সাহাবী। বদর যুদ্ধের কিছুকাল পরে মদীনায় তার ইন্তেকাল হয়। হাফসা রা.কে নিয়ে তখন ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান ওমর রা। তার জন্য যোগ্য পাত্র নির্বাচন করতে ভাবনার সাগরে ডুবে পড়েন তিনি। অবশেষে প্রস্তাব নিয়ে উপস্থিত হন ওসমান রা. এর কাছে। ওসমান রা. বললেন, আমাকে কয়েকদিন ভাবনার অবকাশ দিন। কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পরে পুনরায় সাক্ষাৎ করেন ওমর রা। ওসমান রা. তখন বললেন, বর্তমান অবস্থায় নতুন কোনো বিবাহের আগ্রহ আমার নেই। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এলেন ওমর রা.  মাথায় যেনো ভেঙ্গে পড়েছে ততক্ষণে সুউচ্চ আকাশ। এরপর বিবাবের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন, আবু বকর রা.এর কাছে। প্রস্তাব শুনে নীরবতা অবলম্বন করলেন তিনি। সম্মতি কিংবা অসম্মতি কোনোটাই প্রকাশ করলেন না। এতে ওমর রা. ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লেন এবং অন্তরে পেলেন ভীষণ আঘাত। যেহেতু তার সাথে আবু বকর রা.এর বেশ হৃদ্যতা ছিলো তাই প্রস্তাব প্রদানের পরে আবু বকর রা.এর অপ্রত্যাশিত অবস্থাদৃষ্টে ওমর রা.এর বুক ছমছম করে ওঠলো।

বেদনার্ত হৃদয় নিয়ে সেদিন তিনি ফিরেছিলেন আপন গৃহে। এর কিছুদিন পরে রাসূল সা. হাফসা রা.কে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠালেন ওমর রা.এর কাছে। প্রস্তাব শুনে আনন্দের দ্যুতি বয়ে যায় ওমর রা.এর মুখাবয়বে। অতিরিক্ত কালক্ষেপণ না করে দ্রুত বিবাহের কাজ সম্পন্ন করেন তিনি। বিবাহের কয়েকদিন পরে আবু বকর রা. একান্তে সাক্ষাৎ করেন ওমর রা.এর সাথে। তখন ওমর রা.কে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, যখন তুমি হাফসার বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে এসেছিলে আর আমি নীরবতা অবলম্বন করেছিলাম তখন কি তুমি রাগ করেছিলে? ওমর রা. বলেন, সত্যি তখন আমার ভীষণ রাগ হয়েছিলো! আবু বকর রা. বললেন, তবে তোমাকে আমি তার রহস্য জানাচ্ছি।

রাসূল সা. হাফসাকে ঘরে তোলার ব্যাপারে আমার সাথে পরামর্শ করেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, আমি যখন তোমার মেয়ে আয়েশাকে বিয়ে করি তারপর থেকে লক্ষ করছি ওমরের বুকের নদীতে জোয়ার বইছে, হৃদয়গগনে তার কালো মেঘের আনাগোনা! তার মর্মবেদনা আমি অনুভব করেছি। তাই ঠাহর করেছি, বধুরূপে হাফসাকে ঘরে তোলবো। এ ব্যাপারে তোমার কী পরামর্শ? তখন আমি বলেছিলাম, অবশ্যই, এহেন পরিস্থিতিতে হাফসার স্বামীও যেহেতু পরলোকগমন করেছে আর ওমরের চুপসে যাওয়া বেদনা আবারো তাজা হচ্ছে তাই আপনার এ সিদ্ধান্ত আশা করি বড়ই উপকার বয়ে আনবে। আপনার সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ওমরের বেদনার্ত হৃদয়ে প্রশান্তির স্নিগ্ধ সমীরণ বইবে। ওমর ! হাফসার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যখন তুমি আমার কাছে এসেছিলে তখন রাসূলের গোপন ইচ্ছা প্রকাশ করার বাসনা আমার হয়নি বিধায় চুপ থেকেছি পরবর্তীতে রাসূল সা. যদি হাফসাকে বিয়ে না করতেন তবে আমার দৃঢ় ইচ্ছা ছিলো, আমি ওকে বিয়ে করবো। অনুরূপ বাক্যালাপ ওসমান রা.এর সাথেও ওমর রা.এর হয়েছিলো। সারকথা রাসূল সা. ওমর রা. এর মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যেই হাফসা রা.কে তৃতীয় হিজরীর শাবান মাসে বিবাহ করেন।

৮. অনুরূপ মনোরঞ্জনের উদ্দেশেই রাসূল. উম্মে সালামা রা.কে বিয়ে করেছিলেন। তার জীবন ছিলো বড় বেদনাবিধুর! পদে পদে সয়েছেন অবর্ণনীয় নিপীড়ন। তার বেদনাবিধুর জীবনী পাথর হৃদয়কেও অশ্রুর সাগরে ভাসায়! মহানবী সা.-এর নির্দেশে উম্মে সালামা আপন স্বামী আবু সালামা রা.-এর সাথে সুদূর হাবশায় হিজরত করেছিলেন। মক্কার পিশাচদের হাত থেকে নিজের ঈমানকে রক্ষা করতে অচেনা এক দেশে স্বামীর হাত ধরে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এরপর সেখান থেকে পুনরায় মক্কায়। অবশেষে স্বামীর সাথে হিজরত করেন প্রিয়নবীর শহর মদীনায়।  সেখানেই চতুর্থ হিজরীতে আবু সালামা রা. উম্মে সালামা রা.কে বিধবা করে পরলোকগমন করেন। পরিবার-পরিজন, ঘর-বাড়ি, ধনসম্পদ ও প্রাণেশকে হারিয়ে অকুল পাথারে ভাসতে থাকেন তিনি। আবার অবরুদ্ধ অবচেতনের ঢাকনা খুলে গেলে উদগ্র বাসনা কালো কেউটের মতো সর্পিলতায় পাক দিয়ে ফণা তোলে- এই মানুবজীবনের স্বভাব-প্রকৃতি। রাসূলের কানে এ খবর পৌঁছলে এহেন ভাবনায় তার দু’চোখ সাশ্রু হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় করুণার আধার রাসূল সা. উম্মে সালামা রা-এর বেদনা ভুলিয়ে দিতে এবং তার ভগ্ন হৃদয়ে সান্ত্বনার প্রলেপ লাগাতে, তার সাশ্র“ নয়নের অশ্র“ মুছে দিতে এবং সহায়-সম্বলহীন এক নারীর জীবনতরী এগিয়ে নিতে ওই বছরই শাওয়াল মাসে তাকে বিবাহ করেন।

৯. যয়নাব বিনতে খুযায়মা রা.। তিনি ছিলেন অনাথ মাতা নামে পরিচিতা। তার স্বভাব-বৈশিষ্ট্য ছিলো, প্রচণ্ড ভুখ থাকা সত্বেও সহাস্য বদনে নিজের আহার তুলে দিতেন অনাহারীর মুখে। তার স্বামী ছিলেন মহানবীর ফুফাত ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ.। উহুদের যুদ্ধে কাফির গোষ্ঠীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন তিনি। তার অংগ-প্রত্যঙ্গ কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে দয়াহীন অভিশপ্ত কাফিরেরা। বিরহের যাতনায় যায়নাব রা. -এর চোখ তখন সদা জলে-ছলছল। বাস্তবতার চপেটাঘাতে তার হৃদয়রাজ্যে তখন খলখল সর্বনাশা বান। এহেন পরিস্থিতিতে যায়নাব রা.-এর মনোরঞ্জনের উদ্দেশে রাসূল সা.  তাকে বিবাহ করেন।

১০. জুওয়াইরিয়া রা. বনু মুসতালিক গোত্রের সর্দার হারিসের মেয়ে। তার প্রথম বিবাহ হয়েছিলো মুসাফি’ ইবনে সাফওয়ানের সাথে। মুরায়সীর যুদ্ধে তার স্বামী নির্মমভাবে নিহত হয় এবং জুওয়াইরিয়া রা.সহ বনু মুসতালিকের একশ পরিবার, যাতে ছিলো সাত শতাধিক পুরুষ ও নারী মুসলমান সৈন্যবাহিনীর হাতে বন্দি হন। যুদ্ধলব্ধ সম্পদের সাথে বন্দিদেরকেও মুজাহিদদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হয়। জুওয়াইরিয়া রা. তখন সাহাবী সাবিত ইবনে কায়স রা.-এর ভাগে পড়েন। সর্দার কন্যার জন্য সাধারণ সাহাবীর দাসত্ব বরণ করা খুবই অপমানজনক ছিলো। জুওয়াইরিয়া রা. তাই নয় উকিয়া স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে সাহাবী সাবিত রা. এর দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তি লাভের চুক্তি করেন। কিন্তু চুক্তি পূরণের মতো সামর্থ্য যুদ্ধবন্দি জুওয়াইরিয়া রা.-এর ছিলো না। তাই তিনি এসে সহায়তা চাইলেন রাসূল সা.-এর কাছে। রাসূল সা.ও ভাবলেন তার দুরাবস্থার কথা। চুক্তির সকল অর্থ তিনি পরিশোধ করে দিলেন। এরপর পঞ্চম কিবা ষষ্ঠ হিজরীতে দূরদর্শী রাসূল সা. জুওয়াইরিয়া রা.-এর সম্মতিক্রমে তাকে বিবাহ করেন। রাসূলের বরকতপূর্ণ এ বিবাহের পরে সাহাবীগণ রা. তাদের অধীনস্ত বনু মুসতালিকের যুদ্ধবন্দি সকল দাসদাসীকে মুক্ত করে দেন। এভাবেই চরিত্রের মাধুর্য ও আত্মার উদারতা দিয়ে জনমানবের হৃদয়রাজ্য জয় করেন মহানবী সা.। যার ফলশ্রুতিতে কিছুকাল পরেই ধরিত্রীর সর্বত্র পতপত করে উড়তে শুরু করে ইসলামের হিলালী নিশান।
সারকথা, মহৎ সব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই প্রোঢ় হয়েও দশ দশটি বিবাহ করেন মোহাম্মাদে আরাবী সা.।  তার প্রজ্ঞাপূর্ণ এ সকল বিবাহ শান্তির বার্তা ছড়িয়েছিলো বিভিন্ন জনপদে, প্রশান্তির সমীরণ বইয়ে দিয়েছিলো ইসলামের ঘোর শত্রুদের হৃদয়রাজ্যে। মহামহিম আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়েই এ মহৎ কাজ সম্পন্ন করেন রাসূল সা.। কাম চরিতার্থ করার কোনও বাসনাই ছিলো না এই মহামানবের।

