11.4 C
New York
Sunday, October 26, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 11

দু’আ-র ক্ষমতা

দুআ এমন এক অবিশ্বাস্য শক্তি যা অনেক সময় আমরা একেবারেই বুঝে উঠতে পারি নাকারণ,আমরা যদি বুঝতেই পারতামতবে আমাদের দুআ কবুল হওয়ার জন্য যা করা প্রয়োজন তাই করতাম। কখনও কখনও আমাদের দুআ সাথে সাথেই কবুল হয়আর কখনও কখনও আমাদের প্রত্যাশার চাইতেও বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। যাই হোকযদি সঠিকভাবে দুআ করা হয় তবে তা বদলে দিতে পারে আমাদের জীবন এবং নিয়ে আসতে পারে অভাবনীয় ফলাফল।

দুআ কবুল হওয়ার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই দুআ-র পেছনের ক্রিয়াকৌশল পুরোপুরি বুঝতে হবে। প্রথমত,আমাদের অবশ্যই সম্পূর্ণ বিশ্বাস থাকতে হবে যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের দুআ কবুল করবেনই। আমাদের মনে এ ব্যাপারে সামান্যতম দ্বিধাও যেন না থাকে যে আল্লাহ আমাদের সকল দুআ শুনছেন এবং আমাদের সকল আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সক্ষম

আমাদেরকে অবশ্যই এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে যে, আমরা যেন আমাদের দুআ-র ব্যাপারে আশাহত না হই এবং দুআ কবুল হওয়ায় বিলম্ব দেখে অধৈর্য না হয়ে পড়ি। আমাদের প্রতিনিয়ত নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যেআমাদের দুআ সমূহ কবুল হওয়ার একমাত্র চাবিকাঠি হল দুআ-য় অটল থাকা। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলআমাদের যেন এমন কোন পাপ না থাকে যার জন্য আমরা আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে তওবা করিনিকারণ এটা আমাদের দুআ কবুল হওয়ার পথে প্রথম বাধা হতে পারে;বিশেষ করে যদি সে পাপ অবৈধ উপায়ে উপার্জনের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকে।

একবার যদি এটা পুরোপুরি উপলব্ধি করা যায় এবং সেই অনুসারে কাজ করা যায়তবে এটা নিশ্চিত যে আপনি যা চান আল্লাহ আপনাকে তা-ই দান করবেন কিংবা তার চেয়েও উত্তম কিছু দিবেনআর হতে পারে আপনাকে আল্লাহ তা এমন উপায়ে দিবেন যা আপনি কখনও কল্পনাও করেননি।
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেনঃ
…আর যে আল্লাহকে ভয় করেআল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন। এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক দেবেন।…
[সূরা আত-তালাক্বঃ ০২-০৩]
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) আরও বলেনঃ
আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারেবস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করেতাদের প্রার্থনা কবুল করে নেইযখন আমার কাছে প্রার্থনা করে।…
[সূরাআল-বাক্বারাঃ ১৮৬]
এখন আমি একটি গল্প শোনাবো যা প্রমাণ করে দুআ কতটা শক্তিশালী হতে পারেআর আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) কত বিস্ময়করভাবে আমাদের দুআ-র জবাব দিতে পারেন। এই ঘটনাটিকে প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে না ধরে রূপক হিসেবে বিবেচনা করাই উত্তমঃ
ডাঃ সাঈদএকজন সুপরিচিত ডাক্তার। একবার তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ মেডিক্যাল কনফারেন্সের জন্য অন্য একটি শহরে যাচ্ছিলেনযেখানে তাকে চিকিৎসাক্ষেত্রে তার সাম্প্রতিক গবেষণার জন্য পুরস্কৃত করা হবে। এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে তিনি বার বার উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন এবং সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য তার যেন আর তর সইছিলো না। তিনি তার গবেষণা কাজে দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর পরিশ্রম করেছেনযার ফলে নিজেকে উক্ত পুরস্কারের যোগ্য দাবিদার বলে মনে করেন। যাই হোক,এক ঘন্টা পর প্লেন যখন যাত্রা করলপাইলট ঘোষণা করলেন প্লেনে সমস্যা আছে এবং তারা নিকটবর্তী এয়ারপোর্টে জরুরি অবতরণ করবেন।
সঠিক সময়ে সম্মেলনে যোগ না দিতে পারার আশঙ্কায় তিনি ভীত হয়ে পড়লেন এবং প্লেনটি অবতরণ করার সাথে সাথেই তথ্য সংগ্রহের ডেস্কের কাছে ছুটে গিয়ে রিসেপশনে থাকা মহিলাটিকে তার অতি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে যোগদানের কথা বললেন যাতে তারা তার গন্তব্যে পৌঁছার জন্য বিকল্প কোন ব্যবস্থা করতে পারে। মহিলাটি তাকে বললসাহায্য করার মতো বিকল্প কোন উপায় তার জানা নেই,কারণ পরবর্তী ষোল ঘণ্টার মধ্যে তার গন্তব্যের দিকে আর কোন ফ্লাইট যাবে নাতবে তিনি ইচ্ছে করলে গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন যা এখান থেকে মাত্র তিন ঘণ্টার পথ। আর কোন উপায় না দেখে ডাক্তার সাহেব গাড়ি ভাড়া করার সিদ্ধান্ত নিলেন যদিও দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চড়তে তিনি পছন্দ করেন না।
ডাক্তার সাহেব গাড়ি ভাড়া করে তার যাত্রা শুরু করলেন। কিন্তু যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পরই হঠাৎ আবহাওয়া বদলে গেল এবং প্রচণ্ড ঝড় শুরু হল। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে তিনি সামনের কোন কিছুই দেখছিলেন নাযার ফলে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য একটি বাঁক নেয়ার কথা থাকলেও তিনি ভুল করলেন। প্রায় দুঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর তিনি বুঝতে পারলেন তিনি হারিয়ে গেছেন। ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত অবস্থায়প্রচণ্ড বৃষ্টিতে জনমানবহীন রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে তিনি জনবসতির খোঁজ করছিলেন। কিছু সময় পর তিনি একটি ছোট কুঁড়ে ঘর দেখতে পেলেন। মরিয়া হয়ে তিনি গাড়ি থেকে নামলেন এবং ঘরের দরজায় কড়া নাড়লেন।
ছোটখাট একজন বয়স্কা মহিলা দরজা খুলে দিলেন। ডাক্তার সাহেব মহিলাকে তার অবস্থা সম্পর্কে জানালেন এবং তার টেলিফোনটি ব্যবহার করার অনুমতি চাইলেন। মহিলাটি তাকে বলল তার ঘরে টেলিফোন  কিংবা বিদ্যুৎ কোনটিই নেইতবে যেহেতু তিনি তার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন এবং খুঁজে পেতে কিছুটা সময় লাগবে তাই তিনি ইচ্ছে করলে ভিতরে এসে হালকা খাবার ও সামান্য উষ্ণ পানীয় গ্রহণ করতে পারেন। ক্ষুধার্তভেজা জামা-কাপড় এবং ক্লান্ত শরীর নিয়ে ডাক্তার সাহেব তার এই সদয় অনুগ্রহ গ্রহণ করলেন এবং ভিতরে প্রবেশ করলেন। মহিলাটি তার জন্য টেবিলে সামান্য খাবার এবং চা দিয়ে তার কাছে সালাত আদায় করার অনুমতি চাইলেন।
টেবিলে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে মোমবাতির মৃদু আলোতে ডাক্তার সাহেব দেখলেন মহিলাটি সালাত আদায় করছেআর তার সামনেই দেখা যাচ্ছে একটি ছোট শিশুর দোলনা। প্রতিবার সালাত শেষে তিনি পুনরায় শুরু করছেনআর মনে হচ্ছে সিজদায় গিয়ে তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে দুআ করছেন। মাঝে মাঝে তিনি মৃদুভাবে শিশুর বিছানাটিও দুলিয়ে দিচ্ছেন।
ডাক্তার সাহেব মনে করলেন মহিলাটির সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। তাই সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তিনি মহিলাটির সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজলেন এবং বললেন তিনি আশা করেন আল্লাহ তার (মহিলাটির) দুআ কবুল করবেন। তিনি বললেন সালাতের সময় মহিলাটিকে তিনি অনেক দুআ করতে দেখেছেন এবং তিনি মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলেন তার কোন কিছু প্রয়োজন কিনাহতে পারে তিনি তাকে তা পেতে সাহায্য করতে পারবেন। মৃদু হেসে মহিলাটি বললেন শুধুমাত্র একটি দুআ ছাড়া আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) তার সবগুলো দুআই কবুল করেছেন। বৃদ্ধাটি বললেন তিনি ঠিক বুঝতে পারেননি আল্লাহ কেন তখনও তার সেই দুআটি কবুল করেননি এবং এও বললেন হয়তো এটা তার দুর্বল ঈমানের কারণে
ডাক্তার সাহেব মহিলাটিকে বললেনযদি তিনি কিছু মনে না করেন তবে তাকে (ডাক্তার সাহেবকে) কী কীসের জন্য তিনি দুআ করছিলেন তা বলা যাবেমহিলাটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেনতিনি বললেন, বিছানায় থাকা শিশুটি তার নাতি এবং তার বাবা-মা দুজনই সম্প্রতি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে। তিনি বললেন শিশুটির এক বিশেষ ধরনের ক্যান্সার হয়েছে আর এ পর্যন্ত তিনি যত ডাক্তার দেখিয়েছেন কেউই তার চিকিৎসা করতে পারেনি। তিনি আরও বললেনডাক্তাররা তাকে বলেছেন একজন ডাক্তার আছেন যিনি এই রোগের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞসেই ডাক্তার অনেক দূরে থাকায় তার পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়তাই তিনি দিনরাত আল্লাহর কাছে দুআ করছেন যেন আল্লাহ তাকে ডাক্তার সাঈদ (যিনি তার নাতির চিকিৎসা করতে পারবেন) এর সাথে দেখা করার উপায় করে দেন।
তার কথা শুনে ডাক্তার সাহেবের চোখ অশ্রু সিক্ত হয়ে গেল এবং তিনি বললেনঃ সুবহান আল্লাহ,প্লেনে সমস্যাঝড়আমার রাস্তা হারিয়ে ফেলাআল্লাহ এসব কিছু ঘটিয়েছেন শুধুমাত্র আপনার দুআ কবুল হওয়ার মাধ্যমে ডাক্তার সাঈদের সাথে দেখা হওয়ার জন্য নয়বরং ডাক্তার সাঈদকে সরাসরি আপনার বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য। আমিই ডাক্তার সাঈদ।

অশ্রু সজল চোখে বৃদ্ধা হাত তুলে দুআ করতে লাগলেনঃ হে আল্লাহ! তুমি কত মহান ও দয়াময়!


মুল লেখক – যাইনীব শীবানি
অনুবাদ সহযোগীতা – ইমরান হেলাল

 

ট্যাক্সি ভ্রমণে তওবাহ (একটি ফিরে আসার গল্প)

২০০৪ সাল থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে আমি যখন কোন কাজ খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন সাময়িকভাবে একজন ট্যাক্সি চালক হিসেবে কাজ করতাম।

একদিন যখন আলেক্সান্দ্রিয়ার (মিশর) রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছিলাম, আর শাইখ মিশরী রশিদ আল-আফাসির কণ্ঠে সূরা আল হাদীদের (৫৭ নং সূরা) কিছু আয়াতের তিলাওয়াত শুনছিলাম, তখন ৬০ বছর বয়স্ক এক লোক আমাকে থামালো এবং বললো তাকে কারমুয (আলেক্সান্দ্রিয়ার নিকটবর্তী একটি প্রাচীন শহর) পৌঁছে দিতে। তিনি গাড়ীতে উঠে বসলে আমি তার গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করলাম।

রাস্তার প্রতি মনোযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি বুঝতে পারছিলাম লোকটি খুব বিরক্ত বোধ করছে। যার জন্য তিনি তার হাঁটু নাড়ছেন, হাত চুলকাচ্ছেন এবং বার বার ক্যাসেট প্লেয়ারটির দিকে তাকাচ্ছেন। শাইখ নিম্নোক্ত আয়াতগুলো পাঠ না করা পর্যন্ত তিনি একই কাজ করতে থাকলেন।

যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি? তারা তাদের মত যেন না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল। তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।
[সূরা আল-হাদীদঃ ১৬]

আর গল্পটির শুরু এখানেই।

লোকটি হঠাৎ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং হিস্টোরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো কাঁদতে লাগলেন। তিনি একেবারেই থামছিলেন না, আর তাই বাধ্য হয়েই তাকে শান্ত করার জন্য আমি রাস্তার পাশে গাড়ি থামালাম। আমি তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি কোন উত্তর দিচ্ছিলেন না; বরং তিনি শুধু ডুকরে ডুকরে কেঁদেই যাচ্ছিলেন।

আমি ভাবলাম কুর’আন তিলাওয়াতই হয়তো তার কান্নার কারণ, তাই আমি ক্যাসেট প্লেয়ারটি বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু লোকটি আমাকে সর্বশেষ আয়াতটি পুনরায় বাজাতে বললো। আর যখন আমি পুনরায় তিলাওয়াতটি বাজাতে শুরু করলাম লোকটি আবার কাঁদতে শুরু করলো।

শাইখ সম্পূর্ণ সূরাটির তিলাওয়াত শেষ না করা পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হলো। আর তারপরই লোকটি শান্ত হলো এবং তার ঘটনা বলতে লাগলোঃ

বাবা, আমাকে মাফ করো। আমার নাম মুস’আদ। এক সময় আমার হার্টের অসুখ ছিল এবং যখনই আমার হার্ট অ্যাটাক হতো আমার সন্তানেরা আমাকে পাশের বাড়ির ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতো। এক রাতে আমার হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হলো এবং বরাবরের মতোই আমরা তার কাছে গেলাম, কিন্তু তিনি ঘুমের ভান করে দরজা খুললেন না।

তাই আমার সন্তানেরা আমাকে একটি সরকারী হাসপাতালে নিয়ে গেলো। আর সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসার অবস্থা সম্পর্কে তুমি তো জানোই। যাই হোক, আমি আমার সন্তানদের বললাম আমার অবস্থা ভালোর দিকে। কারণ, পরদিন সকালে তাদের কাজ ছিলো, তাই আমি চাচ্ছিলাম তারা বাড়ি ফিরে যাক। বাড়িতে পৌঁছার পর আমার ব্যথা আরো বেড়ে গেল এবং আমি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। তাই আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাহাম্মাদিয়াহ্‌ (আলেক্সান্দ্রিয়ার একটি প্রাচীন খাল)- এর পাড়ে গিয়ে বসলাম।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি সালাত আদায় করে আল্লাহর কাছে দু’আ করতে থাকলাম এবং কাতরভাবে চাইলাম তিনি যেন আমাকে এই অসুখ থেকে সুস্থতা দান করেন। আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম এবং বললাম,

“হে আল্লাহ, তুমি আমাকে অসুস্থতা দিয়েছো কারণ আমি সালাত আদায় করি না; দয়া করে আমাকে সুস্থ্য করে দাও এবং আমি আর কোনোদিন এক রাকা’আত সালাতও ছাড়বো না।”

আমার ব্যথা আরো বেড়ে গেলো। আমি চিৎকার দিয়ে বললাম, “বন্ধ কর এটা! আমার জন্য কী তোমার খারাপ লাগছে না?!”

কিছুক্ষণ পর আমি কিছুটা স্বাভাবিক বোধ করলাম এবং ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়লাম। জেগে ওঠার পর আমি আগের চেয়ে অনেক ভালো বোধ করলাম। সেদিন থেকে আমি আর কোন ব্যথা কিংবা হার্টের সমস্যায় পড়িনি।

কিন্তু সেদিনের পর আমি এক রাকা’আত সালাতও আদায় করিনি।

তুমি যখন তিলাওয়াতটি বাজাচ্ছিলে, আমার মনে হচ্ছিলো আল্লাহ যেন আমার সাথে কথা বলছেন। সালাতের প্রতি আমার অবহেলার জন্য তিনি আমাকে কঠোরভাবে তিরষ্কার করছেন।

তুমি কি ভাবছো, তিনি আমাকে আবার অসুস্থ করে দিবেন এ ভয়ে আমি কাঁদছিলাম? নাহ! আল্লাহর কসম, আমি সে কারণে কাঁদছিলাম না। আমি শুধু নিজের সম্পর্কে বিভ্রান্ত ও লজ্জাবোধ করছিলাম। আল্লাহ আমার ইচ্ছাকে পূরণ করেছেন, কিন্তু আমি কখনোই আমার কথা রাখিনি।

উপলব্ধিঃ উপর্যুক্ত লোকটির মতো আমাদের অনেকেই বিপদের সময় আল্লাহকে স্মরণ করি এবং তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করি। কিন্তু যখনই আমাদের বিপদ কেটে যায় আল্লাহর কথা আমাদের আর মনে থাকে না। আর একজন প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য এমন হওয়া উচিত নয়। সর্বাবস্থায় আমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করতে হবে, তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে হবে এবং বার বার আমাদের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেন,

সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর;অকৃতজ্ঞ হয়ো না।

মহররম ও আশুরা : করণীয় ও শিক্ষা – মুফতী পিয়ার মাহমুদ

আরবী মাসসমূহের প্রথম মাসটি হলো মহররম। নানা কারণে এ মাসটি মুসলিম উম্মাহর কাছে খুবই গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। কুরআন-হাদীসের ভাষায় এ মাসটি আল্লাহর মাস এবং চার সম্মানিত মাসের অন্যতম। বিশেষ করে এ মাসের ১০ তারিখটির অর্থাৎ আশুরার রয়েছে ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও গুরুত্ব। এ দিনে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো, এ দিনে অসীম কুদরতের মালিক আল্লাহ তাআলা মুসা আ. ও তাঁর সঙ্গীদেরকে সাগরের মধ্যে রাস্তা করে পার করে দিয়েছিলেন। আর একই সাগরের একই রাস্তায় ফেরআউন ও তার অনুসারীদেরকে সলিল সমাধি করেছেন।

ইবনে আব্বাস রা. ইরশাদ করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় আগমনের পর দেখলেন, মদীনাবাসী আশুরার দিন রোযা রাখেন। এ প্রসঙ্গে তারা বললেন, এ দিনটি একটি মহান দিন। এ দিনেই আল্লাহ তাআলা মুসা আ. ও তাঁর সঙ্গীদেরকে সাগরের মধ্যে রাস্তা করে পার করে দিয়েছেন। আর একই সাগরের একই রাস্তায় ফেরআউন ও তার অনুসারীদেরকে সলিল সমাধি করেছেন। এ অনুগ্রহের শুকরিয়া হিসাবে মুসা আ. এ দিনে রোযা রেখেছিলেন। (তাই আমরাও এ দিনে রোযা রাখি) এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাদের চেয়ে মুসা আ.-এর বেশি ঘনিষ্ঠ আমি। এ কথা বলে আশুরার দিন তিনি নিজেও রোযা রাখলেন এবং সাহাবাগণকেও রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন। [বুখারী  :  ১/৪৮১]

এ দিনের আরেকটি হৃদয়বিদারক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, কারবালা প্রান্তরে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দৌহিত্র হযরত হুসাইন রা. এর মর্মমান্তিক শাহাদাত। এ জন্যও এ দিনটি মুসলিম উম্মাহর কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এ ছাড়াও মহররম মাস ও আশুরায় রোযা রাখার রয়েছে বিশেষ ফযীলত ও গুরুত্ব।

এ মাসে রোযা রাখার ফযীলত বর্ণনা করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘রমযানের পর আল্লাহর মাস মহররমের রোযা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।’ [মুসলিম : ২/৩৬৮, হাদীস ১১৬৩; তিরমিযী : ১/১৫৭, হাদীস ৭৪০]

