8.8 C
New York
Saturday, October 25, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 8

ন্যায় বিচার / মুবাশ্বিরাহ্ শর্মা

মাঝেমধ্যে খুব ভয় হয়! কিসের ভয় জানেন? ঈমান হারানোর ভয়। আমি আবার দুনিয়ার মোহে জড়িয়ে আমার রাব্বে কারীমকে ভূলে যাচ্ছি না তো? তবে সাহাবী এবং খলিফাগণদের জীবনীগুলো পড়লেই অন্তরটা শীতল হয়ে যায়। মনের মধ্যে প্রশান্তি অনুভব করি। তেমনই একটা ঘটনা লেখার চেষ্টা করলাম..

সিরিয়ার একটি শহরের নাম রাকা। সেখান থেকে খলিফা হারুন অর রশিদের নিকট চিঠি আসলো। চিঠিতে লেখা ছিল, শহরের বিচারক এক মাস যাবত অসুস্থ, বিচার কাজ স্থবির হয়ে আছে । খলিফা যেন দ্রুত ব্যবস্থা করেন।

খলিফা চিঠির জবাব পাঠালেন। আগামী সপ্তাহের মধ্যে নতুন বিচারক আসবেন। এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন বিচারক এসে যোগ দিলেন।

বিচার কাজ শুরু হয়েছে। স্থানীয় প্রহরীরা একজন বৃদ্ধা মহিলাকে আসামী হিসেবে দরবারে হাজির করলেন। তার অপরাধ, তিনি শহরের এক রেস্তারাঁ থেকে কিছু রুটি আর মধু চুরি করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন ।

বিচারক: আপনি চুরি করেছেন ?

– জ্বি

– আপনি কি জানেন চুরি করা কতো বড় অপরাধ ও পাপ ?

– জ্বি

– জেনেও কেন চুরি করলেন ?

– কারণ আমি গত এক সপ্তাহ যাবত অভুক্ত ছিলাম। আমার সাথে এতিম দু’নাতিও না খেয়ে ছিল। ওদের ক্ষুধার্থ চেহারা ও কান্না সহ্য করতে পারিনি তাই চুরি করেছি। আমার আর এ ছাড়া কোন উপায় ছিল না হুজুর।

বিচারক এবার পুরো দরবারে চোখ বুলালেন। বললেন কাল যেন নগর, খাদ্য, শরিয়া, পুলিশ প্রধান ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যাক্তিগন সবাই উপস্থিত থাকেন। তখন এর রায় দেওয়া হবে।

পরদিন সকালে সবাই হাজির হলেন। বিচারক ও যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে রায় ঘোষণা করলেন,
‘বৃদ্ধা মহিলার চুরির অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৫০টি চাবুক, ৫০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা আর অনাদায়ে এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া করা হলো। তবে অকপটে সত্য বলার কারণে হাত কাটা মাফ করা হলো।’

বিচারক প্রহরীকে চাবুক আনার নির্দেশ দিয়ে নিচে নেমে ঐ বৃদ্ধা মহিলার পাশাপাশি দাঁড়ালেন।

বিচারক বললেন, ‘যে নগরে একজন ক্ষুধার্ত বৃদ্ধ মহিলা না খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় চুরি করতে বাধ্য হয়, সেখানে তো সবচেয়ে বড় অপরাধী সে দেশের খলিফা। আর আমি এসেছি খলিফার প্রতিনিধি হয়ে। আমি যেহেতু তাঁর অধীনে চাকরি করি তাই ৫০টি চাবুকের ২০টি আমার হাতে মারা হউ আর এটাই হলো বিচারকের আদেশ।’

বিচারক আরো বললেন, ‘আদেশ যেন পালন করা হয় এবং বিচারক হিসাবে আমার উপর চাবুক মারতে যেন কোনো রকম করুণা বা দয়া দেখানো না হয়।’

বিচারক হাত বাড়িয়ে দিলেন। দুই হাতে পর পর ২০টি চাবুক মারা হলো। চাবুকের আঘাতের ফলে হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পরছে। ঐ অবস্থায় বিচারক পকেট থেকে একটি রুমাল বের করলেন। কেউ একজন বিচারকের হাত বাঁধার জন্য এগিয়ে গেলে বিচারক নিষেধ করলেন।

এরপর বিচারক বললেন, ‘যে শহরে নগর প্রধান, খাদ্য গুদাম প্রধান ও অন্যান্য সমাজ হিতৈষীরা একজন অভাব গ্রস্থ মহিলার ভরন-পোষণ করতে পারেন না, সেই নগরে তারাও অপরাধী। তাই বাকি ৩০টি চাবুক সমান ভাবে তাদেরকে মারা হোক।’

এরপর বিচারক নিজ পকেট থেকে বের করা রুমালের উপর ৫০টি রৌপ্য মুদ্রা রাখলেন। তারপর বিচারপতি উপস্থিত সবাইকে বললেন, ‘যে সমাজ একজন বৃদ্ধ মহিলাকে চোর বানায়, যে সমাজে এতিম শিশুরা উপবাস থাকে, সে সমাজের সবাই অপরাধী। তাই উপস্থিত সবাইকে ১০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা জরিমানা করা হলো।’

এবার মোট ৫০০দিনার রৌপ্য মুদ্রা থেকে ১০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা জরিমানা বাবদ রেখে বাকি ৪০০টি রৌপ্য মুদ্রা থেকে ২০টি চুরি যাওয়া দোকানের মালিককে দেওয়া হলো। বাকি ৩৮০টি রৌপ্য মুদ্রা বৃদ্ধা মহিলাকে দিয়ে বিচারক বললেন, ‘এগুলো আপনার ভরণ পোষণের জন্য আর আগামী মাসে আপনি খলিফা হারুন অর রশিদের দরবারে আসবেন। খলিফা হারুন অর রশিদ আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থী।’

একমাস পরে বৃদ্ধা খলীফার দরবারে গিয়ে দেখেন খলীফার আসনে বসা লোকটিকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে।

মহিলা ভয়ে ভয়ে খলীফার আসনের দিকে এগিয়ে যান। কাছে গিয়ে বুঝতে পারেন লোকটি সেদিনের সেই বিচারক।

খলীফা চেয়ার থেকে নেমে এসে বললেন, ‘আপনাকে ও আপনার এতিম দু’নাতিকে উপোস রাখার জন্য সেদিন বিচারক হিসেবে ক্ষমা চেয়েছিলাম। আজ দরবারে ডেকে এনেছি প্রজা অধিকার সমুন্নত করতে না পারা অধম এই খলীফাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। আপনি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করুন।

একেই বলে ন্যায় বিচার। সমাজে এই ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যই ইসলাম এসেছে। আর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছে অসংখ্য নবী রাসুল। আসুন, নবী রাসুলের দেখানো পথে সমাজে এমন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমাদের সাধ্যানুযায়ী প্রচেষ্টা চালাই। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন।

ন্যায় বিচার / মুবাশ্বিরাহ্ শর্মা

ক্ষমাগুণ ও উদারতা এনে দিতে পারে বিজয় ও সফলতা : আলী হাসান উসামা

প্রতিনিয়ত ডুবে আছি আমরা গুনাহের অথৈ সাগরে। নিজের ওপরে করেছি শত অবিচার। হৃদয়াকাশ হয়ে গেছে ঘন কালো। তবুও মহামহিম আল্লাহ ধ্বসিয়ে দেননি আমাদেরকে ভূমিতলে। কিংবা করেননি আকাশ থেকে পাথরবর্ষণ। উল্টো সাহস যুগিয়েছেন। নিরাশ হতে বারণ করেছেন। নির্দেশ দিয়েছেন গুনাহ পরিত্যাগের, হেদায়াতের দীপ্ত পথ অবলম্বনের।

বলেছেন,

হে আমার বান্দারা, যারা অবিচার করেছো নিজের ওপরে, নিরাশ হয়ো না তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মার্জনা করবেন পাপরাশি। তিনি তো অতি ক্ষমাশীল, বড় দয়ালু। [সূরা যুমার : ৫৩; সূরা নিসা : ৪৩, ৯৯, ১৩৯ ; সূরা হজ : ৬০ ; সূরা মুজাদালাহ : ২]

মহানবী সা. বলেন, কষ্টের কথা শুনে আল্লাহ থেকে অধিক ধৈর্যধারণকারী কেউ নেই। তারা আল্লাহর জন্য সন্তান স্থির করে। এতোদসত্ত্বেও তিনি তাদেরকে প্রশান্তিতে রাখেন, রিযিক প্রদান করেন। [বোখারি:৭৩৭৮ ; মুসলিম : ২৮০৪]

ক্ষমাশীল মহামহিম আল্লাহ তার প্রিয় নবীকেও নির্দেশ দিয়েছেন ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বনের। ইরশাদ হয়েছে, ক্ষমা অবলম্বন করুন আর সদয়তার নির্দেশ দিন, আর ভ্রুক্ষেপ করবেন না অজ্ঞদের দিকে। [সূরা আ’রাফ : ১৯৯; সূরা মায়িদা : ১৩]

নির্দেশ দিয়েছেন তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারীদেরকেও, তারা যেনো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে অন্যের ভুল-ত্রুটি ও অবিচার। [সূরা জাসিয়া : ১৪ ; সূরা নুর : ২২]

ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বনের ব্যাপারে উৎসাহ যুগিয়েছেন আরো অনেক আয়াতে। ক্ষমাকে অভিহিত করেছেন জান্নাতবাসীদের গুণ বলে। আরো বলেছেন, পুরস্কৃত করবেন তিনি ক্ষমাশীলদেরকে বিশেষ পুরস্কারে। [সূরা আলে ইমরান : ১৩০-১৩৬ ; সূরা তাগাবুন : ১৪-১৫ ; সূরা শুরা : ৩৭-৪৩]

পূর্ববর্তী নবীগণের ক্ষমাগুণ
১. নুহ আ. প্রেরিত হলেন আপন সম্প্রদায়ের কাছে নবুওয়াতের বার্তা নিয়ে। তাদেরকে দাওয়াত দিলেন সত্যধর্মের ও একত্ববাদের। তুলে ধরলেন তাদের সামনে মূর্তিপূজার অসাড়তা। সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ তখন বলে ওঠলো, আমরা তো তোমাকে প্রকাশ্য গোমরাহিতে দেখতে পাচ্ছি। নুহ আ. উত্তেজিত হলেন না। মায়াভরা কণ্ঠে বললেন, “আমার কোনো গোমরাহি নেই। আমি তো রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল।” [সূরা আরাফ : ৬০-৬১]

২. হুদ আ. সরলমনে বড় আশা নিয়ে দাওয়াত দিলেন আপন সম্প্রদায়কে। হতভাগারা তখন বেঁকে বসলো। আপন মুখের ফুৎকারে সত্যের দীপ্ত প্রদীপ নিভিয়ে দিতে উদ্যত হলো। তারা বললো, আমরা তো নিশ্চিতভাবে দেখছি, তুমি নির্বুদ্ধিতায় লিপ্ত রয়েছো। হুদ আ. বললেন, “আমার কোনো নির্বুদ্ধিতা দেখা দেয়নি। আমি তো জগতসমূহের পালনকর্তার পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল।” [সূরা আ’রাফ : ৬৬-৬৭]

মুহাম্মাদে আরাবি সা.-র ক্ষমাগুণ
১. তাওরাতে বর্ণিত মহানবীর গুণাবলির বর্ণনার ধারাবাহিকতায় আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’ছ রা. নলেন, “তিনি কঠিন ও রূঢ় স্বভাবের অধিকারী নন। আর নন তিনি হাট-বাজারে হট্টগোলকারী। তিনি মন্দকে প্রতিহত করেন না মন্দ দ্বারা। তার স্বভাববৈশিষ্ট্য ক্ষমা করা, মার্জনা করা।”  [বোখারি : ২১২৫]

২. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, যেনো আমার চোখে এখনও ভাসছে প্রিয়নবীর মুখাবয়ব। তিনি বর্ণনা করছেন কোনো এক নবীর কথা। (কুরতুবি রহ. বলেন, তিনি মূলত নিজের ঘটনাই বর্ণনা করছেন নিজেকে গোপন রেখে। [ফাতহুল বারি : ১২/৩২৪]

আপন সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে মেরে রক্তাক্ত করে ছেড়েছে। আর সেই নবীর চেহারা থেকে রক্ত মুছছেন আর বলছেন, “প্রভু হে, ক্ষমা করে দাও আমার সম্প্রদায়ের অবুঝ লোকগুলিকে!” – [বোখারি : ৬৯২৯ ; মুসলিম : ১০৫৭]

৩. আনাস বিন মালিক রা. বলেন, একদিন রাসূলের সাথে আমি হাঁটছিলাম। রাসূলের গায়ে ছিলো একটি নাজরানি চাদর। বসনাঞ্চল ছিলো বেশ পুরু। ইত্যবসরে এক গেঁয়ো লোক রাসূলকে দেখে তার চাদর ধরে জোরসে টান দিলো। আমি রাসূলের ঘাড়ের ওপরে দৃষ্টি ফেললাম। টানের আঘাতে তাতে দাগ পড়ে গেছে! এরপর সেই গেঁয়োলোক রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বললো, তোমার কাছে রক্ষিত আল্লাহর সম্পদের কিয়দাংশ আমাকে প্রদানের নির্দেশ দাও। রাসূল সা. তখন তার দিকে ফিরে মৃদু হাসলেন। এরপর তাকে তা প্রদানের নির্দেশ দিলেন।  [বোখারি : ৬০৮৮]

৪. জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. বর্ণনা করেন, নজদ অভিমুখে এক জিহাদে আমি রাসূলের সাথে ছিলাম। জিহাদ শেষে ফেরার পথে ভরদুপুরে সারি সারি বাবলা গাছ বিশিষ্ট এক উপত্যকায় আমরা অবতরণ করলাম। বিক্ষিপ্ত হয়ে সবাই তখন গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করছিলাম। রাসূলও তখন এক বাবলা গাছের সাথে তরবারি ঝুলিয়ে বিশ্রাম করছিলেন। সাহাবিগণের চোখে তখন তন্দ্রা এসেছিল। আচমকা এক বেদুইন এসে রাসূলের ঝুলানো তরবারি নিয়ে তা খাপমুক্ত করলো।

পরক্ষণে সে রাসূলের ওপরই তা ধারণ করলো। রাসূলের ঘুম তখন ভেঙ্গে গেলো। তাকে জাগ্রত হতে দেখে বেদুইন বলে ওঠলো, কে রক্ষা করবে তোমাকে আমার হাত থেকে? রাসূল তখন তিনবার বললেন, আল্লাহ! বেদুইনের দেহ তখন প্রকম্পিত হলো। হাত থেকে পড়ে গেলো তরবারি। অনন্তর রাসূল তাকে কোনোই শাস্তি দিলেন না কিংবা বললেন না কোনো কটু কথা। এরপর রাসূল সবাইকে ডাকলেন। সাহাবিগণের উপস্থিতিতে বিস্তারিত ঘটনা শুনালেন। সেই বেদুইন তখন তার পাশে নীরব বসা।  [বোখারি : ২৯১০, ৩৯৯০ ; মুসলিম : ৮৪৩]

