8.2 C
New York
Monday, October 27, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 19

বিখ্যাত সাহাবী হযরত সালমান ফারসী (রা) এর ইসলাম গ্রহণের বিস্ময়কর কাহিনী।

সালমান আল ফারিসী (আরবি: ﺳﻠﻤﺎﻥ ﺍﻟﻔﺎﺭﺳﻲ ) হযরত মুহম্মদ (সা.) এর একজন বিখ্যাত সাহাবী। হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাকে সালমান আল খায়র নাম প্রদান করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পূর্বে তার নাম ছিল মাবিহ ইবনে বুজখ্শান । তিনি বর্তমান ইরানের ইস্পাহান নামক স্থানে জায়্য নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার জন্মস্থান কোথায় তা নিয়ে মতভেদ আছে। তার পিতা ছিলেন একজন জরাথ্রুস্টবাদী (জরথুস্ত্রীয় বা পারসিক ধর্মের প্রবর্তক জরথুস্ত্র। তাঁর নাম অনুসারেই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় এই ধর্মের নাম হয়েছে “জরোয়াস্ট্রিয়ানিজ্ম” বা জরাথ্রুস্টবাদ। এ ধর্মে ঈশ্বরকে অহুর মজদা বা আহুরা মাজদা (“সর্বজ্ঞানস্বামী”) নামে ডাকা হয়। এদের ধর্মগ্রন্থের নাম অবেস্তা (বা আবেস্তা) বা জেন্দাবেস্তা। পারসিক ধর্মের অনুসারীরা অগ্নি-উপাসক। আগুনের পবিত্রতাকে ঈশ্বরের পবিত্রতার সাথে তুলনীয় মনে করেন পারসিক জরথুস্ত্রীয়রা)

ইসলাম গ্রহণের পূর্বে সালমান খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। খন্দকের যুদ্ধকালীন সময়ে তার পরামর্শে মুসলমান গণ পরিখা খনন করেন। ধর্মীয় জ্ঞানে তার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। তিনি এ ব্যাপারে গভীর রাত পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সাথে আলোচনায় মগ্ন থাকতেন। তার নিকট হতে ৬০ টি এর মতো হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তার সন্তানদের মধ্যে এক পুত্র এবং তিনজন কন্যা সন্তানের কথা জানা যায়। আসুন জানি এ মহান সাহাবীর সত্যে ফিরে আসার কাহিনী –
——–****——–
এটি একজন সত্য-সন্ধানী ও আল্লাহকে পাওয়ার অভিলাষী এক ব্যক্তির জীবন কথা। তিনি হযরত সালমান আল-ফারেসী। সালমান আল-ফারেসীর যবানেই তাঁর সেই সত্য প্রাপ্তির চমকপ্রদ বর্ণনা রয়েছে। তিনি বলেনঃ আমি তখন পারস্যের ইসফাহার অঞ্চলের একজন পারসী নওজোয়ান। আমার গ্রামটির নাম ‘জায়্যান’। বাবা ছিলেন গ্রামের দাহকান-সর্দার। সর্বাধিক ধনবান ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। জন্মের পর থেকেই আমি ছিলাম তাঁর কাছে আল্লাহর সৃষ্টিজগতের মধ্যে সবচে বেশি প্রিয়। আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার প্রতি তাঁর স্নেহ ও ভালবাসাও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে কোন অমঙ্গলের আশংকায় তিনি আমাকে মেয়েদের মত ঘরে আবদ্ধ করে রাখেন। আমার বাবা-মার মাজুসী ধর্মে আমি কঠোর সাধনা শুরু করলাম এবং আমাদের উপাস্য আগুনের তত্ত্বাবধায়কের পদটি খুব তাড়াতাড়ি অর্জন করলাম। রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা উপাসনার সেই আগুন জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্বটি আমার ওপর অর্পিত হয়।

আমার বাবা ছিলেন বিরাট ভূ-সম্পত্তির মালিক। তিনি নিজেই তা দেখাশুনা করতেন। তাতে আমাদের প্রচুর শস্য উৎপন্ন হতো। একদিন কোন কারণবশত তিনি বাড়িতে আটকে গেলেন, গ্রামের খামারটি দেখাশুনার জন্য যেতে পারলেন না। আমাকে ডেকে তিনি বললেনঃ ‘বেটা, তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো, বিশেষ কারণে আজ আমি খামারে যেতে পারছিনা। আজ বরং তুমি একটু সেখানে যাও এবং আমার তরফ থেকে সেখানকার কাজকর্ম তদারক কর।’ আমি খামারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পথে খৃষ্টানদের একটি গীর্জার পাশ দিয়ে যাবার সময় তাদের কিছু কথার আওয়ায আমার কানে ভেসে এলো। তারা তখন প্রার্থনা করছিলো। এ আওয়াযই আমাকে সচেতন করে তোলে।


এটা পড়ুন –  আহা, এ কবর যদি আমার হত !


দীর্ঘদিন ঘরে আবদ্ধ থাকার কারণে খৃষ্টান অথবা অন্য কোন ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞানই ছিল না। তাদের কথার আওয়ায শুনে তারা কি করছে তা দেখার জন্য আমি গীর্জার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম। গভীরভাবে তাদেরকে আমি নিরীক্ষণ করলাম। তাদের প্রার্থনা পদ্ধতি আমার খুবই ভালো লাগলো এবং আমি তাদের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লাম। মনে মনে বললামঃ আমরা যে ধর্মের অনুসারী তা থেকে এ ধর্ম অতি উত্তম। আমি খামারে না গিয়ে সে দিনটি তাদের সাথেই কাটিয়ে দিলাম। তাদেরকে জিজ্ঞেস করলামঃ
– এ ধর্মের মূল উৎস কোথায়?
– শামে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমি বাড়িতে ফিরে আসলাম। সারাদিন আমি কি কি করেছি, বাবা তা আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।
বললামঃ ‘বাবা কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় দেখতে পেলাম তারা তাদের উপাসনালয়ে প্রার্থনা করছে। তাদের ধর্মের যেসব ক্রিয়াকাণ্ড আমি প্রত্যক্ষ করেছি তা আমার খুবই ভালো লেগেছে। বেলা ডোবা পর্যন্ত আমি তাদের সাথেই কাটিয়ে দিয়েছি।’ আমার কথা শুনে বাবা শংকিত হয়ে পড়লেন। তিনি বললেনঃ ‘বেটা, সে ধর্মে কোন কল্যাণ নেই, তোমার ও তোমার পিতৃপুরুষের ধর্ম তা থেকেও উত্তম।’ বললাম, ‘আল্লাহর শপথ, কখনো তা নয়। তাদের ধর্ম আমাদের ধর্ম থেকেও উত্তম।’ আমার কথা শুনে বাবা ভীত হয়ে পড়লেন এবং আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করতে পারি বলে তিনি আশংকা করলেন। তাই আমার পায়ে বেড়ী লাগিয়ে ঘরে বন্দী করে রাখলেন।

আমি সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিলাম। কিছুদিনের মধ্যেই সে সুযোগ এসে গেল। গোপনে খৃস্টানদের কাছে এই বলে সংবাদ পাঠালাম যে, শাম অভিমুখী কোন কাফিলা তাদের কাছে এলে তারা যেন আমাকে খবর দেয়।
কিছুদিনের মধ্যেই শাম অভিমুখী একটি কাফিলা তাদের কাছে এলো। তারা আমাকে সংবাদ দিল। আমি আমার বন্দীদশা তেকে পালিয়ে গোপনে তাদের সাথে বেরিয়ে পড়লাম। তারা আমাকে শামে পৌঁছে দিল। শামে পৌঁছে আমি জিজ্ঞেস করলামঃ
– এ ধর্মের সর্বোত্তম ও সবচেয়ে বেশী জ্ঞানী ব্যক্তি কে?
তারা বললোঃ বিশপ, গীর্জার পুরোহিত।
আমি তাঁর কাছে গেলাম। বললামঃ আমি খৃষ্টধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। আমার ইচ্ছা, আপনার সাহচর্যে থেকে আপনার খিদমত করা, আপনার নিকট থেকে শিক্ষালাভ ও আপনার সাথে প্রার্থনা করা। তিনি বললেনঃ ভেতরে এসো।

আমি ভেতরে ঢুকে তার কাছে গেলাম এবং তার খিদমত শুরু করে দিলাম। কিছুদিন যেতে না যেতেই আমি বুঝতে পারলাম লোকটি অসৎ। কারণ সে তার সংগী সাথীদেরকে দান-খয়রাতের নির্দেশ দেয়, সওয়াব লাভের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে; কিন্তু যখন তারা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার জন্য তার হাতে কিছু তুলে দেয়, তখন সে নিজেই তা আত্মসাত করে এবং নিজের জন্য পুঞ্জিভূত করে রাখে। গরীব মিসকীনদের সে কিছুই দেয় না। এভাবে সে সাত কলস স্বর্ণ পুঞ্জিভূত করে।
তার এ চারিত্রিক অধপতন দেখে আমি তাকে ভীষণ ঘৃণা করতাম। কিছু দিনের মধ্যেই লোকটি মারা গেল। এলাকার খৃষ্টান সম্প্রদায় তাকে দাফনের জন্য সমবেত হলো। তাদেরকে আমি বললামঃ তোমাদের এ বন্ধুটি খুবই অসৎ প্রকৃতির লোক ছিল। তোমাদের সে দান খয়রাতের নির্দেশ দিত এবং সেজন্য তোমাদেরকে অনুপ্রাণিত করতো। কিন্তু তোমরা যখন তা তার হাতে তুলে দিতে সে সবই আত্মসাত করতো। গরীব-মিসকীনদের কিছুই দিত না।

তারা জিজ্ঞেস করলোঃ তুমি তা কেমন করে জানলে?
বললামঃ তোমাদেরকে আমি তার পুঞ্জিভূত সম্পদের গোপন ভাণ্ডার দেখাচ্ছি।
তারা বললোঃ ঠিক আছে, তাই দেখাও।
আমি তাদেরকে গোপন ভাণ্ডারটি দেখিয়ে দিলে তারা সেখান থেকে সাত কলস সোনা-চান্দি উদ্ধার করে। এ দেখে তারা বললোঃ
– আল্লাহর কসম আমরা তাকে দাফন করবো না।
তাকে তারা শুলিতে লটকিয়ে পাথর মেরে তার দেহ জর্জরিত করে দিল। কিছুদিন যেতে না যেতেই তারা অন্য এক ব্যক্তিকে তার স্থলাভিষিক্ত করলো। আমি তাঁরও সাহচর্য গ্রহণ করলাম। এ লোকটি অপেক্ষা দুনিয়ার প্রতি অধিক উদাসীন, আখিরাতের প্রতি অধিক অনুরাগী ও রাতদিন ইবাদতের প্রতি বেশী নিষ্ঠাবান কোন লোক আমি এর আগে দেখিনি। আমি তাঁকে অত্যধিক ভালোবাসতাম। একটা দীর্ঘ সময় তাঁর সাথে আমি কাটালাম। যখন তাঁর মরণ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, আমি তাঁকে বললামঃ
– জনাব, আপনার মৃত্যুর পর কার সাহচর্যে কাটাবার উপদেশ দিচ্ছেন আমাকে?

বললেনঃ বেটা আমি যে সত্যকে আঁকড়ে রেখেছিলাম, এখানে সে সত্যের ধারক আর কাউকে আমি জানিনা। তবে মাওসেলে এক ব্যক্তি আছে, নাম তাঁর অমুক, তিনি এ সত্যের এক বিন্দুও পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করেননি। তুমি তঁঅর সাহচর্য অবলম্বন করেঅ্ আমার সে বন্ধুটির মৃত্যুর পর মাওসেলে গিয়ে তাঁর বর্ণিত লোকটিকে আমি খুঁজে বের করি। আমি তাঁকে আমার সব কথা খুলে বলি। একথাও তাঁকে আমি বলি যে, অমুক ব্যক্তি তাঁর অন্তিম সময়ে আমাকে আপনার সাহচর্য অবলম্বনের কথা বলে গেছেন। আর তিনি আমাকে একথাও বলে গেছেন যে, তিনি যে সত্যের ওপর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, আপনি সে সত্যকেই গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। আমার কথা শুনে তিনি বললেনঃ তুমি আমার কাছে থাক।
আমি তাঁর কাছে থেকে গেলাম। তাঁর চালচলন আমার ভালোই লাগলো। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা গেলেন। তাঁর মরণ সময় নিকটবর্তী হলে আমি তাঁকে বললামঃ

– জনাব, আপনি দেখতেই পাচ্ছেন, আল্লাহর ফায়সালা আপনার কাছে এসে গেছে। আর আমার ব্যাপারটি তো আপনি অবগত আছেন। এখন আমাকে কার কাছে যাওয়ার উপদেশ দিচ্ছেন?
বললেনঃ বেটা, আমরা যে জিনিসের ওপর ছিলাম, তার ওপর অটল আছে এমন কাউকে তো আমি জানিনা। তবে ‘নাস্সিবীনে’ অমুক নামে এক ব্যক্তি আছেন, তুমি তাঁর সাথে মিলতে পার।
তাঁকে কবর দেওয়ার পর আমি নাস্সিবীনের সেই লোকটির সাথে সাক্ষাত করলাম এবং আমার সমস্ত কাহিনী তাঁকে খুলে বললাম। তিনি আমাকে তাঁর কাছে থেকে যেতে বললেন। আমি থেকে গেলাম। এ ব্যক্তিকেও পূর্ববর্তী দু’বন্ধুর মত নিষ্কলুষ চরিত্রের দেখতে পেলাম। আল্লাহ কি মহিমা, অল্পদিনের মধ্যে তিনি মারা গেলেন। অন্তিম সময়ে তাঁকে আমি বললামঃ আমার সম্পর্কে আপনি মোটামুটি সব কথা জানেন। এখন আমাকে কার কাছে যেতে বলেন?

