14.4 C
New York
Saturday, October 18, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 26

বিয়ে ও আমাদের সমাজ

রাসুল সা. বিয়ে করেছেন 25 বছর বয়সে। সুতরাং আমি মনে করি, ছেলেদের 25 এ বিয়ে করাই সুন্নত! না করলে যে সমস্যা তা না। কিন্তু সাবির্ক বিবেচনায় এই বয়সই বিয়ের জন্য পারফেক্ট! কেন? আমার কিছু যুক্তি আমি দিচ্ছি

1.  25 এ বিয়ে করলে সুন্নত আদায় হয়। (মেয়েদের জন্য 17-20) 2. এ বয়সটা হচ্ছে ছেলের বিয়ের জন্য পারফেক্ট সময়! কারণ, এই বয়সে ছেলেদের মধ্যে ম্যাচুরিটি চলে আসে পাশাপাশি রোমান্টিক ভাবটাও বজায় থাকে। বয়স যত বাড়বে, ততই রোমান্টিক ভাবটা ডাইভার্ট হয়ে কর্ম-পেশা, ক্ষমতা ইত্যাদির প্রতি আগ্রহ চলে আসবে।

3.  এ বয়সে বিয়ে না করলে প্রেম করার সম্ভাবনা প্রায় অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকাটাও কঠিন।

4.  25 কে একটা ছেলের জন্য পরিপূর্ণ যৌবন ধরা হয়। সুতরাং 25 বছর থেকে যত দিন লেইট করা হবে ততই তার জন্য ক্ষতিকর!

5.  যেহেতু এই বয়সে একটা ছেলে পরিপূর্ণ যুবক থাকে, সেহেতু যুবক তার সংসারের নানারকম টেনশন মাথায় আসার পূর্বেই স্ত্রীর সাথে প্রেমে লিপ্ত হতে কোনা শরয়ী বাঁধা নাই। বয়স যত বাড়বে, বাচ্চা-কাচ্চা ও সংসারের দায়িত্ব যখন মাথায় আসবে তখন আর নতুন প্রেমকে ঠিকভাবে রোমন্থন করতে পারবে না। আজকাল তো অনেককে এমনও বলতে শুনি, “ধুর মিয়া! বিয়া করলে কি আর বউরে নিয়া ঘুরা যাবে? তখন তো ঘর-সংসার!” অথচ বিয়ের আগে যে ওটা হারাম, কয়জন জানেন? জানলেও মানেন কয়জন?

6.  সন্তাদের যদি প্রপারলি মানুষ করতে চান, তাহলে 25 এ বিয়ের বিকল্প নাই। যত লেইট হবে, বাচ্চা-কাচ্চা তত দেরি করে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সমাজে প্রায়শই দেখা যায়, বাবা হয় বুড়ো হয়ে মারা গেছেন, সন্তানের পড়ালেখা শেষ হওয়ার নাম নাই। আবার এমনও দেখা যায়, বাবা হাসপাতালে পড়ে আছেন বার্ধক্যজনিত কারণে, এদিকে সন্তান টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ জোগাচ্ছেন, পাশাপাশি.. নানারকম টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছেন। আমি মনে করি একজন সফল বাবা হতে হলে সময়মত বিয়েটা খুবই জরুরি। সন্তান মানুষ হওয়ার পিছনে বাবা-মায়ের বড় একটা ভূমিকা রয়েছে, যা অনস্বীকার্য! অনেকে এটাও বলেন, যে, আরে আল্লাহ দেখবেন! এত কিছু দেখলে হবে নাকি? বলি, আল্লাহ কি এসে আপনার সন্তানকে মানুষ করে দিয়ে যাবেন? অথচ যখন বিয়ের বয়স ছিলো, তখন ঠিকই উল্টা-পাল্টা করে বেড়িয়েছেন!

7.  কম বয়সে বিয়ে করলে, নানারকম গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়। যা কিনা যৌবনে একটা মানুষের জন্য সবচে বড় চ্যালেঞ্জ! গোনাহ থেকে বেঁচে থাকাও ইবাদাত কবুলের বড় শর্ত! ইত্যাদি।

আরো অনেকগুলো পয়েন্ট রয়েছে এই মুহূর্তে মনে আসছে না। আরেকটা বড় ব্যাপার হচ্ছে, আমরা সবাই ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করে খুব লাফাই। ওকে ফাইন! ভালো কথা যে,

আপনি ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তিত! যদি আপনি ক্যারিয়ার নিয়েই চিন্তিত হন, তাহলে বউ-সন্তান নিয়ে কেন ক্যারিয়ারের চিন্তা করতে পারেন না? উনাদের নিয়ে কেন দুনিয়া আর আখেরাতের স্বপ্ন দেখতে পারেন না?

মরার পর কৃতকর্মের হিসাব যদি না নেওয়া হতো, তাইলে বিয়ে না করে নানারকম অপকর্ম করলেই বা কি! তাই না? কিন্তু আপনি যদি আল্লাহতে বিশ্বাসী হন! তাহলে ক্যারিয়ারটা আপনার বউ-বাচ্চাকে নিয়েই গঠন করুন না কেন? আপনার ভালো ক্যারিয়ার হলে, ভোগ করবে কে? সবাই না? তাহলে কেন আপনি এত সময় নষ্ট করছেন? ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করে আবার গোনাহও করছেন! আজকাল অনেকের মাথায় এটা কাজ করে, আল্লাহ! হাজবেন্ডকে নিয়ে ঘুরবো কেমনে! বা বউকে নিয়ে ঘুরবো কেমনে? মানুষ কি বলবে! মানুষ কি বলবে সেটা কেন আপনি দেখেন? আপনি মানুষেরটা খান না পড়েন? আপনার হিসাব কি মানুষ দিয়ে দিবে? আপনি যদি আপনার বউকে নিয়ে ঘুরেন তাইলে সমস্যা কি? সমাজ কি বলবে, সেটা ভুলে যান। আল্লাহ কি বলে সেটা দেখেন।

আজকাল আমাদের সমাজে মেয়ের-ছেলের ফ্যামিলি দ্বীনদারি যতটা না দেখেন, তার থেকে বেশি দেখেন, ছেলে-মেয়ে দেখতে কেমন, ক্যারিয়ার কেমন, ইত্যাদি ইত্যাদি! অথচ, হাদিস অনুযায়ী আমরা কেউ দ্বীনদারী দেখি না। দেখি না জাত-বংশ। আমাদের কাছে বাহ্যিক রুপ-লাবন্য আর সৌকর্ষ এখন মহা আগ্রহের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, সংসারী আর সুখী হওয়ার জন্য, রূপ-লাবন্য, টাকা-পয়সা কিছুই কাজে আসে না। মারা গেলে টাকা-পয়সা তো দূরে থাকে, কোমড়ে যদি সামান্য সুতাও বাঁধা থাকে, সেটাও খুলে রাখা হয়, শুধু কাফনে জড়িয়ে 3.5 হাত জায়গা জোটে। তাও একসময় শরীর পচেঁ-গলে শেষ হয়ে যায়। কী থাকে?

সবচে বড় বিষয়, আমরা সমাজ সমাজ, নিয়ে লাফাই। সমাজ কি বলবে সেটা ভাবি। হ্যাঁ, সেটা ভাবা উচিত যদি খারাপ কাজের বিরুদ্ধে হয়। ভালো কাজে সমাজ পরে, আগে শরীয়ত ও ধর্ম! অথচ, আমরা ধর্ম ভুলে ভালো কাজ না করার জন্য সমাজের কথা শুনি। সবকিছু আজ উল্টো হয়ে গেছে। ভালো কাজকে আমরা খারাপ মনে করি, খারাপকে ভালো মনে করি সমাজের দোহাই দিয়ে। অথচ এই সমাজ আপনার হিসাব দিবে না। আপনি বিপদে পড়লে, আপনি গোনাহ করলে সমাজ আপনাকে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে না যে, মাফ করে দেন একে!


বিয়ে নিয়ে এই লেখাটা পড়তে পারেন  ভালবাসা ও দু’টি বাস্তবতা


কার পিছনে আমরা দৌঁড়াচ্ছি ভাই? একটুও কি ভাবছি? হায়! কবে বুঝবো আমরা? নিজে তো গোনাহ করছি, অন্যকেও উৎসাহ দিচ্ছি। গোনাহ থেকে তো ফিরাচ্ছিই না। অনেক আলেম পরিবারই এমন রয়েছেন, সাধারণ মানুষের কথা আর কি বলবো? যাঁদের মুখে মুখে তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহর উপর ভরসা করার কথা বললেও সেই তাঁরাই বাস্তবে সেটা মানতে নারাজ। মানে সুবিধাবাদি আর কি! ছেলে তো ইনকাম করে না, কি খাওয়াবে? আমরা মেয়ে দিবো না এমন ছেলের কাছে। বউ পালবে কীভাবে? ইত্যাদি!

বলি, তখন কি আল্লাহ থাকেন না? অথচ হাদিসে রয়েছে, একবার এক দরিদ্র সাহাবি রা. নিজের দরিদ্রতার কথা বললে, রাসুল সা. তাঁকে বিয়ের পরামর্শ দিয়েছিলেন। পরে ওই সাহাবি রা. এর আর কোনো অভাব-ছিলো না। আসলে, বিয়ে করলে একটা মানুষ আসবে, মানুষ বাড়বে এই চিন্তা থেকে কেন আমরা বেরিয়ে আসতে পারি না? আমরা কেন এটা বুঝি না যে, একটা মানুষ বাড়লে কি, সে তো তাঁর নিজের রিজিক নিয়েই আসবেন আমাদের ঘরে। বিশ্বাসটা মুুখে মুখে না রেখে, অন্তরে যদি আজ মুসলিমরা লালন করতো, তাহলে এতটা অধ:পতন হতো না। আল্লাহ মাফ করুক। আমিন।

পরিশেষে একটাই কথা, যত বেশি তাড়াতাড়ি বিয়ের প্রচলন ঘটবে, সমাজে ততটাই অপকর্ম কমে যাবে ইনশা-আল্লাহ ! তখন ধর্ষণ, শ্লীলতাহানী সহ নানারকম অপকর্মই কমে যাবে ইনশা আল্লাহ! আমরাই কিন্তু সমাজকে বানাই। আবার আমরাই সমাজ নিয়ে লাফাই! আসলে আমরাই তো সমাজ। তাই নয় কি? তাহলে কেন মিথ্যা জিনিষকে আমাদের অবশ্য কর্তব্য ধরে নিচ্ছি? যেখানে আমাদের কোনো দুনিয়া ও আখিরাতে উপকার নাই? আল্লাহ আমাদের প্রতিটি বাবা-মাকে ইখলাস, তাওয়াক্কুল ও সঠিক পথে পরিচালিত করুন। সেই সাথে সাথে আমরা যারা সন্তান রয়েছি। তাদেরও । আমিন।

ইসলাম যে সত্য ধর্ম তার প্রমাণ কি?

প্রশ্ন: সব ধর্মের মানুষই তো বলে তার ধর্ম সত্য। ইসলাম যে সত্য ধর্ম তার প্রমাণ কি?

উত্তর:

আর ওদেরকে যখন বলা হয় ‘আল্লাহ্‌ যা অবতীর্ণ করেছেন তোমরা তার অনুসরণ করো,’ তারা বলে, ‘না, না, আমাদের পূর্বপুরুষদের যেমন দেখেছি আমরা তা-ই অনুসরণ করব’। যদি শয়তান তাদেরকে জ্বলন্ত আগুনের দিকে ডাকে, তবুও কি? – সূরা লুক্বমান (৩১:২১)

আপনার কাছে কেউ যদি এসে বলে, ২ আর ২ যোগ করলে ৩ হয়, কেউ যদি এসে বলে ৪ হয় আর কেউ যদি বলে ৫ হয় – তখন আপনি তাদের বিবাদ মিটানোর জন্য কি করবেন? আপনি আপনার যুক্তি ও বুদ্ধি প্রয়োগ করবেন, এবং যেই উত্তরটাকে আপনি প্রমাণ করতে পারবেন সেটাইকেই সত্য বলে গ্রহণ করবেন। পৃথিবীর সব কিছুই যেহেতু আমরা যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে আমরা বিচার করি, তাহলে কোন্‌ ধর্ম সত্য তা বুঝার জন্যও আমরা কেন যুক্তি আর বুদ্ধি ব্যবহার করব না?

