8.3 C
New York
Friday, October 24, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 21

সফল মাহাথির, আপনিও সফল হোন। মাহাথিরের অনন্য জীবন

মুফতী ওযায়ের আমীনঃ- আধুনিক মালয়েশিয়ার সফল রুপকার । যিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত দলের বাইরে গিয়ে বিরোধী দলের হয়ে এই বুড়ো বয়সে ক্ষমতার মসনদে আসিন হন । আসুন জানি তার সফল জীবনের কথা.. মাহাথির মোহাম্মদ

জন্ম ও প্রাসঙ্গিক কথাঃ ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ ১৯২৫ সালে ২০ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মোহাম্মদ ইস্কান্দারের নয় সন্তানের মধ্যে মাহাথির ছিলেন সবার ছোট। তার পিতা একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন এবং পরবর্তীকালে সরকারি অডিটর হিসেবে কাজ করেছেন। তার মা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন এবং মাহাথিরকে বাসায় পবিত্র কোরআন শিক্ষা দিতেন।
তিনি ১৯৮১-২০০৩ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ছিলেন। তার দল পর পর পাঁচবার সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। তিনি এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০০৩ সালের ৩০শে অক্টোবর তিনি স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন। এখন আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন ।

শিক্ষা জীবন মাহাথির মোহাম্মদ। স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন। নিজ বাসায় ধর্মীয় শিক্ষকের নিকট কোরআন ও ইসলাম শিক্ষা লাভ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৪১ সাল। জাপান মালয়েশিয়ায় আক্রমণ করে। তার সে স্কুল বন্ধ করে দেয়। মাহাথিরের বয়স তখন ষোল। সে সময় মাহাথির একটি স্থানীয় ছোট বাজারে কলা বিক্রি শুরু করেন।

মাহাথির তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন সেবেরাং পেরাক মালয় স্কুলে। কিন্তু তিনি চাইতেন ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করতে। সমস্যা হলো, ইংরেজরা মালয় ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে সহজে সুযোগ দিত না। ভর্তি পরীক্ষা হতো খুবই কঠিন। তাই মালয় ছেলেমেয়েদের জন্য সুযোগ পাওয়া ছিল দুঃসাধ্য।

সেই ছোটবেলাতেই তিনি এ বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথমদিকে স্থান করে নেন। আলোর সেতারের গভর্নমেন্ট ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন মাহাথির।

মাহাথির থেকে ড. মাহাথির: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মাহাথির অনুভব করেন সমাজের জন্য কিছু করার। তখন সিদ্ধান্ত নেন সমাজের জন্য কিছু করতে হলে হয় তাকে আইনবিদ অথবা ডাক্তার হতে হবে। মেধাবী মাহাথির খুব সহজেই বৃত্তি পেয়ে যান। প্রথম পছন্দ আইন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তাকে বলা হয় ডাক্তার হওয়ার। কেননা মালয়েশিয়ায় তখন বেশ কয়েকজন আইনবিদ ছিলেন। সিঙ্গাপুরের কিং অ্যাডওয়ার্ড সেভেন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন মাহাথির। ১৯৪৭ সালে মাত্র সাতজন মালয় শিক্ষার্থী ছিলেন ঐ মেডিকেল কলেজে।

মাহাথিরের ব্যক্তি জীবন ব্যক্তিজীবনে মাহাথির ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি একাই যে স্বপ্ন দেখেছেন এমনটা নয়। পুরো জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। চীনা, মালয়ী, তামিলসহ বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত মালয়েশিয়াকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। তিনি কর্মীদের যা করতে বলেছেন তা নিজে করেও দেখিয়েছেন।

সরকারি কর্মীরা যেন ঠিক সময়ে অফিসে আসেন সেজন্য নিজেও ঠিক সময়ে অফিসে আসতেন। টাইম ম্যাগাজিন একবার তার অফিসে আসার সময় রেকর্ড করেছিল। পরপর পাঁচ দিন তার অফিসে প্রবেশের সময় ছিল সকাল ৭:৫৭, ৭:৫৬, ৭:৫৭, ৭:৫৯, ৭:৫৭

তিনি নিজে একজন পরিশ্রমী এবং শৃংখলা পরায়ণ মানুষ ছিলেন। সময়ের মূল্য দিতে জানতেন তিনি।

সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শাস্ত্র পড়ার সময় তার সাথে যে ছয় জন মালয়ী শিক্ষার্থী ছিলেন তাদের একজন ছিলেন সিতি হাসমাহ নামের একজন ছাত্রী। এই সিতিকেই নিজের জীবনের সঙ্গী করে এতটা পথ হেটেছেন। সাত সন্তানের জনক তিনি ।


কর্মজীবন
১৯৫৩ সালে তিনি চিকিৎসক হিসেবে চাকুরীতে যোগ দেন। মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার পূর্বে তিনি সরকারি চাকুরী ছেড়ে নিজ শহরে একটি প্রাইভেট ক্লিনিক শুরু করেন। তিনি রোগীদের বাড়িতে যেতেন এবং মাঝে মাঝে ছোট খাট অস্ত্রপচার করতেন।

ডাক্তার থেকে রাজনীতিক: একটি মুল্যায়ন
মাহাথিরের মতে চিকিৎসক হিসেবে তার প্রশিক্ষণ ও প্রাকটিস তার মধ্যে স্থিরতা এনেছিল। তিনি ডাক্তারি পেশায় গবেষণা করেই যে কোন পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার সক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তিনি একবার ‘দ্যা ইকোনমিষ্ট’ পত্রিকাতে বলেছিলেন, “চিকিৎসা বিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের জন্য রাজনীতি একটি ভাল পেশা। একজন ডাক্তার রোগীকে পর্যবেক্ষণ করেন, স্বাস্থ্যগত ইতিহাস রেকর্ড করেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন, ল্যাব পরীক্ষা করেন এবং চূড়ান্তভাবে রোগ নির্ণয় করেন। এ প্রক্রিয়াটি রাজনীতির মতই।” ১৯৭৪ সালে মন্ত্রী হবার আগ পর্যন্ত তিনি চিকিৎসা পেশা অব্যাহত রেখেছিলেন।

রাজনীতি
মাহাথির বিশ বছর বয়সেই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। সহপাঠীদের একত্র করে তিনি গোপনে ‘মালয়ান ইউনিয়ন’ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। মালয়ান ইউনিয়ন প্রকৃতার্থে বৃটিশ উপনিবেশ ছিল। মাহাথির ও তার বন্ধুরা তখন রাতের অন্ধকারে সারা শহরে রাজনৈতিক পোষ্টার লাগাতেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সীমিত, ‘মালয়ান ইউনিয়ন’ প্রস্তাবের সমাপ্তি এবং প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা ফিরে পাওয়া।

সাইকেল চালিয়ে তারা সমগ্র প্রদেশ ঘুরে ঘুরে জনগনকে ব্রিটিশ বিরোধী হিসেবে সংঘটিত ও সক্রিয় করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। সংগঠনে মাহাথির সাধারণত সম্পাদক বা দ্বিতীয় অবস্থানটা বেছে নিতেন, কারণ দ্বিতীয় ব্যক্তিকেই বেশি সাংগঠনিক কাজ করতে হয় ও অন্য দলগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়।

মাহাথির প্রথমে ‘কেদাহ মালয় যুব ইউনিয়ন’ এবং পরে ‘কেদাহ মালয় ইউনিয়ন’ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। পরবর্তিতে এটা-ই ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বা ইউএমএনও (UMNO) হিসেবে পরিচিত হয়।

সিঙ্গাপুরেও মাহাথির সংগঠক
সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন মাহাথির সেখানের কলেজের মালয় ছাত্রদের নিয়ে ‘মালয় ছাত্র সংগঠন’ গঠন করেন। তবে এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের শিক্ষার মান ও ফলাফল উন্নয়ন করা। এর কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না।

জাতীয় রাজনীতিতে মাহাথির
সরকারি চাকুরীতে থাকাকালীন তিনি সক্রিয় ভাবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে পারেন নি। নিজ ক্লিনিক চালু করার পর তার জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকে। ইউএমএনও-এর প্রাদেশিক শাখার উর্ধ্বতন পদে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৯৬৪ সালে ৩৯ বছর বয়সে মাহাথির প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপরও এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাহায্যে তিনি ডাক্তারি প্রাকটিস অব্যাহত রাখেন। ১৯৭৪ সাল নাগাদ তিনি এই পেশা ধরে রেখেছিলেন।

১৯৬৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বার নির্বাচনে প্রার্থী হন। সেই বছর ইউএমএনও এর নেতৃত্বে জোটবদ্ধ সম্মিলিত সরকার গঠিত হয়। ইউএমএনও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। কয়েকটি প্রদেশে তারা সরকার গঠন করতেও সক্ষম হয়নি।


এটাও পড়ুন – বাংলার মুসলিম জাগরণে ইসলাম প্রচারক মুনশী মেহের উল্লাহ


১৯৬৯ সালের ৩০শে মে কুয়ালালামপুরে যখন চীনা ও মালয় জাতির মধ্যে তুমুল-দাঙ্গা শুরু হয় তখন রাজনৈতিক সংকট চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে। এই দাঙ্গার জন্য মাহাথির ইউএমএনও নেতৃত্বকে দোষারোপ করে প্রধানমন্ত্রী টুঙ্কু আবদুর রহমানকে কড়া ভাষায় চিঠি লেখেন ও পদত্যাগের পরামর্শ দেন। এ সমালোচনা পার্টি নেতৃবৃন্দ সহ্য করলেন না। তারা মাহাথিরকে দল থেকে বহিষ্কার করলেন। পরবর্তী তিন বছর তিনি নিজ দেশেই রাজনীতি থেকে নির্বাসনে ছিলেন।

১৯৭২ সালে মাহাথিরকে আবার দলের সদস্য ও সিনেটর হিসেবে পুনর্বহাল করা হয়।

শিক্ষামন্ত্রী মনোনীতঃ ১৯৭৪ সালে দল নির্বাচনে জয়ী হবার পর তাকে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়।

উপ-প্রধানমন্ত্রী মনোনীতঃ ১৯৭৬ এ উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতে তিনি সফল হন। উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের জন্য অনেক কিছু করার পরিকল্পনা থাকলেও মাহাথির স্বাধীনভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে সক্ষম ছিলেন না।

প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত ১৯৮১ সালে তিনি সর্বপ্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এপর্যায়ে এসে তিনি তার সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সম্পূর্ণ মুক্ত হন। সেই থেকে টানা ২২ বছর মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এর মধ্যে প্রতিবার তিনি ও তার দল নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন।

মাহাথির মোহাম্মদ এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় যাবৎ নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৩ সালের ওআইসি সম্মেলনের সফল সমাপ্তির পর ৩০শে অক্টোবর তিনি স্বেচ্ছায় দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।

অন্যরকম প্রধানমন্ত্রী: মাহাথিরই পৃথিবীর একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি নিজের নাম লেখা ব্যাজ পরতেন। মাহাথির সঙ্গে ছোট্ট একটি নোটবুক রাখতেন। তার সব চিন্তা লিখে রাখতেন সেই নোটবুকে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর সাজানো থেকে শুরু করে সরকারি রীতিনীতি পর্যন্ত সবকিছুই তিনি লিখে রাখতেন।

আধুনিক মালয়েশিয়া:
ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ বিশ্বময় আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রধান রূপকার হিসেবে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী হবার পর তিনি সকল বিষয় পুনঃপরীক্ষা করেন। সকল নীতি, পদ্ধতি, সরকার চালাতে প্রাত্যহিক সকল কাজ, আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়।

তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ওয়ার্ক-ফ্লো চার্ট আর অফিস ম্যানুয়েল প্রবর্তন করেন। মাহাথির ও তার সরকার দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি তৈরি করেন যার মাধ্যমে প্রত্যেকে তার নিজ নিজ ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়। ব্যবসা এবং রাজনীতিতে ফুটপাতের লোক থেকে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পর্যন্ত দেশের জন্য নিজের জন্য কাজ করবে।

১৯৯০ সালে মালয়েশিয়া বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৮% ছাড়িয়ে যায়। মাহাথির ১৯৭১ সালে প্রনিত নিউ ইকোনমিক পলিসি (এনইপি) সফল ভাবে বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন। এনইপির উদ্দেশ্য ছিল জাতি নির্বিশেষে দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে জাতি পরিচয় মুছে ফেলা। নতুন সম্পদ সৃষ্টি করা এবং এর বৃহত্তর অংশ দরিদ্রদের জন্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে সম্পদের পুনঃবন্টনের চেষ্টা করা হয়।

১৯৯১ সালে বিশ বছর মেয়াদি এনইপি শেষ হয়। দারিদ্র্য বিমোচন বহুলাংশে অর্জিত হয়। সমৃদ্ধির একটি পর্যায়ে পৌছে মালয়েশিয়া বিভিন্ন জাতির সুসম্পর্কসহ একটি জাতিতে পরিনত হয় যা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য ঈর্ষনীয়। বিশ বছর মেয়াদি এনইপি শেষ হবার পর দশ বছর মেয়াদি ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি (এনডিপি) প্রনয়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

যেভাবে বদলে দিলেন মালয়েশিয়াকে

মালয়েশিয়ার আমূল পরিবর্তনে শুরু থেকেই স্বপ্ন দেখেছেন মাহাথির। ক্ষমতায় আসার পর একের পর পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি বাস্তবায়নও করেছেন সেগুলো। দেশটির ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মসূচিও তাঁর ঘোষণা করা ছিল। মাহাথির শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ দিক-

  • মালয়েশিয়ার সকল মুসলিমদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন তিনি।
  • মালয়েশিয়ানদের শিক্ষার ৯৫ শতাংশ খরচ সরকার বহন করে। এই নীতি চালু হয় মাহাথিরের আমল থেকে।
  •  আশির দশকে গৃহিত ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাস্তবায়ন করা শুরু করেন তিনি। ফলাফল এই যে, ১৯৯২ সালে নিজ দেশের সবাইকে কর্মসংস্থান দিয়ে উলটো আরও ৮ লক্ষ বিদেশী শ্রমিক নিয়োগ দেয় মালয়েশিয়া।
  • একই বছর শুধু যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতেই ৬৫০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করে।
  • পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার নির্মাণ, সমুদ্র থেকে ৬,৩০০ হেক্টর জমি উদ্ধার, অত্যাধুনিক এয়ারপোর্ট তৈরি, একাধিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, হাইওয়ে নির্মাণসহ তার অসংখ্য উদ্যোগ সফল হয়েছে।
  • ১৯৯০ সালেই বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছাড়িয়ে যায় ৮ শতাংশের বেশি।
  • ১৯৮২ সালে থাকা মালয়েশিয়ার ২৭ দশমিক ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ জিডিপি ২০০২ সালে এসে দাঁড়ায় ৯৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডোলার।
  • অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর তালিকার তলানীতে থাকা মালয়েশিয়াকে নিয়ে আসেন তালিকার ১৪তম স্থানে।
  • সরকারি দপ্তরগুলোতে আমূল পরিবর্তন আনেন তিনি। সরকারি কর্মীরা যেন ঠিক সময়ে অফিসে আসেন তার জন্য প্রথমবারের মতো চালু করেন ফ্লো-চার্ট।

 

ইসলাম ও মাহাথির
ইসলাম ধর্মের প্রতি বিশ্বাস মাহাথিরের ভিতর আসে পরিবার থেকে। তার পরিবার তাকে ইসলামের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে শিক্ষা দেয়। কিন্তু তাদের কোন রূপ গোঁড়ামি ছিল না। ইসলাম সম্পর্কে “এ নিউ ডিল ফর এশিয়া” গ্রন্থে মাহাথির বলেন, ” ইসলাম ধর্ম আমাদের জীবনের অংশ। একে পরিত্যাগ করার কোন কারণ নেই। সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করা হলে ধর্ম কখনই অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বাধা হতে পারে না। ইসলামের শিক্ষা সমসাময়িক সময়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিতে হবে। ইসলাম শুধু মাত্র সপ্তম শতাব্দীর ধর্ম নয়। ইসলাম অবশ্যই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম।

লেখক – মুফতী ওযায়ের আমীন
জামেয়া রাহমানিয়া দারুল ইসলাম।
দক্ষিণ কাজলা, যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২৩৬

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া,রোর বাংলা,ইন্টারনেট;

সমগ্র বিশ্বে একই দিনে চান্দ্রমাসের সূচনা : একই দিনে রোযা ও ঈদ কি সম্ভব ?

আল্লামা মুফতী মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক দা.বা. একই দিনে রোযা ও ঈদ- একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ।

 প্রথমত : ভৌগোলিক ও জ্যোতির্শাস্ত্রীয় বাস্তবতার আলোকে

সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা শুরু করা, রমযান মাস শেষ হলে একই দিনে ঈদ করা এবং একই দিনে ঈদুল আযহা করা ভৌগোলিক ও জ্যোতির্শাস্ত্রীয় বাস্তবতার দিক থেকে এগুলো মূলত সম্ভবই নয়। কার্যত যা সম্ভব নয়, শরীয়ত নাযিলের সময় সে বিষয়ের ধারণা থাকলেও, শরীয়ত এর হুকুম দেয় না। আর একে তো অসম্ভব, আবার সে সময় এর ধারণাও ছিল না, এমন বিষয়ের হুকুম শরীয়ত কীভাবে দেবে?

কথা এমনিতেই খুব পরিষ্কার; তা সত্ত্বেও আরো স্পষ্ট করার জন্য প্রথমে আমরা বাস্তবতার আলোকে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখব তারপর শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে এর আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

 

সম্ভাব্যতা যাচাই

রোযা ও ঈদের ঐক্যের ডাক বেশি আগের নয়, আবার বেশি নতুনও নয়, ষাট বছরেরও কিছু বেশি এর বয়স। প্রথমে যারা এই আওয়াজ তুলেছেন তারা শুধু মুসলিম বিশ্বব্যাপী ঐক্যের প্রস্তাব পেশ করেছেন। পরবর্তীরা বিশ্বব্যাপী এক করার জন্য পীড়াপীড়ি করছেন এবং এখনও করে চলেছেন।

আমরা উভয় দাবির সম্ভাব্যতা যাচাই করতে চাই। নিম্নোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করুন :

এক. আমাদের কি বিশ্বব্যাপী কোনো সর্বজনীন নেতৃত্ব আছে?

একই দিনে বিশ্বব্যাপী রোযা ও ঈদ করা, অন্তত সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করা, এক্ষেত্রে জানা কথা যে, আমাদের সম্মিলিত কোনো খেলাফত বা নেতৃত্ব অথবা সম্মিলিত কোনো রাষ্ট্র কিছুই নেই। বিশ্বব্যাপী তো নেইই; মুসলিম বিশ্বব্যাপীও নেই। অথচ হিলালের বিশ্বব্যাপী সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য কোনো না কোনো বিশ্বব্যাপী শক্তি ও নেতৃত্বের প্রয়োজন, যেই নেতৃত্ব সবাই মেনে নেবে। এমন কিছু তো বিলকুল নেই! ওআইসি, এটা তো কোনো বিশ্বজনীন সংস্থা নয়। এর নামই তো হল ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশন’। আর ওআইসির ফিকহ একাডেমীর সিদ্ধান্তও ওআইসি সমর্থিত হওয়া জরুরি নয়। তাই ফিকহ একাডেমীর সিদ্ধান্ত ওআইসির কাছে কোনো আইনী মর্যাদা রাখে না। ফিকহ একাডেমী ১৯৮৬ ঈ. সনে এই সুপারিশ পাশ করে যে, কোনো এক শহরে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে সকল মুসলমানের উপরই ঐ চাঁদ দেখা মোতাবেক আমল ওয়াজিব হয়ে যাবে। এই সুপারিশের পর এখন ২০১৬ ঈ. শেষ হয়ে গেল। মোট ত্রিশ বছর পার হয়ে গেল। এখনও পর্যন্ত সেই সুপারিশের উপর আমলের কী পদ্ধতি হবে সে বিষয়ের কোনো খসড়াও তারা পেশ করতে পারেনি এবং ওআইসির মন্ত্রীসভাও একে কার্যকর করার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেয়নি।

এই প্রস্তাব অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বে বা সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করা, একে বাস্তবায়ন করার জন্য অন্তত চাঁদ দেখার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একটি সম্মিলিত বিশ্বজনীন সংগঠনের প্রয়োজন, যার প্রতি সবার ঐকমত্য থাকবে। এর সিদ্ধান্তের প্রতি সমস্ত মুসলমানের আস্থা থাকবে। অন্তত চাঁদ দেখার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এই সংগঠনের ফায়সালা অবশ্য-গ্রহণীয় বলে বিবেচিত হবে। আজও পর্যন্ত কি এরকম কোনো সম্মিলিত সংগঠন অস্তিত্বে এসেছে?

ডক্টর এ কে এম মাহবুবুর রহমান, ডক্টর আব্দুল্লাহ মারূফ প্রমুখের গ্রন্থনা ও সম্পাদনায় প্রকাশিত পুস্তিকা ‘পৃথিবীব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ : শরীয়াহ কী বলে? এর শেষ কথায় তারা যা লিখেছেন, তা হলÑ

আসুন আমরা হকের পক্ষে কথা বলি :

‘আলেম সমাজ ও আম জনতাকে আহ্বান জানাচ্ছি, আসুন আমরা সকল অসত্যের জাল ছিন্ন করে বেড়িয়ে আসি, সঠিক দ্বীনি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে এসকল সমস্যার সমাধান করি। আজকের মুসলমানদের ফরয দায়িত্ব হচ্ছে, মানুষের তৈরি সীমানা উপড়ে ফেলে মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ইসলামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার[1], যারা জীবনের সকল ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ইসলাম বাস্তবায়ন করবে এবং ইসলাম অনুযায়ী সমাধান প্রদান করবে, সকল মুসলমানকে একই তারিখে রোযা রাখা এবং ঈদ উদযাপন করার ঘোষণা প্রদান করবে এবং সকল উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করবে। মূলতঃ একমাত্র ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্রের পক্ষেই তা সম্ভব। আমীন। (পৃথিবীব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ : শরীয়াহ কী বলে?, পৃ. ৪৮)

এই কথাটাই হল আসল কথা, রোযা ও ঈদের ক্ষেত্রে ঐক্যের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য প্রথমে এটাই করা উচিত। এটা না হোক অন্তত এটুকু তো অবশ্যই হওয়া উচিত, যা উপরে বলা হয়েছেÑ অন্ততঃ চাঁদ দেখার প্রসঙ্গে সর্বমান্য, সর্বসম্মত, বিশ্বজনীন  গ্রহণযোগ্য চাঁদের সিদ্ধান্ত দানকারী কোনো সংগঠন হওয়া উচিত। কিন্তু কোথায় সেরকম সংগঠন? তাছাড়া যদি এমন কোনো সম্মিলিত সংগঠন অস্তিত্বে এসেও যায় তারপরেও কার্যত একই দিনে বা একই তারিখে সমগ্র বিশ্বে তো দূরের কথা গোটা ইসলামী বিশ্বেও সময়ের ব্যবধানের কারণে ঐক্য সম্ভব হবে না।

 

দুই. ঐক্যের ভিত্তি কী হবে?

দ্বিতীয় কথা হল, চান্দ্রমাসের সূচনার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী আমরা যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছি, সেই ঐক্য কীসের ভিত্তিতে হবে? শরয়ী পদ্ধতিতে চাঁদ দেখার ভিত্তিতে, না জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের ভিত্তিতে? দুই পদ্ধতির যে পদ্ধতিই গ্রহণ করা হোক বাস্তব  ক্ষেত্রে ঐক্য অসম্ভব।

(ক)

শরয়ী পদ্ধতিতে চাঁদ দেখার বিধান ছেড়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের পদ্ধতি যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে প্রথম কথা তো হল, কোনো রাষ্ট্রেই আহলে হক উলামা এবং তাদের অনুসারীগণ এই পদ্ধতির সাথে একমত হবেন না এবং একমত হতে পারেন না! সেক্ষেত্রে ঐক্যের চিন্তা করাটাই ভুল। তারপরও কথার কথা, কেউ যদি জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের পদ্ধতি গ্রহণ করতে চান তাহলে কি তিনি চাঁদের সম্মিলন বা সংযোগ (কনজাঙ্কশান) এর হিসাব গ্রহণ করবেন নাকি চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতার পদ্ধতি গ্রহণ করবেন? যদি চাঁদের কনজাঙ্কশানের হিসাব গ্রহণ করতে চান, তাহলে কনজাঙ্কশান তো দিন-রাতের যে কোনোও সময়ে, যে কোনো জায়গায় হতে পারে। এখন ধরুন, কনজাঙ্কশানের সময় কোনো এলাকায় সাহরীর সময় চলছে, তারা তো রোযা রাখতে পারবে, ঠিক আছে, কিন্তু যেসব এলাকায় ঐ সময় ফজরের নামায হয়ে গিয়েছে /সূর্য ঢলে পড়েছে সেখানকার অধিবাসীরা কি সেদিন রোযা রাখবে, না পরের দিন? যদি সেদিনই রোযা রাখে তবে তো সেটা অযৌক্তিক; বাস্তবতার নিরিখেও এবং শরীয়তের বিধান হিসেবেও। আর যদি পরের দিন রাখে তবে আর ঐক্য হল কোথায়?

(খ)

যদি চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতার হিসাব গ্রহণ করা হয়, তাহলেও প্রথম কথা হল, চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতার ভিত্তি খোদ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছেই ভিন্ন ভিন্ন। এ জন্যই চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতার নীতি অনুযায়ী প্রস্তুতকৃত লুনার ক্যালেন্ডারে পরস্পর অনেক বৈপরিত্য ও ভিন্নতা পাওয়া যায়। সুতরাং চাঁদ দেখার সম্ভাব্য সময়ই যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন সেহেতু এর ভিত্তিতে ঐক্য কীভাবে হবে? এত লুনার ক্যালেন্ডার দিয়ে রোযা ও ঈদ একসাথে কীভাবে করা যাবে?

আরেকটি কথা চিন্তা করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে জুমার নামাযই IDL (ইন্টারন্যাশনাল ডেট লাইন)-এর এ পাশে আর ও পাশে ভিন্ন ভিন্ন তারিখে হচ্ছে! তাহলে এরপরও ঈদ কি একই দিনে হয়?!

(গ)

এখন বাকি থাকল শরয়ী ভিত্তি ‘হিলাল দেখা’। আর এটাই একমাত্র সঠিক ব্যবস্থা, যার ভিত্তিতে ইসলামী মাসসমূহের শরয়ী সূচনা হবে, রোযা শুরু হবে, ঈদ হবে…। হিলাল দেখার ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ করলে অন্তত একদিনের ব্যবধান অবশ্যই হবে। হিলাল দেখার ভিত্তিতে সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা শুরু করা, একই দিনে ঈদ করা বাস্তব ক্ষেত্রে সম্ভবই নয়। প্রত্যেকে যদি নিজ নিজ অঞ্চলের হিলাল দেখে আমল করে তাহলে ঐক্য সম্ভব না হওয়া তো খুবই স্পষ্ট! সাড়ে চৌদ্দশ বছরের এটাই বাস্তবতা! আর যদি কোনো এক অঞ্চলের হিলাল দেখাকে ভিত্তি বানানো হয়, তবে সেটা কোন অঞ্চল? শরীয়তের কোন্ দলীলের মাধ্যমে সেটা নির্ধারিত হবে? কীসের ভিত্তিতে সেটা অগ্রাধিকার পাবে?

(ঘ)

কেউ যদি কোনো দলীল ছাড়াই শুধু আবেগের বশে সৌদিআরব অথবা মধ্য প্রাচ্যের কোনো অঞ্চলের হিলাল দেখাকে ভিত্তি বানায় তাহলে বিষয়টি বোঝার জন্য নিম্নোক্ত উদাহরণ লক্ষ্য করুন, যা ডক্টর মাহবুবুর রহমান তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি  লেখেনÑ

‘প্রতি চান্দ্র মাসের নতুন চাঁদ সকল সময়ই মধ্য প্রাচ্যের কোনো দেশে সর্ব প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়। তাই মধ্য প্রাচ্যের স্থানীয় সময়ের সবচেয়ে দূরতম অগ্রগামী সময়ের দেশ হচ্ছে জাপান। তার সাথে সময়ের পার্থক্য ৭-৩০ ঘণ্টা। ধরা যাক যদি, মধ্য প্রাচ্যে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় নতুন চাঁদ দেখে। ঐ সময় পৃথিবীর সর্বপূর্ব স্থান জাপানে রাত ১টা ৩০ মিনিট। তখন জাপানে সাহরী খাওয়ার সর্বনি¤œ সময় হলো ৩টা ৪৩ মিনিট। তাহলে জাপানবাসী চাঁদ উদয়ের সংবাদ পাওয়ার পরেও রোযা রাখতে সাহরী খাওয়ার জন্য সময় পাচ্ছেন। উপরন্ত ঐ সময়ের মধ্যে তারাবীর নামায আদায় করাও সম্ভব এবং শুক্রবার রোযা পালন করা সম্ভব। মধ্যপ্রাচ্যের পূর্বে অবস্থিত অন্যান্য দেশের সাথে সময়ের পার্থক্য আরো কম ফলে তারা রোযা রাখার জন্য আরো বেশি সময় পাবেন।’ (পৃথিবীব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ : শরীআহ কী বলে?, পৃ. ৩৯-৪০)

তিনি এটা খেয়াল করেননি যে, এরা তো রাত দেড়টায় গভীর ঘুমে থাকবে। সে সময় চাঁদের খবর তারা কীভাবে পাবে। আর এখানে যা সময় বলা হয়েছে, তা হল জাপানের একটি শহরের হিসেবে। আরো পূর্বের শহরগুলোতে রাতের আরো কম সময় বাকি থাকবে। তাছাড়া উদাহরণটি একটি ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে পেশ করা হয়েছে। তা হল, ‘প্রতি চান্দ্র মাসের নতুন চাঁদ সকল সময়ই মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে সর্ব প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়।’ অথচ এটা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বক্তব্য এবং বাস্তবতার পরিপন্থী। নতুন চাঁদ সাধারণত পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তেই দৃষ্টিগোচর হয়। এমনকি তা কোনো কোনো মাসে প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর থেকে সর্বপ্রথম দৃষ্টিগোচর হয়। তাছাড়া পশ্চিম প্রান্তের সাথে জাপান নয় ইন্দোনেশিয়ার সময় ধরুন। মৌরতানিয়ায় যখন হিলাল দেখা যাবে তখন ইন্দোনেশিয়ায় দিনের কোন সময়? একটু চিন্তা করুন!

ডক্টর মাহবুবুর রহমান সামনে আরো লিখেছেন-

‘এবার পশ্চিমাঞ্চলীয় দেশ নিয়ে আলোচনা করা যাক। ১০৫ ডিগ্রী পশ্চিম দ্রাঘিমার দেশসমূহ মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্রের আলবুক্য়ার্ক, ডেনভার, সিয়েন, মাইলস্ সিটিতে চাঁদ দেখার সংবাদ পৌঁছবে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সকাল ৯ টায়। এমনিভাবে সর্বশেষ ১৮০ ডিগ্রী পশ্চিম দ্রাঘিমার দেশ যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে চাঁদ দেখার সংবাদ পৌঁছবে সেখানের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার ভোর ৪ টায়। অতএব মধ্যপ্রাচ্য বৃহস্পতিবার চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে তারা শুক্রবার ১ রমযানের রোযা পালন করবে। অর্থাৎ সারা পৃথিবীব্যাপি একই দিন রোযা পালন করা সম্ভব।’ (পৃথিবীব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ : শরীআহ কী বলে?, পৃ. ৪০)

এটা তিনি আজব কথা লিখেছেন, কারণ কথা যদি এটাই হয় যে, সমগ্র বিশ্বে একই হিলালের উপর আমল করতে হবে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে যে হিলাল দেখা যাবে, সেই হিলালের উপর তো হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ-বাসীদের তৎক্ষণাৎ আমল করা উচিত। তাদের তো বৃহস্পতিবার থেকেই রোযা রাখা উচিত। সৌদি আরব অথবা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে হিলাল দেখার পর যে এলাকায় সাহরীর সময় পাওয়া যাবে, অন্তত রোযার নিয়ত করার সময় পাওয়া যাবে তাদের তো জুমার দিন পর্যন্ত রোযা বিলম্ব করার পরামর্শ দেওয়া ভুল। আপনি যেহেতু সমগ্র বিশ্বে একই হিলালের উপর আমল করার কথা বলেন, তো আপনি কীভাবে তাদেরকে এই পরামর্শ দিতে পারেন? তো তারা যদি বৃহস্পতিবার রোযা রাখে তাহলে তারা মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীদের চেয়ে একদিন আগে রোযা রাখল। আর যদি শুক্রবার রাখে তাহলে তো এরা বৃহস্পতিবার (দিবাগত) সন্ধ্যায় নিজেরাই হিলাল দেখবে। তাদের রোযা তাদের হিলাল দেখা মোতাবেকই হবে। মধ্যপ্রাচ্যের হিলাল দেখা মোতাবেক নয়। বৃহস্পতিবারের হিলালই তাদের জন্য হিলাল। যদিও আপনারা জবরদস্তি করে এটাকে পুরোনো চাঁদ বলতে চান। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় চাঁদ এখনও পর্যন্ত উদিত হয়ইনি।

এই সকল সম্মানিত ব্যক্তি যদি এই উদাহরণ নিয়েই চিন্তা-ভাবনা করেন, তাহলে তারা ইসলামী চান্দ্রমাসের ক্ষেত্রে একের অধিক হিলালের বিষয়টিও বুঝতে পারবেন। তাহলে জ্যোতির্বিজ্ঞান; যার দোহাই দিয়ে এত লড়াই-ঝগড়া, উলামায়ে কেরামকে এত জাহেল বলা, সেই জ্যোতির্বিজ্ঞানও তো একের অধিক হিলালের ধারণাই দেয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানও তো উদয়স্থলের ভিন্নতাকে মেনে নিচ্ছে। এরকম প্রত্যক্ষ ও বাস্তব বিষয়কে জ্যোতির্বিজ্ঞান কখনোই অস্বীকার করে না।

যাই হোক, এখন আমরা যা বলতে চাচ্ছি তা হল, মধ্যপ্রাচ্যের হিলালকে যদি প্রথম এবং একমাত্র হিলাল ধরা হয় এরপর একে সমগ্র বিশ্বে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে বাস্তব ময়দানে কত জটিলতা সামনে আসবে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

চিন্তা করুন, যে সন্ধ্যায় হিলাল দেখা যায়, রোযা এর পরের দিন হয়। এ ক্ষেত্রে হাওয়াইবাসীরা তো ‘বিশ্বব্যাপী প্রথম হেলাল দিয়ে রোযা রাখা’র নীতি অনুযায়ী বৃহস্পতিবারে রোযা রাখবে, তারা তো হিলালের আগের দিন রোযা রাখছে! আপনার কাছে এর কী ব্যাখ্যা?

আরো শুনুন, এরা যখন বৃহস্পতিবারে রোযা রাখল তখন তো শুক্রবার রাত (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত) তাদের জন্য দ্বিতীয় তারিখ। কারণ ইসলামী চান্দ্র ক্যালেন্ডারে দিন ও তারিখ সূর্যাস্তের পর থেকেই শুরু হয়ে যায়। এখন যাদের নতুন চাঁদ দেখে হাওয়াইবাসীরা বৃহস্পতিবার রোযা রেখেছে অর্থাৎ (মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীদের চাঁদ) তারা তো রোযা রাখবে শুক্রবারে, যা হাওয়াইবাসীদের জন্য অবশ্যই অবশ্যই দ্বিতীয় তারিখ। এটাকে যদি হাওয়াইবাসীদের জন্য প্রথম তারিখ বলা হয়, তবে কি তারা শা‘বানে রোযা রেখেছে? যেহেতু এটা মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম তারিখ আর হাওয়াইয়ে দ্বিতীয় তারিখ আর হাওয়াইবাসীদের রোযা হয়েছে বৃহস্পতিবার, মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীদের রোযা হয়েছে শুক্রবার তবে তো এখানে দিন তারিখ সবই ভিন্ন ভিন্ন হল! আর এটাও কত অবাক কা- যে, যাদের হিলাল দেখে রোযা রাখা হচ্ছে, তারা রোযা রাখছে পরে, আর অন্যরা রোযা রাখছে আগে।

এটা অবশ্য ভিন্ন এক বিষয় যে, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন হিলাল উঠার সম্ভাব্য সন্ধ্যা যখন, তখন তো হাওয়াইবাসীরা রাত যাপন করছে। তো বেচারাদেরকে শেষ রাতে ঘুমের অবস্থায় চাঁদ দেখার সংবাদ/সাক্ষ্য কীভাবে পৌঁছানো হবে?

আপনি যদি বলেন, হাওয়াইবাসীরা মধ্যপ্রাচ্যে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দৃষ্টিগোচর হওয়া হিলালের ভিত্তিতে (যার সংবাদ তারা বৃহস্পতিবার সুবহে সাদিকের কিছু আগে বা সুবহে সাদিকের পর পেয়েছে) শুক্রবার রোযা রাখবে। তাহলে প্রথম প্রশ্ন হলÑআপনাদের কথা মত যদি সর্বপ্রথম হিলাল দেখার মাধ্যমেই সমগ্র বিশ্বে হিলাল উদিত হয়ে রমযান শুরু হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তারা পূর্ণ একদিন রোযা ছাড়া কীভাবে কাটাবে? আপনারা যেভাবে কাফফারার ভয় দেখান, তাদের উপর এক রোযার পরিবর্তে ষাট রোযার কাফফারা আসবে না তো?!

(ঙ)

এ কথা আগেও বলা হয়েছে যে, এই ধারণা ভুল যে, নতুন চাঁদ প্রথমে মক্কায়, অথবা সৌদি রাষ্ট্রের সীমানায় অথবা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো রাষ্ট্রে দেখা যায়। আমরা বেশ কয়েকজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কাছে এই বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। তারা বলেছেন, নতুন চাঁদ সর্বপ্রথম দেখা যাবে এমন নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। এটাও নির্দিষ্ট নেই যে, প্রতি মাসে নতুন চাঁদ একই জায়গায় প্রথমবার দেখা যাবে। বরং কখনো এক জায়গায় দেখা যায়, কখনো অন্য জায়গায়। তবে অধিকাংশ সময় পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তেই সর্বপ্রথম নতুন চাঁদ দৃষ্টিগোচর হয়। তাদের পত্রগুলো আমাদের কাছে আছে। এ বিষয়ের কিতাবে ইনশাআল্লাহ সেগুলো প্রকাশ করা হবে।

এই বিষয়টি জানার জন্য ইন্টারনেটে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেওয়া মুন সাইটিংয়ের চান্দ্রগোলকের বিভিন্ন ছবি দেখা যেতে পারে। সেখানে দেখবেন যে, বছরের অনেক মাসে বরং কোনো কোনো বছরের অধিকাংশ মাসে প্রথম দর্শনযোগ্য চাঁদের ‘দৃষ্ট-রেখা’র বৃত্তে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ নেই। বৃত্তের ভেতরে আছে কখনো প্রশান্ত মহাসাগর বা আটলান্টিক মহাসাগর, কখনো হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, কখনো পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তের অন্যান্য দেশ।

যেহেতু এটাই বাস্তবতা যে, সবসময় হিলাল প্রথমবার সৌদিআরব বা মধ্যপ্রাচ্যে দৃষ্টিগোচর হয় না; বরং অধিকাংশ সময় পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে দৃষ্টিগোচর হয় সুতরাং বাস্তব ক্ষেত্রে রোযা ও ঈদের ঐক্য সম্ভব কি না তা যাচাই করার জন্য পশ্চিম প্রান্তের এলাকাগুলোর সাথে পূর্ব প্রান্তের এলাকাগুলোর সময় মিলিয়ে দেখতে হবে। এ জন্য নিম্নোক্ত উদাহরণটি লক্ষ্য করুনÑ

ধরে নিন, ৫ই জুন সন্ধ্যা ২৯ শা‘বানের সন্ধ্যা। কিন্তু প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের কোনো দেশেই চাঁদ দেখা যায়নি। আবাদি স্থানগুলোর মধ্যে শুধু হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে হিলাল দেখা গেছে সন্ধ্যা ছয়টায়। ধরে নিন যে, কোনো গ্রহণযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে এর সাক্ষ্য বা সংবাদ প্রাচ্যের দেশগুলোতেও এসে পৌঁছল। কিন্তু বিষয় হল, হাওয়াইতে ৫ই জুন সন্ধ্যায় হিলাল দেখা গেছে, তখন বাংলাদেশে ৬ই জুন সকাল দশটা এবং মালয়েশিয়ায় সকাল আটটা। এখন এখানকার লোকেরা যে রোযা রাখবে কীভাবে রাখবে? আর যদি না রাখে তাহলে সাতই জুন হবে তাদের প্রথম রোযা অথচ সেদিন হাওয়াই-র অধিবাসীদের ২য় রোযা চলছে। তাহলে একই দিনে সবার রোযা হল কোথায়? কীভাবেই বা হতে পারে? আর যদি বলেন, হোক না হোক, প্রাচ্যের অধিবাসীদের ৬ই জুনই রোযা রাখতে হবে, তাহলে তারাবীহ ছাড়া, সাহরী ছাড়া, রাতে নিয়ত করা ছাড়া কোন্ দলীলের ভিত্তিতে এদের উপর রোযা ফরয করে দেওয়া হবে?[2] এর চেয়ে বড় কথা হল, রোযার নির্ধারিত সময় তো সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। অথচ এক্ষেত্রে প্রাচ্যের বাসিন্দাদের দিনের বিভিন্ন সময়ে রোযা শুরু করতে হচ্ছে?!