তিনি বললেনঃ অমুন নামে ‘আম্মুরিয়াতে’ এক লোক আছেন, তুমি তাঁরই সুহবত অবলম্বন করবে। এছাড়া আমাদের এ সত্যের ওপর অবশিষ্ট আর কাউকে তো আমি জানিনা। তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে আমি আমার সব কথা বললাম।
আমার কথা শুনে তিনি বললেনঃ আমার কাছে থাক। আল্লাহর কসম, তাঁর কাছে থেকে আমি দেখতে পেলাম তিনি তাঁর পূর্ববর্তী সংগীদের মত একই মত ও পথের অনুসারী। তাঁর কাছে থাকাকালেই আমি অনেকগুলি গরু ও ছাগলের অধিকারী হয়েছিলাম।
কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর পূর্ববর্তী সংগীদের যে পরিণতি দেখেছিলাম, সেই একই পরিণতি তাঁরও ভাগ্যে আমি দেখতে পেলাম। তাঁর জীবনের অন্তিম সময়ে আমি তাঁকে বললামঃ আমার অবস্থা তো আপনি ভালোই জানেন। এখন আমাকে কি করতে বলেন, কার কাছে যেতে পরামর্শ দেন?
বললেনঃ বৎস! আমরা যে সত্যকে ধরে রেখেছিলাম, সে সত্যের ওপর ভূ-পৃষ্ঠে জন্য কোন ব্যক্তি অবশিষ্ট আছে বলে আমার জানা নেই। তবে, অদূর ভবিষ্যতে আরব দেশে একজন নবী আবির্ভূত হবেন। তিনি ইবরাহীমের দ্বীন নতুনভাবে নিয়ে আসবেন। তিনি তাঁর জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে বড় বড় কালো পাথরের যমীনের মাঝখানে খেজুর উদ্যানবিশিষ্ট ভূমির দিকে হিজরাত করবেন। দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট কিছু নিদর্শনও তাঁর থাকবে। তিনি হাদিয়ার জিনিস তো খাবেন; কিন্তু সাদকার জিনিস খাবেন না। তাঁর দু’কাঁধের মাঝখানে নুওয়াতের মোহর থাকবে। তুমি পারলে সে দেশে যাও।

এরপর তিনি মারা গেলেন। আমি আরো কিছুদিন আম্মুরিয়াতে কাটালাম। একদিন সেখানে ‘কালব’ গোত্রের কিছু আরব ব্যবসায়ী এলো। আমি তাদেরকে বললামঃ আপনারা যদি আমাকে সংগে করে আরব দেশে নিয়ে যান, বিনিময়ে আমি আপনাদেরকে আমার এ গরু ছাগলগুলি দিয়ে দেব। তাঁরা বললেনঃ ঠিক আছে, আমরা তোমাকে সংগে করে নিয়ে যাব।
আমি তাঁদেরকে গুরু-ছাগলগুলি দিয়ে দিলাম। তাঁরা আমাকে সংগে নিয়ে চললেন। যখন আমরা মদীনা ও শামে’র মধ্যবর্তী ‘ওয়াদী আল-কুরা’ নামক স্থানে পৌঁছলাম, তখন তাঁরা আমার সংগে বিশ্বাসঘাতকতা করে এক ইহুদীর কাছে আমাকে বিক্রি করে দিল। আমি তার দাসত্ব শুরু করে দিলাম। অল্পদিনের মধ্যেই বনী কুরাইজা গোত্রের তার এক চাচাতো ভাই আমাকে খরীদ করে এবং আমাকে ‘ইয়াসরিবে’ (মদীনা) নিয়ে আসে। এখানে আমি আম্মুরিয়ার বন্ধুটির বর্ণিত সেই খেজুর গাছ দেখতে পেলাম এবং তিনি স্থানটির যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, সে অনুযায়ী শহরটিকে চিনতে পারলাম। এখানে আমি আমার মনিবের কাছে কাটাতে লাগলাম।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন মক্কায় দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। কিন্তু দাস হিসাবে সব সময় কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁর সম্পর্কে কোন কথা বা আলোচনা আমার কানে পৌঁছেনি। কিছুদিনের মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে হিজরাত করে ইয়াসরিবে এলেন। আমি তখন একটি খেজুর গাছের মাথায় উঠে কি যেন কাজ করছিলাম, আমার মনিব গাছের নীচেই বসে ছিলো এমন সময় তার এক ভাতিজা এসে তাকে বললোঃ
আল্লাহ বনী কায়লাকে (আউস ও খাজরাজ গোত্র) ধ্বংস করুন। কসম খোদার, তারা এখন কুবাতে মক্কা থেকে আজই আগত এক ব্যক্তির কাছে সমবেত হয়েছে, যে কিনা নিজেকে নবী বলে মনে করে।
তার কথাগুলি আমার কানে যেতেই আমার গায়ে যেন জ্বর এসে গেল। আমি ভীষণভাবে কাঁপতে শুরু করলাম। আমার ভয় হলো, গাছের নীচে বসা আমার মনিবের ঘাড়ের ওপর ধপাস করে পড়ে না যাই। তাড়াতাড়ি আমি গাছ থেকে নেমে এলাম এবং সেই লোকটিকে বললামঃ

– তুমি কি বললে? কথাগুলি আমার কাছে আবার বলো তো।
আমার কথা শুনে আমার মনিব রেগে ফেটে পড়লো এবং আমার গালে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বললোঃ
– এর সাথে তোমার সম্পর্ক কি? যাও, তুমি যা করছিলে তাই কর।
সেদিন সন্ধ্যায় আমার সংগৃহীত খেজুর থেকে কিছু খেজুর নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে অবস্থান করছিলেন সেদিকে রওয়ানা হলাম। রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট পৌঁছে তাঁকে বললামঃ
– আমি শুনেছি আপনি একজন পূর্ণবান ব্যক্তি। আপনার কিছু সহায়-সম্বলহীন সঙ্গী-সাথী আছেন। এ সামান্য কিছু জিনিস সদকার উদ্দেশ্যে আমার কাছে জমা ছিল, আমি দেখলাম অন্যদের তুলনায় আপনারাই এগুলি পাওয়ার অধিক উপযুক্ত। এ কথা বলে খেজুরগুলি তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। তিনি সঙ্গীদের বললেনঃ তোমরা খাও। কিন্তু তিনি নিজের হাতটি গুটিয়ে নিলেন, কিছুই খেলেন না। মনে মনে আমি বললামঃ এ হলো একটি (লক্ষণ) ।

সেদিন আমি ফিরে এলাম। আমি আবারও কিছু খেজুর জমা করতে লাগলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুবা থেকে মদীনায় এলেন। আমি একদিন খেজুরগুলি নিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বললামঃ ‘আমি দেখেছি, আপনি সদকার জিনিস খাননা। তাই এবার কিছু হাদিয়া নিয়ে এসেছি, আপনাকে দেয়ার উদ্দেশ্যে।’ এবার তিনি নিজে খেলেন এবং সঙ্গীদের আহ্বান জানালেন তাঁরাও তাঁর সাথে খেলেন। আমি মনে মনে বললামঃ এ হলো দ্বিতীয়টি।

তারপর অন্য একদিন আমি রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে গেলাম। তিনি তখন ‘বাকী আল-গারকাদ’ গোরস্থানে তাঁর এক সঙ্গীকে সঙ্গীকে দাফন করছিলেন। আমি দেখলাম, তিনি গায়ে ‘শামলা’ (এক ধরণের ঢিলা পোশাক) জড়িয়ে বসে আছেন। আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তারপর আমি তাঁর পেছনের দিকে দৃষ্টি ঘোরাতে লাগলাম। আমি খুঁজতে লাগলাম, আমার সেই আম্মুরিয়ার বন্ধুটির বর্ণিত নবুওয়াতের মোহরটি।
রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তাঁর পিঠের দিকে ঘন ঘন তাকাতে দেখে আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। তিনি তাঁর পিঠের চাদরটি সরিয়ে নিলেন এবং আমি মোহরটি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আমি তখন পরিস্কারভাবে তাঁকে চিনতে পারলাম এবং হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাঁকে চুমুতে ভরে দিলাম ও কেঁদে চোখের পানিতে বুক ভাসালাম।
আমার এ অবস্থা দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেনঃ – তোমার খবর কি?

আমি সব কাহিনী খুলে বললাম। তিনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন এবং আমার মুখ দিয়েই এ কাহিনীটা তাঁর সংগীদের শোনাতে চাইলেন। আমি তাঁদেরকে শোনালাম। তাঁরা অবাক হয়ে গেলেন, খুবই আনন্দিত হলেন।
দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার কারণে সালমান রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। ফলে তিনি খুবই মর্মজ্বালা ভোগ করতে থাকেন। সালমান বলেনঃ ‘একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে বললেনঃ ‍তুমি তোমার মনিবের সাথে মুকাতাবা (চুক্তি)কর। আমি চুক্তি করলাম, তাকে আমি তিন শ’ খেজুরের চারা লাগিয়ে দেব এবং সেই সাথে চল্লিশ ‘উকিয়া স্বর্ণও দেব। আর বিনিময়ে আমি মুক্তি লাভ করবো। আমি রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ চুক্তির কথা অবহিত করলাম। তিনি সাহাবীদেরকে ডেকে বললেনঃ তোমরা তোমাদের এ ভাইকে সাহায্য কর। তারা প্রত্যেকেই আমাকে পাঁচ, দশ, বিশ, ত্রিশটি করে যে যা পারলেন চারা দিলেন। এভাবে আমার তিনশ’ চারা সংগ্রহ হয়ে গেল। তারপর আমি রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশে গর্ত খুড়লাম। তিনি নিজেই একদিন আমার সাথে সেখানে গেলেন। আমি তঁঅর হাতে একটি করে চারা তুলে দিলাম, আর তিনি সেটা রোপন করলেন। আল্লাহর কসম, তাঁর একটি চারাও মারা যায়নি। (ঐতিহাসিকরা বলছেন, সালামান রাযিয়াল্লাহু আনহু একটি মাত্র চারা রোপন করেছিলেন, আর সেটাই মারা যায়। বাকী সবগুলিই রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোপন করেছিলেন এবং সবগুলিই বেঁচে যায়।।) এভাবে আমি আমার চুক্তির একাংশ পূরণ করলাম, বাকী থাকলো অর্থ।

একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে মুরগীর ডিমের মত দেখতে স্বর্ণজাতীয় কিছু পদার্থ আমার হাতে দিয়ে বললেন, যাও, তোমার চুক্তি মুতাবিক পরিশোধ কর। আমি বললাম, এত েকি তা পরিশোধ হবে? তিনি বরলেনঃ ‘ধর, আল্লাহ এতেই পরিশোধ করবেন।’ আল্লাহর কসম, আমরা ওজন করে দেখলাম তাতে চল্লিশ উকিয়াই আছে।

এভাবে সালমান রাযিয়াল্লাহু আনহু তার চুক্তি পূরণ করে মুক্তিলাভ করেন। গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে হযরত সালমান রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসলমানদের সাথে বসবাস করতে থঅকেন। তখন তঁঅর কোন ঘর-বাড়ী চিল না। রাসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য মুহাজিরদের মত প্রখ্যাত আনসারী সাহাবী আবু দারদার রাযিয়াল্লাহু আনহু সাথে তাঁর মুওয়াখাত বা ভ্রাতু-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। গোলামীর কারণে হযরত সালমান রাযিয়াল্লাহু আনহু বদর ও উহুদ যুদ্ধে শরীক হতে পারেননি। গোলামী থেকে মুক্ত হওয়ার পর খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয। এ যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে পূর্ববর্তী দু’টি যুদ্ধে অনুপস্থিতির ক্ষতি পুষিয়ে নেন। সারা আরবের বিভিন্ন গোত্র কুরাইশদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মদীনা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। খবর পেয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন। অনেকে অনেক রকম পরামর্শ দেন।

হযরত সালমান বলেন, পারস্যে পরিখা খনন করে নগরের হিফাজত করা হয়। মদীনার অরক্ষিত দিকে পরিখা খনন করে নগরীর হিফাজত করা সমীচীন। এ পরামর্শ রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনঃপূত হয়। মদীনার পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে সুদীর্ঘ পরিখা খনন করে বিশাল কুরাইশ বাহিনীর আক্রমণ সহজে প্রতিরোধ করা হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এই পরিখা বা খন্দক খননের কাজে অংশগ্রহণ করেন। কুরাইশ বাহিনী মদীনার উপকণ্ঠে এসে এ অপূর্ব রণ-কৌশল দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। ২১/২২ দিন মদীনা অবরোধ করে বসে থাকার পর শেষে খাদ্য সংকট এবং মরুঝড়ের কবলে পড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

খন্দকের পর যত যুদ্ধ হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে হযরত সালমান অংগ্রহণ করেছেন। রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকালের পর হযরত সালমান বেশ কিছুদিন মদনিায় অবস্থান করেন। সম্ভবতঃ হযরত আবু বকরের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের শেষে অথবা হযরত ’উমারের খিলাফতের প্রথম দিকে তিনি ইরাকে এবং তাঁর দ্বীনী ভাই আবু দারদা রাযিয়াল্লাহু আনহু সিরিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। তিনি হযরত উমারের যুগে ইরান বিজয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মুসিলম মুজাহিদদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ করেন। জালুলু বিজয়েও তিনি অংশগ্রহণ করেন। হযরত উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু তঁঅকে মাদায়েনের ওয়ালী নিযুক্ত করেন। হযরত উসমানের খিলাফতাকলে ইনতিকাল করেন।

ইসলম গ্রহণের পর হযরত সালমানের জীবনের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত হয় রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুহবতে। এ কারণে তিনি ইলম ও মা’রেফাতে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। হযরত আলীকে রাদ্বিয়াল্লাহু আনিহু তাঁর ইল্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে বলেনঃ ‘সালমান ইলম ও হিকমতের ক্ষেত্রে লুকমান হাকীমের সমতুল্য।’ অন্য একটি বর্ণনা মতে তিনি বলেনঃ ‘ইলমে আউয়াল ও ইলমে আখের সকল ইলমের আলিম ছিলেন তিনি।’ ইলমে আখের অর্থ কুরআনের ইলম। আরবে তার কোন আত্মীয় ও খান্দান ছিল না, তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে আহলে বাইতের সদস্য বলে ঘোষণা করেন। হযরত মুয়াজ বিন জাবাল, যিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলিম ও মুজতাহিদ সাহাবী, বলেনঃ চার ব্যক্তি থেকে ইলম হাসিল করবে। সেই চারজনের একজন সালমান।

হযরত সালমান থেকে ষাটটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে তিনটি মুত্তাফাক আলাইহি, একটি মুসলিম ও তিনটি বুখারী এককভাবে বর্ণনা করেছেন। আবু সাঈদ খুদরী, আবুত তুফাইল, ইবন আব্বাস, আউস বিন মালিক ও ইবন আজযা রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবী তাঁর ছাত্র ছিলেন।

হযরত সালমান সেইসব বিশিষ্ট সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ নৈকট্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিন রাতে সালমানের সাথে নিভৃতে আলোচনা করতে বসতেন, আমরা তাঁর স্ত্রীরা ধারণা করতাম সালমান হযতো (আলোচনার দীর্ঘতার ধরুন) আজ আমাদের রাতের সান্নিধ্যটুকু কেড়ে নেবে।’

যুহুদ ও তাকওয়ার তিনি ছিলেন বাস্তব নমুনা। ক্ষণিকের মুসাফির হিসেবে তিনি জীবন যাপন করেছেন। জীবনে কোন বাড়ী তৈরী করেননি। কোথাও কোন প্রাচীর বা গাছের ছায়া পেলে সেখানেই শুয়ে যেতেন। এক ব্যক্তি তাঁর কাছে ইজাযত চাইলো, তাঁকে একটি ঘর বানিয়ে দেওয়ার। তিনি নিষেধ করলেন। বার বার পীড়াপীড়িতে শেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেমন ঘর বানাবে? লোকটি বললোঃ এত ছোট যে, দাঁড়ালে মাথায় চাল বেঁধে যাবে এবং শুয়ে পড়লে দেয়ালে পা ঠেকে যাবে। এ কথায় তিনি রাজী হলেন। তাঁর জন্য একটি ঝুপড়ি ঘর তৈরী করা হয়। হযরত হাসান রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ ‘সালমান যখন পাঁচ হাজার দিরহাম ভাতা পেতেন, তিরিশ হাজার লোকের উপর প্রভুত্ব করতেন তখনও তাঁর একটি মাত্র ‘আবা’ ছিল। তার মধ্যে ভরে তিনি কাঠ সংগ্রহ করতেন। ঘুমানোর সময় আবাটির এক পাশ গায়ে দিতেন এবং অন্য পাশ বিছাতেন।’

হযরত সালমান রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন অন্তিম রোগ শয্যায়, হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে দেখতে যান। সালমান রাযিয়াল্লাহু আনহু কাঁদতে শুরু করলেন। সা’দ বললেনঃ আবু আবদিল্লাহ, কাঁদছেন কেন? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো আপনার প্রতি সন্তুষ্ট অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। হাউজে কাওসারের নিকট তাঁর সাথে আপনি মিলিত হবেন। বললেনঃ আমি মরণ ভয়ে কাদঁছিনে। কান্নার কারণ হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, আমাদের সাজ-সরঞ্জাম যেন একজন মুসাফিরের সাজ-সরঞ্জাম থেকে বেশি না হয়। অথচ আমার কাছে এতগুলি জিনিসপত্র জমা হয়ে গেছে।
সা’দ (রা) বলেনঃ তার সেই জিনিসগুলি একটি বড় পিয়ালা, তামার একটি থালা ও একটি পনির পাত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।

তথ্য সুত্র:-
1. bn.m.wikipedia.org/wiki/সালমান_ফারসি
2.Salman Farsi, the Son of Islam
3. Salman al-Farsi

নাজমুদ্দিন এরবাকান এক ঘুমভাঙ্গা সিংহের উপাখ্যান

তুরস্কে তখন ইসলামী অনুশাসনের উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা। মুসলিম নিজেকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করতো। আল্লাহর দেয়া ফরজ সমূহ পালনের ক্ষেত্রে সর্বদা ভয়ে থাকতে হতো। সে দুঃসময়কে পালটে দিতে, সময়ের বিপরীত স্রোতে চলার অবিচল মনোবল নিয়ে, তুরস্কের মানুষের ভেতরে ইসলামী ধ্যান-ধারণা জাগ্রত করার লক্ষ্যে ও আবারও বৃহৎ তুরস্ক গড়ার লক্ষ্যে এবং জায়োনিজমের বিষদাত ভেঙ্গে নতুন এক বিশ্বব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রখ্যাত আলেম জাহেদ আহমেদ কুতকু এর পরামর্শে ১৯৬৯ সালে ১০ জন উম্মাদকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন মিল্লি গুরুশ(জাতীয় ভিশন অর্থাৎ ইসলামী ভিশন) আন্দোলনের।

“পৃথিবীকে গড়তে হলে সবার আগে নিজকে গড়ো।” এটি শুধু স্লোগান নয়, বাস্তব একটি সত্য কথা। যাদের লক্ষ্য হবে পৃথিবীকে পরিবর্তন তাদের প্রথম কাজ হবে নিজেদেরকে পরিবর্তন করে শক্তিশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।

সে লক্ষ্যে তার্কির উন্নয়নের জন্য, মুসলিমদের জীবন-যাপন সহজ করার উদ্দেশ্যে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং দল গঠনের পরপরই বলেছিলেন- “আগামী নির্বাচনে আমরাই ক্ষমতায় থাকবো।” সবাই বলেছিলো- লোকটা ইউটোপিয়ান।
নির্বাচনের ফলাফলে মিল্লি সালামেত পার্টির আসন সংখ্যা ৪৮। এখন তাদের সাথে কোয়ালিশন ব্যতিত ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে সিএইচপি প্রফে.ড.নাজমুদ্দিন এরবাকানের মিল্লি সালামেত পার্টির সকল দাবী দাওয়া মেনে নিয়ে(৫ মন্ত্রণালয়, ও ভাইস-প্রাইমিনিস্টার পদ দেওয়ার শর্তে) কোয়ালিশন করে।
তখন মিডিয়ার সামনে এসে বলেছিলেন- “এখন কারা ক্ষমতায়??”