৫. ইসলামের আকাশে সদা জ্বলজ্বল করে জ্বলব নবীপত্নীদের অবদান। পারিবারিক জীবনযাপনে ইসলামের নীতিমালা তাদের মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়েছে। হাদীসের বিশুদ্ধ গ্রন্থাবলীতে তাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা দুই হাজার আটশ বাইশ। ইসলামী উম্মাহ কখনো শোধ করতে পারবে না নবীপতœীদের এই ঋণ। তারা সদা স্মৃতি হয়ে থাকবে মুসলমানদের হৃদয়ের মানসপটে। বহুবিবাহ

লেখক আলী হাসান উসামা
ইতিহাস গবেষক, দারুল উলূম দেওবন্দ, ইউপি, ভারত।

উপহাস-অবজ্ঞা করার পরিণতি ও রহস্য – কৌতুকের সীমারেখা

মুফতী মুহাম্মদ তক্বী উসমান দা.বা. অনুবাদঃ মুফতী মাহমুদ হাসান

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰ أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّن نِّسَاءٍ عَسَىٰ أَن يَكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ ۖ وَلَا تَلْمِزُوا أَنفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ ۖ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ ۚ وَمَن لَّمْ يَتُبْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ [٤٩:١١]

মুমিনগণ,কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই যালেম। (সূরা হুজরাত, আয়াত-১১)

উক্ত আয়াতে “তাসখীর”-এর অর্থ হলো, কারো অসম্মান ও তাচ্ছিল্য করা। এমনভাবে কারো দোষ বর্ণনা করা,যাতে মানুষ তাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করে,এতে ওই ব্যক্তির অন্তরে ব্যথা আসে। এ ধরনের কাজ অনেক রকম হতে পারে।

যেমন,কারো চলাফেরা,উঠাবসা,কথাবর্তা,অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি নিয়ে ব্যঙ্গ করা,কারো শারীরিক গঠন ও আকার-আকৃতি নিয়ে কটূক্তি করা তার কোনো কথা বা কাজের ওপর ঠাট্টা করা। চোখ, হাত-পা দ্বারা টিকা-টিপ্পনী মারা ইত্যাদি এ সকল জিনিস অন্তর্ভুক্ত।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,“দুনিয়ায় যারা কাউকে নিয়ে উপহাস করে তাদের জন্য আখিরাতে জান্নাতের দরজা খোলা হবে এবং তাদেরকে জান্নাতের দিকে ডাকা হবে। কিন্তু তারা যখন কাছে এসে জান্নাতের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে উদ্যত হবে তখনই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এভাবে বারবার তাদেরকে ডাকা হবে এবং প্রবেশ করতে গেলেই তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। একপর্যায়ে এভাবে করতে করতে সে নিরাশ হয়ে আর জান্নাতের দিকে ফিরে যাবে না। এভাবে দুনিয়ায় তার উপহাসের পরিণামে আখিরাতে তাকে নিয়ে এ ধরনের উপহাস করা হবে।

অনর্থক কথায় ইহকাল ও পরকালীন ক্ষতি :

কিছু লোক ঠাট্টা ও উপহাসকে হাস্য-রহস্যের অন্তর্ভুক্ত মনে করে কাউকে উপহাস করে বসে,অথচ উভয়ের মাঝে বিস্তর ব্যবধান।

রসিকতা শর্ত সাপেক্ষে বৈধ,যা নবী করীম (সা.) থেকেও প্রমাণিত।

শর্ত হলো, এতে যেন অসত্যের মিশ্রণ না হয় এবং কারো মনে কষ্টের কারণ না হয়। তাও সর্বদা ও অভ্যাসগত যেন না হয়,বরং কখনো কখনো হয়ে যাওয়া মন্দ নয়।

কিন্তু যে উপহাস ও ঠাট্টার কারণে কারো মনে ব্যথা আসে তা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। এ ধরনের উপহাসকেও বৈধ রসিকতার অন্তর্ভুক্ত মনে করা মূর্খতা এবং গোনাহের কারণ।

কারো উপহাস করা মুখের গোনাহের মধ্য থেকে একটি বড় গোনাহ। আমি গত মজলিসে এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এ কথা বলে ছিলাম যে অনর্থক কথা, অর্থাৎ এমন কথা বলা,যা দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণকর নয় তা মানুষকে কোনো না কোনো গোনাহে নিপতিত করার উসিলা হয়ে থাকে,তা থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। তা শুনে কোনো কোনো সাথী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে কখনো কখনো আমরা ঘরে বিবি-বাচ্চা ও মেহমানদের সাথে বিভিন্ন কথা বলে থাকি,ওই সময় কথা না বলে একদম চুপ করে থাকাটা মেহমানের হক্ব পরিপন্থী ও অসম্মান বোঝায় তখন কী করা উচিত?

তো ভালো করে বুঝে নেওয়া উচিত যে অনর্থক কথা বলা এক জিনিস,যাতে দ্বীন-দুনিয়া কোনোটিরই উপকার নেই এবং এর সাথে কারো হক্বও সম্পৃক্ত নয়।

অথচ আমাদের ওপর আমাদের বিবি-বাচ্চাদের হক্ব রয়েছে, তা আদায় করাও জরুরি। ইরশাদ হয়েছে, “তোমার ওপর তোমার নফসেরও একটি হক্ব রয়েছে এবং তোমার স্ত্রীরও হক্ব রয়েছে।” এখন যদি কোনো মানুষ অনর্থক কথা থেকে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে বিবি-বাচ্চাদের সাথেও কথা না বলে,তাহলে তাদের হক্ব নষ্ট হবে,তা কখনো জায়েয হবে না।

অনুরূপ মেহমানের সাথে চুপ করে বসে থাকা ওই মেহমানের অধিকার হরণ হকে । মেহমানের সঙ্গে কিছু আলাপ-আলোচনা করা এবং তাকে খুশি করাও সাওয়াবের কাজ। আর তা একজন মুসলমানের প্রাপ্য। মেহমানের সম্মান করতে হবে। এর জন্য তার মন রক্ষার্থে তার সাথে কথাবার্তা বলতে হবে।

তবে হ্যাঁ,এসব কিছুরও একটি সীমা রয়েছে,সীমাতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়।

মেহমানের হক্ব আদায়ের সীমা :

এ কথার ওপর আমার একটি ঘটনা স্মরণ হয়েছে। তা হলো অধিকাংশ সময় কিতাবাদি মোতালাআয় ব্যস্ত থাকি,বিশেষত যখন লাইব্রেরিতে মোতালাআর জন্য বসি,গবেষণার কাজে নিমগ্ন হই,কোনো বিষয় অন্তরে এলে কলম নিয়ে তা লিখতে উদ্যত হই;ঠিক তখনই কখনো কোনো মেহমান এসে পড়ে। সে সালাম-মুসাফাহা করে কথায় লেগে যায়। তখন এতে অন্তরে একটু বিরক্তির উদ্রেক হয় এবং বোঝা মনে হয়।

এ ব্যাপারে আমাদের হযরত শায়েখকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,ভাই! তুমি যে লেখালেখি ও পড়াশোনা করছ তা কি তোমার নফসের চাহিদা পূরণের জন্য করছ নাকি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করছ। যদি আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্যই এগুলো করে থাকো তাহলে এ মুহূর্তে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি হচ্ছে মেহমানের সম্মান ও আপ্যায়ন করা। এটিই এ মুহূর্তের হক্ব ও অধিকার।

যদিও তুমি আজকের দিনে এই কাজ সম্পাদনের শিডিউল করেছ,তবে যেহেতু এখন মেহমান এসে গেছে,কাজের ফাঁকে মেহমানকেও একটু সময় দেওয়া তার হক্ব এবং আল্লাহর হুকুম। সালাম-কালাম ও সংক্ষিপ্ত কথাই হোক। মেহমানকে ওই সময় পর্যাপ্ত সময় না দিতে পারলেও সংক্ষিপ্ত কথার পর পরবর্তীতে অন্য সময় দিতে পারো।

আর যদি তোমার পড়াশোনা-লেখালেখির কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নয়,বরং তোমার নফসের চাহিদা পূরণার্থে হয় এবং মেহমানকে সময় দিতে কষ্ট হয়,তাহলে তা নফসের গোলামী হবে। এটি কোনো শরীয়ত নয়। যে সময় আল্লাহর যে হুকুম সে সময় তা করার নামই হলো শরীয়ত।

হযরতের এ কথার দ্বারা আমার এ ব্যাপারে সকল সন্দেহ দূর হয়ে গেছে। অর্থাৎ মেহমানের সাথে প্রয়োজন অনুপাতে সালাক কালাম ও আলাপ-আলোচনার দ্বারা সময় নষ্ট হয় না,বরং তা মেহমানের হক্বের অন্তর্ভুক্ত এবং আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ ও সন্তুষ্টির কারণ।

তবে হ্যাঁ,মেহমানকেও আপনার সময় এবং কাজের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। অযথা যেন মেজবানের সময় নষ্ট না করে। অতিরিক্ত ও অনর্থক কথাবার্তায় লিপ্ত না হয়।

 কারো উপহাস করা উচিত নয় :

প্রয়োজনাতিরিক্ত কথাও অনর্থক কথার অন্তুর্ভুক্ত। সাধারণ কথা থেকে টেনে শয়তান গোনাহের দিকে কখন যে নিয়ে যাবে তা টেরও পাওয়া যাবে না। আমাদের মধ্যে কিছু মানুষ রয়েছে সিধেসাদা ও সরল প্রকৃতির। তাদেরকে নিয়ে কিছু মানুষ হাসি-তামাশা করে থাকে,সেই যেন একটা কৌতুকের বিষয় বস্তু। সে কৌতুক যদি এই পরিমাণে সীমাবদ্ধ হয় যাতে সে খুশি থাকে তাহলে তো আপত্তিকর নয়।

তবে যদি কৌতুক ও ঠাট্টা এ পর্যায়ে পৌঁছে যায়,যা তার অন্তরে কষ্ট দেয়,তার খারাপ লাগে,তাহলে এমতাবস্থায় উক্ত কৌতুক ও রহস্য অনেক বড় গোনাহের কারণ হবে।

