12.9 C
New York
Friday, October 24, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 4

আশার আলো (একটি ফিরে আসার গল্প)

আমি একটি দীর্ঘ সফর শেষে ফিরে আসছিলাম, আর আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা)-এর ফয়সালা ছিল আমার বসার জায়গা হবে একদল ভাবলেশহীন যুবকের পাশে যাদের হাসাহাসি ও কথাবার্তার শব্দ ছিল মাত্রাতিরিক্ত এবং বাতাস ছিল তাদের সিগারেটের ধোঁয়ায় পূর্ণআল্লাহর কী অশেষ রহমত! প্লেনটি ছিল পুরোপুরি ভর্তি, যার ফলে আমি আমার বসার জায়গাও বদলাতে পারছিলাম না

সমস্যাটি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু তা ছিল অসম্ভব। তাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে আমার বিরক্তির সীমা যখন চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছাল, আমি আমার কুর’আনের কপিটি বের করে যতটা নিচু আওয়াজে সম্ভব তিলাওয়াত করতে লাগলাম। কিছু সময় পর যুবকগুলো ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যেতে লাগলো। তাদের কেউ খবরের কাগজ পড়তে লাগলো, আর কেউ ঘুমিয়ে পড়লো।

হঠাৎ তাদের মধ্যে এক যুবক চিৎকার দিয়ে বললো, “যথেষ্ট হয়েছে!”

আমি মনে করলাম আমার আওয়াজ সামান্য চড়া ছিল, যা তাকে বিরক্ত করছে। তাই আমি তার কাছে মাফ চাইলাম এবং গুণ গুণ করে পড়তে থাকলাম যার আওয়াজ কেবল আমার কানে পৌঁছাচ্ছিল।আমি লক্ষ্য করলাম, যুবকটি হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে আছে এবং নিজের জায়গায় বসে ছটফট করছে। কিছু সময় পর সে আমার দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত হয়ে বলল, “দয়া করে থামুন! আমি আর শুনতে পারছি না।”

তারপর সে সিট থেকে উঠে কিছু সময়ের জন্য অন্যদিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে সালাম দিয়ে আমার কাছে ক্ষমা চাইলো।তারপর নীরব হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম না তার কী হয়েছে। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল চোখে সে বলল, “তিন বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে আমি আমার কপাল মাটিতে রাখিনি, এমনকি কুর’আনের একটি আয়াত পর্যন্ত তিলাওয়াত করিনি।

গত একমাস ধরে আমি বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছি। আর এমন কোন খারাপ কাজ নেই যা আমি এ সময়ের মধ্যে করিনি। তারপর আমি আপনাকে কুর’আন তিলাওয়াত করতে দেখলাম। সাথে সাথে আমার পুরো পৃথিবী যেন অন্ধকার হয়ে গেল এবং আমার হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে গেল হতাশায়। আমার মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার গলা টিপে ধরে আছে। আর আপনার পঠিত প্রতিটি আয়াত যেন আমার শরীরে চাবুক কষছে।

আমি নিজেকে বললাম, ‘আর কতদিন এমন অবহেলা চলতে থাকবে? এই পথ তোমাকে কোথায় নিয়ে যাবে? এতসব হাস্য-তামাশার শেষ পরিণতিই-বা কী?’ তারপর আমি ওয়াশরুমে ছুটে গেলাম। কেন জানেন?

আমার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছিল এবং নিজেকে লুকানোর কোন জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলাম না এখানে।”

তারপর কিছু সময় ধরে আমি যুবকটির সাথে তওবাহ ও আল্লাহর দিকে পূণরায় ফিরে আসার সাধারণ বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করলাম।শুনে সে নীরব হয়ে গেল।

ভ্রমণ শেষে আমরা যখন প্লেন থেকে নামলাম, যুবকটি আমাকে থামালো এবং মনে হল সে তার বন্ধুদের কাছ থেকে আলাদা থাকতে চায়। খুব চিন্তিতভাবে সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি মনে করেন আল্লাহ আমার তওবাহ কবুল করবেন?”

আমি বললাম, “তুমি যদি আন্তরিকতা ও গুরুত্বের সাথে তওবাহ করো, তবে ইনশা আল্লাহ তোমার সকল পাপ ক্ষমা করে দিবেন আল্লাহ।”

সে বলল, “কিন্তু আমি যে অনেক বড় পাপ কাজ করে ফেলেছি!”

আমি বললাম, “তুমি কি শুনোনি, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) কী বলেছে,

বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সকল গুণাহ ক্ষমা করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”

[সূরা আয-যুমারঃ ৫৩]

আমি লক্ষ্য করলাম, তার চেহারায় আশার আলো দেখা দিয়েছে এবং চোখ অশ্রুতে টলমল করছে। তারপর সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার গন্তব্যে চলে গেল।

একজন মানুষের ভুল কিংবা পাপ যত বড়ই হোক না কেন, তার অন্তরে ধার্মিকতা ও সততার একটি বীজ সব সময়ই লুকানো থাকে।আমরা যদি সেই বীজটির নিকটে পৌঁছে তাকে চারাগাছে পরিণত করতে পারি, ইনশা আল্লাহ একদিন সেটি গাছে পরিণত হয়ে ফল ধারণ করবেই।

ধার্মিকতার এই বীজটি মানুষের অন্তরে সব সময় যুদ্ধ করতে থাকে, এমনকি যখন কারও সঠিকপথে ফিরে আসার ঝোঁক চেপে বসে তখনও। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) যখন তাঁর বান্দার ভালো চান তখন তার অন্তরের আশার আলোটিকে উজ্জ্বল করে তোলেন এবং তাকে সেই পথে পরিচালিত করেন যেই পথে সফর করেছেন দুনিয়া এবং আখিরাতের সফলতম বান্দাগণ। আল্লাহ বলেন,

“অতঃপর আল্লাহ যাকে পথ-প্রদর্শন করতে চান, তার বক্ষকে ইসলামের জন্যে উম্মুক্ত করে দেন এবং যাকে বিপথগামী করতে চান, তার বক্ষকে সংকীর্ণ অত্যধিক সংকীর্ণ করে দেন-যেন সে সবেগে আকাশে আরোহণ করছে। এমনি ভাবে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে না। আল্লাহ তাদের উপর আযাব বর্ষন করেন।”

[সূরা আল-আন’আমঃ ১২৫]


পাদটীকাঃ
মূল লেখকঃ আহমাদ ইবনে ‘আবদ আর-রাহমান আস-সুওইয়ান
উৎসঃ OnIslam.net

বিশ্বস্ত বন্ধুত্বের পথে ৪ পদক্ষেপ

বিশ্বস্ত বন্ধুত্বের পথে ৪ টি পদক্ষেপ: মুসাফির শহীদ যখন আমরা বিশ্বস্ত বন্ধুর কথা ভাবি, তখন আমরা কেবল সর্বকালের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু আবু বকর আস-সিদ্দীক্ব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর কথাই ভাবতে পারি। তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে রাসূল (ﷺ)  বলেন, “আমি যার কাছেই ইসলাম পেশ করেছি, সে-ই ইসলাম গ্রহণের পূর্বে নিজে নিজে বিবেচনা করেছে, একটু চিন্তিত হয়েছে কিংবা আমার নবুওয়াতের প্রমাণ চেয়েছে। কিন্তু আবু বকরকে ইসলাম পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে নিঃসংকোচে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে।” সুবহান আল্লাহ! কী অপূর্ব তাদের বন্ধুত্বের ভীত।

নবী (ﷺ) তাঁকে এতোটাই বিশ্বাস করতেন যে, তিনি তাঁকে ‘আস-সিদ্দিক্ব’ উপাধি দিয়েছিলেন, কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিলো দৃঢ় ও অটল, আর তাঁর বন্ধুত্ব ছিলো পাথরের মতো কঠিন যার কারণে তিনি অনেকবারই নবীজির (ﷺ) বাণীকে সমর্থন করতে গিয়ে বিসর্জন দিয়েছেন নিজের সম্পদ ও নিরাপত্তা।
বন্ধুত্ব
যে সকল বন্ধু আপনাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে

ভালো বন্ধুর একটি মৌলিক উপাদান হলো একমাত্র আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা। একটি চমৎকার হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, যারা পরস্পরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে কিয়ামতের দিন তারা আল্লাহর আরশের ছায়ায় থাকবে। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, সাত প্রকার লোককে আল্লাহ তা’আলা হাশরের ময়দানে নিজের আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন। যখন সে ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। তাদের মধ্যে রয়েছেন সেই  দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবাসেন এবং সেই মহব্বতের জন্যই তারা একত্রিত হন। এবং সেই মহব্বতের কথা স্মরণ রেখেই পরস্পর থেকে পৃথক হন, [বুখারী], যা আমাদের দেখায় জীবন চলার পথে ভালো সাহচর্যের মাধ্যমে কতো সুউচ্চ মর্যাদায় আমরা উন্নিত হতে পারি।

বন্ধুত্বকে অনেকটা সেই পথিকের সাথে তুলনা করা যায়, যে কিনা একটি চূড়ান্ত গন্তব্যের পথে যাত্রা করেছে; যেমনটা একজন লেখক লিখেছেন, “একাকী ভ্রমণ অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু একজন অভিজ্ঞ পথিক জানেন, ভ্রমণই হচ্ছে তার জীবন আর মানব জীবনে সঙ্গী অপরিহার্য এক অঙ্গ। ‘সঙ্গী’ মানে তারাই, যারা এক পাতে খাবার খায়।

তারাই প্রকৃত সুখী, যারা ভেবে নিতে পারে যে, তারা সর্বদা পথেই আছে এবং যাত্রাপথে যাদের সাথেই তাদের সাক্ষাত ঘটে, প্রত্যেককেই তারা নিজেদের কাঙ্ক্ষিত সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে। উত্তম পথিকেরা তাদের বিরক্তিকর সঙ্গীদের দিকে খেয়াল রাখে। তাদের সঙ্গীরা কখন মনোবল হারাচ্ছে, তারা ঠিক ঠিক তা বুঝতে পারে। তারা যেভাবে তাদের খুঁজে পায়, সেভাবেই তাদের গ্রহণ করে নেয়, তাদের কথা শুনে। বুদ্ধিমত্তার সাথে, নম্রভাবে, সর্বোপরি ভালবাসার সাথে তারা তাদের সামনে এগিয়ে যেতে এবং যাত্রাপথের আনন্দ ফিরে পেতে উৎসাহ যোগায়।”

একবার এক ‘আলিম পরস্পরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার জন্য ভালোবাসার এই সুন্দর ধারণাটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেনঃ “একটি বন্ধুত্বকে আল্লাহর জন্য বলে মোহরাঙ্কিত করা সেই সম্পর্কটি কেবল আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও বিশ্বাসের উপর গড়ে তোলার বাধ্যবাধকতাই নির্দেশ করে, এই বন্ধুত্বটি কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলারই স্বার্থে। এটি আরো নির্দেশ করে যে এক্ষেত্রে কেবল সাধারণ ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়; বরং এর দ্বারা বোঝায় সেই ভালোবাসা যা গড়ে ওঠে মৈত্রীর উপর। যা উন্মেষ ঘটায় সহযোগীতা, সম্মান ও শ্রদ্ধার। অর্থাৎ আপনি যাদের ভালোবাসেন কথা ও কাজ উভয় ক্ষেত্রেই তাদের সাথে থাকা। আল্লাহর স্বার্থে অনুগত হওয়ার প্রকৃত অর্থ হলো আল্লাহকে ভালোবাসা ও তাঁর দ্বীনের কল্যাণে কাজ করা; তাদের ভালোবাসা যারা আল্লাহ আয্‌যাওয়াজাল-এর প্রতি অনুগত ও তাদের সাহায্য করা।”

ভালো সঙ্গী খুঁজে পেতে আমরা বিশ্বাসের বীজ বপন করছি যাতে আমাদের বন্ধুত্ব বিশ্বাসের উপর গড়ে ওঠে, আর প্রত্যেকের বিশ্বাস যেনো তাকে ভালো বন্ধু পেতে উৎসাহ যোগায়।

ভালো সহচর পাওয়ার ব্যবহারিক কৌশল

উপর্যুক্ত বন্ধুদের মতো কিছু বিশ্বস্ত বন্ধু খুঁজে পেতে আপনাকে সাহায্য করার জন্যই এখানে কিছু ব্যবহারিক কৌশলের কথা উল্লেখ করা হলো যেগুলো আপনি কাজে লাগাতে পারেনঃ

১. আন্তরিক হোন এবং নিজে থেকে শুরু করুনঃ

ভালো বন্ধু খুঁজে পাওয়ার চাবিকাঠি হলো সকল ইসলামিক কার্যকলাপের পাশাপাশি নিয়্যাতের ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া, আর উপর্যুক্ত গুণাবলী ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো নিজের মধ্যে বিকাশ ঘটানো যা আমরা ভালো বন্ধুদের মাঝে দেখতে চাই।

২. খারাপ বন্ধু ত্যাগ করুনঃ

আমি জানি খারাপ বন্ধু ত্যাগ করার সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা খুব সহজ নয়, কিন্তু মনে রাখবেন আপনি যদি কোনো কিছু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার জন্য ত্যাগ করেন তবে তিনি এর পরিবর্তে অনেক উত্তম কিছু দান করবেন। তার মানে এই নয় যে একসাথে সব খারাপ বন্ধুকেই ত্যাগ করতে হবে, বরং তাদের ভালো কাজ করার উপদেশ দিন, তাদের ভেতর পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্য অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হোন এবং তাদের জন্য দু’আ করুন।

৩. ন্যায়পরায়ণ বন্ধুর খোঁজ করুনঃ

এটা সম্ভব কেবল জ্ঞানী লোকদের মজলিশে উপস্থিত থাকার মাধ্যমে, যারা তাদের সত্যবাদীতা, ন্যায়পরায়ণতা ও উত্তম সাহচর্যের জন্য বিশেষ পরিচিত। সঠিক জায়গায় যান। ঈমান বৃদ্ধির জন্য আমাদের উচিত সে সকল স্থানে যাওয়ার লক্ষ্য স্থির করা যেখানে গেলে ভালো মানুষদের পাওয়া যাবে (মসজিদ, ইসলামিক হালাকা [Study Circle], কিংবা আপনি OIEP/ICD থেকেই শুরু করতে পারেন) এবং ক্ষতিকর স্থান এড়িয়ে চলা।

লক্ষ করুন এ ব্যাপারে নবী (ﷺ) কী বলেছেনঃ

সৎ সহচর ও অসৎ সহযোগীর দৃষ্টান্ত হলোঃ একজন কস্তুরীর (সুগন্ধি) ব্যবসায়ী, অন্যজন হাপর চালানকারী (অর্থাৎ কামার)। কস্তুরীর ব্যবসায়ী হয় তোমাকে বিনামূল্যে কস্তুরী দেবে অথবা তুমি তার কাছ থেকে তা কিনে নেবে। যদি এ দু’টির একটিও না হয়, তবে তুমি অন্তত তার কাছ থেকে এর সুঘ্রাণটা পাবে। আর হাপর চালানকারী হয় তোমার কাপড় পুড়ে ফেলবে অথবা তুমি তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে।
[বুখারী ও মুসলিম]

৪. আল্লাহর কাছে দু’আ করুনঃ

সবসময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে দু’আ করুন যাতে তিনি আপনাকে উত্তম সাহচার্যের দিকে পরিচালিত করেন, আর নিজের পাশাপাশি বন্ধুদের জন্যও দু’আ করুন যাতে আল্লাহ সকলের দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে সর্বোত্তম কল্যাণ দান করেন।

এই ৪ টি কৌশলই আপনার ভালো বন্ধুর অনুসন্ধানে সাহায্য করবে যারা আপনাকে সহায়তা করবে ন্যায়পরায়নতার বীজ বপনে। আর সবশেষে দু’আ করি আমরা সবাই যেনো আখিরাতের বিশ্বস্ত বন্ধুদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি। আমীন।

পুনশ্চঃ ভালো সাহচর্য্যের গুরুত্ব সম্পর্কে উস্তাদ নুমান আলি খানের একটি ভালো রিমাইন্ডার পাওয়া যাবে এখানে