বলুন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তবে প্রমাণ উপস্থাপন করো। – (সূরা বাক্বারাহ্‌ ২:১১১)

আপনি যদি কোন অমুসলিমকে জিজ্ঞেস করেন – তুমি কিভাবে প্রমাণ করবে যে তোমার ধর্ম সত্য? বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আপনি যে উত্তর পাবেন তা হলো – আমি আমার ঈশ্বরকে ডেকে প্রার্থনা করলে তা কবুল হয়, সুতরাং আমার ধর্মই সত্য ধর্ম। আসলে এটা কোন প্রমান হলো না। যদি প্রার্থনা কবুল হওয়াই কোন ধর্ম সত্য কিনা তা প্রমাণ করতে পারে তাহলে পৃথিবীর সব ধর্মই সত্য, কারণ সব ধর্মের মানুষেরই বিভিন্ন প্রার্থনা কবুল হয়ে থাকে। কিন্তু, বিভিন্ন ধর্মগুলোর মধ্যে কনফ্লিক্টিং ব্যাপার থাকার কারণে সব ধর্মই সত্য হতে পারে না।

কোনো ধর্ম সত্য না মিথ্যা তা প্রমান করার জন্য আমাদেরকে সেই ধর্মের গ্রন্থগুলোর দিকে ফিরে যেতে হবে। যেহেতু সব ধর্মের মানুষই দাবী করে তাদের ধর্মগ্রন্থ তাদের ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে , কাজেই সেই ধর্মের গ্রন্থে সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই এমন কিছু দিয়ে দেবেন যার দ্বারা মানুষ বুঝতে পারবে যে ঐ ধর্মটা সন্দেহাতীতভাবে সত্য।

ইসলামে ধর্মের সত্যতার অসংখ্য প্রমান আছে, যেমন স্রষ্টার সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য (তাওহীদ), কোরআনের কাব্যিক, বৈজ্ঞানিক, সংরক্ষণ সহ বিবিধ আশ্চর্য বিষয়, রাসূলুল্লাহ(সা) এর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ইত্যাদি। কিন্তু, এই লেখায় আমি শুধু একটি প্রমানের কথাই বলব – সেটা হলো তাওহীদ।

যে কোন ধর্মেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অংশ হচ্ছে স্রষ্টা ও তাঁর বৈশিষ্ট্য। কাজেই, কোন ধর্ম স্রষ্টার সংজ্ঞাই যদি ঠিক মত দিতে না পারে তাহলে তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য ধর্ম হতে পারে না। আপনি ইসলাম ছাড়া পৃথিবীর অন্য যে কোন ধর্ম নিয়েই পড়াশুনা করতে যান, আপনাকে সেই ধর্মের প্রচারকেরা বলবে যে স্রষ্টার অস্তিত্ব একটা আবেগীয় ব্যাপার, এটা প্রমান করা সম্ভব না, এটা তর্ক-বিতর্কের বিষয় না, অথবা তারা স্রষ্টার এমন সব বৈশিষ্ট্যের কথা বলবে – যে আপনি অবশ্যই কনফিউজড হয়ে পড়বেন । স্রষ্টার সংজ্ঞার ব্যাপারে একমাত্র ইসলাম ধর্মই ব্যতিক্রম। সুরা ইখলাসে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তা’আলার বৈশিষ্ট্য এত সুন্দর করে বর্ণনা করে হয়েছে, যে এরপর স্রষ্টা সম্পর্কে আর কোন দ্বিধা-দ্বন্দের অবকাশ থাকে না।

বলুন – তিনিই আল্লাহ্‌, এক ও অদ্বিতীয়। সবাই তার মুখাপেক্ষী, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি। এবং কেউই তার সমকক্ষ নয়। – সূরা ইখলাস (১১২:১-৪)

আমার আগের লেখায় যুক্তি দিয়ে আল্লাহ্‌র অস্তিত্বের যে প্রমান দেয়া হয়েছে, আল্লাহ্‌র যে বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা বলা হয়েছে, পৃথিবীর আর কোন ধর্মই আল্লাহ্ সম্পর্কে আপনাকে এত যৌক্তিক ও সরল উত্তর দিতে পারবে না। আল্লাহ্‌ এক, তার সাথে তুলনা করা যায় এরকম আর কিছুই নেই, তিনি সর্বশক্তিমান, তাই সব মাধ্যম ছেড়ে সরাসরি তার ইবাদত করতে হবে – এর চেয়ে সহজ আর কিছু হতে পারে? তাওহিদের বানী এতটাই সরল ও সহজাত যে কোনও মানুষ – সে শিক্ষিতই হোক আর অশিক্ষিতই হোক, তরুনই হোক আর বৃদ্ধই হোক – খুব সহজেই এটা তার হৃদয়ে ক্লিক করে।

আল্লাহ মানুষকে এক স্রষ্টায় বিশ্বাসের সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।  ইসলামের ভাষায় একে ফিতরা বলে। পৃথিবীর ২০টিরো বেশী দেশে অন্য ধর্ম থেকে ইসলামে ফিরে আসা মানুষদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, তাদের মুসলিম হওয়ার পেছনে সবচাইতে বেশী যা তাদের প্রভাবিত করেছে তা হলো – আল্লাহ এক (তাওহীদ) [সূত্র: Contemporary Issues – Dr. Bilal Philips]।

আপনি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মে প্রতিষ্ঠিত রাখুন। আপনি ফিতরাহ্‌ এর অনুসরণ করুন, যা দিয়ে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্‌র সৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন করা না হোক। এটাই সরল ধর্ম; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। -সূরা রুম (৩০:৩০)

আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় এক ইসলাম ছাড়া পৃথিবীর আর সকল ধর্মে God এর ধারনা বেশ কনফিউজিং।  হিন্দু ধর্মে ঈশ্বরের ধারণা বেশ জটিল। হিন্দুরা এক ব্রাক্ষ্মণ-এ বিশ্বাস করলেও তাদের চারটি সেক্ট (saivism, shaktism, vaishnavism, smartism) এর ভিন্ন ভিন্ন দেবতা আছে [২]। এই চার সেক্ট ঈশ্বরকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকে, ভিন্ন ভিন্ন মূর্তি বানায় এবং তাদের ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণাও ভিন্ন। কিন্তু, সব সেক্টই প্যান্থেইসম-এ বিশ্বাস করে। যার অর্থ হচ্ছে – স্রষ্টা আর সৃষ্টির মধ্যে কোন পার্থক্য নাই, যা কিছু আমরা দেখি তার সবই স্রষ্টা আর সবই সৃষ্টি। এই বিশ্বাসের ফলে হিন্দুরা মূর্তি, পাথর, গাছ, এমনকি কেউ কেউ শিশ্ন আর যোনিকেও পূজা করে, বেশীরভাগ হিন্দু গোমূত্র আর গোবরকে পূজার উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করে।  হিন্দু ধর্মের ঈশ্বর পৃথিবীতে দেবতা রূপে এসে ধর্ষণ, পরকীয়াসহ এমন সব কাজ করে যা কিছুতেই সৃষ্টিকর্তার কাজ হতে পারে না [৩]।

অন্যদিকে, খ্রীষ্টানরা বলবে ঈশ্বর তাঁর ছেলে যীশুকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন এবং মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে স্যাক্রিফাইস পর্যন্ত করেছেন।  কিন্তু মানুষের সন্তান যেমন মাছ হতে পারে না, তেমনি  অসীম ঈশ্বরের সন্তান কিভাবে সসীম মানুষ হতে পারে তা বোধগম্য নয়। নিজে ‘ঈশ্বর’ হওয়া সত্ত্বেও তিনি মানুষের মতই খাওয়া-দাওয়া করতেন, ঘুমাতেন, ঈশ্বরের কাছে সেজদা করতেন, তাঁর সাহায্য চাইতেন, এমনকি সাধারণ মানুষেরা মিলে এই ‘ঈশ্বর’কে হত্যা পর্যন্ত করে ফেলেছে!  শুধু তাই না, খ্রীষ্টানদের ঈশ্বর পুরো মহাবিশ্বের পালনকর্তা হলেও তার ক্ষমতা এতই সীমিত যে স্বর্গে আদম তাকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে [৪]! বাইবেলে ইব্রাহিম(আ) কে নবী বলা হয়েছে, বাইবেলের ইব্রাহিম(আ) কিন্তু ট্রিনিটি (তিন ঈশ্বরের ধারণা) প্রচার করেননি, তিনি এক ঈশ্বরের কাছেই মানুষকে আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন অর্থাৎ তিনি ইসলাম ধর্মই প্রচার করেছেন।

অন্যদিকে ইহুদীরা বলে তারা আল্লাহ্‌র Chosen People. ইহুদী হয়ে জন্মাতে হয়, ইহুদীতে ধর্মান্তরিত হওয়া যায় না [১]। ইহুদীরা বলে ঈশ্বর নিষ্ঠুর, তারা ঈশ্বরকে অভিশাপ দেয় কারণ তাদের উপর একের পর এক গজব নেমে এসেছিল। আর, বৌদ্ধ ধর্ম তো স্রষ্টা সম্পর্কে কোনো স্বচ্ছ ধারণাই দেয় না।

মোদ্দা কথা, পৃথিবীর বাকী সব ধর্মে সৃষ্টিকর্তার সংজ্ঞা এত কনফিউজিং, কোন চিন্তাশীল মানুষ সহজেই বুঝতে পারবে যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম সত্য ধর্ম হতে পারে না।

তবে কি ওরা কোরআন সম্বন্ধে মন দিয়ে চিন্তা করে না? নাকি ওদের অন্তরে তালা লেগেছে? – সূরা মুহাম্মাদ (সা) (৪৭:২৪)

রেফারেন্স:

১। Islam: The Religion Of Truth by Abdur Raheem Green

২। Concept of God in Hinduism – Hindu Students Association

৩। Krishna on Hinduism, Lot in Bible – Dr. Zakir Naik

৪। How the Bible led me to Islam – Yusha Evans

===================

লেখক – আদনান ফয়সাল

ভালোবাসার বানিজ্য- কয়েকটি অপ্রিয় সত্যকথন

ভ্যালেন্টাইন ডে অর্থ কি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস? সংসদ অভিধানের ১২৫৪ পৃষ্ঠায় ভ্যালেন্টাইন শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে ‘দ্যা নেইম অব টু সেইন্টস (দু’জন খ্রিস্টান ধর্মযাজকের নাম)’। সেখানে আরো উল্লেখ আছে, ভ্যালেন্টাইন অর্থ- ‘এক বছর ধরিয়া বর কনে হিসেবে খেলিবার জন্য নির্বাচিত বর বা কনে’।

ইতিহাস বলে, যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগে চতুর্থ শতকে পৌত্তলিক, মূর্তিপূজারীরা তাদের পশুর দেবতা ও জমির উর্বরতার দেবতা লুপারকালিয়ার সম্মানে ১৪ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। অনুষ্ঠানে যুবতীদের নামে লটারি ইস্যু করা হতো। লটারিতে যে যুবতী যে যুবকের ভাগে পড়তো পরবর্তী এক বছর ওই যুবক সে যুবতীকে ভোগ করতো। এভাবেই শুরু হয় দিবসটির উদযাপন। পরবর্তিতে ৪৯৬ সালে ভ্যালেন্টাইন নামক এক খ্রিস্টান পাদ্রির নামে ভ্যালেন্টাইনস ডে নামে তা রূপান্তরিত হয়।

কই? এখানে তো কোথাও ভালোবাসার কথাই নেই। তাহলে এখানে ভালোবাসা আসলো কোত্থেকে? আসলে প্রথমেই অশ্লীলতার কথা বললে অনেকেই হয়তো গ্রহণ করবে না; তাই, এখানে ভালোবাসার মোড়ক লাগানো হয়েছে। প্রস্রাবের বোতলের ওপর ‘আতর’ লিখে দিলেই যেমন তা পাক হয়ে যায় না তেমনি অবাধ যৌনতায় উদ্বুদ্ধকারী ভ্যালেন্টাইনের সাথে ভালোবাসার মোড়ক লাগালেই তা শুদ্ধ হয়ে যায় না। 

অন্যদিকে আভিধানিকভাবেই এর অর্থ- ‘এক বছর ধরিয়া বর কনে হিসেবে খেলিবার জন্য নির্বাচিত বর বা কনে’। প্রশ্ন হলো, এই নির্বাচিত তরুণ-তরুণী ১ বছর ধরে যে খেলাটি খেলবে তা কী? এক্কাদোক্কা, লুডু, কাবাডি, ফুটবল, ক্রিকেট বা কম্পিউটারের গেম খেলা? না। বরং এ হলো সেই খেলা যার ফলে পৃথিবীতে জারজ সন্তানের জন্ম হবে। চারিত্রিক পবিত্রতা বিনষ্ট হবে। নারী-পুরুষের ব্যক্তিত্ব নষ্ট হবে। দুরারোগ্য ব্যাধি হবে।