এর চেয়েও বড় কথা হল, হিলাল দেখার আগে তো রোযার সময় শুরুই হয় না; প্রাচ্যের বাসিন্দাদের কাছে যদি দিনের কোনো অংশে হাওয়াইয়ের হিলাল দেখা প্রমাণিত হয়ে যায়, আর ততক্ষণ পর্যন্ত এরা কিছু না খেয়েও থাকে তাহলেও তো তাদের রোযা সুবহে সাদিক থেকে হয়েছে গণ্য হবে না। কারণ তাদের সুবহে সাদিকের সময় দুনিয়ার কোথাও নতুন চাঁদ দেখাই যায়নি। এ জন্য ঐটা রোযার সময় ছিল না।

আর যদি মেনেও নেওয়া হয় যে, প্রাচ্যের বাসিন্দারা ৬ই জুনই রোযা রাখবে তাহলে প্রশ্ন হল, পরবর্তীতে যদি হাওয়াইয়ের বাসিন্দারা তাদের হিসাব মতো ২৯ শাবান সন্ধ্যায় হিলাল না দেখে তাহলে তো তাদের পূর্ণ ত্রিশ দিন রোযা রাখতে হবে। তখন প্রাচ্যের বাসিন্দাদের মোট রোযা হয়ে যাচ্ছে একত্রিশটি!

দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, প্রাচ্যের বাসিন্দাদের এই অসম্পূর্ণ রোযা রমযানের ফরয রোযা হিসাবেই ধর্তব্য হবে নাকি এর কাযা আদায় করা তাদের জন্য আবশ্যক? যদি কাযা করতে হয়, তাহলে ঐক্যের আর অর্থ কী? আর যদি কাযা না করতে হয় তাহলে অসম্পূর্ণ রোযা দিয়ে ফরয কীভাবে আদায় হবে?

আজ ১৬ই ডিসেম্বর ২০১৬ ঈ. জুমাবার দিবাগত রাত এখানে সন্ধ্যা সাতটা বিশ মিনিটে কানাডার রিরহরঢ়বম শহরে অবস্থানরত এক বন্ধুর কাছে কিছু তথ্যের বিষয়ে ফোন করা হয়েছিল। তিনি বললেন, ‘আমাদের এখানে আজকে জুমাবার সকাল সাতটা বিশ মিনিট’। অর্থাৎ পূর্ণ বার ঘণ্টার ব্যবধান। আর আমাদের তো শনিবার শুরু হয়ে গেছে, অথচ তারা এখনও জুমার নামাযই পড়েননি। ধরে নিন কানাডাতে যদি হিলাল প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়, যেদিন সন্ধ্যায় সেখানে হিলাল দেখা যাবে, সেসময় আমাদের এখানে হবে পরের দিন সকাল। আমরা যদি ঐ দিনই রোযা রাখি, তবে সে রোযা হবে অসম্পূর্ণ, আর যদি পরের দিন রোযা রাখি, তাহলে দিন ও তারিখ ভিন্ন হয়ে যাবে।

এমনিভাবে প্রথম হিলাল যদি আলাস্কায় হয় তাহলে তো কোরিয়ার মুসলমানেরা যখন এর সংবাদ পাবে তখন তারা সকাল ৯/১০টা পার করছে। তাদের জন্য তো নিয়মমত রোযা রাখা সম্ভবই নয়। আবার এই হিলালের সংবাদ নিউজিল্যান্ডে এমন সময় পৌঁছবে যখন তাদের দিন-তারিখ সব পরিবর্তন হয়ে গেছে। কারণ হল, এক দেশ ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেট লাইনের’ এক পাশে আরেক দেশ অপর পাশে। নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীরা যদি আলাস্কার অধিবাসীদের সাথে একই ভোরে রোযা শুরু করে তাহলেও তাদের দিন ও তারিখ ভিন্ন হবে।

মোটকথা, প্রথমত বিশ্বজনীন কোনো নেতৃত্ব নেই। দ্বিতীয়ত সময়ের ব্যবধান অনেক। এসব কারণে বাস্তবতার আলোকে একই দিনে রোযা শুরু করা, একই দিনে ঈদ করা না বিশ্বব্যাপী সম্ভব না মুসলিম বিশ্বে সম্ভব।

এবার আমরা দেখব যে, শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে এর অবস্থান কী? এ ধরনের প্রয়াস-প্রচেষ্টা কি শরীয়তে কোনো জরুরি বিষয়? বা অন্তত মুস্তাহাব পর্যায়ের কোনো সওয়াবের কাজ?

 

শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে

বিশ্বব্যাপী একই দিনে বা একই তারিখে রোযা ও ঈদ করাকে ফরয/জরুরি সাব্যস্ত করার শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সামনে রাখতে হবে :

১. যে বিষয় গোড়া থেকেই সম্ভব নয় বা যে বিষয় পালনে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়, শরীয়ত কখনো এমন বিষয়ের আদেশ করে না। এজন্য যে কোনো সমঝদার ব্যক্তির কাছে প্রথম ধাপেই এই ফলাফল স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করা শরীয়তের নির্দেশ হতেই পারে না। অসম্ভব অথবা প্রায় অসম্ভব কোনো কাজের আদেশ শরীয়ত করতে পারে না।

২. শরীয়ত নাযিলের সময় যে বিষয়ের কোনোও ধারণা-কল্পনাও ছিল না, এরকম বিষয় শরীয়তের নির্দেশ হওয়ার কথা ভাবাই যায় না। সুতরাং এখানে তো একথা পরিষ্কার যে, এই কাজ শরীয়তের নির্দেশ হতে পারে না।

৩. নব উদ্ভাবিত কোনো কাজকে ফরয-ওয়াজিব তো দূরের কথা; সুন্নতের মর্তবাও যদি দেওয়া হয় তাহলেও এটা বিদআত হয়ে যায়। আর বিদআত তো গোমরাহী আর ভ্রষ্টতা।

৪. যে কাজের বিশেষ কোনো সওয়াব বা ফযীলত কুরআন হাদীসে বর্ণিত হয়নি আবার এই কাজ করতে গেলে অনেক কষ্ট ও অসুবিধা দেখা দেয় এরকম কাজ তো নিঃসন্দেহে ‘তাকাল্লুফ’ তথা লৌকিকতা ও নিরর্থক আয়োজন ছাড়া কিছু নয়। আর এ উম্মতকে এসব তাকাল্লুফ থেকে নিষেধ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে এসেছেÑ نهينا عن التكلف  আমাদেরকে তাকাল্লুফ থেকে নিষেধ করা হয়েছে।

৫. বিশ্বব্যাপী এই ঐক্যের শরয়ী কোনো মানদ- নেই। এটা যদি শরীয়তে নির্দেশিত হতই তাহলে শরীয়তে এর কোনো মানদ-ও থাকত। এই প্রসঙ্গে যে তিনটি মানদ- বলা হয়, এর একটাও আমলযোগ্য নয়!

 

ক. জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত লুনার ক্যালেন্ডার

এতে শরীয়তের বিধান পরিবর্তন হয়ে যায়। সুতরাং এটা সম্পূর্ণ না-জায়েয। শরীয়ত-নির্ধারিত ভিত্তি ‘হিলাল দেখা’ পরিবর্তন করার ইখতিয়ার কারো নেই। কেউ যদি পরিবর্তন করে দেয়ও তাহলেও আহলে হক মুসলমানরা একে গ্রহণ করবে না। তাহলে ঐক্য কীভাবে হবে।

 

খ. প্রথম হিলাল দেখা

এটা এ জন্য মানদ- হতে পারে না যে, প্রথমবার কোথায় হিলাল দৃষ্টিগোচর হয়, তা অনুসন্ধান করার হুকুম শরীয়ত দেয়নি। আর বাস্তবে দূর-দূরান্তের অঞ্চলের জন্য প্রথম হিলাল কোথায় কখন দেখা গিয়েছে তা অনুসন্ধান করা অনেক জটিল বিষয়। তারপরও যদি হিলাল সাব্যস্ত হয়েও যায়, তাহলেও সেটাকে বিশ্বব্যাপী কার্যকর করতে গেলে অনেক জটিলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এজন্য এই পদ্ধতিও আমলযোগ্য নয়।

 

গ. সৌদি আরবের হিলাল দেখাকে ভিত্তি বানানো

সৌদিআরবের চাঁদ দেখার ভিত্তিতেও বিশ্বব্যাপী আমল করা সম্ভব নয়। তাছাড়া কোনো এক জায়গার হিলালকে সমগ্র বিশ্বের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া, শুধু এতটুকু নয় যে, তা দলীলবিহীন, বরং এটা দলীলবিরোধী। সুতরাং এই পদ্ধতিই আসলে গ্রহণ করা উচিত যে, প্রত্যেক অঞ্চলের বাসিন্দারা নিজ নিজ অঞ্চলের হিলাল দেখা অনুসারে আমল করবে।

সুতরাং যেহেতু বিশ্বব্যাপী ঐক্যের শরয়ী কোনো মানদ- নেই তাহলে এটা শরীয়তে ফরয /ওয়াজিব বা সুন্নত তো দূরের কথা; অন্তত শরীয়তের কাম্যও হয় কীভাবে?

৬. শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবতা হল এ-ই। কিন্তু তথাকথিত প্রগতিপন্থী কিছু লোক বিষয়টাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন এবং এর জন্য এমন এমন দলীল বের করেন, যেন কুরআন-হাদীসে সম্পূর্ণ সুস্পষ্টভাবেই বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা শুরু করা এবং একই দিনে ঈদ করার কথা বলা হয়েছে। তারা এটাও বলেন যে, ‘যেহেতু আগের যামানায় প্রচারমাধ্যম এত উন্নত ছিল না; যা এখন হয়েছে, সেজন্য আগের লোকেরা শরীয়তের ঐ ওয়াজিব বিধান বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তাদের যদি সুযোগ হত তাহলে তারা অবশ্যই এটা বাস্তবায়ন করতেন।

এখন তো প্রচারমাধ্যম এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত হয়েছে যে, পুরো বিশ্ব যেন একটি গ্রাম। এখন আমাদের কুরআন-হাদীসের সেই বিধান বাস্তবায়ন করতে বাধা কোথায়?’

সামনে আমরা সেই ভাইদের পেশকৃত দলীলের (বাস্তবে যেগুলো দলীল নয়) উপর পর্যালোচনা করতে চাই। যেন এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এরা কোনো দলীল ছাড়াই একটি নব উদ্ভাবিত বিষয়কে শরীয়তের আবশ্যকীয় বিধান সাব্যস্ত করতে লেগেছেন।

৭. উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার অভিমত আর একই দিনে রোযা ও ঈদ জরুরি হওয়ার মতকে এক মনে করা।

তাদের বড় এক দুর্বলতা হল, তারা ফিকহ-ফতোয়ার কিছু কিতাবে দেখেছেন যে, হানাফী মাযহাবে, (বরং এক অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা মতে শাফেয়ী মাযহাব ছাড়া অন্য তিন মাযহাবেও এবং এক বক্তব্য অনুযায়ী শাফেয়ী মাযহাবেও) উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়। সুতরাং যদি অন্য কোনো এলাকা থেকে ‘তরীকে মুজিব’ অর্থাৎ বিশ্বস্ত ও শরয়ী নিয়ম-সমর্থিত পদ্ধতিতে খবর পাওয়া যায় তাহলে সে অনুযায়ী আমল করা জরুরি। এখান থেকে তাঁরা    এটা বুঝে নিয়েছেন যে, দেখ! সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করার কথা তো ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমও বলে গিয়েছেন!!

এটা তাদের অসম্পূর্ণ বুঝের পরিণাম ছাড়া কিছুই নয়। প্রথম কথা তো হল, لاعبرة لاختلاف المطالع  ‘উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ এমন ব্যাপক ও নিঃশর্ত কথা তো কোনো ইমামই বলেননি। ফিকহের কিতাবের পরবর্তী মুসান্নিফগণের অনেকে এ ধরনের নিঃশর্ত কথা যদিও লিখেছেন, কিন্তু ইমামদের কেউই এরকম নিঃশর্ত কথা বলেননি। ইমাম আহমদ ছাড়া অন্য তিন ইমামের মাযহাবেই অগ্রগণ্য বক্তব্য, যার উপর অধিকাংশ ফকীহ ফতোয়া দিয়েছেন তা এই যে, ‘কাছাকাছি অঞ্চলের ক্ষেত্রে তো এক জায়গার হিলাল দেখা অন্য জায়গার জন্য অবশ্য-অনুসরণীয় হবে, কিন্তু দূরবর্তী অঞ্চলের ক্ষেত্রে এক জায়গার হিলাল দেখা অন্য জায়গার জন্য প্রযোজ্য নয়’। হানাফী মাযহাবেরই অনেক বড় বড় ফকীহ এটা বলেছেন। ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি  থেকে এর বিপরীতে একটি শব্দও বর্ণিত হয়নি।  ‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ জাতীয় বাক্য ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে পাওয়া যায়নি। আর হানাফী মাযহাবে জাহিরুর রিওয়ায়াহ মানে হল ঐসব মাসআলা, যা ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির শাগরেদ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ছয় কিতাবে উল্লেখ আছে। আলহামদু লিল্লাহ ইমাম মুহাম্মাদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সব কিতাব এখন ছাপা আছে। এসব কিতাবের কোথাও لاعبرة لاختلاف المطالع ‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ জাতীয় কোনো বাক্য পাওয়া যায়নি।

অবশ্য এই বাক্য কানযুদ দাকায়েকসহ ফিকহে হানাফীর কিছু কিতাবে অবশ্যই এসেছে। কিন্তু এর যে অর্থ এখন উদ্ভাবন করা হয়েছে যে, পৃথিবীব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করা ফরয, এরকম কথা সেই মুসান্নিফদের কল্পনার আশেপাশেও আসেনি। এখানে সম্পূর্ণ নব উদ্ভাবিত একটি বিষয়কে এই বাক্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য শুধু এ কথা বলা যে, নিজ অঞ্চলের বাইরে থেকেও হিলাল সাব্যস্ত হওয়ার শরয়ী সাক্ষ্য যদি ‘তরীকে মুজিব’ এর মাধ্যমে এসে যায়, তবে সে অনুযায়ী আমল করা জরুরী। কিন্তু তাদের কেউ এ কথা বলেননি যে, ২৯ শা‘বান সন্ধ্যায় মুসলমানদের দায়িত্ব শুধু এটুকু নয় যে, নিজ নিজ এলাকায় হিলাল তালাশ করবে বরং তাদের উপর এটাও ফরয যে, সারা বিশ্বের কোনো এলাকায় আজ হিলাল দেখা গিয়েছে কি না তা সন্ধান করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট সংবাদ ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করে তা যাচাই করতে হবে, হিলাল দেখা প্রমাণিত হলে তা সারা বিশ্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ কথা যদি কোনো একজন ফকীহও কোথাও লিখতেন, তাহলেও বলা যেত যে, যাক! একজন ফকীহ তো অন্তত এ কথা বলেছেন! কিন্তু চার মাযহাবের ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবের বিশাল ভাণ্ডারে কোনো নির্ভরযোগ্য ফকীহের কিতাব থেকে এরকম কথা ইনশাআল্লাহ দেখানো যাবে না! বরং এর বিপরীতে যে সকল আলিম لاعبرة لاختلاف المطالع বক্তব্যকে হানাফী মাযহাবের বা অন্য মাযহাবের অগ্রগণ্য সিদ্ধান্ত মনে করেছেন তাদেরকেই যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, সারা বিশ্বে নয়, বরং বড় কোনো অঞ্চল জুড়ে প্রথম হিলাল দেখার ভিত্তিতে রোযা ও ঈদের আয়োজন করার শরয়ী বিধান কী, তখন তারা সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন, এটা ওয়াজিব তো কখনোই নয় বরং শরীয়তে এটা কাম্য বিষয়ও নয়। (এমদাদুল ফাতাওয়া খ. ২, পৃ. ১২৯)

তো আমরা বলছিলাম, তাদের বড় দুর্বলতা এই যে, তারা কয়েক বছর আগের উদ্ভাবিত একটি প্রস্তাবকে কয়েকশ বছর আগের ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। এই ভুল ধারণার ভিত্তিতে যে لاعبرة لاختلاف المطالع  বাক্যে একথাই বলা হয়েছে, অথচ বিষয়টি এমন নয়।

৯. কুরআন ও হাদীসে কি একই দিনে রোযা ও ঈদ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে?

তাদের এরচেয়েও বড় দুর্বলতা হল, তারা নবউদ্ভাবিত একটি প্রস্তাব, যার সূচনাই হয়েছে বেশি দিন হয়নি, তারা একে সরাসরি কুরআন-হাদীসের হুকুম সাব্যস্ত করছেন।৩[3] তারা বলছেন, কুরআন কারীমের আয়াত ২ : ১৮৫ -এ এবং -صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته শীর্ষক হাদীসে এই হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা শুরু করতে হবে, একই দিনে রোযা শেষ করে ঈদ করতে হবে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

জানি না, তারা সাধারণ বুদ্ধিকে কেন একটু কাজে লাগান না। যদি কোনো হুকুম কুরআন ও হাদীসে স্পষ্টভাবে এসে থাকে তাহলে সেটা আর নতুন কথা হবে কীভাবে? এটা তো তাহলে আয়াত যখন নাযিল হয়েছে, হাদীস যখন ইরশাদ হয়েছে তখন থেকে মানুষের মাঝে একটা জানাশোনা বিষয় হত। অনেক পুরোনো বিষয় হত। তাফসীরের কিতাবে, হাদীসের ব্যাখ্যার কিতাবে, ফিকহের কিতাবে এর আলোচনা হত। প্রত্যেক যুগের আলিম ও ফকীহগণের মুখে এর চর্চা হত। এমন কেন হল যে, পনেরো শতকে এসে এটা আবিষ্কার করতে হল আর দলীল-প্রমাণের  খোঁজে নামা হল।

যাই হোক, এখানে মনে হচ্ছে উক্ত আয়াত এবং উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা পূর্বাপরসহ উল্লেখ করে দিই। যাতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই আয়াত এবং এই হাদীসকে আলোচ্য বিষয়বস্তুতে টেনে আনা আয়াত ও হাদীসের উপর কত বড় জুলুম।

 

২ : ১৮৫ আয়াতের মর্ম

কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেনÑ

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ فِیْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی وَ الْفُرْقَانِ،  فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْیَصُمْهُ،  وَ مَنْ كَانَ مَرِیْضًا اَوْ عَلٰی سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ اَیَّامٍ اُخَرَ،  یُرِیْدُ اللهُ بِكُمُ الْیُسْرَ وَ لَا یُرِیْدُ بِكُمُ الْعُسْرَ  وَ لِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَ لِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلٰی مَا هَدٰىكُمْ وَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ.

“রমযান মাসÑ যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। যা মানুষের জন্য আদ্যোপান্ত হিদায়াত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং সত্য-মিথ্যার মাঝে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এই মাস পাবে সে যেন এই সময় অবশ্যই রোযা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে তবে অন্য সময় সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ, সেটাই করতে চান। তোমাদের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করতে চান না। যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করে নাও এবং আল্লাহ তোমাদের যে পথ দেখিয়েছেন সে জন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”

আয়াতে কারিমায় فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْیَصُمْهُ  অংশটির এক অর্থ তো এটাই, যা উক্ত তরজমা থেকে বুঝে আসছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তিই এই মাস পাবে, অন্য কথায় যে ব্যক্তিই এই মাসে উপনীত হবে সে যেন অবশ্যই এই মাসের রোযা রাখে।

এর আরেক অর্থ এটাও হতে পারে যে, যে ব্যক্তি এই সময় ‘মুকীম’ অবস্থায় থাকবে সে যেন অবশ্যই এই মাসের রোযা রাখে।  (যে সফরে থাকবে তার জন্য ঐ সময় রোযা ফরয নয়, তার জন্য পরবর্তীতে কাযা করে নেওয়ার অনুমতি আছে।) যে অর্থই গ্রহণ করা হোক, এখানে তো দূর থেকেও এ কথা বের করা যায় না যে, বিশ্বব্যাপী একই হিলাল এবং প্রথম হিলালের ভিত্তিতে রোযা রাখা ফরয। বিশ্বব্যাপী একই তারিখে রোযা শুরু করা এবং একই তারিখে ঈদ করা ফরয। এই প্রসঙ্গ আয়াতের কোন্ শব্দ থেকে বুঝে আসে? আয়াতে তো রমযান শুরু হলে শরীয়ত পালনে আদিষ্ট প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য রোযা রাখা ফরযÑএটুকুই বলা হয়েছে। রমযান কীভাবে শুরু হবে সে বিষয়ে এ আয়াত নীরব। তাহলে এ আয়াতের ঐ অর্থ কীভাবে বানানো হচ্ছে? তাদের কেউ কেউ বলেন যে, আয়াতে من শব্দটি ব্যাপকতা বুঝাচ্ছে। কিন্তু এ কথা কে অস্বীকার করে যে, من শব্দটি ব্যাপকতা বুঝাচ্ছে! من শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক।  সে কারণেই তো সকল মুসলিম নর-নারীর উপর রোযা ফরয! হাঁ, ওযরের কারণে শরীয়ত যাদেরকে অনুমতি দিয়েছে তাদের কথা ভিন্ন। এই আয়াতে সকল মুসলমানকেই রোযা রাখার হুকুম দেওয়া হয়েছে। এ থেকে এটা কীভাবে বুঝা যায় যে, প্রত্যেক এলাকার মুসলমানদের উপর একই দিনে রোযা শুরু করা ফরয। এটা তো ভিন্ন এক প্রসঙ্গ। এ বিষয়ে আয়াত নীরব।

যদি আয়াতের ইশারাই ধরা হয়, তাহলে তো শায়েখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আলউছাইমীনের কথা মতো এ আয়াতে এদিকে ইশারা আছে যে, যে অঞ্চলে লোকেরা এখনও রমযান পায়নি তাদের রোযা এখন শুরু হবে না। যখন তারা নিজেরা চাঁদ দেখার মাধ্যমে তাদের ওখানে রমযান শুরু হবে আর তারা রমযান পাবে তখনই তাদের উপর রোযা শুরু করা ফরয হবে। লক্ষ্য করুন যদি কারো রমযান না পাওয়ার বিষয়ই এখানে না থাকে তাহলে এভাবে বলার কী অর্থ যে, তোমাদের মধ্যে যারা রমযান পাবে!

যাইহোক, এটা তো একটা সূক্ষ্ম ইশারা। এ আয়াতে এর সম্ভাবনা আছে বটে! কিন্তু এই আয়াতের সুস্পষ্ট যে অর্থ, তা হল, রমযান শুরু হলে শরীয়ত পালনে আদিষ্ট প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য রোযা ফরয।  উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য কি ধর্তব্য নয় এই বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো হুকুম না এই আয়াতে আছে, না অন্য কোনো আয়াতে! এটা তো এক মুজতাহাদ ফীহ (ইজতিহাদ নির্ভর) মাসআলা। ফকীহগণ এই বিষয়ে ইজতিহাদের পথ অবলম্বন করেছেন এবং তাতে তাদের মাঝে মতভিন্নতাও হয়েছে। এই আয়াতের উদ্দিষ্ট মর্মের মধ্যে উদয়স্থলের বিভিন্নতার মাসআলা সরাসরি দাখিল করা ভুল। আর এই দাবি করা তো অনেক দূরের কথা যে, এই আয়াতে একই হিলাল ও প্রথম হিলালের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। নাউযুবিল্লাহিল আযীম।

রমযান কীভাবে শুরু করতে হবে সে আলোচনা তো ২ : ১৮৯ আয়াতে এসেছে।

یَسْـَٔلُوْنَكَ عَنِ الْاَهِلَّةِ  قُلْ هِیَ مَوَاقِیْتُ لِلنَّاسِ وَ الْحَجِّ

অর্থাৎ মানুষ আপনাকে হিলালসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলে দিন সেগুলো মানুষের জন্য (অর্থাৎ তাদের ইবাদত ও লেনদেনের জন্য, বিশেষ করে) হজ্বের জন্য সময় নিরূপণের মাধ্যম।

তো রমযান কীভাবে শুরু হবে তার বিবরণ এই আয়াতে এবং হাদীস শরীফে এসেছে। লক্ষ্য করুন! এ আয়াত এবং যেসব হাদীসকে এই আয়াতের ব্যাখ্যা বলা হয়েছে, কোথাও এ কথা  নেই যে, ইসলামী মাসসমূহের শরয়ী সূচনা সমগ্র বিশ্বে একই সাথে করা জরুরি এবং একই হিলালের দেখার ভিত্তিতে সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করা জরুরি! হিলালের মাধ্যমে সময় নির্ধারণের ফায়দা সৃষ্টির সূচনা থেকেই মানুষ লাভ করে আসছে। ইসলামে রোযা ফরয হওয়ার সময় থেকেই মানুষ হিলালের মাধ্যমেই রোযার সময়, রমযানের শুরু ও শেষ নির্ধারণ করে আসছে। কখনোই তো তাদের কল্পনায়ও এ কথা আসেনি যে, এই আয়াতে বিশ্বব্যাপী এবং প্রথম দেখা হিলালের ভিত্তিতেই সময় নির্ধারণ করা এবং এক হিলাল ও প্রথম হিলাল দেখার ভিত্তিতে রোযা শুরু করা এবং ঈদ করা ফরয করা হয়েছে। বড় আশ্চর্যের কথা যে, আয়াত নাযিল হওয়ার পর থেকে এতদিন পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ আয়াতের উপর যেভাবে আমল করে এসেছে তা আয়াতের মর্ম নয়। আর যে কথা কালকের সৃষ্ট আর তাও আবার নিছক চিন্তা ও দর্শনের আকারেই রয়ে গেছে, সেটাই নাকি আয়াতের উদ্দিষ্ট অর্থ!!

কুরআনের তাফসীরের কোনো এক নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেও কি এই নব উদ্ভাবিত ব্যাখ্যার একটি উদ্ধৃতি পেশ করা সম্ভব? সালাফে সালেহীনের নির্ভরযোগ্য কোনো এক কিতাবেও কি এই নব উদ্ভাবিত ব্যাখ্যার একটিও উদ্ধৃতি পেশ করা সম্ভব? কোনো সন্দেহ নেই যে, তা কোনোদিনই সম্ভব নয়!

এবার হাদীস শরীফের ভাষ্যটি লক্ষ্য করুন :

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছেÑ

إن الله تبارك و تعالى جعل الأهلة مواقيت للناس، فصوموا لرؤيته، وأفطروا لرؤيته، فإن غم عليكم فعدوا له ثلاثين يوما.

নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা হিলালকে মানুষের জন্য মীকাত (সময় নিরূপণের মাধ্যম) বানিয়েছেন। সুতরাং তোমরা হিলাল দেখে রোযা রাখ এবং হিলাল দেখে রোযা ছাড়। যদি হিলাল দেখা না যায় তাহলে (চলতি মাসের) ত্রিশ দিন গণনা কর! Ñমুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক বিন হাম্মাম (১২৬-২১১ হি.), খ. ৪, পৃ. ১৫৬, হাদীস ৭৩০৬; আসসুনানুল কুবরা বাইহাকী, খ. ৪, পৃ. ২০৫; আলমুসতাদরাক, হাকেম আবু আব্দুল্লাহ, খ. ১, পৃ. ৪২২, হাদীস ১৫৭৯; আস সহীহ, ইমাম ইবনে খুযাইমা (২২২-৩১১হি.) খ. ৩, পৃ. ২০১, হাদীস ১৯০৬)

উক্ত হাদীসে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, হিলাল দেখে রমযান মাস শুরু হবে। পরবর্তী হিলাল দেখে রমযান মাস শেষ হবে। এই জন্য হিলাল দেখে রোযা শুরু করতে হবে। হিলাল দেখে রোযা শেষ করতে হবে। যদি হিলাল দেখা না যায় তাহলে চলতি মাস ত্রিশ দিন গণনা করতে হবে। এই হল, হাদীসের মর্ম। তো এখানে কোথায় আছে যে, বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের এক হিলাল এবং প্রথম হিলাল দেখে একই দিনে রোযা শুরু করতে হবে। একই দিনে ঈদ করতে হবে? আবার বলা হচ্ছে, ‘তা শুধু সওয়াবের কাজ তাই নয়, বরং এটা করা ফরয। অন্যথায় ফরয রোযা ছেড়ে দেওয়ার কবীরা গুনাহ এবং ঈদের দিনে রোযা রাখার গুনাহ তাদের উপর আসবে’। এতসব কথা উক্ত হাদীসের কোন্ শব্দ আর কোন্ বাক্য থেকে বের হল? আসলে তা নব উদ্ভাবিত বিষয়কে হাদীসের উপর চাপিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কী?৪[4]

তারা বলেন,  صوموا لرؤيته-এর মধ্যে صوموا (তোমরা রোযা রাখ) হচ্ছে আদেশসূচক সম্বোধন এবং বহুবচনের শব্দ। এতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে হুকুম করেছেন যে, তারা যেন হিলাল দেখে রোযা রাখে! এই কথা শত ভাগ সঠিক, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই জন্যই সমগ্র বিশ্বের সকল মুসলমানদের উপর রোযা ফরয। কোনো অঞ্চলের মুসলমানরাই এই হুকুমের বাইরে নয়। সবার উপরই রোযা ফরয। আর হিলাল দেখার পরই রোযা ফরয । কারও জন্য এটা জায়েয নেই যে, হিলাল দেখা ছাড়া শুধু হিলালের সম্ভাবনার ভিত্তিতে মাস শুরু করবে এবং এটা জায়েয নেই যে, হিলাল দেখা বাদ দিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের ভিত্তিতে মাস শুরু করবে। রোযা সব অঞ্চলের সব মুসলমানের উপর ফরয। আর হিলাল দেখার পরই রোযা ফরয, এর আগে নয়।

এ হল হাদীসের সরল অর্থ। এখানে এ কথা কোত্থেকে এল যে, বিশ্বব্যাপী সমস্ত মুসলমানকে একই হিলাল এবং প্রথম হিলালের অথবা বিশেষ কোনো অঞ্চলের হিলালের ভিত্তিতে একই তারিখে রোযা শুরু ফরয? বহুবচনের শব্দ দিয়ে সবাইকে রোযা রাখতে বলা হয়েছে। সেখান থেকে এটা কীভাবে সাব্যস্ত হল যে, সবার রোযার সূচনা একই তারিখে হওয়া জরুরি। আচ্ছা أقيموا الصلاة (তোমরা নামায আদায় কর) এ কথার অর্থ কি এই যে, সবাই একই সময়ে নামায আদায় কর? অথবা آتوا الزكاة (তোমরা যাকাত আদায় কর) এর অর্থ কি এই যে, সবাই একই তারিখে যাকাত আদায় কর? أقيموا ও آتوا শব্দদ্বয় সম্বোধনসূচক বহুবচন। উভয় শব্দের সম্বোধনই ব্যাপক। বিশ্বের সকলকে সম্বোধন করা হচ্ছে। কিন্তু এখানে কি এ অর্থ হতে পারে যে, সবাই একই সময়ে নামায আদায় কর, সবাই একই তারিখে যাকাত আদায় কর? ওখানে যদি এ অর্থ হয় যে, সবাই নিজ নিজ সময়ে নামায আদায় কর এবং সবাই নিজ নিজ নেসাবের বছর পূর্ণ হলে যাকাত আদায় কর, তাহলে صوموا لرؤيته -এর ক্ষেত্রে কেন এই অর্থ হবে না যে, সকল মানুষ নিজ নিজ অঞ্চলের হিলাল দেখে রোযা শুরু করবে।

সুতরাং এ কথা বলা যে, ‘صوموا’ বলে সব অঞ্চলের সমস্ত মুসলমানকে সম্বোধন করা হয়েছে। আর সে জন্য বিশ্বব্যাপী এক হিলাল এবং প্রথম হিলাল দেখার ভিত্তিতে সমস্ত মুসলমানের উপর রোযা শুরু করা ফরয’Ñ সম্পূর্ণ ভুল। সম্বোধন সবাইকে করা হয়েছে এ কথা তো ঠিক আছে, কিন্তু শুধু ‘হিলাল দেখা’ এতটুকু বিধানের সাথে তারা যে এক হিলাল দেখা এবং প্রথম হিলাল দেখা অথবা সৌদিআরবের হিলাল দেখার কথা বলছেন তা তো হাদীসে নেই। এসব তো তাঁদের সংযোজন। শরীয়তের কোনো দলীলের আলোকে তাঁরা হাদীসের মর্মের মধ্যে এসব কথা যুক্ত করছেন? জানা কথা যে, এসব তাঁদের নিজেদের থেকে সংযোজন। এসব না কোনো আয়াতে আছে, না কোনো হাদীসে!

হিলাল দেখার সাক্ষ্যের হাদীসসমূহ থেকে কি এ কথা প্রমাণিত হয় যে, বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করা ফরয?

তারা এটাও দাবি করেন যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য এলাকা থেকে আগত হিলালের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ করেছেন। তাহলে বুঝা গেল, যে কোনো এলাকাতে হিলাল দেখা গেলে সব এলাকায় রোযা ও ঈদ করা উচিত।

 

পর্যালোচনা : হিলাল দেখার সাক্ষ্য কবুল করার হাদীসসমূহের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত। শা‘বানের ২৯ তারিখ, রমযানের ২৯ তারিখ, অথবা যিলকদের ২৯ তারিখ এসব তারিখে কখনো কি এমন হয়েছে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিলাল দেখার জন্য অথবা হিলালের সংবাদ বা সাক্ষ্য সংগ্রহ করার জন্য এক দিন দূরত্ব নয়; পাঁচ-দশ মাইল দূরত্বের কোনো এলাকায়ও কোনো লোক পাঠিয়েছেন? হাদীস, সীরাত ও ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে এর একটিও কি দৃষ্টান্ত আছে? উত্তর না-বাচক ছাড়া আর কী? খুব ভালো করে চিন্তা করা দরকার, এক হল সাক্ষ্য এসে গেলে সাক্ষ্য কবুল করা, আরেক হল সাক্ষ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করা, দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। একই হিলাল এবং প্রথম হিলালের ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ করা যদি কুরআন ও হাদীসের নির্দেশ হয়ে থাকে তাহলে অন্যান্য অঞ্চল থেকে নতুন চাঁদের সংবাদ এবং সাক্ষ্য সংগ্রহ করাও তো ফরয হবে। কিন্তু নবী-যুগে এর উপর আমল হল না কেন?  এসে যাওয়া সাক্ষ্য গ্রহণেই কেন ক্ষ্যান্ত থাকা হল?

সুতরাং মদীনা মুনাওয়ারার আশেপাশেও কাউকে না পাঠানো এবং মদীনায় হিলাল দেখা গেলেই রোযা শুরু করা /ঈদ করা এবং মদীনায় হিলাল দেখা না গেলে রোযা শুরু না করা এবং শাওয়ালের হিলাল দেখা না গেলে ত্রিশ রোযা পূর্ণ করা, এগুলোই তো দলীল যে, নিজ নিজ এলাকার হিলাল দেখার ভিত্তিতে আমল করলেই মানুষ দায়িত্বমুক্ত হয়ে যায়।

ভূমিকাস্বরূপ এই প্রয়োজনীয় কথাগুলো মনে রেখে এবার চাঁদ দেখার সাক্ষ্যের হাদীসগুলো নিয়ে চিন্তা করুনÑ

ক. এক হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযিআল্লাহু আনহুর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রোযা রাখার ঘটনা এসেছে। স্পষ্টই যে, এখানে খোদ মদীনার অধিবাসীদেরই এক ব্যক্তির সাক্ষ্য অনুযায়ী রোযা রাখা হয়েছে।

খ. আরেক হাদীসে এসেছে যে, এক বেদুঈন হাররা থেকে এসে রমযানের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দিয়েছে এবং সেই সাক্ষ্য গ্রহণ করে নেওয়া হয়েছে। হাররা আজকাল তো মদীনা মুনাওয়ারারই অংশ। মাসজিদে নববী থেকে হাররা মাত্র ৪-৫ কিলোমিটার দূরত্বে।

গ. আরেক হাদীসে দুই বেদুঈনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ঈদ করার ঘটনা এসেছে। এতে একথার উল্লেখ নেই যে, এই দুই বেদুঈন কোথা হতে এসেছে। কিন্তু বেদুঈনদের বসতি মদীনার আশপাশেই ছিল। এবং এরা সকাল সকাল এসে সাক্ষ্য দিয়েছিল। এটাও তো তাহলে মদীনা থেকে একেবারে কাছের এলাকারই সাক্ষ্য হল।

ঘ. মুসনাদে আহমদ এবং সুনানে ইবনে মাজাহ-এ একটি ঘটনা এমনও বর্ণিত হয়েছে যে, একবার ঊনত্রিশে রমযান সন্ধ্যায় হিলাল দেখা গেল না, তাই সবাই ত্রিশ রমযানের রোযা রাখলেন। দিনের শেষে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এক কাফেলা এল। তারা সাক্ষ্য দিল যে, গতকাল সন্ধ্যায় তারা হিলাল দেখেছে, নবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা ভেঙ্গে ফেলার এবং পরের দিন ঈদের নামাযের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার আদেশ করলেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৫৮৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৫৩)

তো এই কাফেলা কতই বা দূর থেকে আসবে যে, ২৯ শে রমযান সন্ধ্যায় হিলাল দেখে পরের দিন (আসরের সময়ই ধরুন) মদীনায় পৌঁছে যাবে? সেদিন হিলাল দেখার পর থেকে তারা যদি বিরামহীন লাগাতার উটের পিঠে সফর করে থাকে, তাহলে বেশির চেয়ে বেশি পঁচিশ মাইল, আরো বাড়ালে ত্রিশ মাইল দূর থেকেই হয়তো এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

হাদীসের কিতাবসমূহে একটু দূরবর্তী এলাকা থেকে আগত সাক্ষ্য গ্রহণ করার এই একটি ঘটনাই আছে যাকে মূলত দূর বলা যায় না। ফিকহের ভাষায় এটা ‘বিলাদে মুতাকারিবা’র সংজ্ঞায় পড়ে। অপরদিকে সহীহ মুসলিমে এবং সহীহ ইবনে খুযায়মাসহ হাদীসের অন্যান্য অনেক কিতাবে সহীহ সনদে কুরাইব রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বর্ণনাকৃত প্রসিদ্ধ হাদীসটি আছে। এই হাদীসে এসেছে যে, দামেস্কে, যা তখন দারুল খিলাফাহ ছিল, সেখানে স্বয়ং আমীরুল মুমিনীনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক একদিন আগে রমযান শুরু হওয়ার সংবাদ আসলেও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু আনহু সেদিকে দৃষ্টিপাত করেননি। তিনি বলেছেন, আমরা তো শনিবার সন্ধ্যায় হিলাল দেখেছি। এইজন্য আমরা ত্রিশ রোযা পূর্ণ করব। তবে নিজেরা যদি হিলাল দেখি সেটা ভিন্ন কথা। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, মুআবিয়া রাযিআল্লাহু আনহুর হিলাল দেখা এবং রোযা রাখা কি আপনি যথেষ্ট মনে করেন না? তিনি বললেন, না, আমাদেরকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই আদেশ করেছেন।

এই হাদীস থেকে জানা গেল, অনেক দূর-দূরান্তের এলাকা থেকে হিলাল দেখার সংবাদ আসলে সেটা ভিন্ন মাসআলা। হিলাল দেখার সাক্ষ্য গ্রহণ করার প্রসঙ্গে এক হাদীসের বর্ণনাকারী স্বয়ং আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু আনহু। এরপরও তিনি এ কথা বলছেন, তাহলে বুঝা গেল ভিন্ন এলাকার হিলালের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ করা বিষয়ে দূর ও নিকটের পার্থক্য আছে।[5]

দূর ও নিকটের পার্থক্য যদিও কতিপয় ফকীহ গ্রাহ্য করেননি, কিন্তু কোনো ফকীহ, মুজতাহিদ এই ফতোয়া দেননি যে, দূর-দূরান্তের অঞ্চল থেকে হিলাল দেখার সাক্ষ্য সংগ্রহ করে সব এলাকার জন্য সেই হিলালের বিধান বাস্তবায়ন করা জরুরি। হিলাল দেখার সাক্ষ্য গ্রহণের সমস্ত হাদীসের মর্ম ও আবেদনও এ কথার সমর্থন করে না। কেননা এসব হাদীসের প্রেক্ষাপট হল, মদীনা মুনাওয়ারা থেকে হিলাল দেখার জন্য অথবা হিলাল দেখার সাক্ষ্য সংগ্রহ করার জন্য কোনো প্রতিনিধি দলকে এদিক সেদিক পাঠানো হয়নি। যদি রোযা ও ঈদের তারিখের ক্ষেত্রে ঐক্য সৃষ্টি করা জরুরি হত তাহলে অবশ্যই এটা করা হত।

 

ঐ যামানায় কি প্রচার-ব্যবস্থা ও যোগাযোগ-ব্যবস্থা বিলকুল ছিল না?