কেননা তা বান্দার হক্বের সাথে সম্পৃক্ত। আর যে আয়াতটি আমি শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম। সূরা হুজুরাতের আয়াত, যাতে আল্লাহ তাআলা মুআশারাতের দিকনির্দেশনামূলক বেশ কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। ইরশাদ করেন

لا يسخر قوم من قوم

“কেউ যেন কারো উপহাস না করে।”

عسى ان يكونوا خيرا منهم

“হতে পারে যাদেরকে উপহাস ও তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে তারা (আল্লাহর নিকট) তোমাদের থেকে উত্তম।”

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেন, ولا نساء من نساء “অনুরূপ কোনো মহিলা অপর মহিলাকে তাচ্ছিল্য করবে না।” عسى ان يكن خيرا منهن “হতে পারে তাচ্ছিল্যকৃত মহিলা তোমাদের চেয়ে আল্লাহর নিকট উত্তম।”

কোরআনে কারীমের এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সুস্পষ্টভাবে কাউকে নিয়ে উপহাস করতে শক্তভাবে নিষেধ করেছেন।

এই আয়াতে মহিলাদেরকে বিশেষভাবে দ্বিতীয়বার উল্লেখ করা হয়েছে,যদিও আয়াতের প্রথম অংশের দ্বারাই মহিলা-পুরুষ সকলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। তার পরও মহিলাদের ব্যাপারটা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ আল্লাহ তা’আলাই বেশি জানেন।

তবে এর দুটি হিকমত বোঝা যায়।

এক.
সাধারণত মহিলাদের মধ্যে এ অভ্যাসটি বেশি পরিলক্ষিত হয়,তাই তাদেরকে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে।

দুই.
যেহেতু পুরুষদের মজলিস ভিন্ন হবে এবং মহিলাদের মজলিস ভিন্ন হবে,তাই পৃথক পৃথক উল্লেখ করে বোঝানো হয়েছে যে পুরুষ-মহিলার মজলিস ও চলাফেরা ভিন্ন ভিন্ন হওয়া উচিত। আজকাল যেরূপ নারী-পুরুষের যে অবাধ মেলামেশা এ আয়াতে ইঙ্গিতে তা নিষেধ করা হয়েছে।

কাউকে ঠাট্টা ও উপহাস করা কবীরা গোনাহ :

যা হোক! উক্ত আয়াতে কাউকে উপহাস করাকে সুস্পষ্ট গোনাহ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বিশেষভাবে এ কথাও বোঝানো হয়েছে যে তোমরা অন্যকে যে তাচ্ছিল্য করছ এর দ্বারা তোমরা নিজেকে বড় ও উত্তম ভেবেই অপরকে তাচ্ছিল্য করছ। এ তো চরম অহংকার যে নিজেকে উত্তম ভেবে অপরকে তুচ্ছ ভাবা হচ্ছে।

তবে স্মরণ রেখো,আল্লাহ তা’আলা বলছেন,“ওই সহজ-সরল সিধেসাদা যে ব্যক্তিকে তুমি তাচ্ছিল্য করছ,সে আল্লাহ তা’আলার নিকট কতটুকু মর্যাদাশীল। কারো শুধু চেহারা দেখেই তো তুমি বলতে পারবে না যে আল্লাহ তা’আলার সাথে তার কতটুকু সম্পর্ক।

প্রত্যেক বান্দার সঙ্গেই আল্লাহ তা’আলার বিশেষ একটি সম্পর্ক থাকে,এর মাঝে অনুপ্রবেশ করার কি অধিকার তোমার? তুমি কি জানো,সে আল্লাহর সাথে কী সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে, সে আল্লাহর কত প্রিয়? কারো শুধু বাহ্যিক অবয়ব দেখেই কোনো মন্তব্য করা যাবে না। কেননা মানুষ জানে না কার সাথে আল্লাহর সাথে আন্তরিকভাবে কতটুকু গভীর সম্পর্ক।

কাউকে জাহান্নামী বলা জায়েয নেই :

কতেক লোক কারো ব্যাপারে বলে দেয় যে সে তো জাহান্নামী,তার অমুক দোষ ইত্যাদি। নাউযুবিল্লাহ! কথাটি অনেক মারাত্মক কথা। জান্নাত-জাহান্নামের ফয়সালা আল্লাহ তা’আলার হাতে। কাউকে এ ধরনের কথা বলা উচিত নয়।

আল্লাহ তা’আলাই ভালো জানেন। বাহ্যিক কাউকে খারাপ,বদকার,ফাসেক মনে হলেও হযরত হাকীমুল উম্মত থানভী (রহ.)-এর পরামর্শ হলো,তার ব্যাপারে এই চিন্তা করবে যে হতে পারে আল্লাহ তা’আলা তার ভেতর এমন কোনো ভালো গুণ রেখেছেন,যার বদৌলতে তার সাথে আল্লাহর সাথে এমন মজবুত সম্পর্ক হয় যার উসিলায় তোমার চেয়ে মর্যাদায় আগে বেড়ে যাবে। আজ যদিও মন্দ মনে হচ্ছে,কাল হয়তো আল্লাহর রহমতে এমন পরিবর্তন হবে যে সবাইকে পেছনে ফেলে দেবে।

কাউকে দেখে নিজেকে বড় মনে করা,তার থেকে নিজেকে উত্তম মনে করা এবং ওই ব্যক্তিকে ছোট মনে করাকেই তাকাব্বুর বা অহংকার বলা হয়। অহংকার মারাত্মক ক্ষতিকর একটি জিনিস।

আল্লাহ তা’আলা দয়া করে সকল মুমিনকে তা থেকে হেফাজত করুন।

গোনাহগারকে তাচ্ছিল্য করাও হারাম :

এ জন্য আল্লাহ তা’আলার উক্ত ইরশাদ ব্যাপকভাবে সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য –

عسى ان يكون خيرا منهم

“হতে পারে ওই সব লোক তাদের থেকে উত্তম।” বাক্যটি ব্যাপক,মুত্তাকী পরহেযগার, গোনাহগার সকলেই অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপ- يا يسخر قوم من قوم বাক্যটিও ব্যাপক অর্থবোধক।

কেউ কারো উপহাস যেন না করে চাই উপহাসকারী যত বড় মুত্তাকী-পরহেযগারই হোক এবং উপহাসকৃত ব্যক্তি যত বড় ফাসেক ও গোনাহগারই হোক না কেন।

হ্যাঁ,এটা জায়েয আছে যে অমুক ব্যক্তির এ কাজটি গোনাহের কাজ এবং তা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইবে। কিন্তু গোনাহের কারণে গোনাহগার ব্যক্তিকে তাচ্ছিল্য ও অপমান করা বৈধ নয়।

কথাটি এভাবে বুঝতে পারো গোনাহগারকে মূলত অসুস্থ মনে করো। কেউ যদি কোনো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তার ওপর দয়ার আচরণ করা হয়। তার সাথে রাগ করা যাবে না,তাচ্ছিল্য ও অপমান করা যাবে না।

তো গোনাহগার বেচারাও একজন গোনাহের রোগী। কে বলতে পারে,হয়তো আল্লাহর নিকট তার কোনো কাজ পছন্দনীয় হয়ে আছে,যার বদৌলতে তাকে মর্যাদাবান করে দেবেন।


এটা পড়ুন – অন্তরের ১০টি রোগের বর্ণনা – যা আপনার আখেরাত বরবাদ করে দিবে ।


এ জন্য কখনো কাউকে তাচ্ছিল্য ও উপহাস করা যাবে না। তুমি বাহ্যিকভাবে যত বড় মুত্তাকী-পরহেযগারই হও, কিন্তু হতে পারে তোমার চেয়ে ওই উপহাসকৃত ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অনেক মর্যাদাবান।

 ইঙ্গিতেও কাউকে উপহাস করা বৈধ নয় :

কাউকে ইশারা-ইঙ্গিতে উপহাস করাও এর অন্তর্ভুক্ত। কারো কথাবার্তা,চালচলন বা গঠন-প্রকৃতি নিয়ে টিকা-টিপ্পনী মারা ও হাসাহাসি করা,যার কারণে সে কষ্ট পায়,তাও হারাম।

এক হাদীসে এসেছে,একদা উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জনৈকা স্ত্রীর ব্যাপারে আলোচনা প্রসঙ্গে ঈঙ্গিতে তাঁর গঠন বেঁটে হওয়ার কথা বললেন,শুধুমাত্র হাতের ইশারায় তা বলেছিলেন। কিন্তু রাসূল (সা.) তাঁকে বললেন,আয়েশা! তুমি মারাত্মক ভুল করেছ। হযরত আয়েশা (রা.)-কে কঠোরভাবে নিষেধ করলেন যেন কখনো কারো কোনো বিষয় নিয়ে তাচ্ছিল্য না করা হয়। যেরূপ সামনাসামনি কারো কোনো বিষয় নিয়ে এমন কথা বলা,যাতে ওই লোক কষ্ট পায়,তা তো মারাত্মক গোনাহ। সাথে সাথে উক্ত ঠাট্টা ও উপহাস যদি তার সামনে না করে তার অনুপস্থিতিতে করা হয় তাহলে তাতে দ্বিগুণ গোনাহ। উপহাস করার গোনাহ এবং গীবত করার গোনাহ।

হাসি-রহস্য ও উপহাসের মাঝে বিস্তর পার্থক্য :

কখনো কখনো বন্ধুদের মজলিসে পরস্পর হাসি-মশকরা হয়ে থাকে,যাতে এ কথা নিশ্চিত হয় যে এর দ্বারা কোনো সাথী মনে কষ্ট পায় না এবং ওই সব কথায় কেউ অপমান বোধ না করা নিশ্চিত হয় তাহলে তা বৈধ।

কিন্তু যদি এই সম্ভাবনা থাকে যে এর দ্বারা কারো মনে কষ্ট আসতে পারে কিংবা কেউ অপমান বোধ করবে তাহলে এ ধরনের হাসি-তামাশা কখনো বৈধ হবে না।

কারো উপহাস করার ভয়ংকর পরিণতি :

