7.3 C
New York
Monday, October 27, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 20

শয়তান

১৫০ হিজরী। সমরকন্দ। সময়টা শেষ বিকাল। শহরের বাইরে প্রশস্ত মাঠে হাজারো মানুষের ভীড়। একটু পর এখানে একজন আসার কথা। সে নিজেকে খোদা দাবী করে। সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। অপেক্ষাকৃত উচু স্থানে একটি সিংহাসন রাখা। সিংহাসনের চারপাশে রেশমি কাপড়ের ঝালর। আসবে।
অপেক্ষার প্রহর ধীরে চলে। জনতার মাঝে চাপা কৌতুহল ও উতকন্ঠা। অস্বস্তিবোধ করে কেউ কেউ। অনেক অনেক পরে, উত্তর দিক থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে আসে। জনতা ফিরে তাকায় সেদিকে। চারটে সাদা আরবী ঘোড়ায় টেনে আনা গাড়ি দৃশ্যপটে উদয় হয়। ঘোড়াগুলো দ্রুত টেনে আনে গাড়িকে, ধুলো উড়তে থাকে, তার মাঝেই দেখা যায় গাড়িতে বসে আছে এক বেটে লোক। লোকটি সোনালী মুখোশ পরে আছে। তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তার পেছনে দাঁড়িয়ে চার প্রহরী। সবার কোমরে তরবারী। গাড়ির ডানে বামে আরো কয়েকজন সিপাহী। জনতা সরে জায়গা করে দেয়। ভীড়ের মাঝ দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি এগিয়ে যায় সিংহাসনের দিকে। জনতা রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে। সিংহাসনের কাছে এসে গাড়ি থেমে যায়। বেটে লোকটি গাড়ি থেকে নেমে সিড়ি বেয়ে সিংহাসনে উঠে। তার পিছু পিছু সিপাহিরাও উপরে উঠে। তারা উঠেই বেটে লোকটির সামনে সিজদায় চলে যায়। বেটে লোকটি একবার সিপাহিদের দিকে তাকায়, তারপর নিরাসক্ত ভংগিতে ডান হাত উপরে তোলে যেন সে তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছে। সিপাহীরা সেজদা থেকে মাথা তোলে, ধীরে ধীরে সরে আসে তারপর তারা বেটে লোকটির পেছনে চলে যায়। চার প্রহরী বেটে লোকটির পেছনে চলে যায়। বেটে লোকটির সাথে আসা সিপাহিরা এবার সেজদা করে। বেটে লোকটি আগের মতো ডান হাত উঁচু করে গম্ভীর কন্ঠে বলে, তোমাদের সেজদা কবুল হয়েছে। সিপাহিরা ধীরে ধীরে মাথা তোলে।
‘যারা আমার ইবাদত করে তারা নিরাপদ থাকুক’ মুখোশধারী বেটে লোকটি বলে।
সিপাহিরা জোরে স্লোগান দিয়ে উঠে। শ্লোগানের শব্দ পুরো মাঠে ছড়িয়ে যায়। ‘আপনি আমাদের খোদা, আমরা আপনার বান্দা’ সিপাহিরা বলে।
উপস্থিত জনতা হতবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।
‘আমরা তোমাকে খোদা মানি না। তুমি খোদা হলে তার প্রমাণ দাও’ সামনের দিক থেকে একজন বলে উঠে।
‘অপেক্ষা করো। সূর্য অস্ত গেলেই আমার খোদায়ীর প্রমাণ দেখাবো। তোমরা আমার শক্তি টের পাবে’ বেটে লোকটি বলে।
জনতা অপেক্ষা করতে থাকে। সবার মধ্যে চাপা অস্বস্তি খেলা করছে। ধীরে ধীরে সূর্যটা পশ্চিমে হারিয়ে যায়। রোদের তেজ কমে আসে, হালকা লাল আলো ছড়িয়ে পড়ে। সূর্য অস্ত যায়। ধীরে ধীরে চারপাশে আধার ঘনায়। আরো কিছু সময় পার হয়। আকাশে চাঁদ উঠে। চতুর্দশীর চাঁদ।
‘এটা তার সৃষ্টি যিনি এই পৃথিবীর শুরু থেকেই খোদা এবং শেষ দিন পর্যন্তই থাকবেন। তিনি আমাকে তার অবতার করে পাঠিয়েছেন। আমাকেও তিনি অনেক ক্ষমতা দিয়েছেন’ বেটে লোকটির কন্ঠ গমগম করে উঠে।
‘তাহলে তোমার শক্তি দেখাও’ কয়েকজন বলে উঠে। অপেক্ষা করতে করতে সবাই বিরক্ত হয়ে গেছে।
‘পাহাড়ের দিকে তাকাও’ বেটে লোকটি শান্তকন্ঠে বলে।
বেটে লোকটির মঞ্চের পেছন দিকেই ছোট একটি পাহাড়। সাদা জোসনায় ভেসে যাচ্ছে পাহাড়। স্থির কাঠামোকে মনে হচ্ছে ভৌতিক অবয়ব। সবাই পাহাড়ের দিকে তাকায়। প্রথমে কিছুই দেখা যায় না। জনতা বিরক্ত হয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই পাহাড়ের আড়াল থেকে একটি চাঁদ উদিত হয়। চাঁদটি ধীরে ধীরে পাহাড়ের কাছ থেকে সরে আসে। এই চাদকেও চতুর্দশীর চাদের মতো দেখাচ্ছে। চাঁদটি মাঠের উপর চলে আসে। চাঁদ দুটি একইরকম উজ্জ্বল।
‘এই দেখো আমার শক্তি। এই চাঁদ আমার সৃষ্টি। এটাই প্রমান আমি খোদা’ বেটে লোকটি বলে উঠে। জনতা চুপ করে থাকে। তারা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তারা একবার চাদের দিকে তাকায়, আবার মুখোশধারীর দিকে তাকায়, তাকে মনে হচ্ছে রহস্যমানব, জনতা তার চেহারা দেখতে কৌতুহলী হয়।
‘তোমরা নিজের চোখে আমার ক্ষমতা দেখলে। তোমরা যদি আমাকে খোদা মেনে নাও তাহলে আমার নিরাপত্তার চাদর তোমাদের ঘিরে রাখবে। আর যদি এর অন্যথা হয় তাহলে তোমাদের উপর একের পর এক বিপদাপদ আসতেই থাকবে’ একথা বলে মুখোশধারী উঠে দাঁড়ায়। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সে গাড়িতে চড়ে বসে। ঘোড়ার ছুটন্ত পদশব্দের সাথে তার গাড়িও চোখের আড়ালে হারিয়ে যায়।
জনতা কিছুক্ষণ নির্বাক বসে থাকে। এখনো তারা বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি।
‘সে অবশ্যই খোদার অবতার। না হলে সে কীভাবে চাঁদ সৃষ্টি করলো?’ কেউ কেউ বলে উঠে।
‘সে জাদুকর। জাদু দেখাচ্ছে। তার কথায় বিশ্বাস করো না’ অন্যরা প্রতিবাদ জানায়। সেরাতে শহরবাসী ঘরে ফেরে দ্বিধা ও সংশয় নিয়ে।
পরবর্তী কদিন দেখা গেল প্রতিরাতে এই নতুন চাঁদটি উদয় হয়। ধীরে ধীরে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে থেমে যায়। অনেকেই মুখোশধারীর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা পোষণ করতে থাকে। কয়েকজন সাহসী মানুষ রাতের বেলা সেই মাঠে থেকে নতুন চাদটি পর্যবেক্ষন করে। তারা লক্ষ্য করে আসল চাদের সাথে মুখোশধারীর চাদের পার্থক্য হলো এই চাদটি পাহাড়ের ওপাশ থেকে উদিত হয়। আকাশের একটা নির্দিষ্ট অংশে এসে স্থির হয়ে যায়। রাতের শেষভাগে আবার ধীরে ধীরে পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে যায়।
‘এ কেমন চাঁদ? এই চাদের আকার সবসময় একই থাকে। বাড়ে কিংবা কমে না কেনো? আর কেনই বা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে এই চাঁদ থেমে যায়? এই চাঁদ কেনো পূর্ব থেকে পশ্চিমে যায় না?’ লোকেরা মুখোশধারীকে এমন নানা প্রশ্ন করে। প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে সে শান্তস্বরে জবাব দেয়,
‘দেখো আসমানে যে খোদা আছেন আমি সে নই। আমি তার সহকারী। আমাকে এটুকু ক্ষমতাই দেয়া হয়েছে। যদি আমার ক্ষমতার উপর তোমাদের আস্থা না থাকে তাহলে যাও, আমার মতো এমন কাউকে খুজে নাও। দেখি পাও কিনা’
তার কথা শুনে কেউ কেউ তাকে খোদার আসনে বসায়। কেউ কেউ ভাবে সে জাদুর খেল দেখাচ্ছে।
‘এটা যদি জাদু হয় তাহলে আরেকজন জাদুকর খুজে বের করো। এমন কাউকেই তোমরা পাবে না’ মুখোশধারী রাগতস্বরে বলে। কেউ এর চেয়ে বেশি প্রশ্ন করলে মুখোশধারীর প্রহরীরা তাদের উপর হামলে পড়ে।
‘খোদার সাথে বেয়াদবি? তার অপমান করছো? অবশ্যই তোমাদেরকে এর শাস্তি ভোগ করতে হবে’ একথা বলে তারা মারধর করে। দুয়েকজন তো আঘাতের চোটে মারাই যায়। ধীরে ধীরে মুখোশধারীর বিরোধিরা জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে চুপ হয়ে যায়। তার ভক্তরা অবশ্য তাকে খোদার আসনে বসিয়ে দেয়। কেউ কেউ উদ্যোগী হয় নতুন চাদের রহস্য ভেদ করতে। পাহাড়ের পেছন দিকটায় গেলে এই নতুন চাদের রহস্য জানা যেতে পারে। কিন্তু সেখানে যাওয়া সহজ নয়। জায়গাটা দুর্গম এবং সেখানে মুখোশধারীর সিপাহিরা পাহারা দেয়। অচেনা কেউ সেদিকে গেলেই তাকে ধরে ফেলে। তাদেরকে ভয় ভীতি দেখানো হয়। যে কয়েকজন সেদিকে গিয়েছিল তারা ফিরে এসে চুপ হয়ে যায়। আর সেদিকে যাওয়ার নাম নেয় না।
এই মুখোশধারী হলো হেকিম মুকান্না খোরাসানী। ভেলকি দেখিয়ে সে দূর্বল ঈমানের লোকদের ঈমান কিনতে চায়।
##
হেকিম মুকান্না খোরাসানির জন্ম মার্ভের কাছাকাছি একটি শহরে। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ বলেছেন তার বংশীয় নাম হিশাম। আবার কেউ কেউ বলেছেন তার নাম আতা। তার বাবা ও দাদা ছিলেন ধোপা। আর্থিক ও সামাজিকভাবে অবহেলিত। এমনই এক পরিবারে আতার জন্ম। বাল্যকালেই তার এক চোখ নষ্ট হয়ে যায়। শারিরিকভাবে সে ছিল খর্বাকৃতি। ছয় সাত বছর বয়স থেকে আতা টের পায় সমবয়সীদের চোখে সে অবহেলিত। সে তাদের সাথে খেলতে চায়, কিন্তু কেউ তাকে খেলায় নেয় না। এমনকি সে তাদের কাছে গেলেও তারা সহ্য করে না।
‘কানা আসছে। তাকে সরিয়ে দাও। সে আমাদের জন্য কুলক্ষণ ডেকে আনবে’ এই কথা বলে বালকরা তাকে মারধোর করে সরিয়ে দেয়। সমবয়সীদের অবহেলা আতাকে ব্যথিত করে। ধীরে ধীরে সে সবাইকে এড়িয়ে চলতে থাকে। বাড়ির পেছন দিকে নির্জন জায়গা হয়ে উঠে তার আশ্রয়। সে একাকী বসে ভাবতে থাকে সমবয়সীদের অবহেলার কথা।
‘সময় আসুক। তোমরা ঠিকই টের পাবে আমি কে ? আজ তোমরা আমাকে লাঞ্চিত করছো। একদিন আমি তোমাদের লাঞ্চিত করবো’ ক্রোধে মুষ্ঠি বন্ধ করতে করতে বিড়বিড় করে আতা। বাল্যকাল থেকেই আতার মনে এই কষ্টকর স্মৃতি গেথে যায়। জন্মগতভাবে আতা ছিল প্রচন্ড মেধাবী। ছোটবেলাতেই সে পিতাকে এমনসব প্রশ্ন করতো যা তার বয়সি ছেলের সাথে মানায় না। মূর্খ ধোপা ছেলের এসব প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে ধমকাতো।
‘এসব আজগুবি প্রশ্ন তোমার মাথায় কোথেকে আসে? এসব বেহুদা চিন্তা বাদ দিয়ে ঘাটে যাও। কাপড় ধোও। আমাদের পেশায় কিছুটা উন্নতি করতে পারবে’ পিতা বলে।
‘ধোপার পেশা খুবই নিচু পেশা। এই পেশার কারনে কেউ আমাদের সম্মান করে না’ আতা পিতার মুখের উপর বলে দিতো।
‘ধোপার ছেলে ধোপা হয়, অন্যকিছু হতে পারে না’
‘আমি ধোপার ছেলে হবো না, আমি বাদশাহর চেয়েও বড় কিছু হবো’ আতা প্রতিবার দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতো। পিতা কখনো কখনো একে শিশুসুলভ চিন্তা ভেবে ছাড় দিয়েছেন। কিন্তু আতার বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার এই বিশ্বাস পোক্ত হয়। কয়েকবার পিতা তাকে মারধোরও করেন, ‘তুই নিজের চেহারা দেখেছিস? বাদশাহদের চেহারা এমন হয়’? পিতার মারধোর ও তিরস্কারের জবাবে আতার মুখে একটি বাক্যই উচ্চারিত হতো, ‘আমি বাদশাহদের চেয়েও বড় হবো’। পিতা তাকে ঘাটে নিয়ে যেতেন তবে আতা সুযোগ পেলেই পালিয়ে যেত। সে বিভিন্ন মক্তব ও দরসগাহে ঘুরে বেড়াতো। শিক্ষকদের বলতো আমি জ্ঞান অর্জন করতে চাই কিন্তু পিতা আমাকে পড়তে দেয় না। আপনারা আমাকে সুযোগ দিন। এভাবে সে বিভিন্ন মক্তবে পড়তে বসে। শীঘ্রই শিক্ষকরা তার বিস্ময়কর মেধার পরিচয় পান। সমবয়সীদের তুলনায় তার মেধা ও স্মরনশক্তি অনেক বেশি। সে একবার কিছু শুনলে আর ভুলে না। উস্তাদরাও যত্নের সাথে তাকে পড়াতে থাকেন। আতার পিতা কয়েকবার শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ করেন, আমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে। সে আমাদের বংশীয় পেশা ছেড়ে আপনাদের মত হতে চায়, তাকে একটু বুঝান।
‘আপনি ভুল বুঝছেন। সে পাগল হয়নি। তার মেধা খুবই প্রখর। সে পড়ালেখা করে অনেক বড় বিদ্বান হবে। সেদিন আপনাদের আর অভাব থাকবে না। সবাই আপনাদের সম্মান করবে। তাকে লেখাপড়া করতে দিন’ একথা বলে শিক্ষকরা আতার পিতাকে বিদায় করেন। পিতা হতাশ হয়ে তাকে তার মতো চলতে দেন।
আতা বেশিরভাগ সময় দরসগাহে অবস্থান করে। রাতের বেলা কুপি জ্বেলে দুষ্প্রাপ্য বইপত্র পড়তে থাকে। কোনো বিষয় তার কাছে অস্পষ্ট মনে হলে বারবার পড়ে, উস্তাদদের সাথে আলোচনা করে, বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার আগে সে ক্ষান্ত হয় না। উস্তাদরা জানে আতা মেধাবি ছাত্র, জ্ঞান অন্বেষনে তার প্রবল পিপাসা। কেউ টের পায় না আতার মনের গোপন কুঠুরিতে ঠিক কী লুকিয়ে আছে। পচিশ বছর বয়সে আতার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ হয়। ততদিনে সে চিকিতসা ও দর্শনে দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছে। দূর দুরান্তে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। সে একটি ওষুধ আবিস্কার করে যা খেলে বৃদ্ধরাও শরীরে যুবকদের মতো শক্তি অনুভব করে। এই ওষুধের কথা জানতে পেরে দূরদুরান্ত থেকে লোকজন এসে এই ওষুধ কিনতে থাকে। ধনী ও আমীরদের চাকররা এসে আতার গৃহে ধর্না দেয়। অল্পকদিনেই আতার পরিবার ধনী হয়ে যায়। আতার পিতা তাদের বংশীয় পেশা ছেড়ে দিয়ে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাতে থাকে।
খোরাসান ও আশপাশের শহরে আতার প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন তার কাছে আসতে থাকে। সবাই আতার কাছে আসতো ঠিকই কিন্তু কিন্তু মনে মনে তাকে ঘৃণা করতো। তার খর্বাকৃতি দেহ, এক চোখ নষ্ট ও কুচকুচে কালো ত্বক কোনো এক অজানা কারনে তার সাথে অন্যদের দূরত্ব সৃষ্টি করে দিতো। লোকজন তাকে আড়ালে আবডালে কানা হেকিম বলতো। আতার কানে এ কথা পৌছলে সে খুব কষ্ট পায়। সে ভাবতে থাকে কীভাবে মানুষের অবহেলা ও বিদ্রুপ থেকে বাচা যায়। আতা চেহারা সুন্দর করার উপায় নিয়ে ভাবতে থাকে। সে কিছু ওষুধ তৈরী করে কিন্তু কোনোটাই কার্যকর হয় না। শেষ উপায় হিসেবে সে একটি বুদ্ধি বের করে। সাত আট দিনের জন্য সে ঘরে আশ্রয় নেয়। এসময় সে কারো সাথেই দেখা করেনি।
‘হেকিম সাহেব আধ্যাত্মিক সাধনায় আছেন। কাউকে দেখা দিবেন না’ আতার কর্মচারীরা এই বলে দর্শনার্থীদের বিদায় দেয়।
আটদিন পর আতা ঘর থেকে বের হয়। তার চেহারায় সোনালী মুখোশ। মুখোশের গায়ে সুক্ষ্ম কারুকাজ। আতার কদাকার চেহারা হারিয়ে গেছে মুখোশের আড়ালে। পরের কটা দিন লোকেরা আবিস্কার করলো অন্য আতাকে। আতার চেহারার কদার্যতা আর ভাবায় না কাউকে। তার চেহারায় সোনালী মুখোশ। চোখ ও নাকের জায়গায় ছোট্ট ছিদ্র। আরবীতে মুখোশ পরিহিতদের বলা হয় মুকান্না। ধীরে ধীরে আতাকে সবাই মুকান্না নামে ডাকতে থাকে। এই নামের আড়ালে চাপা পড়ে যায় আতা ও হিশাম নামদ্বয়। পরবর্তী বছরগুলোতে মানুষ তাকে চেনে হেকিম মুকান্না আল খোরাসানি নামে, যে নামের সাথে একইসাথে মিশে আছে ঘৃণা ও বিস্ময়।
##
মুকান্নার মনে আছে তার বাল্যকালের কথা। সমবয়সীদের অবহেলা, পথিকের চোখে ঘৃণা, সবই মনে আছে। পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। এখন তার অনেক ভক্তও জুটে গেছে। কিন্তু মুকান্না এতেই সন্তুষ্ট নয়। সে আরো বেশি কিছু চায়। বাল্যকালে সে পিতাকে বলতো, আমি বাদশাহর চেয়েও বড় হবো। সেকথা এখনো সে ভুলেনি। তাকে অনেক বড় হতে হবে, বাদশাহর চেয়েও বড়।
মুকান্না পুনর্জন্মবাদ সম্পর্কে পড়াশোনা করেছিল। হিন্দুদের অনেকে এই মতবাদে বিশ্বাস করে। এই মতবাদ অনুসারে আত্মা চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর। কেউ একবার মারা গেলে আবার সে নতুনভাবে জন্মলাভ করে। আগের জন্মে পূন্য করলে পরের জন্মে সে সুন্দর মানুষের মতো জন্মগ্রহন করবে। আর আগের জন্মে পাপ করলে সে পশুপাখি হয়ে জন্মগ্রহন করবে। মুকান্না এই মতবাদকে তার কাজে লাগায়। সে তার সহচরদের বলে, আমি তোমাদের একটি বিশেষ খবর শুনাবো। আমার কথামতো চললে তোমরা সুখে থাকবে। শহরবাসীকে আমার ঘরে আসতে বলো।
এক বিশেষ দিনে মুকান্নার গৃহের সামনে অনেকেই ভীড় করে। দিনটি ছিল আলোকজ্জ্বল। মুকান্নার মুখোশে রোদ ঝলমল করছে।
‘আমি তোমার একটি বিশেষ সংবাদ দিতে চাই। আমার কথা তোমাদের কাছে নতুন মনে হতে পারে। বিশ্বাস রাখো আমার উপর, আমি মিথ্যা বলছি না। আমি পৃথিবীতে স্রষ্টার অবতার। তিনি যুগে যুগে পৃথিবীতে নিজের অবতার পাঠিয়েছেন। আমিও এমনই একজন’ মুকান্না ধীর কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে বলে।
‘তোমার এই কথার প্রমাণ কী?’ একজন দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে।
‘খোদা প্রথমে আদম (আ) কে তার অবতার বানান। এজন্যই ফেরেশতাদের বলেছিলেন তাকে সেজদা করতে। ইবলিস তাকে সেজদা না করায় বিতাড়িত হয়। কারন আদম (আ) ছিলেন স্রস্টার অবতার। এভাবে অন্যান্য নবীরাও ছিলেন অবতার। তোমাদের এই সময়ে আমি খোদার অবতার। অর্থাৎ জমিনের খোদা। এখন আমিই তোমাদের প্রভু। তোমরা আমাকে মেনে চললে সুখের সন্ধান পাবে’
মুকান্নার কথায় অশিক্ষিত অনেকের বিশ্বাস টলে যায়। কেউ কেউ তাকে অলৌকিক কিছু দেখাতে বলে। মুকান্না দর্শন ও বিজ্ঞানের পাশাপাশি জাদুবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিল। সে আমু দরিয়ার তীরে একটি কূপে একটি কৃত্রিম চাঁদ তৈরী করে লুকিয়ে রাখে। রাত হলে এই চাঁদ ধীরে ধীরে উপরে উঠতো। নির্দিষ্ট এক স্থানে এসে এই চাঁদ থেমে যেত। চাদটি ছিল চতুর্দশীর চাদের মতই উজ্জ্বল। রাতের শেষ প্রহরে এই চাঁদ আবার নেমে যেত। মুকান্নার তৈরী এই কৃত্রিম চাঁদ দেখে তার প্রচুর অনুসারী জুটে যায়। তারা তাকে খোদা বলে মেনে নেয়। খোরাসানের বাসিন্দারা ছিল মূর্তি পূজক। ইসলামের আগমনে তারা ইসলামগ্রহন করলেও অনেকে তাদের পুরনো ধর্মের বিশ্বাস থেকে বের হতে পারেনি। বিশেষত তাওহিদ সম্পর্কে তাদের পরিস্কার জানাশোনা না থাকায় তারা সহজেই মুকান্নার কথায় প্রভাবিত হয়। মুকান্নার পূর্বে আবু মুসলিম খোরাসানিও অনেককে বিভ্রান্ত করে ফেলেছিল, পরে যাকে হত্যা করা হয়। খোরাসানের মুসলিমদের ধর্মীয় জ্ঞান কম ছিল। মুকান্না এই সুযোগ গ্রহন করে।
মুকান্না তার অনুসারীদের বলতো তাকে সেজদা করতে। সে বলতো, আমি শতাব্দীকাল ধরে অবতার থাকবো। তোমরা আমাকে সেজদা করো। আমার কথা মেনে চলো।
ধীরে ধীরে তার অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। কয়েক বছরের মধ্যেই তার অনুসারীর সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারে পৌছে যায়।