এর জবাবে এই কথা যেন না বলা হয় যে, ঐ যামানায় তো যোগাযোগের উন্নত ব্যবস্থা ছিল না। এই সীমাবদ্ধতার কারণে বাধ্য হয়ে তারা নিজ নিজ এলাকার  হিলাল দেখার ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ করত। নয়তো তাদেরও জানা ছিল যে, কুরআন-হাদীসে এক হিলাল এবং প্রথম হিলালের ভিত্তিতে সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করা এবং একই সাথে অন্যান্য চান্দ্রমাস  শুরু করার হুকুম দেওয়া হয়েছে!

এ কথা এ জন্য যথাযথ হবে না যে, প্রচারব্যবস্থা ইসলামের শুরুর যুগ থেকে সব যুগে কমবেশি ছিল। প্রত্যেক যুগেই তার পূর্ববর্তী যুগ থেকে উন্নত থেকে উন্নততর ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। প্রশ্ন হল, প্রত্যেক যুগের দায়িত্বশীল ও আলিমগণ এবং  পীর ও মাশায়েখ কি নিজ নিজ সময়ের প্রচারব্যবস্থাকে সম্ভাব্য পর্যায় পর্যন্ত এই কাজে লাগিয়েছেন? উত্তর যদি না-বাচক হয়ে থাকে তাহলে চিন্তা করুনÑ আপনাদের দৃষ্টিতে তো এটা কুরআন-হাদীসের বিধান। আর ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের কথা মতে এটা কুরআন-হাদীসের সুস্পষ্ট বিধান, তাহলে এই গুরুত্বপূর্ণ বিধান সম্পর্কে ইলমে দ্বীনের ধারক-বাহকগণ, যারা নবীগণের ওয়ারিস তারা কীভাবে অবহেলা-উদাসীনতা প্রদর্শন করতে পারেন?

ঐ যামানায় প্রচলিত প্রচারমাধ্যম এবং যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মধ্যে আমরা শুধু নিন্মোক্ত বিষয়গুলোর আলোচনা করতে চাই :

১. দূত পাঠানো

২. হাতে হাতে চিঠি পাঠানো

এখানে এই আপত্তির সুযোগ নেই যে, ২৯ শে শাবান সন্ধ্যায় হিলাল দেখে পরের দিন সকালে রোযা রাখার  সংবাদ এবং ২৯ শে রমযান সন্ধ্যায় হিলাল দেখে পরের দিন ঈদ করার সংবাদ দূত মাধ্যমে বা হাতে হাতে চিঠির মাধ্যমে কত দূর আর পৌঁছানো সম্ভব?

চতুর্র্দিকে দশ মাইল পর্যন্তও যদি পৌঁছানো যায় তবু সেটা কম কীসে? এইটুকু অঞ্চলের বাসিন্দারা অন্তত প্রথম হিলাল দেখার ভিত্তিতে আমল করা থেকে মাহরূম থাকতো না। এরপরে বিষয় তো শুধু হিলাল দেখার সংবাদ রাতের মধ্যেই পৌঁছানো পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। যদি পহেলা শাওয়াল আছর পর্যন্তও সংবাদ পৌঁছে যায়, তবুও তো সবাই ঈদের দিন রোযা রাখার গুনাহ থেকে বেঁচে যেত। আর পরের দিন ঈদের নামায পড়ে নিত। এমনিভাবে দূর-দূরান্তে ২৭ শে রমযান পর্যন্তও যদি খবর  পৌঁছে যায় তাহলে তো সবাই সঠিক ২৯ তারিখ নির্ধারণ করতে পারবে। একটি রোযা কাযা করতে হবে, তা জানতে পারবে। পঁচিশ রমযানে খবর পৌঁছলে তো সঠিক ২৭-এর রাতও নির্ধারণ করতে পারবে। আর ঈদুল আযহা, কুরবানী, তাকবীরে তাশরীক ও শবে বরাত এসব তারিখের ক্ষেত্রে তো দূত এবং চিঠির ব্যবস্থা শত শত মাইল পর্যন্ত কাজে আসতে পারতো।

৩. ডাকযোগে পাঠানো

ডাকের ব্যবস্থা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু আনহুর যামানায়ও ছিল। পরবর্তীতে এই ব্যবস্থা অনেক উন্নতি করেছে। খেলাফতে বনু উমাইয়া এবং খেলাফতে আব্বাসিয়ার সময়ে তো এই ব্যবস্থা অনেক অনেক উন্নতি করেছে। আরবে ‘ঘোড়ার ডাক’ অনেক প্রাচীন। ডাকপিয়ন সাধারণ মুসাফিরদের মত সফর করতো না যে, দিনে চলত আর রাতে বিশ্রাম নিত। বরং ডাকপিয়নের রাতদিন লাগাতার সফর করতে হত। কয়েক মাইল পর পর তাজাদম ঘোড়া প্রস্তুত থাকত। যেন ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার কারণে ডাক পৌঁছতে বিলম্ব না হয়ে যায়। এভাবে অনেক দীর্ঘ পথও ডাকপিয়ন সংক্ষিপ্ত সময়ে অতিক্রম করে ফেলতো। ডাকের কথা সহীহ বুখারীতেও এসেছে। কুফার ডাকঘরে আবু মূসা আশআরী রাহ.-এর নামায আদায় করার বিবরণ সহীহ বুখারীতে (ফাতহুল বারীর নুসখা, খ. ১, পৃ. ৪০০, কিতাবুল উযু, অধ্যায় ৬৬ أبواب الإبل و الدواب و الغنم و مرابضها) এসেছে। আবু মূসা আশআরী রাযিআল্লাহু আনহু খেলাফতে রাশেদার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় যুগে কুফার গভর্নর ছিলেন। (ফাতহুল বারী, খ. ১, পৃ. ৪০১)

আরবে ডাকব্যবস্থা প্রাচীনকালে কত উন্নত ছিল সে বিষয়ের আলোচনা الطائر الغريد في وصف البريد নামক কিতাবে দেখা যেতে পারে। নুমান আফেন্দীর ডাকের ইতিহাসের উপর লিখিত এই চমৎকার ও অনবদ্য গ্রন্থটি মিসরের  المقتطف প্রেস থেকে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ছেপে প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত গ্রন্থে আগের কালে প্রচলিত ‘আকাশ-ডাকে’র এক গুরুত্বপূর্ণ প্রকার ‘পায়রার ডাক’সহ অন্যান্য প্রকারের বিষয়েও আলোচনা আছে। আরো দেখুন ‘আততারাতীবুল ইদারিয়্যা’, আব্দুল হাই কাত্তানী রাহ. (খ. ১ পৃ. ১৯১-১৯৪)

এরপর যখন চীন পারস্য এবং সিন্ধু ও হিন্দুস্তানসহ অন্যান্য অগ্রসর দেশসমূহও ইসলামের বিজিত অঞ্চলের অধীনে এসে গেছে তখন তো সেখানকার যোগাযোগ মাধ্যমও মুসলিম উম্মাহর ব্যবহারে চলে এসেছে।

দু’টি নমুনা

ঐতিহাসিক তাকীউদ্দীন মাকরিযী রাহ. (৮৪৫হি.)-এর ‘আলমাওয়ায়েজ ওয়াল ই‘তিবার’  খ. ১, পৃ. ৩২২) কিতাবে ইতিহাসের সেই সোনালি  অধ্যায়টিরও উল্লেখ আছে যে, ২৬১ হিজরীতে আফ্রিকায় যে সময় ইবরাহীম বিন মুহাম্মদ বিন আলআগলাবের শাসন প্রতিষ্ঠিত হল তখন তিনি সমুদ্রতীরে ধারাবাহিকভাবে কয়েক মাইল পর পর দূর্গ ও চৌকি স্থাপন করেন। তার কালে পথ ছিল সম্পূর্ণ নিরাপদ। ঐ সময় দূর্গে দূর্গে আগুন প্রজ্বলিত করার মাধ্যমে সাবতা থেকে ইস্কান্দরিয়া পর্যন্ত এক রাতেই সংবাদ পৌঁছে যেত। অথচ সাবতা আর ইস্কান্দারিয়ার মাঝে চার হাজার দুইশ ঊনআশি কিলোমিটারের দূরত্ব। বর্তমানে বাসেই ঊনসত্তর ঘণ্টার পথ।

এমনিভাবে ইস্কান্দরিয়া থেকে তারাবলুসে রাতে কয়েক ঘণ্টায় খবর পৌঁছে যেত। উভয় শহরের মাঝে দূরত্ব মোট আঠার শত বিরাশী কিলোমিটার। এটা হল মুরাবিতীনের শাসন আমলের ঘটনা। দেখুন আবু মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহিদ বিন আলী আততামীমী আলমারাকেশী (৫৮১-৬৪৭)-এর কিতাব ‘আলমুজিব ফি তালখীসী আখবারিল মাগারিব’, পৃ. ২৫০

প্রশ্ন হল, আমাদের পূর্বসূরীদের যুগে, বিশেষত সোনালী তিন যুগে চাঁদ দেখার সাক্ষ্য এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় আদান-প্রদানের জন্য কোনো মাধ্যম কি ব্যবহার করা হয়েছিল? উত্তর যদি না-বাচক হয়ে থাকে তাহলে এর কারণ কী? দ্বীনের বিষয়ে তারা শিথিলতা করতেন বলে কেউ যদি অপবাদ দেয়, সে তো নিজেই নিজের ঈমান বরবাদ করবে, আখেরাত নষ্ট করবে। তাহলে এটা মেনে নেওয়া ছাড়া কি কোনো উপায় আছে যে, আসলে ইসলাম যেহেতু মানব-স্বভাবের অনুকূল ধর্ম, এতে সবক্ষেত্রে সব যুগের এবং সব এলাকার মানুষের সহজতার দিক লক্ষ্য করা হয়েছে। তাই ইসলামী শরীয়তে এই হুকুম দেওয়াই হয়নি যে, হোক না হোক বিশ্বব্যাপী সমস্ত মানুষ যেন তাদের চান্দ্রমাস একই দিনে শুরু করে! একই দিনে রোযা ও ঈদ করে!  সেই জন্যই তো ইসলামের সাড়ে চৌদ্দশত বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাসে এর একটাও নযীর পাওয়া যায় না। এর নযীর তো পাওয়া যায়ই না, যা পাওয়া যায় তা হল, খেলাফতে রাশেদার যুগে খেলাফতের অধীন সমস্ত এলাকায় এটা লিখে পাঠানো হয়েছে যে, তোমরা হিলাল দেখে রোযা রাখ। হিলাল দেখেই রোযা শেষ কর। এই প্রসঙ্গে হযরত উমর রাযিআল্লাহু আনহু  সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানদের নিকট যে পত্র লিখতেন তা খতীব বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির উদ্ধৃতিতে ইমাম নববী রাহমাতুল্লাহি ‘শরহুল মুহাযযাব’ কিতাবে উল্লেখ করেছেন। (খ. ৭ পৃ. ৬৪৯-৬৫০) আরেকটি ফরমান মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাতেও আছে। এই প্রসঙ্গে শা‘বানের শেষে সালাফের খুতবা ও বক্তৃতা দেখা যেতে পারে। কেউ মদীনায় বলছেন صوموا لرؤيته, কেউ দামেশকে বলছেন صوموا لرؤيته। প্রতিটি খুতবাতে একই কথা যে, صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته তোমরা হিলাল দেখে রোযা রাখ। হিলাল দেখে রোযা ছাড়। এসবের নিশ্চিত ও অবশ্যম্ভাবী অর্থ কি এই নয় যে, তারা এবং তাদের শ্রোতারা এই হাদীস থেকে নিজ নিজ এলাকার হিলাল দেখার অর্থই বুঝেছেন!

 

নব উদ্ভাবিত এই প্রস্তাব সামনে আসার পর আলিমগণ কী বলেছেন?

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে চলে আসা এখনও পর্যন্ত বহাল ও বলবৎ এই সুন্নতে মুতাওয়ারাসার বিপরীতে যখন কতিপয় যুক্তিবাদী লোকের পক্ষ থেকে তথাকথিত ঐক্যের  আওয়াজ উঠল তখন আহলে হক আলিমগণ যথাসময়ে এর প্রতিবাদ করেছেন এবং তাদের উত্থাপিত যুক্তিসমূহের বাস্তবতা উন্মোচন করে দিয়েছেন।

 

১. ইবনে আব্দুর রাযযাক রাহ.

هل يمكن اتحاد الشمال الأفريقي مواسم وأعيادا

(গোটা উত্তর আফ্রিকায় একই দিনে ঈদ করা কি সম্ভব?) এবং

هل يمكن توحيد الأعياد الدينية في الأقطار الإسلامية

(গোটা মুসলিম বিশ্বে দ্বীনী পর্বসমূহের তারিখের ক্ষেত্রে ঐক্য সৃষ্টি করা কি সম্ভব?) প্রথম শিরোনামে যখন আলমাগরিব পত্রিকায় ৫ম সংখ্যা ১০ মুহাররম ১৩৬৩ হি. মোতাবেক ৭ জানুয়ারি ১৯৪৪ ঈ.-এ এবং দ্বিতীয় শিরোনামে আলইলম পত্রিকায় ৫২তম সংখ্যা ১৫ই যিলহজ্ব ১৩৫৫ হি. মোতাবেক ১০ নভেম্বর ১৯৪৬ ঈ. দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হল তখন এর বিস্তারিত খণ্ডন লিখেছেন মরক্কোর বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আলেম আল্লামা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব ইবনে আব্দুর রাযযাক (১৯০৬-২০১১ঈ.)। যা তার কিতাব العذب الزلال في مباحث رؤية الهلال -এ যুক্ত আছে। (পৃষ্ঠা : ১৭৪-২০৭) এই কিতাব কাতারের ধর্মমন্ত্রণালয় থেকে বড় বড় দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৮৩৪, রচনাকাল : মুহাররম ১৩৬৭ হি. মুতাবেক ডিসেম্বর ১৯৪৭ঈ.

العذب الزلال  -এর উপর অনেক বড় বড় মণীষী আলিমগণের অভিমত আছে। যা কিতাবের শেষে ছাপা হয়েছে।

 

২. শায়খ আব্দুল্লাহ বিন হুমাইদ, হারামুল মাক্কীর সাবেক ইমাম

শায়খ আব্দুল্লাহ বিন হুমাইদ রাহ.-ও এ মতবাদকে তার কিতাব >تبيان الأدلة في إثبات الأهلة< -এ প্রমাণিক খ-ন করেছেন। শায়েখের এ কিতাবের উর্দূ তরজমা ‘আলফুরকান’ পত্রিকায় Ñযা মাসলাকে দেওবন্দের মূখপত্রÑ প্রকাশিত হয়েছে। এমনিভাবে উলামায়ে আহলে হাদীসও পাকিস্তানে এ কিতাবের উর্দূ তরজমা প্রকাশ করেছেন।

 

৩. রাবেতার ফিকহ একাডেমী

পরে যখন কিছু লোকের পক্ষ থেকে   আবার একই তাকাযা পেশ করা হয়, তখন রাবেতাতুল আলামিল ইসলামীর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘আলমাজমাউল ফিকহিল ইসলামী (ফিকহ একাডেমী, মক্কা মুকাররমা) এর খ-ন করে এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছে :

لا حاجة إلى توحيد الأهلة والأعياد في العالم الإسلامي، لأن توحيدها لا يكفل وحدتهم، كما يتوهمه كثير من المقترحين لتوحيد الأهلة والأعياد. وأن تترك قضية إثبات الهلال إلى دور الإفتاء والقضاة في الدول الإسلامية، لأن ذلك أولى وأجدر بالمصلحة الإسلامية العامة، وأن الذي يكفل توحيد الأمة وجمع كلمتها، هو اتفاقهم على العمل بكتاب الله وسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم في جميع شؤونهم.

মুসলিম জাহানে হিলাল ও ঈদ এক করার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ তা মুসলিমদের ঐক্য নিশ্চিত করবে না যেমনটা হিলাল ও ঈদ এক করার অনেক প্রস্তাবকের ধারণা। হিলাল প্রমাণ হওয়ার বিষয়টি ইসলামী দেশগুলোর কাযা ও ফতোয়া বিভাগগুলোর উপর ছেড়ে দেওয়াই সমীচীন। কারণ এটিই ইসলামের সাধারণ কল্যাণ বিবেচনায় অধিকতর উত্তম ও উপযোগী।

আর যে বিষয়টি উম্মাহর ঐক্য নিশ্চিত করবে তা হচ্ছে, সকল বিষয়ে আল্লাহর কিতাব ও আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার বিষয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ হওয়া।’’ (কারারাতুল মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী, মক্কা মুকাররমা, পৃষ্ঠা : ৮৭-৮৯)

রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর ‘আলমাজমাউল ফিকহী’-এর ঐ অধিবেশনে, যাতে উপরোক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, পুরো বিশ্বের এবং সকল মাযহাবের বড় বড় ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্তে  স্বাক্ষরকারীদের নাম আমরা আলকাউসার শাওয়াল ১৪৩৪ হি. (আগস্ট ২০১৩ঈ.) সংখ্যায় পড়েছি।

 

৪. শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি

শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (১৩১১-১৩৮৯ হি.) যিনি শায়খ বিন বায রাহমাতুল্লাহি আলাইহির আগে সৌদিআরবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। রবিউল আউয়াল ১৩৭৭ হিজরীতে জামিয়াতুদ দুয়ালিল আরাবিয়্যার পক্ষ থেকে তার সামনে ‘তাওহীদুল আহিল্লার’ (হিলাল এক করা) বিষয়ে সেমিনারের প্রস্তাব পেশ করা হয়, তখন তিনি এতে সম্মত হননি।

তাঁর উত্তরের সারকথা হল, এটি এমন কোনো বিষয় নয়, যার জন্য সেমিনার ডাকা কাম্য। এটা তো একটা শাখাগত মাসআলা। صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته শীর্ষক হাদীসের মধ্যেই এর ফায়সালা আছে। এই হাদীসের বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে মতপার্থক্য হয়েছে (এক অঞ্চলের হিলাল দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য অবশ্যগ্রহণীয় কি না) সেটা অন্যান্য শাখাগত মতপার্থক্যের মতই। এই মতপার্থক্যে কোনো ক্ষতি নেই।

আসল কথা তো হল, গোটা উম্মত তাওহীদে উলূহিয়্যাত এবং তাওহীদে রুবূবিয়্যাতের উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়া। পরস্পর বিবাদ-বিসম্বাদের ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহকে একমাত্র সিদ্ধান্তদানকারী হিসেবে গ্রহণে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। মজলিস তো এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য হওয়া উচিত।

সুতরাং রোযা ও ঈদের হিলালের বিষয়ে (তাওহীদুল আহিল্লাহর প্রস্তাব) উক্ত মজলিসের সাথে একমত নই। আমার দৃষ্টিতে এ জন্য মজলিসের প্রয়োজন  নেই, মুসলিম উম্মাহ সুদীর্ঘ চৌদ্দ শতাব্দী অতিবাহিত করল, রোযা ও ঈদের মধ্যে তারিখের পার্থক্য ছিল, কিন্তু তারা একে ক্ষতিকর মনে করেননি। আর না তারা এর জন্য সেমিনার আহ্বান করার প্রয়োজন বোধ করেছেন! (ফতোয়া ওয়া রাসাইলি সামাহাতিশ শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলুশ শায়খ, খ. ৪, পৃ. ১৫৫-১৫৮, ফতোয়া নাম্বার : ১০৯৬)

এই বিষয়ে রাবেতাতুল আলামিল ইসলামীর ফিকহ একাডেমীর বিবৃতি একটু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সৌদি আরবের হাইয়াতু কিবারিল উলামার সুপারিশ আমরা আলকাউসার শাওয়াল ১৪৩৪ হি. (আগস্ট ২০১৩ঈ.) সংখ্যায় পড়েছি।

 

৫. হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.

হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. এই বিষয়ে যে সারৎসার ও অনবদ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন তা তাঁর পুস্তিকা ‘রুইয়াতে হিলালে’র পৃষ্ঠা : ১১-১২, ৩২-৩৭ -এ বিদ্যমান আছে। যার বাংলা অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

 

৬. হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসূফ বিন্নুরী রাহ.

হযরত রাহ.-এর তিরমিযীর শরাহ ‘মাআরেফুস সুনান’ দেখা যেতে পারে। তিনি সেখানে ‘তাওহীদুল আহিল্লা’র মতকে শরীয়তের মেযাজের খেলাফ বলেছেন।

 

৭. মাওলানা আব্দুল মাজিদ দরিয়াবাদী রাহ.

মাওলানা আব্দুল মাজিদ দরিয়াবাদী রাহ. মাওলানা ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন পণ্ডিত ও চিন্তাবিদ ব্যক্তিত্ব। যে বন্ধুরা সবসময় বুদ্ধির কথা বলেন, তাদের তো তাঁর কথার প্রতি মান্যতা থাকা চাই। বিশ্বব্যাপী নয়, শুধু ভারতব্যাপী একই তারিখে রোযা ও ঈদের জবরদস্তি করার উপর তিনি কী রকম সমালোচনা করেছেন তা তার তাফসীরে মাজেদী খ. ১, পৃ. ৩৩৮-৩৪০ আয়াত (২ 🙂 ১৮৫ এ দেখা যেতে পারে। এই কিতাবের উর্দূ ও ইংরেজী উভয় সংস্করণই হাতের নাগালে পাওয়া যায়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে এর বাংলা অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

 

৮. মাওলানা আব্দুর রহমান কীলানী রাহ.

আহলে হাদীস ঘরানার বড় আলেম, মাওলানা আব্দুর রহমান কীলানী রাহ. (১৯২৩-১৯৯৫ঈ.) তার কিতাব الشمس والقمر بحسبان (اسلام كا نظام فلكيات)  -এর পঞ্চম অধ্যায়ে (উদয়স্থলের বিভিন্নতা এবং ইসলামী পর্ব-উৎসবে ঐক্যের প্রচেষ্টা) শিরোনামে তিনি সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। পরিশেষে তিনি লেখেনÑ

‘…হযরত উমর রাযিআল্লাহু আনহুর মত চিন্তাশীল ও বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব, যিনি জনসাধারণের সহজতার জন্য অসংখ্য  নীতি ও ব্যবস্থার উদ্ভাবক বলে স্বীকৃত। তিনি মদীনা মুনাওয়ারা থেকে হাজার হাজার মাইল বিস্তৃত সা¤্রাজ্য সুন্দর ও সঠিকভাবে শাসন করেছেন। তিনি যদি ভালো মনে করতেন তাহলে কি মুসলমানদের এই ঐক্যের জন্য ব্যবস্থা না নিয়ে পারতেন? তিনি তো কথায় কথায় মজলিসে শূরা ডেকে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত জারী করতেন কিন্তু কখনোই ঈদ বা রমযানের ঐক্যের মাসআলা তাঁর আলোচনায় আসেনি! ঐ স্বর্ণযুগে যদি এর কোনো নযীর না পাওয়া যায়, তাহলে এখন অনেক বছর পরে এসে এ বিষয়ে কেন এত চাপাচাপি?

ইসলামের দুই ঈদ, ইবাদত এবং শোকরের নামায আদায়। ইসলামে ঈদ উৎসব পালনের জন্য নয়। তাই ঈদের ক্ষেত্রে ঈদের নামায (ফিতরা ও কুরবানী) ছাড়া আর কোনো বিধান ইসলামে দেওয়া হয়নি।

মুসলিম  ঐক্যের জন্য ইসলাম যে বিষয়গুলোর তাকীদ করেছে সেগুলোর মধ্যে হল, দলীয় সাম্প্রদায়িকতা থেকে বেঁচে থাকা। ফরয নামায জামাতের সাথে আদায় করা, যাকাত-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, হজ্বের সম্মিলন ইত্যাদিসহ আরো বিষয়। এসব বিষয়ে তো মুসলমানদের কোনো মনোযোগ নেই। শুধু অন্যান্য ধর্মের দেখাদেখি ধর্মীয় আবেগের সর্বোচ্চ সীমা কেবল উৎসব উদযাপনÑ ঈদ ও অন্যান্য পর্বের তারিখ এক করার আওয়াজ তোলা। বস্তুত ধর্মের সাথে সম্পর্কহীনতার প্রকাশ যে, মানুষ জরুরি বিষয়গুলোর দিকে নযর দেয় না। নিজের সমস্ত শক্তি অপ্রয়োজনীয় ও অহেতুক কাজে ব্যয় করে। (ইসলাম কা নেযামে ফালাকিয়্যাত,  মাওলানা আব্দুর রহমান কীলানী, মাকতাবাতুস সালাম, লাহোর, পৃষ্ঠা: ৭৯)

 

৯. হাফেজ সালাহুদ্দীন ইউসুফ

আহলে হাদীস ঘরানার আরেকজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব হাফেজ সালাহুদ্দীন ইউসুফ তাঁর কিতাব مسألۂ رؤیت ہلال اور بارہ اسلامی مہینے  -এর মধ্যে বিশদ আলোচনা শেষে সারসংক্ষেপে লেখেনÑ ‘মুসলিম বিশ্বে একই দিনে ঈদ পালন করা, রমযান ও অন্যান্য মাস একই দিনে সূচনার যে মতবাদ, তা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও দলীলবিহীন। সৌদিআরবের হিলাল দেখাকেও এক্ষেত্রে ভিত্তি বানানো যাবে না।’ (পৃষ্ঠা: ১৫৩, দারুস সালাম ইন্টারন্যাশনাল)

 

১০. পীর করম শাহ আজহারী

তিনি তার তাফসীরগ্রন্থ ‘যিয়াউল কুরআন’  খ. ১ পৃ. ১২৫-এ লেখেনÑ

কারণ, উদয়স্থলের ভিন্নতা একটি স্বীকৃত বিষয়। এ কারণে ফকীহগণ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, যদি দূর-দূরান্তের অঞ্চলে চাঁদ দেখা যায় তাহলে তা ধর্তব্য হবে না।

إن البلاد إذا تباعدت كتباعد الشام من الحجاز، فالواجب على أهل كل بلد أن تعمل على رؤيته دون رؤية غيره. (قرطبي)

(প্রকাশক যিয়াউল কুরআন পাবলিকেশন্স, গঞ্জ বখশ রোড লাহোর, মুদ্রণকাল: ১৯৯৫ ঈ.)

 

১১. ড. ইউসূফ আলকারযাভী

আল্লামা ড. ইউসুফ কারযাভী রাহ. প্রথমে যা কিছুই লিখে থাকুন সম্প্রতি ২০১৬ ঈ. ইস্তাম্বুলে হিজরী ক্যালেন্ডারের উপর যে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় তাতে তিনি পরিষ্কার বলেছেন যে, কুরআন-হাদীসে কোথাও নেই যে, গোটা দুনিয়ায় একই দিনে রোযা ও ঈদ করতে হবে।

সেমিনারের পর সাক্ষাৎকারে আরো বলেছেন, মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার স্থানগত ও সময়গত এত দূরত্ব থাকা অবস্থায় চাঁদসমূহ এক করার চিন্তা সম্পূর্ণ অর্থহীন। দেখুন:

http://www.huffpostarabi.com/2016/05/30/story_n_10203036.html

মোটকথা, বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করার মতবাদ একটি নতুন বিষয়। চার মাযহাবেরই অধিকাংশ আলেম এবং এই উপমহাদেশের দেওবন্দী, বেরলভী ও আহলে হাদীস, সকল ঘরানার অধিকাংশ আলেম একে এক অপ্রয়োজনীয় বরং ভিত্তিহীন প্রচেষ্টা গণ্য করেছেন। আর এ প্রয়াসকে বিশেষ কোনো সওয়াবের কাজ মনে করা হলে তা বিদআত হওয়ার বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বীনের ইলম এবং শরীয়তের রুচি-প্রকৃতি সম্পর্কে বেখবর থাকার কারণে যারা একে ফরয বা ওয়াজিব বলতে চান, তারা তো বুঝে অথবা না বুঝে শরীয়তের বিকৃতিতে লিপ্ত।

প্রকাশ থাকে যে, যারা একই দিনে রোযা ও ঈদকে ফরয বা ওয়াজিব বলার প্রবক্তা, মাজমাউল ফিকহিল ইসলামীর (জিদ্দা ফিকহ একাডেমী) সুপারিশে তাদের এই মতের পক্ষে কোনো দলীল নেই।


এটা পড়ুন –  কাবলাল জুমআ চার রাকাতঃ একটি দালিলিক আলোচনা


জ্যোতির্বিদগণ কী বলেন?

তাদের উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে আপত্তি হল, ‘আলিমরা বিজ্ঞান জানে না, জ্যোতির্বিজ্ঞান বুঝে না। এজন্যই মুসলিম জাতি আজ অধঃপতনের শিকার। আলিমরা জ্যোতির্বিজ্ঞান না জানার কারণেই রোযা ও ঈদের ঐক্যের বিরোধী’! কিন্তু তাদের এই আপত্তির বাস্তবতা আজও আমাদের বুঝে আসে না! ধরে নিন, একজন মৌলবী সাহেবও জ্যোতির্বিজ্ঞান জানে না, কিন্তু আমাদের ইঞ্জিনিয়ার সাহেবরা তো জানেন। (যদিও আফসোসের কথা হল, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের দেশে এস্ট্রোনমির গবেষণার কাজ ইঞ্জিনিয়ারদেরকেই করতে হচ্ছে। দেশে আমাদের জানা মতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই এস্ট্রোনমি বিভাগ নেই।) কিন্তু এরা জ্যোতির্বিজ্ঞান জানা সত্ত্বেও কেন বলেন যে,

১. ‘চান্দ্রমাস হয়তো ঊনত্রিশ দিন হবে, নয়তো ত্রিশ দিন’ অথচ জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসারে চান্দ্রমাসের সময়ের মধ্যে ভাংতি আছে।

২. কেন তারা বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করা উচিত’, অথচ জ্যোতির্বিজ্ঞান বলে বিশ্বের সব জায়গায় একই দিনে নতুন চাঁদ দেখা অসম্ভব। এ জন্যই জ্যোতির্বিজ্ঞান উদয়স্থলের বিভিন্নতা স্বীকার করে। কারণ এটা একটা বাস্তবতা।

৩. কেন তারা বলেন, ‘চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতার পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে লুনার ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করে সেই মোতাবেক রোযা ও ঈদ করা উচিত’। অথচ জ্যোতির্বিজ্ঞান এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুন থেকে চান্দ্রমাস হিসাব করে। এদিকে ইসলামের শিক্ষা হল, চান্দ্রমাস হিলাল দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্য সময় থেকে নয়, দেখার মাধ্যমে শুরু হবে। এই জন্য হিলাল দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতার পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে প্রস্তুতকৃত লুনার ক্যালেন্ডার মোতাবেক আমল করলে না ইসলামী শরীয়তের শিক্ষা মোতাবেক আমল হবে, না জ্যোতির্বিজ্ঞানের পদ্ধতি অনুসারে আমল হবে।

মেহেরবানী করে একটু বলুন দেখি, শরীয়ত তো চান্দ্রমাসের হিসাবকে চাঁদ দেখার সাথে সম্পৃক্ত করেছে। এক্ষেত্রে শরীয়তের নিকট জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের কোনো ই‘তিবার নেই। তাহলে বাস্তবেই যদি আলিমগণ জ্যোতির্বিজ্ঞান না জানেন, এতে এমন কী অন্যায় হয়ে গেল যে, এর কারণে তাঁরা হিলালের সাথে সম্পৃক্ত শরীয়তের বিধান বুঝবেন না?!

যাই হোক এখন আমরা বলতে চাচ্ছি, তারা তো জ্যোতির্বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে আলিমগণের সাথে মতানৈক্যে লিপ্ত হচ্ছেন। অথচ আমরা দেখি যে, হিলাল দেখার মাসআলায়ও এবং একই তারিখে রোযা ও ঈদ করার ইস্যুতেও বড় বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানী আলিমগণের সাথেই আছেন।

দ্বীনী বিষয় বিশেষত রোযা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, হজ্ব ও কুরবানী ইত্যাদির ক্ষেত্রে হিলাল দেখার ভিত্তিতেই চান্দ্রমাসের হিসাব হবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের ভিত্তিতে নয়।

এখানে আমরা শুধু দরসে নেযামীর পাঠ্যভুক্ত একটি কিতাবের পাঠ উল্লেখ করছি। ‘দরসে নেযামী’ আমাদের উপমহাদেশের সমস্ত মাদরাসার নেসাবের ভিত্তি। কিতাবটির নাম হল ‘শরহে চিগমিনী’। এটি মূসা পাশা বিন মুহাম্মাদ (৮৯৯হি.)-এর রচনা। যা মাহমূদ বিন উমর চিগমিনী রাহ. (৬১৮হি.)-এর কিতাব ‘আলমুলাখ্খাসের’ ব্যাখ্যাগ্রন্থ। এতে আছেÑ

وأوضح الأوضاع هوالهلال، لكن رؤية الهلال تختلف باختلاف المساكن، كما أشرنا إليه، فلم يلتفت إليها عند أهل الحساب إلا في الأمور الشرعية امتثالا لأمر الشرع.

চাঁদের কলাসমূহের সবচেয়ে সুস্পষ্ট কলা হল, হিলাল। কিন্তু স্থানভেদে হিলাল দেখা ভিন্ন ভিন্ন হয়। এজন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা হিলালের দিকে দৃষ্টিপাত করেননি। কিন্তু দ্বীনী বিষয়াদিতে শরীয়তের হুকুম তামিল করার জন্য হিলালকে গ্রহণ করেছেন। (শরহু চিগমিনী, পৃষ্ঠা: ১২৭, মাকতাবায়ে আশরাফিয়া দেওবন্দ থেকে ১৩৮৭ হি.-এ মুদ্রিত)

তো বুঝা গেল, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নিজস্ব শাস্ত্রীয় পরিম-লে যদিও এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুন থেকে চাঁদের হিসাব শুরু করেন কিন্তু দ্বীনী বিষয়ে যেহেতু শরীয়তের হুকুম মান্য করতে হবে আর শরীয়ত যেহেতু দ্বীনী বিষয়ে হিলাল দেখার উপর ভিত্তি রেখেছে সেহেতু তারা দ্বীনী বিষয়ের ক্ষেত্রে হিলাল দেখারই অনুসরণ করে। নিজস্ব শাস্ত্রের মর্যাদা ও ব্যবহারের ক্ষেত্র শাস্ত্রজ্ঞরা বেশি বুঝেন নাকি ভিন্ন শাস্ত্রের লোকেরা?

এখন বলছিলাম যে, ‘আলিমরা জ্যোতির্বিজ্ঞান বুঝে না’Ñ একে বাহানা বানিয়ে তারা বিশ্বব্যাপী একই তারিখে রোযা ও ঈদ করার প্রচারণা চালাচ্ছেন, তাদের তো খবর নিয়ে দেখা উচিত যে, এই বিষয়ে স্বয়ং জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বক্তব্য কী? আমরা এখানে আগের ও পরের এবং বর্তমান সময়ের দু’চারজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর উদ্ধৃতি পেশ করছি :

 

১. আলবেরুনী (৪৪০হি.=১০৪৮ঈ.)

আলবেরুনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি হিসাব-নির্ভর লুনার ক্যালেন্ডারের ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ পালনকারী বাতিল ফিরকা বাতেনী শীয়াদের খ-ন করতে গিয়ে যে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন তার সামান্য একটি অংশ এইÑ

فإذن لا يمكن ما ذكروه من تمام شهر رمضان أبدا ووقوع أوله وآخره في جميع المعمور من الأرض متفقا كما يخرجه الجدول الذي يستعملونه.

অর্থ : এটা সম্ভব নয় যে, রমযান মাস সবসময় ত্রিশ দিনেই হবে এবং এটাও সম্ভব নয় যে, মাসের শুরু ও শেষ সমগ্র বিশ্বে একই তারিখে হবে। যেমনটা তাদের ক্যালেন্ডারে দেওয়া থাকে। ‘আলআসারুল বাকিয়া আনিল কুরূনিল খালিয়া, পৃষ্ঠা : ৬৬

 

২. ইবনে রুশদ (৫২০-৫৯৫ হি.)

তিনি একইসাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন এবং অনেক বড় ফকীহও ছিলেন। তিনি ইলমুল ফিকহ বিষয়ে তাঁর কিতাব বিদায়াতুল মুজতাহিদ (খ. ১, পৃ. ৩৫৮)-এ লিখেছেন, দূর-দূরান্তের অঞ্চলের ক্ষেত্রে এক এলাকার হিলাল দেখা অন্য এলাকার জন্য ই‘তেবার করা হবে না। তার আরবী বক্তব্য এইÑ

>وأجمعوا أنه لا يراعى ذلك في البلدان النائية كالأندلس والحجاز<.

তিনি আরো লিখেছেনÑ ‘দূরবর্তী ও নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহের এক অঞ্চলের হিলাল দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য ধর্তব্য হওয়া না হওয়ার পার্থক্য করা আকলেরও দাবি।’

তার আরবী পাঠ হলÑ

والنظر يعطي الفرق بين البلاد النائية والقريبة، وبخاصة ما كان نأيه في الطول والعرض كثيرا.

৩. ডক্টর হুসাইন কামালুদ্দীন (১৩৩২ হি.=১৯১৩ ইংÑ১৪০৭ হি.=১৯৮৭ ঈ.)

প্রকৌশল ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তার অবদান অনেক। মিশর ও সৌদিআরবের বড় বড় ইউনিভার্সিটিতে তিনি এ বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তিনি دورتا الشمس  والقمر وتعيين أوائل الشهور العربية باستعمال الحساب নামে তার বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছেন। লক্ষণীয় বিষয় হল, তিনি তার এই কিতাবে (পৃষ্ঠা: ২৮-এ) প্রথমে জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোকে হিলালের উদয়স্থলের বিভিন্নতার বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। এরপর তিনি লিখেছেন

>وهكذا بنى الشارع على اختلاف المطالع كثيرا من الأحكام ومن أظهرها مواقيت الصلاة، ولا يجوز توحيد الصوم والأعياد لجميع أهل الأرض<.

‘শরীয়ত উদয়স্থলের বিভিন্নতাকে অনেক আহকামের ভিত্তি বানিয়েছে। তন্মধ্যে সুস্পষ্ট আহকাম হল নামাযের সময়। আর সারা পৃথিবীতে রোযা ও ঈদের ঐক্য জায়েয নয়।

 

৪. মূসা রূহানী (১৪১৯হি.= ১৯৯৮ঈ.)

