12.4 C
New York
Saturday, October 18, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 27

জনসংখ্যা ও বিশ্বাস

ইসলামের যেসব বিষয়ে আজ বহু মুসলিমদের মধ্যেই দোটানা কাজ করে, তার মধ্যে অন্যতম একটি হল ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ’। বিশেষ করে ছোটবেলা থেকেই যে বান্দারা ‘জনসংখ্যা বিস্ফোরণ’, ‘Population Problem’ ইত্যাদি রচনা-প্যারাগ্রাফ লিখে বড় হয়েছে, তারা দ্বীনদার হওয়ার পরও এবিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটুখানি খটকা যেন অনেকেরই থেকে যায়। আজ সে বিষয়েই একটু ঝাড়ফুঁক করা যাক।

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনবহুল দেশ চীন; ১৪১ কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস সেখানে। জীবনব্যবস্থা, প্রযুক্তি, চিকিৎসা প্রভৃতির উন্নতির সাথে সাথে হু হু করে জনসংখ্যা বেড়ে চলে। এই বিষয়টিকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নিয়ে চীন ১৯৭৯ তে One Child Policy চালু করে অর্থাৎ, কেউ একের অধিক সন্তান নিতে পারবে না। প্রথমদিকে ধারণা করা হয়েছিল এই তো চুকে যাবে জনসংখ্যা সমস্যা। তাহলে এর পরের গল্পে চোখ বুলানো যাক।

চীনা দম্পতিরা যখন দেখল একজনের বেশি সন্তান নিতে পারবে না, তারা ছেলে সন্তানকেই প্রাধান্য দিল। ‘বাবামায়ের বৃদ্ধ বয়সে ছেলে দেখেশুনে রাখবে’, ‘মেয়েকে তো পরের সংসারেই পাঠিয়ে দিতে হয়’ – এমনসব স্বাভাবিক ধারণা থেকেই একমাত্র সন্তানটি ছেলেই হোক চেয়েছিল চীনা দম্পতিরা। আর সেকারণে মেয়ে সন্তান হলে অ্যাবরশন করিয়ে ফেলতেও দ্বিধা করতো না। এভাবে করেই চলল দুই দশকেরও বেশি সময়।

ফলাফলে নিদারুণভাবে নষ্ট হয়ে গেল জেন্ডার রেশিও। এখন চীনে প্রতি ১০০ জন মেয়ের জন্য ১০৬ জন ছেলে। প্রথমে মনে হতে পারে মাত্র ৬ জন… তাহলে মোট জনসংখ্যার বিশালতার দিকে তাকান। আসল হিসাবে প্রায় ৬ কোটি নারী সংকটে পড়েছে চীন। এতটুকুতেই কাহিনী শেষ হতে পারতো। কিন্তু না, আরও এক জেনারেশন আগে থেকেই পুরুষেরা নারীর অভাবে বিয়ে করতে পারছে না। এখন বিয়ের বাজারে নারীদের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। অনেকে বিয়ের জন্য ষাট বছর পর্যন্ত টাকা জমিয়েছে এমনও নাকি হদিস রয়েছে। বিয়ে না করতে পারায় আর্থসামাজিক চরম অবক্ষয়ের মুখে রয়েছে চীন। অবশেষে ২০১৫ সালে চীন বাধ্য হয়ে উঠিয়ে দিয়েছে One Child Policy। কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হবার তা হয়েছে ভালভাবেই। 

ইকোনোমিস্টের একটি রিপোর্টে উঠে এসেছিল চীনের এইসমস্ত তথ্য। International Food Policy Research Institute (IFPRI) এ গত বছরের নভেম্বরে ইকোনোমিস্টের রিপোর্ট উল্লেখ করা হয়েছিল। [১] এছাড়া জার্নালগুলোতে ঘাঁটলে Gender Ratio সামান্য এদিক ওদিক হলেই সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কত ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে তা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাবেন। [২]


এটা পড়তে পারেন এক মূহুর্তের রাগ, সারা জীবনের কান্না।


শুধু চীন নয়, ভারত, ফ্রান্স, জার্মানি সহ অনেক দেশই Gender Ratio এর এই সমস্যায় মারাত্নক আক্রান্ত। রাশিয়ায় নাকি মেয়েরা বর খুঁজে পায় না। ‘দুইটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভাল হয়’ ধরনের ক্যাম্পেইন যখন এখানে জোরেশোরে চালানো হতো আর যুক্তি (অপ) দেখানো হতো, এ ব্যাপারে ইসলামের সাধারণ বিধান (অধিক সন্তান গ্রহণ) নিয়ে মুসলিমরা চুপসে থাকা শুরু হয়েছিল; আর আজ অবধি অনেকে চুপসেই আছে।

কাফিরদের যুক্তি আর লাইফস্টাইলে মুগ্ধ হয়ে ওদের থেকে ধার করা হয়েছিল এই বিষয়টি। এখনই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ না করলেও এমন অবস্থা চলতে থাকলে সব অঞ্চলই ধীরে ধীরে আর্থ সামাজিক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অতিপ্রাকৃতিক সত্ত্বা তথা আল্লাহর উপর বিশ্বাসকে ছাঁটাই করে যখন মানুষ নিজ বুদ্ধিতে কাজ করতে যায় তখন এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক

হ্যাঁ, মূল সমস্যা এটাই। কিছু বিষয়ই আছে যেগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা অসার বৈ কিছু নয়। কিছু বিষয়ই আছে যেগুলো সৃষ্টিকর্তার জিম্মাদারিতে ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা ও ধর্মব্যবস্থাকে রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে আলাদা করে ফেলা নাস্তিক্যবাদী সিস্টেম যুক্তি থেকে পণ্ডিতি করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। বড় বড় জায়ান্টরাই যে এখন সমস্যায় কুপোকাত হচ্ছে সেটা তো প্রত্যক্ষ। আর আমাদের সমস্যা হল, আমরা পরাজিত মনোভাব নিয়ে কাফিরদের ফালতু যুক্তিগুলোই বারবার শুনতে শুনতে সত্য ভেবে ওদেরকেই অনুসরণ করতে শুরু করি। একটা মিথ্যাকে বারংবার সত্য হিসেবে প্রচার করতে থাকলে সেটা একসময় সত্য হিসেবেই প্রচলিত হয়ে যায়। আর জনসংখ্যার এই ব্যাপারটা তারই একটা উদাহরণমাত্র।

কনভিন্সড না তাই না? বিশ্বাসের ব্যাপারটা এমনই, যুক্তি দিয়ে বিচার করতে চাইলে কনভিন্সড হওয়া গেলে সেটাকে ‘বিশ্বাস’ বলা হতো না। আরেকটি ছোট্ট বিষয় অবতারণা করেই তাহলে শেষ করি। সেটা হল The Returning Soldier Effect phenomenon : যুদ্ধ বিগ্রহ আর Stress এর সময় মেয়ে সন্তানদের তুলনায় ছেলে সন্তান অধিক হারে জন্ম নেয়। যুদ্ধ বিগ্রহ, আন্দোলন ইত্যাদিতে ছেলেরা সাধারণত বেশি মারা যায়, একইসাথে সেসময় জন্মগ্রহণ করা শিশুদেরও বেশিরভাগ হয় ছেলে! এমন ঘটনার সত্যতায় কোনো ভুল নেই, কিন্তু কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না কেন এমনটা হয়। একদিন হয়তো সাইকোলজির বা চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবষকেরা এই হরমোন, ঐ হরমোন ইত্যাদি বলে কয়ে কীভাবে হয় সেটার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাবে। কিন্তু ‘কেন হয়?’ সেই উত্তর ‘আল্লাহর বিশ্বাস’কে বাদ দেওয়া বোকারা কখনও ঠাহর করতে পারবে না।

References:

[১] https://tinyurl.com/y6wvalv4

https://twitter.com/TheEconomist/status/953312804622229505

https://tinyurl.com/yazylmhu

[২] http://www.pnas.org/content/103/36/13271.full

================

লেখক তানভীর আহমেদ

নবী একজন কিন্তু মাযহাব চারটি কেন ?

নবী একজন কিন্তু মাযহাব চারটি কেন ? কথা সত্য মতলব খারাপ। একটি কথোপকথন ।

একদা মুহাম্মদ আমীন সফদর রহঃ এর কাছে কয়েকজন কথিত আহলে হাদীসের লোক এল। এসে হযরতের কাছে বসল। বসেই বলতে লাগল-“আমরা অনেক পেরেশানীতে আছি। বহুত পেরেশানীতে আছি”।

সফদর রহঃ-“যারাই বড়দের ছেড়ে দেয়, তারা সারা জীবনই পেরেশানীতে থাকে। মওদুদী এই পেরেশানীতেই ছিল। কাদিয়ানীও এই পেরেশানীতেই ছিল। আপনারাও মনে হয় বড়দের ছেড়ে নিজেরাই সব বুঝতে চাচ্ছেন। এজন্যই পেরেশানীতে আছেন”।

কথিত আহলে হাদীস-চারজন ইমাম। চার, চার, চার। কি করবো আমরা?

সফদর রহঃ-আপনি এখানে চারজন পেলেন কোথায়? এখানেতো কোন হাম্বলী নেই। শাফেয়ীও নেই। মালেকীও নেই।

কথিত আহলে হাদীস-যদি চারজন হয়ে যায়!

সফদর রহঃ-হলে ভিন্ন কথা। সেই পেরেশানী এখনই কেন টেনে আনছেন?

কথিত আহলে হাদীস-এটা কেমন কথা যে, আল্লাহ,নবী এক আর  ইমাম হল চারজন?

সফদর রহঃ-এটা কেমন কথা যে, আল্লাহ এক আর নবী এক লাখ চব্বিশ হাজার? ওখানে যেমন বল যে, এক নবীকে মান, আর বাকিদের ছেড়ে দাও। এখানেওতো ব্যাপার তাই। এক ইমামকে মান। বাকিদের ছেড়ে দাও।

কোথাও কি আছে নাকি যে, ইমাম বেশি হতে পারবে না? যদি থাকে বলেন আমি মেনে নিব। আমি দেখি ইমাম বেশি হতে পারবে কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ فَلا تَكُنْ فِي مِرْيَةٍ مِنْ لِقَائِهِ وَجَعَلْنَاهُ هُدىً لِبَنِي إِسْرائيلَ وَجَعَلْنَا مِنْهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا

অর্থাৎ বাস্তব কথা হল আমি মুসাকে কিতাব দিয়েছি, সুতরাং (হে রাসূল!) তুমি তার সাক্ষাত সম্পর্কে কোন সন্দেহে থেকো না। আমি সে কিতাবকে বনী ইসরাঈলের জন্য বানিয়েছিলাম পথ-নির্দেশ।

আর আমি তাদের মধ্যে কিছু লোককে, এমন ইমাম বানিয়ে দিলাম, যারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথ প্রদর্শন করত। {সূরা সাজদা-২৩,২৪}

এক রাসূলের উম্মতের মাঝে কয়েকজন ইমাম হতে পারে। এটাতো কুরআন বলছে। কুরআনের শব্দ ইমামের বহুবচন আইয়িম্মাহ ব্যবহৃত হয়েছে।

কথিত আহলে হাদীস- চার ইমামই কি সঠিক?

সফদর রহঃ-হ্যাঁ, চার ইমামই সঠিক।

কথিত আহলে হাদীস-তাহলে চার ইমামের অনুসরণ করেন না কেন? শুধু নিজের ইমামের অনুসরণ করেন কেন?

সফদর রহঃ-যেমন সবাই এক লাখ চব্বিশ হাজার নবীকে সঠিক মানি, কিন্তু অনুসরণ করি আমাদের নবীর। তেমনি সঠিক মানি চার ইমামকেই। কিন্তু অনুসরণ করি নিজের ইমামকে।

কথিত আহলে হাদীস-কোন হাদীসে আছে নাকি এক ইমামের অনুসরণ কর?

সফদর রহঃ-আপনি কুরআন পড়েন?

কথিত আহলে হাদীস-হ্যাঁ পড়ি।

সফদর রহঃ-এক কেরাতে? না সাত কেরাতে?

কথিত আহলে হাদীস-এক কেরাতে?

সফদর রহঃ-সারা জীবন এক কেরাতে কুরআন পড়া আর বাকি কেরাতকে ছেড়ে দেবার কথা কুরআন বা হাদিসের কোথাও আছে?

কথিত আহলে হাদীস-আমাদের কাছে আছেই এটা। তাই পড়ি। কিন্তু এক ইমামের অনুসরণ করলেতো চতুর্থাংশ দ্বীন মানা হয়।

সফদর রহঃ-এক কেরাতে কুরআন পড়লে কি সাত ভাগের একভাগ সওয়াব পাওয়া যায়?

কথিত আহলে হাদীস-না, না, এক কিরাতে পড়লে পূর্ণ কুরআন পড়ার সওয়াবই পাওয়া যায়।

সফদর রহঃ-তেমনি এক ইমামকে মানলে পূর্ণ শরীয়তেরই অনুসরণ হয়।

কথিত আহলে হাদীস-আপনাদের আকল কখনো হবে না? ইমামদের মাঝেতো হারাম-হালালের মতভেদ। একজন যেটাকে হালাল বলেন, অন্যজন সেটাকে হারাম বলেন। তাহলে যিনি হারাম বলেন তিনিও সঠিক। আর হালাল যিনি বলেন তিনিও সঠিক! এটা কি করে সম্ভব?

সফদর রহঃ-আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ তায়ালা আকল দিয়েছেন। নবীগণ সবাই সঠিক।

আদম আঃ এর সময়ে আপন বোনকে বিবাহ করা জায়েজ। আমাদের দ্বীনে হারাম। কিন্তু উভয় নবীই সঠিক।

ইয়াকুব আঃ এর দুইজন স্ত্রী আপন বোন ছিল। এটা সে সময় জায়েজ ছিল। কিন্তু আমাদের নবীর দ্বীনে তা হারাম। উভয়ই সঠিক। সবার আল্লাহ একই। অথচ হুকুম ভিন্ন। তেমনি চার ইমামই সঠিক। কিন্তু তাদের হুকুম ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।

কথিত আহলে হাদীস-আরে এখানেতো নাসেখ মানসুখের বিষয়। একটি হুকুম এসে অন্যটাকে রহিত করে দিয়েছে।

সফদর রহঃ-আর ইমামদের ইখতিলাফের মাঝে রাজেহ-মারজুহ এর মাসআলা। তথা একটি হুকুমের উপর অন্যটিকে প্রাধান্য দেবার মাসআলা। যেমন রহিত হওয়া বিষয়ের উপর আমল জায়েজ নয়, তেমনি প্রাধান্য পাওয়া হুকুম রেখে অপ্রাধান্য পাওয়া বিষয়ের উপর আমল করাও জায়েজ নয়।

কথিত আহলে হাদীস-আপনারা যেহেতু অন্য ইমামদের মানেন না, তাহলে তাদের বাতিল বলেন না কেন? সঠিক বলেন কেন?

সফদর রহঃ-আদম আঃ সঠিক নবী হলে কেন বোনকে বিবাহ করা যায় না? ইয়াকুব আঃ সঠিক নবী হলে দুইবোনকে এক সাথে বিবাহ করা কেন করা যাবে না?

কথিত আহলে হাদীস-আমরা শুধু আমাদের নবীকে মানি। বাকিরাও হক একথা ঠিক আছে।

সফদর রহঃ-আমরাও বলি-অন্য ইমাম ঠিক আছে, কিন্তু আমরা মানি আমাদের ইমামকে।

কথিত আহলে হাদীস-সেখানেতো সময় আলাদা আলাদা।

সফদর রহঃ-এখানে এলাকা আলাদা আলাদা। শাফেয়ী শ্রীলংকায় আর হানাফী পাকিস্তানে [বাংলাদেশে]। সেখানে সময় আলাদা আলাদা, আর এখানে এলাকা আলাদা আলাদা।

কথিত আহলে হাদীস-যদি কোন মাসআলায় তিন ইমাম একদিকে হয় আর এক ইমাম একদিকে হয় তাহলে কী করবেন?

সফদর রহঃ-তিন জন নয়, তিন হাজার হলেও আমাদের ইমামকেই মানবো।

কথিত আহলে হাদীস-এটা কোন ইনসাফ হল?

সফদর রহঃ-অবশ্যই এটা ইনসাফ।

কথিত আহলে হাদীস-আরে অপরদিকে তিন ইমাম।

সফদর রহঃ-তাতে কি? আমরাতো আমাদের ইমামের অনুসরণ করবো। তিন হাজার হলেও কি?

কথিত আহলে হাদীস-আপনি কি জিদ করছেন নাকি?

সফদর রহঃ-নাহ, জিদ করবো কেন? ইউসুফ আঃ তার পিতা ইয়াকুব আঃ কে সিজদা করেছিলেন এটা কুরআনে আছে কি?

কথিত আহলে হাদীস-হ্যাঁ আছে।

সফদর রহঃ-সে আয়াতের তাফসীরে মুফাসসিরীনরা বলেন-হুজুর সাঃ এর নবুওয়াতের আগে সকল নবীর যুগে সম্মান করে সেজদা দেয়া জায়েজ ছিল। তো একদিকে এক লাখ তেইশ হাজার নয় শত নিরান্নবই নবীর কাছে সম্মানসূচক সেজদা জায়েজ। আর একজন হযরত মুহাম্মদ সাঃ বলেন জায়েজ নয়। আপনি বলছেন তিন জনের কথা। এখানে লাখের বিষয়। কাকে মানবেন? বিশাল জামাতকে? না একজনকে?

মুফাসসিরীনরা বলেন-প্রথম সকল নবীর শরীয়তে দেহযুক্ত ছবি আঁকা জায়েজ ছিল। কেবল আমাদের নবীর শরীয়তে না জায়েজ। তাহলে এক লাখ তেইশ হাজার নয় শত নিরান্নব্বই নবীর শরীয়ত মানবেন না আমাদের এক নবীর শরীয়ত মানবেন? বেশি কে না একজনকে?

কুরবানীর গোস্ত খাওয়া আমাদের নবীর আগে কারো শরীয়তে জায়েজ ছিল না। তাহলে কাকে মানবেন? লাখ নবীকে না আমাদের এক নবীকে?

কথিত আহলে হাদীস-[কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে] দ্বীন মক্কা-মদীনায় এসেছে? না কুফায়?

সফদর রহঃ-মক্কা-মদিনায়।

কথিত আহলে হাদীস-তাহলে মক্কা-মদিনার ইমামকে মানা উচিত না কুফার ইমামের?

সফদর রহঃ-আপনার মন কি বলে?

কথিত আহলে হাদীস-মক্কা-মদিনার ইমামদের মানা উচিত।

সফদর রহঃ-বড় একটি মিথ্যা কথা বলেছেন আপনি। কখনো এটা মাফ হবে না।

কথিত আহলে হাদীস-ভুল হইছে?

সফদর রহঃ-হ্যাঁ, বহুত বড়।

কথিত আহলে হাদীস-কিভাবে?

সফদর রহঃ-কুরআন মক্কা-মদিনায় নাজিল হয়েছে না?

কথিত আহলে হাদীস-হ্যাঁ।

সফদর রহঃ-সাত জন ক্বারী ছিল। এর মাঝে মক্কা-মদীনার ক্বারীও ছিল। বসরার ক্বারীও ছিল। কিন্তু সবাই ক্বারী আসেম কুফীর কিরাতে কুরআন কেন পড়েন? কুফী ক্বারীর কেরাতে কুরআন পড়লে আপনাদের থেকে বড় কুফী আর কে আছে? কুরআন নাজিল হয়েছে মক্কা-মদিনায় আর কেরাত পড় কুফীর! এটা কেমন কথা?

কথিত আহলে হাদীস-কুফার লোকেরাতো আর কুরআন নিজেরা বানায়নি। কুফাতে যে সাহাবারা এসেছেন তারা কুরআন সাথে নিয়ে এসেছিলেন।

সফদর রহঃ-মক্কা-মদিনা থেকে সাহাবারা গিয়ে কুরআন যদি কুফায় নিয়ে নতুন না বানিয়ে থাকেন, তাহলে নামায কি মক্কা-মদিনা থেকে সাহাবারা কুফায় নিয়ে গিয়ে নতুন নামায বানিয়ে ফেলেছেন?

খামোশ হয়ে গেল কথিত আহলে হাদীসের লম্বা জিহবা।


এটা পড়তে পারেন – মাযহাব কি ও কেন?

মাযহাব কি ও কেন?

প্রবন্ধটিতে যা জানতে পারব–

মাযহাব কি এবং কেন?
মাযহাব কি রাসূল,সাহাবী এবং তাবেঈ কারো মানার দলীল আছে?
কুরআন ও হাদীস দেখে আমল করলে অসুবিধা কোথায়?
মুহাদ্দিসগন কি মাযহাব মেনেছেন?
আমরা কেন চারটি মাযহাব থেকে বেছে বেছে মাসআলা আমল করতে পারব না?
কেন একটি মাযহাবই মানতে হবে?

মাযহাব কি

মুজতাহিদ হল কুরআন সুন্নাহ, সাহাবাদের ফাতওয়া, কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের ঐক্যমত্বে এবং যুক্তির নিরিখে কুরআন সুন্নাহ থেকে মাসআলা বেরকারী গবেষক দলের নাম। যারা নিষ্ঠার সাথে বিভিন্ন মূলনীতি নির্ধারণ করে কুরআন সুন্নাহর বাহ্যিক বিপরীতমুখী মাসআলার মাঝে সামাঞ্জস্যতা এনেছেন। কুরআন সুন্নাহর একাধিক অর্থবোধক শব্দের নির্ধারিত পালনীয় অর্থকে নির্ধারিত করে দিয়েছেন। নতুন উদ্ভূত মাসআলার শরয়ী মূলনীতির আলোকে সমাধান বরে করেছেন। সেই সাথে নতুন নতুন মাসআলার কোন মূলনীতির আলোকে হুকুম আরোপিত হবে যার বিধান সরাসরি কুরআন সুন্নাহে বর্ণিত নেই, সেই মূলনীতিও নির্ধারিত করেছেন। মূলত সেই গবেষক দলের নাম হল মুজতাহিদ। আর তাদের উদ্ভাবিত মূলনীতির আলোকে বের হওয়া মাসআলার নাম মাযহাব।

এবং কেন?