তিরমিযী শরীফের এক বর্ণনায় আছে, হযরত আলী রা.-কে জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাস করলেন, রমযানের পর এমন কোন মাস আছে কি যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার নির্দেশ দেন ? আলী রা. বলেলন, জনৈক সাহাবী এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছেও করেছিলেন। তখন আমি তাঁর খিদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, রমযান ছাড়াও তুমি যদি রোযা রাখতে চাও, তাহলে মহররম মাসে রোযা রাখ। কারণ এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবূল করেছিলেন এবং ভবিষ্যতেও  অন্যান্য জাতির তওবা কবূল করবেন। [তিরমিযী : ১/১৫৭]

এর মধ্যে আবার আশুরার রোযার গুরুত্ব ও ফযীলত আরো বেশি। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রমযান ও আশুরার রোযা যেমন গুরুত্বের সাথে রাখতে দেখেছি, অন্য সময়ের কোন রোযাকে এত গুরুতে¦র সাথে রাখতে দেখিনি।’ [বুখারী : ১/২১৮,হাদীস : ২০০৬]

অন্য বর্ণনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, আশুরার রোযার ফলে তিনি অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।’ [তিরমিযী : ১/১৫৮,হাদীস  ৭৫২; মুসলিম : ১/৩৬৭]

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রেখে ইহুদিদের সাদৃশ্য বর্জন কর।’ [মুসনাদে আহমাদ : ১/২৪১, হাদীস ২১৫৪; সহীহ ইবনে খুযাইমা : হাদীস ২০৯৫; শুআবুল ঈমান : হাদীস ৩৫১১]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, ‘যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি, তাহলে অবশ্যই ৯ তারিখেও রোযা রাখব।’ [মুসলিম : ১/৩৫৯]

বলা বহুল্য যে, নবী দৌহিত্র হযরত হুসাইন রা.-এর কারবালা প্রান্তরে আশুরার দিন মর্মমান্তিক শাহাদাত ছিল উম্মাহর জীবনের অনেক বড় কষ্ট ও অসহনীয় ব্যাপার। এ কথাও নির্মম সত্য যে, তাঁর সাহচর্যধন্য সাহবাগনের বিশাল এক জামাত জীবিত থাকতে তাঁর অনুসারীদের কর্তৃক শহীদ হওয়া ছিল আরো যাতনা ও কষ্টের। এই যাতনা ও কষ্টকে পুঁজি করে হযরত হুসাইন রা. ও আহলে বাইতের প্রতি অতি দরদ ও দয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে এক শ্রেণীর বিপথগামী মানুষ ফযীলতে পরিপুষ্ট বর্ণিত আমলগুলোকে বর্জন করে আবিষ্কার করেছে ।

আশুরাকেন্দ্রিক নানা কুসংস্কার ও রসম-রেওয়াজ। যেগুলো কুরআন-হাদীসের আলোকে চরম নিন্দিত কাজ ও মারাত্মক অপরাধ বলে পরিগণিত। নিম্নে তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করছি।
এ সকল কুসংস্কারের অন্যতম হলো তাজিয়া। তাজিয়া মানে মহররমের শোক মিছিল বা র‌্যালিতে বাহিত হুসাইন রা. এর কাল্পনিক কবর। এ তাজিয়া কেন্দ্রিক ঈমান-আমল বিনষ্টকারী বহু পাপাচার হয়ে থাকে। একে কেন্দ্র করে কিছু শিরকী আকীদা ও আমলও প্রকাশ পায়। কোন কোন মূর্খ ও আপরিণামদর্শীর বিশ্বাস হলো, হযরত হুসাইন রা. নিজে হাজির হয়ে এ তাজিয়ায় সমাসীন হয়ে থাকেন। (নাউযুবিল্লাহ) এ আকীদা ও বিশ্বাসের বশবর্তী হয়েই তারা তাজিয়ার পাদদেশে বিভিন্ন রকমের নযর-নিয়ায পেশ করে থাকে। তাজিয়ার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ায়। এর দিকে পিঠ ফেরায় না। একে দেখতে যাওয়াকে যিয়ারত বলে আখ্যায়িত করে। এ সকল বিশ্বাস ও কর্ম মূলত শিরকের অন্তর্ভুক্ত। কারণ এই যে তাজিয়ার পাদদেশে নযর-নিয়ায পেশ করে। হাত জোড় করে দাঁড়ায়। তার দিকে পিঠ ফিরায় না। এগুলো তো এ বিশ্বাসেই করে থাকে যে, এই তাজিয়ায় হযরত হুসাইন রা. উপস্থিত। আর এ কথা কে না জানে যে, উপস্থিত হওয়ার জন্য পৃথিবীর যত স্থানে তাজিয়া বানানো হয়েছে সকল স্থানেই তাকে হাযির হতে হবে। এ বিশ্বাসের মূলকথা হলো, হযরত হুসাইন রা. সর্বত্র উপস্থিত হতে পারেন। হাযির তথা ‘সর্বত্র উপস্থিত এমন’ হওয়ার জন্য আলিমুল গায়েব হওয়া অপরিহার্য। কেননা, সর্বত্র উপস্থিত হওয়ার জন্য সে সম্পর্কে তার ইলম থাকতে হবে। অন্যথায় সময়মত সেখানে উপস্থিত হওয়া অসম্ভব। সে হিসাবে তাদের আকীদা মতে হুসাইন রা. আলিমুল গায়েবও।

অথচ কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট ভাষ্য ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা মতে, হাযির ও আলিমুল গায়েব এই গুণ দুটি কেবল মাত্র আল্লাহর। মানুষ বা অন্য কোন সৃষ্টি সে যত উর্ধ্বেরই হোক না কেন, এই গুণগুলোর অধিকারী সে হতে পারে না। এ সম্পর্কে কুরাআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসূল! আপনি বলুন, গায়েবের ইলম একমাত্র আল্লাহর জন্যই।’ [সূরা ইউনুস] অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী! আপনি বলুন, অদৃশ্যের সংবাদ আল্লাহ ছাড়া আকাশ-জমীনের আর কেউ জানে না।’ [সূরা নমল : আয়াত ৬৫]

আর শিরকের ব্যাপারে পরম দয়ালু আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাআলা তাঁর সাথে শরীক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্য সকল অন্যায়-অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন।’ [সূরা নিসা : ৪৮]
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করবে, অল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন এবং তার আবাস হবে জাহান্নাম।’ [সূরা মায়িদা : আয়াত ৭২]

এভাবে তাজিয়ার সামনে নযর-নিয়ায পেশ করাও হারাম, নাজায়িয ও শিরকের অন্তর্ভুক্ত। কারণ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে নযর-নিয়ায পেশ করা বাতিল, হারাম শিরকী কর্মের অন্তর্ভুক্ত। [রদ্দুল মুহতার : ২/৪৩৯; মাহমুদিয়া : ২/৪৩৪৯]

আশুরায় পালিত আরেকটি কুসংস্কার হলো, হযরত হুসাইন রা. এর শাহাদাতের শোকে মাতম করা আর শোকগাথা পাঠ করা। এক শ্রেণীর মানুষ এটি পালন করে অসীম গুরুত্ব ও বিপুল আগ্রহ নিয়ে। শরীয়তের দৃষ্টিতে কারো শোকে বা অন্য কোন কারণে এ জাতীয় কাজ-কর্ম হারাম ও নিষিদ্ধ। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আউফের রা. বর্ণনায় এসেছে, (তিনি ছিলেন বাইআতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহবীদের একজন) তাঁর একজন মেয়ে ইন্তিকাল করলেন। তিনি একটি খচ্চরে আরোহণ করে জানাযার পিছনে পিছনে যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় মহিলারা মাতম ও শোকগাথার মত করে কান্নাকাটি করছিলেন। তখন তিনি বললেন, ‘তোমরা মাতম ও শোকগাথার মত করে কেঁদো না। কেননা রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাতম ও শোকগাথা পাঠ করতে নিষেধ করেছেন।’ [মুসনাদে আহমাদ : হাদীস ১৯১৪০; ইবনে মাজা : হাদীস ১৫৯২]

শোকপালনও আশুরা উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ। আশুরা উপলক্ষ্যে এ শ্রেণীর লোকেরা সাজ-সজ্জা থেকে বিরত থেকে এ দিন শোক পালন করে থাকে। শরীয়তে এর কোন ভিত্তি নেই। কুরআন-সুন্নাহের বিধান মতে, স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন আর গর্ভবতী হলে গর্ভপাত পর্যন্ত স্ত্রী শোক পালন করবে। অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুতে সর্বোচ্চ তিন দিন শোকপালনের অনুমতি রয়েছ। শরীয়তের বিধান এতটুকুই। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মাঝে যারা মৃত্যুবরণ করবে আর রেখে যাবে নিজেদের স্ত্রীদেরকে, তখন সে স্ত্রীদের কর্তব্য হলো তারা চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে (অর্থাৎ সাজ-সজ্জা, আনন্দ-ফুর্তি, বিয়ে-শাদী ইত্যাদি বর্জন করে শোক পালন করবে)। [সুরা বাকারা : আয়াত ২৩৪]

উম্মুল মুমিনীন উম্মে হাবীবা রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,‘এমন নারী যে আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে তার জন্য স্বামী ছাড়া অন্য কারো মৃত্যুতে তিন দিনের বেশি শোকপালন করা হালাল নয়। কেবল স্বামীর মৃত্যুতেই সে চার মাস দশ দিন পর্যন্ত শোক পালন করবে।’ [বুখারী :  হাদীস ১২৮১, ১২৮২, ১২৮৩, ১২৮৪; মুআত্তা মালেক : ২২১৫, ২২১৬, ২২১৯; মুসনাদে আহমাদ : হাদীস ২৭৩৯৮; ইবনে মাজা, হাদীস : ২০৮৫, ২০৮৬]

বর্ণিত আয়াত ও হাদীসের আলোকে এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর উপর স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে চার মাস দশ দিন শোক পালন করা ওয়াজিব বা বাধ্যতামূলক। না করা বা কম করার কোন সুযোগ নেই। আর অন্যের মৃত্যুতে মৃত্যুর পর থেকে সর্বোচ্চ তিন দিন শোক পালনের অনুমতি রয়েছ। তিন দিনের পর বা এর বেশি করার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং এখন যারা প্রায় দেড় হাজার বছর পর হযরত হুসাইন রা. এর জন্য ১০ মহররম শোক পালন করেন, তাদের উদ্দেশ্য কি তা বোধগম্য নয়। নেপথ্যের কুশীলবরা দীনের প্রতি অতি দরদ দেখিয়ে দীন ধ্বংসের চক্রান্তে লিপ্ত কি না, তা খতিয়ে দেখার যথেষ্ট প্রয়োজন অনুভব হয়।

আশুরার দিন হযরত হুসাইন রা. এর জন্য শোক পালনের উদ্দেশ্যে অনেকেই বিশেষ রঙের পোশাকও পরিধান করে থাকে। এটিও নাজায়িয ও নিষিদ্ধ। ইবনে মাজার এক বর্ণনায় আছে- ‘একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক জানাযায় গিয়ে দেখলেন যে, লোকজন শোক পালনের উদ্দেশ্যে এক বিশেষ ধরনের পোশাক পরিহিত অবস্থায় আছে। এ অবস্থা দেখে তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, তোমরা কি জাহেলী যুগের কাজ শুরু করেছ, নাকি জাহেলী প্রথার অনুসরণ করেছ ? আমার ইচ্ছা হচ্ছিল, তোমাদের জন্য এমন বদ দুআ করি, যেন তোমাদের চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। এ কথার সাথে সাথে সবাই নিজ নিজ শোকের পোশাক খুলে ফেলে দিয়ে তওবা করে নিলেন।’ [ইবনে মাজা]

শোক মিছিল ও শোক র‌্যালি বের করাও আশুরা দিবসের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এক শ্রেণীর মানুষ এ দিনে শোক পালনের উদ্দেশ্যে বিশেষ রঙের পোশাক পরিধান করে ঢাল-তলোয়ার, খঞ্জর, ঢোল-তবলা ইত্যাদি নিয়ে শোকমিছিল ও শোকর‌্যালি বের করে। সেই শোক মিছিল বা র‌্যালিতে হায় হুসাইন! হায় হুসাইন! এর রব উঠে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজের গায়ে নিজে আঘাত করে নিজেকে রক্তাক্ত করে। মুখ চাপড়ায়, গায়ের কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। অথচ এর প্রত্যেকটি কাজই ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর বাচনিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তারা আমাদের দলভুক্ত নয়, যারা শোক ও বিপদাপদে মুখে আঘাত করে, কাপড় ছিঁড়ে বা জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে।’ [বুখারী : হাদীস ১২৯৭,  ১২৯৮; মুসলিম : হাদীস ১০৩; তিরমিযী : হাদীস ৯৯৯]

অন্য বর্ণনায় আছে-ইয়াযীদ ইবনে আউস র. বলেন, আমি আবু মুসা আশআরী রা. খিদমতে উপস্থিত হলাম। তখন তিনি কঠিন কোন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ফলে তাঁর স্ত্রী কাঁদতে উদ্যত হলেন। এটা দেখে আবু মুসা আশআরী রা. তাকে বললেন, তুমি কি শুননি এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেছেন ? স্ত্রী বললেন, হ্যাঁ, শুনেছি। এ কথা বললে তিনি চুপ হয়ে গেলেন।

ইয়াযীদ ইবনে আউস রহ. বলেন, এরপর আবু মুসা আশআরী রা. ইন্তিকাল করলে আমি তাঁর স্ত্রীর খিদমতে উপস্থিত হয়ে তাঁকে বললাম, আপনি কাঁদতে গেলে ‘তুমি কি শুননি এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেছেন ? এ কথা বলে আবু মুসা আশআরী রা. আপনাকে কি বলেছেন যে আপনি না কেঁদে একেবারে চুপ হয়ে গেলেন। স্ত্রী বললেন, সে কথাটি হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,‘তারা আমাদের দলভুক্ত নয়, যারা শোক ও বিপদাপদে চুল ছেঁড়ে, আহাজারী করে আর চিল্লিয়ে চিল্লেয়ে কান্নাকাটি করে এবং কাপড় ছেঁড়ে ।’ [আবু দাউদ, হাদীস : ৩১৩০; বুখারী, হাদীস : ১২৯৬; মুসলিম, হাদীস : ১০৪]

যে দীনের জন্য হুসাইন রা. প্রাণ দিয়ে গেলেন, সেই দীনের প্রাণপুরুষ, স্বয়ং হুসাইন রা.-এর নানা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মুখনিসৃত এত কঠোর ও সতর্কমূলক বাণী সত্ত্বেও কি মতলবে, কিশের নেশায় এই নিষিদ্ধ কাজগুলো তারা মহা আয়োজনে করেন, তা কোটি টাকার প্রশ্ন। অথচ শোক-দুঃখ ও বিপদাপদে দয়াল নবীর শিক্ষা হচ্ছে, (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পুত্র ইবরাহীমের মৃত্যুর সময় বলেছিলেন আর তখন তাঁর দু-চোখ দিয়ে কান্নার অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল) ‘নিশ্চয় চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না, যা আমাদের রবের কাছে পছন্দনীয় নয়। হে ইবরাহীম! তোমার শোকে আমরা কাতর ও ব্যাকুল।’
[বুখারী, হাদীস : ১৩০৩; মুসলিম, হাদীস : ২৩১৫;আবু দাউদ, হাদীস : ২৩১৫; আহমাদ, হাদীস : ১৩০১৪; ইবনে মাজা, হাদীস : ১৫৮৯]

অনেকেই আবার (বিশেষ করে মহিলারা) আশুরার দিন হুসাইন রা. এর শোকে আহাজারী করেন, বিলাপ করে কান্নাকাটি করেন। এটিও নাজায়িয ও নিষিদ্ধ। সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রা বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আহাজারী-বিলাপকারী এবং তা শ্রবণকারীর উপর অভিশাপ করেছেন।’ [আবু দাউদ,হাদীস : ৩১২৮; মুসলিম,হাদীস : ৯৩৪; আহমাদ, হাদীস :   ১১৬২২; ইবনে মাজা, হাদীস : ১৫৮২]

আশুরায় অন্য সকল আয়োজনের সাথে গান-বাজনার আয়োজনও কারা হয়। এ দিন বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঢোল-তবলা ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে হুসাইন রা. ও আহলে বাইতের নামে বিভিন্ন রকমের শোক প্রকাশক গান-বাজনা করা হয়। অথচ ইসালামে গান-বাজনা হারাম ও ভয়াবহ অপরাধ। কোন নবীর যুগেই তা জায়িয ছিল না। এ উম্মতের জন্যও কোনক্রমেই জায়িয নয়। কুরআন-সুন্নাহয় গান-বাজনাকারীর ও শ্রবণকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির হুসিয়ারী এসেছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এক শ্রেণীর লোক এমন রয়েছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশে ‘লাহওয়াল হাদীস’ তথা অবান্তর কথাবার্তা ক্রয় করে অন্ধভাবে এবং তা নিয়ে করে ঠাট্টা-বিদ্রপ। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ [সূরা লুকমান : ৬]

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস, জাবের রা., ইমাম বুখারী, বায়হাকী, ইবনে জারীর প্রমুখ আয়াতে উল্লেখিত ‘লাহওয়াল হাদীস’ এর তাফসীর করেছেন গান-বাজনা করা। অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী ও তাফসীরবিদগণ এর তাফসীর করতে গিয়ে বলেছেন, ‘গান-বাজনা, বাদ্যযন্ত্র, অনর্থক গল্প, উপন্যাস ও কিস্যা-কাহিনীসহ যে সকল বিষয় মানুষকে আল্লাহর ইবাদত ও স্মরণ থেকে গাফেল করে দেয়, সে সবই ‘লাহওয়াল হাদীস’ এর অন্তর্ভুক্ত।’ [মাআরিফুল কুরআন : ৭/৪] মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম বলেন, ‘আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। তাদের সামনে গায়িকারা গান করবে বিভিন্ন ধরণের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে। আল্লাহ তাআলা এদেরকে ভূগর্ভে বিলীন করে দিবেন আর কতকের আকৃতি বিকৃত করে বানর ও শূকরে পরিণত করে দিবেন।’
[তাবরানী-কাবীর : ৩৪১৯; শুআবুল ঈমান,বায়হাকী হাদীস : ৪৭৫৯; ইবনে মাজা : ২/ ৪০২০; ইবনে হিব্বান, হাদীস :  ৬৭৫৮]

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ইবনে আব্বাসের রা. বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা মদ, জুয়া-তবলা ও সারেঙ্গী হারাম করেছেন।’ [আবু দাউদ,হাদীস : ৩৬৮৫]