আমাদের দেশের অতি উৎসাহী কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া বেশ আগে থেকেই দিনটিকে সামনে রেখে পরিকল্পনা করে থাকে। তাদের একটি বড় উদ্দেশ্য থাকে বিজ্ঞাপন প্রাপ্তি ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া। হোটেল, বিনোদন কেন্দ্রগুলো অধীর আগ্রহে থাকে দিনটির জন্য। মূলত শুধু একালে নয়; শুরু থেকেই বাণিজ্যিকীকরণের হাত ধরেই ভ্যালেন্টাইন ডে ছড়িযে যায় বিশ্বজুড়ে। ১৮৪০ সালে সর্বপ্রথম ভ্যালেন্টাইন কার্ড বের করে পশ্চিমারা। ব্যাপক প্রচারের কারণে প্রায় পাঁচ হাজার ডলারের কার্ড বিক্রি হয় ওই বছর। পরবর্তিতে এ দিবসে বিভিন্ন ধরনের ভ্যালেন্টাইন কার্ড ও গোলাপ ফুল আসল মূল্যের তিন-চারগুণ হারে বিক্রি হয়। তখন থেকেই ধান্দাবাজ পশ্চিমা ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়িক ও পুঁজিবাদী চিন্তা নিয়ে এ দিবসটিকে বিশ্বজুড়ে ছড়ানোর চেষ্টা করে। এভাবেই শুরু হয় ভালোবাসা নিয়ে রমরমা বাণিজ্য।

বাণিজ্যিক ভালোবাসার দিবসটিতে কী করা হয়? কী ভালোবাসা! ভ্যালেন্টাইন ডে অর্থ যদি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হয় তাহলে ঘটা করে দিনটি পালনকারীরা গরিব-দুখী অনাহারিদের জন্য সাহায্যের হাত প্রসারিত করে না কেন? মূলত বিভিন্ন দিবসের প্রচলনের মাধ্যমে যুবক-যুবতীদের চরিত্র নষ্ট করে দিতেই তাদের এহেন প্রয়াস।

যে কারণে তারা সেদিন ছুটে যায় না হাসপাতালের বেডে পড়ে থাকা একজন রোগীর সেবায়, রেল লাইন কিম্বা ফুটপাতে শুয়ে থাকা শীতার্ত মানুষের শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করে দিতে উদ্যোগ গ্রহণ করে না। তারা শুধু শেখায় কিভাবে অশ্লীলতার চর্চা করতে হবে। যুগলবন্দি হয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরা, অবাধ মেলামেশাই যে ভালোবাসার সাধারণ দৃশ্য। এর মাধ্যমে আমাদেরকে ফ্রি সেক্স, লিভিং টুগেদারে উৎসাহিত করাই টার্গেট। তাদের ভালোবাসার টার্গেট একমাত্র তরুণ-তরুণী। সরকার যদি ঘোষণা করে যে, এবারের ভ্যালেন্টইন ডে-তে ১০ থেকে ৪০ বছর বয়সী কোনো মহিলা ভ্যালেন্টাইন ডেতে পার্ক বা বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে যেতে পারবে না তাহলেই এ কথিত ভালোবাসা উধাও হয়ে যাবে।

 

বাণিজ্যিক ভালোবাসার দিবসটির কোনো ভিত্তি কি আমাদের সংস্কৃতিতে আছে? না। সংস্কৃতির উৎস হচ্ছে তিনটি- ১. ধর্ম, ২. দেশ, ৩. মাতৃভাষা। ইসলাম নামক শান্তির একমাত্র জীবন বিধানে কি এর কোনো ভিত্তি আছে? আজকে যে সব মিডিয়াকর্মী বিজ্ঞাপন পাওয়া কিংবা অন্য কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এ দিবসটিকে ছড়াতে উঠেপড়ে লেগেছেন তারাও কি প্রমাণ করতে পারবেন যে, ভ্যালেন্টাইন ডে আমাদের বাংলাদেশীয় সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত? তাদেরকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, ভালোবাসা দিবসকে তারা পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আমদানি করেছেন।

আমাদের মাতৃভাষা বাংলার সঙ্গেও এর কোনো সম্পর্ক নেই। তাই, এ ভালোবাসা দিবস আমাদের সংস্কৃতি নয়; বরং তাদের সংস্কৃতি, যাদের সমাজে কুমারি মাতা হওয়াকে স্বাভাবিক মনে করা হয়। যে জাতি তাদের কৃষ্টি-কালচার ও ধর্মীয় চেতনাকে বাদ দিয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতিকে লালন করে তারা কখনো স্বকীয়তা নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। ভ্যালেন্টাইনস ডের প্রেমিকরা কি একবারো তা চিন্তা করেছেন যে, এর মাধ্যমে আমাদের জাতীয় স্বকীয়তা তার অস্তিত্ব হারাতে চলেছে। হারাবো অনেক কিছু; পাবো না কিছুই। হ্যাঁ, ফুল, কার্ড মদ ব্যবসায়ীদের এতে বাণিজ্য করে লাভবান হবার সুযোগ হলেও সাধারণ মানুষের জন্য এতে পাবার নেই কিছুই। আছে শুধুই হারাবার। আপনার পুত্র-কন্যা হারাবে তাদের মহামূল্যবান চরিত্র।

একজন যুবক হয়তো মনে মনে ভাববেন, আজো লটারির মাধ্যমে এক বছরের জন্য যৌনসঙ্গী পাওয়া গেলে তা অসমর্থনের কী! হে যুবক ভাই, তাহলে তো আপনার যুবতী বোনকেও তো কেউ না কেউ পণ্যের মতো লটারির মাধ্যমে ১ বছর ভোগ করত। তা কি আপনি সমর্থন করতেন?
আমাদের ছোট্ট বাংলাদেশে হত্যা, গুম, ধর্ষণ, ছিনতাই যেখানে বেড়েই চলেছে; ইয়াবার মতো মারাত্মক মাদকের লাগাম টেনে রাখা যাচ্ছে না; এইডসের মতো মহামারি ছড়াচ্ছে দ্রুত; সেখানে কেন এই অপরাধ উস্কে দেয়ার এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন? নিজেদের ফাইভ স্টার হোটেল, নাইট ক্লাব কিম্বা বিনোদন কেন্দ্রগুলোর রমরমা ব্যবসা জমাতে কেন বছরের কিছু দিনে অশ্লীলতার অবৈধতাকে বৈধ করে দেয়ার অপচেষ্টা? 

অনেকেই হয়তো ভাবছেন, বিজাতীয় সংস্কৃতি হোক না, আমাদের সন্তানরা একটু আনন্দ করবে এতে সমস্যা কোথায়? আপনাকে মনে রাখতে হবে আপনার সন্তান প্রথম মাদক গ্রহণের পূর্বে কিন্তু আপনার অনুমতি নেবে না। আপনার কলিজার টুকরা সন্তান হয়তো ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপন করতে যেয়েই জীবনের প্রথম মাদকের বিষাক্ত ছোবলে অক্রান্ত হবে। আপনার সব স্বপ্ন মিশে যাবে মাটির সাথে। একটি রাত কিম্বা দিনই হবে আপনার পুরো জীবনের কান্নার কারণ। তাই, এখনই সতর্ক হতে হবে। নিজেদের সন্তানকে বিরত রাখতে হবে কথিত ভালোবাসার চর্চা থেকে।
ভালোবাসার কোনো দিন-ক্ষণ নেই। ভালোবাসা বিশেষ কোনো দিনের ফ্রেমে বন্দি না হয়ে উন্মুক্ত থাকুক। পবিত্র থাকুক, অবারিত হোক এর চিরন্তন ধারা। আমাদের মধ্যে চর্চা হোক শুদ্ধ সংস্কৃতির; বিলুপ্ত হোক ভ্যালেন্টাইনস ডে অপসংস্কৃতি।

এই লেখাটিও পড়তে পারেন-ভালবাসা-ও-দুটি-বাস্তবতা

============

লেখক– যুবায়ের আহমাদ

প্রচলিত এমন অনেক বিষয় আমরা হাদীস বলে জানি-মূলত সেগুলো হাদীস নয়।

‘‘জ্ঞান-সাধকের দোয়াতের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে মূল্যবান’’ এ কথাটি  হাদিস হিসেবে জনশ্রুতি থাকলেও হাদীস বিশারদগণের নির্ভরযোগ্য মতানুসারে এটি হাদীস নয়; বরং পরবর্তী কারো বাণী। ইমাম সাখাবী রাহ. ‘আল মাকাসিদুল হাসানাতে’ ( পৃ. ৪৪২, বর্ণনা: ১০০৫ ) এটিকে হাসান বসরী রাহ.-এর বাণী বলে উল্লেখ করেছেন।

শাওকানী রাহ.,যারকাশী রাহ.,তাহের পাটনী রাহ.-সহ আরো অনেক হাদিস বিশারদ এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।

(দেখুন: আল ফাওয়াইদুল মাজমূআ, খ. ১ পৃ. ২৮৭, বর্ণনা: ৫৩; আললাআলিল মানছূরাহ,  পৃ. ১০১, বর্ণনা: ১০; আল আসারুল মারফূআ ২০৭; কাশফুল খাফা, খ.২ পৃ.২০০; তাযকিরাতুল মাওযূআত খ. ২ পৃ. ৩৬৯; মিযানুল ইতিদাল খ.৩ পৃ. ৪৯৮।)

সুতরাং এটিকে হাদীস হিসেবে বলা উচিত নয়।


এটা পড়তে পারেন-নামায মুমিনের মেরাজ-আঠারো হাজার মাখলুকাতঃ এগুলো কি হাদীস ?


এটি হাদীস নয় : ফিরিশতারা গুনাহ মাথায় নিয়ে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন

কোনো ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশের সময় ফিরিশতারা তার গুনাহ মাথায় করে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন, যাতে গুনাহসহ কোনো ব্যক্তিকে পবিত্র মসজিদে প্রবেশ করতে না হয়। ওই ব্যক্তি বেশি দেরি করলে একসময় ফিরিশতারা বলেন, আল্লাহ! তার গুনাহ বহন করতে আমাদের তো খুব কষ্ট হচ্ছে। তখন আল্লাহ বলেন, গুনাহগুলো সমুদ্রে ফেলে দাও।

মসজিদে যত বেশি সময় কাটানো যায় ততই ভালো। কিন্তু মসজিদে বেশি সময় অবস্থান করার প্রতি উদ্বুদ্ধকারী উপরোক্ত বর্ণনার কোনো ভিত্তি নেই। নামাযের পর পবিত্র অবস্থায় নামাযের স্থানে বসে থাকলে ফিরিশতা মাগফিরাতের দুআ করে – হে আল্লাহ তাকে মাফ করে দিন, তার প্রতি রহম করুন। (সহীহ বুখারী, হাদীস:৬৫৯) এক নামাযের পর আরেক নামাযের অপেক্ষায় থাকলে গুনাহ মাফ হয়। (সহীহ মুসলিম, হাদীস:২৫১) কিন্তু ফিরিশতারা গুনাহ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন আর দেরি করে বের হলে কষ্টের কারণে তা সমুদ্রে ফেলে দেন- গুনাহ মাফ হওয়ার এই আজগুবি কাহিনীর কোনোই ভিত্তি নেই। এ ধরনের কল্পিত বিষয় বলা আবার হাদীস হিসেবে বলা অনেক বড় অন্যায়।

এটি কি হাদীস : সালাম দিলে নববই নেকী আর জওয়াব দিলে দশ নেকী

উপরের কথাটা বেশ প্রসিদ্ধ। কেউ কেউ প্রশ্ন করে থাকেন যে, এটা হাদীস কি না? আমাদের জানামতে এ কথাটা হাদীসের প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে নেই। বরং একটি সহীহ হাদীসে এসেছে যে, সালামে শুধু ‘আস্সালামু আলাইকুম’ বললে দশ নেকী, ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বৃদ্ধি করলে বিশ নেকী এবং ‘ওয়া বারাকাতুহ’সহ পুরো সালাম বললে ত্রিশ নেকী পাওয়া যায়।

দেখুন : সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ৫১৫৩, জামে তিরমিযী হাদীস : ২৬৮৯

এজন্য ওই প্রচলিত কথাটির পরিবর্তে উপরোক্ত হাদীসে উল্লেখিত বিষয়টি প্রচার করা উচিত। 

মায়ের গর্ভে কী আছে – এটা কি একমাত্র আল্লাহই জানেন ?