মূল লেখক-আবু প্রোডাক্টিভ
অনুবাদ সহযোগীতা-ইমরান হেলাল
উৎস www.ProductiveMuslim.com

নামায নিয়ে যত ফাযায়েল-মাসায়েল,গুরুত্ব ও প্রভাব,না পড়ার ভয়াবহতা।

নামাযের গুরুত্ব ও প্রভাবঃ মূল-মুহাম্মদ মনযুর নুমানী, অনুবাদ-মাহমুদ হাসান মাসরুর । আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উপর ঈমান আনা এবং তাওহীদ ও রেসালাতের সাক্ষ্য দান করার পর ইসলামে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নামায। এটা আল্লাহ পাকের জন্য খাস একটি ইবাদত। কোরআন শরীফের পঞ্চাশটিরও বেশি আয়াতে এবং নবীজীর শতাধিক হাদীসে দৈনিক পাঁচওয়াক্ত নামায যথাযথভাবে আদায়ের উপর জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে।

নামাযকে দ্বীনের খুটি এবং ইসলামের বুনিয়াদরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। নামাযের অনেক তাছীর ও সুপ্রভাব রয়েছে। সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব হলো, নামায অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে নামাযীকে বাঁচিয়ে রাখে। কোনে বান্দা যখন আল্লাহ তাআলাকে হাজির নাযির জেনে, আল্লাহ তার সম্মুখে আছেন, তাঁর নামায প্রত্যক্ষ করছেন এই ধ্যান করে, খুশুখুযু তথা বিনয়স্থিরতা ও প্রেমভয় নিয়ে নিয়মিত নামায আদায় করতে থাকে, তখন এই নামায রিপুর দোষ থেকে তার অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে দেয়, জীবনকে পরিশীলিত করে তোলে। অন্যায় ও অপরাধ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে আনে।

এই নামায সততা, সাধুতা, আল্লাহ প্রেম ও খোদাভীতির গুণ তাকে উপহার দেয়। এ জন্যই ইসলামে নামাযের এত গুরুত্ব, সমস্ত ফরজ ইবাদতের উপর নামাযের শ্রেষ্ঠত্ব। এবং এই কারণেই নবীজীর আদত ছিলো, কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তাওহীদ শিক্ষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই তাকে নামায আদায়ের আদেশ দিতেন, অঙ্গীকার নিতেন।

নবীজীর দৃষ্টিতে নামায ও নামাযী
হাদীস থেকে জানা যায়, নামায না পড়াকে নবীজী কুফুরী কাজ এবং কাফেরের স্বভাব বলে উল্লেখ করেছেন। এক হাদীসে এসেছে,
لَا سَهْمَ فِي الْإِسْلَامِ لِمَنْ لَا صَلَاةَ لَهُ. قال الهيثمي: وَفِيهِ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ سَعِيدِ بْنِ أَبِي سَعِيدٍ، وَقَدْ أَجْمَعُوا عَلَى ضَعْفِهِ.

যার ভিতরে নামায নেই, তার ভিতর দ্বীনের কোনো হিস্যা নেই। মুসনাদে বায্যার, হাদীস নং ৮৫৩৯

অন্য এক হাদীসে নবীজী ইরশাদ করেন,
إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ
কোনো বান্দা আর কুফর-শিরকের মাঝে পার্থক্য বোঝা যাবে তার নামায তরকের দ্বারা। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৪

হাদীসের মতলব হলো, যখন কেউ নামায ছেড়ে দিলো, তখন সে যেন কুফরের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হলো। তার নামায না পড়াটা কুফরি কাজের সমতূল্য হলো। নামায আদায় কত বড় সৌভাগ্যের বিষয় আর তরক করাটা কত বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় সামনের হাদীস থেকে তা কিছুটা অনুমান করা যাবে।

নবীজী ইরশাদ করেন,
مَنْ حَافَظَ عَلَيْهَا كَانَتْ لَهُ نُورًا، وَبُرْهَانًا، وَنَجَاةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ لَمْ يُحَافِظْ عَلَيْهَا لَمْ يَكُنْ لَهُ نُورٌ، وَلَا بُرْهَانٌ، وَلَا نَجَاةٌ.

যে ব্যক্তি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায যত্নের সাথে আদায় করবে, কেয়ামতের সময় এ নামায তার জন্য আলো হবে, তার ঈমান ও ইসলামের দলিল হবে এবং তার নাজাতের ওসিলা হবে। আর যে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়মিত নামায আদায় করবে না, কেয়ামতের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে নামায তার জন্য আলো হবে না, দলিল হবে না এবং সে আযাব ও শাস্তি থেকে রেহাইও পাবে না। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৬৫৭৬ দ্বীনি ভাই ও বোন! আমাদের সবারই ভাবা উচিৎ, যদি যত্নের সঙ্গে সময় মতো নামায পড়ে আমরা অভ্যস্ত না হই, তাহলে আমাদের হাশর কী হবে? আমাদের পরিণাম কী দাঁড়াবে?

বে-নামাযীর লাঞ্ছনাকর অবস্থা কেয়ামতের দিন বেনামাযী সর্ব প্রথম যে অপদস্থতা ও লাঞ্ছনার শিকার হবে, কোরআন শরীফের একটি আয়াতে তার বিবরণ এসেছে, যার মর্ম নিম্নরূপ-
يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ فَلَا يَسْتَطِيعُونَ .خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ وَقَدْ كَانُوا يُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ وَهُمْ سَالِمُونَ

কেয়ামতের সেই কঠিন দিনে যখন আল্লাহ তাআলার বিশেষ নূর প্রকাশ পাবে এবং সকল মানুষকে সিজদায় পড়ে যেতে বলা হবে, তখন (যে খোশনসীব দুনিয়াতে নামায পড়তো, সে তো সিজদায় পড়ে যাবে। কিন্তু) যারা নামায পড়তো না, তারা সিজদার জন্য ঝুঁকতেই পারবে না। (কারণ তাদের কোমরকে কাঠের মতো শক্ত করে দেওয়া হবে।) ভয় ও লজ্জার কারণে তাদের চক্ষু অবনমিত থাকবে। লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার আযাব তাদেরকে ঘিরে ফেলবে।

এ শাস্তি এই জন্য যে, দুনিয়াতে তাদেরকে সিজদার প্রতি আহ্বান করা হতো, যখন তারা সুস্থ সবল ছিলো। তা সত্ত্বেও তারা সিজদায় ঝুঁকে পড়তো না। সূরা ৬৮, আয়াত ৪২-৪৩ বে-নামাযী ব্যক্তি এক হিসাবে খোদাদ্রোহী। তাকে যত লাঞ্ছিত করা হোক আর যত শাস্তিই দেয়া হোক, সে এর উযুক্তই বটে। উম্মতের কতক মুজতাহিদ ঈমাম তো বেনামাযীকে ইসলাম থেকে খারিজ এবং কতলের উপযুক্ত বলেও মত প্রকাশ করেছেন! আমার দ্বীনি ভাই! নামাযই আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে বান্দার সম্পর্কের ভিত রচনা করে, মানুষকে আল্লাহ তাআলার রহমতের হকদার বানায়। সুতরাং নামায ছাড়া মুসলমান হওয়ার দাবী দলিলহীন ও ভিত্তিহীন।

নামায পড়ার ফায়দা আল্লাহ তাআলার যে বান্দা দৈনিক পাঁচবার আল্লাহ তাআলার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ায়, তাঁর প্রশংসা ও স্তুতি গায়, তাঁর সামনে ঝোঁকে ও সিজদাবনত হয় এবং দুআয় নিমগ্ন হয়, সে বান্দা আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমত ও মুহাব্বতের অধিকারী হয়ে যায়। তাঁর গোনাহখাতা ঝরে যেতে থাকে, পাপের পঙ্কিলতা থেকে জীবন শুদ্ধ হতে থাকে, অন্তর আল্লাহ তাআলার নূরে নূরান্বিত হয়ে ওঠে।

হাদীস শরীফে নবীজী বড় সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন,
أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَنَّ نَهْرًا بِبَابِ أَحَدِكُمْ يَغْتَسِلُ مِنْهُ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسَ مَرَّاتٍ، هَلْ يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْءٌ؟ قَالُوا: لَا يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْءٌ، قَالَ: فَذَلِكَ مَثَلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ، يَمْحُو اللهُ بِهِنَّ الْخَطَايَا

বলো তো, তোমাদের কারো ঘরের পাশেই যদি নহরনালা বহমান থাকে, আর সে তাতে দিনে পাঁচবার গোসল করে, তাহলে কি তার শরীরে কোনো ময়লা থাকতে পারে? সাহাবারা বললেন, ইয়া রাসুল আল্লাহ! কোনো ময়লা থাকতে পারে না। নবীজী বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযেরও উদাহরণ তেমন। এর বরকতে বান্দার গোনাহখাতা মাফ হয়ে যায়। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৬৭

জামাতে নামায পড়ার গুরুত্ব ও ফজীলত

হাদীস শরীফ থেকে জানা যায়, নামাযের প্রকৃত ফজীলত ও বরকত জামাতে নামায পড়ার দ্বারা হাসিল হয়। নবীজী জামাতে নামায পড়ার উপর কঠিনভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। যারা অসতর্কতা ও অলসতার কারণে জামাতে শরিক হয় না, নবীজী একবার তাদের সম্পর্কে বলেন,
وَلَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ آمُرَ بِالصَّلَاةِ، فَتُقَامَ، ثُمَّ آمُرَ رَجُلًا فَيُصَلِّيَ بِالنَّاسِ، ثُمَّ أَنْطَلِقَ مَعِي بِرِجَالٍ مَعَهُمْ حُزَمٌ مِنْ حَطَبٍ إِلَى قَوْمٍ لَا يَشْهَدُونَ الصَّلَاةَ، فَأُحَرِّقَ عَلَيْهِمْ بُيُوتَهُمْ بِالنَّارِ

আমার ইচ্ছা হয় এদের ঘরদোরে আগুন লাগিয়ে দিই। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫২

বোঝার জন্য এই একটি হাদীসই যথেষ্ট যে, জামাত তরক করাটা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নিকট কতটা অপছন্দীয় ছিলো। একটি হাদীসে এসেছে,
صَلَاةُ الرَّجُلِ فِي الْجَمَاعَةِ تَزِيدُ عَلَى صَلَاتِهِ وَحْدَهُ سَبْعًا وَعِشْرِينَ

একা নামায পড়ার চেয়ে জামাতে নামায পড়লে ২৭ গুণ বেশী সওয়াব হয়। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫০

এছাড়াও জামাতে নামায পড়ার অনেক ফায়দা রয়েছে। যেমন, এর মাধ্যমে মানুষের মাঝে সময়ানুবর্তিতা সৃষ্টি হয়। দৈনিক পাঁচবার মহল্লার দ্বীনদার ভাইদের সঙ্গে একত্র হওয়ার দ্বারা বড় বড় কাজের সুযোগ লাভ হয়। জামাতের পাবন্দীর দ্বারা খোদ নামাযের উপর পাবন্দী নসীব হয়। অভিজ্ঞতায় বলে, যারা জামাতের পাবন্দী করে না, প্রায়ই তাদের নামায কাজা হয়ে যায়।

এমনিভাবে বড় ফায়দা হলো, যারা জামাতে শরিক হয়, তাদের প্রত্যেকের নামায পুরো মসজিদের জামাতের একটি অংশ হয়ে যায়। মসজিদের সেই জামাতে আল্লাহ তাআলার কতক নেককার বান্দাও থাকেন, যাদের নামায খুশুখুজু পূর্ণ হয়। তাদের নামায যখন আল্লাহ তাআলা কবুল করেন, তখন আল্লাহ পাকের দয়া ও করুণার সামনে এ আশাই হয় যে, এই নামাযীদের ওসিলায় আমার নামাযও আল্লাহ তাআলা কবুল করবেন, যদিও আমার নামায সেই মানের নামায নয়। আমার নামায কবুল হওয়ার মত নয়।

সুতরাং, একান্ত অপারগতা ব্যতীত জামাত তরক করলে কী পরিমাণ ছওয়াব ও বরকত থেকে আমরা বঞ্চিত হবো তা ভেবে দেখা উচিৎ। উল্লেখ্য যে, জামাআতে নামায পড়ার এই ফযীলত শুধু পুরুষের জন্য। হাদীস শরীফে স্পষ্ট এসেছে, মহিলার জন্য মসজিদে নামায পড়ার চেয়ে ঘরে নামায পড়া অধিক উত্তম ও ফযীলতপূর্ণ।

খুশুখুজুর গুরুত্ব

খুশুখুজুর সঙ্গে নামায পড়ার মতলব হলো, যখন নামাযে দাঁড়াবে তখন আল্লাহ তাআলাকে বিশেষভাবে হাজির নাযির জ্ঞান করবে। আল্লাহ তাআলার মুহাব্বতে দেহমন আপ্লুত করে তুলবে এবং অন্তরাত্মায় তাঁর বড়ত্ব ও মহত্বের সম্মুখে নিজেকে মিটিয়ে দেয়ার অনুভূতি জাগ্রত রাখবে। যেন আমি এক মহা অপরাধে অপরাধী, ধৃত হয়ে কোনো মহা প্রতাপের অধিকারী বাদশার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছি! নামাযে দাঁড়িয়ে কল্পনা করবে, আমি মহামহীয়ান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সম্মুখে তাঁরই সম্মানে দাঁড়িয়ে আছি।

রুকু করার সময় ভাববে, আমি অবনতশির হচ্ছি আল্লাহ পাকের জালাল ও মহিমার সামনে। নিজেকে সিজদায় নিক্ষেপ করার সময় অনুভবের চেষ্টা করবে, আল্লাহ জাল্লা জালালুহুর অশেষ অসীম কুদরত ও ইজ্জতের সামনে আমি আমার অস্তিত্বের সমস্ত অপারগতা ও অপদস্ততার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছি। নামাযে যা কিছু পড়া হয়, তা বুঝে বুঝে পড়তে পারলে খুবই ভালো। এতে নামাযের আসল স্বাদ অনুভব করা সহজ হয়, খুশুখুজু পয়দা হয়।

নামাযের রূহ বা প্রাণ হলো হৃদয়ের আল্লাহমুখিতা ও খুশুখুজু। এমন নামায যে বান্দার নসীব হবে, সে সুনিশ্চিতভাবে কামিয়াব ও সফল। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ. الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ
ঐ সকল মুমিন সফল ও কামিয়াব, যারা খুশুখুজুর সঙ্গে নিয়মিত নামায আদায় করে। সূরা ২৩ আয়াত ১-২

এক হাদীসে নবীজি ইরশাদ করেন-
خَمْسُ صَلَوَاتٍ افْتَرَضَهُنَّ اللَّهُ تَعَالَى مَنْ أَحْسَنَ وُضُوءَهُنَّ وَصَلَّاهُنَّ لِوَقْتِهِنَّ وَأَتَمَّ رُكُوعَهُنَّ وَخُشُوعَهُنَّ كَانَ لَهُ عَلَى اللَّهِ عَهْدٌ أَنْ يَغْفِرَ لَهُ، وَمَنْ لَمْ يَفْعَلْ فَلَيْسَ لَهُ عَلَى اللَّهِ عَهْدٌ، إِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُ وَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ

পাঁচটি নামায আল্লাহ ফরজ করেছেন। যে ব্যক্তি যথানিয়মে ওজু করবে এবং যথাসময়ে নামায আদায় করবে, উত্তমরূপে রুকু সিজদা করবে এবং খুশুখুজুর সঙ্গে নামযগুলি পড়ে যাবে, তার জন্য আল্লাহ তাআলার ওয়াদা রয়েছে, তিনি অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু যে ব্যক্তি যথাযথভাবে নামায আদায় করবে না তার জন্য আল্লাহ পাকের কোনো ওয়াদা নেই। চাইলে তাকে তিনি শাস্তি দিতে পারেন, ক্ষমাও করতে পারেন। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪২৫

