ইসলামে শ্রমিকের অধিকার

442
ইসলামে শ্রমিকের অধিকার

সমাজে নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষের মধ্যে অনেকে নিজ নিজ পরিমণ্ডলে তাদের প্রকৃত প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। একথা সমাজের সচেতন মহল সকলেই জানেন। তাদের মধ্যে একটি শ্রেণীর নাম শ্রমিক শ্রেণী। তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুগে যুগে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। এমনি এক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকরা জড়ো হয়েছিল। সেখানে শ্রমিকদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। এতে প্রায় ১০-১২ জন্য শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। এরপর ১৮৯৪ সালের মে মাসে মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। শ্রমিকের এ আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যা মে দিবস নামে পরিচিত।
কিন্তু এত আন্দোলন-সংগ্রামের পরও আজও শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এজন্য তাদের এখনও আত্মবলি দিতে হচ্ছে। এর কারণ, তাদের সমস্যা সমাধানের চিন্তা করা হয়েছে স্বার্থান্ধ বিবেকের দৃষ্টিকোণ থেকে। আমরা বিশ্বাস করি যে, ইসলাম মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানবজীবনের অন্য সকল ক্ষেত্রের মতো শ্রমিকের অধিকার বিষয়েও রয়েছে ইসলামের হৃদয় শীতলকরা অনিন্দ্য সুন্দর সমাধান। কেননা, নিপীড়িত মানুষের প্রকৃত বন্ধু আল্লাহ প্রদত্ত দীন তথা ইসলাম। দুনিয়ার আর কোনো মতাদর্শ শ্রমিকদের এর চেয়ে বেশি সম্মান দিতে পারেনি।

ইসলাম এমন এক জীবন বিধান, যা সর্বস্তরের মানুষের সার্বিক শান্তি ও কল্যাণের নিশ্চয়তা দান করে। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ আল্লাহ তাআলার খলীফা। আল্লাহ তাআলা যেমন ন্যায়নিষ্ঠ, তেমনি তাঁর খলীফা তথা মানুষকেও হতে হবে ন্যায়নিষ্ঠ। ইসলাম মানুষের সম্পূর্ণ মনোবৃত্তিরই আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। এটাই ইসলামের প্রধান লক্ষ্য। এখানেই ইসলামের সার্থকতা। ইসলাম মানুষের মন-মানসিকতাকে প্রথম থেকেই এমনভাবে গড়ে তুলতে চায়। যাতে তার মধ্যে পশুসুলভ আচরণ এবং শোষণমূলক চরিত্রের সৃষ্টি না হয়। মানুষ যেন হয় অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও মানবতাবাদী। এ উদ্দেশ্যে ইসলাম বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। নির্ধারণ করে দিয়েছে কিছু নীতিমালা। যাতে এসবের আলোকে একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে ওঠে।


ইসলামে নারীর সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার


 মানুষের মধ্যে সাধারণত জুলুম-অত্যাচার ও শোষণ-পীড়নের মানসিকতা জন্ম নেয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী-স্বার্থ সংরক্ষণের মানসিকতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকে। ইসলাম প্রথমে এ ব্যাধির নিরাময়ের ব্যবস্থা করেছে। ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে সম্পদ উপার্জনের উদ্দেশ্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ-সংরক্ষণ নয়। লক্ষ্য নয় বিলাসভোগও। বরং-
একজন মুমিনের সম্পদ উপার্জনের উদ্দেশ্য হবে, এর দ্বারা তার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে আবর্তিত হুকুম আহকাম পালনে সহায়তা লাভ করা, সমাজের কল্যাণ করা, অসহায়ের সহায়তা করা, সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আখেরাতের কামিয়াবি লাভ করা। দুনিয়ার সম্ভোগ ও বিলাসিতাকে ইসলাম কখনও সমর্থন করেনি। আল্লাহ তাআলা এক আয়াতে বলেন, 

‘যা কিছু আল্লাহ তোমাকে দিয়েছেন, এর মাধ্যমে তুমি পরকালীন আবাস লাভে সচেষ্ট হও।’ [সূরা কাসাস, আয়াত: ৭৭]