এছাড়াও বহু প্রমাণ ও নির্ভরযোগ্য হাদীস রয়েছে যাতে গান-বাদ্য হারাম ও নাজায়িয বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে রয়েছে বিশেষ সতর্কবাণী ও কঠিন শাস্তির ঘোষণা। তাই এ ব্যাপারে সকলের সতর্ক থাকা উচিত। অনেক স্থানে এ দিনে নিজ বাচ্চাদেরকে ভিক্ষুক সাজিয়ে ভিক্ষা করানো হয়। তাদের বিশ্বাস হলো, এ কাজ করালে বাচ্চা দীর্ঘায়ু হয়। এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত আকীদা ও ভিত্তিহীন বিশ্বাস। ইসলামে এ সকল আকীদা-বিশ্বাসের কোন স্থান নেই। আশুরায় উদযাপিত কুসংস্কারগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন হলো খিচুড়িভোজ। হযরত হুসাইন রা. এর জন্য ঈসালে সাওয়াব করার উদ্দেশ্যে এ দিন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে টাকা-পয়সা, চাল-ডাল ইত্যাদি উঠিয়ে খিচুড়িভোজের আয়োজন করা হয়। এই খিচুড়ি বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও ফকীর-মিসকীনদের মাঝে বিলানো হয়। এভাবে এই আয়োজন করা নিষিদ্ধ। কারণ এতে আহলে বাইতের চরম মানহানী হয়। কারণ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন দুজাহানের বাদশা আর তাঁর বংশের লোকজন হলেন বাদশার পরিবার। বিশেষ করে নবী দৌহিত্র হাসান-হুসাইন রা. হলেন জান্নাতের যুবকদের সরদারও। সুতরাং বাদশার পরিবারের জন্য বিশেষত হুসাইন রা. এর জন্য এভাবে চাঁদা তোলে ঈসালে সওয়াব করা অবশ্যই চরম মানহানিকর। এ ছাড়াও যিনি জান্নাতের যুবকদের সরদার হবেন তিনি কি এভাবে মেগে চাঁদা উঠিয়ে ঈসালে সওয়াব করার মুহতাজ হবেন? মোটেই নয়। এদের বিবেক-বুদ্ধি দেখে সত্যিই বড় করুণা জাগে। দ্বিতীয়ত এটা করাকে জরুরী মনে করা হয় আর কোন মুস্তাহাব বা মুবাহ কাজকে জরুরী মনে করলে তা যে নিষিদ্ধ কাজে পরিণত হয় তা তো সকলেরই জানা। তৃতীয়ত এটা মূলত মৃত্যুবাষির্কী পালন। আর মৃত্যুবাষির্কী পালন যে ইসলামে নিষিদ্ধ তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
[রদ্দুল মুহতার :  ৩/১৩৮-১৩৯। আরও দেখুন, বাযযাযিয়া আলা হামিশিল হিন্দিয়া :  ৪/৮১]

এ সকল কারণে এই খিচুড়িভোজের আয়োজন নাজায়িয ও নিষিদ্ধ হবে। তবে কেউ যদি স্বউদ্যেগে বর্ণিত নিষিদ্ধ পন্থা এড়িয়ে সহীহ পন্থায় হুসাইন রা. এর জন্য ঈসালে সাওয়াব করেন, তাহলে তা জায়িয হবে এবং নিঃসন্দেহে ঈসালে সাওয়াবকারীও নেকী প্রাপ্ত হবেন। এ দিন এ উপলক্ষ্যে গণহারে শরবত পান করানো হয়। এতে তাদের বিশ্বাস হলো, কারবালার শহীদগণ যেহেতু পিপাসিত অবস্থায় শহীদ হয়েছেন, তাই তাদের পিপাসা নিবারণের জন্য শরবত পান করানো উচিত। এ বিশ্বাসও সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন। এ সকল বোধ-বিশ্বাসের ইসলামে কোন স্থান নেই। পাঠক! আত্মবিস্মৃত ও গাফেল মুসলিম উম্মাহ ফযীলতে পরিপুষ্ট মহররম ও আশুরাকে এভাবেই অপসংস্কতি ও রসম-রেওয়াজের নষ্ট জালের অক্টোপাসে আবদ্ধ করেছে বড় নির্দয়ভাবে। সকল ক্ষেত্রেই উম্মাহর এই দুর্দশা দেখে বড় কষ্ট হয়। সেই কষ্টের তাকাদা থেকেই বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের অবতারণা। উদ্দেশ্যে, উম্মাহ যেন হক-বাতিলের পার্থক্য বুঝতে পারে। উপলব্ধি করতে পারে এ ক্ষেত্রে ইসলমের শিক্ষা এবং হৃদয়াঙ্গম করতে পারে নিম্নের বিষয়গুলো।

১. মহররম আল্লাহর মাস। ফলে এ মাসের গুরুত্ব অভাবনীয় এবং তাতে নফল ইবাদতের ফযীলত অতুলনীয়। তাই এ মাসে বেশি বেশি নফল ইবাদত করা দরকার। বিশেষ করে ৯-১০ বা ১০-১১ তারিখে দুটি রোযা রাখা এ মাসের বিশেষ আমল। যা আমরা পূর্বেই জানতে পেরেছি।

২. বর্ণিত রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারগুলো নিজে পরিহার করা এবং সমাজ থেকে এগুলো নির্মলে সবিশেষ যত্নবান হওয়া।

৩. আশুরায় হুসাইন রা. এর শোকে ব্যাকুল ও কাতর হয়ে বর্ণিত রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারগুলোতে না জড়িয়ে তাঁর শাহাদাতের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করা। তাঁর শাহাদাতের প্রকৃত শিক্ষা হলো, বাতিল ও তাগুতি শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে তা প্রতিহত করতে প্রাণপণ চেষ্টা করা। এতেই নিহিত রয়েছে উম্মাহর মুক্তি ও শক্তি। তাই বলি, বিদূরিত হোক সকল মহররমী রসম-রেওয়াজ আর কুসংস্কার। নির্মল ও সজিব হয়ে উঠুক বিশ্বদরবার। মুহাম্মাদী আভায় আলোকিত হোক মুমিনের প্রাণ। হুসাইনী চেতনায় ঝলসে উঠুক মুমিনের ঈমান।


মুফতী পিয়ার মাহমুদ
ধর্মীয় গবেষক, গ্রন্থ প্রণেতা ও মুহাদ্দিস
জামিয়া মিফতাহুল উলুম, নেত্রকোনা

সমকামিতা , যেসব কারণে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না – আলি মোস্তাফা

মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, “খারাপ মানুষদের কারনে সমাজ ধ্বংস হয় না, বরং সমাজ ধ্বংস হয় খারাপ কাজ দেখেও ভালো মানুষদের নীরবতায়।” এই উক্তিটা সমকামিতা-বিতর্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সমকামিতা অবশ্যই খারাপ। এর কোনো উপকারিতা নেই, কিন্তু অপকারিতা প্রচুর। এমনকি যারা সমকামিতা সমর্থন করছেন, হয়ত তাদের অনেকেই সমকামের ধারেকাছেও যান নি, যাবেনও না। অথচ মুক্তমনা সাজতে তারা এই অপকর্মকে সমর্থন করছেন। আবার উল্টোটাও রয়েছে, কেউ কেউ মনের পশুত্বকে (সমকামের চাহিদা) এতদিন চাপা দিয়ে রাখলেও এই রায়ে তারা উৎফুল্ল, তাই সমকামিতার সপক্ষে বিতর্ক করেই যাচ্ছে, কিন্তু লজ্জাবশত তারা নিজেকে সমকামী বলে ঘোষণা করছে না! আসলে এরাও জানে, সমকামিতা খারাপ। কিন্তু দুঃখজনক হল, কেউ কেউ আবার মনে মনে ঘৃণা করলেও তাদের মতে, যার যা খুশি করুক, তাতে আমার কি? অথচ এই ধারণা ভুল। এই ধারণাই মানুষকে খারাপ কাজ করতে উৎসাহিত করে। তাই প্রত্যেকেরই উচিৎ খারাপের বিরুদ্ধে লড়াই করা। একটাবার ভাবুন তো, আজ যারা শিশু, তাদের জন্য আমরা কতটা সুস্থ সমাজ রেখে যাচ্ছি? তাদেরকে সুস্থ সমাজ উপহার দিতে আমরা কতটা সচেষ্ট?

কিন্তু বেশিরভাগ লোক চুপ করে থাকলেই তো আর আমি চুপ করে থাকতে পারি না।
“এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”

তাই আমার এই লেখা। লেখাটি পড়ার পর যদি সমকামীরা, সমকামিতার সমর্থকরা তাদের ভুল বুঝতে পেরে সঠিক পথ ও মত অনুসরণ করেন, তাহলেই আমার লেখা সার্থক মনে করবো।

যেসব কারণে সমকামিতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না

1.
কিছু সমকামীর দাবী হচ্ছে সমকামিতা বিষম-যৌনতার মতই প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক বিষয়। অথচ তাঁদের এইদাবী ভিত্তিহীন।

A) এরা দূরবীন দিয়ে খুঁজে খুঁজে কিছু প্রানী আবিষ্কারকরেছে যারা নাকি সমকামী। হয়ত তাদের এই দাবী সঠিক যে, কিছু প্রানী সমকামী।

i) কিন্তু ব্যতিক্রম কখনোই নিয়ম হতে পারে না। বরং ব্যতিক্রম ‘নিয়ম’কেই প্রতিষ্ঠিত করে। সুতরাং সমকামিতা কোনোভাবেই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক নয়।

ii) তাছাড়া কিছু পশুর মধ্যে সমকামিতা থাকলেই তা মানুষের মধ্যেও প্রচলন করতে হবে? মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের মধ্যেও যদি জোর করে পশুত্ব আনা হয়, তাহলে আর মনুষ্যত্ব কোথায় থাকলো? সুতরাং পশুর পশুত্ব কখনো মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক বিষয় হতে পারে না।

iii) কিছু পশু রয়েছে যারা নিজেদের বিষ্ঠা খায়। এটা তাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই বলে মানুষও নিজেদের বিষ্ঠা খাওয়া শুরু করবে? তবে কেউ যদি খেতে চায়, তাহলে সভ্য সমাজের মানুষদের কিছুই করার নেই। কিন্তু যুক্তির নামে অযুক্তি দিয়ে সেটাকে বৈধ করার চেষ্টা অন্যায় ছাড়া কিছুই নয়।

সুতরাং কিছু প্রাণী সমকাম করে বলে এটা মানুষের মধ্যেও চালু করার মধ্যে মধ্যে কোনো যৌক্তিকতা নেই।

B] পশুদের মধ্যে জোর করে যৌন সঙ্গম খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। গ্রামে যাদের বাড়ি, তারা হয়ত খেয়াল করে দেখেছেন যে মোরগ অনেকসময়েই মুরগীর সাথে জোর করে সঙ্গম করে থাকে। তাহলে কি মানুষের মধ্যেও এটা স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বিষয় হওয়া উচিৎ? কিংবা এইসব প্রানীকে অনুসরণ করা উচিৎ।
বরং জীবগজগতে যত সমকামী পশু রয়েছে, তার চেয়ে অনেকগুণ পশু রয়েছে যারা জোর করে যৌন সঙ্গম করে। এমনকি শুকরের মত কিছু প্রানী আবার সঙ্গীনির সাথে যৌনসঙ্গমের সময় তার আরও বেশকিছু পুরুষ সঙ্গীকে ডেকে আনে, মানবসমাজে যেটা গ্যাংরেপ হিসেবে পরিচিত ও ঘৃণিত।
অর্থাৎ পশুজগতে এসব খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তাহলে তো এই যুক্তিতে বলতে হয় ধর্ষণও স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম। কিন্তু মানুষের জন্য আসলেই কি তাই?

C) সমীক্ষা করলে দেখা যাবে গ্রামের চেয়ে শহরে সমকামিতার হার বেশী। এই তথ্যটাই প্রমাণ করে সমকামিতা স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক নয়, বরং তা হতে পারে রাজনৈতিক। হতে পারে সুস্থ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে একটি পুঁজিবাদী চাল। কিংবা হতে পারে মানসিক অসুস্থতা।

D) এদের একটা অংশ এব্যাপারে দাবী করে যে মানুষের মধ্যে জন্মগতভাবেই ‘Gay Gene’ থাকে। যার কারণে একটা সময় এরা সমকামী হয়ে ওঠে। অর্থাৎ সমকামিতা সহজাত ও জন্মগত বৈশিষ্ট্য। অথচ তাঁদের এই দাবীও ভিত্তিহীন। বিশ্বের একাধিক বিজ্ঞানীই দাবী করেছেন এরকম কোনো জিনের অস্তিত্ব নেই। কয়েকবছর আগে আমেরিকার বিখ্যাত জনহপকিন্সের দুই বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিক প্রায় ২০০সায়েন্টিফিক জার্নাল ঘেটে নিউ অ্যাটলান্টিক নামকজার্নালে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, যেখানে তাঁরাদেখিয়েছেন, সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের সাথে সহজাত, জন্মগত বা বায়োলজিক্যাল যে সম্পর্ক এতদিন ভাবাহত, তার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। কিছুবায়োলজিক্যাল ফ্যাক্টর রয়েছে যার সাথে লৈঙ্গিকআচরণগত সম্পর্ক আছে কিন্তু সেটা কোনোমতেইসেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনে ভূমিকা রাখে না। অর্থাৎসমকামিতা কোনোমতেই জীনগত, জন্মগত, প্রাকৃতিকবিষয় নয়।

সাথে উল্লেখ্য, ভারতের কিছু বিজ্ঞানী (এমনকি খড়গপুর আইআইটি-এর এক অধ্যাপকও) দাবী করেছেন গোমূত্রের মধ্যে অনেক গুণ রয়েছে। বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে গোমূত্র পান করা প্রমোট করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবেই কি গোমূত্র পান করা মানুষের পক্ষে ভালো? ভেবে দেখুন তো। আসলে নিজেদের মানবতাবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কখনো কখনো বিজ্ঞানীদেরকে কাজে লাগানো হয়।

2.

সমকামীদের আর একটা অংশ অবশ্য প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক ইত্যাদি যুক্তি দিতে চায় না। বরং তাদের দাবী হল আমাদের ইচ্ছে, তাই আমরা সমকামী, পায়ুকামী। এটাকে তারা স্বাধীনতা মনে করে। অথচ অবাধ স্বাধীনতা কখনোই সমাজ ও দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। সমকামীদের এই যুক্তির সাহায্যে মদ খাওয়া, সিগারেট খাওয়া, জোর করে সঙ্গম ইত্যাদির স্বাধীনতার দাবী তোলা অস্বাভাবিক নয়। যেমন কয়েকবছর আগে কেউ (সে যেই হোক না কেন, সেটা বড় কথা নয়) টুইটারে টুইট করেছিল “Rape is surprise sex.” বাস্তবেই ধর্ষকরা ধর্ষণকে বিনোদন বলেই মনে করে। এমনকি অনেক মেয়েও তাই মনে করে! সুতরাং এই ধর্ষণকে লিগ্যাল করার দাবীটা কি খুব অযৌক্তিক? একইভাবে সিগারেট ও মদের ব্যাপারটাও। দেশের অনেক জায়গাতেই সিগারেট ও মদ নিষিদ্ধ। সেখানেও কি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে এগুলি চালু করা উচিৎ? আমি মনে করি, না, কখনোই না। মানবিক কারণেই সিগারেট ও মদ নিষিদ্ধ হওয়া উচিৎ। সিগারেট ও মদে যিনি আসক্ত, তার শারীরিক ক্ষতি হয়, পারিবারিক অশান্তি হয়, খুন, ধর্ষণের মত অনেক অপরাধই হয় মদের কারণে। সুতরাং মদ নামক তরলটি কিছু মানুষের প্রিয় হলেও তা নিষিদ্ধ হওয়াই উচিৎ।

অবশ্য সমকামীদের বেশিরভাগই মদ ও সিগারেটে আসক্ত। সুতরাং তারা স্বাধীনতার নামে মদ-সিগারেটও নিষিদ্ধ হওয়ার বিরোধিতা করবেন, তা স্বাভাবিক। কিন্তু যারা সমকামী নন, তারা ভেবে দেখুন তো আসলেই কি স্বাধীনতার নামে এগুলি সমাজে চালু থাকা উচিৎ?

আবার ফ্রান্সে স্বাধীনতার নামে পেডোফিলিয়া বা শিশুদের সাথে যৌনমিলনকেও বৈধ করা হয়েছে। তাহলে কি ভারতেও স্বাধীনতা ও আধুনিকতার নামে শিশুদের সাথে যৌনমিলন বৈধ করা হবে? নাস্তিকদের গুরু রিকার্ড ডকিন্সও ‘হালকা লেভেলের শিশুকামিতা’কে ক্ষতিকর মনে করেন না। তারমানে এটা অন্যায় নয়?

“সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পায়ুকামিতার চেয়ে ‘ক্রাইম; তথা চুরি, ডাকাতি, খুন খারাবি অধিকতর যৌক্তিকভাবে বৈধতার দাবী রাখে। পায়ুকামিতার সাথে কোনো ধরণের জেনেটিক ব্যাপার নেই, অন্যদিকে ‘ক্রাইম’ এর জন্য দায়ী জিন শনাক্ত করা হয়েছে।

অর্থাৎ বিজ্ঞানের দাবী অনুযায়ী ক্রাইম তথা সহিংসতার জন্য আপনি দায়ী না, বরং আপনার জিন দায়ী। যত ক্রাইমই করেন না কেন, বলে দিবেন এটা আপনি নিজের ইচ্ছায় করেন নি, আপনার জিন আপনাকে দিয়ে করিয়েছে…সুতরাং পায়ুকামিতা বৈধতা পেল, ‘ক্রাইম’ কেন বৈধ হবে না? বিজ্ঞানের আলোকে জবাব চাই।“ন [সাইফুর রহমান, গবেষক, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি]

3.

উপরিউক্ত পয়েন্টগুলি থেকে এটা স্পষ্ট যে সমকামিতা কোনো প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক বিষয় নয়। বরং এটাএকটা মানসিক বিকৃতির পরিণাম। কিন্তু অনেকে আবার এটাকে আধুনিকতা ভাবেন। পত্রপত্রিকায় প্রচার করা হচ্ছে, মধ্যযুগীয় নিয়ম বাতিল করে আধুনিকতার পথে ভারত। অথচ সমকামিতা আদৌ আধুনিক বিষয় নয়, বরং প্রাচীনযুগীয়। ইউরোপে হয়ত এটা হাল আমলে প্রচলন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইজরায়েল/প্যালেস্তাইনে সমকামিতার প্রচলন হয় কয়েক হাজার বছর আগেই, লুত আঃ-এর আমলে। পরবর্তীতে বৈদিক যুগের বিভিন্ন সাহিত্য থেকে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে সেসময় অর্থাৎ আজ থেকে ৩ হাজার বছর আগে ভারতে সমকামিতার প্রচলন ছিল। তারপর মধ্যযুগে এটা বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং সমকামিতা বৈধ করে ভারত আধুনিক যুগে নয়, বরং মধ্যযুগ ছাড়িয়ে প্রাচীনযুগে পৌঁছে গেল!