৫. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, এক গেঁয়ো এসে মসজিদে ঢুকলো। রাসূল সা. তখন বসা। সে এসে নামাযে দাঁড়ালো। নামায শেষে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে লাগলো, “হে আল্লাহ, আপনি রহম করুন আমাকে ও মুহাম্মাদকে! আমাদের সাথে রহম করবেন না আর কাউকে!” রাসূল সা. তার দিকে তাকালেন। বললেন, “তুমি দেখছি এক ব্যাপক বিষয়কে সংকীর্ণ করে ফেলেছো!” কিছুক্ষণ অতিক্রান্ত না হতেই সেই গেঁয়ো মসজিদে পেশাব করতে বসে গেলো। সাহাবিরা তখন দ্রুতবেগে তার কাছে ছুটে গেলো। রাসূল তাদেরকে বাধা প্রদানে বারণ করলেন। পেশাব শেষ হলে সাহাবিদেরকে এক বালতি পানি ঢেলে দিতে নির্দেশ দিলেন। এরপর বললেন, তোমাদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে সহজকারীরূপে; কঠিনকারীরূপে নয়। [তিরমিযী : ১৪৮ ; আবু দাউদ : ৩৮০]

৬. কুরাইশ কাফিরগোষ্ঠী কী নির্মম অত্যাচার করেছিলো নিরপরাধ মুসলমানদের ওপরে! বইয়ে ছিলো রক্তের কতো বন্যা! মহানবীকেও করেছিলো নিপীড়িত, নিগৃহীত।

অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পরে রাসূল সা. সেই মক্কায় প্রবেশ করলেন অবনত মস্তকে, সাশ্রু নয়নে। উচ্চারিত হচ্ছিলো তার পবিত্র যবানে,[সূরা ফাতহ : ১]

এরপর ঘোষণা করলেন সাধারণ ক্ষমা- “যে অস্ত্র সমর্পণ করবে সে নিরাপদ। যে বন্ধ রাখবে নিজ ঘরের দরজা সে নিরাপদ। যে প্রবেশ করবে হারামে সে নিরাপদ। যে প্রবেশ করবে আবু সুফিয়ানের ঘরে সেও নিরাপদ। অবশেষে সবার উপস্থিতিতে করুণার আধার রাসূল সা. ঘোষণা দিলেন,  আজ তোমাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই! তোমরা সবাই মুক্ত। [আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/২৯১-৩০৮]

৭. আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. নিজ হাতে আঘাত করেননি কাউকে; না স্ত্রী কিংবা দাস-দাসীকে। তবে আল্লাহর রাহে জিহাদের বিষয়টি ভিন্ন। আর কখনো এমন হয়নি, তার সাথে কোনো অন্যায় আচরণ হয়েছে আর তিনি অন্যায়কারী থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছেন। তবে কেউ আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়াবলিতে লিপ্ত হলে আল্লাহর জন্য তিনি তার শোধ নিতেন। [মুসলিম : ২৩২৮]

সাহাবিদের ক্ষমাগুণ
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, উহুদ যুদ্ধ চলাকালে ইবলিস হঠাৎ সৈন্যদলের মাঝে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওঠলো- ঐ যে পেছনে! সামনের দল তখন পেছনের দলের ওপরে চড়াও হলো। একপর্যায়ে তারা হুযায়ফা রা. -এর বাবা ইয়ামান রা.-কে লড়াইয়ের প্রভ-তায় আঘাত করে বসলো। হুযায়ফা রা. চিৎকার করে ওঠলেন- আমার বাবা! আমার বাবা!! কিন্তু ততক্ষণে ইয়ামান রা. শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেছেন। অবস্থাদৃষ্টে হুযায়ফা রা. বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন! তিনি কোনো শোধ নিলেন না হত্যাকারীদের থেকে।  [বোখারি:৬৮৮৩]

সালাফের ক্ষমাগুণ
শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকি উসমানি দা.বা. আপন পিতা মুফতিয়ে আযম পাকিস্তান আল্লামা শফি রহ. সূত্রে বর্ণনা করেন, প্রখ্যাত বুযুর্গ মাওলানা ইসমাইল শহিদ রহ. অতীতে যার দৃষ্টান্ত মেলা ভার- একবার দিল্লির জামে মসজিদে বয়ান করছিলেন। মজলিস ছিলো ভক্ত-অনুরক্তদের উপস্থিতিতে টইটুম্বুর। ইত্যবসরে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলে ওঠলো, শুনলাম, আপনি নাকি হারামযাদা! মাওলানা ইসমাইল শহিদ রহ. বিনয়ভরা কণ্ঠে বললেন, ভাই, তুমি ভুল শুনেছো! আমার মায়ের বিয়ের স্বাক্ষী তো এখনও দিল্লিতে জীবিত রয়েছে। [মেরে ওয়ালেদ মেরে শায়খ : ১১০]

ক্ষমাপরায়ণতা/ক্ষমাগুণ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ
১. আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. মেহরাবে উপবিষ্ট অবস্থায় বললেন, তোমরা দয়া করো। পরিণামে দয়াপ্রাপ্ত হবে। অন্যকে ক্ষমা করো। ফলস্বরূপ নিজেরা ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে। [মুসনাদে আহমদ : ৬৫৪১]
২. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, সদকা সম্পদে সামান্য পরিমাণও হ্রাস করে না। ক্ষমা শুধু ব্যক্তির মর্যাদাই বৃদ্ধি করে। আল্লাহর জন্য কেউ বিনয় অবলম্বন করলে পরিণামে আল্লাহ তার মর্যাদা সুউচ্চ করেন। [মুসলিম : ২৫২৮ ; তিরমিযী : ২০২৯]
৩. মুআয বিন আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলেছেন, প্রতিশোধ গ্রহণে সক্ষম অবস্থায় যে ক্রোধ সংবরণ করে কেয়ামত দিবসে সকল সৃষ্টির উপস্থিতিতে আল্লাহ তাকে আহ্বান করে জান্নাতের হুর নির্বাচনের বিশেষ অধিকার প্রদান করবেন। [তিরমিযী : ২৩৯৩ ; আবু দাউদ : ৪৭৭৭]
৪. উকবা বিন আমির রাযি. রাসূলের কাছে আবেদন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে শ্রেষ্ঠতম আমলের কথা বলে দিন। রাসূল সা. বললেন,  হে উকবা, যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তুমি তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখো। যে তোমাকে বঞ্চিত করে তুমি তাকে প্রদান করো। যে তোমার প্রতি অবিচার করে তুমি তাকে ক্ষমা করো। [মুসনাদে আহমাদ : ১৭৩৩৪,১৭৪৫২; আবু দাউদ : ৪৮৯৬ ; মুসলিম : ২৫৮৮]

ক্ষমাপরায়ণতা সম্পর্কিত আছার
১. আবু বকর রা. বলেন, আমার কাছে এ মর্মে বর্ণনা পৌঁছেছে যে, মহামহিম আল্লাহ কেয়ামত দিবসে একজন আহ্বানকারীকে নির্দেশ দিবেন। অনন্তর সে আহ্বান করবে, আল্লাহর কাছে যার কিছু পাওনা রয়েছে সে যেনো উপস্থিত হয়। ক্ষমাশীল বান্দারা তখন মহামহিমের দরবারে উপস্থিত হবে। আল্লাহ তখন তাদেরকে ক্ষমাগুণের পুরস্কারস্বরূপ যথেষ্ট প্রতিদান দিবেন। [ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন : ৩/১৯৫]
২. হাসান বসরি রহ. বলেন, মুমিনের সর্বোত্তম চরিত্রগুণ হলো ক্ষমাপরায়ণতা। [আলআদাবুশ কারণয়্যাহ : ১/৭১]
৩. এক ব্যক্তি উমর ইবনে আবদুল আযিয রহ.-এর কাছে উপস্থিত হয়ে নিজ অত্যাচারিত হওয়ার অভিযোগ করলো। উমর রহ. বললেন, অত্যাচারিত অবস্থায় আল্লাহর দরবারে তোমার উপস্থিত হওয়া শোধ নিয়ে উপস্থিত হওয়া থেকে বহুগুণে কল্যাণকর। [ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন : ৩/১৮৩]
৪. এক বুযুর্গ বলেন, সহনশীল সে নয়, যে অত্যাচারিত হলে সহনশীলতা প্রদর্শন করে। পরবর্তীতে সুযোগ পেলে শোধ নিয়ে নেয়। প্রকৃত সহনশীল সে, যে অত্যাচারিত হলে ধৈর্য ধরে। প্রতিশোধের ক্ষমতা পেলে ক্ষমা করে। [ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন : ৩/১৯৬; ফাতহুল বারি : ১৪/৩১৯ ; ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন : ৩/১৮৩; দালিলুল ফালিহিন : ৩/৯১]

ক্ষমাপরায়ণতার উপকারিতা

  • ক্ষমাপরায়ণতা উত্তম চরিত্রের দীপ্ত বহিঃপ্রকাশ।
  • ক্ষমাপরায়ণতা ঈমানের পূর্ণতার পরিচায়ক।
  • ক্ষমাপরায়ণতা মহানুভবতা ও উদারতার ইঙ্গিতবাহক।
  • ক্ষমাগুণ আল্লাহর নৈকট্য ও মানুষের ভালোবাসা লাভের উপায়।
  • ক্ষমাগুণ সমাজকে সুন্দর করে। উপহার দেয় সম্প্রীতির বন্ধনে অটুট আলোকিত এক জাতি।
  • ক্ষমাগুণ এক আলোকবর্তিকা, যা অমুসলিমদেরকেও ইসলাম গ্রহণে উৎসাহিত করে।

পুনশ্চ
ক্ষমাপরায়ণতার গুণ অর্জনের জন্য প্রয়োজন দৃঢ় সংকল্প। মিটিয়ে দিতে হবে নিজের আমিত্ত্বে। আল্লাহ বলেন, প্রকৃতপক্ষে যে সবর অবলম্বন করে ও ক্ষমা প্রদর্শন করে, নিঃসন্দেহে তা বড় হিম্মতের কাজ। [সূরা শুরা : ৪৩]

স্মতর্ব্য যে, ক্ষমাপরায়ণতার পুরস্কার শুধু পারলৌকিকই নয়। অর্জন করুন এ নববী গুণ আর উপভোগ করুন জীবন। আল্লাহ বলেন, তুমি মন্দকে প্রতিহত করো এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট। ফলস্বরূপ তোমার এবং যার মধ্যে ছিলো শত্রুতা সহসাই দেখবে সে হয়ে যাবে সুহৃদ। আর এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা সহিষ্ণু এবং যারা মহা ভাগ্যবান। [হা-মিম-সাজদা : ৩৪-৩৫]

বছরের পর বছর লুকিয়ে নামাজ আদায় করেছি! অ্যানা কলিন্স ওসামা

আমি বড় হয়েছি আমেরিকার একটি কট্টর খ্রিষ্টান পরিবারে। ওই সময় প্রায় সবাই নিয়ম করে প্রতি রোববার চার্চে যেতো প্রার্থনা করতো। আর আমার পরিবার তখন চার্চ কমিউনিটির সাথে যুক্ত ছিল। তো আমরা এর ব্যতিক্রম হতেই পারি না। অন্য শিশুদের চেয়ে আমাকে আরো বেশি ধার্মিক হতে হবে- ছোটবেলা থেকে এমনটাই আমাকে বোঝানো হয়েছে।

মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় অনেক যাজকরাও আসতেন। ঠিক মনে নেই, আমার কোনো এক জন্মদিনে এক আত্মীয় আমাকে একটি বাইবেল উপহার দিলেন আর আমার বোনকে একটি পুতুল দিলেন। আমি প্রায় প্রতিদিনই এটি পড়তাম।

তখন আমি জুনিয়র হাইস্কুলে পড়ি। দুই বছরের জন্য আমি একটি বাইবেল স্টাডি প্রোগ্রামে অংশ নিলাম। এই সময় বাইবেলের কয়েকটি অংশ পড়লাম। কিন্তু ভালোভাবে বুঝতে পারলাম না। উদাহারণ হিসেবে একটু বলি, বাইবেলে অরিজিনাল সিন নাম একটি আইডিয়া আছে, যার অর্থ সব মানুষই পাপীষ্ঠ হয়ে জন্ম গ্রহণ করে।
তখন মনে হলো, আমার ছোট একটা ভাই আছে। আমি জানি শিশুরা পাপী নয়।

এছাড়া বাইবেলের আরো কিছু বিষয় নিয়ে ধন্দে পড়ে গেলা। আমার ভেতর অনেক প্রশ্ন জাগলো। কিন্তু আমি কাউকে ভয়ে প্রশ্ন করতে পারছিলাম না। কারণ সবার কাছে আমি যে, ‘লক্ষ্মী মেয়ে’। আমি কী করে এসব প্রশ্ন তুলি? আলহামদুলিল্লাহ, আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো অন্য একজনের মাধ্যমে পেয়ে যেতাম। মানে ওই প্রোগ্রামে এক ছেলে ছিল সে অনেক প্রশ্ন করত। তার প্রশ্নের কোনো শেষ ছিল না। সে প্রশ্ন করতেই থাকত। কিন্তু সন্তুষ্ট হতো না। আমার অবস্থাও তার মতো ছিল। কোনো উত্তরই পরিস্কার ছিল না।

অবশেষে মিশিগান ইউনিভার্সিটির ধর্মবিষয়ক এক অধ্যাপক ছেলেটিকে পরামর্শ দিলেন, প্রার্থনা করতে। প্রার্থনার মাধ্যমেই বিশ্বাস জন্মাবে। তার কথা আমিও প্রার্থনা করলাম। এভাবে হাইস্কুল পার করলাম। এরপর কলেজে। সেখানে আমি ধর্ম সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতামত জানলাম।

কিন্তু এসবে আমার কোনো উপকার হলো না। ঠিক ওই সময়টায় আমার সাথে লিবিয়ার এক মুসলমান ভাইয়ের সাথে পরিচয় হলো। তিনি আমাকে ইসলাম ধর্ম ও কোরআন শরীফ সম্পর্কে কিছু ধারণা দিলো। তিনি আমাকে বললেন, ইসলাম হলো সবচেয়ে আধুনিক ধর্ম। কিন্তু আমি জানতাম, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য পিছিয়ে পড়া জায়গা। তাছাড়া তিনি যতটা বলছেন, আমার চোখে ইসলাম অতটা আধুনিক ধর্ম নয়।

একদিন আমার পরিবার ওই মুসলমান ভাইটিকে ক্রিসমাস চার্চের সার্ভিসে নিয়ে গেলেন। দিনটি চমৎকার ছিল। সার্ভিস শেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের প্রার্থনার এ রীতিকে বানিয়েছে? কে শিখিয়েছে কখন দাঁড়াতে হবে এবং কখন হাঁটু গেরে বসতে হবে? কে-ই বা তোমাদের শিখিয়েছে, কিভাবে প্রার্থনা করতে হবে?

তার এতো সব প্রশ্নে আমি যার-পর নাই বিরক্ত হলাম। তারপরও চার্চের ইতিহাস তাকে জানালাম। তাকে তো ইতিহাস জানালাম কিন্তু তার প্রশ্নগুলো আমাকে ভাবিয়ে তুললো। আসলেই কি এইভাবে প্রার্থনা করতে হয়? তারা কিভাবে জানলেন প্রার্থনার ওই পদ্ধতি?