মূলত ইসলামের এ বুনিয়াদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই ইসলামী সমাজে জুলুম-অবিচার ও শোষণের কোনো মনোবৃত্তি সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ নেই।
এ ছাড়া ইসলাম জুলুম-অত্যাচার ও শোষণ-পীড়নের ঘৃণ্যতা সম্পর্কে মানুষের মনে এমনি এক অনুভূতি জাগিয়ে তোলে, যার ফলে একজন প্রকৃত মুসলমান এ থেকে ফিরে থাকতে পারে। তার উপর কোন প্রকার চাপ প্রয়োগের প্রয়োজন না পড়ে। এর সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম ভালো কাজে পরস্পরের সহযোগিতা করতে এবং গুনাহ ও অন্যায় কাজে সহযোগিতা না করতে নির্দেশ দিয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার কাজে পরস্পর সাহায্য করবে, এবং পাপ ও সীমালংঘনের কাজে একে অন্যের সাহায্য করবে না। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর। [সূরা মায়িদা, আয়াত: ২]
অপর এক আয়াতে এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎকার্য ও সীমালংঘন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর। [সূরা নাহল, আয়াত: ৯০]
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুলুমের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, তোমরা জুলুম-অত্যাচার থেকে বেঁচে থাক, তা কেয়ামতের দিন বিপুল অন্ধকারের কারণ হবে। [সহীহ বুখারী, হাদীস: ২৪৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস, ২৫৭৮, ২৫৭৯; সুনানে তিরমিযী, হাদীস: ২০৩০]
অর্থাৎ, অন্ধকারে মানুষ যেমন দিশেহারা হয়ে যায়, কাউকে সাহায্যকারী পায় না, তেমনি জালিমও কেয়ামতের দিন অসহায় হয়ে পড়বে।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে কুফরকে পর্যন্ত সহ্য করেন, কিন্তু জুলুম ও অত্যাচারকে কখনও সহ্য করে না। জুলুমের শাস্তি অনেক সময় আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতেই দিয়ে দেন। কখনও জুলুমের শাস্তি হতে দেরি দেখে মানুষ মনে করে হয়ত জালেম পার পেয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যেদিন পাকড়াও করেন, সেদিন তার আর আত্মরক্ষার কোন পথ খোলা থাকে না।
এ হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা কখনও জালিমকে কিছু সময়ের জন্য ছাড় দিয়ে রাখেন, কিন্তু যখন তাকে ধরেন তখন তাকে আর ছাড়েন না। এরপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দলিল স্বরূপ কুরআন পাকের একটি আয়াত তেলাওয়াত করেন, যার তরজমা এই, আর এমনি তোমার প্রতিপালকের ধরা (অর্থাৎ, ধ্বংস না করে নিষ্কৃতি দেন না)। যখন তিনি পাকড়াও করেন জনপদ সমূহকে, যখন সেই সব জনপদের অধিবাসীরা জুলুম করে। নিশ্চয় তাঁর ধরা অতিবেদনাদায়ক, কঠোর। [সূরা হুদ, আয়াত: ১০২] [সহীহ বুখারী, হাদীস: ৪৬৮৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস; ২৫৮৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ৪০১৭, ৪০১৮; সুনানে তিরমিযী, হাদীস: ৩১১০]
জুলুম-অত্যাচারের পরিণতিতে আল্লাহ তাআলার যে আযাব নেমে আসে তা এতই ভয়াবহ যে, সাধারণ জীব-জন্তুও তা থেকে রক্ষা পায় না। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রা. একবার এক লোককে বলতে শুনলেন যে, জালিম কেবল নিজেরই অশুভ পরিণতি ডেকে আনে; অন্য কারও নয়। তখন তিনি বলে উঠলেন, না, না, বরং জালিমের জুলুমের পরিণামে হুবারা পাখিও দুর্বল হয়ে তার বাসায় মরে পড়ে থাকে। [বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, ৯ খ. পৃ. ৫৪৪, হাদীস, ৭০৭৫]
ইসলাম শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে এবং তাদের অধিকার পূরণে অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। এ সম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এরা (অর্থাৎ, চাকর-বাকর, কর্মচারী, ক্রীতদাস ইত্যাদি) তোমাদের ভাই, তোমাদের খেদমতগার। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং যার ভাই তার অধীন রয়েছে, তাকে যা সে নিজে খায় তা থেকে খেতে দেবে। যা সে নিজে পরে, তাই তাকে পরাবে। তাদের উপর এমন কাজ চাপিয়ে দেবে না, যা তাদের পক্ষে পালন করা অধিক কষ্টকর। আর যদি তাদের উপর অধিক কষ্টকর কোনো কাজ চাপিয়ে দিয়ে থাক, তবে তাদেরকে সাহায্য কর। [সহীহ বুখারী, হাদীস: ৩০, ২৫৪৫, ৬০৫০; সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১৬৬১]