মাযহাব পালনের কথা এই জন্য বলা হয় যে, যেহেতু কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে আলেম খুবই নগণ্য। যারাও আছে তারা কুরআনে কারীমের কোন আয়াতের হুকুম রহিত হয়ে গেছে, কোন আয়াতের হুকুম বহাল আছে, কোন আয়াত কোন প্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে, কোন আয়াত কাদের উদ্দেশ্য করে নাজিল হয়েছে। কোন আয়াতাংশের প্রকৃত অর্থ কি? আরবী ব্যাকরণের কোন নীতিতে পড়েছে এই বাক্যটি? এই আয়াত বা হাদীসে কী কী অলংকারশাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে? ইত্যাদী সম্পর্কে বিজ্ঞ হন না। সেই সাথে কোনটি সহীহ হাদীস কোনটি দুর্বল হাদীস? কোন হাদীস কি কারণে দুর্বল? কোন হাদীস কী কারণে শক্তিশালী? হাদীসের বর্ণনাকারীদের জীবনী একদম নখদর্পনে থাকা আলেম এখন নাই। অথচ হাদীসের শক্তিশালী না হলে তার দ্বারা শরয়ী হুকুম প্রমাণিত হয়না।

এই সকল বিষয়ে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি পাওয়া যাওয়া দুস্কর। একেতু অধিকাংশ মানুষই আলেম না। আর মুষ্টিমেয় যারা আলেম তারাও উল্লেখিত সকল বিষয় সম্পর্কে প্রাজ্ঞ নয়। তাই আমাদের পক্ষে কুরআন সুন্নাহ থেকে সঠিক মাসআলা বের করা অসম্ভব।

একটি উদাহরণ

এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-اقيموا الصلاة  তথা সালাত কায়েম কর। আরেক আয়াতে বলেছেন-

إِنَّ اللَّهَ وَمَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ   

তথা নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা এবং ফেরেস্তারা নবীজীর উপর সালাত পড়ে। এই আয়াতের শেষাংশে এসেছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

তথা হে মুমিনরা তোমরাও তাঁর উপর সালাত পড় এবং তাঁকে সালাম জানাও। {সূরা আহযাব-৫৬}

এই সকল স্থানে লক্ষ্য করুন-“সালাত” শব্দটির দিকে। তিনটি স্থানে সালাত এসেছে। এই তিন স্থানের সালাত শব্দের ৪টি অর্থ। প্রথম অংশে সালাত দ্বারা উদ্দেশ্য হল “নামায” অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আমাদের নির্দেশ দিলেন যে, তোমরা নামায কায়েম কর।  {সূরা বাকারা-৪৩}

আর দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ও তার ফেরেস্তারা নবীজী সাঃ এর উপর সালাত পড়েন মানে হল-আল্লাহ তায়ালা নবীজী সাঃ এর উপর রহমত পাঠান, আর ফেরেস্তারা নবীজী সাঃ এর জন্য মাগফিরাতের দুআ করেন।

আর তৃতীয় আয়াতাংশে “সালাত” দ্বারা উদ্দেশ্য হল উম্মতরা যেন নবীজী সাঃ এর উপর দরূদ পাঠ করেন।

كتاب الكليات ـ لأبى البقاء الكفومى

একজন সাধারণ পাঠক বা সাধারণ আলেম এই পার্থক্যের কথা কিভাবে জানবে? সেতো নামাযের স্থানে বলবে রহমাতের কথা, রহমতের স্থানে বলবে দরূদের কথা, দরূদের স্থানে বলবে নামাযের কথা। এরকম করলে দ্বীন আর দ্বীন থাকবে না, হবে জগাখিচুরী।

এরকম অসখ্যা স্থান আছে, যার অর্থ উদ্ধার করা কঠিন। তাই একজন বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ ব্যক্তির শরাপন্ন হয়ে তার গবেষনা অনুযায়ী উক্ত বিষয়ের সমাধান নেয়াটাই হল যৌক্তিক। এই নির্দেশনাই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে দিয়েছেন-

فَاسْأَلوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ} النحل:43

তথা তোমরা না জানলে বিজ্ঞদের কাছে জিজ্ঞেস করে নাও। {সূরা নাহল-৪৩}

বিজ্ঞ ফুক্বাহায়ে কিরাম কুরআন সুন্নাহ, ইজমায়ে উম্মাত, এবং যুক্তির নিরিখে সকল সমস্যার সমাধান বের করেছেন। সেই সকল বিজ্ঞদের অনুসরণ করার নামই হল মাযহাব অনুসরণ। যেই অনুসরণের নির্দেশ সরাসরি আল্লাহ তায়ালা দিলেন পবিত্র কুরআনে।

মাযহাব কি রাসূল,সাহাবী এবং তাবেঈ কারো মানার দলীল আছে?

মাযহাব কি এটা নিশ্চয় আগের বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে। সেই হিসেবে রাসূল সাঃ এর দুনিয়াতে কারো মাযহাব অনুসরণের দরকার নাই। কারণ তিনি নিজেইতো শরীয়ত প্রণেতাদের একজন। তিনি কার ব্যাখ্যা গ্রহণ করে অনুসরণ করবেন? তিনি কেবল আল্লাহ তায়ালার থেকেই সমাধান জেনে আমল করেছেন, এবং আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন।

সাহাবীদের মাযহাব কি?

সাহাবায়ে কিরাম যারা সরাসরি রাসূল সাঃ এর কাছে ছিলেন তাদের জন্য রাসূল সাঃ এর ব্যাখ্যা অনুসরণ করা ছিল আবশ্যক। এছাড়া কারো ব্যাখ্যা নয়। কিন্তু যেই সকল সাহাবারা ছিলেন নবীজী সাঃ থেকে দূরে তারা সেই স্থানের বিজ্ঞ সাহাবীর মাযহাব তথা মত অনুসরণ করতেন। যেমন ইয়ামেনে হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ এর মত তথা মাযহাবের অনুসরণ হত। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদের অনুসরণ করতেন ইরাকের মানুষ।

রাসূল সাঃ যখন মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ কে ইয়ামানে পাঠাতে মনস্ত করলেন তখন মুয়াজ রাঃ কে জিজ্ঞেস করলেন-“যখন তোমার কাছে বিচারের ভার ন্যস্ত হবে তখন তুমি কিভাবে ফায়সাল করবে?” তখন তিনি বললেন-“আমি ফায়সালা করব কিতাবুল্লাহ দ্বারা”। রাসূল সাঃ বললেন-“যদি কিতাবুল্লাহ এ না পাও?” তিনি বললেন-“তাহলে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর সুন্নাত দ্বারা ফায়সালা করব”। রাসূল সাঃ বললেন-“যদি রাসূলুল্লাহ এর সুন্নাতে না পাও?” তখন তিনি বললেন-“তাহলে আমি ইজতিহাদ তথা উদ্ভাবন করার চেষ্টা করব”। তখন রাসূল সাঃ তাঁর বুকে চাপড় মেরে বললেন-“যাবতীয় প্রশংসা ঐ আল্লাহর যিনি তাঁর রাসূলের প্রতিনিধিকে সেই তৌফিক দিয়েছেন যে ব্যাপারে তাঁর রাসূল সন্তুষ্ট”। {সূনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৫৯৪, সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং-১৩২৭, সুনানে দারেমী, হাদিস নং-১৬৮, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২২০৬১}

এই হাদীসে লক্ষ্য করুন-রাসূল সাঃ এর জীবদ্দশায় হযরত  মুয়াজ রাঃ বলছেন যে, আমি কুরআন সুন্নাহ এ না পেলে নিজ থেকে ইজতিহাদ করব, আল্লাহর নবী বললেন-“আল হামদুলিল্লাহ”। আর ইয়ামেনের লোকদের উপর হযরত মুয়াজের মত তথা মাযহাব অনুসরণ যে আবশ্যক এটাও কিন্তু হাদীস দ্বারা স্পষ্ট।

এছাড়া সাহাবাদের যুগে যে সকল সাহাবাদের মাযহাব তথা মত অনুসরণীয় ছিল। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হল-

হযরত ওমর বিন খাত্তাব রাঃ, হযরত আলী বিন আবু তালিব রাঃ, হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাঃ, হযরত আয়েশা রাঃ, হযরত জায়েদ বিন সাবেত রাঃ, হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ, হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ প্রমূখ সাহাবাগণ।

তাবেয়ীদের মাযহাব

তাবেয়ীরা যেই সকল এলাকায় থাকতেন, সেই সকল এলাকার বিজ্ঞ সাহাবীদের বা বিজ্ঞ মুজতাহিদের মত তথা মাযহাবের  অনুসরণ করতেন। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলেন-

হযরত সাঈদ বিন মুসায়্যিব রহঃ, হযরত আবু সালমা বিন আব্দির রহমান রহঃ, হযরত ওরওয়া বিন জুবাইর রহঃ হযরত কাসেম বিন মুহাম্মদ রহঃ, হযরত সুলাইমান বিন ইয়াসার রহঃ, হযরত খারেজা বিন জায়েদ রহঃ প্রমূখবৃন্দ।

তারপর মদীনায় যাদের মত তথা মাযহাবের অনুসরণ করা হত তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হল-হযরত ইমাম জুহরী রহঃ, হযরত ইয়াহইয়া বিন সাঈদ রহঃ, হযরত রাবিয়া বিন আব্দির রহমান রহঃ।

আর মক্কা মুকার্রমায় ছিলেন আতা বিন আবি রাবাহ রহঃ, আলী বিন আবি তালহা রহঃ, আব্দুল মালিক বিন জুরাইজ রহঃ প্রমূখ।

আর কুফায় ছিলেন হযরত ইবরাহীম নাখয়ী, আমের বিন শুরাহবীল, শা’বী, আলকামা, আল আসওয়াদ রহঃ।

আর বসরায় ছিলেন-হাসান বসরী রহঃ। ইয়ামানে হযরত তাওস বিন কায়সান রহঃ। শামে হযরত মাকহুল রহঃ প্রমূখ।

যাদের ফাতওয়া বিধৃত হয়েছে-মুয়াত্তাগুলোতে।, মুসনাদগুলোতে, আর সুনানগুলোতে, যেমন মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, কিতাবুল আসার, শরহু মায়ানিল আসার ইত্যাদী গ্রন্থে।

কুরআন ও হাদীস দেখে আমল করলে অসুবিধা কোথায়?

কি কি অসুবিধা তা আশা করি মাযহাব কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে পেয়ে গেছেন। সেই উত্তরটি আবার দেখে নিন।

মুহাদ্দিসগন কি মাযহাব মেনেছেন?

এই কথাটি বুঝার আগে একটি কথা আগে বুঝে নিন। সেটা হল-রাসূল সাঃ এর যুগ থেকেই দু’টি দল চলে আসছে, একটি দল হল যারা ইজতিহাদ তথা উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী। তারা ইজতিহাদ করতেন তথা মত দিতেন বিভিন্ন বিষয়ে। আর একদল ছিলেন যাদের এই ক্ষমতা ছিলনা, তারা সেই মুজতাহিদদের মতের তথা মাযহাবের অনুসরণ করতেন।

ঠিক একই অবস্থা ছিল সাহাবাদের যুগে। একদল ছিল মুজতাহিদ, যাদের একটি তালিকা ইতোপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। আর বিশাল এক জামাত ছিল যারা ইজতিহাদের ক্ষমতা রাখতেন না। তারা সেই সকল মুজতাহিদদের মাযহাব তথা মতের অনুসরণ করতেন। তেমনি তাবেয়ীদের একই অবস্থা ছিল, একদল মুজতাহিদ, আরেকদল মুকাল্লিদ তথা অনুসারী। এমনি মুহাদ্দিসীনদের মাঝেও দুই দল ছিল, একদল ছিল যারা ইজতিহাদের ক্ষমতা রাখতেন, আরেকদল ছিল যারা ইজতিহাদের ক্ষমতা রাখতেন না। তাই তাদের মাঝে কারো কারো মাযহাব রয়েছে কারো কারো নেই। কেউ কেউ নিজেই মাসআলা বের করেছেন, কেউ কেউ অন্য কোন ইমামের অনুসরণ করেছেন।

যেমন ইমাম বুখারী মুজতাহিদ ছিলেন, তাই তার কারো অনুসরণের দরকার নাই। তবে কেউ কেই তাকে শাফেয়ী মাযহাবী বলে মত ব্যক্ত করেছেন। {আল ইনসাফ=৬৭, তাবাকাতুশ শাফেয়িয়্যাহ-২/২, আবজাদুল উলুম—৮১০}

এমনিভাবে ইমাম মুসলিম রহঃ ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। {আল হিত্তাহ-১৮৬}

নাসায়ী শরীফের সংকলক ইমাম নাসায়ী রহঃ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহঃ এর মাযাহাবের অনুসারী ছিলেন।, ইমাম আবু দাউদ রহঃ, ও ছিলেন হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী। {ফয়জুল বারী-১/৫৮, আবজাদুল উলুম-৮১০, ইলাউল মুয়াক্কিয়ীন-১/২৩৬}

১। ইমাম বুখারী রহঃ শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী।
সুত্রঃ নবাব ছিদ্দিক হাসান খান লিখিত আবজাদুল উলুম পৃষ্ঠা নং ৮১০, আলহিত্তা পৃষ্ঠা নং ২৮৩।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহঃ লিখিত আল-ইনসাফ পৃষ্ঠা নং ৬৭।
আল্লামা তাজ উদ্দীন সুবকী রহঃ লিখিত ত্ববকাতুশ শাফেয়ী পৃষ্ঠা নং ২/২।
✿২। ইমাম মুসলিম রহঃ শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী।
সুত্রঃ ছিদ্দিক হাঃ খান লিখিত আল-হিত্তা পৃষ্ঠা নং ২২৮।
✿৩। ইমাম তিরমিজী নিজে মুজ্তাহিদ ছিলেন। তবে হানাফী ও হাম্বলী মাজহাবের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন।
সুত্রঃ শা ওয়ালিউল্লাহ রহঃ লিখিত আল-ইনসাফ পৃষ্ঠা নং ৭৯।
✿৪। ইমাম নাসাঈ শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী ছিলেন।
সুত্রঃ নঃ ছিঃ হাঃ লিখিত আল-হিত্তা পৃষ্ঠা নং ২৯৩।
✿৫। ইমাম আবুদাউদ রহঃ শাফেয়ী।
সুত্রঃ আল-হিত্তা পৃষ্ঠা নং ২২৮।
আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহঃ ইবনে তাইমিয়ার উদ্দৃতি দিয়ে ফয়জুল বারী ১/৫৮ তে ইমাম আবুদাউদ রহঃকে হাম্বলী বলে উল্যেখ করেছেন।
✿৬। ইমাম ইবনে মাজাহ শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী।
সুত্রঃ ফয়জুলবারী ১/৫৮।
এ গেল ছিহাহ ছিত্তার ইমামগণের মাজহাব।
অন্যান্য ইমামগণের মাজহাব নবাব ছিদ্দীক হাসান খান সাহেবের আল-হিত্তা থেকে।
╚►৭। মিশকাত শরিফ প্রণেতা সাফেয়ী, পৃঃ১৩৫
╚►৮। ইমাম খাত্তাবী রহঃ শাফেয়ী, পৃঃ ১৩৫
╚►৯। ইমাম নববী রহঃ শাফেয়ী, পৃঃ ১৩৫
╚►১০। ইমাম বাগভী রহঃ শাফেয়ী, পৃঃ ১৩৮
╚►১১। ইমাম ত্বহাবী হাম্বলী, পৃঃ১৩৫
╚►১২। বড় পীর আঃ কাদের জিলানী রহঃ হাম্বলী, পৃঃ ৩০০
╚►১৩। ইমাম ইবনে তাইমিয়া হাম্বলী, পৃঃ ১৬৮
╚►১৪। ইবনে কায়্যিম রহঃ হাম্বলী, পৃঃ১৬৮
╚►১৫। ইমাম আঃ বার রহঃ মালেকী, পৃঃ১৩৫
╚►১৬। ইমাম আঃ হক রহঃ হানাফী, পৃঃ১৬০
╚►১৭। শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহঃ হানাফী, পৃঃ ১৬০-১৬৩
╚►১৮। ইমাম ইবনে বাত্তাল মালেকী, পৃঃ২১৩
╚►১৯। ইমাম হালাবী রহঃ হানাফী পৃঃ২১৩
╚►২০। ইমাম শামসুদ্দীন আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুদদায়েম রহঃ শাফেয়ী, পৃঃ২১৫
╚►২১। ইমাম বদরুদ্দীন আঈনী রহঃ হানাফী, পৃঃ২১৬
╚►২২। ইমাম যারকানী রহঃ শাফেয়ী, পৃঃ ২১৭
╚►২৩। ইমাম ক্বাজী মুহিব্বুদ্দীন হাম্বলী, পৃঃ ২১৮
╚►২৪। ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী, পৃঃ২১৯
╚►২৫। ইমাম বুলকিনী শাফেয়ী, পৃঃ ২১৯
╚►২৬। ইমাম মার‍্যুকী মালেকী পৃঃ ২২০
╚►২৭। ইমাম জালালুদ্দীন বকরী শাফেয়ী, পৃঃ২২০
╚►২৮। ইমাম কুস্তলানী শাফেয়ী, পৃঃ২২২
╚►২৯। ইমাম ইবনে আরাবী মালেকী, পৃঃ ২২৪
এমন কি তাদের মডেল আব্দুল ওয়াহ্হাব নজদীকে ও হাম্বলী বলে উল্লেখ করেছেন তার আল্-হিত্তাতু ফিস সিহাহিস সিত্তাহ’র ১৬৭ পৃষ্ঠায়।

ইমাম তাহাবী রহঃ ছিলেন হানাফী রহঃ এর অনুসারী। যা তার সংকলিত তাহাবী শরীফ পড়লেই যে কেউ বুঝতে পারবে। এছাড়াও বাকি সকল মুহাদ্দিস হয়ত মুজতাহিদ ছিলেন, নতুবা ছিলেন মুকাল্লিদ কোননা কোন ইমামের।

কেন একটি মাযহাবই মানতে হবে?

কুরআনে কারীম ৭টি কিরাতে নাজীল হয়েছে। কিন্তু একটি কিরাতে প্রচলন করেছেন হযরত উসমান রাঃ। যেটা ছিল আবু আসেম কুফী রহঃ এর কিরাত। এর কারণ ছিল বিশৃংখলা রোধ করা। যেন দ্বীনকে কেউ ছেলেখেলা বানিয়ে না ফেলে। আর সবার জন্য এটা সহজলভ্য হয়।

তেমনি একটি মাযহাবকে আবশ্যক বলা হয় এই জন্য যে, একাধিক মাযহাব অনুসরণের অনুমোদন থাকলে সবাই নিজের রিপু পূজারী হয়ে যেত। যেই বিধান যখন ইচ্ছে পালন করত, যেই বিধান যখন ইচেছ ছেড়ে দিত। এর মাধ্যমে মূলত দ্বীন পালন হতনা, বরং নিজের প্রবৃত্তির পূজা হত। তাই ৪র্থ শতাব্দীর উলামায়ে কিরাম একটি মাযহাবের অনুসরণকে বাধ্যতামূলক বলে এই প্রবৃত্তি পূজার পথকে বন্ধ করে দিয়েছেন। যা সেই কালের ওলামায়ে কিরামের সর্বসম্মত সীদ্ধান্ত ছিল। আর একবার উম্মতের মাঝে ইজমা হয়ে গেলে তা পরবর্তীদের মানা আবশ্যক হয়ে যায়। ইমাম ইবনে তাইমিয়াও লাগামহীনভাবে যে মাযহাব মনে চায় সেটাকে মানা সুষ্পষ্ট হারাম ও অবৈধ ঘোষণা করেন। {ফাতওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া-২/২৪১}

বিস্তারিত জানতে দেখুন

১-তাযাল্লিয়াতে সফদর, মাওলানা মুহাম্মদ আমীন সফদর প্রণীত।

২-মাযহাব মানি কেন? মুফতী রফিকুল ইসলাম আল মাদানী প্রণীত

৩-মাযহাব কি ও কেন? মুফতী তাকী উসমানী কৃত।


এটাও পড়ুন – নবী একজন কিন্তু মাযহাব চারটি কেন ?

এ যুগের ইব্রাহিম আদহাম

তাবলীগ আমার কাজ। ২০০৯ সালের কথা। দিল্লী নিজামুদ্দীন মারকাজে তাকে প্রথম কাছ থেকে দেখি।এর আগে দূর থেকে চিনতাম। নানান সফরে সাথীদের কাছে তার অনেক কারগুজারি শুনেছি। হঠাৎ দেখি আরব খিত্তায় নাস্তা লাগিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে একজন সবাইকে হাত ধুয়ে দিচ্ছেন ।আমি গিয়েছিলাম এক দ্বীনি বন্ধুর সাহায্যে আরবদের তাবলিগী চালচলন উপভোগ করার জন্য আরব খিত্তায়। বন্ধু খলিল আমাকে বললো দেখো ইনি হলেন কাতারের যুবরাজ। বাদশাহী ছেড়ে যিনি তাবলীগের পথে। আমি কাতারের যুবরাজ শেখ ফাহাদ বিন হামদের কথা বলছি।

তখন অবাক হয়ে দেখলাম অনেক্ষণ। চোখের জল সামলানো মুশকিল হয়ে দাড়িয়েছিলো। ঐ দিন দুপুরে আবার দেখি ঐ ব্যক্তিকে, মারকাজের বাহিরে সাধারণ একটি চা ষ্টল থেকে চা নিয়ে আসতেছেন। চুপচাপ দেখলাম। মাগরিবের নামাজের পুর্ব মুহুর্তে দেখলাম, মারকাজ মসজিদের একেবারে প্রথম কাতারের এক কোনায় নিরবে বসে কেউ যেন হাউ হাউ করে কাঁদতেছে। মাথার উপর বড় একটা রোমাল দিয়ে সমস্ত মুখ মণ্ডল আবৃত্ত করা। চিনতে পারা মুশকিল। আমিও একটু কিনারে বসে দুয়া শুরু করলাম। মাগরিবের আজান শুরু হলে দোয়া থেকে হাত নামান তিনি। আমিও দোয়া শেষ করে এদিক ওদিক তাকাই। এদিকে আজানও শেষ হলো।তখন দেখি ইনি তো সেই ব্যক্তি, যিনি কাতারের যুবরাজ । উনার দিকে আমার তাকানো দেখে আমাকে সালাম দিলেন। আমিও সালাম গ্রহণ করে জবাব দিলাম । এই সল্প সময়ের মধ্যে আমাকে প্রশ্ন করলেন, ইউ ফ্রম? আমি বললাম আই এম বাংলাদেশী। সাথে সাথে আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে নিয়ে অনেক্ষণ রাখলেন। আর দোয়া দিতে থাকলেন।

পরক্ষনেই নামাজ শুরু হয়ে গেলো,, নামাজের পর সুন্নত পড়ে ঐ আল্লাহর ওলীর সাথে বেশ মুজাকারা হয়। বাংলাদেশে চার মাসের সফর করে দ্বীন শিখেছেন। আরব হয়েও আলেমদের প্রতি তাঁর সীমাহিন শ্রদ্ধা দেখলে অবাক হতে হয়। আলেমদের খেদমত করা নিজের জন্য পরম সৌভাগ্য মনে করেন। দুদিন তাকে কাছে থেকে দেখে আমি বুজতে পারলাম, তাঁর মধ্যে উম্মতের হেদায়তের কি পরিমান ফিকির রয়েছে! কারণ,, যাদের অর্থ, স্বাস্থ্য, সম্মান কোন ধরনের অভাব নেই, তারা কেন মসজিদের কোনে নিরিবিলি বসে এত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদেন হাউমাউ করে। কিসের নেশায়, কোন দরদ আর ভয়ে।

===============

ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান। হওয়ার কথা ছিল বর্তমান বাদশাহ
কিন্তু না, রাজ সিংহাসনের মোহ থাকে রাজদরবারে আটকাতে পারেনি।
রাজ মুকুটের লোভ ছেড়ে খোদার প্রেমে তিনি এখন একজন আপাদমস্তক দা’য়ী ইলাল্লাহ। রাজমহল ছেড়ে তিনি পড়ে থাকেন কাতার মার্কাজ মসজিদে।
সেখানে নিজের প্রতিষ্টিত হিফজ খানাতেই থাকেন সাধারন তালেবে এলেমদের সাথে। অধিকাংশ সময়ই কাটান দেশ থেকে দেশান্তরে তাবলীগ জামাতের সফরে।

আমরা বলখের বাদশাহ, ইব্রাহিম ইবনে আদহাম এর কথা ইতিহাসে পড়েছি।
তিনি কি তার চেয়ে কম? আমার সৌভাগ্য, আমাদের বর্তমান আধুনিক যুগে এমন মানুষের দেখা পেয়েছি।

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্যমতে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনী দেশ কাতার। 
পৃথিবীর সেরা সূখি মানুষদের দেশ। আইএমঅএফ এর তথ্যমতে মাথাপিছু সর্বোচ্চ আয়ের দেশ। প্রাকৃতিক গ্যাস ভান্ডারে কাতারের অবস্থান তৃতীয়। 
অতি সম্প্রতি ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক হয়ে বিশ্ব দরবারে কাতার সদর্পে ঘোষণা করেছে নিজেদের সমৃদ্ধ অর্থনীতির কথা।
১৯৭২ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সেখানে রাজতান্ত্রিক শাসন চলছে।

কাতারের ঐতিহ্য ও শাসনরীতি অনুযায়ী দেশটির ক্রাঊন প্রিন্স বা যুবরাজ পরবর্তী আমির হন। যুবরাজ হন সাধারণত বাদশাহ বা আমিরের বড় ছেলে।
সে রীতি অনুযায়ী পরবর্তী খলিফা বা বাদশাহ হওয়ার কথা ছিল শেখ ফাহাদ বিন হামদ বিন খলিফা আল সানির। কিন্তু না! সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভবিষ্যতের বাদশাহ নিজের যুবরাজের পদটি ছেড়ে দেন তার ছোট ভাই শেখ তামিম বিন হামদ বিন খলিফা আল সানির জন্য ( বর্তমান বাদশাহ)।

তিনি বেছে নেন অন্য এক পদ। রাজ পরিবারের অঢেল বিলাস বৈভব ছেড়ে তিনি দিনহীন সাধারণ মানুষের মতো নেমে পড়েন আলোর পথে,আল্লাহর পথে। 
আল্লাহর রাস্তার মেহনতে এখন তার চির বিচরণ। ছিলেন কাতার সেনাবাহীনীর জেনারেল। পড়ালেখা করেছেন দাদার ( সাবেক বাদশাহ) ইচ্ছায় আমেরিকা ডিফেন্স ইউনির্ভাসিটিত। সেখানেই পরিচিত হন তাবলীগ জামাতের সাথীদের সাথে। সেনা অফিসার থাকা অবস্থায়ই তাবলিগের সঙ্গে জরিয়ে পড়েন ওতঃপ্রোত ভাবে। একসময় ছেড়ে দেন চাকুরী। শুধু কি তাই?