আসলেই কি প্রার্থনার এই রীতি ঐশ্বরিক? আমি খ্রিষ্টান ধর্মের অনেক কিছুই বিশ্বাস করি না। কিন্তু চার্চে সব সময় যেতাম। বেশিরভাগ সময় সেখানে নিজেকে অপরিচিত মনে হতো, মনে হতো ভিনগ্রহের কোনো বাসিন্দা।

এরই মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল। আমার খুব কাছের একজন মানুষ বৈবাহিক সমস্যায় সমস্যায় ভুগছিলেন। সে সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদের চার্চের এক সহকারি যাজকের কাছে গেলেন। কিন্তু ওই যাজক সমস্যার সমাধানের বদলে তাকে এক মোটেলে নিয়ে শারিরীক নির্যাতন করল।

এই ঘটনাটি খ্রিষ্টান ধর্মের যাজকদের সম্পর্কে আমার মনোভাব পাল্টে দিলো। যাজকদের ব্যাপারে আমি সচেতন হলাম। এরপরও আমি চার্চে যাওয়া বন্ধ করিনি। কিন্তু কিছু প্রশ্ন আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো- কেন আমি সরাসরি ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ করতে পারব না? কেন একজন মানুষের মাধ্যমেই আমাকে ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ করতে হবে? কেন আমি অন্যের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইব?

এই সবের মাঝেই একটি বইয়ের দোকানে আমি কোরআন শরীফের অনুবাদ পেলাম। আমি সেটি কিনে পড়তে শুরু করলাম। ফুরসত পেলাই আমি কোরআন পড়তাম। এভাবে আট বছর আমি কোরআন শরীফের অনুবাদ পড়লাম।

পাশাপাশি অন্য ধর্ম সম্পর্কেও পড়াশোনা করলাম। ধীরে ধীরে আমি সচেতন হতে থাকলাম এবং আমার পাপের কথা মনে করে ভয় করতে শুরু করল। কিভাবে আমি বুঝবো, ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করেছেন কিনা? আমি খ্রিষ্টান ধর্মের মতো ‘ক্ষমা করলে, ক্ষমা পাবো’ এই নীতিতে আমার বিশ্বাস ছিল না। আমার পাপের বোঝা আমার উপরই ভারী হচ্ছিল এবং আমি বুঝতে পারছিলাম না, কিভাবে এই বোঝা কমাবো? তবুও আমি ক্ষমা চেয়ে যাচ্ছিলাম।

আমি কোরআনে পড়েছিলাম-

(সূরা : আল মায়েদাহ ৮২-৮৪ আয়াত)
৮২.) ঈমানদারদের সাথে শত্রুতার ক্ষেত্রে তুমি ইহুদী ও
মুশরিকদের পাবে সবচেয়ে বেশী উগ্র। আর ঈমানদারদের
সাথে বন্ধুত্বের ব্যাপারে নিকটতম পাবে তাদেরকে যারা বলেছিল আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী (খ্রিষ্টান)। এর কারণ হচ্ছে, তাদের মধ্যে ইবাদাতকারী আলেম, সংসার বিরাগী দরবেশ পাওয়া যায়, আর তাদের মধ্যে আত্মগরিমা নেই।

৮৩.) যখন তারা এ কালাম শোনে, যা রসূলের ওপর নাযিল
হয়েছে, তোমরা দেখতে পাও, সত্যকে চিনতে পারার কারণে
তাদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তারা বলে ওঠে, “হে আমাদের রব! আমরা ঈমান এনেছি, সাক্ষ্যদাতাদের মধ্যে আমাদের নাম
লিখে নাও।”

৮৪.) আর তারা আরো বলে, “আমরা আল্লাহর ওপর ঈমান
কেন আনবো না এবং যে সত্য আমাদের কাছে এসেছে তাকে
কেন মেনে নেবো না-যখন আমরা এ ইচ্ছা পোষণ করে থাকি যে, আমাদের রব যেন আমাদের সৎ ও সত্যনিষ্ঠ লোকদের অন্তর্ভুক্ত
করেন।”
এই আয়াতগুলো তেলোয়াত করার পর আমি বিশ্বাস করতে
শুরু করলাম যে, ইসলাম ধর্মেই আমি আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবো। আমি টেলিভিশনের খবরে মুসলমানদের নামাজ আদায় করতে দেখতাম। এবং জানতাম মুসলমানদের প্রার্থনা করার বিশেষ পদ্ধতি আছে।

আমি এক অমুসলিমের লেখা একটি বই পেলাম, যেখানে নামাজ সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা আছে। আমি সেই নিয়ম অনুযায়ী নামাজ আদায় করতে থাকলাম। জানতাম পুরোপুরি সঠিক হবে না, তবুও পড়তাম। বছরের পর বছর আমি লুকিয়ে নামাজ পড়েছি।
অবশেষে আমি কোরআন শরীফ থেকে সূরা আল মায়েদাহের ৩ নং আয়াতটি তেলোয়াত করলাম-
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ
করে দিয়েছি, আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ
করেছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন
হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি।”

আনন্দে আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগল। কারণ আমি জানতাম, যুগ যুগ আগে, পৃথিবী সৃষ্টিরও আগে পরম করুনাময় আল্লাহ এই কোরআন আমার জন্য লিখেছেন। কারণ আল্লাহ জানতেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের চেকতোয়াগার অ্যানা কলিন্স ১৯৮৬ সালের মে মাসে কোরআনের এই আয়াতটি পড়বে।

এখন আমি জানি, আমার অনেক কিছু শেখার আছে। এই যেমন-কিভাবে সহী-শুদ্ধভাবে আমি নামাজ পড়া যায়? সমস্যা হলো আমার সাথে মুসলমান কারো পরিচয় নেই। এখনকার মতো আমেরিকায় আগে এতো মুসলমানের বসবাস ছিল না। তখন আমি জানতাম তা কোথায় তারা থাকেন? আমি ফোনবুকে ইসলামিক সোসাইটির ফোন নাম্বার পেলাম। আমি ফোন করার পর ওপাশ থেকে যখন কেউ কথা বলছে, আমি কোনো কথা বলতে পারতাম না। তারা কি ভাববে এই ভেবে ভয়ে রেখে দিতাম।

এরপর কয়েক মাস আমি একটি মসজিদে কয়েকবার ফোন করলাম। একই অবস্থা, আমি ভয়ে কথা বলতে পারতাম না। নামাজের নিয়ম-কানুন জানতে একদিন সাহস করে ও মসজিদের ঠিকানায় একটি চিঠি লিখলাম।

আল্লাহ সহায় হলেন এবং ওই মসজিদ থেকে এক ভাই আমাকে ফোন দিলেন। তাকে বললাম, আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে চাই।

তিনি এ কথা শুনে বললেন, ‘অপেক্ষা করুন। যখন পুরোপুরি
নিশ্চিত হবেন, তখনই এ সিদ্ধান্ত নিন।’ তার কথা শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু আমি এটাও জানতাম, তিনি ভুল বলেননি। কারণ জানি, যদি একবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি, আমার পুরো জীবন বদলে যাবে।

ওদিকে ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্মের প্রতি আমি দুবর্ল হয়ে যাচ্ছিলাম। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা আমি শুধু এই কথাই ভাবতাম। অনেক সময় উৎসবের দিনে আমি মসজিদের চারদিকে চক্কর দিতাম, যদি কোনো মুসলমানকে দেখতে পেতাম। মসজিদের ভেতরটা দেখার জন্য আমার মন ছুঁটে যেতো কিন্তু …।

অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন এলো, ১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাস। সকালের দিকে আমি রান্না ঘরে কাজ করছিলাম। হঠাৎ কি যেন হলো, আমি ছটফট করতে লাগলাম। সাথে সাথে মসজিদের ওই ভাইয়ের কাছে চিঠি লিখলাম। কারণ কখনো পর্যন্ত মসজিদে যাওয়ার সাহস আমার ছিল না। পরদিন ওই ভাই আমাকে ফোন দিলেন। আমি কালিমায় শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলাম।
তিনি আমাকে বললেন, এই মুহূর্ত থেকে আপনি সদ্য ভূমিষ্ঠ
শিশুর মতো পবিত্র। আল্লাহ আপনার সব গুনাহ মাফ করে
দিয়েছেন।

মনে হলো কাধ থেকে সব পাপের বোঝা পড়ে গেছে। আমি
আনন্দে কেঁদে ফেললাম। ওই দিন সারারাত আমি ঘুমাতে
পারিনি। শুধু কেঁদেছি আর আল্লাহর নাম জপেছি।
আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ।

====================================
লেখক- হায়াৎ অ্যানা কলিন্স ওসামা —
ভাষান্তর : অনুবাদ- বোন (সাবরিনা সোবহান)
কৃতজ্ঞতা – তাবলীগি মেহনতের জীবন্ত কারগুজারি পেজ

ইসলামের অমৃত সুধা পান করার পর এই প্রথম পূজো’বিহীন দিন কাটছে আমার।

ইসলামের অমৃত সুধা পান করার পর এই প্রথম পূজো’বিহীন দিন কাটছে আমার। যদিও এটা আমার জন্য অনেক সৌভাগ্যের, অনেক অশ্লীলতা থেকে বাঁচাতে পারছি নিজেকে।

এই সৌভাগ্য হয়তো সবার হয়না, আল্লাহ তা’লা যাকে হেদায়েত দেন তারই ভাগ্যে জুটে আল্লাহর এই অশেষ রহমত।

পূজায় সবসময় বিশেষ আকর্ষন থাকে গান আর নাচ । পড়ালেখার পাশাপাশি নাচের স্কুলেও ভর্তি হয়েছিলাম । বান্ধবীদের মধ্যে আমি, সুজাতা আর সূবর্ণা ছিলাম খুব কাছের। তিনজনই নাচে খুব পারদর্শী ছিলাম বলে পূজায় সবসময় আমাদের ডাক পড়তো। নিজেকে নিয়ে খুব গর্ব করতাম, এইজন্য যে পূজামন্ডপে নাচের সুযোগ পেয়েছি। যেটা সাধারণত সবার ভাগ্যে জুটে না।

কয়েকবছর আগের ঘটনা, অষ্টমীর দিন! যথারীতি নাচের জন্য আমাদের তিনজনের ডাক পড়লো। আমরাও খুব আগ্রহে ছিলাম। মধ্যরাতে মঞ্চে উঠলাম নাচ করার জন্য। নাচের একপর্যায়ে খেয়াল করলাম মাতাল অবস্থায় মঞ্চে উঠে পড়েছে আমাদের এলাকার এক আধবয়স্ক মানুষ। টাকার প্রভাব ছিলো বলে তাকে কেউ কিছু বললোনা। হঠাৎ সে আমাদের গায়ে হাত দিতে শুরু করলো, রাগে থাকতে না পেরে দিয়ে দিলাম একটা চড়!

দর্শকরা সবাই হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে! যেনো আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি তাকে চড় দিয়ে। অবশ্য অনেকেই খুশিও হয়েছিলো। বিষয়টা বড়দার চোখেও পড়লো, আমাকে মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে চলে গেলাম।

বাবা বললেন, তুই কাজটা ভালো করিস নি, এরকম সামান্য ঘটনার জন্য তাঁকে চড় মারতে হবে কেনো?

আমি বললাম, এটা সামান্য ঘটনা? একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের গায়ে হাত দেয়া সামান্য ঘটনা? ও আচ্ছা এটা তো আমাদের ধর্মেই আছে! যেখানে দেবতারা এরকম অশ্লীলতা করতে পারে সেখানে সাধারণ মানুষের কাছে তো এটা সামান্য ঘটনাই! কথা শেষ না হতেই বাবার হাতের স্টীলের হ্যান্ডেলওয়ালা টর্চটা আমার দিকে ছুঁড়ে মারলো ! এখনো হাতে সেই আঘাতটার চিহ্ন আছে ।

জীবনে সেইদিনই প্রথম বাবার সাথে জোর গলায় কথা বলেছিলাম, বাবাও আমার ব্যবহার দেখে হতবাক! বড়দাও আমার কথা শুনে অবাক! কি বলে ফেলেছি আমি! তাদের চেহারার ভাবমূর্তি দেখে মনে হচ্ছে আমি অনেক বড় পাপ করে ফেলেছি। মা বললেন, যা বলেছিস বলেছিস! আর কোনদিন এরকম কথা মুখেও আনবি না!

সেইদিনের ঘটনার পর থেকে আর কোনোদিন পূজায় নাচতে যায়নি! মনে মনে চিন্তা করলাম, যেখানে নিজের ইজ্জতের কোনো দামই নেই, অন্তত সেটা আমার ধর্ম হতে পারেনা।

আরেকটা চিন্তা সবসময় মাথায় ঘুরপাক খেতো, যখন প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হতো, এর আগমূহুর্তে দূর্গার হাতে সবাই চিঠিতে নিজের ইচ্ছার কথা লিখে বেধে দিতো। আমিও দিয়েছিলাম কয়েকবার! পরক্ষনে ভাবতাম প্রতিমা টা তো পানিতে তলিয়ে যাবে! তাহলে আমাদের ইচ্ছার চিঠিগুলো ভগবানের হাতে কে পৌছাবে?

ইসলাম গ্রহণের পর অন্তত সেই কনফিউশনটা আর নেই! কারণ আমার রাব্বে কারীমের কাছে নিজের ইচ্ছাটা চিঠির মাধ্যমে বলতে হয়না, বলতে হয় জায়নামাযে সিজদায় কান্নারত অবস্থায়! নিজের সব কষ্ট দূর হয়ে এখন প্রশান্তি মন নিয়ে অপেক্ষা করছি নিজের রবের দিদারে। আলহামদুলিল্লাহ।
.

====================================
লিখেছেন, মুবাশ্বিরাহ্ শর্মা – নবমুসলিমা এক বোন।

মীলাদ কিয়াম, সহীহ মীলাদ, ঈদে মীলাদুন্নবী ও জশনে জুলুস প্রসঙ্গ / মুফতী মনসূরুল হক দা.বা.