নাস্তিক প্রশ্ন: একমাত্র আল্লাহ জানেন গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে(Quran 31:34), যা অন্য কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয় (Sahih Bukhari 2:17:149) ! তিনি কি জানতেন না ভবিষ্যতে আল্ট্রাসনোগ্রাফি আবিষ্কৃত হবে?

উত্তরঃ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে—
“নিশ্চয় আল্লাহর কাছেই কিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং মাতৃগর্ভে যা থাকে, তিনি তা জানেন। কেউ জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে, এবং কেউ জানে না কোন স্থানে সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।”
(কুরআন, লুকমান ৩১:৩৪)

রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ গায়বের কুঞ্জি হল পাঁচটি, যা আল্লাহ ব্যতিত কেউ জানে না।

কেউ জানে না যে আগামীকাল কী ঘটবে। কেউ জানে না যে মায়ের গর্ভে কী আছে। কেউ জানে না যে, আগামীকাল সে কী অর্জন করবে। কেউ জানে না যে, সে কোথায় মারা যাবে। কেউ জানে না যে, কখন বৃষ্টি হবে।
[সহীহ বুখারী :: খণ্ড ২ :: অধ্যায় ১৭ :: হাদিস ১৪৯]


এ লেখাটি পড়তে পারেন- যুক্তি নয় বিশ্বাস- আল্লাহ কী সব সংশয়ের উত্তর দিতে বাধ্য ?


এখানে আলোচ্য আয়াত বা হাদিসে কোথাও এটা বলা হয়নি যে—“একমাত্র আল্লাহ জানেন গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে।” ছেলে বা মেয়ের কথাই আলোচ্য আয়াত বা হাদিসে আসেনি। এটি অভিযোগকারীরা নিজে থেকে যোগ করেছে কুরআন ও হাদিসের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার জন্য। আলোচ্য আয়াত ও হাদিসে বলা হয়েছে যে—মাতৃগর্ভে যা থাকে, আল্লাহই তা জানেন এবং তিনি ছাড়া কেউ জানে না।

এখানে “মায়ের গর্ভে কী আছে” বলতে শুধুমাত্র ছেলে সন্তান বা মেয়েসন্তানই বোঝায় না বরং এর সাথে সাথে সেটি সুস্থ সন্তান নাকি অসুস্থ সন্তান, কীরকম হায়াতপ্রাপ্ত সন্তান,নেক সন্তান নাকি পাপী সন্তান, কীরকম রিযিকপ্রাপ্ত সন্তান—এই সব কিছুকেই বোঝায়। “মায়ের গর্ভে কী আছে” বলতে এর সবগুলোকেই বোঝায় এবং এই সমস্ত তথ্য সম্পর্কেই আল্লাহ তা’আলা অধিক জ্ঞাত। কীরকম হায়াতপ্রাপ্ত সন্তান,নেক সন্তান নাকি পাপী সন্তান, কীরকম রিযিকপ্রাপ্ত সন্তান—আল্লাহ ব্যতিত আর কারো পক্ষে এইসব তথ্য জানা সম্ভব নয়। আল্ট্রাসনোগ্রাফি বা অন্য কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এগুলো জানা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

এগুলো হচ্ছে গায়েবের সংবাদ যা কোন মানুষের পক্ষে জানা অসম্ভব; যেমনভাবে কেউ জানে না পরদিন সে কী উপার্জন করবে বা কোন দেশে সে মারা যাবে। এমনকি ১০০% নিখুঁতভাবে এটাও বলা সম্ভব না যে কখন বৃষ্টি হবে।আবহাওয়াবিদগণ শুধুমাত্র একটা সম্ভাব্যতা বলতে পারেন, কিন্তু তা কখনো শতভাগ নির্ভুল হয় না।

কাজেই আলোচ্য আয়াত ও হাদিসে যথার্থরূপেই বলা হয়েছে যে—একমাত্র আল্লাহই জানেন মায়ের গর্ভে কী আছে।

হৃদ‌য়ে আঁ‌কি মহাম‌া‌নবের ছ‌বি-যার আগমনে ধন্য হল এ ধরা

হিজরত-মদিনায় হিজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাই‌হি ওয়া সাল্লা‌মের আহ্বা‌নে ইসলামের প্রতি উৎসাহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন মদীনা থে‌কে মক্কায় হজ্ব কর‌তে আসা মদীনার বা‌রোজন লোক। তারা মূলত হজ্জ করতে এসে ইসলামের দাওয়াত পেয়েছিলেন।

তারা আকাবা নামক স্থানে নবী‌জির কাছে শপথ করেন যে, যে কোনো অবস্থায় নবী মুহাম্মাদকে আমরা রক্ষা করবো এবং মানুষ‌কে ইসলামের দাওয়াত দিবো। আমরা ইসলাম প্রসারে কাজ করবো এক‌নিষ্ঠভ‌া‌বে। এই শপথ আকাবার শপথ না‌মে প‌রি‌চিত। সময়‌টি ছি‌লো নবুওয়‌তের বা‌রোতম বছর। নবুওয়‌তের তেরতম বৎস‌রে সংগ‌ঠিত হয় ‌দ্বিতীয় বাইআ‌তে আকাবা। ‌সে বাইয়া‌তে অংশ নেন মদীনার সত্তরজন পুরুষ ও দুজন নারী।

মাদীনাবাসীরা রাসূল‌কে মদীনায় গম‌নের আমন্ত্রণ জানা‌লেন। তা‌দের আগ্র‌হে কোন কম‌তি ছি‌লো না। রাসূ‌লের প্রতি তা‌দের ভা‌লোবাসা ‌ছি‌লো আক‌াশচুম্বি। ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য জানমাল কুরবান কর‌তে প্রস্তুত ছি‌লেন সবাই। মক্কার কা‌ফের‌দের অত্যাচারে অসহ্য হ‌য়ে কেউ হিজরত কর‌লেন আ‌বি‌সিনিয়ায়। ‌অনে‌কেই হিজরত ক‌রলেন মদীনায়। সেখা‌নে কায়েম হ‌লো ইসলামী প‌রি‌বেশ।

হযরত আবু বকর রা‌যি. হিজরতের ইচ্ছা কর‌লে র‌াসূল ব‌ললেন, অ‌পেক্ষা ক‌রো। রাসূল হিজর‌তের ইশারা দি‌লেন। রাসূলও হিজর‌তের ইরাদা করে‌ছেন। এখন আল্লাহ তাআলার নি‌র্দেশের অ‌পেক্ষামাত্র। এ‌দি‌কে মক্কার কা‌ফেররা আটলো দুষ্টু বু‌দ্ধি। ষড়যন্ত্র কর‌লো মে‌রে ফেলার। ঘেরাও কর‌লো রাসূ‌লের বাসবভন। আল্লাহর পক্ষ থে‌কে নি‌র্দেশ এ‌লো হিজর‌তের। রাসূল সাঃ হ‌াতে একমু‌ষ্টি মা‌টি নি‌লেন। শুরু কর‌লেন সূরা ইয়াসিনের তেলাওয়াত। فاغشيناهم فهم لا يصرون পর্যন্ত পৌঁ‌ছে মাটিতে ফু দি‌‌য়ে নি‌ক্ষেপ করলেন ঘেরাওকারী‌দের দি‌কে। চলে গে‌লেন তি‌নি। কেউ কিছু বুঝ‌তে পার‌লো না।

রাসূল মদীনায় এ‌লেন। মক্কার মুসলমান সবাই চ‌লে এ‌লেন মদীনায়। দ‌লে দ‌লে ইসলাম গ্রহণ ক‌রেন মদীনার মানুষ।ইসলা‌মের নিয়মনী‌তি কার না ভা‌লো লা‌গে! ইসলা‌মী শিষ্টাচা‌রে মুগ্ধ হ‌য়ে ইসলামের পতাকাত‌লে আশ্রয় নিলেন অগ‌নিত মানুষ। রাসূ‌লের হা‌তে বায়আত হ‌য়ে ধন্য হলেন তারা। ইসলা‌মের বা‌ণি ছ‌ড়ি‌য়ে পড়‌লো সারা বি‌শ্বে। রাসূল ইসলামের দাওয়াত পাঠা‌লেন বি‌ভিন্ন দে‌শের শাসক‌দের কাছে।

যুদ্ধ জিহাদ: মুসলমানরা মদীনায় এ‌সেও নিষ্কৃ‌তি পান নি মক্কার কা‌ফের‌দের দুষ্কৃ‌তি থে‌কে। মে‌তে ও‌ঠে মুসলমান‌দের‌কে দু‌নিয়া থে‌কে বিদায় ক‌রার ষড়য‌ন্ত্রে। রক্ষা ও শ‌ক্তি সঞ্চা‌রের জন্য বদর ও উহুদের যুদ্ধ সংঘ‌টিত হয় মক্কার কা‌ফের‌দের সা‌থেই। এছাড়াও আ‌রো অনেক যুদ্ধ হ‌য়ে‌ছে কাফের‌দের সা‌থে। সবখা‌নেই ইসলা‌মের বিজয় হ‌য়ে‌ছে। যে মক্কা ছে‌ড়ে চ‌লে এ‌লেন নির্যাত‌নে অসহ্য হ‌য়ে। রাসূল সাহাবা‌দের বিশাল বা‌হিনী নি‌য়ে বিজয় ক‌রেছেন স্মৃ‌তি বিজ‌ড়িত পূণ্যভূ‌মি মক্কা।

সারা আর‌ব ইসলা‌মের পদানত হ‌লো। আর‌বজু‌ড়ে উড়‌লো ইসলামের বিজয় কেতন। মক্কার যে সকল লো‌কেরা নির্যাত‌নের ভয়ে ইসলাম গ্রহণ ক‌রে‌নি আজ তারা গ্রহণ ক‌রে‌ছে ইসলাম। ইসলামের বিজয় ‌দে‌খে মক্কার লো‌কেরা দ‌লে দ‌লে গ্রহণ ক‌রে‌ছে ইসলামধর্ম। ইসলা‌মে য‌দি জিহাদ না থাক‌তো তাহ‌লে হয়ত এ‌তো‌দিনে ইসলামও থাক‌তো না। কারণ বি‌রো‌ধি শ‌ক্তি‌কে প্র‌তিহত না কর‌লে তা‌দের বি‌রুদ্ধে যুদ্ধ না কর‌লে তারা তো আমা‌কে ধ্বংস ক‌রে দি‌বে। তাই সর্বদা ‌বি‌রো‌ধি শক্তিকে দুর্বল ক‌রে রাখ‌তে হ‌বে। যখন যু‌দ্ধের প্র‌য়োজন হ‌বে তখন যু্দ্ধ কর‌তে হ‌বে।

মুসলমানরা যখন কুফু‌রি শ‌ক্তির বিরু‌দ্ধে যুদ্ধ করা ছে‌ড়ে দি‌বে, তখনই নে‌মে আস‌বে মুসলমান‌দের পতন। আজ মুসলমানরা জিহাদ ছে‌ড়ে দি‌য়ে‌ছে ব‌লেই মুস‌লিম উম্মাহর করুণ প‌রিণ‌তি। জিহাদ বিষ‌য়ে স‌ঠিক জ্ঞান পর্যন্ত নেই মুসলিম‌দের।  চলবে…………………

পূর্ব প্রকাশের পর...পূর্বের লেখা

লেখক- আতা খান

 

নামায মুমিনের মেরাজ-আঠারো হাজার মাখলুকাতঃ এগুলো কি হাদীস ?