একটি হাদীসে এসেছে,যারা অন্য কারো উপহাস করে,তারা তো এই উপহাস করে বসেই থাকে,কিন্তু তাদের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। আখিরাতে তাদের সাথেও এ ধরনের উপহাস করা হবে। জান্নাতের দরজা খুলে তাদেরকে জান্নাতের দিকে ডাকা হবে,কিন্তু তারা যখন এগিয়ে এসে দরজা দিয়ে ঢুকতে যাবে,অমনিই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং তারা ফিরে যাবে। এরপর পুণরায় দরজা খুলে তাদেরকে ডাকা হবে,আবার যেইমাত্র তারা এগিয়ে এসে ঢুকতে যাবে তখনই দরজা পুনরায় বন্ধ করে দেওয়া হবে। এভাবেই তার সাথে বারবার উপহাস করতে থাকবে। একপর্যায়ে সে নিরাশ হয়ে আর জান্নাতের দিকে যাবে না। এই শাস্তি এই জন্যই যে তুমি দুনিয়ায় তোমার কথাবার্তায় কাউকে উপহাস করে কষ্ট দিয়েছিলে এখন দেখো এর মজা কী রূপ।

এ জন্যই সাবধান হওয়া উচিত,যেকোনো কথা বলার আগে মেপেজুখেচিন্তাভাবনা করেই তবে বলতে হবে।

রহস্য ও কৌতুকের সীমারেখা :

কেউ কেউ মানুষের উপহাস করাকে সাধারণ রহস্য ও কৌতুকের অন্তর্ভুক্ত মনে করে থাকে। অথচ উভয়ের মাঝে বিস্তর ব্যবধান।

হাসি-রহস্য হচ্ছে ওই সব কথাবার্তা,যার দ্বারা সকলের মনে প্রফুল্লতা আসে।

হযরত রাসূলে করীম (সা.) থেকেও তা প্রমাণিত। তবে শর্ত হলো, এ ক্ষেত্রে কোনো মিথ্যা ও অসারতার আশ্রয় নেওয়া যাবে না,কাউকে অপমান করা যাবে না। তাহলে তা বৈধ।

একটি হাদীসে এসেছে,জনৈকা বৃদ্ধা মহিলাকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন,কোনো বৃদ্ধা জান্নাতে যাবে না। এতদশ্রবণে বৃদ্ধা মহিলা কান্না আরম্ভ করল। তখন রাসূল (সা.) সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,আসল কথা হলো বৃদ্ধ অবস্থায় কেউই জান্নাতে যাবে না। অর্থাৎ জান্নাতে প্রবেশের সময় আল্লাহ তা’আলা সকলকে যৌবন অবস্থা ফিরিয়ে দেবেন।

তো রাসূল (সা.) ওই বৃদ্ধার সাথে রহস্য করতে গিয়ে কথাটি একটু ঘুরিয়ে বলেছেন,যা বৃদ্ধা বুঝতে পারেনি। তবে রাসূল (সা.)-এর কথায় অসত্যের মিশ্রণ হয়নি এবং ওই বৃদ্ধার মনে কষ্ট বা সম্ভ্রমহানিও হয়নি।

অনুরূপ একটি হাদীসে এসেছে,জনৈক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, তোমাকে আমি একটি উটের বাচ্চা দেব তখন লোকটি বলল,হুজুর! আমি তো বাহনের উট চেয়েছি,বাচ্চা দিয়ে কী কাজ হবে? রাসূল (সা.) বললেন,বাহনের উপযুক্ত বড় উটটিও তো কোনো একটি উটনীর বাচ্চা হবে।

সামান্য সময়ের জন্য রাসূল (সা.) লোকটির সাথে রহস্য করলেন। কিন্তু এতে কোনো অসত্যের আশ্রয় নেওয়া হয়নি এবং কাউকে কষ্টও দেওয়া হয়নি। এসব অবশ্যই বৈধ।

তবে এমন বৈধ কৌতুকও মাঝেমধ্যে হয়ে গেলে মন্দ নয়,কিন্তু নিয়মিত এতে লিপ্ত হয়ে যাওয়াও কাম্য নয়। মাঝেমধ্যে হলে ভালো।

তবে অবশ্যই ধর্তব্য যে এসব কৌতুক রহস্যের মধ্য দিয়ে কোনো মিথ্যার প্রচার যেন না হয়,কারো প্রতি দোষারোপ বা গীবত না হয়। সর্বোপরি কেউ যেন কষ্ট না পায়। অন্যথায় তা মারাত্মক গোনাহ হিসেবে বিবেচিত হবে।

সারকথা হলো,সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের উঠাবসা, চলাফেরা ও কথাবার্তা লাগাতার চলতে থাকে। মুখ দিয়ে কী বের হচ্ছে এর প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই,এতে কি কারো মনে কষ্ট দেওয়া হয়ে যাচ্ছে কি না,তারও খবর নেই। কী হবে এর পরিণতি।

পরিণতি সম্বন্ধে বেখবর হওয়া কখনো উচিত নয়। দুনিয়ার কাজকারবারে লিপ্ত হয়ে আখিরাতকে ভুলে যাওয়া অত্যন্ত বোকামি।

এ কথা স্মরণ রাখা উচিত,দুনিয়া থেকে আমার চলে যেতে হবে,আল্লাহর সামনে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। প্রতিটি কাজ ও কথার জন্য আমার জবাবদিহি করতে হবে।

অসতর্কতা ও গাফিলতিতে আমার থেকে যেন এমন কোনো কথা ও কাজ প্রকাশ না পায়,যার ফলে আখিরাতে আমার পরিণতি খারাপ হয়। এ জন্য সর্বদা অন্তরে আল্লাহ তা’আলাকে স্মরণ রাখবে। আল্লাহর নিয়ামতসমূহের শুকরিয়া জ্ঞাপন করবে।

সকল প্রয়োজনীয়তা আল্লাহর কাছে চাওয়ার অভ্যাস করবে। সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জীবনাচরণ অধ্যায়ন করবে। যেমন-আম্বিয়ায়ে কেরাম,সাহাবায়ে কেরাম ও নেককার ওলী-বুজুর্গদের জীবনী পড়ার দ্বারাও আখিরাতের ফিকির ও আল্লাহর স্মরণ লাভ হয়ে থাকে। যেরূপ নেককার ওলী-বুজুর্গদের সংশ্রবে থাকার দ্বারা আখিরাতের ফিকির লাভ হয়, তদ্রুপ তাদের জীবনাচরণ পড়ার দ্বারাও তা অর্জিত হয়। আল্লাহর ভালোবাসাপ্রাপ্ত বান্দাদের জীবনী-কথাবার্তা অধ্যায়নের দ্বারা অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা গভীর হয়। অন্তরে ঈমান তাজা হয়,গাফিলতি দূর হয়ে আখিরাতের ফিকির পয়দা হয়। এতে অযথা ও মন্দ কথাবার্তা-কাজকর্ম থেকেও মুক্ত হওয়া যায়। আল্লাহ তা’আলা নিজ দয়ায় আমাদের সকলকে এর তাওফীক দান করুন।

খালিদ বিন ওয়ালীদ রা ইসলামের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ অপারেজেয় সেনাপতির ইসলাম গ্রহণ

হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ রা. বলেন, আল্লাহ তাআলা যখন আমার মঙ্গলের ইচ্ছা করলেন তখন আমার অন্তরে ইসলামের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করলেন এবং আমার সামনে হেদায়েতের পথ উন্মুক্ত করে দিলেন। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম যে, আমি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, কিন্তু যুদ্ধ হতে ফেরার পর প্রত্যেক বারই মনে হয়েছে যে, আমার এই দৌড়-ঝাপ একটি নিরর্থক কাজ।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই বিজয় লাভ করবেন। তারপর যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন তখন আমিও মুশরিকদের একদল ঘোড় সওয়ারের সাথে রওয়ানা হলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের সাথে ‘উসফান’ নামক স্থানে আমার মুখামুখী হলেন। আমি তাঁর মোকাবেলায় দাঁড়িয়ে গেলাম এবং তাঁকে কিছু উত্যক্ত করতে চাইলাম (কিন্তু পারলাম না)।

তিনি আপন সাহাবীদেরকে নিয়ে আমাদের সামনে যোহরের নামায আদায় করতে লাগলেন। আমরা ইচ্ছা করেছিলাম যে, নামাযরত অবস্থায় তাদের উপর আক্রমণ করি, কিন্তু আমরা কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি বলে আক্রমণ করতে পারিনি। আর এই না পারার মধ্যেই আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত ছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুরভিসন্ধির কথা (ওহীর মাধ্যমে) জানতে পারলেন। অতএব তিনি সাহাবীগণ সহ আসরের নামায ‘সালাতুল খাওফের’ পদ্ধতিতে আদায় করলেন। এই ব্যাপারটি আমাদের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করল। আমি মনে মনে বললাম, এই ব্যক্তিকে (গায়েবীভাবে) হেফাজত করা হচ্ছে।

অতঃপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের পথ হতে এক পার্শ্বে সরে গেলেন এবং আমাদের ঘোড়ার রাস্তা ছেড়ে ডান দিকের রাস্তা ধরে অগ্রসর হলেন। তারপর তিনি যখন হুদায়বিয়াতে কুরাইশদের সাথে সন্ধি করলেন এবং কুরাইশগণ তাঁকে (বিনা যুদ্ধে) ফিরিয়ে দিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচাল তখন আমি মনে মনে বললাম, (এখন) আর কি বাকি রইল? আমি কোথায় যাব? নাজাশীর নিকট কি? সেখানেই বা কি করে যাই! নাজাশী তো স্বয়ং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসারী হয়ে গেছে এবং তাঁর সাহাবীগণ সেখানে নিরাপদ আশ্রয়ে কালাতিপাত করছে। নাকি হেরাকল এর নিকট চলে যাব? সেখানে গেলে তো নিজের ধর্ম ছেড়ে খৃষ্টান নচেৎ ইহুদী ধর্ম অবলম্বন করতে হবে এবং অনারব দেশে জীবন কাটাতে হবে। আর না অবশিষ্ট যারা আছে তাদের সাথে নিজ বাড়িতেই থেকে যাব? আমি এরূপ চিন্তা-ভাবনা করতেছিলাম।

ইতিমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (গত বৎসরের) কাযা ওমরা আদায়ের উদ্দেশ্যে মক্কায় প্রবেশ করলেন। আমি গা-ঢাকা দিলাম এবং তাঁর মক্কায় প্রবেশকালে উপস্থিত থাকলাম না। আমার ভাই ওলীদ ইবনে ওলীদ রা. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ওমরা আদায়ের উদ্দেশ্যে মক্কায় প্রবেশ করে আমাকে তালাশ করলেন। আমাকে না পেয়ে এই মর্মে চিঠি লিখলেন,