এখানে উল্লেখ্য, প্রাচীনযুগে ভারতে সমকামিতা থাকার পাশাপাশি ছিল যথেচ্ছ যৌনাচার, অশ্লীলতা। নারীদেরকে দেবদাসী হিসেবে রাখা হত। এক নারী একাধিক পুরুষের সাথে কিংবা এক পুরুষ একাধিক নারীর সাথে, বাবা মেয়ের সাথে জোর করে, গুরুর ছাত্র গুরুর স্ত্রীর সাথে জোর করে যৌনমিলন করতো। সমাজে নারীদের কোনো সম্মান ছিল না। বিশেষ করে যৌনতার ক্ষেত্রে তো নয়ই। আজ আমরা ইউরোপ, আমেরিকাতেও এটাই দেখতে পাই। নারীদেরকে পণ্য ছাড়া আর কিছু ভাবা হয় না। সমকামিতা বৈধ করার ফলে এদেশেও এরকম সমস্যা দেখা দেবে, যা সমাজ ও দেশের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক।

অন্যদিকে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই ইউরোপ-আমেরিকা-জাপানকে আধুনিকতার মাপকাঠি হিসেবে দেখেন। ইউরোপের উন্নত দেশগুলিতে চালু হয়েছে, সুতরাং এখানেও চালু হতে হবে, ভাবখানা এমন। অথচ এটা কোনো যৌক্তিক কারণ হতে পারে না। আগেই বলা হয়েছে, ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলিতে নারীকে ‘পণ্য’ মনে করা হয়। এর হাজার উদাহরণ দেওয়া যায়। এবিষয়ে নাহয় অন্য সময় আলোচনা করা যাবে। শুধু জাপানের মত উন্নত দেশের একটা উদাহরণ দেই। সেদেশের অনেক বড় বড় অনুষ্ঠানে, বড় বড় হোটেলে অতিথিদেরকে খাবার দেওয়া হয় উলঙ্গ নারীর ‘উন্মুক্ত শরীরের উপরে’। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। উন্মুক্ত শরীরের উপর খাবার রাখা হয়, আর সেই নারী থাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ, সেই নারীর শরীর থেকে খাবার তুলে খান অতিথিরা। এটা কি নারীর অপমান নয়? এখানে কি তাঁকে পণ্য হিসেবে জাহির করা হচ্ছে না? কিন্তু না, জাপানে এটাকে অসম্মানজনক মনে করা হয় না। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে সবক্ষেত্রেই আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপানের অনুসরণ আধুনিকতা নয়। অথচ সেই ভুলটাই করে চলেছেন বাংলার কিছু বুদ্ধিজীবী।

4.
আদালতের অনুমোদন কখনোই ‘যুক্তি’ হতে পারে না। “আদালত নিশ্চয় ভালো মনে করেছে, তা নাহলে এটা কেন বৈধ করবে? আপনি কি সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের থেকেও বেশী জ্ঞানী?” এই ধারনা চূড়ান্ত ভুল। কেননা কোনো আদালতই কখনোই ‘চুড়ান্ত সঠিক’ রায় দিতে পারে না। ২০১৩ সালে সুপ্রিমকোর্ট এক রায়ে জানায়, সমকামিতা বৈধ নয়। ২০১৮ সালের রায়ে আবার বৈধ! তাহলে সুপ্রিমকোর্ট ২০১৩ সালে ভুল রায় দিয়েছিল, ২০১৮ তে ঠিক, নতুবা ২০১৩ তে ঠিক রায় দিয়েছিল, ২০১৮ তে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে আদালতের রায় কখনোই চিরসত্য হতে পারে না এবং সমকামিতার পক্ষে আদালতের রায় কোনো যুক্তি হতে পারে না।

তাছাড়া আদালত প্রায়ই ভুল কিংবা অযৌক্তিক কিংবা জনবিরোধী/জনগণের অকল্যাণকর রায় দিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, যশোর রোড চওড়া করার উদ্দেশ্যে কলকাতা হাইকোর্ট যশোর রোডের প্রাচীন গাছগুলি কাটার অনুমতি দিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। অথচ এই গাছগুলি কাটার অনুমোদন দেওয়া অন্যায় ছাড়া কিছুই নয়।

আবার বাবরী মসজিদ বিষয়ক মামলায় আদালত ওই জমিটিকে বিভিন্ন দলের মধ্যে ভাগ করে দেয়। এই রায় নিয়ে দেশজুড়েই সমালোচনা হয় এবং রায় প্রত্যাখ্যান করে মামলার সাথে যুক্ত প্রায় সব সংগঠনই। এছাড়া কিছুদিন আগে সুপ্রিমকোর্ট রায় দেয়, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী স্ত্রীদের সাথে (বিয়ে করেও) যৌনমিলন করলে তা ধর্ষণ হিসবে ধরা হবে! এই রায়টি নিয়েও সমালোচনা হয়। প্রশ্ন ওঠে, আদালত কি মানুষের বেডরুমে নজর রাখার জন্য লোক নিয়োগ করবে? আরও প্রশ্ন ওঠে বিয়ে না করেই যেখানে ১৫/১৬ বছর বয়সী মেয়েদের সাথে শারীরির মিলন করা যাচ্ছে, সেখানে বিয়ে করে মিলনে বাধা কেন? উল্লেখ্য, ভারতে কিছু জাতিকে ১৫ বছর বয়সী মেয়েদেরকে বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

সুতরাং, আদালতের রায় চরম সত্য নয়, কখনও কখনও তা বিতর্কিত হতে পারে, কখনও কখনও তা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন হতে পারে।

5.
সমকামিতা যে মানসিক অসুস্থতা, তা এদের জীবনযাপন পদ্ধতি দেখলেই বোঝা যায়। এদের এশিরভাগই নানারকম ড্রাগে আশক্ত। এদের মধ্যে হতাশা ও আত্মহত্যার প্রবণতা প্রবল। প্রকৃতপক্ষে এরা রোগী ছাড়া কিছুই নয়। আর অন্যান্য রোগে মত এই রোগেও এরা নিজেরা কষ্ট পায়। সুতরাং এদেরকে সুস্থ করার দায়িত্ব নেওয়া উচিৎ। কাউন্সেলিং করিয়ে এদেরকে সুস্থ করা যায়।

6.
মধ্যযুগে এক প্রজাহিতৈষী শাসক জনগনকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, একটা জাতীকে ধ্বংস করে দেওয়ার উপায় হল অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেওয়া। আর এই নিয়মটাই মেনে চলেছে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী পশ্চিমা দেশগুলি। উদাহরণস্বরূপ লিবিয়ার প্রসঙ্গ আনা যেতে পারে। লিবিয়ায় গদ্দাফির পতনের পর বেশ কিছু গোষ্ঠী আমেরিকা ও ফ্রান্সের সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। এসময় পশ্চিমা সেনারা পরীক্ষামূলকভাবে তাদের মধ্যে কিছু সিনেমা ও গান (অশ্লীল তো বটেই) ছড়িয়ে দেয়। দেখা যায় এরফলে বিদ্রোহীদের অনেকেই সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই বাদ দিয়ে সেইসব সিনেমা ও গান নিয়েই মেতে থাকে। বিদ্রোহ নির্মূল করতে পরবর্তীতে আরও ব্যাপকভাবে বিদ্রোহীদের মধ্যে সিনেমা ও গান ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ভারতীয় সংবাদমধ্যমের দাবী অনুযায়ী সেগুলি বলিউডের সিনেমা ও গান ছিল। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলি তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কখনো কখনো অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেয়।

সমকামিতার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। আর সমকামিতা বাড়লেই সমাজে অশ্লীলতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের কথাই ধরুন। আজ থেকে দশ বছর আগেও সেদেশে সমকামিতা নিয়ে কোনো আলোচনা হত না। তারপর মূলত DW Bangla ও বাংলা ট্রিবিউন নামের মিডিয়াদুটি সমকামিতার প্রচার শুরু করে। এখন সেদেশে আরও কয়েকটি মিডিয়াও সমকামিতা প্রমোট করে। উল্লেখ্য উপরিউক্ত মিডিয়া দুটি জার্মানি থেকে পরিচালিত হয় ও তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য বাংলাদেশে জার্মান সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটানো। এমনকি বাংলাদেশে যেসব তথাকথিত মুক্তমনারা নাস্তিকতা ও সমকামিতার পক্ষে কথা বলেন, তারাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জার্মানি থেকে সহায়তা পেয়ে থাকেন। এভাবে চলতে থাকলে ১০ বছর পর বাংলাদেশে সমকামিতার প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে৷ সুতরাং সমকামিতা স্বাভাবিক নয়, বরং পরিকল্পিতভাবেই এর প্রসার ঘটানো হচ্ছে। ভারতের ক্ষেত্রে এটা শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে এবং ৩৭৭ ধারা তুলে দিয়ে এই পরিকল্পনা পরিপুর্ণতা পেল।

কিন্তু দেশ ও সমাজকে সুস্থ রাখতে সমকামিতা নিষিদ্ধ করার দাবী তুলতে হবে।

7.

উপরে যৌক্তিকভাবেই দেখানো হয়েছে যে সমকামিতা স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক নয়। বরং এটি একটি মানসিক অসুস্থতা। এখন, সমকামিতার বৈধতা, সমাজ ও দেশের জন্য কি কি ক্ষতি করতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।

A) সমকামিতার ফলে এইডস সহ অন্যান্য যৌন রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। সমকামীরা কনডম ব্যবহার করুন আর নাই করুন, সতর্কতা অবলম্বন করুন কিংবা নাই করুন, একই থালায় খান কিংবা একই টুথব্রাশে দাঁত মাজুন (তসলিমা নাসরিনের ‘ফরাসী প্রেমিক’-এর সমকামী দানিয়েল-এর মত), যাই করুন না কেন, যৌন রোগের সম্ভবনা অত্যন্ত বেশী। তাছাড়া এরা পায়ুকামী বলে এদের গনোরিয়া ও অন্যান্য রোগ হয়ে থাকে। [এবিষয়ে গুগল সার্চ করে নামীদামি ওয়েবসাইটগুলিতে প্রচুর আর্টিকেল পাবেন। সমকামিতা কুফল নিয়ে Jakaria Masud ও Miraj Gazi এর টাইমলাইনে তাঁদের লেখা পড়তে পারে। কমেন্টবক্সে লিঙ্ক দিলাম।] এরফলে সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগকে যৌন রোগের প্রতি বেশী গুরুত্ব দিতে হয়। এছাড়া বেশিরভাগ সমকামী আসলে উভকামী। এরা সমকামী হিসেবে পরিচত হলেও কখনো কখনো বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সাথেও যৌনমিলন করে। এরফলে এইসব রোগের বিস্তার আরও বেশী সংখ্যক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সমাজটাকেই রোগাক্রান্ত করে তুলবে।

B] মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য শুধু যৌনতা নয়, সুস্থভাবে, পরিবারের মধ্যে, সমাজবদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকা। কিন্তু সমকামীদের অন্যতম উদ্দেশ্যই হল যৌনতা। এমনকি এজন্য তারা পরিবার, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনকেও ত্যাগ করতেও পিছপা হয় না। এমনকি এমনটা দেখা যায় ইউরোপের ক্ষেত্রেও। যে স্বাধীনতা এত আপনজনদেরকে দূরে থাকতে বাধ্য করে, কি প্রয়োজন সেই স্বাধীনতাকে প্রমোট করার?

C) ভারতে সমকামীরা আগেও ছিল। কিন্তু এই আইন তৈরি হওয়ার ফলে সমকামিতার প্রচার হল। এরফলে আরও বেশী মানুষ সমকামিতায় ঝুঁকবে যা সমাজ ও দেশের জন্য কোনোমতেই ভালো নয়। প্রকৃতপক্ষে এই দাবীকে খারিজ করে দিলে মামলাকারীদের কিছুই ক্ষতি হত না। কারণ তারা যতক্ষণ না প্রকাশ্যে পায়ুকাম বা এরকম কিছু করছে, ততোক্ষণ পর্যন্ত আইনের কোনো ক্ষমতা ছিল না তাঁদেরকে কিছু করার। সোজা কথায় সমকাম বৈধ না হলেও তাদের কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু এটি বৈধ হওয়ায় এখন অন্যদের, স্বাভাবিক সমাজের অনেক অসুবিধা হবে।

D) যৌন হয়রানির সংখ্যা বাড়বে। আইনও আরও জটিল হয়ে পড়বে। কিন্তু আমাদের দেশে বিচারব্যবস্থায় ৯২ মাসেও একবছর হয় না। সুতরাং বিচারব্যবস্থা ও আইনি ব্যবস্থায় এর ব্যাপক কুপ্রভাব পড়বে। পুরুষ যৌন হয়রানি বাড়ার সাথে সাথে মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসানোও বাড়বে।

E) সমকাম যেহেতু লিগ্যাল। তাই সমকামীরা এখন সমলিঙ্গের যে কাউকে প্রকাশ্যে প্রেমের, বিয়ের বা সমকামের প্রস্তাব দিতে পারবে। যা অনেকের কাছেই লজ্জাজনক হতে পারে।

F) দুজন পুরুষ বা দুজন মহিলা একসাথে থাকলেই তাদের মধ্যে সমকাম করার ইচ্ছে জাগতে পারে। এভাবে ক্রমেই এই মানসিক অসুস্থতা বাড়বে। আবার দুজন পুরুষ বা দুজন মহিলা (বিশেষ করে কলেজ স্টুডেন্টদের ক্ষেত্রে) একই ফ্ল্যাট বা ভাড়া বাড়িতে থাকলেই লোকে সন্দেহ করতে পারে, যা তাদের মানসিক চাপের কারণ হতে পারে।

G) একটি অন্যতম বিষয়। স্কুল হোস্টেলগুলির ক্ষেত্রে এই নিয়মের কি হবে? মিডিয়ার মাধ্যমে স্কুল ছাত্র-ছাত্রীরাও জানে যে দুজন ছেলে্র মধ্যে বা দুজন মেয়ের মধ্যে যৌনতা অপরাধ নয়। স্বাভাবিকভাবেই হোস্টেলে অভিভাবকরা না থাকায় এসবের প্রতি তারা ইন্টারেস্টেড হবে। ক্রমে তারা সুস্থ জীবন থেকে অসুস্থতার দিকে এগিয়ে যাবে। যতই বলা হোক, যার যা খুশি করতেই পারে, অন্যদের তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, বাস্তবে ছোটরাই এই অযৌক্তি ও মনুষত্ব বিরোধী আইনের শিকার হবে। এমনকি জোর করে পায়ুকাম করার ঘটনাও বাড়বে। এর বিচার কিভাবে হবে? আসলে আমরা ছোটদের জন্য একটা অসুস্থ পৃথিবী রেখে যাচ্ছি, যা চরম অন্যায়।

[কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ যাদের লেখা থেকে তথ্য, তত্ত্ব, যুক্তি নিয়েছি বা যাদের লেখা চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে। তারা হলেন, Saifur Rahman (Researcher, Cambridge University), আরিফ আজাদ (লেখক, প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ), Jakaria Masud (Writer), Ahmed Ali (Writer)
এছাড়াও সামান্য হলেও যাদের থেকে উপকৃত হয়েছি, Shamsul Arefin Shakti (Writer), Ahmed Hassan Barbhuiya, Imran Nazir Kousar Alom Byapari Mira Gazi প্রমুখ]


আলি মোস্তাফা
কোচবিহার
০৯/০৯/২০১৮

কুরবানীর মাসয়ালা – যা না জানলে হয়ত আপনার কুরবানী নষ্ট হয়ে যেতে পারে ।

কুরবানীর গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসায়েল । অনেক সময়েই এসবের ব্যপারে জিজ্ঞাসিত হতে হয়, আবার নিজেরও প্রয়োজন পড়ে। জানা না থাকলে তখন পড়তে হয় বিপাকে।

তাই পড়ে নিতে পারেন—

কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি আদায় করা ওয়াজিব।

সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এই ইবাদত পালন করে না তার ব্যাপারে হাদীস শরীফে এসেছে, ‘যার কুরবানীর সামর্থ্য রয়েছে কিন্তু কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’-মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস : ৩৫১৯; আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব ২/১৫৫

ইবাদতের মূলকথা হল আল্লাহ তাআলার আনুগত্য এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। তাই যেকোনো ইবাদতের পূর্ণতার জন্য দুটি বিষয় জরুরি। ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পালন করা এবং শরীয়তের নির্দেশনা মোতাবেক মাসায়েল অনুযায়ী সম্পাদন করা। এ উদ্দেশ্যে এখানে কুরবানীর কিছু জরুরি মাসায়েল উল্লেখ হল।

কার উপর কুরবানী ওয়াজিব

মাসআলা : ১. প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।

আর নিসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্ত্তর ক্ষেত্রে নিসাব হল এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্ত্ত মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।-আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫

নেসাবের মেয়াদ

মাসআলা ২. কুরবানীর নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কুরবানীর তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২

কুরবানীর সময়

মাসআলা : ৩. মোট তিনদিন কুরবানী করা যায়। যিলহজ্বের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে যিলহজ্বের ১০ তারিখেই কুরবানী করা উত্তম। -মুয়াত্তা মালেক ১৮৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৮, ২৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৫

নাবালেগের কুরবানী

মাসআলা : ৪. নাবালেগ শিশু-কিশোর তদ্রূপ যে সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন নয়, নেসাবের মালিক হলেও তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। অবশ্য তার অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষে কুরবানী করলে তা সহীহ হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৬

মুসাফিরের জন্য কুরবানী

মাসআলা : ৫. যে ব্যক্তি কুরবানীর দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে (অর্থাৎ ৪৮ মাইল বা প্রায় ৭৮ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার নিয়তে নিজ এলাকা ত্যাগ করেছে) তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। -ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৪, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৫, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৫

নাবালেগের পক্ষ থেকে কুরবানী

মাসআলা : ৬. নাবালেগের পক্ষ থেকে কুরবানী দেওয়া অভিভাবকের উপর ওয়াজিব নয়; বরং মুস্তাহাব।-রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৫; ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৫

দরিদ্র ব্যক্তির কুরবানীর হুকুম

মাসআলা : ৭. দরিদ্র ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কুরবানীর নিয়তে কোনো পশু কিনে তাহলে তা কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যায়। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯২

কুরবানী করতে না পারলে

মাসআলা : ৮. কেউ যদি কুরবানীর দিনগুলোতে ওয়াজিব কুরবানী দিতে না পারে তাহলে কুরবানীর পশু ক্রয় না করে থাকলে তার উপর কুরবানীর উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করে ছিল, কিন্তু কোনো কারণে কুরবানী দেওয়া হয়নি তাহলে ঐ পশু জীবিত সদকা করে দিবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৪, ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৫

প্রথম দিন কখন থেকে কুরবানী করা যাবে

মাসআলা : ৯. যেসব এলাকার লোকদের উপর জুমা ও ঈদের নামায ওয়াজিব তাদের জন্য ঈদের নামাযের আগে কুরবানী করা জায়েয নয়। অবশ্য বৃষ্টিবাদল বা অন্য কোনো ওজরে যদি প্রথম দিন ঈদের নামায না হয় তাহলে ঈদের নামাযের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম দিনেও কুরবানী করা জায়েয।-সহীহ বুখারী ২/৮৩২, কাযীখান ৩/৩৪৪, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৮

রাতে কুরবানী করা

মাসআলা : ১০. ১০ ও ১১ তারিখ দিবাগত রাতেও কুরবানী করা জায়েয। তবে দিনে কুরবানী করাই ভালো। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ১৪৯২৭; মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২২, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০, কাযীখান ৩/৩৪৫, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩

কুরবানীর উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত পশু সময়ের পর যবাই করলে

মাসআলা : ১১. কুরবানীর দিনগুলোতে যদি জবাই করতে না পারে তাহলে খরিদকৃত পশুই সদকা করে দিতে হবে। তবে যদি (সময়ের পরে) জবাই করে ফেলে তাহলে পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত পশুর চেয়ে কমে যায় তাহলে যে পরিমাণ মূল্য হ্রাস পেল তা-ও সদকা করতে হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০২, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০-৩২১

কোন কোন পশু দ্বারা কুরবানী করা যাবে

মাসআলা : ১২. উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। -কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫

নর ও মাদা পশুর কুরবানী

মাসআলা : ১৩. যেসব পশু কুরবানী করা জায়েয সেগুলোর নর-মাদা দুটোই কুরবানী করা যায়। -কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫

কুরবানীর পশুর বয়সসীমা

মাসআলা : ১৪. উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।

উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না। -কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬

এক পশুতে শরীকের সংখ্যা

মাসআলা : ১৫. একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কুরবানী দিতে পারবে। এমন একটি পশু কয়েকজন মিলে কুরবানী করলে কারোটাই সহীহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না। -সহীহ মুসলিম ১৩১৮, মুয়াত্তা মালেক ১/৩১৯, কাযীখান ৩/৩৪৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭-২০৮

সাত শরীকের কুরবানী

মাসআলা : ১৬. সাতজনে মিলে কুরবানী করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরীকের কুরবানীই সহীহ হবে না। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭

মাসআলা : ১৭. উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। -সহীহ মুসলিম ১৩১৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭

কোনো অংশীদারের গলদ নিয়ত হলে

মাসআলা : ১৮. যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানী না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানী করে তাহলে তার কুরবানী সহীহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরীকদের কারো কুরবানী হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীক নির্বাচন করতে হবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৮, কাযীখান ৩/৩৪৯