শায়খুল হাদীস ও শায়খুত তাফসীর হওয়ার সাথে সাথে প্রাচীন ও আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের বড় পারদর্শী ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর চল্লিশের কাছাকাছি ছোট-বড় কিতাব রচনা করেছেন। তিনি তার ‘সায়রুল কামার ওয়া ঈদুল ফিতর’ কিতাবে নিজ নিজ এলাকার হিলাল দেখার বিধানকেই সমর্থন করেছেন আর পরিষ্কার লিখে দিয়েছেন যে, শরীয়তের বিধানের ভিত্তি শরয়ী দলীল, বিজ্ঞানের গবেষণা নয়। তিনি এটাও সুস্পষ্ট করে বলেছেন যে, সৌদিআরবের ঈদ থেকে উপমহাদেশের ঈদ পরে হওয়াতে আশ্চর্যের কিছু নেই। শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকেও নয়, জ্যোতির্বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও নয়।

 

৫. ডক্টর ইউসুফ মুরওয়া

Jackson university of Mississippi থেকে নিউকিøয়ার ফিজিক্সে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করা ছাড়াও বৃটেন, জার্মানি ও আমেরিকার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে নিউকিøয়ার ফিজিক্সসহ সাইন্সের আরো কিছু বিষয়ে উচ্চ ডিগ্রি অর্জনকারী এবং বিজ্ঞানের জগতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী প্রতিষ্ঠানالجمعية اللبنانية للأبحاث العلمية -এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান ড. ইউসুফ মুরওয়া একই দিনে রোযা ও ঈদের মতবাদের পর্যালোচনা ঐ সময়ের আকাবির ওলামা মাশায়েখের খেদমতে পেশ করেছেন। তাতে তিনি লিখেছেনÑ

‘যেহেতু মুসলিম বিশ্ব মাশাআল্লাহ বেশ বড় সীমানা জুড়ে বিস্তৃত। ইন্দোনেশিয়া থেকে পশ্চিম আফ্রিকা পর্যন্ত, ১৪২ ডিগ্রি পূর্ব থেকে ১৮ ডিগ্রি পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই ভৌগোলিকভাবে ইসলামী বিশ্বকে তিনটি জোনে ভাগ করা চাই।

১. ৩০ ডিগ্রি পূর্ব থেকে ২০ ডিগ্রি পশ্চিম পর্যন্ত যেসব রাষ্ট্র রয়েছে যথা লিবিয়া তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, মৌরতানিয়া, মালী, চাঁদ, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, বেনীন, ঘানা ইত্যাদি।

২. ৩০ ডিগ্রি পূর্ব এবং ৮০ ডিগ্রি পূর্বের মধ্যবর্তী রাষ্ট্রগুলো। যথা মিশর, সুদান, সোমালিয়া, সৌদিআরব, ইয়েমেন, জর্দান, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত  ইরান, তুরস্ক পশ্চিম আফগানিস্তান, পাকিস্তান…।

৩. ৮০ ডিগ্রি পূর্ব এবং ১৪০ ডিগ্রি পূর্বের মধ্যবর্তী অঞ্চলসমূহ। যথা বাংলাদেশ, বার্মা, থাইল্যান্ড, চীন মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া।

তিনি লিখেছেন, এই হল তিনটি জোন। এবার কোনো এক জোনে নতুন চাঁদ দর্শনযোগ্য হওয়ার অর্থ এই নয় যে, অবশ্যই অবশ্যই অন্য দুই জোনেও তা দর্শনযোগ্য হয়েছে।

তার এই লেখা মাজাল্লাতু মাজমায়িল ফিকহিল ইসলামী, সংখ্যা : ২, খ- : ২, পৃষ্ঠা : ৮৮৭-৮৯০-এ প্রকাশিত হয়েছে। আলোচনাটি তার কিতাব ‘আলউলূমুত তাবয়িয়্যাহ ফীল কুরআনে’ও যুক্ত আছে। (পৃ. ১১-১২)

৬. জামালুদ্দীন আব্দুর রাযযাক

الجمعية المغربية لعلم الفلك-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার জামালুদ্দীন আব্দুর রাযযাকের কিতাব التقويم القمري الإسلامي الموحد (একক ইসলামী চান্দ্র ক্যালেন্ডার) ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর রাবাত থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তিনি পরিষ্কার লিখেছেনÑ

لا سبيل إلى التوحيد إذا اعتمدنا رؤية الهلال، حتى مع إقرار الموقف الثالث.

لا سبيل إلى التوحيد إذا اشترطنا أن ساعة الدخول في الشهر، في بلد ما، تأتي بعد إثبات إمكان الرؤية، في مكان ما من العالم، حتى مع إقرار الحساب وإقرار الموقف الثالث. هذه النقطة من الأهمية بمكان<.

যদি হিলাল দেখাকেই ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে (রোযা ও ঈদের তারিখের ক্ষেত্রে) ঐক্য সম্ভব নয়। এমনকি যদি এক্ষেত্রে উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মতটিকেই অগ্রগণ্য ধরা হয় তবুও সম্ভব নয়; বরং কোনো শহরে মাস শুরু হওয়ার জন্য যদি এই শর্ত যুক্ত করা হয় যে, পুরো বিশ্বের কোথাও না কোথাও হিলাল দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতা সৃষ্টি হতে হবে। (অন্যথায় মাস শুরু করা যাবে না) তাহলেও ঐক্য সম্ভব নয়। এক্ষেত্রেও জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবকে ভিত্তি বা উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার মতকে গ্রহণ করা হলেও ঐক্য সম্ভব নয়।’ (আততাকবীমুল কামারিল ইসলামিয়্যিল মুওয়াহহিদ’, জামালুদ্দীন আব্দুর রাযযাক, পৃ. ৫)

এই সুস্পষ্ট বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েও তিনি একক ইসলামিক হিজরী ক্যালেন্ডারের নমুনা পেশ করেছেন। কিন্তু জানা কথা যে, শরীয়তের মানসূস আলাইহি এবং মুজমা আলাইহি বিধান হিলাল দেখার বিধান বাদ দিয়ে এটা গ্রহণ করবে তার বক্তব্য উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল, স্বয়ং বড় বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাই শরীয়ত নির্ধারিত ভিত্তি (হিলাল দেখা) বহাল রেখে এবং উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয় মত গ্রহণ করেও বিশ্বব্যাপী ঐক্য অসম্ভব বলেছেন।

 

৭. ডক্টর মুহাম্মাদ শওকত ঊদাহ

International Astronomical Center ICOP -এর প্রধান, জর্দান আলজামইয়্যাতুল ফালাকিয়্যার হিলাল পর্যবেক্ষণ কমিটির প্রধান, ও ‘আলইত্তিহাদুল আরাবী লিউলূমিল ফিযায়ি ওয়াল ফালাক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ডক্টর মুহাম্মাদ শওকত ঊদাহ প্রথমে পুরো পৃথিবীকে দুই ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগের জন্য আলাদা আলাদা লুনার ক্যালেন্ডার তৈরী করেছেন। এটা ২০০১ সনের কথা। পরে তিনি পুরো পৃথিবীকে তিন ভাগে ভাগ করে একেক অংশের জন্য আলাদা আলাদা ক্যালেন্ডার তৈরী করেন। পরবর্তীতে তিনি আরো চিন্তা গবেষণার পর চূড়ান্তভাবে আরেকটি লুনার ক্যালেন্ডার তৈরী করেছেন। তাতে পুরো পৃথিবীকে দুই ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক অংশের জন্য একটি করে ক্যালেন্ডার তৈরী করেন। এক অংশে উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা। দ্বিতীয় অংশে অন্য সব মহাদেশ। তিনি পরিষ্কার লিখেছেন, হিলাল দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্যতার উপর ভিত্তি করে যদি লুনার ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করা হয়, তাহলে সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি লুনার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আমল করা কখনোই সম্ভব হবে না। বিশ্বকে অন্তত দুই ভাগে ভাগ করা জরুরি, তিনি দালীলিক আলোচনা করে তার সিদ্ধান্ত এই ভাষায় পেশ করেছেনÑ

>ومن هنا برزت الحاجة الضرورية لتقسيم العالم إلى قسمين على الأقل<. (تطبيقات تكنولوجيا المعلومات لإعداد تقويم هجري عالمي، دكتور محمد شوكت عودة، ص ৭-৮)

উভয় ক্যালেন্ডারে কোনো মাসে তারিখ অভিন্ন আবার কোনো মাসে ভিন্ন। যাই হোক, শওকত ঊদাহ এই ক্যালেন্ডার কোনো মাসআলা হিসেবে পেশ করেননি। তিনি শুধু একটি প্রস্তাব উলামায়ে কেরামের কাছে রেখেছেন।

তার কাছে আমরা একই দিনে রোযা ও ঈদের প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম যে, কিছু লোক এই মতবাদের দাওয়াত দিচ্ছে, এ বিষয়ে আপনারা কী মনে করেন, তিনি উত্তরে লিখেছেনÑ

>مسألة هل يصوم الناس معا أو لا يصوموا معا فهي مسألة فقهية يجيب عليها الفقهاء وليس نحن الفلكيون، بالنسبة لنا فنحن مجرد حاسبون، نطوع حساباتنا لما يطلبه ويقره الفقهاء<.

‘সমস্ত মানুষ একই তারিখে রোযা রাখবে, না আলাদা আলাদা রাখবে এটা তো ফিকহী মাসআলা। এর জওয়াব তো উলামায়ে কেরাম দেবেন। আমরা তো হিসাব জানি, ব্যস, ফকীহগণ যেভাবে বলবেন, আমরা সেভাবেই হিসাবের খেদমত পেশ করে দেব।’ এটা তিনি আমাদেরকে ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৪ ঈ.-এর চিঠিতে লেখেন।

১৩ই মে ২০১৩ ঈ.-এর পত্রে তিনি এটাও লিখেছেনÑ

>من الناحية العملية والعلمية لا يمكن توحيد جميع البلاد الإسلامية بناء على رؤية الهلال، فلا يمكن الطلب من سكان أندونسيا وماليزيا والدول الشرقية الانتظار لمعرفة نتيجة تحري الهلال في موريتانيا، ففي هذه الحالة ستشرق الشمس في أندونسيا والناس لا تعرف بعد هل هذا اليوم هو عيد أم لا مثلاً!

فغاية ما يمكن فعله هو توحيد الدول الإسلامية بناء على تقويم هجري مبني على الحسابات الفلكية، أما التوحيد المبني على الرؤية الفعلية فهذا وهم، ولا يمكن تحقيقه<.

‘বাস্তবতার আলোকে এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনোভাবেই হিলাল দেখার ভিত্তিতে মুসলিম বিশ্বব্যাপী তারিখ এক করা সম্ভব নয়। এটা কীভাবে হতে পারে যে, আমরা ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও অন্যান্য প্রাচ্যের দেশগুলোর উপর বিধান চাপিয়ে দেব যে, তারা যেন মৌরতানিয়ার চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করে। এমন করতে গেলে তো ইন্দোনেশিয়ায় সূর্যোদয় হয়ে যাবে তখনও তারা জানতে পারবে না যে, আজ ঈদ হবে না, রোযাই রাখতে হবে।

হাঁ, সর্বোচ্চ যা হতে পারে তা হল, জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের ভিত্তিতে প্রণীত একটি হিজরী ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে কেবল মুসলিম বিশ্বে ঐক্য সৃষ্টি করা যেতে পারে। কিন্তু হিলাল দেখার ভিত্তিতে ঐক্য বাস্তবে অসম্ভব। এটা নিছক কল্পনা। একে বাস্তবের রূপ দেওয়া সম্ভব নয়।’

তো শরীয়ত যখন হিলাল দেখাকেই ভিত্তি বানিয়েছে, আর পৃথিবীর প্রাকৃতিক অবস্থাই এরকম যে, হিলাল দেখার ভিত্তিতে অন্তত ইসলামী বিশ্বেও একই দিনে রোযা ও ঈদ সম্ভব নয়। হাঁ, জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবকে ভিত্তি বানালে শুধু বর্তমান মুসলিম বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করার কথা ভাবা যায়। কিন্তু সমগ্র বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদ করা কখনো সম্ভব নয়। তাহলে কোনো মুসলমান এমন আছে যে, শরয়ী ভিত্তি বাদ দিয়ে একই তারিখে রোযা ও ঈদ করতে যাবে? আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়ত অনুসরণ উদ্দেশ্য নাকি দিলের খাহেশ পুরা করা?

ডক্টর মুহাম্মদ শওকত ঊদাহ এই বিষয়টি তার প্রবন্ধ ‘আলহিলাল বাইনাল হিসাবাতিল ফালাকিয়্যাতি ওয়ার রুইয়াতি’তেও লিখেছেন। তিনি বলেছেন কোনো স্থানের হিলাল দেখা গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্য ধর্তব্য হবে কি না এর ফায়সালা উলামায়ে কেরাম করবেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ নয়।

তিনি আরো লিখেন, হিজরী মাসের সূচনা কীভাবে হবে এটা শরীয়তের মাসআলা। এর ফায়সালা করবেন ফকীহগণ। জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ নয়। আর জানা কথা যে, এই বিষয়ে ফকীহগণের ইজমা আছে যে, এই বিষয়ে চাঁদ দেখাই ভিত্তি। অন্য কিছু নয়। দেখুন, তার প্রবন্ধ ‘আলহিলাল বাইনাল হিসাবাতিল ফালাকিয়্যাতি ওয়ার রুইয়াতি’, পৃ. ৭, ১১ ও ১৩

মুহাম্মদ শওকত ঊদাহ একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, কোনো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার নন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী, তাই তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন যে, কোন্ মাসআলা শরীয়তের সাথে সম্পৃক্ত আর কোনটা জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত। একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর এই বাস্তবতার বিষয়ে সুস্পষ্ট জবানবন্দীর পর আপনি ঐ ভাইদের কথার হাকীকত বুঝতে পারবেন, যারা বলে বলে ক্লান্ত হয়ে যান যে, আলিমরা জ্যোতির্বিজ্ঞান জানে না। তাই তারা লুনার ক্যালেন্ডারের বিরোধিতা করেন। এই জন্যই তারা একই দিনে বিশ্বব্যাপী রোযা ও ঈদ করার বিপক্ষে। নাউযুবিল্লাহিল আযীম।

এ সকল ভাইয়ের খেদমতে আমরা বর্তমান সময়ের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. ইলিয়াসের একটি কথা পেশ করতে পারি যা তিনি Washington Islamic centre কর্তৃক প্রকাশিত লিফলেটের উপরে মন্তব্য করে বলেছেন। লিফলেটের বক্তব্য ছিলÑ

“…. Many good Muslim leaders call for the unification of Muslim dates on the basis of astronomical findings, especially now that science has advanced so much as to put man on the face of the moon. ”

এর উপর মন্তব্য করে ড. ইলিয়াস বলেন,

“… Statements of this nature are common in private discussions that take place every year especially at the time of Ramadan. also the mass media, especially newspapers, are full of such comments, mostly from those lacking any appropriate background in astronomy and /or in the Islamic aspects  concerned….” (Astronomy of Islamic Calendar, by: Mohammad Ilyas, page- 60, Published by: A.S. NOORDEEN, Kuala Lumpur, Malaysia, First Published in 1997)

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ বাস্তবতা উপলব্ধি করার তাওফিক দান করুন এবং সকল প্রকার প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত রাখুনÑআমীন।

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

 


[1] জানি না এ সীমানা নির্ধারণের সূত্র কী? অমুসলিম দেশগুলো তো আল্লাহর জমীনেরই অংশ। এগুলোর উপর তাদের দখলদারিত্ব পুরোটাই জোরপূবর্ক। এগুলোকে কেন বাদ দেওয়া হচ্ছে? তাছাড়া মরক্কোকে কেন মুসলিমদেশগুলোর শেষ সীমানা ধরা হল মৌরতানিয়াও তো মুসলিম দেশ। (আবদুল মালেক)

[2] হানাফী মাযহাবে রমযানের রোযার জন্য সুবহে সাদিকের আগেই নিয়ত করে নেওয়া মুস্তাহাব। আর অন্যান্য মাযহাবে তো এটা রোযা সহীহ হওয়ার জন্য শর্ত। সাহরী করা সুন্নত। রমযানের তারাবী প্রথম রাত্রেও সুন্নাতে মুআক্কাদা। অথচ একই দিনে রোযার এই উদ্ভাবিত পদ্ধতির কারণে এসব আমল হ-য-ব-র-ল হয়ে যায়।

[3] ৩. ১৫ই জ্বিলহজ্ব ১৩৬৫ হি. মোতাবেক ১০ নভেম্বর ১৯৪৬ খৃ., ‘আলইলম’ পত্রিকার ৫২তম সংখ্যায় এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়-هل يمكن توحيد الأعياد الدينية في الأقطار الإسلامية (মুসলিম বিশ্বে দ্বীনী পর্বসমূহের তারিখের ক্ষেত্রে ঐক্য সৃষ্টি করা সম্ভব?)। তখন শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব ইবনে আব্দুর রাযযাক (১৯০৬-২০১১ঈ.) যিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং দ্বীনী ইলম, উভয় শাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের অধিকারী। তিনি তার কিতাব العذب الزلال في مباحث رؤية الهلال (খ. ১, পৃ. ১৮৯-২০৭)-এ উক্ত প্রবন্ধের বিস্তারিত খ-ন লিখেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, যুগ যুগ ধরে অনুসৃত কর্মপন্থাই সঠিক। এ থেকে সরে আসার কোনো অর্থই হয় না।

আমাদের জানা নেই, ১৯৪৬ -এর আগেও  কেউ এই ধরনের দাবি করেছেন কি না, কিন্তু আফসোস হল,  সময় যতই যাচ্ছে আবেগ-প্রবণ লোকদের বাড়াবাড়ি বেড়ে চলেছে। প্রথমে বলা হয়েছিল, শুধু মুসলিম বিশ্বে একই তারিখে রোযা ও ঈদ কর। এখন বলা হচ্ছে, সমগ্র বিশ্বেই একই তারিখে কর! আসলে এটাও অসম্ভব ওটাও অসম্ভব!

[4] বিশ্বব্যাপী একই দিনে রোযা ও ঈদ করার থিওরিকে এই হাদীসের উদ্দিষ্ট অর্থ বলে সাব্যস্ত করা হাদীসের সুস্পষ্ট বিকৃতি। উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়ার বিষয়ে এই হাদীস দিয়ে দলীল পেশ করা  যেমন কয়েকজন ফকীহ করেছেন- সেটা একটা সম্ভাবনাপূর্ণ বিষয়। হাদীসের পূর্বাপরের সাথে তা পুরোপুরি মিলে না। এটা হাদীসের স্বাভাবিক মর্মের বাইরের একটি বিষয়। এটাকে হাদীসের সরাসরি উদ্দিষ্ট মর্ম সাব্যস্ত করা আপত্তিজনক। সৌদিআরবের সাবেক সর্বোচ্চ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব শায়েখ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীমও এই হাদীস থেকে উক্ত বিষয়ে দলীল প্রদানের উত্তর দিয়েছেন। দেখুন, ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িলি সামাহাতিশ শায়েখ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম, খ. ৪, পৃ. ১৫৫, ফতোয়া : ১০৯৫।

[5] কুরাইব রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বর্ণিত হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ। মুহাদ্দিসগণ একে সহীহ বলেছেন এবং এর মাধ্যমে দলীল পেশ করেছেন এবং বড় বড় ফকীহগণও এই হাদীস দিয়ে দলীল দিয়েছেন। এর উপর মাসআলার ভিত্তি রেখেছেন।

লেখক ======
আল্লামা মুফতী মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক দা.বা.
শিক্ষাসচিব এবং উলুমুল হাদীস অনুষদের প্রধান
উচ্চতর ইসলামি শিক্ষা ও দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া

নবীকে হাজির নাজির বিশ্বাস করা কী কোন মুসলিমের আকীদা হতে পারে ?

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী  হাজির নাজির মানে কি ?

হাজির ও নাজির উভয় শব্দই আরবী। হাজির অর্থ হল উপস্থিত। আর নাজির অর্থ হল দ্রষ্টা। তথা যিনি দেখেন।

আল্লাহ তাআলা কি হাজির নাজির না রাসূল সাঃ?

রেজাখানী মতাদর্শী বেদআতি গ্র“পের আক্বীদা হল আল্লাহ তাআলা হাজির নন।

পাকিস্তানের রেজাখানী বেরেলবী গ্রুপের আলেম আহমাদ ইয়ারখান গুজরাটী তার রচিত জাআল হক্ব গ্রন্থে লিখেন-“প্রতি স্থানে হাজির হওয়া এটা আল্লাহ তাআলার সিফাত কখনোই নয়। আল্লাহ তাআলা স্থান থেকে পবিত্র। {জাআল হক্ব ওয়া যাহাক্বাল বাতিল-১৬১}

আহমাদ ইয়ারখান সাহেব এর পর লিখেন-“আল্লাহ তাআলা প্রতিটি স্থানে বিদ্যমান মানাটা বদ্বিনী। প্রতি স্থানে বিদ্যমান হওয়াটা এটা রাসূল সাঃ এরই শান। {জাআল হাক্ব ওয়াযহাক্বাল বাতিল-১৬২}

সহীহ আক্বিদা

আল্লাহ তাআলা সর্বত্র বিরাজমান তথা হাজির। কিন্তু কিভাবে হাজির তা আমাদের জানা নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সর্বত্র হাজির থাকার উপর কুরআনে কারীমে অসংখ্য আয়াত রয়েছে। যেমন-

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ ۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ ۖ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ [٢:١٨٦]

আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে। {সূরা বাকারা-১৮৬}

وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ ۖ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ [٥٠:١٦

আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী। {সূরা কাফ-১৬}

فَلَوْلا إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ (83) وَأَنْتُمْ حِينَئِذٍ تَنْظُرُونَ (84) وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ وَلَكِنْ لا تُبْصِرُونَ (85

অতঃপর যখন কারও প্রাণ কন্ঠাগত হয়। এবং তোমরা তাকিয়ে থাক, তখন আমি তোমাদের অপেক্ষা তার অধিক নিকটে থাকি; কিন্তু তোমরা দেখ না। (সূরা ওয়াকিয়া-৮৭, ৮৪, ৮৫)

وَلِلَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ ۚ فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ وَاسِعٌ عَلِيمٌ [٢:١١٥]

পূর্ব ও পশ্চিম আল্লারই। অতএব, তোমরা যেদিকেই মুখ ফেরাও, সেদিকেই আল্লাহ বিরাজমান। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ। (সূরা বাক্বারা-১১৫}

قوله تعالى  { وَهُوَ مَعَكُمْ  أَيْنَمَا كُنتُمْ } [ الحديد : 4 

তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথে আছেন {সূরা হাদীদ-৪}

أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۖ مَا يَكُونُ مِنْ نَجْوَىٰ ثَلَاثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ وَلَا خَمْسَةٍ إِلَّا هُوَ سَادِسُهُمْ وَلَا أَدْنَىٰ مِنْ ذَٰلِكَ وَلَا أَكْثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمْ أَيْنَ مَا كَانُوا ۖ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا عَمِلُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۚ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ [٥٨:٧]

আপনি কি ভেবে দেখেননি যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, আল্লাহ তা জানেন। তিন ব্যক্তির এমন কোন পরামর্শ হয় না যাতে তিনি চতুর্থ না থাকেন এবং পাঁচ জনেরও হয় না, যাতে তিনি ষষ্ঠ না থাকেন তারা এতদপেক্ষা কম হোক বা বেশী হোক তারা যেখানেই থাকুক না কেন তিনি তাদের সাথে আছেন, তারা যা করে, তিনি কেয়ামতের দিন তা তাদেরকে জানিয়ে দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত। (সূরা মুজাদালা-৭)

উদাহরণত কিছু আয়াত উপস্থাপন করা হল। এরকম আরো অনেক আয়াতে সরাসরি প্রমাণ করে যে,আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বত্র বিরাজমান। কিন্তু বিরাজমানতার অবস্থা কি? এটা আমাদের জানা নেই। এটা আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন।

সুতরাং বুঝা গেল সর্বত্র বিরাজমানতা তথা হাজির থাকাটা এটা আল্লাহর সিফাত। এ সিফাত অন্যের জন্য প্রতিষ্ঠিত করা সুষ্পষ্ট শিরকী আক্বিদা।

নবী হাজির নাজির হওয়া মুসলমানদের নয় খৃষ্টানদের আক্বিদা

খৃষ্টানদের আক্বিদা হল হযরত ঈসা আঃ সর্বত্র বিরাজমান, তথা হাজির নাজির। যেমনটি লিখেছেন খৃষ্টান পাদ্রী ইমাদুদ্দীন তার রচিত “তাফতীশুল আওলীয়ায়। তিনি লিখেন- ঈসা আঃ প্রত্যেক স্থানে হাজির ও নাজির। {তাফতীশুল আওলিয়া-১০৮}

খৃষ্টানদের আক্বিদা হল যে মজলিস ঈসা আঃ এর নামে করা হয়, সেখানে ঈসা আঃ উপস্থিত হন।

ঈসা আঃ বলেন-“কেননা যেখানে দুই অথবা তিনজন আমার নামে একত্র হয়, সেখানে আমি তাদের মাঝে উপস্থিত হই”। {ইঞ্জিল, মথি, অধ্যায় ১৮, পরিচ্ছেদ-২০}

কোন সৃষ্টিকে সর্বত্র হাজির নাজির বিশ্বাস করা এটা খৃষ্টানদের আক্বিদা মুসলমানদের আক্বিদা নয়।

শরীয়তের দৃষ্টিতে সর্বত্র হাজির নাজির হওয়া এবং সর্বত্র বিদ্যমান হওয়া এটা শুধুমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথেই খাস। সৃষ্টিজীবের মাঝে এ সিফাত কখনোই নেই।

একটি উদ্ভট যুক্তি ও তার খন্ডন

মাওলানা আহমাদ ইয়ারখান রেজাখানী বেরেলবী বলেন-“হাজীর হওয়া আল্লাহ তাআলার সিফাত নয়। কারণ হাজির অর্থ হল যিনি আগে ছিলেন না, এখন এসেছেন, আর এমন বিশ্বাস আল্লাহ তাআলা ক্ষেত্রে বলা কিছুতেই জায়েজ নয়, আর নাজির হল দ্রষ্টা। আল্লাহ তাআলারতো কোন চোখই নাই, তাই তিনি আমাদের মত দেখবেন কিভাবে? তাছাড়া হাজির নাজির যদি আল্লাহর সিফাতই হইতো, তাহলে আল্লাহর নিরান্নবই নামের মাঝে এ সিফাতের কথা থাকতো। অথচ তা নেই। সুতরাং বুঝা গেল যে, এটা আল্লাহ তাআলার সিফাত নয়। বরং এটি মাখলুকের সিফাত। তাই এ সিফাতের অধিকারী হলেন রাসূল সাঃ ও বুজুর্গানে দ্বীন। {দ্রষ্টব্য-জাআল হক্ব ওয়া জাহাক্বাল বাতিল-১৫৩}

প্রথম জবাব

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ তাআলা কোন স্থানের মুখাপেক্ষি নন, সেই সাথে আল্লাহ তাআলার প্রসিদ্ধ নাম হল ৯৯টি।

কিন্তু কথা হল এ ৯৯ নাম ছাড়া আল্লাহ তাআলার কি আর কোন নাম নেই? একটু চোখ খুলে দেখুন-

১-

আল্লামা নববী রহঃ শরহে মুসলিমের ২ নং খন্ডের ৩২২ নং পৃষ্ঠায়, আল্লামা খাজেন রাহঃ তাফসীরে খাজেনের ২ নং খন্ডের ২৬৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেন যে, “সমস্ত ওলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, আল্লাহ তাআলা সকল নাম কেবল এ ৯৯টিই নয়, বরং এছাড়াও আছে।

২-

(একথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম নববী রহঃ লিখেন) ইমাম আবু বকর ইবনুল আরাবী রহঃ আল্লাহ তাআলা এক হাজার নাম একত্র করেছেন। এর পর তিনি স্পষ্টই লিখেছেন যে, وهذا قليلতথা “এটাও অনেক অল্প”।

৩-

ইমাম রাজী রহঃ লিখেন যে, ওলামায়ে কেরামের নিকট আল্লাহ তাআলার এক হাজার নাম প্রসিদ্ধ ও পরিচিত। যা কিতাবুল্লাহ ও হাদীসে পাওয়া যায়। {তাফসীরে কাবীর, মুকাদ্দামা-১/৩}

৪-

হাফেজ ইবনে কাসীর রহঃ বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তাআলার ৫ হাজার নাম আছে। যা কুরআনে কারীম, সহীহ হাদীস ও পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবে বলা হয়েছে। {তাফসীরে ইবনে কাসীর-১/১৯}

যখন সকল ওলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, আল্লাহর সিফাতী নাম শুধু এ নিরান্নব্বই নামে সীমাবদ্ধ নয়, সেখানে ৯৯ নামে হাজির নাজির সিফাতী নাম না থাকাতে তা বাতিল বলাটা কতটা আহমকীর পরিচয় একটু ভেবে দেখবেন কি?

দ্বিতীয় জবাব

যদি আপনাদের কথা দু’মিনিটের জন্য মেনেও নেই যে,আল্লাহর সিফাতী নাম এ ৯৯ নামে সীমাবদ্ধ। তাহলে আপনাদের কাছে প্রশ্ন যে, আল্লাহর নামসমূহকে কি সহজতার জন্য অন্য ভাষায় অনুবাদ করে বলা  জায়েজ আছে? যদি বলেন জায়েজ নেই। তাহলে প্রশ্ন হল যে, আল্লাহ এর অনুবাদ তাহলে খোদা বলা কিভাবে জায়েজ? এটাতো ৯৯ নামের অন্তর্ভূক্ত নয়। অথচ এ অনুবাদ বেরেলবী গ্র“প অহর্নিশি করে বেড়ায়।

যদি বলা হয় যে, আরবীতে ইয়া রব, ইয়া মালিক এর অনুবাদ ফার্সিতে করা হয় খোদা বলে। তাতে কোন সমস্যাতো নেই।

তাইতো আমরা বলি যে, এটা যেমন, তেমনি এখানে দেখে নিতে পারেন যে, ৯৯ নামের মাঝে কোন নামের অনুবাদ হাজির নাজির হয় কি না?

চোখ খুলে মেশকাত শরীফের ১ নং খন্ডের ১৯৯ নং পৃষ্ঠায় দেখুন ইবারতের নিচে শহীদ অর্থ লিখা হয়েছে হাজির। আর প্রসিদ্ধ ডিকশনারী “সাররাহ”এ লিখা হয়েছে যে, শহীদ মানে হাজির ও স্বাক্ষ্য।

এমনিভাবে “বাসীর”এর অর্থ লিখা হয়েছে যে, দ্রষ্টা,তথা নাজির। দেখুন-“সাররাহ”-১৬০।

এখন বলুন! আল্লাহ শহীদ ও বসীর নয় কি? আর শহীদের অনুবাদ হাজির, আর বাসীরের অনুবাদ নাজির জায়েজ আছে কি নেই?

এবার তাহলে বেরেলবী রেজাখানী গ্র“পের ব্যক্তিরা হাদীস ব্যাখ্যাতা ও অভিধানবীদদের বিরুদ্ধে এ্যাকশনে নামতে পারেন কেন তারা শহীদের অনুবাদ হাজির করলেন? কারণ হাজিরতো আপনাদের পরিভাষা অনুযায়ী কেবল ঐ ব্যক্তিই হতে পারে, যিনি প্রথমে ছিলেন না, তারপর এসে গেলেন।

সুতরাং বুঝা গেল যে, তাদের এ যুক্তিটি একটি অজ্ঞতাসূচক খোড়া যুক্তি।

তৃতীয় জবাব

রেজাখানী বেদআতিতের যুক্তি হল যে, নাজির তথা দ্রষ্টা হওয়ার জন্য শারিরিক চোখ থাকা আবশ্যক। আর আল্লাহ তাআলা যেহেতু শারিরিক চোখ থেকে মুক্ত, তাই আল্লাহ তাআলা নাজির নন।

এ সকল হযরাতদের কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ হল নিম্নোক্ত আয়াতের মানে কি? আমাদের আমাদের একটু কষ্ট করে বুঝিয়ে দিন। যেমন-

১-

কুরআনে কারীমে হযরত মুসা আঃ এর ঘটনা যাতে হযরত মুসা আঃ তার জাতিকে নিম্নোক্ত শব্দে নসিহত করেন-

قَالُوا أُوذِينَا مِنْ قَبْلِ أَنْ تَأْتِيَنَا وَمِنْ بَعْدِ مَا جِئْتَنَا ۚ قَالَ عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَنْ يُهْلِكَ عَدُوَّكُمْ وَيَسْتَخْلِفَكُمْ فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ [٧:١٢٩

তারা বলল, আমাদের কষ্ট ছিল তোমার আসার পূর্বে এবং তোমার আসার পরে। তিনি বললেন, তোমাদের পরওয়ারদেগার শীঘ্রই তোমাদের শক্রদের ধ্বংস করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দেশে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন। তারপর দেখবেন, তোমরা কেমন কাজ কর। {সূরা আরাফ-১২৯}

রেজাখানীদের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা যে, যদি দেখার জন্য শারিরিক চোখ লাগে, তাহলে আয়াতে فَيَنْظُرَতথা তিনি ”দেখবেন”কথাটার মানে কি? আমাদের মত শারিরিক চোখ নেই বলে আল্লাহ তাআলা কি দেখেন না? তিনি কি দ্রষ্টা নয়?

 

২-

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অন্যত্র ইরশাদ করেন-

ثُمَّ جَعَلْنَاكُمْ خَلَائِفَ فِي الْأَرْضِ مِنْ بَعْدِهِمْ لِنَنْظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ [١٠:١٤

 

অতঃপর আমি তোমাদেরকে যমীনে তাদের পর প্রতিনিধি বানিয়েছি যাতে দেখতে পারি তোমরা কি কর। {সূরা ইউনুস-১৪}

 

এ আয়াতেও নজর শব্দ বিদ্যমান। এর মানে কি একটু বলবেন কি?

 

৩-

عن أبي سعيد الخدري قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : إن الدنيا حلوة خضرة و إن الله مستخلفكم فيها فناظر كيف تعلمون فاتقوا الدنيا و اتقوا النساء

অনুবাদ- হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাঃ বলেন। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেনযে, নিশ্চয় দুনিয়া হল মিষ্টান্ন আর সবুজ শ্যামলিমা। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদের এতে খলীফা বানাবেন, তারপর দেখবেন তোমরা কি কাজ কর? তাই দুনিয়া থেকে দুরে থাক, আর মহিলা থেকে (চক্রান্ত থেকে) বেঁচে থাক। {শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-১০৩০১}

 

এ হাদীসে সুষ্পষ্ট নাজির শব্দ এসেছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শানে। এ নাজির মানে কি? একটু বলবেন কি?

 

৪-

হযরত ইয়াজ বিন হিমার রাঃ থেকে বর্ণিত। এক দীর্ঘ হাদীসের একাংশে রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-

وَإِنَّ اللَّهَ نَظَرَ إِلَى أَهْلِ الأَرْضِ فَمَقَتَهُمْ عَرَبَهُمْ وَعَجَمَهُمْ إِلاَّ بَقَايَا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ

অনুবাদ- নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা ভূমিবাসীদের দিকে নজর দিয়ে দেখে সকল আরব আজমের লোকদের উপর অসন্তুষ্ট হলেন। তবে আহলে কিতাবীদের মধ্য থেকে কতিপয় লোক আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টি থেকে বেঁেচ যায়। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ৭৩৮৬, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৭৪৮৪, মুসনাদে তায়ালিসী, হাদীস নং-১০৭৯, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস নং-২০০৮৮}

এ হাদীসে নজর দিয়ে দেখে মানে কি?

৫-

অন্য হাদীসে রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « إِنَّ اللَّهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ

অনুবাদ-হযরত আবু হুরায়রা রাঃ বর্ণনা করেন। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন যে, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদের বাহ্যিক সুরত দেখেন না, (তথা কে কালো, কে সুন্দর) এবং তোমাদের সম্পদ দেখেন না। বরং তিনি তোমাদের মন ও আমলের অবস্থা দেখেন। {সহীহ মুসলিম,হাদীস নং-৬৭০৮, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৩৯৪, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৭৮২৭}

এ দুটি হাদীসে স্পষ্ট নজর শব্দ এসেছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শানে। আগের বর্ণিত শুয়াবুল ঈমানের হাদীসেতো সরাসরি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে নাজির বলা হয়েছে।

সুতরাং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর “নাজির”হওয়াকে অস্বিকার করাতো সরাসরি কুরআন হাদীস অস্বিকার করা। রেজাখানী গ্র“প যদি একথার ইলান করে দেন যে, তারা কুরআন ও হাদীস মানেন না, শুধু রেজাখানী ধর্মগুরুর কথাই মানেন,তাহলেতো আর কোন কথাই নেই। কিন্তু কুরআন হাদীস মানেন বলে প্রচার করেও এসব আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য সাব্যস্ত করা নাজির আক্বিদা অস্বিকার করেন কেন?

দৃষ্টি আকর্ষণ

একটি কথা ষ্পষ্ট করে জেনে রাখা দরকার যে, আমরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদা হল, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হাজির, কিন্তু তাঁর আমাদের মত শরীর নেই। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার স্বীয় শান অনুযায়ী হাজির সর্বত্র। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নাজির,তথা সর্বদ্রষ্টা। কিভাবে সবকিছু দেখেন। সেটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই ভাল জানেন। এটাও তার শান অনুযায়ী প্রযোজ্য। এটার আর কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যাওয়াটা ঈমানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই এসব বিষয়ে যত বিতর্ক এড়িয়ে চলা যায়, ততই মঙ্গলজনক।

কুরআন হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতার চিত্র

উল্লেখিত কুরআন ও হাদীসের দলীল দ্বারা একথা স্পষ্ট যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হাজির ও নাজির। তবু রেজাখানী বেরেলবী বেদআতি আলেম মাওলানা সৈয়দ আহমাদ সাঈদ কাজেমী আমরূহী মুলতানী কী বলেন দেখুন-

“আল্লাহ তাআলার আসমায়ে হুসনার মাঝে হাজির নাজির কোন নাম নেই। আর কুরআন ও হাদীসে কোথাও হাজির নাজির শব্দ আল্লাহ তাআলার জন্য ব্যবহৃত হয়নি। সালাফে সালেহীনের কেউ আল্লাহর শানে এ শব্দ বলেন নি। কোন ব্যক্তি কিয়ামত পর্যন্ত একথা প্রমাণ করতে পারবে না যে, সাহাবায়ে কেরাম রাঃ অথবা তাবেয়ীগণ অথবা আইয়িম্মায়ে মুজতাহিদীনগণ আল্লাহর শানে হাজির নাজির শব্দ ব্যবহার করেছেন। {তাসকীনুল খাওয়াতীর-৩}

কাজেমী সাহেব স্বীয় দিলের উপর হাত রেখে (যদি দিল বলে কিছু থাকে) বলুন- উপরে বর্ণিত শুয়াবুল ঈমানে ১০৩০১ নং হাদীসে আল্লাহর শানে বলা ”নাজির”শব্দটি কি আপনার গোচরিভূত হয়নি? কি এটা হাদীস নয়।

আবু সাঈদ খুদরী রাঃ সাহাবী নয়, যিনি আল্লাহর শানে নাজির শব্দসহ হাদীস বর্ণনা করছেন?

আবু নাজরাহ রহঃ কি তাবেয়ী নয়, যিনি এ হাদীস বর্ণনা করেছেন?

তাহলে কাজেমী সাহেবের কাছে আমাদের প্রশ্ন হল-এরকম ভুল দাবি সাহাবী ও তাবেয়ী কি করে করলেন? না জেনে না বুঝে? (নাউজুবিল্লাহ)

কাজেমী সাহেবের আরো আগ্রাসী মন্তব্য

“এমনিভাবে মুতাআখখিরীনর জামানায় যখন কিছু লোক আল্লাহ তাআলাকে হাজির নাজির বলতে শুরু করা হল, তখনকার ওলামারা এটাকে বাঁধা দেন। এমন কি কিছু ওলামাগণতো এভাবে বলাকে কুফরী মন্তব্য করেছেন”। {তাসকীনুল খাওয়াতের}

কাজেমী সাহেব অতি চাতুরতার সাথে কোন জমানায় এমন ঘটনা ঘটেছিল, আর কোন আলেমরা এমন ফাতওয়া দিয়েছিলেন, কিংবা কোন কিতাবে এমন উদ্ভট কথা আছে তার কোন কিছুই উল্লেখ না করে একটি হাস্যকর মন্তব্য করে দিলেন। আসলে মনে হয় তিনি এমনটি স্বপ্নে পেয়েছিলেন!