ইসলামী শরী‘আতে মনগড়া ইবাদতের বৈধতা নেই। ইবাদতের মৌলিক বুনিয়াদ হলোঃ কুরআন এবং সুন্নাহ। এর বাইরে ইবাদতের নামে কোন কিছু করলে সেটা হবে বিদ‘আত ও গোমরাহী। হাদীস শরীফে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ “প্রত্যেক বিদ‘আত গোমরাহী, আর প্রত্যেক গোমরাহী জাহান্নামে টেনে নিয়ে যাবে।” (সুনানে নাসায়ী, হাদীস নংঃ ১৫৭৮)

মীলাদ প্রসঙ্গ

মীলাদ এর আভিধানিক অর্থ জন্ম, জন্মকাল ও জন্ম তারিখ। পরিভাষায় মীলাদ বলা হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা বা জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনার মজলিস।

তবে আমাদের দেশে প্রচলিত মীলাদ বলতে বোঝায় ঐ সব অনুষ্ঠান, যেখানে মওজু’ রেওয়ায়েত সম্বলিত তাওয়ালূদ পাঠ করা হয় এবং অনেক স্থানে দুরূদ পাঠ করার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মজলিসে হাজির-নাজির হয়ে যান-এই বিশ্বাসে কিয়ামও করা হয়। এসব করা হলে মূলত সেটাকে মীলাদ মাহফিল মনে করা হয়, চাই তাতে রাসূলের জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা হোক বা না হোক। পক্ষান্তরে এসব ছাড়া অর্থাৎ তাওয়ালূদ, সমস্বরে ভুল দরূদ তথা ইয়া নবী সালা-মালাইকা… এবং কিয়াম করা না হলে সেটাকে মীলাদ মনে করা হয় না।

মীলাদের হুকুম

মীলাদ বলতে যদি এই অর্থ হয় যে, রাসূলের জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা, তাহলে নিঃসন্দেহে তা কল্যাণ ও বরকতের বিষয়। কিন্তু যদি প্রচলিত অর্থ উদ্দেশ্য হয়, যা উপরে উল্লেখ করা হলো, তাহলে তা কুরআন সুন্নাহের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ বিদ‘আত ও গোমরাহী।

কেননা শরী‘আতের ভিত্তি যে চারটি বিষয়ের উপর তথা কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস, এই চারটির কোনটি দ্বারা উক্ত মীলাদ প্রমাণীত নয়।

দ্বিতীয়ত, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাদেরকে সত্যের মাপকাঠি বলেছেন এবং যাদের যুগকে সর্বোত্তম যুগ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং যাদের আদর্শকে আঁকড়ে ধরতে বলেছেন তারা হলেন সাহবায়ে কিরাম। তাদের কারো থেকে এজাতীয় মীলাদ প্রমাণিত নেই, এবং তাদের কারো যুগেই এর অস্তিত্ব ছিল না। এমনকি চার মাযহাবের ইমামগণের কারো যুগেও তার হদিস ছিল না। এক কথায় রাসূলের যমানা থেকে দীর্ঘ ছয়শত (৬০০) বছর পর্যন্ত এর কোন অস্তিত্ব ছিল না। বরং ৬০৪ হিজরীতে তার সূচনা হয়।

কিয়াম প্রসঙ্গ

কিয়াম শব্দের আভিধানিক অর্থ দাঁড়ানো। আর মুআশারা তথা সামাজিকতায় কিয়াম বলতে বোঝায় কারো আগমনে দাঁড়ানো। আর মীলাদের ক্ষেত্রে কিয়াম বলতে বোঝায় কোন মজলিসে সমস্বরে দরূদ পাঠ করার পর, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত মজলিসে হাজির হয়ে গেছেন,এই ধারণায় ইয়া নবী বলতে বলতে তাঁর সম্মানে দাঁড়িয়ে যাওয়া, এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুরূদ পাঠ করা।

মীলাদের মধ্যে কিয়ামের হুকুম

এক. যখন উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা একথা প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত মীলাদ কুরআন সুন্নাহ ইজমা কিয়াস আমল দ্বারা সাব্যস্ত নয়, এবং খাইরূল কুরুনের যুগে তার কোন অস্তিত্ব ছিল না, তখন কিয়াম বৈধ হওয়ার তো কোন প্রশ্নই আসে না।

উপরোন্তু নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় নিজের জন্য কিয়াম করাকে অপছন্দ করতেন। ফলে সাহাবায়ে কিরাম তাঁর প্রতি অপরিসিম মুহাব্বত ও ভালোবাসা থাকা সত্বেও, তিনি যখন স্বশরীরে উপস্থিত হতেন তখন তাঁকে দেখতে পেয়েও তারা দাঁড়াতেন না। সুতরাং যখন তিনি তাঁর জীবদ্দশায়ই তাঁর সম্মানে দাঁড়ানোকে অপছন্দ করতেন, তখন স্বয়ং রাসূলের অপছন্দনীয় বস্তুকেই রাসূলের জন্য সম্মানের বিষয় নির্ধারণ করা, নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশ করা কিংবা রাসূলের প্রতি অবজ্ঞা ও উপহাস করা ছাড়া, আর কি বলা যেতে পারে!! (আল্লাহ তা‘আলা আমাদের হিফাযত করুন)

দুই. হাদীস শরীফে আছে- হযরত আবূ হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে আমার কবরের নিকট এসে আমার উপর দুরূদ পাঠ করবে আমি তা সরাসরি শুনব, আর যে দূরে থেকে আমার উপর দুরূদ পাঠ করবে তা আমার নিকট পৌঁছানো হবে। (শুআবুল ঈমান হা.নং-১৫৮৩)

অন্যত্র আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- আল্লাহর কতক ফিরিশতা রয়েছেন, যারা গোটা পৃথিবীতে বিচরণ করতে থাকেন, এবং উম্মতের সালাম আমার নিকট পেশ করেন। (দারেমী, হা.নং-২৭৭৪)

সুতরাং তাদের কথা অনুযায়ী যদি রাসূল দরূদের মজলিসে সস্বশরীরে হাযির হয়ে থাকেন, তাহলে উল্লেখিত হাদীসের কি অর্থ থাকে, যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, ফিরিশতা দ্বারা দুরূদ পৌঁছানো হয়। মূলত এটা চরম অজ্ঞতার বর্হিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছুই না।

তিন. কুরআন এবং হাদীসের অসংখ্য দলীল দ্বারা একথা প্রমাণিত যে, রাসূল হাযির-নাযির নন। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই হাযির-নাযির বা সর্বত্র বিরাজমান। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন- (তোহফায়ে আহলে বিদ‘আত, ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত ধারণা)

প্রচলিত মীলাদের ব্যাপারে প্রসিদ্ধ উলামায়ে কিরামের উক্তি

ইমাম সুয়ূতী রহ. বলেন,

প্রচলিত মীলাদ না কুরআন সুন্নাহর কোথাও আছে, না পূর্ববর্তী উম্মতের আদর্শ কোন ব্যক্তি থেকে প্রমাণিত। বরং তা সুস্পষ্ট বিদ‘আত, যার আবিষ্কারক হলো একদল পেটপূজারী। (আল-হাবী লিল ফাতওয়া: ১/২২২-২২৩)

হাফেয সাখাবী রহ. তার ফাতওয়া গ্রন্থে উল্লেখ করেন,

এজাতীয় মীলাদ সর্বোত্তম তিন যুগের সালফে সালিহীনের কারো থেকে সাব্যস্ত নেই। বরং এর পরবর্তী যুগে সূচনা হয়েছে। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ: ১/৩৬২)

আল্লামা আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ মিসরী মালেকী রহ. বলেন,

চার মাযহাবের উলামায়ে কিরাম এজাতীয় প্রচলিত মীলাদ নিন্দণীয় হওয়ার ক্ষেত্রে ঐক্যমত পোষণ করেন। (আল ক্বওলুল মু’তামাদ, পৃষ্ঠা: ১৬২)

সহীহ ও বৈধ মীলাদ

মীলাদের অর্থ হল জন্ম। মীলাদ মাহফিলের উদ্দেশ্য হলো নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে হয়েছে এবং তিনি নবুয়তের ২৩ বছরে উম্মতের জন্য কি কি সুন্নাত বা তরিকা রেখে গেছেন, তার কোন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা, এবং আলোচনা শেষে শ্রোতাগণ নিজস্ব ভাবে হাদীসে বর্ণিত সহীহ দরূদ ৩ বার বা ১১ বার পড়ে নেয়া, তারপর সকলে মিলে দু‘আ মুনাজাত করা। এ হলো সহীহ মীলাদের রূপরেখা। এর মধ্যে কোন গুনাহ নেই, বরং এটা বরকতময় মাহফিল।

ঈদে মিলাদুন্নবী ও জশনে জুলুস প্রসঙ্গ

রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ এলে সমাজের এক শ্রেণীর লোক নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন পালনের নামে জশনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবীর ব্যাপক উৎসব  ও আনন্দমুখর আয়োজন করে থাকে।

একে কেন্দ্র করে দেয়াল লিখন, ব্যানার বানানো, সভা-সমাবেশ, গেইট সাজানো, রাসূলের শানে কাসিদা পাঠ, নকল বাইতুল্লাহ ও রওজা শরীফের প্রতিকৃতি নিয়ে রাস্তায় নারী-পুরুষের সম্মিলিত শোভাযাত্রা, ঢোল-তবলা ও হারমোনিয়াম সজ্জিত ব্যান্ডপার্টির গগণবিদারী নিবেদন (!) গান-বাজনা এবং নারী-পুরুষের উদ্দাম নাচা-নাচি ও অবাধ ঢলাঢলি। অবশেষে মিষ্টি ও তবারক বিতরণ করা হয়ে থাকে। এবং এটাকে মহাপূণ্যের কাজ ও শ্রেষ্ঠ ঈদ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে।

শরঈ দৃষ্টিতে এর হুকুম

এক. ইসলামে কোন মহা-মনীষীর জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালনের বিধান নেই।

যদি থাকত তাহলে বছরের প্রত্যেক দিনই জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালন করতে হতো। কেননা লক্ষাধিক নবী-রাসূল ও লক্ষাধিক সাহাবা এবং শত সহস্র ওলী-বুযুর্গ দুনিয়াতে আগমন করে বিদায় নিয়ে গেছেন। আর তালাশ করলে দেখা যাবে, বছরের প্রত্যেক দিন কোন না কোন নবী কিংবা সাহাবা অথবা কোন বুযুর্গ জন্ম গ্রহন করেছেন কিংবা ইন্তিকাল করেছেন। ফলে সারা জীবন কেবল জন্ম দিবস আর মৃত্যু দিবস পালনের মাঝেই কেটে যাবে। ইবাদত বন্দেগীর সুযোগ হবে না। কখনো দেখা যাবে একই দিনে কোন মহামনীষী জন্ম গ্রহন করেছেন আবার কোন মনীষী ইন্তিকাল করেছেন।  তখন একই দিন জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন করতে হবে। যার পরিণতি হবে সমাজে সর্বদা অশৃঙ্খল-গোলযোগ মারামারি। অথচ ইসলাম মানুষকে সুশৃঙ্খল যিন্দেগী যাপন করা শিখায়।

দুই. নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়ত লাভের পর ২৩ বছর জীবিত ছিলেন। অতঃপর রাসূলের ইন্তিকালের পর সাহাবায়ে কিরাম ১১০ বছর পর্যন্ত দুনিয়াতে ছিলেন। এই সূদীর্ঘ কালের প্রতি বছরই রবিউল আউয়াল মাস আসতো, কিন্তু কোন বছরই না রাসূল স্বয়ং নিজের জন্মদিন পালন করেছেন, এবং না কোন সাহাবা করেছেন।

তিন. জাহেলী যুগে মদীনাবাসীরা (প্রথা অনুযায়ী) দুটি দিনে আনন্দ উৎসব করতো। অতঃপর আল্লাহর রাসূল মদীনায় আগমন করে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য এ দুটি দিনের চেয়ে উত্তম দুটি দিন তথা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। (সুনানে নাসাঈ হা.নং-১৫৫৬)

এর দ্বারা একথা প্রতিয়মান হয় যে, মুসলমান কখনো নিজেরা নিজেদের ঈদ নির্ধারণ করতে পারে না। বরং তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়ে থাকে। আর কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী মুসলমানদের ঈদ হলো দু’টি, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। সুতরাং তৃতীয় কোন দিনকে ঈদ হিসাবে নির্ধারণ হলে, সেটা হবে স্পষ্ট বিদ‘আত ও গোমরাহী। কুরআন-সুন্নাহর সাথে যার আদৌ কোন সম্পর্ক নেই।

সাহাবা, তাবেঈন এবং তাবে তাবেঈন এই তিন সোনালী যুগে এর কোন অস্তিত্ব ছিলো না। কুরআন-সুন্নাহয় ও আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের আলোচনায় দুই ঈদের অধ্যায় আছে এবং মাসাইলের আলোচনা আছে, কিন্তু ঈদে মিলাদুন্নবী নামে না কোন অধ্যায় আছে, না তার ফাযায়েল ও মাসাইলের আলোচনা আছে।

এ ঈদ যেমন মনগড়া, তার পালনের রীতিও মনগড়া। এ ক্ষেত্রে যে সকল ফযীলতের কথা বর্ণনা করা হয়, সে সবও জাল এবং বানোয়াট। নির্ভরযোগ্য কোন হাদীসের কিতাবে সেগুলোর নাম-গন্ধও নেই। প্রমাণের জন্য বাংলা ভাষায় অনূদিত হাদীস ও ফিকহের কিতাবগুলো দেখা যেতে পারে। সেগুলোতে দুই ঈদের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু কথিত শ্রেষ্ঠ ঈদের আলোচনা কুরআন-হাদীসের কোথাও নেই।

ঈদে মীলাদুন্নবীর সূচনা যেভাবে হয়

মুসলিম সাম্রাজ্যে প্রাধান্য বিস্তারকারী খৃষ্টানরা ঈসা ‘আলাইহিস সালামের জন্মদিবস উপলক্ষে“ ক্রিসমাস-ডে” পালন করতো, তাদের সেই আড়ম্বরপূর্ণ জন্মোৎসবের জৌলুসে দূর্বল ঈমানের মুসলমানরা প্রভাবিত হয়ে পড়ে, এবং মুসলিম সমাজে খৃষ্টানদের ন্যায় নবীর জন্ম উদযাপনের রেওয়াজ না থাকায় তারা এটাকে নিজেদের ত্রুটি হিসেবে সাব্যস্ত করে।

এরই ধারাবাহিকতায় ইরাকের মুসেল নগরীতে, স্বেচ্ছাচারী বাদশাহ মালিক মুযাফ্ফর আবু সাঈদ কূকবুরী (মৃত ৬৩০হি.) ৬০৪ হিজরীতে সর্বপ্রথম এই ঈদে মীলদুন্নবীর সূচনা করে। এরপর তার দেখাদেখি অন্য লোকেরাও শুরু করে।

উক্ত বাদশাহ সম্পর্কে ইমাম আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ মিসরী মালেকী লেখেন- সে একজন অপব্যয়ী বাদশাহ ছিলো। সে তার সময়কালের আলেমদের হুকুম দিতো, তারা যেন তাদের ইজতিহাদ ও গবেষণা অনুযায়ী আমল করে এবং অন্য কারো মাযহাবের অনুসরণ না করে। ফলে দুনিয়া পূজারী একদল আলেম তার ভক্ত এবং দলভূক্ত হয়ে পড়ে। (আল কাওলুল মু’তামাদ ফী আমলিল মাওলিদ, রাহে সুন্নাত সূত্রে,পৃষ্ঠা: ১৬২)

উক্ত অপব্যয়ী বাদশাহ প্রজাগণের মনোরঞ্জন ও নিজের জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষে প্রতি বছর ১২ই রবীউল আউয়ালকে কেন্দ্র করে মীলাদুন্নবী উদযাপন করতো। এবং এ অনুষ্ঠানে সে রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে তিন লক্ষ দীনার ব্যয় করতো । (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়াঃ-১৩/১৩৯-১৪০)

অতপর দুনিয়ালোভী দরবারী মৌলবী উমর ইবনে দেহইয়া আবূল খাত্তাব মীলাদ মাহফিল ও জশনে জুলুসের  স্বপক্ষে দলীলাদী সম্বলিত কিতাব রচনা করে বাদশার কাছ থেকে প্রচুর অর্থ কড়ি হাতিয়ে নেয়। তার ব্যাপারে হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, সে আইম্মায়ে দীন এবং পূর্বসূরী উলামায়ে কেরামের ব্যাপারে অত্যন্ত আপত্তিকর ও গালিগালাজ মূলক কথাবার্তা বলত। সে দুষ্টভাষী, আহমক এবং অত্যন্ত অহংকারী ছিল। আর ধর্মীয় ব্যাপারে ছিল চরম উদাসীন। (লিসানুল মিযান: ৪/২৯৬)

তিনি আরো বলেন- আমি মানুষদেরকে তার ব্যাপারে মিথ্যা ও অবিশ্বাস যোগ্যতার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ পেয়েছি। (লিসানুল মিযান ৪/২৯০)