ক্ষমতায় এসে কীভাবে কাজ করা যায়, আমেরিকাকে বুড়ি আংগুল দেখিয়ে কীভাবে নির্যাতিত মুসলিমদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া যায় তা করে দেখিয়েছেন মাত্র ৪ বছরের ক্ষমতায় তাও মাত্র ৪৮ টি আসন নিয়ে।

৭৪-৭৮ সালের কার্যাবলী-

১) উপ-প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে, তার্কির প্রধানমন্ত্রী বৃটেন সফরে গেলে প্রধানমত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় এরবাকান হোজার উপর। সাথে সাথেই দেরী না করে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। সাইপ্রাস দখল করার, একরাতে যতটুকু পারা যায়। আমেরিকান ওয়ারক্রাফট যদি আসে তাহলে সেখানেও হামলা করার নির্দেশ দেন। সাইপ্রাস বিজয়ের পর আমেরিকাও কোন কথা বলতে সাহস পায় নি এবং বাধ্য হয়ে তার্কির প্রধানমন্ত্রী দ্রুত বৃটেন ত্যাগ করে দেশে ফিরে আসেন।

২) আজ যারা আমেরিকার ভয়ে তাদের ঘাটিসমূহ বন্ধ করতে সাহস পায় না তাদের জন্য উদাহরণ হচ্ছেন ড.এরবাকান।

৭৪ এর সাইপ্রাস বিজয়ের পর আমেরিকা তার্কির উপর Embargo দেয়। তার্কির ইসলামপন্থী থেকে শুরু করে অনেকেই তাকে দোষারোপ করছিলো সাইপ্রাস বিজয়ের জন্য এবং আমেরিকার পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে সংকিত ছিলো। সে সময়ে যারা আমেরিকার ভয়ে কাবু ছিলো তাদের উদ্দেশ্যে সংসদে দাঁড়িয়ে ধমকের সুরে বলেছিলেন- “আমেরিকা আমার কী??”(আমেরিকা আমার কী করবে?)
এমবার্গো দিয়ে তাকে দমিয়ে রাখা যায় নি, উলটো তিনি আমেরিকার ২৫ টি সামরিক ঘাটি (বর্তমান ইনজিরলিক সহ) বন্ধ করে দিয়ে সেসব ঘাটিতে তার্কির পতাকা উড়িয়ে দেন।

এরপর ১৯৮০ সালে তার দল বিরোধীদলে ছিলো। সেসময়ে তার কুদুস মিটিং এর কারণে ইতিহাসের প্রথম কোন বিরোধীদলের বিরুদ্ধে ক্যু সংগঠিত হয়। ক্যু এরপর সকল মিলিটারী বেস আবার চালু করা হয়। সে সময়ের সি’আইএর এডভাইজর বলেন- “Our boys did it”। (দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো আজ পর্যন্ত এই ঘাটিগুলো বন্ধ করার সাহস পায় নি কেউ। এসকল ঘাটি থেকে এখনো প্রতিদিন বিমান হামলা করা হচ্ছে সিরিয়াতে ইরাকে। আর নিহত হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা।)

সেই সাথে তার্কির অবকাঠামো উন্নয়নে মনযোগ দেন এবং ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য কাজ শুরু করেন। তিনি যে কাজগুলো করেছেন মাত্র পাচ বছর ক্ষমতায় থেকে আজ পর্যন্ত তার নজির কেউ স্থাপন করতে পারেনি।

১- আধ্যাত্মিক উন্নয়নকে সরকারী কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিকরন
২- পুনরায় মাদ্রাসা স্থাপন
৩- ৫০০০ এর বেশী কুরআন কোর্স চালু করা
৪- সকল স্কুলে দ্বীন ও আখলাক দারস বাধ্যতামূলক করে দেওয়া
৫- মুসলিম দেশসমূহ থেকে পাশ করে আসা শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি দেওয়া। (বর্তমান সময়েও যা নাই। কয়েকটি দেশের সার্টিফিকেটকে এখনো স্বীকৃতি দেওয়া হয় না)
৬- তুরস্ককে ওআইসির অন্তর্ভুক্তিকরন
৭- ইসলামীক ডেভলেপমেন্ট ব্যাংক গঠনে অগ্রনী ভূমিকা পালন
৮- তুরস্কে সুদ মুক্ত ব্যাংক চালু করা (বর্তমানে যেখানে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় অবস্থিত)
৯- ভারী শিল্প কারখানা স্থাপন করা। ২৭০ টির বেশি ভারী শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
১০- নতুন বৃহৎ তুরস্কের পরিকল্পনা
১১- ন্যয় ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতির সামনে ১০০ বছরের বিস্তারিত ভিশন পেশ করা।
১২- তুরস্ক এবং ইরানের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ব্যবসা শুরু করা।
১৩- বসনিয়াকে স্বাধীন করার জন্য মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ এবং সেখানে অত্যাধুনিক অস্ত্র কারখানা প্রতিষ্ঠা করা।

মিল্লি সালামেত ও রেফাহ পার্টির শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত কারখানা-
১৮ টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি,
১৬ টি সার-কারখানা,
১৪ টি চিনির ফ্যাক্টরি…
২৩ টি সুমের ব্যাংক ফ্যাক্টরি
৬ টি উদ্ভিদ ফ্যাক্টরী
৭৭ টি বৃহৎ শিল্প সেবা প্রতিষ্ঠান
৬৩ টি organized industrial Zone
২৫৩ টি ছোট শিল্প-কারখানা,
৩২ টি বৃহৎ মেশিনারী ফ্যাক্টরী
৪ টি নৌ কারখানা
১০ টি ইঞ্জিন ফ্যাক্টরী
১১ টি ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল শিল্প-কারখানা
৩ টি গবেষণা সেন্টার(প্রাকৃতিক সম্পদ)
৪ টি ইলেক্ট্রোনিক শিল্প-কারখানা এবং
সর্বশেষ Taksan প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যা ছিলো “ফ্যাক্টরী বানানোর ফ্যাক্টরী।” মানে অন্যান্য ফ্যাক্টরী বানাতে হলে যা সরঞ্জাম লাগবে তা এই ফ্যাক্টরি সরবরাহ করবে।
এতো কম সময়ে এরকম উৎপাদন আর কেউ করে দেখাতে পারে নি তার্কির ইতিহাসে।


এটাও পড়ুন –  সফল মাহাথির, আপনিও সফল হোন। মাহাথিরের অনন্য জীবন


এটি হচ্ছে উন্নয়ন, সত্যিকারের উন্নয়ন। যারা রাস্তা-ঘাট আর বিল্ডিং এর মধ্যে উন্নয়ন খুজে ওরা অজ্ঞ। কারণ এই সাদা বিল্ডিং আমাকে আপনাকে খাবার দিবে না। রেড ইন্ডিয়ানদের একটি কথা ছিলো- “যখন নদীর মাছ শেষ হয়ে যাবে, গাছ-পালা ধ্বংস হয়ে যাবে, খাবারের কিছু অবশিষ্ট থাকবে না, তখন এই সাদা চামড়ার বৃটিশরা বুঝতে পারবে যে টাকা চিবিয়ে খাওয়া যায় না।” তেমনি বর্তমান সময়ে ভারী শিল্পে উন্নয়ন ব্যতিত দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তার প্রতিষ্ঠিত শিল্প-কারখানার অধিকাংশই বিক্রি করে দেয়া হয়েছে যা তার্কির নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার শামিল।
এরবাকান হোজার নির্মিত বিখ্যাত Taksan ফ্যাক্টরি যখন বিক্রি করে দেয় সরকার, সেসময় তা নিয়ে তার্কির পত্রিকা রিপোর্ট করেছিলো- “শিক্ষক তৈরী করেছিলো, আর ছাত্ররা বিক্রি করে দিল।”

বসনিয়ার স্বাধীনতাঃ

বসনিয়ার নিপীড়িত মুসলিমদের পাশে দাড়ানোর সাহস যখন কেউ পাচ্ছিলো না তখন প্রফেসর এরবাকান বিরোধীদলে থেকেও সবরকমের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন। বসনিয়ার বিখ্যাত নেতা আলীয়া ইজ্জেত বেগভিচ যখন তার কাছে সাহায্যের জন্য আসেন। এক মাসের মধ্যে ৩৬ মিলিয়ন ডলার দিয়ে সেসময়ে বসনিয়ার একটি স্ট্র্যাটিজক পজিশনে অবস্থিত মার্সিডিজ ফ্যাক্টরীকে অস্ত্র ফ্যাক্টরীতে রুপান্তর করেন, তাও মাত্র ১১ মাসের মাথায়, তার উপর বিরোধীদলে থেকে। সেই সাথে আলীয়া ইজ্জেত বেগভিচের পার্টির প্রধান কার্যালয়ের ভাড়া পর্যন্ত এরবাকান হোজার রেফা পার্টি বহন করতো।
বসনিয়ার স্বাধীনতায় প্রফেসর এরবাকানের অবদান অনেকটা উহ্যই থেকে গিয়েছে কারণ তিনি ডাক-ঢোল পিটানোর চেয়ে কাজে বিশ্বাসী ছিলেন।

ক্ষমতায় থেকে হোক আর না থেকেই হোক, আমেরিকা, ইসরাঈল, ন্যাটো কাউকে পরোয়া না করে মুসলিমদের সহায়তায় সর্বদা পাশে দাড়িয়েছেন।

বর্তমান সময়ের তার্কির সবচেয়ে বড় দাতব্য সংস্থা(IHH) তিনিই গড়েছিলেন ১৯৯২ সালে বসনিয়ায় সাহায্য প্রেরণের জন্য। উল্লেখ্য ২০০৯ সালে গাজায় যে ত্রাণবাহী জাহাজে ইসরাঈল হামলা করেছিলো সেটা তারই পাঠানো জাহাজ ছিলো।

৫৪_তম_সরকারের_অবদানসমূহ (১১ মাস)

১। সরকারী চাকুরীজীবীদের বেতন ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করা,
২। কৃষকদেরকে ২০০ ভাগ বেশী ভর্তুকি দেওয়া,
৩। সকল প্রকার কর্মচারীর বেতন ভাতাকে ৩০০ গুন বাড়িয়ে দেওয়া।
৪। ব্যাল্যান্স বাজেট করা (তুরস্কের ইতিহাসে প্রথম, এর আগে এবং পরে আর কেউ করতে পারেনি)
৫। অর্থনীতিকে সুদ মুক্ত করার লক্ষ্যে নতুন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা এবং সুদকে সম্পূর্ণ রূপে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা। সেই সাথে তার্কির সুদের পরিমাণ ইতিহাসের সর্বনিম্নে নিয়ে এসেছিলেন মাত্র ১১ মাসের ক্ষমতায়।
৬। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নতুন ফান্ড গঠন। এক্ষেত্রে ভ্যাট না নিয়ে, ঋণ না নিয়ে শুধু মাত্র ১ বছরে দেশীয় ভাবে ৬ মাসের মধ্যে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড গঠন করা।
৭। তুরস্কের অভ্যন্তরে অবস্থিত সকল বিদেশী সৈন্যকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া।

৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে সব মিলিয়ে তিনি মাত্র ১৫ বছর রাজনীতি করেছেন সক্রিয়ভাবে। আর বাকি ২৫ বছর হয় জেলে অথবা রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ ছিলেন। (২০০৩ সালেও তাকে আবার নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। এরপর আবার ফিরে আসেন ২০০৭ সালে)

মাত্র পাচ বছরের শাসনামলে তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন কীভাবে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, কীভাবে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। দেশকে স্বনির্ভর করার ক্ষেত্রে নিজেদের উৎপাদন বৃদ্ধি করা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি মুসলিম বিশ্বকে সেদিকেই বেশি জোর দেয়ার কথা বলেছেন বারবার। নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে D-8 প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

আমেরিকা- ইসরাঈলের প্রতিষ্ঠিত সুদভিত্তিক পুজিবাদী অর্থব্যবস্থার বিরুদ্ধে নতুন অর্থব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ডী-৮ গঠন করেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল একবার এরবাকান হোজার কাছে এসে বলেছিলো- “হোজা, আমেরিকার সাথে আমরা কীভাবে পারবো? ওদের এই আছে সেই আছে।”
এরবাকান হোজা হেসেছিলেন। কারণ ওরা সবাইই আন্দোলনের সুসময়ে এসে যোগ দিয়েছিলো। কঠিন সময় ওরা দেখে নাই। তাই তিনি বলেছিলেন- “তুমি এ কথার বলার মাধ্যমেই নিজেকে ওদের বুদ্ধিবৃত্তিক দাসে ও গোলামে পরিণত করেছো। মিল্লি গুরুশ কী তুমি কী ভুলে গিয়েছো???”(https://www.youtube.com/watch?v=0BWn8zSzVyk)

তিনি বলতেন- “আমরা শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার জন্য নয় বরং সিস্টেম পরিবর্তন করার জন্য রাজনীতি করি।”

তার লক্ষ্য ছিলো জায়োনিজমের হাত থেকে উম্মাহকে রক্ষা করা এবং একটি বাসযোগ্য পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করা। সে জন্য তিনি কাজ করে গিয়েছেন আজীবন।
তিনি এক বক্তব্যে বলেছিলেন- “আমার পরেও তোমরা তোমাদের লক্ষ্য থেকে তোমরা বিচ্যুত হয়ো না।
“বিজয় মুমিনদের জন্য এবং বিজয় অতি নিকটবর্তী।”
“এই মিল্লিগুরুশের ভাইয়েরা, এরপর তোমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দ্বিতীয় ইয়াল্টা কনফারেন্স করে নতুন দুনিয়া প্রতিষ্ঠা করা।”
https://www.youtube.com/watch?v=H_S9MfKrzJo

বর্তমানে এরকম একজন নেতা প্রয়োজন খুব, যার কথা শুনলে ইসরাঈল ভয়ে কাপবে। আমেরিকা-ইসরাঈলকে যে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে তাদের সকল ঘাটি বন্ধ করে দিয়ে ইসরাঈলের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করবে।

১৯৯৭ সালে তার ক্ষমতাকালে ইসরাঈল কোন হামলা করার সাহস পায় নি ফিলিস্তিনে। তাই সে সময়ের ইসরাঈলী প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে, আপনারা কী কারনে হামলা করেননি।

উত্তরে সে বলেছিলো- “যে ব্যক্তি একদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে সাইপ্রাস দখল করে নিতে পারে, তার ক্ষমতাকালে ফিলিস্তিনে হামলা করা আত্মহত্যার শামিল।”