আমরা যদি আল্লাহ পাকের ক্ষমা পেতে চাই, আখেরাতের শাস্তি থেকে বাঁচতে চাই, তাহলে উত্তম থেকে উত্তমরূপে নামায আদায় করা আমাদের একান্ত কর্তব্য।

নামায পড়ার নিয়ম

যখন নামাযের সময় হবে, তখন ভালোভাবে অজু করে নিবে। মনে মনে ভাববে, আল্লাহ তাআলার দরবারে হাজির হওয়ার জন্য এবং তাঁর ইবাদত ও বন্দেগীর জন্য আমি পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা অর্জন করছি। এর ভিতরও অনেক রহমত ও বরকত নিহিত আছে। এক হাদীসে এসেছে,

إِذَا تَوَضَّأَ الْعَبْدُ الْمُسْلِمُ أَوِ الْمُؤْمِنُ فَغَسَلَ وَجْهَهُ خَرَجَ مِنْ وَجْهِهِ كُلُّ خَطِيئَةٍ نَظَرَ إِلَيْهَا بِعَيْنَيْهِ مَعَ الْمَاءِ أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ، فَإِذَا غَسَلَ يَدَيْهِ خَرَجَ مِنْ يَدَيْهِ كُلُّ خَطِيئَةٍ كَانَ بَطَشَتْهَا يَدَاهُ مَعَ الْمَاءِ أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ، فَإِذَا غَسَلَ رِجْلَيْهِ خَرَجَتْ كُلُّ خَطِيئَةٍ مَشَتْهَا رِجْلَاهُ مَعَ الْمَاء أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ حَتَّى يَخْرُجَ نَقِيًّا مِنَ الذُّنُوبِ

অজুর সময় যে অঙ্গগুলো ধৌত করা হয়, সে অঙ্গগুলো থেকে হয়ে যাওয়া গোনাহ ওজুর পানি দ্বারা বের হয়ে যায়। ওজুর পানি দ্বারা গোনাহের ছাপ-চি‎হ্নও ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৪

অযুর পর যখন নামাজে দাঁড়াবে তখন ধ্যান করবে, আমি গোনাহগার। আমি এখন এমন এক সর্বজ্ঞাতা মালিকের সামনে দাঁড়াচ্ছি, যিনি আমার ভিতর-বাহির, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল বিষয় সম্পর্কে সুপরিজ্ঞাত। কেয়ামতের দিন আবার আমাকে তাঁর সামনে দাঁড়াতে হবে। এরপর যে ওয়াক্তের নামাজের জন্য দাঁড়িয়েছে, সে ওয়াক্তের নামাজের নিয়ত করবে। নিয়মমত কান পর্যন্ত হাত তুলে হৃদয়ের গভীর থেকে বলবে, ‘আল্লাহু আকবার’।

অত:পর হাত বাঁধবে এবং আল্লাহ তাআলার দরবারে হাজির হওয়ার পরিপূর্ণ ধ্যান রেখে পাঠ করবে,

سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ، وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالَى جَدُّكَ، وَلَا إِلَهَ غَيْرَكَ

হে আল্লাহ! তুমি পূতপবিত্র, চির প্রশংসার্হ, তোমার নাম পরম বরকতময়। তোমার মর্যাদা বড় মহিমাময়। তুমি ব্যতীত কোনো মা‘বুদ নেই। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৭৭৬

اعوذ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
বিতাড়িত শয়তান থেকে আমি আল্লাহ তাআলার আশ্রয় গ্রহণ করছি।

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
পরম করুণাময় চির মেহেরবান আল্লাহর নামে শুরু করছি।

الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ .الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ. َالِكِ يَوْمِ الدِّينِ. إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ. اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ. صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّين.َ امين
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার। যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক, সকলের প্রতি দয়াবান, পরম দয়ালু। যিনি কর্মফল দিবসের মালিক। (হে আল্লাহ!) আমরা তোমারই ইবাদত করি, তোমার কাছেই সাহায্য চাই। তুমি আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করো। সেই সকল লোকের পথে, যাদের প্রতি তুমি অনুগ্রহ করেছো; ঐ সকল লোকের পথে নয়, যাদের উপর তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং তাদের পথেও নয়, যারা পথহারা হয়েছে। (হে আল্লাহ! তুমি আমার এই দুআ কবুল করে নাও) এরপর কোনো সূরা বা তার অংশ বিশেষ তেলাওয়াত করবে।

এখানে আমরা ছোট ছোট চারটি সূরা উল্লেখ করছি:

১। সূরা আছর

وَالْعَصْرِ. إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ. إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ.

কালের শপথ! বস্তুত সকল মানুষ মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে আছে। তবে তাদের কথা ভিন্ন, যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করছে এবং একে অন্যকে সত্যের ও ধৈর্য্যরে উপদেশ দিচ্ছে।

২। সূরা ইখলাস

قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ. اللَّهُ الصَّمَدُ. لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ. وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ.

বলুন, আল্লাহ তাআলা সর্বদিক থেকে এক অদ্বিতীয়। আল্লাহ পাক এমন যে, সকলে তার মুখাপেক্ষী; তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তাঁর কোনো সন্তান নেই, তিনিও কারো সন্তান নন, তাঁর কোনো সমকক্ষ নেই। সুরা ১১২

৩। সূরা ফালাক

قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ. مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ. وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ. وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ. وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ.

বলো, আমি ভোরের মালিকের আশ্রয় গ্রহণ করছি; তিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট থেকে, অন্ধকার রাতের অনিষ্ট থেকে, যখন তা ছেয়ে যায়; সেই সব নারীর অনিষ্ট থেকে, যারা সুতার গিরায় ফুঁ মারে; হিংসুকের হিংসা হতে, যখন সে হিংসা করতে থাকে। সুরা ১১৩

৪। সূরা নাস

قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ. مَلِكِ النَّاسِ. إِلَهِ النَّاسِ. مِنْ شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ. الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ. مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ.

বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি সমস্ত মানুষের অধিপতির, সমস্ত মানুষের মা’বুদের, পশ্চাতে আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট থেকে, যে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়; সে জিনদের মধ্য থেকে হোক বা মানুষের মধ্য থেকে।

মোটকথা সূরা ফাতেহা পড়ার পর একটি সূরা বা তার কিয়দাংশ পাঠ করবে। প্রত্যেক নামাযে এতটুকু তেলাওয়াত করা জরুরি। কেরাতশেষে আল্লাহ পাকের বড়ত্ব ও মহত্বের ধ্যান করে দিল থেকে আল্লাহু আকবার উচ্চারণ করবে এবং রুকুতে যাবে। আর বারবার বলতে থাকবে, অন্তত তিনবার বলবে, সুবহানা রাব্বিয়াল আযীম পূত পবিত্র আমার মহান মালিক। সুবহানা রাব্বিয়াল আযীম পূতপবিত্র আমার মহীয়ান প্রতিপালক। সুবহানা রাব্বিয়াল আযীম পূতপবিত্র আমার আল্লাহ তাআলা।

এরপর মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াবে এবং বলবে,

سمع الله لمن حمده
আল্লাহ সেই বান্দার কথা শুনছেন ও কবুল করেছেন যে তাঁর প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণনা করছে।

তারপর বলবে, ربنا لك الحمد প্রশংসা তোমার হে পরওরদেগার।

অতঃপর অন্তর থেকে আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় লুটিয়ে পড়বে। একে একে দুটি সেজদা করবে। আল্লাহু পাকের সামনে মন ও প্রাণের গভীরতম প্রদেশ থেকে বলতে থাকবে,

سبحان ربي الاعلى
আমি আমার মহান প্রভূর পবিত্রতা ঘোষণা করছি।

سبحان ربي الاعلى
আমি আমার মহান প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা করছি।

سبحان ربي الاعلى
আমি আমার মহান মালিকের সুচিশুভ্রতার ঘোষণা দিচ্ছি।

সিজদা অবস্থায় ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ‘লা’ পড়বে আর নিজের ক্ষুদ্রতা ও অক্ষমতার কথা চিন্তা করতে থাকবে এবং আল্লাহ পাকের অসীম অশেষ বড়ত্ব ও বিশালত্বের ধ্যানে মগ্ন থাকবে। এই চিন্তা ও ধ্যান যত গভীর হবে, নামাযও ততো জানদার ও প্রাণবন্ত হবে।

এ-গেলো এক রাকাতের বিবরণ। সামনে যত রাকাত পড়বে, এ-নিয়মেই পড়বে। তবে ‘সুবহানাকা আল্লাহুম্মা’ শুধু প্রথম রাকাতে পড়বে। আর নামাযের মাঝখানে বা শেষে যখন বসবে, তখন ‘আত্তাহিয়্যাতু’ পড়বে। এই দুআর ভিতর নামাযের সারমর্ম গচ্ছিত আছে,

التَّحِيَّاتُ لِلَّهِ وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ، السَّلاَمُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللَّهِ وَبَرَكَاتُهُ، السَّلاَمُ عَلَيْنَا وَعَلَى عِبَادِ اللَّهِ الصَّالِحِينَ، فَإِنَّكُمْ إِذَا قُلْتُمُوهَا أَصَابَتْ كُلَّ عَبْدٍ لِلَّهِ صَالِحٍ فِي السَّمَاءِ وَالأَرْضِ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ

সমস্ত আদব ও সম্মান, সাদাকা ও ইবাদত আল্লাহ তোমার জন্য। তোমার প্রতি হে রাসূল! আল্লাহর রহমত বরকত ও সালাম বর্ষিত হোক। শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের সকলের উপর এবং আল্লাহ পাকের সকল নেক বান্দার উপর। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ তাআলা ব্যতীত ইবাদতের উপযুক্ত আর কোনো মা’বুদ নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। সহীহ বোখারী, হাদীস নং ৮৩১

তিন রাকাত ও চার রাকাত বিশিষ্ট নামাযে প্রথম দুই রাকাতের পর বসতে হয়। সেখানে শুধু ‘আত্তাহিয়্যাতু’ পড়বে। আর নামাযের শেষ বৈঠকে ‘আত্তাহিয়্যাতুর’ পর দরুদ শরীফ পড়বে,

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ

হে আল্লাহ! নবীজি ও তাঁর আপনজনদের উপর বিশেষ রহমত নাযিল করো, যেমন রহমত নাযিল করেছো হযরত ইবরাহীম ও তার নিকটজনদের উপর। আল্লাহ! নিশ্চই তুমি মহিমান্বিত ও প্রশংসিত। বরকত নাযিল করো হে আল্লাহ! নবীজি ও তাঁর আপনজনদের উপর, যেমন তুমি বরকত অবতীর্ণ করেছো হযরত ইবরাহীম ও তার পরিবার-পরিজনের উপর। আল্লাহ! তুমি বড় মহিমান্বিত ও প্রশংসিত। সহীহ বোখারী, হাদীস নং ৩৩৭০

দরুদ শরীফ মূলত নবীজি, তাঁর পরিবারপরিজন ও আপনজনদের জন্য রহমত ও বরকতের দুআ বিশেষ। যেহেতু নবীজির মাধ্যমেই দ্বীনের নেয়ামত ও নামাযের এ দৌলত আমরা লাভ করেছি, তাই আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য দরুদ শরীফ দান করেছেন। সুতরাং নবীজির অনুগ্রহ স্মরণ করে আত্তাহিয়্যাতু পড়ার পর হৃদয় থেকে দরুদ পাঠ করবে। নবীজির জন্য রহমত ও বরকতের দুআ করবে। তারপর নিজের জন্য এই দুআটি পাঠ করে সালাম ফিরাবে,

اللَّهُمَّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي ظُلْمًا كَثِيرًا، وَلاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ، فَاغْفِرْ لِي مَغْفِرَةً مِنْ عِنْدِكَ، وَارْحَمْنِي إِنَّكَ أَنْتَ الغَفُورُ الرَّحِيمُ

আয় আল্লাহ! আমি তোমার ইবাদত ও আনুগত্যে অবহেলা করে নিজের উপর বহু অন্যায় করে ফেলেছি। আর তুমি ছাড়া তো মার্জনাকারী কেউ নেই। সুতরাং একান্ত আপন অনুগ্রহে আমাকে ক্ষমা করো। আমার প্রতি দয়া করো মালিক, তুমি বড় ক্ষমাশীল, তুমি বড় দয়ালু। সহীহ বোখারী, হাদীস নং ৮৩৪

এই দুআর মধ্যে নামাযে হয়ে যাওয়া ত্রুটিবিচ্যুতির স্বীকারোক্তি রয়েছে, আল্লাহ তাআলার রহমত ও ক্ষমা লাভের সকাতর প্রার্থনা রয়েছে। মূলত একজন বিনয়ী বান্দার জন্য এটাই শোভনীয় যে, নামাযের মতো ইবাদত করার পরও নিজেকে গোনাহগার ভাববে। অহমিকাবোধের তো প্রশ্নই আসে না, বরং নিজের নামাযকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করে লজ্জিত হবে।

নামায কবুল হওয়ার ব্যাপারে কেবলি আল্লাহ তাআলার রহমতের উপর ভরসা করবে। কারণ, আল্লাহ তাআলার ইবাদতের হক আদায় করা বান্দার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। হে আমার ভাই! নামায হলো পরশপাথরের মতো একটি ইবাদত।

উল্লিখিত পদ্ধতিতে ধ্যান ও খুশুখুজুর সঙ্গে যে ব্যক্তি নামায আদায় করবে, নামাযই তাকে আমলে-আখলাকে ফেরেশতাতূল্য বানিয়ে তুলবে। উম্মতের নামাযের বিষয়ে নবীজির এত ফিকির ছিলো যে, দুনিয়ার জীবনের শেষ মুহূর্তেও উম্মতকে নামায কায়েমের অসিয়ত করে গেছেন

সুতরাং যে সকল ভায়েরা নামায পড়েন না, নামায কায়েমের চেষ্টা করেন না, তারা আল্লাহর ওয়া¯েস্ত ভেবে দেখুন, কেয়ামতের দিন কীভাবে নবীজির সামনে দাঁড়াবেন, কিভাবে নবীজীকে মুখ দেখাবেন! আপনি তো নবীজীর শেষ অসিয়তকেও আমলে নিচ্ছেন না। আসুন আমরা সবাই ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ভাষায় দুআ করি,

رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلَاةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ. رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ
হে আমার আল্লাহ! আমাকে এবং আমার বংশধরদেরকে নামাযী বানিয়ে দাও। হে আমাদের মালিক! আমাদের এ দুআ তুমি কবুল করে নাও। ওহে আমাদের প্রভু! আমাকে, আমার মাতাপিতাকে এবং সকল ঈমানদারকে কেয়ামতের দিন তুমি ক্ষমা করে দিও। সূরা ১৪, আয়াত ৪০-৪১

ভুল রসম : ফাতেহায়ে ইয়াযদাহম-এর কোনো শরয়ী ভিত্তি আছে কি?

রসম ও রেওয়াজে অনুরক্ত লোকেরা দীর্ঘদিন থেকে ফাতেহায়ে ইয়াযদাহম নামেও একটি রসম পালন করে থাকে। ‘ইয়াযদাহম’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘একাদশ’। অর্থাৎ রবীউস সানীর এগারো তারিখে কৃত ফাতেহা বা ইসালে ছওয়াব মাহফিল। বলা হয়ে থাকে, এ তারিখে ওলীয়ে কামেল শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রহ.-এর ইন্তেকাল হয়েছিল।

এজন্য তাঁর ওফাতদিবস পালন করার উদ্দেশ্যে এই রসমের সূচনা করা হয়। ওই আল্লাহর বান্দারা এ বিষয়টি চিন্তা করেনি যে, ইসলামে না জন্মদিবস পালন করা হয়, না মৃত্যুদিবস। না শায়খ জীলানী রহ. তাঁর কোনো শায়খের জন্মদিবস বা মৃত্যুদিবস পালন করেছেন, না তার কোনো খলীফা বা শাগরিদ তা পালন করেছেন। বলাবাহুল্য যে, এই ভিত্তিহীন রসম পালনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চিন্তা করা আর তাতে ইসালে ছওয়াবের নিয়ত করা বাতুলতা মাত্র।

এদিকে মজার বিষয় এই যে, গিয়ারভীর এই রসম এ তারিখে এ জন্যই পালন করা হয় যে, এটা শায়খ জীলানীর ওফাতদিবস। আল্লাহর কী শান, এই ভিত্তিহীন রেওয়াজের উদযাপন দিবসের জন্যও একটি ভিত্তিহীন তারিখ নির্ধারিত হয়েছে।

যারা এটা পালন করে থাকে তাদের কর্তব্য ছিল ইলমে তারীখ এবং আসমাউর রিজালের দু’চারটি কিতাব উল্টেপাল্টে দেখা যে, সত্যি সত্যিই তাঁর ওফাত এগারো তারিখে হয়েছে কি না?