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, আম্মাবাদ, এখনও ইসলাম গ্রহণে তোমার মত হলো না, এটা অপেক্ষা বিস্ময়কর বিষয় আমি আর দেখি না। অথচ তুমি একজন বুদ্ধিমান লোক। ইসলামের ন্যায় দ্বীন সম্পর্কেও কি মানুষ অজ্ঞ থাকতে পারে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে বলেছেন, খালেদ কোথায়? সে যদি তার সকল প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম মুসলমানদের সাথে সংযুক্ত করত তবে তার জন্য অনেক ভাল হত এবং আমরা তাকে অন্যের উপর প্রাধান্য দিতাম। হে আমার ভাই! এযাবৎ নেক কাজের যে সকল সুযোগ তুমি হারিয়েছো, এখন তো অন্তত তা পূরণ করে লও।

হযরত খালিদ রা. বলেন, ভাইয়ের চিঠি পাওয়ার পর মদীনায় যাওয়ার জন্য আমার মন উগ্রীব হয়ে উঠল এবং ইসলামের প্রতি আগ্রহ বেড়ে গেল। আরো খুশি লাগল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছেন। এমন সময় একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, যেন আমি দুর্ভিক্ষ কবলিত কংকীর্ণ একস্থানে রয়েছি। অতঃপর সেখান হতে আমি এক সবুজ-শ্যামল ও প্রশস্ত একস্থানে বের হয়ে আসলাম। ভাবলাম, এটা নিশ্চয় সত্য স্বপ্ন হবে।

অতএব মদীনায় পৌঁছে ভাবলাম, হযরত আবু বকর রা. কে এই স্বপ্নের কথা বলব। তিনি শুনে বললেন, তোমাকে যে আল্লাহ তাআলা ইসলামের প্রতি হেদায়েত দান করেছেন এটাই তোমার সবুজ-শ্যামল ও প্রশস্ত এলাকায় বের হয়ে আসার ব্যাখা। আর নিজেকে যে সংকীর্ণ স্থানে দেখেছ, তা তোমার পূর্বেকার শিরকের অবস্থা।
হযরত খালিদ রা. বলেন, আমি যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট যাওয়ার দৃঢ়সংকল্প তখন চিন্তা করলাম, কাকে সঙ্গে নিব? এই ব্যাপারে সফওয়ান ইবনে উমাইয়ার নিকট সাক্ষাৎ করে বললাম, হে আবু ওহব! তুমি কি আমাদের অবস্থা দেখতেছ না? বর্তমানে আমাদের সংখ্যা মাড়িদাঁতের ন্যায় কমে গেছে।

অপরদিকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরব অনারব সকলের উপর জয়ী হয়ে গেছেন। অতএব আমাদেরও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট যেয়ে তাঁর অনুগত হয়ে যাওয়া উচিত। কারণ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মান আমাদেরই সম্মান। সফওয়ান আমার প্রস্তাব অত্যন্ত কঠোরভাবে প্রত্যাখান করে বলল, আমি যদি একাকীও থেকে যাই তবুও তার আনুগত্য কখনই করবো না। এই কথার পর আমি তার নিকট হতে চলে আসলাম এবং ভাবলাম, লোকটির পিতা ও ভাই বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছে। এই জন্য সে মানতে পারছে না।


এটা পড়ুন – সবুজ পোষাকের বীরাঙ্গনা ও ভিখারি শাহজাদা


অতঃপর ইকরামা ইবনে আবি জাহলের সাথে সাক্ষাৎ হল। তাকেও সেরূপ বললাম, যেরূপ সফওয়ানকে বলেছিলাম। ইকরামাও সফওয়ানের মতই জবাব দিল। আমি তাকে বললাম, আমার কথাগুলো গোপন রেখো। সে বলল, আচ্ছা কাউকে বলবো না। তারপর আমি ঘরে এসে আমার সওয়ারি প্রস্তুত করতে বললাম এবং সওয়ারি নিয়ে বের হয়ে গেলাম। চলার পথে ওসমান ইবনে তালহার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। মনে মনে ভাবলাম, সে তো আমার বন্ধু। তার কাছেই মনের কথা খুলে বলব। কিন্তু (মুসলমানদের হাতে) তার বাপ-দাদা নিহত হওয়ার কথা স্মরণ হওয়ায় তার সাথে আলোচনা করা সমীচীন মনে করলাম না।

আবার মনে হল, আমার কি আর ক্ষতি হবে? আমি তো এখনই রওয়ানা হয়ে যাব। সুতরাং তার সাথে বর্তমান পরিস্থিতির অবনতি সম্পর্কে আলোচনা করে বললাম, আমাদের অবস্থাতো গর্তের ভিতর আত্মগোপনকারী সেই শৃগালের ন্যায় হযে গেছে যে, এক বালতি পানি গর্তের মুখে ঢেলে দিলেই বের হয়ে আসবে। কথা প্রসঙ্গে উপরিউক্ত দুজনের সাথে যা বলেছিলাম তাও বললাম। শুনে সে তৎক্ষণাত রাজি হয়ে গেল। আমি বললাম, আমি তো আজই রওয়ানা হতে ইচ্ছা করেছি। আমার সওয়ারি ‘ফাজ্জ নামক’ স্থানে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। তারপর আমরা উভয়ে স্থির করলাম যে, ইয়াজুজ নামক স্থানে আমরা পরস্পর মিলিত হব। সে আগে পৌঁছে গেলে আমার জন্য এবং আমি আগে পৌঁছে গেলে তার জন্য অপেক্ষা করব।

হযরত খালিদ রা. বলেন, আমরা ভোররাত্রে ফজরের পূর্বেই রওয়ানা হয়ে গেলাম এবং ফজর পর্যন্ত ইয়াজুজে পৌঁছে আমরা পরস্পর মিলিত হলাম। সেখান হতে আমরা ভোরে রওয়ানা হলাম এবং হাদ্দায় পৌঁছে হযরত আমর ইবনে আস রা. এর সাথে আমাদের সাক্ষাত হল। তিনি আমাদেরকে দেখে বললেন, তোমাদেরকে মারহাবা! আমরা বললাম, আপনাকেও মারহাবা! তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কোথায় যাচ্ছ? আমরা জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কি উদ্দেশ্যে এসেছেন? তিনি বললেন, তোমরা কি উদ্দেশ্যে এসেছো? আমরা বললাম, ইসলাম গ্রহণ ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উদ্দেশ্যে এসেছি। তিনি বললেন, আমাকেও এই একই উদ্দেশ্য এখানে এনেছে।

অতঃপর আমরা তিনজন একসঙ্গে মদীনায় আসলাম এবং হাররায় আমাদের উটগুলিকে বসিয়ে অবতরণ করলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের আগমন সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন। আমি আমার (সফরের পোশাক পরিবর্তন করে) ভাল পোশাক পরিধান করলাম এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে চললাম। পথে আমার ভাইয়ের সাথে দেখা হলে সে বলল, তাড়াতাড়ি যাও, তোমার আগমন সংবাদে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনন্দিত হয়েছেন এবং তিনি তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমরা দ্রুত চললাম। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি দূর হতে নজর পড়তেই দেখলাম যে, তিনি আমার প্রতি চেয়ে মুচকি হাসছেন। আমি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, আসসালামু আলাইকা ইয়া নবীআল্লাহ! তিনি হাসিমুখে আমার সালামের উত্তর দিলেন। আমি বললাম, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল।’

তিনি বললেন, কাছে আস। তারপর বললেন, সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য যিনি তোমাকে হেদায়েত দান করেছেন। তোমার বুদ্ধি বিবেচনা দেখে আমি এরই আশা করেছিলাম যে, তুমি ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করবে। হযরত খালেদ রা. বলেন, আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি হকের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে আপনার বিরুদ্ধে যে সকল যুদ্ধ করেছি আমার তা স্মরণ আছে। আপনি আল্লাহর নিকট দুআ করুন যেন আমাকে মাফ করে দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইসলাম পূর্বেকার সকল গুনাহ মিটিয়ে দেয়। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, তবুও আপনি দুআ করুন। তিনি দুআ করলেন, হে আল্লাহ! খালেদ ইবনে ওলীদ আপনার পথে বাধা প্রদানের যত প্রচেষ্টা করেছে তা সবই আপনি ক্ষমা করে দিন।

হযরত খালিদ রা. বলেন, অতঃপর হযরত ওসমান ও হযরত আমর রা. অগ্রসর হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বাইআত হলেন। হযরত খালিদ রা. বলেন, আমরা অষ্টম হিজরীর সফর মাসে মদীনায় গিয়েছিলাম। আল্লাহর কসম, যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কোন সাহাবীকে আমার সমকক্ষ মনে করতেন না। [আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া]
লেখিকা: গ্রন্থ প্রণেতা, সম্পাদক ও প্রকাশক ‘মাসিক আল জান্নাত

সময় আছে এখনো,শুধরে নিন নিজেকে আর ভয় করুন আল্লাহকে ।

ইবনে উমর (রাঃ) বলেন, এক-দুইবার বা পাঁচ-সাতবার নয় বরং এর চেয়েও বেশীবার আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে, বনী ইসরাইলে কিফল নামে এক ব্যক্তি ছিল। সে কোন গুনাহের কাজকে ছাড়ত না। একবার এক মহিলা (অভাবে পড়ে) তার কাছে আসলে, সে ব্যভিচারের শর্তে তাকে ষাট দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) দেয়। যখন সে ঐ মহিলার সাথে বদকাজ করতে উদ্যত হলো, তখন মহিলাটি (আল্লাহর ভয়ে) প্রকম্পিত হয়ে কেঁদে ফে…লল। লোকটি বললঃ কাঁদছ কেন? আমি কি তোমাকে যবরদস্তী করেছি?