আজ পর্যন্ত তার মতো কেউ সাহস করেনি আমেরিকার সকল ঘাটি বন্ধ করে দিয়ে সেখানে তার্কির পতাকা উড়িয়ে দেওয়ার। মাত্র ৫ বছরের ক্ষমতাকালে তিনি তার্কিকে যে শক্ত ভিত দিয়েছেন তার উপর নির্ভর করেই তার্কি আজ এ পর্যন্ত এসেছে।

প্রফেসর.ড.নাজমুদ্দিন এরবাকান ছিলেন একজন প্রধানমন্ত্রী, গণিতিবিদ, বিজ্ঞানী, কুর’আনে হাফেজ, আলেম এবং রাজনীতিবিদ।
তার্কির রাজনীতিতে তার সম্মান কত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আস্তিক নাস্তিক জাতিয়তাবাদী সকলেই তার নাম যে সময়ই বলে না কেন বলার সময় “এরবাকান হোজা(উস্তাদ)” বলে।

যে ঘুম-ভাঙ্গা সিংহের গর্জনে বাতিল শক্তি সদা-কম্পমান থাকতো, সে সিংহ-পুরুষ ২০১১ সালের আজকের এই দিনে আল্লাহর এই দুনিয়া ছেড়েছিলেন আর রেখে গিয়েছেন তার স্মৃতি ও প্রেরণার কিছু রঙের তুলি।
তার্কির ইতিহাসে এতো পরিমাণ মানুষ কারও জানাযায় আসে নি, যে পরিমাণ মানুষ তার জানাযায় এসেছিলো।
আল্লাহ তার্কির এই সিংহ-পুরুষকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।

এরকম ঘুম-ভাঙ্গা সিংহের গর্জনের অপেক্ষায় পুরো উম্মাহ…

আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়

إِذَا جَآءَ نَصۡرُ ٱللَّهِ وَٱلۡفَتۡحُ (١) وَرَأَيۡتَ ٱلنَّاسَ يَدۡخُلُونَ فِى دِينِ ٱللَّهِ أَفۡوَاجً۬ا (٢)
“যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়, এবং আপনি দেখবেন মানুষ দলে দলে আল্লাহ তা’লার দ্বীনে প্রবেশ করছে।”
[সূরা নাছর, ১-২]
কুরআনের এই ছোট্ট সূরা ‘নাছর’ আমরা সাধারণত ছোটবেলাতেই মুখস্ত করি। সলাত আদায়েও অহরহ তিলাওয়াত হয় এই সূরা। অথচ উপলব্ধি করি না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর ﷺ জীবনের সার্থকতা ঘোষণা দেওয়া আয়াতগুলো!
এমনটা তো সত্যিকার মুমিনরা সকলেই চাই, তাই নয় কি? মানুষ দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করুক, আসুক আল্লাহর আদিষ্ট শরীয়াতের ছায়াতলে। কিন্তু কখনও কি প্রশ্ন করি কখন বা কী করলে আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়? আল্লাহ তো ওয়াদা করেছেনই إِنَّ نَصۡرَ ٱللَّهِ قَرِيبٌ۬ (٢١٤) ‘আল্লাহর সাহায্য নিকটে’ (২ঃ২১৪), তাহলে কেন এখনও এই রক্তাক্ত উম্মাহর জন্যও সাহায্য আসছে না? কী করলে আসবে স্বয়ং আল্লাহর সাহায্য?
يَـٰٓأَيُّہَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن تَنصُرُواْ ٱللَّهَ يَنصُرۡكُمۡ وَيُثَبِّتۡ أَقۡدَامَكُمۡ (٧)
“ওহে যারা ঈমান এনেছো, যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো, আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ়প্রতিষ্ঠ রাখবেন।”
[সূরা মুহাম্মাদ, ৭]
وَلَيَنصُرَنَّ ٱللَّهُ مَن يَنصُرُهُ ۥۤ‌ۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَقَوِىٌّ عَزِيزٌ (٤٠)
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সাহায্য করবেন যারা আল্লাহ তা’লার সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, শক্তিধর।”
[সূরা হাজ্জ, ৪০]
কিন্তু আমরা তো নগন্য বান্দা! আর আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা হলেন রব্ব! নগন্য মাখলুক হয়ে স্বয়ং আল্লাহকে কীভাবে সাহায্য করব আমরা? স্বয়ং আল্লাহ তা’লাই দিলেন উত্তর –
لَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا رُسُلَنَا بِٱلۡبَيِّنَـٰتِ وَأَنزَلۡنَا مَعَهُمُ ٱلۡكِتَـٰبَ وَٱلۡمِيزَانَ لِيَقُومَ ٱلنَّاسُ بِٱلۡقِسۡطِ‌ۖ وَأَنزَلۡنَا ٱلۡحَدِيدَ فِيهِ بَأۡسٌ۬ شَدِيدٌ۬ وَمَنَـٰفِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعۡلَمَ ٱللَّهُ مَن يَنصُرُهُ ۥ وَرُسُلَهُ ۥ بِٱلۡغَيۡبِ‌ۚ إِنَّ ٱللَّهَ قَوِىٌّ عَزِيزٌ۬ (٢٥)
“আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। আরও নাযিল করেছি ‘হাদীদ’ যাতে রয়েছে প্রচন্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার। এটা এইজন্য যে আল্লাহ জেনে নিবেন কে না দেখেই তাঁকে ও তাঁর রাসূলগণকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহই শক্তিধর, পরাক্রমশালী।”
[সূরা হাদীদ, ২৫]
এভাবেই আল্লাহ তা’লা তাঁকে সাহায্য করার উপায়ও স্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছেন। হাতে ‘হাদীদ’ তুলে নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনকে সাহায্য করা হল আমাদের দায়িত্ব। তাহলেই চলে আসবে কাঙ্ক্ষিত সাহায্য ও বিজয় – যা আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন মুমিনদের জন্য ওয়াদা করেছেন।
কিয়ামাত পর্যন্ত একদল বান্দা ‘হাদীদ’ উঠিয়ে নিয়ে আল্লাহর সাহায্য করতে থাকবে। আর তাই তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকেও হবে সাহায্যপ্রাপ্ত। ঠিক যেমন সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহর রাসূল ﷺ! রাসূলের ﷺ জীবন সায়াহ্নে এসেছিল আকাঙ্ক্ষিত বিজয়। মানুষ দলে দলে প্রবেশ করেছিল আল্লাহর দ্বীনে। তিনি ﷺ যে সেই ‘হাদীদ’ সহকারে প্রেরিত হয়েছিলেন ইবাদাত কেবল আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট করতে!

“আমি কিয়ামত দিবসের পূর্বে তরবারি হাতে এই উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছি যে, ইবাদাত কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য বরাদ্দ হয়ে যাবে এবং তাঁর সাথে কোনো শরিক করা হবে না। আমার রিযিক আসে আমার বর্শার ছায়াতল হতে, আর যারাই আমার আদেশের বিরুদ্ধে যাবে তাদের জন্য অপমান (আর লাঞ্ছনা) তাকদিরে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। আর যেই তাদের অনুকরণ করে সে তাদেরই একজন।”
[মুসনাদে আহমাদ ৪৮৬৯; সহীহ আল জামি’ ২৮৩১]
আর এজন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন? তাঁর ভাষায়,
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوَدِدْتُ أَنِّي أُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ ثُمَّ أُحْيَا، ثُمَّ أُقْتَلُ ‏”‏‏.‏
“… সেই সত্ত্বার শপথ যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ, আমি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করতে গিয়ে ভালবাসব শহীদ হয়ে যেতে, অতঃপর পুনরুত্থিত হয়ে আবার শহীদ হয়ে যেতে, অতঃপর পুনরুত্থিত হয়ে আবার শহীদ হয়ে যেতে, অতঃপর পুনরুত্থিত হয়ে আবার শহীদ হয়ে যেতে।”
[সহীহ বুখারি, ২৭৯৭]
সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম।
তাহলে আমরাও কি আল্লাহর নাযিলকৃত ‘হাদীদ’ উঠিয়ে নিয়ে আল্লাহর সাহয্যে রত হবো, নাকি এক অনুভূতিশুন্য হৃদয় নিয়ে সূরা ‘নাছর’ তিলাওয়াত করে যাব, আর মিথ্যা স্বপ্ন বুনে যাব আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের?
রমাদান, ১৪৩৯ হিজরি

আমরা রোজা রাখি কেন?

আদনান ফায়সালঃ  আচ্ছা বলুন তো – আমরা রোজা রাখি কেন? ছোটবেলায় আমরা অনেকেই শুনেছি যে – গরীব মানুষেরা না খেয়ে কত কষ্টে থাকে তা যেন আমরা বুঝতে পারি এর জন্যই রোজা রাখা। কিন্তু আমরা যদি কুরআনে বর্ণিত রমজান মাস ও রোজা বিষয়ক আয়াতগুলোর দিকে তাকাই তাহলে বুঝতে পারব – এটা কখনোই রোজার মূল উদ্দেশ্য না।  হ্যাঁ রোজা রাখার একটা সুফল হয়তো এটা যে আমরা না-খেয়ে থাকা মানুষের কষ্ট বুঝতে পারব, কিন্তু এটা মোটেও রোজার মূল উদ্দেশ্য নয়!

আমরা যখন গরীব মানুষের কষ্ট বুঝতে পারাকে রোজার মূল উদ্দেশ্য করে ফেলব তখন সমস্যা কি? এর সমস্যা হলো আমরা যদি কোন রকমে না খেয়ে দিন কাটিয়ে দিতে পারি, তাহলেই আমরা ধরে নিব যে আমরা সফল ভাবে রোজা রেখেছি। ‘আরে ভাই গরীবের কষ্ট বুঝে গেসি, রোজার উদ্দেশ্য সফল’! হয়তো আমাদের দিন শুরু হয়েছিল ফজর নামাজ না পড়ে, সকাল কেটেছে যাকে দেখতে পারি না তার গীবত করে, দুপুর কাটিয়েছি অফিসের কাজে ফাঁকি মেরে, বিকাল কাটিয়েছি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ইফতারী কিনে, আযান পড়তেই ধুমসে ইফতার খেয়ে ‘ফাটিয়ে ফেলেছি’ – রোজা তো অবশ্যই সফল! কারণ? ঐ যে, রোজার উদ্দেশ্য ছিলো গরীবের না খেয়ে থাকার কষ্ট বুঝা – ঐ বুঝ তো দিনের বেলা বুঝা হয়ে গেছে!

প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাহলে রোজার উদ্দেশ্য কি? রোজার উদ্দেশ্য আল্লাহ ‘আযযা ওয়াজাল স্পষ্টভাবে কুরআনুল কারিমে বলে দিয়েছেন:

হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হলো, যেভাবে ফরয করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীগনদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া  অর্জন করতে পারো। – (সূরা বাকারাহ্‌ ২:১৮৩)

সুতরাং আল্লাহ আমাদেরকে কেন রোজা রাখতে হুকুম করেছেন তা স্পষ্ট – যাতে আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারি।

রমজানের উদ্দেশ্য ১: তাকওয়া অর্জন করা।

এখন তাহলে জানা দরকার তাকওয়া শব্দের অর্থ কি?

তাকওয়া অর্থ হলো আল্লাহ-সচেতনতা (God Consciousness), তাকয়া মানে ঢাল (Protection)। তাকওয়া আমাদের আর যাবতীয় পাপ কাজের মধ্যে ঢালস্বরূপ। যার তাকওয়া আছে, আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট; যার তাকওয়া নেই তার উপর আল্লাহ অসন্তুষ্ট।

প্র্যাকটিকাল ভাবে বলতে গেলে – আমরা যা ভাবছি, যা করছি, যা বলছি, যা শুনছি – আল্লাহ তার সবকিছু দেখছেন, শুনছেন, রেকর্ড করে রাখছেন, বিচার দিবসে সবার সামনে আমাদের গোপন-প্রকাশ্য সমস্ত কাজ দেখানো হবে, ভাল-মন্দ সব কাজের প্রতিদান দেয়া হবে – এই চিন্তাগুলো মাথায় রেখে যে কোন কিছু করার নামই তাকওয়া।

ব্যাপারটা আসলে খুব ভয়ংকর। আমি আজ সকালে ফজরের নামাজ পড়েছিলাম কিনা তার জবাব আমাকে দিতে হবে, ঠিক মত হিসাব করে যাকাতের টাকা গরীব মানুষকে দিয়েছিলাম কিনা তার জবাব দিতে হবে, সুদের টাকায় বাড়ি-গাড়ি করলে তার জবাব দিতে হবে, কোন বন্ধুর সাথে অন্য কোন বন্ধুর বদনাম করলে তার জবাব দিতে হবে, রিকশাওয়ালাকে অকারণে ধমক দিলে তার জবাব দিতে হবে, অফিসে বসে কাজে ফাঁকি দিলে জবাব দিতে হবে, জবাব দিতে হবে আমাদের প্রতিটা কাজের, কথার, চাহনির!

আবু হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন: যে মানুষ রোজা রেখে মিথ্যা কথা এবং খারাপ কাজ ছাড়তে পারে না, তার না খেয়ে থাকার প্রয়োজন আল্লাহর কাছে নাই (অর্থাৎ তার রোজা আল্লাহ্‌ কবুল করবেন না)। – (বুখারী)

 

স্কলারেরা বলেছেন – এই পৃথিবীটা হলো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলা একটা রাস্তার মতো যার প্রতি পদে পদে পাপের কাঁটা বিছানো। তাকওয়া মানে হলো এই কাঁটাগুলোকে সর্ন্তপণে এড়িয়ে সঠিক পথে চলা। সঠিক পথ কোন্‌টা? আল্লাহ্‌ যা করতে আমাদের নিষেধ করেছেন তা না করা, আর যা করতে আদেশ করেছেন সেটা করাই হলো সঠিক পথ। আল্লাহর এই আদেশ-নিষেধগুলো যে যত বেশী মেনে চলবে, আমরা বলব যে তার তাকওয়া তত বেশী, অর্থাৎ সে তত বেশী মুত্তাকী।

কিন্তুরোজা রাখার সাথে তাকওয়া অর্জনের সম্পর্ক কি?

রোজাকে আরবীতে ‘সাওম’ বলে, যার অর্থ হলো বিরত থাকা। রোজা রাখলে আমরা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেই, এমনকি যখন একা ঘরে থাকি, বাথরুমে থাকি তখনও কিন্তু আমরা খাই না। আমরা খাই না কারণ কেউ না দেখলেও তো আল্লাহ্‌ দেখছে, অর্থাৎ আমরা তাকওয়ার কারণেই রোজার সময় খাই না। এখন দেখুন, এই খাবার খাওয়া কিন্তু আমাদের মৌলিক চাহিদা। কিন্তু, গীবত করা, গান-নাচ দেখা, দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা, কাজের লোকের সাথে খারাপ ব্যবহার , মানুষের উপকার করে খোঁটা দেয়া – এগুলো একটাও কি আমাদের মৌলিক চাহিদা? না। রোজার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ ‘আযযা ওয়া জাল আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন – হে মানুষ! তোমরা যদি তাকওয়ার কারনে তোমার মৌলিক চাহিদা থেকেই বিরত থাকতে পারো, তাহলে যেই কাজগুলো অপশনাল সেগুলো থেকে কেন বিরত থাকতে পারবে না?

আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন: রোজা ঢালস্বরুপ। – (বুখারী-১৮৯৪)

আবার ভেবে দেখুন, রোজার সময় না খাওয়ার কারণে আমাদের শরীর দুর্বল থাকে। আর দুর্বল শরীরে আমাদের নফসের বা অন্তরের কু-চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। আর নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে আল্লাহর হুকুম মেনে চলার নামই তো তাকওয়া।

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাকওয়া অর্জন করব কিভাবে?