মুহাক্কিক উলামায়ে কিরামের দৃষ্টিতে মীলাদুন্নবী

১. আল্লামা তাজুদ্দীন ফাকেহীনী রহ. ছিলেন মীলাদ উদ্ভবকালের একজন সুপ্রসিদ্ধ আলেম। তিনি মীলাদের প্রতিবাদে এক মূল্যবান কিতাব রচনা করেছেন। কিতাবটির নাম “আল মাওরিদ ফিল কালামিল মাওলিদ” উক্ত গ্রন্থে তিনি লিখেছেন-“মীলাদের এই প্রথা না কুরআনে আছে, না হাদীসে আছে। আর না পূর্বসূরীদের থেকে তা বর্ণিত আছে। বরং এটি একটি বিদ‘আত কাজ, যাকে বাতিলপন্থি ও স্বার্থপরগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে। আর পেট পূজারীরা তা লালন করেছে”। (বারাহীনে ক্বাতিআঃ-১৬৪)

২. আল্লামা ইবনুল হাজ্জ মালেকী রহ. যাকে মীলাদের গোঁড়া সমর্থক মৌলভী আহমদ রেজা খাঁ বেরেলভী ইমাম বলে আখ্যায়িত করেছেন, তিনি মাদখাল নামক গ্রন্থে লিখেছেন “লোকেরা যে সমস্ত বিদ‘আত কাজকে ইবাদত মনে করে এবং এতে ইসলামের শান শওকত প্রকাশ হয় বলে ধারণা করে, তন্মধ্যে রয়েছে মীলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান। রবীউল আউয়াল মাসে বিশেষ করে এ আয়োজন করা হয়, বস্তুত এসব আয়োজন অনুষ্ঠান অনেক বিদ‘আত ও হারাম কাজ সম্বলিত হয়”। (মাদখালঃ-১/৯৮৫ আল মিনহাজুল ওয়াজিহঃ-২৫২)

৩. আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. লিখেছেন-প্রচলিত এই মীলাদ অনুষ্ঠান যা সালফে সালিহীনের যুগে ছিল না। যদি এ কাজে কোন ফযিলত ও বরকত থাকত , তবে পূর্বসূরীরা আমাদের চাইতে বেশী হকদার ছিলেন ,কারণ তারা নবী প্রেমের ক্ষেত্রে আমাদের চাইতে অনেক অগ্রগামী এবং ভাল কাজে অধিক আগ্রহী ছিলেন। (ইকতিজা উসসিরাতিল মুস্তাকিমঃ-২৬৫)

৪. আল্লামা ইবনে হাজার আসক্বালানী রহ. কে প্রশ্ন করা হয়, মীলাদ অনুষ্ঠান কি বিদ‘আত? না শরী‘আতে এর কোন ভিত্তি আছে? জবাবে তিনি বলেন-মীলাদ অনুষ্ঠান মূলত বিদ‘আত । তিন পবিত্র যুগের সালফে সালিহীনের আমলে এর অস্তিত্ব ছিল না। (হিওয়ার মাআল মালিকীঃ-১৭৭)

৫. কুতুবুল আলম রশীদ আহমদ গংগুহী রহ. এক প্রশ্নের জবাবে লিখেন-“মীলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান সর্বাবস্থায় নাজায়িয। মনদুব কাজের জন্য ডাকাডাকি করা শরী‘আতে নিষিদ্ধ”। আল্লাহ সর্বজ্ঞ। অন্যত্র লিখেন- “বর্তমান যুগের মাহফিলগুলো যথা মীলাদ, ওরশ, তিন দিনা, চল্লিশা, সবই বর্জন করা দরকার। কেননা, এগুলোর অধিকাংশ গুনাহ ও বিদ‘আত থেকে মুক্ত নয়”। (ফাতওয়া রশীদিয়াঃ-১৩১)

৬. হাকীমুল উম্মত শাহ আশরাফ আলী থানবী রহ. প্রচলিত ঈদে মীলদুন্নবীর যৌক্তিকতা খন্ডনের পর লিখেন – “মোট কথা, যুক্তি ও শরী‘আত উভয় দিক দিয়ে প্রমাণিত হল যে, এই নবোদ্ভাবিত ঈদে মীলাদুন্নবী নাজায়িয, বিদ‘আত এবং পরিত্যাজ্য”। (আশরাফুল জওয়াবঃ-১৩৮)

৭. সৌদি আরবের প্রধান মুফতী আল্লামা শায়েখ আব্দুল আযীয বিন বায রহ. এর ফাতওয়ায় তিনি এক প্রশ্নের জবাবে লিখেন-কুরআন সুন্নাহ তথা অন্যান্য শর‘ঈ দলীল মতে ঈদে মীলাদুন্নবীর আয়োজন অনুষ্ঠান ভিত্তিহীন, বরং বিদ‘আত। এতে ইহুদী, খৃষ্টানদের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এসব অনুষ্ঠানে মুসলমানদের যোগদান করা নাজায়িয। কেননা, এর দ্বারা বিদ‘আতের সম্প্রসারণ ও এর প্রতি উৎসাহ যোগানো হয়। (মাজমুউল ফাতওয়াঃ-৪/২৮০)

সুতরাং উল্লেখিত আলোচনার ভিত্তিতে শর‘ঈ দৃষ্টিতে দীনের নামে এ জাতীয় অনুষ্ঠান উদযাপন করা মারাত্মক বিদ‘আত ও না-জায়িয প্রমাণিত হয়, যা বর্জন করা সকলের জন্য জরুরী।

সুরা আসর – আকারে ছোট হলেও লাইফের সব নির্দেশনা আছে।

একটা জিনিস খুব করে মন থেকে চাচ্ছেন, “ওহ আল্লাহ! আমাকে এ জিনিসটা মিলিয়ে দাও, আমার জন্য এ কাজটা সহজ করে দাও।”

কিন্তু কই! আল্লাহ তো দিলেন না! এত দিন ধরে মনের একান্ত আবেগ-অনুভুতি মিশিয়ে আল্লাহর কাছে চেয়েছি আল্লাহ তো দিলেন না!

দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে সবর করেই আছি কিচ্ছুই তো হচ্ছেনা, অবস্থা তো পরিবর্তন হচ্ছেনা! আল্লাহ তো আমার দিকে দেখছেন না! আমাকে দয়া করছেন না! আমার দিকে তাঁর রহমত, করুনার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন না!

আমাদের সবার জীবনে এমন কিছু না কিছু আছেনা? অবশ্যই আছে। এটাই জীবন। কেন পাইনা? আল্লাহ কৃপণ? – নাহ!
তাহলে আমি যা চাই দিয়ে দিলে ক্ষতি কি?
-তিনি কি আল-‘আলীম (ভুত-ভবিষ্যত সর্বজ্ঞাতা) নন?

দিয়ে দিলেই যদি সব ঝামেলা চুকে যেত তবে তাঁর ক্ষতি কি! কিন্তু তিনি তো জানেন কোনটা কখন কিভাবে আমার জন্য কল্যাণকর। আমার মা-বাবাও তো আমাকে এমন কিছু দিবেন না যেটা আমার জন্য অকল্যাণকর। যেদিন মা পড়াশোনার জন্য বাসা থেকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিলেন সেদিন মাকে মনে মনে শত্রুই মনে হলো।

তিনি আমার ভালো চান না! কেন আমাকে হোস্টেলে পাঠালেন! ঐখানে পাঠিয়ে তিনি মনে হয় আপদ বিদায় করতে চাচ্ছেন! এরা কেউ আমার ভালো চায়না! আজ পদে পদে বুঝি সেদিনের মায়ের ডিসিশান আমার অপছন্দ হলেও আজ সেটা আমার জন্য কত বড় কল্যাণ বয়ে এনেছে! আল্লাহু আকবর! মায়ের সিদ্ধান্তে যদি এইরকম সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকে তাহলে আমার রব যিনি আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাঁর সিদ্ধান্ত আমার জন্য কত বড় কল্যাণকর সেটা আমরা কেন ভুলে যাই!

আজ আমি যা পাবার জন্য ‘দাও, দাও’ করে দুনিয়া মাথায় তুলছি, আল্লাহর কাছে তা কল্যাণকর হলে কিসে রব্বে কারীমকে আটকাতো আমার উপর নিয়ামতের বৃষ্টি বর্ষণ করতে? আমি তো তার উপর ঈমান এনেছি হয়তো প্রিয় বান্দা হতে পারি নাই কিন্তু তিনি তো আমাকে আমার ঐ মায়ের তুলনায় অনেক অনেক বেশি ভালোবাসেন যিনি এক মূহুর্তের জন্যও আমার ক্ষতি হোক এমন কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না, মানতে পারেন না! ‘

বছরের পর বছর কিংবা মাসের পর মাস যে নিয়ামাহ খুঁজে খুঁজে সবরের বাঁধ ভেঙে পড়ছে; একটি বার কি চিন্তা করে দেখেছি-
হয়ত আমার আকাঙ্ক্ষা আকুতি রব্বের কাছে প্রিয়জনের বুলির মত মধুর। এই আকুতির ভালবাসায় তিনি বৃষ্টির মত অঝোর ধারায় ঢেলে দিতে চান কল্যাণ….

কেবল সময়ের অপেক্ষা। বান্দা আর কিছুটা সময় কাটাক না আকুতি মাখা বিনয়ে। এ যে আল-ওয়াদুদের সাথে ছোট্ট মাখলুকের এক গভীর বন্ধন।

আমরা তো বড়ই অকৃতজ্ঞ; পেয়ে গেলাম তো ভুলে গেলাম! এর চেয়ে এটা কি উত্তম না যে, এমন জিনিস যেটা আল্লাহ দেননি তার জন্য আমি আল্লাহর আরো কাছাকাছি যেতে পেরেছি, কান্নাকাটি করে বুঝতে শিখেছি দুনিয়াই সব পাওয়ার জায়গা নয়। এখানে পেয়ে গেলাম তো ভুলে গেলাম। তার চাইতে এখানে না পাওয়া সব একত্রে জমা থাক যেদিন আল্লাহ এখানকার সব চাওয়া পাওয়া গুনে গুনে বহগুণে বাড়িয়ে দিবেন। সেদিন আমার কোন ইচ্ছাই তিনি অপূর্ণ রাখবেন না।

আমার রব দয়াময়। তিনি তো চাইলেই দিয়ে দিতে পারতেন। তিনি ইচ্ছা করা মাত্রই তা হয়ে যেত। তার আগে আমার নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার,
“আমি কি আমার ইখলাস(নিষ্ঠা), আমলে, আখলাকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছি আমার রবকে?” হয়তোবা আল্লাহ আরো একটু সময় দিচ্ছেন, তিনি আমাকে আরেকটু কাছে চান, তাঁর আরো কাছে আমার যায়গা তিনি পছন্দ করেছেন। হয়তোবা আমার আরো আকুলতা, আরেকটু অশ্রু ঝরানো আমাকে তার কাছে পোঁছে দিতে সাহায্য করবে! আমাকে তাঁর প্রিয় করে তুলবে! তিনি যে বান্দার অশ্রুমাখা প্রার্থনা বড্ড বেশি ভালোবাসেন!

যখন কিছু না-পাওয়ার আকুতি ভেতরকে পেরেশান করে তোলে, তখন চাওয়ায় তীব্রতা আরো বেশি বাড়ে।বাড়ে ইখলাসও, অন্তর থেকে উঠে আসা আকুতিগুলো দুয়ার রূপ নেয়, বুকের গভীর থেকে উঠে আসা আক্ষেপগুলো অশ্রুতে রূপ নেয়……..

আপনি যখন সুখে থাকবেন দেখবেন আল্লাহর কাছে জানানো তখনকার মনের আকুতিগুলো আর যখন দুঃখে কষ্টে থাকবেন তখনকার দুয়াগুলোর আকুতি-আন্তরিকতা কখনো এক নয়!
দুঃখের দিনের দু’আগুলো হয় বাদশাহের কাছে নি:স্ব অসহায় ভিখারী প্রজার মত।

রব্বে কারীমের সাথে এটাই বড় বন্ধন। আমরা তো রব্বের সাথে এই বাঁধনে বাঁধা।

আল্লাহর রাসুল (সা) দুনিয়ার জীবনে এক মূহুর্তের জন্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে প্রাধান্য দেন নাই!
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ সুখ-সমৃদ্ধি-সম্পদের পাহাড় দিতে চেয়েছিলেন। তিনি বেছে নিয়েছিলেন ক্ষুধার্ত-শোকসংকুল জীবন। এক বেলা খাওয়া তো আরেক বেলা উপবাসের জীবন আর না হয় খাদ্যের অভাবে আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট হয়ে রোজা থেকে কাটিয়ে দেওয়া জীবন।

আয়িশা রাযি. বলেন, আল্লাহর রাসুলের জীবদ্দশায় একটানা তিন বেলা কখনো পেট ভরে খেতে পায়নি। সুবহানআল্লাহ! এ ছিল দুনিয়া এবং আখিরাতের বাদশার জীবন! চাইলে তো উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহ তাঁকে দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন!

আল্লাহর রাসুল (সা) এভাবেই আল্লাহর প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন,
“সে প্রেমময় রব্ব, আমি একদিন কিছু খেয়ে তৃপ্ত হয়ে তোমার শোকরে লুটিয়ে পড়ব, অন্যদিন ক্ষুধায় কাতর হয়ে সব দু:খ-ব্যথা বুকে নিয়ে সবর করব।

আমি তোমারই নিষ্ঠাবান বান্দা ছিলাম, তেমনি আছি। অভাব দুর্দশা আমাকে তোমার থেকে পৃথক করেনি।”
-এটাই কি প্রকৃত ভালবাসা নয়? বান্দার সাথে রবের প্রেমময় আকুতি নয়?

আমরা কেন বুঝিনা যে, আমাদের রব চাচ্ছেন আমাদের আরেকটু এগিয়ে নিতে। তিনি পথ খুলে দিচ্ছেন এভাবে তাই একটু সময় লাগছে। তিনি চান আরেকবার রাতের শেষ প্রহরে নির্জনে আমি তাঁর সাথে একান্তে কথা বলি, আরেকটু বিশ্বাসের বাঁধন গভীর হোক। আরো একবার আকুতি করে বলি “ইয়া কারীম, তুমি দাও। ইয়া রহমান, তুমি সহজ করো”।

একটু অপেক্ষা, আরো কিছুটা সময় সবর করাটা খুব নিন্দনীয় কিছু মনে হচ্ছে? যদি একটু সবরের বিনিময়ে জান্নাতের পথে একটু একটু অগ্রসর হই! তারপরও আমি অনুশোচনায় ভুগবো, ডিপ্রেশনে থাকব? উঁহু না। কখনোই না!