মহিলাটি বললঃ না, আমি এ গোনাহের কাজ কখনো করিনি। আজ কেবল অভাবের তাড়নায় পড়ে এতে বাধ্য হচ্ছি। লোকটি বললঃ অভাবের তাড়নায় পড়েই তুমি এসেছ অথচ কখনো তা করনি!? যাও তোমাকে ছেড়ে দিলাম। দিনারগুলোও তোমারই। সে আরো বললঃ আল্লাহর কসম! এরপর আর কখনো আমি আল্লাহর নাফরমানী করব না।

পরে এ রাতেই কিফল মারা যায়। সকালে তার ঘরের দরজায় লেখা ছিলঃ “আল্লাহ্‌ তা’আলা কিফলকে মাফ করে দিয়েছেন।”

{ জামে তিরমিযি,হাদিস নং- ২৪৯৮, মুসনাদে আহমাদ,হাদিস নং- ৪৭৪৭}

আরেকটি হাদীসঃ

আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন সাহাবা, নাম থা’লাবা (Tha’laba, বাংলায় অনেক সময় সালাবা বলা হয়)। মাত্র ষোল বছর বয়স। রাসূল (সা) এর জন্য বার্তাবাহক হিসেবে এখানে সেখানে ছুটোছুটি করে বেড়াতেন তিনি। একদিন উনি মদীনার পথ ধরে চলছেন, এমন সময় একটা বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাঁর চোখ পড়ল দরজা খুলে থাকা এক ঘরের মধ্যে। ভিতরে গোসলখানায় একজন মহিলা গোসলরত ছিলেন, এবং বাতাসে সেখানের পর্দা উড়ছিল, তাই থা’লাবার চোখ ঐ মহিলার উপর যেয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে উনি দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন।

কিন্তু থা’লাবার ( সালাবা ) মন এক গভীর অপরাধবোধে ভরে গেল। প্রচন্ড দুঃখ তাকে আচ্ছাদন করল। তার নিজেকে মুনাফিক্বের মত লাগছিল। তিনি ভাবলেন, ‘কিভাবে আমি রাসূল (সা) এর সাহাবা হয়ে এতোটা অপ্রীতিকর কাজ করতে পারি?! মানুষের গোপনীয়তাকে নষ্ট করতে পারি? যেই আমি কিনা রাসূল (সা) এর বার্তা বাহক হিসেবে কাজ করি, কেমন করে এই ভীষণ আপত্তিজনক আচরণ তার পক্ষে সম্ভব?’ তাঁর মন আল্লাহর ভয়ে কাতর হয়ে গেল। তিনি ভাবলেন, ‘না জানি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমার এমন আচরণের কথা রাসূল সা এর কাছে প্রকাশ করে দেয়!’ ভয়ে, রাসূল (সা) এর মুখোমুখি হওয়ার লজ্জায়, তিনি তৎক্ষণাৎ ঐ স্থান থেকে পালিয়ে গেলেন।

এভাবে অনেকদিন চলে গেল। রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়ালাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য সাহাবাদের কে থা’লাবার( সালাবা কথা জিজ্ঞেস করতেই থাকতেন। কিন্তু সবাই জানাল কেউ-ই থা’লাবা কে দেখেনি। এদিকে রাসূল সা এর দুশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়ছিল। তিনি উমর (রা), সালমান আল ফারিসি সহ আরো কিছু সাহাবাদের পাঠালেন থা’লাবার খোঁজ আনার জন্য। মদীনা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও থা’লাবার দেখা মিলল না। পরে মদীনার একেবারে সীমানাবর্তী একটা স্থানে, মক্কা ও মদীনার মধ্যখানে অবস্থিত পর্বতময় একটা জায়গায় পৌঁছে কিছু বেদুঈনের সাথে দেখা হল তাদের। সেখানে এসে তারা থা’লাবার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে শুরু করলেন। ‘তোমরা কি লম্বা, তরুণ, কম বয়সী একটা ছেলেকে এদিকে আসতে দেখেছ?’

বেদুঈনগুলো মেষ চড়াচ্ছিল। তারা জবাব দিল, সে খবর তারা জানেনা, তবে তারা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কি ক্রন্দনরত বালকের সন্ধানে এসেছ?’ একথা শুনে সাহাবীরা আগ্রহী হয়ে উঠলেন এবং তার বর্ণনা জানতে চাইলেন। উত্তরে ওরা বলল, ‘আমরা প্রতিদিন দেখি মাগরিবের সময় এখানে একটা ছেলে আসে, সে দেখতে এতো লম্বা, কিন্তু খুব দুর্বল, সে শুধুই কাঁদতে থাকে। আমরা তাকে খাওয়ার জন্য এক বাটি দুধ দেই, সে দুধের বাটিতে চুমুক দেয়ার সময় তার চোখের পানি টপটপ করে পড়ে মিশে যায় দুধের সাথে, কিন্তু সেদিকে তার হুঁশ থাকেনা!’ তারা জানালো চল্লিশ দিন যাবৎ ছেলেটা এখানে আছে। একটা পর্বতের গুহার মধ্যে সে থাকে, দিনে একবারই সে নেমে আসে, কাঁদতে কাঁদতে; আবার কাঁদতে কাঁদতে, আল্লাহর কাছে সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা করতে করতে উপরে চলে যায়।

সাহাবারা বর্ণনা শুনেই বুঝলেন, এ থা’লাবা না হয়ে আর যায় না।

তবে তাঁরা উপরে যেয়ে থা’লাবা ভড়কে দিতে চাচ্ছিলেন না, এজন্য নিচেই অপেক্ষা করতে লাগলেন।

যথাসময়ে প্রতিদিনের মত আজও থা’লাবা ক্রন্দনরত অবস্থায় নেমে আসলেন, তাঁর আর কোনদিকে খেয়াল নাই। কী দুর্বল শরীর হয়ে গেছে তাঁর! বেদুঈনদের কথামত তাঁরা দেখতে পেলেন, থা’লাবা দুধের বাটিতে হাতে কাঁদছে, আর তাঁর অশ্রু মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তাঁর চেহারায় গভীর বিষাদের চিহ্ন স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।

সাহাবারা তাকে বললেন, ‘আমাদের সাথে ফিরে চল’; অথচ থা’লাবা যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি বারবার সাহাবাদেরকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ‘আল্লাহ কি আমার মুনাফেক্বী বিষয়ক কোন সূরা নাযিল করেছে?’

সাহাবারা উত্তরে বললেন, ‘না আমাদের জানামতে এমন কোন আয়াত নাযিল হয় নাই।’

উমর (রা) বললেন, রাসূল (সা) আমাদেরকে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। তুমি যদি এখন যেতে রাজি না হও, তাহলে তোমাকে আমরা জোর করে ধরে নিয়ে যাব। রাসূল (সা) এর কথা অমান্য করবেন এমন কোন সাহাবা ছিল নাহ। কিন্তু থা’লাবা এতোটাই লজ্জিত ছিলেন যে ফিরে যেতে চাচ্ছিলেন নাহ। এরপর সাহাবারা তাকে রাসূল (সা) এর কাছে মদীনায় নিয়ে আসেন।

মহানবী (সা) এর কাছে এসে থা’লাবা আবারও একই প্রশ্ন করে, ‘আল্লাহ কি আমাকে মুনাফিক্বদের মধ্যে অন্তর্গত করেছেন অথবা এমন কোন আয়াত নাযিল করেছেন যেখানে বলা আমি মুনাফিক্ব?’ রাসূল (সা) তাকে নিশ্চিত করলেন যে এমন কিছুই নাযিল হয়নি। তিনি থা’লাবার দুর্বল পরিশ্রান্ত মাথাটা নিজের কোলের উপর রাখলেন। থা’লাবা কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, এমন গুনাহগার ব্যক্তির মাথা আপনার কোল থেকে সরিয়ে দিন।’ উনার কাছে মনে হচ্ছিল যেন সে এসব স্নেহের যোগ্য নাহ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সান্ত্বনা দিতেই থাকলেন। আল্লাহর রহমত আর দয়ার উপর ভরসা করতে বললেন। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে বললেন। এমন সময় থা’লাবা বললেন,

‘হে আল্লাহর রাসূল আমার এমন মনে হচ্ছে যেন আমার হাড় আর মাংসের মাঝখানে পিঁপড়া হেঁটে বেড়াচ্ছে।’

রাসূল (সা) বললেন, ‘ওটা হল মৃত্যুর ফেরেশতা। তোমার সময় এসেছে থা’লাবা, শাহাদাহ পড়’।

থা’লাবা শাহাদাহ বলতে থাকলেন, ‘আল্লাহ ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য আর কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’

উনি শাহাদাহ বলতে থাকলেন… বলতেই থাকলেন… এমনভাবে তাঁর রুহ শরীর থেকে বের হয়ে গেল।

মহানবী (সা) থা’লাবাকে ( ) গোসল করিয়ে জানাজার পর কবর দিতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আরো অনেক সাহাবা থা’লাবাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মহানবী (সা) পা টিপে টিপে অনেক সাবধানে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। উমর রাদিয়ালাহু আনহু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আপনি এভাবে কেন হাঁটছেন যেন ভিড়ের মাঝে হেঁটে চলেছেন.. কতো রাস্তা ফাঁকা পরে আছে, আপনি আরাম করে কেন চলছেন না ইয়া রাসুল?’

উত্তরে রাসূল (সা) বললেন, ‘হে উমর, আমাকে অনেক সাবধানে চলতে হচ্ছে। সমস্ত রাস্তা ফেরেশতাদের দ্বারা ভরে গেছে । থা’লাবার জন্য এতো ফেরেশতা এসেছে যে আমি ঠিকমত হাঁটার জায়গা পাচ্ছি না’।

সুবহান আল্লাহ !

এই সেই থা’লাবা যে ভুলক্রমে একটা ভুল করার জন্য এতো প্রায়শ্চিত্য করেছেন। গুনাহ-র কাজ করা তো দূরের কথা, গুনাহ না করেও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে চেয়ে ব্যাকুল হয়েছেন। কত উঁচু ছিলেন তিনি আল্লাহর চোখে যে তাকে নেয়ার জন্য ফেরেশতাদের আগমনে রাস্তা ভরে গিয়েছিল! এই সব ফেরেশতারা নেমে এসেছে শুধু থা’লাবার জন্য, তাঁর জন্য দুআ করার জন্য, তাকে নিয়ে যাবার জন্য। আর আমরা সারাদিন জেনে না জেনে এতো ভুল করেও, এতো গুনাহ করেও অনুশোচনা করি না! উলটা আমাদের পছন্দ মত কিছু না হলেই আল্লাহর আদেশের উপর অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকি, জীবন নিয়ে নালিশ করতে থাকি।
( হিলয়াতুল আউলিয়া,৯/৩২৯-৩৩১;মায়ারিফাত আস-সাহাবা,১/৪৯৮ আরও দেখুন এখানে )

একটা হাদীস আছে, ‘মু’মিন বান্দার কাছে তার গুনাহগুলো এমন যেন এখনই পাহাড় ভেঙ্গে তার মাথার উপর পড়বে; আর একজন দুর্বৃত্তকারীর কাছে গুনাহ এরকম যে মাছি এসে তার নাকের উপর উড়াউড়ি করছে, আর সে হাত নাড়িয়ে সেটা সরিয়ে দিল’।

[বুখারি, বইঃ৭৫, হাদীস নং ৩২০]


এটাও পড়ুন – আহা, এ কবর যদি আমার হত !