তাকে প্রস্তাব করা হয় তিনি যেন কমপক্ষে কাতারের ধর্ম মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে দ্বীনের কাজ করেন। তিনি তাও ফিরিয়ে দিলেন। বিনয়ের সাথে এই কথা বলেন, “মন্ত্রী হলে সিকউরটি থাকবে। এতে সাধারন মানুষ অহরহ আসতে পারবেনা আমার কাছে। আর আমার কাজইতো সর্ব সাধারনের দ্বারে দ্বারে বারে বারে যাওয়া।’

রাজকীয় সমস্ত ভোগ-বিলাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন মানুষের দ্বারে দ্বারে ইসলামের আলো পৌঁছে দিতে। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে কাজ করার তাগিদে তিনি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ৪মাস লাগিয়েছেন।এর পর পাক ভারত বাংলাদেশের মুরব্বিদের সাহচর্যে আরো কিকিছু সসয় থেকে নিজেকে আমূল বদলে ফেলেন।শুরু করেন দেশ- বিদেশে দ্বীনের দাওয়াতের কাজ।

=====================

তিনি প্রতিবছর আসেন আমাদের বাংলাদেশ বিশ্ব ইজতেমায়। ঘুরেন গ্রামে গ্রামে। এভাবে পৃথিবীর পথে প্রান্তরে। থাকেন মাটির বিছানায়। টিনের ছালা কিংবা মাটির দেয়ল ঘেরা অনেক মসজিদে।
সাধারন গ্রাম্য টয়লেট ব্যবহার করেন নিঃসংকোচে।
বাংলাদেশের আমার এক বন্ধুর কথা অনুযায়ী- চাপাইনবাবগঞ্জ, ভোলা, টেকনাফ ও ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে,পথে-ঘাটে দাওয়াতের উদ্দেশ্যে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন নিতান্তই একজন সাধারন সাদা মাটা দা’য়ী হিসাবে। তাবলীগের ঈমানী মেহনত একজন মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে শেখ হামাদ তার উজ্জল দৃষ্টান্ত।

রাজকীয় পরিচয়ের বাহিরে তৈরী করেছেন সাধারন নাগরিক পরিচয়ের পাসর্পোট। তার জামাতের কয়েকজন ছাড়া কেউ জানতো না তার পরিচয়।
তিনি নিজেকে এতোটাই লুকিয়ে রাখেন যে, এক বন্ধু আমাকে বললেন বাংলাদেশস্থ কাতার দূতাবাসও জানতে পারেনি তার বাংলাদেশে অবস্থানের কথা। প্রায় প্রতি বছরই আসেন বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমায়।
তার পরিবারের সদস্যরা রাজকীয় প্লেন নিয়ে আসলেও তিনি আসেন সাধারন মানুষের সাথে জামাত বন্দি হয়ে।

রাজ-পরিবারের অতীব গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়েও তিনি নিজের জন্য দু’টি
পাসপোর্ট ব্যবহার করেন।একটি রাজকীয় কোন সফরে যান তখনই শুধু রয়েল পাসপোর্টটি ব্যবহার করেন। অন্যথায় তিনি সবসময় তিনি সাধারণ কাতারি পাসপোর্টটি ব্যবহার করেন। ইমিগ্রেশনের লোকজনও তার এই সাধারণ পাসপোর্টে তাকে চিনতে পারে না। তার সাধারণ চলাফেরার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো,তিনি সবসময় মিডিয়ার একেবারে অন্তরালে থাকেন। তাই তার বর্তমান বা দু’এক দশকের কোন ছবি মিডিয়ার কাছে নেই।

তার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাওয়াতের কাজে সময় লাগানো একজন তাবলিগি সাথী নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,কোন মসজিদে যখন যুবরাজ শেখ ফাহাদ যেতেন ,তখন জামাতের আমির তাকে যদি সমাজের নেতৃস্থানীয় কোনো লোক যেমন,এলাকার চেয়ারম্যান,বড় ব্যাবসায়ী,রাজনৈতিক নেতার কাছে তশকিলে পাঠাতে চাইতেন ।তখন তিনি তাদের কাছে না গিয়ে এলাকার নিম্নশ্রেণীর কাছে যেতে পছন্দ করতেন।
নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তির বদলে তিনি ছুটে যেতেন সাধারণ রিক্সাওয়ালা,পান বিক্রেতা, কৃষক,শ্রমিকদের কাছে। তাদের পাশে বসে,তাদের হাত ধরে দ্বীনের কথা শোনানোর জন্য নিয়ে আসতেন মসজিদে।

নিজ হাতে তাদের আপ্যায়ন করাতেন। এভাবেই তিনি নিজের রাজকীয় গর্বকে মিটিয়ে দিয়েছিলেন ভারত, পাকিস্তান, বেশীরভাগ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আত্মশুদ্ধির কল্যাণে। আরবি, ইংরেজী, ফ্রেঞ্চ,  জার্মানি,উর্দুসহ কয়েকটি ভাষায় পারদর্শী এই যুবরাজ রাজ- পরিবারের সদস্য হলেও ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সরল জীবন যাপন করেন। বর্তমানে উপমহাদেশের তাবলিগওয়ালা মানুষজন অনেকেই তার পরিচয় জেনে যাওয়ায় তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় লম্বা সফর কমিয়ে দিয়েছেন।তিনি আফ্রিকা মহাদেশে কয়েক বছর একাধারে মেহনত করেছেন নিরলসভাবে। আফ্রিকার প্রায় প্রতিটি দেশে তিনি দাওয়াতে তাবলিগের মিশন নিয়ে ছুটে গেছেন বহুবার।

জানামতে বর্তমানে তিনি আরব,ইউরোপ ও আমেরিকায় বেশি কাজ করতেছেন। আরবের কোন দেশেই তাবলিগ জামাত উপমহাদেশের মতো মসজিদ কেন্দ্রিক কাজ করার অনুমতি নেই।সেখানে কাজ করতে হলে তাবলিগ জামাতের জন্য আলাদা কামরা বা হোটেল বা হল ভাড়া করে নিতে হয়। কিন্তু শুধুমাত্র যুবরাজ শেখ ফাহাদের কারণেই আরবের মধ্যে কেবল কাতারে সাধারণভাবে মসজিদ ভিত্তিক তাবলিগ জামাতের কর্ম সম্পাদন করার অনুমতি আছে। কাতারের ধর্মমন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে তাবলিগের উপর খড়্গহস্ত হতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক চাপে। কিন্তু শুধু ঐ যুবরাজের কারণে কাতার সরকার তাবলিগবিরোধী কোনো কর্মসূচি গ্রহণে সাফল্য লাভ করেনি। তার দাওয়াতের কারণে কাতারের উচ্চস্তরের অনেক মানুষ তাবলিগ জামাতের সাথে যুক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজ পরিবারের অনেক সদস্য যেমন আছে তেমনি আছে ধনাঢ্যরা। বাংলাদেশের এক বন্ধু বলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় এবার বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে কাতার থেকে আগত মেহমানদের বহর দেখে।

রাজপরিবার, মন্ত্রীরা সহ তিনটি বিমান রিজার্ভ করে তারা টঙ্গি তুরাগ তীরের বিশ্ব ইজতেমায় এসেছেন। এই তিনটি বিমান ইজতেমার কয়েকদিন বাংলাদেশের বিমানবন্দরেই অবস্থান করে। ইজতেমা শেষ করে তদের নিয়েই তা উড়ে যায় কাতারে। রাজ-পরিবারের মাঝেও তিনি তাবলিগের দাওয়াত ছড়িয়ে দিয়েছেন।তার চাচাতো ভাই শেখ নাসের যুক্ত হয়েছেন তাবলিগের এই নিঃস্বার্থ দাওয়াতি কাজে। কাতারের সাবেক ধর্মমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহও বর্তমানে তাবলিগের কাজে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছেন। শোনা যায়, সৌদি বাদশাহ নাকি সন্ত্রাসবাদের অজুহাত তুলে অনেকবার কাতারের বাদশাহ হাম্মাদ বিন খলিফাকে তার দেশে তাবলীগের কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু কাতারের আমির সৌদি বাদশাহকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন,কোনভাবেই তিনি তার দেশে তাবলিগের কার্যক্রমে কোনো হস্তক্ষেপ করবেন না। কেননা, তিনি উপলব্ধি করেছেন, পৃথিবীতে একমাত্র এই একটি জামাত অনন্য পদ্ধতিতে নিঃস্বার্থভাবে দ্বীনের খেদমত করে যাচ্ছে। উপরন্ত তিনি সৌদি বাদশাহকে বলেছেন, সৌদি আরবে তাবলিগের ওপর যে সমস্ত বিধি-নিষেধ আছে তা তুলে দিয়ে তাদেরকে বেশি করে কাজ করার সুযোগ করে দেয়া উচিৎ।

প্রসাদ ছেড়ে আল্লাহর পথে চলে আসা এই যুবরাজ এভাবেই নিজের জীবনকে ইসলামের খেদমতে সেপে দিয়েছেন।তিনি যেন এ যুগের ইব্রাহীম ইবনে আদাম (রহঃ)। আমাদের সন্তানদের আমরা ফাহাদ বিন হামদের রাজকীয় জীবন বদলে যাওয়ার গল্প শুনাব ইব্রাহিম ইবনে আদহামের মত।

আল্লাহ তাকে দীর্ঘ হায়াতে তৈয়েবা নসীব করুন। আরও বেশী করে তাকে দ্বীনের খেদমতের তৌফিক্ব দান করুন। সাথে আমাদের সকলকে যেন তার মত জীবনকে পরিবর্তন করে দ্বীনের মেহনত করার তৌফীক্ব দেন।


এটা পড়তে পারেন –মাওলানা ভাসানী (রহ:) আজো কেন আমাদের কাছে অজানা ?

 

=========================

লেখক— সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ

হৃদ‌য়ে আঁ‌কি মহাম‌া‌নবের ছ‌বি

মানুষ সবাই আল্লাহর সৃ‌ষ্টি। দু‌নিয়ার শুরু লগ্ন থে‌কে নিয়ে অদ্যব‌ধি মানু‌ষের বসবাস এ পৃ‌থিবীজু‌ড়ে। কেয়ামত পর্যন্ত থাক‌বে মানু‌ষের বসবাস। যা‌দের পথচলা শুরু হ‌য়ে‌ছিল পৃ‌থিবীর সূচনাল‌গ্নে, সে মানুষগু‌লো এখন আর নেই। আজ‌কের মানুষগু‌লোও এক‌দিন হা‌রি‌য়ে যাবে। থে‌মে যা‌বে তা‌দের পথচল‌া। মানুষ চ‌লে যায়, ত‌বে র‌য়ে যায় তার রে‌খে যাওয়া আদর্শ। ‌কীর্ত‌ি বেঁচে থাকে আজীবন।

পৃ‌থিবীর ই‌তিহাসে এমন এক মান‌বের আ‌বির্ভাব ঘটে‌ছে। যি‌নি মহামানব,অতুলনীয়। তার ম‌তো আ‌রেক‌টি মানুষ আসে‌নি। আস‌বেও না। ইয়াকুত তো পাথর ত‌বে সাধারণ কোন পাথর নয়। এ‌ম‌নিভা‌বে তি‌নিও একজন মা‌টির‌ তৈ‌রি মানুষ; ত‌বে সাধারণ মানুষ নন। এ সর্বশ্রেষ্ট মানুষ‌টি হ‌লেন, আমা‌দের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই‌হি ওয়া সাল্লাম। তি‌নি সকলের রাহবার,নবী‌দের সরদার,রহম‌তের কাণ্ডারী। জগতবা‌সির জন্য রহমত।

মহান আল্লাহ রাব্ববুল আলামীন রাসূলকে স‌ম্ভোধন ক‌রে ব‌লে‌ছেন, ‌হে রাসূল আ‌মি আপনা‌কে জগ‌তবাসীর জন্য রহমত স্বরূপ ‌প্রেরণ ক‌রে‌ছি। রাসূ‌লের ছেলে‌বেলা, যৌবনকাল, নবুওয়‌তের আ‌গে ও প‌রে মানু‌ষের সা‌থে চলাফেরা, ওঠাবসা, লেন‌দেন, আচার ব্যবহার, ইবাদত ব‌ন্দে‌গি ও রাষ্ট্র প‌রিচালনাসহ ইত্য‌াদি বিষ‌য়ে আমাদের জন্য র‌য়ে‌ছে আদর্শ। আল্লাহ তাআলা মানবজাতি‌কে লক্ষ ক‌রে বলে‌ছেন, আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই‌হি ওয়া সাল্লা‌মের মা‌ঝে তোমা‌দের জন্য র‌য়ে‌ছে উত্তম আদর্শ। এ শ্রেষ্ঠ মানুষ‌টির আদর্শ যারা গ্রহণ কর‌বে, তারা পৌঁ‌ছে যা‌বে শ্রেষ্ঠ‌ত্বের কাতা‌রে। দু‌নিয়া ও আখিরাত উভয় জগ‌তে তারা হবেন সম্মা‌নিত। তারাই হ‌বেন আল্লাহ তাআলার প্রিয়বান্দ‌া। আল্লাহ তাআলা তা‌দের জন্যই রে‌খে‌ছেন পরকালের সুখ-শা‌ন্তি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই‌হি ওয়া সাল্লামের আদর্শ সম্পর্কে জান‌তে হ‌লে জানতে হ‌বে নবী জীব‌নের নানা দিক।

উ‌ল্লেখ কর‌ছি নবী‌জির জীবনা‌দর্শের কিছু দিক। ‌ হেরা গুহার র‌শ্মি: আরবদের মা‌ঝে সর্বদা লে‌গে থাক‌তো ঝগড়া বিবাদ। সাধারণ বিষয়‌কে কেন্দ্র ক‌রে ম‌ারামা‌রি হানাহা‌নিতে লিপ্ত হওয়া ছি‌লো সে যু‌গের সাধারণ ব্যাপার। সমা‌জের এমন দুরাবস্থার কী সমাধ‌ান। এমন প‌রি‌স্থি‌তি ‌থেকে উত্তর‌ণের কী উপায়! এ নি‌য়ে ভাবনায় ডু‌বে থা‌কেন মুহাম্মদ না‌মের শান্তি‌প্রিয় মানুষ‌টি।সর্বদা মানবতার মু‌ক্তির চিন্তায় বি‌ভোর তি‌নি। ঘ‌রে ঘ‌রে শা‌ন্তি পৌঁছে দি‌তে প্রতিষ্ঠা কর‌লেন হিলফুল ফুজুল নামের শা‌ন্তিমূলক সংগঠন।

জা‌হে‌লিয়া‌তের প্লাবন থামা‌নোর ফি‌কির নি‌য়ে ধ্যা‌নে বস‌লেন হেরা গুহায়। তি‌নি চেয়ে থাকতেন কাবার রহস্যময় কালো ঘরটির দিকে, যা সভ্যতার প্রথম সূতিকাগার। তিনি যেন অপেক্ষায় আছেন কাবার মালিকের হেদায়েতের প্রত্যাশায়। এভা‌বেই কে‌টে গেল তিন‌টি বছর। হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পূর্ণ হলো চ‌ল্লিশ বছর। ২৭ রমজান রাতে আল্লাহর ওহি নি‌য়ে হা‌জির হ‌লেন জিবরাঈল আমীন। না‌যিল হ‌লো ও‌হি। তি‌নি এখন আল্লাহর পক্ষ থে‌কে ঘো‌ষিত নবী। সনদপ্রাপ্ত নবী। নাযিল হয় সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত।

সমা‌জে শুনা‌লেন শা‌ন্তির বাণী। মানুষ‌কে দেখা‌লেন এক আ‌লোর দিগন্ত। পূণ্য হ‌লো আরব। ধন্য হ‌লো আরবের মানুষ। হিংস্র স্বভা‌বের মানুষগু‌লো হ‌য়ে গে‌লো মানব ফেরেশতা। আল্লাহর খুব প্রিয় বান্দা হওয়ার সৌভাগ্য হা‌সিল কর‌লেন তারাই। দু‌নিয়ায় থাকাবস্থায় তারাই পে‌য়ে গে‌লেন জান্না‌তের শুভ সংবাদ। আর হেরা গুহার এ আলোর র‌শ্মি ছ‌ড়ি‌য়ে পড়ল সারা বি‌শ্বে। স‌ঠিক প‌থের দিশা পেল সারা বি‌শ্বের মানুষ।

ইসলা‌মের দাওয়াত: প্রথ‌মে গোপ‌নেই শুরু হ‌লো ইসলা‌মের দাওয়াত। জীবন স‌ঙ্গিনী হযরত খাদীজা রা‌যি. সাড়া দি‌লেন রাসূ‌লের ডা‌কে। গ্রহণ কর‌লেন ইসলাম। বন্ধুবর হযরত আবু বকর রা‌যি. গ্রহণ কর‌লেন ইসলাম। তি‌নি নি‌জেও শুরু কর‌লেন দাওয়া‌তের কাজ। চাচা‌তো ভাই হযরত আলীও মুসলমান হ‌য়ে গে‌লেন। এভা‌বেই বৃ‌দ্ধি পে‌তে থাক‌লো মুসলমান‌দের সংখ্যা। কারণ মুহাম্মদ সম্প‌র্কে কেউ কখ‌নো খারাপ শু‌নে‌নি। কেউ খারাপ জা‌নে‌নি। তি‌নিও কারো সা‌থে কখ‌নো খারাপ আচরণ ক‌রেন নি। তি‌নি ছি‌লেন সবার প্রিয়। সবাই ভ‌ক্তি কর‌তো তা‌কে। তি‌নি ছি‌লেন বিশ্বস্ত ও সত্যবা‌দি। আল আমীন উপা‌ধি‌তে ভূ‌ষিত ছি‌লেন সেই বাল্যকাল থে‌কেই। সবাই টাকা পয়সা, সোনা গয়না আমানত রে‌খে যে‌তো নির্ভ‌য়ে। এমন মানু‌ষের ডা‌কে কে না সাড়া দেয়। এ সুবা‌দে ধী‌রে ধী‌রে বাড়‌তে লাগ‌লো মুসলমাদের সংখ্যা।

সময় এ‌লো প্রকা‌শ্যে দাওয়াত দেওয়ার। মহ‌াম্মদ সাল্লাল্লাল্লাহু আলাই‌হি ওয়া সাল্লাম মারওয়া পাহা‌ড়ে দাঁড়িয়ে উচ্চ ক‌ণ্ঠে ডাক‌লেন মক্কাবা‌সি‌কে। তা‌দের বিশ্বস্ত ব্য‌ক্তি‌টির ডা‌কে সাড়া দি‌য়ে স‌মে‌বেত হ‌লো সবাই। সবাই‌কে শুনা‌লেন আল্লাহর বানী। ডাক‌লেন সফলতার দি‌কে। আল্লাহর হুকম পালন কর‌লে কী লাভ, না ম‌ান‌লে কী ক্ষ‌তি তা জানা‌লেন সবাই‌কে।

যা‌দের কপা‌লে হেদায়াত লেখা নেই তারা বড় হতভাগা। তারা শুরু কর‌লো মুসলমান‌দের বি‌রো‌ধিতা। মান‌লো না রাসূ‌লের কথা। গ্রহণ কর‌লো না ইসলাম। অন্য‌দের‌কেও বারণ ক‌রতো ইসলাম গ্রহণ থে‌কে। এ‌তেই ক্ষ্যান্ত নয়। শুরু কর‌লো মুসলমান‌দের উপর অসহনীয় নির্যাত‌ন। তাদের অপরাধ ছি‌লো, তারা আল্লাহ‌কে বিশ্বাস ক‌রে‌ছে। আল্লাহর রাসূল‌কে তার প্রে‌রিত রাসূল হি‌সে‌বে বিশ্বাস ক‌রে‌ছে। আল্লাহ তাআলার হুকুম পালন করেছে।

মুসলমানরা নির্যাতন স‌হ্য ক‌রে‌ছে। নির্যাত‌নের ভ‌য়ে জন্মভূ‌মি ছে‌ড়ে‌ছে। কিন্তু নির্যাতনের ভ‌য়ে ইসলাম ত্য‌াগ ক‌রে‌নি। এটাই ঈমানের স্বাদ। যারা একবার এ স্বাদ পে‌য়ে‌ছে, গলায় ছু‌ড়ি লাগা‌লেও তাদের‌কে ঈমা‌নের পথ থে‌কে ফিরি‌য়ে আনা যা‌য় না। মদিনায় হিজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাই‌হি ওয়া সাল্লা‌মের আহ্বা‌নে ইসলামের প্রতি উৎসাহী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন মদীনা থে‌কে মক্কায় হজ্ব কর‌তে আসা মদীনার বা‌রোজন লোক। তারা মূলত হজ্জ করতে এসে ইসলামের দাওয়াত পেয়েছিলেন। চলমান ………………

=============================

লেখক —- আতা খান

 

সন্তানের শিক্ষা পরিকল্পনা

সন্তানের শিক্ষা পরিকল্পনা

যারা আলেম বানাতে চান সাধারণ শিক্ষাসহ
(যারা শুধু আলেম বা শুধু সাধারণ শিক্ষা দিতে চান তাদের জন্য ভিন্ন পরিকল্পনা প্রযোজ্য)

৮ বছর পর্যন্ত স্কুল কিন্ডার গার্ডেন, নুরানি মাদরাসাসহ সহজ ও নিকটের যে কোন প্রতিষ্ঠানে পড়ানো যেতে পারে।

৮এর পর নাজেরা হিফজ ৪/৫ বছর।

১২/১৩ বছর বয়সে ৫ম সমাপনী পরীক্ষা।

১৪-১৬ বছর বয়সে মিজান, নাহুমীর, হিদায়াতুন্নাহু সমাপ্তি পর্যন্ত এক নাগারে কওমী মাদরাসা।
(পূর্ণ বছর পড়তে হবে। মাঝখানে অন্য কিছু পড়া বা গ্যাপ দেয়া যাবে না)

এরপর ৮ম সমাপনী।

(ভাংতি বছর ভিন্ন অতিরিক্ত সাবজেক্ট পড়বে। আংশিক বর্ষে কওমী মাদরাসার কোন ক্লাস পড়বে না।)

১৭-১৯বছর বয়সে কাফিয়া, শরহে বেকায়া, হেদায়া।

এরপর দশম বোর্ড পরীক্ষা।

২১ ও ২২ বছর মিশকাত, দাওরা।

২৩ বছর আলিম/ Hsc

২৪-২৭ অনার্স/ফাজিল/মুফতী।

২৮মাষ্টার্স/কামিল।
বি.দ্র…..
জেনারেল পরীক্ষার পর
ভাংতি বছরগুলো অতিরিক্ত ভিন্ন সাবজেক্ট পড়াবে।

কিন্তু কওমী মাদরাসার কোন ক্লাস আংশিক বছরে পড়াবে না।

 

উল্লেখ্য উক্ত সিলেবাসের প্রতিষ্ঠান আপনি খোঁজ ক্রলে পেয়ে যাবেন ইনশা–আল্লাহ

===============

লেখক – মুফতি উজায়ের আমীন

আযাদীর শিরোনাম : শহীদ টিপু সুলতান রহ.