একেক টুকরা সবরের বিনিময় জান্নাত! একেক টুকরা জান্নাত। নিয়ামতে ডুবে জান্নাত কিনে নেয়া এত সহজ ছিল না। ফেরআউন পারেনি। আসিয়া (আ) পেরেছেন! দাম্ভিক আবু জাহেল পারেনি, ক্রীতদাস বিলাল (রদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তা কিনে নিয়েছেন।’

একেকটা দিনের সবর, একেকটা যুদ্ধ, ময়দানে হোঁচট খাওয়া প্রত্যেকটা আঘাত আল্লাহ দেখছেন। তিনি ফেলে দেবেন না। আপনার প্রতিটা দীর্ঘশ্বাসের ব্যাপারে যিনি খবর রাখেন তিনি আল্লাহ। তিনি কি আপনাকে এর বিনিময় দিবেন না? তা কি করে হয়! কাফিরদেরও তিনি দুনিয়ার শান-শওকত ভোগ করাচ্ছেন আর আপনি তো তার উপরই ঈমান এনেছেন। তাকেই রব হিসাবে মেনে নিয়েছেন। নিজের দুঃখ অস্থিরতা তার সমীপেই নিবেদন করেছেন।

আল্লাহ বলছেন “যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কার নষ্ট করি না।” (সূরা কাহফ:30)

কে কত পেয়েছে, কে কত সম্পদের পাহাড় বানিয়েছে, কে কত কম সময়ে পুরস্কার জিতেছে, নিয়ামতের বন্যায় ডুবে গেছে …এগুলো চেয়ে চেয়ে দেখা আর টুক করে আক্ষেপের শ্বাস ফেলার জন্য আল্লাহ আপনাকে আমাকে সিলেক্ট করেননি। আপনার পজিশন ইউনিক। তিনি নির্ধারণ করেই রেখেছেন। চলুন, সম্পর্কটা আরেকটু এগিয়ে নিই, আরেকটু কাছে।

ফেরাউনের অসহনীয় অত্যাচারে প্রাণ দিয়ে বিনিময়ে আল্লাহর ‘কাছে’ জান্নাতে একটা ঘর চাইতে হয়, একজন তো তা-ই দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। কি ছিল তাঁর?
আগলে রাখার মত নেককার স্বামী, নাকি ধার্মিক ফ্যামিলি সাপোর্ট; নাকি এজুকেশনাল/প্রফেশনাল কোয়ালিফিকেশন, নাকি গোটা চারেক সদকায়ে জারিয়া সন্তান??
উঁহু না! এসবের কিচ্ছুই ছিল না তাঁর!

আমরা সবকিছু সহজ চাই। না পেলে তড়পাই। অন্যেরটা দেখে মিইয়ে যাই।
দুনিয়া এজন্য নয়। ডিফিকাল্টি ইজ লাইফ, লাইফ ইজ ডিফিকাল্টি।
কে কয়টা ধাপ পার করছে তা মেপে মেপে বিনিময় দেয়া হবে হাশরে। ডিফিকাল্টিগুলো তাকওয়া(আল্লাহভীতি) আর তাওয়াক্কুল(ভরসা) দিয়ে হ্যান্ডেলিং এ কে কত চৌকস, সাকসেস এর মানদণ্ড তাতেই নির্ধারিত হয় আল্লাহর কাছে এবং শেষবেলায়(আখিরাতে)।

টার্গেট আল্লাহর রাসুল (সা) আর তাঁর সাথীদের মিসকীনের জীবন নাকি দুনিয়ার বিলাসিতা, ভোগ, আর দাম্ভিকতায় পরিপূর্ণ এক জিল্লাতের জীবন?

কিসে আপনি সন্তুষ্ট? গোলামীর জীবনে নাকি সিনা টান টান করে মাথা উঁচু করে গায়রেতের সাথে বেঁচে থাকার জীবনে! তাগুতের ভয়ে হককে গোপন করা জীবন নাকি তাগুতের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে চলা সেই কন্টাকীর্ন জীবন যা বেছে নিয়েছেন যুগে যুগে নবী রাসুল আর তাদের সঙ্গী-সাথিরা!

“কালের শপথ!
নিশ্চই মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ।
কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের।” (সুরা আছর)

সুবহানআল্লাহ! সুরা আসর নামের ছোট্ট সুরার ৩টা মাত্র আয়াতে লাইফের সব নির্দেশনা আছে। একদম সব। একজন মুমিনের পুরো জীবনের গাইডলাইন।

আজ থেকে আমরা যেনো অন্তরে এ জিনিসগুলা সেট করে নেই, “পরিস্থিতি যাই হোক না কেন আমি হক্বের উপর থাকবো, সবর করব, সৎকর্মে এগিয়ে যাবো ইন শা আল্লাহ। আমি শুধু জানি, ‘কি আমার চাই’ কিন্তু আল্লাহ তো জানেন আসলেই আমার জন্য কখন কি দরকার। আমাদের রব তো এমন নন যে, বান্দা তাঁর কাছে আসতে চাইবে আর তিনি তা কঠিন করে দিবেন।

আল্লাহর সাথে ব্যাবসা !

আল্লাহর সাথে ব্যাবসা!
————————-
আপনি কি জানেন যে, আজও সৌদি আরবের একটি ব্যাংকে হযরত উসমান ইবনে আফফান রা. -এর একটি একাউন্ট রয়ে গেছে?! আপনি কি উসমান ইবনে আফফান টাওয়ারের কাহিনী জানেন, বর্তমানে যেটি মসজিদে নববীর পাশে নির্মাণাধীন?! সেখানে কি আজও উসমান বিন আফফান রা. – এর বংশধররা রয়ে গেছে, যাঁরা তাঁর নামে এই টাওয়ারটি নির্মাণ করছেন?! ইহা এক লোমহর্ষক কাহিনী! তাহলে শুনা যাক-

মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরতের পর যখন দিন দিন মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে থাকলো, ততবেশি পানিরও প্রয়োজন বাড়তে থাকলো। মদীনায় যে কূপ থেকে সবচেয়ে বেশি পানি সরবরাহ করা হতো, তার নাম ছিলো রূমা কূপ। কিন্তু এই কূপটি ছিলো একজন ইহুদীর। ইহুদী অত্যন্ত শক্তদিলের আদমী ছিলো। সে একফোঁটা হলেও পানিকে বিক্রি করতো!

হযরত উসমান রা. – বিষয়টি জানতে পারলেন। তিনি ইহুদীর কাছে এসে কূপটি বিক্রয় করার আবেদন করলেন। কিন্তু ইহুদী তা প্রত্যাখ্যান করে বসলো। তিনি কূপের অর্ধেক বিক্রয় করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। এভাবে যে, কূপটি পালাক্রমে একদিন তাঁর মালিকানায় থাকবে। আরেকদিক ইহুদীর। আর ইহুদী তার মালিকানার দিন পানি বিক্রি করবে। এবার ইহুদী সম্মতি প্রকাশ করলো। কারণ, সে মনে করে করলো, এবার আগের চেয়ে ক্রেতা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। আবার অর্ধেক কূপের দাম তো পকেটেই আছে! কিন্তু ঘটলো তার বিপরিত। পানি বিক্রির ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলো! একজনও ক্রেতার খবর নাই! ইহুদীর আশ্চর্যেরও সীমা নাই! ইহুদী অনুসন্ধান করে জানতে পারলো যে, উসমান রা. – তাঁর মালিকানাধীন অর্ধেক কূপ মানুষের জন্য আল্লাহর ওয়াস্তে ওয়াকফ করে দিয়েছেন।

মানুষেরা তাঁর মালিকানার দিন ফ্রি তে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নিয়ে যায়, তাই তার (ইহুদীর) মালিকানার দিন আর প্রয়োজন পড়েনা! ইহুদীর তো মাথায় হাত! সে তড়িৎ উসমান রা. – এর কাছে গিয়ে পুরো কূপটি খরিদ করে নেয়ার অনুরোধ করতে লাগলো। তিনি ২০ হাজার দিরহামের বিনিময়ে পুরো কূপটি কিনে নিলেন। পুরোটাই আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দিলেন।

কিছুদিন পর তাঁর কাছে একজন সাহাবি আগমন করে দ্বিগুণ মূল্যে কূপটি খরিদ করতে চাইলেন। উসমান রা. – বললেন, এর চেয়েও বেশি মূল্য আমার সামনে পেশ করা হয়েছে, কিন্তু আমি দেইনি। ঐ সাহাবি তিনগুণ মূল্য দিয়ে খরিদ করতে চাইলেন। উসমান রা. – বললেন, এর চেয়েও বেশি মূল্য পেশ করা হয়েছে এ, তবুও আমি দেইনি। এবার ঐ সাহাবি আশ্চর্য হয়ে বললেন, এরকম চড়ামূল্য দিয়ে ক্রেতা আমি ব্যতিত আর কাউকে পাবেননা আপনি! উসমান রা. – বললেন, ভালো কাজের প্রতিদান স্বরূপ আল্লাহ আমাকে দশগুণ দান করবেন!

উসমান রা. – কূপটি ওয়াকফ করে দিলেন। কিছুদিনের মধ্যে কূপের আশেপাশের খেজুরগাছগুলো খুব দ্রুত বাড়তে লাগলো। কালের আবর্তে হয়ে গেলো এক বিশাল খর্জুর বিথিকা। এভাবে আসলো উসমানী খিলাফাহর যুগ। উসমানী খিলাফাহ বাগানটাকে খুবই পরিচর্যা করলো। উসমানী খিলাফাহর পতনের পর আসলো সৌদি সরকারের আমল। সৌদি সরকার বাগানটির আরও যত্ন নিলো। এমনকি বাগানের খেজুর গাছের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো ১৫৫০-এ!

সৌদি সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় একটি প্রসংশনীয় অবস্থানে উত্তীর্ণ হলো। কৃষি মন্ত্রণালয় বাগানের আহরিত খেজুর আরব সহ বিশ্ববাজারে রফতানি করে বিরাট লাভের অধিকারী হতে লাগলো। লাভের অর্ধেক ইয়াতিম ও ফকির-মিসকিনদের জন্য ব্যয় করতে লাগলো আর বাকি অর্ধেক উসমান রা. এর নামে একাউন্ট খুলে সঞ্চিত করতে শুরু করলো। একাউন্ট পরিচালনা করতে লাগলো স্বয়ং সরকারী মন্ত্রণালয়।

এভাবে লাভ শুধু বাড়তেই থাকলো বাড়তেই থাকলো। একসময় একাউন্টে এমন পরিমাণ সম্পদ সঞ্চিত হলো যে, যা দিয়ে মসজিদে নববীর পাশেই সদর এলাকায় একটা জমি কেনা যাবে। অতঃপর মসজিদে নববীর পাশেই একটি জমি কিনে ‘উসমান ইবনে আফফান রা. – টাওয়ার’ এর কাজ শুরু হলো ঐ লাভ থেকেই। বর্তমানে টাওয়ারের কাজ শেষ পর্যায় চলে এসেছে। অচিরেই টাওয়ারটি টাওয়ার কমিটিকে পাঁচটি মেয়াদে ভাড়া দেয়া হবে। বার্ষিক ভাড়া আসবে ৫০ মিলিয়ন সৌদি রেয়াল! অর্ধেক ইয়াতিম ও ফকির-মিসকিনদের একাউন্টে, আর বাকি অর্ধেক উসমান রা. – এর? একাউন্টে।

খুশির বিষয় হচ্ছে, যে জমিতে টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে, সেই জমিকে চিরস্থায়ীকালের জন্য ‘উসমান ইবনে আফফান রা. – এলাকা’ নামে রেজিষ্ট্রি করা হয়েছে!

আল্লাহু আকবার! ইহা আল্লাহ তা’লার সাথে ব্যবসার ফল! যে ব্যবসা ১৪ টি শতাব্দীকাল ধরে চলমান!! জানিনা উসমান রা. – এর আমলনামায় লিখিত পূণ্যের পরিমাণ কতটুকু?!


সুত্র- আরবের জনপ্রিয় ফেইসবুক পেইজ (قصص و عبر) হতে অনূদিত।

দাম্পত্য জীবনের মাধুর্য ও তিক্ততা : ইসলামের নির্দেশনা

আল্লাহ তাআলার অশেষ শুকরিয়া। তিনি মুসলমানকে ইসলামের মতো পূর্ণাঙ্গ দ্বীন দান করেছেন। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত আদায় করার পথ ও পন্থা যেমন বলে দিয়েছেন তেমনি লেনদেন, আচার-আচরণ, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন কেমন হবে তাও জানিয়ে দিয়েছেন।

বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে দাম্পত্যজীবন ও পারিবারিক জীবনের সূচনা হয়। ইসলামী শরীয়তে এই সম্পর্ক কায়েম করতে হলে যেমন সুনির্ধারিত কিছু বিধান রয়েছে তেমনি প্রয়োজনে এই সম্পর্ক ছিন্ন করতে হলেও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। কুরআন-হাদীসে সেগুলো অনুসরণ করারও জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। যদি সেই বিধানগুলো মান্য না করা হয় তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করা হবে, যা একটি মারাত্মক গুনাহ।

সাথে সাথে এই অমান্য করার কারণে জীবনের পদে পদে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে এবং অসংখ্য বালা-মুসীবতে নিপতিত হতে হবে, যার বাস্তব নমুনা আমাদের সমাজ জীবনে প্রতিদিন সৃষ্টি হচ্ছে এবং পেপার-পত্রিকায় সেগুলো শিরোনাম হচ্ছে। বিশেষত শরীয়ত পরিপন্থী পদ্ধতিতে তালাক প্রদান করে দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটালে যে পেরেশানি ও জটিলতা সৃষ্টি হয় তা বর্ণনাতীত।

বিবাহ করার উদ্দেশ্য তালাক দেওয়া নয়

বিবাহের মাধ্যমে যে দাম্পত্য সম্পর্কের সূচনা হয় তা অটুট থাকা এবং আজীবন স্থায়ীত্ব লাভ করা ইসলামে কাম্য। সুতরাং স্বামী কখনও বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করার চেষ্টা করবে না এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের পরিস্থিতিও সৃষ্টি করবে না। কেননা বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হলে এর কুপ্রভাব শুধু স্বামী-স্ত্রীর উপর সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং গোটা পরিবারটিই তছনছ হয়ে যায়, সন্তান-সন্ততির জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কোনো কোনো সময় এই ঘটনার জের পরিবারের গন্ডি অতিক্রম করে বংশীয় কোন্দলে পরিণত হয় এবং সামাজিক জীবনে এর অত্যন্ত খারাপ প্রভাব পড়ে।

এজন্য যে সকল কারণে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয় সেগুলো দূর করার জন্য ইসলামী শরীয়ত বিভিন্ন বিধান দিয়েছে এবং এ বিষয়ে কুরআন-হাদীসে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। প্রথমে বুঝিয়ে-শুনিয়ে সমাধান করতে বলা হয়েছে। এরপর স্ত্রীর সাথে শয্যা ত্যাগ, সতর্ক করা, শাসন করার পথ অবলম্বন করার আদেশ করা হয়েছে। এতটুকুতে মীমাংসা না হলে উভয় পক্ষে দুজন শালিস নিযুক্ত করে একটি চুড়ান্ত ফয়সালায় উপনীত হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। এগুলো হল দাম্পত্য জীবনে ইসলামী হেদায়েতের অনন্য বৈশিষ্ট্য। আফসোস! আমাদের যদি বোধোদয় হত এবং ইসলামী নির্দেশনাকে আদর্শ বানাতে পারতাম! সুতরাং আবেগের বশিভূত হয়ে নয়; বরং বুঝে-শুনে, চিন্তা-ফিকির করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

স্বামী-স্ত্রীর প্রতি কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা

সাধারণত বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার পিছনে মৌলিক যে কারণগুলো থাকে সেগুলো হল, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের হক যথাযথ আদায় না করা। একজন অন্যজনকে গুরুত্ব না দেওয়া। কথায়-কাজে অযথা দ্বিমত পোষণ করা। একে অন্যের প্রতি আস্থা না রাখা, বিশ্বাস না করা। এ সকল কারণে একসময় তাদের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ চরমে পৌঁছে এবং দাম্পত্য জীবন ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়। সুতরাং উভয়ের কর্তব্য হল, পরস্পরের হকগুলো যথাযথভাবে জানা এবং তা আদায় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। কোনো ক্ষেত্রে দোষ-ত্রুটি হয়ে গেলে তা অকপটে স্বীকার করে নেওয়া এবং অতি দ্রুত সেটাকে শুধরে নেওয়া। এভাবে সবকিছুকে সহজভাবে মেনে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। তাহলে সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে। এরকম শুধরে নেওয়া ও মেনে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে না তুললে সামান্য মনোমালিন্যেও অন্তরে প্রচন্ড কষ্ট অনুভব করবে। এখানে স্বামী-স্ত্রীর কিছু শরয়ী হক তুলে ধরা হল।