আঠারো হাজার মাখলুকাত-

উপরের কথাটি লোকমুখে এতই প্রসিদ্ধ যে, অনেকের কাছে তা কুরআন-হাদীসের বাণীর মতো স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু মাখলুকাতের এই নির্দিষ্ট সংখ্যা না কুরআনে আছে, না কোনো সহীহ হাদীসে। বাস্তবতা হল, আল্লাহ তাআলা অগণিত মাখলুক পয়দা করেছেন। জলে ও স্থলে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাখলুক আল্লাহর অসীম কুদরতের প্রমাণ। মানুষের জানার বাইরেও রয়েছে অসংখ্য মাখলুক।

আল্লাহ তাআলা কত ধরনের মাখলুক সৃষ্টি করেছেন তার নির্দিষ্ট সংখ্যা সহীহ হাদীসে বলা হয়নি। একটি ‘মুনকার’ বর্ণনায় এর সংখ্যা ‘এক হাজার’ বলা হয়েছে। কিন্তু অনেক মুহাদ্দিস বর্ণনাটিকে মাওযূ বা জাল বলে আখ্যা দিয়েছেন। (আলমাওযূআত, ইবনুল জাওযী ২/২১৬; আলফাওয়াইদুল মাজমুআ পৃ. ৪৫৮-৪৫৯)

এছাড়া এই সংখ্যা সম্পর্কে কিছু মনীষীর উক্তিও রয়েছে। যেমন মারওয়ান ইবনুল হাকামের কথামতে সতের হাজার জগত রয়েছে। আর আবুল আলিয়ার অনুমান অনুযায়ী চৌদ্দ হাজার কিংবা আঠারো হাজার মাখলুকাত আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এই বিভিন্ন সংখ্যা কিছু মনীষীর উক্তিমাত্র, হাদীস নয়।

দ্বিতীয়ত তাদের বক্তব্য থেকেও অনুমিত হয় যে, নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা বোঝাতে নয়; বরং আধিক্য বোঝাতেই তারা এ সব কথা বলেছেন। তাও আবার অনুমান করে। এই কারণে এর কোনোটিকেই প্রমাণিত সত্য মনে করার কোনো কারণ নেই; বরং এ বিষয়ে ইবনে কাসীর রাহ.-এর কথাটিই মূল কথা, যা তিনি আবুল আলিয়ার পূর্বোক্ত কথাটি পূর্ণভাবে উদ্ধৃত করার পর বলেছেন। আর তা হল, هذا كلام غريب يحتاج مثل هذا إلى دليل صحيح অর্থাৎ এটি এমন একটি আজব কথা, যার জন্য বিশুদ্ধ দলীলের প্রয়োজন রয়েছে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/২৬)

অতএব আঠারো হাজার নয়; বরং বলা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা অসংখ্য অগণিত মাখলুক পয়দা করেছেন, যা আমরা গুণে ও হিসাব করে শেষ করতে পারব না।

আসসালাতু মি’রাজুল মু’মিনীন: এটি কি হাদীস ?

‘নামায মুমিনের মেরাজ’ কথাটা একটা প্রসিদ্ধ উক্তি। কেউ কেউ একে হাদীস মনে করে থাকেন। কিন্তু হাদীসের প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহে এটা পাওয়া যায় না। তবে এ কথাটার মর্ম বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে আহরণ করা যায়। এ জন্য একথাটা একটি প্রসিদ্ধ উক্তি হিসেবেই বলা উচিত, হাদীস হিসেবে নয়। হাদীস বলতে হলে নিম্নোক্ত কোনো সহীহ হাদীস উল্লেখ করা যায়- ‘মুমিন যখন নামাযে দাড়ায় তখন সে তার রবের সঙ্গে একান্তে কথা বলে।’ সহীহ  বুখারী, হাদীস ৪১৩

তোমাদের কেউ যখন নামাযে দাড়ায় তখন সে আল্লাহর সঙ্গে একান্তে কথা বলে, যতক্ষণ সে তার জায়নামাযে থাকে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪২৬

জ্ঞান-সাধকের দোয়াতের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে মূল্যবানঃএটি হাদীস নয়

‘‘জ্ঞান-সাধকের দোয়াতের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে মূল্যবান’’ এ কথাটি হাদীস হিসেবে জনশ্রুতি থাকলেও হাদীস বিশারদগণের নির্ভরযোগ্য মতানুসারে এটি হাদীস নয়; বরং পরবর্তী কারো বাণী। ইমাম সাখাবী রাহ. ‘আল মাকাসিদুল হাসানাতে’ ( পৃ. ৪৪২, বর্ণনা: ১০০৫ ) এটিকে হাসান বসরী রাহ.-এর বাণী বলে উল্লেখ করেছেন।

শাওকানী রাহ.,যারকাশী রাহ.,তাহের পাটনী রাহ.-সহ আরো অনেক হাদীস বিশারদ এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।

(দেখুন: আল ফাওয়াইদুল মাজমূআ, খ. ১ পৃ. ২৮৭, বর্ণনা: ৫৩; আললাআলিল মানছূরাহ,  পৃ. ১০১, বর্ণনা: ১০; আল আসারুল মারফূআ ২০৭; কাশফুল খাফা, খ.২ পৃ.২০০; তাযকিরাতুল মাওযূআত খ. ২ পৃ. ৩৬৯; মিযানুল ইতিদাল খ.৩ পৃ. ৪৯৮।)

সুতরাং এটিকে হাদীস হিসেবে বলা উচিত নয়।

কুরআনে বিজ্ঞান- কাকতালীয় না বাস্তবতা?

দেবাশীষ বললো, – ‘ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান খোঁজা আর আমাজন জঙ্গলের রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে সভ্যতা খোঁজা একই ব্যাপার। দুইটাই হাস্যকর। হা হা হা হা।’

ওর কথায় অন্যরা খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। সাকিব বললো, – ‘দেখ দেবাশীষ, অন্য ধর্মগ্রন্থগুলোর ব্যাপারে জানি না, তবে আল কুরআনে এমন অনেক বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্ট নিয়ে বলা আছে যা বিজ্ঞান অতি সম্প্রতিই জানতে পেরেছে।’

দেবাশীষ বিদ্রুপের সুরে বললো, – ‘হ্যাঁ। এইজন্যই তো মুসলমানদের কেউই নোবেল পায়না বিজ্ঞানে। সব অই ইহুদি-খ্রিষ্ঠানরাই মেরে দেয়। এখন আবার বলিস না যেন অইসব ইহুদি-খ্রিষ্ঠানগুলা কুরআনে পড়েই এসব বের করছে। হা হা হা। পারিসও ভাই তোরা। হা হা হা।’

রাকিব বললো,- ‘নোবেল লাভ করার উদ্দেশ্যে তো কুরআনে নাজিল হয়নি, কুরআনে এসেছে একটি গাইডবুক হিসেবে।মানুষকে মুত্তাকী বানাতে।’
– ‘হুম, তো?’- দেবাশীষের প্রশ্ন।

রাকিব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। ঠিক সেসময় সাজিদ বলে উঠলো,- ‘আমি দেবাশীষের সাথে একমত। আমাদের উচিত না ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান খোঁজা।’

সাজিদের কথা শুনে আমরা সবাই ‘থ’ হয়ে গেলাম। কোথায় সে দেবাশীষকে যুক্তি আর প্রমান দিয়ে একহাত নেবে তা না, উল্টো সে দেবাশীষের পক্ষেই সাফাই করছে।

সাজিদ আবার বলতে লাগলো,- ‘আরো ক্লিয়ারলি, বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মগ্রন্থগুলোকে যাচাই করা ঠিক না। কারণ, ধর্মগ্রন্থগুলো ইউনিক।পাল্টানোর সুযোগ নেই।কিন্তু বিজ্ঞান প্রতিনিয়তই পাল্টায়। বিজ্ঞান এতোই ছলনাময়ী যে, পৃথিবীর ইতিহাসের সবচে সেরা বিজ্ঞানি, স্যার আলবার্ট আইনষ্টাইনকেও তার দেওয়া মত তুলে নিয়ে ভুল স্বীকার করতে হয়েছে।’

দেবাশীষ বললো,- ‘মানে? তুই কি বলতে চাস?’

সাজিদ মুচকি হাসলো। বললো,- ‘দোস্ত, আমি তো তোকেই ডিফেন্ড করছি। বলছি যে, ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞান খোঁজা আর তা দিয়ে ধর্মগ্রন্থকে জাজ করা করাটা বোকামি। আচ্ছা বাদ দে। দেবাশীষ, শেক্সপিয়ারের রচনা তোর কাছে কেমন লাগে রে?’

আমি একটু অবাক হলাম। এই আলোচনায় আবার শেক্সপিয়ার কোত্থেকে এসে পড়লো? যাহোক, কাহিনী কোনদিকে মোড় নেয় দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

দেবাশীষ বললো,- ‘ভালো লাগে। কেনো?’
– ‘হ্যামলেট পড়েছিস?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘পড়ে নিশ্চয় কান্না পেয়েছে?’

দেবাশীষ বাঁকা চোখে সাজিদের দিকে তাকালো।সাজিদ বললো,- ‘আরে বাবা, এটা তো কোন রোমান্টিক রচনা না যে এটা পড়ে মজা পেয়েছিস কিনা জিজ্ঞেস করবো। এটা একটা করুণ রসভিত্তিক রচনা। এটা পড়ে মন খারাপ হবে, কান্না পাবে এটাই স্বাভাবিক, তাই না?’
দেবাশীষ কিচ্ছু বললো না।

সাজিদ আবার বললো,- ‘শেক্সপিয়ারের A Mid Summer Night’s Dream পড়েছিস? কিংবা, Comedy Of Errors?’
– ‘হ্যাঁ।
– ‘Comedy Of Errors পড়ে নিশ্চই হেসে কুটিকুটি হয়েছিস, তাই না? ‘হাহাহাহা।’

দেবাশীষ বললো,- ‘হ্যাঁ। মজার রচনা।’
সাজিদ বললো,- ‘তোকে শেক্সপিয়ারের আরেকটি নাটকের নাম বলি। হয়তো পড়ে থাকবি। নাটকের নাম হচ্ছে ‘Henry The Fourth’. ধারনা করা হয়, শেক্সপিয়ার এই নাটকটি লিখেছিলেন ১৫৯৭ সালের দিকে এবং সেটি প্রিন্ট হয় ১৬০৫ সালের দিকে।’
– ‘তো?’
– ‘আরে বাবা, বলতে দে। সেই নাটকের একপর্যায়ে মৌমাছিদের নিয়ে দারুন কিছু কথা আছে। শেক্সপিয়ার দেখিয়েছেন, পুরুষ মৌমাছিদের একজন রাজা থাকে। রাজাটা নির্ধারিত হয় পুরুষ মৌমাছিদের ভেতর থেকেই। রাজা ব্যতীত, অন্যান্য মৌমাছিরা হলো সৈনিক মৌমাছি। এই সৈনিক মৌমাছিদের কাজ হলো মৌছাক নির্মান, মধু সংগ্রহ থেকে শুরু করে সব। রাজার নির্দেশমতো, সৈনিক মৌমাছিরা তাদের প্রাত্যহিক কাজ শেষ করে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে রাজা মৌমাছির কাছে জবাবদিহি করে। অনেকটা প্রাচীন যুগের রাজা বাদশাহদের শাসনের মতো আর কি।’

আমরা সবাই শেক্সপিয়ারের গল্প শুনছি। কারো মুখে কোন কথা নেই।

সাজিদ আবার শুরু করলো-
‘চিন্তা কর, শেক্সপিয়ারের আমলেও মানুষজনের বিশ্বাস ছিলো যে, মৌমাছি দু প্রকার। স্ত্রী মৌমাছি আর পুরুষ মৌমাছি। স্ত্রী মৌমাছি খালি সন্তান উৎপাদন করে, আর বাদবাকি কাজকর্ম করে পুরুষ মৌমাছিরা।’

সাকিব বললো,- ‘তেমনটা তো আমরাও বিশ্বাস করি। এবং, এটাই তো স্বাভাবিক,তাই না?’
– ‘হা হা হা। এরকমটাই হওয়া স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু মৌমাছির জীবনচক্র অন্যান্য কীট পতঙ্গের তুলনায় একদম আলাদা।’
– ‘কি রকম?’- রাকিবের প্রশ্ন।

সাজিদ বললো,- ‘১৯৭৩ সালে অষ্ট্রিয়ান বিজ্ঞানি Karl Von-Frisch ‘Physiology of Medicine’ বিষয়ে সফল গবেষণার জন্য চিকিৎবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘মৌমাছির জীবনচক্র’।অর্থাৎ, মৌমাছিরা কিভাবে তাদের জীবন নির্বাহ করে।

এই গবেষণা চালাতে গিয়ে তিনি এমন সব আশ্চর্জজনক জিনিস সামনে নিয়ে এলেন, যা শেক্সপিয়ারের সময়কার পুরো বিশ্বাসকে পাল্টে দিলো। তিনি ফটোগ্রাফি এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে করে দেখিয়েছেন যে, মৌমাছি দুই প্রকার নয়, মৌমাছি আসলে তিন প্রকার
প্রথমটা হলো, পুরুষ মৌমাছি।
দ্বিতীয়টি হলো স্ত্রী মৌমাছি। এই মৌমাছিদের বলা হয় Queen Bee. এরা শুধু সন্তান উৎপাদন করা ছাড়া আর কোন কাজ করে না। এই দুই প্রকার ছাড়াও আরো একপ্রকার মৌমাছি আছে। লিঙ্গভেদে এরাও স্ত্রী মৌমাছি তবে একটু ভিন্ন।’

– ‘কি রকম?’- দেবাশীষ প্রশ্ন করলো।
‘আমরা জানি, পুরুষ মৌমাছিরাই মৌচাক নির্মান থেকে শুরু করে মধু সংগ্রহ সব করে থাকে কিন্তু এই ধারনা ভুল। পুরুষ মৌমাছি শুধু একটিই কাজ করে, আর তা হলো কেবল রানী মৌমাছিদের প্রজনন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করা। মানে, সন্তান উৎপাদনে সহায়তা করা। এই কাজ ছাড়া পুরুষ মৌমাছির আর কোন কাজ নেই।’
– ‘তাহলে মৌচাক নির্মান থেকে শুরু করে বাকি কাজ কারা করে?’- রাকিব জিজ্ঞেস করলো।
– ‘হ্যাঁ। তৃতীয় প্রকারের মৌমাছিরাই । বাদ বাকি সব কাজ করে থাকে। লিঙ্গভেদে এরাও স্ত্রী মৌমাছি, কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে এরা সন্তান জন্মদানে অক্ষম।সোজা কথায়, এদের বন্ধ্যা বলা যায়।’

আমি বললাম,- ‘ও আচ্ছা।’

সাজিদ আবার বলতে লাগলো,- ‘বিজ্ঞানি Karl Von-Frisch এই বিশেষ শ্রেণীর স্ত্রী মৌমাছিদের নাম দিয়েছেন Worker Bee বা কর্মী মৌমাছি। এরা Queen Bee তথা রানী মৌমাছির থেকে আলাদা একটি দিকেই।সেটা হলো রানী মৌমাছির কাজ হলো সন্তান উৎপাদন, আর কর্মী মৌমাছির কাজ সন্তান জন্ম দেওয়া ছাড়া অন্যসব।’
সাকিব বললো,- ‘বাহ, দারুন তো। এরা কি প্রাকৃতিকভাবেই সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে থাকে?’