কুরবানীর পশুতে আকীকার অংশ

মাসআলা : ১৯. কুরবানীর গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কুরবানী ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে।-তাহতাবী আলাদ্দুর ৪/১৬৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩৬২

মাসআলা : ২০. শরীকদের কারো পুরো বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না।

মাসআলা : ২১. যদি কেউ গরু, মহিষ বা উট একা কুরবানী দেওয়ার নিয়তে কিনে আর সে ধনী হয় তাহলে ইচ্ছা করলে অন্যকে শরীক করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে একা কুরবানী করাই শ্রেয়। শরীক করলে সে টাকা সদকা করে দেওয়া উত্তম। আর যদি ওই ব্যক্তি এমন গরীব হয়, যার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়, তাহলে সে অন্যকে শরীক করতে পারবে না। এমন গরীব ব্যক্তি যদি কাউকে শরীক করতে চায় তাহলে পশু ক্রয়ের সময়ই নিয়ত করে নিবে।-কাযীখান ৩/৩৫০-৩৫১, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১০

কুরবানীর উত্তম পশু

মাসআলা : ২২. কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম।-মুসনাদে আহমদ ৬/১৩৬, আলমগীরী ৫/৩০০, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩

খোড়া পশুর কুরবানী

মাসআলা : ২৩. যে পশু তিন পায়ে চলে, এক পা মাটিতে রাখতে পারে না বা ভর করতে পারে না এমন পশুর কুরবানী জায়েয নয়। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫, সুনানে আবু দাউদ ৩৮৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৩, আলমগীরী ৫/২৯৭

রুগ্ন ও দুর্বল পশুর কুরবানী

মাসআলা : ২৪. এমন শুকনো দুর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫, আলমগীরী ৫/২৯৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪

দাঁত নেই এমন পশুর কুরবানী

মাসআলা : ২৫. যে পশুর একটি দাঁতও নেই বা এত বেশি দাঁত পড়ে গেছে যে, ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারে না এমন পশু দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয নয়। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৫, আলমগীরী ৫/২৯৮

যে পশুর শিং ভেঙ্গে বা ফেটে গেছে

মাসআলা : ২৬. যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে, যে কারণে

মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। পক্ষান্তরে যে পশুর অর্ধেক শিং বা কিছু শিং ফেটে বা ভেঙ্গে গেছে বা শিং একেবারে উঠেইনি সে পশু কুরবানী করা জায়েয। -জামে তিরমিযী ১/২৭৬, সুনানে আবু দাউদ ৩৮৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৪, আলমগীরী ৫/২৯৭

কান বা লেজ কাটা পশুর কুরবানী

মাসআলা : ২৭. যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কুরবানী জায়েয নয়। আর যদি অর্ধেকের বেশি থাকে তাহলে তার কুরবানী জায়েয। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫, মুসনাদে আহমদ ১/৬১০, ইলাউস সুনান ১৭/২৩৮, কাযীখান ৩/৩৫২, আলমগীরী ৫/২৯৭-২৯৮

অন্ধ পশুর কুরবানী

মাসআলা : ২৮. যে পশুর দুটি চোখই অন্ধ বা এক চোখ পুরো নষ্ট সে পশু কুরবানী করা জায়েয নয়। -জামে তিরমিযী ১/২৭৫, কাযীখান ৩/৩৫২, আলমগীরী ২৯৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৪

নতুন পশু ক্রয়ের পর হারানোটা পাওয়া গেলে

মাসআলা : ২৯. কুরবানীর পশু হারিয়ে যাওয়ার পরে যদি আরেকটি কেনা হয় এবং পরে হারানোটিও পাওয়া যায় তাহলে কুরবানীদাতা গরীব হলে (যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়) দুটি পশুই কুরবানী করা ওয়াজিব। আর ধনী হলে কোনো একটি কুরবানী করলেই হবে। তবে দুটি কুরবানী করাই উত্তম। -সুনানে বায়হাকী ৫/২৪৪, ইলাউস সুনান ১৭/২৮০, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৯, কাযীখান ৩/৩৪৭

গর্ভবতী পশুর কুরবানী

মাসআলা : ৩০. গর্ভবতী পশু কুরবানী করা জায়েয। জবাইয়ের পর যদি বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায় তাহলে সেটাও জবাই করতে হবে। তবে প্রসবের সময় আসন্ন হলে সে পশু কুরবানী করা মাকরূহ। -কাযীখান ৩/৩৫০

পশু কেনার পর দোষ দেখা দিলে

মাসআলা : ৩১. কুরবানীর নিয়তে ভালো পশু কেনার পর যদি তাতে এমন কোনো দোষ দেখা দেয় যে কারণে কুরবানী জায়েয হয় না তাহলে ওই পশুর কুরবানী সহীহ হবে না। এর স্থলে আরেকটি পশু কুরবানী করতে হবে। তবে ক্রেতা গরীব হলে ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারাই কুরবানী করতে পারবে। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, ফাতাওয়া নাওয়াযেল ২৩৯, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৫

পশুর বয়সের ব্যাপারে বিক্রেতার কথা

মাসআলা : ৩২. যদি বিক্রেতা কুরবানীর পশুর বয়স পূর্ণ হয়েছে বলে স্বীকার করে আর পশুর শরীরের অবস্থা দেখেও তাই মনে হয় তাহলে বিক্রেতার কথার উপর নির্ভর করে পশু কেনা এবং তা দ্বারা কুরবানী করা যাবে। -আহকামে ঈদুল আযহা, মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. ৫

বন্ধ্যা পশুর কুরবানী

মাসআলা : ৩৩. বন্ধ্যা পশুর কুরবানী জায়েয। -রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৫

নিজের কুরবানীর পশু নিজে জবাই করা

মাসআলা : ৩৪. কুরবানীর পশু নিজে জবাই করা উত্তম। নিজে না পারলে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কুরবানীদাতা পুরুষ হলে জবাইস্থলে তার উপস্থিত থাকা ভালো। -মুসনাদে আহমদ ২২৬৫৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২২-২২৩, আলমগীরী ৫/৩০০, ইলাউস সুনান ১৭/২৭১-২৭৪

জবাইয়ে একাধিক ব্যক্তি শরীক হলে

মাসআলা : ৩৫. অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ যবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তবে ওই কুরবানী সহীহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না। -রদ্দুল মুহতার ৬/৩৩৪

কুরবানীর পশু থেকে জবাইয়ের আগে উপকৃত হওয়া

মাসআলা : ৩৬. কুরবানীর পশু কেনার পর বা নির্দিষ্ট করার পর তা থেকে উপকৃত হওয়া জায়েয নয়। যেমন হালচাষ করা, আরোহণ করা, পশম কাটা ইত্যাদি।সুতরাং কুরবানীর পশু দ্বারা এসব করা যাবে না। যদি করে তবে পশমের মূল্য, হালচাষের মূল্য ইত্যাদি সদকা করে দিবে।-মুসনাদে আহমদ ২/১৪৬, নায়লুল আওতার ৩/১৭২, ইলাউস সুনান ১৭/২৭৭, কাযীখান ৩/৩৫৪, আলমগীরী ৫/৩০০

কুরবানীর পশুর দুধ পান করা

মাসআলা : ৩৭. কুরবানীর পশুর দুধ পান করা যাবে না। যদি জবাইয়ের সময় আসন্ন হয় আর দুধ দোহন না করলে পশুর

কষ্ট হবে না বলে মনে হয় তাহলে দোহন করবে না। প্রয়োজনে ওলানে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দেবে। এতে দুধের চাপ কমে যাবে। যদি দুধ দোহন করে ফেলে তাহলে তা সদকা করে দিতে হবে। নিজে পান করে থাকলে মূল্য সদকা করে দিবে। -মুসনাদে আহমদ ২/১৪৬, ইলাউস সুনান ১৭/২৭৭,

রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৯, কাযীখান ৩/৩৫৪, আলমগীরী ৫/৩০১

কোনো শরীকের মৃত্যু ঘটলে

মাসআলা : ৩৮. কয়েকজন মিলে কুরবানী করার ক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে কোনো শরীকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিসরা যদি মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করার অনুমতি দেয় তবে তা জায়েয হবে। নতুবা ওই শরীকের টাকা ফেরত দিতে হবে। অবশ্য তার

স্থলে অন্যকে শরীক করা যাবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৯, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৬, কাযীখান ৩/৩৫১

কুরবানীর পশুর বাচ্চা হলে

মাসআলা : ৩৯. কুরবানীর পশু বাচ্চা দিলে ওই বাচ্চা জবাই না করে জীবিত সদকা করে দেওয়া উত্তম। যদি সদকা না করে তবে কুরবানীর পশুর সাথে বাচ্চাকেও জবাই করবে এবং গোশত সদকা করে দিবে।-কাযীখান ৩/৩৪৯, আলমগীরী ৫/৩০১, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৩

মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী

মাসআলা : ৪০. মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করা জায়েয। মৃত ব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে তবে সেটি নফল কুরবানী হিসেবে গণ্য হবে। কুরবানীর স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কুরবানীর ওসিয়ত করে গিয়ে থাকে তবে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। গরীব-মিসকীনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। -মুসনাদে আহমদ ১/১০৭, হাদীস ৮৪৫, ইলাউস সুনান ১৭/২৬৮, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬, কাযীখান ৩/৩৫২

কুরবানীর গোশত জমিয়ে রাখা

মাসআলা : ৪১. কুরবানীর গোশত তিনদিনেরও অধিক জমিয়ে রেখে খাওয়া জায়েয।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, সহীহ মুসলিম ২/১৫৯, মুয়াত্তা মালেক ১/৩১৮, ইলাউস সুনান ১৭/২৭০

কুরবানীর গোশত বণ্টন

মাসআলা : ৪২. শরীকে কুরবানী করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েয নয়।-আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৭, কাযীখান ৩/৩৫১

মাসআলা : ৪৩. কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরীব-মিসকীনকে এবং এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য পুরো গোশত যদি নিজে রেখে দেয় তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, আলমগীরী ৫/৩০০

গোশত, চর্বি বিক্রি করা

মাসআলা : ৪৪. কুরবানীর গোশত, চর্বি ইত্যাদি বিক্রি করা জায়েয নয়। বিক্রি করলে পূর্ণ মূল্য সদকা করে দিতে হবে। -ইলাউস সুনান ১৭/২৫৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫, কাযীখান ৩/৩৫৪, আলমগীরী ৫/৩০১

জবাইকারীকে চামড়া, গোশত দেওয়া

মাসআলা : ৪৫. জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েয হবে না। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে গোশত বা তরকারী দেওয়া যাবে।

জবাইয়ের অস্ত্র

মাসআলা : ৪৬. ধারালো অস্ত্র দ্বারা জবাই করা উত্তম।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩

পশু নিস্তেজ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা

মাসআলা : ৪৭. জবাইয়ের পর পশু

নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা অন্য কোনো অঙ্গ কাটা মাকরূহ। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩

অন্য পশুর সামনে জবাই করা

মাসআলা : ৪৮. এক পশুকে অন্য পশুর সামনে জবাই করবে না। জবাইয়ের সময় প্রাণীকে অধিক কষ্ট না দেওয়া।

কুরবানীর গোশত বিধর্মীকে দেওয়া

মাসআলা : ৪৯. কুরবানীর গোশত হিন্দু ও অন্য ধর্মাবলম্বীকে দেওয়া জায়েয।-ইলাউস সুনান ৭/২৮৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০০

অন্য কারো ওয়াজিব কুরবানী আদায় করতে চাইলে

মাসআলা : ৫০. অন্যের ওয়াজিব কুরবানী দিতে চাইলে ওই ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে। নতুবা ওই ব্যক্তির কুরবানী আদায় হবে না। অবশ্য স্বামী বা পিতা যদি স্ত্রী বা সন্তানের বিনা অনুমতিতে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করে তাহলে তাদের কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। তবে অনুমতি নিয়ে আদায় করা ভালো।

কুরবানীর পশু চুরি হয়ে গেলে বা মরে গেলে

মাসআলা : ৫১. কুরবানীর পশু যদি চুরি হয়ে যায় বা মরে যায় আর কুরবানীদাতার উপর পূর্ব থেকে কুরবানী ওয়াজিব থাকে তাহলে আরেকটি পশু কুরবানী করতে হবে। গরীব হলে (যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়) তার জন্য আরেকটি পশু কুরবানী করা ওয়াজিব নয়।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৯

পাগল পশুর কুরবানী

মাসআলা : ৫২. পাগল পশু কুরবানী করা জায়েয। তবে যদি এমন পাগল হয় যে, ঘাস পানি দিলে খায় না এবং মাঠেও চরে না তাহলে সেটার কুরবানী জায়েয হবে না। -আননিহায়া ফী গরীবিল হাদীস ১/২৩০, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, ইলাউস সুনান ১৭/২৫২

নিজের কুরবানীর গোশত খাওয়া

মাসআলা : ৫৩. কুরবানীদাতার জন্য নিজ কুরবানীর গোশত খাওয়া মুস্তাহাব। -সূরা হজ্ব ২৮, সহীহ মুসলিম ২২/১৫৯, মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৯০৭৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪

ঋণ করে কুরবানী করা

মাসআলা : ৫৪. কুরবানী ওয়াজিব এমন ব্যক্তিও ঋণের টাকা দিয়ে কুরবানী করলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। তবে সুদের উপর ঋণ নিয়ে কুরবানী করা যাবে না।

হাজীদের উপর ঈদুল আযহার কুরবানী

মাসআলা : ৫৫. যেসকল হাজী কুরবানীর দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে তাদের উপর ঈদুল আযহার কুরবানী ওয়াজিব নয়। কিন্তু যে হাজী কুরবানীর কোনো দিন মুকীম থাকবে সামর্থ্যবান হলে তার উপর ঈদুল আযহার কুরবানী করা জরুরি হবে। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৩, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৫, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৫, ইমদাদুল ফাতাওয়া ২/১৬৬

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করা

মাসআলা : ৫৬. সামর্থ্যবান ব্যক্তির রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করা উত্তম। এটি বড় সৌভাগ্যের বিষয়ও বটে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রা.কে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করার ওসিয়্যত করেছিলেন। তাই তিনি প্রতি বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেও কুরবানী দিতেন। -সুনানে আবু দাউদ ২/২৯, জামে তিরমিযী ১/২৭৫, ইলাউস সুনান ১৭/২৬৮, মিশকাত ৩/৩০৯

কোন দিন কুরবানী করা উত্তম

মাসআলা : ৫৭. ১০, ১১ ও ১২ এ তিন দিনের মধ্যে প্রথম দিন কুরবানী করা অধিক উত্তম। এরপর দ্বিতীয় দিন, এরপর তৃতীয় দিন। -রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৬

খাসীকৃত ছাগল দ্বারা কুরবানী

মাসআলা : ৫৮. খাসিকৃত ছাগল দ্বারা কুরবানী করা উত্তম। -ফাতহুল কাদীর ৮/৪৯৮, মাজমাউল আনহুর ৪/২২৪, ইলাউস সুনান ১৭/৪৫৩

জীবিত ব্যক্তির নামে কুরবানী

মাসআলা : ৫৯. যেমনিভাবে মৃতের পক্ষ থেকে ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরবানী করা জায়েয তদ্রূপ জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার ইসালে সওয়াবের জন্য নফল কুরবানী করা জায়েয। এ কুরবানীর গোশত দাতা ও তার পরিবারও খেতে পারবে।

বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির কুরবানী অন্যত্রে করা

মাসআলা : ৬০. বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির জন্য নিজ দেশে বা অন্য কোথাও কুরবানী করা জায়েয।

কুরবানীদাতা ভিন্ন স্থানে থাকলে কখন জবাই করবে

মাসআলা : ৬১. কুরবানীদাতা এক স্থানে আর কুরবানীর পশু ভিন্ন স্থানে থাকলে কুরবানীদাতার ঈদের নামায পড়া বা না পড়া ধর্তব্য নয়; বরং পশু যে এলাকায় আছে ওই এলাকায় ঈদের জামাত হয়ে গেলে পশু জবাই করা যাবে। -আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৮

কুরবানীর চামড়া বিক্রির অর্থ সাদকা করা

মাসআলা : ৬২. কুরবানীর চামড়া কুরবানীদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। তবে কেউ যদি নিজে ব্যবহার না করে বিক্রি করে তবে বিক্রিলব্ধ মূল্য পুরোটা সদকা করা জরুরি। -আদ্দুররুল মুখতার, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১

কুরবানীর চামড়া বিক্রির নিয়ত

মাসআলা : ৬৩. কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রি করলে মূল্য সদকা করে দেওয়ার নিয়তে বিক্রি করবে। সদকার নিয়ত না করে নিজের খরচের নিয়ত করা নাজায়েয ও গুনাহ। নিয়ত যা-ই হোক বিক্রিলব্ধ অর্থ পুরোটাই সদকা করে দেওয়া জরুরি। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১, কাযীখান ৩/৩৫৪

কুরবানীর শেষ সময়ে মুকীম হলে

মাসআলা : ৬৪. কুরবানীর সময়ের প্রথম দিকে মুসাফির থাকার পরে ৩য় দিন কুরবানীর সময় শেষ হওয়ার পূর্বে মুকীম হয়ে গেলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। পক্ষান্তরে প্রথম দিনে মুকীম ছিল অতপর তৃতীয় দিনে মুসাফির হয়ে গেছে তাহলেও তার উপর কুরবানী ওয়াজিব থাকবে না। অর্থাৎ সে কুরবানী না দিলে গুনাহগার হবে না। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৪৬, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৯

কুরবানীর পশুতে ভিন্ন ইবাদতের নিয়তে শরীক হওয়া

মাসআলা : ৬৫. এক কুরবানীর পশুতে আকীকা, হজ্বের কুরবানীর নিয়ত করা যাবে। এতে প্রত্যেকের নিয়তকৃত ইবাদত আদায় হয়ে যাবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৯, রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৬, আলমাবসূত সারাখছী ৪/১৪৪, আলইনায়া ৮/৪৩৫-৩৪৬, আলমুগনী ৫/৪৫৯

কুরবানীর গোশত দিয়ে খানা শুরু করা

মাসআলা : ৬৬. ঈদুল আযহার দিন সর্বপ্রথম নিজ কুরবানীর গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত। অর্থাৎ সকাল থেকে কিছু না খেয়ে প্রথমে কুরবানীর গোশত খাওয়া সুন্নত। এই সুন্নত শুধু ১০ যিলহজ্বের জন্য। ১১ বা ১২ তারিখের গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত নয়। -জামে তিরমিযী ১/১২০, শরহুল মুনয়া ৫৬৬, আদ্দুররুল মুখতার ২/১৭৬, আলবাহরুর রায়েক ২/১৬৩

কুরবানীর পশুর হাড় বিক্রি

মাসআলা : ৬৭. কুরবানীর মৌসুমে অনেক মহাজন কুরবানীর হাড় ক্রয় করে থাকে। টোকাইরা বাড়ি বাড়ি থেকে হাড় সংগ্রহ করে তাদের কাছে বিক্রি করে। এদের ক্রয়-বিক্রয় জায়েয। এতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু কোনো কুরবানীদাতার জন্য নিজ কুরবানীর কোনো কিছু এমনকি হাড়ও বিক্রি করা জায়েয হবে না। করলে মূল্য সদকা করে দিতে হবে। আর জেনে শুনে মহাজনদের জন্য এদের কাছ থেকে ক্রয় করাও বৈধ হবে না। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫, কাযীখান ৩/৩৫৪, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১