স্বামীর ওপর স্ত্রীর হকসমূহ

  • স্ত্রীর সাথে সর্বদা ভালো আচরণ করা।
  • স্ত্রীর কোনো কথায় বা কাজে কষ্ট পেলে ধৈর্য্য ধারণ করা।
  • উচ্ছৃঙ্খল, বেপর্দা চলাফেরা করতে থাকলে নম্র ভাষায় তাকে বোঝানো।
  • সামান্য বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া-বিবাদ না করা। কথায় কথায় ধমক না দেওয়া। রাগ না করা।
  • স্ত্রীর আত্মমর্যাদায় আঘাত করে এমন বিষয়ে সংযত থাকা। শুধু শুধু স্ত্রীর প্রতি কুধারণা না করা। স্ত্রীর সম্পর্কে উদাসীন না থাকা।
  • সামর্থ্যানুযায়ী স্ত্রীর খোরপোষ দেওয়া। অপচয় না করা।
  • নামায পড়া এবং দ্বীনের আহকাম মেনে চলার জন্য উৎসাহ দিতে থাকা। হায়েয-নেফাসের মাসআলাগুলো ভালোভাবে শিক্ষা দেওয়া। শরীয়ত পরিপন্থী কাজ থেকে বিরত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা।
  • একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের মাঝে সমতা রক্ষা করা।
  • চাহিদানুযায়ী তাদের সাথে মেলামেশা করা।
  • অনুমতি ব্যতীত আযল অর্থাৎ মেলামেশার সময় শেষ মুহূর্তে স্বাভাবিক স্থান ত্যাগ না করা।
  • একান্ত নিরুপায় না হলে তালাক না দেওয়া এবং প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শরীয়ত-গৃহীত পন্থায় তালাক দেওয়া।
  • প্রয়োজন মাফিক থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা।
  • মাঝে মাঝে স্ত্রীর নিকটাত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাত করার সুযোগ করে দেওয়া।
  • স্ত্রীর সাথে মেলামেশার চিত্র অন্যের কাছে বর্ণনা না করা।
  • প্রয়োজনে স্ত্রীকে শাসন করা। সতর্ক করা। শরীয়ত যতটুকু অনুমতি দিয়েছে তার চেয়ে বেশি হাত না তোলা।

স্ত্রীর ওপর স্বামীর হকসমূহ

  • সর্বদা স্বামীর মন জয় করার চেষ্টা করা।
  • স্বামীর সাথে অসংযত আচরণ না করা। স্বামীকে কষ্ট না দেওয়া।
  • শরীয়তসম্মত প্রত্যেক কাজে স্বামীর আনুগত্য করা। গুনাহ এবং শরীয়ত বিরোধী কাজে অপারগতা তুলে ধরা এবং স্বামীকে নরম ভাষায় বোঝানো।
  • প্রয়োজনাতিরিক্ত ভরণ-পোষণ দাবি না করা।
  • পরপুরুষের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক না রাখা।
  • স্বামীর অনুমতি ছাড়া কাউকে ঘরে ঢোকার অনুমিত না দেওয়া।
  • অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া।
  • স্বামীর সম্পদ হেফাযত করা। অনুমতি ছাড়া সেখান থেকে কাউকে কোনো কিছু না দেওয়া।
  • স্বামীকে অসন্তুষ্ট করে অতিরিক্ত নফল নামাযে মশগুল না থাকা। অতিরিক্ত নফল রোযা না রাখা।
  • স্বামী মেলামেশার জন্য আহবান করলে শরীয়তসম্মত কোনো ওযর না থাকলে আপত্তি না করা।
  • স্বামীর আমানত হিসেবে নিজের ইজ্জত-আব্রু হেফাযত করা। কোনো ধরনের খেয়ানত না করা।
  • স্বামী দরিদ্র কিংবা অসুন্দর হওয়ার কারণে তাকে তুচ্ছ না করা।
  • স্বামীকে কোনো গুনাহের কাজ করতে দেখলে আদবের সাথে তাকে বিরত রাখা।
  • স্বামীর নাম ধরে না ডাকা।
  • কারো কাছে স্বামীর বদনাম, দোষ-ত্রুটি বর্ণনা না করা।
  • শ্বশুর-শাশুড়িকে সম্মানের পাত্র মনে করা। তাদেরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করা। ঝগড়া-বিবাদ কিংবা অন্য কোনো উপায়ে তাদের মনে কষ্ট না দেওয়া।
  • সন্তানদের লালন-পালনে অবহেলা না করা।

উত্তম স্ত্রীর গুণাবলি

কুরআন-হাদীসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, উত্তম স্ত্রী হল যে স্বামীকে সম্মান করে। স্বামীর বশ্যতা স্বীকার করে। স্বামীর আদেশ-নিষেধ মান্য করে। স্বামীর ধন-সম্পদ হেফাযত করে এবং অন্যান্য হকসমূহ যথাযথভাবে আদায় করে। সাথে সাথে নিজের সতীত্ব রক্ষা করে, শরীয়তের বিধানুসারে জীবন পরিচালনা করে।

স্বামীর উপস্থিতি-অনুপস্থিতি সর্বাবস্থায় নিজের সতীত্ব এবং স্বামীর ধন-সম্পদ হেফাযত করা স্ত্রীর কর্তব্য। সাধারণত এদু’টি ক্ষেত্রে মহিলাদের থেকে সবচেয়ে বেশি খেয়ানত হয়ে থাকে। কোনো কোনো মহিলার ক্ষেত্রে এমনও ঘটে যে, স্বামী ঘর থেকে বের হলে, চাকরি বা অন্য কোনো স্থানে গেলে, সেই সুযোগে স্বামীর অজান্তে নিজেকে নাফরমানির কাজে জড়িয়ে ফেলে। স্বামীর উপস্থিতিতে এটা সে করতে পারত না। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এতে স্বামীকে ধোকা দেওয়া হলেও প্রকারান্তরে এটা হচ্ছে নিজের জীবনে অভিশাপ টেনে আনা।

সুতরাং স্ত্রীর অবশ্যকর্তব্য হল, আল্লাহকে হাযির-নাযির জেনে স্বামীর উপস্থিতি-অনুপস্থিতি সর্বাবস্থায় নিজের ইজ্জত-আব্রু সংরক্ষণ করা। হাদীস শরীফে আছে-‘উত্তম স্ত্রী হল, যখন তুমি তার দিকে তাকাও তখন সে তোমাকে আনন্দিত করে। যখন তাকে আদেশ কর তখন সে আনুগত্য করে আর যখন তুমি স্থানান্তরে যাও তখন সে তার ইজ্জত-আব্রু রক্ষা করে এবং সম্পদ হেফাযত করে।’

আর যে স্ত্রী শরীয়তের হুকুম মেনে চলে, স্বামীর আদেশ মান্য করে, তার খেদমত করে, নিজের সতীত্ব রক্ষা করে হাদীস শরীফে তার জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।

হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, রমযান মাসের রোযা রাখে, লজ্জাস্থানের হেফাযত করে এবং স্বামীর অনুগত থাকে তাকে বলা হবে তুমি যে দরজা দিয়ে চাও জান্নাতে প্রবেশ কর।’ -মুসনাদে আহমদ হাদীস ১৬৬১

পক্ষান্তরে যে স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে ভালো আচরণ করে না এবং স্বামী তার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকে তার সম্পর্কে হাদীস শরীফে এসেছে যে, ‘তার কোনো নামায কবুল হয় না, কোনো নেক আমল উপরে উঠানো হয় না যতক্ষণ স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট না হবে।-সহীহ ইবনে হিববান হাদীস ৫৩৫৫

অন্য হাদীসে আছে-হুসাইন ইবনে মুহসিন থেকে বর্ণিত, তাঁর এক ফুফু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে কোনো প্রয়োজনে এসেছিলেন। তাঁর প্রয়োজন পূর্ণ হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি বিবাহিতা? তিনি বললেন, জ্বী হাঁ। নবীজী বললেন, তুমি স্বামীর সাথে কেমন আচরণ করে থাক? তিনি বললেন, আমি একেবারে অপারগ না হলে তার সেবা ও আনুগত্যে ত্রুটি করি না। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, স্বামীর সাথে তোমার আচরণ কেমন তা ভেবে দেখ। কারণ স্বামীই তোমার জান্নাত কিংবা জাহান্নাম।-মুসনাদে আহমদ খ. ৪, পৃ. ৩৪১৩; খ. ৬, পৃ. ৪১৯

উত্তম স্বামী

একটি পরিবার সুন্দর ও সুখময় করে গড়ে তোলার জন্য স্বামীর কর্তব্য সবচেয়ে বেশি। সুতরাং সে যেন স্ত্রীর খুটিনাটি বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ না করে এবং স্ত্রীকে সব কথা মেনে নেওয়ার জন্য বাধ্য না করে। কেননা নারীদেরকে সৃষ্টিই করা হয়েছে নাযুক তবিয়ত দিয়ে। অতএব স্ত্রীর ওপর অধিক চাপ প্রয়োগ করতে থাকলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশংকাই বেশি।

হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে পাঁজরের হাড্ডি দ্বারা। তুমি যদি তাকে সোজা করতে যাও তাহলে ভেঙ্গে ফেলবে। তাই তার মন রক্ষা করে চল। তাহলেই একসাথে জীবন যাপন করতে পারবে।-সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৪১৭৮

আরেকটি হাদীসে আছে-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ কর। কেননা তাদেরকে পাঁজরের হাড্ডি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড্ডিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বাঁকা হল উপরেরটি। সুতরাং তুমি যদি তা সোজা করতে যাও তাহলে ভেঙ্গে ফেলবে। আর যদি একেবারে ছেড়ে দাও তাহলে বাঁকাই থেকে যাবে। তাই স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ কর।’-সহীহ বুখারী ও মুসলিম

অন্য হাদীসে এসেছে, তুমি যদি স্ত্রীকে সোজা করতে যাও তাহলে ভেঙ্গে ফেলবে। আর ভাঙ্গার অর্থ তাকে তালাক প্রদান করা। -সহীহ মুসলিম

অতএব স্বামী নিজেকে সংযত রাখবে। সবকিছু ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবে। ছাড় দেওয়া ও মায়া-মমতার মাধ্যমে যতদূর সম্ভব দাম্পত্য জীবন স্থায়ী করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। মাথা গরম করে দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন এক নিমিষেই শেষ করে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

অবাধ্য স্ত্রীকে সংশোধনের কয়েকটি নির্দেশনা

কোনো স্ত্রী যদি স্বামীর আনুগত্য না করে, স্বামীর হক আদায় না করে বরং উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করতে থাকে তাহলে স্বামীর দায়িত্ব হল তাকে সংশোধনের জোর চেষ্টা করা। শরীয়ত এ ধরনের স্ত্রীকে সুশৃংখল জীবনে ফিরিয়ে আনতে কিছু দিক-নির্দেশনাও দিয়ে দিয়েছে। স্বামী প্রথমে সেগুলো অনুসরণ করবে। তারপরও যদি স্ত্রীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন না আসে এবং সে তার মন মতোই চলতে থাকে তাহলে চূড়ান্ত ফয়সালা তালাক দেওয়ার পথ বেছে নিতে পারবে। তবে মনমতো তালাক দেওয়া যাবে না। শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে তালাক প্রদান করতে হবে।

প্রথম পদক্ষেপ

স্ত্রীর এই অবাধ্যতা দেখে উত্তেজিত হবে না এবং ঝগড়া-বিবাদের পথ অবলম্বন করবে না; বরং নিজেকে সংযত রাখবে এবং স্ত্রীকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বোঝাতে থাকবে । স্ত্রীর প্রতি মায়া-মুহাববত প্রকাশ করে তার মন গলানোর চেষ্টা করবে। স্ত্রী কোনো ভুল ধারণায় থাকলে যথাসম্ভব তা দূর করার চেষ্টা করবে। স্ত্রী যদি স্বামীর এই মহৎ আচরণে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে স্বামীভক্ত বানিয়ে ফেলে তাহলে একটি সুখী পরিবার রচিত হবে এবং স্বামী অন্তর্জবালা থেকে মুক্তি পাবে। আর স্ত্রী অবাধ্য থাকার কারণে যে গুনাহে লিপ্ত ছিল তা থেকে সে পরিত্রাণ পাবে। যদি এই চেষ্টা বিফলে যায় তাহলে দ্বিতীয় নির্দেশনা অবলম্বন করবে।

দ্বিতীয় পদক্ষেপ

স্ত্রীর ব্যবহারে রাগ-অনুরাগ প্রকাশ করার জন্য স্বামী স্ত্রীর সাথে একত্রে রাতযাপন করা থেকে বিরত থাকবে। স্ত্রীর ঘুমানোর জায়গা পৃথক করে দিবে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এটা সাধারণ একটি শাস্তি, কিন্তু মনস্তাত্বিক বিচারে সর্বোত্তম সতর্কবাণী। স্ত্রী যদি এতেই সতর্ক হয়ে যায় এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয় তাহলে দাম্পত্য জীবন সুখের হবে। অশান্তি-পেরেশানী দূর হবে। আর যদি এই ভদ্রোচিত সাজা স্ত্রীর অবাধ্যতা ও বক্রতার মধ্যে কোনো পরিবর্তন না আনে তাহলে তৃতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে।

তৃতীয় পদক্ষেপ

উল্লেখিত দুটি পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরও কোনো কাজ না হলে তৃতীয় পদক্ষেপ হিসেবে শরীয়ত স্ত্রীকে হালকা শাসন, হাত উঠানোর অনুমতি দিয়েছে। তবে রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে নয়; বরং অন্তরে মুহাববত পোষণ করে বাহ্যিকভাবে স্ত্রীকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে এটা করা যাবে। লক্ষ রাখতে হবে যেন এর কারণে তার শরীরে কোনো দাগ না পড়ে এবং চেহারা বা স্পর্শকাতর কোনো স্থানে আঘাত না আসে। অবশ্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদেরকে এ ধরনের শাস্তি দেওয়া পছন্দ করেননি। তাই এই পন্থা পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। কেউ কেউ স্ত্রীকে শাসনের নামে বেধড়ক মারপিট করে থাকে, যা শরীয়ত সমর্থন করে না এবং এটা স্ত্রীর ওপর সুস্পষ্ট জুলুম। যাহোক এই যৎসামান্য শাসনের মাধ্যমেও যদি মোআমালা সাফ হয়ে যায় এবং উভয়ে আপোষ-মীমাংসায় পৌঁছে যায় তাহলেও মাকসাদ হাসিল হয়ে যাবে। ঘরে-সংসারে শান্তি ফিরে আসবে।

স্ত্র¿ীকে সংশোধনের জন্য এই তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণের কথা কুরআনুল কারীমের একটি আয়াতে একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-(তরজমা)

‘স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশংকা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও। তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর। অতঃপর তাদেরকে প্রহার কর। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ অন্বেষণ করো না।’