– ‘হ্যাঁ।’
– ‘আরো, মজার ব্যাপার আছে। বিজ্ঞানি Karl Von-Frisch আরো প্রমান করেছেন যে, এইসব কর্মী মৌমাছিরা যখন ফুল থেকে রস সংগ্রহে বের হয়, তখন তারা খুব অদ্ভুত একটি কাজ করে।সেটা হলো, ধর, কোন কর্মী মৌমাছি কোন এক জায়গায় ফুলের উদ্যানের সন্ধান পেলো যেখান থেকে রস সংগ্রহ করা যাবে। তখন অই মৌমাছিটি তার অন্যান্য সঙ্গীদের এই ফুলের উদ্যান সম্পর্কে খবর দেয়।

মৌমাছিটি ঠিক সেভাবেই বলে, যেভাবে যে পথ দিয়ে সে অই উদ্যানে গিয়েছিলো।মানে, এক্সাক্ট যে পথে সে এই উদ্যানের সন্ধান পায়, সে পথের কথাই অন্যদের বলে।আর, অন্যান্য মৌমাছিরাও ঠিক তার বাতলে দেওয়া পথ অনুসরণ করেই সে উদ্যানে পৌঁছে। একটুও হেরফের করেনা।বিজ্ঞানি Karl Von-Frisch এই ভারি অদ্ভুত জিনিসটার নাম রেখেছে ‘Waggle Dance’..

আমি বললাম,- ‘ভেরি ইন্টারেষ্টিং……’
সাজিদ বললো,- ‘মোদ্দাকথা, Karl Von-Frisch প্রমান করেছেন যে, স্ত্রী মৌমাছি দু প্রকারের। রানী মৌমাছি আর কর্মী মৌমাছি। দুই প্রকারের কাজ সম্পূর্ণ আলাদা।আর, পুরুষ মৌমাছি মৌচাক নির্মান, মধু সংগ্রহ এসব করে না। এসব করে কর্মী স্ত্রী মৌমাছিরাই।’
এই পুরো জিনিসটার উপর Karl Von-Frisch একটি বইও লিখেছেন। বইটির নাম- ‘The Dancing Bees’. এই জিনিসগুলা প্রমান করে তিনি ১৯৭৩ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান।

এতোটুকু বলে সাজিদ থামলো। দেবাশীষ বললো,- ‘এতোকিছু বলার উদ্দেশ্য কি?’

সাজিদ তার দিকে তাকালো। এরপর বললো,- ‘যে জিনিসটা ১৯৭৩ সালে বিজ্ঞান প্রমান করেছে, সেই জিনিসটা ১৫০০ বছর আগে কোরান বলে রেখেছে।’
দেবাশীষ সাজিদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো।

সাজিদ বললো,- ‘কুরআন যেহেতু আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে, আমাদের আরবি ব্যাকরণ অনুসারে তার অর্থ বুঝতে হবে। বাংলা কিংবা ইংরেজি কোনটাতেই পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গের জন্য আলাদা আলাদা ক্রিয়া (Verb) ব্যবহৃত হয় না।

যেমন ইংলিশে পুংলিঙ্গের জন্য আমরা বলি, He does the work, আবার স্ত্রী লিঙ্গের জন্যও বলি, She does the work..

খেয়াল করো, দুটো বাক্যে জেন্ডার পাল্টে গেলেও ক্রিয়া পাল্টেনি। পুংলিঙ্গের জন্য যেমন does, স্ত্রীলিঙ্গের জন্যও does. কিন্তু আরবিতে সেরকম নয়। আরবিতে জেন্ডারভেদে ক্রিয়ার রূপ পাল্টে যায়।’

আমরা মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনছি।

সে বলে যাচ্ছে-
‘কুরআনে মৌমাছির নামেই একটি সূরা আছে। নাম সূরা আন-নাহল। এই সূরার ৬৮ নাম্বার আয়াতে আছে- ‘(হে মুহাম্মদ) আপনার রব মৌমাছিকে আদেশ দিয়েছেন যে, মৌচাক বানিয়ে নাও পাহাড়ে,বৃক্ষে এবং মানুষ যে গৃহ নির্মান করে, তাতে।’

খেয়াল কর, এখানে সন্তান জন্মদানের কথা বলা হচ্ছে না কিন্তু। মৌচাক নির্মানের কথা বলা হচ্ছে।
Karl Von-Frisch আমাদের জানিয়েছেন, মৌচাক নির্মানের কাজ করে থাকে স্ত্রী কর্মী মৌমাছি।এখন আমাদের দেখতে হবে কুরআনে কোন মৌমাছিকে এই নির্দেশ দিচ্ছে।স্ত্রী মৌমাছিকে? নাকি, পুরুষ মৌমাছিকে।

যদি পুরুষ মৌমাছিকে এইই নির্দেশ দেয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারে কুরআন ভুল। আরবি ব্যাকরণে, পুরুষ মৌমাছিকে মৌচাক নির্মান কাজের নির্দেশ দিতে যে ক্রিয়া ব্যবহৃত হয় তা হলো ‘ইত্তাখিজ’ আর স্ত্রী মৌমাছির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় ‘ইত্তাখিজি’।
অত্যন্ত আশ্চর্জনক ব্যাপার হচ্ছে, কুরআনে এই আয়াতে ‘মৌমাছিকে নির্দেশ দিতে ‘ইত্তাখিজ’ ব্যবহার না করে, ‘ইত্তাখিজি’ ব্যবহার করেছে।মানে, এই নির্দেশটা কোরান নিঃসন্দেহে স্ত্রী মৌমাছিকেই দিচ্ছে, পুরুষ মৌমাছিকে নয়।

বলতো দেবাশীষ, এই সুক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক ব্যাপারটি মুহাম্মদ সাঃ ১৫০০ বছর আগে কোন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন? এমনকি, শেক্সপিয়ারের সময়কালেও যেখানে এটা নিয়ে ভুল ধারনা প্রচলিত ছিলো?’
দেবাশীষ চুপ করে আছে। সাজিদ আবার বলতে লাগলো,- ‘শুধু এই আয়াত নয়, এর পরের আয়াতে আছে ‘অত:পর, চোষন করে নাও প্রত্যেক ফুল থেকে,এবং চল স্বীয় রবের সহজ-সরল পথে’।

চোষণ বা পান করার ক্ষেত্রে আরবিতে পুংলিঙ্গের জন্য ব্যবহৃত হয় ‘ক্বুল’ শব্দ, এবং স্ত্রীলিঙ্গের জন্য ব্যবহৃত হয় ‘ক্বুলি’। কোরান এখানে ‘ক্বুল’ ব্যবহার না করে ‘ক্বুলি’ ব্যবহার করেছে। ‘সহজ সরল পথে’ চলার নির্দেশের ক্ষেত্রে পুংলিঙ্গের জন্য ব্যবহৃত শব্দ ‘ঊসলুক’, এবং স্ত্রীলিঙ্গের জন্য ব্যবহৃত হয় ‘ঊসলুকি’। মজার ব্যাপার, কোরান ‘ঊসলুক’ ব্যবহার না করে, ‘ঊসলুকি’ ক্রিয়া ব্যবহার করেছে।মানে, নির্দেশটা পুরুষ মৌমাছির জন্য নয়, স্ত্রী মৌমাছির জন্য।

আরো মজার ব্যাপার, এই আয়াতে কোরান মৌমাছিকে একটি ‘সহজ সরল’ পথে চলার নির্দেশ দিচ্ছে।আচ্ছা, মৌমাছির কি পরকালে জবাবদিহিতার কোন দায় আছে? পাপ পূণ্যের? নেই। তাহলে তাদের কেনো সহজ সরল পথে চলার নির্দেশ দেওয়া হলো?

খেয়াল কর, বিজ্ঞানি Karl Von-Frisch মৌমাছিদের ব্যাপারে যে আশ্চর্যজনক ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছেন, তা হলো- তারা ঠিক যে পথে কোন ফুলের উদ্যানের সন্ধান পায়, ঠিক একই পথের,একই রাস্তা অন্যদের বাতলে দেয়।কোন হেরফের করে না। অন্যরাও ঠিক সে পথ অনুসরণ করে উদ্যানে পৌঁছে।এটাই তাদের জন্য সহজ-সরল পথ।বিজ্ঞানি Karl Von-Frisch এটার নাম দিয়েছেন ‘Waggle Dance’. কুরআনও কি ঠিক একই কথা বলছে না?

দেবাশীষ, এখন তোকে যদি প্রশ্ন করি, কুরআন কি এই জিনিসগুলো বিজ্ঞানি Karl Von-Frisch এর থেকে নকল করেছে?
তোর উত্তর হবে ‘না।’ কারন, তিনি এসব প্রমান করেছেন মাত্র সেদিন। ১৯৭৩ সালে। কুরআন নাজিল হয়েছে আজ থেকে ১৫০০ বছর আগে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন নিরক্ষর মুহাম্মদ সাঃ এই বৈজ্ঞানিক ব্যাপারগুলো ঠিক কোথায় পেলেন? কোরান কেনো এই নির্দেশগুলো পুরুষ মৌমাছিকে দিলো না? কেনো স্ত্রী মৌমাছিকে দিলো?

যদি এই কুরআনে সুপার ন্যাচারাল কোন শক্তি, যিনিই এই মৌমাছির সৃষ্টিকর্তা, যিনিই মৌমাছিদের এই জীবনচক্রের জন্য উপযুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন তার নিকট থেকে না আসে, তাহলে ১৫০০ বছর আগে আরবের মরুভূমিতে বসে কে এটা বলতে পারে?

যে জিনিস ১৯৭৩ সালে আবিষ্কার করে বিজ্ঞানি Karl Von-Frisch নোবেল পেলেন, তা কুরআনে বহু শতাব্দী আগেই বলা আছে।কই, মুসলিমরা কি দাবি করেছে Karl Von-Frisch কুরআনে থেকে নকল করেছে? করে নি। মুসলিমরা কি তার নোবেল পুরষ্কারে ভাগ বসাতে গেছে? না, যায় নি।কারন এর কোনটাই কুরআনের উদ্দেশ্য নয়।

আমরা বিজ্ঞান দিয়ে কুরআনকে বিচার করি না, বরং, দিনশেষে, বিজ্ঞানই কোরানের সাথে এসে কাঁধে কাঁধ মিলায়।

এতোটুকু বলে সাজিদ থেমে গেলো। দেবাশীষ কিছুই বলছে না। সাকিব আর রাকিবের চেহারাটা তখন দেখার মতো। তারা খুবই উৎফুল্ল এবং খোশমেজাজি একটা চেহারায় দেবাশীষের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন তারা বলতে চাইছে- ‘দে দে ব্যাটা। পারলে এবার কোন উত্তর দে…………’

==============================

লেখকঃ-  আরিফ আজাদ

মৃতের একাধিক জানাজা কি জায়েজ ?