‘আজ থেকে গোটা হিন্দুস্থান আমাদের’ কথাটি বলেছিলেন জেনারেল হার্স যেদিন হিন্দুস্থানের বীর সেনানী টিপু সুলতান শাহাদাত বরণ করেছিলেন। তাঁর এই শাহাদাতের মধ্য দিয়ে বস্তুত গোটা হিন্দুস্থানের ওপর নেমে এসেছিল পরাধীনতার অন্ধকার। টিপু সুলতান যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন ইংরেজদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছেন, দেশের স্বাধীনতা আগলে রেখেছেন। কিন্তু তিনি শাহাদাত বরণ করলে শুধু হিন্দুস্থানই নয়, গোটা মুসলিম বিশ্ব যেন স্বাধীনতার এক অতন্দ্রপ্রহরী হারিয়ে অভিভাবকহারা অবস্থায় পড়ে যায়। তাই টিপু সুলতান ছিলেন ভারতবাসীর জন্য একজন চিরস্বরণীয় বীর। কিন্তু ইতিহাস বিকৃতি আর আমাদের উদাসীনতায় এই মুসলিম বীর আমাদের কাছে হয় অপরিচিত থেকেছেন নতুবা এমন পরিচয় লাভ করেছেন যা তার মতো মহান বীরের জন্য অবমাননার শামিল।

টিপু সুলতান ছিলেন একজন সত্যিকারের  আলেম ও মুমিন ব্যক্তি। পিতা হায়দার আলী  নিজে নিরক্ষর  হওয়া সত্ত্বেও তিনি পুত্র টিপুর জন্য তালীম-তরবিয়ত তথা উত্তম শিক্ষা দীক্ষার ব্যবস্থা করেন। ইলম ও জাগতিক শিক্ষার সাথে সাথে তিনি অল্প বয়সে যুদ্ধ বিদ্যা রপ্ত করেন।  ১৭৬৭ সালে মাত্র সতের বছর বয়সে সুলতান টিপু ইংরেজদের  বিরুদ্ধে মহীশুরের প্রথম যুদ্ধে সাত  হাজার সৈন্যের এক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন এবং বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন করে ইংরেজদের পরাস্ত করেন। সেই সতের বছর বয়সে যে টিপু সুলতান ইসলামের দুশমনের বিরুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার  সেই হাতিয়ার বীরত্বের উজ্জ্বল নমুনা হয়ে থাকে।

 টিপু সুলতান শুধু একজন শাসকই ছিলেন না, একজন আমলদার আলেমও ছিলেন। সাত-আট বছর বয়সে খেলাধূলায় মত্ত একদল শিশুর সাথে তাকে দেখে জনৈক দরবেশ কাছে ডেকে নেন এবং ভবিষ্যত শাসক হওয়ার   সুসংবাদ দিয়ে তার কাছ থেকে ওয়াদা নেন যে, তিনি শাসক হওয়ার পর ঠিক এই জায়গায় একটি শানদার মসজিদ নির্মাণ করবেন। শাসক হওয়ার পর ওয়াদামাফিক তিনি মসজিদে আলা নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং ১২০৪ হিজরী মোতাবেক ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে এর উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে তিনি দেশের ওলামা-মাশায়েখ এবং বুযুর্গানে কেরামকে দাওয়াত করেন এবং ঘোষণা করেন : আজকের উদ্বোধনী দিনে সেই ব্যক্তি নামাযের  ইমামতী করবেন যিনি সাহেবে তারতিব অর্থাৎ বালেগ হওয়ার পর জীবনে কখনো যার নামায কাজা হয়নি। কিন্তু কি আশ্চর্য! কেউই তখন সামনে অগ্রসর হননি। অবস্থা দেখে টিপু সুলতান নামাযের ইমামতি করেন এবং বলেন     ‘আলহামদু লিল্লাহ, আমি সাহেবে তারতীব।’

 সারা জীবন অব্যাহতভাবে যুদ্ধে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও কখনো তার নামায কাযা হয়নি দেখে উপস্থিত লোকজন যারপর নাই হয়রান হয়ে যান।

 একবার নেজাম ও মারাঠা বাহিনী তানগ্বাদড়া সাগরের পাড়ে সমবেত হয় টিপু সুলতানের বাহিনীর ওপর আক্রমণ করার জন্য। টিপু ছিলেন সমুদ্রের অপর পাড়ে এবং সেসময় সমুদ্র ছিল ভয়ংকর রকমের উত্তাল। সাগরের উত্তালতা দেখে তার হযরত আমর ইবনে আস রা. ও নীল দরিয়ার ঘটনার কথা মনে পড়ে এবং তিনি ভাবেন, সাচ্চা মুসলমানের যবানে আল্লাহ তায়ালা এখনও তাছীর রেখেছেন। এই বলে তিনি আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দুআ করেন এবং তার আদেশে মুজাহিদরা সমুদ্রে একুশ বার গোলা ছোঁড়ে। এর কিছুক্ষণ পর সমুদ্রের উত্তালতা কেটে যায়। টিপু সুলতানের কারামত দেখে মুজাহিদরা তাকবীর  ধ্বনি দিয়ে দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।


এটাও পড়তে পারেন- ড. আব্দুর রহমান আস সুমাইত রহঃ একটি আদর্শ,একটি মডেল!


টিপু সুলতান ছিলেন হিন্দুস্তানের এক বিরল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শাসক। ভারত উপমহাদেশে তিনিই সর্বপ্রথম উর্দু পত্রিকা প্রকাশ করেন। ‘ফাতহুল মুজাহিদীন’ নামে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকাটি তার তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হত এবং এতে মুজাহিদদের দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে উল্লেখ থাকত।

 ইংরেজরা  একমাত্র তার প্রতিরোধের কারণেই গোটা হিন্দুস্তান কবজা  করতে ব্যর্থ হচ্ছি। একারণে তারা তার বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। হাজার হাজার লোককে গাদ্দারে  পরিণত করে। মহীশুর বাহিনীর সাথে ইংরেজ বাহিনীর  ফয়সালাকারী যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৭৯৯ সালের মে মাসে। ৪ মে ফজরের নামায আদায় করে টিপু সুলতান শত্রু বাহিনীর মোকাবেলায় অবতীর্ণ হন। গাদ্দার পরিবেষ্টিত হয়ে তাকে যুদ্ধ করতে হয়। এমনকি তার ব্যক্তিগত ও খাস খাদেম গোলাম রাজা খানও তার সঙ্গে চরম গাদ্দারী করে। তার কাছে পানি থাকা সত্ত্বেও সে সুলতানকে পানি দিতে অস্বীকার করে এবং সুলতান সারা দিন পানির পিপাসায় ছটফট করেন। এই গাদ্দারই তাকে দুশমনের হাতে আত্নসমর্পনের কুপরামর্শ দেয়। সেসময় তাকে লক্ষ করেই টিপু সুলতান সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেন-

‘আমার কাছে সিংহের একদিনের জীবন শিয়ালের শত বছরের জীবনের চেয়ে উত্তম।’

সকাল থেকে অব্যাহত লড়াইয়ে তিনি ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আসমানের বাসিন্দারা আল্লাহর এই মকবুল বান্দাকে ইস্তেকবাল করার জন্য প্রস্ত্তত হয়ে যায়। বিকেলের কোনো এক সময় মহীশুরের এক গাদ্দার ইংরেজদেরকে ইশারা করে বলে দেয় ইনিই হলেন টিপু সুলতান। তৎক্ষণাৎ দুশমনেরা বন্দুকের  সকল নল তার দিকে তাক করে এবং চতুর্দিক থেকে অবিরাম গোলা বর্ষণ হতে থাকে।

একটি গুলি এসে তার বুকে বিদ্ধ হয় এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এসময় একজন  সৈনিক তার কোমরে ঝুলানো হীরা খচিত শমশীর খুলে নিতে চাইলে তার আত্নমর্যাদায় আঘাত লাগে, তিনি তলোয়ার দিয়ে তার ওপর আঘাত করেন। সে বন্দুকের সাহায্যে আক্রমণ প্রতিহত করলেও অন্য একজন ইংরেজ সৈনিক এতে প্রাণ হারায়। সে সময় নিকটে অবস্থিত অন্য একজন ইংরেজ সৈনিক তাকে লক্ষ করে গুলি ছুঁড়লে তাঁর কানে গিয়ে তা আঘাত করে । এই গুলিতে সুলতান টিপু শাহাদাত বরণ করেন, সেই সাথে হিন্দুস্তানের আযাদীর সূর্যও অস্তমিত যায়। সে  দিনটি ছিল ১৭৯৯ ইংরেজী সালের ৪ ই মে।

পরের দিন ৫ মে টিপু সুলতানকে গোসল ও কাফন দেওয়া হয়। লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান তাকে শেষবারের মতো এক নজর দেখার জন্য ভীড় করে। হিন্দু মহিলারা মাথায় মাটি নিক্ষেপ করে করে শোক প্রকাশ করতে থাকে। লালবাগে পৌঁছানোর পর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। শহরের কাজ্বী জানাযার নামাযে ইমামতি করেন। নামাযান্তে পিতা হায়দার আলীর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। সে সময় তার ঈসালে সওয়াবের জন্য শাহযাদাদের পক্ষ থেকে পাঁচ হাজার রুপিয়া সদকা করা হয়।

এভাবেই ভারত উপমহাদেশের একজন স্বাধীনচেতা, দেশপ্রেমিক, লড়াকু সৈনিক ও  অকুতোভয় আলেম শাসকের জীবনাবসান  হয়।

টিপ সুলতান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন-  টিপু সুলতান

=======================

লেখক- আবু বকর সিরাজী

মহাবিশ্বের কী একাধিক স্রষ্টা থাকা সম্ভব – নাকি এর একজন স্রষ্টা আছে ?

মহাবিশ্ব কী নিজে নিজেই সৃষ্টি-নাকি এর একজন স্রষ্টা আছে

একজন মানুষকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করলেন। কিন্তু সে আরামের ঘুম ছেড়ে উঠছে না তো উঠছেই না। এদিকে আরও অনেকেই ঘুমিয়ে রয়েছে, তাদেরও ডেকে দিতে হবে। তাছাড়া আপনার নিজেরও কাজ রয়েছে। আরও কয়েকবার ডেকে আপনি বুঝলেন সে আসলে ঘুমিয়ে নেই, ঘুমের ভান করে রয়েছে।
ডাকাডাকির বেলাও প্রায় শেষ হয়ে আসছে। এহেন পরিস্থিতিতে বোঝা উচিত – যে ঘুমিয়ে আছে, তাকে ডাকা যেতে পারে। কিন্তু যে ঘুমের ভান করে পড়ে রয়েছে আর এভাবেই পড়ে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাকে ডেকে সময় নষ্ট করা মোটেও যুক্তিপূর্ণ নয়।

[১]

যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছোবার প্রধানত দু’টো বৈজ্ঞানিক উপায় রয়েছে।
১) Deductive Reasoning বা সূত্রাবরোহী পদ্ধতি
২) Inductive Reasoning বা আবেশীয়/আরোহী পদ্ধতি
দু’টো একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। বাংলার চেয়ে ইংরেজি শব্দ দু’টোই অধিক প্রচলিত বলে আমরা ইংরেজি শব্দদু’টোই ব্যবহার করছি।
Deductive Reasoning এ মূলত এক বা একাধিক সূত্র/তথ্য/প্রস্তাবনা/Premise থেকে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে আসা হয়। সিদ্ধান্তে আসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশ্ন ও তার আলোচনা করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতির বিশেষত্ব হল, যদি সূত্র/তথ্য/প্রস্তাবনা বা Premise সত্য হয়, তবে এর থেকে যে সিদ্ধান্ত বা Conclusion টানা হবে তা অবশ্যই অবশ্যই সত্য হবে। বাংলা সূত্রাবরোহী (সূত্র+অবরোহী) অর্থই হল সূত্র হতে উদ্ভূত।
এই পদ্ধতিতে নেওয়া যৌক্তিক সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণিত করবার একমাত্র উপায় হল সূত্রে বা প্রস্তাবনায় ভুল প্রমাণ করা।
উদাহরণস্বরূপ, আমরা একটি প্রস্তাবনা/Premise বা সূত্র পেশ করলাম যে ‘সমস্ত গাড়ির রঙ লাল’; এরপর যদি বলা হয় আপনার বন্ধুর একটি গাড়ি রয়েছে। তাহলে আমরা সূত্রানুযায়ী সহজেই এই সিদ্ধান্তে আসতে পারব যে আপনার বন্ধুর গাড়িটির রঙও লাল হবে। সূত্রানুযায়ী গাড়ির রঙ লাল ব্যতীত অন্য কোনও রঙ হওয়া সম্ভব না। ‘আপনার বন্ধুর গাড়ির রঙ লাল নয়’ কেবল তখনই প্রমাণ করা যাবে যখন ‘সমস্ত গাড়ির রঙ লাল নয়’ প্রমাণিত হবে, অর্থাৎ যখন সূত্রে ভুল প্রমাণ করা হবে। এই হল Deductive Reasoning বা সূত্রাবরোহী পদ্ধতি।
Deductive Reasoning এর প্রস্তাবনায় ভুল থাকলে বা প্রাপ্ত কোনো সিদ্ধান্তে ভুল থাকলে সেটা নিয়ে আরও আলোচনা আর প্রশ্ন করতে করতে একসময় স্ববিরোধী বক্তব্য চলে আসে। তখন ‘যা ধরে নেওয়া হয়েছিল তা সত্য নয়’ – এই সিদ্ধান্তে আসা হয়। স্ববিরোধীতা বা অসঙ্গতি সৃষ্টি করে প্রস্তাবনা সত্য নয় – এভাবে সিদ্ধান্তে আসাকে আলাদা করে ‘Contradiction method’ বা স্ববিরোধী/অসঙ্গতি পদ্ধতিও বলা হয়। সাধারণত গণিতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও অনেকগুলো বিকল্প (option) থেকে ভুলগুলো বাতিল (eliminate) করে সঠিক সিদ্ধান্ত বেছে নিতেও এই পদ্ধতি অহরহ ব্যবহার করা হয়।
Inductive reasoning বা আবেশীয় পদ্ধতি হল কিছু পর্যবেক্ষণ বা Observation থেকে সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে Conclusion বা সিদ্ধান্তে আসা। এই পদ্ধতিতে সাধারণত পরবর্তী পর্যবেক্ষণগুলোর ব্যাপারে সম্ভাব্য সিদ্ধান্তে আসা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, কাওকে জিজ্ঞাসা করা হল, অমুক শহরের কবুতরগুলোর রঙ কী? সে উত্তর জানবার জন্য কয়েকদিন ধরে ও শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ফিরে মোটামোটি ১০,০০০ কবুতর যাচাই করে দেখল যে সবগুলোর রঙই সাদা। তাই সে এই সিদ্ধান্তে আসলো যে, এই শহরের কবুতরগুলোর রঙ সাদা।
কিন্তু তার এই সিদ্ধান্ত আসলে নেওয়া হয়েছে ১০,০০০ কবুতর পর্যবেক্ষণ করে। ১০,০০১ তম কবুতরটি সবসময়ই ধূসর বা বাদামি হতেই পারে। তাই Inductive reasoning বা আবেশীয় পদ্ধতির সিদ্ধান্ত কখনোই পরম বা Absolute হয় না, বরং একটি সাধারণ সিদ্ধান্ত হয়। যেহেতু একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক পর্যবেক্ষণ থেকে সিদ্ধান্তে আসা হয়, তাই পরবর্তী পর্যবেক্ষণ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য আসবার সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে। এই হল Inductive Reasoning বা আবেশী পদ্ধতি।

[২]

স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে নাকি নেই সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে আমরা মূলত Deductive reasoning method অনুসরণ করব। এতে করে আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে বা Conclusion এ কোনোরকম সন্দেহের অবকাশ থাকবে না।
প্রথমেই তাহলে সূত্র নির্বাচন করা যাক। সূত্র হিসেবে যে ধ্রুবসত্যকে বাছাই করছি তা আমাদের অবশ্যই মানতে হবে। আর সেটা হল “আমাদের, এই মহাবিশ্বের বাস্তব অস্তিত্ব”; পৃথিবী, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র এককথায় এই বিশ্বজগতের অস্তিত্ব রয়েছে – এটাই হবে আমাদের সূত্র বা Premise.
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আমাদের সূত্রে কোনোই ভুল নেই। অর্থাৎ, আমরা রয়েছি বা আমাদের অস্তিত্ব আসলেও রয়েছে। ব্যাপারটা এভাবে জোর দিয়ে বলায় হাস্যকর শোনালেও এর কিছু কারণ রয়েছে। এখানে আমাদের দু’টি বিষয় মাথায় রাখতে হবে,
প্রথমত, ‘তত্ত্ব’ (Theory) আর ‘সত্য’ (fact/law) এই দুইয়ের পার্থক্য। একদম সহজকথায়, তত্ত্ব হল যা কিছু ‘হতে পারে’ বলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চালিয়ে দেওয়া যায়। সেই নির্দিষ্ট সময় বছর, যুগ বা শতাব্দীও হতে পারে। পর্যবেক্ষণ, গবেষণা, নতুন আবিষ্কার ইত্যাদির মাধ্যমে সেই সময়টুকু শেষ হয় আর তখন কেবল দু’টো ঘটনাই ঘটতে পারে। এক, Theory টি সত্যে বা Fact এ পরিণত হয়। অথবা দুই, Theory টি অসার ধারণায় অন্যকথায় ‘মিথ্যায়’ পরিণত হয়। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত তা Theory বা তত্ত্বই থাকে, সত্য নয়। অথচ আমরা অনেকসময় মানুষের চিন্তাধারণাগুলো কেবল Theory থাকা অবস্থাতেই সেগুলোকে প্রমাণ পাবার আগেই, যৌক্তিক বিশ্লেষণ ছাড়াই সত্য ভেবে বসি যেটা আসলে চরম বোকামি।
দ্বিতীয়ত, প্রমাণের অযোগ্য সবকিছু অযৌক্তিক, মিথ্যা মেনে নিতে হবে। যেমনঃ আমরা সবাই আসলে কারও স্বপ্নে রয়েছি। কিন্তু আমরা তা কখনো বুঝতে পারব না। যখনই ওই সত্ত্বার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে তখনই এই বিশ্বজগতের বিলুপ্তি হবে। অথবা, আমরা আসলে এলিয়েনদের বানানো কম্পিউটার সিম্যুলেটরে রয়েছি। কিন্তু জগতটা এতই বাস্তব যে আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু এসবের সবই প্রমাণের অযোগ্য বলে এগুলোকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
বিষয়গুলো হাস্যকর শোনালেও হিন্দু ধর্মমতে, এই বিশ্বজগত হল বিষ্ণুর স্বপ্ন। পৃথিবীতে খারাপ বিষয়াদি কেন হয় সেই প্রশ্নের জবাব দিতে তারা এটা আবিষ্কার করেছে। এ বিষয়ে আলোচনা পরে করা যাবে। এই ধরনের বিষয়গুলোর একটা বৈশিষ্ট্য হল এগুলো আসলে আমাদের Observation বা পর্যবেক্ষণেরই আওতার বাইরে। অর্থাৎ, কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ম্যাট্রিক্সের জগতের বাইরে আমাদের পর্যবেক্ষণ যেমন সম্ভব না, তেমনি সত্যও কোনকালে জানা সম্ভব হবে না। আবার কারও স্বপ্নে অবস্থান করলেও তার স্বপ্নের বাইরে গিয়ে সে সত্য জানা সম্ভব না। এমনকি সে স্বপ্ন ভেঙ্গে উঠে পড়লেও না। কারণ তখন তো আমাদের অস্তিত্বই থাকবে না। মানুষ চিন্তা, বুদ্ধি আর যৌক্তিকতার অতলে নামতে নামতে এমন অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে যে আজ এ ধরনের ফালতু প্রশ্নেরও উত্তর দিতে হচ্ছে!
পর্যবেক্ষণের আওতামুক্ত হলেও শুধুমাত্র যে একটি ক্ষেত্রে বিশ্বাস স্থাপন করা যায় তা হল যদি Deductive reasoning বা পর্যবেক্ষণ দ্বারা শেষমেশ অকাট্যভাবে কোনোকিছুর অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়। এ সংক্রান্ত উদাহরণ একটু পরেই আলোচিত হবে। কিন্তু অস্তিত্বেরও প্রমাণ ব্যতিরেকেই কোনোকিছুকে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না।
মজার ব্যাপার হল, ‘Multiverse Theory’ বা ‘বহু মহাবিশ্ব তত্ত্ব’ উপরের দুই পয়েন্টের দু’টোতেই পড়ে। একে তো তত্ত্ব কারণ নামডাকওয়ালা বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। তাও আবার প্রমাণের অযোগ্য এবং আমাদের পর্যবেক্ষণ আওতারই বাহিরে। কোটি কোটি বাদ দিলাম, শুধুমাত্র দুটো মহাবিশ্ব থাকলেও এই নিজেদেরটি বাদে দ্বিতীয়টি আমাদের কখনোই পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয় (নিজেদের মহাবিশ্বই যে আসলে ৫% ও পর্যবেক্ষণ সম্ভব হয় নাই তার কথা তো বাদই দিলাম)।
অপ্রমাণ্যতা স্বত্বেও নাস্তিক্যবাদী বিজ্ঞানীদের টানাহেঁচড়ার কারণে এই মাল্টিভার্স থিউরি জনপ্রিয়তা হারাবে না সেকথা সহজে অনুমেয়। যেন স্রষ্টাকে অবিশ্বাসের জন্যই এতসব আয়োজন। প্রশ্ন হল, মহাবিশ্বের শুরু নিয়ে যদি পর্যবেক্ষণের আওতামুক্ত ‘মাল্টিভার্স থিউরি’ র মত জটিল অকল্পপনীয় কিছুতে বিশ্বাস করা যায় – তবে একজন স্রষ্টা সমগ্র মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন তা বিশ্বাস করতে সমস্যা কোথায়?
যাই হোক, উপরের বিষয়গুলো বুঝতে পারলে আমাদের প্রথমে ধরে নেওয়া সূত্র বা প্রস্তাবনাকে নিখাদ সত্য মেনে নিতে কারও বেগ পেতে হবে না। আবার স্মরণ করিয়ে দিই। আমাদের সূত্র বা Premise ছিল ‘আমাদের নিজেদের, সমস্ত বিশ্বজগতের বাস্তব অস্তিত্ব’।

[৩]