যে কোন পরীক্ষায় পাশ করতে হলেই আগে জানা লাগে পরীক্ষার সিলেবাস কি। ঠিক তেমনি তাকওয়া বা আল্লাহ-ভীতি অর্জন করতে হলে আমাদের জানা লাগবে কোন্‌ কাজে আল্লাহ্‌ শাস্তি দিবেন আর কোন্‌ কাজে আল্লাহ্‌ পুরস্কার দিবেন।

আমরা যখন জানব নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ না পড়লে আমরা কাফের হয়ে যেতে পারি তখন ইসলামের প্রতি সত্যিই যদি আমাদের ভালোবাসা থাকে তো আমরা আর কোন উসিলাতেই নামাজ ছাড়ব না। যখন জানব কবরে লাশ রাখার পর তা দুইদিক থেকে এমনভাবে চাপ দেয় যে এক পাশের পাঁজরের হাড় আরেক পাশের পাঁজরের হাড়ের উপরে উঠে যায়, আর কবরে আজাবের একটা কারণ হলো দাঁড়িয়ে প্রশ্রাব করা, আমাদের ঈমান থাকলে সেদিন থেকে আমাদের পক্ষে আর দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা সম্ভব হবে না। যখন জানব মিথ্যা বললে আমাদের চোয়ালের চামড়া আংটা ঢুকিয়ে টেনে ছিড়ে ফেলা হবে তখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে বিশ্বাসী হলে ঘূনাক্ষরেও মিথ্যা বলব না। যখন জানব গীবত করলে মৃত মানুষের মাংস হবে আমাদের জাহান্নামের খাবার তখন গীবত করতে গেলে আমাদের গলায় কাঁটা বিধবে। যখন শুনব ব্যভিচারী নারী-পুরুষকে উলংগ করে আগুনে পোড়ানো হবে তখন এই কাজের চিন্তা আমরা আর কিছুতেই করব না। যখন জানব সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যদি আমরা মানুষের বিপদে সাহায্যের জন্য এগিয়ে না যাই, তাহলে কেয়ামতের দিনে আমাদের দু’পা তার জায়গা থেকে নড়বে না, শক্ত হয়ে আটকে থাকবে, তখন আমরা নিজের সামর্থ্যের শেষবিন্দু দিব মানুষকে সাহায্য করার জন্য।

অন্যদিকে আমরা যখন জানব, প্রতিবার সুবহানআল্লাহ্‌ বললে জান্নাতে আমার জন্য একটা গাছ লাগানো হবে তখন বেশী করে আমরা সুবহানআল্লাহ্‌ বলব, যখন জানব মা-বাবার সেবা জান্নাতে যাওয়ার সবচেয়ে বড় উপায় তখন আমরা আমাদের পড়াশুনা, চাকরী, ব্যবসার চাইতে মা-বাবার সেবায় বেশী মন দিব, যখন জানব মানুষকে ক্ষমা করলে আল্লাহ্‌ আমাকে ক্ষমা করবেন তখন অনায়াসে অন্য মানুষের ভুল ক্ষমা করতে পারব।

মোদ্দা কথা হলো, তাকওয়া অর্জন করতে হলে আমাদের আগে লাগবে  কি করা উচিত, আর কি করা উচিত না তার জ্ঞান। এই জ্ঞান কোথায় পাব? এক আয়াত পরেই আল্লাহ্‌ এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন:

রমযান মাস, এতে মানবজাতির জন্য পথ-প্রদর্শক , সঠিক পথের স্পষ্ট প্রমাণ এবং সঠিক ও ভুলের পার্থক্য নির্ণয়কারী কুরআন নাজিল করা হয়েছে। অতএব তোমাদের তোমাদের মধ্যে যে কেউ এই মাস পাবে, সে যেন রোজা রাখে। – (সূরা বাকারাহ্‌ ২:১৮৫ আয়াতাংশ)

 

সুতরাং কোন্‌ কাজটা ভালো কোন্‌ কাজটা মন্দ, এইটা বুঝার জন্য মুসলমানের মানদন্ড হলো কুরআন। কুরআন শুধু আরবীতে পড়লেই চলবে না, যে ভাষায় আমরা এর অর্থ বুঝতে পারবো সেই ভাষাতে কুরআন অনুবাদ পড়তে হবে, ব্যাখা পড়তে হবে, স্কলারদের লেকচার শুনতে হবে, শুধুমাত্র তাহলেই আমরা জানতে পারবো আল্লাহর কাছে কোন্‌ কাজটা সঠিক, কোন্‌ কাজটা ভুল। আর আল্লাহর দেয়া মানদন্ড অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার মানেই হলো তাকওয়া অর্জন করা।

 রমজানের উদ্দেশ্য ২: কোরআন থেকে সঠিক ও ভুল পথের নির্দেশনা নেয়া।

রমজান মাসে কুরআনের এই গুরুত্বের কারণেই আমরা তারাবীহ্‌ এর নামাজে কুরআন পড়ে শেষ করি। কিন্তু, আমরা যেটা করি না সেটা হলো কুরআন থেকে পরামর্শ গ্রহণ করা, অথচ আল্লাহ্‌ এই উদ্দেশ্যে কুরআন নাজিল করেছেন।

প্রশ্ন দাঁড়ায় – এই পরামর্শ কি শুধু মুসলমানেরাই গ্রহন করবে? দেখুন তো আরেকবার আল্লাহ্‌ সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে কি বলেছেন? আল্লাহ্‌ বলেছেন – “কুরআন মানবজাতির পথ-প্রদর্শক”! অর্থাৎ, রমজানে এই কোরআন শুধু আমি নিজেই পড়লেই হবে না, আমার আশে পাশের নামাজী, বেনামাজী, হিন্দু, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, নাস্তিক, সবাইকে কুরআন পড়ার জন্য বলতে হবে।

 এখন প্রশ্ন হলো, আমি মুত্তাকী হলে আল্লাহর লাভ কি?

আল্লাহ্‌ হলেন আল-গণি বা প্রয়োজনমুক্ত, আবার তিনি আর-রাহমান বা পরম দয়ালু।  আল্লাহ্‌ আমাদেরকে ভালবাসেন আর তাই তিনি চান আমরা ইহজীবনে শান্তি এবং পরজীবনে জান্নাত পাই।  ইহজীবনে শান্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করা, তাকওয়া অর্জন করা।

যার তাকওয়া নাই তার অন্তরে শান্তি নাই, সে যত পায় তত চায়, তাও তার মন ভরে না। আর যখন মৃত্যু তার কাছে চলে আসে তখন সে গভীর হতাশায় ডুবে যায়, ‘হায় আমি এতকাল কি করলাম!’ বলতে বলতে তার কলজে ফেটে পড়ে। নিজেকে বার বার প্রশ্ন করে, ‘যেই দুনিয়ার পিছনে সারা জীবন দৌড়েছি তাকে ছেড়ে এখন আমি কিভাবে যাবো?’ আল্লাহ্‌ মানুষকে অন্তরের এই ছটফটানি থেকে মুক্তি দিতে চান, এই মুক্তির একমাত্র পথ হলো তাকওয়া অর্জন করা।

আল্লাহ্‌ তো তোমাদের জন্য সহজটাই চান, তোমাদের জন্য যা কষ্টকর তিনি তা চান না। – (সূরা বাকারাহ্‌ ২:১৮৫ আয়াতাংশ)

 

হুমম, বোঝা গেল যে আল্লাহ্‌ আমাদের মংগলের জন্যই চান যে আমরা রোজা রাখি, তাকওয়া অর্জন করি। কিন্তু, আল্লাহ্‌ যদি আসলেই আমাদের জন্য জীবনকে সহজ করতে চান, তাহলে কি তিনি রমজান মাসে আমাদের জন্য এমন বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করেছেন, যা আমাদের তাকওয়া অর্জনে সাহায্য করবে?

রমজানের স্পেশাল প্যাকেজ!

রমজানে আল্লাহর তরফ থেকে আমাদের জন্য আছে বিশেষ সুবিধা, স্পেশাল প্যাকেজ। যে শয়তান আমাদের জন্মলগ্ন থেকে আমাদের কানে কুমন্ত্রণা দিয়ে আসছে আল্লাহ্‌ সেই শয়তানকে রমজানে শেকল-বন্দি করে রাখেন। কাজেই, রোজার মাসে কোন পাপ করে ফেললে শয়তানকে দোষ দেয়ার কোন উপায় নাই! রোজার মাসে কোনও পাপ করলে সেটা আমরা করি আমাদের অন্তরের কু-চাহিদা থেকেই।

সুসংবাদ আরো আছে। রমজানের মাসে জাহান্নামের দরজাগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয়, আর জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। অর্থাৎ, আল্লাহ্‌ মানুষের অন্তরে এমন অবস্থা তৈরী করেন যে খারাপ কাজ করা খুব কঠিন হয়ে যায়, আর ভালো কাজ করা সহজ হয়ে যায়।

আবু হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন: যখন রমজান মাস শুরু হয়, জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, আর শয়তানকে শেকল-বন্দি করা হয়। – (বুখারী)

আল্লাহ্‌ কেন এমন করেন? আল্লাহ্‌ এরকম করেন যাতে আমরা নিজেদের এই মাসে ট্রেইন-আপ করে নিতে পারি, বাকী ১১ মাস শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই এর জন্য। আমরা যখন ড্রাইভিং শিখি তখন যেমন আমাদের ইন্সট্রাক্টর আমাদের এমন রাস্তায় নিয়ে যান যে রাস্তায় গাড়ি, মানুষ নাই – যাতে আমরা ভালো মতো করে আগে চালানো শিখতে পারি, রমজানও তেমনি আমাদের ট্রেনিং টাইম। আল্লাহ্‌ এক মাস ধরে শয়তানকে আমাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে রাখেন যাতে আমরা নিজের তাকওয়াকে মজবুত করে নিতে পারি বাকী ১১ মাস শয়তানের সাথে লড়াই এর জন্য।

রমজানের উদ্দেশ্য ৩: সারা বছর শয়তানের সাথে লড়াই করার জন্য নিজেকে ট্রেইন-আপ করা।

ভেবে দেখুন, আমরা আমাদের ড্রাইভিং ট্রেনিং এর সময় প্যারালাল পার্কিং, ব্যাক-ইন, ড্রাইভ-ইন কোনও ধরনের পার্কিং প্র্যাকটিসই কিন্তু বাদ রাখতে চাই না, কারণ ট্রেনিং শেষে পরীক্ষায় কোন্‌ প্রশ্নটা আসবে আমাদের তো সেটা জানা নাই। ঠিক তেমনি রমজান মাসের এই ট্রেনিং টাইমে সব ধরনের ভালো কাজ বেশী বেশী করে করতে হবে, একদম ছোটখাটো খারাপ কাজ, যেমন খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ না বলা, ডানপায়ে বাথরুমে প্রবেশ করা – এগুলো থেকেও বিরত থাকতে হবে। বলা তো যায় না, ট্রেনিং টাইম শেষে শয়তান যখন আবার মুক্তি পাবে তখন সে কোন্‌ দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে!

আর তাই রাসূলুল্লাহ(সা) রমজান মাস এলেই ভালো কাজ করার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। ঝোড়ো বাতাস যেমনি সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে যায়, তেমনি ভাবে তিনি তার বাসার সবকিছু ঝেড়ে-ঝুড়ে দান করে দিতেন!

রাসূলুল্লাহ(সা) এমনিতেই দানশীল ছিলেন, কিন্তু রমজান মাস আসলে তার দানশীলতা ঝোড়ো বাতাসকেও ছাড়িয়ে যেত (বুখারী)।  

রমজান মাসে জিব্রিল(আ) এসে রাসূলুল্লাহ(সা) কে কুরআন শিক্ষা দিতেন। রাসূলুল্লাহ(সা) নিজে রমজানে রাতে অনেক বেশী নামাজ পড়তেন, আর তাঁর পরিবারে সদস্য, সাহাবাদেরকেও পড়তে বলতেন। আর, এর জন্য আমরাও রমজানের রাতে তারাবীহ পড়ি। রমজানের এই তারাবীহ পড়া হলো সারা বছর তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার প্র্যাকটিস। রমজান মাসে যদি আমরা ৮ বা ২০ রাকআত তারাবীহ পড়তে পারি, তাহলে ট্রেনিং শেষে সারা বছর কেন কমপক্ষে দুই-চার রাকআত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে পারবো না?

রমজানের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে সুন্দর ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছেন, এর জন্য আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করব। তাই আল্লাহ রমজান মাস সংক্রান্ত এই আয়াতটি শেষ করেছেন এভাবে:

এজন্য যে, তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে, এবং তোমাদের যে সুপথ দেখিয়েছেন  তার জন্য তোমরা তাঁর (আল্লাহর) তাকবীর পাঠ করবে, যাতে তোমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারো। –  (সূরা বাকারাহ্‌ ২:১৮৫ আয়াতাংশ)

আর তাই সারা রমজান মাস রোজার রাখার পর আমরা ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার’ (হে আল্লাহ্‌ তুমি সবচেয়ে মহান, হে আল্লাহ্‌ তুমি সবচেয়ে মহান) বলতে বলতে ঈদের নামাজ পড়তে যাই, এটা আল্লাহর প্রতি মুসলমানদের কৃতজ্ঞতার বহি:প্রকাশ। হে আল্লাহ্‌ আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ – তাকওয়া অর্জনের জন্য, শয়তানের সাথে লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়ার জন্য, নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য – তুমি আমাদেরকে ট্রেনিং নেয়ার জন্য এত চমৎকার ব্যবস্থা করে দিয়েছ, আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ, আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ!

আর কোনো বোনাস আছে কি?

আমরা রোজা রাখব আমাদের নিজেদেরই প্রয়োজনে। কিন্তু পরম করুনাময় আল্লাহ্‌ এই রোজার বিনিময়ে আমাদেরকে অনেক পুরষ্কার, আর পুরষ্কারের উপর পুরষ্কার দিবেন। যেমন, আমরা রমজানের এই গিফটকে কাজে লাগিয়ে অতীতের সব গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারি।

আবু হুরায়রা(রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন: যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে আল্লাহর কাছে পুরষ্কার পাওয়ার উদ্দেশ্যে রমজান মাসে রোজা রাখবে, আল্লাহ্‌ তাঁর আগের সব গুনাহ মাফ করে দিবেন। (বুখারী, মুসলিম)

তাহলে শর্ত হলো, রোজা রাখতে হবে শুধুই আল্লাহর কাছ থেকে পুরষ্কার পাওয়ার উদ্দেশ্যে। কেউ যদি রোজা রাখে তার বাবা খুশী হবে এই ভেবে, বা শ্বশুর বাড়ির লোকেরা কি বলবে এই ভেবে, অথবা বন্ধুরা বা প্রতিবেশীরা ‘রোজাদার’ বলবে ভেবে, বা বাসার সবাই রাখে তাই আমাকেও রাখতে হয় এই ভেবে – তাহলে গুনাহ মাফ হবে না। কারণ, একজনের বাবা/বন্ধুরা হয়তো রোজা রাখলে খুশী হয় আবার আরেকজনের বাবা/বন্ধুরা রোজা রাখলে অখুশী হয়। যার বাবা/বন্ধুরা রোজা রাখলে অখুশী হয় তার কখনো রোজাও রাখা হবে না, তাকওয়াও অর্জন করা হবে না।

রোজাদারেরা বিচার দিবসে ‘রাইয়ান’ নামক দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে (বুখারী)।

রাইয়ান শব্দের একটা অর্থ হলো, পানির উৎস। যেহেতু, রোজাদারেরা দুনিয়াতে তৃষ্ণায় কষ্ট পেতে থাকার পরেও শুধু আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার জন্য পানি না খেয়ে ধৈর্য ধরত, তাই সেইদিন আল্লাহ্‌ তাদেরকে পুরষ্কারস্বরুপ নিয়ে যাবেন অনন্ত পানির উৎসের কাছে!  আল্লাহ আমাদের সব ভালো কাজের পুরষ্কার ৭০০ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন, কিন্তু রোজা রাখার পুরষ্কার আল্লাহ্‌ যত গুণ ইচ্ছা ততগুণ বাড়াবেন!