যাইহোক! কথা হচ্ছে, রেজাখানী বেরেলবী বেদআতি গ্র“পকে যদি বলা হয় যে, আপনারা রাসূল সাঃ কে কেন হাজির নাজির বিশ্বাস করেন, অথচ আল্লাহ হলেন হাজির নাজির। তখন তাদের জবাব হল যেহেতু ৯৯ নামের মাঝে হাজির নাজির শব্দ নেই, আর দেখার জন্য শারিরিক চোখ লাগে আর আল্লাহ এসব থেকে পবিত্র তাই, আল্লাহ তাআলা দেখেন না।

পাঠকদের কাছেই বিচার রইল এমন যুক্তি ও উদ্ভটতার।

চতুর্থ জবাব

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

فَلَنَقُصَّنَّ عَلَيْهِمْ بِعِلْمٍ ۖ وَمَا كُنَّا غَائِبِينَ [٧:٧

অনুবাদ-অতঃপর স্বজ্ঞানে তাদের কাছে অবস্থা বর্ণনা করব। বস্তুত আমি অনুপস্থিত তো ছিলাম না। {সূরা আরাফ-৭}

 

এক হাদীসে এসেছে যে, সাহাবাগণ একবার জোরে জোরে জিকির করতেছিলেন। তখর রাসূল সাঃ তাদের জোরে জোরে জিকির করতে নিষেধ করে বলেন-

فإنكم لا تدعون أصم ولا غائبا إنه معكم إنه سميع قريب

অনুবাদ-নিশ্চয় তোমরা বধীর বা গায়েব তথা অনুপস্থিত কাউকে ডাকছো না। নিশ্চয় তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। নিশ্চয় তিনি শুনেন, তিনি তোমাদের নিকটে। (তারপরও জোরে আওয়াজে কেন জিকির করছো?) {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-২৮৩০, ৩৯৬৮, ৬০২১, ৬০৪৬, ৬২৩৬, ৬৯৫২}

আরেকটি যুক্তি ও তার খন্ডন

নবীজী সাঃ কে গায়ের জোরে হাজির নাজির বানানোর পায়তারাকারীদের আরেকটি হাস্যকর যুক্তি হল- হযরত আজরাঈল আঃ যদি একসাথে অনেক মানুষের জানকবচ করতে পারেন, তাহলে রাসূল সাঃ কেন এক সাথে সর্বত্র উপস্থিত হতে পারবেন না?

উত্তর-১

হযরত আজরাঈল আঃ কি একা একা জান কবচ করেন? না তার সাথে আরো ফেরেস্তা থাকেন? নিশ্চয় আরো অনেক ফেরেস্তা থাকেন। তাহলে একা রাসূল সাঃ সর্বত্র হাজির হওয়ার উদাহরণ দিতে গিয়ে হাজার হাজার সাথি বেষ্টিত আজরাঈল আঃ এর উদাহরণ দেয়াটা কি যৌক্তিক হয়েছে?

উত্তর-২

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকে যে কাজ করার দায়িত্ব দেন তাকে সেই কাজ করার ক্ষমতাও দিয়ে দেন। আজরাঈল আঃ কে আল্লাহ তাআলা সকল মানুষের জান কবচের দায়িত্ব দিয়েছেন, তাই কিভাবে করতে হবে, একসাথে অনেকের জান কবচের ক্ষমতাও আল্লাহ পাক তাকে দিয়েছেন। আর রাসূল সাঃ কে যেহেতু আল্লাহ তাআলা সারা পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে উম্মতীদের অবস্থা দেখার দায়িত্ব দেন নাই। তাই তাকে এ ক্ষমতাও দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই।

উত্তর-৩

আজরাঈল আঃ একই সাথে একাধিক স্থানে রুহ কবচ করতে পারেন। তাই কি তিনিও হাজির নাজির? যদি বলা হয় যে, হ্যাঁ এ অর্থে আজরাঈল আঃ ও হাজির নাজির। তাহলে হাজির নাজির হওয়াটা রাসূল সাঃ এর বৈশিষ্ট রইল কোথায়? অন্যের মাঝে যা আছে তা থাকার নামতো বৈশিষ্ট নয়, বৈশিষ্ট বলাইতো হয় ঐ বস্তুকে যাতে ঐ ব্যক্তি খাস। যেটি অন্যের মাঝে নেই।

যদি বলা হয় যে, না আজরাঈল আঃ হাজির নাজির নয়, তাহলে আজরাঈল আঃ এর উদাহরণ দিয়ে রাসূল সাঃ এর হাজির নাজির প্রমাণিত হয় কি করে?

রাসূল সাঃ কে হাজির নাজির বিশ্বাস করা রাসূল সাঃ এর সম্মানকে খাটো করা

আমরা জানি যে, কোন সম্মানী ব্যক্তির দরবারে গিয়ে তাকে হাদিয়া দেয়াটা তাকে সম্মান জানানো। কিংবা কোন সম্মানিত প্রতিনিধির মাধ্যমে হাদিয়া পাঠানো সম্মানজনক।

কিন্তু হাদিয়া দেয়ার জন্য খবর দিয়ে ডেকে আনা যত্রতত্র এটা উক্ত সম্মানী ব্যক্তির জন্য সম্মানজনক নয়।

রাসূল সাঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পর তামাম সৃষ্টিজীবের মাঝে শ্রেষ্ট। সর্বোত্তম। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তার মত উত্তম চরিত্রের অধিকারী কেউ ছিল না। কখনোও হবে না। তার মত এমন সম্মানিত ব্যক্তিত্বের কাছে হাদিয়া পাঠানোটা সম্মানের। তাকে জান্নাতের বাগান মদীনা মুনাওয়ারার রওজা মুবারক থেকে তুলে এনে মদখোর, দাড়িহীন, টুপিহীন, সুন্নাতহীন মানুষের হালুয়া-রুটির মিলাদ মাহফিলে উপস্থিত করা হাজির নাজির বিশ্বাস করে কতটা সম্মানজনক বিবেকবান পাঠকরা একটু ভেবে দেখবেন।

অথচ রাসূল সাঃ একাধিক হাদীসে ইরশাদ করেছেন যে, তার উপর কেউ দরূদ পড়লে তা তার কাছে ফেরেস্তার মাঝে পৌঁছানো হয়। একদল ফেরেস্তা সর্বদা পৃথিবীব্যাপী ঘুরে দরূদপাঠকারীর দরূদ রাসূল সাঃ এর দরবারে পৌঁছানোর জন্য।

যদি রাসূল সাঃ হাজির নাজির হতেন, তাহলে ফেরেস্তা কেন দরূদ পৌঁছে দিতে নিযুক্ত থাকবে, রাসূল সাঃ নিজেইতো নাকি উক্ত মজলিসে উপস্থিত হয়ে যান!

দেখুন রাসূল সাঃ হাদীসে কী ইরশাদ করেছেন

عن أبي هريرة قال في رواية الحنفي قال : عن النبي صلى الله عليه و سلم قال : من صلى علي عند قبري سمعته و من صلى علي نائيا أبلغته

হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-“যে ব্যক্তি আমার কবরের পাশে গিয়ে দরূদ পাঠ করে তা আমি নিজেই শুনব। আর যে ব্যক্তি দূর থেকে আমার উপর দরূদ পাঠ করে তা আমার কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। {সুনানে বায়হাকী, হাদিস নং-১৫৮৩, কানযুল উম্মাল ফি সুনানিল ওকওয়াল ওয়াল আফআল, হাদিস নং-১৫৮৩}

আরেক হাদীসে রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-

عن عبد الله بن مسعود قال قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : ان لله ملائكة سياحين في الأرض يبلغوني عن أمتي السلام

অনুবাদ-হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাঃ থেকে বর্র্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন- নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার নিয়োজিত কতিপয় ফেরেস্তা জমীনে ঘুরে বেড়ায়, তারা আমার কাছে উম্মতের পক্ষ থেকে সালাম পৌঁছায়। {সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৯১৪, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-২৭৭৪, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৪৩২০}

হাজির নাজিরের বিশ্বাস রাসূল সাঃ এর হিজরত ও মিরাজ অস্বিকার

হিজরত মানে হল ছেড়ে দেয়া। আর রাসূল সাঃ এর হিজরত মানে হল, মক্কা ছেড়ে মদীনায় গমণ করা। এখন প্রশ্ন হল, যদি রাসূল সাঃ হাজির নাজিন হন সর্বত্র। তাহলে রাসূল সাঃ মক্কা ছেড়ে মদীনায় গিয়েছিলেন? না মদীনায় ছিলেন? হাজির নাজির হলেতো মক্কা থেকে মদীনায় যাওয়া প্রমাণিত হয় না। বরং তিনিতো মদীনায় হাজিরই ছিলেন। তাহলে হিজরত হল কি করে?

মিরাজ হল বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে সপ্ত আকাশ ডিঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আরসে গিয়ে পৌছা। এখন প্রশ্ন হল, রাসূল সাঃ কি আল্লাহর আরসে গিয়েছিলেন? না ওখানে ছিলেন নাউজুবিল্লাহ। যদি হাজির নাজির হয়ে থাকেন, তাহলেতো যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তিনিতো সেখানেই হাজিরই ছিলেন। তাহলে মিরাজ আর রইল কোথায়?

তাই রাসূল সাঃ কে হাজির নাজির বলাটা বাহ্যিকভাবে সম্মানজনক মনে করা হলেও আসলে চূড়ান্ত পর্যায়ের অপমানজনক বক্তব্য। এর দ্বারা রাসূল সাঃ এর হিজরত এবং মিরাজকে অস্বিকার করা হচ্ছে। আর হিজরত আর মিরাজ অস্বিকারকারীর নাম আশেকে রাসূল হতে পারে না, হবে আশেকে শয়তান।

শেষ কথা

রাসূল সাঃ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ মাখলুক। সবচে’সম্মানী আল্লাহর পর। তার মত কেউ নেই। হবেও না কোনদিন। কিন্তু তাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সমকক্ষও সাব্যস্ত করা যেমন যাবে না। তেমনি তার যথোপযুক্ত সম্মান ও বৈশিষ্ট অস্বিকার করাও যাবে না। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সঠিক আক্বিদা।

তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের খাস বৈশিষ্ট হাজির নাজির হওয়াটি রাসূল সাঃ এর জন্য সাব্যস্ত করাটা একটি শিরকী আক্বিদা ছাড়া কিছু নয়।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকল বাতিল আক্বিদা, শিরক-বেদআত থেকে বেঁচে সঠিক পদ্ধতিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রিয়ভাজন হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।

লেখক– লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

কাবলাল জুমআ চার রাকাতঃ একটি দালিলিক আলোচনা

আল্লামা মুফতী মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক দা.বা.  একজন সম্মানিত আলিমের একটি কথা, যিনি রিয়াদ থেকে পি.এইচ.ডি করেছেন এবং এখন এদেশের একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে খেদমতে নিয়োজিত আছেন, আমার খুব ভালো লেগেছে। তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের চলতে হবে সুন্নাহ এবং উম্মাহকে একসাথে নিয়ে।’’ এরপর তিনি একথার ব্যাখ্যা করেন, ‘‘সুন্নাহ হচ্ছে সূত্র ও দলীল এবং উম্মাহর জীবন-ব্যবস্থা। আর উম্মাহকে সাথে নিয়ে চলার অর্থ, মুসলিমজাহানের কোনো অঞ্চলে কোনো কাজ প্রচলিত থাকলে এবং সুন্নাহয় তার কোনো না কোনো দলীল পাওয়া গেলে সে কাজের বিরোধিতা করে উম্মাহকে পেরেশান করা উচিত নয়।’’

‘‘সুন্নাহ এবং উম্মাহ উভয়কে নিয়ে চলা এবং জুমহূর উম্মাহর সঙ্গে থাকার’’ অর্থ উপরোক্ত ব্যাখ্যার চেয়েও অনেক বিস্তৃত ও গভীর। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে যেটুকু তিনি বলেছেন তা-ও স্বস্থানে অতি গুরুত্বপূর্ণ। উম্মাহর মাঝে ব্যাপকভাবে অথবা কোনো অঞ্চলে যে আমল জারি আছে, যদি তার কোনো শরয়ী সনদ থাকে, তখন শুধু একারণে তার বিরোধিতা করা যে, তা অমুক মাযহাবের বিরোধী বা অমুক আলিমের মতে তা দলীলবিহীন, এরপর এর বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা করে সাধারণ মানুষের মাঝে অস্থিরতা ছড়ানো শরীয়তের রীতি ও রুচির সম্পূর্ণ বিরোধী। আল্লাহর নবীর সুন্নাহ এবং সালাফের নীতি-আদর্শের সাথে এর কোনো মিল নেই।

হায়! দ্বীন ও ধর্ম যখন নানামুখি বিপদের সম্মুখীন তখন গোদের উপর বিষফোড়ার ন্যায় এই আপদ দেখা দিয়েছে যে, উম্মাহর মাঝে প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত অনেক বিষয় সম্পর্কে (যা শুধু-এই নয় যে, কোনো রকম তার প্রমাণ-সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়; বরং যার প্রমাণই তুলনামূলক বেশি শক্তিশালী এবং যা সরাসরি সুন্নাহর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত) প্রচার করা হচ্ছে যে, ‘তা বিদআত, ভিত্তিহীন ও সুন্নাহ-বিরোধী!’

মুসলমানের বর্তমান মুমূর্ষু অবস্থাতেও যাদের মনে করুণা জাগে না; বরং ‘জ্ঞান-গবেষণার’ নামে এবং ‘হাদীস-অনুসরণের’ শিরোনামে তাদেরকে আরো বেশি অস্থিরতা ও বিক্ষিপ্ততার মাঝে নিক্ষেপ করে চলেছেন তাদের সমীপে বিনীত নিবেদন, ‘অনুগ্রহ করে আপনার অধ্যয়ন-সীমা কিছুটা প্রশস্ত করুন এবং খানিকটা গভীর করুন, আর ‘ফুরু’-এর সাথে ‘উসূল’ পাঠেও খানিকটা অভ্যস্ত হোন। তাহলে প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত বিষয়াদিকে ভিত্তিহীন ও প্রমাণহীন বলার পাপ থেকে আত্মরক্ষা সহজ হবে।

দেখুন, এ নিছক একটি পাপ নয়, অনেক পাপের সমষ্টি, যার অন্যতম হচ্ছে, উম্মাহকে তার ঐসব আলিম মনীষী সম্পর্কে আস্থাহীন করা, যাঁদের নিকট থেকে উম্মাহ দ্বীন ও ঈমান এবং সালাত ও সিয়াম শিখেছে। এ যে কোনো পুণ্যকর্ম নয় তা তো বলাই বাহুল্য। এ ঠিক এমনই, যেমন কেউ রিয়াদে গিয়ে শায়খ ইবনে বায রাহ. ও শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সালিহ উছাইমীন রাহ.-এর ফতোয়াসমূহের বিরুদ্ধে হাদীস ও আছার প্রচার করতে থাকল এবং ঐ অঞ্চলের সাধারণ মুসলমানদের অস্থির ও উদভ্রান্ত করে তুলল।

এ তো জানা কথা যে, যেসব বিষয়ে হাদীস-সুন্নাহ-ভিত্তিক একাধিক ইজতিহাদী মত আছে তাতে এই কাজ করা মোটেই কঠিন নয়। কারণ এসব ক্ষেত্রে দুদিকেই হাদীস ও আছার থাকে। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, এ জাতীয় কাজ করলে তা কি দ্বীনের সেবা ও খিদমত হবে, না…?

দুই.

যেসব বিষয় উম্মাহর মাঝে প্রতিষ্ঠিত ও শক্তিশালী দলীল দ্বারা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান সময়ে অপপ্রচারের শিকার তার একটি হচ্ছে জুমার আগের সুন্নত। খুব বিস্মিত হয়েছি যখন বিভিন্ন জায়গা থেকে এ প্রশ্ন আসা শুরু হয়েছে যে, ‘জুমার আগে সুন্নত পড়ার সূত্র কী, এ তো বিদআত। এর না কোনো দলীল আছে, না কোনো সহীহ হাদীস (নাউযুবিল্লাহ)!’ জানা গেছে, এইসব কথা তাদের পক্ষ হতে ছড়ানো হয়েছে যারা সচেতনভাবে বা অসচেতনভাবে মনে করেন, মানুষের মনে ফিকহ ও ফকীহ সম্পর্কে অশ্রদ্ধা তৈরি করা এবং সাধারণ মানুষকে আলিমদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা দ্বীনের এক বড় খেদমত!

এঁরা যদিও মুজতাহিদ ইমামগণের ‘তাকলীদ’-এর চরম বিরোধী, কিন্তু ‘যাল্লাতুল উলামা’ বা আলিমগণের ভুল ভ্রান্তির অনুসরণের বিষয়ে অতিআগ্রহী। তা না হলে এঁরা জুমার আগে সুন্নত পড়ার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতেন না। আমার জানা মতে, সম্ভবত সপ্তম হিজরী শতাব্দীতে কোনো আলিম এই দাবি করেছিলেন যে, সালাতুল জুমুআর আগে সুন্নত পড়া বিদআত (অথচ তা গোটা মুসলিমজাহানে সাহাবা-যুগ থেকে চলে আসছিল)।

আল্লাহ তাআলা জাযায়ে খায়ের দান করুন ইমাম যায়নুদ্দীন ইবনে রজব হাম্বলী রাহ.কে (৭৯৫হি.), যাঁর তালীমের সূত্র ইমাম ইবনুল কাইয়েম রাহ. (৭৫১হি.) ও ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. (৭২৮হি.)-এর সাথে যুক্ত, তিনি এ বিষয়ে দুটি পুস্তক রচনা করেন :

١ـ نفي البدعة عن الصلاة قبل الجمعة

٢ـ إزالة الشنعة عن الصلاة قبل الجمعة.

এ দুটি পুস্তিকায় তিনি সুস্পষ্ট  দলীল প্রমাণ দ্বারা ঐ অভিনব দাবি জোরালোভাবে খন্ডন করেন। আমার সামনে পুস্তিকা দুটি নেই, তবে ‘সহীহ বুখারী’র উপর তাঁর অপূর্ব ভাষ্যগ্রন্থ ‘‘ফাতহুল বারী’’র পঞ্চম খন্ডে, যা অনেক আগেই মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে, এ বিষয়ে সারগর্ভ আলোচনা রয়েছে। ঐখানে তিনি লিখেছেন, এ বিষয়ে যারা আরো বিশদ ও বিস্তারিত জানতে চান তারা যেন পুস্তিকা দুটি পাঠ করেন।

তিন.

কিছু মানুষ, যারা এই প্রতিষ্ঠিত সুন্নাহর বিরোধিতা করেছেন, আমার জানা মতে, তাদের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এই যে, ‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় তো জুমার প্রথম আযান ছিল না। এখন যাকে দ্বিতীয় আযান বলা হয় সেটিই শুধু ছিল। অর্থাৎ যে আযান খতীবের সামনে দেওয়া হয়। আযানের পরেই খুতবা শুরু হত। আর খুতবা  সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথেই নামায। তাহলে কাবলাল জুমা পড়ার সুযোগ ছিল কোথায়? বোঝা গেল, ঐ যামানায় জুমার আগে কোনো নামায ছিল না।’

এই প্রশ্ন শুনে খুব অবাক হয়েছি। কারণ আম মানুষের কারো কারো এই ধারণা আছে বলে জানতাম যে, আযানের আগে সুন্নত পড়া যায় না, কিন্তু কোনো আলিমেরও এ জাতীয় বিভ্রান্তি হতে পারে, তা জানা ছিল না। যেমন ধরুন, যোহরের সময় সোয়া বারোটায় হয়ে গেল, মসজিদে সাধারণত আযান দেওয়া হয় পৌনে একটায়, আযানের আগে কি যোহরের সুন্নত পড়া যাবে না? নিঃসন্দেহে সবাই বলবেন, পড়া যাবে। তাহলে এ বলে জুমার সুন্নতকেই কীভাবে অস্বীকার করে দেওয়া যায় যে, ‘আযানের পর তো খুৎবা শুরু হয়, আর খুৎবার পর নামায, তাহলে সুন্নতের সময় কোথায়’?! কে না জানে, জুমার সুন্নত দ্বিতীয় আযানের আগে পড়া হত, এখনও আগেই পড়া হয়। সুতরাং এ প্রশ্নই অর্থহীন যে, ‘সুন্নতের সময় কোথায়?’ কোনো হাদীস কি আছে, আযানের আগে সুন্নত পড়া যায় না?

তাছাড়া তৃতীয় খলীফায়ে রাশেদ উসমান ইবনে আফফান রা.-এর যামানায় যখন প্রথম আযান শুরু হল এবং এর উপর সাহাবায়ে কেরামের ইজমাও সম্পন্ন হল তখন তো নিঃসন্দেহে এই আযানও শরীয়তসম্মত আযান, যা সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং এখন তো এ প্রশ্ন আরো অর্থহীন যে, ‘আযানের আগে সুন্নত কীভাবে পড়া যাবে!’ কিংবা ‘আযানের আগে পড়া নামায কাবলাস সালাহ সুন্নত কীভাবে হবে?’ সুন্নত তো শরীয়তসম্মত আযানের পরই পড়া হচ্ছে।

চার.

অনেকগুলো সহীহ হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা আছে, জুমার জন্য যেন আগে আগে যাওয়া হয়, মসজিদে পৌঁছে যদি দেখা যায়, ইমাম খুৎবার জন্য আসেননি তাহলে নামায পড়বে, ইমাম এসে গেলে  চুপচাপ বসে খুৎবা শুনবে। এ বিষয়ে যদি আর কোনো দলীল না-ও থাকত তাহলেও শুধু ঐ হাদীসগুলো দ্বারাই কাবলাল জুমা নামায প্রমাণিত হত। তবে ঐ নামায কি সুন্নতে মুয়াক্কাদা হবে, না গায়রে মুআক্কাদা সেটা সাব্যস্ত হত অন্য দলীল দ্বারা।

তো সহীহ ও মারফূ হাদীসের মাধ্যমে যখন কাবলাল জুমা নামায প্রমাণিত হল তখন এ দাবির অবকাশ কীভাবে থাকে যে, জুমার আগে কোনো নামায নেই।

আফসোস, ঐ হাদীসগুলোর  আলোচনাও এখন কম হয়! নীচে কিছু হাদীস উপস্থাপিত হল।

عن عطاء الخراساني قال : كان نُبَيْشَة الهُذَلي يحدث عن رسول الله صلى الله عليه وسلم : أن المسلم إذااغتسل يوم الجمعة، ثم أَقْبَلَ إلى المسجد لا يُؤْذِيْ أحدا، فإن 

لم يجد الإمام خَرَج صلى ما بدا له، وإن وجدالإمامَ قد خرج، جلس، فاستمع وأنصت حتى يقضي الإمام جمعته وكلامه، إن لم يُغْفَر له في جمعته تلكذنوبُه كلُّها، أن تكون كفارة للجمعة التي تليها.

(তাবেয়ী) আতা খোরাসানী রাহ. নুবাইশা রা. থেকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস বর্ণনা করতেন যে, মুসলিম যখন জুমার দিন গোসল করে মসজিদের দিকে রওনা হয়, কাউকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকে, ইমাম (খুৎবার জন্য) বের হয়নি দেখলে যে পরিমাণ ইচ্ছা নামায পড়ে, ইমাম বের হয়ে থাকলে বসে যায় ও চুপচাপ শুনতে থাকে, একপর্যায়ে ইমামের সালাত ও কালাম সমাপ্ত হয়, তাহলে এ ব্যক্তির এ সপ্তাহের সকল গুনাহ যদি মাফ না-ও হয় এ তো অবশ্যই হবে যে, পরবর্তী জুমার জন্য তা কাফফারা হয়ে যায়।-মুসনাদে আহমদ খন্ড ৫, পৃ. ৭৫ (২০৭২১)

এই হাদীস ‘সহীহ লি-গায়রিহী’। মুহাদ্দিস নূরুদ্দীন হাইছামী রাহ. ‘মাজমাউয যাওয়াইদ’’ কিতাবে (২/১৭১) লিখেছেন-

رجاله رجال الصحيح، خلا شيخ أحمد وهو ثقة.

২.

সালমান ফারেসী রাহ. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

عن سلمان الفارسي قال : قال النبي صلى الله عليه وسلم
: لا يغتسل رجل يوم الجمعة ويتطَهَّر ما استطاعمن طُهر ويَدَّهن من دُهنِه أو يمس من طيب بيته، ثم يخرج فلا يُفَرِّق بين اثنين،
ثم يُصَلِّي ما كُتِب له، ثميُنْصِت إذا تكلَّم الإمام، إلا غُفِر له ما بينه وبين الجمعة الأخرى.

কোনো পুরুষ যখন জুমার দিন গোসল করে, সাধ্যমত পবিত্রতা অর্জন করে, তেল ব্যবহার করে বা ঘরে যে সুগন্ধি আছে তা ব্যবহার করে, এরপর (জুমার জন্য) বের হয় এবং (বসার জন্য) দুই জনকে আলাদা করে না, এরপর তাওফীক মতো নামায পড়ে এবং ইমাম যখন কথা বলে তখন চুপ থাকে, তাহলে অন্য জুমা পর্যন্ত তার (গুনাহ) মাফ করা হয়।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৮৮৩; মুসনাদে আহমদ ৮/৪৩ (২৩৭১০); সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ২৭৭৬

৩.

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

عن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال
: من اغتسل ثم أتى الجمعة فَصَلَّى ما قُدِّر لهثم أنصت حتى يفرغ من خطبته، ثم يصلي معه، غفر له ما بينه وبين الجمعة الأخرى وفضل ثلاثة أيام.

যে গোসল করে, এরপর জুমায় আসে, এরপর তাওফীক মতো নামায পড়ে, এরপর চুপ থাকে (ইমাম) তার খুতবা সমাপ্ত করা পর্যন্ত, এরপর তার সাথে নামায পড়ে, তার অন্য জুমা পর্যন্ত ও আরো তিন দিনের (গুনাহ) মাফ করে দেওয়া হয়।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৮৫৭

৪.

আবু সায়ীদ খুদরী রা. ও আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

عن أبي سعيد الخدري وأبي هريرة رضي الله عنهما قالا
: قال رسول الله صلى الله وعليه وسلم : من اغتسليوم الجمعة واستاك، ومسَّ من طيب إن كان عنده،
ولبِس من أحسن ثيابه، ثم خرج حتى يأتي المسجد، فلميتَخَطَّ رِقاب الناس حتى ركع ما شاء أن يركع، ثم أنصت إذا خرج
الإمام فلم يتكلم حتى يفرغ من صلاته،كانت كفارة لما بينها وبين الجمعة التي قبلها.

قال (الراوي) : وكان أبو هريرة يقول : وثلاثة أيام زيادة، إن الله جعل الحسنة الحسنة بعشر أمثالها.

যে জুমার দিন গোসল করে ও মিসওয়াক করে, তারপর সুগন্ধি থাকলে তা ব্যবহার করে, নিজের একটি উত্তম পোশাক পরিধান করে, এরপর বের হয় ও মসজিদে আসে এবং মানুষের কাঁধ ডিঙ্গানো থেকে বিরত থাকে, এরপর যে পরিমাণ ইচ্ছা রুকু (নামায আদায়) করে, এরপর ইমাম যখন বের হয় তখন থেকে তার নামায সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত কথা বলা থেকে বিরত থাকে, তাহলে এ জুমা থেকে আগের জুমা পর্যন্ত যা (গুনাহ) হয়েছে তার কাফফারা হয়ে যায়। (বর্ণনাকারী) বলেন, আবু হুরায়রা রা. বলতেন, এর সাথে আরো তিন দিনের (গুনাহ মাফ হয়)। আল্লাহ তাআলা নেক আমলকে দশগুণ বানিয়ে দেন।-মুসনাদে আহমদ ৩/৮১ (১১৭৬৭); সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৩৪৩ (كتاب الطهارة، باب الغسل للجمعة)

এ হাদীসের সনদ ‘হাসান’।

.

আবুদ দারদা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

عن أبي الدرداء رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم
: من اغتسل يوم الجمعة، ثم لبسثيابه، ومَسَّ طيبا إن كان عنده،
ثم مَشَى إلى الجمعة وعليه السكينة، ولم يَتَخَطَّ أحدا ولم يؤذه، رَكَعَ ما قُضِيله، ثم انتَظَر حتى ينصرف الإمام، غُفِر له ما بين الجمعتين.

যে জুমার দিন গোসল করে, এরপর তার পোশাক পরিধান করে, তার কাছে সুগন্ধি থাকলে তা ব্যবহার করে, এরপর ধীরস্থিরভাবে জুমার দিকে যায়, কাউকে ডিঙ্গিয়ে (সামনে) যাওয়া থেকে বিরত থাকে, কাউকে কষ্ট দেয় না, তাওফীক মতো রুকু (নামায আদায়) করে, এরপর ইমাম নামায সমাপ্ত করা পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তার দুই জুমার মাঝে যা (গুনাহ) হয়েছে  তা মাফ করে দেওয়া হয়।-মুসনাদে আহমদ ৫/১৯৮ (২১৭২৯)

এই হাদীস ‘সহীহ লিগায়রিহী’

এই হাদীসগুলোতে ইমাম খুৎবার জন্য উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত যে নামায পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে তা তো কাবলাল জুমা (জুমার আগের) নামাযই। গোসল করে জুমার জন্য ঘর থেকে বের হল এবং ইমামের অপেক্ষায় রইল, ইত্যবসরে যে নামায পড়া হবে তা যে ‘কাবলাল জুমা’ নামায এতে কোনো সন্দেহ আছে? যারা বলেন, জুমার আগে কোনো নামায নেই, তাদের উপরোক্ত হাদীসগুলো মনে রাখা প্রয়োজন।

এখানে এই দাবির সুযোগ নেই যে, ‘‘এই হাদীসগুলোতে যে নামাযের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে তা নফল নামায।’’ কারণ সুন্নতে কাবলিয়া (ফরজের আগে যে সুন্নত পড়া হয়) তাতে দুই ধরনের নামাযই আছে : সুন্নতে মুয়াক্কাদাও আছে, সুন্নতে গায়রে মুয়াক্কাদাও (নফল) আছে। যোহরের আগের চার রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা, আর আসরের আগের চার রাকাত সুন্নতে গায়রে মুয়াক্কাদা (নফল)। কিন্তু নফল হওয়ার কারণে কি একথা বলা যাবে যে, ‘আসরের আগে কোনো নামায নেই’?

পাঁচ.

কেউ কেউ বলেন, জুমার আগে নামায তো আছে, কিন্তু তা নফল নামায, যত রাকাত ইচ্ছা পড়বে। তাদের দাবি, ‘‘জুমার আগে  ‘সুন্নতে রাতিবাহ’ (সব সময় আদায় করার মতো সুন্নত) বা সুন্নতে মুয়াক্কাদা নেই।’’

এঁদের সংশয়ের সূত্র বোধহয় এইখানে যে, উপরোক্ত হাদীসসমূহে তো রাকাত-সংখ্যা নির্ধারণ ছাড়াই নামায পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে, যার দ্বারা বোঝা যায়, এটি নফল নামায। কিন্তু তাঁরা যদি এ বিষয়ে অন্যান্য হাদীস ও আছার সামনে রাখতেন তাহলে পরিষ্কার হয়ে যেত যে, জুমার আগের নামায দুই প্রকারের : এক. নফল, যার যত রাকাত ইচ্ছা পড়তে পারে। দুই. সুন্নতে রাতিবা, যার রাকাত-সংখ্যাও নির্ধারিত এবং সে বিষয়ে তাকীদও আছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও তা আদায় করা প্রমাণিত।

খাইরুল কুরূন থেকে মুসলমানদের এ আমল চলে আসছে যে, তাঁরা জুমার আগের নফল নামায ‘যাওয়ালে শামস’ বা সূর্য ঢলে যাওয়ার আগেও পড়তেন, আবার পরেও পড়তেন, কিন্তু এই চার রাকাত পড়তেন সূর্য ঢলে যাওয়ার পরে। আর এরই নাম ‘কাবলাল জুমা’ বা ‘জুমার আগের সুন্নত’।

এ বিষয়ে হাদীস ও আছার লক্ষ করুন।

প্রথমে আছার :

১.

জাবালা ইবনে সুহাইম রাহ. আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘তিনি জুমার আগে চার রাকাত পড়তেন। মাঝে সালাম ফেরাতেন না।’

عن جَبَلة بن سُحَيْم، عن عبد الله بن عمر أنه كان يصلي قبل الجمعة أربعا لا يفصل بينهن بسلام، ثم بعدالجمعة ركعتين ثم أربعا.

-শরহু মাআনিল আছার, তহাবী পৃ. ১৬৪-১৬৫

আল্লামা নীমাভী রাহ. ‘‘আছারুস সুনান’’ পৃ. ৩০২-এ এর সনদকে সহীহ বলেছেন। ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. ‘‘ফাতহুল বারী শরহু সহীহিল বুখারী’’ গ্রন্থে (৫/৫৩৯) একে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. জুমার আগে দীর্ঘসময় নামায পড়তেন। কিন্তু উপরের বর্ণনায় চার রাকাতকে আলাদা করে এজন্যই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তা সুন্নতে রাতিবা।

নাফে রাহ. বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. জুমার আগে দীর্ঘ সময় নামায পড়তেন (يطيل الصلاة قبل الجمعة) আর জুমার পরে ঘরে গিয়ে দুই রাকাত পড়তেন। আর বলতেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপই করতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১১২৮, কিতাবুল জুমুআ)

ইমাম ইবনে রজব রাহ. সহীহ বুখারীর ভাষ্যগ্রন্থে এই হাদীসের আলোচনায় লেখেন-

وظاهر هذا يدل على رفع جميع ذلك إلى النبي صلى الله عليه وسلم : صلاته قبل الجمعة وبعدها في بيته،
فإناسم الإشارة يتناول كل ما قبله مما قرب وبعد، صرح به غير واحد من الفقهاء والأصوليين.

وهذا فيما وضع للإشارة إلى البعيد أظهر، مثل لفظة ذلك، فإن تخصيص القريب بها دون البعيد يخالفوضعها لغة.

আহলে ইলম বুঝতে পারছেন, এখানে ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. ঐ ব্যক্তিদের বক্তব্য খন্ডন করছেন যারা বলেছেন যে, সুনানে আবু দাউদের উপরোক্ত হাদীস দ্বারা শুধু ‘বা’দাল জুমা’ (জুমার পরের নামায) মারফূ হওয়া প্রমাণিত হয়, কাবলাল জুমা নয়। উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা ‘যাদুল মাআদ’ ও ‘ফতহুল বারী, ইবনে হাজার’-এর আলোচনার দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে যায়।

যাক, এ তো ছিল একটি প্রাসঙ্গিক কথা। আমি কাবলাল জুমা চার রাকাত সুন্নত সম্পর্কে আছার উল্লেখ করছিলাম। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর আছর উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয় আছর এই-

২.

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, ‘তিনি জুমার দিন নিজ ঘরে চার রাকাত পড়তেন। এরপর মসজিদে আসতেন এবং জুমার আগে আর কোনো নামায পড়তেন না, জুমার পরেও না।’

عن ابن عباس رضي الله عنهما أنه كان يصلي يوم الجمعة في بيته أربع ركعات، ثم يأتي المسجد فلا يصليقبلها ولا بعدها.

এই আছরটি মুহাদ্দিস হার্ব ইবনে ইসমাঈল আলকিরমানী (২৮০হি.) তাঁর কিতাবে সনদসহ বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে রজব রাহ. বুখারীর ভাষ্যগ্রন্থে (৫/৫৮০) তা দলীল হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

উল্লেখ্য, এ বর্ণনায় জুমার পরে কোনো নামায না-পড়ার অর্থ হবে মসজিদে না পড়া।

৩.

সাফিয়া রাহ. বলেন, তিনি (উম্মুল মুমিনীন) সফিয়্যাহ রা.কে দেখেছেন, জুমার জন্য ইমাম আসার আগে চার রাকাত পড়েছেন। এরপর ইমামের সাথে দুই রাকাত জুমা আদায় করেছেন।

عن صافية قالت : رأيت صفية بنت حُيَيّ رضي الله عنها : صلَّت أربع ركعات قبل خروج الإمام للجمعة، ثمصلت الجمعة مع الإمام ركعتين.

তবাকাতে ইবনে সা’দ   ; নসবুর রায়াহ ২/২০৭; ফাতহুল বারী, ইবনে রজব ৫/৫৩৯

নারীদের উপর জুমা ফরয নয়, তাঁরা ঘরে যোহর পড়ে থাকেন। তবে কখনো যদি জুমা পড়েন তবে ফরজ আদায় হয়ে যাবে। ঐ অবস্থায়ও তাদের জুমার আগে চার রাকাত পড়া উচিত, যেমনটা সাফিয়্যাহ রা.-এর আমল থেকে জানা গেল।

.

আবু ওবায়দা রাহ. বর্ণনা করেন, (আববাজান) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. জুমার আগে চার রাকাত পড়তেন।

عن أبي عُبَيْدة، عن عبد الله قال : كان يصلي قبل الجمعة أربعا.

-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা খন্ড ৪, পৃ. ১১৪ (৫৪০২)

তাবেয়ী ক্বাতাদা রাহ.ও একথাই বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. জুমার আগে চার রাকাত পড়তেন, জুমার পরেও চার রাকাত পড়তেন।

أن ابن مسعود كان يصلي قبل الجمعة أربع ركعات وبعدها أربع ركعات.

-মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক খন্ড ৩, পৃ. ২৪৭ (৫৫২৪)

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. শুধু নিজে চার রাকাত পড়তেন  এমন নয়, তিনি অন্যদেরও চার রাকাত কাবলাল জুমা পড়ার আদেশ দিতেন।

তাঁর বিশিষ্ট শাগরিদ আবু আব্দুর রহমান আসসুলামী রাহ.-এর বর্ণনা : আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. আমাদেরকে জুমার আগে চার রাকাত এবং জুমার পরে চার রাকাত পড়ার আদেশ করতেন। পরে যখন আলী রা. আগমন করলেন তখন তিনি আমাদেরকে জুমার পরে প্রথমে দুই রাকাত এরপর চার রাকাত পড়ার আদেশ করেন।

كان عبد الله يأمر أن نُصَلِّي قَبْلَ الجُمْعة أربعا، وبعدها أربعا، حتى جاءنا علي فأمرنا أن نصلي بعدها ركعتينثم أربعا.

-মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক খন্ড ৩, পৃ. ২৪৭ (৫৫২৫)

নফল নামাযের বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া যায়, আদেশ দেওয়া যায় না। আদেশ করার অর্থ, এই নামায অন্তত সুন্নতে মুয়াক্কাদা, যেমন পরের চার রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা।

এ বর্ণনার সনদ সহীহ ও মুত্তাছিল।

এই বর্ণনায় লক্ষণীয় বিষয় এই যে, খলীফায়ে রাশিদ আলী ইবনে আবী তালিব রা. যখন কুফায় এসে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর শিক্ষা দেখলেন এবং তাঁর আদেশ সম্পর্কে অবগত হলেন তখন তিনি কাবলাল জুমার বিষয়ে কোনো পরিবর্তন করেননি, শুধু বা’দাল জুমা চার রাকাতের সাথে আরো দুই রাকাত যোগ করার আদেশ করেছেন। ফলে পরবর্তী সময়ে ইমাম আবু ইউসুফ রাহ.সহ আরো অনেক ইমামের নিকটে, জুমার পরের সুন্নত সর্বমোট ছয় রাকাত। এ থেকেও প্রমাণিত হয় খলীফায়ে রাশিদ আলী ইবনে আবী তালিব রা.-এর নিকটেও কাবলাল জুমার সুন্নত চার রাকাত।

এ শুধু উপরোক্ত চার, পাঁচজন সাহাবীরই আমল নয়, খাইরুল কুরূনে সাহাবা-তাবেয়ীনের সাধারণ আমল এটিই ছিল। দু’টি বর্ণনা লক্ষ করুন :

৫.

তাবেয়ী আমর ইবনে সায়ীদ ইবনুল আস রাহ. (৭০হি.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণকে দেখতাম, জুমার দিন সূর্য যখন ঢলে যেত তখন তাঁরা দাড়িয়ে যেতেন এবং চার রাকাত পড়তেন।’

كنت أرى أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم، فإذا زالت الشمس يوم الجمعة، قاموا فصلوا أربعا.