এই মহাবিশ্বের বাস্তব অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়ার পর এখন মহাবিশ্বের শুরুটা নিয়ে আলোচনা করি। একটু চিন্তা করলে বুঝবেন, মহাবিশ্বের আসলেও কোনো শুরু ছিল কিনা সে বিষয়ে কেবল দু’টো বিকল্পই থাকতে পারেঃ
১) মহাবিশ্বের কোনও শুরু ছিল না অর্থাৎ মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে বিরাজমান অথবা,
২) মহাবিশ্বের একটি শুরু ছিল অর্থাৎ মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে নয়, বরং সসীম সময় ধরে বিরাজ করছে।
এই পর্যায়ে একটু ইতিহাসের গল্প না করলেই নয়। মহাবিশ্ব যে অনন্তকাল ধরে চলে আসছে এর পক্ষে বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশেও অনেক নামকরা বিজ্ঞানীদের রায় ছিল। এটাকে বলা হতো ‘Steady-state model’। কিন্তু এখন আমরা জানি, মহাবিশ্ব ১২-১৫ বিলিয়ন বছরের পুরোনো। যার অর্থ ১২-১৫ বিলিয়ন বছর আগে মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে বা অন্যকথায় মহাবিশ্ব অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে।
১৯২৯ সালে বিজ্ঞানী Edwin Huble এর পর্যবেক্ষণে যখন পাওয়া গেল যে মহাবিশ্ব আসলে স্থির অবস্থায় নেই, বরং ক্রমাগত সম্প্রসারণশীল তা তখনকার Scientific Community গুলোর জন্য একটা বড় ধাক্কা ছিল। কারণ নাস্তিক্যবাদের চর্চা করা বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন, এই পর্যবেক্ষণ আসলে স্রষ্টার থাকার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে দিচ্ছে। বিজ্ঞানী Edwin Huble এর পর্যবেক্ষণ ‘Big Bang Theory’ কে নতুন মাত্রা দিয়েছিল। পরবর্তীতে ‘Cosmic background radiation’ এর আবিষ্কার নাস্তিক্যবাদী বিজ্ঞানীদের ‘Steady-state-model’ এর কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। কেউ আর অমত করতে পারে না যে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল আর এটি অনন্তকাল ধরে চলে আসছে না, বরং এর একটা শুরু হয়েছিল।
Bartrand Russel এর “The Universe is just there” এর মত উক্তিগুলো তাই এখন অসার হয়ে গেছে। সকলেই জানে মহাবিশ্বের একটা শুরু ছিল আর তাই এখন সবাই যে প্রশ্নটি নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয় তা হল মহাবিশ্বের শুরু কীভাবে হয়েছিল। মহাবিশ্বের যে একটা শুরু ছিল তা ‘Thermodynamics’ বা তাপ গতিবিদ্যার ২য় সূত্র থেকেও যৌক্তিকভাবে প্রমাণ করা যায়। Thermodynamics এর ২য় সূত্র মূলত Entropy নিয়ে কথা বলে।
সহজ ভাষায়, সবকিছু ধীরে ধীরে এলোমেলো অবস্থার দিকে এগোচ্ছে। আর এলোমেলো অবস্থার দিকে যেতে যেতে মহাবিশ্ব একসময় চূড়ান্ত এক অবস্থায় পৌঁছাবে যখন এর আসলে বিলুপ্তি ঘটবে। তাহলে কথা হল, মহাবিশ্ব যদি অনন্তকাল ধরে বিরাজ করে, তবে ইতোমধ্যেই তো সেই চূড়ান্ত এলোমেলো অবস্থা অর্জন করে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ সে তো অসীম সময় পেয়েছে। কিন্তু সেই চূড়ান্ত এলোমেলো অবস্থা তো নয়ই, বরং আমরা মহাবিশ্বে নিখুঁত ভারসাম্য (Fine Tuning) দেখতে পাই।
কিন্তু সত্যিকার অর্থে আরও আগেই যখন ‘Big-Bang’ কে সাপোর্ট করা ‘Expanding Universe’ মানুষ পর্যবেক্ষণ করে নাই বা ‘Thermodynamics’ এর সূত্রগুলোও আবিষ্কৃত হয় নাই তখনও কেবল যুক্তি দিয়ে মহাবিশ্ব যে অসীম সময় ধরে নয়, বরং সসীম সময় ধরে চলে আসছে তা প্রমাণ করা যেত। সেটা হচ্ছে The problem of Infinity এর যুক্তি।
এই লজিকের একই ধরনের উদাহরণ বহু রয়েছে। এর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে যেটা সুন্দর মনে হয়েছে সেটিই দিলাম। একটি দোকানে Sale(সেল) চলছে। তাই আপনি দোকানটিতে প্রবেশের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন। (উল্লেখ্য, সামনের কেউ লাইন থেকে সরে যাবে না আর পিছন থেকেও কেউ লাইন ভেঙ্গে লাইনে আসতে পারবে না। যারা অযথা তর্ক করতে চায় তারা এসব খুঁটিনাটি নিয়ে পড়ে থাকবে) এখন আপনার সামনে যদি ৫ জন মানুষ থাকে, তবে আপনি পাঁচ জনের পরে প্রবেশ করবেন। আর যদি ২০ জন থাকে তবে আপনি ২০ জনের পরেই দোকানে প্রবেশ করবেন। তাহলে প্রশ্ন হল, আপনার সামনে যদি অসীম সংখ্যক মানুষ থাকে তাহলে আপনি কি কখনও দোকানে প্রবেশ করতে পারবেন?
উত্তরটা হলঃ না – আপনি কখনোই সেই দোকানে প্রবেশ করতে পারবেন না। কারণ আপনার পালা আসতে সামনের অসীম সংখ্যক মানুষকে আগে সেই দোকানে প্রবেশ করতে হবে। আর অসীম কখনও ফুরোবার নয়।
এখন আপনার সামনের প্রত্যেক মানুষ প্রবেশ করাকে যদি ‘একটা ঘটনা’ (event) হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে প্রথম ক্ষেত্রে আপনি ৫ টি ঘটনার পরে, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ২০ টি ঘটনার পরে আর শেষ ক্ষেত্রে আপনি অসীম সংখ্যক ঘটনার পরে আপনার পালা আসছে। সুতরাং, অসীমের ক্ষেত্রে আপনি যে আসলে কখনোই সেই দোকানে প্রবেশ করতে পারবেন না তা আসলে নির্দেশ করে – একটি ঘটনা ঘটার আগে অসীম সংখ্যক ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। কারণ তা হলে বর্তমানে যে ঘটনাগুলো হচ্ছে তার পালাই কখনও আসতো না।
এখন পৃথিবীর জন্ম, তার আগে সূর্যের জন্ম, তারও আগে গ্যালাক্সিগুলোর জন্ম ইত্যাদি তো এক একটি মহাজাগতিক ঘটনা (cosmological event). তাহলে মহাবিশ্ব যদি অনন্তকাল ধরে অবস্থান করে, তো এই পৃথিবী, সূর্য, গ্যালাক্সিসমূহের জন্মের আগেই অনন্তসময়ে অনন্ত/অসীম সংখ্যক ঘটনা ঘটে তবেই এইসব ঘটবার পালা আসার কথা। কিন্তু অসীমের যেহেতু শেষ নেই – তাই গ্যালাক্সি, সূর্য কোনোকিছুর জন্মই হওয়ার কথা না। এখনও সেই অসীম সংখ্যক ঘটনা ঘটবার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবার কথা।
কিন্তু বাস্তবতা হল – গ্যালাক্সিগুলোর, আমাদের সোলার সিস্টেমের সূর্যের আর আমাদের পৃথিবীর জন্ম তো হয়েছেই বরং আরও বিলিয়ন বছর ধরে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন সংখ্যক ঘটনাও ঘটে গেছে। অর্থাৎ, সেই দোকানের উদাহরণে আপনি শুধু লাইন শেষ করে দোকানে প্রবেশই করেন নাই, রীতিমত বহু কেনাকাটাও করে ফেলেছেন। আর এর সবই সম্ভব হয়েছে আপনার আগে সসীম সংখ্যক মানুষ দাঁড়িয়ে থাকবার ফলে। মানুষের সংখ্যা সসীম ছিল বলেই আপনার পালা এসেছিল। তেমনি মহাবিশ্বের অতীতও সসীম অর্থাৎ মহাবিশ্বের একটা শুরু ছিল বলেই তা আজকের এই অবস্থানে এসেছে।
এই যুক্তিটি অন্য কোনও পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর না করেই এই সিদ্ধান্তে এনে দেয় যে মহাবিশ্বের একটি শুরু ছিল। যারা বিজ্ঞানের ছাত্র নন বা কোনও কারণে এখনও Edwin Huble এর পর্যবেক্ষণ বা Thermodynamics এর ২য় সূত্র সম্পর্কে জানেন না তারাও খুব সহজে এই যুক্তিটি ধাতস্থ করতে পারবেন। আর মানুষের পর্যবেক্ষণ আর ক্ষমতার উপর ভরসা করা ঠিক না, কারণ মানুষের পর্যবেক্ষণ আর সক্ষমতা সবসময়ই অসম্পূর্ণ। যেমনঃ আমরা যদি মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল এটা পর্যবেক্ষণের জন্য টেলিস্কোপ বা উপযুক্ত যন্ত্রপাতি কখনো তৈরিই করতে না পারতাম, তবে কি মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল থাকত না? বস্তুত, আমরা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করতে সক্ষম হই বা না হই আর পর্যবেক্ষণ করতে পারি বা না পারি সত্য কখনো পরিবর্তন হবে না… সেটা মানুষ নিজেকে যতই পণ্ডিত মনে করে সত্যকে ছুঁড়ে ফেলুক না কেন।
সুতরাং ‘মহাবিশ্ব অসীম সময় ধরে চলে আসছে না, বরং এর একটা শুরু ছিল’ তা প্রমাণিত হল। এখন প্রশ্ন হল, এই মহাবিশ্ব একসময় ছিল না। কিন্তু এখন তা আছে। এখনও তো তা অনস্তিত্বেই থেকে যেতে পারতো – তাহলে মহাবিশ্বের অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আসবার বা সৃষ্টি হওয়ার কারণ কী?

[৪]

মহাবিশ্বের সৃষ্টির পেছনে কেবলমাত্র চার ধরনের কারণ থাকতে পারে। সেগুলো হল –
(১) মহাবিশ্ব শূন্য থেকে কোনো ‘কারণ ছাড়াই’ সৃষ্টি হয়েছে (The Universe was created from nothing via nothing)
(২) মহাবিশ্ব নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে (The Universe created itself)
(৩) মহাবিশ্ব অন্যকোনো সৃষ্ট কারণ থেকে সৃষ্ট হয়েছে: যেমন অন্য একটি মহাবিশ্ব থেকে (The Universe was created from something created. For example, from another universe)
(৪) মহাবিশ্ব কোনো অসৃষ্ট কারণ থেকে সৃষ্টি হয়েছে (The universe was created by something uncreated)
Hawking এর Law of Gravitation, Krauss এর Universe from Nothing বা Dawkins এর Delusion সবকিছুই উপরের কোনো না কোনটির আলোচনায় অবশ্যই চলে আসবে। কারণ মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার পিছনে উপরের চারটি ‘ধরণ’ বা ‘প্রকার’ ব্যতীত আর কোনও প্রকার সম্ভব না।
এখানে লক্ষণীয়, মহাবিশ্ব একসময় ছিল না, পরে এসেছে সেটা আগেই যৌক্তিক প্রমাণাদি দিয়ে আমরা দেখিয়েছি। অর্থাৎ, বস্তুগত বা Materialistic/Physical দিক থেকে মহাবিশ্ব শূন্য থেকেই এসেছিল। আর এটি উল্লিখিত চারটি বিকল্পের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু কেবল প্রথমটিতে এর ‘কোনো কারণ নেই’ বলা হয়েছে আর বাকি ধরনগুলোয় ভিন্ন ভিন্ন কারণ বা Cause দেখানো হয়েছে, কিন্তু সেগুলোতে বার বার ‘শূন্য থেকে’ উল্লেখিত হয় নি।
এখন যেহেতু চারটি বিকল্প একইসাথে সত্য হতে পারে না, সুতরাং আমরা একটি একটি করে যাচাই করে দেখব – কোনটি সবচেয়ে যৌক্তিক হতে পারে।

[৪.১]

(১) মহাবিশ্ব শূন্য থেকে কোনো কারণ ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে (The Universe was created from nothing via nothing)
প্রথমত আমাদের বুঝতে হবে এখানে ‘শূন্য’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে। শূন্য বলতে সাধারণত ‘কোনোকিছুর’ অনুপস্থিতি বোঝায় আর এখানে সেই ‘কোনোকিছু’ হল গোটা মহাবিশ্ব – এর সময়, এর স্থান, পদার্থ, শক্তি (time, space, matter & energy) সবকিছুর অনুপস্থিতি! এখন প্রশ্ন হল, কোনোকিছু কি শূন্য থেকে কোনও কারণ ছাড়াই হয়ে যেতে পারে?
সময় মহাবিশ্বের অংশ। মহাবিশ্বের জন্মের প্রথম সেকেন্ডে কী হয়েছিল সেটা নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা হতে পারে – কিন্তু t=o সেকেন্ডে কোনও কিছুই হওয়া সম্ভব না যদি না সময়ের ঊর্ধ্বে কোনকিছু থেকে থাকে আর যদি না সেই ‘কিছু’ সময় শুরু হওয়ার নির্দেশ দেয়। শুধু মহাবিশ্ব জন্মের সময়ই না, এখনও t=0 সেকেন্ডে কোনোকিছু হওয়া সম্ভব না।
এছাড়া শূন্যের কোনো explanatory power বা গড়বার শক্তি নেই তা গাণিতিকভাবেও এটা প্রমাণিত। ০+০+০+০+… … … + ০ = ০ ই হবে। অগণিত শূন্য বা অগণিত ‘Nothing’ মিলিয়েও মহাবিশ্ব তো দূরের কথা, একটা কণাও সৃষ্টি করতে পারে না। এটা হল কমন সেন্স।
অর্থাৎ, মহাবিশ্ব পরম শূন্য থেকে কোনও কারণ ব্যতিরেকেই সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু তবু যৌক্তিক বিচারবুদ্ধিহীন বিজ্ঞানীদের শূন্য থেকে ‘কোনও কারণ ছাড়াই’ নিজে নিজে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার চেষ্টা অক্ষুণ্ণ থাকবে – যেন স্রষ্টাকে অবিশ্বাস করতেই এত আয়োজন।

[৪.২]

(২) মহাবিশ্ব নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে (The Universe created itself)
ভেবে দেখুন, কোনও কিছুকে সৃষ্টি করতে হলে তার নিজের অস্তিত্ব থাকতে হবে। এখানে বলা হয়েছে ‘মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছে’। কিন্তু তার তো অস্তিত্বই ছিল না। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আর অনস্তিত্ব একইসাথে বিদ্যমান – যা কিনা স্ববিরোধী বক্তব্য। অর্থাৎ, মহাবিশ্ব নিজে নিজে সৃষ্টি হতে পারে না। আসলে কোনওকিছুই নিজে নিজে সৃষ্টি হতে পারে না। আর এখানে তো পুরো মহাবিশ্বের কথা বলা হচ্ছে!
এই পর্যায়ে এসে কিছু নামডাকওয়ালা বিজ্ঞানীর অযৌক্তিক ধারণায় আলোকপাত করতেই হয়। কেউ কেউ দাবি করতে পারে যে, প্রথম পয়েন্টের ‘শূন্য’ আসলে ‘পরম শূন্য’ নয়। সেখানে শক্তির এক অতিবিরাজমান অবস্থা ছিল বা ‘শূন্য’ আসলে ‘কোয়ান্টাম ভ্যাকিউম’ যেখানে সেকেন্ডের বিলিয়ন ভাগের মধ্যে একটা কণা (matter) ও একটা প্রতিকণা (anti-matter) তৈরি হয়ে একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। কিন্তু সেটা হতেও তো সময়ের প্রয়োজন। তাহলে এবার হয়ত কেউ কেউ বলবেন, সময় ছিল কিন্তু তার আচরণ এখনকার মত ছিল না ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে প্রশ্ন চলে আসে, সময়ের আচরণ এখন কেমন? তখন কেমন ছিল? কেন ঐরকম ছিল? সেই আচরণ পরিবর্তন করল কে বা পরিবর্তনের কারণ কী ছিল?
উপরের ধারণাগুলো মূলত বিজ্ঞানী হকিংয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত। The Grand Design এর কথাবার্তা থিউরি পর্যায়ে থাকলেও এর অসারতা নিয়ে একটু আলোচনা দরকার যাতে কিছু মানুষের উপকার হয়। কারণ ভাষাশৈলীর কারণে সাধারণ মানুষ অনেকসময় যৌক্তিক ভ্রান্তি (logical fallacy) ধরতে পারে না।
একদম সহজভাষায় হকিং যা বুঝিয়েছে তা হল পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো (Laws of Physics) ছিল বলেই মহাবিশ্ব শূন্য থেকে নিজে নিজেই সৃষ্টি হতে পারে। হকিং সমস্ত সূত্রও বোঝান নি। কেবল মহাকর্ষ বলের সূত্র (laws of gravitation) বুঝিয়েছেন। সূত্র বললেও যাদের বুঝতে কষ্ট হচ্ছে তাদের জন্য আরও সহজ করে দিইঃ মহাকর্ষ বলের যে চিরাচরিত আচরণ (গাণিতিকভাবে প্রকাশ করলে তা সূত্র) তার কারণেই মহাবিশ্ব শূন্য থেকে নিজেকে সৃষ্টি করতে পারবে।
সরাসরি হকিং এর ভাষায়, “Because There is a law of gravity the universe can and will create itself from nothing.” – The Grand Design by Stephen Hawking
শুনতে ভাল শোনালেও যারা একটু চিন্তা করতে পারেন তারা প্রথমেই ধরে ফেলতে পারবেন যে এটা একটা স্ববিরোধী বক্তব্য – “Because there is a law of gravity…” অর্থাৎ, “Because there is something the universe … create itself from nothing.” অর্থাৎ, মহাকর্ষ বলের সূত্রও তো কোনকিছু বা something, তাহলে তা nothing বা শূন্যে কীভাবে থাকতে পারে? আর মহাকর্ষ হল মহাবিশ্বের যেকোন দু’টি কণার মধ্যকার আকর্ষণ। যখন কোনও কণাই ছিল না তখন কীভাবে মহাকর্ষের সূত্র কাজ করে? আচ্ছা তারপরও ধরে নিলাম যে মহাকর্ষ ছিল না কিন্তু মহাকর্ষের আচরণ ছিল অর্থাৎ, কণা ছিল না ঠিক – তবে যদি থাকত তা ঐ কণাদ্বয়ের সাথে ঐরকম আচরণে কাজ করত। অর্থাৎ, স্ববিরোধী হলেও আমরা তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম যে শূন্যতেও আসলে কিছু ছিল!
কিন্তু তা মেনে নিলেও হকিংয়ের বক্তব্যের শেষ অংশটি অসারই রয়ে যায় প্রধানত দুইটি কারণে।
১ম টি হল, (২) এ উল্লিখিত স্ববিরোধী কারণ অর্থাৎ, ‘মহাবিশ্ব নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করতে পারবে’। কারণ আগেই বলেছি এর অর্থ হল মহাবিশ্বের একইসাথে অস্তিত্বে আবার অনস্তিত্বে থাকা; যা আসলে স্ববিরোধী। এক্ষেত্রে আরেকটা উদাহরণ দিই। ধরুন, x সৃষ্টি করেছে yকে। অর্থাৎ, আপনার কাছে যদি x থাকে তাহলে আপনি y পাবেন। কিন্তু এখন যদি বলি, x সৃষ্টি করেছে x কে। তাহলে অর্থ কী দাঁড়ায়? এর অর্থ দাঁড়ায়, আপনার কাছে যদি x থাকে তাহলে আপনি x পাবেন! আপনার কাছে যদি x নাই থাকে, তাহলে আপনি x পেলেন কোথা থেকে? আর যদি x থেকেই থাকে তাহলে তো আছেই, নতুন করে পাবার দরকার কী? অর্থাৎ, বোকামিপূর্ণ অসার কথা অসারই থেকে যায়, এমনকি তা বিশ্বজোড়া বিজ্ঞানী থেকে এলেও।
আর ২য় যে কারণে হকিং এর বক্তব্য অসার হয় শুধু সেটা নিয়েই ছোটখাটো একটা বই লিখা যাবে। কারণ হকিং এমন এক চিন্তার ফাঁদে পড়েছে যেখানে সে ভাবছে ‘সূত্র বা law কোনোকিছু সৃষ্টি করতে পারে’। অথচ মহাকর্ষের সূত্র মহাকর্ষ বল তৈরি করে না। এটা শুধুমাত্র মহাকর্ষ বলের ধরন বা আচরণ ব্যাখ্যা করে। আর পদার্থবিজ্ঞানের, রসায়নের প্রত্যেক সূত্রই এরূপ কেবল প্রকৃতির ব্যাখ্যা করে থাকে। কিন্তু বাস্তবে কোনো কাজ সম্পন্ন হতে একজন কর্ম সম্পাদনকারী প্রয়োজন হয়। সূত্রগুলো আছে বলেই কোন কাজ নিজে নিজে হতে পারে না।
যেমনঃ নিউটনের গতির সূত্র F=ma কখনও কোনও বস্তুতে গতির সঞ্চার করে নি, বরং গতিশীল বস্তুর গতির প্রকৃতি কেমন হবে সেকথা ব্যাখ্যা করেছে। বস্তুটি গতিশীল হতে গতি সঞ্চারণকারী কাউকে প্রয়োজন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ধারণা। কারণ অনেকেই এই সহজ ব্যাপারটা আজ বুঝতে পারছে না, এমনকি জনপ্রিয় বিজ্ঞানীরাও চিন্তার এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন কিছু সাধারণ তাত্ত্বিক জ্ঞান না থাকবার কারণে।
আরেকটা সহজ উদাহরণ দিয়ে এই বিষয়ের ইতি টানব। ধরে নিন, পুরো মহাবিশ্বটি একটি জেট ইঞ্জিন। এখন এই জেট ইঞ্জিনে বিজ্ঞানের অনেকগুলো সূত্র প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু তার মানে কি এই যে এইসব সূত্র থাকার কারণে জেট ইঞ্জিনটি নিজে নিজেই অস্তিত্বে চলে আসতে পারে? বরং ইঞ্জিনটিতে কেউ সূত্রগুলো প্রয়োগের ফলেই সেটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু পদার্থ থেকে পরিপূর্ণ একটি ইঞ্জিন হয়ে উঠবে। অর্থাৎ, সূত্র থাকলেও একজন কর্ম সম্পাদনকারী সত্ত্বা বা একটি কর্ম সম্পাদনকারী কারণ প্রয়োজন।
বস্তুত মহাবিশ্বের অনস্তিত্বের সময় কোনও সূত্রের অস্তিত্বও থাকা সম্ভব না কারণ সূত্রগুলো মহাবিশ্বেরই অংশ। তবুও হকিংয়ের থিউরি মেনে নিয়েও তার অসারতা প্রমাণ করা হল।

[৪.৩]

(৩) মহাবিশ্ব অন্যকোনো সৃষ্ট কারণ থেকে সৃষ্ট হয়েছে: যেমন অন্য একটি মহাবিশ্ব থেকে (The Universe was created from something created. For example, from another universe)
মহাবিশ্ব যদি অন্য কোনও সৃষ্ট কারণ থেকে সৃষ্টি হয় তাহলে প্রশ্ন আসে সেই কারণটা ঘটবার কারণ কী? তাহলে পরবর্তী প্রশ্ন আসে সেই কারণের কারণের কারণ ঘটবার কারণ কী?… এভাবে চলতেই থাকে। অর্থাৎ, অন্য কোন মহাবিশ্ব থেকে সৃষ্টি হলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, সেই মহাবিশ্বটি কোথা থেকে এল? আর সেই মহাবিশ্বটি যদি আরেকটি মহাবিশ্ব থেকে সৃষ্টি হয় তাহলে সেটা কোত্থেকে এল?… এভাবে চলতেই থাকে আর তা আবারও Infinite বা অসীমের সমস্যায় আক্রান্ত হয়। আর সেটা আমরা আমাদের দ্বিতীয় সূত্রের সত্যতা যাচাইয়ে ব্যাখ্যা করেছি। অর্থাৎ, অসীম সংখ্যক সৃষ্ট কারণের সিরিজ শেষ করে বর্তমান মহাবিশ্বই কখনও অস্তিত্বে আসতে পারতো না।
তাহলে সিদ্ধান্তগুলো যাচাই করে অসম্ভব আর স্ববিরোধীগুলো eliminate বা বাতিল করে শেষমেশ আমাদের কাছে একটিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বাকি থাকে। অন্যান্য সিদ্ধান্তগুলো পর্যায়ক্রমে বাতিল হওয়ায় এটিই সত্য প্রতিপণ্য হয়। আর তা হলঃ
মহাবিশ্ব কোনো অসৃষ্ট কারণ থেকে সৃষ্টি হয়েছে (the universe was created by something uncreated/uncaused).