শেষ কথা:

আসুন আমরা সবাই এই রোজায় তাকওয়া অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি, তারাবীহ নামাজ পড়ি, অর্থ বুঝে কোরআন পড়ার ও শুনার চেষ্টা করি। আর খুব বেশী বেশী করে আল্লাহর কাছে তাওবাহ করি। মানুষ মাত্রই পাপী, এই পাপী মানুষদের মাঝে তারাই শ্রেষ্ঠ যারা বেশী বেশী তাওবাহ করে।

 কা’ব ইবনে উজরাহ(রা) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) একবার তাঁর মিম্বরে আরোহন করার সময় প্রতি ধাপ পার হওয়ার সময় বললেন – ‘আমিন’। আমরা রাসূলুল্লাহ(সা) কে জিজ্ঞেস করলে উনি বললেন – আমি যখন মিম্বরে প্রথম ধাপ উঠলাম, জিব্রিল(আ) আমার কাছে আসলেন এবং বললেন – ‘ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি যে রহমতের মাস রমজান পেল কিন্তু তার পাপগুলো মাফ করিয়ে নিতে পারলো না’, আর আমি বললাম – ‘আমিন’।  – (হাকিম, বায়হাকী)

আল্লাহ্‌ যেন আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত না করেন যারা রমজান মাস পেল, অথচ এর উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব  অনুধাবন করতে ব্যর্থ হলো, তাওবাহ করলো না এবং নিষ্পাপ হয়ে বেরিয়ে আসতে পারলো না।

 

 

 

এ সত্য আপনাকে শক্তি যোগাবে ধৈর্য ধারন করার ।

ইমাম আহমদ,আন নাসায়ী,ইবনে হিব্বান,আল হাকিম,আল বাযযার আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ননা করেছেন একবার এক বেদুঈন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে প্রশ্ন করলেন তুমি কি কখনো ‘উম্ম মিলদাম’ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলে ?লোকটি বলল, উম্ম মিলদাম কি?রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন উম্ম মিলদাম হল এক প্রকার জ্বর যা চামড়া ও হাড়ের মাঝে প্রবেশ করে। অর্থাৎ জ্বর,,,
এ বেদুইন লোকটির জীবনে কখনো জ্বর হয় নি এমনকি সে জানতই না যে জ্বর কি।
পরের প্রশ্নটি শুনুন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন তোমার কি কখনও মাথাব্যাথা হয়েছে?

সে বলল মাথাব্যাথা কি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন এটা হল এক প্রকার স্নায়ু যার কারনে মাথার ভেতর ব্যাথা অনুভুত হয় , লোকটি বলল , না, এটা আমার কখনোই হয় নি, মাথাব্যাথা কি সেটাই এই লোক জানতো না।
লোকটি চলে যাবার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন কেউ যদি কোন জাহান্নামি ব্যাক্তিকে দেখতে চায় তবে সে যেন একে দেখে নেয়।


এটা পড়ুন এক মূহুর্তের রাগ, সারা জীবনের কান্না।


সবসময় ব্যাপার এই রকম না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য।
সহীহ হাদীসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন মুমিন হল গাছের কচি ডালের মতো, যেভাবে কচি ডালকে বাতাস একবার ডানে , একবার বামে নাড়া দেয় মুমিনের জীবনে পরীক্ষাগুলোর ভুমিকাও ঠিক একই রকম।

কোন ব্যাক্তি যদি জীবনে কখনো পরীক্ষার সম্মুখীন না হয় তবে সাধারনত এর অর্থ হল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা ঐ ব্যাক্তিকে তার অবস্থার উপরে ছেড়ে দিতে চান। হয়তো সে জাহান্নমি হবে ( আউযু বিল্লাহ মিন যালিক) অথবা সে জান্নাতে নিম্ন মর্যাদার অধিকারী হবে। কিন্তু সে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
এরকম একজন ব্যক্তির মর্যাদা কখনোই তাদের সমান হবে না যারা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে।
আল্লাহ্ না করুন যদি কখনো আপনার উপর কোন বিপর্যয় আপতিত হয় তবে এ সত্য আপনাকে শক্তি যোগাবে ধৈর্য ধারন করার ও দৃঢ়তার সাথে বিপর্যয়ের মোকাবেলা করার।

কেন আমি ইসলাম মানব বা ইসলাম গ্রহণের উপকারিতা

মূল : আই. এ. ইবরাহীম, বঙ্গানুবাদ : মুহাম্মদ ইসমাইল জাবীহুল্লাহ সম্পাদনাঃ মুয়াজ আব্দুল্লাহ । ইসলামে ব্যক্তি ও সমাজের প্রচুর কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলামের খাতিরে ব্যক্তি যে সমস্ত কল্যাণ ও ফায়দা লাভ করে তা এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইত্যাদি।

১. চিরন্তন জান্নাতের পথ:

আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে বলেন:
“হে নবী! যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদেরকে আপনি এমন জান্নাতের সুসংবাদ দিন যার নিচ দিয়ে নদী সমূহ প্রবহমান থাকবে।” (সূরা আল-বাকারা: ২৫)

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
“তোমরা সামনে ধাবিত হও তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে, যা আকাশ ও পৃথিবীর মত প্রশস্ত। এটা প্রস্তুত করা হয়েছে আল্লাহ ও তার রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারীদের জন্য।” (সূরা আল-হাদীদ: ২১)

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বলেছেন:

“আমি ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে জানি যে সর্বশেষে জাহান্নাম থেকে বের হওয়ার অনুমতি পাবে এবং সর্বশেষে জান্নাতে প্রবেশ করবে। ঐ ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুখের উপর ভর করা অবস্থায় (উপুড় হয়ে) বের হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: যাও, জান্নাতে প্রবেশ কর। সে জান্নাতের কাছে এসে মনে করবে জান্নাত ভর্তি হয়ে গেছে। সে ফিরে এসে বলবে: হে আল্লাহ!জান্নাতকে দেখলাম ভর্তি হয়ে গেছে। আল্লাহ তা‘আলা পুনরায় বলবেন:যাও, জান্নাতে প্রবেশ কর। সে আবার জান্নাতের কাছে এসে মনে করবে যে, জান্নাত ভর্তি হয়ে গেছে। ফিরে এসে পুনরায় বলবে-আল্লাহ! জান্নাতকে দেখলাম ভরপুর হয়ে গেছে। আল্লাহ তা‘আলা এবার বলবেন: যাও, জান্নাতে প্রবেশ কর। তোমার জন্য সেখানে রয়েছে দুনিয়া ও তার দশগুণ পরিমাণ স্থান।” সহীহ বুখারী, #৬৫৭১ এবং সহীহ মুসলিম, #১৮৬; সহীহ মুসলিম, #১৮৮ এবং মুসনাদ আহমাদ, #১০৮৩২ -এ বর্ণিত।

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:

“আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় এক সকাল অথবা এক সন্ধ্যা কাটানো দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু আছে তা হতে উত্তম। আর জান্নাতের মধ্যকার তোমাদের কারো ধনুক বা পা রাখার সমপরিমাণ স্থান দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছু হতে উত্তম।” সহীহ বুখারী, #৬৫৬৮ এবং মুসনাদ আহমাদ, #১৩৩৬৮।

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

“আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য এমন জান্নাতকে প্রস্তুত করে রেখেছি যাকে কোন চোখ দেখেনি। কোন কান (যথার্থ) শোনেনি এবং কোন অন্তর কল্পনাও করতে পারে নি।” সহীহ মুসলিম, #২৮২৫ এবং মুসনাদ আহমাদ, #৮৬০৯।

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য বর্ণনায় বলেন:

يُؤْتَى بِأَشَدِّ النَّاسِ بُؤْسًا فِى الدُّنْيَا مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَيُصْبَغُ صَبْغَةً فِى الْجَنَّةِ فَيُقَالُ لَهُ يَا ابْنَ آدَمَ هَلْ رَأَيْتَ بُؤْسًا قَطُّ هَلْ مَرَّ بِكَ شِدَّةٌ قَطُّ فَيَقُولُ لاَ وَاللَّهِ يَا رَبِّ مَا مَرَّ بِى بُؤُسٌ قَطُّ وَلاَ رَأَيْتُ شِدَّةً قَطُّ

অর্থাৎ “দুনিয়ার সবচেয়ে দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত জান্নাতি ব্যক্তিকে বেহেশত থেকে ঘুরিয়ে এনে জিজ্ঞাসা করা হবে-হে আদম সন্তান! তুমি কি দুনিয়াতে কখনো দুঃখ দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছিলে? তোমার উপর দিয়ে কি কোন কঠিন পর্যায় অতিক্রম করেছ? সে বলবে: না। হে আল্লাহ! দুনিয়াতে আমার উপর কখনও দুঃখ-দুর্দশা আসে নি। এবং আমি কোন কঠিন পর্যায়কে অবলোকন করি নি।” সহীহ মুসলিম, #২৮০৭ এবং মুসনাদ আহমাদ, #১২৬৯৯।

যখন আপনি জান্নাতে প্রবেশ করবেন সেখানে অত্যন্ত সুখে ও শান্তিতে বসবাস করবেন। কোন রোগ-বালাই, যন্ত্রণা, চিন্তা অথবা মৃত্যু সেখানে থাকবে না। আপনার উপরে থাকবে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। আপনি সেখানে হবেন চিরস্থায়ী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

“আর যারা ঈমান আনবে ও নেক আমল করবে আমি তাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাব যার নিচ দিয়ে নদীসমূহ প্রবহমান থাকবে। তারা সেখানে থাকবে চিরস্থায়ী। তাদের সাথে থাকবে পবিত্র সঙ্গিনী। আমি তাদেরকে সুশীতল ছায়ায় প্রবেশ করাবো।” (সূরা আন-নিসা: ৫৭)

২. জাহান্নাম থেকে মুক্তি

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“নিশ্চয় যারা কুফরী করেছে এবং কুফরী অবস্থায় মারা গেছে তারা যদি আযাবের বিনিময়ে সারা পৃথিবী পরিমাণ স্বর্ণও দেয় তা গ্রহণ করা হবে না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। আর তাদের কোন সাহায্যকারীও নেই।” (সূরা আলে-ইমরান: ৯১)

অতএব, জাহান্নাম থেকে মুক্ত হওয়া ও জান্নাতে প্রবেশ করার এটাই (ইসলাম) একমাত্র সুযোগ। কারণ, কোন ব্যক্তি কাফের অবস্থায় মারা গেলে দুনিয়ায় এসে ঈমান আনার কোন পথ খোলা থাকবে না। কিয়ামতের দিন কাফেরের কি পরিস্থিতি হবে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে তা উল্লেখ করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন
“আর আপনি যদি দেখেন, যখন তাদেরকে দোযখের উপর দাঁড় করানো হবে। তারা বলবে: কতই না ভালো হত, যদি আমরা পুনঃপ্রেরিত হতাম; তাহলে, আমরা স্বীয় পালনকর্তার নিদর্শনসমূহে মিথ্যারোপ করতাম না এবং আমরা মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।” (সূরা আল-আন‘আম: ২৭)

দ্বিতীয়বার তাদের কাউকে আর তাওবার জন্য ফিরে আসার সুযোগ দেয়া হবে না।

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

“কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী দোযখী ব্যক্তিকে দোযখ থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করবেন: হে আদম সন্তান! তুমি কি দুনিয়ায় কখনও সুখ-শান্তির দেখা পেয়েছ? তোমার কাছে কি কখনও সুখের সময় এসেছে? সে বলবে: না, হে আল্লাহ! আমি সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দেখা পাই নি। সহীহ মুসলিম, #২৮০৭ এবং মুসনাদ আহমাদ, #১২৬৯৯।

৩. আসল সুখ ও আত্মিক শান্তি:

আমরা আল্লাহ তা‘আলার আদেশ নিষেধ মেনে দুনিয়াতে সৌভাগ্য ও আত্মিক শান্তি নিশ্চিত করতে পারি। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেন:

“যারা ঈমান আনে তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা প্রশান্তি লাভ করে।” (সূরা আর-রা‘দ: ২৮)

অপরদিকে যারা আল্লাহ তা‘আলার কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় দুনিয়ায় তাদের জীবন কণ্টকময় হয়ে পড়ে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“আর যে আমার জিকির (স্মরণ) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবন নির্বাহের পথ সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব।” (সুরা তাহা: ১২৪)

এখান থেকেই আয়াতের ব্যাখ্যা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কেন কিছু কিছু মানুষ প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েও প্রকৃত শান্তি না পেয়ে আত্মহত্যা করে! উদাহরণস্বরূপ— “Cat Stevens” মুসলিম হয়ে “ইউসুফ ইসলাম” নাম ধারণ করেছেন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত পোপ-সংগীত-শিল্পী। তার এক রাত্রের আয়ের পরিমাণই ছিল ১,৫০,০০০ ডলার। তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর সত্যিকার শান্তিলাভ করেছেন যা তিনি অর্থের প্রাচুর্য সত্ত্বেও লাভ করতে পারেন নি।

নও-মুসলিমদের ঘটনাসমূহ পড়তে নও-মুসলিমদের-কাহিনী ব্রাউজ করতে পারেন। এই লিংকটিতে আপনি পাবেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পেশার নও মুসলিমদের চিন্তা-ভাবনা ও অনুভূতি; যারা বিভিন্নজন বিভিন্ন স্তরের শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব, যাদের কৃষ্টি-কালচার ও ভিন্ন ভিন্ন।

৪. সত্যিকার তাওবা দ্বারা বিগত জীবনের গুনাহ ক্ষমা

কেউ যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আল্লাহ তা‘আলা তার বিগত জীবনের সব গুনাহ মাফ করে দেন। হাদীসে এসেছে—
আমর ইবনুল আস রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলেন। তিনি বলেন: আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম: আপনার হাত প্রসারিত করুন আমি আপনার হাতে বায়‘আত হব। তিনি তার হাত সম্প্রসারণ করলেন। আমি আমার হাত গুটিয়ে নিলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: “তোমার কি হয়েছে হে আমর?” আমি বললাম: আমি শর্ত করতে চাই। তিনি বললেন: “কি শর্ত করতে চাও?” আমি জবাব দিলাম: আমাকে যেন ক্ষমা করে দেয়া হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “তুমি কি জানো না যে, ইসলাম তার পূর্বেকার সবকিছুকে (গুনাহ) ধ্বংস করে দেয়?” সহীহ মুসলিম, #১২১ এবং মুসনাদ আহমাদ, #১৭৩৫৭।

প্রবন্ধটি ইসলামহাউজ.কমে প্রকাশিত ইসলামের সচিত্র গাইড গ্রন্থ থেকে সঙ্কলিত ও সম্পাদিত

মানবাধিকার ও হযরত মুহাম্মদ সা. : আবদুল খালেক

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সা. হলেন কালজয়ী জীবন ব্যবস্থা ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক। যেহেতু ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান তাই স্বাভাবিক ভাবে মানবাধিকারের বিষয়টি ইসলামের অন্তর্ভূক্ত। জনগুরুত্বপূর্ণ  মানবাধিকারের মত সংবেদনশীল একটি বিষয় সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী, আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। তিনি কথা ও কাজে সারাটি জীবন মানবাধিকার সংরক্ষণে আপোষহীন সংগ্রাম করে গেছেন। এমনকি নবুওত প্রাপ্তির পূর্বেও মানবাধিকার প্রশ্নে তাঁর সোচ্চার কণ্ঠ আজও নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের প্রেরণার উৎস।

মানবাধিকার সংরক্ষণে হযরত মুহাম্মদ সা. এর ভূমিকা  অবদান আলোচনার পূর্বে মানবাধিকার কাকে বলে সে বিষয়ে সামান্য আলোকপাত সমীচীন মনে করি।

সহজ কথায় মানবাধিকার হল- মানব পরিবারে জন্ম গ্রহণ করার কারণে প্রাপ্ত পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সার্বজনীন, সহজাত, অহস্থান্ত যোগ্য এবং অলংঘনীয় কতিপয় অধিকার। যা জাতী, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, নারী পুরুষ নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এই অধিকারগুলো কোন দেশ বা সময়ের পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ নয়।

যে কোন ব্যক্তি জন্ম গ্রহণ করার সাথে সাথে এই অধিকারসমূহ দাবী করতে পারে। মানবমণ্ডলী মানবাধিকার ভোগ ব্যতীত নিজেকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারে না। এক কথায় বলা যায় ‘প্রকৃতি প্রদত্ত আইনের আওতায় প্রাপ্য মানুষের অধিকার সমূহই মানবাধিকার”।