#
হেকিম মুকান্না তার অনুসারীদের বলতো, আমি এসেছি তোমাদের সুখ শান্তি ও আরাম আয়েশের মুখ দেখাতে। তোমাদের যা ইচ্ছা হয় গ্রহণ করো। যা পান করতে মন চায় পান করো।
মুকান্না তার এই দর্শন অনুসারে শুয়োর এবং মদ বৈধ করে। সে সকল প্রকার আত্মীয়তার বন্ধন অস্বীকার করে। তার মতে যে কোনো নারী যে কারো জন্য বৈধ। এর ফলে দরিদ্র ঘরের সুন্দরী মেয়েদের জীবন হয়ে উঠে বিপন্ন। ধনী ও প্রভাবশালীরা এসব মেয়েদের তুলে নিয়ে যেত। কেউ মুকান্নার কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলে সে বলতো, আমার অনুসারীদের জন্য আমি সবকিছু বৈধ করেছি। যারা আমাকে খোদা মেনে নিবে তাদের জন্য সবকিছু বৈধ।
মুকান্নার অনুসারীরা দিনের একটা সময় ঘরের কোনো বসে মুকান্নার চেহারা কল্পনা করতো। এটাই ছিল তাদের কথিত ইবাদত। মুকান্নার এই ধর্মমত ছিল সবচেয়ে সহজ ধর্ম। যা ইচ্ছা করা যায়। তাই দ্রুত তার অনুসারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তার অনুসারীরা কখনো কখনো আবেগের আতিশয্যে বলে বসতো, প্রভু , আমাদের কে আপনার চেহারা দেখান। আমাদের অন্তর প্রশান্ত হোক।
‘বেকুবের মতো কথা বলো না। সৃষ্টি কখনো স্রষ্টার চেহারা দেখতে পারে না। আমার চেহারা দেখলে তোমরা সহ্য করতে পারবে না’ মুকান্না ক্রোধের সাথে জবাব দিত। একথা শুনে কেউ আর কিছু বলার সাহস পেতো না।
মুকান্নার সশস্ত্র প্রহরীরা বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াতো। কোথাও কেউ মুকান্নার বিরুদ্ধাচারন করলেই তাকে হত্যা করতো। মুকান্নার অনুসারীরা কিছু মসজিদ নির্মান করে, যদিও তারা নামাজ পড়ত না। মুকান্না আগেই বলেছে যারা তাকে মেনে নিবে তাদের জন্য নামাজ রোজা মাফ। মুকান্না নিজে শুয়রের মাংস খেতো, মদপান করতো। তার হেরেমে ছিল বিভিন্ন এলাকা থেকে তুলে আনা সুন্দরী মেয়েরা। মুকান্নার সহচররা কোথাও কোনো সুন্দরী মেয়ে পেলেই তাকে নিয়ে আসতো। মুকান্না তাদেরকে নিজের হেরেমে রেখে দিতো। মুকান্নার অনেক সন্তান হয় সে যাদের নামও জানতো না। মুকান্নার হেরেমে এক মুসলিম মেয়ে ছিল যার নাম সালমা। তাকে মুকান্নার লোক অপহরন করে এনেছিল দুরের এক গ্রাম থেকে। সালমার কিছুই করার ছিল না। রাত গভীর হলে সালমা নামাজে দাড়াতো। দুহাত তুলে দোয়া করতো, হে আল্লাহ, আমাকে এই শয়তানের হাত থেকে মুক্তি দিন। তার উপর আপনার আজাব পাঠান। তাকে ধবংস করে দিন।
মুকান্নার অনুসারী বাড়তে থাকে। সে বিভিন্ন এলাকা দখল করে। চলতে থাকে তার অত্যাচার ও লুটতরাজ। এ সময় মুকান্না দাসিক নামে একটি কেল্লা নির্মান করে। কিছুদিন পরে তার মনে হয় এই কেল্লা নিরাপদ নয়। এ চিন্তা থেকে সে সিয়াম পর্বতে আরেকটি কেল্লা নির্মান করে। এই কেল্লা ছিল খুবই মজবুত। কেল্লার চারপাশে প্রশস্ত পরিখা খনন করা হয়। শত্রুপক্ষ আক্রমন করলে এই পরিখা অতিক্রম করা তাদের জন্য কঠিন হবে। কেল্লায় প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও খাদ্যশস্য জমা করা হয় যেন দীর্ঘমেয়াদী অবরোধেও তাদের কোনো সমস্যা না হয়।
‘এখন আর আমার বিশ্বাসীদের উপর বিপদের ভয় নেই। আজ থেকে তোমরা নিরাপদ। এই কেল্লা দখল করার শক্তি কারো নেই’ মুকান্না তার অনুসারীদের বলে। কেল্লা নির্মানের পর খোরাসানের আশপাশের এলাকার মুসলমানদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। মুকান্নার সিপাহিরা প্রচুর মুসলমানকে হত্যা করে। যুবতী মেয়েদের বন্দী করে। মুকান্না শীঘ্রই নিজেকে স্বাধীন শাসক ঘোষনা দেয়।
#
সময়টা ছিল উত্তাল। আব্বাসী সালতানাত তখনো নিজেদের পা মজবুত করতে পারেনি। আবু মুসলিম খোরাসানির সমস্যা সামাল দিতে না দিতেই বোখারায় অনেকে বিদ্রোহ করে। এর মধ্যে ছিল মাবিজা নামে একটি গোত্র। মুকান্নার সাথে এই গোত্রের সরদার যোগাযোগ করে। মুকান্নাকে সে খোদা না মানলেও রাজনৈতিক কারনে তার সাথে সন্ধি করে। এছাড়া কয়েকটি তুর্কি গোত্রও মুকান্নার সাথে হাত মেলায়। মুকান্না হয়ে উঠে অপ্রতিরোধ্য। তার জুলুম নির্যাতন বেড়ে যায় কয়েকগুন।
#
নির্যাতিত মুসলমানদের একটি দল বাগদাদ পৌছায়। ক্ষমতায় তখন আব্বাসী খলিফা মানসুরের পুত্র মাহদি। নির্যাতিত এই মুসলমানরা খলিফা মাহদিকে খোরাসানের অবস্থা জানায়। এই প্রথম খলিফা মাহদি খোরাসানের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হন। এর আগে মুকান্না সম্পর্কে তার কোনো ধারনাই ছিল না। খলিফা জানতে পারলেন মুকান্না খোরাসানে একটি নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেছে। একইসাথে সে মুসলমানদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। খলিফা ক্ষিপ্ত হন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন এখনই মুকান্নাকে থামাতে হবে। খলিফা মুকান্নার বিরুদ্ধে একটি বাহিনী প্রেরন করেন। এই বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন আবু নোমান জুনাইদ ও লাইস বিন নসর। মুকান্নার একটি অগ্রবর্তী বাহিনীর সাথে খলিফার বাহিনীর লড়াই হয়। এই লড়াইয়ে খলিফার বাহিনী পরাজিত হয়। যুদ্ধে লাইস বিন নসরের ভাই মুহাম্মদ বিন নসর শহীদ হন।
খলিফা দাতে দাত চেপে এই সংবাদ হজম করেন। তিনি আরেক বিখ্যাত সেনাপতি জিবরিল বিন ইয়াহইয়া কে ডেকে পাঠান।
‘কাল পর্যন্ত তোমরা কুফরের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলে। ইসলাম তোমাদেরকে এই আধার থেকে টেনে আলোর প্রাসাদে নিয়ে এসেছে। আমি জানি এখনো তোমাদের আত্মমর্যাদাবোধ হারিয়ে যায়নি। খোরাসানের মাটিতে মুসলিম বোনদের ইজ্জত লুন্ঠন করা হচ্ছে। যুবক ও বৃদ্ধদের হত্যা করা হচ্ছে। নিজেকে খোদার আসনে বসিয়েছে এক দুষ্ট বামন। তুমি সেখানে যাও। চিরতরে তার রাজত্বের স্বপ্ন মুছে দাও’ খলিফা আবেগাপ্লুত কন্ঠে বললেন।
#
জিবরিল বিন ইয়াহইয়া রওনা হলেন খোরাসানের পথে। চোখেমুখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। মুকান্নার অনুসারিরা বোখারায় একটি কেল্লায় অবস্থান করছিল। জিবরিল বিন ইয়াহইয়া এই কেল্লায় হামলা চালান। চার মাস লড়াইয়ের পর মুকান্নার বাহিনী পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে মুকান্নার এক হাজার সৈন্য নিহত হয়। নিজ বাহিনীর পরাজয়ের খবর শুনে মুকান্না থমকে যায়।
‘যারা আসছে সবাই প্রবেশের পর কেল্লার ফটক আটকে দাও। এখানে আমরা নিরাপদ’ বলে সে।
জিবরিল বিন ইয়াহইয়া পরাজিত বাহিনীকে ধাওয়া করে সিয়াম পর্বতের কেল্লায় পৌছান। এখানে পৌছে তিনি থমকে যান। পরিখা পার না হয়ে কেল্লায় আক্রমন করা যাচ্ছে না, আবার পরিখাও পার হওয়া যাচ্ছে না। জিবরিল বিন ইয়াহইয়া কেল্লা অবরোধ করলেন।
##
খলিফা খোরাসানের অভিযান নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন সেনাপতি জিবরিল বিন ইয়াহইয়ার সাথে। কেল্লা অবরোধের সংবাদ শুনে তিনি আরেক সেনাপতি আবু আউনকে পাঠালেন কিন্তু তিনি এসেও কেল্লায় আক্রমনের কোন উপায় বের করতে পারলেন না। খলিফা বাধ্য হয়ে আরেক সেনাপতি মুয়াজ বিন মুসলিম কে সত্তর হাজার সৈন্যসহ পাঠালেন। মুয়াজ বিন মুসলিম তার বাহিনী নিয়ে ঝড়ের বেগে খোরাসান পৌছলেন। এই বাহিনী পাঠিয়েও খলিফা নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। তিনি উকবা বিন মুসলিমের নেতৃত্বে আরেকটি বাহিনী প্রেরণ করেন। উকবা বিন মুসলিম দ্রুত এসে মুয়াজ বিন মুসলিমের বাহিনীর সাথে মিলিত হন। এই দুই বাহিনী একত্রে তাওয়ালিস অঞ্চলের একটি কেল্লায় আক্রমন করে, যা মুকান্নার বাহিনীর দখলে ছিল। এই যুদ্ধে মুকান্নার বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। মুকান্না পরাজয়ের সংবাদ শুনে সতর্ক পদক্ষেপ নেয়। সে বুঝতে পারে খোলা ময়দানে মুসলিম বাহিনীর মোকাবিলা করতে পারবে না। সে তার বাহিনীকে কেল্লাতেই অবস্থানের নির্দেশ দেয়।
মুয়াজ বিন মুসলিম এসে অবরোধের নিয়ন্ত্রন নেন। তার সহকারী ছিলেন সাইদ বিন আমর। দূর্ভাগ্যজনকভাবে কয়েকদিনের মধ্যে মুয়াজ বিন মুসলিমের সাথে সাইদ বিন আমরের কথা কাটাকাটি থেকে তীব্র ঝগড়া হয়। এমনকি সাইদ বিন আমর খলিফার কাছে পত্র লিখে বলেন, যদি আমাকে একা এই অভিযানের দায়িত্ব দেয়া হয় তাহলে আমি শীঘ্রই মুকান্নার কেল্লাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিবো। খলিফা সাইদের কথা মেনে নেন। মুয়াজ বিন মুসলিমকে বাগদাদে তলব করা হয়। মুয়াজ বিন মুসলিম বাগদাদ ফিরে যান কিন্তু তার ছেলেকে সাইদ বিন আমরের বাহিনিতেই রেখে যান।
সাইদ বিন আমর পরিখা অতিক্রমের অনেক চেষ্টা করেন কিন্তু প্রতিবারই ব্যার্থ হন। মুসলিম বাহিনী অবস্থান করছিল খোলা ময়দানে। প্রতিকূল আবহাওয়া সহ্য করতে হচ্ছিল। এছাড়া মুকান্নার বাহিনী আচমকা তীর নিক্ষেপ করে অনেক মুসলমানকে হত্যা করছিল । এতকিছুর পরেও মুসলমান বাহিনী মনোবল হারায়নি। সাইদ বিন আমর নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। যেকোন মূল্যে মুকান্না কে পরাজিত করবেনই। সাইদ বিন আমর কাঠ ও লোহার কিছু সিড়ি নির্মান করে পরিখা অতিক্রমের চেষ্টা করেন। কিন্তু এই চেষ্টা সফল হয়নি উলটো অনেকে প্রাণ হারায়। সাইদ বিন আমর খলিফাকে বিস্তারিত জানিয়ে পত্র লেখেন।
##
সেসময় ভারতবর্ষের সিন্ধ অঞ্চল ছিল আব্বাসী সালতানাতের শাসনাধীন। খলিফা মাহদি কজন কর্মচারী পাঠিয়ে সেখান থেকে প্রচুর চামড়া সংগ্রহ করেন। গরু ও ছাগলের চামড়া সাইদ বিন আমরের কাছে পাঠানো হয়। সাইদ বিন আমর এসব চামড়ায় বালু ভরে চামড়া সেলাই করে দেন। তারপর বালুভর্তি বস্তসদৃশ চামড়াগুলো পরিখাতে ফেলা হয়। পরিখার একদিক ভরে যায়। কেল্লায় হামলা চালানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। সাইদ বিন আমর এবার প্রচন্ড শক্তিতে আক্রমন করেন। কেল্লার পতন আসন্ন বুঝতে পেরে মুকান্নার সেনারা গোপনে সাইদের সাথে যোগাযোগ করে। তারা জানায় তারা তওবা করে মুকান্নার পক্ষত্যাগ করবে বিনিময়ে তাদেরকে জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে। সাইদ এ শর্ত মেনে নেন। মুকান্নার ত্রিশ হাজার সৈন্য সাইদ বিন আমরের কাছে আত্মসমর্পন করে। মুকান্না নানাভাবে তাদের থামাতো চেয়েও সফল হয়নি।
‘তুমি যদি খোদা হতে তাহলে এখানে বসে থাকতে না। আরো আগেই মুসলিম বাহিনীকে বিপদে ফেলে ধবংস করে দিতে’ এই বলে মুকান্নার সৈন্যরা কেল্লা থেকে বের হয়ে যায়।
##
কেল্লায় শুধু মুকান্নার দু হাজার সৈন্য অবশিষ্ট থাকে। এরা ছিল তার প্রতি নিবেদিতপ্রান। কোনোভাবেই তারা পক্ষত্যাগ করবে না। মুকান্না বুঝতে পারে কেল্লার পতন আসন্ন। যেকোনো সময় বাগদাদের সৈন্যরা কেল্লায় প্রবেশ করবে। তাকেও আবু মুসলিম খোরাসানির মতো হত্যা করা হবে। মুকান্না তার অবশিষ্ট সৈন্যদেরকে কেল্লার প্রাংগনে জড়ো করে। সে তেজোদীপ্ত কন্ঠে বলে,
‘এখন তোমাদের সামনে দুটো পথ খোলা। তোমরা আত্মসমর্পন করে মুসলমানদের গোলাম হয়ে যাও । অথবা আমার সাথে আসমানে চলো। সেখানে তোমরা সুখে থাকবে।
‘আমরা আপনার সান্নিধ্য ছাড়া আর কিছু চাই না’ মুকান্নার অনুচররা সমস্বরে বলে উঠে ।
এরপর মুকান্না মাঠে আগুন জ্বালানোর নির্দেশ দেয়। আগুন জ্বলে উঠলে কেল্লার মূল্যবান সব জিনিসপত্র আগুনে ফেলা হয়। ভারবাহী পশুগুলোকেও আগুনে ফেলা হয়।
‘আমি যাচ্ছি , তোমরা আমার সাথে আসো’ একথা বলে মুকান্না আগুনে ঝাপ দেয়। তার অনুচর ও হেরেমের মহিলারা তাকে অনুসরণ করে। কারো কারো মতে মুকান্না সবাইকে মদপান করিয়ে মাতাল করেছিল। তারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে মুকান্না কে অনুসরণ করে আগুনে ঝাপ দেয়।
মুকান্নার হেরেমের এক মেয়ে এই সময় লুকিয়ে ছিল। মুকান্না ও তার সাথীরা মারা গেলে সে কেল্লার প্রাচীরে চড়ে মুসলিম বাহিনীকে কেল্লায় প্রবেশের আহবান জানায়।
‘আপনারা ভেতরে আসুন। এখানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই’
মুসলিম বাহিনী কেল্লায় প্রবেশ করে। সেখানে তখন মেয়েটি ছাড়া আর কেউ ছিলো না।
এই মেয়েই ছিল সালমা, যে রাত জেগে জেগে আল্লাহর কাছে দোয়া করতো।
মুকান্নার এই ফেতনা প্রায় ১৩ বছর স্থায়ী হয়েছিল। ১৬৩ হিজরীতে মুকান্নার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই ফেতনার সমাপ্তি ঘটে।
অনুবাদকের কথা
খান আসিফ তার লেখায় কোনো ইতিহাস গ্রন্থের উদ্ধৃতি দেননি। চলুন এবার মুকান্নার ঘটনা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মতামত দেখে আসা যাক । প্রথমদিকের ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রায় সবাই হেকিম মুকান্না আল খোরাসানির কথা উল্লেখ করেছেন। ইবনে কাসির রহিমাহুল্লাহ ১৬৩ হিজরীর ঘটনাবলীতে মুকান্নার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, মুকান্নার তৈরী এই নকল চাঁদ দুই মাসের দূরত্ব থেকেও দেখা যেত। ইবনে কাসির লিখেছেন, মুকান্না তার স্ত্রীদের বিষপান করিয়ে হত্যা করে। নিজেও বিষপান করে আত্মহত্যা করে। মুসলিম সৈন্যরা কেল্লায় প্রবেশ করে তার লাশ পায়। তারা তার মাথা কেটে খলিফার কাছে পাঠিয়ে দেয়। খলিফা তখন হালাব শহরে অবস্থান করছিলেন। (১)
ইবনে জারীর তাবারি লিখেছেন, মুকান্নার মাথা কেটে খলিফার কাছে প্রেরণ করা হয়। (২)
ইবনে খালদুন মুকান্নার সাথে লড়াইয়ের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখছেন, মুকান্না সোনার তৈরী একটি মুখোশ পরে থাকতো। এছাড়া তিনি মুকান্নার নকল চাঁদের কথাও উল্লেখ করেছেন। (৩)
ইবনে আসীর লিখেছেন, মুকান্না ও তার অনুসারীদের বিশ্বাস ছিল আবু মুসলিম খোরাসানী আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। (নাউজুবিল্লাহ)। মুকান্নার অনুসারীরা যুদ্ধের সময় বলতো হে হিশাম, আমাদের সাহায্য করো। মুকান্নার হত্যা সম্পর্কে ইবনে আসীর দুইটি বর্ননা উল্লেখ করেছেন। ১. মুকান্না বিষপানে আত্মহত্যা করে। পরে তার মাথা কেটে খলিফার কাছে প্রেরণ করা হয়। ২. মুকান্না আগুনে পুড়ে মারা যায়। (৪)
ইবনুল জাওযি লিখেছেন, মুকান্না তার হেরেমের মহিলাদের বিষপানে হত্যা করে , পরে নিজেও বিষপান করে আত্মহত্যা করে। (৫)
হাফেজ শামসুদ্দিন জাহাভী লিখেছেন, মুকান্না বিষ পান করে আত্মহত্যা করে। (৬)
খান আসিফের লেখায় যেমনটা দেখা যাচ্ছে, তিনি মুকান্নার খোদায়ী দাবির জন্য অনেকটাই বাল্যকালের অবহেলা ও বিদ্রুপকে দায়ী করছেন। নির্মোহ বিশ্লেষণে এই সিদ্ধান্ত অতিরিক্ত সরলীকরণ বলেই মনে হয়। মুকান্নার জীবনি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রথম থেকেই সে আবু মুসলিম খোরাসানি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সে মনে করতো আবু মুসলিম খোরাসানী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। এছাড়া ড. মুহাম্মদ বিন নাসের বিন আহমদ লিখেছেন, মুকান্না জীবনের প্রথম দিকেই রযযামিয়াদের (শিয়াদের একটি শাখা) মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়। (৭) এইসব বর্ননা দ্বারা বুঝা যায়, মুকান্না বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। একইসাথে বাল্যকালের অবহেলাও তার মনে ক্রিয়াশীল ছিল।
এবার আসা যাক মুকান্নার চাঁদ প্রসংগে। ঐতিহাসিকদের যারাই চাঁদের কথা উল্লেখ করেছেন তারা এই চাঁদের রহস্য সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেননি। এই চাঁদ সম্পর্কে একটি বর্ননা পাওয়া যায় বুলদানুল খিলাফাতিশ শরকিয়্যাহ গ্রন্থে। সেখানে আছে, মুকান্না একটি কুপে পারদভর্তি থালা রেখে দেয়। সেখান থেকেই চাঁদ উঠতো (৮)। এই বর্ননা থেকে ড. মুহাম্মদ বিন নাসের বিন আহমদ অনুমান করছেন সম্ভবত চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে শূন্যে চাঁদের আকৃতি তৈরী করতো।
বিষয়টি পরিস্কার করতে চুয়েটের একজন অধ্যাপকের দারস্থ হই। তিনি বলেন, মূল বিষয় হলো মানুষের দৃষ্টির কোণ । যেহেতু মানুষের দৃষ্টিগত সীমাবদ্ধতা আছে এবং নানা কোনে নানাভাবে খেল দেখানো যায় । তাই অনেকক্ষেত্রে সামনে না থাকা জিনিস আপাতভাবে সামনে এনে মানুষকে তাক লাগানো যায় । আলোর কোন সৃষ্টি করে অথবা মানুষের দৃষ্টিসীমার কোণ(এংগেল) ব্যবহার করে এই কাজ করা যায়। এই কৌশল খাটিয়েই ডেভিড কপারফিল্ড কিছু সময়ের জন্য স্টাচু অফ লিবার্টিকে মানুষের দৃষ্টিসীমার আড়ালে নিয়ে যান।
টীকা
১। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১০ম খন্ড, ১৪৫,১৪৬ পৃষ্ঠা– হাফেজ ইমাদুদ্দিন ইবনে কাসির। মাকতাবাতুল মাআরিফ, বৈরুত।
২। তারীখে তাবারী, ৯ম খন্ড, ১৪৪ পৃষ্ঠা– ইবনে জারির তাবারি। দারুল মাআরিফ, মিসর।
৩। তারীখে ইবনে খালদুন, ৪র্থ খন্ড, ১৫৮ পৃষ্ঠা– আব্দুর রহমান ইবনে খালদুন। দারুল ফিকর।
৪। আল কামেল ফিত তারিখ, ৫ম খন্ড, ২৩৮, ২৩২ পৃষ্ঠা– ইবনুল আসীর। দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত।
৫। আল মুন্তাজাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম, ৮ম খন্ড, ২৬৩ পৃষ্ঠা– ইবনুল জাওযি। দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত।
৬। তারীখুল ইসলাম ওয়া ওয়াফায়াতুল মাশাহিরি ওয়াল আলাম, ১০ম খন্ড, ১৪ পৃষ্ঠা– হাফেজ শামসুদ্দিন জাহাভী। দারুল কিতাবিল আরাবি, বৈরুত।
৭। জামেয়া ইমাম মুহাম্মদ বিন সাউদ সাময়িকী, শাওয়াল, ১৪২০ হিজরী। হারাকাতুল মুকান্না আল খোরাসানি — ড. মুহাম্মদ বিন নাসের বিন আহমদ। ২৭৯ পৃষ্ঠা।
৮। বুলদানুল খিলাফাতিশ শরকিয়্যাহ, ৫১৩, ১৪ পৃষ্ঠা– মুআসসাসাতুর রিসালাহ।
(কয়েকটি আরবী বাক্যের অনুবাদ করতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। তখন হিশাম খান, আবদুল্লাহ তালহা, আশরাফ মাহদী সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা)