আল্লামা মানাযির আহসান গীলানী রহ. উল্লিখিত হাদীসটির ব্যাখ্যা দান করতে গিয়ে বলেন, এ হাদীস থেকে আমরা কয়েকটি বিষয় আমরা জানতে পারি।
  1. যারা নিজেদের কাজে শ্রমিক নিয়োগ করে তাদের উচিত শ্রমিকদেরকে নিজেদের ভাইয়ের মতো মনে করা এবং উভয় পক্ষের মধ্যে এরূপ সম্পর্ক থাকা, যা দুই ভাইয়ের মধ্যে থাকে।
  2. অন্তত থাকা-খাওয়ার ব্যাপার তাদের পরস্পরের মধ্যে যেন অর্থনৈতিক সমতা বিদ্যমান থাকে। যা নিজে খাবে তা শ্রমিককে খাওয়াবে। যা নিজে পরবে, তা মজদুরকে পরতে দেবে। এ থেকে অনুমিত হয় যে, শ্রমনীতির ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হল, শ্রমিককে অন্তত এ পরিমান মজুরি দেওযা উচিত, যার দ্বারা খাওয়া-পরার বিষয়ে তারা মালিক পক্ষের সমপর্যায়ে আসতে পারে। বর্তমানে যদি শ্রমিকদের মজুরি এ পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়, তবে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত অতি সহজে দূর করা সম্ভব।
  3. সময় ও কাজের ধরন উভয় দিক থেকে শ্রমিকের উপর এ পরিমাণ বোঝা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না, যা তাদেরকে পর্যুদস্ত এবং কাবু করে ফেলে। উপর্যুক্ত হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বলেছেন, তাদের উপর এমন কাজ চাপিয়ে দেবে না, যা তাদের পক্ষে পালন করা অধিক কষ্টকর। এ কথাটির উপর ভিত্তি করে বর্তমান শ্রমিকদের কাজের সময় ও কাজের ধরন সম্পর্কিত জটিলতা অতি সহজে দূরীভূত করা যায়।
  4. এমন কোনো কাজ যদি এসে যায়, যা আঞ্জাম দেওয়া শ্রমিকদের পক্ষে অধিক কষ্টকর হয়, তবে সে কাজ বন্ধ করে দিতে হবে এমন নয়। অথবা শ্রমিকদের প্রতি লক্ষ না করে তাদের দ্বারা এ কঠিন কাজ করিয়ে নিতে হবে এমনও নয়; বরং এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিয়োগদানকারী কর্তৃপক্ষ বা মালিক পক্ষ আরও বেশি শ্রমশক্তি নিয়োগ করে তাদের কাজকে হালকা করে দিতে সাহায্য করবে। হাদীসে তবে ‘তাদেরকে সাহায্য কর’ বলে এ কথাই বোঝানো হয়েছে। এর মানে এ নয় যে, মালিক নিজেই সে কাজে লেগে যাবে বা লেগে যেতে হবে। বরং উদ্দেশ্য হল, আরও বেশি শ্রমশক্তি নিয়োগ করে তাদের সাহায্য করবে।
আমি মনে করি, শ্রমিক পক্ষ ও মালিক পক্ষের মধ্যে বর্তমান কালে যে সব দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেয়, সে সবের সুষ্ঠু সমাধান উক্ত হাদীস শরীফের আলোকে পেশ করা সম্ভব। এ কেবল কথার ফুলঝুরি নয়, বরং হাদীস শরীফের এ নির্দেশনার বাস্তবচিত্রের একটি তালিকা পেশ করা যাবে, যাতে দেখা যাবে যে, সাহাবায়ে কেরাম তা বাস্তবায়ন করিয়ে দেখিয়েছেন। উপর্যুক্ত হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত আবু যর গিফারী রা.-এরই জীবনের বাস্তব অবস্থা ছিল এরকমই। এমনিভাবে হযরত উমর রা. এর বায়তুল মুকাদ্দাস সফরের কাহিনী, যেখানে অর্ধেক পথে তিনি উটের পিঠে আরোহণ করেছেন, আর অর্ধেক পথে গোলামকে উটের পিঠে চড়িয়েছেন। (ইসলামী মাআশিরাত, পৃ. ৩৬৩-৩৬৪)
অপর একটি হাদীসে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি কেয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোকের বিপক্ষ হব, (অর্থাৎ, তাদের কৃতকর্মের জবাব চাইব)। এক. যে ব্যক্তি আমার নামে কসম করে কাউকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এরপর তা ভঙ্গ করেছে। দুই. যে ব্যক্তি কোনো মুক্ত-স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার অর্থ খেয়ে ফেলেছে। তিন. যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে কাজে খাটিয়ে তার থেকে পূর্ণ কাজ আদায় করে নিয়েছে, কিন্তু তাকে তার পারিশ্রমিক দেয়নি। [সহীহ বুখারী, হাদীস: ২২২৭, ২২৭০; মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ৮৬৭৭, ৮৬৯২]
রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, তোমরা শ্রমিকদের গায়ের ঘাম শোকাবার পূর্বে তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও। [সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস: ২৪৪৩/ ২৪৪৪; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস: ৬৬৮২; তাবারানী, আল-মুজামুস সগীর, হাদীস: ৩৪]
আর একটি হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা শ্রমিককে তার শ্রমোৎপন্ন দ্রব্য হতে কিছু দান কর। কেননা, আল্লাহর শ্রমিক বঞ্চিত করা যায় না। [মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ৮৬০৪/৮৬০৫]
এ হাদীসটিতে কয়েকটি বিষয় আমরা দেখতে পাই,
এক. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে শ্রমিককে মর্যাদা দিয়েছেন যে, তাকে তিনি আল্লাহর শ্রমিক বলে অভিহিত করেছেন। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, শ্রমিক শ্রম গ্রহণকারীর গোলাম নয়।
দুই. শ্রমিককে লাভের অংশ না দেওয়াকে “বঞ্চিত করা” বলে উল্লেখ করেছেন। এতে বোঝা যায় যে, লভ্যাংশে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এটি শ্রমিকের প্রতি শ্রম গ্রহণকারীর কোনো অনুগ্রহ নয়। কেননা, অনুগ্রহ করা থেকে বিরত থাকলে তাকে ‘বঞ্চিত করা’ বলা যায় না।
এ বিষয়টি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপর একটি হাদীসে আরও স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, তোমাদের কারও খাদেম যদি খাবার প্রস্তুত করে নিয়ে আসে তবে তাকে নিজের সঙ্গে খাবারে শরিক করে নিও। কারণ, সে তোমার জন্যই আগুন ও ধোঁয়ার জ্বালা সহ্য করেছে। যদি খাবারের অনুপাতে বেশি লোক থাকে, তবে খাদেমের হাতে সামান্য কিছু তথা এক দুই লোকমা হলেও তুলে দেবে। [সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১৬৬৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস: ৩৮৪৬; মুসনাদে আহমদ, হাদীস; ৭৭১২, ৭৭২৭]
শ্রমিকের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কত বেশি লক্ষ্য ছিল, তার অনুমান এ হাদীস থেকে করা যেতে পারে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পূর্বমুহূর্তে দুনিয়াবাসীকে যে সর্বশেষ উপদেশ দিয়েছিলেন, তা ছিল, নামাযের প্রতি এবং যারা তোমাদের অধীন রয়েছে তাদের ন্যায্য অধিকারের প্রতি তোমরা যত্নশীল থেকো। [সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস: ১৬২৫, ২৬৯৭, ২৬৯৮; মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ৫৮৬, ১২১৬৯, ২৬৪৮৩]
কখনও শ্রমিকদের থেকে ভুল বা অন্যায়-অপরাধ হয়ে যেতে পারে, যার কারণে মালিক পক্ষ ক্ষুব্ধ হতে পারে। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে শান্ত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রতিশোধ নিতে পারার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নিজের ক্রোধকে দমন করতে পারে, আল্লাহ তাআলা তার মন প্রশান্তি ও ঈমানের দ্বারা পূর্ণ করে দেবেন। [মুসনাদুশ শিহাব, হাদীস: ৪৩৭]
এক হাদীসে এসেছে যে, এক সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার কর্মচারীকে কতবার ক্ষমা করব? প্রশ্ন শুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীরব রইলেন। লোকটি আবারও একই প্রশ্ন করলে তখন তিনি বললেন, প্রতিদিন সত্তর বার। [সুনানে তিরমিযী হাদীস: ১৯৪৯]
তাই ফিকহবিদগণ বলেছেন, শ্রমিক যদি ইচ্ছাকৃত সম্পদের ক্ষতিসাধন না করে তবে অনিচ্ছাকৃত ভুলের কারণে যে ক্ষতি হয় তার জন্য শ্রমিকের নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ নেওয়া যাবে না।
লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামেয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা। গ্রন্থ প্রণেতা, অনুবাদক ও গবেষক
Facebook Comments