সাইয়েদুল মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আলামীন মুহাম্মাদ সা. কথা, কাজ ও অনুমোদনে মানবাধিকার সংরক্ষণে যে অবদান রেখেছেন তা বিশ্বের ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে লেখা রয়েছে। ৬২২ খ্রীষ্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ সা. এর নেতৃত্বে প্রণীত বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান ‘মদিনা সনদ’ মানবাধিকারের সর্বশ্রেষ্ঠ দলিল। যা আজো বিশ্বের মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। মদিনা সনদের অন্যতম একটি ধারায় বলা হয়েছে-

“মদিনায় বসবাসরত ইহুদী, নাসারা, পৌত্তলিক এবং মুসলমান সকলেই একদেশী এবং সকলেই সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। বর্ণিত সকল ধর্মের লোক স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না। এমনকি মুহাম্মদ সা. এর অনুমতি ব্যতীত কারো সহিত যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারবেনা। সকলের নিকট মদিনা নগরী পবিত্র বলে গণ্য হবে। মদিনা নগরী বহি:শত্র“ দ্বারা আক্রান্ত হলে সকলেই সম্মিলিতভাবে শত্র“র আক্রমণ প্রতিরোধ করবে। নিজেদের মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে আল্লাহ ও রসুল সা. এর ফায়সালা সকলকে মেনে নিতে হবে।


এটা পড়ুন – রোম সম্রাটের প্রতি রাসুলুল্লাহর(স) দাওয়াত


 তাহলে দেখা যায় মানবাধিকার রক্ষা কবচ মদিনা সনদ দিয়ে মহানবী সা. মদিনায় বসবাসরত বহুমাত্রিক ধর্মাবলম্বী ইহুদী, নাসারা, পৌত্তলিক ও মুসলমানদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মদিনায় আনসার ও মোহাজেরদের সম্মিলিত শক্তি দ্বারা মানুষের রক্ত, ইজ্জত, সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানে সফল রাষ্ট্র নায়ক মুহাম্মদ সা. মদিনা প্রজাতন্ত্রে সাম্যের ভিত্তিতে সকলকে ন্যায্য অধিকার প্রদান করে মানবাধিকার সংরক্ষণে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নি:সন্দেহে।

হযরত মুহাম্মদ সা. এর সমগ্র জীবনাদর্শে প্রতিফলিত হয়েছে মানবাধিকার সংরক্ষণের বুলন্দ আওয়াজ। বিশাল জনসমূদ্রে প্রদত্ত বিদায় হজ্জের ভাষণে মুহাম্মদ সা. মানবাধিকার সংরক্ষণের বিষয়টি সর্বোচ্চে স্থান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- “আজকের এই দিন, এই মাস এবং এই শহর যেমন তোমাদের নিকট পবিত্র, তেমনি তোমাদের জীবন, ধনসম্পদ তোমাদের নিকট পবিত্র। একজন মুসলমানের রক্ত অপর মুসলমানের জন্য হারাম। অধিকন্তু কোন মুসলমানের সম্পদ আত্মসাৎ করা অবৈধ।”

উপরোক্ত  কথাগুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় মহানবী সা. মানবাধিকার লংঘনের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করেছেন এবং ঐ পথসমূহ বন্ধ করার প্রয়াস পেয়েছেন।  তিনি বুঝতে পেরেছেন সার্বজনিন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ভূ-মন্ডলে বসবাসকারী মানব গোষ্ঠির মধ্যে পরস্পরের একনিষ্ঠ আন্তরিকতা, সহমর্মীতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ। তাই নবী করিম সা. ঘোষণা করেছেন- “সকল মুসলমান পরস্পরের ভাই।” সুতরাং দেখা যায় একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার উপর পরিচালিত এক ভাইয়ের পক্ষেই সম্ভব অপর ভাইয়ের মান সম্মান, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান।

মানুষের মধ্যে শ্রেণী বৈষম্য হল মানবাধিকার লংঘনের অন্যতম কারণ। তাই তিনি ভাইকে ভাইয়ের আসনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দাস প্রথা বিলুপ্তির সূচনা করেছিলেন। তিনি দাস প্রথার বিরুদ্ধে কতটা কঠোর মনোভাব পোষণ করতেন তা নীচের হাদিস থেকে সহজে বুঝা যায়। তিনি বলেছেন- “যে ব্যক্তি কোন স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার প্রাপ্ত মূল্য ভোগ করে কেয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেব।” মহানবী সা. আরেকটি হাদিসে বলেছেন- “যে ব্যক্তি কোন স্বাধীন মানুষকে দাসে পরিণত করে তার নামাজ আল্লাহর নিকট কবুল হবে না।

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের ভারসাম্য শক্তি হল ন্যায় বিচার। ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত উচ্চ মানের। ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত আপনজনের সুপারিশ বা কোন অশুভ শক্তি তাঁকে দুর্বল বা আদর্শচ্যুত করতে পারে নি। হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা রা. বর্ণনা করেন- “মাখযুমী গোত্রের এক মহিলা চোরের হাতকাটা শাস্তি রহিত করার জন্য হযরত উসামা রা. রসুল সা. এর নিকট সুপারিশ করলেন। এর প্রত্যুত্তোরে তিনি বললেন হে উসামা! তুমি আল্লাহর আইন কার্যকরী করার বিষয়ে সুপারিশ করছ? অতপর মহানবী সা. দাঁড়িয়ে বললেন-“তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ধ্বংস হওয়ার কারণ ছিল অভিজাত বংশের লোক চুরি করলে তাকে ছেঁড়ে দিত এবং দুর্বল ব্যক্তি চুরি করলে তাকে শাস্তি দিত। আল্লাহর কসম মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করে তবে তার হাত কর্তিত হবে।

ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে এহেন দৃঢ়তা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সক্ষম হওয়ায় দুনিয়াব্যাপী ইসলাম মানবতার ধর্ম হিসেবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে প্রসার ও প্রচার লাভ করেছিল।
সার্বজনিন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় শিক্ষা হল আরেকটি রক্ষাকবচ।
সার্বজনীন শিক্ষা বিস্তারে মহানবী সা. এর অবদান সকল ধর্মের শিক্ষানুরাগীদের নিকট করেছেন- “প্রত্যেক মুসলমান নরনারীর উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।” সে ক্ষেত্রে তিনি নারী পুরুষের মধ্যে কোন পার্থক্য প্রদর্শন করেননি। মানবাধিকারের সার্বজনীন স্বীকৃতি পাওয়া যায় মহানবী সা. এর নিম্নোক্ত বাণীর মধ্যে। তিনি বলেছেন- “তোমরা দুলনা হতে কবর পর্যন্ত শিক্ষা অর্জন কর।”

১৪০০ বছর পূর্বে বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসুল সা. ঘোষিত মানবাধিকার যুগে যুগে বিভিন্নভাবে লংঘিত হয়েছে। বনী আদম বঞ্চিত হয়েছে তাদের প্রাপ্য মৌলিক অধিকার থেকে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যুগে যুগে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের জন্য সম্পাদিত হয়েছে বিভিন্ন চুক্তি, দলিল, বহুপক্ষীয় সমঝোতা। সর্বশেষ ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত ২৫টি বিষয়ে সার্বজনীন মানবাধিকার (টহরাবৎংধষ উবষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং) ঘোষণা করা হয়।
তবুও দুনিয়াতাবৎ একবিংশ শতাব্দিতে অহরহ মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার চাক্ষুষ পর্য্যবেক্ষক ছয়মত কোটি বনি আদম।

মানবাধিকার পুরোপুরি সংরক্ষণ, ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির জন্য আজ প্রয়োজন হযরত মুহাম্মদ সা. এর আদর্শের অনুসরণ ও অনুকরণ। পরিশেষে ঐতিহাসিক অধ্যাপক হিট্টির ভাষায় বলতে হয় “মুহাম্মদ সা. কে দুনিয়াবাসী একমাত্র নেতা মেনে নেয়, তাহলে তার দ্বারাই সম্ভব সকল সমস্যার সমাধান পূর্বক পৃথিবীতে শান্তি পূর্ণ:স্থাপিত করা।” মহান আল্লাহ আমাদেরকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি অর্জনের সুযোগ করে দিন। আমিন।
লেখক : প্রধান শিক্ষক,
আধুনগর উচ্চ বিদ্যালয়,
লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।

নারীর অর্থনৈতিক অধিকার : আতিকুর রহমান নগরী

ধন-সম্পদ বা টাকা-পয়সা ছাড়া মানবজীবন চলতে পারে না। মানবজীবনে অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। এগুলোর যোগান দিতে মানুষকে অর্থ উপার্জনের পন্থা বেছে নিতে হয়। অর্থ উপার্জন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষ স্বাভাবিক ভাবে দু-ধরণের পেশা অবলম্বন করে থাকেন চাকরি বা ব্যবসায়। তবে সেই চাকরি ও ব্যবসাও হতে হবে বৈধ। আর এদুটোই হচ্ছে অর্থ উপার্জনের বৈধ পন্থা।

অর্থ উপার্জনের মাধ্যম ছাড়া কারো পক্ষেই এসব মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। অর্থনীতি মানবজীবনের জীবিকানির্বাহের অন্যতম চালিকা শক্তি। তাই আল্লাহ তা‘আলা ফরজ ইবাদত সমাপনান্তে জীবিকা নির্বাহে উপার্জন করার লক্ষ্যে জমিনে বিচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন, সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও। [সূরা: জুমুআ ১০]

ইসলাম সর্বদা নারীদের শালীন পরিবেশে শিক্ষা, কাজ ও চলাফেরার কথা বলে। শরিয়ত নির্ধারিত গন্ডির মধ্যে থেকে নারীরা অবশ্যই শিক্ষা অর্জনসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে। ইসলাম কোথাও নারীকে বন্দি করে রাখার কথা বলেনি।

ইসলাম নারী শিক্ষার প্রতি যেমন গুরুত্বারোপ করেছে তেমনি নারী-পুরুষের ভোটাধিকারেও কোনো ধরনের পার্থক্য সৃষ্টি করেনি। এমনকি ইসলাম নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে কাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকারও প্রদান করেছে।

কুরআনে কারীমের সূরা বাকারার ১৮৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি ব্যবসাকে হালাল করেছি এবং সুদকে হারাম করেছি।’ এই আয়াতে ব্যবসা হালাল হওয়া এবং সুদ হারাম হওয়া নারী-পুরুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। একজন পুরুষ হালাল পন্থায় যেসব ব্যবসা করতে পারবে। নারীও সে ধরনের ব্যবসা করতে পারবে। সে বিবাহিত হোক কিংবা অবিবাহিত হোক। সে তার অর্জিত সম্পদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণকারী। সে কোনো বিধিনিষেধ ছাড়াই তার সম্পত্তির ব্যাপারে সব ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, যা একজন পুরুষের জন্যও প্রযোজ্য।

কুরআন ও হাদীসের কোনো স্থানে নারীর কাজকর্মের ব্যাপারে কোনো বিধিনিষেধ আরোপিত হয়নি। শুধু দু’টি বিষয়ের প্রতি সঙ্গত কারণে নির্দেশ দিয়েছে। শর্ত দু’টি হলো প্রথমত, ব্যবসা হতে হবে হালাল পদ্ধতিতে ও শরীয়ত নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যে। দ্বিতীয়ত, পর্দা রক্ষা করতে হবে। তাছাড়া ইসলাম নারীদের সৌন্দর্য প্রদর্শনকারী কোনো পেশায় নিয়োজিত হতেও নিষেধ করেছে।

বর্তমান যুগ অর্থনৈতিক যুগ, অর্থের প্রয়োজন আজ যেন পূর্বাপেক্ষা অনেক গুণ বেশি বেড়ে গেছে। অর্থ ছাড়া এ যুগের জীবন ধারণ তো দূরের কথা শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণও যেন সম্ভব নয় এমনি এক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে জীবন ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে। তাই পরিবারের একজন লোকের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকা, এক ব্যক্তির উপার্জনে গোটা পরিবারের সব রকমের প্রয়োজন পূরণ করা আজ যেন সুদূরপরাহত ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। আজকের লোকদের মনোভাব এমনি। তারা মনে করে, জীবন বড় কঠিন, সংকটময়, সমস্যা সংকুল। তাই একজন পুরুষের উপার্জনের উপর নির্ভর না করে ঘরের মেয়েদের-স্ত্রীদের উচিত অর্থোপার্জনের জন্য বাইরে বেরিয়ে পড়া।

এতে করে একদিকে পারিবারিক প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারে স্বামীর সাথে সহযোগিতা করা হবে, জীবন যাত্রার মান উন্নত হবে। অন্যথায় বেচারা স্বামীর একার পক্ষে সংসার সুষ্ঠভাবে চালিয়ে নেয়া কিছুতেই সম্ভব হবে না। আর অন্যদিকে নারীরাও কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয় পড়ে নিজেদের কর্মক্ষমতার বিকাশ সাধনের সুযোগ পাবে। এ হচ্ছে আধুনিক সমাজের মনস্তত্ত্ব। এর আবেদন যে খুবই তীব্র আকর্ষণীয় ও অপ্রত্যাখ্যানীয়, তাতে সন্দেহ নেই। এরই ফলে আজ দেখা যাচ্ছে, দলে দলে মেয়েরা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ছে। অফিসে, ব্যবসাকেন্দ্রে, হাসপাতালে, উড়োজাহাজে, রেড়িও, টিভি স্টেশনে- সর্বত্রই আজ নারীদের প্রচন্ড ভীড়। এ সম্পর্কে দুটো প্রশ্ন অত্যন্ত মৌলিক, একটি পারিবারিক-সামাজিক ও নৈতিক আর দ্বিতীয়টি নিতান্তই অর্থনৈতিক।

নারী সমাজ আজ যে ঘর ছেড়ে অর্থোপার্জন কেন্দ্রসমূহে ভীড় জমাচ্ছে, তার বাস্তব ফলটা যে কী হচ্ছে তা আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। পরিবারের মেয়েরা নিজেদের শিশু সন্তানকে ঘরে রেখে দিয়ে কিংবা চাকর-চাকরানীর হাতে সপে দিয়ে অফিসে, বিপণীতে উপস্থিত হচ্ছে।

দীর্ঘ সময় ধরে দিন রাতের প্রায় সময়ই শিশু সন্তানরা মায়ের স্নেহ বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হচ্ছে। আর তারা প্রকৃত পক্ষে লালিত পালিত হচ্ছে, চাকর চাকরানীর হতে। ধাত্রী আর চাকর চাকরানীরা যে সন্তানের মা নয়, মায়ের কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করাও তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়- এ কথা যুক্তি দিয়ে বোঝাবার প্রয়োজন পড়ে না  অথচ ছোট ছোট মানব শিশুদের পক্ষে মানুষ হিসেবে লালিত-পালিত হওয়ার সবচাইতে বেশি প্রয়োজনীয় হচ্ছে মায়ের স্নেহ-দরদ ও বাৎসল্যপূর্ণ ক্রোড়।

অপরদিকে স্বামীও উপার্জনের জন্য বের হয়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে স্ত্রীও। স্বামী এক অফিসে, স্ত্রী অপর অফিসে, স্বামী এক কারখানা, স্ত্রী অপর কারখানায়। স্বামী এক দোকানে, স্ত্রী অপর এক দোকানে। স্বামী এক জায়গায় ভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে পাশাপাশি বসে কাজ করছে, আর স্ত্রী অপর এক স্থানে ভিন্ন পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে রুজী- রোজগারে ব্যস্ত হয়ে আছে। জীবনে একটি বৃহত্তম ক্ষেত্রে স্বামী আর স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের বন্ধনে ফাটল ধরা ছেদ আসা যে অতি স্বাভাবিক তা বলে বোঝাবার অপেক্ষা রাখে না। এতে করে না স্বামীত্ব রক্ষা পায়, না থাকে স্ত্রীর বিশ্বস্ততা। উভয়ই অর্থনৈতিক প্রয়োজনের দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মনির্ভরশীল এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজস্ব পদ ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে আত্মচিন্তায় মশগুল।