আমরা তারীখ ও রিজালের অনেক গ্রন্থে শায়খ জীলানীর জীবনালোচনা পড়েছি। কোথাও এগারো রবীউস সানীর কথা নেই। আট, নয় বা দশ রবীউস সানী ৫৬১ হিজরীর কথা উল্লেখিত হয়েছে।

-দেখুন : সিয়ারু আলামিন নুবালা,  যাহাবী ১৫/১৮৯; আলমুনাতাযাম ইবনুল জাওযী : ১৮/১৭৩; যায়লু তবাকাতিল হানাবিলা, ইবনে রজব ১/২৫১; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৮/৩৯৫; শাজারাতুয যাহাব, ইবনুল ইমাদ ৪/২০২; তারীখুল ইসলাম, যাহাবী ৩৯/৬০

গত কিছুদিন পূর্বে একটি দৈনিক পত্রিকায় দেখতে পেলাম, ফাতেহা ইয়াজদহমের প্রথাগত এক মাহফিলের জনৈক বক্তার কিছু কথা ছাপা হয়েছে। পীরে তরীকত ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মহাসচিব বলে বক্তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন, শায়েখ জিলানী (রহ.) শরীয়ত ও তাসাউওফ বিষয়ের শিক্ষা পীর আবু সাঈদ মাখজুমী থেকে লাভ করেছেন।

অথচ শায়খের উস্তাদের নাম আবু সাদ মুখাররিমী, আবু সাঈদ মাখজুমী নয়। যাক এটি তো শুধু নামের ভুল।

কিন্তু অবাক হলাম যখন তার বরাতেই একথাও উদ্ধৃত দেখা গেল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে তিনি মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন।’

যদি কোন সাধারণ লোকের মুখেও এ কথা শোনা যেত তাহলেও অবাক হওয়ার মত ছিল। কারণ তাওহীদে বিশ্বাসী কোন মুসলমানের অজানা নয় যে, জীবন ও মরণ একমাত্র আল্লাহর হাতেই। এটি কোন মাখলুকের সাধ্যে নেই। থাকতেও পারে না। আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করে মানুষ আল্লাহর ওলী হতে পারে, কিন্তু যে বিষয়গুলোর ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই রাখেন সেগুলোর কেউ অধিকারী হতে পারে না।

যদি ‘ফাতেহায়ে ইয়াজদহম’এর মাহফিলে এমন আলোচনা হয়ে থাকে তাহলে তো এটি শুধু রসম-রেওয়াজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং শিরক ও বিদয়াতের প্রচারকও বটে।

বিয়েতে প্রচলিত ভুল ! এটা কেবল সামাজিক প্রথা নয় , বরং ইবাদত ।

বিয়েতে প্রচলিত ভুল – মুফতী মনসূরুল হক দা.বা.
বিবাহ-শাদী মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যা মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে বিশেষ নে‘আমত হিসাবে দান করেছেন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিবাহ-শাদী দুনিয়াবী কাজ বা মুবাহ মনে হলেও যথা নিয়মে সুন্নাত তরীকায় যদি তা সম্পাদন করা হয় তাহলে সেটা বরকতপূর্ণ ইবাদত ও অনেকে সওয়াবের কাজ হয়। এর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দাম্পত্য জীবন সুখময় হয়। কিন্তু বর্তমান সমাজে বিবাহ-শাদী সুন্নত তরীকায় তো হয়ই না। উপরন্তু এটা বিভিন্ন ধরনের কুপ্রথা এবং বড় বড় অনেক গুনাহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে পারিবারিক জীবনে অশান্তির ঝড় বয়ে চলছে। এজন্য নিম্নে বিবাহ-শাদী সম্পর্কিত কিছু ভুল এবং কুপ্রথা তুলে ধারা হল। যাতে এগুলো থেকে বাঁচা হয়।

বিবাহের পূর্বের ভুলসমূহ

১. বিবাহ শাদী যেহেতু ইবাদত, সুতরাং এখানে দীনদারীকে প্রাধান্য দিতে হবে। দুনিয়াদারগণ সৌন্দর্য, মাল, দৌলত ও খান্দানকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এটা রাসূলের সুন্নাতের বিপরীত হওয়ায় শান্তি বয়ে আনে না।

২. কোন কোন জায়গায় অভিভাবক এবং সাক্ষী ছাড়া শুধু বর কনের পরস্পরের সন্তুষ্টিতেই বিবাহের প্রচলন আছে। অথচ এভাবে বিবাহ বিশুদ্ধ হয় না। বরং এটি যিনা-ব্যভিচার বলে গণ্য হবে। সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও যদি মেয়ে পক্ষের অভিভাবকের সম্মতি না থাকে, আর ছেলে সে মেয়ের “কুফু” তথা দীনদারী মালদারী ও পেশাগত দিক থেকে সামঞ্জস্যশীল না হয় তাহলে সে বিবাহও শুদ্ধ হয় না।

৩. কেউ কেউ ধারণা করে যে মাসিক চলাকালীন সময় বিবাহ শুদ্ধ হয় না। অথচ এ অবস্থায়ও বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যায়। অবশ্য এ অবস্থায় সহবাস জায়িয নেই।

৪. কেউ কেউ ধারণা করে যে মুরীদনীর সাথে পীর সাহেবের বিবাহ জায়িয নেই। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ সকলেই তাঁর মুরীদনী ছিলেন।

৫. অনেকে অনেক বয়স হওয়ার পরও বিবাহ করে না কিংবা প্রথম স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পর বা সে মৃত্যু বরণ করার পর আর ২য় বিবাহ করে না। অথচ শারীরিক বিবেচনায় তার বিবাহ করা জরুরী ছিল। এ অবস্থায় থাকা মানে যিনা-ব্যভিচারে জড়িত হওয়ার রাস্তা খুলে দেয়া।

৬. অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় (উদাহরণ স্বরূপ) ৬০ বছরের বয়স্ক লোক অল্প বয়সী যুবতী মেয়েকে বিবাহ করে বসে। ফলে ঐ মেয়ে নিশ্চিত জুলুমের শিকার হয়।

৭. অনেকে স্ত্রীর খেদমতে অক্ষম হওয়া সত্ত্বেও দুর্বলতা লুকিয়ে লোক দেখানোর জন্য বিয়ে করে স্ত্রীর জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। এটা মারাত্মক গুনাহের কাজ।

৮. কোন কোন আধুনিক শিক্ষিত লোক আধুনিক শিক্ষা তথা ডাক্তারি প্রফেসারি ইত্যাদি ডিগ্রি দেখে মেয়ে বিয়ে করে। তাদের ভাবা উচিৎ বিয়ের দ্বারা উদ্দেশ্য কী? যদি তার স্ত্রীর দ্বারা টাকা কামানো উদ্দেশ্য হয় তাহলে এটা তো বড় লজ্জাজনক কথা যে, পুরুষ হয়ে মহিলাদের কামাইয়ের আশায় বসে থাকবে। মনে রাখতে হবে এধরণের পরিবারে শান্তি আসে না।

৯. কেউ কেউ পালক পুত্রের তালাক দেয়া স্ত্রী বিবাহ করাকে না জায়িয মনে করে। এটা জাহিলী যুগের বদ-রসম।

১০. কেউ কেউ বিধবা মহিলাদের বিবাহ করাকে অপছন্দ করে। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকাংশ স্ত্রী বিধবা ছিলেন। (বুখারী হাঃ নং ৫০৭৭)

বিয়েতে প্রচলিত ভুল

বর পক্ষের ভুলসমূহ

১. বিবাহ শাদী যেহেতু ইবাদত, সুতরাং বিবাহকে কেন্দ্র করে কোন প্রকার গুনাহ না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে খায়ের বরকত লাভ হবে। যদি বিবাহকে গুনাহ মুক্ত করা না যায় তাহলে সেখানে অশান্তি হওয়া নিশ্চিত।
২. প্রথাগতভাবে অনেক লোকের বর যাত্রী হিসেবে যাওয়া।
৩. দাওয়াতকৃত সংখ্যার অধিক লোক নিয়ে যাওয়া।
৪. লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কন্যার জন্য যৌতুক পাঠানো এবং এটাকে জরুরী মনে করা।
৫. গায়রে মাহরাম পুরুষ দ্বারা মেয়ের ইজন বা অনুমতি আনা।
৬. বেগানা পুরুষদের কন্যার মুখ দেখা এবং দেখানো।
৭. নাচ-গান, বাজনা ইত্যাদি করা।
৮. সালামী গ্রহণ করা।
৯. মোহরানা সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পূর্বেই না করা, বরং করাকে দোষ মনে করা। অতঃপর বিবাহের সময় তর্ক-বিতর্ক করা।
১০. লোক দেখানোর জন্য বা গর্বের সাথে ওলীমা করা।
১১. মোহরানার বিষয়ে গুরুত্ব না দেয়া এবং মোহরানা আদায়ে গাফলতী করা।
১২. ইচ্ছাকৃত এমন কর্মকাণ্ড করা যে কারণে কোন পক্ষের অদূরদর্শিতা প্রমাণিত হয় অথবা তাদের অস্থিরতার কারণ হয়। আর নিজেদের সুনাম প্রকাশ পায়।
১৩. বিবাহ অনুষ্ঠানের কারণে ফরয ওয়াজিবসহ শরী‘আতের বিধানের ব্যাপারে উদাসীনতা এবং অনীহা প্রকাশ করা।

 কন্যা পক্ষের ভুলসমূহ

১. বর যাত্রার চাহিদা।
২. ছেলের জন্য উপঢৌকন/যৌতুক প্রকাশ্যে পাঠানো, পাঠানোকে পছন্দ করা এবং জরুরী মনে করা।
৩. আত্মীয়-স্বজন মহল্লাবাসীদের জন্য প্রথাগত দাওয়াত এবং খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা।
৪. বিবাহের সরঞ্জাম, অলংকারাদী প্রকাশ্যে দেখা এবং অন্যদেরকে দেখানো।
৫. বিবাহের পর রসম হিসাবে জামাতাকে শরবত পান করানো।
৬. বেগানা মহিলারা জামাতার সামনে আসা।
৭. সালামী গ্রহণ করা। এটাকে জরুরী মনে করা এবং নেয়া দেয়া।
৮. যাতে মহল্লায় খুব প্রসিদ্ধ হয় সে জন্যে ইচ্ছাকৃত কোন কিছু করা।
৯. ফরয-ওয়াজিব ইত্যাদি বিষয়ে উদাসীন হওয়া।

এছাড়াও বিবাহ উপলক্ষে অনেক বেপর্দা, যুবক যুবতীদের অবাধ মেলা-মেশা, অপব্যয়, ছবি এবং ভিডিও ইত্যাদি করা হয়, যাতে বিবাহের সকল খায়ের বরকত নষ্ট হয়ে যায়।

বিবাহের কিছু কুপ্রথা

  • মেয়ের ইযিন আনার জন্য ছেলেপক্ষ স্বাক্ষী পাঠিয়ে থাকে, শরী‘আতের দৃষ্টিতে এর কোন প্রয়োজন নেই।
  • বিবাহের সময় অনেকে বর-কনের দ্বারা তিনবার করে ইজাব কবূল পাঠ করিয়ে থাকে এবং পরে তাদের দ্বারা আমীন বলানো হয়। শরী‘আতে এর কোন ভিত্তি নেই।
  • ইজাব কবূলের মাধ্যমে আকদ সম্পাদন হওয়ার পর মজলিসে উপস্থিত সকলকে লক্ষ্য করে সামনে দাঁড়িয়ে হাত উঠিয়ে বর যে সালাম করে থাকে তারও কোন ভিত্তি নেই।
  • ঝগড়া-ফাসাদের আশংকা থাকা সত্ত্বেও খেজুর ছিটানোকে জরুরী মনে করা হয়। অথচ এ সম্পর্কিত হাদীসকে মুহাদ্দিসীনে কেরাম যঈফ বলেছেন।

বিবাহ শাদীর আরো কতিপয় কুসংস্কার

  • অনেক জায়গায় বিবাহ রওয়ানা হওয়ার আগে এলাকার প্রসিদ্ধ মাযার যিয়ারত করে তারপর রওয়ানা হয়। শরী‘আতে এর কোন ভিত্তি নেই।
  • বরের নিকট কনে পক্ষের লোকেরা হাত ধোয়ানোর টাকা, পান পাত্রের পানের সাথে টাকা দিয়ে তার থেকে কয়েকগুণ বেশী টাকা জোর যবরদস্তী করে আদায় করে থাকে। এটা না জায়িয।
  • অনেক জায়গায় গেট সাজিয়ে সেখানে বরকে আটকে দেয়া হয় এবং টাকা না দেয়া পর্যন্ত ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। এটাও একটা গর্হিত কাজ।
  • খাওয়া দাওয়া শেষে কনে পক্ষের লোকেরা বরের হাত ধোয়ায়। পরে হাত ধোয়ানো বাবদ টাকা দাবী করে। অনেক জায়গায় এ নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। এটা একেবারেই অনুচিত। মূলতঃ এসব হিন্দুয়ানী প্রথা। দীর্ঘ দিন যাবত হিন্দুদের সাথে বসবাস করার কারণে আমাদের মধ্যে এই কুসংস্কারগুলি অনুপ্রবেশ করেছে।
  • বিবাহ পড়ানোর আগে বা পরে যৌতুকের বিভিন্ন জিনিস-পত্র প্রকাশ্য মজলিসে সকলের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এটাও অন্যায় ও নির্লজ্জতার কাজ।
  • বিবাহের পরে নারী-পুরুষ সকলের সামনে কনের পিতা বা মাতা জামাই-মেয়ের হাত একসাথে করে তাদেরকে দু‘আ দেয়। কনের পিতা জামাইকে বলে “আমার মেয়েকে তোমার হাতে সঁপে দিলাম, তুমি এক দেখে শুনে রেখ” এর কোন ভিত্তি শরী‘আতে নেই।
  • বিবাহ করে আনার পর শ্বশুর বাড়ীতে নববধূকে বিভিন্ন কায়দায় বরণ করা হয়। কোথাও ধান, দুবলা ঘাস, দুধের স্বর ইত্যাদি দিয়ে বরণ করা হয় এবং নববধূর চেহারা সকলকে দেখানো হয়; এসবই হিন্দুয়ানী প্রথা। কোন মুসলমানের জন্য এসব করা জায়িয নেই।
  • অনেক জায়গায় মেয়ের বিয়ের আগের দিন আর কোথাও মেয়ে শ্বশুর বাড়ী যাওয়ার পরের দিন মেয়ের বাড়ী থেকে ছেলের বাড়ীতে মাছ-মিষ্টি ইত্যাদি পাঠানো হয়ে থাকে। কোথাও এটাকে চৌথি বলা হয়। এটাও বিজাতীয় নাজায়িয প্রথা।
  • বর বা কনেকে কোলে করে গাড়ী বা পালকী থেকে নামিয়ে ঘরে তোলাও চরম অভদ্রতা বৈই কিছু নয়।
  • ঈদের সময় বা অন্য কোন মৌসুমে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে চাল, আটা, ময়দা, পিঠা ইত্যাদি পাঠানো এবং এ প্রচলনকে জরুরী মনে করার প্রথা অনেক জায়গায় চালু আছে। আবার অনেক জায়গায় আনুষ্ঠানিকভাবে জামাইকে এবং তার ভাই-বোনদেরকে কাপড়-চোপড় দেয়ার প্রথা আছে। এমনকি এটাকে এতটাই জরুরী মনে করা হয় যে, ঋণ করে হলেও তা দিতে হয়। এটা শরী‘আতের সীমালঙ্ঘন ছাড়া আর কিছু নয়।
  • আজকাল বিবাহ অনুষ্ঠানে বেগানা মহিলাদের সাজ-সজ্জা করে নিজেকে বিকশিত করে একত্রিত হতে দেখা যায় এবং যুবক যুবতীদের অবাধ মেলা-মেশা করতেও দেখা যায়। এধরনের বেপর্দা আর বেহায়াপনার কারণে উক্ত মজলিসে উপস্থিত নারী পুরুষ সকলেই গুনাহগার হবে।
  • বিবাহ উপলক্ষে গান-বাজনা, ভিডিও, ভিসিআর ইত্যাদি মহামারী আকার ধারণ করেছে। আর কোন কোন এলাকায় তো যুবতী তরুণী মেয়েরা একত্রিত হয়ে নাচ গানও করে থাকে। শরী‘আতের দৃষ্টিতে এসব হারাম ও নাজায়িয।
  • আজকাল বিবাহ অনুষ্ঠান মানেই গুনাহের ছড়াছড়ি। এমন এমন গুনাহ সেখানে সংঘটিত হয় যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ছবি তোলা ও ভিডিও করা। শরী‘আতের দৃষ্টিতে কোন প্রাণীর ছবি তোলা চাই ক্যামেরার মাধ্যমে হোক কিংবা ভিডিও এর মাধ্যমে হোক বা অংকন করা হোক সবই হারাম।
  • বিবাহের পরে মেয়েকে উঠিয়ে দেয়ার আগ মুহূর্তে মেয়ের বাড়ীতে পাড়া-প্রতিবেশী মেয়েরা একত্রিত হয়, আর বরকে অন্দর মহলে এনে সকলে মিলে হৈ হুল্লা করে তার মুখ দর্শন করে। মেয়েরা হাসি মজাক করে বিভিন্ন উপায়ে নতুন দুলাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে। আর নির্লজ্জ হাসি তামাশায় মেতে উঠে। এধরনের বেপর্দেগী শরী‘আতের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম।
  • অনেক জায়গায় প্রথা চালু আছে যে, নববধূকে বর নিজে বা তার ভগ্নীপতি অথবা তার ছোট ভাই পালকী বা গাড়ী থেকে নামিয়ে কোলে করে ঘরে নেয়। তারপর উপস্থিত মহল্লাবাসীর সামনে নববধূর মুখ খুলে দেখানো হয়। এ সকল কাজ হারাম এবং নাজায়েয।