ইসলামে নিকাব নেই !

তানভীর আহমেদঃ রঙঢঙের যুগেও যেসব বোনেরা নিজেদের হিফাজত করে যথাযথ হিজাব করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে, দুই একজন ইসলামবিদ্বেষীর কারণে সেসব বোনদের ভোগান্তি আর অপমানের শিকার হতে হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানের ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। এখন যখন সেই কালপ্রিটরা বুঝতে পেরেছে যে ৮৮% মুসলিমদের দেশে কোনো প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করলে আর যাই হোক সুবিধা করা যাবে না, তখন তারা একটু ডিফারেন্ট এপ্রোচ নিল। আর সেটা হল হিজাব থাকুক – সমস্যা নেই, কিন্তু নিকাব পরিধান করা যাবে না।
তারা ভাবল, এখন যে হারে পূর্ণ দ্বীন না বোঝা বোকা মেয়েগুলো হিজাবের নামে লালনীল পট্টি বেঁধে, লিপস্টিক দিয়ে নয়া জামানার সম্ভ্রমী সেজেছে তাতে হিজাব থাকলেও সমস্যা নেই। কিন্তু যারা এখনও দ্বীনকে আঁকড়ে ধরে নিজেদের পর্দার ইবাদাতে পূর্ণতা এনে নিকাবও করছে এদেরকে সওয়া যায় না। সুতরাং, নিকাব নিষিদ্ধ করো। তাছাড়া একদল আলেমের ফতোয়া তো আছেই! প্রথমদিকে বলা হল হিজাবই তো যথেষ্ট, নিকাবের আর কী দরকার? এরপর ধীরে ধীরে এল, ইসলামে নিকাবের বিধানই নাকি নেই! আল্লাহু আকবার! ফলাফলস্বরূপ আইইউবিএটিসহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা নিকাব নিষিদ্ধ করতে দেখেছি। আরও হয়ত অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই কাতারে দাঁড়িয়ে আছে।

এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট যা হয়ত আমাদের নজর এড়িয়ে যায় তা হল, জ্বিন শয়তানের মত মানব শয়তানদেরও হুটহাট কাজ না করে ধীরস্থির কর্মপদ্ধতি বারসিসাকে যেমনি শয়তান সরাসরি জিনা-হত্যা আর শিরকের অপরাধে জড়াতে পারে নি, কিন্তু ঠিকই দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় ঠিকই উপরোক্ত ভয়ানক অপরাধগুলোতে জড়িয়ে ফেলেছিল; তেমনি মানব শয়তানরাও কিন্তু সরাসরি পর্দা-হিজাব সমস্ত বাদ এমন সুর তুলে নাই। কিন্তু তারা ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে।


এটা পড়ুন – পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ নেক রমণী


 প্রথমে তারা নিকবকে আক্রমণ করেছে। প্রথমে বলছে নিকাব ছাড়াও পর্দা হয়। এরপর বলছে, নিকাব ছাড়াও যেহেতু পর্দা হয়, সেহেতু আমার প্রতিষ্ঠানে থাকতে হলে নিকাব করা যাবে না। এমনি হিজাব করে আসো, তাতে সমস্যা নেই; আমি তো আর ইসলামবিদ্বেষী নই যে হিজাব নিষিদ্ধ করব! এরপর হয়ত একদিন বলা হবে অমুক দিন সবাইকে শাড়িই পরিধান করতে হবে।
এহেন পরিস্থিতিগুলো মাথায় রেখে ইসলামে নিকাবের বিধান নিয়ে পড়াশোনার আগ্রহ জমলো, যেহেতু সকল ফিতনার এখানেই হয়েছিল শুরু। অতঃপর যা জেনেছি সুবহানাল্লাহ! নিকাবের দলিলসমূহ থেকে শুরু অন্যান্য আলেমরা যারা নিকাব ছাড়াও পর্দা হয় এমন ফতোয়া দিয়েছিলেন তাদের দলিলগুলোরও যথার্থ রিফিউটেশন। অর্থাৎ এককথায় জানতে পেরেছি, ইসলামে নিকাব ছাড়া পর্দা নেই
পরবর্তী কয়েকটি প্যারায় আমি উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দলিল উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ। আমার মতে এই বিষয়ে সবার অন্তত সাধারণ থাকা উচিত। তানাহলে হুটহাট কেউ আপনাকে বা আপনার সামনে কোনো বোনকে হয়ত পার্সোনালি আক্রমণ করে বলবে, ‘ইসলামে নিকাব নেই’ আর তখন জ্ঞানহীনতার দরুণ আপনি বাধ্য হবেন মেনে নিতে। আর পরবর্তীতে যা হবার তাই হবে। ধীরে ধীরে আক্রমণের মাত্রা বাড়তে বাড়তে একসময় নিকাব খুলে ফেলবার মত বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা চাই না আমাদের কারও মা, বোন, স্ত্রী বা কন্যার এমন অবস্থার শিকার হতে হয়। তাই এসব ঘটনা ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকাকালীনই নিকাবের শক্ত দলিলগুলো দিয়ে ইতি টেনে দিতে হবে ইনশাআল্লাহ। আর আল্লাহ তো মু’মিনদেরই সাথে রয়েছেন।
নিকাবের উল্লেখযোগ্য দলিলসমূহঃ

প্রথম দলিল

আল কুরআনের আয়াতঃ

“হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।”

(সূরা আহযাব: ৫৯)
এই আয়াতে সকল নারীর কথাই উল্লেখ রয়েছে। রাসূল্লাহ (সঃ) এর পূন্যাত্মা স্ত্রীগণসহ অন্যান্য মুসলিম নারীগণও এ হুকুমের আওতাভুক্ত। এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, মুসলিম নারীদের জন্য চেহারার পর্দা করা জরুরী। আরও আদেশ করা হয়েছে তারা যেন তাদের সৌন্দর্য পরপুরুষ থেকে আড়ালে রাখে।

দ্বিতীয় দলিল

দু’টি হাদিস ও ব্যাখ্যাঃ
যে কেউ অহংকার বশত তার কাপড়কে মাটিতে হেঁচড়িয়ে চলবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দিকে তাকাবেন না।
(বুখারী শরিফ, হাদিস নং- ৫৭৮৪ এবং মুসলিম শরিফ, হাদিস নং- ২০৮৫)
এটা শুধু পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য, নারীদের জন্য নয়। এ ব্যাপারে নিম্নের হাদিসটি উল্লেখযোগ্য-
ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গর্বভরে তার কাপড় হেঁচড়িয়ে চলে ক্বিয়ামত দিবসে আল্লাহ তার দিকে (রহমতের দৃষ্টিতে) তাকাবেন না’, উম্মে সালমা বললেন, তাহলে মহিলারা তাদের আঁচল কী করবে? রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন, ‘এক বিঘত ঝুলিয়ে পরবে’, উম্মে সালমা বললেন, তবে তো তাদের পা প্রকাশ হয়ে পড়বে। নবী করীম (সঃ) বললেন, ‘এক হাত ঝুলিয়ে দিবে, তার থেকে বেশি করবে না’
(তিরমিযী হা/১৮৩৫; নাসাঈ হা/৫৩৩৬)
এ হাদিসে মহিলাদের পা ঢেকে রাখা ওয়াজিব হওয়ার দলিল। আর এটা মহিলা সাহাবিদের নিকট খুবই পরিচিত ও জানা ছিল।

নিঃসন্দেহে দু’পায়ের গোড়ালির সৌন্দর্য্য সম্পূর্ণ মুখমন্ডল ও হাতের সৌন্দর্য্যের তুলনায় কিছুই নয়।

কেননা, এ বাস্তবতা অনস্বীকার্য যে মুখমণ্ডলেই মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য্য প্রতিফলিত হয়। এছাড়া শরী‘আতের হিকমত হচ্ছে ছোট বা হালকা ফিতনায় বিধান হালকা করা এবং গুরুতর ফিতনার ক্ষেত্রে কঠিন করা। এর বিপরীত করলে সেটি হবে আল্লাহর হিকমত ও শরী‘আতের মধ্যে দন্দ্ব সৃষ্টি করা। তাই মুখের নিকাবও আবহমান কাল ধরে ওয়াজিব

তৃতীয় দলিল

“ইহরাম গ্রহণকারী নারী যেন নেকাব ও হাতমোজা পরিধান না করে।”

(সহীহ বুখারী ৪/৬৩, হাদীস : ১৮৩৮)
এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (সা) যুগের নারীরা অর্থাৎ সাহাবিয়াতগণ সাধারণত নিকাব এবং হাতমোজা উভয়ই ব্যবহার করতো। আর এজন্যই ইহরাম অবস্থায় তা বিশেষভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সাহাবিয়াতগণ যদি নিকাব আর হাতমোজা নাই পরিধান করতেন তবে কখনোই ইহরামের জন্য এমন নির্দেশ আসতো না।

চতুর্থ দলিল

হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা (রাঃ) হতে বর্ণিত,
তিনি বলেন- আমি জনৈক মেয়েকে বিবাহ করার জন্য প্রস্তাব দেই এবং বিষয়টা রাসূল (সাঃ)-কে বলি । রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে বললেন, “তুমি কি তাকে দেখেছো?” আমি বললাম, “না।” তিনি বললেন, “তুমি তাকে দেখে এসো । কারণ- এ দেখাটা তোমাদের মাঝে সৌহার্দ্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে বেশ উপযোগী হবে।” ফলে আমি মেয়েটিকে দেখার জন্য যাই। তখন তার বাবা-মা সেখানে ছিল এবং মেয়েটি পর্দার আড়ালে লুকিয়ে ছিল। তখন আমি বললাম, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মেয়েটিকে দেখার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন।” আমার এ-কথায় তার বাবা-মা নীরব রইলেন। অন্য বর্ণনায় আছে – “যেন তারা আমার এ কথাকে অপছন্দ করলেন।” (তারা বিবাহের আগে পাত্রীকে দেখানোর পক্ষে ছিলেন না।) ইতিমধ্যে মেয়েটি বলল, “যদি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে দেখার জন্য আপনাকে আদেশ করে থাকেন, তাহলে আপনার দেখার সুবিধার্থে আমি আপনার সামনে আসছি। আর যদি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে দেখার জন্য আপনাকে নির্দেশ না দিয়ে থাকেন, তাহলে আপনি আমার দিকে দৃষ্টি দিবেন না।” হযরত মুগীরা (রাঃ) বলেন, “এরপর আমি তাকে দেখি এবং তাকে বিবাহ করি।”
(সুনানে ইবনে মাজাহ, ২য় খন্ড, ৪২৪ পৃষ্ঠা; হাদীস নং ১৮৬৬)
আল্লাহ আমাদের প্রতি রহম করুন। নারী সাহাবাগণ কেমন আল্লাহভীরু ছিলেন। সাহাবীকে শপথ দিচ্ছেন – আল্লাহর রাসূল অনুমতি দিলে সে তার চেহারা দেখাবে, নয়ত নয়। অথচ আমরা আজ নিকাব ইসলামে নেই বলে বলে প্রচার করছি! সেই নারী সাহাবাটি তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা একজন সৎ, পরহেযগার সাহাবীর সামনে একবার খোলা চেহারায় আসতে কতো সংকোচ করেছে। অথচ আমরা চেহারা অনাবৃত রেখে, নকশি বোরকা গায়ে জড়িয়ে দ্বিধাহীন চিত্তে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াব! আল্লাহু আকবার! আমাদের আল্লাহকে সর্ববিষয়ে ভয় করা উচিত এবং তাঁর ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।

বিভ্রান্তি নিরসন

আল-কুরআনের সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেনঃ

“ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে… ”

অনেকে দাবি করেন যে এই আয়াতের إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا (ইল্লা মা- যহা-র মিনহা) অর্থাৎ ‘যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া’ দিয়ে চেহারা আর হাতের অবকাশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসলে চেহারা আর হাত এর উদ্দেশ্য নয়। إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا বলে আল্লাহ সুবহানাহুতাআলা সৌন্দর্য্য প্রকাশক সেসব বিষয়াদি পরিস্থিতিকে বাদ দিয়েছেন যা এমনিই প্রকাশ হয়ে যায় অর্থাৎ যার উপর বান্দার নিয়ন্ত্রণ নেই। যেমন নারীর দৈর্ঘ্য ও খর্বতা, কৃশতা ও স্থুলতা ইত্যাদি। আবার, অনেক সময় একদিক থেকে জোর বাতাস বইলে নারীর যথাযথ পর্দা থাকা স্বত্বেও একদিকের আকৃতির কিয়দাংশ বোঝা যেতে পারে যা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। এই বিষয়গুলো বোঝাতেই আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا বলেছেন কিন্তু إِلَّا مَا ظَهَرَت (ইল্লা মা- যহা-রতু) অর্থাৎ ‘নারী নিজে যা প্রকাশ করে’ বলেন নাই।

সুতরাং, إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا (ইল্লা মা- যহা-র মিনহা) এর উদ্দেশ্য হল,

যে বিষয়াদিগুলো ইচ্ছা ব্যতীত এমনিতেই স্বাভাবিকভাবে প্রকাশিত হয়ে যায় সেগুলো।

সুতরাং আমাদের আল্লাহকেই যথার্থরূপে ভয় করে তাঁর বিধান মেনে নেওয়াই কল্যাণকর।
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে তেমনিভাবে ভয় করো ঠিক যেমনিভাবে ভয় করা উচিত…” (সূরা আল-ইমরান, ১০২)
(এখানে কেবল উল্লেখযোগ্য দলিলগুলো দেওয়া হয়েছে। ইসলামের এই ওয়াজিব বিধানটির ওয়াল্লাহি আরও বহু দলিল রয়েছে।)
পরিশেষে কেবল এতটুকুই বলব, আপনার সামনে যখন একজন বোনের নিকাব বা হিজাব নিয়ে ঠাট্টা করা হবে বা কথা শোনানো হবে তখন তা আসলে সেই বোনটির জন্য পরীক্ষা নয়। তা আপনারও পরীক্ষা সুবহানাল্লাহ! কারণ তখন আসলে ইসলামের একটি বিধানকে আক্রমণ করা হয়েছে। তাই সামনে এগিয়ে তখন কথা না বললে নিজে কতটুকু দ্বীন ধারণ করি, পালন করি সেই প্রশ্নের চেয়ে আদৌ নিজের ঈমান আছে কিনা সেই প্রশ্নই গুরুতর হয়ে যাবে।
আল্লাহ আমাদের যথার্থরূপে ইসলামের বিধিবিধানগুলো মেনে নেবার এবং মেনে চলবার তাওফিক দিন। আল্লাহ আমাদের যথার্থরূপে ‘সৎ কাজের উপদেশ ও অসৎ কাজে বাধা দেওয়া’ র তাওফিক দিন। আমাদের চেষ্টাগুলোকে কবুল করুন।

আল্লাহ এক, রাসূল এক, ধর্ম এক মাযহাব এত কেন ?

ছোট্ট একটি প্রশ্ন। এক আল্লাহ, এক রাসূল, এক কিবলা, এক ধর্ম। তবে হাদীস প্রনেতা পৃথিবীতে এত কেন? আসলে কি আল্লাহ এই সকল মানুষগুলোকে হাদীস সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছিলেন? হাদীস সংগ্রহের দায়িত্ব যদি আল্লাহ কাউকে দিতেন, তাহলে একজনকে দিতে পারতেন। তাহলে পৃথিবীতে এত মাযহাব হতো না। এত ফিরকাহ বা মাযহাবের জন্য কি হাদীস প্রনেতারা দায়ী, নাকি আমরা। কিংবা আল্লাহ। কোনটাকে আপনি দায়ী মনে করেন। আমরা যে সব হাদীসগুলো পড়ি এ কথাগুলো কম-বেশী প্রায় সবগুলো কোরআনে আছে। আবার দেখুন অনেক ‍কিছু হাদীসে আছে যা কোরআনে নেই। সেই কারণে কোরআনকে কি আপনি অপূর্ণাঙ্গ কিতাব বলবেন? আল্লাহ বলেছে, কোরআনে সব আছে। যদি কোরআনে সব থেকে থাকে তবে হাদীস আমাদের কি নেয়ার আছে। হাদীস ছাড়া কোরআন কি পূর্ণাঙ্গ কিতাব। যদি হাদীস নিতেই হয়, তাহলে কোরআনের পূর্ণাঙ্গতা কতটা যৌক্তিক?

উত্তরঃ-
       আপনি ছোট বলে অনেক বড় প্রশ্নই করে ফেলেছেন। কেননা, এ প্রশ্নের উত্তর দীর্ঘ হবে। নিম্নে উত্তর প্রদান করা হলো। আশা করি মনযোগ সহকারে উত্তরটি পড়বেন এবং অনুধাবন করবেন। তবে উত্তর প্রদানের পূর্বে একটি বিষয়ে আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করা প্রয়োজন। আর তা হলো যে, আপনি প্রশ্নটি করার ক্ষেত্রে নিজের কাছে কোনো উত্তর খুঁজেননি। আমাদের বিশ্বাস আপনি নিজের কাছে জিজ্ঞাসা করলেও এসব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতেন। যেমন দেখুন! আপনার প্রশ্ন হলো, ধর্ম এক, আল্লাহ এক, রাসূল এক, তাহলে হাদিস প্রণেতা এত কেন? আপনি বলুন তো! ক্লাস এক, শিক্ষক এক, ছাত্র এত কেন?
     আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, আল্লাহ তা‘আলা কি এ সব মানুষকে হাদিস সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়ে ছিলেন? তার উত্তর হলো, হ্যাঁ, কেননা কোরআন হাদিসের অসংখ্য স্থানে অন্যের নিকট দ্বীন পৌঁছানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন, রাসূল স. ইরশাদ করেছেন,يحملهذاالعلممنكلخلفعدوله ‘দ্বীনের এই ইলম প্রত্যেক পরবর্তীদের নিষ্ঠাবানরা বহন করবে।’ (মেশকাতুল আসার:8/373)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, عن عبد الله بن عمرو، أن النبي صلى الله عليه وسلم، قال: بلغوا عني ولو آية‘আমার পক্ষ থেকে একটি বিষয় হলেও তোমরা অন্যের কাছে পৌঁছিয়ে দাও।’ (বুখারী শরিফ: 1/491)
       মনে রাখতে হবে, এই আদেশের আওতায় হাদিস প্রণেতা, ফিকাহবিদসহ সকল স্তরের মুসলমান এমনকি আপনি, আমিও অন্তর্ভূক্ত। হাদিস সংকলনকারী মুহাদ্দিসগণ অনেক ত্যাগের মাধ্যমে দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালন করেছেন। যা তাদের সমগ্র মুসলিম জাতির ওপর এক অসাধারণ কৃপা ও অনুগ্রহ। মুসলমানগণ কোনো দিন তাদের এ ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না।

এটা পড়ুন –  একটি সরল মূল্যায়ন: কুরআন-সুন্নাহ থাকতে মাযহাব কেন ?


একাধিক মাযহাব ও ফিরকার জন্য তাঁরা কোনোভাবেই দায়ী নন। কারণ তাদের দায়ী করতে হলে আগে যিনি হাদিসগুলো বলেছেন, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ স.
نعوذباللهতাঁকেই দায়ী করতে হবে। আর শেষ পর্যন্ত نعوذبالله আল্লাহ তা‘আলাকে দায়ী করতে হবে। যা হবে চরম জ্ঞান পাপ ও ধৃষ্টতা। কেননা, এসব কিছুর পেছনে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাই মূল নিয়ামক। আর তাঁর কোনো কাজই অহেতুক ও রহস্য মুক্ত নয়। মানুষ চিন্তা করলে অনেক সময় সে রহস্য বুঝতে সক্ষম হয়। আবার অনেক সময় সক্ষমহয় না। হাদিস সংগ্রহ যদি একজনই করতো, তারপরও মাযহাব এক না হয়ে একাধিক হতো এতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষের বুঝের ভিন্নতা এর বড় কারণ। একই বিষয় একজন এক রকম বুঝলেও অন্যজন অন্য রকম বুঝেন। একই রুগী দুই ডাক্তারের কাছে গেলে দুইজন দুই ধরণের চিকিৎসা করে থাকেন। বুখারী শরিফের একটি হাদিসে এসেছে,
عن ابن عمر رضي الله عنهما قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم يوم الأحزاب ( لا يصلين أحد العصرإلا في بني قريظة) فأدرك بعضهم العصر في الطريق فقال بعضهم لا نصلي حتى نأتيها وقال بعضهم بل نصلي لم يرد منا ذلك . فذكر ذلك للنبي صلى الله عليه و سلم فلم يعنف واحدا منهم.
অর্থাৎ- নবী করীম স. আহযাবের দিন সাহাবায়ে কেরামের একটি জামাতকে ‘বনী কুরাইজা’ নামক স্থানে এ বলে পাঠালেন যে, তোমাদের কেউ যেন বনী কুরাইজায় না পৌঁছা পর্যন্ত আছরের নামায না পড়ে। কিন্তু ঘটনাক্রমে সেখানে পৌঁছতে দেরী হওয়ায় পথিমধ্যে আছরের নামাযের সময় ঘনিয়ে আসে। তখন একদল সাহাবী (রাসূল স. এর আদেশের প্রতি লক্ষ্য করে) বললেন, আমরা বনী কুরাইজাতে পৌঁছার আগে আছরের নামায আদায় করবো না। কিন্তু আরেক দল সাহাবী  (রাসূল স. এর আদেশের উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য করে) বললেন, আমরা আছরের নামায রাস্তায় পড়ে নিব। কেননা, রাসূল স. আমাদের থেকে এই বাহ্যত অর্থ উদ্দেশ্য নেননি। (বরং রাসূলের উদ্দেশ্য হলো, আমরা যেন অতিদ্রুত বনী কুরাইজায় যাই এবং আছরের নামায সেখানে গিয়ে পড়ি। কিন্তু আমাদের দূর্বলতা ও অলসতার কারণে পৌঁছতে দেরী হয়ে যায়। তাই আছরের নামায কাযা করবো না) এ ঘটনা রাসূলুল্লাহ স. কে জানানো হলে তিনি কোনো দলকেই ভর্ৎসনা করেননি। (বুখারী শরিফ : 2/591) এখানে আদেশ ও আদেশদাতা একই হওয়া সত্বেও বুঝ ভিন্ন হওয়ায় আদেশ পালনে মতভেদ দেখা দিয়েছে।
       এত মাযহাবের জন্য আমরা কাউকে দায়ী মনে করি না। আমরা বিশ্বাস করি যে, এমনটি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ছিলো, তাই তা হয়েছে। বলাবাহুল্য যে, এ ভিন্নতার প্রয়োজন ছিলো। কেননা, মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিগতভাবে সব ক্ষেত্রে ভিন্নতা দিয়ে সৃষ্টি করে অভিন্ন কোনো বিধান চাপিয়ে দেয়া যৌক্তিকতার পরিপন্থী। আর আল্লাহ পাক অন্যায় অযৌক্তিক সব বিষয় থেকে মুক্ত।
       আপনার আর একটি প্রশ্ন হলো, হাদিস সংগ্রহের দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলা একজনকে দিতে পারতেন। এ প্রশ্নের উত্তর অনেকখানি পূর্বের বর্ণনায় এসে গেছে। তারপরও আপনি নিজেও একজন মানুষ। আপনি নিজে অন্যের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত না হলেও নিজের ব্যাপারে অবশ্যই অবগত রয়েছেন যে, একজন মানুষের মেধা, জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে তার কি পরিমাণ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সীমাবদ্ধতা দিয়েই আল্লাহ মানুষকে তৈরী করেছেন। তাহলে একজনকে হাদিস সংগ্রহের দায়িত্ব প্রদান করার প্রস্তাব নিতান্তই হাস্যকর। কেননা, তা সম্ভবই নয়।
       আপনার সর্বশেষ প্রশ্ন হলো, হাদিস ছাড়া কোরআন পূর্ণাঙ্গ কি না? উত্তর হলো, কোরআন পূর্ণাঙ্গি একটি কিতাব। হাদিস ছাড়াও কোরআন পূর্ণাঙ্গ। তবে এর অর্থ এই নয় যে, হাদিসের কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা, কোরআন হলো মূল আর হাদিস হলো তার ব্যাখ্যা। সুতরাং কোনোটিই অপরটির অপূর্ণতার দলিল বহন করে না। কোরআন অপূর্ণ নয়। তবে কোরআনের সকল বিষয় সকলের বোধগম্য নয়। তাই সম্ভবত এই কোরআনকেألم দ্বারা শুরু করে প্রথমেই এই বার্তা দেয়া হয়েছে যে, এই কোরআনে পরিবেশিত সকল বিষয় সকলের বোধগম্য নয়। এটি কোরআনের অপূর্ণতা নয়; বরং মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। আর হাদিসের অনুসরণ মূলত কোরআনেরই অনুসরণ। কেননা, কোরআন শরিফের বিভিন্ন জায়গায় ইরশাদ হয়েছে,
{يَاأَيُّهَاالَّذِينَآمَنُواأَطِيعُوااللَّهَوَأَطِيعُواالرَّسُولَ‘তোমরা আল্লাহর অনুসরণ করো এবং রাসূলের অনুসরণ করো।’ (সূরা সূরা নিসা- 59)
আর রাসূলের অনুসরণ তাঁর কথা ও কাজের অনুসরণ ব্যতীত সম্ভব নয়। তাঁর কথা ও কাজকেই তো হাদিস বলা হয়। তাই হাদিসের অনুসরণ মানে কোরআনেরই অনুসরণ করা।
 

স্বর্গ চ্যুতি – বন্দে আলী মিয়া

স্বর্গ চ্যুতি । মাটির দ্বারা প্রস্তুত তুচ্ছ মানব আদমের জন্য আজাযিলের এই দুর্দশা ঘটলো। আজাযিল সেই নিরপরাধ আদমকে জব্দ করবার জন্য সুযোগ খুঁজতে লাগলো।

খোদাতা’লা বেহেশতে বিচিত্র উদ্যান রচনা করে নানারকম সুন্দর সুন্দর ফল ও ফুলের গাছ সৃষ্টি করলেন। সেই বাগানের দু’টি গাছ সৃষ্ট হলো –তার একটি নাম জীবন-বৃক্ষ, অপরটির নাম জ্ঞান-বৃক্ষ। খোদা আদমকে সেই বাগানে বাস করবার অনুমতি দিলেন। খোদা আদমকে অনুমতি দিলেন –বাগানের সমস্ত গাছের ফল সে খেতে পারে, কিন্তু জীবন-বৃক্ষ ও জ্ঞান-বৃক্ষের ফল সে কখনো যেন ভক্ষণ না করে। এই গাছের ফল আহার করামাত্র তার মৃত্যু ঘটবে।

এর পরে অনেক দিন চলে যাবার পর খোদা মনে করলেন আদমেরন একজন সঙ্গিনী সৃষ্টি করা প্রয়োজন। একদিন তিনি সমস্ত পশুপক্ষীকে আদমনের নিকটে এনে তাদের প্রত্যেকের নামকরণ করতে বললেন। আদম প্রত্যেক জীবের আলাদা আলাদা নাম রাখলেন। তারা চলে গেলে আদম চিন্তা করতে লাগলেন, খোদাতা’লা সকল জীবজন্তুকে জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন কেবল মাত্র তিনিই একাকী রয়েছেন।

সেই রাত্রে আদ ঘুমিয়ে পড়লে খোদা তাঁর বাম পাঁজড় থেকে একটা হাড় বের করে নিয়ে তা দিয়ে একটি নারী সৃষ্টি করে তাঁর পাশে শুইয়ে রাখলেন। ঘুম ভাঙলে পাশে একটি সুন্দরী নারীকে দেখে তিনি মনে মনে পরম বিস্ময়বোধ করলেন। এমন সময়ে খোদা বললেনঃ এর নাম বিবি হাওয়া। এ হলো তোমার সঙ্গিনী। তোমরা দু’জনে একত্রে বেহেশতের বাগানে থাকবে, খেলবে, বেড়াবে। কিন্তু সাবধান সেদিন তোমাকে নিষেধ করেছি –আজ আবার তোমাকে ও তোমার সঙ্গিনীকে বলছি, যখন ইচ্ছে হবে এই বাগানের সকল রকম ফল আহার করবে, কিন্তু এই জীবন-বৃক্ষ ও জ্ঞান-বৃক্ষের ফল কখনো আহার করবে না!