প্রত্যেকেরই মনস্তত্ত্ব সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাবধারায় চালিত ও প্রতিফলিত হতে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। অতঃপর বাকী থাকে শুধু যৌন মিলনের প্রয়োজন পূরণ করার কাজটুকু। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভের পর এ সাধারণ কাজে পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল হওয়া কতটুকু সম্ভব! বিশেষত বাইরে যখন সুযোগ সুবিধার কোন অভাব নেই! বস্তুত এরূপ অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আকর্ষণ ক্ষীণ হয়ে আসতে বাধ্য। অতঃপর এমন অবস্থা দেখা দেবে, যখন পরিচয়ের ক্ষেত্রে তারা পরস্পর স্বামী- স্ত্রী হলেও কার্যত তারা এক ঘরে রাত্রি যাপনকারী দুই নারী পুরুষ মাত্র। আর শেষ পর্যন্ত চুড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তাদের ক্ষেত্রে বিচিত্র কিছু নয়। পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলা, সম্প্রীতি, নির্লিপ্ততা, গভীর প্রেম- ভালোবাসা শূন্য হয়ে বাস্তব ক্ষেত্রে অর্থোপার্জনের যন্ত্র বিশেষে পরিণত হয়ে পড়ে। এ ধরণের জীবন যাপনের এ এক অতি স্বাভাবিক পরিণতি ছাড়া আর কিছু নয়।

স্ত্রীর ঘাড়ে অর্থ উপার্জনের বোঝা চালানো  ইসলাম নারীর উপর অর্থনৈতিক কোন দায়-দায়িত্ব চাপায়নি। পরিবারের আর্থিক দায়-দায়িত্ব বহন করা পুরুষের উপর  অর্পিত হয়েছে। সেহেতু নারীকে তার জীবিকার জন্য চাকরি করার প্রয়োজন নেই। তবে পুরুষের উপার্জনে যদি সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট না হয় এবং প্রকৃত অভাবের সময়, সংকটকালে উভয়েই চাকরি করার প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে এমন অবস্থায়ও নারীর স্বাধীনতা রয়েছে। ইচ্ছা করলে সে বাইরে চাকরি করতে পারে, ইচ্ছা করলে নাও করতে পারে। কেউ জোর করে তার ঘাড়ে চাকরির বোঝা চাপিয়ে দিতে পারে না। চাকরি না করে পুরুষের উপার্জন ভোগ করা তার অধিকার। এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তার ঘাড়ে উপার্জনের বোঝা চাপিয়ে দেয়া অন্যায়, জুলুম। নারীর চাকরি করার অধিকার অবশ্যই আছে।

ইসলাম নারীকে বাইরে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। কারণ, ইসলাম  বাস্তব ও প্রাকৃতিক ধর্ম। এর পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত, এর আয়তন অতি ব্যাপক। তা মানবীয় প্রয়োজনেও জীবনের সর্বাবস্থায় সাড়া দেয়। অনেক মহিলাকে বাইরে কাজ করতে হয়। বিভিন্ন পরিস্থিতি তাদেরকে বাইরে কাজ করতে বাধ্য করে।যেমন করে বাপ মারা গেলে মাকে চাকরি করতে হয়, চাকরি করে এতিম ছেলে -মেয়েদের মুখে দু, মুঠো ভাত তুলে দিতে হয়। কোন গরীব যুবতীর বিয়ে শাদী না হলে তাকে চাকরি করে জীবন বাঁচাতে হয়। কিন্তু যাদের সংসার সচ্ছল, স্বামী বা ভাই চাকরি করে, তাদের সংসারেই প্রচুর কাজ রয়ে গেছে। তাদের বাইরে কাজ করার সময় ও সুযোগ কোথায়? যাদের পুরুষরা সারাদিন বাইরে কাজ করে জীবিকা উপার্জন করে, তাদের জন্য বাড়িতে একটা শান্তি পূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশ, একটা আরামদায়ক পরিবেশ সরবরাহ করা নারীর দায়িত্ব।

ইসলামের অসাধারণ সৌন্দর্যগুলোর মধ্যে একটা সৌন্দর্য এই যে, পুরুষকে উপার্জন, রক্ষণা বেক্ষণ ও নারীর ভরণ-পোষণের কাজে নিয়োজিত রেখে নারী জাতিকে এ সকল দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে দিয়েছে। আর নারীর উপর পুরুষের জন্য শান্তিপূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশ সৃষ্টি করা, গর্ভে সন্তান ধারণ করা, সন্তান জন্ম দেয়া, তাদের লালন -পালন করা, শিক্ষা- দিক্ষা দিয়ে আদর্শ নাগরিক রূপে গড়ে তোলা ইত্যাদির এক লম্বা ধারাবাহিক কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

এভাবে ইসলামের দৃষ্টিতে একজন নারীর প্রধান কাজ ও প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে স্ত্রী ধর্ম ও মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করা। এ গুরু দায়িত্বের উপর যদি তার উপর নিজের ভরণ-পোষণের জন্য এবং ছেলে-মেয়েদের উপার্জনের প্রচন্ড কষ্ট-ক্লেশের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়, তবে সেটা হবে নারীর প্রতি অন্যায় –- অবিচার।  তাই নবী সা. বলেছেন, স্বামীর খেদমত করা, সন্তুষ্টি অন্বেষণ করা, মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করা: অর্থাৎ, সন্তান গর্ভে ধারণ করা, তাদের সুশিক্ষা দান করা, তাদের চরিত্র গঠন করা ও ভবিষ্যৎ জীবনের উন্নত সাধন করা ইত্যাদির জন্য নারী জাতিকে উৎসাহিত করেছেন।

তাছাড়া ঘর গুছানো, ঘর সাজানো, রান্না/বান্না করা, কাপড় সেলাই করা ইত্যাদি গৃহস্থালী কাজের এত ব্যাপক দায়িত্ব প্রকৃতগতভাবেই নারী জাতির উপর ন্যস্ত করে দেয়া হয়েছে। যা হোক, ইসলামে নারী জাতির মূল্য, সমাজে তাদের গুরুত্ব ও মানুষ হিসেবে তাদের কৃতকার্যতার পরিমাণ নির্ণয় করা সম্পূর্ণ ভিন্ন নীতিতে। আর তা হলো, খোদাভীতি ও তার আনুগত্য স্বীকার করা, স্বামীর প্রতি তার কর্তব্য পালন করা , সন্তান গর্ভে ধারণ করা, তাদের লালন/পালন ও শিক্ষা –দিক্ষা দেয়ার যে সকল দায়িত্ব তাদের উপর অর্পিত হয়েছে, সে সকল পূর্ণ করার উপর।
লেখক: প্রবন্ধকার, কলামিস্ট

একাকী সফর ও নি:সঙ্গ রাত্রি যাপন সুন্নাতের খেলাফ।

মুফতী ওযায়ের আমীনঃ ইবনে ওমর রাযি. বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: নি:সঙ্গতায় কী সমস্যা রয়েছে আমি যা জানি; মানুষ যদি তা জানতো, কোন আরোহী রাত্রিকালীন নি:সঙ্গ বিচরণ করতো না। -(বুখারী:২৯৯৮)
عَنْ ابْنِ عُمَرَ رضي الله عنهما عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : لَوْ يَعْلَمُ النَّاسُ مَا فِي الْوَحْدَةِ مَا أَعْلَمُ ، مَا سَارَ رَاكِبٌ بِلَيْلٍ وَحْدَهُ. رواه البخاري (2998)

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহি. বর্ণনা করেন: নি:সঙ্গ রাত্রিযাপন ও একাকী ভ্রমন করতে রাসূলুল্লাহ সা. নিষেধ করেছেন। -(মুসনাদে আহমদ-২:৯১)
وقد أخرج الإمام أحمد في “المسند” (2/91) هذا الحديث بزيادة فيها : أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنْ الْوَحْدَةِ أَنْ يَبِيتَ الرَّجُلُ وَحْدَهُ أَوْ يُسَافِرَ وَحْدَهُ )

روى الطبراني في الأوسط (2079) عن جابر أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : لو يعلم الناس ما في الوحدة ما سار راكب بليل أبدا ، ولا نام رجل في بيت وحده.
জাবের রাযি. বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সা. বলেন: নির্জনতা ও নি:সঙ্গতায় কী যে সমস্যা রয়েছে মানুষ যদি জানতো, কোন মুসাফির রাত্রিকালীন কখনোই ভ্রমন করতো না। কোন লোক ঘরে নি:সঙ্গ ঘুমাতো না। -(তাবরানী-২০৭৯)

নির্জন একা রাত্রিযাপন কতটা ঠিক। ইসলামে এ বিষয়ে কোন নির্দেশনা আছে কি-না? তবে একা থাকা অনেকটা সাহসের ব্যাপার। কিন্তু ঝুকিও কম নয়। হোজায়ফা ভাই মারা গেলেন। বাঁচার কতো আকুতিই না তিনি করেছিলেন হয়তো। এটাই বা কে বলতে পারে। শুনেছি তিনি খাট থেকে নিচে ফ্লোরে পড়েছিলেন। কেউ যদি থাকতেন হয়তো কোন সহযোগীতা করতে পারতেন।


এটা পড়ুন –  জনসংখ্যা ও বিশ্বাস


বরুড়া মাদরাসা মসজিদের ২তলায় সম্ভবত ২০০২সালে চাঁদপুরের একজন ছাত্র মৃত্যুবরন করেছিলেন। তাও তিনি একা ছিলেন। সহপাঠী ছাত্ররা সাড়াদিন দারসে না পেয়ে দুপুরবেলা তাঁকে সিড়ির উপরে তাঁর কক্ষে তাকে খুঁজতে যায়। সেখানে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ পান। কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করেন। তারা দেখতে পান তা লাশ পড়ে আছে। নাকে মুখে খানিকটা রক্তের দাগ ছিল। তার শরীরে পিঁপড়ে ধরেছিল।

বরুড়ার ঝাপুয়া মাদরাসায় ময়মনসিংহের একজন শিক্ষক নির্জন কক্ষে মৃত্যুবরন করেন। পরে তার লাশ পাওয়া যায়। এর রহস্য আজো অনুদ্ঘাটিত।

বরুড়া মাদরাসায় আমাদের জুনিয়র ঝাপুয়া-কৈয়্যনির একছাত্র মুমতাজ উদ্দীন ভাই নিজ বাড়ির পুকুরঘাটে শেষরাতে রহস্যজনক মৃত্যুবরন করেন। সকালে তার লাশ পাওয়া যায়।

মালিবাগ জামেয়া শরইয়্যাহ-র কাফিয়া জামাতের সহপাঠী আব্দুল্লাহ (ছদ্মনাম)। ১৯৯৮ঈ. সনে পীরজঙ্গি মাদরাসায় শরহে বেকায়া জামাতে ভর্তি হলেন। একদিন ফজরে খবর পেলাম আবদুর মুমিন ভাই মৃত্যুবরন করেছেন। দৌড়ে ছুটে গেলাম পীরজঙ্গি মাদরাসায়। শুনতে পেলাম। ছাত্রদের মাঝেই অন্যদিনের মতো ঘুমিয়েছিলেন। শেষরাতে দাপাদাপি করে ছাত্রদের মাঝেই মারা গেলেন। মৃত্যুযন্ত্রণা এতোটা কঠিন ছিল যে তিনি বিছানায়-ই মল-মূত্র ত্যাগ করেন। আল্লাহ পাক আমাদেরকে স্বাভাবিক সহজ মৃত্যু নসীব করুন। তবে কিছুটা মনের তৃপ্তি হলো মৃত্যুর পূর্বে প্রিয়ভাজনেষুদের কিঞ্চিৎ ছোঁয়া পেয়েছিলেন। আজো আব্দুল্লাহ ভাইয়ের মন কাঁদে। আঁখি কাঁদে। হৃদয় কাঁদে।

মুসলিম রোগী দেখে মার্কিন ডাক্তার অরিভিয়ার ইসলাম গ্রহণ

আলী হাসান তৈয়বঃ  সম্প্রতি মার্কিন শিশু ও নারী বিশেষজ্ঞ ডা. ইউ এস অরিভিয়া ইসলাম গ্রহণ করেন। নিজের ইসলাম গ্রহণ প্রসঙ্গে ডা. অরিভিয়া বলেন, আমি আমেরিকার একটি হাসপাতালে নারী ও শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করি। একদিন হাসপাতালে এক আরব মুসলিম নারী এলেন বাচ্চা প্রসবের জন্য। প্রসবের পূর্ব মুহূর্তে তিনি ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। প্রসব মুহূর্ত ঘনিয়ে তাকে জানালাম, আমি বাসায় যাচ্ছি, আর আপনার বাচ্চা প্রসবের দায়িত্ব অর্পণ করে যাচ্ছি অন্য এক ডাক্তারের হাতে। মহিলা হঠাৎ কাঁদতে লাগলেন, দ্বিধা ও শঙ্কায় চিৎকার জুড়ে দিলেন, ‘না না, আমি কোনো পুরুষ ডাক্তারের সাহায্য চাই না। আমি তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। এমতাবস্থায় তার স্বামী আমাকে জানালেন, সে চাইছে তার কাছে যেন কোনো পুরুষের আগমন না ঘটে। কারণ সে সাবালক হওয়া থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত আপন বাপ, ভাই ও মামা প্রভৃতি মাহরাম পুরুষ ছাড়া অন্য কেউ তার চেহারা দেখে নি।

আমি হেসে উঠলাম আর অপার বিস্ময় নিয়ে তাকে বললাম, অথচ আমি কিনা এমন এক নারী আমেরিকান, হেন কোনো পুরুষ নেই যে তার চেহারা দেখে নি। অতঃপর আমি তার আবেদনে সাড়া দিলাম।

বাচ্চা প্রসবের পরদিন আমি তাকে সাহস ও সান্ত্বনা দিতে এলাম। পাশে বসে তাকে জানালাম, প্রসাবোত্তর সময়ে দাম্পত্যমিলন অব্যাহত রাখার দরুন আমেরিকায় অনেক মহিলা অভ্যন্তরীণ সংক্রমণ এবং সন্তান প্রসবঘটিত জ্বরে ভোগেন। তাই এ সম্পর্ক স্থাপন থেকে আপনি কমপক্ষে চল্লিশ দিন বিরত থাকবেন। এ চল্লিশ দিন পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রম থেকে দূরে থাকার গুরুত্বও তুলে ধরলাম তার সামনে। এটা করলাম আমি সর্বশেষ ডাক্তারি গবেষণার ফলাফলের নিরিখে।


এটা পড়ুন –  বলবীর সিং – এক মসজিদ শহীদকারী যখন শত মসজিদ নির্মাতা !!


অথচ আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে তিনি জানালেন, ইসলাম এ কথা বলে দিয়েছে। প্রসবোত্তর চল্লিশ দিন পবিত্র হওয়া অবধি ইসলাম স্ত্রী মিলন নিষিদ্ধ করেছে। তেমনি এ সময় তাকে সালাত আদায় এবং সাওম পালন থেকেও অব্যাহতি দিয়েছে।

এ কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বিস্ময়ে বিমূঢ় হলাম। তাহলে আমাদের এত গবেষণা আর এত পরিশ্রমের পর কেবল আমরা ইসলামের শিক্ষা পর্যন্ত পৌঁছলাম!!

আরেকদিন এক শিশু বিশেষজ্ঞ এলেন নবজাতককে দেখতে। তিনি শিশুর মায়ের উদ্দেশে বললেন, বাচ্চাকে যদি ডান কাতে শোয়ান তবে তা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এতে করে তার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক থাকে। শিশুর বাবা তখন বলে উঠলেন, আমরা সবাই সবসময় এ নিয়ম মেনে চলি। আমরা সর্বদা ডান পাশ হয়ে ঘুমাই। এটা আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত। এ কথা শুনে আমি বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম!!

এই জ্ঞান লাভ করতে আমাদের জীবনটাই পার করলাম আর সে কিনা তার ধর্ম থেকেই এ শিক্ষা পেয়ে এসেছে! ফলে আমি এ ধর্ম সম্পর্কে জানার সিদ্ধান্ত নিলাম। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনার জন্য আমি এক মাসের ছুটি নিলাম এবং আমেরিকার অন্য শহরে চলে গেলাম, যেখানে একটি ইসলামিক সেন্টার রয়েছে। সেখানে আমি অধিকাংশ সময় নানা জিজ্ঞাসা আর প্রশ্নোত্তরের মধ্যে কাটালাম। অনেক আরব ও আমেরিকান মুসলমানের সঙ্গে উঠাবসা করলাম। আলহামদুলিল্লাহ এর কয়েক মাসের মাথায় আমি ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিলাম।

সূত্র : ইন্টারনেট