স্বপ্নপূরণের পথে :: এ পি জে আবদুল কালাম

তার পুরো নাম: আবুল পাকির জয়নুল আবেদীন আবদুল কালাম। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং বিজ্ঞানী। ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর ভারতের তামিলনাড়ুতে তাঁর জন্ম। জীবনে বহুবার নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তরুণদের উদ্দেশে প্রেরণাদায়ক ও উত্সাহব্যঞ্জক বক্তৃতা করেছেন এই ‘ভারতরত্ন’। সর্বশেষ ১৯ এপ্রিল, ২০১০ জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণদের উদ্দেশে ‘জীবন, স্বপ্ন ও কাজ’-এর ওপর যে বক্তৃতা করেন এখানে তার নির্বাচিত অংশ।

জীবনের লক্ষ্য: স্বপ্ন আর দৃঢ় সংকল্প

বন্ধুরা, সফল যাঁরা, কেমন তাঁরা—এ প্রশ্ন অনেকেরই। তুমি যদি কোনো সফল ও আদর্শ মানুষের জীবনের ইতিহাস চর্চা করো, দেখবে, শৈশবেই তাঁর মনে একটা স্বপ্ন বাসা বাঁধে। স্বপ্নটাকে সত্যি করার জন্য একটা দৃঢ় সংকল্প থাকে তাঁর। আর প্রতি পদে-পরিস্থিতিতে স্বপ্নটা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয় লক্ষ্য ছোঁয়ার কথা। আর কারও নয়, নিজের সত্যি গল্পটাই তোমাদের শোনাতে পারি।

বয়স তখন সবে ১০। তখনো কিন্তু আমরা বিদ্যুত্ পাইনি। মনে আছে, সন্ধ্যা নামলে কেরোসিনের প্রদীপ জ্বালিয়ে পড়তাম। সেই কেরোসিন ছিল রেশন কার্ড দিয়ে কেনা! আমি তখন পড়ি পঞ্চম শ্রেণীতে। শ্রী শিবাসুব্রাহ্মনিয়া ছিল আমাদের সবার পছন্দের শিক্ষক। একদিন তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে উড়ন্ত একটা পাখির চিত্র আঁকলেন। পাখিরা কীভাবে ওড়ে, উড়তে উড়তে কী করে তারা পথ পাল্টায়, তিনি তা শেখাচ্ছিলেন। ২৫ মিনিটের ক্লাস। এরপর তিনি জানতে চাইলেন, ‘বুঝতে পেরেছ?’

আমি দ্বিধাহীনভাবে বললাম, ‘না’। ক্লাসের অনেক ছাত্রই বলল, ‘বুঝতে পারিনি’। স্যার কিন্তু রাগলেন না। বরং বিকেলে আমাদের নিয়ে গেলেন রামেশ্বরাম সমুদ্রসৈকতে। জলের কলতান আর পাখিদের কিচিরমিচির গান, ওহ! এখনো ভুলতে পারিনি সেই সন্ধ্যার স্মৃতিটা। লেজ বাঁকিয়ে ডানা ঝাপটে পতপত শব্দে কী সুন্দর উড়ছে পাখিরা। কী আশ্চর্য, যেদিকে মন চাই সেদিকেই উড়ছে তারা। ‘বলো তো বন্ধুরা,’ স্যার জানতে চাইলেন, ‘ওড়ার জন্য পাখিদের ইঞ্জিনটা কোথায়?’ কিছুক্ষণ পরে আঁধার নেমে এল, কিন্তু আমরা এরই মধ্যে জেনে গেছি, পাখিরা ওড়ে নিজ জীবন আর ইচ্ছাশক্তির প্রেরণায়।

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলাম উড়ু উড়ু মন নিয়ে। বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে তারাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ঠিক করলাম, বিমান-বিজ্ঞানী হব। পরের দিন স্যারকে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, কীভাবে আমি বিমান-বিজ্ঞান সম্পর্কে আরও জানতে পারব?’ তিনি বললেন, ‘আগে অষ্টম শ্রেণী শেষ করো। তারপর হাই স্কুলে যাবে। এরপর যেতে হবে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। যদি তুমি সব ক্লাসেই ভালো করো, তবেই তোমার স্বপ্ন সত্যি হবে।’ কলেজে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার পর আমি মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করি। নিরন্তর শ্রম সাধনায় হয়ে উঠলাম একজন রকেট ইঞ্জিনিয়ার ও প্রযুক্তিবিদ। সেদিনের দেখা স্বপ্নটা আমার এভাবেই সত্যি হলো।

বন্ধুরা, তোমরা কামারশালায় গেলে দেখবে, কীভাবে আগুনে লোহা গলিয়ে নির্দিষ্ট ছাঁচের হাতুড়ি বানানো হয়। ঠিক একইভাবে তোমার জীবনের লক্ষ্যটাকে নির্দিষ্ট করতে হবে। স্বপ্ন দেখো আর দৃঢ় সংকল্প আঁকো মনের মধ্যে।

চাই জ্ঞান চর্চা

মনের কোণে শুধু স্বপ্ন আঁকলেই তো হবে না। চাই নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞান আহরণ। তা ছাড়া স্বপ্ন কখনোই সত্যি হবে না। জ্ঞান তোমাকে মহান করবে। জ্ঞান তোমাকে সফলতার দ্বারে ঠেলে নিয়ে যাবে। কাজ করার সময় নানা সমস্যা দেখা যাবে। কিন্তু মনে রাখবে, সমস্যা যেন কোনোভাবেই তোমার ওপর গুরুগিরি করতে না পারে। সমস্যাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করবে না। সমস্যার সমাধান করেই এগোতে হবে তোমাকে। দেখবে সাফল্যরা কেমন সূর্যের মতো, তারাদের মতো তোমার চারপাশে ঝিলমিল করবে।

কঠোর পরিশ্রম

লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অবশ্যই কঠিন পরিশ্রমী হতে হবে। অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। সময়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আমার জীবন থেকে বুঝেছি, কেউ যখন কোনো স্বপ্ন পূরণের জন্য সচেষ্ট হয়, তার মনে এক ধরনের জেদ তৈরি হয়। ফলে তার কাজের ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ে। স্বপ্ন আর কাজের মাধ্যমেই তৈরি হয় মেধা। মনে রাখবে, তুমি যতই বিশেষজ্ঞ হও না কেন, তোমাকে অবশ্যই প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকতে হবে। কারণ, অনুশীলনের বিকল্প কিছু নেই। স্বপ্ন যদি পূরণ করতে চাও, তোমার যত শক্তি তার সবটুকু প্রয়োগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

ব্যর্থতা জয় করার সাহস

তুমি যখন কোনো লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করবে, দেখবে সেখানে অনেক ধরনের সমস্যা আসবে। হয়তো সমস্যার সমাধান করতে পারছ না। নিজেকে ব্যর্থ মনে হতে পারে। তোমার মনে হবে, আর বুঝি সম্ভব না। কিন্তু সত্যিকারের সফল যারা, তারা ব্যর্থতাকে ভয় করে না। বরং তারা জানে, ব্যর্থতাকে জয় করেই এগোতে হবে। ব্যর্থ হলে প্রথমেই ধৈর্য ধরতে হবে। মনে রেখো, পরিস্থিতি সামলাতে হবে নিজেকেই। এ জন্য দরকার সাহস।

নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা

পৃথিবীতে কেউ শ্রেষ্ঠ হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। এটা একটা প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিংবা একটা জাতি নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। সফলদের একটা স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্নের পেছনেই তারা ছোটে। আগে থেকেই তারা প্রস্তুত থাকে যেকোনো ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য। ব্যর্থ হলে তারা ভেঙে পড়ে না। বরং নতুন উদ্যমে কাজ করে যায়। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যায়। তারা কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না। কিন্তু তারা নিজেদের সঙ্গেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। গতকাল যতটা কাজ করেছে আজ তার চেয়ে বেশি কাজ করে। আর প্রতিজ্ঞা করে, আজ যা কাজ করেছে তার চেয়ে বেশি কাজ করবে আগামীকাল। তুমিও তা-ই করো। এভাবেই শ্রেষ্ঠত্ব আসে। এভাবেই স্বপ্ন হয় সত্যি।


নির্বাচিত অংশ ভাষান্তর: জাহাঙ্গীর আলম

হতাশায় ভুগছেন? নবীজির মুখে শুনুন ফিরে আসার গল্প

বুখারি ও মুসলিম শরীফে হযরত আবু সাঈদ ইবনে মালেক ইবনে সিনান আল-খুদরী রা. থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, নবী কারীম সা. পূর্ব যুগের এক তাওবাকারির ঘটনা বর্ণনা করে বলেন-
كَانَ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكُم رَجُلٌ قَتَلَ تِسْعَةً وَ تِسْعِيْنَ نَفْساً، فَسَأَلَ عَنْ أَعْلَمِ أَهْلِ الأَرْضِ، فَدُلَّ عَلَى رَاهِبٍ. فَأتَاهُ فَقَالَ : إنَّهُ قَتَلَ تِسْعَةً وَ تِسْعِيْنَ نَفْساً فَهَلْ لَهُ مِنْ تَوْبَةٌ؟ فَقَالَ : لا. فَقَتَلَهُ فَكَمَّلَ بِهِ مِئَةَ، ثُمَّ سَألَ عَنْ أعْلَمِ أهْلِ الأرْضِ، فَدُلَّ عَلى رَجُلٍ عَالِمٍ فَقَالَ: إنَّهُ قَتَلَ مِئَةَ نَفْسٍ فَهَلْ لَهُ مِنْ تَوْبَةٍ ؟ فَقَالَ : نَعَمْ، وَمَنْ يَحُوْلُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ التَّوْبَةِ ؟ اِنْطَلِقْ إلَى أرْضِ كَذَا وَكَذَا فإنَّ بِهَا أُنَاسًا يَعْبُدُوْنَ الله َ تَعَالَى فَاعْبُدِ الله َ مَعَهُمْ، وَلَا تَرْجِعْ إلَى أَرْضِكَ فَإنَّهَا أرْضُ سُوْءٍ. فَانْطَلَقَ حَتَّى إذَا نَصَفَ الطَّرِيْقَ أَتَاهُ المَوْتُ فَاخْتَصَمَتْ فِيْهِ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ وَمَلَائِكَةُ العَذَابِ. فَقَالَتْ مَلاَئِكَةُ الرَّحْمَةِ : جَاءَ تَائِباً مُقْبِلاً بِقَلْبِهِ إِلَى الله ِ تَعَالى! وَقَالَتْ مَلاَئِكَةُ العَذَابِ : إِنَّهُ لَمْ يَعْمَلْ خَيْراً قَطُّ. فَاتَاهُمْ مَلَكٌ فِي صُوْرَةِ آدَمِيٍّ فَجَعَلُوهُ بَيْنَهُمْ -أيْ حَكَماً- فَقَالَ قِيْسُوا مَا بَيْنَ الأرْضَيْنِ، فَإلَى أَيَّتِهِمَا كَانَ أَدْنَى فَهُوَ لَهُ، فَقَاسُوا فَوَجَدُوه أَدْنَى إلَى الأرْضِ الَّتِي أَرَادَ، فَقَبَضْتُهُ مَلاَئِكَةُ الرَّحْمَةِ. متفق عليه.
وفي رواية في الصحيح : فَكَانَ إلَى القَرْيَةِ الصَّالِحَةِ أقْرَبَ بِشِبْرٍ فَجُعِلَ مِنْ أَهْلِهَا.
وفي رواية في الصحيح : فَاَوْحَى الله ُ تَعَالى إِلَى هَذِهِ أنْ تَبَاعَدِي وَإلىَ هَذِهِ أَنْ تَقَرَّبِي. وَقَالَ قِيْسُوا ماَ بَيْنَهُمَا، فَوَجَدُوهُ إلَى هَذِه أَقْرَبَ بِشِبْرٍ فَغُفِرَ لَهُ.