[৪.৪]

(৪) মহাবিশ্ব কোনো অসৃষ্ট কারণ থেকে সৃষ্টি হয়েছে (the universe was created by something uncreated/uncaused)
অসৃষ্ট কারণ বা Uncaused/Eternal Cause এর স্বরূপ উপলব্ধি করতে গেলেই একে যাচাই করা হয়ে যাবে। তাহলে এই অসৃষ্ট কারণের স্বরূপটি কেমন?
প্রথমত,
মহাবিশ্ব একসময় ছিল না (তা আমরা আগেই প্রমাণ করে এসেছি)। অতঃপর এই কারণটি মহাবিশ্বকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছে। এই বিষয়টি সেই ‘কারণ বা Cause’ এর ইচ্ছাশক্তি নির্দেশ করে। এটি তো মহাবিশ্বকে অস্তিত্বে নাও আনতে পারতো। অতএব ‘কারণ’টির ইচ্ছাশক্তি রয়েছে আর ইচ্ছাশক্তি নির্দেশ করে কোনো ‘সত্ত্বা’ বা Personality কে। এখন কোনো সত্ত্বাকে ‘এটি/এটার’ না বলে ‘তিনি/তাঁর’ বলাই শ্রেয়। তাই আমরা সেটাই বলব। আর এই সত্ত্বা যেহেতু শূন্য থেকে সমস্তকিছু সৃষ্টি করেছেন তাই তাঁকে আমরা ‘স্রষ্টা/ সৃষ্টিকর্তা’ বা The Creator বলব।
দ্বিতীয়ত,
অসৃষ্ট এই সৃষ্টিকর্তা হলেন সমস্তকিছু থেকে ঊর্ধ্বে অর্থাৎ, পরম (Absolute). আর ‘সবকিছুর ঊর্ধ্বে পরম সত্ত্বা’ বললে কেবল ‘একক’ সত্ত্বাকেই নির্দেশ করা হয়। প্রশ্ন আসতে পারে, সেটা কীভাবে? কারণ ‘অনন্ত’, ‘অসীম’, ‘পরম’ স্বাভাবিকভাবেই ‘এক’ এর বেশি হতে পারে না। Absolute বা পরম মানেই হল সবকিছুর ঊর্ধ্বে – আর সবকিছুর ঊর্ধ্বে কেবল ‘একক’ সংখ্যক সত্ত্বাই থাকতে পারে। তাঁর উপর বা সমান কিছু থাকলে সে সংজ্ঞা অনুসারেই আর পরম বা সবকিছুর ঊর্ধ্বে থাকে না। অথচ এমন অসৃষ্ট সত্ত্বা রয়েছে তা আমরা আগেই Deductive reasoning দিয়ে প্রমাণ করেছি। সুতরাং, এমন অসৃষ্ট পরম একজন সত্ত্বা রয়েছেন এবং ‘একজন’ ই রয়েছে।
এই বিষয়টা এতই সহজবোধ্য যে ভাষাগতভাবেও শুধুমাত্র ‘পরম’ শব্দটির সমার্থক হিসেবে পরিপূর্ণ, অসীম, সর্বশ্রেষ্ঠ, অদ্বিতীয় ইত্যাদি পাবেন। আর ইংরেজি ‘Absolute’ খুঁজলে পাবেন Ultimate, Supreme, Unparalleled, Unique ইত্যাদি। অর্থাৎ এইসমস্ত পরম বিষয়গুলো একইসাথে একজনেরই হতে পারে, এর দ্বিতীয় বলতে কিছু নেই।
বিজ্ঞানী হকিং এর কথা আবার মনে পড়ল। “মহাবিশ্বের উৎপত্তি ব্যাখ্যায় সৃষ্টিকর্তার কোনও প্রয়োজন নেই, পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো থাকবার কারণে মহাবিশ্ব নিজে নিজে জন্ম হওয়াই বাঞ্চনীয় ছিল।” কিন্তু সূত্রের কেবল ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা আছে, ক্রিয়া সম্পাদনের ক্ষমতা নেই তা তো আগেই ব্যাখ্যা করেছি। আর অসৃষ্ট কারণই যে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত তাও ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করেছি। সেই অসৃষ্ট কারণ বা Uncaused cause যে আসলে একজন ব্যক্তিত্ব বা সত্ত্বা “সৃষ্টিকর্তা” তাও দেখিয়েছি। তবুও এখন মনে পড়ল কারণ প্রকৃত বক্তব্য আসলে হওয়া উচিত এমন –
“মহাবিশ্বের সৃষ্টি ব্যখ্যায় একজন সৃষ্টিকর্তাই যথেষ্ট।”
তৃতীয়ত,
স্রষ্টার স্বরূপ সৃষ্টি থেকে ভিন্ন। যেমনঃ মহাবিশ্ব সসীম, কিন্তু স্রষ্টা অসীম। তেমনি সৃষ্টির আর কোনো বৈশিষ্ট্যই তার মত নয়। কেউ একটি চেয়ার বানালে সেই চেয়ারের স্রষ্টা তাতে রূপান্তর হয়ে যায় না, বরং তার সত্ত্বা আলাদাই থাকে। স্রষ্টা সম্পর্কে আমরা ততক্ষণ কিছু নিশ্চিত জানব না যতক্ষণ না তিনি নিজে আমাদের সেকথা জানাবেন। আমাদের পক্ষে স্রষ্টার সত্ত্বা কল্পনাও অসম্ভব, আমরা চেষ্টা করতে পারি কিন্তু কোনও ফল হবে না।
কারণ একটা Unknown reality কে কখনোই Known reality দিয়ে বিচার করা যায় না। যেমনঃ যে ব্যক্তি আগে কখনোই মিষ্টি স্বাদ পায় নি, তাকে যতই বোঝানো হোক না কেন – মিষ্টি স্বাদ আসলে কেমন তা কখনোই বোঝানো যাবে না। অথবা মনে করেন এক ব্যক্তি চোখ ঠিক থাকা সত্ত্বেও কখনো লাল রঙ দেখে নাই, তাহলে আপনি তাকে কখনোই লাল আসলে দেখতে কেমন তা বলে বুঝাতে পারবেন না। আর এবার চিন্তা করুন, এমন এক রঙ – বিচারবুদ্ধি দিয়ে শুধুমাত্র এর অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়েছেন কিন্তু আপনিও কক্ষনো দেখেন নাই, আবার আরেক লোক যাকে বুঝাতে চান সেও কখনো দেখে নাই, । তাহলে সেটা আসলেই কেমন তা নিয়ে পড়ে থাকা তো বাড়াবাড়ি আর অযথা সময় নষত ছাড়া কিছু না।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, পর্যবেক্ষণ আওতার বাহিরে না সবকিছুকে আমরা মিথ্যা সাব্যস্ত করব বলে বিবেচনা করেছিলাম। তাহলে স্রষ্টা পর্যবেক্ষণ আওতার বাহিরে হলেও কেন অসম্ভব সাব্যস্ত করছি না। মনে করিয়ে দিই, শুধুমাত্র একটা ব্যতিক্রম উল্লেখ করা হয়েছিল। আর তা হল অকাট্য Premise বা সূত্র থেকে যদি Deductive reasoning করে নিশ্চিতভাবে কোনোকিছু প্রমাণ করা যায় তাহলে পর্যবেক্ষণাতীত হলেও তা সত্য হবে।
আমরাও Deductive reasoning করে শেষমেশ একটিমাত্র যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি – আর তা হল ‘একজন অসৃষ্ট স্রষ্টার অস্তিত্ব’। আর আমাদের আলোচনার Deductive nature এর কারণে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত ‘একজন অসৃষ্ট স্রষ্টা’ সম্পর্কে আরও জ্ঞান অর্জন সম্ভব না হলেও তা অকাট্যই রয়ে যাবে। একটা উদাহরণ দিই।
যেমন মনে করুন, ভূতত্ত্ববিদরা মাটি খুঁড়ে গভীরে কিছু বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, আসবাবপত্র তথা সভ্যতার নিদর্শনাদি পেল। তাহলে এ সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞান অর্জন ছাড়াই বলে দেওয়া যায় যে একসময় সেখানে মানুষের কোনও সভ্যতা ছিল কিন্তু কালক্রমে তা চাপা পড়েছে। কেউ একথা বলবে না যে তারা দেখতে কেমন ছিল, তাদের স্বভাব কেমন ছিল এসব না জানলে তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করব না। বরং তাদের না দেখেই অন্তত সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল সেকথা বলা যাবে।
আরেকটি উদাহরণ দিই। চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠ, যে অংশটা সাধারণত পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান না, সেখানে এমন কোনও প্রযুক্তি পাওয়া গেল যেটা আপনি জানেন যে কোনো মানুষের পাঠানো নয়। আমেরিকা, জাপান, রাশিয়া কারও নয়। কেউ স্বীকার করছে না – এমন নয়, বরং সেই প্রযুক্তি আসলেই কোনো মানুষের নয়। তাহলে তো আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারব যে সেটা মানুষ ভিন্ন অন্যকোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর রেখে যাওয়া। কেউ এটা বুঝে নিতে মোটেও বুদ্ধিমান প্রাণীগুলো দেখতে কেমন, কোথায় থাকে, তাদের বুদ্ধিমত্তা কোন স্তরের এসব জিজ্ঞেস করবে না। এসব প্রশ্ন ওই বুদ্ধিমান প্রাণির অস্তিত্ব আছে মেনে নেওয়ার পরে আসবে।
অর্থাৎ, একটি কারণ বা ব্যাখ্যাকে (explanation) সবচেয়ে যৌক্তিক বলতে সবসময় সেই ব্যাখ্যার ব্যাখ্যা (explanation of the explanation) প্রয়োজন হয় না। উপরের প্রথম উদাহরণটির ক্ষেত্রে আদিম সভ্যতার অস্তিত্ব বুঝে নিতে তাদের সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানতে হয় না আর দ্বিতীয় উদাহরণটির ক্ষেত্রে মানুষ ভিন্ন কোনও বুদ্ধিমান প্রাণির অস্তিত্ব বুঝে নিতেও সেই প্রাণি সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা অর্জন প্রয়োজন হয় না। তেমনি স্রষ্টার অস্তিত্ব বুঝে নিতেও তাঁর সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা অর্জন অপ্রয়োজনীয়।
এছাড়া ব্যাখ্যার ব্যাখ্যা প্রয়োজন হলে ব্যাখ্যার-ব্যাখ্যার ব্যাখ্যাও প্রয়োজন হত। তাহলে ব্যাখ্যার-ব্যাখ্যার-ব্যাখ্যার ব্যাখ্যা… এভাবে করে চলতেই থাকত। ফলাফল – কখনো কোনো সিদ্ধান্তেই পৌঁছানো সম্ভব হতো না। Infinte সংখ্যক ব্যাখ্যা দরকার হতো – যা Infinite Problem এরই আরেক ভার্সন বলা যেতে পারে।
Unknown Reality কে তাই Known reality দিয়ে ব্যাখ্যা করা না যাক, কিন্তু সেই Unknown reality একারণে False বা মিথ্যা হয়ে যায় না। আর আমরা যেহেতু Deductive Reasoning করে দেখিয়েছি একজন ‘অসৃষ্ট অসীম স্রষ্টা’ রয়েছেন তাই আরও পর্যবেক্ষণ, ব্যাখ্যা বা স্রষ্টা সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা পাওয়া ছাড়াই এটা সত্য বলে মেনে নিতে হবে।
‘মাল্টিভার্স থিউরি’ বা ‘আমরা কারও স্বপ্নে রয়েছি’ এসমস্ত কথাবার্তা অসার হয় কারণ এগুলোর অস্তিত্বের প্রমাণও মেলে না, পর্যবেক্ষণও সম্ভব হয় না। কিন্তু আমরা যৌক্তিকভাবে Deductive reasoning দিয়ে দেখিয়েছি যে, একজন অসৃষ্ট স্রষ্টা রয়েছেন। তাছাড়া যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে মাল্টিভার্স তত্ত্ব সত্য, তবুও একজন পরম স্রষ্টার ক্ষেত্রে কোটি কোটি মহাবিশ্ব সৃষ্টি একটি মহাবিশ্ব সৃষ্টির মতোই সহজ। তাই মাল্টিভার্স থিউরিও আস্তিকতার বিলুপ্তি ঘটায় না।
এখন, Unknown Reality কে কখনো Known Reality দিয়ে ধারণ করা যায় না বলে স্রষ্টার কোনো মূর্তি, ছবি, প্রতিমূর্তি ইত্যাদি যাকিছু আমরা কল্পনা করতে পারি তা থাকা সম্ভব নয়। এমন যা কিছু আছে তা মোটেও স্রষ্টা হতে পারে না। স্রষ্টাকে এসবে ধারণ করার চেষ্টা অন্ধদের হাতি দেখার মতই হাস্যকর। হাতি হাতড়ে হাতড়ে শেষমেশ কেউ বলবে হাতি কুলার মত, কেউ বলবে খাম্বার মত ইত্যাদি। কিন্তু এখানেও তো অন্ধেরা হাতড়ে দেখেছে অর্থাৎ অন্তত কোনওভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে, কিন্তু স্রষ্টার অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়েও তো আমরা তাঁকে পুরোপুরি পর্যবেক্ষণ করতে পারছি না। স্রষ্টার স্বরূপ তাই ছবি মূর্তিতে ধারণ করার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ এবং ফলাফল মিথ্যা – আসলে এর চেয়ে বিরাট আর শ্রেষ্ঠ মিথ্যা আর কিছু হতে পারে না।
কারণ এতে আমার আপনার মতো সৃষ্টির ওপর মিথ্যা আরোপ করা হয় না, বরং স্বয়ং সমস্ত সৃষ্টির স্রষ্টার ওপর মিথ্যা আরোপ করা হয়। আর আন্দাজে ছবি মূর্তি ইত্যাদি বানিয়ে পূজা করা কেবল মিথ্যা আরোপ করেই বসে থাকা না, বরং সেটাতো ‘সমস্ত মিথ্যার শ্রেষ্ঠ মিথ্যা’ কেই উপাসনা করা, বাড়াবাড়ি করা।
চতুর্থত,
স্রষ্টা সমস্ত সৃষ্টির ঊর্ধ্বে অর্থাৎ, বস্তুগত কোনোকিছু স্রষ্টার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু এর অর্থ এও নয় যে স্রষ্টা দয়াবান, ক্ষমাকারী, বিচারক ইত্যাদি হতে পারবেন না। কারণ এগুলো বস্তুবাচক বিষয় নয়, বরং গুণবাচক বিষয়াদি। গুণবাচক বিষয়াদি বস্তুগত বিষয়ে সীমাবদ্ধ ও প্রযোজ্য নয়।
গুণবাচক বৈশিষ্টাবলি কখনোই বস্তুগত জিনিসে প্রযোজ্য তো নয়ই, বরং সেগুলো কোনো Personality বা সত্ত্বার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। Personification কেবল Person, Entity বা সত্ত্বার ক্ষেত্রেই সম্ভব আর গুণবাচক বৈশিষ্টাবলি আরোপ Personification এর একটি অংশমাত্র। তাই ‘টেবিলটি অনেক দয়ালু’ কথাটা যেমনি হাস্যকর, মিথ্যা, অযৌক্তিক তেমনি ‘মহাবিশ্বের কি দয়া’, ‘প্রকৃতির কী আজব খেয়াল’, ‘প্রকৃতি চাইল এটা করতে’, ‘প্রকৃতি আপন মনে ওটা বেছে নিল’ ইত্যাদি কথাবার্তাও হাস্যকর, মিথ্যা, অযৌক্তিক। এগুলো কল্পনার বিষয়বস্তু হতে পারে, বাস্তব জগতের নয়। এমনসব বস্তুগত বিষয়ে Personification অসম্ভব আর হাস্যকর হলেও কিছু মানুষ অহরহ এসব ব্যবহার করে আসছে – যেন স্রষ্টাকে অস্বীকার করতেই এত আয়োজন।
পঞ্চমত,
অসৃষ্ট স্রষ্টা ‘অনন্ত-অসীম’ সত্ত্বা হওয়ায় তাঁর কোনো আদি অন্ত নেই। অতএব স্রষ্টা সময়ের ঊর্ধ্বে। সময় দ্বারা তিনি আবদ্ধ নন। বরং সময় তাঁরই সৃষ্টি এবং মহাবিশ্বকে তিনি সময়ের ফ্রেমে আবদ্ধ করেছেন। সময়ের ফ্রেম বলতে মূলত ‘Present’ বা ‘বর্তমান’ এর ফ্রেম বোঝাচ্ছি। আমরা কখনোই বর্তমানকে অতিক্রম করে যেতে পারি না। আপনি প্রতি মুহুর্তে বর্তমানেই আছেন। কিছুক্ষণ আগের অতীতেও ফিরে যেতে পারবেন না, বর্তমানকে পাশ কাটিয়ে ভবিষ্যতেও চলে যেতে পারবেন না। ফিকশনগুলোতে এমন বহুকিছু দেখানো হলেও এটাই ফ্যাক্ট। আমাদের জন্য সময় ধীরে বা দ্রুত যেতে পারে – সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু সময়ের ঊর্ধ্বে উঠে একে অতিক্রম করা আমাদের জন্য অসম্ভব।
তাহলে ভাবুন তো, সময়ের ঊর্ধ্বে কোনও একজন সত্ত্বার জন্য কি একই জিনিস খাটে? উত্তরটা সহজ – না, খাটে না। যখন সময়ই ছিল না তখনও স্রষ্টা ছিলেন। তিনি আমাদেরকে সময় দ্বারা আবদ্ধ করেছেন কিন্তু তিনি সময়ের ঊর্ধ্বে বলে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত তাঁর কাছে একইসাথে বিরাজ করে। তাই স্রষ্টা অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সবকিছু সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞান রাখবেন – সেটাই স্বাভাবিক। এখন তিনি যদি আপনার ভবিষ্যত দেখে সেটা লিখে রাখেন তাহলে সেটা মোটেও আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে না, বরং আপনার নিজ থেকে নেওয়া সিদ্ধান্তই হবে। কারণ আপনি ভবিষ্যত সম্পর্কে জানেন না বলে একটু পর ডানে যাবেন নাকি বামে যাবেন সেটা আপনার নিকট সিদ্ধান্ত হিসেবেই আবির্ভূত হবে। আমরা বর্তমানের ফ্রেমে বন্দি বলে আমরা যে ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছু জানি না – এই না জানাই আমাদেরকে নিজেদের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর জন্য এককভাবে দায়ী করে।
এই হল স্রষ্টার পক্ষ থেকে ‘Free will বা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি’ দেওয়া সত্ত্বেও তাঁর আগে থেকে সবকিছু জানা থাকার একটি ব্যাখ্যা – তিনি সময়ের ঊর্ধ্বে, আমরা নই। বর্তমানের ফ্রেমে বন্দি আমাদের কাছে বিকল্প কাজগুলো সব অজানা Option বা সিদ্ধান্ত হিসেবেই এসেছিল। তাই স্রষ্টা আগে থেকে জেনে থাকলেও আমাদের সমস্ত কাজের দায়ভার আমাদেরই। এখন কেউ বলতে পারে, স্রষ্টা চাইলে আমাদেরকে দিয়ে জোর করে শুধু ভালটাই করিয়ে নিতে পারতেন – কিন্তু তা হলে সেটা আর আমাদের Free will থাকত না।
ষষ্ঠত,
মহাবিশ্ব একসময় ছিল না, পরে এসেছে সেটা আগেই যৌক্তিক প্রমাণাদি দিয়ে আমরা দেখিয়েছি। অর্থাৎ, বস্তুগত বা Materialistic/Physical দিক থেকে মহাবিশ্ব শূন্য থেকেই এসেছিল। কিন্তু শূন্য থেকে আসবার জন্য ‘কোনো কারণ ছিল না’ – এই বিকল্পটি অসম্ভব – তা আমরা মূলত [৪.১] এর আলোচনায় দেখিয়েছি। আর বাকি [৪.২], [৪.৩], [৪.৪] এ বস্তুগতভাবে ‘শূন্য’ থেকে সৃষ্টি হলেও তার সম্ভাব্য সকল কারণ নিয়ে আলোচনা করেছি ও শেষে একজন অসৃষ্ট সৃষ্টিকর্তাই হল সবেচেয়ে যৌক্তিক কারণ তা দেখিয়েছি।
অর্থাৎ, সৃষ্টিকর্তা ‘শূন্য থেকে’ই সব সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তিনি অনন্ত, অসীম, পরম ও অসৃষ্ট বলে মহাবিশ্বের এবং সমস্ত সৃষ্টির বস্তুগত শূন্যতাতেও তিনি ছিলেন, আবার সমস্ত সৃষ্টির বিলুপ্তি ঘটলেও তিনি থাকবেন।
সপ্তমত,
“স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করল?”
মজার ব্যাপার হল এর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে রিচার্ড ডকিন্সের ‘The God Delusion’ এর প্রধান যুক্তিগুলোতেও আলোকপাত করা হয়ে যাবে। সহজকথায় বাচ্চাদের মতই সে মন্তব্য করেছে ‘যদি মহাবিশ্ব একজন স্রষ্টা সৃষ্টি করে থাকে, তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করেছে (তার ভাষায় মহাবিশ্বের যদি designer থাকে তবে সেই designer এর design কে করেছে)। আর এই প্রশ্ন চলতেই থাকে বলে স্রষ্টার অস্তিত্বই অসম্ভব।’
খেয়াল করুন, ডকিন্স ধরেই নিয়েছে একজন ‘সৃষ্ট স্রষ্টা’র কথা অর্থাৎ, স্রষ্টাকে কেউ একজন সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমরা যৌক্তিক বিচার করেই দেখিয়েছি যে মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি হবে Uncaused/ Uncreated বা অসৃষ্ট। অর্থাৎ, স্রষ্টা এমন এক সত্ত্বা যাকে কেউ সৃষ্টি করে নাই; তিনি অসৃষ্ট, পরম ও অনন্ত বিরাজমান। স্রষ্টা যদি অসৃষ্ট না হন, তবে মহাবিশ্বই সৃষ্টি হয়ে বর্তমান পর্যায়ে আসতো না সেটা আমরা আমাদের [৩] এর আলোচনায় ‘দোকানের লাইন’ উদাহরণটিতেই উল্লেখ করেছিলাম। অর্থাৎ, ডকিন্সের স্রষ্টাকে যেমন ধারণা করছে (সৃষ্ট) তা আমরা ন ইজেরাই বাদ প্রমাণ করেছি।
(‘কোন সৃষ্ট স্রষ্টা অসম্ভব’ তা মূলত [৪.৩]“মহাবিশ্ব কোনো সৃষ্ট কারণ থেকে সৃষ্ট হয়েছে” (The Universe was created from something created) এ আলোচনা করার কথা থাকলেও তখন ‘অসৃষ্ট কারণ’ এর স্বরূপ যে আসলে ‘সত্ত্বা’ আর সেই সত্ত্বা যে ‘সৃষ্টিকর্তা’ তা ধারাবাহিকভাবে পরে এসেছে – আর তাই ধারাবাহিকতা ঠিক রেখে ‘সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করলো’ এমন প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার আগে মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যে ‘অসৃষ্ট একক সৃষ্টিকর্তা’ তা আমরা আগে প্রমাণ করে নিয়েছি।)
বোকারা হয়ত এখানে ডারউইনিজম টেনে আনতে পারে। কিন্তু ডারউনিজম এখানে আদতে আলোচনার অংশই হতে পারে না। ডারউইনিজম প্রাণসৃষ্টির সাথে জড়িত, মহাবিশ্ব সৃষ্টির সাথে নয়। যদিও ডারউইনিজম প্রাণসৃষ্টিরও অপব্যাখ্যা করে, আজ এ বিষয়ে আলোচনা হবে না। কারণ, মহাবিশ্বের শুরু আর এর অসৃষ্ট কারণ ‘একক সৃষ্টিকর্তা’ এর সাথে ডারউইনিজম এর কোনো সম্পর্কই নেই।
খেয়াল করলে দেখবেন, নাস্তিকেরা নিজেদের ধারণাগুলোকে সৃষ্টিকর্তার স্বরূপে চাপিয়ে তারপর অস্বীকার করতে চায়। যেমনঃ ডকিন্স ধরেই নিয়েছে সৃষ্টিকর্তাকে কেউ সৃষ্টি করেছে – সৃষ্ট সৃষ্টিকর্তা। সেই হিসেবে ডকিন্সের বই ‘The God Delusion’ না হয়ে ‘The Created God Delusion’ হওয়া উচিত ছিল! সৃষ্টিকর্তা নিজের সম্পর্কে যা কিছু জানিয়েছেন তা বাদ দিয়ে নিজের ধ্যান ধারণা মত স্রষ্টা বানিয়ে নিয়ে তার পূজা করা বা ধ্যান ধারণা থেকে ‘কোনো সৃষ্টিকর্তাই নেই’ উপসংহার টানা তাই একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তাই প্রকৃত স্রষ্টাকে চিনতে তাঁকে সঠিক ধারণায় সংজ্ঞায়িত করা অপরিহার্য।
এখন আলোচনার সুবিধার্থে পুরোটা অনেক সংক্ষেপে একবার চোখ বুলিয়ে নিন –
[১] আমরা প্রথমে সিদ্ধান্তে পৌঁছোবার Deductive আর Inductive দুই ধরনের পথ ব্যাখ্যা করেছিলাম।
[২] এরপর আমরা Deductive reasoning পদ্ধতিতে এগিয়েছি এবং সূত্র বা Premise হিসেবে ‘আমাদের মহাবিশ্বের বাস্তব অস্তিত্ব আছে’ ধরে নিয়েছিলাম।
[৩] সেখান থেকে মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে প্রশ্ন করে ‘মহাবিশ্বের একটি শুরু হয়েছিল’ প্রমাণ করেছিলাম।
[৪] এরপর এই শুরুর কারণ হিসেবে চার ধরনের সম্ভাব্য সকল কারণ দাঁড় করিয়েছিলাম –
প্রথমটি ছিল – শূন্য থেকে কোনো ‘কারণ ছাড়াই’ মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়ে যাওয়া,
দ্বিতীয়টি ছিল – মহাবিশ্ব নিজেকে নিজে সৃষ্টি করা,
তৃতীয়টি ছিল – কোনো ‘সৃষ্ট’ কারণে মহাবিশ্বের সূচনা আর
শেষটি ছিল – কোনো ‘অসৃষ্ট’ কারণে তা হওয়া।
[৪.১], [৪.২], [৪.৩] এ একে একে প্রত্যেক বিকল্পকে যাচাই করে স্ববিরোধীতা আর অসম্ভাব্যতার কারণে বাদ দিতে দিতে শেষমেশ আমরা পৌঁছেছি একমাত্র যৌক্তিক সিদ্ধান্তে – মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে কোনও অসৃষ্ট কারণ অর্থাৎ, Uncreated or Uncaused Cause এর ফলে।
[৪.৪] এরপর আমরা এই অসৃষ্ট কারণ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে এর সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি –
প্রথমত, এর ইচ্ছাশক্তি রয়েছে সুতরাং এটি ‘সত্ত্বা’ বা Personality. এই সত্ত্বা যেহেতু শূন্য থেকে সমস্তকিছু সৃষ্টি করেছেন তাই তিনি স্রষ্টা বা সৃষ্টিকর্তা।
দ্বিতীয়ত, অনন্ত, অসীম, পরম সত্ত্বা কেবল একক সংখ্যক থাকতে পারে বলে স্রষ্টাও একজনই রয়েছেন।
তৃতীয়ত, আমাদের Deductive reasoning এর কারণে স্রষ্টার অস্তিত্ব নিশ্চিত হতে আমাদের তাঁর সম্পর্কে পুরোপুরি জানা লাগে না। আর স্রষ্টা আমাদের প্রেক্ষিতে Unknown Reality তে অবস্থান করেন বলে তাঁর কোনো ছবি, মূর্তি ইত্যাদি থাকতে পারে না।
চতুর্থত, গুণবাচক বৈশিষ্টাবলি বস্তুগত বিষয়ে সীমাবদ্ধ ও প্রযোজ্য নয়। তাই স্রষ্টার ক্ষেত্রে গুণগুলোর প্রযোজ্যতাও স্রষ্টার সত্ত্বাকে সসীম করে দেয় না। তাছাড়া, গুণবাচক বৈশিষ্ট্যসমূহের আরোপ Personification এর অংশ এবং বস্তুগত কিছুতে এর আরোপ অযৌক্তিক ও হাস্যকর।
পঞ্চমত, তিনি সময়ের ঊর্ধ্বে বলে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন আর আমরা সময় দ্বারা সীমাবদ্ধ বলে আর ভবিষ্যত জানি না বলে সব সম্ভাবনাই আমাদের কাছে বিকল্প বা Option হিসেবে আসে। আর তাই আমরা নিজেদের সিদ্ধান্তের কারণে নিজেরাই দায়ী থাকব।
ষষ্ঠত, সৃষ্টিকর্তা ‘শূন্য থেকে’ই সব সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তিনি অনন্ত, অসীম, পরম ও অসৃষ্ট বলে মহাবিশ্বের এবং সমস্ত সৃষ্টির বস্তুগত শূন্যতাতেও তিনি ছিলেন, আবার সমস্ত সৃষ্টির বিলুপ্তি ঘটলেও তিনি থাকবেন।
সপ্তমত, ‘স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করল’ এমন প্রশ্ন অবান্তর কারণ এখানে ধরেই নেওয়া হয়েছে স্রষ্টাকে কেউ সৃষ্টি করেছে। ‘সৃষ্ট স্রষ্টা’ বা অন্য কোনও সৃষ্ট বিষয়াদি থেকে মহাবিশ্ব জন্ম হয়ে বর্তমান পর্যন্ত আসাই সম্ভব ছিল না। আর আমরাও শেষ কারণটিকে ‘অসৃষ্ট’ বলে এসেছি। স্রষ্টার স্বরূপই হল তিনি অসৃষ্ট – তাই যারা স্রষ্টার সংজ্ঞায়ন করতেই ভুল করবে সেগুলো তো অসম্ভাব্যতা সৃষ্টি করবেই।
সংক্ষেপে এই ছিল আমাদের পুরো আলোচনা।
Deductive Reasoning করে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করা মানে হল, যে সূত্র বা প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল, তাকেই অস্বীকার করা। আমাদের সূত্রটি ছিল, “মহাবিশ্বের বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে”। সুতরাং, আমাদের প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত – ‘মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ হলেন একজন অসৃষ্ট, পরম, অনন্ত, অসীম সৃষ্টিকর্তা’ একথা অস্বীকার করার অর্থ হল পুরো মহাবিশ্বের অস্তিত্বই অস্বীকার করা… নিজের অস্তিত্বই অস্বীকার করা।
সুতরাং, একজন অসৃষ্ট পরম স্রষ্টা রয়েছেন এবং একজনই রয়েছেন।
(প্রমাণিত)