সেই দিন থেকে আদম ও হাওয়া মনের সুখে সেই বাগানের নানা রকম ফলমূল খেয়ে বেড়াতে লাগলেন।

একদিন হাওয়া একা একা বাগানে বেড়াচ্ছেন। এই সুযোগে শয়তান একটা সাপের মূর্তি ধরে তাঁর কাছে এলো। সে সময়ে সিংহ, বাঘ, সাপ, গরু, হরিণ, ভেড়া, ছাগল সকলে একসঙ্গে খেলা করতো। কেউ কাউকে হিংসা করতো না। সাপ হাওয়াকে জিজ্ঞাসা করলোঃ তোমরা কি এই বাগানের সব গাছের ফল খাও।


এটা পড়ুন –  আদি মানব ও আজাযিল


হাওয়া জবাব দিলেনঃ না, দু’টি গাছের ফল খাওয়া আমাদের নিষেধ!

সাপ জিজ্ঞাসা করলোঃ কোন কোন গাছের ফল তোমরা খাও না?

হাওয়া গাছ দু’টি দেখিয়ে দিলেন।

সাপ বললোঃ কেন তোমরা এ দু’টি গাছের ফল খাও না?

হাওয়া বললেনঃ জানি না খোদা বারণ করেছেন।

সাপ বললোঃ খোদা তোমাদের বোকা বানিয়ে এখানে রেখেছেন। এই গাছের ফল খেলে তোমাদের জ্ঞান-চক্ষু খুলে যাবে, তোমাদের ওপরে খোদার আর কোন কারসাজি চলবে না, তাই খোদা তোমাদের এই গাছের ফল খেতে বারণ করেছে, কি সুন্দর আর মিষ্টি এই ফল তা তোমরা জানো না।

সাপের কুপরামর্শে হাওয়ার মন দুলে উঠলো। তিনি ভাবলেন –তাইতো, অমন সুন্দর ফল না জানি কেমন মিষ্টি! তিনি লোভ সামলাতে পারলেন না। একটা ফল ছিঁড়ে নিলেন। আধখানা নিজে খেয়ে অর্ধেক আদমের জন্য নিয়ে গেলেন। আদম হাওয়ার হাত থেকে সেই নতুন রকমের ফলটুকু নিয়ে সাগ্রহে খেলে ফেললেন।

শয়তান উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে মনে মনে হাসতে লাগলো। ফল খাবার পরে তাঁরা সর্বপ্রথম মুঝতে পারলেন যে নিজেরা বস্ত্রহীন। তখন বড় বড় ডুমুরের পাতার সঙ্গে লতা গেঁথে তাঁরা লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করতে লাগলেন। এমন সময়ে খোদাতা’লা আদম ও হাওয়াকে নিকটে ডাকলেন, কিন্তু তাঁরা প্রতিদিনের মতো সমুখে গেলেন না। গাছের আড়ালে গিয়ে লুকোলেন।

খোদাতা’লা বললেনঃ আমি বুঝতে পেরেছি তোমরা জ্ঞান-বৃক্ষের ফল খেয়েছো।

আদম বললেনঃ হাওয়া আমাকে দিয়েছে।

খোদা ক্রুব্ধ কণ্ঠে বললেনঃ আমার আদেশ অমান্য করে যে পাপ আজ তোমরা করলে, বংশ পরম্পরাক্রমে এর ফল সকলকে ভোগ করতে হবে। ত

হাওয়াকে উদ্দেশ্য করে তিনি অভিশাপ দিলেনঃ তুমি প্রসব বেদনায় অত্যন্ত যন্ত্রণা ভোগ করবার পর তোমার সন্তান জন্মগ্রহণ করবে। চিরকাল তোমাকে পুরুষের অধীন হয়ে থাকতে হবে। পুরুষ তোমায় শাসন করবে।

আদমকে তিনি অভিশাপ দিলেনঃ তোমার শস্যক্ষেত্র আগাছা কুগাছা ও নানা কাঁটা গাছে ভর্তি হয়ে যাবে। এক মুষ্টি অন্নের জন্য আ-মরণ তোমাকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে।

সাপকে অভিশাপ দিয়ে বললেনঃ নির্বোধ নারীকে কুপরামর্শ দিয়ে পাপ করিয়েছ –এর শাস্তি তোমাকে সারা জীবন ভোগ করতে হবে। যে মাটিতে মানুষ পা দিয়ে চলবে সেই মাটিতে সর্বদা বুক পেতে তুমি চলবে এবং সেই খেয়ে তোমাকে জীবনধারণ করতে হবে। এই নারী বংশই হবে তোমাদের পরম শত্রু! তারা যখনই তোমাকে দেখবে তখনই বধ করার চেষ্টা করবে।

এই কথা বলে খোদা দু’খানা চামড়া তাঁদের পরিয়ে বাগান থেকে বের কের পৃথিবীতে নির্বাসন দিলেন।

লেখকের  কোরাণের গল্প নামক বই থেকে নেওয়া হয়েছে ।

হযরত দাউদ আঃ যার কবরে পাখ-পাখালী ছায়া দান করেছেন ।

মাওলানা যুবাইর আহমদ: আল্লাহ তার মাঝে নবুওয়াত ও রাজত্বের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। আল্লাহ তাকে প্রজ্ঞা ও বাকপটুতা দান করেছিলেন। তিনি এমন নবী ছিলেন, যার সাথে পাখ-পাখালী, পাহাড়, পর্বত তাসবীহ পাঠ করত। চিরবিরল এক কণ্ঠস্বর আল্লাহ তাকে দান করেছিলে। শয়তান জালুতকে হত্যা করার জন্য আল্লাহ তাকে বনী ইসরাঈল সম্প্রদায় থেকে নবী হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। ফলে সে দাউদ আ. এর হাতেই নির্মমভাবে নিহত হয়েছিল। তিনি ছিলেন অসীম সাহসী; যার কারণে কখনো তিনি যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করেননি। এবং শত্র“র তরবারীর ঝঞ্ঝনানীতে ভীত হননি।
আল্লাহ তাকে একত্রে রাজত্ব ও নবুওয়াত দান করেছিলেন। এমনকি তাকে লৌহ বর্ম তৈরির কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলেন। আর লোহাকে তার আদেশের অধীন করে দিয়েছিলেন। এভাবেই আল্লাহ তার মর্যাদাকে সমুন্নত করেছিলেন।
আল্লাহ তার ওপর যাবুর কিতাব অবতীর্ণ করেছিলেন। আর তাকে এমন সুমধুর, সুন্দর ও কোমল কষ্ঠস্বর দান করেছিলেন যা তিনি ইতোপূর্বে অন্য কাউকে দান করেননি। যখন তিনি যাবুর কিতাব পড়তেন তখন মানব-দানব, পশু-পাখি সব স্থির হয়ে যেত। এবং তার তেলাওয়াতের মাধুর্যে মুগ্ধ ও বিমহিত হয়ে পড়ত। তিনি ছিলেন দুনিয়া বিরাগী, অধিক নামায আদায়কারী।
তিনি ছিলেন স্বভাব গাম্ভীর্যের অধিকারী ও বিনয়ের মূর্তপ্রতীক। আল্লাহ তাআলার স্মরণ তার যবান থেকে বিচ্ছিন্ন হতো না, তিনি সকাল যাপন করতেন আল্লাহ যিকিরের মাধ্যমে এবং তার প্রতিপালকের নেয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের মাধ্যম দিয়ে। হালকা আওয়াজে তার জবানে সদা আল্লাহর জিকির চলমান থাকত। যখনই সময় পেতেন তখনই তিনি যাবুর কিতাব তেলাওয়াত করতেন। আল্লাহ তার জবানে হেদায়েতের নূর ঢেলে দিয়েছিলেন। পাহাড়-পর্বত তার অধীন করে দিয়েছিলেন। এরা সকাল-সন্ধ্যায় তার সাথে তাসবীহ পাঠে মগ্ন থাকত। পাখ-পাখালিরাও তার কাছে জমা হয়ে আল্লাহর গুণকীর্তন করতো এবং যাবুরের কিতাবের তেলাওয়াত শ্রবণ করতো। তাঁর ইবাদত ছিল অনুসরণীয় ও অবিস্মরনীয় ইবাদত। কারণ তাঁর নামায ছিল সর্বোত্তম নামায এবং তার রোযা ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ রোযা।


এটা পড়ুন – আদি মানব ও আজাযিল


রাসূল সা. বলেছেন, আল্লাহ তাআলার কাছে পছন্দনীয় রোযা হল দাউদ আ. এর রোযা। তিনি অর্ধরাত্র ঘুমিয়ে একতৃতীয়াংশ নামাযে কাটাতেন। এরপর আবার এক ষষ্ঠাংশ ঘুমাতেন। তিনি সারা বছর একদিন অন্তর অন্তর রোযা রাখতেন। তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! যদি আমার প্রতিটি পশমের দুটি করে মুখ থাকতো যা দিন রাত এবং যুগ যুগ ধরে আপনার তাসবীহ পাঠ করতো, আমি মনে করি, তবুও আপনার নেয়ামতের হক আদায় হওয়ার মত নয়। হযরত দাউদ আ. এর অন্তর বিচার দিবস ও জাহান্নামের ভয়ে সদা সংকিত থাকতো। তিনি পৃথিবীতে বসবাস করতেন আখেরাতকে সামনে রেখে। তার চোখের অশ্র“ এক মুহূর্তের জন্য থেমে থাকতো না।

এক পর্যায়ে তার চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে ছিল, তখন লোকেরা তাকে তিরস্কার করে বলত- এটা কোন ধরনের কান্না যার কারণে আপনি দিন দিন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন। উত্তরে তিনি বলতেন তোমরা আমাকে এ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবেনা। শরীরের সমস্ত অংশ পুরে যাওয়ার আগপূর্ব পর্যন্ত এবং কান্নার দিন আসার আগ পর্যন্ত আমি কাঁদতে থাকবো।

তিনি আরো বলতেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার সূর্যের তাপ সহ্য করতে পারি না, তাহলে আমি কিভাবে আপনার জাহান্নামের ঐ কঠিন আগুন সহ্য করবো? তার হৃদয়ে সামান্যতম অহংকার ছিল না।
তার নবুওয়াত তার গাম্ভীর্যকে বৃদ্ধি করেছে আর তার রাজত্ব বৃদ্ধি করেছে তার বিনয়কে। তিনি নিজ হাতের উপার্জন দ্বারা আহার করতেন। বিশাল রাজত্ব ভান্ডার থেকে এক লুকমা খাবারের মূল্য তিনি গ্রহণ করতেন না; বরং তিনি নিজ হাতে বর্ম তৈরি করতেন এবং তা বাজারে বিক্রি করে অর্জিত অর্থ দিয়ে খাবার খেতেন। এই ব্যাপারে রাসূল সা. দাউদ আ. এর প্রশংসা করে বলেছেন- আল্লাহর নবী দাউদ আ. নিজ হাতে উপার্জন করে খাবারের ব্যবস্থা করতেন, তাই মানুষ যা ভক্ষণ করে তার মধ্যে সর্বোত্তম হল যা সে নিজ হাতে উপার্জন করে।

তিনি তার বাড়িতে উৎকৃষ্ট মানের রুটি দ্বারা লোকদের মেহমানদারী করতেন অথচ তিনি নিজে সাধারণ যবের রুটি খেতেন। বিরল আত্মমর্যাদাবোধের অধিকারী ছিলেন দাউদ আ.। তিনি যখন বাড়ি থেকে বের হতেন, দরজা বন্ধ করে বের হতেন। ফলে তিনি বাড়িতে ফেরা পর্যন্ত কেউ তার বাড়িতে প্রবেশ করতে পারত না। একবার দাউদ আ. এর স্ত্রী অন্দর মহল থেকে বের হয়ে দেখেন যে, বাড়ির ভেতরে এক লোক দাড়িয়ে আছে, তখন তিনি বললেন, বাড়িতে কে প্রবেশ করেছে? দরজা বন্ধ থাকা সত্বেও এই লোকটি কিভাবে বাড়িতে প্রবেশ করল? ঠিক এই মুহূর্তে হযরত দাউদ আ. বাড়িতে এলেন। তিনি অবাক হলেন, যে বাড়ির দরজা বন্ধ থাকা সত্বেও কিভাবে একজন পুরুষ লোক বাড়িতে প্রবেশ করল? তখন দাউদ আ. লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? লোকটি বলল আমি এমন একজন লোক, যে কোন রাজা বাদশাহকে ভয় করে না এবং যার ব্যাপারে কোন পর্দার বিধান নেই। একথা শুনে দাউদ আ. বললেন। এবার আমার বোঝার আর বাকি নেই। আল্লাহর কসম, নিশ্চয় আপনি মালাকুল মাউত। আল্লাহর আদেশ পালনে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। তারপর লোকটি কিছুক্ষণ হযরত দাউদ আ. এর নিকট অবস্থান করে তার জান কবজ করে নিয়ে যায়। তার গোসল ও দাফন কাফনের কাজ সম্পন্ন হতে হতে সূর্যের তাপ প্রখর হয়ে উঠল। তাই সুলাইমান আ. পাখ-পাখালিকে বললেন, তোমরা হযরত দাউদ আ. এর কবরকে ছায়া দিয়ে রাখো। তার আদেশে পাখিরা কবরের ওপর ছায়া বিস্তার করল। এক পর্যায়ে দেখা গেল যে পুরা এলাকা ছায়ায় ঢেকে গেছে। পরবর্তীতে তিনি আবার তাদেরকে চলে যেতে বললেন।

তথ্য সূত্র : আয-যুহহাদু মিয়াতুন

লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষক- দারুল কুরআন ইসলামীয়া মাদরাসা, উত্তরখান, ঢাকা।

এক নজরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মৌলিক আকীদাসমূহ

ইমাম ত্বহাবী রহঃ লিখিত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা সম্বলিত বই আকীদাতুত তাহাবী থেকে নেওয়া হয়েছে ।
আমরা আল্লাহ তায়ালার তাওফীককে বিশ্বাস করে তাঁর একত্মবাদের ব্যাপারে বলি:

১.    আল্লাহ এক।

২.    তাঁর কোন শরীক (অংশিদার) নেই।

৩.    কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়।

৪.    তাঁকে অক্ষমকারী কোন জিনিস নেই।

৫.    তিনি ব্যতীত কোন মা‘বুদ নেই।

৬.    তিনি আদি, যার কোন শুরু নেই।

৭.    তিনি অবিনশ্বর, যার কোন অন্ত নেই।

৮.   তাঁর কোন ধ্বংসও নেই এবং ক্ষয়ও নেই।

৯.    তিনি যা ইচ্ছা করেন-তাই হয়।

১০.মানুষের ধারণা আল্লাহ তায়ালা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না।

১১.বোধশক্তি তাঁকে উপলব্ধি করতে পারে না।

১২.সৃষ্টিজীব তাঁর সাদৃশ্যতা অবলম্বন করতে পারে না।

১৩.তিনি চিরস্থায়ী, কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না।

১৪.তিনি চিরঞ্জীব কখনো ঘুমান না।

১৫.তিনি প্রয়োজন ব্যতীত  অর্থাৎ তিনি নিজ প্রয়োজনে মাখলুক সৃষ্টি করেননি।

১৬.তিনি কষ্ট ব্যতিত রিযিকদাতা।

১৭.কোনরূপ ভয় ব্যতিত মৃত্যুদানকারী।

১৮.কোন কষ্ট ছাড়াই পুনরুত্থানকারী।

১৯.তিনি মাখলুক সৃষ্টির পূর্বে স্বীয় গুণাবলীর সাথে অনাদি।

২০.মাখলুককে সৃষ্টির দ্বারা তাঁর এমন কোন গুণ বৃদ্ধি পায়নি, যা তাদের সৃষ্টির পূর্বে ছিল না।

২১.যেমনিভাবে তিনি নিজ গুণাবলী নিয়ে অনাদি, তদ্রƒপ তিনি নিজ গুণাবলীসহ চিরন্তন ও চিরঞ্জীব।

২২.সৃষ্টিজীবকে সৃষ্টি করার পর তিনি খালেক

২৩.প্রতিপালিতদের অবর্তমানেও তিনি প্রতিপালনের গুণে গুণান্বিত। এবং মাখলুকের অবর্তমানেও  হওয়ার  গুণে গুণান্বিত।

২৪.যেমনিভাবে তিনি মৃতদের জীবিত করার পর তাদের জীবন দানকারী, ঠিক তেমনিভাবে তিনি মৃতদের জীবিত করার পূর্বেও এ গুণবাচক নামের (তথা মৃতকে জীবন দানকরা) অধিকারী। এমনিভাবে তিনি সৃষ্টিজীবকে সৃষ্টি করার পূর্বেও খালেক (স্রষ্টা) নামটির অধিকারী ছিলেন।

২৫.তিনি স্বীয় ইলম দ্বারা সৃষ্টিজীবকে সৃষ্টি করেছেন।

২৬.তিনি মাখলুকের জন্য পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন।

২৭.তিনি তাদের জন্য জীবন-মৃত্যুর সময় ধার্য করেছেন। এবং মাখলুককে সৃষ্টি করার পূর্ব থেকেই তাঁর নিকট কোন বিষয় গোপন ও অস্পষ্ট নেই।

২৮.মাখলুককে সৃষ্টি করার পূর্বেই তারা যা করবে- তা তিনি জানেন।

২৯.তিনি মাখলুককে স্বীয় আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাঁর অবাধ্যতা করতে নিষেধ করেছেন।

৩০.সবকিছু তাঁর ক্ষমতায় পরিচালিত হয়।

৩১.তাঁর ইচ্ছায় সবকিছু কার্যকর হয়।

৩২.আল্লাহর চাওয়ার বাইরে বান্দার কোন চাওয়া নেই, সুতরাং তিনি তাদের জন্য যা চান, তাই হয়। আর যা চান না তা হয় না।

৩৩.তিনি নিজ অনুগ্রহে যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দান করেন এবং রক্ষা করেন ও বিপদমুক্ত করেন।

৩৪.তিনি ইনসাফ স্বরূপ যাকে ইচ্ছা তাকে পথভ্রষ্ট করেন এবং তার থেকে সাহায্য উঠিয়ে নেন। এবং তাকে মুসিবতে লিপ্ত করেন।

৩৫.সকলকেই তাঁর ইচ্ছা, অনুগ্রহ ও ইনসাফের মাঝে আবর্তিত।

৩৬.তাঁর ফায়সালাকে প্রত্যাখান করার কেউ নেই।

৩৭.তাঁর হুকুমকে পশ্চাতে নিক্ষেপকারী কেউ নেই।

৩৮.তাঁর নির্দেশের উপর প্রভাব বিস্তারকারী কেউ নেই।

৩৯.তিনি প্রতিপক্ষ ও সমকক্ষ থেকে অনেক উর্ধ্বে।

৪০.নিশ্চয় মুহাম্মাদ সা. তাঁর নির্বাচিত বান্দা।

৪১.তাঁর মনোনিত নবী।

৪২.তাঁর সন্তোষভাজন নবী।

৪৩.তিনি সর্বশেষ নবী।


এটা পড়ুন ঈমাণ ভঙ্গের কারণ সমূহ


৪৪.তিনি (মুহাম্মাদ সা.) মুত্তাকীদের ইমাম।

৪৫.রাসূলকুল শিরোমনি।

৪৬.জগত-সমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালার প্রিয়ভাজন।

৪৭.আর মুহাম্মাদ সা. এর নবুওয়াতের পর প্রত্যেক নবুওয়াতের দাবিই ভ্রষ্টতা ও প্রবৃত্তি প্রসুত।

৪৮.মুহাম্মাদ সা. সত্য ও হেদায়েত নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন সকল জীন এবং সমস্ত মাখলুকের নিকট।

৪৯.কোরআন শরীফ আল্লাহ তায়ালার কালাম তথা কথা।

৫০.কোরআন আল্লাহ তায়ালার থেকে প্রকাশ পেয়েছে-বলার কোন পদ্ধতি ব্যতিরেকে।

৫১.কোরআন শরীফকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীর উপর অবতীর্ণ করেছেন ওহীরূপে।

৫২.কোরআনকে সকল মুমিন সত্য বলে সত্যায়ন করে।

৫৩.সকল মুমিন বিশ্বাস করে যে, “কোরআন” বাস্তবে আল্লাহর কালাম, সৃষ্টিকুলের কথার ন্যায় তা মাখলুক (সৃষ্ট) নয়।

৫৪.যে ব্যক্তি কোরআন শরীফ শ্রবন করে মনে করে যে, এটা মাখলুকের কথা, সে কুফুরী করল।

৫৫.কোরআন শরীফ মানুষের কথার সদৃশ নয়।

৫৬.যে ব্যক্তি মানবীয় কোন গুণের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার গুণ বর্ণনা করবে সে কুফুরী করেছে বলে সাব্যস্ত হবে।

৫৭.জান্নাতবাসীদের জন্য আল্লাহ তায়ালার দর্শন লাভ হবে-এটা সত্য। তবে সে দর্শনের কোন  كيفية(পদ্ধতি) আমাদের জানা নেই। এবং সেই দর্শন হবে পরিবেষ্টন ব্যতিরেকে।

৫৮.আমরা আরও বিশ্বাস করি যে, এই  رؤية(দর্শন) এর ব্যাপারে যে সকল সহীহ হাদীস হুজুর সা. থেকে বর্ণিত আছে সেগুলো তেমনই যেমনটি রাসূল সা. বলেছেন এবং সে সকল সহীহ হাদীসের ব্যাখ্যা উহাই রাসূল সা. এগুলোর দ্বারা যা উদ্দেশ্য নিয়েছেন।

৫৯. رؤيةসম্পর্কিত আয়াত ও হাদীসের মধ্যে আমরা নিজস্ব মত কিংবা ধারণাপ্রসূত কোন তাবীল বা ব্যাখ্যা করি না।

৬০.এবং এই আয়াত ও হাদীসের ব্যাপারে আমরা নিজেদের প্রবৃত্তি প্রসূত কোন কিছু ধারণাও করি না।

৬১.ইসলামের চরণ প্রতিষ্ঠিত থাকে কেবলমাত্র আত্মসমর্পণ ও বশ্যতা স্বীকারের পৃষ্ঠে।

৬২.যে ব্যত্তি নিষিদ্ধ বিষয় সম্পর্কে অবগতি লাভ করতে চায় এবং আত্মসমর্পণের দ্বারা তার বুঝ শক্তি পরিতৃপ্ত হয় না সে নিষ্কলুষ একত্মবাদের বিশ্বাস, নিরংকুশ মারেফাত ও বিশুদ্ধ ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়।