রাতে কুরবানী করা

মাসআলা : ৬৮. ১০ ও ১১ তারিখ দিবাগত রাতে কুরবানী করা জায়েয। তবে রাতে আলোস্বল্পতার দরুণ জবাইয়ে ত্রুটি হতে পারে বিধায় রাতে জবাই করা অনুত্তম। অবশ্য পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকলে রাতে জবাই করতে কোনো অসুবিধা নেই। -ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৩৪৫, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৬, আহসানুল ফাতাওয়া ৭/৫১০

কাজের লোককে কুরবানীর গোশত খাওয়ানো

মাসআলা : ৬৯. কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া জায়েয নয়। গোশতও পারিশ্রমিক হিসেবে কাজের লোককে দেওয়া যাবে না। অবশ্য এ সময় ঘরের অন্যান্য সদস্যদের মতো কাজের লোকদেরকেও গোশত খাওয়ানো যাবে।-আহকামুল কুরআন জাস্সাস ৩/২৩৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, আলবাহরুর রায়েক ৮/৩২৬, ইমদাদুল মুফতীন

জবাইকারীকে পারিশ্রমিক দেওয়া

মাসআলা : ৭০. কুরবানী পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া জায়েয। তবে কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া যাবে না। -কিফায়াতুল মুফতী ৮/২৬৫

মোরগ কুরবানী করা

মাসআলা : ৭১. কোনো কোনো এলাকায় দরিদ্রদের মাঝে মোরগ কুরবানী করার প্রচলন আছে। এটি না জায়েয। কুরবানীর দিনে মোরগ জবাই করা নিষেধ নয়, তবে কুরবানীর নিয়তে করা যাবে না। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৪, ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ৬/২৯০, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২০০
সূত্রঃ মাসিক আল কাউসার ।

ইসলামে স্বাধীনতার অর্থ

ইসলামে স্বাধীনতা বলতে নাস্তিক্যবাদী শ্লোগানগুলোর মতো অনিয়ন্ত্রিত বা নামমাত্র নিয়ন্ত্রিত স্বাধিকার বুঝায় না।

ইসলাম একটি বাস্তববাদী ও ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গির ধর্ম। এতে তাই স্বাধীনতা একটি আপেক্ষিক বিষয়। কেননা মানুষ আল্লাহ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয় নিয়মের এক বিশাল জালের ভেতর আবদ্ধ, যা এ মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে।

আল্লাহ তা‘আলাই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। এতে যা কিছু হচ্ছে তা সরাসরি তাঁর নির্দেশ কিংবা তাঁর সৃষ্ট স্বয়ংক্রিয় নিয়মের মাধ্যমেই পরিচালিত হচ্ছে। এ মহাবিশ্বে কোনো কিছুই তাঁর নির্দেশ বা ইঙ্গিত ছাড়া হয় না। আর তিনি তাঁর সৃষ্টির ওপর পূর্ণ ক্ষমতাবান।

তবে এর অর্থ এই নয় যে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে মানুষের জীবন প্রণালী কেমন হবে সে রায় দিয়ে দিয়েছেন। অনেকে যেমন তাকদীরের ইসলামী আকীদাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন।

বস্তুত তাকদীর হলো, বান্দার যাবতীয় কাজ-কর্মের পূর্ব লিখন। যা কেবল স্রষ্টার নিরংকুশ জ্ঞান নির্ভর। এটি এমন এক জ্ঞান যা কোনো স্থান, কাল বা সসীম ইন্দ্রীয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এমন জ্ঞান, যা সর্বস্থান ও সর্বকালের সব বস্তুকে পূর্ণভাবে বেষ্টন করে রেখেছে।(১)

মানুষের স্বাধীনতা দায়বদ্ধ তার স্রষ্টার প্রতি, যিনি তাদেরকে বানিয়েছেন পৃথিবীতে তাঁর বান্দারূপে, যিনি সকল সৃষ্টিকে করেছেন তাদের অনুগত।

অগণিত সৃষ্টিকে তিনি মানুষের বশীভূত বানিয়েছেন যাতে তারা সাময়িক জীবনে এসবকে নি‘আমত হিসেবে গ্রহণ করে। এসবকে বশে এনে যাতে অর্জন করতে পারে পরকালীন জীবনের শাশ্বত সুখ।

মৌলিকভাবে এ দায়িত্ব বর্তায় তার আকল-বুদ্ধি, হেদায়াত-সুপথ (আসমানী শিক্ষা) এবং অনিবার্য পরিণামধারী উপকরণ নির্বাচনের স্বাধীনতার ওপর। একইভাবে সে নিজের প্রতি এবং অন্যান্য সৃষ্টির প্রতিও দায়বদ্ধ।

লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, সাধারণ অবস্থায় মানুষের পক্ষে মহাজাগতিক নিয়মের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সে আসমানী শিক্ষাকে উপেক্ষা করতে পারে। যদিও তা হবে বিশেষভাবে চিরস্থায়ী জীবনে তার প্রত্যাবর্তনস্থলের হিসাবে। সুতরাং স্বাধীনতা মুফতে আসবে না, আর মুফতে তা সংরক্ষণ করা সম্ভবও নয়।

এক ধাপ এগিয়ে বলা যায়, মানুষের স্বাধীনতা যে জনসমষ্টির মধ্যে সে বাস করে তার বিশ্বাস ও চেতনার সঙ্গে জড়িত। চাই সে জনসমষ্টি পরিবার হোক কিংবা সেই কর্মস্থল সংগঠন হোক। আর যা ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সাধারণ ব্যাপারগুলোতে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতের অনুসারী। একটি দেশে একটি জনসমষ্টির ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য বিশ্ব-সমাজ বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য।

চুক্তির নিয়ম হলো, মানুষ যখন সদস্য হিসেবে সুবিধাদি ভোগ করার জন্য স্বেচ্ছায় কোনো কিছু নিজের জন্য অপরিহার্য করে নেয় কিংবা কোনো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়, তখন তাকে চুক্তির সময়সীমা অতিক্রম কিংবা দ্বিতীয় পক্ষের চুক্তি প্রত্যাহার পর্যন্ত এর ধারাগুলো মেনে চলতে হয়। অন্যথায় তাকে ভোগ করতে হয় শাস্তি।

এসব চুক্তি সত্ত্বেও মানুষের অনেক বিষয়ে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা রয়েছে। নশ্বর ইহকালের বিচারে কিংবা শাশ্বত পরকালের মানদণ্ডে ভালো-মন্দ গ্রহণের স্বাধীনতা ছাড়াও মানুষ বহুবিধ স্বাধীনতার অধিকারী। এসবই গ্রহণীয় বা অগ্রহণীয় বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের পরিচায়ক।

সুতরাং বৈষম্য ও বিভিন্নতা মানব সমাজের কল্যাণ সাধনে অন্যতম অপরিহার্য প্রাকৃতিক গুণ। অন্যথায় মানুষের জরুরি প্রয়োজনাদি ও সুখ-সমৃদ্ধি অর্জনে সহজাত সম্পদগুলোকে কাজে লাগাতে প্রেরণদায়ী প্রতিযোগিতা দুর্বল হয়ে পড়বে। তাছাড়া মানুষের পরিচয় ও পারস্পরিক সহযোগিতার জন্যও এই বিভিন্নতা অপরিহার্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَاٱلنَّاسُإِنَّاخَلَقۡنَٰكُممِّنذَكَرٖوَأُنثَىٰوَجَعَلۡنَٰكُمۡشُعُوبٗاوَقَبَآئِلَلِتَعَارَفُوٓاْۚإِنَّأَكۡرَمَكُمۡعِندَٱللَّهِأَتۡقَىٰكُمۡۚإِنَّٱللَّهَعَلِيمٌخَبِيرٞ١٣﴾ [الحجرات: ١٣]
“হে মানুষ, আমরা তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত”। [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩]

লেখক – ড. সাঈদ ইসমাঈল চীনী
====================================
রেফারেন্স –

১) ইসমাঈল, কাশফুল গুয়ুম: ৫৫-৫৬ পৃ.।

লেখাটি #শেয়ার করে দাওয়াতি কাজে সাহায্য করুন!
————————————————————
► Website: www.articlebari.com
► Facebook: www.facebook.com/articlebari

আটরশী ও মাইজভান্ডার দরবারের আসল রূপ !

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী আমাদের বাংলাদেশে ভ্রান্ত আকীদাপন্থী নামধারী পীরদের মাঝে আটরশী ও মাইজভান্ডারীর দু’টি দরবার খুবই প্রসিদ্ধ। হিন্দুদের ধর্মগুরু ও তাদের মন্দিদের কার্যক্রমের অনুরূপ পরিচালিত হয় এসব দরবারগুলো।

হিন্দুদের মূর্তিপূজার মতই এসব দরবারে কবরপূজা হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের মূর্তিদের ঘিরে যতগুলো রুসুম রেওয়াজ পরিচালনা করে হুবহু একই পদ্ধতির রুসুম রেওয়াজ এসব দরবারে পরিচালিত হয়।

যেমন

বর্তমান মূর্তিপূজকরা প্রধানত মূর্তিপূজায় ৪টি কাজ করে থাকেঃ

১. বছরে দু’বার মূর্তিকে কেন্দ্র করে বড় আকারের অনুষ্ঠান করে।

যথা- (ক) কালিপূজা (খ) দূর্গা পূজা।
ছোট আকারের পূজা আরো অনেক হয়। কিন্তু সারাদেশব্যাপী ধুমধামের সাথে এ দু’টি পূজা পালন করে থাকে।এসময় তারা মূর্তিকে ঘিরে যা করে তারা সারাংশ হলঃ

২. মূর্তির সামনে প্রদিপ জ্বালায়।
৩. মূর্তির নামে মান্নত করে ও পশু বলি দেয়।
৪. মূর্তির সামনে মাথা নত করে ও সেজদা করে।

কবর বা মাযার পূজারীরা যা করে কবরকে কেন্দ্র করেঃ

১. বছরে দু’বার বড় আকারে উরস ও ফাতেহা মাহফিল নামে অনুষ্ঠান করে পীর বা বুযুর্গদের কবরকে ঘিরে।
২. কবরের সামনে মোমবাতি প্রজ্জ্বলিত করে নিয়মিত।
৩. কবরে শায়িত বুযুর্গের নামে মান্নত ও কুরবানী করে।
৪. কবরকে সামনে নিয়ে দুআ করে, ক্ষেত্র বিশেষে মাথানত ও সেজদাও করে।

বিজ্ঞ পাঠকের কাছে আমার জিজ্ঞাসা-মূর্তিপূজকদের মূর্তিপূজায় যে কর্মাদী করে আর আমাদের দেশের মাজারও কবরপূজারীরা যা করে এর মাঝে কি কোন পার্থক্য আছে?

এবার আসুন দেখি কবর পূজারীদের কর্মকান্ড কুরআন ও হাদিসের মানদন্ডেঃ


স্বীয় কবরকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান করাকে নিষিদ্ধ করে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

عن أبى هريرة قال قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم- « لا تجعلوا بيوتكم قبورا ولا تجعلوا قبرى عيدا وصلوا على فإن صلاتكم تبلغنى حيث كنتم (سنن ابى داود-كتاب المناسك، باب زيارة القبور، رقم الحديث-2044)

“তোমরা স্বীয় ঘরকে কবর বানিয়োনা। (অর্থাৎ কবরের ন্যায় ইবাদত-নামায, তেলাওয়াত ও যিকির ইত্যাদি বিহীন করনা।) এবং আমার কবরে উৎসব করোনা।(অর্থাৎ বার্ষিক, মাসিক বা সাপ্তাহিক কোন আসরের আয়োজন করনা। তবে হ্যাঁ আমার উপর দুরূদ পাঠ কর। নিশ্চয় তোমরা যেখানেই থাক না কেন তোমাদের দরূদ আমার নিকট পৌঁছে থাকে।(আল্লাহ তায়ালার ফেরেশতারা পৌঁছিয়ে দেন।)” (সুনানে আবু দাউদ: হাদিস নং-২০৪৪)

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ রওযা মুবারকে উৎসব (উরস) পালন করতে বারণ করেছেন। তাহলে অন্য কে আর এমন আছে যার কবরে তা বৈধ হবে?

হাদীসের বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার আল্লামা মুনাভী রহঃ এই হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন-

قال المناوي ويؤخذ منه أن اجتماع العامة في بعض أضرحة الأولياء في يوم أو شهر مخصوص من السنة ويقولون هذا يوم مولد الشيخ ويأكلون ويشربون وربما يرقصون فيه منهي عنه شرعا وعلى ولي الشرع ردعهم على ذلك وإنكاره عليهم وإبطاله (عون المعبود-كتاب المناسك باب زيارة القبور-6/23)

“এ হাদিস থেকে বুঝা যায় যে, সাধারণ মানুষ যারা বছরের কোন নির্দিষ্ট মাসে বা দিনে (উরসের নামে) ওলীদের মাযারে একত্রিত হয় এবং বলে-আজ পীর সাহেবের জন্ম বার্ষিকী (মৃত্যু বার্ষিকী), সেখানে তারা পানাহারেরও আয়োজন করে, আবার নাচ গানেরও ব্যবস্থা করে থাকে, এ সবগুলিই শরীয়ত পরিপন্থী ও গর্হিত কাজ। এ সব কাজ প্রশাসনের প্রতিরোধ করা জরুরী। (আউনুল মা’বুদ-৬/২৩)


কবরের সামনে বাতি প্রজ্জ্বলন করাকে হারাম সাব্যস্ত করে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

عن ابن عباس قال : لعن رسول الله صلى الله عليه و سلم زائرات القبور والمتخذين عليها المساجد والسرج (سنن الترمذى- أبواب الصلاة عن رسول الله صلى الله عليه و سلم ، باب ما جاء في كراهية أن يتخذ على القبر مسجدا-2/136)

“হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিশম্পাত করেছেন (বেপর্দা) কবর যিয়ারতকারীনী মহিলাদের উপর, এবং সেসব লোকদের উপর যারা কবরকে মসজিদ বানায় (কবরকে সেজদা করে) এবং সেখানে বাতি প্রজ্জ্বলিত করে। (জামি তিরমীযী-২/১৩৬)

উক্ত হাদিসে সুষ্পষ্ট কবরে বাতি প্রজ্জ্বলনকারীর উপর অভিশম্পাত করেছেন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।


আল্লাহ ছাড়া কারো নামে মান্নত বা কুরবানী করা যায়না। কারণ মান্নত ও কুরবানী হচ্ছে ইবাদত। আর ইবাদত আল্লাহ ছাড়া কারা জন্য করা জায়েজ নয়। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-

قُلْ إِنَّ صَلاَتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (162) لاَ شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَاْ أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ (163) (سورة الأنعام-162-163)

“আপনি বলুনঃ আমার নামায, আমার কুরবানী এবং আমার জীবন ও আমার মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই। তাঁর কোন অংশিদার নেই। আমি তা-ই করতে আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম আনুগত্যশীল। (সূরা আনআম-১৬২-১৬৩)

সূরা কাউসারে মহান রাব্বুর আলামীন বলেন- فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ (2) অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন। (সূরা কাউসার-২)

সুতরাং পীরের নামে ও মাযারের নামে মান্নত করা কি শিরকী কাজ ছাড়া আর কী হতে পারে?


আল্লাহ ছাড়া কাউকে সেজদা করা সুষ্পষ্ট হারাম। কুরআনের অসংখ্য আয়াত ও হাদীসে নববী দ্বারা যা দিবালোকের ন্যয় পরিস্কার। একথা মনে হয় অন্ধ পীর ও মাজারপূজারী ছাড়া সকল মুসলমানরাই জানে।

কুরআন ও হাদীসের উল্লেখিত বিবরণ মোতাবিক কবর ও মূর্তিপূজার সাযুজ্যতার মাধ্যমে আমরা সহজেই অনুমান করে নিতে পারি আমাদের দেশের আটরশী, মাইজভান্ডারীসহ মাযারপূজারী ও কবরপূজারীরা কি পরিমাণ শিরকী কর্মকান্ডে লিপ্ত।

আরবের মুশরিকদের শিরক কি ছিল?

মহান রাব্বুর আলামীন বলেন-

قُلْ مَن يَرْزُقُكُم مِّنَ السَّمَاء وَالأَرْضِ أَمَّن يَمْلِكُ السَّمْعَ والأَبْصَارَ وَمَن يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيَّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ الأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلاَ تَتَّقُونَ (سورة يونس-31)

“হে পয়গম্বর! আপনি মুশকদেরকে জিজ্ঞেস করুন যে, বল তো কে তোমাদেরকে আসমান জমিন থেকে রুযী কে দেন? এবং কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কে মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্মসম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তারা পরিস্কার বলবে যে, মহান আল্লাহ। বল এরপরও কি তোমরা ভয় করবে না? (সূরা ইউনুস-৩১)

আল্লাহ তায়ালাই মূল ক্ষমতার অধিকারী একথা আরবের মুশরিকরাও বিশ্বাস করতো, তারপরও তারা কাফের কেন?

এই সূরার প্রথমাংশে মহান রাব্বুল আলামীন এ প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে-

وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لاَ يَضُرُّهُمْ وَلاَ يَنفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلاء شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لاَ يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلاَ فِي الأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ (18)

আর তার (মুশরেকরা) আল্লাহ ভিন্ন এমন কতিপয়ের ইবাদত করে, যারা তাদের কোন অপকারও করতে পারেনা এবং তাদের কোন উপকারও করতে পারেনা, ও তারা বলে-এরা হল আল্লাহ তায়ালার কাছে আমাদের সুপারিশকারী। (হে রাসূল!) আপনি বলে দিন, তোমরা কি আল্লাহ তায়ালাকে এমন বিষয়ের সংবাদ দিচ্ছ যা আছে বলে তিনি (নিজেও) জানেন না, না আসমানে না জমিনে! তিনি তাদের শিরকী কার্যকলাপ হতে পবিত্র ও অনেক ঊর্দ্ধে। (সূরা ইউনুস-১৮)

আরবের মুশরিকরা আল্লাহকে স্রষ্টা স্বীকার করতো। আরবের মুশরিকরা কাবার হিফাযত করতো। কাবা তওয়াফ করতো। মেহমানদারী করতো। কিন্তু এরপরও তারা কফির। তারা মুশরিক।

কেন? কারণ তারা আল্লাহর সাথে সাথে মূর্তির কাছে সন্তান চাইতো। মূর্তির জন্য মান্নত করতো। মূর্তির নামে কুরবানী করতো।

এসব কারণে তারা মুশরিক। ধিকৃত।

প্রশ্ন হল, একই কাজ মাইজভান্ডারী, আটরশীর মাজারের মুরীদেরা করার পরও তারা খাঁটি মুসলিম থাকে কী করে? তারা কেন মুশরিক নয়?