এ আছরটি ইমাম আবু বকর আল-আছরাম রাহ. (২৭৩হি.) তাঁর কিতাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর সূত্রে ইমাম ইবনে আব্দুল বার রাহ. ‘‘আততামহীদ’’ (খন্ড ৪, পৃ. ২৬ حديث ثامن لزيد بن أسلم)) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।

এই বর্ণনার সনদ নিম্নরূপ :

قال الأثرم : حدثنا منجاب بن الحارث قال : أخبرنا خالد بن سعيد بن عمرو بن سعيد بن العاص عن أبيهقال : كنت أرى …

আহলে ইলম জানেন, এ সনদটি সহীহ। গ্রন্থকার ‘আছরাম’ তো ইমাম, ‘মিনজাব’ ছিকা রাবী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য কিতাবে তাঁর সূত্রে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ১৩১ হিজরীতে তাঁর ইন্তিকাল। (তাহযীবুত তাহযীব খন্ড ১০, পৃ. ২৯৭-২৯৮; তাকরীবুত তাহযীব ৬৮৮২)

তাঁর উস্তাদ ‘খালিদ ইবনে সায়ীদের’ রেওয়ায়েতও সহীহ বুখারীতে আছে। ইমাম মুসলিম রাহ. মুহাম্মাদ ইবনে বিশ্র থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি তাকেالثقة الصدوق المأمون উপাধিতে ভূষিত করেছেন। (তাহযীবুত তাহযীব খন্ড ৩, পৃ. ৯৫)

তাঁর পিতা ‘আমর ইবনে সায়ীদ’ তো প্রসিদ্ধ তাবেয়ী, যিনি অনেক সাহাবীকে দেখেছেন। অনেক সাহাবীর জীবদ্দশায় ৭০ হিজরীতে তাঁর ইন্তেকাল।

এই আছরটি আবু বকর আল আছরামের উদ্ধৃতিতে ইবনে রজব রাহ. বুখারীর ভাষ্যগ্রন্থে (খন্ড ৫, পৃ. ৫৪২) উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি আছরাম রাহ.-এর হাওয়ালায় এই আছরও বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম আবু বকর ইবনে আইয়াশ রাহ. বলেন, আমরা জুমায় (তাবেয়ী ইমাম) হাবীব ইবনে আবী ছাবিত (রাহ.)-এর সাথে থাকতাম। তিনি জিজ্ঞাসা করতেন, ‘সূর্য কি ঢলে গেছে?’ এরপর নিজেও দেখতেন। সূর্য ঢলার পর তিনি কাবলাল জুমা চার রাকাত নামায পড়তেন।

ইবনে রজব রাহ. ছাড়া ইবনে কুদামা হাম্বলী রাহ.ও এই আছর ‘‘আলমুগনী’’তে (খন্ড ৩, পৃ. ২৫০) উল্লেখ করেছেন। এর আরবী পাঠ এই-

فإذا زالت الشمس صَلَّى الأربع التي قبل الجمعة.

আমর ইবনে সায়ীদ রাহ.-এর বিবরণ দ্বারা সাহাবা-যুগের তা’আমুল (কর্মধারা) সামনে এল। এবার সাহাবা-যুগ ও তাবেয়ী-যুগের কর্মধারা দেখুন :

২.

(তাবেয়ী) ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. (৯৫হি.) বলেন, ‘তাঁরা জুমার আগে চার রাকাত পড়া পছন্দ করতেন।’

قال إبراهيم النخعي : كانوا يحبون أن يصلوا قبل الجمعة أربعا.

-কিতাবুল ঈদাইন, ইবনে আবিদ দুন্য়া

ইমাম ইবনে রজব রাহ. বলেন, ‘এই আছরের সনদ সহীহ।’ এরপর তিনি ইমাম ইবনে আবী খাইছামা রাহ.-এর  ‘‘কিতাবুত তারীখে’’র উদ্ধৃতিতে ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.-এর এই বক্তব্য বর্ণনা করেছেন যে, ‘যখন আমি তোমাদেরকে كانوا يستحبون (তারা পছন্দ করতেন) বলব তাহলে তা এমন বিষয় হবে, যার উপর তাঁদের ইজমা ছিল।’ (ফাতহুল বারী খন্ড ৫, পৃ. ৫৪০)

ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.-এর বক্তব্য থেকে জানা গেল, তিনি যখন (তাঁরা পছন্দ করতেন) শিরোনামে কোনো আমল বর্ণনা করেন তখন তা অন্তত কুফায় অবস্থানকারী সাহাবা-তাবেয়ীন (যাদের সংখ্যা ছিল কয়েক হাজার)-এর সর্বসম্মত কর্মধারা হবে। তো সে যুগের এই সাধারণ কর্মধারা ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.-এর সূত্রে ইমাম ইবনে আবী শাইবা রাহ.ও তাঁর ‘‘আলমুসান্নাফ’’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। (দ্র. আলমুসান্নাফ খন্ড, ৪, পৃ. ১১৫-১১৬; ৫৪০৫)

সাহাবা-তাবেয়ীনের এই সাধারণ কর্মধারা প্রমাণ করে, জুমার আগে নফল নামাযের রাকাত-সংখ্যা যদিও নির্ধারিত নয়, প্রত্যেকে নিজ নিজ ইচ্ছা ও অভিরুচি অনুযায়ী পড়বে। তবে এসময় চার রাকাত নামাযের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। আর তা পড়া হত সূর্য ঢলে যাওয়ার পর দ্বিতীয় আযানের আগে।

আর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর ঐ চার রাকাতের আদেশ দেওয়া এবং খলীফায়ে রাশেদের তাঁর সাথে একমত থাকা, বলাই বাহুল্য, নিছক ইজতিহাদের ভিত্তিতে হতে পারে না। এ কারণে তাঁর এই হুকুম ‘‘মারফূ হুকমী’’ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত।

যারা দাবি করেন কোনো হাদীসেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জুমার আগে নামায পড়া প্রমাণিত নয়-না ঘরে, না মসজিদে, তাদের দাবি সত্য নয়। যদি তা সত্যও হত তবুও উপরোক্ত আছর, সাহাবা-তাবেয়ীনের ব্যাপক রীতি এবং উপরে উল্লেখিত ‘মারফূ হুকমী’ একথা প্রমাণে যথেষ্ট হত যে, জুমার আগে চার রাকাত সুন্নতে রাতিবা (মুয়াক্কাদাহ) রয়েছে।

ক্বাবলাল জুমআ সুন্নত সম্পর্কে স্পষ্ট মারফূ হাদীস

এ বিষয়ে সুনানে ইবনে মাজাহর একটি হাদীসই তালিবানে ইলমের হাতের কাছে থাকায় শুধু এ হাদীসটির কথাই সাধারণত বলা হয়। আর এর সনদ অতি দুর্বল হওয়ায় বলে দেওয়া হয়, ‘এ বিষয়ে যে মারফূ হাদীসটি আছে তার সনদ অতি দুর্বল। সেটি ছাড়া আর কোনো মারফূ হাদীস নেই।’ এই ধারণা ঠিক নয়। জুমার আগে নামায পড়া আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনেক দলীল দ্বারা প্রমাণিত। এ বিষয়টিই নিবেদন করার ইচ্ছা রাখি। অনুরোধ করি, ধৈর্যের সাথে পুরো আলোচনাটি পাঠ করার।

সুনানে ইবনে মাজায় (কিতাবুল জুমা, বাবুস সালাহ কাবলাল জুমা-র অধীনে) হাদীসটি বর্ণনা করা হয়েছে :

عن بقية، عن مبشر بن عبيد، عن حجاج بن أرطاة،
عن عطية العوفي، عن ابن عباس قال كان النبي صلىالله عليه وسلم يركع قبل الجمعة أربعا لا يفصل في شيء منهن.

বাকিয়্যাহ মুবাশশির ইবনে উবাইদ থেকে, তিনি হাজ্জাজ ইবনে আরতাত থেকে, তিনি আতিয়্যা আল আওফী থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার আগে চার রাকাত পড়তেন। মাঝে (সালামের দ্বারা) আলাদা করতেন না, (অর্থাৎ আত্তাহিয়্যাতু পড়ে তৃতীয় রাকাতের জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন)।’-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১১২৯

সনদের যে অংশ উল্লেখিত হয়েছে তাতেই ‘আসমাউর রিজাল’-বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বুঝতে পেরেছেন, এই সনদ অতি দুর্বল, বিশেষত মুবাশশির ইবনে উবাইদ তো এমন রাবী, যার সত্যবাদিতাই সংশয়পূর্ণ। সুতরাং এই সনদ যে নির্ভরযোগ্য নয় তাতে আর সন্দেহ কি। ব্যাস, এখান থেকেই প্রসিদ্ধ করে দেওয়া হল যে, এ বিষয়ে একমাত্র হাদীস ইবনে মাজার হাদীসটি, আর তা অতি দুর্বল।

‘‘ইলাউস সুনানে’’ ‘‘মাজমাউয যাওয়াইদ’’ এর বক্তব্য থেকে অনুমান করা হয়েছিল যে, এ হাদীস তবারানীতে যে সনদে বর্ণিত হয়েছে তাতে বোধ হয়, মুবাশশির ইবনে উবাইদ নেই, সুতরাং ঐ সনদ নির্ভরযোগ্য হতে পারে। কিন্তু এই অনুমান সঠিক প্রমাণিত হয়নি। তবারানীর ‘‘আলমু’জামুল কাবীরে’’ এই রেওয়াতের সনদ সেটিই যা ইবনে মাজার সনদ। এতে মুবাশশির ইবনে উবাইদ আছে। আর এটা নসবুর রায়া (খন্ড ২, পৃ. ২০৬) থেকেও বোঝা যায়। যাহোক, এতে এই ধারণা আরো প্রবল হয়ে গেল যে, এ বিষয়ে কোনো সহীহ মারফূ হাদীস নেই!

আগেই বলেছি, এই ধারণা সঠিক নয়। আর তা সঠিক নয় কয়েক কারণে। এক. কয়েকজন হাফিযুল হাদীস স্পষ্টভাষায় বলেছেন, হাদীসটি ইবনে মাজা যে সনদে বর্ণনা করেছেন তা জয়ীফ বটে, কিন্তু ইমাম আবুল হাসান আল খিলায়ী রাহ. (৪৯২ হি.) ‘‘আল ফাওয়াইদ’’ কিতাবে তা নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণনা করেছেন। সনদের শেষ অংশ তাঁরা উল্লেখও করেছেন। হাফেয আবু যুরআ ইরাকী (৮২৬ হিজরী) তরহুত তাছরীব গ্রন্থে ( খ. ৩, পৃ. ৩৬) লেখেন-

والمتن المذكور رواه أبو الحسن الخِلَعي في فوائده بإسناد جيد من طريق أبي إسحاق عن عاصم بن ضمرة عنعلي رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم.

সুতরাং এ বিষয়ের প্রথম মারফূ হাদীস যার সনদ নির্ভরযোগ্য তা এই-

১. আবু ইসহাক আস সাবীয়ী আসিম ইবনে দমরা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি আলী রা. থেকে, যে, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার আগে চার রাকাত পড়তেন।’ (আল-ফাওয়াইদ, আবুল হাসান আল খিলায়ী-তরহুত তাছরীব খ ৩, পৃ. ৩৬)

একাধিক হাদীসবিশারদ ‘‘আল ফাওয়াইদ’’-এর উদ্ধৃতিতে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং সনদ নির্ভরযোগ্য বলেছেন। যেমন :

ক. হাফিয যাইনুদ্দীন ইরাকী (৮০৬ হি.) (দ্র. ফয়যুল কাদীর)

খ. হাফিয আবু যুরআ ইরাকী (৮২৬ হি.) (দ্র. তরহুত তাছরীব ৩/৩৬)

গ. হাফিয শিহাবুদ্দীন আল বূসীরী (৮৪০ হি.) (দ্র. মিসবাহুয যুজাজাহ ফী যাওয়াইদি ইবনে মাজাহ খ. ১, পৃ. ১৩৬)

ঘ. মুহাদ্দিস আব্দুর রউফ আল

মুনাভী (১০৩১ হি.) (দ্র. ফয়জুল কাদীর খ. ৫ পৃ. ২১৬)

ঙ. মুহাদ্দিস মুরতাজা যাবিদী (১২০৫ হি.) (দ্র. ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন ফি শরহি ইহইয়াই উলূমিদ্দীন খ. ৩, পৃ. ২৭৫)

সনদের শেষ অংশ তো তাঁরা উল্লেখ করেই দিয়েছেন, যা কমসে কম ‘হাসান’ পর্যায়ের। আর আবুল হাসান আল খিলায়ী থেকে আবু ইসহাক আস সাবীয়ী পর্যন্ত সনদের যে অংশ তা উল্লেখ না করলেও তাঁরা একবাক্যে বলেছেন, তা ‘জাইয়েদ সনদ’ যার শাব্দিক অর্থ উত্তম সনদ। আর উসূলে হাদীসের পরিভাষায় ‘জাইয়েদ সনদ’ কে ‘হাসান’-এর উপরে গণ্য করা হয়। (তাদরীবুর রাবী খ. ১ পৃ. ১৭৮)

আবুল হাসান আল খিলায়ীর সনদের সমর্থন ঐ রেওয়ায়েত দ্বারাও হয়, যা তবারানী ‘‘আলমুজামুল আওসাত’’ কিতাবে এবং আবু সায়ীদ ইবনুল আরাবী তাঁর ‘‘আলমু’জাম’’ কিতাবে বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাটি এই-

محمد بن عبد الرحمن السَّهْمي، حدثنا حُصَيْن بن عبد الرحمن السُّلَمِي، عن أبي إسحاق، عن عاصم بنضَمْرة،
عن علي قال : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصلي قبل الجمعة أربعا، وبعدها أربعا، يجعلالتسليمَ في آخرهن.

২.

মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুর রহমান আসসাহমী বর্ণনা করেন, আমাদেরকে হুসাইন ইবনে আব্দুর রহমান আসসুলামী বর্ণনা করেছেন, তিনি আবু ইসহাক (সাবীয়ী) থেকে, তিনি আসিম ইবনে দমরা থেকে, তিনি আলী রা. থেকে, যে ‘‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার আগে চার রাকাত এবং জুমার পরে চার রাকাত পড়তেন এবং সর্বশেষ রাকাতে সালাম ফেরাতেন।’’-আলমুজামুল আওসাত, তবারানী খ. ২, পৃ. ৩৬৮ আলমু’জাম আবু সায়ীদ ইবনুল আরাবী-লিসানুল মীযান খ. ৭, পৃ. ২৭৮, ৫ : ২৪২)

সনদের মান : সনদের সকল রাবী পরিচিত ও প্রসিদ্ধ এবং উত্তম স্মৃতিশক্তির অধিকারী ও নির্ভরযোগ্য। সামান্য আপত্তি শুধু আছে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুর রহমান আস-সাহমী সম্পর্কে। তাঁর ব্যাপারে ইমাম আবু হাতিম বলেছেন ليسبالمشهور অর্থাৎ ‘তিনি তেমন প্রসিদ্ধ রাবী নন’। হযরতুল ইমামের এ উক্তি লিসানুল মীযানে এভাবেই আছে। তবে ইবনে আবী হাতিম এর কিতাব ‘‘আলজরহু ওয়াত তা’দীলে’’ (খ. ৩ কিসত : ২ পৃ. ৩২৬) লেখা আছে  ليسبمشهور যার অর্থ : ‘তিনি প্রসিদ্ধ নন’। যা হোক, লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে আবু হাতিম রাহ. তাuঁক ‘মাজহূল’ (অপরিচিত) বলেননি। এদিকে ইমাম ইবনে আদী রাহ. ‘‘আল-কামিল’’ কিতাবে (খ. ৬, পৃ. ১৯১-১৯২) তাঁর বর্ণনাসমূহ পরীক্ষা করার পর নিম্নোক্ত ভাষায় তার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছেন-

وهو عندي لا بأس به.

অর্থাৎ ‘আমার কাছে এই রাবীর মাঝে অসুবিধার কিছু নেই।’

আহলে ইলমের জানা আছে, হাদীস-বিশারদ ইমামগণ এ ধরনের মন্তব্য সাধারণত ঐ সকল রাবী সম্পর্কে করেন যাদের রেওয়ায়েত ‘হাসান’ পর্যায়ের হয়।

এদিকে ইমাম ইবনে হিববান তাঁকে ‘‘কিতাবুছ ছিকাত’’ (খ. ৯, পৃ. ৭২)-এ অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যার অর্থ, তিনি তাঁর নিকটে ‘ছিকা’ রাবীদের মধ্যে গণ্য।

‘‘লিসানুল মীযান’’ কিতাবে অবশ্য ইবনে আবী হাতিমের উদ্ধৃতিতে ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন থেকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি এই রাবীকে ‘জয়ীফ’ বলেছেন, কিন্তু ইবনে আবী হাতিমের ‘কিতাবুল জরহি ওয়াত তা’দীলে (খ. ৩, কিসত : ২, পৃ. ৩২৬) এই বক্তব্য আমরা পাইনি, তদ্রূপ ‘‘তারীখে ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীনে’’ও না। একারণে এই উদ্ধৃতিটি সংশয়পূর্ণ।

এই রাবী সম্পর্কে ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত সেটিই যা ইবনে আদী রাহ. বলেছেন। এ কারণে আলোচিত হাদীসটি সনদের বিচারে তো ‘হাসান’ পর্যায়ের, কিন্তু এর মতন (বক্তব্য) সাহাবা-তাবেয়ীন যুগে ব্যাপকভাবে বরিত ও অনুসৃত (মুতালাক্কা বিলকবূল) ছিল, যা প্রবন্ধের শুরুতে উল্লেখিত আছার ও তাআমূল (কর্মধারার) বিবরণ থেকে সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়েছে। ঐখানে বলা হয়েছিল, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. জুমার আগে চার রাকাত পড়ার যে আদেশ করেছিলেন, আলী রা. তা বহাল রেখেছিলেন। বলাবাহুল্য, এর কারণ
এ-ই হবে যে, তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরূপই করতে দেখেছেন। যার বিবরণ তাঁর বর্ণনাকৃত হাদীসে এসেছে।

৩.

মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুর রহমান আস-সাহমীর এ বর্ণনার সমর্থন আলী রা.-এর ঐ প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারাও হয়, যা সুন্নত ও নফল সম্পর্কে খুবই প্রসিদ্ধ এবং ‘সুনান’ ও ‘মাসানীদ’ গ্রন্থসমূহে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত।

আসিম ইবনে দমরা বলেন-

أتينا عليا، فقلنا : يا أمير المؤمنين ألا تحدثنا عن صلاة النبي صلى الله عليه وسلم بالنهار تطوعا؟ فقال : منيطيق ذلك منكم؟ قلنا نأخذ منه ما أطقنا.

আমরা আলী রা. এর কাছে এলাম এবং আরজ করলাম, আমীরুল মু’মিনীন! আপনি কি আমাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘সালাতুত তাতাওউ’ (সুন্নত ও নফল নামাযসমূহের) বিষয়ে অবগত করবেন না? তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে তার (অনুসরণের) হিম্মত রাখে? আরজ করলাম, ‘আমরা সাধ্যমতো আমল করব।’

এরপর আলী রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিবসের সুন্নত ও নফল নামাযের বিবরণ দিলেন। প্রথমে ফজরের পর সূর্য মাথার উপর আসার আগ পর্যন্ত দুই নামাযের কথা বললেন : দুই রাকাত এবং চার রাকাত (অর্থাৎ ইশরাকের দুই রাকাত  ও চাশতের চার রাকাত)

এর পর বলেন-

ثم أمهل فإذا زالت الشمس قام فصلى أربعا، ثم صلى بعد الظهر ركعتين،
ويصلي قبل العصر أربعا، يفصلبين كل ركعتين بتسليم على الملائكة المقربين ومن اتبعهم من المؤمنين والمسلمين، فتلك ست عشرة ركعة.

‘এরপর তিনি নামায পড়া থেকে বিরত থাকতেন। যখন সূর্য ঢলে যেত তখন দাঁড়াতেন ও চার রাকাত পড়তেন। এরপর যোহরের পর দুই রাকাত পড়তেন, আসরের আগে চার রাকাত পড়তেন। প্রতি দুই রাকাতকে তাশাহহুদ দ্বারা আলাদা করতেন। এ হল সর্বমোট ষোল রাকাত। (আল-আহাদীসুল মুখতারা, যিয়াউদ্দীন আলমাকদেসী খ. ১, পৃ. ১৪২-১৪৩ হাদীস : ৫১৪)

সুনানে ইবনে মাজায় (হাদীস : ১১৬১) এই হাদীসের শেষে আছে-

قال علي فتلك ست عشرة ركعة، تطوع رسول الله صلى الله عليه وسلم بالنهار،
وقل من يداوم عليها. قالوكيع : زاد فيه أبي : فقال حبيب بن أبي ثابت : يا أبا إسحاق! ما أحب أن لي بحديثك هذا مِلْءَ مسجدكهذا ذهبا.

অর্থাৎ, আলী রা. বললেন, ‘এ হচ্ছে সর্বমোট ষোল রাকাত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিনের তাতাওউ (নফল ও সুন্নত) নামায। খুব অল্প সংখ্যক মানুষই তা নিয়মিত আদায় করে।’

রাবী বলেন, এই হাদীস বর্ণনা করার পর (উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে থেকে ইমাম) হাবীব ইবনে আবী ছাবিত বলে উঠলেন, ‘আবু ইসহাক! আপনার বর্ণিত এই হাদীসের বিনিময়ে তো আপনার এই মসজিদ ভরে যায় এই পরিমাণ স্বর্ণের মালিক হওয়াও আমি পছন্দ করব না!

এ হাদীসে সূর্য ঢলে যাওয়ার পর যে চার রাকাতের কথা এসেছে, খুব সহজেই বোঝা যায়, সপ্তাহের ছয়দিন তা যোহরের আগের সুন্নত আর জুমার দিন জুমার আগের সুন্নত। কিন্তু অধিকাংশ দিনে তা যেহেতু ‘কাবলায যোহর’ আর জুমাও হচ্ছে যোহরেরই স্থলাভিষিক্ত তাই এ চার রাকাতকে অন্যান্য বর্ণনায় এভাবে বলা হয়েছে-

وأربعا قبل الظهر إذا زالت الشمس

(এবং জোহরের আগে চার রাকাত, যখন সূর্য ঢলে যায়) এবং এভাবে-

ويصلي قبل الظهر أربعا.

(এবং যোহরের আগে চার রাকাত পড়তেন)

এই বর্ণনাগুলোতে ‘যোহর’ শব্দ ব্যবহৃত হওয়ায় অনেকে মনে করেছেন, এই চার রাকাত শুধু ‘যোহরের নামাযে’র আগে পড়তে হবে, কারণ এই হাদীসে তো ‘কাবলায যোহর’ বলা হয়েছে, ‘কাবলাল জুমা নয়!’ বলাবাহুল্য, এটা অগভীর চিন্তার ফল। কারণ,এখানে ঐ সকল সুন্নত ও নফল নামাযের আলোচনা হচ্ছে, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিনে আদায় করতেন। জুমার দিনও তো দিনই বটে, রাত তো নয়। তাহলে এই ‘দিন’ সূর্য ঢলে যাওয়ার পর চার রাকাত নামায কেন হবে না? এ বিষয়ে জুমার দিনের নিয়ম যদি আলাদা হত তাহলে আলী রা. তা বলতেন। বলেননি যখন বোঝা গেল যে, জুমার দিনেও এ নামায পড়া হত। জুমার দিন কি ইশরাক, চাশত ও আসরের আগের সুন্নতসমূহ নেই? তাহলে সূর্য ঢলে যাওয়ার পরের এই চার রাকাত কেন থাকবে না? এটিও তো ‘আন নাহার’ (দিবস) শব্দের অন্তর্ভুক্ত।

৪.

আব্দুল্লাহ ইবনুস সাইব রা. বর্ণনা করেছেন-

أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يصلي أربعا بعد أن تزول الشمس، قبل الظهر، وقال : إنها ساعةتُفْتَح فيها أبواب السماء، فأحب أن يصعد لي فيها عمل صالح.

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য ঢলার পর যোহরের আগে চার রাকাত নামায পড়তেন। এবং বললেন ‘এই সময় (সূর্য ঢলার পর) আসমানের দরজাসমূহ খোলা হয়। আমি চাই, এ সময় আমার কোনো নেক আমল ওপরে যাক।-আশ শামাইলুল মুহাম্মাদিয়্যাহ, তিরমিযী, হাদীস : ২৯৫; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৪৮২; মুসনাদে আহমদ খ. ৬, পৃ. ৪১১, হাদীস : ১৫৩৯৬

ইমাম তিরমিযীর মতে, হাদীসটি ‘হাসান’।

এ হাদীসে সূর্য ঢলার পর চার রাকাত নামাযের কথা এসেছে। এটিই জুমার দিন ‘কাবলাল জুমা’, অন্যান্য দিন ‘কাবলায যোহর’। যেহেতু ছয়দিন তা কাবলায যোহর তাই একে বলা হয়েছে ‘কাবলায যোহর’। নতুবা এ নামাযের যে হিকমত বর্ণনা করা হয়েছে (অর্থাৎ সূর্য ঢলার সময় আসমানের দরজা খোলা হয়, এ কারণে এ সময় কোনো নেক আমল পাঠানো উচিৎ’) তা তো জুমার দিনেও আছে। জুমার দিনও তো সূর্য ঢলে এবং আসমানের দরজা খোলে। সুতরাং ঐ দিন চার রাকাত রহিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। পরবর্তী হাদীস থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়।

৫.

আবু আইয়ুব আনসারী রা. থেকে বর্ণিত-

أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يدمن أربع ركعات عند زوال الشمس، فقلت : يا رسول الله إنك تُدْمِنهذه الأربع ركعات عند زوال الشمس، فقال
: إن أبواب السماء تفتح عند زوال الشمس. فلا ترتج حتىيُصَلي الظهر، فأحب أن يصعد لي في تلك الساعة خير؟ قلت : أفي كلهن قراءة؟ قال : نعم، قلت : هلفيهن تسليم فاصل؟ قال : لا.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাললাম সর্বদা সূর্য ঢলার পর চার রাকাত নামায পড়তেন। আমি আরজ করলাম, আল্লাহর রাসূল! আপনি সর্বদা সূর্য ঢললে চার রাকাত নামায পড়েন (এর তাৎপর্য কী?) ইরশাদ করলেন, সূর্য ঢলার পর আসমানের দরজা খোলা হয়, এরপর যোহর পড়া পর্যন্ত বন্ধ করা হয় না। আমি চাই, ঐ সময় আমার কোনো নেক আমল ওপরে যাক। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘প্রতি রাকাতে কি কুরআন পড়তে হবে?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। বললাম, এর মাঝে কি সালাম ফিরাতে হবে? তিনি বললেন, ‘না’।-আশ শামাইলুল মুহাম্মাদিয়্যাহ, তিরমিযী, হাদীস : ২৯৩; মুসনাদে আহমদ ২৩৫৩২

এ হাদীস বিভিন্ন সনদে মুসনাদে আহমদ সহ বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। এর সনদগত মান কমসে কম ‘হাসান লিগায়রিহী’। (দ্র. টীকা, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা খ. ৪, পৃ. ২৭৩, (৫৯৯২); পৃ. ১১৫ (৫৪০৫) শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামা। শায়খ শুআইব আরনাউত তো মুসনাদে আহমদের টীকায় (হাদীস ২৩৫৫১) একে ‘সহীহ লিগায়রিহী’ বলেছেন।

এই হাদীস থেকে জানা গেল, সূর্য ঢলার পর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা (কোনো দিন বাদ দেওয়া ছাড়া) চার রাকাত পড়তেন। বোঝা গেল, জুমার দিনও পড়তেন, নতুবা সর্বদা পড়া হয় না। তাছাড়া এ চার রাকাতের যে কারণ বর্ণনা করা হয়েছে তা জুমার দিনেও রয়েছে।

আর এ বর্ণনার ‘যোহর পড়া পর্যন্ত আসমানের দরজা বন্ধ করা হয় না, কথাটির অর্থ ‘দুপুরের ফরয পড়া
পর্যন্ত’। যেমনটি মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার (খ. ৪ পৃ. ২৭৩, হাদীস : ৫৯৯২) বর্ণনায় আছে। ঐ বর্ণনার আরবী পাঠ এই

إن أبواب الجنة تفتح عند زوال الشمس فلا ترتج حتى تقام الصلاة، فأحب أن أقدم.

অর্থাৎ, সূর্য ঢলে গেলে জান্নাতের দরজা খোলা হয় এরপর নামায কায়েম হওয়া পর্যন্ত বন্ধ করা হয় না। একারণে আমি চাই, কিছু পাঠাতে।

এই নামায জুমার দিন জুমা, বাকি ছয় দিন জোহর।

এখানে আরো একটি বিষয় পরিষ্কার করে দিতে চাই। সূর্য ঢলে যাওয়ার পরের চার রাকাত সম্পর্কে কেউ কেউ এই সম্ভাবনাও বের করেছেন যে, হতে পারে, এটি সূর্য ঢলার পরের আলাদা একটি নামায। এ কথা সঠিক বলে মেনে নিলেও তো মূল বিষয় অর্থাৎ জুমার দিনও জুমার আগে সূর্য ঢলার পর চার রাকাত পড়া উচিৎ। কারণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আমল করতেন ও এর ফযীলত ও তাৎপর্যও বয়ান করতেন। এখন এই নামাযের নাম কী রাখা হবে-কাবলাল জুমা নামায, না সূর্য ঢলার পরের নামায তা আপনার ইচ্ছা। কিন্তু এই দাবির অধিকার তো কারো নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার দিন জুমার আগে কোনো নামাযই পড়তেন না।

আলোচনা দীর্ঘ হয়ে গেল, তবু কিছু কথা বলা হল না। তবে যা কিছু আরজ করা হল, আশা করি এতে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। অর্থাৎ, জুমার আগে যে পরিমাণ ইচ্ছা নফল পড়ুন, তা ছওয়াবের কাজ। তবে কমসে কম চার রাকাত তো অবশ্যই পড়া চাই। কারণ তার আলাদা গুরুত্ব আছে। এর গুরুত্ব ও তাকিদ হাদীস ও আছার দ্বারা প্রমাণিত এবং সাহাবা-তাবেয়ীন যুগে তা ব্যাপকভাবে পড়া হতো। সুতরাং কোনো অপযুক্তি-অপব্যাখ্যার শিকার হয়ে তা পরিত্যাগ ও অস্বীকার করা হবে খুবই দুঃখজনক ভুল।

শোনা যায়, কোনো কোনো মহল থেকে এ সুন্নতের উপর এভাবে প্রশ্ন তোলা হয় যে, আল্লাহর রাসূলের যুগে তো সূর্য ঢলার পরই জুমা শুরু হত। সুতরাং তখন সুন্নত পড়ার সময়ই ছিল না। সূর্য ঢলার আগে হচ্ছে মাকরূহ ওয়াক্ত । আর তার আগে তো জুমার ওয়াক্তই হয়নি। তাহলে ঐ সময় কোনো নামায পড়া হলে তা ‘কাবলাল জুমা’ কীভাবে হবে?

এই কুট প্রশ্নের জবাবে এখন শুধু দুটি কথা নিবেদন করছি :

১.

কোনো হাদীসে এ কথা আছে যে, নবী-যুগে সূর্য ঢলার সঙ্গে সঙ্গেই জুমা শুরু হয়ে যেত, এমনকি চার রাকাত সুন্নত পড়ারও সুযোগ পাওয়া যেত না? আমাদের জানামতে এমন কথা কোনো হাদীসে নেই।

২.

যারা কাবলাল জুমা সুন্নত অস্বীকার করেন তারা একথাও বলেন যে, সূর্য ঢলার আগেও জুমার নামায পড়া যায়। তা-ই যদি হয় তবে চার রাকাত সুন্নত সূর্য ঢলার আগে পড়লে ‘কাবলাল জুমা’ কেন হবে না? বরং তাদের অনেকে তো বলে, জুমার দিন দুপুরে কোনো মাকরূহ ওয়াক্ত নেই। তাহলে এদের তো একথা উচ্চারণ করারই অধিকার নেই যে, নবী যুগে জুমার আগে সুন্নত পড়ার সময়ই পাওয়া যেত না!

আর উপরে উল্লেখিত হাদীস ও আছার থাকা অবস্থায় এ জাতীয় কথা বার্তার কোনো অবকাশ থাকে কি? আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং উম্মতের চরম দুর্দশার সময় তাদের প্রতি মমতাশীল হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।

উল্লেখ্য, কাবলাল জুমা সুন্নত শুধু হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত নয়। এমনটা হলেও কোনো অসুবিধা ছিল না। কারণ দলীলভিত্তিক সিদ্ধান্ত যে মাযহাবেরই হোক, দলীল-মান্যতার খাতিরেই তা গ্রহণ করা জরুরি। কোনো মুজতাহিদ যদি অন্য দলীলের কারণে ঐ সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত করেন তবুও তাঁর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা জরুরি। কিন্তু এখানে
বাস্তবতা এই যে, কাবলাল জুমা নামায ‘সুন্নতে রাতিবা’ ও মুয়াক্কাদা হওয়াই অধিকাংশ ইমামের মাযহাব আর সেটাই দলীলেরও দাবি।

ইমাম ইবনে রজব রাহ. লিখেছেন, ‘এ বিষয়ে ইজমা আছে যে, জুমার আগে সূর্য ঢলার পর নামায পড়া একটি উত্তম আমল।’ মতপার্থক্য শুধু এখানে যে, ঐ নামায জোহরের আগের সুন্নতের মতো সুন্নতে রাতিবা, না আসরের আগের নামাযের মতো মুস্তাহাব। অধিকাংশ ইমামের মতে তা সুন্নতে রাতিবা। আওযায়ী, সুফিয়ান ছাওরী, আবু হানীফা ও তাঁর সঙ্গীদের সিদ্ধান্ত এটাই। ইমাম আহমদ রাহ.-এর বক্তব্য থেকেও তা-ই প্রকাশিত। তবে শাফেয়ী মাযহাবের পরবর্তী অনেক ফকীহ বলেছেন, তা মুস্তাহাব, সুন্নতে রাতিবা নয়।-ফাতহুল বারী, ইবনে রজব, খ. ৫, পৃ. ৫৪১, ৫৪২-৫৪৩

সুতরাং দলীলের কথা বললেও ‘সুন্নতে রাতিবা’র সিদ্ধান্তই অগ্রগণ্য। আর জুমহূর ও অধিকাংশ মনীষীর সিদ্ধান্তের কথা বললে তাঁদের সিদ্ধান্তও এটিই।

লেখক ======
আল্লামা মুফতী মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক দা.বা.
শিক্ষাসচিব এবং উলুমুল হাদীস অনুষদের প্রধান
উচ্চতর ইসলামি শিক্ষা ও দাওয়াহ প্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া

সিয়াম ও রামাদান সম্পর্কিত নির্বাচিত হাদীস

১। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, (রমজান মাসের) চাঁদ না দেখা পর্যন্ত তোমরা রোযা রেখো না। আর (শাওয়াল মাসের) চাঁদ না দেখা পর্যন্ত তোমরা ইফতার করো না। আকাশ মেঘলা থাকার দরুন যদি চাঁদ তোমাদের থেকে গোপন থাকে তবে (শা‘বান) মাসের দিনগুলো পূর্ণ করবে। অপর বর্ণনায় আছে, নবী করীম সা. বলেছেন, মাস কখনও ঊনত্রিশ রাতে (দিনে) ও হয়। সুতরাং চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোযা রাখবে না। যদি মেঘলা আকাশের কারণে চাঁদ তোমাদের থেকে গোপন থাকে তবে (শাবান মাস) ত্রিশ দিন পূর্ণ করবে। [বুখারী ও মুসলিম]
২। হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা সাহরী খাও। কেননা, সাহরী খাওয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে। [বুখারী ও মুসলিম]
৩। হযরত আমর ইবনুল আস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমাদের রোযা এবং আহলে কিতাব (ইহুদি ও খ্রিস্টান) দের রোযার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরী খাওয়া। [মুসলিম]


রোজার আয়াত – সিয়াম ও রামাদান সম্পর্কে নির্বাচিত কুরআনের আয়াত


৪। হযরত সাহল ইবনে সা‘দ রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মানুষ ততদিন কল্যাণের সাথে থাকবে যতদিন তারা ইফতার শীঘ্র শীঘ্র করবে। [বুখারী ও মুসলিম]
৫। হযরত ওমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখন এ (পূর্ব) দিক হতে রাত আসবে এবং এ (পশ্চিম) দিক হতে দিন প্রস্থান করবে এবং সূর্য অস্তমিত হবে তখনই রোযাদার ইফতার করবে।
৬। হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধারে (মাঝে ইফতার না করে) রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা. আপনি তো একাধারে (সাওমে বেসাল) রোযা রেখে থাকেন? রাসূল সা. বললেন, তোমাদের মধ্য থেকে কে আমার মতো? আমি রাত যাপন করি, তখন আমার প্রতিপালক আমাকে আহার করান এবং পান করান। [বুখারী ও মুসলিম]
৭। হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা এবং তা অনুসারে কার্যকলাপ করা পরিত্যাগ করেনি, তার পানাহার পরিত্যাগ করাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। [বুখারী]
৮। হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মারা গিয়েছে অথচ তার জিম্মায় (ফরজ) রোযা রয়েছে, তার পক্ষে তার অলি (অভিবাবক) রোযা রাখবে। [বুখারী ও মুসলিম]
৯। হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে কখনও নাপাক অবস্থায় সকাল করে ফেলতেন। আর নাপাকী স্বপ্ন দোষের কারণে ছিল না, অতঃপর তিনি গোসল করতেন এবং রোযা অব্যাহত রাখতেন। [বুখারী ও মুসলিম]
১০। হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় শিঙ্গা নিয়েছেন এবং তিনি রোযা অবস্থায়ও শিঙ্গা নিয়েছেন। [বুখারী ও মুসলিম]
১১। হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে রোযা অবস্থায় ভুল করে কিছু খেয়েছে বা পান করেছে সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে। কেননা, আল্লাহই তাকে পানাহার করিয়েছেন। [বুখারী ও মুসলিম]
১২। তাবেয়ী হযরত আতা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যদি কেউ  (রোযা অবস্থায়) কুলি করে অতঃপর মুখের সম্পূর্ণ পানি ফেলে দেয়, সে নিজের থুথু বা মুখে যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা গিলে ফেললে তার কোনো ক্ষতি হবে না। ইলককে চিবাবে না, যদি ইলক (আঠা জাতীয় বস্তু যা চিবানো যায়) মিশ্রিত থুথু গিলে ফেলে তবে আমি এ কথা বলব না যে, তার রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। তবে এরূপ করা নিষেধ। [বুখারী, তরজমাতুল বাব]
১৩। হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত হামযা ইবনে আমর আসলামী রা. একবার নবী কারীম সা. কে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি সফরে থাকাকালে রোযা রাখতে পারবো? আর তিনি বেশি বেশি রোযা রাখতেন। তখন নবী করীম সা. বললেন,যদি চাও তবে রোযা রাখতে পার, আর যদি চাও তবে ভাঙ্গতেও পার। [বুখারী ও মুসলিম]
১৪। হযরত জাবের রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফরে  (এক স্থানে) লোকের ভিড় দেখতে পেলেন এবং দেখলেন এক ব্যক্তির উপরে ছায়া দেওয়া হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি? লোকেরা বলল, এক রোযাদার ব্যক্তি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সফরে রোযা রাখা পুণ্যের কাজ নয়। [বুখারী ও মুসলিম]

সিয়াম ও রামাদান সম্পর্কে নির্বাচিত কুরআনের আয়াত

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

১। হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। [সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৩]

 أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ ۚ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ ۚ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ ۖ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ ۚ وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ ۖ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ

২। গণনার কয়েকটি দিনের জন্য (নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের জন্য)। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোযা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়, তার এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করবে। যে ব্যক্তি আনন্দের সঙ্গে সৎকর্ম করে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি রোযা রাখ, তবে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার। [সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৪]

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ ۚ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ۖ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ ۗ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

৩। রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মাঝে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসটির রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না, যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। [সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৫]


রোজার হাদীস পড়ুন – সিয়াম ও রামাদান-সম্পর্কিত নির্বাচিত হাদীস


وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ ۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ ۖ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ

৪। আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে, বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নিই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে। [সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৬]

أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَىٰ نِسَائِكُمْ ۚ هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ ۗ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَخْتَانُونَ أَنْفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنْكُمْ ۖ فَالْآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ ۚ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ۖ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ ۚ وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ ۗ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
৫। রোযার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে মিলিত হওয়া তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ । আল্লাহ অবগত রয়েছেন যে, তোমরা আত্মপ্রতারণা করছিলে, সুতরাং তিনি তোমাদের ক্ষমা করেছেন এবং তোমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন। অতঃপর তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে মিলিত হও এবং যা কিছু আল্লাহ তোমাদের জন্য দান করেছেন তা আহরণ কর। এবং পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত। আর যতক্ষণ তোমরা এ‘তেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন আল্লাহ নিজের আয়াতসমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা বাঁচতে পারে। [সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৭]

যে কারণে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ড. শিবশক্তি

পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিদায়াত প্রাপ্ত হৃদয়। মহান আল্লাহ পাক যাকে ভালোবাসেন তাকেই হিদায়াতের মতো মূল্যবান সম্পদ দ্বারা সমৃদ্ধশালী করেন। এ সম্পদ যদি আল্লাহ পাক কাউকে দান করতে চান তবে কেউ তা রুখতে পারেনা।