আমরা আমাদের গুনাহগুলোকে দেখেও না দেখার ভান করি। স্বীকার করতে চাইনা। কতো রকম যুক্তি দিয়ে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করি। একটু ফ্যাশন, শখ, মনের ইচ্ছা পূরণ, মানুষের সামনে বড় হওয়া, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আমরা গুনাহ-র কাজে জড়িয়ে পরি। কিন্তু আল্লাহর কাছে বিনয়ের সাথে ক্ষমা চাওয়ার কথা ভাবতে পারিনা। আমাদের যুক্তি, অহংকার, শয়তানের মতই আমাদেরকে ক্ষমা প্রার্থনা থেকে বিরত রাখে। কিয়ামতের দিন এক আল্লাহর রহমত আর দয়া ছাড়া কিছুই আমাদেরকে আগুন থেকে বাঁচাতে পারবে না। জান্নাত তাদের জন্যই যারা আল্লাহর কাছে মাথা নত করে। আত্মসমর্পণ করে পূর্ণভাবে। নিজের ইচ্ছা, অহম বোধের কাছে মাথা নত করেনা। তাই ঈমানদার ব্যক্তিই বিনয়ী। তার রবের সামনে কাঁদতে সে লজ্জা পায় না। ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে কুন্ঠাবোধ করে না। সততার সাথে ক্ষমা চেয়ে দৃড়ভাবে সেই কাজ থেকে বিরত থাকে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন, ‘যে তওবা করে এবং ঈমান আনে ও পুণ্য-পবিত্র ক্রিয়াকর্ম করে। সুতরাং তারাই, — আল্লাহ্ তাদের মন্দকাজকে সৎকাজ দিয়ে বদলে দেবেন। আর আল্লাহ্ সতত পরিত্রাণকারী, অফুরন্ত ফলদাতা’।

[সূরাহ ফুরক্বানঃ ৭০]

আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের জেনে না জেনে করা গুনাহগুলো থেকে ক্ষমা করে দিক ! আমাদেরকে সঠিকভাবে মনের অন্তঃস্থল থেকে অনুতাপ করার, ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দান করুক। আমাদেরকে নিজেদের ভুল বুঝার আর স্বীকার করে নিয়ে খারাপ কাজগুলো থেকে দূরে থাকার তওফিক দিক… আমীন।

ঘটনার ভিডিও দেখুন – এখানে

তাবীজ ব্যবহার ও এর হুকুম কি ?

প্রশ্ন : তাবীজ ব্যবহারের হুকুম কি? ওই হাদীসের ব্যাখ্যা কি হবে যাতে বলা হয়েছে “যে ব্যক্তি তাবীজঝুলালো সে শিরক করল”।

بسم الله الرحمن الرحيم

উত্তরঃ কিছু শর্ত সাপেক্ষে তাবীজ ব্যবহার করা জায়েয আছে। সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা.কর্তৃক বাচ্চাদের গলায় তাবীজ লটকিয়ে দেয়ার ঘটনা এর বৈধতার প্রমাণ বহন করে। আবু দাউদ শরীফের এক বর্ণনায় এসেছে,

–  عن عمرو بن شعيب، عن أبيه، عن جده، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يعلمهم من الفزع كلمات: «أعوذ بكلمات الله التامة، من غضبه وشر عباده، ومن همزات الشياطين وأن يحضرون» وكان عبد الله بن عمرو يعلمهن من عقل من بنيه، ومن لم يعقل كتبه فأعلقه عليه ــ سنن أبي داود

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেরেশানীর সময় বলার জন্য এই শব্দগুলো (দুয়া) সাহাবীদের শিখাতেনঃ أعوذ بكلمات الله التامة، من غضبه وشر عباده، ومن همزات الشياطين وأن يحضرون । হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি.তার বুঝমান মেয়েদের এই দুয়া শিখাতেন আর অবুঝ বাচ্চাদের গলায় লিখে ঝুলিয়ে দিতেন।(আবু দাউদ শরীফ ২/৫৪৩)

মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতেও অনুরূপ বর্ণনা এসেছে,

عن عمرو بن شعيب عن أبيه عن جده قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا فزع أحدكم في نومه فليقل بسم الله أعوذ بكلمات الله التامات من غضبه وسوء عقابه ومن شر عباده ومن شر الشياطين وأن يحضرون فكان عبد الله يعلمها ولده من أدرك منهم ومن لم يدرك كتبها وعلقها عليه ــ مصنف ابن أبي شيبة – (5 / 44

……হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি.তার সন্তানদের মাঝে যারা বুঝমান ছিল তাদের এই দুয়া শিখাতেন আর যারা অবুঝ বাচ্চা ছিল তাদের গলায় লিখে ঝুলিয়ে দিতেন।

তাবেঈনের মাঝেও অনেকের থেকে তাবীজ লিখে দেয়ার কথা এসেছে, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতে হযরত মুজাহিদ, মুহাম্মদ ইবনে সিরীন, উবায়দুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ও জাহ্‌হাক রহ. প্রমুখ কর্তৃক অন্যদের তাবীজ লিখে দেয়ার কথা, তাবিজ হাতে বা গলায় বাঁধা ও তাবীজ লেখা বৈধ হওয়ার মর্মে তাদের মন্তব্য বর্ণিত হয়েছে।(মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা,হাদীস নং ২৩৪৫,২৩৪৪৮,২৩৪৪৯,২৩৫০,২৩৫১)

ইবনে তাইমিয়া রহ.ও এর বৈধতের পক্ষে বলেছেন,

(ويجوز أن يكتب للمصاب وغيره من المرضى شيئا من كتاب الله وذكره بالمداد المباح ويغسل ويسقى ـ مجموع فتاوى ابن تيمية – (19 / 64

বিপদ্গ্রস্থ,অসুস্থ ও এধরণের লোকদের জন্য কালী দ্বারা আল্লাহর কিতাব বা আল্লাহর যিকির থেকে কিছু লিখে দেয়া,গোসল করানো ও পান করানো জায়েয আছে।( তবে উলামায়ে কেরাম তাবীজ ও ঝাড় ফুক বৈধতা হবার যে সকল শর্তারোপ করেছেন তা হল,

১)এতে শিরকীপূর্ণ কোন কথা থাকতে পারবেনা বরং কুরআনের আয়াত,আল্লাহর নাম ও সিফাত বা দুয়ায়ে মাসূরা এ জাতীয় অর্থবোধক কোন কিছু লিখা থাকতে হবে।) মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ কুয়েতিয়া,১৩/২৫)

{ وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ} [الإسراء : 82]

আমি কোরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত।(সূরা বনী ইসরাঈলঃ৮২)

২) অবোধগম্য কোন কথা না হতে হবে।( মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ কুয়েতিয়া,১৩/২৪, ফাতাওয়া শামী, ৫/২৩২, উমদাতুল কারী ৫/৩৫২)
উল্লেখ্য, নকশার মাধ্যমে (ابجد) তাবীজ জায়েজ। কেননা এটাও বোধগম্য ভাষা।( আহসানুল ফাতাওয়া ৮/২৫৬)

৩)আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষা না হওয়া।

৪)অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতির মত তাবিজকেও একটি ঔষধ মনে করতে হবে। তাবীজের নিজস্ব প্রভাব مؤثر بالذات) ( আছে এরূপ বিশ্বাসে তাবীজ ব্যবহার করা যাবে না। শুধু তাবীজই নয় বরং অন্যান্য ঔষধকেও আরোগ্য দানকারী মনে করে চিকিৎসা নেয়া বৈধ নয়। বরং আল্লাহ তাআলাই আরোগ্য দানকারী,এগুলো উসিলা বা মাধ্যম মাত্র। কুরআনে এসেছে।

{وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِ} [الشعراء : 80]

যখন আমি রোগাক্রান্ত হই,তখন তিনিই(আল্লাহ তাআলা) আরোগ্য দান করেন। (সূরা আশ-শো’আরাঃ ৮০)

“যে ব্যক্তি তাবীয ঝুলালো সে শিরক করল”। হাদীসের ব্যাখ্যা

শুরুতেই ঐ সকল হাদীস দেখেনেই যাতে তাবীজকে শিরক বলা হয়েছে,

(من علق تميمة فقد أشرك (رواه أحمد

যে তাবীজ লটকালো,সে শিরক করল। (মুসনাদে আহমদ)

عن النبي صلى الله عليه و سلم أن الرقى و التمائم و التولية من الشرك ـــ المستدرك على الصحيحين للنيسابوري ـ كتاب الطب

অবশ্যই ঝাড়-ফুক, তাবীজ ও যাদু শিরক।( মুসতাদরাকে হাকেম)

عن عقبة بن عامر الجهني ان رسول الله صلى الله عليه و سلم أقبل إليه رهط فبايع تسعة وامسك عن واحد فقالوا يا رسول الله بايعت تسعة وتركت هذا قال ان عليه تميمة فادخل يده فقطعها فبايعه وقال من علق تميمة فقد اشرك ـ مسند أحمد بن حنبل – 17458

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে একদল লোক উপস্থিত হল। অতঃপর তিনি নয় জনকে বাইয়াত করালেন আর একজনকে বাইয়াত করালেন না। তারা বলল,ইয়া রাসূলুল্লাহ! নয় জনকে বাইয়াত করলেন আর একজনকে বাদ রাখলেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,তার সাথে একটি তাবীজ রয়েছে। তখন তার হাত ভিতরে ঢুকালেন ও সেটা ছিড়ে ফেললেন। অতপর তাকেও বাইয়াত করালেন এবং বললেন, যে যে তাবীজ লটকালো,সে শিরক করল।(মুসনাদে আহমদ)


এটা পড়ুন – আপনি কি ধূমপায়ী ? আপনার জন্য সুখবর !