“তোমাদের পূর্বের এক যুগে এক ব্যক্তি নিরানব্বই জন মানুষকে হত্যা করল। এরপর সে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আলেমের অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। তাকে এক পাদ্রীকে দেখিয়ে দেয়া হল। সে তার কাছে গিয়ে বলল, সে নিরানব্বই জন মানুষকে হত্যা করেছে, তার জন্য তাওবার কোন সুযোগ আছে কি না? পাদ্রী উত্তর দিল, নেই। এতে লোকটি ক্ষিপ্ত হয়ে পাদ্রীকে হত্যা করে একশত সংখ্যা পুরণ করল।

এরপর আবার সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলেম সম্পর্কে জানতে চাইল। তাকে এক আলেমেকে দেখিয়ে দেয়া হল। সে আলেমের কাছে যেয়ে জিজ্ঞাসা করল, সে একশত মানুষকে খুন করেছে, তার তাওবা করার কোন সুযোগ আছে কি? আলেম বললেন, হ্যাঁ, তাওবার সুযোগ আছে।

এ ব্যক্তি আর তাওবার মধ্যে কি বাধা থাকতে পারে? তুমি অমুক স্থানে চলে যাও। সেখানে কিছু মানুষ আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী করছে। তুমি তাদের সাথে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করতে থাকো। আর তোমার দেশে ফিরে যেও না। সেটা খারাপ স্থান। লোকটি নির্দেশিত স্থানের দিকে পথ চলতে শুরু করল। যখন অর্ধেক পথ অতিক্রম করল তখন তার মৃত্যুর সময় এসে গেল। তার মৃত্যু নিয়ে রহমতের ফেরেশ্‌তা ও শাস্তির ফেরেশ্‌তাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হল।

রহমতের ফেরেশ্‌তাগন বললেন, এ লোকটি আন্তরিকভাবে তাওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছে। আর শাস্তির ফেরেশ্‌তাগন বললেন, লোকটি কখনো কোন ভাল কাজ করেনি। তখন এক ফেরেশ্‌তা মানুষের আকৃতিতে তাদের কাছে এল। উভয় দল তাকে ফয়সালাকারী হিসাবে মেনে নিল। সে বলল, তোমরা উভয় দিকে স্থানের দূরত্ব মেপে দেখ। যে দুরত্বটি কম হবে তাকে সে দিকের লোক বলে ধরা হবে। দূরত্ব পরিমাপের পর যে দিকের উদ্দেশ্যে সে এসেছিল তাকে সে দিকটির নিকটবর্তী পাওয়া গেল। এ কারণে রহমতের ফেরেশ্‌তাগণই তার জান কবজ করল।” (বুখারী ও মুসলিম)

বুখারীর অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, সে ভাল মানুষদের স্থানের দিকে মাত্র অর্ধহাত বেশী পথ অতিক্রম করেছিল, তাই তাকে তাদের অন্তর্ভূক্ত বলে ধরা হয়েছে। বুখারীর আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ যমীনকে নির্দেশ দিলেন, যেন ভাল দিকের অংশটা নিকটতর করে দেয়। আর খারাপ দিকের অংশটার দুরত্ব বাড়িয়ে দেয়। পরে সে বলল, এখন তোমরা উভয় দুরত্ব পরিমাপ করো। দেখা গেল সে মাত্র অর্ধ হাত পথ বেশী অতিক্রম করেছে। এ কারণে আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দিলেন।

শিক্ষা ও সংশ্লিষ্ট মাসায়েল :

১. ওয়াজ, বক্তৃতা ও শিক্ষা প্রদানে বাস-ব উদাহরণ পেশ করার অনুপম দৃষ্টান- রেখেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

২. যার ইবাদত কম কিন্তু ইলম বেশী, সে শ্রেষ্ঠ ঐ ব্যক্তির চেয়ে, যার ইবাদত বেশী ইলম কম। যেমন এ হাদীসে দেখা গেল যে ব্যক্তি ফতোয়া দিল যে তোমার তাওবা নেই সে আলেম ছিল না, ছিল একজন ভাল আবেদ। তার কথা সঠিক ছিল না। আর যে তাওবার সুযোগ আছে বলে জানাল, সে ছিল একজন ভাল আলেম। তার কথাই সঠিক প্রমাণিত হল।

৩. বিভিন্ন ওয়াজ, নসীহত, বক্তৃতা, লেখনীতে পূর্ববর্তী জাতিদের ঘটনা তুলে ধরা যেতে পারে। তবে তা যেন কুরআন-সুন্নাহ বা ইসলামী কোন আকীদার পরিপন্থী না হয়।

৪. গুনাহ বা পাপ যত মারাত্নকই হোকনা কেন, তা থেকে তাওবা করা সম্ভব।

৫. দাঈ অর্থাত ইসলামের দাওয়াত-কর্মীদের এমন কথা বার্তা বলা দরকার যাতে মানুষ আশান্বিত হয়। মানুষ নিরাশ হয়ে যায়, এমন ধরনের কথা বলা ঠিক নয়।

৬.  সর্বদা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা আর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করা আলেম ও দায়ীদের একটি বড় গুণ।

৭. অসৎ ব্যক্তি ও অসুস্থ সমাজের সঙ্গ বর্জন করা। এবং সৎ ব্যক্তি ও সৎ সমাজের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করা কর্তব্য।

৮. ফেরেশতাগন বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করতে পারেন।

৯. যে আল্লাহর পথে চলার চেষ্টা করে আল্লাহর রহমত তার দিকে এগিয়ে আসে। তাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন এবং পথ চলা সহজ করে দেন।

১০. আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের ক্ষমা করে দেয়ার দিকটা  প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

১১. আল্লাহ তাআলা পরাক্রমশালী হওয়া সত্বেও আদল ও ইনসাফ পছন্দ করেন। তাই দু দল ফেরেশতার বিতর্ক একটি ন্যায়ানুগ পন্থায় ফয়সালা করার জন্য অন্য ফেরেশতা পাঠালেন।

১২. হাদীসটি দিয়ে বুঝে আসে, যে মানুষ হত্যা করার অপরাধে অপরাধী আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন যদি সে তাওবা করে। অথচ অন্য অনেক সহীহ হাদীস স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে যে, আল্লাহ মানুষের অধিকার হরণকারীকে ক্ষমা করেন না। অতএব যে কাউকে হত্যা করল সে তো অন্য মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করে নিল। আল্লাহ তাকে কিভাবে ক্ষমা করবেন?

এর উত্তর হল : যে ব্যক্তি কোন মানুষকে হত্যা করল সে তিন জনের অধিকার ক্ষুন্ন করল। ১. আল্লাহর অধিকার বা হক। কারণ আল্লাহ মানুষ হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। মানুষকে নিরাপত্তা দিতে আদেশ করেছেন।

হত্যাকারী আল্লাহর নির্দেশ লংঘন করে সে তাঁর অধিকার ক্ষুন্ন করেছে। ২. নিহত ব্যক্তির অধিকার। তাকে হত্যা করে হত্যাকারী তার বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করেছে। ৩. নিহত ব্যক্তির আত্নীয়-স্বজন, পরিবার ও সন্তানদের অধিকার। হত্যাকারী ব্যক্তিকে হত্যা করে তার পরিবারের লোকজন থেকে ভরণ-পোষণ, ভালোবাসা-মুহব্বাত, আদর-স্নেহ পাবার অধিকার থেকে চিরতরে বঞ্চিত করেছে।

হত্যাকারী এ তিন ধরণের অধিকার হরণের অপরাধ করেছে। আল্লাহর কাছে তাওবা করলে আল্লাহ শুধু প্রথম অধিকার -যা তাঁর নিজের সাথে সংশ্লিষ্ট- নষ্ট করার অপরাধ ক্ষমা করবেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অপরাধ ক্ষমা করবেন না। এ হাদীসে প্রথম ধরনের অপরাধ ক্ষমা করার কথা বলা হয়েছে। (শরহু রিয়াদিস সালেহীন মিন কালামি সায়্যিদিল মুরসালীন)

কুরআনে বর্ণিত পূর্ববর্তীদের শিক্ষণীয় তিন ঘটনা

পূর্ববর্তীদের জীবনেতিহাস পরবর্তীদের জন্য সম্পদ। তাদের ধ্বংস বা অর্জন সবকিছুতেই রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও জীবনের পাথেয়। তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মানব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘটে যাওয়া ইতিহাস থেকে প্রয়োজনীয় নির্যাসটুকু আমাদের শিক্ষা হিসেবে কুরআন মাজীদে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন। এ নিবন্ধে ইনশাআল্লাহ, এমনই তিনটি কুরআন-বর্ণিত ঘটনা উল্লেখ করা হবে, যেন আমরা এ থেকে অর্জনটুকু গ্রহণ করি।

প্রথম ঘটনা

أَوْ كَالَّذِي مَرَّ عَلَى قَرْيَةٍ وَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَى عُرُوشِهَا قَالَ أَنَّىَ يُحْيِـي هَـَذِهِ اللّهُ بَعْدَ مَوْتِهَا

“তুমি কি সে লোককে দেখোনি যে এমন এক জনপদ দিয়ে যাচ্ছিল যার বাড়িঘরগুলো ভেঙ্গে ছাদের উপর পড়ে ছিল? সে বলল, কেমন করে আল্লাহ মরণের পর একে জীবিত করবেন?” (সূরা বাকারা, আয়াত: ২৫৯)

আল্লাহ তার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দিতে একশত বছরের জন্য তার প্রাণ নিয়ে নিলেন এবং তাকে ঐ স্থানেই পড়ে থাকলো। একশত বছর পর, আল্লাহ তাকে পুনরায় জীবন দান করলে সে ব্যক্তি ধারণা করলো, সে হয়তো একদিন বা তার থেকে কম সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ তাকে জানান, সে এভাবে একশত বছর পরে ছিল। কুরআন মাজীদে আল্লাহ বলেন,

فَأَمَاتَهُ اللّهُ مِئَةَ عَامٍ ثُمَّ بَعَثَهُ قَالَ كَمْ لَبِثْتَ قَالَ لَبِثْتُ يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ قَالَ بَل لَّبِثْتَ مِئَةَ عَامٍ فَانظُرْ إِلَى طَعَامِكَ وَشَرَابِكَ لَمْ يَتَسَنَّهْ وَانظُرْ إِلَى حِمَارِكَ وَلِنَجْعَلَكَ آيَةً لِّلنَّاسِ وَانظُرْ إِلَى العِظَامِ كَيْفَ نُنشِزُهَا ثُمَّ نَكْسُوهَا لَحْمًا فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ قَالَ أَعْلَمُ أَنَّ اللّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

অতঃপর আল্লাহ তাকে মৃত অবস্থায় রাখলেন একশ বছর। তারপর তাকে উঠালেন। বললেন, কত কাল এভাবে ছিলে? বলল আমি ছিলাম, একদিন কংবা একদিনের কিছু কম সময়। বললেন, তা নয়; বরং তুমি তো একশ বছর ছিলে। এবার চেয়ে দেখ নিজের খাবার ও পানীয়ের দিকে-সেগুলো পচে যায় নি এবং দেখ নিজের গাধাটির দিকে। আর আমি তোমাকে মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বানাতে চেয়েছি। আর হাড়গুলোর দিকে চেয়ে দেখ যে, আমি এগুলোকে কেমন করে জুড়ে দেই এবং সেগুলোর উপর মাংসের আবরণ পরিয়ে দেই। অতঃপর যখন তার উপর এ অবস্থা প্রকাশিত হল, তখন বলে উঠল-আমি জানি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল। -সূরা বাকারা, আয়াত: ২৫৯

ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা

এই ঘটনাটি আমাদেরকে পুনরুজ্জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত করে। গল্পের এই ব্যক্তিটির মতোই আমাদেরকেও আমাদের মৃত্যুর পর একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে পুনরুজ্জীবিত করা হবে।

দ্বিতীয় ঘটনা

প্রাচীনকালে ‘সাবা’ নামে একটি রাজ্য ছিল যে রাজ্যের অঞ্চলগুলোকে আল্লাহ পানি সরবরাহের ব্যবস্থার মাধ্যমে উর্বর করেছিলেন। এই পানিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার জন্য ‘সাবা’র রাজারা একটি বিশাল বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন। এর ফলে তাদের রাজ্যটি বিভিন্ন ফল, ফসল ও গাছ-গাছালিতে সমৃদ্ধ ছিল।

কিন্তু তাদের সমৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা তারা ভুলে যেতে লাগলো। এমনকি তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যের উপাসনা করা শুরু করলো। আল্লাহ তাদেরকে এই অকৃতজ্ঞতার শাস্তি স্বরূপ তাদেরকে প্রদত্ত নেয়ামতসমূহ তুলে নেন। তাদের সমৃদ্ধির উৎস বিশাল বাঁধটিতে ইঁদুর গর্ত করে করে ফেলে এবং এভাবে বাঁধটি ধ্বসে পড়ে। ফলে তাদের ফল-ফসলে সমৃদ্ধ অঞ্চলটি বন্যায় ভেসে যায়।

এ ঘটনা বর্ণনা করে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,

لَقَدْ كَانَ لِسَبَإٍ فِي مَسْكَنِهِمْ آيَةٌ جَنَّتَانِ عَن يَمِينٍ وَشِمَالٍ كُلُوا مِن رِّزْقِ رَبِّكُمْ وَاشْكُرُوا لَهُ بَلْدَةٌ طَيِّبَةٌ وَرَبٌّ غَفُورٌ. فَأَعْرَضُوا فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ سَيْلَ الْعَرِمِ وَبَدَّلْنَاهُم بِجَنَّتَيْهِمْ جَنَّتَيْنِ ذَوَاتَى أُكُلٍ خَمْطٍ وَأَثْلٍ وَشَيْءٍ مِّن سِدْرٍ قَلِيلٍ. ذَلِكَ جَزَيْنَاهُم بِمَا كَفَرُوا وَهَلْ نُجَازِي إِلَّا الْكَفُورَ

“সাবার অধিবাসীদের জন্যে তাদের বাসভূমিতে ছিল এক নিদর্শন-দুটি উদ্যান, একটি ডানদিকে, একটি বামদিকে। তোমরা তোমাদের পালনকর্তার রিযিক খাও এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। স্বাস্থ্যকর শহর এবং ক্ষমাশীল পালনকর্তা। অতঃপর তারা অবাধ্যতা করল ফলে আমি তাদের উপর প্রেরণ করলাম প্রবল বন্যা! আর তাদের উদ্যানদ্বয়কে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুই উদ্যানে, যাতে উদগত হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউ গাছ এবং সামান্য কুলবৃক্ষ। এটা ছিল কুফরের কারণে তাদের প্রতি আমার শাস্তি। আমি অকৃতজ্ঞ ব্যতীত কাউকে শাস্তি দেই না।” -সূরা সাবা, আয়াত: ১৫-১৭

এখান থেকে আমরা যা শিখলাম

এই ঘটনাটি আমাদের জন্য শিক্ষা যে, আমাদের উন্নতি ও সমৃদ্ধির সময়ে আমরা যেন আল্লাহকে ভুলে না যাই এবং তার অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ না হই। আমাদের সবসময় এই বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন এবং আল্লাহর যাবতীয় নেয়ামতের জন্য সর্বদা তার শোকর আদায় করা উচিত। আল্লাহ বলেন,

“যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর।” (সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৭)

তৃতীয় ঘটনা

যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মুক্ত করা দাস ও পালিত পুত্র। তিনি তার সাথে যয়নব বিনতে হারেসা (রা.) এর বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সম্মিলিত বিবাহিত জীবন সুখের ছিল না এবং তারা একজন অপরজনের কাছ থেকে স্বাচ্ছন্দ্য পাচ্ছিলেন না। এর ফলে যায়েদ (রা.) যয়নব (রা.) কে তালাক দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু রাসূল (সা.) তাকে তা করতে নিষেধ করেছিলেন।

পরবর্তীতে আল্লাহ রাসূল (সা.) কে এই বিবাহ বিচ্ছেদে বাধা না দেওয়ার জন্য আদেশ দিলেন এবং বিবাহ বিচ্ছেদের পর আল্লাহ রাসূল (সা.) কে যয়নব (রা.) কে বিবাহ করার আদেশ দিলেন।

زَوَّجْنَاكَهَا لِكَيْ لَا يَكُونَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌ فِي أَزْوَاجِ أَدْعِيَائِهِمْ إِذَا قَضَوْا مِنْهُنَّ وَطَرًا وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ مَفْعُولًا

“…তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে।” (সূরা আহযাব, আয়াত: ৩৭)

এখানে আমাদের জন্যে যা শেখার আছে

হযরত যায়েদ ও যয়নব (রা.) উভয়েই উচ্চ মানের সাহাবী ছিলেন। যায়েদ (রা.) ছিলেন এমন একজন সাহাবী, যাকে কুরআনে তার নাম ধরে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি ছিলেন প্রথম তিনজন ঈমান গ্রহণকারী সাহাবাদের মধ্যে একজন।

অপরদিকে যয়নব (রা.) ছিলেন উম্মুল মুমিনীনদের মধ্যে অন্যতম এবং তিনি তার উদারতা, কোমলতা ও দানশীলতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন।

এত উঁচু পর্যায়ের সাহাবী হওয়া সত্ত্বেও তারা উভয়ে একত্রে থাকতে সক্ষম হননি। তাদের মধ্যকার ঝগড়া ও তিক্ততা এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত তারা আলাদা হয়ে যান।

এ থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, কোন দম্পতি যদি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে তাদের মধ্যে একজন অথবা দুইজনই মন্দ চরিত্রের লোক, এমনটি ভাবার কোন যৌক্তিকতাই নেই। একটি দম্পতি যদি পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে সাধারনভাবে এটা ধারণা করা যেতে পারে, তারা একজন অপরজনের যোগ্য নয়।

আমাদের কখনোই উচিত নয় এ প্রসঙ্গে নিকৃষ্ট ধারণা করা এবং এর বিচার-বিবেচনা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়াই আমাদের জন্য যুক্তিযুক্ত। রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে উপরোক্ত তিনটি ঘটনা থেকে অর্জিত শিক্ষা জীবনে বাস্তবায়নের তাওফিক দান করেন। আমীন।

সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস,পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলামের জন্য প্রথম……

সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. অত্যন্ত অল্প বয়সে ঈমান আনেন। যখন মাত্র ১৭ বছর বয়স তখন তিনি মুসলমান হন। তিনি ছিলেন ১৭ তম ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তি। ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম তীরন্দাজ।

তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তাঁর মা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর নিজের পিতা-পিতামহের ধর্মে প্রত্যাবর্তনের জন্য চাপ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি পানাহার ছেড়ে দেন। যতক্ষণ না সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস ইসলাম ত্যাগের ঘোষণা দিচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি মৃত্যু হলেও জলস্পর্শও করবেন না জানিয়ে দেন।

ক্রমে তার স্বাস্থ ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন, এমনকি তিনি ঠিকমত কথাও বলতে পারছিলেন না। তার পুত্র তাকে বারংবার বুঝিয়েও ব্যর্থ হলেন। শেষাবধি দৃঢ়তার সাথে বললেন, যদি তোমার দেহে একশ জীবনও সঞ্চারিত হয়। আর তা এক এক করে মৃত্যু বরণ করে তবুও আমি আমার ঈমান ত্যাগ করব না।

ছেলের এই দৃঢ়তায় তাঁর মা নিরাশ হয়ে অনাহার ভঙ্গ করতে বাধ্য হয়। আরেকদিন যখন সাদ ঘরে নামাজ পড়ছিলেন, তাঁর মা হামনা সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে প্রতিবেশিদের ডেকে সাদকে প্রহার করতে বলে, যতক্ষণ না সাদ ঈমান আনে কিম্বা মারা যায়!