আর সে মূল্যবান হিদায়াত যদি মহান আল্লাহ পাক তার হাবীব হুজুর সা. এর দীদারের মাধ্যমে কাউকে দান করেন তবে তা যে কত বড় সৌভাগ্যের বিষয় তা সহজেই অনুমেয়। সে সৌভাগ্যশীল মানুষদের একজন হলেন ভারতের ৭০ কোটি হিন্দুর সাক্ষাৎ ভগবান ড. শিবশক্তি স্বরুপজি। হিদায়াতের নূর দ্বারা আলোকিত হয়ে পৃথিবীর সেরা আলোকিত মানুষে পরিণত হলেন ড. শিবশক্তি। তার ইসলাম গ্রহণের এ ঘটনায় সারা বিশ্ব বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। সারা দুনিয়ার স্বনামধন্য সব মিডিয়া তা গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছিল। তার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী যেকোন সত্যান্বেষী ও সত্যপ্রিয় মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে। ড. শিবশক্তি স্বরুপজীর বদলে যাওয়া জীবনের ঈর্ষণীয় সে উপাখ্যান আর্টিক্যাল বাড়ির এর পাঠক পাঠিকাদের সামনে তুলে ধরার ব্যকুলতা হৃদয়ে অনুভব করছি। চলুন, শুনি সে স্বার্থক জীবনের অভূতপূর্ব কাহিনী।
১৯৮৬ সালের রমজান মাস। এ পবিত্র মাসেই ড. শিবশক্তি একটি স্বপ্ন দেখলেন। যে স্বপ্নটি তার জীবনকে পৌঁছে দিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়। স্বপ্নটির সারসংক্ষেপ এমন যে, তিনি স্বপ্ন দেখার এক পর্যায়ে ভয়ে হাপাচ্ছেন আর দৌঁড়াচ্ছেন। এমন সময় তিনি তার সামনে এক নূরানী চেহারার সীমাহীন ব্যক্তিত্ববান এক মানুষকে দেখতে পেলেন, যিনি তাকে ভয় নেই বলে আশ্বস্ত করলেন এবং তার পরিচয় পেশ করলেন ড. সাহেবের কাছে যে, আমিই শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সা.! সে স্বপ্নের মধ্যেই নবীজি সা. শিবশক্তিকে কালিমা পড়ার আহ্বান জানালেন এবং কালিমা স্বয়ং নিজেই পড়িয়ে দিলেন। এরপর থেকেই তিনি ইসলামকে মনে প্রাণে কবুল করে নিলেন এবং নিজের নাম পরিবর্তন করে ড. ইসলামুল হক রাখলেন।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, ঠিক একই স্বপ্নটি তার বিদূষী স্ত্রী স্ত্রীমতি শ্রদ্ধাদেবীও দেখলেন, তিনিও কালিমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলামকে গ্রহণ করে খাদিজা হক নাম ধারণ করলেন। তাদের উচ্চশিক্ষিত গ্রাজুয়েট কন্যা শ্রীমতি অপরাজিতা দেবীও ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তার নাম রাখা হলো আয়েশা হক। তাদের আরেক কন্যাও স্বামীসহ ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন পিতার কাছে।
ড. সাহেব ভারতের বৃন্দাবনে জন্মগ্রহণ করেছেন। আর এ বৃন্দাবনেই হিন্দুদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম। হিন্দুসমাজ এ বৃন্দাবনকে তাদের পবিত্র তীর্থভূমি হিসেবে বিবেচনা করে। রাধা কৃষ্ণের লীলাভূমি নামেও এটি সারা পৃথিবীতে পরিচিত। ভারতের হিন্দুসমাজ মনে করত রাধা কৃষ্ণের এ লীলাভূমি বৃন্দাবনেই আরেক ভগবান জন্মগ্রহণ করে ‘শিবশক্তি’ নামধারণ করেছেন।

হিন্দুসমাজের এমন পূজনীয় ভগবান সমতুল্য শিবশক্তির ইসলাম গ্রহণের এ ঘটনায় ভারতীয় হিন্দুসমাজ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। দুঃখে আর ক্ষোভে তাদের জ্ঞানীয় শক্তি লোভ পেয়ে যায়। ব্রাক্ষèণ্যবাদের পতাকাবাহী এক শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক লোক ড. শিবশক্তির বিরুদ্ধে মিছিল বের করে তার ফাসির দাবিতে উস্কানিমূলক শ্লোগান দিতে থাকে। তারা ‘নব ভারত টাইমস’ ‘নব ভারত সমাচার’ প্রভৃতি পত্রিকায় তার বিরুদ্ধে নানা প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। ড. সাহেব সীমাহীন ধৈর্য আর সহিষ্ণুতার সাথে এ সমস্ত বিদ্বেষপূর্ণ প্রতিবেদনের জবাব দিয়েছেন তার লিখিত দুটি পুস্তক হিন্দি ভাষায় লিখিত ‘খোলাপত্র’ ও উর্দু ভাষায় লিখিত ‘লিজিয়ে আপ ভি সৌচিয়ে’ দ্বারা।
অপরদিকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পৈতৃক আশ্রমের স্বর্ণসিংহাসনের মোহ ত্যাগ করে তিনি যখন ইসলামকে কবুল করেছেন তখন স্বাভাবিক ভাবেই পৃথিবীর সচেতন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সারা জাহানের জ্ঞানী গুণীরা তাকে মোবারকবাদ জানিয়ে পত্র লিখতে থাকেন। তাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোলাগার কথা জানান।

ড. শিবশক্তি উত্তর ভারতের মথুরা জেলার বৃন্দাবনে ১৯৩৬ সালে এক ঐতিহ্যবাহী মোহন্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তারা বংশানুক্রমেই সর্বস্বামী বা মোহন্ত। তার পিতার নাম প্রিতমদাস উদাসেন এবং মায়ের নাম ভানুমতি কর। তাদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ সন্তান হলেন শিবশক্তি।
পিতার আশ্রমেই শিবশক্তি প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পরে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অরিয়ান্টালিজম এ মাস্টার্স করেন। গুরু কুল কাংড়ি থেকে ‘আচারিয়া’ পদবি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে বিশ্বের দশটি প্রধান ধর্মের উপর ডক্টরেট অব ডিভাইটিটি এবং অরিয়ান্টালিজম এ আরেকটি ‘পি এইচ ডি লাভ করেন।


নও মুসলিমের কাহিনী পড়ুন মসজিদ শহীদকারী যখন শত মসজিদ নির্মাতা !!


পৃথিবীর বারটি ভাষায় তিনি পা-িত্য অর্জন করেন। যার মধ্যে অন্যতম হলো ইংরেজি, সংস্কৃতি, গ্রিক, উর্দু, পালি, মারাঠি, গোরমুখি, গুজরাটি, আরবী প্রভৃতি ভাষা।
সমকালীন ধর্মগুরু ও প-িতদের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। বালঠাকুর, নানা সাহেব দেশমুখ, বাব সাহেব দেশমুখ, পুরীর শংকরার্চার্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রমুখের সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও হৃদত্যাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
তিনি যখন ভ্যার্টিকানের পোপ পল-৬ এর বৃত্তি নিয়ে ইটালি যান তখন তাকে সেখানকার নাগরিকত্ব দেয়া হয়। পোপ জন পলের পক্ষ থেকে তাকে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহনের আহব্বান জানালে তিনি তা উপেক্ষা করে ভারতে এসে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ভগবানের আসনে আরোহন করেন।
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মোহন্তগিরি পেশা ছিল তাঁর অঢেল তীর্থ উপার্জনের উৎস। অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগী অঢেল বিত্ত, সম্মান আর সেবাযতেœর মোহ তাকে ধরে রাখতে পারেনি। কালিমার শ্বাশত আহবান তাকে বিমোহিত করতে সক্ষম হয়েছিল বিধায় তা সম্ভব হয়েছে।
আর্কষণীয় চেহারার শ্বেতশুভ্র চুল-দাড়িশোভিত ড. ইসলামুল হক বর্তমানে তাঁর ভাগ্যবতী স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে ভূপালের ১৫নং নীলম কলোনির একটি ভাড়া বাসার দোতলায় থাকেন। ভবনের পাশেই জাওয়াবিত মসজিদ। সেখানে তিনি ৫ ওয়াক্ত নামায আদায় করেন। পাওয়ার থেরাপির আয়ুর্বেদ শাস্ত্র দ্বারা চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁর জীবনে এতো প্রতিকূল অবস্থার মাঝেও তিনি সীমাহীন নির্ভীক মানুষ। তিনি বলেছেন, এক আল্লাহকে ছাড়া কাউকে তিনি ভয় করেন না।
একজন সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিল যে, “ভারতীয় হিন্দুদের ভগবানের আসনে সমাসীন হবার সৌভাগ্য লাভ করেও আপনি কেন ইসলাম গ্রহণ করেছেন?
জবাবে ড. সাহেব বলেছিলেন, ‘আমি ভারতের আর ১০ জন হিন্দুর মত নই। আমি ব্যাপক পড়াশোনা করেছি। ভালো-মন্দ সম্পর্কে আমার যথেষ্ট জ্ঞান হয়েছে। বিশ্বের প্রধান ১০ টি ধর্মের উপর পড়াশোনা করে আমি অক্সফোর্ড থেকে পি. এইচ. ডি. ডিগ্রি লাভ করেছি। ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েই আমি ইসলামের সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি। মানবীয় জীবন ব্যবস্থা হিসেবে একমাত্র ইসলামই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে। অন্য কোন ধর্মের এ দুঃসাহস নেই। ইসলামের সৌন্দর্য ও মানসিকতা আমাকে ইসলাম গ্রহনে উদ্বুদ্ধ করেছে।
তাছাড়া গভীর রাতে হযরত মুহাম্মদ সা. আমাকে ও আমার বিদূষী স্ত্রীকে ইসলাম গ্রহনের নির্দেশও দেন। হাদীসের ভাষ্যনুযায়ী এ স্বপ্ন মিথ্যা হয়না। স্বপ্নযোগে হযরত মোহাম্মদ সা. এর দীদার কয়জনের ভাগ্যে জোটে?’ তিনি আরো বলেন, “নবীজি সা. এর নির্দেশ আমরা পালন করেছি মাত্র। কাজেই আমাদের ইসলাম গ্রহণ নিয়ে কোনরূপ প্রশ্ন তোলা ঠিক হবেনা বলে আমি মনে করি। ইসলাম গ্রহণ করতে পেরে আমরা নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। ”
সৌজন্য – মাসিক আল জান্নাত

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ নেক রমণী

মমিনুল ইসলাম মোল্লাঃ রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, একজন মুসলিম পুরুষের জীবনে সঙ্গী নির্বাচন করার জন্য একজন নেক ও সৎ রমণী প্রয়োজন। আর মুসলিম রমণীর উপর আবশ্যক হচ্ছে, নেক স্ত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। এ অবস্থায় আল্লাহ দুজনের উপরই সন্তুষ্ট হন। তাই নেককার রমণীর মাধ্যমে শুধুমাত্র দুনিয়ার জীবনই নয় আখিরাতের জীবনও শান্তিময় হতে পারে। সংসারে ধৈর্য ও সহ্য ক্ষমতার খুবই প্রয়োজন। এক্ষেত্রে স্বামীর চেয়ে স্ত্রীকেই বেশি ধৈর্যশীল হতে হয়।

রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “শিক্ষা অর্জন করার মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করা যায়। ধৈর্যের অনুশীলনের মাধ্যমে সহিষ্ণু হওয়া যায়। যে ব্যক্তি কল্যাণ লাভের চেষ্টা করে তাকে কল্যাণ প্রদান করা হয়” [ছহিহুল জামে, হাদীস নং২৩২৮]। আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পৃথিবীটা হচ্ছে ভোগের বস্তু। আর পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হচ্ছে নেক রমণী।” [মুসলিম শরীফ : হাদীস নং ২৬৬৮]।

মুসলিম রমণীগণ সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করলে তিনি বেহেস্তে প্রবেশ করবেন। মুসনাদে আহমদ এ বলা হয়েছে, “মুসলিম রমনী যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, রমযানের ছিয়াম পালন করে নিজের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, তবে তাকে বলা হবে, জান্নাতের যে কোন দরজা দিয়ে ইচ্ছে তুমি প্রবেশ কর।” পর্দা মুসলিম বোনদের জন্য শ্রেষ্ঠ ইবাদত। এটি একটি অবশ্যপালনীয় কাজ। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহীহ হাদিসে বার বার এর উপর তাকিদ দিয়েছেন। মনের পর্দার সাথে সাথে বাইরের পর্দাও পালন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই মনের খবর জানেন। তাই মুসলিম বোন ও আমাদের মা-চাচিদেরকে বাড়িতেও পর্দার সাথে জীবন অতিবাহিত করতে হবে। পর্দার সাথে যৌনতা, অশ্লীলতা ও বেহায়হাপনা সংশ্লিষ্ট।

আমাদের দেশে রাস্তাঘাটে কিংবা কর্মস্থলে যতগুলো যৌন হয়রানীর ঘটনা ঘটে তার চেয়ে বেশি ঘটে নিজ বাড়িতে ও প্রতিবেশী যুবকদের মাধ্যমে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহিলারা তা গোপনে সহ্য করে নেন। কোন ক্ষেত্রে তা প্রকাশ পেলেও লোক-পারিবারিক/বংশীয় সম্মান রক্ষা ও লোক-লজ্জার ভয়ে সেগুলো ধামা-চাপা দেয়া হয়। সেজন্য মুসলিম নারীকে অবশ্যই বাড়িতে পর্দার নিয়ম মেনে চলতে হবে।

পর্দা রক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে না দিলে পিতা, স্বামী ও পুত্রের আল্লাহর কাছে জবাবদেহী করতে হবে।
আল্লাহ বলেন, “হে নবী! আপনি আপনার পত্নগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনের স্ত্রীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না।” [সুরা আহযাব : আয়াত ৫৯]

তাছাড়া মহিলারা সুগন্ধী ব্যবহার করে বাইরে বের হবে না। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, “যে নারী সুগন্ধী মেখে ঘর থেকে বের হয় অতঃপর মানুষের সম্মুখ দিয়ে হেটে চলে যাতে করে তারা তার সুবাশ অনুভব করে তবে সেই নারী ব্যভিচারী।” [তিরমিজি, আবু দাউদ]।
গৃহিণীকে স্বামীর সামর্থ, সুবিধা-অসুবিধার কথা বুঝতে হবে। ইসলাম ধর্মের বিধি-বিধানের আলোকে একজন পুরুষ পরিবার পরিচালনা করবেন। প্রতিটি পরিবারকে সুখের নীড়ে পরিণত করতে আল্লাহ পাকের নির্দেশনা ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা প্রয়োজন। সহীহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে, “রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, উষ্ট্রারোহী মহিলাদের মধ্যে কুরাইশ বংশীয় মহিলারা সর্বোত্তম। তারা শিশুদের প্রতি স্নেহশীলা এবং স্বামীর মর্যাদা রক্ষার্থে উত্তম হেফাজতকারিণী ” [বুখারি শরীফ : হাদীস নং ৪৭১১]।
নারীরা অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ। এতে অনেক সময় দাম্পত্য জীবনে সমস্যা সৃষ্টি হয়। নারী জাতি স্বভাবতই স্নেহ আদর-ভালোবাসার প্রত্যাশী। পরিপূর্ণ আদর-সোহাগে সে সাংসারিক কাজে আরো গতিশীল হয়ে উঠে। অন্য দিকে অবহেলা ও লাঞ্ছনায় সে লজ্জাবতী লতার মতো নুইয়ে পড়ে। তবে এটাও চিন্তার বিষয় একজন নারী দীর্ঘদিন ধরে লাভ করা বাবার স্নেহ, ভাইয়ের আদর ও মায়ের সোহাগপূর্ণ একটি পরিবেশ ছেড়ে এসেছে। তাই পরিবর্তী পরিস্থিতি মেনে নিতে কিছুটা সময় লাগে। তাই এক্ষেত্রে একমাত্র স্বামী বেচারাই তার কষ্ট লাঘব করতে পারে । আর স্বামীও যদি তাকে প্রশ্রয় না দেয় তাহলে তার মনের জমানো কথাগুলো বলার মতো কোন যায়গা সে খুঁজে পায় না , তাই সংসারে ধীরে ধীরে অশান্তি নেমে আসে।

সংসারের শান্তির জন্য আকাশ কুসুম কল্পনা, অনিশ্চিত ধারণা ও অযৌক্তিক অনুমান থেকে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। বিয়ের পর স্ত্রীর ভরণ-পোষণ, কাপড়-চোপড়, সোনা-গয়নাসহ সকল চাহিদা স্বামীকে পূরণ করতে হবে। তাই বলে আপনি যা খুশি তা চাইতে পারবেন না। না দিতে পারলে বলতে পারবেন না “তোমার সংসারে এসে একদিনও শান্তি পেলাম না,” তোমার মতো অকর্মার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, না জানি সামনে আরো কত দুর্গতি আছে,” অথবা আপনি যদি বলেন, রহমান সাহেবও তো তোমার মতো চাকরিই করেন, উনি পাঁচ তলা বাড়ি করতে পারলে আমরা সারা জীবন ভাড়া বাসায় থাকবো কেন ? এমনও শোনা যায় কাদের সাহেবও তো ব্যবসা করেন, তোমার ব্যবসায় বার বার লোকসান হবে কেন ? যদি বলা হয় যা চাই তা দিতে না পারলে তিন কথা বলে আনছো কেন ? অথবা কেউ কেউ বলেন আমাকে সেচ্ছায় বিদায় করে দাও, আামি কারো কাছে কোন অভিযোগ করবো না।

এ ব্যাপারে তিরমিযি শরীফে বলা হয়েছে, যে নারী কোনরূপ অসুবিধা ছাড়াই বিনা কারণে স্বামীর নিকট তালাক চায়, তার জন্য জান্নাতের সুঘ্রাণ হারাম”। স্বামীর কথার বাইরে স্ত্রীর চলার কোন ব্যবস্থা নেই। ইবনে আবদে রাব্বেহী আন্দালুসী “ত্ববায়েউন নেসা” গ্রন্থে লিখেছেন, মেয়েটিকে নিয়ে তিনি ২০ বছর সংসার করেছেন। আমি সর্বদাই তার উপর খুশি থেকেছি। একদিন আমি ঘরে ফজরের দুরাকাত সুন্নত আদায় করলাম। এমন সময় মুয়াজ্জিন নামাজের ইকামত দিতে লাগলো। হঠাৎ একটি বিষধর বিচ্ছু দেখে আমি সেটি একটি পাত্র দিয়ে ঢেকে স্ত্রীকে বল্লাম যয়নাব! আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত নাড়াচাড়া করবে না, নামায শেষে ফিরে দেখি বিচ্ছুটি তাকে দংশন করেছে। যেহেতু তাকে বলেছিলাম আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি নড়াচড়া করবে না, তাই বিচ্ছুটি পাত্রের নীচ থেকে বের হয়ে তাকে দংশন করল কিন্তু সে আমার নির্দেশের লংঘন করল না এবং সেখান থেকে পালিয়ে গেল না । সে স্বামীর এতদূর আনুগত্যকারীনী ছিল।

আজকাল স্বামী একটু সচ্ছল হলেই স্ত্রী কাজের মেয়ে রাখার জন্য চাপাচাপি করেন। অথচ হাদিসে আছে, নবী কন্যা ফাতেমা রা. সব কাজ নিজ হাতে করতেন, আটা বানানোর যাতা ঘুরাতে ঘুরাতে হাতে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল, কলসি দিয়ে পানি আনতে আনতে কোমড়ে দাগ পড়ে গিয়েছিল। অনেক মহিলা তার স্বামীর উপর প্রভাব বিস্তার করতে চান। এটি নিতান্তই গর্হিত কাজ। আল্লাহ বলেন, “পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল এ জন্য যে, আলাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় আনুগত্যা এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোক চুর অন্তরালেও তার হেফাযত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সবার উপর শ্রেষ্ঠ। [সুরা নিসা : আয়াত ৩৪]।

বিয়ের পর স্বামীর সংসারকে আপন করে নিতে হয়। সংসারের প্রয়োজনে ঘরের বাইরে সকল কাজে স্বামীকে সাহায্য করতে হবে। হযরত আবু বকর রা. এর কন্যা আসমা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যুবাইর রা. আমাকে যখন বিবাহ করেন তখন একটি ঘোড়া বাদে অন্য কিছুই তার ছিল না। আমি ঘোড়াটিকে দানাপানি খাওয়াতাম, ঘাস ও খড়ের যোগান দিতাম। ঘোড়ার জন্য খেজুরের আঁটি কুটে তার খাদ্যে মিশাতাম, সার্বক্ষণিক তাকে খাওয়াতাম ও পানি পান করতাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবাইরকে যে জমি দিয়েছিলেন সেখান থেকে আমি খেজুরের বিচির বোঝা নিজের মাথায় নিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি আসতাম। ঐ স্থানটি আমাদের বাড়ি থেকে দু মাইল দূরে ছিল [মুসলিম শরীফ : হাদীস নং ২১৮২]।


এটা পড়ুন – ইসলাম ও নারী


হে মুসলিম বোন! আমাদেরকে একদিন আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। মহিলাদেরকে জীবনের সিংহভাগই স্বামী ও সন্তানের সেবায় কাটাতে হয়। সন্তানকে বকা-ঝকা বা গালি-গালাজ না করে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ? সন্তানকে সঠিক সময়ে আদব কায়দা শিক্ষা না দিলে পরবর্তীতে তারা মানতে চায় না। এক্ষেত্রে গালমন্দ না করে আমরা আল্লাহর কাছে হেদায়েত চাইব। আল্লাহর কাছে দু হাত তুলে বলব, “আমাকে এরূপ ভাগ্য দান কর, যাতে আমি তোমার নেয়ামতের শোকর করি, যা তুমি দান করেছ আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে এবং যাতে আমি তোমার পছন্দনীয় সৎকাজ করি। আমার সন্তানদেরকে সৎকর্মপরায়ণ কর, আমি তোমার প্রতি তওবা করলাম এবং আমি আজ্ঞাবহদের অন্যতম। [সুরা আহকাফ : আয়াত ১৫]।
যাদের সন্তান নেই তারা আল্লাহর কাছে বলবেন, “হে আমার প্রতিপালক আমাকে তুমি তোমার নিকট হতে সৎ বংশধর দান কর। নিশ্চয়ই তুমি প্রার্থনা শ্রবনকারী” [সুরা আলে-ইমরান : আয়াত ৩৮]।
হাদিসে আছে প্রতিটি শিশু ইসলামি ফিতরাত নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তার পিতা-মাতাই তাকে অন্য ধর্মে দীক্ষিত করে। তাই শিশু যখন কথা বলতে শিখে তখন সোনামনি “আব্বু‘” বল, না বলে আল্লাহু, আল্লাহু আকবর, সুবহানাল্লাহ্ ইত্যাদি শেখাতে হবে। বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সময় “বিছমিল্লাহ” বলে খাওয়াতে হবে। অন্যথায় শয়তানের বাচ্চা তাতে অংশ নিবে। শিশুদেরকে ছোট থাকতেই ইসলামি আদব কায়দা শেখাতে হবে। শৈশবে শিক্ষা না দিলে পরবর্তীতে শিক্ষার ভিত্তি দৃঢ় হয় না। আমরা যদি ঘুম পাড়ানোর গান কিংবা ছড়া দিয়ে ঘুম না পাড়িয়ে সুবহনাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, ইত্যাদি জিকিরের সাথে ঘুম পাড়াই, তাহলে জিকিরের সওয়াব যেমন পাবেন তেমনি আপনার অবুঝ সন্তানের মধ্যেও এর প্রভাব পড়বে। মা বাবা ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিজ হাতে খাওয়ার সময় ডান হাতে খাওয়ার শিক্ষা দেবেন। কেননা ডান হাত দিয়ে সামনে থেকে এবং ডান দিক থেকে খাওয়া শুরু করার কথা বুখারি শরিফে (৫৩৭৬) বর্ণিত হয়েছে। তবে খাওয়ার শুরুতে বিছমিল্লাহ্ এবং খাওয়ার শেষে আলহামদুলিল্লাহ্, বলার শিক্ষা দিতে হবে। খাওয়ার পর পানি খেতে হয়। এসময় ডান হাতে গ্লাস ধরা, বসে পান করা, পানির পাত্রে শ্বাস না ফেলা এবং তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করা সুন্নত। ঘুম থেকে উঠে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা থেকে আবার ঘুমুতে যাওয়া পর্যন্ত সবকিছুই ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী আমাদেরকে করতে হবে এবং শিশুদের শিক্ষা দিতে হবে। নিয়মিত চুল পরিষ্কার করা ভাল। চুল অচড়ানোর সময় ডান দিক থেকে শুরু করতে হবে। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযু, চুল-দাড়ি আচড়ানো ও জুতা পরিধানসহ অন্যান্য সকল (শুভ) কাজ ডান দিক থেকে শুরু করা পছন্দ করতেন। [বুখারি শরীফ : হাদীস নং ১৬৮]।

শিশুদেরকে দাঁত পষ্কিারের অভ্যাস করাতে হবে। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মিসওয়াক মুখ পরিষ্কারকারী এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপায়” [নাসাঈ শরীফ : মিসওয়াক করার উৎসাহ প্রদান অনুচ্ছেদ, হাদীস নং ৫]।
ঘরে ঢুকতে বিছমিল্লাহ বলে ঢুকতে হবে। এছাড়া ঘরে প্রবেশ করে সবাইকে সালাম দিতে হবে। ছেলে-মেয়েদেরকে আমরা অনেক সময় অন্যের ঘরে বিভিন্ন প্রয়োজনে পাঠাই। এক্ষেত্রেও কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে। রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ তিনবার অনুমতি প্রার্থনার পরেও যদি তাকে অনুমতি না দেয়া হয়, তাহলে সেখানে না যাওয়াই উত্তম। [বুখারি শরীফ]।

শিশুদেরকে সালাম দেয়া/নেয়া শেখাতে হবে। কারও সাথে সাক্ষাৎ হলে সালাম বিনিময়ের পর ডান হাতে মুসাফা করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এ সময়কালের কৃতকর্মের হিসেব দিতে হবে। বিধর্মীদের মতো যাচ্ছে-তাই করে চললে হবে না। জান্নাতি নারীর গুণাবলী আপনার মধ্যে কতটুকু আছে একটু ভেবে দেখুন। একজন পুণ্যবতী নারী ইচ্ছে করলে তার বেনামাযী স্বামীও সন্তানদেরকে ইসলামের সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারেন। তাই বলা যায়, একজন আদর্শ রমণী আখেরাতের জীবনকেও সুন্দর করতে সাহায্য করে।
লেখক : মমিনুল ইসলাম মোল্লা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা

আপনি কি ধূমপায়ী ? আপনার জন্য সুখবর !

ধূমপানের ক্ষতি এবং পরিণতি সম্পর্কে জানার পর, তা হালাল বলার কোন অবকাশ আছে বলে আমি মনে করিনা। ধূমপানকারী দেশে সমাজে সর্বমহলে একজন ঘৃনিত ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত হয়। যে ধূমপানের মত বদঅভ্যাসে আক্রান্ত, তাদের যে সব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তা
এখানে আলোচনা করা দরকার। নিম্নে এর কয়েকটি পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো:
ধূমপান একটি মারাত্মক ব্যাধি, অত্যন্ত ক্ষতিকর ও বিপদজনক রোগ। কিন্তু তিক্ত হলে ও সত্য বর্তমান দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ এ ধরণের একটি মারাত্মক ব্যধিতে আক্রান্ত। এর ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে জানেনা, এমন লোক খুব

১. ধূমপান আল্লাহর নাফরমানি এবং তার হুকুমের অবাধ্য হওয়া। আল্লাহ নিশ্চয় তাকে শাস্তি প্রদান করবেন।
২. আল্লাহ তাআলা ধুমপান এবং এর সাথে সম্পৃক্ত সকলকে ঘৃনা করেন।ধূমপান
৩. ধুমপানকারী ফেরেশতাদের কষ্ট দেয়।
৪. যে সব ঈমানদার ব্যক্তিবর্গ ধুমপান করে না, একজন ধুমপায়ী তাদের কষ্টের কারন হয়।
৫. ধুমপান নির্মল পরিবেশকে দুষিত করে।
৬. ধুমপান অযথা খরচ, এতে কোন দুনিয়া ও আখেরাতের বিন্দু পরিমাণও উপকার হয় না।
৭. আর ধুমপান হল অপচয়, আল্লাহ তাআলা অপচয় করার ব্যপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তিনি বলেন। তোমরা অপচয় কর না, নিশ্চয় অপচয়কারীদের আল্লাহ পছন্দ করেন না।
৮. এটির মাধ্যমে মন্দ এবং খারাপ কাজে সহযোগিতা হয়। আল্লাহ বলেন: তোমরা ভাল ও তাকোয়াপূর্ন কাজে সহযোগিতা কর আর মন্দ ও খারাপ কাজে সহযোগিতা কর না।
৯. ধুমপান দ্বারা ইসলামের দুশমনদের ইসলামের বিপক্ষে সহযোগিতা করা।
১০. ধুমপানকারী গুনাহের কাজকে হালকা করে দেখে। আর এ কথা আমাদের সকলের জানা, গুনাহকে হালকা করে দেখা সাধারন গুনাহ অপেক্ষা বড় পাপ। রাসূল (সাঃ) বলেন: আমার সকল উম্মতকে ক্ষমা করা হবে, তবে যারা গুনাহকে খাট করে দেখে তারা ব্যাতীত।
১১. ধুমপানের সকল সামগ্রী নাপাক ও দুর্গন্ধময় এবং ধুমপানকারীকেও এভাবে নাপাক ও দুর্গন্ধময় করে।
১২. ধুমপান দ্বারা অনর্থক কাজে মানুষের সময় নষ্ট হয়।
১৩. আর যারা ধুমপানের লেনদেন করে, তারা সাধারনত ইসলামের দুশমনদের সাথে সাদৃষ্য রাখে।
১৪. ধুমপান একজন মানুষের সম্ভ্রম হনন করে, সম্মান হানি ঘটায়।
১৫. ধুমপান একজন মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি বিলোপ করে এবং তা তার নির্বোধ বা জ্ঞান-হীন হওয়াকেই বুঝায়। কারন সে নিশ্চিত জানে যে ধুমপান তার জন্য ক্ষতিকর, তার পরও সে পান করে। এতে তার বোকামীই প্রকাশ পায়।
১৬. ধুমপানকারী তার ছেলে সন্তান এবং উত্তরসূরীদের জন্য একজন আদর্শহীন ব্যক্তিকে পরিণত হয়।
১৭. আর ধুমপানকারীর জন্য ইবাদত-বন্দেগী করা কঠিন হয়।
১৮. এ কাজটি ধুমপানকারীকে ইলম এবং যিকরের মজলিশ হতে দূরে রাখে এবং তাকে এ ধরনের মজলিশে উপস্হিত হতে হয়।
১৯. ধুমপান মানুষকে খারাপ মানুষের সাথে উঠা বসায় বাধ্য করে।
২০. ধুমপানের অভ্যাস একজন মানুষকে রোযা রাখা হতে বিরত রাখে। কারন, রোযা রাখলে সে ধুমপান করতে পারে না।
২১. ধুমপানের মাধ্যমে যেসব উপার্জন হয়, তা সম্পূর্ন হারাম। কারন, ধুমপানের ব্যবসা করা এবং এর লেনদেন সম্পূর্ন হারাম।
২২. ধুমপান মানুষের অপমৃত্যু ঘটায়। আন্তর্জাতিক স্বাস্হ সংস্হা তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করেন যে, সমগ্র পৃথীবিতে ধুমপানের কারনে যত বেশি অপমৃত্যুর ঘটন ঘটে অন্য কোন রোগ-ব্যধির কারনে তত বেশি অপমৃত্যু ঘটেনা।
২৩. ধুমপানের কারনে ফুসফুসে ক্যান্সার, শরীরে তাপ, প্রদাহ, জ্বালাপোড়া ইত্যাদি দীর্ঘ মেয়াদী রোগব্যাধী দেখা যায়।
২৪. ধুমপানের কারনে কন্ঠনালীতে ক্যান্সার হয়।
২৫. ধুমপানের কারনে রক্তনালীগুলো দুর্বল হয় এবং অনেক সময় একজন ধুমপায়ীর রক্তের চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
২৬. এটি স্মরনশক্তি কমিয়ে দেয় এবং মনোবল দুর্বল করে দেয়।
২৭. ইন্দ্রিয় ক্ষমতা দুর্বল করে; বিশেষ করে ঘ্রান নেয়া এবং স্বাদ গ্রহনের ক্ষমতা লোপ পায়।
২৮. অতিরিক্ত ধুমপানের কারনে দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়।
২৯. মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বার বার সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়।

৩০. হার্ডের সাথে সম্পৃক্ত ধমনীগুলো ব্লগ হয়ে যায়।
৩১. বক্ষ ব্যাধীতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

ফুসফুস
আপনি কোনটা চান ?

৩২. রক্তের উচ্চ চাপের কারন হয়।
৩৩. যৌনশক্তি বিলুপ্ত হয়।
৩৪. হজমশক্তি কমায় এবং ধারনক্ষমতা লোপ পায়, আর তার শরীর ঢিলে হয়ে যায়।
৩৫. ধুমপায়ী সব সময় দুর্বলতা অনুভব করে এবং আতঙ্কগ্রস্ত থাকে।
৩৬. ধুমপানকারীর ঠোটে মুখে জিহ্বা গলনালি ইত্যাদীতে ক্যান্সার হয়।
৩৭. পাকস্হলী ক্ষত হতে থাকে।
৩৮. ধুমপানের কারনে যকৃত শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৩৯. ধুমপানের কারনে মুত্রথলিতে ক্যান্সার হয় এবং মুত্রথলি যক্ষায় আক্রান্ত হয়।
৪০. কিডনিতে ক্যান্সার হয়।
৪১. পেশাব বিশাক্ত হয়।

এতকিছুর পরও একজন জ্ঞানী লোকের জন্য ধুমপান করা উচিৎ……………?
আপনারাই মতামত দিন…

বলবীর সিং – এক মসজিদ শহীদকারী যখন শত মসজিদ নির্মাতা !!

সকল মুসলমানের কাছে আমার একটিই নিবেদন আর তাহল, নিজের জীবনের লক্ষ কী তা জেনে এবং ইসলামকে মানবতার আমানত মনে করে মানুষের কাছে পৌছে দিই। পৌছে দেবার কথা ভাবি। কেবল ইসলামের প্রতি দুশমনীর কারণে তার থেকে বদলা নেবার প্রতিশোধ গ্রহণে উৎসাহিত না হই। আহমদ ভাই! আমি একথা একেবারে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বাবরী মসজিদ শাহাদতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক শিব সেনা, বজরং দলের সদস্যসহ সকল হিন্দু যদি এটা জানত যে, ইসলাম কী? মুসলমান কাকে বলে? কুরআনুল করীম কী? মসজিদ আসলে কোন বস্তুর নাম! তাহলে মসজিদ ভাঙার প্রশড়বই উঠতো না। তাদের সকলেই মসজিদ বানাবার কথা ভাবতো। আমি আমার প্রবল প্রত্যয় থেকে বলছি, বাল থ্যাকার, উইরে কুঠিয়ার যদি ইসলামের প্রকৃত সত্য ও মর্মবাণী জানতে পারে এবং জানতে পারে যে, ইসলাম (কেবল মুসলমানদের নয়) আমাদেরও ধর্ম, এটি আমাদের দরকার। তাহলে তাদের প্রত্যেকেই নিজ খরচে বাবরী মসজিদ পুনর্বার নির্মাণ করাকে নিজেদের সে․ভাগ্য মনে করত।

বলবীর সিং বাবরী মসজিদ
বলবীর সিং মুহাম্মদ আমের নাম ধারণ করে ১৯৯৩ সালের জুন মাসে হিন্দু থেকে ইসলামে দীক্ষিত হন ।

মাস্টার মুহাম্মদ আমের. আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

আহমদ আওয়াহ. ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

প্রশ্নঃ. মাস্টার সাহেব! অনেক দিন থেকেই আমার ওপর আব্বার নির্দেশ ছিল ‘আরমুগান’-এর জন্য আপনার একটি সাক্ষৎকার যেন গ্রহণ করি। ভালোই হলো যে, আজ আপনি এসে গেছেন। এ সুযোগে আমি আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।

আমের : আহমদ ভাই! আপনি আমার মনের কথা বলেছেন। যখন থেকে ‘আরমুগান’ পত্রিকায় নওমুসলিমদের সাক্ষৎকার ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হছে, তখন থেকেই আমার আন্তরিক ই‛ছা ছিল যে আমার ইসলাম কবুলের ঘটনাটি এতে ছাপা হোক। এজন্য নয় যে, আমার নাম এতে ছাপা হবে, বরং এজন্য যে, যাতে করে যাঁরা দাওয়াতের কাজ করছেন তাঁরা অনুপ্রাণিত হন, তাঁদের মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং দুনিয়ার সামনে মেহেরবান মালিক ও হেদায়েতদানকারী মহাপ্রভুর অসীম দয়া ও করুণার একটি উদাহরণ এসে যায়। আর যাঁরা দাওয়াতের ময়দানে কাজ করছেন তাঁরা যেন জানতে পারেন যে, যখন এ ধরনের আহম্মক ও নির্বোধ, যে তাঁর বরকতময় ঘর ধসিয়েছিল, তাকেই যদি আল্লাহ তা’আলা হেদায়েত দ্বারা ধন্য করতে পারেন তখন শরীফ ও ভদ্র-সজ্জন সাদাসিধে মানুষের পক্ষে হেদায়েত পাওয়া কঠিন হবে কেন? তাদের হেদায়েত লাভের সে․ভাগ্য জুটবে না কেন?