ইবাদাতের ব্যাপারে বর্তমানে আমারা এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এক মৃতের নামাজে জানাজার একাধিক জামাত বর্তমান সময়ে সামাজিক প্রভাব ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কিছুদিন আগেও একাধিক জানাজার নামাজের উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো প্রচলন ছিলো না।

এখন তো প্রায়ই দেখা যায়, কেউ শহরে মারা গেলে তার বসবাসের মহল্লার মসজিদ থেকে শুরু করে আরও বেশ কয়েক স্থানে মরহুমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে নামাজে জানাজার দৃষ্টান্ত মহানবী (সা.) ও তার অনুসারী সাহাবাদের জীবনে নেই। এটা নামাজে জানাজার বিধান নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ছাড়া আর কিছুই না।

কেউ মারা গেলে তার জানাজার নামাজ পড়া সব মুসলমানের ওপর ফরজে কেফায়া। যখন একবার কিছু মানুষ এক মৃতের জানাজার নামাজ পড়ল তখন এ ফরজ সবার থেকেই আদায় হয়ে যায়। যেহেতু ফরজ নামাজে জানাজা আদায় হয়ে গেছে সেহেতু আবার ফরজ নামাজে জানাজা আদায়ের সুযোগ নেই। এক ফরজ একাধিকবার আদায় করা যায় না।

তারপরও ………

একাধিক জানাজার পদ্ধতি এমন হতে পারে —

(১) ওলীর উপস্থিতিতে বা অনুপস্থিতিতে তার অনুমতিক্রমে জানাযা পড়ানো হয়েছে। বা অলী নিজেই জানাযা পড়ে ফেলেছে।

(২) ওলীর নিষেধ সত্বেও বা তাকে না জানিয়ে পড়ানো হয়েছে।

এ দুই সূরতের প্রথম সূরত তথা ওলীর উপস্থিতিতে বা অনুপস্থিতিতে তার অনুমতিক্রমে যদি জানাজা পড়া হয় তাহলে দ্বিতীয়বার জানাযা পড়ার বিধান নেই। কারণ ওলী পড়ুক বা সে অনুমতি দিক একই হুকমে হবে।

মহানবী (সা.) আদেশ করেছেন, মৃতকে যতো দ্রুত সম্ভব কবরস্থ করতে। -সুনানে আবু দাউদ: ৩১৮৩

একাধিক নামাজে জানাজার আয়োজন করলে মৃতকে তাড়াতাড়ি কবরস্থ করার সুস্পষ্ট হাদিসটি অমান্য করা হয়।

তবে দ্বিতীয় সূরত তথা তার অনুমতি ছাড়াই যদি জানাযা পড়ানো হয়, তাহলে ওলী আবার জানাযা পড়তে পারে।

আর এক্ষেত্রে প্রথমবার যারা জানাযা পড়ে ফেলেছেন, তারা ওলীর সাথে দ্বিতীয়বার জানাযায় শরীক হতে পারবে না। কারণ জানাযা নামায এটি ফরজ বিধান। এর কোন নফল নেই।

আর প্রথম যারা আদায় করেছেন, তাদের প্রথম পড়ার দ্বারা তাদের ফরজ আদায় হয়ে গেছে। এখন দ্বিতীয়বার পড়ার দ্বারা ফরজ আর থাকছে না, বরং তা নফল হয়ে যাবে। আর জানাযা নামাযে নফল বলতে কিছু নেই। তাই প্রথমবার যারা শরীক হয়েছেন, তারা দ্বিতীয় জানাযায় আর শরীক হবে না।

ইসলাম মতে মৃতের অভিভাবকের সম্মতিতে নামাজে জানাজা মাত্র একবার হবে। যারা যে কোনো কারণে নামাজে জানাজার জামাতে অংশ নিতে পারবে না- তারা মৃতের জন্য ব্যক্তিগতভাবে মাগফিরাতের দোয়া করবে, সম্ভব হলে দাফন কাজে অংশ নেবে, কবর জিয়ারত করবে, তার জন্য কোরআন তেলাওয়াত করে মাগফিরাত কামনা করবে।

শরীয়ত সম্মত পদ্ধতিতে একবার জানাযা হয়ে যাবার পর দ্বিতীয়বার জানাযা পড়া অহেতুক কাজ। এমন অহেতুক কাজ থেকে বিরত থাকা প্রতিটি মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব।

তারপরও যদি কেউ একাধিক জানাজা পড়ে সেটা হবে রাজনৈতিক ও সামাজিক জানাজা। ইসলামে এর কোন অবস্থান নেই।

(وان صلى هو) الولى (بحق) بأن لم يحضر من يقدم عليه (لا يصلى غيره بعده) (الدر المختار، كتاب الصلاة، باب الجنائز-2/223)

فإن صلى عليه الولى، لم يجز أن يصلى عليه أحد بعده (البحر الرائق، كتاب الصلاة، باب الجنائز-2/319)

وكذا فى الفتاوى الهندية، كتاب الصلاة، الباب الحادى والعشرون فى الجنائز، الفصل الخامس فى الصلاة على الميت-1/164)

ولا يصلى على الميت واحد إلا مرة واحدة، والتنفل بصلاة الجنازة غير مشروع، الفتاوى الهندية، كتاب الصلاة، الباب الحادى والعشرون فى الجنائز، الفصل الخامس فى الصلاة على الميت-1/165)

“قوله: ولا يصلى غيره بعده) أى بعد ما صلى الولى، لأن الفرض قد تأدى بالأولى، والتنفل بها غير مشروع، (البحر الرائق، كتاب الصلاة، باب الجنائز، فصل أحق بصلاته-2/318، وكذا فى رد المحتار، كتاب الصلاة، باب الجنائز-2/223)

فإن صلى غيره: أى الولى ممن ليس له حق التقدم على الولى ولم يتابعه الولى، أعاد الولى، وإلا لا يعيد صلاة الجنازة، (الدر المختار مع رد المحتار، كتاب الصلاة، باب صلاة الجنازة-2/222-223)

فان صلى عليه غير الولى والسلطان، أعاد الولى) لأن الحق له، (البحر الرائق، كتاب الصلاة، باب الجنائز-2/318، الفتاوى الهندية، كتاب الصلاة، الباب الحادى والعشرون فى الجنائز، الفصل الخامس فى الصلاة على الميت-1/164

 

আদি মানব ও আজাযিল

পৃথিবী সৃষ্টির একেবারে প্রথম দিকের কথা। তখন এখানে কোন জীবজন্তু, পশুপক্ষী বা কীটপতঙ্গ কিছুই ছিল না। সমস্ত দুনিয়ায় বাস করতো শুধু জিনেরা। তারা কেবলই নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি, মারামার নিয়েই থাকতো, ভুলেও কখনো আল্লাহ তা’লাকে স্মরণ করতো না। একদিন আজাযিল খোদার দরগায় আরজ (প্রার্থনা) করলোঃ হে প্রভু, আমাকে হুকুম দাও, আমি দুনিয়ায় গিয়ে জিনবংশ গারত (ধ্বংস) করে দুনিয়া থেকে পাপ দূর করে দেই। খোদা তার আরজ মঞ্জুর করলেন। আজাযিল চল্লিশ হাজার ফেরেশতাকে সঙ্গে নিয়ে নেমে এলো দুনিয়াতে। জিনদের সৎপথে আনবার জন্য অনক সদুপদেশ দিলো, কিন্তু তারা সে কথাতে একেবারে কর্ণপাতই করলো না। আজাযিল কি আর করে। তখন তাদের ধ্বংস করে বেহেশতে ফিরে গেলো। জিনের দল নিশ্চিহ্ন হওয়ায় দুনিয়া খালি পড়ে রইলো।

দোজখ (নরক) সব শুদ্ধ সাতটা। তার মধ্যে যে দোজখে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশী গোনাগারদের (পাপিদের) রাখা হয়, তার নাম সিজ্জীন। দুনিয়ার নিচের পাতাল এবং পাতালেরও অনেক নিচে সেই সিজ্জীন দোজখ। সেখানে দিনরাত শুধু দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। এত আগুন হেতু সেখানে ভয়ঙ্কর অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে আজাযিলের জন্ম হয়। এই আজাযিল ভাল মানুষের দুশমন। দুনিয়ার মধ্যে তার মতো পাপি এখন আর কেউ নাই। সে শুধু নিজে পাপ করে না, প্রলোভন দ্বারা সকলকে পাপের পথে নিয়ে যায়। কিন্তু চিরকাল সে এমন ছিল না। তার মতো ধার্মিক এবং সৎ ফেরেশতারা অবধি হতে পারে নি। সত্যি সত্যি একদিন সে সকল ফেরেশতাদের সরদার ছিলো। খোদার নিকট তার মরতবা (মর্যাদা) অন্য সব ফেরেশতাদের চেয়ে অনেক বেশি ছিলো।

আজাযিল জন্মের পরে কিন্তু অন্য জানোয়ারদের মতো বৃথা সময় নষ্ট করেনি। সে খোদার এবাদতে মশগুল হয়ে পুরা একটি হাজার বছর কাটিয়ে দিয়েছিল। সমস্ত দোজখে তিল পরিমাণ জায়গাও ছিলো না যেখানে দাঁড়িয়ে খোদার উপাসনা করেনি।

খোদা খুশী হয়ে তাকে সিজ্জীন দোজখ থেকে পাতালে আসবার অনুমতি দিলেন। কিন্তু এখানে এসেও তার অহঙ্কারের লেশমাত্র দেখা দিলো না। সে খোদাতা’লার এবাদতে আরো অধিক মনোযোগ প্রদান করলো। দেখতে দেখতে হাজারবছর কেটে গেলো এবং এমন এতটুকু জায়গা ফাঁক রইলো না, যেখানে দাঁড়িয়ে সে খোদার উপাসনা করলো না। এমনি করে আরো হাজার বছর কেটে গেলো। খোদা তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে দুনিয়ার উপরে নিয়ে এলেন। কিন্তু এত উন্নতি করেও সে খোদাকে ক্ষণকালের জন্যও ভুললো না। দিনরাত খোদার এবাদতে মশগুল হয়ে রইলো। করুনাময় খোদাতা’লা এবার তাকে প্রথম আসমানে তুলে নিলেন।

এমনিভাবে খোদাকে স্তবস্তূতিতে খুশী করে এক ধাপ এক ধাপ করে সে একেবারে আসমানে উঠতে লাগলো। এক এক আসমানে হাজার বছর করে সাত হাজার বছর ধরে আহার নেই, নিদ্রা নেই, দিনরাত কেবল রোজা আর নামাজ, নামাজ আর রোজা করে সে কাটালো। কোনো দিকে তার লক্ষ্য নেই, একম মনে এক প্রাণে খোদার উপাসনায় মশগুল হয়ে রইলো। খোদা তার ওপরে খুব খুশী হয়ে দোজখের না-পাক (অপবিত্র) জানোয়ারকে বেহেশতে আসবার অনুমতি দিলেন।

তাহলে তোমরা দেখছো, না-পাক জানোয়ারও নিজের সাধনার বলে মত উন্নতি করতে পারলো। কোথায় ছিলো আর কোথায় এলো। বেহেশতে এসে তার মনে এতটুকু দেমাগ বা এতটুকু অহঙ্কার দেখা দিল না। ফেরেশতাগণ যখন হাসিখুশী ও আমোদ-প্রমোদে রত থাকতো, তখন আজাযিল খোদার এবাদতে মগ্ন হয়ে থাকতো। মনে তার সুখ নেই –শান্তি নেই, চোখ দিয়ে কেবল ঝর-ঝর ধারায় পানি পড়তো। সে খোদার কাছে এই আরজ করতোঃ হে এলাহী আলমিন, তোমার এবাদত বন্দেগী কিছুই করতে পারলাম না। আমার গোনাহ মাফ করো। আমি বেহেশত চাই না –আমি চাই তোমাকে।

এইরূপ বেহেশতের আমোদ-আহলাদ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সমস্ত অগ্রাহ্য করে সে আরো হাজার বছর খোদার এবাদতে কাটিয়ে দিলো। এবার খোদাতা’লা তার ওপর অতিশয় সদয় হয়ে ফেরেশতাদের সরদার করে বেহেশতের খাজাঞ্চী করে দিলেন।