৬৩.আর সে কুফর ও ঈমান, তাসদীক ও তাকজীব, ইকরার ও ইনকারের মাঝে দোদুল্যমান থাকে আর সর্বদা সে সন্দেহ, অস্থিরতা, অভিযোগ ও বক্রতায় লিপ্ত থাকে। ফলে সে  مؤمن مصدق হয় না আবার  كافر جاحدও হয় না।

৬৪.জান্নাতবাসীদের জন্য আল্লাহ তায়ালার দর্শন লাভের উপর ঐ ব্যক্তির ঈমান আনয়ন সহীহ হবে না যে এটাকে কল্পনা দ্বারা অপব্যাখ্যা করে আমরা নিজ বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী এটার (দর্শনের) ব্যাখ্যা করে।

৬৫.যে ব্যক্তি আল্লাহর গুণাবলিকে অস্বীকার এবং মাখলুকের গুণের সাথে তুলনা করা থেকে বিরত থাকতে পারেনি তার পদস্খলন ঘটেছে এবং সে আল্লাহর পবিত্রতা প্রমান করতে পারেনি। কারণ আমাদের সুউচ্চ মহান প্রভু একক গুণে গুণান্বিত, অদ্বিতীয় বিশেষণে বিশেষিত।

৬৬.ভূপৃষ্ঠে কেউ তাঁর গুণে গুণান্বিত নয়।

৬৭.আল্লাহ তায়ালা পরিধি, সীমা-পরিসীমা, অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও উপাদান-উপকরণ থেকে বহু উর্ধ্বে।

৬৮.যাবতীয় উদ্ভাবিত বস্তুর ন্যায় তাকে ষষ্ঠ দিক পরিবেষ্টন করতে পারে না।

৬৯.মেরাজ সত্য। নবী কারীম সা. কে রাতের বেলায় ভ্রমন করানো হয়েছে এবং তাকে জাগ্রতবস্থায় স্বশরীরে নভোম-লে উঠানো হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তার উর্ধ্ব জগতের যেখানে চেয়েছেন সেখানেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাকে যে জিনিস দ্বারা সম্মানিত করতে চেয়েছেন তা দ্বারা তাকে সম্মানিত করেছেন। তিনি যা ওহী করার ইচ্ছা করেছেন তা তার বান্দার নিকট ওহী করেছেন।

৭০. “হাউজে কাওসার” চিরসত্য। যা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে উম্মতের পিপাসা নিবারণার্থে দানস্বরূপ সম্মানিত করেছেন।

৭১.নবী কারীম সা. এর সুপারিশ সত্য। যে সুপারিশ আল্লাহ তায়ালা তাঁর উম্মতের জন্য সংরক্ষিত করে রেখেছেন। যেমনটি হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে।

৭২.আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম আ. ও তাঁর সন্তানদের থেকে রুহজগতে যে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন তা চিরসত্য।

৭৩.আল্লাহ তায়ালা অনাদিকাল হতে পূর্ণরূপেই জানেন যে, কত সংখ্যক লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে আর কত সংখ্যক লোক জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এসংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে না এবং হ্রাস হবে না।

৭৪.অনুরূপ আল্লাহ তায়ালা নিজ বান্দাদের কর্ম সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অবগত।

৭৫.যাকে যে কর্মের জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন তা তাঁর জন্য সহজসাধ্য করা হয়েছে।

৭৬.সকল কর্মের প্রতিদান শেষ অবস্থার উপর নির্ভরশীল।

৭৭.আল্লাহর ফায়সালা দ্বারা যে সৌভাগ্যবান হয়েছে সেই প্রকৃত সৌভাগ্যবান আর যে দুর্ভাগা হয়েছে সেই মূলত হতভাগা।

৭৮.তাকদীর হল মাখলুক সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার একটি গোপন রহস্য। যা নৈকট্যশীল কোন ফেরেশতা এবং নবী-রাসূলও জানেন না।

৭৯.তাকদীর সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করা ব্যর্থতা ও আল্লাহ তায়ালার রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ এবং এটা সীমালঙ্ঘনের মাধ্যম।

৮০.তাকদীরের উদ্দেশ্য তালাশ করতে আল্লাহ তায়ালা নিষেধ করেছেন সুতরাং যদি কেউ বলে তিনি এটা কেন করলেন তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে।

৮১. علم وجود কে অস্বীকার করা কুফুরী এবং  علم مفقودএর দাবী করা কুফুরী। علم وجود  কে গ্রহণ করা এবং  علم مفقودএর অন্বেষণ বর্জন  করা ব্যতিত ঈমান সহীহ হবে না।

৮২.আমরা  لوح محفوظএর প্রতি বিশ্বাস রাখি।

৮৩.আমরা (قلم) কলম এবং কলম যা লিখেছে তার প্রতি বিশ্বাস রাখি।

৮৪.যদি সকল সৃষ্টি জীব সংঘবদ্ধ হয়ে চেষ্টা করে ঐ সকল বিষয় না হওয়ার জন্য যা সংঘটিত হওয়ার কথা আল্লাহ তায়ালা লওহে মাহফুজে লিখে রেখেছেন; তাহলে তারা সক্ষম হবে না। তদ্রƒপ যদি সকল মাখলুক একত্রিত হয়ে ঐ সকল বিষয় সংঘটিত হওয়ার জন্য চেষ্টা চালায়, যা সংঘঠিত হওয়ার কথা আল্লাহ তায়ালা লওহে মাহফুজে লেখেননি, তাহলে এতেও তারা সক্ষম হবে না।

৮৫.কিয়ামত অবধি যা কিছু হবে কলম তা লিখে শুকিয়ে গেছে।

৮৬.বান্দার কাছে যা পৌঁছেনি তা পৌঁছার ছিলো না। আর যা পৌঁছেছে তা পৌঁছারই ছিল।

৮৭.বান্দার উপর এই কথা বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, মাখলুক থেকে যা হবে আল্লাহ তায়ালা তা পূর্ব হতেই জানেন।

৮৮.আল্লাহ যা কিছু নির্ধারণ করেছেন তা নিজ ইচ্ছা থেকে নির্ধারণ করেছেন।

৮৯.আসমান যমিনের কেউ তাঁর ইচ্ছার খ-নকারী নেই।

৯০.এবং তা পশ্চাতে নিক্ষেপকারী ও দূরিভূতকারী কেউ নেই।

৯১.তাঁর পরিবর্তন ও পরিবর্ধনকারী কেউ নেই।

৯২.তাতে কেউ কিছু বৃদ্ধি করতে পারে না এবং কেউ কিছু কমাতেও পারে না।

৯৩.আল্লাহর সৃষ্টি ব্যতিত কোন কিছু সৃষ্ট হয় না।

৯৪.আল্লাহর সকল সৃষ্টি সুন্দর হয়।

৯৫.আরশ,কুরসী সত্য।

৯৬.তিনি আরশ ও অন্যান্য সকল কিছু থেকে অমুখাপেক্ষী।

৯৭.তিনি সকল বিষয়কে পরিবেষ্টনকারী।

৯৮.তিনি সব কিছুর উর্ধ্বে।

৯৯.সৃষ্টিকুল তাঁকে পরিবেষ্টন করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

১০০.আমরা দৃঢ় বিশ্বাস ও সত্যায়ন পূর্বক এবং আনুগত্য করত: এ কথা বলি যে, আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম আ. কে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন আর তিনি মুসা আ. এর সঙ্গে কথা বলেছেন।

১০১.আমরা সকল ফেরেশতা ও নবী-রাসূলের প্রতি অবতীর্ণ সকল ঐশী কিতাবের প্রতি ঈমান রাখি।

১০২.আমরা সাক্ষ্য দেই যে, সকল নবী সুস্পষ্ট সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।

১০৩.আমরা কিবলার অনুসারীদের মুমিন, মুসলমান নামে ভূষিত করি, যতক্ষণ তাঁরা নবী কারীম সা. এর আনীত বিষয়ের উপর বিশ্বাসী থাকবে এবং যা কিছু বলেছেন তা সত্যায়ন করবে।

১০৪.আমরা আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বা নিয়ে অহেতুক গবেষণা করি না।

১০৫.আমরা আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করি না।

১০৬.আমরা কোরআনের ব্যাপারে কোন বিবাদে লিপ্ত হই না।

১০৭.আমরা সাক্ষ্য দেই যে, কোরআন বিশ্ব জাহানের পালনকর্তার কালাম যা নিয়ে জিবরাঈল আ. অবতরণ করেছেন এবং তিনি নবীকুলের সর্দার মুহাম্মাদ সা. কে শিক্ষা দিয়েছেন।

১০৮.মাখলুকের কোন কথা আল্লাহ তায়ালার কালামের সমকক্ষ হতে পারে না।

১০৯.আমরা কোরআনকে মাখলুক (সৃষ্ট) বলি না।

১১০.আমরা কখনো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বিরোধিতা করি না।

১১১.আমরা আহলে কিবলাদের (মুসলমানদের) কাউকে কোন গুনাহের কারণে কাফের বলি না।

১১২.আমরা একথা বলি না যে, ঈমান থাকা অবস্থায় কোন পাপীর পাপ ক্ষতি সাধন করে না।

১১৩.সৎকর্মশীলদের ব্যাপারে আমরা আশা করি যে, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিবেন তবে আমরা তাদের ক্ষমার ব্যাপারে নিশ্চিত নই।

১১৪.আমরা তাদের পাপের ইস্তিগফার (ক্ষমাপ্রার্থনা) করি।

১১৫.আমরা তাদের জন্য জান্নাতের সাক্ষ্য দেই না।

১১৬.আমরা তাদের ব্যাপারে আশংকা বোধ করি তবে নিরাশ হই না।

১১৭.আল্লাহর শাস্তি থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া এবং তাঁর রহমত হতে নিরাশ হয়ে যাওয়া-এ দুটি ইসলাম বহির্ভূত কাজ ও কুফরী, আর কিবলাপন্থি তথা মুসলমানদের জন্য এ দুয়ের মাঝে হচ্ছে হকের পথ।

১১৮.যে সকল বিষয় বিশ্বাস করার দ্বারা বান্দা ঈমানদার বলে সাব্যস্ত হয় তার কোন একটি অস্বীকার করলে সে ঈমান থেকে বের হয়ে যাবে এবং কাফের হয়ে যাবে।

১১৯.আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কোরআন এবং রাসূল সা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসসমূহ সত্য।

১২০.মৌলিক ঈমান এটা এক। আর ঈমানের মৌলিক বিষয়ে মুমিনগণ সবাই সমান। তবে তাদের মাঝে মর্যাদাগত প্রকৃত পার্থক্য হয় তাকওয়া, কুপ্রবৃত্তির বিরোধিতা ও উত্তম বিষয় আকড়ে ধরার কারণে।

১২১.সকল মুমিন আল্লাহর বন্ধু। তবে তাদের মধ্য হতে যে,  تقوى- معرفتএবং  قرانএর সর্বাধিক অনুগত সে তাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তি।

১২২.ঈমান হচ্ছে-আল্লাহ তায়ালা, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাবসমুহ, তাঁর নবী রাসূলগণের প্রতি, পরকাল দিবস, মৃত্যুর পর পুনরুত্থান এবং এর ভালো-মন্দ ও তিক্ত-মিষ্টতার প্রতি বিশ্বাস রাখা।

১২৩.আমরা নবী-রাসূলদের ব্যাপারে ঈমান আনার ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য করি না।

১২৪.মুহাম্মাদ সা. এর উম্মতের মধ্যে যারা ঈমান অবস্থায় কবীরা গুনাহ করবে তাঁরা জাহান্নামে যাবে, তবে চিরকাল থাকবে না। যদিও তাওবা না করে মারা যায়। হ্যাঁ আল্লাহ চাইলে তাদেরকে ক্ষমা করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন। আর যদি এদের শাস্তি দেন তাহলে প্রত্যেকের অপরাধ অনুযায়ী দিবেন। অতঃপর তাঁর অনুগ্রহে এদেরকে জান্নাত দান করবেন। কারণ আল্লাহ তায়ালা সকল মুমিন বান্দাদের অভিভাবক তিনি কাফেরদের মত মুমিনদের সাথে আচরণ করবেন না।

১২৫.আমরা কিবলাপন্থি প্রত্যেক সৎ ও অসৎ ব্যক্তির পেছনে নামায আদায় করাকে বৈধ মনে করি। তাদের জানাজা পড়াকেও বৈধ মনে করি।

১২৬.আমরা কাউকে জান্নাতী বা জাহান্নামী বলি না।

১২৭.আমরা তাদের কারো প্রতি কুফর, শিরক কিংবা নিফাকের সাক্ষ্য দেই না। যাবৎ না তাদের থেকে তা প্রকাশ পায়।

১২৮.আমরা তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়াদী আল্লাহর নিকট ন্যস্ত করি।

১২৯.আমরা উম্মতে মুহাম্মাদী সা. এর কারো প্রতি তরবারী চালানো বৈধ মনে করি না। তবে যার উপর চালানো ওয়াজিব হয়েছে সে ব্যতিত।

১৩০.আমরা আমাদের ইমাম ও শাসকবর্গের আনুগত্য থেকে বের হওয়াকে বৈধ মনে করি না যদিও তারা জালেম হয়ে থাকে।

১৩১.আমরা তাদের জন্য বদ-দোয়া করি না এবং তাদের আনুগত্য পরিত্যাগ করি না।

১৩২.আমরা তাদের আনুগত্যকে আল্লাহর আনুগত্যের ন্যায় ফরজ মনে করি যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আল্লাহর সাথে অবাধ্যতার নির্দেশ না দেন।

১৩৩.আমরা শাসকদের কল্যান ও সুস্থতার দোয়া করি।

১৩৪.আমরা সুন্নাত ও জামাতের অনুসরণ করি। (জামাত হলো রাসূল সা.) এর আনুগত্য ও স্বীয় ধর্মের বিষয়ে সুবোধের অধিকারী সাহাবায়ে কেরাম এবং ঐ সকল ব্যক্তিবর্গ যারা তাঁদের যথাযথ অনুসরণ করবে।

১৩৫.আমরা বিচ্ছিন্নতা, বিরোধিতা ও বিভেদকে পরিত্যাগ করি।

১৩৬.আমরা ন্যায়পরায়ন ও বিশ্বস্ত লোকদেরকে ভালবাসি।

১৩৭.আমরা জালেম ও খেয়ানতকারীদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করি।

১৩৮.যেসব বিষয়ের জ্ঞান আমাদের নিকট অস্পষ্ট সে ক্ষেত্রে আমরা বলি-আল্লাহই ভাল জানেন।

১৩৯.আমরা মুসাফির ও মুক্বিম অবস্থায় মোজার উপর মাসাহ করাকে বৈধ মনে করি।

১৪০.হজ্জ ও জিহাদ উভয়টি পৃথক পৃথক ফরজ। এ দু‘টি কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম শাসকগণের মাধ্যমে অব্যাহত থাকবে, চাই তারা সৎ হোক কিংবা অসৎ।

১৪১.কোন কিছুই এ দুটিকে বাতিল বা রহিত করতে পারবে না।

১৪২.আমরা কিরামান কাতেবীন ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনয়ন করি যে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে আমাদের উপর পর্যবেক্ষক হিসাবে নিয়োজিত রেখেছেন।

১৪৩.আমরা বিশ্ববাসীর রূহ কবজের কাজে নিয়োজিত ফেরেশতার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করি।

১৪৪.আমরা কবরের শাস্তি ও নেয়ামতসমুহ সত্য বলে বিশ্বাস করি এবং তার উপযুক্ত ব্যক্তি তা ভোগ করবে-তাও বিশ্বাস করি।

১৪৫.আমরা বিশ্বাস করি যে, কবরে মুনকার-নাকীর ফেরেশতা মৃত ব্যক্তিকে তার রব (প্রতিপালক) রাসূল ও ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন। যেমনটি হুজুর সা. ও সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে বর্ণিত আছে।

১৪৬.কবর হয়ত জান্নাতের বাগিচাসমূহের মধ্য হতে একটি বাগিচা। অথবা জাহান্নামের গর্তসমূহের মধ্য হতে একটি গর্ত হবে।

১৪৭.আমরা বিশ্বাস করি পুনরুত্থানকে।

১৪৮.কিয়ামত দিবসে আমলসমূহের প্রতিদানকে।

১৪৯.আমলনামা পেশ করাকে।

১৫০.আমলসমূহের হিসাব-নিকাশকে।

১৫১.আমলনামা পাঠ করাকে।

১৫২.উত্তম প্রতিদানকে।

১৫৩.শাস্তিকে।

১৫৪.পুলসিরাতকে।

১৫৫.মিযানকে।

১৫৬.পুনরুত্থান হলো কিয়ামত দিবসে দেহসমূহ একত্রিত করে তা জীবিত করা।

১৫৭.জান্নাত এবং জাহান্নাম এমন দু‘টি সৃষ্টি, যা কখনো ধ্বংস হবে না।

১৫৮.আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টির পূর্বেই জান্নাত জাহান্নাম সৃজন করেছেন। এবং জান্নাত ও জাহান্নামের অধিবাসিদেরকেও সৃষ্টি করেছেন।

১৫৯.মানুষের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি নিজ অনুগ্রহে জান্নাতি বানিয়েছেন।

১৬০.প্রত্যেকেই সেই কাজই করে যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রত্যেকে সেদিকেরই অনুগামী হয় যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।

১৬১.কল্যান ও অকল্যান উভয়টি বান্দার উপর নির্ধারিত।

১৬২.সক্ষমতা দ্ইু প্রকার। যথা:- ১. এমন সক্ষমতা যার সাথে  فعل(ক্রিয়া) পাওয়া যায়। যেমন তাওফিক, যে গুণের অধিকারি কোন মাখলুককে মনে করা জায়েয নেই। আর তা কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে। ২. এ প্রকার সক্ষমতা হলো যেমন সুস্থ থাকা। সাধ্যানুযায়ী হওয়া। সম্ভব হওয়া ও আসবাবপত্র ঠিক থাকা ইত্যাদি যা কর্মের পূর্বে হয়ে থাকে।

১৬৩.বান্দার সকল কাজের ¯্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা। আর বান্দা কাসেব অর্থাৎ উপার্জনকারি।

১৬৪.আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের উপর তাদের সাধ্যের বাইরে কোন কিছু চাপিয়ে দেননি আর বান্দা শুধু ততটুকই করতে পারে যার সক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়েছে। আর এটাই হলো

لا حول ولا قوة إلا بالله এর তাফসির। অতএব আমরা বলি আল্লাহ তায়ালার সাহায্য ছাড়া গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার কোন সাধ্য নেই এবং আল্লাহ তায়ালার তাওফিক ছাড়া তার আনুগত্য করা ও আনুগত্যের উপর অটল থাকা সম্ভব নয়।

১৬৫.প্রত্যেক বস্তু আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা, ইলম ও ফয়সালা অনুযায়ী সংগঠিত হয়। অতএব আল্লাহর ইচ্ছা মাখলুকের সকল ইচ্ছার উপর গালেব (বিজয়ী) থাকবে এবং তার ফয়সালা সমস্ত কৌশলের উপর প্রাধান্য থাকবে।

১৬৬.আল্লাহ তায়ালা যা চান তাই করেন।

১৬৭.তিনি যা করেন তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন না।

১৬৮.সকল সৃষ্টিজীবকে তার কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।

১৬৯.জীবিতদের দু‘আ এবং তাদের দানের মাঝে মৃত ব্যক্তিদের জন্য উপকার রয়েছে।

১৭০.আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের দোয়াসমূহ কবুল করেন।

১৭১.তিনি প্রয়োজনসমূহ পূর্ণ করেন।

১৭২.তিনি সব কিছুর অধিপতি।

১৭৩.তার উপর কারো আধিপত্য নেই।

১৭৪.তিনি কারো উপর জুলুম করেন না।

১৭৫.কেউ এক পলক পরিমাণ সময়ও আল্লাহ তায়ালা থেকে অমুখাপেক্ষী নয়।

১৭৬.যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা থেকে এক মুহূর্ত অমুখাপেক্ষী হবে সে কুফুরী করেছে বলে সাব্যস্ত হবে। এবং ধ্বংসশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

১৭৭.আল্লাহ তায়ালা ক্রোধান্বিত হন এবং সন্তুষ্ট হন। তবে সৃষ্টিজীবের কারো মত নয়।

১৭৮.আমরা রাসূল সা. এর সাহাবাদেরকে ভালবাসি।

১৭৯.আমরা তাদের কাউকে ভালবাসার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করি না।

১৮০.আমরা তাদের কারো থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করি না।

১৮১.তাদের সাথে যারা বিদ্বেষ পোষণ করে আমরাও তাদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করি।

১৮২.যারা অন্যায়ভাবে তাদের সমালোচনা করে তাদের সাথেও আমরা বিদ্বেষ পোষণ করি।

১৮৩.আমরা কেবলমাত্র তাদের সুআলোচনাই করবো।

১৮৪.তাদেরকে ভালবাসা দ্বীন, ঈমান ও ইহসানের বহিঃপ্রকাশ।

১৮৫.তাদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করা কুফুরী নিফাক এবং নাফারমানী এর নামান্তর।

১৮৬.আমরা রাসূল সা. এর পরে সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর রা. এর খেলাফতকে স্বীকার করি। তারপর হযরত উমর রা. এর ফেলাফতকে, তারপর হযরত উসমান রা. এর খেলাফতকে, তারপর হযরত আলী রা. এর খেলাফতকে।

১৮৭.রাসূল সা. যে দশজন সাহাবীর নাম উল্লেখ করে তাদের জান্নাতী হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন আমরা তাদের জন্য জান্নাতের সাক্ষ্য প্রদান করি।

১৮৮.যারা রাসূল সা. এর সাহাবী, পুত-পবিত্রা স্ত্রীগণ এবং তাঁর সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে সুআলোচনা করবে তারা নিফাক থেকে মুক্ত থাকবে।

১৮৯.পূর্ববর্তী সালফে সালেহীন উলামাগণ (তথা সাহাবায়ে কেরাম) তাবেঈন এবং তাদের পরবর্তীদের মধ্য হতে যারা কোরআন, হাদীস ও ফিকহে পারদর্শী এবং গবেষক তাদেরকে সম্মানের সাথে স্মরণ করতে হবে। আর যারা অসম্মানের সাথে তাদেরকে স্মরণ করবে তারা পথভ্রষ্ট।

১৯০.আমরা কোন ওলীকে নবীগণের উপর প্রাধান্য দেই না। বরং আমরা বলি একজন নবী সকল ওলী থেকে শেষ্ঠ।

১৯১.আমরা ঐ সব কারামাত (অলৌকিক ঘটনাকে) বিশ্বস করি যা ওলীদের থেকে প্রকাশ পায় এবং নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর বর্ণনা দ্বারা প্রমানিত।

১৯২.আমরা কিয়ামতের আলামতসমূহের উপর বিশ্বাস রাখি।

১৯৩.কোন জ্যোতিষী, কোন গণক ও এমন কোন ব্যক্তি যে কুরআন, হাদীস ও ইজমায়ে উম্মতের রিরুদ্ধে কথা বলে তাদেরকে আমরা বিশ্বাস করি না।

১৯৪.আমরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতকে সত্য ও সঠিক মনে করি।

১৯৫.আমরা বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারীকে পথভ্রষ্ট ও শাস্তিযোগ্য মনে করি।

১৯৬.আসমান ও যমীনে আল্লাহর ধর্ম একটাই। আর তা হলো ইসলাম ধর্ম।

১৯৭.ইসলাম ধর্ম বাড়া-বাড়ি, ছাড়া-ছাড়ি, তাশবীহ-তা’লীল, জবর-ক্বদর, আশা-নিরাশা এগুলোর মাঝামাঝি একটি ধর্ম।

ইমাম ত্বহাবী রহঃ লিখিত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা সম্বলিত বই আকীদাতুত তাহাবী থেকে নেওয়া হয়েছে ।