প্রশ্ন:. আপনি আপনার খান্দানের পরিচয় দিন।

উত্তর. হরিয়ানা প্রদেশের পানিপথ জেলার একটি গ্রামে আমার অধিবাস। ১৯৭০ সালের ৬ ডিসেম্বর এক রাজপুত পরিবারে আমার জন্ম। আমার পিতা একজন কৃষক হবার সাথে সাথে একটি প্রাইমারী স্কুলের হেড মাস্টারও ছিলেন। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন এবং মানুষকে ভালোবাসা তাঁর ধর্ম ছিল। কারও উপর জুলুম-নিপীঁড়ন; তা সে যে কোনো ধরনেরই হোক, তাঁর মনোবেদনার কারণ ছিল।

১৯৪৭ সালের দেশ-বিভাগের সময়কার হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তিনি স্বচ্ছ দেখেছিলেন। তিনি তা খুবই মর্মবেদনার সঙ্গে আলোচনা করতেন এবং সে সময়কার ব্যাপক মুসলিম হত্যাকে দেশের জন্য বড় ধরনের কলঙ্ক মনে করতেন। অবশিষ্ট মুসলমানদেরকে পুনর্বাসনের ব্যাপারে তিনি খুবই সাহায্য করেছেন। তিনি তাঁরস্কুলে মুসলমান ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে বিশেষ খেয়াল রাখতেন। জন্মসূত্রে আমার নাম বলবীর সিং। গ্রামের স্কুল থেকে পাস করে আমি হাই ¯স্কুলে ভর্তি হই। ম্যাট্রিক পাস করে পানিপথে গিয়ে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই। মুম্বাইয়ের পর পানিপথ ছিল শিবসেনার সবচে’ মজবুত কেন্দ্র। বিশেষ করে যুবক শ্রেণী ও স্কুলের লোকেরা শিবসেনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিল। ওখানে অনেক শিব ক্সসনিকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং আমিও পানিপথ শাখায় আমার নাম লেখাই।

পানিপথের ইতিহাস তুলে ধরে সেখানকার যুবকদের মধ্যে মুসলমানদের বিশেষ করে সম্রাট বাবর ও অপরাপর মুলিম সম্রাটদের বিরুদ্ধে বিরাট ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ান হত। আমার পিতা যখন জানতে পারলেন যে, আমি শিবসেনায় নাম লিখিয়েছি তখন তিনি আমাকে খুব বোঝাতে চেষ্টা করলেন। তিনি আমাকে ইতিহাসের সূত্র ধরে বোঝাতে চেষ্টা করেন। সম্রাট বাবর বিশেষ করে সম্রাট আওরঙ্গযেবের শাসনামলের ন্যায় ও ইনসাফ এবং অমুসলিমদের সঙ্গে কৃত তাঁর আচরণের কাহিনী তিনি আমাকে শোনান এবং আমাকে বলতে চেষ্টা করেন, ইংরেজরা ভুল ও বিকৃত ইতিহাস আমাদেরকে পরস্পরের সঙ্গে লড়াই বাধাবার এবং দেশকে দুর্বল করবার জন্য সৃষ্টি করেছিল। তিনি ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময়কার জুলুম-নিপীড়ন, হত্যা ও ধ্বংসাত্মক ঘটনাবলী শুনিয়ে আমাকে শিবসেনার যাবতীয় কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আমার পিতার সেসব চেষ্টা বিফলে যায়। আমার উপলব্ধিতে কোন কিছুই ধরা পড়েনি।

প্রশ্ন:. ফুলাত থাকাকালে বাবরী মসজিদ শহীদ করার ক্ষেত্রে আপনার অংশগ্রহণের কথা শুনিয়েছিলেন। এবার একটু বিস্তারিতভাবে সে সম্পর্কে আমাদেরকে বলুন।

উত্তর. ঘটনাটি এরকম ৯০ সালে লালকৃষ্ণ আদভানিজীর রথযাত্রায় আমাকে পানিপথের কর্মসূচী সফল করার ক্ষেত্রে বিশেষ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। রথযাত্রায় ঐসব দায়িত্বশীল নেতৃবর্গ আমাদের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের আক্সন জ্বালিয়ে দেন। আমি শিবজীর নামে শপথ গ্রহণ করি যে, যাই কিছু ঘটুক না কেন আর কেউ কিছু করুক আর নাই করুক, আমি একাই গিয়ে রাম মন্দিরের ওপর থেকে জুলুম করে চাপিয়ে দেওয়া (মসজিদরূপ) অবকাঠামো ভেঙে ক্সঁড়িয়ে দেবই। এ যাত্রায় আমার কর্মতৎপরতার দরূন আমাকে শিবসেনার যুব শাখার সহ-সভাপতি নির্বাচিত করা হয় । আমি আমার যুব টিম নিয়ে ৩০ অক্টোবর অযোধ্যায় যাই। পথিমধ্যে পুলিশ আমাদেরকে ফয়েযাবাদে থামিয়ে দেয়। এতদসত্ত্বেও আমি এবং আমার কিছু সাথী কোন প্রকার গা বাঁচিয়ে অযোধ্যায় গিয়ে পেঁ․ছি। বহু চেষ্টা করেও আমি বাবরী মসজিদের কাছে পেঁ․ছুতে পারলাম না। এর ফলে আমার শরীরে ঘৃণা ও বিদ্বেষের আগুন আরও জ্বলে ওঠে।

আমি আমার সাথীদেরকে বারবার বলছিলাম এরকম জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। রামের জন্মভূমিতে আরব লুটেরাদের কারণে রামভক্তদের ওপর কালি চলবে, এ কেমন অন্যায় ও জুলুম! আমার খুব রাগ হচ্ছিল। আমি রাগে ক্ষোভে ফুসছিলাম। কখনো মনে হচ্ছিল যে, আমি নিজেকেই শেষ করে দেই। আমি আত্মহত্যা করি। সারা দেশে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছিল। আমি সেদিনের জন্য খুবই অস্থির ছিলাম যেন আমার সুযোগ মিলে যায় আর আমি নিজ হাতে বাবরী মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেই। এভাবে একদিন দু’দিন করে সেই অপেক্ষার দিনটিও কাছে এসে পড়ল, যে দিনটাকে আমি সে সময় খুশির দিন, আনন্দের দিন ভাবতাম। আমি আমার কিছু আবেগ-দীপ্ত সাথীকে নিয়ে ৯২ সালের ১ ডিসেম্বর প্রথমে অযোধ্যা যাই। আমার সাথীদের মধ্যে সোনীপথের নিকটবর্তী জাটদের একটি গ্রামের যোগীন্দর পাল নামক এক যুবকও ছিল। সে ছিল আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার পিতা ছিল একজন বিরাট জমিদার। জমিদার হলেও তিনি মানুষকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি তাঁর একমাত্র পুত্রকে অযোধ্যা যেতে বাধা দেন। তার বড় চাচাও তাকে ফেরাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সে কারোর বাধা মানেনি।

আমরা ৬ ডিসেম্বরের আগের রাত্রে বাবরী মসজিদের একবারে কাছাকাছি গিয়ে পেয়েছি এবং বাবরী মসজিদের সামনে কিছু মুসলমানদের বাড়ির ছাদে রাত কাটাই। আমার বারবার মনে হত, না জানি আমাদেরকে ৩০ অক্টোবরের মতো আজও এই ‘শুভ’ কাজ থেকে বঞ্চিত হতে হয়! কয়েকবারই মনে হয়েছে, লীডার না জানি কী করেন, আমাদের নিজেদের গিয়েই কর সেবা শুরু করা উচিত। কিন্তু আমাদের সঞ্চালক আমাদেরকে বাধা দিলেন এবং শৃংখলার সঙ্গে থাকতে বললেন। আমি তাঁর ভাষণ শুনতে শুনতে ঘরের ছাদ থেকে নেমে এলাম এবং কোদাল হাতে বাবরী মসজিদ ভাঙতে অগ্রসর হলাম।

বাবরী মসজিদ
উগ্র শিবসেনারা মসজিদের ছাদে ।

আমার মনস্কামনা পূরণের সময় এসে গেল। আমি মাঝের গম্বুজটির ওপর কোদাল দিয়ে আঘাত হানলাম এবং ভগবান রামের নামে জোরে জোরে ধ্বনি দিলাম। দেখতে না দেখতেই মসজিদ ভেঙে গুড়িয়ে গেল। মসজিদ ভেঙে পড়ার আগেই আমরা নিচে নেমে পড়ি। আমরা খুবই আনন্দিত ছিলাম। রাম লীলা লাগানোর পর তার সামনে মাথা ঝুকিয়ে আমরা আমাদের বাড়ি-ঘরে ফিরে এলাম, সাথে করে নিয়ে এলাম মসজিদের দু’টুকরো করে ইট, যা আমরা খুশিমনে আমাদের পানিপথের সাথীদের দেখালাম। তারা আমাদের পিঠ চাপড়ে আমাদের কৃতিত্বে আনন্দ প্রকাশ করল। শিবসেনার দফতরেও দুটো ইট রেখে দেওয়া হয়। এরপর এক বিরাট সভা হয় এবং সকলেই তাদের বক্তৃতায় অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে আমার উচাচ্ছিসিত প্রশংসা করে যে, আমাদের পরম গর্ব, পানিপথের নওজোয়ান শিবসৈনিক রামের প্রতি ভক্তিপ্রযুক্ত সর্ব-প্রথম কোদাল চালিয়েছিল। আমি আমার বাড়ি গিয়েও অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে একথা বলে ছিলাম।


নও মুসলিমদের এ কাহিনীটি পড়ুন – কুরআনের ভুল খুঁজতে গিয়ে অধ্যাপকের ইসলাম গ্রহণ


আমার পিতাজী খুবই অসন্তুষ্ট হন এবং এ ব্যাপারে তাঁর গভীর দুঃখের কথা জানিয়ে আমাকে পরিস্কার বলে দেন, এখন আর এই ঘরে আমি আর তুমি দুজনে এক সঙ্গে থাকতে পারি না। তুমি থাকলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব, নইলে তুমি আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। মালিকের ঘর যে ভেঙেছে আমি তার মুখ দেখতে চাই না। আমার মৃত্যু পর্যন্ত তুমি তোমার মুখ কখনো আমাকে দেখাবে না। আমি ধারণাও করতে পারিনি এমনটা ঘটবে। আমি তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। তিনি আমাকে এও বলেন যে, এ ধরণের জালিমদের দরূণ এদেশ ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে যাবে। অবশেষে রাগে-ক্ষোভে তিনি বাড়ি ছেড়ে যেতে উদ্যত হলেন। আমি ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে বললাম, আপনি বাড়ি ছেড়ে যাবেন না। আমি নিজেই আর এ বাড়িতে থাকতে চাইনে, যেখানে একজন রাম মন্দির ভক্তকে জালিম মনে করা হয়। এরপর আমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসি এবং পানিপথে থাকতে শুরু করি।

প্রশ্ন:. আপনি আপনার ইসলাম কবুলের ব্যাপারে কিছু বলুন?

উত্তর. প্রিয় ভাই আহমদ! আমার আল্লাহ কত মেহেরবান ও দয়ালু। তিনি চাননি আমি জুলুম ও শিরকের অন্ধকারে হাবুডুবু খাই। যিনি আমাকে ইসলামের নূর ও হেদায়েত দ্বারা ধন্য করেছেন। আমার মতো জালিম যে কিনা তাঁর পবিত্র ঘরকে শহীদ করেছে সে-ই তাকে হেদায়েত দানে ধন্য করেছেন। ঘটনা ছিল, আমার বন্ধু যোগীন্দর বাবরী মসজিদের কিছু ইট এনে রেখেছিল এবং মাইক দিয়ে ঘোষণা দেয় যে, ইটক্সলো রামমন্দিরের ওপর নির্মিত অবকাঠামোর। সে․ভাগ্যμমে তা আমাদের হাতে এসে পৌছেছে। সমস্ত হিন্দু ভাই এসে যেন এর ওপর পেশাব করে। আর কি! ঘোষণা হতেই ভিড় লেগে গেল। যে-ই আসত ঘৃণা ভরে এর ওপর পেশাব করে যেত।

এবার মসজিদের যিনি মালিক তাঁর শান প্রদর্শনের পালা। চার-পাঁচ দিন পর যোগীন্দরের মস্তিক বিকৃতি ঘটে। সে পাগল হয়ে যায় এবং সম্পুর্ণ উলঙ্গ থাকতে শুরু করে। পরনে আদে․ কাপড় রাখত না। সম্মানিত জমিদার চে․ধুরীর একমাত্র পুত্র ছিল সে। পাগলামীর পর্যায়ে সে বার বার তার মাকে কাপড় খুলে তাকে মুখ কালো করতে বলতো। তারপর ঐ অবস্থায় মাকে জড়িয়ে ধরত। তার পিতা এতে খুবই পেরেশান হয়ে পড়েন। ছেলের সুচিকিৎসার জন্য সাধু-সনড়ব্যাসী ও আলিম-ওলামা দেখান। বার বার মহান মালিকের কাছে মাফ চাইতে থাকেন। দান-খয়রাত করতে থাকেন। কিন্তু তার অবস্থার উপশম না হয়ে বরং উত্তরোত্তর খারাপই হতে থাকে। একদিন তিনি বাইরে যেতেই সে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। মা চিৎকার করতে শুরু করলে মহল্লাবাসী ছুটে এসে তাকে রক্ষা করে। এরপর থেকে তাকে শেকলে বেঁধে রাখা হয়। যোগীন্দরের পিতা ছিলেন খুবই সম্মানিত লোক। তিনি এই ঘটনার কথা শুনে ছেলেকে ক্সলি করে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। এমন সময় কেউ তাঁকে বলে যে, এখানে সোনীপথে ঈদগাহর পাশে একটি মাদরাসা আছে। ওখানে একজন বড় মাওলানা সাহেব এসে থাকেন। একবার গিয়ে তাঁর সঙ্গে আপনি দেখা করুন। এরপর যদি কিছু না হয় তখন যা হয় করবেন।

তিনি সোনীপথে যান। গিয়ে জানতে পারেন, মাওলানা সাহেব তো মাসের পয়লা তারিখে আসেন। বিগত পরশু পয়লা জানুয়ারি তারিখে এসে তিনি ২রা তারিখে চলে গেছেন। চে․ধুরী সাহেব খুব হতাশ হন এবং ঝাড়-ফুঁক করনেওয়ালা কাউকে পাওয়া যায় কিনা খোঁজ করেন। জানা গেল মাদরাসার যিম্মাদার কারী সাহেব ঝাড়-ফুঁক করে থাকেন, কিন্তু তিনিও মাওলানা সাহেবের সঙ্গে সফরে বেরিয়ে গেছেন। এরপর ঈদগায় জ‣নক দোকানদার তাকে মাওলানা সাহেবের দিল্লীর ঠিকানা দিয়ে দেয় এবং এও জানায় যে, আগামী পরশু বুধবার হযরত মাওলানা এখানে আসার (বুওয়ানা, দিল্লী) প্রতিশ্রূতি দিয়েছেন। তিনি তখন তাঁর ছেলেকে শেকলে বেঁধে বুওয়ানার ইমাম সাহেবের কাছে নিয়ে যান। তিনি ছিলেন আপনার আব্বার মুরীদ এবং বহুদিন থেকে বুওয়ানার জন্য তারিখ নিতে চাইতেন। মাওলানা সাহেব প্রত্যেকবার তার কাছে ওযর-আপত্তি এবং অপারগতা প্রকাশ করতেন। এবারে তিনি এদিককার সফরে দু’দিন পর যোহরের নামায পড়ার ওয়াদা করে গেছেন।

বুওয়ানার ইমাম সাহেব তাঁকে বলেন যে, অবস্থা খারাপ হবার দরুন ৬ ডিসেম্বরের আগে হরিয়ানার বহু ইমাম ও মুদাররিস এখান থেকে ইউ.পি.তে নিজেদের বাড়ি-ঘরে চলে গিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক মাস পর্যন্ত ফিরে আসেননি। এ জন্য মাওলানা সাহেব ১ তারিখে এ বিষয়ে বক্তৃতা করেন এবং বক্তৃতায় বিরাট জোর দিয়ে একথা বলেন যে, মুসলমানরা এসব অমুসলিম ভাইকে যদি ইসলামের দাওয়াত দিতেন এবং ইসলাম, আল্লাহ ও মসজিদের পরিচয় তুলে ধরতেন তাহলে এ ধরণের দূর্ঘটনার জন্ম হতো না। তিনি বলেন যে, বাবরী মসজিদের শাহাদতের যিম্মাদার এক দিক দিয়ে আমরা মুসলমানরাও। আর এখনও যদি আমাদের হুঁশ হয় এবং আমরা যদি দাওয়াতের হক আদায় করতে থাকি তাহলে এই মসজিদ যারা ভেঙেছে, এই মসজিদ যারা ধসিয়েছে তারা মসজিদ নির্মাতা হতে পারে। হতে পারে তারাই মসজিদ আবাদকারী। ঠিক এ ধরনের প্রেক্ষাপটে আমাদের রাসূল হাদীয়ে বরহক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলতেন, হে আল্লাহ! তুমি আমার জাতিকে হেদায়েত দান কর, সুপথ প্রদর্শন কর। কেননা তারা তো জানে না।

যোগীন্দরের পিতা চৌধুরী রঘুবীর সিং যখন বুওয়ানার ইমাম (সম্ভবত তাঁর নাম ছিল মাওলানা বশীর আহমদ)-এর কাছে গিয়ে পৌছুলেন, সে সময় তাঁর পীর সাহেবের বক্তৃতার খুবই প্রভাব ছিল। তিনি চে․ধুরী সাহেবকে বলেন, আমি ঝাড়-ফুঁক করতাম। কিন্তু আমাদের হযরত আমাকে একাজ করা থেকে থামিয়ে দিয়েছেন। কেননা একাজে অনেক সময় মিথ্যা বলতে এবং মহিলাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়। আর আপনার ছেলের ওপর তো কোন জাদু কিংবা জিন-ভুতের আছরও নেই বরং এ তো সেই মালিকের আযাবের ফল । আপনার জন্য একটি সুযোগ আছে। আমাদের বড় হযরত আগামী পরশু বুধবার দুপুরে এখানে আসছেন। আপনি তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করুন এবং আপনার কথা তাঁকে বলুন। আপনার ছেলে আশা করি ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু আপনাকে একটি কাজ করতে হবে আর তাহলো, আপনার ছেলে যদি ভালো হয়ে যায় তবে আপনাকে মুসলমান হতে হবে। চৌধুরী সাহেব বললেন, আমার ছেলে ভালো হয়ে গেলে আমি সব কিছু করার জন্য তৈরি আছি।

তৃতীয় দিন ছিল বুধবার। চৌধুরী রঘুবীর সিং যোগীন্দরকে নিয়ে সকাল ৮ টার সময় বুওয়ানা পৌছেন। দুপুর বেলা যোহরের আগেই মাওলানা সাহেবের আগমন ঘটে। শেকলে বাঁধা যোগীন্দর সম্পূর্ণ দিগম্বর অবস্থায় দাঁড়ানো। চৌধুরী সাহেব কাঁদতে কাঁদতে মাওলানা সাহেবের পায়ের ওপর পড়ে যান এবং বলতে থাকেন, মাওলানা সাহেব! আমি এই আহম্মকটাকে খুবই ঠেকাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে পানিপথের এক কুচত্রূীর চত্রূান্তে পড়ে। মাওলানা সাহেব! আমার ওপর দয়া করুন। আমাকে মার্জনা করে দিন। আমার ঘর বাঁচান। মাওলানা সাহেব কঠোর ভাষায় তাকে মাথা তুলতে বলেন এবং পুরো ঘটনা শোনেন।

তিনি চৌধুরী সাহেবকে বলেন যে, সমগ্র জগত সংসার নিয়ন্ত্রণকারী সর্বশক্তিমান আল্লাহর ঘর মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে তারা এত বড় পাপ করেছে এবং এত বড় জুলুম করেছে যে, যদি তিনি গোটা বিশ্বচরাচর ধ্বংস করে দেন তাহলে তা যথার্থ হবে। এতো বরং কমই হয়েছে যে, এই পাপের বোঝা কেবল একাকী তার ওপর পড়েছে। আমরাও সেই সর্বশক্তিমান মালিকেরই বান্দা এবং এক দিক থেকে এই বিরাট পাপের অংশীদার আমরাও। আর তা এই দিক দিয়ে যে, আমরা তাদেরকে বোঝাবার হক আদায় করিনি যারা বাবরী মসজিদ শহীদ করেছে। এখন আমাদের আয়ত্ত্বে আর কিছু নেই। আমরা কেবল এতটুকু করতে পারি যে, আপনি সেই মালিকের সামনে কাঁদেন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চান। আর আমরাও ক্ষমা চাই।

এরপর মাওলানা সাহেব বললেন, যতক্ষণ না আমরা মসজিদের প্রোগ্রাম থেকে মুক্ত হই আপনি গভীর ধ্যানের সাথে ও মনোযোগ সহকারে মালিকের কাছে সত্যিকার অন্তর দিয়ে মাফ চান এবং প্রার্থনা করতে থাকুন যে, মালিক! আমার বিপদ কেবল আপনিই দূর করতে পারেন, আর কেউ দূর করতে পারে না। এরপর চৌধুরী সাহেব আবার মাওলানা সাহেবের পায়ের ওপরে পড়ে গেলেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলেন, জ্বী! আমার যদি সেই ক্ষমতা থাকতো; তাহলে কি আমাকে এই দিন দেখতে হতো! আপনি মালিকের আপনজন। যা কিছু করার আপনিই করুন।

মাওলানা সাহেব তখন তাকে বললেন, আপনি আমার কাছে চিকিৎসার জন্য এসেছেন। এখন যেই চিকিৎসার কথা আমি বলছি তা আপনার করা উচিত। এবার তিনি সম্মত হলেন। মাওলানা সাহেব মসজিদে গেলেন। নামায পড়লেন। অল্প সময়ের জন্য উপস্থিত লোকদের সামনে বক্তিতাও দিলেন এবং দোয়া করলেন। মাওলানা সাহেব সকলকেই চৌধুরী সাহেবের জন্য দোয়া করতে বললেন। প্রোগ্রাম শেষ হবার পর মসজিদে নাশতা হল। নাশতা থেকে মুক্ত হবার পর মসজিদ থেকে বের হতেই আল্লাহর কী মেহেরবানী দেখুন, যোগীন্দর তার পিতার মাথা থেকে পাগড়ী টেনে নিয়ে তার উলঙ্গ শরীর ঢাকল এবং দিব্যি সুস্থ মানুষের মতো তার পিতার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। সকলেই এ দৃশ্য দেখে আনন্দিত হলেন। বুওয়ানার ইমাম সাহেবের খুশির তো অন্ত ছিল না। তিনি চৌধুরী সাহেবকে তাঁর প্রতিশ্রূতির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং তাঁকে এও বলে ভয় দেখালেন যে, যেই মালিক তাকে ভালো করে দিয়েছেন যদি তুমি ওয়াদা মাফিক মুসলমান না হও তাহলে সে আবার এর চেয়ে আরও বেশি মারাত্মক পাগল হতে পারে। চৌধুরী সাহেব তৈরি হলেন এবং ইমাম সাহেবকে বললেন, মাওলানা সাহেবের ঋণ আমার সাত পুরুষ পর্যন্ত শোধ করতে পারবে না। আমি আপনার গোলাম। আপনি যেখানে চান আমাকে বিক্রী করতে পারেন। হযরত মাওলানা এ কথা শুনতেই ইমাম সাহেব তার সুস্থ হবার ব্যাপারে যে এধরনের ওয়াদা নিয়েছিলেন, তাতে ইমাম সাহেবকে বোঝালেন যে, এ ধরনের কাজ ঠিক নয়, তাকওয়া পরিপন্থী।

এরপর চৌধুরী সাহেবকে মসজিদে নিয়ে যাওয়া হতেই যোগীন্দর তার পিতাকে জিজ্ঞেস করল, পিতাজী! আপনি, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বললেন, মুসলমান হতে। তখন যোগীন্দর বলল, আমাকে তো আপনার আগে মুসলমান হতে হবে এবং আমাকে বাবরী মসজিদ পূণর্বার অবশ্যই নির্মাণ করতে হবে। তারপর তাঁরা উভয়ে খুশি মনে ওযু করলেন। তাঁদেরকে কলেমা পড়ানো হল। পিতার নাম মুহাম্মদ উছমান এবং পুত্রের নাম মুহাম্মদ ওমর রাখা হল। এরপর তাঁরা খুবই খুশি হয়ে নিজেদের গ্রামে ফিরে গেলেন। গ্রামে একটি ছোট মসজিদ ছিল। তাঁরা মসজিদের ইমাম সাহেবের সঙ্গে সাক্ষৎ করলেন। ইমাম সাহেব স্থানীয় মুসলমানদেরকে তাঁদের পিতা-পুত্রের মুসলমান হবার কথা জনিয়ে দিলেন। ফলে একজন দু’জনের কান থেকে গোটা এলাকায় একথা ছড়িয়ে পড়ল। হিন্দুদের কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে এলাকার প্রতাপশালী হিন্দুদের এ নিয়ে মিটিং হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় যে, তাঁদের দু’জনকেই রাতের বেলা মেরে ফেলতে হবে। অন্যথায় তাঁরা কত লোকের ধর্ম নষ্ট করে দেবে। তাদের এই মিটিংয়ে একজন ধর্মত্যাগী মুরতাদ উপস্থিত ছিল। সে ইমাম সাহেবকে গোপনে তাদের চক্রান্তের কথা জানিয়ে দেয়। ফলে আল্লাহর মেহেরবানীতে রাতের অন্ধকারে তাদেরকে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হয়। তাঁরা ফুলাত গিয়ে পৌছেন। পরে তাঁদেরকে ৪০ দিনের জন্য তবলীগ জামায়াতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আমীর সাহেবের পরামর্শে যোগীন্দর (ওমর) তিন চিল্লাও দেয়। পরে যোগীন্দরের মা-ও মুসলমান হয়ে যায়।

অতঃপর মুহাম্মদ ওমর (যোগীন্দর)-এর বিয়ে হয় দিল্লীর এক ভালো মুসলিম পরিবারে। এখন তারা বেশ আনন্দের সঙ্গেই দিল্লীতে সপরিবারে বসবাস করছেন। গ্রামের জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি সব বিক্রী করে তাঁরা দিল্লীতে একটি কারখানা দিয়েছেন।

প্রশ্ন:. মাস্টার সাহেব! আমি আপনাকে আপনার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলাম। আমি জানতে চেয়েছিলাম আপনি কিভাবে মুসলমান হলেন? আপনি যোগীন্দরের ও তার পরিবারের (মুসলমান হবার) কাহিনী শোনালেন। যদিও তা খুবই চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর, কিন্তু আমি তো আপনার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে জানতে চাই, কিভাবে আপনি ইসলাম গ্রহণ করলেন সে সম্পর্কে।

উত্তর. প্রিয় ভাইটি আমার! আসলে আমার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী এর থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। এজন্য আমি এর প্রথম অংশ শোনালাম। এখন দ্বিতীয় অংশও শুনুন।

১৯৯৩ সালের ৯ মার্চ আমার পিতা অকস্মাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। বাবরী মসজিদের শাহাদত এবং তাতে আমার অংশগ্রহণ তাঁকে খুবই আঘাত দিয়েছিল। তিনি প্রায় আমার মাকে বলতেন, মালিক আমাকে মুসলমানদের মধ্যে জন্ম দিলেন না কেন? আমি যদি মুসলমানদের ঘরে জন্ম নিতাম তাহলে অন্তত জুলুম-নিপীড়ন সহ্যকারীদের তালিকায় আমার নাম থাকত। তিনি আমার পরিবারের লোকদেরকে ওসিয়ত করেছিলেন, আমি মারা গেলে আমার লাশের খাটিয়ার (আরতির) কাছে যেন বলবীর না আসে, প্রথা ও রেওয়াজ মাফিক আগুনে যেন পোড়ানো না হয়। হিন্দুদের শ্মশানে যেন না নেওয়া হয়। পরিবারের লোকেরা তাঁর অন্তিম ই‛ছা মুতাবিক সব কিছু করে। আট দিন পর আমি আমার পিতার মৃত্যুর খবর পাই। এতে আমার মন ভেঙে যায়। তাঁর মৃত্যুর পর বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা আমার কাছে জুলুম মনে হতে থাকে এবং গর্বের পরিবর্তে আফসোস হতে থাকে। আমার দিল্ যেন হঠাৎ দপ করে নিভে যায়। আমি বাড়ি গেলে মা আমার পিতার কথা স্মরণ করে কাঁদতে থাকেন এবং বলতে থাকেন যে, এমন দেবতার মতো বাপকে তুই কষ্ট দিয়ে মেরে ফেললি! তুই কতটা নিচ ও হীন জাতের মানুষ। মায়ের এ ধরনের আচরণের কারণে আমি বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিই।

জুন মাসে মুহাম্মদ ওমর (যোগীন্দর) তাবলীগ জামায়াত থেকে ফিরে এল। সে পানিপথে আমার সঙ্গে দেখা করল এবং তার পুরো ঘটনা আমাকে বলল। বিগত দু’মাস থেকে আমার মন সব সময় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকত, না জানি কোন আসমানী বালা-মুসীবত আমার ওপর এসে পড়ে। পিতার দুঃখ ও মনোকষ্ট এবং বাবরী মসজিদের শাহাদতের দরুন আমার মন সব সময় সন্দিগ্ধ থাকত। মুহাম্মদ ওমরের কথা শুনে আমি আরও বেশি পেরেশান হয়ে পড়লাম। ওমর ভাই আমাকে আরও বেশি জোর দিলেন, আমি যেন ২৩ জুন তারিখে সোনীপথে যখন মাওলানা সাহেব আসবেন তাঁর সাথে গিয়ে অবশ্যই দেখা করি। আরও ভালো হয় যদি তাঁর সঙ্গে আমি কিছু দিন থাকি। আমি প্রোগ্রাম বানালাম। কিন্তু পৌছাতে আমার কিছুটা দেরি হয়। ওমর ভাই আমার আগেই পৌছে গিয়েছিল এবং মাওলানা সাহেবকে আমার অবস্থা সম্পর্কে সব বলেছিল। আমি সেখানে গেলে মাওলানা সাহেব আমাকে সাগ্রহে কাছে টেনে নিলেন এবং বললেন, আপনার আন্দোলনে এই গোনাহ করার জন্য যোগীন্দরের সঙ্গে যদি সর্বময় মালিক এরূপ করতে পারেন তাহলে আপনার সঙ্গেও একই রূপ ব্যবহার করা হতে পারে। আর মালিক যদি এই জগতে শাস্তি নাও দেন তাহলে মৃত্যর পর চিরস্থায়ী জীবনে যেই শাস্তি মিলবে আপনি তা কল্পনাও করতে পারবেন না।

এক ঘণ্টা সাথে থাকার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আসমানী বালার হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে, মুসলমান হওয়া দরকার। মাওলানা সাহেব দু’দিনের জন্য বাইরে কোন সফরে যাাচ্ছিলেন। আমি আরও দু’দিন তাঁর সাথে থাকার আকাঙক্ষা ব্যক্ত করলাম। তিনি খুব খুশি হয়েই অনুমতি দিলেন। একদিন হরিয়ানা, এরপর দিল্লী ও খোর্জার সফর ছিল। দু’দিন পর তিনি ফুলাত ফিরে এলেন। এ দু’দিন আমার মন ইসলাম গ্রহণের জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমি ওমর ভাইকে আমার ই‛ছার কথা বললাম। সে খুব খুশি হয়ে মাওলানা সাহেবকে তা জানাল। আলহামদুলিল্লাহ! ২৫ জুন ১৯৯৩ বাদ যোহর আমি ইসলাম কবুল করি। মাওলানা সাহেব আমার নাম রাখেন মুহাম্মদ আমের। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা এবং নামাযের নিয়ম-কানুন ও দরকারী মাসলা-মাসায়েল শেখার জন্য তিনি আমাকে কিছুদিন ফুলাত থাকার পরামর্শ দিলেন। আমি আমার স্ত্রী ও ছোট বা‛চাদের সমস্যার কথা বললে তিনি বাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি কয়েক মাস ফুলাত এসে থাকলাম এবং আমার স্ত্রীর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কাজ করতে থাকি। তিন মাস পর আলহামদুলিল্লাহ! আমার স্ত্রীও মুসলমান হয়ে যায়।

প্রশ্ন. আপনার মা’র কী হল?

উত্তর: আমি আমার মাকে আমার মুসলমান হবার ব্যাপারে জানালে তিনি খুব খুশি হন এবং বলেন, তোর বাপের আত্মা এতে শান্তি পাবে। আমার মাও ঐ বছরেই মুসলমান হন।

 

প্রশ্ন:. এখন আপনি কী করছেন? উত্তর. বর্তমানে আমি একটি জুনিয়ার হাই¯স্কুল চালাচ্ছি। ¯স্কুলে ইসলামী শিক্ষার সাথে সাথে ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষারও ব্যবস্থা আছে।

প্রশ্নঃ. আব্বা বলছিলেন, আপনি হরিয়ানা, পাঞ্জাবসহ বিভিনড়ব জায়গায় অনাবাদী মসজিদক্সলো পুনরায় আবাদ করার জন্য চেষ্টা করছেন ?

উত্তর. ওমর ভাইয়ের সাথে মিলে একত্রে আমরা প্রোগ্রাম বানিয়েছি যে, আল্লাহর ঘর শহীদ করে আমরা যেই বিরাট গুনাহ করেছি তার কাফ্ফারা হিসেবে আমরা বিরান মসজিদগুলো আবাদ করব এবং নতুন নতুন মসজিদ বানাব। আমরা দু’জনে মিলে আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নেব। আমি বিরান মসজিদগুলো আবাদ করব আর ওমর ভাই নতুন নতুন মসজিদ বানাতে চেষ্টা চালাবেন এবং এ ব্যাপারে মসজিদ বানাবার ও সেগুলো লোকে ভরপুর করাবার কর্মসূচী হাতে নিলাম। আলহামদুলিল্লাহ! ২০০৪ ইং সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত এই পাপী ১৩টি বিরান ও অধিকৃত মসজিদ হরিয়ানা, পাঞ্জাব, দিল্লী ও মীরাট সেনানিবাস এলাকায় আবাদ করেছে। এব্যাপারে ওমর ভাই আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত সে বিশটি মসজিদ তৈরী করেছে এবং একুশতম মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেছে। আমরা উভয়ে এই সিদ্ধান্তও নিয়েছি, বাবরী মসজিদের প্রত্যেক শাহাদত বার্ষিকীতে ৬ ডিসেম্বর তারিখে একটি বিরান ও অনাবাদী মসজিদে অবশ্যই নামায শুরু করাতে হবে। আলহামদুলিল্লাহ! আমরা আজ পর্যন্ত কোন বছরেই এটা করতে ব্যর্থ হইনি। অবশ্য শ’য়ের লক্ষ্য পূরণ এখনও অনেক দূরে। আশা করছি এবছর এর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাবে। আটটি মসজিদ সম্পর্কে কথাবার্তা চলছে। আশা করি, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সেগুলো আবাদ হয়ে যাবে। ওমর ভাই অনেক আগেই তো লক্ষ্য অর্জনে আমার চেয়ে এগিয়ে আছে। আর আসলে আমার কাজও তো তারই ভাগে পড়ে। আমাকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসার মাধ্যম তো মূলত সেই।

প্রশ্ন:. আপনার খান্দানের কথা কিছু বলুন কী অবস্থা তাদের ?

উত্তর. আমার ছাড়া আমাদের পরিবারে আমার এক বড় ভাই আছেন। আমার ভাবী চার বছর আগে মারা গেছেন। ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল আমার বিয়ের পর। তাঁর চারটি ছোট ছোট বা‛চা আছে। একটি বা‛চা কিছুটা প্রতিবন্ধী ধরনের। আমার ভাবী ছিলেন খুবই ভালো মহিলা। আদর্শ স্ত্রীর মতোই তিনি ভাইয়ের সঙ্গে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন। ভাবীর মৃত্যুতে দুঃখে-শোকে ভাইটা আমার পাগল প্রায় হয়ে পড়েছিলেন। ভাবীর মৃত্যুর পর আমার স্ত্রী তাঁর ছেলমেয়েদের খুবই সেবা-যত্ন করে। আমার বড় ভাই ছিলেন খুবই শরীফ ও সজ্জন মানুষ। তিনি আমার স্ত্রীর সেবায় খুবই প্রীত হন। আমি তাকে ইসলামের দাওয়াত দেই। কিন্তু আমার আচরণে আমার পিতার দুঃখ ও মনোকষ্টের কারণে তিনি আমাকে ভালো মানুষ মনে করতেন না। আমি আমার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করলাম, আমাদের ছেলেমেয়েরা কিছুটা বড় হয়ে গেছে। আর আমার ভাই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে খুব বিপদে আছেন। বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে তাঁকে। ভালো হয় যদি আমি তোমাকে তালাক দিয়ে দিই আর ইদ্দত পালনের পর ভাই রাজী হলে মুসলমান হয়ে তোমাকে বিয়ে করল। এতে আমাদের উভয়ের জন্য নাজাতের ব্যবস্থা হতে পারে।

প্রথমে তো সে রাজী হয়নি এবং এ ধরনের প্রস্তাব তার কাছে খুবই খারাপ মনে হয়। কিন্তু আমি যখন তাকে আন্তরিক ভাবেই বোঝাতে চেষ্টা করলাম তখন সে রাজী হল। এ্ররপর আমি আমার ভাইকে বোঝালাম যে, এসব অবুঝ ছেলেমেয়ের জীবন বাঁচাবার স্বার্থে আপনি যদি মুসলমান হয়ে যান আর আমার স্ত্রীকে বিয়ে করেন তাহলে ক্ষতি কী? কেননা এমন মহিলা পাওয়া কঠিন হবে যে এসব বা‛চাকে মায়ের স্নেহ-মমতা দিয়ে লালন-পালন করবে। শুরুতে তিনি এপ্রস্তাব খুব খারাপ মনে করেন যে, লোকে কী বলবে? আমি বললাম, যুক্তি-বুদ্ধির নিরীখে কাজটি যদি সঠিক হয়, তাহলে তা মানতে ক্ষতি কি? আমাদের পরামর্শ হল। আমি আমার স্ত্রীকে তালাক দিলাম। ইদ্দত পালন শেষ হলে আমার ভাইকে কলেমা পড়িয়ে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলাম। আলহামদুলিল্লাহ! তাঁরা এখন খুব সুখে-শান্তিতে ঘর করছে। আমার ছেলেমেয়েরাও এখন সেখানে এক সাথেই থাকে।

প্রশ্ন. আপনি তাহলে একা থাকেন?

উত্তর. না, হযরত মাওলানার পরামর্শে একজন বয়স্ক নওমুসলিম মহিলাকে বিয়ে করেছি। আলহামদুলিল্লাহ! আমরাও আনন্দের সাথে দাম্পত্য জীবন যাপন করছি।

প্রশ্ন. আরমুগানের পাঠকদের জন্য আপনি কি কিছু বলবেন?

উত্তর. সকল মুসলমানের কাছে আমার একটিই নিবেদন আর তাহলো, নিজের জীবনের লক্ষ্য কি তা জেনে এবং ইসলামকে মানবতার আমানত মনে করে একে মানুষের কাছে পোঁছে দিই, পৌছে দেবার কথা ভাবি। কেবল ইসলামের প্রতি দুশমনীর কারণে তার থেকে বদলা নেবার প্রতিশোধ গ্রহণে উৎসাহিত না হই। আহমদ ভাই! আমি একথা একেবারে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বাবরী মসজিদ শাহাদতে অংশ গ্রহণকারী প্রত্যেক শিবসেনা, বজরং দলের সদস্যসহ সকল হিন্দু যদি এটা জানত যে, ইসলাম কী! মুসলমান কাকে বলে? কুরআনুল করীম কী? মসজিদ আসলে কোন বস্তুর নাম, তাহলে তাদের সকলেই মসজিদ নির্মাণের কথা ভাবতে পারত, মসজিদ ভাঙ্গার প্রশ্নই উঠতে পারতো না। আমি আমার প্রবল প্রত্যয় থেকে বলছি, বাল থ্যাকার, উইরে কুঠিয়ার যদি ইসলামের প্রকৃত সত্য ও মর্মবাণী জানতে পারে এবং জানতে পারে যে, ইসলাম (কেবল মুসলমানদের নয়) আমাদেরও ধর্ম, এটি আমাদের দরকার তাহলে তাদের প্রত্যেকেই নিজ খরচে বাবরী মসজিদ পূণর্বার নির্মাণ করাকে নিজেদের সে․ভাগ্য ভাববে।

আহমদ ভাই! সে যাকগে, কিছু লোকতো এমন আছে যারা মুসলমানদের প্রতি শত্রূতায় বিখ্যাত, কিন্তু এখন একশ কোটি হিন্দুর মধ্যে এমন লোক এক লক্ষও হবে না। সত্য কথা বলতে কি, আমি বোধহয় বাড়িয়ে বলছি, ৯৯ কোটি ৯৯ লক্ষ লোক তো আমার পিতার মত, যারা মানবতার বন্ধু বরং ইসলামী নীতিসমূহকে তারা অন্তর দিয়েই পছন্দ করে। আহমদ ভাই! আমার পিতা (কাঁদতে কাঁদতে) কি স্বভাবগতভাবে মুসলমান ছিলেন না? কিন্তু মুসলমানরা তাঁকে দাওয়াত না দেবার কারণে তিনি কুফরী অবস্থায় মারা গেছেন। আমার সঙ্গে, আমার পিতার সঙ্গে মুসলমানদের এ কত বড় জুলুম। এ কথা সত্যি যে, বাবরী মসজিদ যে শহীদ করেছে সেই আমার থেকে বড় জুলুমকারী জালিম আর কে হতে পারে? কিন্তু আমার চেয়েও বড় জালিম তো সেই সব মুসলমান যাদের দাওয়াতের ক্ষত্রে অলসতা ও অবহেলার দরুন আমার এমন প্রিয় বাবা আজ দোযখে চলে গেছেন। মাওলানা সাহেব সত্য বলেছেন, আমরা যারা বাবরী মসজিদ শহীদ করেছি তারা না জানার কারণে এবং মুসলমানদের না চেনার দরুন এমন জুলুম করেছি। আমরা অজানা ও অজ্ঞতার দরুন এ ধরনের জুলুম করেছি এবং মুসলমানেরা জেনে বুঝে তাদের দোযখে যাবার উপলক্ষ পরিণত হচ্ছে। আমার পিতার কুফরী অবস্থায় মারা যাবার কথা যখন রাত্রে মনে হয় তখন আমার ঘুম পালিয়ে যায়। সপ্তাহের পর সপ্তাহ আমার ঘুম আসে না। ঘুম আনবার জন্য আমাকে ঘুমের বড়ি খেতে হয়। হায়! মুসলমানদের যদি এই ব্যথার অনুভূতি হতো!

প্রশ্ন. বহুত বহুত শুকরিয়া, মাশাআল্লাহ্! আপনার জীবন আল্লাহর হাদী নামক সিফত এবং ইসলামের সত্যতার খোলা নিদর্শন।

উত্তর. নিঃসন্দেহ আহমদ ভাই। এজন্য আমার অভিলাষ ছিল যে, আরমুগানের পাতায় এ কাহিনী ছাপা হোক। আল্লাহ তা’আলা এর প্রকাশনাকে মুসলমানদের চোখ খুলবার মাধ্যম বানান। আমীন! আল্লাহ হাফেজ।

 

সাক্ষাৎকার গ্রহণে

মাওলানা আহমদ আওয়াহ নদভী

মাসিক আরমুগান, জুন ২০০৫ ইং