শেষের আলাপঃ

بِسۡمِ ٱللهِ ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ
قُلۡ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ (١) ٱللَّهُ ٱلصَّمَدُ (٢) لَمۡ يَلِدۡ وَلَمۡ يُولَدۡ (٣) وَلَمۡ يَكُن لَّهُ ۥ ڪُفُوًا أَحَدٌ (٤)
অর্থঃ
(১) বলুন, তিনি আল্লাহ আল-আহাদ (এক ও অদ্বিতীয়), (২) আল্লাহ আস-সামাদ (অনন্ত, অসীম, পরম, অমুখাপেক্ষী ইত্যাদি) (৩) তিনি কাউকে জন্ম দেন নাই, এবং কেউ তাঁকে জন্ম দেয় নাই (অর্থাৎ কেউ তাঁকে সৃষ্টি করে নাই ) (৪) এবং আর কোনোকিছুই তাঁর সমতুল্য নয়। [সূরা ইখলাস]
আমি একজন মুসলিম, আমি একজন মু’মিন। আর মুমিনদের উপরের এত্তসব কথাবার্তা প্রয়োজন ছিল না। আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা অনেক আগেই নিজের সম্পর্কে তাঁর বান্দাদের জানিয়ে উপরে উল্লিখিত সূরা ইখলাস নাযিল করেছিলেন। আর প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী আদম (আ’লাইহস সালাম) থেকে শেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ ﷺ পর্যন্ত সকল নবী রাসূলগণ তাওহীদ বা একত্ববাদের কথাই প্রচার করেছেন।
ভাবতেও অবাক লাগে, এত এত কথাবার্তা বলে এসে শেষমেশ সূরা ইখলাসেই ফিরে এলাম! মু’মিনরা এভাবেই এগিয়ে থাকে। মু’মিনরা ‘গায়েবে’ অর্থাৎ না দেখেও যুক্তিতর্ক ছাড়াই একমাত্র স্রষ্টা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। একারণেই তারা মু’মিন বা বিশ্বাসী হয়। আরও বিস্তারিত বললে, অকাট্য প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস স্থাপন করে বলেই তারা মু’মিন হয়। কোনো প্রমাণ বা নিদর্শন এলে তাদের ঈমান বাড়ে, কিন্তু নিদর্শনের অভাব তাদের মনকে বিষন্ন করে না। অকাট্য প্রমাণ থাকলে তো সবাই-ই বিশ্বাস স্থাপন করতো! না দেখে বা অকাট্য প্রমাণ ছাড়া বিশ্বাস স্থাপনই তো পরীক্ষা!
(এটি আমাদের ইসলামের আকিদাহগত বিষয়। আরও বিস্তারিত জানতে ‘অকাট্যতা’ নোটটি পড়ে ফেলতে পারেন ইন-শা-আল্লাহ – অকাট্যতা)
আসলে যারা বিশ্বাস স্থাপন করতে চায়, তারা প্রমাণাদিতে আল্লাহর অস্তিত্বের অকাট্যতা খুঁজে পায়। আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করতে চায় না, তারা সবসময় সংশয়েই ডুবে থাকে। উপরে যে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে ‘একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব’ প্রমাণ করেছি এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। যে অবিশ্বাসীই থাকতে চায়, সংশয় সন্দেহে থাকতে চায় – সে ঠিকই এর ভেতর থেকেও প্রশ্ন বের করে নেবে। সে নিয়্যাতই ওইরকম করে নিয়েছে। তাই বিশ্বাস না করার জন্য পাল্টা যুক্তিতর্কে মেতে উঠবে।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে যেকোনো ধর্মেই বিশ্বাস স্থাপন করা যায়। সেই একক স্রষ্টার মনোনীত ধর্মটি চেনার জন্য একটি নির্দেশনাই যথেষ্ট – সৃষ্টিকর্তার বাণীতে কোনো ভুল বা স্ববিরোধিতা নেই। এটা আরেকদিনের আলোচনা।
কিন্তু সেজন্যও নিয়্যাতকে ঠিক করে নেওয়া অপরিহার্য।
যারা বলবে আমি আস্তিক দেখে আমার লিখায় শেষমেশ আস্তিকতারই জয় হয়েছে, তাদের বলি – তোমরাও তাহলে নাস্তিক দেখে তোমাদের কথাবার্তা, লিখাও তো নাস্তিকতার পক্ষেই যাবে। তাহলে তোমাদের কথা কেন শুনব?
তুমি নাস্তিক নও? তুমি কেবলই নিরপেক্ষ মুক্তমনা? তোমার এই দাবি প্রমাণ করতে পারবে? তোমার মস্তিষ্ক ছিঁড়ে তোমার চিন্তাগুলো নিরপেক্ষ – তা কি পারবে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিতে? তোমার মুখের কথায় তোমাকে ‘নিরপেক্ষ’ বিশ্বাস করতে বলছ? তুমি আমার কথা, আমার উপস্থাপিত প্রমাণ বিশ্বাস করতে চাও না – তবে আমিও তোমার কথা কেন বিশ্বাস করব?!
বিজ্ঞান আজ এককথা তো কাল আরেককথা বলে। যে স্কেলের দাগগুলো আজ একরকম তো কাল আরেকরকম, তা দিয়ে কখনও কিছু মাপা যায় না। বিজ্ঞান এই চির পরিবর্তনশীল স্কেল। একে দিয়ে ধর্মকে মাপতে গেলেও আজ নাস্তিকতা পাবেন তো কাল আস্তিকতা।
আর সত্য কোনো বিজ্ঞানীর বক্তব্যের উপর নির্ভর করে না। যত বড় বিজ্ঞানীই হোক না কেন, সবাই ভুল করতেই পারে। তাছাড়া, আস্তিকতা আর নাস্তিকতা উভয় পক্ষেই বিজ্ঞানীরা রয়েছেন।
হয়তো ভাবছেন, যে পক্ষের কথা অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয় সে পক্ষেই যাবেন। কিন্তু আসলে যে পক্ষে আগে থেকেই যেতে চান, সে পক্ষকেই অধিক যুক্তিযুক্ত ভেবে নিচ্ছেন।
অনেকের জন্য পৃথিবীর সময়টা আরামে ঘুমিয়ে থাকার মতোই কেবল উপভোগের ক্ষেত্র। তাই আজ যতো পারে, উপভোগ করে নিতে চায়। আগামীকাল যে আজকের এই সময়ের হিসেব দিতে হবে তা মানতেও চায় না, শুনতেও চায় না। বরং প্রমাণ করতে চায় যে আগামীকাল বলে কিছু নেই, হিসাব নেবার কেউ নেই। এই ধরনের মানুষেরা ঘুমিয়ে নেই, বরং ঘুমের ভান করে পড়ে রয়েছে। এরা ডাক শুনেছে ঠিকই, কিন্তু আজকের করণীয় অস্বীকার করে পড়ে থেকে আরাম করাই বেছে নিয়েছে। তাই তারা করে নিক কিছুক্ষণ আরাম।
“… শীঘ্রই তারা জানতে পারবে। বরং না, অতিশীঘ্রই তারা জানতে পারবে।” [সূরা নাবা, ৪-৫]
===================
লেখক — তানভীর আহমেদ

ভালবাসা ও দু’টি বাস্তবতা

সাধারণভাবে ভালবাসা বলতে আমরা যা বুঝি তেমন প্রত্যেক ভালবাসাই, যদি সত্য হয়ে থাকে, একটা পরিণতিকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে – বিয়ে। একে অপরকে ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার সেইসব কপটপূর্ণ ফেলনা ভালবাসার কথা আজ বাদ। আপনি একেবারে মন থেকেই কাওকে ভালবাসেন আর মন থেকে চান যেন আপনার ভালবাসা পরিণতি পাক, অথবা আপনি কাওকে ভালবাসলে মন থেকেই ভালবাসবেন এমন সততা পোষণ করেন, তাহলে অনুরোধ থাকবে একবার পুরোটা পড়ে দেখার জন্য। কেননা মন থেকে সৎ থাকলেও আপনি হয়ত দু’টি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করছেন বা করবেন যা চুরমার করে দিতে পারে আপনার ভালবাসা।
প্রথমেই এক ভাইয়ের জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা উল্লেখ করব। ভার্সিটি জীবন থেকেই এক আপুর সাথে প্রেম করতেন। তারা দু’জনেই মন থেকে ছিলেন সৎ এবং তাদের এই ভালবাসাকে পরিণতি দিতে দু’জনেই ছিলেন বদ্ধপরিকর। এরপর ভার্সিটি থেকে বের হয়েই ভাইটি ভাল একটা চাকরি পেয়ে যান এবং এক সময়ে তাদের এই ভালবাসার কথা তাদের পরিবারদ্বয়কে জানানো হয়, প্রকাশ করা হয় বিয়ের আগ্রহ। দুই পরিবারই সহজেই মেনে নেয় এবং একটা সময়ে কথাবার্তা বলে বিয়ের দিন-তারিখও ঠিক করা হয়ে যায়। কোথাও কোন সমস্যা ছিল না – শুধুমাত্র একটা বিষয় ছাড়া। আর তা হল তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বিয়ের আগ পর্যন্ত তাদের সমস্ত মেলেমেশাগুলো ছিল আল্লাহ, যিনি এই বিশ্বজগৎ-আমার-আপনার রব, তাঁর পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ। আর একারণেই একেবারে ঘটনার শেষ পর্যন্ত সেই ভাইটিকে আমার আরেক দ্বীনি ভাই বার বার স্মরণ করিয়ে দিতেন আল্লাহর নিষেধাজ্ঞার কথা। কিন্তু এই দ্বীনি ভাইটি ঐ ভাইটিকে কোন যুক্তি দেখাতে পারতেন না।
“কয়েকদিন পরেই তো বিয়ে করছি। বিয়ের তারিখও ঠিক হয়ে গেছে। তাহলে এখন কথা বলতে – দেখা করতে সমস্যা কোথায় ?” – এই প্রশ্নের মনমত কোন জবাব দিতে পারত না সেই দ্বীনি ভাইটি। তারপরও শুধু না করে যেতেন। কারণটা ছিল ঐ যে – রবের নিকট এর অবৈধতা। এভাবে করেই দিন কেটে যাচ্ছিল। অতঃপর বিয়ের দিন-তারিখ ঘনিয়ে আসলো। বিয়ের উদ্দেশ্যে ভাইটি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন – বাসে।
ভাইটি চট্টগ্রামে পৌঁছেছিলেন ঠিকই। কিন্তু প্রাণ নিয়ে নয়। আসার পথে বাস অ্যাক্সিডেন্ট করে আর সেই অ্যাক্সিডেন্টে অধিকাংশ বেঁচে গেলেও হাতে গোনা যে দুই-তিনজন মৃত্যুবরণ করেছিল – তাদের মধ্যে সেই ভাইটিও ছিল একজন।
দ্বীনি ভাইটি সেই ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পান কয়েকদিন পরে। তিনি যখন ঘটনাটি বলছিলেন তখন উল্লেখ করেছিলেন, “মৃত্যু যে এভাবে চলে আসতে পারে – সেটা আমাদের কারও মাথাতেই আসে নি। আমার নিজেরও একেবারে কল্পনার বাইরে যেটা ছিল অগত্যা তাই হয়েছিল।”
এই হল প্রথম বাস্তবতা। আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন, সমস্ত কিছু যতই ঠিক দিকে এগোচ্ছে বলে মনে হোক না কেন – আপনার রবের অনুমতি না থাকলে কোনো কিছুই সম্ভব না। যে ভাইটির ঘটনা বলছিলাম তিনি তো মন থেকে সৎই ছিলেন, আপুটিও ছিলেন। তাদের পরিবারও তো রাজি ছিল – না শুধু রাজিই নয়, বরং তারা তো খুশি হয়ে বিয়ের দিন তারিখও নির্ধারণ করেছিলেন। ঘটনাটির পর এতসমস্ত চিন্তা করে দেখলাম, শুধুমাত্র যে জিনিসটির অভাব এখানে ছিল তা হল আল্লাহ সুবহানাহুতা’লার ইচ্ছা বা অনুমতি।
পরবর্তীতে সেই আপুটির আরেক জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়। কারও জীবনই তো আর থেমে থাকে না। কিন্তু আমি এটা নিশ্চিত যে আপুটি অনেক যন্ত্রণা পেয়েছিলেন, হয়ত এখনও পান।