হলে কি হবে, তথাপি সে আল্লাহকে এক মুহুর্তের জন্যও ভুললো না। দিনরাত আল্লাহর নামে মশগুল হয়ে রইল, আর মাঝে মাঝে বেহেশতের মিনারের ওপরে উঠে আল্লাহতা’লার উপাসনার উপকারিতা সম্বন্ধে ফেরেশতাদের উপদেশ দিতে লাগলো। ফেরেশতাগণ তার জ্ঞান ও বুদ্ধি দেখে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলোঃ আজাযিল খোদার অতিশয় পিয়ারা (প্রিয়)। যদি আমরা খোদার কাছে কখনো কোন প্রকার বেয়াদবি করে ফেলি, তাহলে তার সুপারিশে আমরা বেঁচে যাবো। খোদা তার কতা না শুনে পারবেন না। এমনই করে ফেরেশতাদের মধ্যে মরতবা দিনে দিনে বেড়ে যেতে লাগলো। কিন্তু যার এত মরতবা তার আশা এখনো মিটলো না। এখনো খোদার এবাদত ছাড়া আর কোন দিক লক্ষ্য নেই। নিরালায় বসে কেবল খোদার যিকির করতে লাগলো। এইরূপে আরো হাজার বছর কেটে গেলো। সজল নয়নে কেবলই সে খোদার কাছে আরজ করতে লাগলোঃ হে রহমান, তুমি আমাকে দোজখ থেকে বেহেশতে এনেছো। এখন আমাকে মেহেরবানি করে একবার ‘লওহে মহফুযে’ তুলে নাও।

খোদা তার আরজ মঞ্জুর করলেন। সেখানে দিয়েও খোদার নাম ছাড়া অন্য কিছুই মনের মধ্যে সে স্থান দিলো না –দিনরাত খোদার উপাসনায় একেবারে ডুবে রইলো। একদিন সে দেখতে পেলো ‘লওহে-মহফুযের’ এক জায়গায় লেখা রয়েছে, “একজন ফেরেশতা ছয় লক্ষ বৎসর খোদার উপাসনা করিবার পরও যদি সে একটিবার খোদার আদেশ অমান্য করে, তা হলে সে চরম দুর্দশাপ্রাপ্ত হবে। তখন থেকে তার নাম হবে ইবলিশ”। আজাযিল ভয়ে কাঁপতে লাগলো! তার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো। কোন দিক তার হুঁশ নেই –ধীর স্থিরভাবে পাথরের মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খোদার দরগায় আরজ করতে লাগলো।

এমনিভাবে পাঁচ লক্ষ বছর কেটে গেলো। একদিন খোদা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন আজাযিল, এখানে কেউ যদি আমার একটি মাত্র আদেশ অমান্য করে, তবে তাকে কি শাস্তি দেওয়া উচিত?

আজাযিল প্রত্যুত্তর করলোঃ কেউ যদি আপনার আদেশ অমান্য করে, তাহলে তাকে আপনার দরবার থেকে চিরদিনের জন্য দূর করে দেওয়া উচিত।

খোদা বললেনঃ বেশ কথা। তুমি এখানে ঐ কথাগুলি লিখে রাখ।

আজাযিল খোদার হুকুম পালন করলো!

তোমাদের হয়তো স্মরণ আছে, আল্লাহর নির্দেশে আজাযিল জিনবংশ গারত করবার পরে দুনিয়া খালি পড়ে থাকে। খোদার বোধ হয় খেয়াল হলো যে, তিনি জিনদের বদলে মানুষ দ্বারা দুনিয়া পূর্ণ করবেন। তিনি সে কথা ফেরেশতাদের বললেন। তারা জবাব দিলোঃ হে পরোয়ারদিগার, একবার তুমি জিন পয়দা করে ঠকেছো। তারা কেবল ঝগড়াঝাটি মারামারি করে দিন কাটিয়েছে। আবার এখন মানুষ সৃষ্টি করে ফ্যাসাদ বাড়িয়ে কি লাভ! আমরা তো তোমার এবাদতে মশগুল আছি।

খোদা হেসে বললেনঃ দেখ ফেরেশতাগণ, আমি কি তোমাদের চেয়ে বেশি বুঝিনা।

এই কথা শুনে তারা খুব লজ্জা পেলো। তার বিনয়ের সঙ্গে বললোঃ হে রহমানুর রহিম। তোমার খেয়াল বুঝবার ক্ষমতা কারো নেই।

খোদতা’লা হযরত আদমকে সৃষ্টি করবার ব্যবস্থা করলেন। তিনি দুনিয়া থেকে একমুষ্টি মাটি নিয়ে হযরত আদমের শরীর সৃষ্টি করবার হুকুম দিলেন এবং দেহের মধ্যে আত্মা প্রবেশ করবার পূর্বে মাটিটুকুকে বেহেশতের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দেবার ব্যবস্থা করলেন?

একদিন আজাযিল ফেরেশতাদের সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে সেখানে এসে হাজিল। আদমের চেহারা দেখে সে খুব হাসতে লাগলো। তারপর তাঁকে নিয়ে এমন বিদ্রূপ শুরু করলো যে, ফেরেশতারা তাকে বললোঃ দেখ আজাযিল! খোদা যাকে খলিফারূপে দুনিয়ায় পাঠাবার জন্য পয়দা করেছেন, তাঁকে নিয়ে তোমার এরূপ বেয়াদবি করা উচিত নয়।

ফেরেশতাদের কথায় আজাযিল কিছুমাত্র লজ্জাবোধ করলো না, বরং অবজ্ঞাভরে বললোঃ বলো কি, খোদা এই মাটির ঢেলাকে খলিফারূপে দুনিয়ায় পাঠাবেন! তিনি যদি একে আমার অধীন করে দেন, তাহলে আমি এক্ষুণি একে গলা টিপে মেরে ফেলবো; আর আমাকে যদি এর অধীন করে দেন তবে আমি কিছুতেই মানবো না।

আজাযিলের স্পর্ধা দেখে ফেরেশতারা অসন্তুষ্ট হয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। আজাযিল সেই মাটির মূর্তিটির সুমুখে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কি চিন্তা করলো, তারপর তার নাক দিয়ে তার শরীরের মধ্যে ঢুকতে চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে বড় মুস্কিলে পড়লো। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বের হয়ে এসে সেই মূর্তির গায়ে থুথু দিয়ে সেখানে থেকে চলে গেল।

খোদার আদেশে এক শুভ মুহুর্তে হযরত আদমের আত্মা তাঁর শরীরে প্রবেশ করলো। তারপর তাকে বিচিত্র পোশাকে সজ্জিত করে একটি অনিন্দ-সুন্দর সিংহাসনে বসানো হলো। এইরূপে নিজের খলিফাকে সৃষ্টি করে খোদাতা’লা ফেরেশতাদের বললেনঃ আমি হযরত আদমকে তোমাদের চেয়ে বড় করে পয়দা করেছি। তোমরা এসে সেজদা (প্রণাম) করো।

খোদার আদেশ পেয়ে ফেরেশতারা অতিশয় ভক্তিতে ও শ্রদ্ধায় আদম আলাইহিসসালামকে সেজদা করলো। কিন্তু আজাযিল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। সেজদা তো করলোই না –এমন কি মাথা পর্যন্ত নোয়াল না।

ফেরেশতারা আজাযিলের এই স্পর্ধা দেখে তাজ্জব হয়ে গেলো।

খোদা আজাযিলকে বললেনঃ আজাযিল! আমার হুকুমে ফেরেশতাগণ আদমকে সেজদা করলো, কিন্তু তুমি তাকে সেজদা করলে না কেন?

আজাযিল জবাবা দিলোঃ হে খোদা! আদমকে দুনিয়ার না-পাক মাটি থেকে পয়দা করছো, কিন্তু তুমি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করছো। আমি তাকে সেজদা করিতে পারি না।

অতিশয় অসন্তুষ্ট হয়ে খোদা বললেনঃ রে মুর্খ, আত্ম-অহঙ্কারে তুই আমার হুকুম অমান্য করেছিস! জানিস তাকে মাটি থেকে পয়দা করবার ব্যবস্থা আমিই করেছি –আমিই তাকে ফেরেশতাদের বড় করেছি, আর আমিই তাকে সেজদা করতে বলেছি। কিন্তু এত স্পর্ধা তোর কিসে হলো? তুই এতদিন আমার এবাদত করেছিস সেই জন্য কি? কিন্তু তুই-ই না লওহে-মহফুযে’ লিখে রেখেছিস লক্ষ লক্ষ বৎসর আমার এবাদতে মশগুল হয়ে থাকলেও আমার একটি মাত্র আদেশ অমান্য করলে সমস্ত এবাদত পণ্ড হয়ে যাবে? তুই আজ থেকে মরদুদ হয়ে গেলি। তুই আমার দরবার থেকে দূর হয়ে যা।

খোদা এই কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে আজাযিলের চেহারা বিশ্রীরূপে পরিবর্তিত হয়ে গেলো। তার পায়ের রং হলো অত্যন্ত কালো, মুখ হলো শুকরের মুখের মতো। চোখ দু’টি কপাল থেকে বুকের ওপর নেমে এলো। তার নাম হলো ইবলিস।

আজাযিল নিজের দুর্দশা দেখে মনে মনে খুব ভয় পেলো, কিন্তু বাইরে সে ভাব মোটেই প্রকাশ করলো না। খোদার দরগায় আরজ করলোঃ হে খোদা! আমি নিজের অহম্মকিতে যে পাপ করেছি তার শাস্তি ভোগ আমাকে করতেই হবে‍! তার জন্য আমাকে যে দোজখী করেছ, তাও আমাকে মানতে হবে। আমি জানি, হাজার চেষ্টা করলেও আমার এ কসুর মাফ হবে না। তোমার দরবার থেকে চিরকালের জন্য চলে যাবার আগে আমি গোটা কয়েক আরজ পেশ করতে ইচ্ছা করি। আশা করি তুমি তা মঞ্জুর করবে।

খোদা বললেনঃ বল তোর কি আরজ আছে?

ইবলিস বললোঃ আমার প্রথম আরজ এই যে, আমাকে কেয়ামত (শেষদিন) পর্যন্ত স্বাধীনতা দাও।

খোদা সে আরজ মঞ্জুর করলেন।

ইবলিস তার দ্বিতীয় আবেদন পেশ করলো। বললোঃ আমাকে লোকচক্ষে অদৃশ্য করে দাও। আর কেউ জানতে না পারে এমনি করে সকলের হাড় মাংস স্নায়ু মজ্জা শরীরের মধ্যে প্রবেশ করবার ক্ষমতা দাও।

খোদা তাও মঞ্জুর করলেন।

তারপর ইবলিস বললোঃ লক্ষ লক্ষ বছর তোমার এবাদতে মশগুল থেকে সিজ্জীন দোজখ হতে বেহেশতে আসবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। কিন্তু তোমার তৈয়ারী সামান্য বান্দার ওপর বেয়াদবি করার জন্য আমাকে শাস্তি দিলে। তোমার প্রিয় মানবের ওপর আমি তার প্রতিশোধ নেবো। তুমি আমাকে শয়তান করলে। আমি তোমার বান্দাকে শয়তান করে তৈরী করবো! যেমন সামান্য একটু কসুরে আমাকে নারকী করলে, তেমনি তোমার প্রিয় মানুষেরা দিন রাত তোমার রোজা নামাজ করলেও আমি বান্দাকে দোজখে পাঠাবার ব্যবস্থা আমি করবো, আর তুমি তাদের সৎপথে চালিত করবার জন্য অনেক নবী ও পয়গম্বর পাঠাবে। তারা তাদের উদ্ধারের জন্য অনেক পরামর্শ, অনেক উপদেশ দান করবেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হবে না। আজ থেকে তোমার মানবের অনিষ্ট করাই হবে আমার একমাত্র কাজ।

এই বলে ইবলিস ডানা মেলে দুনিয়ার দিকে উড়ে গেলো। সেই থেকে সে শয়তান। তার প্রতিজ্ঞা কেমন করে পূরণ করছে তা তোমরা দিন রাত দেখতে পাচ্ছ। খোদার ঈমানদারের চেয়ে শতাদের বেঈমানদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

তাহলে তোমরা দেখতে পেলে, ইবলিস লক্ষ লক্ষ বছর খোদার উপাসনা করে কত উন্নতি করেছিলো। একদিনের সামান্য একটু কসুরে তা সমস্ত নষ্ট হয়ে তার কত অধঃপতন হলো। সুতরাং তোমার জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ন্যায় ধর্ম ও সত্য পথে চলতে চেষ্টা করবে। কখনো ভুলেও এক নিমিষের জন্য একটুও ত্রুটি করবে না। জীবরেন একটু কসুরও খোদা মাফ করেন না। তোমরা হয়ত মনে করবে, প্রথমে একটু আধটু কসুর করে ভাল ভাল কাজ করবে, কিন্তু তা হয় না।


এটা পড়তে পারেন –কুরআনে কি অসম্পূর্ণ পানিচক্রের বিবরণ আছে ?

================

লেখক –  বন্দে আলী মিয়া