এবার জবাবে আসা যাক!এখানে প্রথম হাদীস দুটিতে যে তাবিজের কথা বলা হয়েছে,তার দ্বারা শিরকপূর্ণ তাবীজ উদ্দেশ্য। তার প্রমাণ হলো দ্বিতীয় হাদীসে ঝাড়-ফুককেও শিরক বলা হয়েছে,অথচ সব ঝাড়-ফুক শিরক নয়; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে ঝাড়-ফুক করেছেন ও কখনো সাহাবাদেরও করতে বলেছেন,

عن عائشة : أن رسول الله صلى الله عليه و سلم كان يرقي يقول ( امسح الباس رب الناس بيدك الشفاء لا كاشف له إلا أنت ) صحيح البخاري – باب رقية النبي صلى الله عليه و سلم

আম্মাজান আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঝাড়-ফুক করতেন, আর এ দু’আ পাঠ করতেনঃ امسح الباس رب الناس بيدك الشفاء لا كاشف له إلا أنت ।(সহীহ বুখারী ২/৮৫৫)

عن عائشة قالت كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يأمرني أن استرقي من العين ـ صحيح مسلم – باب استحباب الرقية من العين والنملة والحمة والنظرة

আম্মাজান আয়েশা রা. হতে বর্ণিত,তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বদনযর থেকে বাচতে ঝাড়-ফুকের নির্দেশ দিতেন। (সহীহ মুসলিম,২/২২৩)

অতএব এখানে ঝাড়-ফুককের ক্ষেত্রে যে ব্যাখ্যা দেয়া হবে তাবীজের ক্ষেত্রেও একই ব্যাখ্যা করা হবে। বিশেষতঃ এর ব্যাখ্যা দিতে আমরা সকলেই বাধ্য,কেননা সহীহ হাদীস দ্বারা সাহাবা ও তাবেঈনগন কর্তৃক ঝাড়-ফুকের মত তাবীজ ব্যবহারেরও প্রমাণ পাওয়া যায়; যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা যেই ঝাড়-ফুক বা তাবীজ ব্যবহার করেছেন তা শিরকপূর্ণ ছিলনা,শিরকপূর্ণ হলে তাঁরা তা করতেনও না। সুতরাং একথা স্পষ্ট হয়ে গেল,হাদীসে যে তাবীজ ব্যবহার নিষিদ্ধ বলা হয়েছে তা শিরকপূর্ণ। আর আমরা তো আগেই বলেছি, শিরকপূর্ণ তাবীজ ব্যবহার বৈধ নেই।

তৃতীয় হাদীসে তাবীজ থাকার কারণে এক ব্যক্তির বাইয়াত না নেয়া ও তার তাবীজ খুলে ফেলার কথা বর্ণিত হয়েছে। এ দ্বারা কোন ভাবেই সব রকম তাবীজ নিষিদ্ধ হওয়ার দলীল দেয়া যায় না। কারণ,সে লোকটা ইসলাম গ্রহণের জন্য এসেছিল। মুসলমান হবার পূর্বে সে যে তাবীজ লাগিয়ে ছিল তা শিরকপূর্ণ তাবীজ হওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং তার তাবীজটির প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আপত্তি করাটাই যুক্তিসঙ্গত।
والله اعلم بالصواب

উত্তর প্রদানে              .
মাওলানা মুহাম্মাদ আরমান সাদিক .
ইফতা বিভাগ             .
জামিয়াতুল আসআদ আল ইসলামিয়া.

সত্যায়ন ও সার্বিক তত্তাবধানে
মুফতী হাফীজুদ্দীন দা. বা.
প্রধান মুফতী
জামিয়াতুল আসআদ আল ইসলামিয়া

আল্লাহর নামে কারো নাম রাখা বা নামকরণ করার হুকুম

আল্লাহ তা’আলার সত্ত্বাগত নাম একটি। তা হল, “আল্লাহ্”। এই নামে কারো নাম রাখা না জায়েয ও হারাম। এছাড়া আল্লাহ তা’আলার গুণবাচক আরো অনেক নাম রয়েছে। এক হাদীসে বর্ণিত আছে,

حدثنا إبراهيم بن يعقوب قال: حدثني صفوان بن صالح، قال: حدثنا الوليد بن مسلم، قال: حدثنا شعيب بن أبي حمزة، عن أبي الزناد، عن الأعرج، عن أبي هريرة، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إن لله تعالى تسعة وتسعين اسما، مئة غير واحدة، من أحصاها دخل الجنة.

অর্থাৎ, হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা’আলার গুণবাচক নিরানব্বইটি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি এই নামগুলো গণনা করে এবং উচ্চারণ করে, আল্লাহ তা’আলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিবেন। (সুনানে তিরমিযী: ৫/৪১১, হাদীস নং-৩৫০৭)

তবে এই নামগুলো কোন একটি নামে কোন ব্যক্তির নামকরণ করা যাবে কিনা, এ ব্যাপারে কুরআন-হাদীস ও তাফসীর এবং ফিকহের কিতাব থেকে কয়েকটি নীতিমালা পেশ করা হল-

১. আল্লাহ তা’আলার যে সমস্ত গুণবাচক নাম একমাত্র আল্লাহ তা’আলার সাথেই খাস, ঐ সমস্ত নাম অন্য কারো জন্য ব্যবহার করা, কারো নাম রাখা বা এ নামে ডাকা জায়েয নেই। এ ধরণের কয়েকটি গুণবাচক নাম হল, আর রহমান, আল কুদ্দুসু, আর জাব্বারু, আল মুতাকাব্বিরু, আল খালিকু, আর বারিউ, আল মুসাওয়িরু, আর রাযযাকু, আর গাফফারু, আল কাহহারু, আত তাওয়াবু, আল ওয়াহহাবু, আল খাল্লাকু, আল ফাত্তাহু, আল কাইয়্যূমু, আর রাব্বু, আল মুহীতু, আল মালকিু, আল গাফূুুরু, আল আহাদু, আস সামাদু, আল হাক্কু, আল কাদিরু, আল মুহয়ী।

২. আল্লাহ তা’আলার ঐ সমস্ত গুণবাচক নাম যা আল্লাহ তা’আলার সাথে খাস নয়, বরং অন্য অর্থেও ব্যবহার হয়। সুতরাং এ ধরণের নামগুলো অন্য অর্থের দিকে লক্ষ্য করে আল্লাহ ছাড়া অন্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করার অনুমতি রয়েছে। এ কথার বিশ্লেষণ এই যে, যদি কোরআন ও হাদীস, তা’আমুলে উম্মাত তথা যুগে যুগের মুসলমানের প্রচলন অথবা বর্তমানে সামাজিকভাবে ঐ নামগুলো অন্যের জন্যও ব্যবহার হয়ে থাকে তাহলে এই ধরণের নাম রাখাতে কোন অসুবিধা নেই। যেমন, আযীয, করীম, রহীম, আযীম,, রশীদ, কবীর, বদী’, কাফীল, হাদী, ওয়াসে’, হাকীম ইত্যাদি।

পক্ষান্তরে যদি কোরআন ও হাদীস, তা’আমুলে উম্মাত তথা যুগে যুগের মুসলমানের প্রচলন অথবা বর্তমানে সামাজিকভাবে ঐ নামগুলো অন্যের জন্য ব্যবহার না হয়ে থাকে তাহলে এই ধরণের নাম রাখা থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক।


এটা পড়ুন – মৃত্যু দিবস পালন : শরয়ী দৃষ্টিকোণ


৩. এমনিভাবে কোরআন ও হাদীসে নেই, তা’আমুলে উম্মাত তথা যুগে যুগের মুসলমানদের মাঝেও প্রচলন নেই অথবা বর্তমানে সামাজিকভাবে ঐ নামগুলো অন্যের জন্য ব্যবহারও হয় না, তাহলে এই ধরণের নাম রাখা থেকেও বেঁচে থাকা উচিৎ। কেননা আল্লাহ তা’আলার নামের ক্ষেত্রে মূলনীতি তো হল এই যে, তা একমাত্র আল্লাহ তা’আলার জন্যই ব্যবহৃত হবে।

শুধুমাত্র দলীল থাকার কারণে যুগে যুগের মুসলমানদের মধ্যকার প্রচলনের ফলে বর্তমানে সামাজিকভাবে ঐ নামগুলো অন্যের জন্য ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। কেননা কোন কিছু জায়েয হবার জন্য শরীয়তের সমর্থন ও দলীলের প্রয়োজন রয়েছে। (রূহুল মাআনী: ৯/১২৩, ফাতওয়া শামী: ৫/২৬৮, ফাতাওয়া আলমগীরী: ৩৬২- ফাতাওয়ায়ে উসমানী সূত্রে)
এই তিন নীতিমালার আলোকে যেসব গুণবাচক নাম অন্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা জায়েয নাই- সেসব নামগুলোর শুরুতে “আবদ” শব্দ যোগ করে “আব্দুন যোগে” গুণবাচক নামগুলোর ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে, এভাবে নাম ডাকাও জায়েয। ( যেমন, রহমান- আব্দুন যোগে আব্দুর রহমান নাম রাখা জায়েয)

আর যেসব গুণবাচক নাম অন্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা জায়েয সেসব নামগুলোর শুরুতেও “আব্দুন” শব্দ যোগ করা উত্তম। কেননা যিনি এ বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করলেন তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাঁর নামের সদ্ব্যবহার করা ও বাহ্যিকভাবে তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা প্রতিটি মানুষের অবশ্য পালনীয় দায়িত্য ও কর্তব্য। (ফাতওয়া শামী: ৯/৬৮৮, ফাতাওয়া সিরাজিয়া: ৩১৯, ফাতাওয়া হিনদিয়া: ৫/৪১৮)

বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, যদি বান্দার মধ্য থেকে কাউকে তা’জীমস্বরূপ-সম্মান প্রদর্শনপূর্বক কাউকে আল্লাহর সমপর্যায়ের ধরে নিয়ে তুলনা করার উদ্দেশ্যে রহীম, রহমান ইত্যাদি বলে ডাকে, তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। তবে এহেন উদ্দেশ্য না থাকলে কাফের হবে না। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া: ২৯/২৩২)