এটা একটা ঘটনা, কোন গল্প নয়। এমন আরও বহু ঘটনা মানুষের জীবনে ঘুরপাক খায় – একেবারে হুবহু না হলেও এমন যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি সৃষ্টি করা ঘটনা। তা নাহলে আত্নহত্যা তো দূরের কথা, ব্রেকআপ শব্দটাও বর্তমানে এতটা প্রচলন পেত না। কৌতুহল আশা-আকাঙ্খা আর আনন্দমাখা অনুভূতি দিয়ে যে সম্পর্কগুলোর সূচনা হয় সেগুলো শেষ হয় মনোমালিন্য, হতাশা আর যন্ত্রণা দিয়ে। আর সমস্ত কিছু ঠিক থাকার পরও যে পরিণতি অধরাই রয়ে যেতে পারে তার উদাহরণ তো কেবলই দিলাম। আর এই জীবন বিষিয়ে তোলা ঘটনার কারণ ঐ এক বাস্তবতাকে ভুলে যাওয়া : আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোনকিছুই সম্ভব না।
তাই ভাই বা বোন আমার, আপনি হয়ত এখন উদ্দেশ্য ভাল রেখেই কারও সাথে প্রেম করে চলেছেন, কাটাচ্ছেন অনেক সুন্দর সময়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ইচ্ছা না থাকলে আপনার কাটানো সেই সুন্দর সময়গুলোই হয়ত দানব হয়ে আপনার জীবনকে তিক্ত করে তুলবে। ইসলাম বিয়ের আগে প্রেম ভালবাসাকে নিষিদ্ধ করেছে আমার-আপনার আত্মিক-মানসিক নিরাপত্তার জন্যেই। যাতে আমরা বাস্তবতাকে ভুলে গিয়ে জীবনকে দুর্বিষহ করে না তুলি।
এই তো গেল প্রথম বাস্তবতা। এটা নিয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করলে একটা প্রশ্ন মাথায় চলে আসে আর সেই প্রশ্নটা আমাদেরকে ক্রমান্বয়ে দ্বিতীয় বাস্তবতার দিকে ধাবিত করে।
প্রশ্নটা ভাগ্যবিশ্বাস নিয়ে। আল্লাহর হাতেই যদি শেষ পর্যন্ত সবকিছু থাকে তাহলে কি আমরা কখনও চেষ্টা করব না? এটা সুবিস্তারিতভাবে আরেকসময়ে আলোচনার দাবি রাখে। এখন শুধু একথা মাথায় রাখি যে, আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা তাঁর বান্দাদেরকে স্বাভাবিকভাবে যা কিছু কল্যাণকর তাঁর দিকেই ধাবিত করেন। বান্দার গুনাহ আর দুআ সেই স্বাভাবিকতার পরিবর্তন আনতে পারে। যদিও বান্দা দুআ করবে নাকি করবে না তা আল্লাহ সুবহানাহু তাঁর ই’লমে গায়িবের কারণে আগে থেকেই লিখে রেখেছেন, প্রকৃতপক্ষে আমরা দুআ করব বলেই তিনি লিখে রেখেছেন। তিনি লিখে রেখেছেন বলে আমরা করব – ব্যাপারটি এমন নয়। দুআ ছাড়াও অন্যান্য যেকোনো কাজের জন্যও এটি প্রযোজ্য।
আর এই কথাগুলো আসলে এমন যা একজন বিশ্বাসীর সন্দেহ দূর করে তার বিশ্বাসকে পোক্ত করে আবার একইসাথে অবিশ্বাসীর সন্দেহ বাড়িয়ে তুলে তার অবিশ্বাসকেও পোক্ত করে। এটা নির্ভর করে সেই মানুষটি মনের গহীনে এই সত্যকে অন্যসব সত্যের সাথে স্বীকার করে বিশ্বাসী হতে চায়, নাকি সন্দেহের মধ্যেই ডুবতে ডুবতে অতলে হারিয়ে যেতে চায় – তার ওপর। তাই দেখা যায়, অনেক অবিশ্বাসীও তাদের মনের সত্য স্বীকারের অনুভূতির দরুণ বিষয়গুলো বুঝতে পারে এবং বিশ্বাসীদের পথে পা বাড়ায়। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ। (তাকদীর আর এই সংক্রান্ত বিষয়াদি বিস্তারিত লিখা হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ; নোটের নাম – ‘এক’ এর উপপাদ্য।)
যাই হোক, ভালোবাসায় ফিরে যাই। প্রথম বাস্তবতা আমাদেরকে শেখায় যে কোন কাজের সফলতা-ব্যর্থতা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে তাই আমাদের ভালবাসার বা অন্য যেকোন কাজের সফলতার জন্য আল্লাহর অনুমতি প্রয়োজন। আর আল্লাহর অনুমতি কীভাবে পাওয়া যায়? – দুআ !
দুআর মাধ্যমে আপনি আল্লাহর কাছে চাইবেন। দুআ হল মুমিনের অস্ত্র। এর মাধ্যমে আপনি আল্লাহর অনুমতি চাইবেন। কিন্তু কীভাবে চাইবেন? এই প্রশ্নটির উত্তরেই রয়েছে দ্বিতীয় বাস্তবতা যা ক্রমে ক্রমে আসবে বলেছিলাম।
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করব যা আপনাকে পুরো ব্যাপারটি বুঝতে সহজ করে দিবে ইনশাআল্লাহ।
এক বোন বছরের পর বছর ধরে দুআ করেছিলেন যেন তার বিয়ে এক নির্দিষ্ট ব্যক্তির সাথে হয়। অতঃপর ৭-৮ বছরের দুআ আর চেষ্টার পর সকল বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে সেই বোনের বিয়ে যখন অমুক ব্যক্তির সাথেই হয়েছিল তখন তিনি উল্লেখ করেন – আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা যে তার দুআ কবুল করেছিলেন তা তিনি একেবারে অনুভব করেছিলেন। অতঃপর হয়ত ভালই কেটেছিল সেই বোনের কিছুদিন। হ্যাঁ হয়ত, তাও আবার কিছুদিন। কেননা বিয়ের দেড় বছরের মাথায় শুনেছিলাম স্বামীর ব্যবহার আর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এক খালাত বোনের বাসায় একেবারে চলে আসেন।
মাঝে যে তিনি একবারও দুঃখ কষ্ট সইতে না পেরে বাবার বাড়িতে চলে আসেন নি – এমনটি নয়। মানসিক নির্যাতন আর তার স্বামীর অন্য নারী-বান্ধবী-কলিগদের প্রতি কাতরতা দেখে রেগে বহুবারই বাবার বাড়িতে চলে এসেছিলেন। কিন্তু বাড়িতে শোনানো ‘তুমি তো নিজের পছন্দেই বিয়ে করেছ। তাহলে এখন এখানে এসব বলছ কেন?’ – এমনসব প্রশ্ন আর কিছুদিন পর পর স্বামীর ক্ষমা চেয়ে নিতে আসা – ইত্যাদি তাকে বাধ্য করত বারবার স্বামীর কাছে ফিরে যেতে। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হত না। পরবর্তীতে তার স্বামী আরও খারাপ-অকথ্য কিছু ঘটনা ঘটালে তিনি বাধ্য হয়ে চলে যান সেই খালাত বোনের বাসায়। আরও অনেক ঘটনার পরে বোনটির স্বামী তাকে তালাক দিলে শেষে বোনটির আরেকবার বিয়ে হয়। হয়ত বোনটি এখন যথাসম্ভব ভালই আছেন।
কিন্তু তার দুঃখের দিনগুলোতে তিনি আফসোস করে করে কাঁদতেন, “কেন যে আল্লাহ তার দুআ কবুল করেছিলেন? তাতে যে কোন কল্যাণ ছিল না…” – এখানেই হল আল্লাহর কাছে কীভাবে চাইবেন তার উত্তর ও দ্বিতীয় বাস্তবতা। আর সেটা হলঃ
আল্লাহর নিকট দুআতে আমাদের চাইতে হবে ‘যা কিছু কল্যাণকর’ বা এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করে, মোটেই নির্দিষ্ট করে কিছু উল্লেখ করে নয়। কারণ একটি নির্দিষ্ট বিষয় কারও জন্য কল্যাণকর নাও হতে পারে।
আমরা আমাদের সীমিত জ্ঞান দিয়ে হয়ত বুঝতে পারছি না। কিন্তু আল্লাহ সুবহানহুতা’লা জানেন – আমাদের জন্য প্রকৃতপক্ষে কী কল্যাণকর আর কী অকল্যাণকর। আমরা এখন জীবনের যে সাদা বিন্দুতে অবস্থান করে একে ভাল ভাবছি হয়ত সেই সাদা বিন্দুটিই সমস্ত জীবনছবির সবচেয়ে অসুন্দর-অকল্যাণকর অংশ। সমস্তটার খবর তো কেবল আল্লাহই জানেন।
রাসূলুল্লাহ সা. এর শেখানো দুআগুলো খেয়াল করলেও এই বাস্তবতা চোখে পড়ে। দুআ যে বিষয়েই হোক না কেন, কখনই তা নির্দিষ্ট করে না চেয়ে বরং সেই বিষয়ে যা কিছু আল্লাহর জ্ঞানে কল্যাণকর তা চাওয়া হয়েছে, আর নিস্তার চাওয়া হয়েছে অকল্যাণ থেকে। উপরের ঘটনাটিতে বোনটির ভুল ছিল একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকেই স্বামী হিসেবে পাবার জন্য দুআ করা। অথচ উত্তম হতো তিনি যদি ‘যে স্বামী তার দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর হবে’ এমনটি চেয়ে দুআ করতেন।
তাই ভাই বা বোন আমার, এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করবেন না। আল্লাহর অনুমতি প্রয়োজন বোঝার পর আপনি যে নির্দিষ্ট মানুষটির সাথে আপনার পরিণতির জন্য দুআ করবেন বলে ভাবছিলেন সেই যে কিছুদিন পর আপনার জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মানুষে পরিণত হবে না তার গ্যারান্টি তো আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না। যে মানুষটি আপনাকে আজ এত ভালবাসছে, সে তো পরবর্তীতে অন্য কারও প্রতি আরও আকৃষ্ট হতেই পারে। দেখতে, শুনতে, জ্ঞানে গুণে যে স্কেলেই তুলনা করুন না কেন, আপনার চেয়েও ভাললাগার মত, ভালবাসার মত মানুষ আশেপাশেই রয়েছে, অহরহ রয়েছে। আর একারণেই আজ লক্ষ লক্ষ ব্রেকআপের পর কোটি কোটি নতুন রিলেশন দেখা যায়। আর নিয়মিত হারে পেপার পত্রিকার পরকীয়ার ঘটনা তো বাদই দিলাম।
তাছাড়া আল্লাহর ভয়বিহীন মানুষগুলোর পক্ষে যে পশুর স্তরেও নেমে যাওয়া অসম্ভব না। আর যে এখন আপনার সাথে হারাম সম্পর্কে মজে গিয়ে দুনিয়ার জীবনের সামান্য লৌকিক ভাল সময়ের আড়ালে অনন্ত অসীম আখিরাতের জীবনটিকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিচ্ছে – তাও আবার শুধু নিজেরটাকেই নয় বরং আপনারটাকেও, সে আসলে আল্লাহর আযাবকে কতটাই বা ভয় করে আর আপনাকেই বা আসলে কতটা ভালবাসে ! প্রকৃতঅর্থেই সে আপনাকে ভালবাসলে যে সে তার এই ভালবাসাকে কেবল এই জীবনে সীমাবদ্ধ রাখতে মোটেই চাইত না, বরং অনন্তকালের জন্য স্থায়ী করতে চাইত। বাদ দিত এই কয়েকদিনের হারাম সম্পর্ক। তাই হারাম সম্পর্ক বাদ দিন, আল্লাহর কাছে কল্যাণকর জীবনসঙ্গী চেয়ে দুআ করতে থাকুন এবং সবর করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনার প্রতি কোনও যুলুম করবেন না।
আর কথা বাড়াব না। অতি সংক্ষেপে সমস্তটা আরেকবার উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হব –
১। আপনি যা কিছুই করার স্বপ্ন দেখুন না কেন, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ইচ্ছা বা অনুমতি ছাড়া তা অসম্ভব। সুতরাং দুআর মাধ্যমে আল্লাহর অনুমতি প্রার্থনা করুন।
২। আল্লাহই যাবতীয় কল্যাণ এবং অকল্যাণের জ্ঞান রাখেন। সুতরাং আল্লাহর কাছে যা চাইবেন তা নির্দিষ্ট না করে যা আপনার দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর হবে তা চাইবেন। এরপর আল্লাহর সিদ্ধান্তে ভরসা করে সবর করবেন।
এই দুই বাস্তবতাকে যতদিন মেনে নিয়ে কাজ করতে পারবেন না, ততদিন জীবন বিষিয়ে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু না, বরং অতি স্বাভাবিক। আর ভালবাসা ভাললাগার ব্যাপারটিও যে এর উর্ধ্বে নয় তা তো বিভিন্ন জীবন থেকে নেওয়া দু’টো ঘটনা উল্লেখ করেই বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কী করা সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত তাও দেখানোর চেষ্টা করলাম। এরপরও না বুঝলে আরও সহজ করে দিই। ভালবাসুন তাঁকে যিনি ভালবাসার সবচেয়ে বেশি দাবি রাখেনঃ আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন। তারপরও না বুঝলে মাফ করবেন : আপনার দুই দিনের জীবনের কিছু সময় নষ্ট করলাম।
অতঃপর ভাল থাকুক আপনার জীবন, আপনার ভালবাসা।
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাঁর বান্দাদেরকে এতটা ভালবাসেন, এতটা ক্ষমা করেন। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্ললাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর যিনি তাঁর উম্মাতকে ভালবেসেছেন, ভালবাসতে শিখিয়েছেন।
(‘এক’ এর উপপাদ্য Theorem of ‘The One’ লেখার লিংক – )
===================
লেখক — তানভীর আহমেদ

বিয়ের প্রকৃত বয়স – হালাল সম্পর্ক অনাবিল সুখের আঁধার

“কী করলে তুমি বিশ্বাস করবা যে আমি তোমাকে সত্যিই ভালবাসি?” নাস্তা খেতে যাওয়ার সময় রাস্তার একপাশে মোবাইলে কথা বলতে থাকা ছেলেটার কথা কান এড়িয়ে গেল না। ছেলেটার কণ্ঠে বিরক্তি আর উৎকণ্ঠা। ভাবলাম, কতটা Insecurity তে ভুগলে একটা মেয়ে একটা ছেলেকে এমন কথা বলতে পারে! আর ছেলেটাও যে কতটা মানসিক অশান্তিতে ভুগলে পছন্দের মানুষটিকেও এমন বিরক্তির সুরে কথা শোনাতে পারে!
এমন Insecurity তে ভুগবার ঘটনা কিন্তু হারাম সম্পর্কের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। কারণ কি মেয়েরা স্বভাবগতভাবেই আরেকজন মানুষকে এতটা বিশ্বাস করতে ভয় পায়? কারণটা কি ছেলেরা একটু উড়নচণ্ডী স্বভাবের হয়? অনেকে অনেক কারণ বললেও আসল কারণটা কিন্তু আড়ালেই থেকে যায়। সেটা হল হারাম সম্পর্কগুলোতে আল্লাহর রহমত থাকে না।
আর আপনার বিয়ের আগের প্রেমের সম্পর্কে আপনি সৎ থাকলেও, বিয়ের জন্য একেবারে খাঁটি নিয়্যাত রাখলেও আর অনেক সুখে থাকলেও কিন্তু হারাম হারামই থেকে যায়। সেটা হালাল হয়ে যায় না। [১]
আবার আপনার এমন বয়স হয়েছে যে কারও সাথে সুখ, দুঃখগুলো ভাগাভাগি করে নিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে এমন কাউকে খুঁজে পেতে যে আপনাকে বুঝবে, ভালবাসবে, সাহায্য করবে, উৎসাহ দিবে। বাবা-মা আর বন্ধুদের মত করে না। সহজকথায়, আপনার প্রেম করতে ইচ্ছে করে। আর এই ইচ্ছে হওয়াতে দোষের কিছু নেই কারণ বয়সটাই এমন। দোষ হবে যদি আপনার এই ইচ্ছে মেটাতে আপনার রব্বের দ্বারা নিষিদ্ধ কিছুতে জড়ান। তাহলে নিষিদ্ধ নয় কী? উত্তরটা সবার জানা, শুধু হয় না মানাঃ বিয়ে
কিন্তু পরিবার, সমাজ সভ্যতা আজ যুগের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে বেতাল হয়ে গেছে। তাদের মতে, আপনার বিয়ের বয়সই হয় নি। আপনি হারাম থেকে বেঁচে থাকতে চাইছেন সেটা যেন তারা বুঝতেই চায় না। তারা বলছে, অন্যরা তো তোমার মত এমন বিয়ে বিয়ে করে লাফালাফি করছে না। অথচ তারা বুঝতে চাইছে না যে অন্যরা হালাল-হারামের তোয়াক্কা করে না; তারা বয়ফ্রেন্ড, গার্ল্ফ্রেন্ড, জাস্ট-ফ্রেন্ডসহ নানাপদের সম্পর্ক তৈরি করে নিয়ে মানসিক চাহিদা মিটিয়ে চলেছে।
আবার রাসূল ﷺ বলেছেন ‘সামর্থ্য’ হলেই বিয়ে করে ফেলতে। এই সামর্থ্য কেবল মানসিক আর শারীরিক সামর্থ্য নয়। আর্থিকও যে তার অন্তর্ভুক্ত তা অনেকসময় আমরা মানতে চাই না। কোনো এক দ্বীনি ভাইয়ের বা বোনের আপনারই মত বয়সে একেবারে স্বপ্ন সত্য হওয়ার মত করে বিয়ে হয়ে গিয়েছে, আমরা শুধু সেই উদাহরণ টেনে আনতে চাই। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সেইসব ভাইবোনদের সাথে আপনার পরিস্থিতি মোটেই একরকম নয়। হয়তো তাদের বাবা-মা রাজি হয়ে গিয়েছিলেন বা কোনও একটি কারণে আল্লাহ সহজ করে দিয়েছেন। হতে পারে তিনি আল্লাহ সুবহানাহুর কাছে অনেক বেশি দুয়া করেছিলেন।
বিষয়টা যাই হোক না কেন, এমন ভাইবোনেরা অণুপ্রেরণা হতে পারেন, কিন্তু উদাহরণ নয়। কারণ পরিবার-সমাজ আজ অসুস্থতায় ভুগছে একথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। তাহলে আমাদের কী করা উচিত? সমাজের মুণ্ডুপাত করার আগে আসুন আগে নিজেদের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো শুধরে নেওয়ার আর নিজেদের করণীয়গুলো ঠিকভাবে করবার চেষ্টা করি ইনশাআল্লাহ। অনেক ভাই বিভিন্ন সময়ে এই বিষয়ে নাসীহা চান, তাই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই লিখাটি লিখা। আল্লাহ কবুল করুন।
প্রথমত,
আল্লাহর কাছে বেশি বেশি করে দুআ করা যেন তিনি বিষয়টি সহজ করে দেন। আর একইসাথে তাঁর উপর এই বিষয়ে ভরসা রাখা যে তিনি সুবহানাহুতা’লা কখনও কোনও বান্দাকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেন না। প্রায় সকলেই সূরা ফুরকান এর ৭৪ নং আয়াতে স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের শেখানো দুয়া জানেন। তবুও আরেকবার উল্লেখ করে দিচ্ছি ইনশাআল্লাহঃ
وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
অর্থঃ এবং যারা বলে, “ইয়া রব, আমাদের স্ত্রী-সন্তানদের পক্ষ থেকে আমাদের চোখে শীতলতা দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য আদর্শস্বরূপ করুন। (সূরা ফুরকান, ৭৪)
পরিচিত এক দ্বীনি ভাই ভার্সিটির ৩য় বছরেই বিয়ে করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার কাছে অন্যান্যরা এই সাফল্যের রহস্য জিজ্ঞাসা করায় তিনি সোজা উত্তর দিয়েছিলেন যে তিনি নাকি আল্লাহর কাছে অনেক দুআ করেছেন। আর অবশেষে আল্লাহ তার দুয়া কবুল করেছিলেন। তাই দুআকে কখনোই অবহেলা করবেন না। দুয়া তো মু’মিনের অস্ত্রস্বরূপ।
দ্বিতীয়ত,
রোযা রাখা। রাসূলুল্লাহর ﷺ সামর্থ্য হলেই বিয়ের হাদিসটির দ্বিতীয় অংশটি হল ‘না পারলে রোযা রাখ’ অর্থাৎ যদি কোনো কারণে বিয়ে করতে না পার তাহলে রোযা রাখা। আর অবস্থাভেদে এই রোযা লাগাতারও হতে পারে। এতে করে কামনা-বাসনা আর দৃষ্টি হিফাজতে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
তৃতীয়ত,
(এই বিষয়টি বিশেষ করে ভাইদের জন্য) আর্থিক সামর্থ্য অর্জনের হালাল চেষ্টা করা ও আল্লাহর সাহায্য চাওয়া। এই বিষয়ে অনেক ভাইদেরকেই উদাসীন হতে দেখা যায়। অথচ এই সমস্যার সমাধান হলেই দেখা যায় অনেক পরিবার আর না করে না। যদিও আসলে অভিভাবকদেরই উচিত ছিল সন্তানদের বিয়ের বয়স হলেই বিয়ের ব্যবস্থা করা ও সাহায্য করা আর তা না হলে আল্লাহর কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে, তবুও ফিতনা এড়াবার জন্য জাহিল অভিভাবকদের থেকে এ আশা না করাই উত্তম।
নিজের বিয়ের খরচাপাতিগুলো নিজে বহন করা আর বিয়ের পরে স্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এর সমাধান না হলে বিয়ের আগের ফিতনার চেয়ে বিয়ের পরের ফিতনাই আরও মারাত্নক আকার ধারণ করতে পারে। অনেক ভাইকে দেখেছি পরিবার বিয়ের খরচ দিচ্ছে বলে অপ্রয়োজনীয় বাজে খরচে ভাইদের বাধ্য করেছে যদিও রাসূল ﷺ বলেছেন যে সেই বিয়েই সবচেয়ে বরকতপূর্ণ যে বিয়েতে খরচ করা হয় সবচেয়ে কম। অর্থাৎ হাল আমলের লাইটিং-ফাইটিং টাইপেরও বাজে খরচ করা হয় না। গানবাজনা, গায়ে হলুদ, মেহেদি নাইটের মত জাহিলি সংস্কৃতি তো দূরের কথা। আর্থিক দৃঢ়তার অভাবে ভাইয়েরা জানা সত্ত্বেও পরিবারের চাপে এসব কাজে আর না করতে পারেন নাই। আল্লাহ ক্ষমা করুন।
এছাড়া একজন মেয়ে তার নিজ পরিবার ছেড়ে যখন স্বামীর ঘরে এসে সংসার করতে আসে, তখন একবুক স্বপ্ন নিয়ে আসে। হয়তো তার দ্বীনের কোনো একটি বিষয় নিজ পরিবারে অনেক কঠিন হয় বা হয়তো এক অপূর্ণ ইচ্ছা যা সে স্বামীর সান্নিধ্যে এসে সহজ হবে বোধ করছিল। এছাড়া স্ত্রী এলে আপনি নিজেও হয়তো অনেক বিষয় সহজ হবে বলে আশা করেন, কিন্তু শেষমেশ আসলে পুরুষকেই এগুলো সামলাতে হয়।
তাই ভাইদের জন্য এটা একটা পরীক্ষা। আর বহু ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বিষয়টা অনেকখানি সহজ হতে পারে কেবল ভাইদের আর্থিক অবস্থার দৃঢ়তা। তাই ব্যবসা বা চাকরি যাই আপনার জন্য সহজসাধ্য মনে হয় তাই তাওয়াক্কুল করে চেষ্টা করতে থাকুন। এক্ষেত্রে আবশ্যক, আয়ের উৎস হালাল হচ্ছে কিনা আশেপাশের অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিন। আল্লাহ আমাদের জন্য সহজ করুন।
চতুর্থত,
নিজের পরিবারকে যথাসম্ভব সুন্দর আচরণে বোঝানো আর তাদের হিদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করা। আল্লাহর ইচ্ছায় শুধুমাত্র পরিবারের সাপোর্ট থাকলেই বিয়ের বিষয়টা অনেক সহজ হতে পারে। পরিবারকে বোঝানোর জন্য তাদেরকে সুন্নাহ মেনে বিয়ের উপকারিতা, তাতে খরচ কীভাবে কমানো যায় আর সেটাই যে আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়, বর্তমান সমাজের অসুস্থতার দিকে ইঙ্গিত আর বিয়েই যে তার উত্তম সমাধান, জীবনসাথীর ক্ষেত্রে দ্বীনদারিতাই যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়াদি গুরুত্ব পেতে পারে ইনশাআল্লাহ। এই বিষয়টার খিয়ানত বোনদের পরিবারের ক্ষেত্রে বেশি হয়ে থাকে। তাই এবিষয়ে অনেক আগে থেকেই ধীরে ধীরে জোর দেওয়া উচিত ইনশাআল্লাহ।
পঞ্চমত,
নফল ইবাদাত বাড়িয়ে দিন আর আশেপাশের হারামে মজে থাকা মানুষগুলোর দিকে নজর না দিয়ে সিরতল মুস্তাকিমে যুদ্ধরত বান্দাদের দিকে নজর দিন। শয়তান যেন আপনাকে হতাশার ধোঁকায় ফেলতে না পারে। কিছু নফল ইবাদাত হতে পারে রাতের শেষাংশের কিয়ামুল-লাইল, চাশতের সলাত, সকাল-সন্ধ্যার জিকির, কুরআন তিলাওয়াত, নতুন নতুন দুআ ও যিকির শেখা, আমল করা ইত্যাদি।
আল্লাহ আমাদের নিয়্যাতগুলো পবিত্র করে দিন এবং আমাদের আমল ও চেষ্টাগুলোকে কবুল করুন। এই লিখাটির সমস্ত সার্থকতা আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং তিনিই একমাত্র প্রশংসার মালিক। একইসাথে সমস্ত ভুলত্রুটি কেবলই আমার এবং আমিই দায়ী। আল্লাহ আমায় ক্ষমা করুন।
বিঃদ্রঃ এই নোটটি লিখার সময় লেখক অবিবাহিত ছিলেন। তাই আমাদের কষ্ট বুঝবেন না… ইত্যাদি অভিযোগ ভিত্তিহীন।
ধৈর্য্য ধরে পড়বার জন্য জাঝাকাল্লাহ। আল্লাহ আপনার চেষ্টাগুলো কবুল করুন ও আপনার জন্য অর্ধেক দ্বীন পূর্ণ করা সহজ করে দিন।
[১] নিয়্যত ভাল হলেও এমন ভালবাসাগুলো সম্পর্কে আরও জানতে পারবেন ‘ভালবাসা ও দু’টি বাস্তবতা’ লেখাটিতে।
===================
লেখক — তানভীর আহমেদ