একজন মা নিজ সন্তানকে নির্যাতনের জন্য লোক ডেকে আনছে, এই ঘটনা বিস্ময়কর। ইসলামের মোকাবেলায় ইসলামের শত্রুরা বরাবরই এইরকম বিস্ময়কর চরিত্র নিয়ে আজও হাজির।

একবার আবু দাব্ব উপত্যকায় সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস, সা’দ ইবনে যায়িদ, খাব্বাব ইবনে আরাত আল তামিমি, আম্মার বিন ইয়াসির, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. নামাজ আদায় করছিলেন। এটা কোনোভাবে আবু সুফিয়ান, আল আখনাস বিন শুরাইক্ব জানতে পেরে সদলবলে সেখানে উপস্থিত হয়ে সাহাবাদের উপর হামলা করে।

ইসলাম সেখানে ছিল নবীন। নবুওয়্যাতের তৃতীয় বর্ষ ছিল সেটা। এত কম সংখ্যক ছিলেন তারা যে, কেবল সংখ্যালঘু শব্দের দ্বারাই তাদের সংখ্যা তখন চিহ্নিত করা যায় না। ইসলামগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল কেবলমাত্র হাতেগোণা। এই সময়ে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্তাপন করলেন তারা। মুসলমানগণ পাল্টা প্রতিহত করল।

সা’দ আবি ওয়াক্কাস কাছেই দেখতে পান মাটিতে একটা উটের চোয়ালের হাড় পড়ে আছে তিনি তা তীর ছোঁড়ার মত ছুঁড়ে মারেন। একজন মুশরিকের কপাল গিয়ে এমনভাবে তা আঘাত করে যে, কপাল চিড়ে মাথা ফেটে যায়। এই দৃশ্য দেখে বাকিরা দৌড়ে পালিয়ে গেল। এটা ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রতিরোধের প্রথম ঘটনা। প্রথম কোনও রক্তপাত।

এত স্বল্পসংখ্যক হয়েও যে অদম্য সাহস ও স্পৃহায় আত্মরক্ষার যে মৌল মানবাধিকারের চর্চা সম্ভবত দুনিয়ার ইতিহাসে তা নজির বিহীন। কোনও আদর্শের এত অল্পসংখ্যক লোক সংখ্যাগরিষ্ঠের এত বড়ো নেতা ও তাঁর দলের সঙ্গে এভাবে প্রতিরোধ ও বিজয় অর্জন করেছে পৃথিবীর ইতিহাসে এঁর আর কোনও নজির আছে বলে আমার জানা নেই।

সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস ইসলামের জন্য কেবল প্রথম রক্তই ঝরান নি, তিনি ছিলেন ইসলামের জন্য প্রথম তীর নিক্ষেপকারী। বদরের যুদ্ধে তিনি ও তাঁর ভাই উমায়ের অংশ নেন। উমায়েরের বয়স কম ছিল বলে রাসুল অনুমতি দেন নি, কিন্তু অত্যধিক আগ্রহ আর কান্নাকাটির মুখে তাঁকে অনুমতি দেওয়া হয়।

যে চৌদ্দ জন সাহাবা বদরে শহীদ হন, উমায়ের ছিলেন তাঁদের একজন। সাদ এবং উমায়ের দুইভাই একসাথে বদরপ্রান্তে রওয়ানা হয়েছিলেন, ফেরার সময় প্রিয়তর ছোটভাইকে রেখে একা একা ফিরতে হয়েছে তাঁকে। এই ইসলাম কত ত্যাগের মাধ্যমে আমাদের হাতে পৌঁছেছে!

উহুদের যুদ্ধে যখন মুসলমানরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল, যে পনেরোজন সাহাবা তখনও অকুতোভয় লড়ছিলেন রাসুলের পাশে থেকে তাঁর মধ্যে সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. ছিলেন অন্যতম। তিনি নিজের দেহ দিয়ে রাসুলের দেহকে আড়াল করে রাখছিলেন। মানবঢাল তৈরি করেছিলেন।

তিনি তীর নিক্ষেপ করে যাচ্ছিলেন একের পর এক। এগিয়ে আসা শত্রুদল তাঁর তীরের ঝড়ে ক্রমে ধ্বসে যেতে থাকে। রাসুল নিজে তাঁর জন্য তীর কুড়িয়ে দিয়েছেন সে যুদ্ধে। এমনকি রাসুল তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমার জন্য আমার পিতা, মাতা কুরবান হউক’। আলী রা. বলেন, রাসুল আর কোনও ব্যক্তি স্বমন্ধে কখনোই এমনটি বলেন নি।

উহুদের যুদ্ধে কোনও কোনও বর্ণনামতে, তিনি একাই এক হাজার তীর নিক্ষেপ করেছেন। সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. বিদায় হজ্বের সময় রাসুলের সাথে ছিলেন। উমার রা. এঁর আমলে তিনি এক লক্ষ মুসলিম সেনার সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। এঁর মধ্যে তিনি ৩৫ হাজার সৈন্যকে বেছে নিয়েছিলেন পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে।

কাদেসিয়ায় সেই যুদ্ধ চলাকালীন তিনি ছিলেন সায়াটিকায় আক্রান্ত। তাঁর কোমরের উপরের অংশ থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত এই স্নায়বিক ব্যথা ছিল। ঘোড়ায় চড়া এমনকি নাড়াচাড়াও হয়ে উঠেছিল ছিল অসম্ভব। এইরকম অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি যুদ্ধের কম্যান্ড নিজ হাতে রাখেন।

পারস্যের সহকারী সম্রাট ও যৌথ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক রুস্তমের নেতৃত্বে আসা হস্তি, অশ্বারোহী, পদাতিক বাহিনীর ১ লক্ষ বিশ হাজার সৈন্যকে তাঁর বাহিনী পরাস্ত করে। কিংবদনন্তী সেনাপতি রুস্তম নিহত হয়। ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম এই বিজয় সম্পন্ন হবার দুইমাসের মাথায় পারস্যের রাজধানী মাদায়েনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। ততদিনে সেনাপতি সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

মাদায়েন দজলা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। নদীর দুইপাশেই শহর গড়ে উঠেছিল। দজলা নদীর পশ্চিমাংশের নাম ছিল ‘বাহুরাসীর’ ইংরেজিতে যাকে ‘Seleucia’ এবং সিরিয়ান আরবিতে ‘সালিক্ব’ বলা হয়। অপর অংশ যা ছিল দজলার পূর্ব তীরে এর নাম ছিল ‘তায়সাফুন’, ইংরেজিতে একে ‘Ctesiphon’ বলা হয়।

এর বর্তমান নাম সালমান পাক, যা ইরাকের রাজধানী বাগদাদের জিরো পয়েন্ট থেকে প্রায় পনেরো মাইল উত্তরে। আধুনিক ইরাকের বাগদাদ প্রদেশেই সে সময়কার মাদায়েন অবস্থিত ছিল।

সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. পশ্চিম মাদায়েন জয় করেন। দুই মাস শহর অবরোধ করা হয়। এরপর স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধ হয়, যুদ্ধে মুসলমানগণ বিজয়ী হয়। তারা শহরে প্রবেশ করে দেখল, শহর খালি করে সবাই পূর্ব মাদায়েনে চলে গেছে। পশ্চিম মাদায়েনে পৌঁছার পর মুসলমানদের চোখে পারস্য সম্রাটের ‘সাদা প্রাসাদ’ দৃশ্যমান হয়।

মুসলিম সেনাদল সেখানে যাওয়ার জন্য নৌকার খোঁজ করল। দেখা গেল, সব নৌকা পূর্ব মাদায়েনের নদী বন্দর ফিরাযে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সমস্ত সংযোগ সেতু ভেঙে ফেলা হয়েছে। সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. চিন্তিত হয়ে পড়লেন পার হওয়ার ব্যাপারে।

এ বছর অকস্মাৎ নদীতে বন্যা হল। বন্যায় পানি ফেনিল আর কালো হয়ে নদীর বিস্তৃতি প্রায় আধ মাইল ব্যাপ্ত হয়ে গেল। বর্তমানের দজলা অনেক অগভীর হলেও তখন ছিল যথেষ্ট নাব্যতা। সেই সময় এক রাতে সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. স্বপ্নে দেখলেন, ঘোড়া নিয়ে মুসলমানগণ নদী পার হচ্ছেন।

তিনি পরদিন সকালেই সৈন্য সমাবেশে স্বপ্নের কথা জানিয়ে তা বাস্তবায়নের ইচ্ছে প্রকাশ করলেন এবং স্বেচ্ছায় নদী পার হতে কে কে চায় সে কথা জানতে চাইলেন। আসিম ইবনু আমর রা. এবং তাঁর সাথে আরও ছয়শো সৈন্য দাঁড়াল। তিনি তাঁদের নিয়ে একটা ব্যাটালিয়ন গঠন করলেন, এর নাম দেওয়া হল আল আহওয়াল অর্থাৎ ভয়ঙ্কর।

উদ্দেশ্য ছিল তারা প্রথমে নদী পার হবে এবং হামলা চালিয়ে শত্রুদের ভীত করে তুলবে। কা’কা বিন আমরের নেতৃত্বে আরও একটি ব্যাটালিয়ন গঠন করা হল ‘খারসা’ নামে। যার অর্থ ‘বোবা, নিঃশব্দ’। এই নামকরণের উদ্দেশ্য ছিল তারা কিছুটা অগ্রসর হয়ে নদী পার হবে ব্যাক-আপ ফোর্স হিসেবে এবং ভিন্ন দিক দিয়ে শত্রুর উপর নিঃশব্দে আক্রমণ চালাবে।

এই দুই ব্যাটালিয়নের অধিনায়কেরাই ছিলেন বনু তামিম গোত্রের। আল আহওয়াল ব্যাটালিয়ন যখন ঘোড়া দিয়ে নদী পার হল, তখন ইরানি সৈন্যরা বলল, এরা দানব কিম্বা জিন। প্রকৃতই সৈন্যরা ভীতির মধ্যে পড়ে গেল। পরে যখন পাশ থেকে খারসা ব্যাটালিয়ন আক্রমণ করল তখন ফিরায নদী বন্দরের নিয়োজিত সৈন্যরা এই দুই ব্যাটালিয়নে গড়ে উঠা মাত্র এক বিগ্রেড সৈন্যের হাতে পরাজয় বরণ করল।

বন্দরের নিয়ন্ত্রণ মুসলমানদের হাতে আসলে সেনাপতি সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস সকল অশ্বারোহীকে নদীতে নেমে গেলেন। নদী এমনভাবে গল্প করতে করতে তারা পার হচ্ছিলেন যে, যেন তারা ডাঙ্গায় ঘোড়া নিয়ে চলছেন। বর্ষীয়ান সাহাবী সালমান ফার্সী রা. বলেন, আমরা এমনভাবে নদী অক্ষত অবস্থায় পার হই যে, কারো হাত থেকে একটা রশিও হারায় নি।

একজনের একটা পাত্র হারিয়ে গেলে, যখন সে তা খুঁজতে লাগল, দেখা গেল নদীর স্রোত তা তাঁর কাছে ফেরত নিয়ে এসেছে। সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. এই অবস্থাদৃষ্টে বললেন, ‘আল্লাহ্‌র কসম, ততদিন মুসলামান বিজয়ী হবে, আল্লাহর সাহায্য পাবে, আল্লাহ্‌ তাদের জন্য যথেষ্ট হবেন, যতদিন মুসলমানের মধ্যে এমন পাপ না থাকবে যা সওয়াবকে অতিক্রম করে’।

এই যে, আজকে মুসলমানদের দুনিয়াজোড়া পতন, পদে পদে লাঞ্ছিত হওয়া, মার খাওয়া তাঁর কারণ সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. এঁর এই উক্তির মধ্যে নিহিত আছে। এমনকি মুসলমানের বিজয়ের সূত্রও বুনা আছে এর মাঝে। পতনের কারণ আমাদের গুনাহর পাল্লা আমাদের সওয়াবের পাল্লাকে অতিক্রম করে ভারী হয়ে যাওয়া।

আর এই পতন থেকে মুক্তির উপায় একমাত্র এটাই, এই গুনাহের পথ থেকে তওবা করে সওয়াবের দিকে ধাবিত হওয়া। নেক কাজের প্রতি ঝুঁকে যাওয়া। অন্য কিছুই আমাদের বিজয়ী করতে পারবে না, না অর্থ, না জ্ঞান-বিজ্ঞান, না সমর শক্তি, না সংখ্যা। এই যে, ফিলাস্তিন থেকে আরাকান, মুসলমান মার খাচ্ছে, এই হত্যা এই পরাজয়ের ভাগীদার তো আমিও।

এই সবই তো আমাদের গুনাহের ফসল। আমাদের রব এ থেকে আমাদের প্রত্যাবর্তনের তাওফিক দিন।

আমরা প্রিয়জনদের জন্য কত গুনাহর দিকে পা বাড়াই, কখনো বন্ধুদের সাথে মিলে, কখনো প্রেমের জন্য, এইসবই সম্পর্কের নামে করি আমরা। অথচ ইসলামের জন্য সম্পর্ককে কী করে উপেক্ষা করতে হয়, এমনকি নিজের মাকেও- সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস আমাদের দেখিয়ে গেছেন।

ক্রিকেটে কেউ ইনজুরি নিয়ে খেললে, সেটাকে বীরত্ব অবহিত করে কতজনই তো কত অনুপ্রাণিত হই- অথচ সিভিয়ার ইনজুরি নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা এই সাহাবির আদর্শের ফ্যান আমরা কতজন হতে পেরেছি? আজ এই না হওয়া, এই না পারা, এই অনুসরণ না করাই উম্মাহর পতনের কারণ।

জিমে গিয়ে পছন্দের তারকার মত শরীর বানায় কতজন! সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. ছিলেন সুঠাম ও সুগঠিত দেহের অধিকারী। চওড়া কাঁধ, পেশিবহুল দেহের, কোঁকড়ানো ঘন কালো চুলের এক মহান দীর্ঘদেহী পুরুষ! কেন আমাদের অনুসরণে সেইসব দুশ্চরিত্র লোকেরা চলে আসে, কেন তারা আইকন হয়, আশারায়ে মুবাশশরার অন্যতম সা’দ বিন ওয়াক্কাসের মত অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বাদ রেখে।

যে তারুণ্য আমাদের গুনাহতে ডুবিয়ে দেয়, মুসলমান হয়েও ইসলাম থেকে দূরে সরায়। সে তারুণ্যই সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসকে মূর্তি পূজা থেকে ইসলামের দিকে নিয়ে এসেছিল। ইসলামকে তাঁর দ্বারা শক্তিশালী করেছিল। আর আমাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে চলেছে। আফসোস!


সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস
লেখক – আরজু আহমদ

মরুভূমিতে এক স্বর্ণখনি – মালির গল্প

মালি বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত। মানুষের গড় আয়ু এবং স্বাক্ষরতার হার সেখানে বিপজ্জনকভাবে কম। গোত্রভিত্তিক কোন্দলকে কেন্দ্র করে মালির উত্তরাঞ্চলে তুয়ারেগ গোত্রের বিদ্রোহ দেশটিকে দুভাগে বিভক্ত করার ঝুঁকির মুখে ফেলেছে, যার কারণে মালি সাম্প্রতিক বিশ্ব খবরেও উঠে এসেছে। কিন্তু মালির জীবন সবসময়ই এমন নেতিবাচক বা হতাশায় পরিপূর্ণ ছিলনা। একসময় মালি ছিল একটি সফল মুসলিম রাষ্ট্রের উজ্জ্বল উদাহরণ। ছিল বিশ্ববাসীর কাছে ঈর্ষার বস্তু। সত্যিই দেশটা ছিল যেন মরূভূমিতে এক স্বর্ণের খনি।

ভূগোল
মালি হিসাবে পরিচিত অঞ্চলটি সাহারা মরুভূমির দক্ষিণ প্রান্তসীমায় অবস্থিত। তাই মালিতে দু’টি ভিন্ন ধরনের অঞ্চল রয়েছে। উত্তরাঞ্চলে রয়েছে শুষ্ক ও অনুর্বর মরুভূমি, আর এর থেকে দক্ষিণ দিকে তা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে ঘনবর্ষণ বনাঞ্চলে। এই অঞ্চলটি ‘সাহেল’ নামে পরিচিত।

মালিতে উর্বর জমির অভাব থাকলেও অন্যান্য অতি মূল্যবান সম্পদ সে অভাব পূরণ করে দিয়েছে। স্বর্ণ ও লবণের খনি শত শত বছর ধরে মালির অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করছে। মালির উত্তরাঞ্চল থেকে বাণিজ্যপথ বর্ধিত হয়ে উত্তর আফ্রিকার উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যেখানকার ধনী ব্যবসায়ীগণ ইউরোপ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় পাঠানোর জন্য চড়ামূল্যে স্বর্ণ ও লবণ কিনতে আগ্রহী ছিল। এই বাণিজ্যপথগুলো মাদিন্‌কা নামক পশ্চিম আফ্রিকার স্থানীয় গোত্রটিকে অবিশ্বাস্যরকম সম্পদশালী গোত্রে পরিণত করেছিল।

আফ্রিকার মানচিত্রে তৎকালীন বাণিজ্যপথগুলো দেখা যাচ্ছে যেগুলো দিয়ে এই অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটে

অতীতের মালি ও ইসলাম
এই বাণিজ্যপথগুলো দিয়ে শুধুমাত্র মালামালই কেনাবেচা হতোনা। আইডিয়া বা চিন্তার ধারাও প্রবাহিত হতো উত্তর থেকে দক্ষিণে। স্বর্ণ আর লবণের সাথে সাথে মুসলিম বণিকগণ ইসলামকেও সাথে করে নিয়ে যেতেন। ফলে ৮ম শতক থেকে ইসলাম ধীরে ধীরে পশ্চিম আফ্রিকার সাহেলে শিকড় গাড়তে শুরু করে। প্রথমদিকে পশ্চিম আফ্রিকার অমুসলিমরা ইসলামকে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করে, কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে অন্ততপক্ষে সাধারণ জনগণ থেকে মুসলিমদের আলাদা রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু যখন মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে তখন ধীরে ধীরে ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়ে যায়।

‘মালি’ নামক এক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন সুনদিয়াতা কেইতা নামক এক ব্যক্তি, যিনি ইতিহাসে বেশ অজ্ঞাত, তার ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কিছু জানা যায়না। তার জীবনের অনেক গল্প শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লোকমুখে প্রচলিত হয়ে আসছে। যার ফলে সময়ের সাথে প্রকৃত ঘটনা বিকৃত হয়ে গিয়েছে (উদাহরণস্বরূপ, একটি উপাখ্যান হচ্ছে তিনি একটি পূর্ণবয়স্ক বড় গাছ সমূলে উপড়ে ফেলেছিলেন এবং সেটা আবার তার মায়ের উঠানে রোপণ করেছিলেন)। তবে আমরা যা জানি তা হলো, তিনি মালি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন এবং ১২৩০-এর দশকে পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম জনগণের জন্য একটি শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি “মান্‌সা” উপাধি ধারণ করেন, মাদিন্‌কা ভাষায় যার অর্থ হলো রাজা।

মান্‌সা মুসা এবং তাঁর হজ্জ
মালির দশম “মান্‌সা” বা রাজা ছিল “প্রথম মুসা” যিনি ১৩১২ সাল থেকে ১৩৭৭ সাল পর্যন্ত মালি শাসন করেন। তাঁর ভাই মান্‌সা আবু বকর আটলান্টিক মহাসাগরে আমেরিকা আবিষ্কারের অভিযানে বের হলে মুসাকে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তাঁর শাসনামল সম্পর্কে আমরা যা জানি তার বেশীরভাগই এসেছে ১৩২৪ সালে তাঁর হজ্জ পালনের ঘটনা থেকে।

ছবিতে ইউরোপীয় অ্যাটলাসে মান্‌সা মুসা’র রূপায়ণ

একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে মান্‌সা মুসা ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ্জ পালনের সিদ্ধান্ত নেন। ভৌগলিকভাবে দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত বলে মালি থেকে মক্কায় যাত্রা এখনকার আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থাতেই কঠিন, আর তখনতো ছিল সেটা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। তারপরও ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে মুসা ৬০,০০০ লোকের এক বিশাল কাফেলা নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

যেহেতু তাঁর সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর অন্যতম ধনী সাম্রাজ্যের একটি, স্বাভাবিকভাবেই সেই কাফেলা যাত্রাপথে সকলের মনে ছাপ রেখে যায়। কাফেলায় ছিল ১২,০০০ চাকর-বাকর, প্রত্যেকের পরনে ছিল মূল্যবান সিল্কের পোশাক ও সাথে ছিল ৪ পাউন্ডের এক স্বর্ণখন্ড। ৮০টি উটের প্রত্যেকটি ৫০ থেকে ৩০০ পাউন্ডের স্বর্ণগুড়া বহন করছিল যেগুলো যাত্রাপথে গরীবদের মাঝে বিলানো হয়েছিল। অভুতপূর্ব জীবজন্তু এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আনাগোনা এই কাফেলার যাত্রাটিকে মহাকাব্যিক করে তোলে এবং যে ব্যক্তিই কাফেলাটি অবলোকন করেছে তাদের মনে তা স্থায়ী ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। এই জাঁকজমক কাফেলার বিভিন্ন বর্ণনা বিভিন্ন এলাকার লোকজনের মুখে মুখে চালু হয়ে যায়।

মক্কার যাত্রাপথে মান্‌সা মুসা মিশরে যাত্রাবিরতি নেন। প্রথমে তিনি মিশরের মামলুক সুলতানের সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানান কারণ তখনকার রীতি অনুযায়ী সুলতানকে মাথা নিচু করে কুর্নিশ করতে হতো। মুসা দৃঢ়কন্ঠে জানান দেন যে তিনি শুধুমাত্র এক আল্লাহ্‌র সামনেই মাথা নোয়ান। মামলুক সরকার তাঁর আচরণে বেশ প্রভাবিত হয়, কারণ কর্মকর্তারা লক্ষ্য করেন যে তিনি কুরআন জানেন এবং সময়মতো নামাজ পড়াকে বেশ গুরত্ব দেন। মুসা স্পষ্টতই একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন।

মুসার এই অঢেল পরিমাণ সম্পদ মিশরে কিছু অনিচ্ছাকৃত ফলাফল বয়ে নিয়ে। তিনি সরকারী কর্মকর্তা, গরীব জনগণ, স্কলারসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের মাঝে স্বর্ণ বিতরণ করেন। কিন্তু চাহিদা ও যোগানের নিয়মানুযায়ী স্বর্ণের দাম সেখানে একদম পড়ে যায়, যা মিশরের অর্থনীতিকে একদম বিকলাঙ্গ করে দেয়। এমনকি এই ঘটনার এক দশক পরেও, ইবনে বতুতার মিশর সফরের সময়ও তিনি লক্ষ্য করেন মিশরের অর্থনীতি মুসার সফরের প্রভাব বা সেই মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মুসার মিশর সফর মালি সাম্রাজ্যের ধনসম্পদ ও এর গুরত্বের এক নিদর্শন বহন করে, এটি দেখিয়ে দেয় মালি সাম্রাজ্যের গুরুত্ব কতখানি, এমনকি দূরদূরান্তের রাজ্যসমূহতেও।

মালিতে প্রত্যাবর্তন
হজ্জের পর জন্মভূমি মালিতে ফিরে আসার সময় মান্‌সা মুসা সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবান মুসলিমদেরকে নিয়ে আসার ব্যাপারে গুরত্ব আরোপ করেন। তাঁর প্রচুর ধনসম্পদ থেকে তিনি স্কলার, শিল্পী, শিক্ষক, স্থপতি এবং অন্যান্য পেশার লোকদের অর্থপ্রদান করেন যেন তারা মালিতে এসে এখানকার ইসলাম প্রচার ও প্রসারে অবদান রাখেন। মিশর, সিরিয়া, ইরাক, আল-আন্দালুস (মুসলিম স্পেন) এবং হেজাজ থেকে তিনি প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মালিতে নিয়ে আসেন।

ছবিতে সান্‌কোরে মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়, মালির স্বকীয় স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন

মালির উপর এর প্রভাব ছিল অপরিমেয়। মালির স্থাপনাগুলোর মধ্যে স্পেনীয়, আরব ও পারস্যের স্থাপত্যকলার প্রভাব পড়তে শুরু করে। বিভিন্ন সংস্কৃতির এক স্বকীয় মিশ্রণের ফলে সৃষ্ট এই স্থাপত্যকলা আজও পশ্চিম আফ্রিকায় দেখা যায়। মান্‌সা মুসার হজ্জ প্রখ্যাত শহর তিম্বুক্তুর জন্য রহমতস্বরূপ ছিল, কেননা সেখানে সান্‌কোরে মসজিদের মতো অনেক মসজিদ গড়ে উঠে বিশ্বের নামকরা সব স্থপতিদের নকশায়। মান্‌সা মুসা আন্দালুসিয়ার স্থপতি ইবন ইসহাককে ২০০ কিলোগ্রাম স্বর্ণ প্রদান করেন তিম্বুক্তুর সান্‌কোরে মসজিদ নির্মাণ করার জন্য। বিশ্বসেরা স্থপতি, স্কলার এবং শিক্ষকদের ভালো মাইনে দেয়ার সুবাদে মালি এবং তিম্বুক্তু ইসলামী জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু
মুসার হজ্জের পর মালির যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনটি ঘটে তা হলো জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এর উত্থান। বিশ্বের নামকরা স্কলারদের নিয়ে মালিতে সেসময়কার সবচেয়ে সমৃদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় এবং বিকশিত হয় জ্ঞানার্জনের সংস্কৃতি। গাও ও তিম্বুক্তু শহরগুলোতে ছিল প্রচুর লাইব্রেরী। ব্যক্তিগত ও সরকারী সংগ্রহে ইসলামী আইন, জ্যোর্তিবিজ্ঞান, ভাষা, ইতিহাস থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে ছিল হাজার হাজার বই। ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তখন আফ্রিকার সকল প্রান্ত থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করত।

তিম্বুক্তুর লাইব্রেরীতে তৎকালীন মালির জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতের পাণ্ডুলিপি

জ্ঞান আহরণের এই রীতি আজও মালিতে প্রচলিত। বিভিন্ন পরিবারের ব্যক্তিগত সংগ্রহের লাইব্রেরীতে এখনও শত শত বই দেখা যায়, যার বড় অংশ শত বছরের পুরনো। মান্‌সা মুসার আমল থেকে প্রাপ্ত ঐতিহ্যবাহী সেসব জ্ঞানের ব্যাপারে তারা খুবই সংরক্ষণশীল, যার ফলে বর্হিবিশ্বের জন্য এই লাইব্রেরীগুলোর নাগাল পাওয়া খুব কঠিন।

সাহেল অঞ্চলের মরুকরণের ফলে পাণ্ডুলিপিগুলো আজ হুমকির সম্মুখীন, পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এই ঐতিহাসিক ও মহামূল্যবান বইগুলো প্রায় নষ্ট হয়ে ধুলোয় পরিণত হচ্ছে। পশ্চিম আফ্রিকায় রাজনৈতিক কোন্দলও বাকি পান্ডুলিপির ধ্বংসের কারণ হয়ে পড়েছে। এইসব মহামূল্যবান বইগুলোকে ডিজিট্যালি সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়া হাতে নেয়া হয়েছে। তিম্বুক্তু শিক্ষা ফাউন্ডেশন এই বইগুলো ইতিহাসের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার আগেই প্রতিটি পৃষ্ঠা স্ক্যান করার উদ্যোগ নিয়েছে। অনলাইনে আজ সবাই প্রতিটি পাণ্ডুলিপিই খুঁজে পেতে পারেন ও পড়তে পারেন।

মালি পশ্চিম আফ্রিকার জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ার সাথে সাথে ইসলাম এই অঞ্চলের জনগণের হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করতে থাকে। সাধারণ মানুষের জন্যও ধর্মীয় ও সেক্যুলার বিষয়ে শিক্ষিত হওয়ার ব্যাপারটি সাধারণ একটা ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল তখন সেখানে। সমাজে শিক্ষার প্রভাব ১৩৫০-এর দশকে ইবনে বতুতার মালি সফরের বর্ণনায় পাওয়া যায়। যেখানে তিনি মন্তব্য করেনঃ

“যদি দিনটি হয় শুক্রবার, তবে কেউই তাড়াতাড়ি মসজিদে না গেলে অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে জায়গা পায়না। তাই প্রত্যেক ব্যক্তি তার বালক সন্তানকে আগেই জায়নামাজসহ মসজিদে পাঠিয়ে দেয়া একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলেরা মসজিদে গিয়ে তাদের বাবাদের পছন্দমতো স্থানে জায়নামাজ বিছিয়ে জায়গাটি বাবারা আসা পর্যন্ত দখল করে রাখে।”

উপসংহার
মালির গুরত্ব এবং বিশ্বে এর অবদান বলে শেষ করা যাবেনা। এর ইতিহাসে এটি ছিল ইসলামী জ্ঞান ও সম্পদের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯শ শতকে ফ্রান্স উপনিবেশ গড়ার আগ পর্যন্ত ১৬শ থেকে ১৮শ শতকে এর গুরত্ব কমতে থাকে। কিন্তু এর ইতিহাস চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়নি। পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিমদের জীবনে এই ইতিহাস এখনো জিইয়ে আছে এবং বিশ্বে মালি যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে গিয়েছে তা আজও অব্যাহত।

অনুবাদ করা হয়েছে A Gold Mine in the Desert – The Story of Mali আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদকঃ জাহ্‌রা বিনতে মুহাম্মাদ

Sources:

Hamdun, Said, and Noel King. Ibn Battuta in Black Africa. 2nd ed. Bellew Publishing Co Ltd, 1975. Print.

Hill, M. (Jan, 209). The Spread of Islam in West Africa. Retrieved from http://spice.stanford.edu/docs/the_spread_of_islam_in_west_africa_containment_mixing_and_reform_from_the_eighth_to_the_twentieth_century/

Morgan, M. (2007). Lost History. Washington D.C.: National Geographic Society.

Quick, A. H. (2007). Deeper Roots. (3rd ed.). Cape Town: DPB Printers and Booksellers.