ইসলামে শ্রমিকের অধিকার

সমাজে নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষের মধ্যে অনেকে নিজ নিজ পরিমণ্ডলে তাদের প্রকৃত প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। একথা সমাজের সচেতন মহল সকলেই জানেন। তাদের মধ্যে একটি শ্রেণীর নাম শ্রমিক শ্রেণী। তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুগে যুগে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। এমনি এক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকরা জড়ো হয়েছিল। সেখানে শ্রমিকদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। এতে প্রায় ১০-১২ জন্য শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। এরপর ১৮৯৪ সালের মে মাসে মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। শ্রমিকের এ আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যা মে দিবস নামে পরিচিত।
কিন্তু এত আন্দোলন-সংগ্রামের পরও আজও শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এজন্য তাদের এখনও আত্মবলি দিতে হচ্ছে। এর কারণ, তাদের সমস্যা সমাধানের চিন্তা করা হয়েছে স্বার্থান্ধ বিবেকের দৃষ্টিকোণ থেকে। আমরা বিশ্বাস করি যে, ইসলাম মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানবজীবনের অন্য সকল ক্ষেত্রের মতো শ্রমিকের অধিকার বিষয়েও রয়েছে ইসলামের হৃদয় শীতলকরা অনিন্দ্য সুন্দর সমাধান। কেননা, নিপীড়িত মানুষের প্রকৃত বন্ধু আল্লাহ প্রদত্ত দীন তথা ইসলাম। দুনিয়ার আর কোনো মতাদর্শ শ্রমিকদের এর চেয়ে বেশি সম্মান দিতে পারেনি।

ইসলাম এমন এক জীবন বিধান, যা সর্বস্তরের মানুষের সার্বিক শান্তি ও কল্যাণের নিশ্চয়তা দান করে। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ আল্লাহ তাআলার খলীফা। আল্লাহ তাআলা যেমন ন্যায়নিষ্ঠ, তেমনি তাঁর খলীফা তথা মানুষকেও হতে হবে ন্যায়নিষ্ঠ। ইসলাম মানুষের সম্পূর্ণ মনোবৃত্তিরই আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। এটাই ইসলামের প্রধান লক্ষ্য। এখানেই ইসলামের সার্থকতা। ইসলাম মানুষের মন-মানসিকতাকে প্রথম থেকেই এমনভাবে গড়ে তুলতে চায়। যাতে তার মধ্যে পশুসুলভ আচরণ এবং শোষণমূলক চরিত্রের সৃষ্টি না হয়। মানুষ যেন হয় অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও মানবতাবাদী। এ উদ্দেশ্যে ইসলাম বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। নির্ধারণ করে দিয়েছে কিছু নীতিমালা। যাতে এসবের আলোকে একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে ওঠে।


ইসলামে নারীর সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার


 মানুষের মধ্যে সাধারণত জুলুম-অত্যাচার ও শোষণ-পীড়নের মানসিকতা জন্ম নেয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী-স্বার্থ সংরক্ষণের মানসিকতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকে। ইসলাম প্রথমে এ ব্যাধির নিরাময়ের ব্যবস্থা করেছে। ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে সম্পদ উপার্জনের উদ্দেশ্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ-সংরক্ষণ নয়। লক্ষ্য নয় বিলাসভোগও। বরং-
একজন মুমিনের সম্পদ উপার্জনের উদ্দেশ্য হবে, এর দ্বারা তার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে আবর্তিত হুকুম আহকাম পালনে সহায়তা লাভ করা, সমাজের কল্যাণ করা, অসহায়ের সহায়তা করা, সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আখেরাতের কামিয়াবি লাভ করা। দুনিয়ার সম্ভোগ ও বিলাসিতাকে ইসলাম কখনও সমর্থন করেনি। আল্লাহ তাআলা এক আয়াতে বলেন, 

‘যা কিছু আল্লাহ তোমাকে দিয়েছেন, এর মাধ্যমে তুমি পরকালীন আবাস লাভে সচেষ্ট হও।’ [সূরা কাসাস, আয়াত: ৭৭]

মূলত ইসলামের এ বুনিয়াদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই ইসলামী সমাজে জুলুম-অবিচার ও শোষণের কোনো মনোবৃত্তি সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ নেই।
এ ছাড়া ইসলাম জুলুম-অত্যাচার ও শোষণ-পীড়নের ঘৃণ্যতা সম্পর্কে মানুষের মনে এমনি এক অনুভূতি জাগিয়ে তোলে, যার ফলে একজন প্রকৃত মুসলমান এ থেকে ফিরে থাকতে পারে। তার উপর কোন প্রকার চাপ প্রয়োগের প্রয়োজন না পড়ে। এর সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম ভালো কাজে পরস্পরের সহযোগিতা করতে এবং গুনাহ ও অন্যায় কাজে সহযোগিতা না করতে নির্দেশ দিয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার কাজে পরস্পর সাহায্য করবে, এবং পাপ ও সীমালংঘনের কাজে একে অন্যের সাহায্য করবে না। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর। [সূরা মায়িদা, আয়াত: ২]
অপর এক আয়াতে এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎকার্য ও সীমালংঘন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর। [সূরা নাহল, আয়াত: ৯০]
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুলুমের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, তোমরা জুলুম-অত্যাচার থেকে বেঁচে থাক, তা কেয়ামতের দিন বিপুল অন্ধকারের কারণ হবে। [সহীহ বুখারী, হাদীস: ২৪৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস, ২৫৭৮, ২৫৭৯; সুনানে তিরমিযী, হাদীস: ২০৩০]
অর্থাৎ, অন্ধকারে মানুষ যেমন দিশেহারা হয়ে যায়, কাউকে সাহায্যকারী পায় না, তেমনি জালিমও কেয়ামতের দিন অসহায় হয়ে পড়বে।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে কুফরকে পর্যন্ত সহ্য করেন, কিন্তু জুলুম ও অত্যাচারকে কখনও সহ্য করে না। জুলুমের শাস্তি অনেক সময় আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতেই দিয়ে দেন। কখনও জুলুমের শাস্তি হতে দেরি দেখে মানুষ মনে করে হয়ত জালেম পার পেয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যেদিন পাকড়াও করেন, সেদিন তার আর আত্মরক্ষার কোন পথ খোলা থাকে না।
এ হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা কখনও জালিমকে কিছু সময়ের জন্য ছাড় দিয়ে রাখেন, কিন্তু যখন তাকে ধরেন তখন তাকে আর ছাড়েন না। এরপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দলিল স্বরূপ কুরআন পাকের একটি আয়াত তেলাওয়াত করেন, যার তরজমা এই, আর এমনি তোমার প্রতিপালকের ধরা (অর্থাৎ, ধ্বংস না করে নিষ্কৃতি দেন না)। যখন তিনি পাকড়াও করেন জনপদ সমূহকে, যখন সেই সব জনপদের অধিবাসীরা জুলুম করে। নিশ্চয় তাঁর ধরা অতিবেদনাদায়ক, কঠোর। [সূরা হুদ, আয়াত: ১০২] [সহীহ বুখারী, হাদীস: ৪৬৮৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস; ২৫৮৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ৪০১৭, ৪০১৮; সুনানে তিরমিযী, হাদীস: ৩১১০]
জুলুম-অত্যাচারের পরিণতিতে আল্লাহ তাআলার যে আযাব নেমে আসে তা এতই ভয়াবহ যে, সাধারণ জীব-জন্তুও তা থেকে রক্ষা পায় না। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রা. একবার এক লোককে বলতে শুনলেন যে, জালিম কেবল নিজেরই অশুভ পরিণতি ডেকে আনে; অন্য কারও নয়। তখন তিনি বলে উঠলেন, না, না, বরং জালিমের জুলুমের পরিণামে হুবারা পাখিও দুর্বল হয়ে তার বাসায় মরে পড়ে থাকে। [বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, ৯ খ. পৃ. ৫৪৪, হাদীস, ৭০৭৫]
ইসলাম শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে এবং তাদের অধিকার পূরণে অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। এ সম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এরা (অর্থাৎ, চাকর-বাকর, কর্মচারী, ক্রীতদাস ইত্যাদি) তোমাদের ভাই, তোমাদের খেদমতগার। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং যার ভাই তার অধীন রয়েছে, তাকে যা সে নিজে খায় তা থেকে খেতে দেবে। যা সে নিজে পরে, তাই তাকে পরাবে। তাদের উপর এমন কাজ চাপিয়ে দেবে না, যা তাদের পক্ষে পালন করা অধিক কষ্টকর। আর যদি তাদের উপর অধিক কষ্টকর কোনো কাজ চাপিয়ে দিয়ে থাক, তবে তাদেরকে সাহায্য কর। [সহীহ বুখারী, হাদীস: ৩০, ২৫৪৫, ৬০৫০; সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১৬৬১]
আল্লামা মানাযির আহসান গীলানী রহ. উল্লিখিত হাদীসটির ব্যাখ্যা দান করতে গিয়ে বলেন, এ হাদীস থেকে আমরা কয়েকটি বিষয় আমরা জানতে পারি।
  1. যারা নিজেদের কাজে শ্রমিক নিয়োগ করে তাদের উচিত শ্রমিকদেরকে নিজেদের ভাইয়ের মতো মনে করা এবং উভয় পক্ষের মধ্যে এরূপ সম্পর্ক থাকা, যা দুই ভাইয়ের মধ্যে থাকে।
  2. অন্তত থাকা-খাওয়ার ব্যাপার তাদের পরস্পরের মধ্যে যেন অর্থনৈতিক সমতা বিদ্যমান থাকে। যা নিজে খাবে তা শ্রমিককে খাওয়াবে। যা নিজে পরবে, তা মজদুরকে পরতে দেবে। এ থেকে অনুমিত হয় যে, শ্রমনীতির ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হল, শ্রমিককে অন্তত এ পরিমান মজুরি দেওযা উচিত, যার দ্বারা খাওয়া-পরার বিষয়ে তারা মালিক পক্ষের সমপর্যায়ে আসতে পারে। বর্তমানে যদি শ্রমিকদের মজুরি এ পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়, তবে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত অতি সহজে দূর করা সম্ভব।
  3. সময় ও কাজের ধরন উভয় দিক থেকে শ্রমিকের উপর এ পরিমাণ বোঝা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না, যা তাদেরকে পর্যুদস্ত এবং কাবু করে ফেলে। উপর্যুক্ত হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বলেছেন, তাদের উপর এমন কাজ চাপিয়ে দেবে না, যা তাদের পক্ষে পালন করা অধিক কষ্টকর। এ কথাটির উপর ভিত্তি করে বর্তমান শ্রমিকদের কাজের সময় ও কাজের ধরন সম্পর্কিত জটিলতা অতি সহজে দূরীভূত করা যায়।
  4. এমন কোনো কাজ যদি এসে যায়, যা আঞ্জাম দেওয়া শ্রমিকদের পক্ষে অধিক কষ্টকর হয়, তবে সে কাজ বন্ধ করে দিতে হবে এমন নয়। অথবা শ্রমিকদের প্রতি লক্ষ না করে তাদের দ্বারা এ কঠিন কাজ করিয়ে নিতে হবে এমনও নয়; বরং এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিয়োগদানকারী কর্তৃপক্ষ বা মালিক পক্ষ আরও বেশি শ্রমশক্তি নিয়োগ করে তাদের কাজকে হালকা করে দিতে সাহায্য করবে। হাদীসে তবে ‘তাদেরকে সাহায্য কর’ বলে এ কথাই বোঝানো হয়েছে। এর মানে এ নয় যে, মালিক নিজেই সে কাজে লেগে যাবে বা লেগে যেতে হবে। বরং উদ্দেশ্য হল, আরও বেশি শ্রমশক্তি নিয়োগ করে তাদের সাহায্য করবে।
আমি মনে করি, শ্রমিক পক্ষ ও মালিক পক্ষের মধ্যে বর্তমান কালে যে সব দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেয়, সে সবের সুষ্ঠু সমাধান উক্ত হাদীস শরীফের আলোকে পেশ করা সম্ভব। এ কেবল কথার ফুলঝুরি নয়, বরং হাদীস শরীফের এ নির্দেশনার বাস্তবচিত্রের একটি তালিকা পেশ করা যাবে, যাতে দেখা যাবে যে, সাহাবায়ে কেরাম তা বাস্তবায়ন করিয়ে দেখিয়েছেন। উপর্যুক্ত হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত আবু যর গিফারী রা.-এরই জীবনের বাস্তব অবস্থা ছিল এরকমই। এমনিভাবে হযরত উমর রা. এর বায়তুল মুকাদ্দাস সফরের কাহিনী, যেখানে অর্ধেক পথে তিনি উটের পিঠে আরোহণ করেছেন, আর অর্ধেক পথে গোলামকে উটের পিঠে চড়িয়েছেন। (ইসলামী মাআশিরাত, পৃ. ৩৬৩-৩৬৪)
অপর একটি হাদীসে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি কেয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোকের বিপক্ষ হব, (অর্থাৎ, তাদের কৃতকর্মের জবাব চাইব)। এক. যে ব্যক্তি আমার নামে কসম করে কাউকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এরপর তা ভঙ্গ করেছে। দুই. যে ব্যক্তি কোনো মুক্ত-স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার অর্থ খেয়ে ফেলেছে। তিন. যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে কাজে খাটিয়ে তার থেকে পূর্ণ কাজ আদায় করে নিয়েছে, কিন্তু তাকে তার পারিশ্রমিক দেয়নি। [সহীহ বুখারী, হাদীস: ২২২৭, ২২৭০; মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ৮৬৭৭, ৮৬৯২]
রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, তোমরা শ্রমিকদের গায়ের ঘাম শোকাবার পূর্বে তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও। [সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস: ২৪৪৩/ ২৪৪৪; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস: ৬৬৮২; তাবারানী, আল-মুজামুস সগীর, হাদীস: ৩৪]
আর একটি হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা শ্রমিককে তার শ্রমোৎপন্ন দ্রব্য হতে কিছু দান কর। কেননা, আল্লাহর শ্রমিক বঞ্চিত করা যায় না। [মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ৮৬০৪/৮৬০৫]
এ হাদীসটিতে কয়েকটি বিষয় আমরা দেখতে পাই,
এক. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে শ্রমিককে মর্যাদা দিয়েছেন যে, তাকে তিনি আল্লাহর শ্রমিক বলে অভিহিত করেছেন। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, শ্রমিক শ্রম গ্রহণকারীর গোলাম নয়।
দুই. শ্রমিককে লাভের অংশ না দেওয়াকে “বঞ্চিত করা” বলে উল্লেখ করেছেন। এতে বোঝা যায় যে, লভ্যাংশে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এটি শ্রমিকের প্রতি শ্রম গ্রহণকারীর কোনো অনুগ্রহ নয়। কেননা, অনুগ্রহ করা থেকে বিরত থাকলে তাকে ‘বঞ্চিত করা’ বলা যায় না।
এ বিষয়টি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপর একটি হাদীসে আরও স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, তোমাদের কারও খাদেম যদি খাবার প্রস্তুত করে নিয়ে আসে তবে তাকে নিজের সঙ্গে খাবারে শরিক করে নিও। কারণ, সে তোমার জন্যই আগুন ও ধোঁয়ার জ্বালা সহ্য করেছে। যদি খাবারের অনুপাতে বেশি লোক থাকে, তবে খাদেমের হাতে সামান্য কিছু তথা এক দুই লোকমা হলেও তুলে দেবে। [সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১৬৬৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস: ৩৮৪৬; মুসনাদে আহমদ, হাদীস; ৭৭১২, ৭৭২৭]
শ্রমিকের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কত বেশি লক্ষ্য ছিল, তার অনুমান এ হাদীস থেকে করা যেতে পারে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পূর্বমুহূর্তে দুনিয়াবাসীকে যে সর্বশেষ উপদেশ দিয়েছিলেন, তা ছিল, নামাযের প্রতি এবং যারা তোমাদের অধীন রয়েছে তাদের ন্যায্য অধিকারের প্রতি তোমরা যত্নশীল থেকো। [সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস: ১৬২৫, ২৬৯৭, ২৬৯৮; মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ৫৮৬, ১২১৬৯, ২৬৪৮৩]
কখনও শ্রমিকদের থেকে ভুল বা অন্যায়-অপরাধ হয়ে যেতে পারে, যার কারণে মালিক পক্ষ ক্ষুব্ধ হতে পারে। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে শান্ত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রতিশোধ নিতে পারার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নিজের ক্রোধকে দমন করতে পারে, আল্লাহ তাআলা তার মন প্রশান্তি ও ঈমানের দ্বারা পূর্ণ করে দেবেন। [মুসনাদুশ শিহাব, হাদীস: ৪৩৭]
এক হাদীসে এসেছে যে, এক সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার কর্মচারীকে কতবার ক্ষমা করব? প্রশ্ন শুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীরব রইলেন। লোকটি আবারও একই প্রশ্ন করলে তখন তিনি বললেন, প্রতিদিন সত্তর বার। [সুনানে তিরমিযী হাদীস: ১৯৪৯]
তাই ফিকহবিদগণ বলেছেন, শ্রমিক যদি ইচ্ছাকৃত সম্পদের ক্ষতিসাধন না করে তবে অনিচ্ছাকৃত ভুলের কারণে যে ক্ষতি হয় তার জন্য শ্রমিকের নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ নেওয়া যাবে না।
লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামেয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা। গ্রন্থ প্রণেতা, অনুবাদক ও গবেষক

পরকাল ভাবনা

মাওলানা আহমদ মায়মূন: আল্লাহ তাআরা তওবাকারীকে পছন্দ করেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদেরকে ভালোবাসেন, আর ভালোবাসেন পরিচ্ছন্নতা অবলম্বনকারী লোকদেরকে। [সূরা বাকারা : আয়াত ২২২]

যখন কারও অন্তরে পরকালের ভয় জাগ্রত হয় তখন সে বাহ্যিকভাবে এবং মানসিকভাবে আল্লাহ তাআলার অনুগত হওয়ার চেষ্টা করে। এ জন্য সে নিজের জীবনে কৃত অন্যায় অপরাধ ও ভুলত্রুটির জন্য অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। কখনও যদি তার কাছ থেকে অনিচ্ছাকৃত পাপকার্য সংঘটিত হয় তখনই সে আল্লাহ তাআলার সমীপে কান্নাকাটি করে এবং কাকুতি-মিনতি করে তা মার্জনা করিয়ে নিতে চেষ্টা করে। অন্যথা সে স্বস্তিবোধ করে না।
সে নিজের অতীত অন্যায়-অপরাধের জন্য যেমন লজ্জিত হয়, তেমনি ভবিষ্যতে এরূপ কাজ না করার জন্য দৃঢ় সংকল্প করে। এরপরও যদি মানবীয় দুর্বলতার কারণে পুনরায় তদ্রুপ অপরাধ করে বসে, তবে সে পুনরায় তওবা করতে বিলম্ব করে না।
এরূপ ব্যক্তি যেমন নিজের আত্মাকে পাপাচারের অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করে, তেমনি তার শরীর আর লেবাস-পোশাককেও সে বাহ্যিক অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে। এ জন্য আল্লাহ তাআলা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অবলম্বনকারী এবং অপবিত্রতা থেকে আত্মরক্ষাকারীদেরকে ভালোবাসেন বলে পবিত্র কুরআন কারীমে উল্লেখ করেছেন।

আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের ক্ষেত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাই যারা পরকালের চিন্তা মাথায় রাখে তারা পাপ-পঙ্কিলতা থেকে আত্মিক পরিচ্ছন্নতা অর্জনের পাশাপাশি শরীর এবং লেবাস-পোশাকের বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতার প্রতিও পুরোপুরি যত্নশীল থাকে।

এরূপ ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হয়। তখন সেই বান্দার কোন কাজে কেউ বিঘ্ন সৃষ্টি করুক অথবা কেউ তার কোনরূপ ক্ষতি করার চেষ্টা করুক, তা আল্লাহ তাআলা বরদাশত করেন না। আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মান দান করেন, মানুষের অন্তর থেকে তার ভুল-ত্রুটির কথা ভুলিয়ে দেন। তাকে গাম্ভীর্যের আবরণে আবৃত করে দেন। কারণ, সেই বান্দা নিজের অন্তরে আল্লাহ তাআলার মাহাত্ম ও পরকালের ভয়কে স্থান দিয়েছে। এরূপ ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা মানুষের মধ্যে সশ্রদ্ধ মর্যাদার আসন দান করেন। তখন তার চেহারায় তাকওয়া ও আল্লাহ-ভীতির ছাপ পরিলক্ষিত হয়।

দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন। এক হাদীসে রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তুমি দুনিয়ার বিষয়ে নির্মোহ হও, আল্লাহ তাআলা তোমাকে ভালোবাসবেন। মানুষের সম্পদের ব্যাপারে নির্মোহ হও, মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে। [সুনানে ইবনে মাজা : হাদীস নং ৪১০২]

যার অন্তরে যত বেশি পরকালের ভয় থাকবে সে ততবেশি দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ থাকবে। অপ্রয়োজনীয় জিনিস বৈধ হওয়া সত্ত্বেও পরিত্যাগ করবে এবং সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু পেয়েই সন্তুষ্ট থাকবে।

দুনিয়ার প্রতি নির্মোহতার মূল কথা হল, দুনিয়া অর্জন করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বে স্বেচ্ছায় তা পরিত্যাগ করে আখেরাতমুখী হওয়া। এর ফলে বান্দার অন্তরাত্মা আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং পরকালের সঠিক মূল্যায়ন তার অন্তরে স্থান করে নেয়। দুনিয়া সম্পূর্ণ বিরসভাবে তার সামনে উদ্ভাসিত হয়। এরপর সে নিজেকে দুনিয়ার একজন মুসাফিরের মতো মনে করে এবং পথিকের মতো সামান্য পাথেয় পেয়েই সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত থাকে। এর ফলে মানুষ দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে। সে দুনিয়ার কেবল এতটুকুই গ্রহণ করে, যার দ্বারা তার পরকালমুখী সফর সহজে সম্পন্ন হয়ে যায়।

দুনিয়ার প্রতি নির্মোহতার প্রথম স্তর হচ্ছে, মানুষের মন দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট থাকে, কিন্তু মানুষ সংযম ও সাধনার মাধ্যমে মনকে দুনিয়া থেকে ফিরিয়ে পরকালমুখী করে দেয়। এ স্তরে মানুষ নিজেকে নির্মোহরূপে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে।


সফলতার চার ধাপ – সূরা আল-‘আসর এর আলোকে


নির্মোহতার দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে, মানুষের মন দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্টই হয় না। কেননা, তার সম্মুখে এ বিষয়টি সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকে যে, দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ ও আনন্দ এবং ভোগ-বিলাস একত্র হয় না। তাই সে স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্টচিত্তে নিজের দুনিয়ার মূল্যবান ভোগ-বিলাসের সামগ্রীকে পরকালের চিরস্থায়ী সুখ সামগ্রীর মোকাবিলায় তুচ্ছ মনে করে দূরে ঠেলে দেয়। এটাই মূলত প্রকৃত নির্মোহতা।

নির্মোহতার তৃতীয় স্তর হচ্ছে, দুনিয়ার প্রতি বান্দার অনুরাগ বা বিরাগ কোনোটাই থাকে না; বরং দুনিয়ার সহায়-সম্পদ থাকা, না থাকা উভয়টি তার কাছে সমান। সে দুনিয়া এবং দুনিয়ার যাবতীয় ভোগসামগ্রীকে এক ফোটা পানির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় না এবং আল্লাহর কাছে থাকে পরকালের ভা-ারকে অফুরন্ত এবং অকুল সমুদ্রের মতো মনে করে। এটা নির্মোহতার সর্বোৎকৃষ্ট স্তর। আর তা এ জন্য যে, কোনো কিছুর প্রতি বিরাগ প্রকাশের জন্যও তার প্রতি মনোনিবেশের সময় লাগে। অথচ সে দুনিয়ার প্রতি মনোনিবেশের জন্য কোনো সময় ব্যয় করতে প্রস্তুত নয়। তার অবস্থা এ পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায় যে, দুনিয়ার প্রতি তার ধ্যানই থাকে না। সুতরাং দুনিয়ার ভোগসামগ্রী থাকা না তার কাছে সমান।

আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমের বিভিন্ন জায়গায় দুনিয়ার ভোগসামগ্রীর প্রকৃত স্বরূপ সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। এবং এ সবের তুচ্ছতা ও অসারতা ব্যক্ত করেছেন। কুরআন কারীমের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছে দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে পরকালের প্রতি অভিমুখী হওয়ার আহ্বান। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এ পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত আর কিছুই নয়। আর পারলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত।’ [সূরা আনকাবুত : আয়াত ৬৪]

উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা পরকালের জীবনকেই প্রকৃত জীবন বলে উল্লেখ করেছেন এবং দুনিয়ার জীবনের অসারতা ব্যক্ত করেছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি দুনিয়ার সম্পদ আল্লাহ তাআলার কাছে মশার ডানার সমান গুরুত্ব রাখত তবে আল্লাহ তাআলা তার থেকে এক ঢোক পানি কোন কাফেরকে পান করতে দিতেন না। [সুনানে তিরমিযী : হাদীস নং ২৩২০; সুনানে ইবনে মাজা : হাদীস নং ৪১১০]