আটরশী ও মাইজভান্ডারীদের আরো কিছু কুফরী আকীদা

আটরশী ও মাইজভান্ডারীদের মাঝে উপরোক্ত শিরকী কাজ ছাড়াও আরো অনেক ইসলাম ও কুরআন হাদীস বিরোধী আকীদা বিদ্যমান।

কয়েকটি নিচে উদ্ধৃত করা হলঃ


ইসলাম আসার পর ইসলাম ছাড়াও অন্য যেকোন ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে আমল করে মানুষ আখেরাতে মুক্তি পেতে পারে। [মাইজভান্ডারী সিলসিলার দ্বিতীয় পীর সায়্যিদ দিলাওয়ার হুসাইন (মৃত্যু ১৯৮২ ইং) রচিত “বেলায়েতে মুতলাকা” গ্রন্থের ৮৯-৯১, ১২৯ পৃষ্ঠা দৃষ্টব্য]

ঠিক একই বক্তব্য রয়েছে আটরশীর পীরের।

বিশ্ব জাকের মঞ্জিল, ২৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪ ইং এর প্রকাশিত সংবাদঃ পীর সাহেব বলেন, “হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খৃষ্টানগণ নিজ নিজ ধর্মের আলোকেই সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করতে পারে”।

অথচ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনঃ

إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ ۗ [٣:١٩]

নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম। [সূরা আলে ইমরান-১৯]

وَقُل لِّلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ ۚ فَإِنْ أَسْلَمُوا فَقَدِ اهْتَدَوا ۖ وَّإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ ۗ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ [٣:٢٠]

আর আহলে কিতাবদের এবং নিরক্ষরদের [আরব মুশরকেদের] বলে দাও যে, তোমরাও কি আতœসমর্পণ করেছ? তখন যদি তারা আত্মসমর্পণ  করে, তবে সরল পথ প্রাপ্ত হলো, আর যদি মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তাহলে তোমার দায়িত্ব হলো শুধু পৌঁছে দেয়া। আর আল্লাহর দৃষ্টিতে রয়েছে সকল বান্দা। [সূরা আলে ইমরান-২০]

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ [٣:٨٥]

যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত। [সূরা আলে ইমরান-৮৫]

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ: «وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَا يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الْأُمَّةِ يَهُودِيٌّ، وَلَا نَصْرَانِيٌّ، ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ، إِلَّا كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ

হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ঐ সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, এ উম্মতের ইয়াহুদী বা খৃষ্টান যে-ই আমার দাওয়াত পাে আর আমার আনীত দ্বীনের উপর ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করবে, সে হবে জাহান্নামী। [সহীহ মুসলিম-১/৮৬, হাদীস নং-২৪০]

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী রহঃ লিখেনঃ

وانما ذكر اليهود والنصرى تنبيها على من سواهما، لأن اليهود والنصارى لهم كتاب، فإذا كان هذا شانهم مع أن لهم كتابا فغيرهم ممن لا كتاب لهم أولى (شرح مسلم-1/86)

“ইয়াহুদ ও খৃষ্টানদের উল্লেখ এজন্যে করা হয়েছে যেন অন্যদের ব্যাপারে সতর্কারোপ হয়ে যায়। কেননা, ইয়াহুদ ও খৃষ্টানদের রয়েছে আসমানী কিতাব। তাদের নিকট আসমানী কিতাব থাকা সত্ত্বেও যখন অবস্থা এমন, তাহলে যাদের কিতাব নেই তাদের অবস্থাতো বলার অপেক্ষাই রাখে না”। [শরহে মুসলিম-১/৮৬]


মাইজভান্ডারীদের মতেঃ

ক) তরীকত শরীয়ত থেকে ভিন্ন একটি বিষয়।
খ) বিশেষ ব্যক্তিবর্গের জন্য শরীয়তের অনুসরণ করা জরুরী নয়।
গ) বিশেষ ব্যক্তিবর্গের জন্যে নামায, রোযা ও অন্যান্য ইবাদত পালন করা অপরিহার্য নয়।
ঘ) বিশেষ ব্যক্তিবর্গের শরীয়ত ও কুরআন-হাদীস এবং সাধারণ মানুষের শরীয়ত ও কুরআন-হাদীস থেকে ভিন্ন।
ঙ) সাধারণ মানুষের জন্যে শরীয়তে মুহাম্মদীর অনুসরণও আবশ্যক নয়, বরং নিজের ইচ্ছেমত যে কোন ধর্মের অনুসরণ করলেই আখেরাতে মুক্তি পাওয়া যাবে।

দেখুন- মাইজভান্ডারীর পীরের লেখা “বেলায়েতে মোতলাকা” গ্রন্থের ১৬, ১১৮, ১১৯-১২০ নং পৃষ্ঠা।

এমন সব কুফরী আকীদা আমলে ভরপুর এসব ভান্ডারী ও আটরশীদের দরবার। এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে হলে পড়–ন মাওলানা আব্দুল মালেক দামাত বারাকাতুহুর লেখা “তাসাওউফ তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ” গ্রন্থটি।

আল্লাহ তাআলা আমাদের এসব ভ্রান্ত পীরদের ভন্ডামী থেকে আমাদের দেশের সরলপ্রাণ মুসলমানদের ঈমান ও আমলকে হিফাযত করুন। আমীন।

হজ ও কুরবানি সম্পর্কিত নির্বাচিত হাদীস

১। জুনদুব ইবন আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি কুরবানির দিন রাসুল সা.-এর কাছে উপস্থিত ছিলেন। রাসূল সা. নামায আদায় করলেন। এরপর খুৎবা দিলেন এবং বললেন, নামায আদায় করার পূর্বে যে ব্যক্তি কুরবানির পশু জবাই করেছে, সে যেন এর স্থলে আরেকটি কুরবানি করে। আর যে  ব্যক্তি নামাযের পূর্বে জবাই করেনি সে যেন আল্লাহর নামে জবাই করে। [সহীহ বুখারি : হাদিস ৬৮৯৬] ( হজ ও কুরবানি )

২। আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সা. বিসমিল্লাহ পড়ে এবং তাকবীর বলে দুইটি ভেড়া কুরবানি করেছেন। [সহীহ বুখারি : হাদিস ৬৮৯৫]

৩। আবিস রহ. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি আয়িশা রা.-কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুল সা. কি কুরবানির পোশত তিন দিনের বেশী সময় খেতে নিষেধ করেছেন? তিনি বললেন, সেই বছরেই কেবল নিষেধ করেছিলেন যেই বছর মানুষ অনাহারে আক্রান্ত হয়েছিল। তখন তিনি চেয়েছিলেন যেন ধনীরা গরীবদের খাওয়ায়। আমরা তো বকরীর পায়াশুলো তুলে রাখতাম এবং পনের দিন পর তা খেতাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, কোন্ জিনিস  আপনাদের এগুলো খেতে বাধ্য করত? তিনি হেসে বললেন, মুহাম্মদ সা. আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর পবিবার-পরিজন একাধারে তিন দিন তরকারিসহ গমের রুটি পেট ভরে খান নি। [সহীহ বুখারি : হাদিস ৫০২৯] ( হজ ও কুরবানি )

৩। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. এক ব্যক্তিকে একটা কুরবানির উট হাঁকিয়ে নিয়ে যেতে দেখে বললেন, তুমি এর উপর সাওয়ার হয়ে যাও। সে বলল ইয়া রাসুলুল্লাহ সা.! এটি তো কুরবানির উট। তখন তিনি দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার বললেন, ওয়াইলাকা (তোমার অনিষ্ট হোক) তুমি এতে সাওয়ার হয়ে যাও। [সহীহ বুখারি : হাদিস ৫৭২৯]

৪। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল সা.-এর কাছে আরজ করল, আমি তো প্রস্তর নিক্ষেপের পূর্বে যিয়ারত করে ফেলেছি। তিনি বললেন, কোন দোষ নেই। আরেক ব্যক্তি বলল, আমি তো যবেহ করার পূর্বে মাথা মু-ন করে ফেলেছি। তিনি বললেন, কোন দোষ নেই। অপর ব্যক্তি বলল, আমি তো  প্রস্তর নিক্ষেপের পূর্বে যবেহ করে ফেলেছি! তিনি বললেন, কোন দোষ নেই। [সহীহ বুখারি : হাদিস নাম্বার ৬২১১]

৫। আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. কুরবানির দিন খুতবা দিচ্ছিলেন। তখন এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়াল এবং আরজ করল, ইয়া রাসুলুলাহ! আমি ধারণা করলাম যে, অমুক অমুক আমলের পূর্বে অমুক অমুক রুকন হবে। এরপর অপর এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়াল এবং আরজ করল, ইয়া রাসুলুল্লাহ সা.! অমুক অমুক আমলের পূর্ব অমুক আমল হবে, (অর্থাৎ তারা যবেহ, হলক ও তাওয়াফ) এই তিনটি কাজ সম্পর্কে জানতে চাইল। তখন রাসুল সা. বললেন, করতে পার, কোন দোষ নেই। ঐ দিন যা-কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো তিনি বললেন, করতে পার কোন দোষ নেই। [সহীহ বুখারি : হাদিস ৬২১০]

৬। আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাদের কাছে আল্লাহর কিতাব এবং রাসুল সা. থেকে বর্ণিত এই সহীফা ছাড়া আর কিছুই নাই। তিনি আরো বলেন, আয়ির নামক স্থান থেকে অমুক স্থান পর্যন্ত হল হারম। যদি কেউ এতে কুরআন-সুন্নাহর খেলাফ অসঙ্গত কোন কাজ করে অথবা কুরআন-সুন্নাহর খেলাফ আচরণকারীকে আশ্রয় দেয়, তাহলে তাঁর উপর আল্লাহর লা’নত এবং সকল ফেরেশতা এবং মানুষের। সে ব্যক্তির কোন নফল এবং ফরজ ইবাদাত কবুল করা হবে না। তিনি আরো বলেন, মুসলমান কর্তৃক নিরাপত্তাদানের অধিকার সকলের ক্ষেত্রে সমান। তাই যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দেওয়া নিরাপত্তাকে লঙ্ঘন করবে, তাঁর প্রতি আল্লাহর লা’নত এবং সকল মানুষের ও ফিরিশতাদের। আর কবুল করা হবে না তাঁদের কোন নফল এবং ফরজ ইবাদাত। যে ব্যক্তি তাঁর মাওলার (মিত্রের) অনুমতি ব্যতীত অন্য কাওমের সাথে বন্ধুত্ব করবে, তাঁর প্রতিও আল্লাহর লা’নত এবং সকল ফেরেশতা ও মানুষের। সে ব্যক্তির কোন নফল এবং ফরজ ইবাদাত কবুল করা হবে না। [সহীহ বুখারি : হাদিস ১৭৪৯]

৭। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলতেন, আমি যদি মদিনাতে কোন হরিণকে বেড়াতে দেখি তাহলে তাঁকে আমি তাড়াবো না। কেননা রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, মদিনার কংকরময় দুই এলাকার মধ্যবর্তী এলাকা হল হারম বা সম্মানিত স্থান। [সহীহ বুখারি : হাদিস নাম্বার ১৭৫২]

৮। উকবা ইবনে আমির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার বোন পায়ে হেঁটে হজ করার মান্নত করেছিল। আমাকে এ বিষয়ে রাসুল সা. থেকে ফতোয়া আনার অনুরোধ করলে আমি রাসুল সা.-কে  বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, পায়ে হেঁটেও চলুক, সওয়ারও হোক। [সহীহ বুখারি : হাদিস ১৭৪৪]

৯। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে তাঁর দুই ছেলের উপর ভর করে হেঁটে যেতে দেখে বললেন, তাঁর কি হয়েছে? তাঁরা বললেন, তিনি পায়ে হেটে হজ করার মান্নত করেছেন। রাসূল বললেন, লোকটি নিজেকে কষ্ট দিক, আল্লাহ তাআলার এর কোন প্রয়োজন নেই। তাই তিনি তাঁকে সওয়ার হয়ে চলার জন্য আদেশ করলেন। [সহীহ বুখারি : হাদিস ১৭৪৩]

হেরা পাহাড় ও তার গুহা

প্রথমত: পাহাড়টির পরিচয়:

মসজিদে হারাম থেকে পূর্ব-উত্তর কোণে ত্বায়েফ (সায়েল) রোডে মসজিদে হারাম হতে ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পার্শ্ববর্তী স্থান থেকে তার উচ্চতা ২৮১ মিটার, তার চূড়া উটের কুঁজের মতো এবং তার আয়তন হলো ৫ কিলোমিটার। তার কিবলার দিক বিস্তৃত ফাঁকা অংশ, যেখান থেকে মসজিদে হারাম দেখা যায়। গুহায় দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ মিটার।[১]

দ্বিতীয়ত: এর হাকীকত বা রহস্য:

হেরাপাহাড়, সেই পাহাড় যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে ইবাদতের জন্য নির্জনতা অবলম্বনকরতেন। সেখানে জিবরীল আলাইহিস সালাম অবতরণ করেন এবং সে হেরা গুহায় সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়। আল্লাহতা‘আলার বাণী:

﴿ٱقۡرَأۡبِٱسۡمِرَبِّكَٱلَّذِيخَلَقَ١خَلَقَٱلۡإِنسَٰنَمِنۡعَلَقٍ٢ٱقۡرَأۡوَرَبُّكَٱلۡأَكۡرَمُ٣ٱلَّذِيعَلَّمَبِٱلۡقَلَمِ٤عَلَّمَٱلۡإِنسَٰنَمَالَمۡيَعۡلَمۡ٥﴾ [العلق: ١،٥]

“তুমি পড় তোমার সেই রব্বের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে । পড় এবং তোমার রব্ব মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে (এমনজ্ঞান) যা সে জানতোনা।”[সূরাআল-‘আলাক, আয়াত: ১-৫]

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, প্রথম দিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অহী প্রাপ্ত হন নিদ্রাযোগে সঠিক স্বপ্নের মধ্যে। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা প্রত্যুষের আলো সদৃশ স্পষ্ট হয়ে দেখা দিত। অতঃপর তাঁর নিকট নির্জন ও নিঃসঙ্গ পরিবেশ পছন্দ হয়। কাজেই তিনি একাধারে কয়েকদিন পর্যন্ত নিজ পরিবারে অবস্থান না করে হেরা  পর্বতের গুহায় নির্জন পরিবেশে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকেন। আর এই উদ্দেশ্যে তিনি প্রয়োজনীয় খাদ্য সমাগ্রী সাথে নিয়ে যেতেন। তারপর তিনি তাঁর জীবন সঙ্গিনী মহিয়সী বিবি খাদীজার নিকট ফিরে এসে আবার কয়েকদিনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী নিয়ে যেতেন।

এভাবে হেরা গুহায় অবস্থান কালে তাঁর নিকট প্রকৃত সত্য (আল্লাহরঅহী) সমাগত হয়। (আল্লাহর) ফিরিশতা জিবরীল আলাইহিস সালাম সেখানে আগমনপূর্বক তাঁকে বললেন, আপনি পড়ুন! রাসুলুল্লাহ্সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি বললাম, আমিতো পড়তে জানিনা ! তিনি বললেন, তখন আমাকে ফিরিশতা জিবরীল (আলাইহিস সালাম) জড়িয়ে ধরে এত কঠিনভাবে  আলিঙ্গন করলেন যে তাতে আমি ভীষণ কষ্ট অনুভব করলাম। অতঃপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, আপনি পড়ুন ! তখন আমি পূর্বের ন্যায় বললাম, আমিতো পড়তে জানিনা ! তখন তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে এত কঠিনভাবে আলিঙ্গন করলেন যে তাতে আমি ভীষণ কষ্ট অনুভব করলাম। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, আপনি পড়ুন! আমি পূর্বানুরূপ তখনও বললাম,  আমিতো পড়তে জানিনা। তখন তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে তৃতীয়বার আলিঙ্গন করে ছেড়ে দিলেন। তারপর তিনি বললেন:

﴿ٱقۡرَأۡبِٱسۡمِرَبِّكَٱلَّذِيخَلَقَ١خَلَقَٱلۡإِنسَٰنَمِنۡعَلَقٍ٢ٱقۡرَأۡوَرَبُّكَٱلۡأَكۡرَمُ٣﴾ [العلق: ١،٣]

“আপনি আপনার রব্বের নামে পড়ুন, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট বাঁধা রক্ত হতে। আপনি পড়ুন ! আর আপনার রব্ব মহামহিমান্বিত ! [সূরা আল-‘আলাক, আয়াত: ১-৩]

এসেই পাহাড় যাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন: “স্থির হও হে হেরা।”

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার হেরা পাহাড়ে অবস্থান করছেন এমন সময় পাহাড় নড়া-চড়া শুরু করে, তখন রাসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: হে হেরা স্থির হও, তোমার উপরতো একজন নবী, এক সিদ্দীক ও শহীদ রয়েছেন” সে সময় তার উপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবুবকর, উমার, উসমান, আলী, ত্বালহা, যুবায়ের ও সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহুম উপস্থিত ছিলেন।[২]

এ হেরা পাহাড়ের চূড়ায় যে গুহা রয়েছে, অহী অবতীর্ণ হওয়ার পর, এমনকি মক্কা বিজয়ের পর, কিংবা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হজের সময় বা তাঁর কোনো সাহাবী কখনও আসা-যাওয়া করেছেন বলে কোনো দলীল-প্রমাণ নেই।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন: হেরা গুহায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী হওয়ার পূর্বেই নির্জনতা গ্রহণ করত: ইবাদত করেন। অতঃপর আল্লাহ যখন তাঁকে নবুওয়াত ও রিসালাত দ্বারা সম্মানিত করলেন, সৃষ্টির ওপর তাঁর প্রতি ঈমান আনা, তাঁর অনুসরণ ও আনুগত্য ফরয করে দিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও যারা তাঁর প্রতি ঈমান আনেন সেই সর্বোত্তম সৃষ্টি মুহাজিরগণ মক্কায় বেশ কিছু বছর অবস্থান করেন; কিন্তু সে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে বা তাঁর কোনো সাহাবী হেরা পাহাড়ে যাননি।

অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করেন ও চারবার উমরা করেন। অথচ সেগুলোর কোনোটিতে না রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, না তাঁর কোনো সাহাবী হেরা গুহায় আগমন করেন, না সেখানে তারা যিয়ারত করেন, না মক্কার পার্শ্ববর্তী কোনো স্থানের কোনো অংশ তাঁরা যিয়ারত করেন। অতএব, সেখানে মসজিদে হারাম, সাফা-মারওয়ার মধ্যবর্তীস্থান, মিনা, মুযদালিফা ও ‘আরাফাত ব্যতীত আর কোনো স্থানে কোনো ধরণের ইবাদত নেই।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদীন ও অন্যান্য মহান উত্তরসূরীগণ অতিবাহিত হয়েছেন তারা হেরা গুহাবা এ ধরণের অন্য কোথাও সালাত বা দো‘আর জন্য গমন করেননি।

আর সর্বজন বিদিত যে, যদি তা শরী‘আত সম্মত হত বা এমন মুস্তাহাব আমলের অন্তর্ভুক্ত হত যাতে আল্লাহ নেকী দিবেন তবে এব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মানুষ অপেক্ষা বেশি জানতেন ও সাহাবীগণ ও এসম্পর্কে জানতেন। আর সাহাবীগণ ছিলেন নেকীর কাজ সমূহের ক্ষেত্র সর্বাধিক অবগত ও আগ্রহী। তাসত্ত্বেও যেহেতু তারা এ সবের কোনো কিছুর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেন নি, তাতে বুঝা যায় যে, এ পর্বত বা এ জাতীয় কোনো স্থানে গিয়ে ইবাদত করা হচ্ছে সেই সব নতুন নতুন আবিস্কৃত বিদ‘আত সমূহের অন্তর্ভুক্ত; যেগুলোকে তারা কোনো ইবাদত, নৈকট্য অর্জনের উপায় বা অনুসরণ যোগ্য গণ্য করতেন না।

সুতরাং যে সেগুলোকে কোনো ইবাদত, নৈকট্য অর্জনের উপায় বা অনুসরণ যোগ্য গণ্য করল সে অবশ্যই তাদের হক পথের অনুসরণ পরিত্যাগ করে অন্য ভ্রান্ত পথের অনুসরণ করল এবং এমন নিয়ম-নীতি প্রবর্তন করল যার অনুমতি আল্লাহ প্রদান করেননি।[৩]

তৃতীয়ত: হেরা গুহায় কতিপয় হাজী দ্বারা যে সমস্ত বিদ‘আত সুন্নাত বিরোধী কার্যকলাপ সংঘটিত হয়:

হেরা পাহাড়ে কোনো কোনো হাজী বেশ কিছু বিদ‘আত ও সুন্নাত পরিপন্থী কার্যকলাপে পতিত হয়। আর তার কারণ হলো, এ পাহাড়ের পবিত্রতা ও ভিন্ন মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য আছে বলে তাদের ভ্রান্ত ধারণা, যার ভ্রান্ততা সম্পর্কে ইতোপূর্বে সতর্ক করা হয়েছে। হাজীগণ যেন এ সমস্ত বিদ‘আত ও কুসংস্কারে পতিত হওয়া থেকে সতর্ক থাকে এজন্য নিম্নে তার কতিপয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হলো:

১। নেকীর উদ্দেশ্যে হেরা পাহাড় যিয়ারত করা, তার উপর আরোহণ ও তার পবিত্রতা ও ভিন্ন মর্যাদার বিশ্বাস পোষণ করা।

২. হেরা পাহাড়কে কিবলা করে উভয় হাত উঠিয়ে খুব করে দো‘আ করা।

৩. সেখানে সালাত আদায় করা।

৪. তার উপর বিভিন্ন নাম বা অন্য কিছু লেখা-লেখি করা।

৫.সেখানে ত্বাওয়াফ করা।

৬.সেখানকার গাছ-পালা ও পাথর দ্বারা বরকত গ্রহণ ও সেগুলোতে নেকড়া, সূতাবাঁধা।

৭. বিভিন্ন ভ্রান্ত বিশ্বাসে যেমন,যেন বারবার সেখানে আগমন করতেপারে। অমুকব্যক্তি হজ করতে পারে, রোগ-ব্যাধি মুক্ত হয়, সন্তান প্রসব হয়না এমন মহিলার যেন সন্তান প্রসব হয় ইত্যাদি বিশ্বাসে ম্যাসেজ, কবিতা, চিত্র, নেকড়া ইত্যাদি স্থাপন করা,পয়সা দেওয়া।

এধরণের বিদ‘আত ও কুসংস্কার সেখানে ঘটে থাকে অথচ যে ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কোনো দলীল অবতীর্ণ করেননি।


রেফারেন্স
[১] দেখুন: আল জামে আল-লাতীফপৃ: ২৯৯ইত্যাদি গ্রন্থ।
[২]সহীহ মুসলিম: ৭/১২৮-৬৪০১।
[৩]দেখুন: ইকতিদ্বা উস সিরাতিল মুসতাকীম: ২/৩৩৩।

আলেম সমাজের প্রতি অবজ্ঞা একটি ধ্বংসাত্মক ব্যাধি : বিচারপতি আল্লামা তাকী উসমানী

হযরত আমর ইবনে আওফ রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. এরশাদ করেন-
اتقوا زلة العالم وانتظروا هيئته
“উলামায়ে দ্বীনের ত্র“টি-বিচ্যুতি দেখা থেকে বেঁচে থাক এবং তাদেরকে বিচ্যুতি থেকে ফিরে আসার অপেক্ষা কর।” [সুনানে কুবরা লিল বায়হাকী : হা.১৯২৬৩, আল মুদখালু ইলাস সুনানিল কুবরা লিল বায়হাকী : হা.৬৭৩]
আলেম দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যাকে আল্লাহ তা’আলা দ্বীন ইসলামের তথা কুরআন, হাদীস ও ফিকহের ইলম বা জ্ঞান দান করেছেন। তোমার নিশ্চিত জানা আছে অমুক কাজটি গুনাহ।  তুমি দেখতে পাচ্ছ একজন আলেম উক্ত গুনাহে জড়িত। এখানে তুমি এটা কখনো চিন্তা করবে না যে, এতবড় আলেম ব্যক্তি যখন এ গুনাহের কাজ করছেন, আমিও করি; বরং তুমি ঐ আলেমের কৃতগুনাহ থেকে বেচে থাকবে, তুমি ওটাতে লিপ্ত হয়ো না।

পাপ কাজে উলামাদের অনুসরণ করো না ।
উক্ত হাদীসের প্রথম বাক্যে তাদেরকে সর্তক করেছেন, যাদেরকে গুনাহ থেকে নিষেধ করা হলে বলে উঠে, অমুক আলেমও তো এটা করে, অমুক আলেম অমুক সময় এই কাজ করেছিলেন। রাসূল সা. এ ধরণের যুক্তি দেয়ার মূল কেটে দিয়েছেন যে,

তোমরা উক্ত আলেমের কৃতগুনাহের অনুসরণ করো না, বরং তোমরা আলেমগণের শুধু ভালো ভালো কাজগুলোর অনুসরণ করো। ঐ আলেম যদি সত্যিই কোন গুনাহের কাজ করেই থাকেন, তবে তোমাদের মনে যেন এটা বাসা না বাঁধে, অমুক বড় আলেম যখন এ কাজ করেছেন, আমিও করব।

একটু ভেবে দেখ, যদি উক্ত আলেম নরকের রাস্তায় পা বাড়ায়, তুমি কি তার পেছনে জাহান্নামের পথেই অগ্রসর হবে? তাকে যদি আগুনে পুড়ানো হয়, তুমিও কি আগুনে জ্বলবে? বাস্তব কথা হলো, তুমি এটাতে সম্মত হবে না। সুতরাং কি কারণে তুমি গুনাহের কাজে তাঁর অনুসরণ করছো?

আলেমের আমল গ্রহণীয় হওয়া জরুরী নয়
আলেমগণ বলেছেন, যে আলেম সত্য ও সঠিক অর্থেই আলেম, তার ফাতাওয়া ও মাসআলা গ্রহণযোগ্য। তার আমল গ্রহণযোগ্য হওয়ার প্রয়োজন নেই। যদি তিনি কোন ভুল কাজে লিপ্ত থাকেন আর তুমি জিজ্ঞাসা কর, এ কাজটি কি ঠিক? জায়েয? তখন তিনি উত্তর দিবেন, কাজটি না জায়েয। তাই তুমি তার দেয়া ফাতাওয়ার অনুসরণ কর। তার আমলের অনুসরণ করো না। সুতরাং একথা বলা অমুক কাজটি যেহেতু বড় আলেমগণ করেছেন, আমিও করি- যথার্থ নয়। যেমন ভাবে যথার্থ নয় এ কথা বলা- অমুক আলেমগণ যখন আগুনে পুড়ে ভস্ম হচ্ছেন, আমিও তাদের সাথে গিয়ে অগ্নিতে পুড়ে ছাই হই। এজন্য রাসূল সা. বলেছেন, আলেমদের ভুল-ত্র“টি ধরা থেকে বেঁচে থাক অর্থাৎ তাদের অন্যায় কাজের অনুসরণ করিও না।

আলেমগণের প্রতি মন্দ ধারণা না করা
কেউ কেউ আরেকটি ভুল করে থাকে, তাহল সে যখনই কোন আলেমকে ভুল কাজে লিপ্ত দেখে ততক্ষণাৎ তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বসে। তার উপর মন্দ ধারণা পোষণ করে কখনো তার কুৎসা রটাতে থাকে। পর্যায়ক্রমে পুরো আলেম সম্প্রদায়ের উপর ঢালাওভাবে কুৎসা রটাতে থাকে যে, বর্তমানের আলেম সম্প্রদায় এমনি হয়ে থাকে।

নবী করীম সা. এধরণের ধারণা করতে বারণ করেছেন যে, যদি কোন আলেম গুনাহে লিপ্ত হয় তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করিও না। আলেমগণ তোমাদের মতই রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। যে গোস্ত, হাড্ডি, তোমাদের আছে তাদেরও তাই আছে। যে আত্মা-রিপু তোমাদের রয়েছে তাদের ও সেরূপ রিপুই রয়েছে, শয়তান তোমাদের পেছনে যেমন লেগে আছে, তাদের পেছনেও তেমনি লেগে রয়েছে। তাঁরা কোন নবী নন, তাঁরা কোন নিষ্পাপ ফেরেশতাও নয়। বরং তাঁরা এ পৃথিবীরই বাসিন্দা।

সুতরাং এটা তোমরা কোত্থেকে বুঝে নিলে তারা গুনাহ থেকে পবিত্র? যেহেতু তারা মানুষ, মানবীয় চাহিদায় তাদেরও ভুল হওয়া স্বাভাবিক। অতএব তার গুনাহের কারণে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং তার উপর মন্দ ধারণা করা ঠিক নয়। এজন্যই রাসূল সা. ঐ আলেম থেকে তড়িৎ সম্পর্ক ছিন্ন করতে বারণ করেছেন। তাকে সুপথে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ তার নিকট সঠিক জ্ঞান আছে, আশা করা যায় তিনি কোন সময় সঠিক পথে ফিরে আসবেন।

আলেমগণের জন্য দুআ কর
আলেমগণের জন্য প্রার্থনা কর: হে প্রভূ! অমুক ব্যক্তি আপনার দ্বীনের ধারক বাহক তার দ্বারা আমাদের দ্বীন ইসলামের জ্ঞান লাভ হয়। তিনি অমুক ভুলের মাঝে নিপতিত। হে আল্লাহ ! তোমার দয়ায় তাকে উক্ত ভুল থেকে উদ্ধার করে দাও। আমীন।

এ প্রার্থনায় তোমার দুটি লাভ হবে। এক. দুআ করার বিনিময়ে পূণ্য পাবে। দুই. অপর মুসলমানের মঙ্গল কামনা করার প্রতিদান পাবে। যদি তোমার এ দুআটি আল্লাহর নিকট গ্রহণীয় হয় তবে তো তুমি উক্ত আলেমের আত্মশুদ্ধির কারণ হবে। এর ফলশ্র“তিতে তিনি যত সৎকাজ করবেন, তা তোমার আমলনামায় লিপিবদ্ধ হবে। অতএব অকারণে কোন আলেমের কুৎসা রটানো, অমুক ব্যাক্তি বড় আলেম হয়েছে বটে কিন্তুু সে এ ধরনের বাজে কাজ করে, সুতরাং তার থেকে ভালোর আশা করা যায়না। তার দ্বারা তোমাদের কোন উপকার সাধিত হবার নয়।

আমলবিহীন আলেমও সম্মানের পাত্র
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানুভী রহ. বলেন, আলেগণের উচিত তার ইলম অনুযায়ী আমল করা। কিন্তু যদি কোন আলেম স্বীয় ইলম অনুযায়ী আমল নাও করেন তবুও তিনি স্বীয় জ্ঞানের কারণে তোমাদের নিকট সম্মানের পাত্র। আল্লাহ তাআলা তাকে জ্ঞান দান করেছেন, তার এই ইলমেরও একটি সম্মান আছে। এ সম্মানের কারণে সে আলেমও সম্মানের পাত্র। যেমন মহান আল্লাহ তাআলা মাতা পিতার শানে ইরশাদ করেন। ‘যদি মাতা পিতা কাফের মুশরিকও হন তাহলে শিরিক বিষয়ে তাদের নির্দেশ গ্রহণ করোনা, কিন্তু দুনিয়াতে তাদের সাথে সদাচারণ করো। কারণ আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে তাদের মাতা পিতা হওয়ার যে সম্মান অর্জিত হয়েছে তা নীতিগত ভাবেই সম্মানের যোগ্য। অতএব তোমাদের পক্ষে তাদের হেয় করার কোন অবকাশ নেই।

তেমনি একজন আলেম আমলবিহীন হওয়ার পরেও তুমি তার জন্য দুআ করো, হে প্রভু! অমুক আলেমকে সৎকাজের সামর্থ্য দাও। তুমি তার অসৎ আচরণের হেতু তাকে হেয় করো না।
হযরত আশরাফ আলী থানুভী রহ. আলেমগণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, এককভাবে শুধু জ্ঞান কোন বস্তু নয়, বা কোন কাজে আসেনা। যতক্ষণ পর্যন্ত না তার সাথে আমল থাকবে। পাশাপাশি তিনি একথাও বলেছেন, আমার অভ্যাস হলো যখনই আমার নিকট কোন আলেম ব্যক্তি আসেন, যদিও তার সম্পর্কে আমার জানা আছে যে, তিনি অমুক অমুক খারাপ কাজে অভ্যস্থ, তবুও আমি তার নিকট ইলম থাকার দরুণ তার সম্মান করে থাকি।

আলেমগণের সাথে পরস্পর সম্পর্ক স্থাপন কর ।
সুতরাং এ ধরণের প্রোপাগাণ্ডা করা এবং আলেমগণের দুর্ণাম করা বা তাচ্ছিল্য ভরে দেখা ও বলা: ‘আরে মিয়া আজকালকার আলেম সবই এক রকম। বর্তমানের আলেমদের তো অবস্থাই এই। কী আর বলব তাদের কথা।’ এ ধরনের উক্তি করা বর্তমানের একটি ফ্যাশান হয়ে পড়েছে। যারা অমুসলিম তাদের তো এরকম অবজ্ঞা করাই কাজের কাজ। কারণ তাদের জানা রয়েছে যতক্ষণ  পর্যন্ত আলেমদের কুৎসা রটানো না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা মুসলিম জাতিকে পথহারা করতে পারব না। যখনই আলেমগণের সাথে জাতির সম্পর্ক ছিন্ন করে দিব, তখনই এই জাতিকে পথহারা করতে পারব।

হযরত আল্লামা মুফতী শফী রহ. বলেন: যখন ছাগল ভেড়াকে দলচুত্য করে দিবে তখনই বাঘ ও সিংহের জন্য স্বাধীনতা এসে যাবে। তারা যখন তখন যেখানে সেখানে ছাগল ভেড়াকে ধরে ধরে খাবে। সুতরাং বিজাতীয়দের কাজই তো হলো উলামাদের কুৎসা রটানো। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো, বিজাতীয়দের অনুসরণ করে দ্বীনদার মুসলমানদেরও বর্তমানে এটা একটা ফ্যাশন হয়ে যাচ্ছে। তারাও আজ সর্বক্ষণ আলেমদের বদনাম দুর্ণাম ও তাদেরকে হেয়পতিপন্ন করার পিছনে মেতে উঠেছে। তারা বলে বেড়ায় উলামাদের তো এই অবস্থা  ঐ অবস্থা। অথচ এ আলোচনায় তাদের কোন লাভ নেই ক্ষতি ছাড়া। আর যখন মুসলিম জাতির উলামাদের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হবে, তখন শয়তান হবে তাদের গুরু। সুতরাং নিজেদের স্বার্থে হলেও, কোন আলেমকে আমলহীন পেলে তার জন্য দুআ কর, তাদের পিছনে পড়না, বরং দুআ করলে আল্লাহর ইচ্ছায় এই দুআ তোমাদেরই কাজে আসবে, যখন সেই আলেম সঠিক পথে ফিরে আসবে।

ডাকাত হয়ে গেল পীর ।
হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ. একদা স্বীয় মুরীদদের বলতেছিলেন। তোমরা কেন আমার পিছনে ছুটছো? আমার অবস্থাতো ঐ পীরের ন্যায় যে প্রকৃত পক্ষে একজন ডাকাত ছিল। ডাকাত যখন দেখল মানুষ গভীর ভালবাসা ও ভক্তিসহ পীরের নিকট উপঢৌকন নিয়ে যায়, তাদের হাতে চুমু খায়। তার মনে জাগল এটা তো ভাল ব্যবসা। আমি শুধু শুধু রাত জেগে ডাকাতি করে থাকি। তার চেয়ে ভাল, আমি পীর সেজে যাই। মানুষ আমার নিকট উপঢৌকন নিয়ে আসবে হাতে চুমু খাবে।

ব্যস, যেমনি চিন্তা তেমনি কাজ। লোকটি ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে পীর সেজে গেল। একটি খানকা বানিয়ে বসে গেল। একটা লম্বা তাসবীহ নিল আর একটি লম্বা জামা পরিধান করল এবং পীরদের মতই হুলিয়া বানিয়ে তাসবীহ পড়া শুরু করল। এরপর মানুষ যখন দেখতে পেল, কোন একজন আল্লাহ ওয়ালা এখানে বসে আছে, তারা ভাবল বড় পীর হবে বোধ হয়। তখন মানুষ তার হাতে মুরীদ হতে লাগল। এক সময় মুরীদদের সংখা অনেক হলো, কেউ কেউ উপঢৌকন নিয়ে হাজির হতে লাগল। কেউ কেউ হাতে চুমু খেতে লাগল। পীর সাহেব প্রত্যেক মুরীদকে বিশেষ বিশেষ যিকির বলে দিলেন। তুমি এই যিকির করবে তুমি ঐ যিকির করবে। আর যিকিরের বৈশিষ্ট্য হলো, আল্লাহ তাআলা এর উসীলায় মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। যেহেতু  এ মুরীদগণ খাটি নিয়তে ও একাগ্রচিত্তে আল্লাহর যিকির করতে থাকলো। পরিণামে আল্লাহ তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করলেন। খুলে দিলেন তাদের অর্ন্তদৃষ্টি। আসীন করলেন উচ্চাসনে।

মুরীদের দুআও কাজে আসে
একদা মুরীদগণ পরস্পর আলোচনা করলো। আল্লাহ তা’আলা তো আমাদেরকে এ স্তরে পৌছিয়েছেন, আমরা দেখি আমাদের পীর সাহেব কোন স্তরে আছে। তারা মুরাকাবা করে পীর সাহেবের স্তর নির্ণয় করতে পারল না। মুরীদরা বলাবলি করতে লাগল, অসম্ভব আমাদের পীর সাহেবের অবস্থান এত উপরে যে, যেখানে আমাদের অর্ন্তদৃষ্টি পৌঁছতে পারেনা।

অবশেষে বিষয়টি পীর সাহেবকে জানাল, হযরত আমরা আপনার অবস্থান খুঁজতে চাইলাম, কিন্তু আপনার অবস্থান এতই উপরে যে, সেখানে আমরা পৌঁছতে পারিনি। তখন পীর সাহেব তার প্রকৃত অবস্থা  প্রকাশ করল এবং কাঁদু কাঁদু অবস্থায় বলল, তোমাদেরকে আমি আমার অবস্থান বলে দিলাম। আমি আসলে একজন ডাকাত। এরপর তার পীর হওয়ার পূর্ণ ঘটনা বলল। আরো  বলল, তোমাদের রিয়াযাত ও মুশাহাদার ময়দানে এত উচ্চাসন লাভ হয়েছে একমাত্র আল্লাহর যিকির একাগ্রতার সাথে করার কারণে। আর আমি তো সর্বনিন্ম স্তরে। তোমরা আমার স্থান কোথায় পাবে? সুতরাং তোমরা আমার নিকট থেকে দূরে সরে যাও। অন্য কোন পীরের সন্ধানে যাও। পীর সাহেব সম্পর্কে একথা শুনে মুরীদগণ সবাই মিলে পীর সাহেবের জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করল।

হে আল্লাহ ! আমাদের পীর সাহেব চোর হোক আর ডাকাত হোক। তুমি আমাদেরকে যা কিছু দিয়েছো, তা তার মাধ্যমেই দিয়েছো। হে আল্লাহ! এখন তুমি তাকেও আত্মশুদ্ধি করে দাও। সমাসীন করে দাও মর্যাদার উচ্চাসনে। যেহেতু মুরীদগণ মুখলেছ ও অত্যন্ত খোদাভীরু ছিল। তাই তাদের দুআর বরকতে আল্লাহ তা’আলা ঐ পীর সাহেবকেও ক্ষমা করে দেন। আর তাকে পৌঁছে দিলেন মর্যাদার উচ্চাসনে।

উপসংহার
যখন কোন আলেম ব্যাক্তির মাঝে কোন ভুল বিষয় পরিলক্ষিত হয়, তখন তাকে দুর্ণাম করে হেয় পতিপন্ন ও লাঞ্ছিত না করে তার জন্য দুআ করাই কাম্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে উপরোল্লিখিত কথা ও বিষয়ের উপর আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : বিচারপতি আল্লামা তাকী উসমানী,


الدال علي الخير كفاعله . প্রতি শেয়ারে নিশ্চিত সওয়াব, আপনার একটি শেয়ারে কারো জীবন বদলাতে পারে, কেউ হতে পারে পরিপুর্ন গুনাহ মুক্ত, পেতে পারে হেদায়াত, তাই খুব শেয়ার করি, جزاک اللہ