দুনিয়ার মূল্য যেহেতু আল্লাহ তাআলার কাছে এতই তুচ্ছ, তাই আল্লাহ তাআলা কাফেরদেরকে অঢেল সম্পদ দিয়ে ভাসিয়ে দেন এবং তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য সবসময় দুনিয়াকে সঙ্কুচিত করে রাখেন। এজন্য হাদীস শরীফে কোথাও দুনিয়াতে মুসাফিরের মতো, আবার কোথাও মৃতদের মতো জীবন অতিবাহিত করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। কেননা, এ দুনিয়া অবস্থানের উপযুক্ত নয় এবং অবস্থানের কোনো জায়গা নয়।
কোথাও এভাবে বলা হয়েছে, পরকালের তুলনায় এ দুনিয়ার মূল্য এতটুকুও নয়, যেমন সমুদ্রের তুলনায় এক ফোটা পানি। এ দুনিয়ার জীবন অতি সংক্ষিপ্ত ও ক্ষণস্থায়ী। [সুনানে তিরমিযী : হাদীস নং ২৪৯৫; সুনানে ইবনে মাজা : হাদীস নং ৪২৫৭]

এক হাদীসে রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তুমি দুনিয়াতে এভাবে জীবন যাপন কর, যেন একজন প্রবাসী অথবা একজন পথিক। [সহীহ বুখারী : হাদীস নং ৬৪১৬; মুসনাদে আহমদ : হাদীস নং ৩৭১০, ৪৭৬৪, ৪৭৬৫]
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক হাদীসে নিজের অন্তরের অবস্থা এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, যদি উহুদ পর্বতের সমান সোনা আমার নিকট থাকত, তবে তা থেকে ঋণ পরিশোধের জন্য যদি কিছু রাখার প্রয়োজন হয় তা ব্যতীত তার কিছু অংশ আমার নিকট থাকা অবস্থায় তিনটি দিন অতিবাহিত হোক, তা আমার পছন্দ নয়। [সহীহ বুখারী : হাদীস নং ২৩৮৯, ৬৪৪৪, ৬৪৪৫; মুসনাদে আহমদ : হাদীস নং ৯৮৯৩, ২১৪২৬, ২১৫৩২]

বাস্তবেই দুনিয়ার সকল মানুষের মধ্যে দুনিয়ার প্রতি সর্বাধিক নির্মোহ মানুষ ছিলেন রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাই তিনি বলতেন, দুনিয়ার সাথে আমার কী সম্পর্ক! আমার আর দুনিয়ার উদাহরণ এরকম, যেমন কোনো আরোহী পথিক কোনো গাছের ছায়ায় সামান্য সময় বিশ্রামের জন্য দাঁড়ায়, তারপর সে উক্ত স্থানটি ত্যাগ করে সামনে এগিয়ে যায়। [মুসনাদে আহমদ : হাদীস নং ৩৭০৮, ৪২০৯; সুনানে তিরমিযী : হাদীস নং ২৩৭৭]
অর্থাৎ, দুনিয়া কেবল এতটুকুই সময়ের ঠিকানা এবং কেবল এটুকু সময়ই দুনিয়ায় অবস্থান করতে হবে। পরকালের অনন্ত জীবনের তুলনায় দুনিয়ার জীবনকাল এতই সামান্য। এক হাদীসে বলা হয়েছে যে, রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দুনিয়া ছেড়ে যান, তখন তাঁর বাহন জন্তু একটি সাদা খচ্চর, তাঁর হাতিয়ার এবং এক খ- জমি, যা তিনি ছিন্নমূল লোকদের জন্য দান করে যান, এছাড়া তিনি কোন দীনার-দেরহাম বা কোনো দাস-দাসী রেখে যাননি। [সহীহ বুখারী : হাদীস নং ৪৪৬১]

এটাই প্রকৃত ঈমানের দাবি যে, একজন ঈমানদার মানুষ দুনিয়ার তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দেবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির সামনে নিজেকে বিলীন করে দেবে। যেমনটি করেছেন সাহাবায়ে কেরাম রা.। তাঁরা অন্তর থেকে দুনিয়ার মোহকে এভাবে দূরে নিক্ষেপ করেছেন এবং দুনিয়া থেকে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন যে, মৃত্যু পর্যন্ত আর সেদিকে ফিরে তাকাননি।
দুনিয়ার উদাহরণ হল গ্রীষ্মকালীন মেঘের মতো। আকাশের একদিকে ছেয়ে যায়, আর অপর দিক পরিষ্কার হয়ে যায়। দুনিয়া কখন আসে, আর কখন চলে যায়, তা অনেক সময় বুঝেও ওঠা যায় না। দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী ভোগসামগ্রীকে জীবনের সহায়-সম্পদ রূপে গ্রহণ করা অবশ্যই ঈমান ও বুদ্ধিমত্তার দুর্বলতার কারনেই হয়ে থাকে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুনিয়াকে মু’মিনের জন্য বন্দীশালা এবং কাফেরের জন্য স্বর্গস্থান বলে উল্লেখ করেছেন। [সহীহ মুসলিম : হাদীস নং ২৯৫৬]

বন্দীদের জন্য যেমন নানা রকম বিধি-নিষেধের বাধ্য-বাধকতা থাকে, তেমনি মু’মিন বান্দার জন্যও শরীয়াতের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয় বিষয়াদি থেকে দূরে থাকার বিধি-নিষেধের বাধ্য-বাধকতা আছে। বন্দী যেমন বন্দীত্ব থেকে মুক্তি লাভের পর নিজের মন মতো আরাম-আয়েশ ভোগ করার সুযোগ পায়, তেমনি একজন মু’মিনও মৃত্যুর মাধ্যমে এ দুনিয়ার বন্দীদশা থেকে মুক্তি লাভের পরই তার মন মতো সুখের জীবন উপভোগ করার সুযোগ লাভ করে। আল্লাহ তাআলা এ দুনিয়াকে স্থায়ী সম্মানের জন্য বানাননি, কাজেই এ দুনিয়াকে অবলম্বন করে কেউ স্থায়ী সম্মান লাভের আশা করতে পারে না।

যার অন্তরে দুনিয়ার প্রতি নির্মোহতা সৃষ্টি হয় তার সামনে দুনিয়ার প্রকৃত অসারতা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। দুনিয়ার প্রতি নির্মোহ ব্যক্তি তাকে বলা যাবে, যে দুনিয়ার নশ্বরতা, ভঙ্গুরতা, অসারতা, দুর্বলতা অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা উপলব্ধি করতে পারে। এ কজন নির্মোহ ব্যক্তির চোখের সামনে পরকারের জীবন উপস্থিত থাকে। দুনিয়া ছেড়ে তাকে পরপারে পাড়ি জমাতে হবে, এ অনুভূতি প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে তার অন্তরে জাগ্রত থাকে। সে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন আর পরকালের অনন্ত জীবনের ফারাক বুঝতে পারে। যেখানে অধিক সংখ্যক মানুষ পরকালের প্রাপ্য বাকি সুখ-ভোগের আশায় দুনিয়ার নগদ প্রাপ্তি এবং উপস্থিত ভোগ-বিলাস ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, সেখানে যাকে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী আনন্দ-উপেক্ষা করে পরকালের অনন্তকালীন সুখ-শান্তিকে অগ্রাধিকার দিতে পারে। সুতরাং আল্লাহ তাআলার প্রতি যার ভালোবাসা নিখাদ, সে দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের প্রতি মোহগ্রস্ত ও বুঁদ হয়ে থাকতে পারে না।
সে দুনিয়াকে কখনও অবস্থানের একমাত্র জায়গা মনে করে না, দুনিয়ার জীবনকে সে কখনও দীর্ঘ মনে করে না। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে পরকাল অভিমুখী হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামেয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা। গ্রন্থ প্রণেতা, অনুবাদক ও গবেষক

মুফতী আমিনী রাহ. : সংগ্রামী এক আলেমের জীবন

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদঃ  তিনি হঠাৎ করে চলে গেলেন। সবাইকে হতবুদ্ধি, নির্বাক ও শোকবিদ্ধ করে চলে গেলেন। ঘরবাড়ি-ময়দান শূন্য করেই চলে গেলেন। ঝড়ের রাতে জাহাজ থেকে নাবিক নেমে গেলে যেমন হয়, গহীন অরণ্যে কাফেলার রাহবার নিখোঁজ হয়ে গেলে যেমন হয়—দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ ও আলেম সমাজের অবস্থা তার চলে যাওয়ায় তেমনই হয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন মুফতী ফজলুল হক আমিনী।

জাতীয় ঈদগাহে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে তার নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় বুধবার বিকাল সাড়ে তিনটায়। ওইদিন আসরের পর লালবাগ শাহী মসজিদের সামনের সংরক্ষিত করবস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

এক নজরে তার জীবনের দিকে তাকালে আমরা দেখব, তিনি ১৯৪৫ সালের ১৫ই নভেম্বর বি-বাড়ীয়া জেলার আমীনপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ও দ্বীনদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বি, বাড়ীয়া জামেয়া ইউনুসিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি মুন্সিগঞ্জ জেলাধীন বিক্রমপুরের মোস্তফাগঞ্জ মাদরাসায় তিন বছর পড়াশুনা করেন। তারপর ১৯৬১ সালে রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসায় চলে আসেন। এখানে তিনি হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রাহ. ও হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ., কিংবদন্তী মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ রাহ., শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হক রাহ., আরেফ বিল্লাহ মাওলানা সালাহ উদ্দীন রাহ. এবং হযরত মাওলানা আব্দুল মজীদ ঢাকুবী রহ. -এর বিশেষ তত্ত্বাবধানে দাওরায়ে হাদীসের সনদ লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী [রহঃ]-এর কাছে হাদীস পড়ার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান করাচী নিউ টাউন মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি উলুমুল হাদীসের উপর পাঠ গ্রহণ করে দেশে ফিরে আসেন।

কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে। প্রথমে মাদরাসা-ই- নূরিয়া কামরাঙ্গীরচরে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ওই বছরই তিনি হজরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর কন্যার সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭২ সালে মাত্র নয় মাসে তিনি কুরআন শরীফ হেফয করেন। এ সময় তিনি ঢাকার আলু বাজারে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। একই সাথে আলু বাজার মসজিদের খতীবের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৭৫ সালে তিনি জামেয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসার শিক্ষক ও সহকারী মুফতী নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি  লালবাগ জামেয়ার ভাইস প্রিন্সিপাল ও প্রধান মুফতীর দয়িত্ব পান। ১৯৮৭ সালে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর ইন্তেকালের পর থেকে তিনি লালবাগ জামেয়ার প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালে পান বড়কাটারা হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও মুতাওয়াল্লির দায়িত্ব। ইন্তেকালের আগ পর্যন্তই এই দুইটি মাদরাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পাশাপাশি ঢাকার কাকরাইল, দাউদকান্দির গৌরীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু মাদরাসার প্রধান অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

মুফতী আমিনী রাহ.-এর বিশেষত্ব কী ছিল? তিনি একজন প্রজ্ঞাবান বড় আলেম ছিলেন। ঐতিহ্যবাহী দুটি বড় মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদীস ছিলেন। ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান হিসেবে সরব একজন ইসলামী রাজনীতিক ছিলেন। তার পরিচয় এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। গত দুই যুগ ধরে তিনি ছিলেন এদেশের ধর্মপ্রাণ-দেশপ্রেমিক মানুষ ও সর্বস্তরের আলেম সমাজের একজন প্রধান প্রতিনিধি। তিনি তাদের ভাই ছিলেন। তিনি তাদের দুঃখ ও দ্রোহের কণ্ঠ ছিলেন। তিনি তাদেরবন্ধু, নেতা ও অভিভাবক ছিলেন। সঙ্কটকালে তার গমগমা কণ্ঠ আর হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন তারা। আহা! এত সুন্দর করে জনসভা ও মাহফিলগুলোতে ইসলামের অতীত গৌরব, বীরত্ব, আশাব্যঞ্জকতা, উদ্দীপনা, আল্লাহনির্ভরতা আর সাহসের পঙক্তিমালা তিনি উচ্চারণ করতেন যে মুহূর্তের মধ্যেই লাখো মানুষের ছায়াচ্ছন্ন, চিন্তাক্লিষ্ট চেহারায় প্রত্যয় ও আশ্বাসের রোদ হেসে উঠত। তিনি তার বক্তব্যে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা পেশ করতেন। তিনি বীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, গাজী নুরুদ্দীন জঙ্গি রাহ.-এর অমিত সাহসের ইতিহাস উচ্চারণ করতেন। শাহ ওয়ালি উল্লাহ, সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ, কাসেম নানুতুবী ও শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান রাহ.-এর জীবনব্যাপী সংগ্রামের দাস্তান শোনাতেন। শেখ সাদী, জালালুদ্দীন রূমী, আকবর এলাহাবাদী, ইকবাল, হালী, জিগার মুরাদাবাদী ও খাজা আজিজুল হাসান মজযুব রাহ.-এর শের আবৃত্তি করতেন। তার কণ্ঠের উঠানামায় লাখো মানুষের মজমা তরঙ্গের মতো দুলতে থাকতো। তিনি সাহসের কণ্ঠ ছিলেন। সংগ্রামের ময়দানে অবিচলতার পাহাড় ছিলেন।

আশির দশকের শুরু পর্যন্ত তিনি ছিলেন অতি মনোযোগী ও নীরবতাবাদী একজন মেধাবী আলেম-শিক্ষক। তার শিক্ষক ও অভিভাবক হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. তাকে রাজনীতিতে নামালেন। ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সেই যে নামলেন তিনি, আর সরে গেলেন না। তিনি যখন গেলেন তখন কোটি মানুষকে রাস্তায় রেখে একদমই তিনি চলে গেলেন।

নব্বই দশকের শুরুতে ভারতের উত্তর প্রদেশে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হলে এই দেশে লংমার্চের ডাক দেয়া হয়। সেই লংমার্চ আন্দোলনের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ও প্রধান নির্বাহী ছিলেন মুফতী আমিনী রাহ.। তার শিক্ষক শায়খুল হাসীস আল্লামাআজিজুল হক রাহ. ছিলেন এ লংমার্চের আহ্বায়ক ও অভিভাবক। মুফতী আমিনী রাহ. ছিলেন এর কার্যনির্বাহী প্রধান। ১৯৯৪ সালে এক নাস্তিক মহিলা লেখক পবিত্র কুরআন পরিবর্তনের ডাক দিলে তিনি ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সারা দেশে ছুটে বেড়িয়ে আন্দোলন সংগঠিত করেন। হরতাল পালন করেন। সেই মুরতাদ মহিলা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। ২০০১ সালে সব রকম ফতোয়া নিষিদ্ধ করার একটি রায় উচ্চ আদালত থেকে ঘোষিত হলে তিনি বিচারপতিকে মুরতাদ ঘোষণা করে ঝুঁকিপূর্ণ ও ঘটনাবহুল এক আন্দোলনে নেমে পড়েন। তখন চার মাসের জন্য তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। আওয়ামীলীগ সরকার ঘোষিত শিক্ষানীতি ও নারীনীতি নিয়ে তিনি সোচ্চার প্রতিবাদ করেন। নারীনীতির মধ্যে উত্তরাধিকারসহ সবপর্যায়ে নারীর সম-অধিকারের কুরআনবিরোধী ধারা বাতিলের জন্য দেশবাসীর প্রতি আন্দোলনের ডাক দেন। এক পর্যায়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে বহু প্রতিকূলতা ও প্রশাসনিক প্রতিরোধের মুখে ২০১১ সালের ৪ এপ্রিল দেশব্যাপি সফল হরতাল পালন করেন। এর ঠিক ছয়দিন পর তার ছোট ছেলেকে গুম করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তাকে কোনোভাবেই নমনীয় করা যায়নি। পরবর্তী সময়ে সেই ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। প্রতিটি আন্দোলনেই তিনি ছিলেন মূল আহ্বায়ক এবং আগাগোড়া অনমনীয় ও দৃঢ়পদ। সারাদেশের শীর্ষ আলেমরা প্রতিটি আন্দোলনে তার সঙ্গে ও পাশে থেকে তাকে সহযোগিতা করেন। প্রতিবাদ, আন্দোলন, সংগ্রামে ধর্মপ্রাণ মানুষের আস্থা ও আশ্বাসের মিনারে পরিণত হন তিনি।

আন্দোলন-সংগ্রামে প্রবীণত্ব ও নেতৃত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি সব সময় সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন ছিলেন না। কিন্তু কার্যনির্বাহী দায়িত্ব তাকেই আঞ্জাম দিতে হয়েছে সব সময়। তার সময়কালে প্রায় সময়ই তিনি তার গুরুজনদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ স্নেহ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছেন। খতিব উবায়দুল হক রাহ., বি-বাড়িয়ার বড়হুজুর মাওলানা সিরাজুল ইসলাম রাহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রাহ. ও আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মতো বটবৃক্ষরা সব সময় তাকে স্নেহ-ছায়া বিলিয়ে এসেছেন। বড়দের সঙ্গে তিনি এভাবেই শ্রদ্ধা ও আস্থার সম্পর্ক বজায় রাখতেন।


আরো পড়ুন সফল মাহাথির, আপনিও সফল হোন। মাহাথিরের অনন্য জীবন


সংগ্রামী আলেম মুফতী ফজলুল হক আমিনী রাহ.-এর জীবনে তার প্রত্যক্ষ উস্তায তিন মনীষীর প্রভাবের কথা তিনি প্রায়ই বলতেন। সবচেয়ে বেশি বলতেন বাংলার সংস্কারক পুরুষ মোজাহেদে আযম হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী-ছদর ছাহেব রাহ.-এর কথা। বলতেন প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ও সংগ্রামী আলেম করাচির হযরত ইউসুফ বিন্নৌরী রাহ.-এর কথা। আর পরবর্তী পর্যায়ে দেশবরেণ্য বুযুর্গ ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী  ‌’তাওবার রাজনীতিক’ হযরত মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর জীবন ও সংগ্রামের প্রভাবের কথা বিভিন্ন সময় উল্লেখ করতেন। তার পড়াশোনা, মেযাজ, চিন্তাধারা ও বিভিন্ন পদক্ষেপের ক্ষেত্রে তিনি এই মনীষীদের কথা শ্রদ্ধা ও প্রত্যয়ের সঙ্গে উল্লেখ করতেন।

মুফতী আমিনী রাহ. মেধাবী ও সংগ্রামী একজন আলেম ছিলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে বিচরণের কারণে তার আচরণে কখনো কখনো একটা আটপৌড়ে ও গাম্ভীর্যহীন ভাব বিরাজ করত। খোলামেলা ভাষায় বক্তব্য দিতেন। প্রাণ খুলে মিশতেন। জোরের সঙ্গে কখনো বিরক্তি প্রকাশ করতেন। কখনো বয়ানের মধ্যেও হেসে উঠতেন। যা দেখলে অনেক সময় তাকে গভীর মনের ও চিন্তার মানুষ বলে মনে হতো না। একটা বিভ্রম তৈরি হতো। কিন্তু বাস্তবতা এ রকম ছিল না। যারা জানেন তারা জানেন যে, তিনি কেবল হাদীসের দরসের প্রস্তুতির জন্য নয়, বরাবর অধ্যয়ন পাগল একজন মানুষ ছিলেন। গভীর অধ্যয়ন ও পাঠনিমগ্নতায় তিনি অনেক সময়ই বিভোর থাকতেন। মাঝে মাঝেই ইসলামী জ্ঞান, দর্শন, ফিকহ ও চিন্তাধারা বিষয়ে নতুন প্রকাশিত আরবি-উর্দু-ফার্সির বহু কিতাব কার্টন ধরে ধরে তিনি কিনে আনতেন। ইসলাম বিষয়ে আলোচিত নতুন প্রকাশিত কোনো গ্রন্থ তার অপঠিত থাকত না। লালবাগ মাদরাসার বিশাল লাইব্রেরির প্রাচীন শত শত কিতাবের কোনো কোনো পৃষ্ঠায় কাঠপেন্সিলে তার নোট ও পর্যবেক্ষণ আঁকা আছে। তার অন্তরে আচরণে আধ্যাত্মিকতার একটি স্বচ্ছ ঝর্ণা প্রবাহিত থাকতো। বেশিরভাগ সময়ই তার বক্তব্যে থাকতো আকাবিরে দ্বীন ও আসলাফে উম্মতের চোখভেজা বর্ণনা।

যারা জানেন তারা মুফতী আমিনী রাহ.-এর আরেকটি বিষয় সম্পর্কেও জানেন। বছরের প্রায় প্রতি রাতে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টাকেঁদে-কেটে দুআ করতেন। এ দুআ কখনও মাদরাসায় তার রুম বন্ধ করে করতেন, কখনও ছাত্রদের ডেকে এনে দফতরে সম্মিলিতভাবে করতেন। দুআয় সময় দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকতেন। সে কান্না সহজে শেষ হতোনা। লালবাগ মাদরাসায় প্রতি বৃহস্পতিবার শেষ রাতে তিনি একটি সম্মিলিত দুআর আয়োজন করতেন। রাত ৩টার আগেই সারা মাদরাসার ছাত্ররা উঠে এসে শাহী মসজিদের বারান্দায় তাহাজ্জুদ পড়ত। তেলাওয়াত করত। ফজরের আযানের আধা ঘণ্টা আগে তিনি সবার মুখোমুখি দাঁড়াতেন। এরপর সবাইকে নিয়ে দু’হাত আল্লাহর দরবারে তুলে ধরতেন। সামনে ছাত্ররা বসা। উল্টোদিকে একা তিনি দাঁড়ানো। মসজিদের বাতিগুলো থাকত নেভানো। রাজনীতির ময়দানে হুঙ্কার দেয়া মুফতি আমিনী সেই অন্ধকার শেষ রাতে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে অসহায়ের মতো, ভিক্ষুকের মতো, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর মতোচিত্কার করে কাঁদতে থাকতেন। তার সঙ্গে সারাটা মসজিদ যেন কাঁদতে থাকত। মনে হতো তার বুক যেন ফেটে যাচ্ছে। কান্নায়-কষ্টে, আবেদনে-আবদারে, দুঃখে-কাতরতায় তিনি নুয়ে নুয়ে পড়তেন। এবং অপরিহার্যভাবে এসব দুআয় তিনি দেশ, দেশের মানুষ, দেশের স্বাধীনতা ও শান্তির জন্য বড় একটি সময় জোরে জোরে দুআ করতেন।

দীর্ঘ বিশ মাস গৃহবন্দী থেকে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। কাছের মানুষরা জানেন, তাকে কতটা চাপের মধ্যে রাখা হয়েছিল। কতবার তাকে আদালতের বারান্দায় টেনে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো একটি মামলা কি তার ব্যক্তিগত ‘দুর্নীতি’, ‘উপার্জন’ কিংবা ‘অনৈতিকতা’ নিয়ে ছিল? দেশ ও ইসলামের জন্য লড়তে লড়তে, কুরআন ও সুন্নাহর জন্য বলতে বলতে তিনি অবরুদ্ধ হলেন। বছরের পর বছর অবরুদ্ধ ও প্রায় নির্বাক থাকতে বাধ্য হলেন। আমার মতো তার হাজার হাজার অকৃতজ্ঞ ছাত্র, লাখ লাখ আলেম আর কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ তাকে মুক্ত করার কোনো চেষ্টা করিনি। তিনি তো আমাদের হয়েই লড়েছিলেন। তিনি তো দ্বীনের জন্যই টার্গেট হয়েছিলেন। আহা! ক্ষমাহীন নিস্পৃহা ও নির্বিকারত্ব নিয়ে আমরা তাকে তার অবস্থায় ছেড়ে রাখলাম। কোনো প্রতিবাদ, কোনো আন্দোলন, কোনো শব্দ আমরা করলাম না। এমনকি চিত্কার করে কাঁদলামও না। আমাদের এ অপরাধ কি আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করবেন?

মুফতি আমিনী রাহ.। আমার শিক্ষক। আমাদের শিক্ষক। আমরা তার জন্য বেহেশতে উঁচু মাকামের প্রার্থনা করি। জানাযার লাখো মানুষের জনসমুদ্র তার জন্য হাউমাউ করে কেঁদেছে, ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে। আর ঘন ঘন চোখ মুছেছেন হাজার হাজার মানুষ। তাকে হারানোর কষ্ট অনেকের চোখে স্রোত সৃষ্টি করেছে। শেষ জীবনে তাকে কষ্ট দেওয়ার কষ্টে অনেকের বুকে পাথর জমেছে।

ইয়া আল্লাহ! তোমার প্রিয় এই মর্দে মুমিন ও মর্দে মুজাহিদকে তুমি শান্তির ছায়ায় টেনে নাও। আমীন। l

হাদীস ও আছারের আলোকে রমযান : ফাযাইল ও মাসাইল

মুহাম্মাদ ফজলুল বারী ,মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ফাহাদঃ বছরের অন্যতম ফযীলতপূর্ণ মাস হল রমযান। প্রত্যেক মুসলিমের জীবনে রমযানের গুরুত্ব অপরিসীম। রমযান হল পূণ্য অর্জনের শ্রেষ্ঠ মৌসুম। দীর্ঘ এক মাসের রোযা, তারাবী, তাহাজ্জুদ, কুরআন তেলাওয়াত ও অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন করে এবং সব ধরনের গুনাহ থেকে বিরত থেকে অর্জন করে হৃদয় ও আত্মার পরিশুদ্ধি।

মাসজুড়ে তাকওয়ার অনুশীলনের মাধ্যমে তৈরি হয় বছরের বাকি দিনগুলো পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত থাকার যোগ্যতা। বান্দার এই অনুশীলনকে যথার্থ ও তার সংযমকে স্বার্থক করার জন্য প্রয়োজন যথাযথভাবে এ মাসের বন্দেগীগুলো আগ্রহের সঙ্গে সঠিকভাবে আদায় করা। এ লক্ষ্যেই রমযানকে সামনে রেখে কুরআন হাদীস ও আছারের আলোকে রমযানের কিছু ফাযাইল ও মাসাইল নিম্নে উল্লেখ করা হল।

রোযার ফযিলত/ফাজায়েল

ফাযাইল প্রসঙ্গ রোযার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দিবেন রোযা একমাত্র আল্লাহর জন্য। শুধু আল্লাহর ভয়েই বান্দা পানাহার থেকে বিরত থাকে। নইলে পৃথিবীর কোন শক্তি এমন আছে যা তাকে গোপনে এক ঢোক পানি পান করা থেকে বিরত রাখতে পারে? রোযাদার পিপাসায় কাতর হয়, ওযুর জন্য মুখে পানি নেয়, কিন্তু এক কাতরা পানি হলকের নিচে নামতে দেয় না। কার ভয়ে, কার মুহাব্বতে? একমাত্র আল্লাহ তাআলার ভয়ে, আল্লাহ তাআলার মুহাব্বতে। কেউ দেখছে না, কিন’ আল্লাহ দেখছেন। কেউ জানছে না, কিন’ আল্লাহ জানছেন।

আহা! জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি এই অনুভূতি লাভ করতে পারতাম! এজন্যই তো রোযার প্রতিদান দিবেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। তাঁর শান অনুযায়ী।

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বনী আদমের প্রতিটি আমলের প্রতিদান বহু গুণে বৃদ্ধি হতে থাকে, ১০ গুণ থেকে ৭০০গুণ, এমনকি আল্লাহ চাইলে তার চেয়েও বেশি দেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তবে রোযার বিষয়টি ভিন্ন। কেননা, রোযা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি স্বয়ং এর প্রতিদান দিব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ থেকে বিরত থাকে।

রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দ : এক. ইফতারের মুহূর্তে দুই. রবের সঙ্গে সাক্ষাতের মুহূর্তে। আর রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও উত্তম।-সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৫১

রোযাদারের জন্য জান্নাতের বিশেষ দরজা হযরত সাহ্ল ইবনে সাদ থেকে বর্ণিত, জান্নাতে রাইয়ান নামে একটি দরজা আছে। এই দরজা দিয়ে শুধু রোযাদাররা প্রবেশ করবে। ঘোষণা করা হবে, রোযাদাররা কোথায়? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে। যখন তাঁরা প্রবেশ করবে তখন ঐ দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং তা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করবে না।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৮৯৬

অন্য রেওয়াতে আছে, জান্নাতে একটি দরজা আছে, যার নাম রাইয়ান। শুধু রোযাদারগণ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। আর যে তাতে প্রবেশ করবে সে কখনো পিপাসার্ত হবে না।-জামে তিরমিযী ৭৬৫; ইবনে মাজাহ : ১৬৪০

রোযা রোযাদারের জন্য সুপারিশ করবে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রোযা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানো থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং আমার সুপারিশ কবুল করুন। তখন দু’জনের সুপারিশই গ্রহণ করা হবে।-মুসনাদে আহমদ হাদীস : ৬৫৮৯; তবারানী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/৪১৯

রোযাদারের দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তিন ব্যক্তির দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না :

  • ১. রোযাদারের দুআ ইফতার করা পর্যন্ত
  • ২. ন্যায়পরায়ণ বাদশাহের দুআ ও
  • ৩. মাজলুমের দুআ।

আল্লাহ তাআলা তাদের দুআ মেঘমালার উপরে উঠিয়ে নেন এবং এর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। আর আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার ইজ্জতের কসম! বিলম্বে হলেও আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব।- মুসনাদে আহমদ হাদীস : ৯৭৪৩; জামে তিরমিযী হাদীস : ৩৫৯৮; ইবনে হিব্বান হাদীস : ৩৪২৮; ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৭৫২

রোযাদারের জন্য মাগফিরাতের পুরষ্কার পূর্ণ এক মাস বান্দা রোযা রাখল। প্রতিদিন ঘোষণা হচ্ছিল, ‘কে আছ ক্ষমাপ্রার্থী, আমার কাছে ক্ষমা চাও। আমি ক্ষমা করে দিব।’ মাস শেষ। বান্দা তার মালিকের হুকুম পালন করেছে। এবার তাঁর পক্ষ থেকে আসছে ক্ষমার ঘোষণা।

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখবে আল্লাহ তাআলা তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০১; জামে তিরমিযী হাদীস : ৬৮৩; ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৩২৬

সেহরী ও ইফতার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সেহরী খাও, সেহরীতে বরকত রয়েছে।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯২৩; সহীহ মুসলিম হাদীস : ১০৯৫ অন্য হাদীসে আছে, আমাদের রোযা ও আহলে কিতাবীদের রোযার মাঝে পার্থক্য হল সেহরী খাওয়া (আমরা সেহরী খাই তারা খায় না)।-সহীহ মুসলিম হাদীস : ১০৯৬

শেষ ওয়াক্তে সেহরী খাওয়া সুন্নত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার উম্মত কল্যাণের মাঝে থাকবে যতদিন তারা সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করবে ও শেষ ওয়াক্তে সেহরী খাবে।-মুসনাদে আহমদ ৫/১৭৪ হাদীস

অন্য হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সেহরী খাওয়া ও আযানের মাঝের সময়ের ব্যবধান ছিল পঞ্চাশ আয়াত তেলাওয়াত পরিমাণ।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯২১; সহীহ মুসলিম হাদীস : ১০৯৬

রমযানে ইফতারঃ ইফতারের সময় দুআ কবুল হয় ইফতারের সময় হওয়ার কিছু পূর্বেই দস্তরখানে বসা উচিত। কত সুন্দর দৃশ্য! সামনে কত রংবেরঙের খাবার, কিন’ বান্দা সেদিকে হাত বাড়াচ্ছে না শুধু রবের অনুমতির অপেক্ষায়। আহা! দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতিও যদি রবের অনুমতি ছাড়া হাত না বাড়াতাম! ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে বেশি বেশি দুআ ও ইসি-গফার করা উচিত।

হাদীস শরীফে এসেছে, ইফতারের সময় রোযাদারের দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।-ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৭৫৩ এই হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ রা. ইফতারের সময় নিম্নোক্ত দুআ পড়তেন : অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আপনার ঐ রহমতের ওছিলায় প্রার্থনা করছি, যা সকল বস’তে পরিব্যাপ্ত, আমাকে ক্ষমা করে দিন।-ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৭৫৩;

আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ হাদীস : ৪৮১ হযরত আয়েশা রা.কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শবে কদরে পড়ার জন্য একটি দুআ শিখিয়েছেন। শেষ দশকের রাতে এই দুআ বেশি বেশি পড়া উচিত। ইফতারের পূর্বেও তা পড়া যায়। অর্থ : ‘হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করতে ভালবাস। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও। প্রতিদিন ইফতারের সময় অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দেওয়া হয় হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, প্রতিদিন ইফতারের সময় অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং এটা প্রতি রাতে।-ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৬৪৩

সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করুন হাদীস শরীফে আছে, মানুষ যতদিন সময় হওয়ার সাথে সাথে দ্রুত ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণের মাঝে থাকবে।-সহীহ মুসলিম হাদীস : ১০৯৮; জামে তিরমিযী হাদীস : ৬৯৯ ইফতারের দুআ ‘পিপাসা নিবারিত হল, শিরা উপশিরা সতেজ হল আর সওমের ছাওয়াব প্রাপ্তির খাতায় লিখিত হয়ে গেল।-সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ২৩৫৭; আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলা হাদীস : ৪৭৮

‘হে আল্লাহ! আপনার সন’ষ্টির উদ্দেশ্যেই রোযা রেখেছি এবং আপনার দেওয়া রিযিক দিয়ে ইফতার করছি।-সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ২৩৫৮

খেজুর বা পানি দিয়ে ইফতার শুরু করুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন কেউ ইফতার করে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। কেননা, তা বরকতের খাদ্য। যদি তা না থাকে তাহলে পানি দ্বারা। কেননা তা পবিত্র বস’।-জামে তিরমিযী হাদীস : ৬৯৫; সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ২৩৫৫

রমযান মাসের সর্বোত্তম আমলঃ কীভাবে রমযান মাসকে অধিক ফলপ্রসূ করা যায় রমযান মাসের সর্বোত্তম আমল যে রোযা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ রোযার ব্যাপারেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন স্বয়ং আমি এর প্রতিদান দিব। রোযা ঢাল; এ ঢাল যেন অক্ষুণ্ন থাকে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোযা ঢাল স্বরূপ।-সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৫১; ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৬৩৯

অন্য হাদীসে আছে, যুদ্ধে ব্যবহৃত ঢালের মতো রোযা জাহান্নাম থেকে ঢাল। রোযা যেহেতু জাহান্নাম থেকে ঢাল সুতরাং তা আমাকে অক্ষুণ্ন রাখতে হবে এবং কী করলে তা ভেঙ্গে যায় তাও জানতে হবে। এক হাদীসে এসেছে, রোযা ঢাল যতক্ষণ না তা বিদীর্ণ করে ফেলা হয়।-মুসনাদে আহমদ হাদীস : ১৬৯০

কীভাবে এই ঢালকে বিদীর্ণ হওয়া থেকে রক্ষা করা যায়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোযা হচ্ছে ঢাল। যখন তোমাদের কেউ রোযা থাকে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে এবং মূর্খের ন্যায় কাজ না করে। কেউ যদি তাকে গালি দেয় বা ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয় তাহলে সে যেন বলে, আমি রোযাদার, আমি রোযাদার।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০৪; সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৫১

অন্য হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মন্দ কাজ বর্জন করল না তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০৩ নিয়মিত তারাবীহ পড়-ন এ মাসের বিশেষ আমলের মধ্যে তারাবী নামায অন্যতম। এ নামায সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে ছওয়াবের আশায় রমানের রাতে দণ্ডায়মান হয় তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।-সহীহ বুখারী হাদীস : ২০০৯

বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করুন কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, (অর্থ) রমযান মাস, মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং হক বাতিলের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।-সূরা বাকারা : ১৮৫

হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত জিবরীল আ. রমযানের প্রতি রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আসতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০২

যথাসাধ্য দান করুন দান করার অর্থ অন্যকে দেওয়া নয়, নিজের জন্য আখিরাতের সঞ্চয় করা। সুতরাং দান করি আর হিসাব করি যে, আখেরাতের জন্য কী পরিমাণ সংরক্ষণ করলাম। আর এর জন্য সর্বোত্তম সময় হল রমযান মাস। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক দাতা ছিলেন। রমযানে তাঁর দানের হাত আরো প্রসারিত হত।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০২

তাহাজ্জুদের সুযোগকে কাজে লাগান এবং তা অভ্যাসে পরিণত করুন হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘ফরয নামাযের পরে সর্বোত্তম নামায হল রাতের নামায (অর্থাৎ তাহাজ্জুদ)।’-সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৬৩; মুসনাদে আহমদ হাদীস : ৮৫৩৪; জামে তিরমিযী হাদীস : ৪৩৮

রমযানে তাহাজ্জুদঃ রমযান মাসে যেহেতু সেহরীর জন্য ওঠা হয়। তাই একটু আগে উঠে দুই চার রাকাত তাহাজ্জুদ পড়া খুবই সহজ। এজন্য এই বিষয়ে মনোযোগী হওয়া উচিত। পাশাপাশি ফিকির করা উচিত যে, এটাকে যেন আগামীর জন্য অভ্যাসে পরিণত করতে পারি। পরিবারের লোকদেরকেও উঠিয়ে দিই। বেশি বেশি দুআ ও ইসে-গফার করুন এক হাদীসে এসেছে, ‘রোযাদারের দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।’

অন্য রেওয়ায়েতে আছে, রমযানে রোযাদারকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। বিশেষ করে শেষ রাত দুআ ও ইস্তেগফারের সবচেয়ে উপযোগী সময়। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকে তখন আল্লাহ তাআলা নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসেন এবং ঘোষণা করতে থাকেন, কে আমাকে ডাকছ আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে প্রার্থনা করছ আমি তাকে দান করব। কে আছ ক্ষমাপ্রার্থী আমি তাকে ক্ষমা করে দিব।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১১৪৫; সহীহ মুসলিম হাদীস : ৭৫৮

শবে কদরঃ শবে কদরের অন্বেষণে থাকুন কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, (অর্থ) নিশ্চয়ই আমি তা (কুরআন) নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি কি জানেন লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।-সূরা কদর : ১-৩ হাদীস শরীফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় কদরের রাতে নামাযে দণ্ডায়মান থাকবে তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।-সহীহ মুসলিম হাদীস : ৭৬০; সহীহ বুখারী হাদীস : ২০১৪ সুতরাং এই ফযীলত লাভে সচেষ্ট হওয়া কর্তব্য। অন্তত ইশা ও ফজর যদি জামাতের সাথে হয় তবুও সারারাত নামায পড়ার সমান ছওয়াব পাওয়া যাবে এবং শবে কদরের ন্যূনতম ফযীলত লাভ করা যাবে। কারণ এক হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি ইশা ও ফজর জামাতের সাথে পড়ল সে যেন সারারাত দাঁড়িয়ে নামায পড়ল।-সহীহ মুসলিম হাদীস : ৬৫৬; মুসনাদে আহমদ হাদীস : ৪০৮

ইতিকাফঃ শেষ দশকে ইতিকাফ করুন শবে কদর লাভ করার সবচেয়ে উত্তম উপায় হল শেষ দশকে ইতিকাফ করা। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা শেষ দশকে শবে কদর অন্বেষণ কর।’ অন্য রেওয়ায়েতে আছে, ‘তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোতে শবে কদর তালাশ কর।’-সহীহ বুখারী হাদীস : ২০১৭; ২০২০

নির্দিষ্টভাবে সাতাশের রাতকে শবে কদর বলা ঠিক নয়। কারণ হাদীসে শেষ দশকে শবে কদর অন্বেষণ করতে বলা হয়েছে। তাই শেষ দশকের সব রাতেই যথাসম্ভব বেশি বেশি ইবাদাত করা চাই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের মাঝের দশ দিন ইতিকাফ করতেন। এক বছর এভাবে ইতিকাফ শেষ করার পর যখন রমযানের একুশতম রাত এল তখন তিনি ঘোষণা করলেন, যে ব্যক্তি আমার সাথে ইতিকাফ করেছে সে যেন শেষ দশকে ইতিকাফ করে। কারণ আমাকে শবে কদর সম্পর্কে অবগত করা হয়েছিল (যে তা শেষ দশকের অমুক রাতে)। এরপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। … সুতরাং তোমরা শেষ দশকে শবে কদর খোঁজ কর।’-সহীহ বুখারী হাদীস : ২০২৭; সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৬৭

সুতরাং বুঝা গেল যে, শেষ দশকে যে ইতিকাফ করবে তার শবে কদর নসীব হবে। মাসনূন ইতিকাফ দশ দিন। যাদের দশ দিন ইতিকাফ করার সুযোগ নেই বা সাহস হয় না তারা দুই তিন দিন নফল ইতিকাফ করতে পারেন। হাদীস শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন’ষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করবে আল্লাহ তাআলা তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। অর্থাৎ আসমান ও যমীনের দূরত্ব থেকে অধিক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন।-শুআবুল ঈমান হাদীস ”: ৩৯৬৫

মাসাইল প্রসঙ্গ রোযার হুকুম, সময় ও শর্ত ১. রমযানের চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রোযা রাখা ফরয। দেখুন : সূরা বাকারা : ১৮৩ ও ১৮৫; সহীহ মুসলিম ১/৩৪৭ ২. প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্ক ব্যক্তির উপর রমযানের রোযা ফরয। ৩. রোযার সময় হচ্ছে সুবহে সাদিক থেকে সূুরযাস । দেখুন : সূরা বাকারা : ১৮৭; সহীহ মুসলিম ১/৩৪৯ ৪.

রোযার নিয়ত করা জরুরি। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, সকল আমলই নিয়তের উপর নির্ভরশীল। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২ ৫. সুবহে সাদিকের পূর্বেই রোযার নিয়ত করে নেওয়া উচিত। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৬৬

যেসব কারণে রোযা ভঙ্গ হয় না

  • ১. ভুলে কোনো কিছু খেলে বা পান করলে। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৯; সহীহ মুসলিম ১/৩৬৪; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/১৭৩
  • ২. ভুলে স্ত্রী সহবাস করলে। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৯; শরহে মুসলিম, নববী ১/৩৫৪; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/১৭৪
  • ৩. দিনের বেলা স্বপ্নদোষ হলে। দেুখন : জামে তিরমিযী ১/১৫২
  • ৪. চোখে সুরমা ব্যবহার করলে। দেখুন : জামে তিরমিযী ১/১৫৪; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/২০৭-২০৮
  • ৫. অনিচ্ছাকৃত মুখভর বমি হলে। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৬০; জামে তিরমিযী ১/১৫২; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/২১৫
  • ৬. ধুলাবালি, ধোঁয়া, মশা-মাছি ইত্যাদি যা পরিহার করা সম্ভব নয় অনিচ্ছায় হলকের (কণ্ঠনালি) ভিতরে চলে গেলে। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৯; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৪৯
  • ৭. জুনুবী অবস্থায় সুবহে সাদিক হয়ে গেলে। দেখুন : সূরা বাকারা : ১৮৭; সহীহ বুখারী ১/২৫৮; সহীহ মুসলিম ১/৩৫৩-৩৫৪; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/১৭৯; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/২৮০

রোযা অবস্থায় যা করা মাকরূহ নয়

১. সকাল কিংবা সন্ধ্যায় মিসওয়াক করা। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৮-২৫৯; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/২০০; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৭৩

২. শীতলতা লাভের জন্য মাথা, দেহে পানি ঢালা। আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন রোযা অবস্থায় বাইরে বের হলেন। যখন ‘আরাজ’ নামক স্থানে পৌঁছলেন তখন রোযা তাঁর জন্য কষ্টকর হয়ে দাড়াল। ফলে তিনি মাথায় পানি ঢেলেছিলেন।-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/২০৬ ৩. সুরমা ব্যবহার করা।-প্রাগুক্ত।

যেসব কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় তবে কাফফারা ওয়াজিব হয় না

  • ১. কানে ঔষধ বা তেল ঢাললে। তেমনিভাবে নাকে ঔষধ দিয়ে টেনে ভিতরে নিয়ে গেলে। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৯
  • ২. ইচ্ছা করে মুখভরে বমি করলে। আলী রা. বলেন, কেউ বমি করলে রোযা কাযা করতে হয় না। তবে ইচ্ছা করে বমি করলে তাকে কাযা করতে হবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৮০; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/২১৫; মুসতাদরাকে হাকেম ১/৪২৭
  • ৩. রাত্র বাকি আছে মনে করে সময়ের পরে সেহরী খেলে। সাঈদ ইবনে জুবায়র রা. বলেন, কেউ (সুবহে সাদিক হয়নি মনে করে) সুবহে সাদিকের পর কিছু খেলে অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকবে এবং অন্য একদিন তা কাযা করে নিবে। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৪৯
  • ৪. সূর্য অস্ত- গিয়েছে মনে করে সময়ের আগেই ইফতার করে ফেললে। হযরত আলী ইবনে হানযালা রাহ. তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আমি রমযানে হযরত ওমর রা.-এর কাছে ছিলাম তখন তাঁর সামনে পানীয় পেশ করা হল। কিছু লোক সূর্য ডুবে গিয়েছে মনে করে ইফতার করে ফেললেন। এরপর মুআযযিন এসে বললেন, আমীরুল মু’মিনীন! সূর্য তো এখনো অস্ত- যায়নি। তখন ওমর রা. ঘোষণা করলেন, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শিরক থেকে নিষেধ করেছেন। দুই বার কিংবা তিন বার তিনি একথা বলেছেন। এরপর বললেন, যারা ইফতার করেছে তারা যেন এই দিনের পরিবর্তে অন্য একদিন রোযা রাখে। আর যারা ইফতার করেনি তারা যেন সূর্যাস- পর্যন- তাদের রোযা পূর্ণ করে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৫০
  • ৫. ভুলক্রমে পানাহারের পর ইচ্ছাকৃত পানাহার করলে।-প্রাগুক্ত।

যেসব কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় এবং কাফফারা দেওয়া ওয়াজিব হয়

১. ইচ্ছাকৃত পানাহার করা। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৯; সহীহ মুসলিম ১/৩৪৯; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/১৯৭

২. ইচ্ছাকৃত স্ত্রী সহবাস করলে। দেখুন : প্রাগুক্ত; সহীহ মুসলিম ১/৩৫৪; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/৩৪৬; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/১৮৮

রোযা অবস্থায় যা করা মাকরূহ

  • ১. মুখে পানি নিয়ে গড়গড়া করলে। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৮৫
  • ২. নাকে বেশি বেশি পানি দেওয়া। আছেম ইবনে লাকীত ইবনে ছাবিরা তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নাকে ভালো করে পানি দাও। তবে যদি তুমি রোযাদার হও। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/৩৩৩
  • ৩. বিনা প্রয়োজনে কোনো কিছু চাবানো। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৭৯; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/২০৩

রোযার দিন অবশিষ্ট সময় যা করা উচিত

  • ১. অসুস্থতা, বার্ধক্য ইত্যাদি শরীয়তসম্মত কোনো ওযরের কারণে কেউ রমযানের রোযা রাখতে সক্ষম না হলে সে পানাহার করতে পারবে। তবে রোযাদারদের অগোচরে পানাহার করা উচিত।
  • ২. মুসাফির যদি দিনের বেলা সফর থেকে বাড়ি ফিরে আসে তাহলে অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকবে। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/২২১
  • ৩. তদ্রূপ দিনের বেলা কোনো মহিলার হায়েয বন্ধ হলে অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকবে। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/২২০; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/১৭০

কিছু সমসাময়িক মাসআলা উল্লেখিত মাসআলাগুলো ছাড়াও বর্তমান ফকীহগণ কুরআন, হাদীস ও আছারের আলোকে সূক্ষ্ম গবেষণা ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করে রমযান মাসে সমকালীন চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান প্রদান করেছেন। প্রয়োহনীয় কিছু বিষয় নিম্নে উল্লেখ করা হল।

  • ১. এণ্ডোসকপি : রোযা অবস্থায় এণ্ডোসকপি পরীক্ষা করানো যায়। তবে পরীক্ষা করার সময় যদি নলের ভিতর দিয়ে পানি বা কোনো ঔষধ ভিতরে প্রবেশ করানো হয় তাহলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। অন্যথায় নষ্ট হবে না। এণ্ডোসকপির মতোই মলদ্বার দিয়ে নল ঢুকিয়ে যে পরীক্ষা করা হয় তার হুকুমও অভিন্ন।
  • ২. এনজিওগ্রাম : সাধারণ পদ্ধতির এনজিওগ্রাম-এর কারণে রোযা নষ্ট হয় না।
  • ৩.ইনেজকশন ও ইনসুলিন : ইনজেকশন ও ইনসুলিন গ্রহণের কারণে রোযা নষ্ট হয় না। তবে যেসব ইনজেকশন খাদ্যের কাজ দেয় তা জটিল ওযর ছাড়া গ্রহণ করা মাকরূহ। ৪. নাইট্রোগ্লিসারিন : এরোসোল জাতীয় এ ঔষধটি ব্যবহার করলে রোযা নষ্ট হয় না। ৫. ভেন্টোলিন ইনহেলার : রোযা অবস্থায় এই ইনহেলার ব্যবহার করলে রোযা নষ্ট হয়ে যায়।বিশেষ কৃতজ্ঞতা – মাসিক আল কাউসার