পরস্পর সম্পর্ক বজায় রাখার সর্বশেষ পদক্ষেপ

উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো এজন্য রাখা হয়েছে যেন স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত সমস্যা তারা নিজেরাই যেন সমাধান করতে পারে। কিন্তু কখনও কখনও ঝগড়া-বিবাদ এত চরম আকার ধারণ করে যে, চাই সেটা স্ত্রীর অবাধ্যতা ও বল্গাহীন চলাফেরা করার কারণে হোক কিংবা স্বামীর অন্যায় আচরণ, অমানবিক নির্যাতনের কারণে হোক তখন আর ঘরের কথা ঘরে থাকে না বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। এতে সাধারণত দেখা যায়, এক পক্ষের লোক অন্য পক্ষ সম্পর্কে কটুক্তি করে এবং অপবাদ রটাতে থাকে। যার ফলে উভয় পরিবার ও পক্ষ-বিপক্ষের লোকদের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে এটা পারিবারিক কোন্দল থেকে বংশীয় কোন্দলে পরিণত হয়।

কুরআনুল করীমে এই বিবাদ-বিসম্বাদ দূর করার জন্য এবং পরস্পর সুস্থ আপোষ-মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্য একটি স্বচ্ছ ও কার্যকরী পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-(তরজমা) যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মতো পরিস্থিতির আশংকা কর তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ। -সূরা নিসা ৩৫

তবে উভয় সালিসের মধ্যে নিন্মোক্ত গুণাবলী থাকা আবশ্যক।

১. জ্ঞানী হওয়া

২. সুবিবেচক হওয়া

৩. নেক নিয়তে ফয়সালা করার মানসিকতা থাকা। অর্থাৎ তাদের অন্তরের একান্ত কামনা থাকবে যে, স্বামী স্ত্রীর মাঝে একটি সুষ্ঠু ফয়সালা হোক। এজন্য তারা যথাসাধ্য চেষ্টাও করবে। যখন এই সালিসদ্বয় ইখলাসের সাথে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মীমাংসা করার জন্য প্রচেষ্টা চালাবে তখন আল্লাহ তাআলার গায়েবী মদদ তাদের সাথে থাকবে। ফলে তাদের বিচারকার্যের মাকসাদ হাসিল হবে এবং তাদের অসীলায় আল্লাহ তাআলা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের অন্তরে মুহাববত ও সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করে দিবেন। ইনশাআল্লাহ।

 হল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত

পরিস্থিতি কখনো এমন নাযুক হয়ে যায় যে, মীমাংসা ও সংশোধনের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কোনোক্রমেই একমতে পৌঁছা সম্ভব হয় না। দাম্পত্য জীবন থেকে সাফল্য লাভ হওয়া তো দূরের কথা, একে অপরের চেহারা পর্যন্ত দেখতে চায় না। যতদ্রুত সম্ভব বিচ্ছেদ ঘটালেই তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এরকম চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে শরীয়ত স্বামীকে তালাক দেওয়ার এখতিয়ার দিয়েছে। তবে তালাক দেওয়া অত্যন্ত অপছন্দনীয় ও ঘৃণিত কাজ। তারপরও তালাক দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা না থাকলে শরীয়ত সমর্থিত পদ্ধতি অনুসরণ করে তালাক দিবে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করার সুফল অনেক।

তালাক দেওয়ার সর্বোত্তম পদ্ধতি

কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা এবং সাহাবা-তাবেঈনের আমল থেকে প্রমাণিত হয় যে, তালাক দেওয়ার সর্বোত্তম পদ্ধতি হল, স্ত্রী যখন হায়েয থেকে পবিত্র হবে তখন স্বামী তার সঙ্গে সহবাস না করে সুস্পষ্ট শব্দে এক তালাক দিবে। যেমন স্বামী স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলবে, আমি তোমাকে এক তালাক দিলাম। এরপর স্বামী যদি স্ত্রীকে ইদ্দত চলা অবস্থায় ফিরিয়ে নেয় তাহলে ভালো। পুনরায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কায়েম হয়ে যাবে। অন্যথায় ইদ্দত শেষ হওয়ার সাথে সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং স্ত্রী স্বামী থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যাবে। এখন স্ত্রী স্বাধীন। ইচ্ছা করলে সে অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। ফকীহগণ এভাবে তালাক দেওয়াকে ‘তালাকে আহসান’ বলেছেন। সাহাবায়ে কেরামও এই পদ্ধতিকে সর্বোত্তম পদ্ধতি বিবেচনা করেছেন। সুতরাং তালাক দিতে একান্ত বাধ্য হলে এই পদ্ধতিতে তালাক দেওয়া কর্তব্য।

সর্বোত্তম পদ্ধতিতে তালাক দেওয়ার সুফলসমূহ

এ পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সুফল হল:

১. অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় তালাকের পরে স্ত্রীই বেশি অনুতপ্ত হয় এবং বৈবাহিক সম্পর্ক পুনর্বহাল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। যদি শরীয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী এক তালাক দেওয়া হয় তাহলে এই আশা পূরণ হওয়ার সুযোগ থাকে এবং তারা পুনরায় বৈবাহিক জীবন শুরু করতে পারে। কিন্তু স্বামী একসাথে তিন তালাক দিলে ইদ্দত চলা অবস্থায়ও স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না এবং ইদ্দতের পরেও নতুনভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অবকাশ থাকে না। তারা একে অপরের জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে যায়। এমতাবস্থায় অনুতপ্ত হওয়া এবং আপোষের জন্য আগ্রহী হওয়া কোনো কাজে আসে না। অবশ্য তালাকপ্রাপ্তা মাহিলার যদি ইদ্দত শেষে অন্যত্র বিবাহ হয় এবং দুর্ভাগ্যবশত সেই স্বামী কর্তৃকও তালাকপ্রাপ্তা হয় বা স্বামী মারা যায় তাহলে ইদ্দত শেষে সে প্রথম স্বামীর জন্য পুনরায় হালাল সাব্যস্ত হবে এবং উভয়ে সম্মত হলে নতুন মহর ধার্য করে আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে।

এ পদ্ধতিতে দীর্ঘ সময় স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণের অবকাশ পাওয়া যায় এবং তালাকের কারণে সৃষ্ট সমস্যা নিয়েও ভাববার সুযোগ থাকে।

উল্লেখ্য, তালাকের সময় স্ত্রী গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত তার ইদ্দতের সময়। আর গর্ভবর্তী না হলে তিন হায়েয অতিক্রম করা পর্যন্ত।

যদি এ সময়ের মধ্যে চিন্তা-ভাবনার পর উভয়ে নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং বৈবাহিক সম্পর্ক বহাল রাখতে সম্মত হয়, স্ত্রী নিজের দোষ-ত্রুটি সংশোধনের ওয়াদা করে, স্বামীর কথা মেনে চলতে রাজি হয়, স্বামীও সন্তান-সন্ততির কথা মাথায় রেখে স্ত্রীর সাথে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে চায় তাহলে পেরেশান হওয়ার দরকার হয় না। পুনরায় স্ত্রীর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ফেলাই যথেষ্ট। আগের মতোই তারা স্বামী-স্ত্রী হয়ে যায়।

এক্ষেত্রে সর্বোত্তম হল, স্বামী দুইজন পুরুষ কিংবা একজন পুরুষ ও দুইজন মহিলার সামনে বলবে, আমি আমার স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করলাম। যাতে পরিচিতদের মাঝে কোনো ভুল ধারণা সৃষ্টি না হয় এবং তালাকের মতো স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ও সবার জানা হয়ে যায়।

২. যদি বিচ্ছেদের পর দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তির কথা মনে পড়ে, পরস্পরের গুণ ও অবদান স্মরণ হয় এবং আবার তারা দাম্পত্য জীবন শুরু করতে চায় তাহলে নতুন মহর ধার্য করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। প্রথম তালাকের ইদ্দত শেষ হয়ে গেলেও এক্ষেত্রে অন্যত্র বিবাহের প্রয়োজন হবে না। দুর্ভাগ্যবশত দ্বিতীয়বারও তাদের মাঝে বনিবনা না হলে এবং আল্লাহ না করুন পুনরায় তালাক দেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সেক্ষেত্রেও ইসলামী দিক নির্দেশনার পূর্ণ অনুসরণ করবে। তাতে কাজ না হলে স্ত্রীকে তালাকে আহসান দিবে। অর্থাৎ স্ত্রী হায়েয থেকে পবিত্র থাকা অবস্থায়-যে সময়ে স্বামী তার সাথে সহবাস করেনি-সুস্পষ্ট ভাষায় এক তালাক দিবে।

শরীয়ত এমতাবস্থায়ও বিবাহ টিকিয়ে রাখার সুযোগ রেখেছে। স্ত্রীকে ইদ্দতের মধ্যে ফিরিয়ে নিতে পারবে আর ইদ্দত শেষ হলে নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। তবে স্বামী যেহেতু স্ত্রীকে দুই ধাপে দুই তালাক প্রদান করেছে তাই এখন শুধু একটি তালাক তার অধিকারে আছে। এই তৃতীয় তালাক প্রদান করলে আর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকবে না এবং পুনরায় বিবাহও করতে পারবে না। কেননা এই সুযোগ দুই তালাক পর্যন্তই সীমিত। যে ব্যক্তি উপরোক্ত পদ্ধতিতে দুই তালাক দেওয়ার পর পুনরায় বৈবাহিক সম্পর্ক কায়েম করবে তকে আগামী দিনগুলোতে খুব হিসাব নিকাশ করে চলতে হবে। কেননা একটু অসতর্কতার কারণে তৃতীয় তালাক দিয়ে ফেললে আর এই স্ত্রীকে নিয়ে ঘরসংসার করার সুযোগ থাকবে না; বরং মহিলাটি তার জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে যাবে। এজন্য খুব সাবধান থাকতে হবে।

মোটকথা ‘আহসান’ পদ্ধতিতে তালাক দিলে তালাক-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ পাওয়া যায়। ধীর-স্থিরভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তাড়াহুড়া করে অনাকাংখিত কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। পক্ষান্তরে একসাথে তিন তালাক দিলে এই অবকাশগুলো থাকে না এবং তা কোনো সুফলও বয়ে আনে না; বরং স্বামী-স্ত্রী উভয়ে যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে। জীবন চলা তাদের জন্য দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।

সুতরাং একটু খোলা মনে চিন্তা করে দেখুন দাম্পত্য সম্পর্ক অটুট রাখার জন্য শরীয়তের ভূমিকা কত গুরুত্বপূর্ণ। পারস্পরিক কলহ-বিবাদ দূর করার জন্য পর্যায়ক্রমে পদক্ষেপ গ্রহণ করার আদেশ করেছে। মিলে মিশে থাকার কোনো পথ খোলা না থাকলে বিশেষ পদ্ধতিতে তালাক দেওয়ার হুকুম দিয়েছে। অর্থাৎ স্ত্রী হায়েয থেকে পবিত্র থাকা অবস্থায় এক তালাক দিবে। কেননা হায়েয অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দেওয়া মারাত্মক গুনাহ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

পরবর্তীতে স্ত্রীর প্রতি মুহাববত প্রকাশ পেলে ইদ্দতের মধ্যে তাকে গ্রহণ করতে পারবে। ইদ্দত শেষ হয়ে গেলে নতুন বিবাহের মাধ্যমে দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরায় স্থাপিত হওয়া সম্ভব। কিন্তু তিন তালাক দিলে স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করার বা নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকে না। এভাবেই ইসলামী শরীয়ত বৈবাহিক সম্পর্ক অটুট রাখার অবকাশ দিয়েছে। কিন্তু অনেক মানুষই শরীয়তের এই সহজ পদ্ধতি উপেক্ষা করে। তিন তালাকের কঠিন হুকুম তা তাদের উপর আরোপিত হয়ে যায়। অর্থাৎ বিবাহ ভেঙ্গে যায় এবং তারা পরষ্পরের জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে যায়। এখন মহিলাটির অন্যত্র বিবাহ হলে এবং সেই স্বামী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্তা হলেই কেবল প্রথম স্বামীর জন্য হালাল হবে।

অনেকে শরীয়তের পন্ডিত সেজে বলতে থাকে, অন্তরের নিয়ত ছাড়া শুধু রাগের মাথায় তিন তালাক দিলে তিন তালাকই হয়ে যাবে-এটা কেমন কথা? এ ধরনের আরো অনেক তর্ক ও অসার যুক্তির অবতারণা করে থাকে। তাদের যুক্তির খন্ডনে যুক্তি দিয়ে বলা যায়, একটি কাজ যদি অন্যায় হয় তবে তা করা নিষিদ্ধ হবে , কিন্তু করে ফেললে তার ক্রিয়া প্রকাশিত হবে না-এটাই বা কেমন কথা? কোনো মানুষকে হত্যা করা জঘন্য অপরাধ এবং কবীরা গুনাহ। কিন্তু কেউ যদি ঘটনাক্রমে কাউকে গুলি করে মেরে ফেলে তখন কি এই তর্ক তাকে বাঁচিয়ে তুলবে যে, যে গুলি করেছে সেকি ন্যায় করেছে না অন্যায় করেছে?

তালাক দেওয়ার ভুল পদ্ধতি এবং তার কুফল

ইসলামী শরীয়তে একান্ত প্রয়োজনে তালাক দেওয়ার অবকাশ রাখা হয়েছে এবং সেজন্য সুন্দর পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে পদ্ধতি উপেক্ষা করতে দেখা যায়। আবার কোথাও পুরোপুরি উপেক্ষা করা না হলেও যথাযথ অনুসরণ করা হয় না। সমাজে তালাক দেওয়ার বিভিন্ন ভুল পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে এবং দিন দিন নতুন নতুন পদ্ধতির কথা শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং শরীয়ত পরিপন্থী পদ্ধতি, যার কারণে একটি সুখী সংসার নিমিষেই শেষ হয়ে যায় এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়ে অন্তর্জ্বালায় জ্বলতে থাকে তা হল-একসাথে তিন তালাক দেওয়া। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এভাবেই তালাক দেওয়া-নেওয়া হয়। অনেকে একেই তালাক দেওয়ার একমাত্র পদ্ধতি মনে করে। এটা ছাড়া ভিন্ন পন্থায় তালাক দিলে তালাক দেওয়া হয়েছে বলে মনে করে না।

এই ভুল রেওয়াজ এতই ব্যাপক যে, তালাক কার্যকরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও এভাবেই তালাক কার্যকর করে থাকে। তদ্রূপ শিক্ষিত অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র সব শ্রেণীর লোকদের মধ্যেই এই প্রবণতা দেখা যায় যে, তারা যখন রাগে ক্ষোভে অথবা সিদ্ধান্ত নিয়ে লিখিত বা মৌখিকভাবে তালাক দেয় তখন একসাথে তিন তালাকই দিয়ে থাকে। এর কম তালাক দেওয়ার কোনো পন্থা আছে কি না সেটা জানারও প্রয়োজন বোধ করে না।

কখনও এমনও ঘটে যে, কেউ যদি এক তালাক বা দুই তালাক দেয় তাহলে তাকে তৃতীয় তালাক দিতে বাধ্য করা হয় এবং নানা রকম হুমকি-ধমকি দিয়ে, ঠাট্টা বিদ্রূপ করে কিংবা যেকোনো ভাবে উত্তেজিত করে তৃতীয় তালাক দেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়।

দৃশ্যটা এমন থাকে যে, যতক্ষণ স্বামী তিন তালাক না দিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজে ঠান্ডা হয়, না স্ত্রী, না অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন। সন্তান-সন্ততির ভবিষ্যতের কথা, সংসার ভাঙ্গার কথা, দুই পরিবারের মাঝে শত্রুতা ও সংঘাতের কথা কোনোটাই মাথায় থাকে না।
যেই তিন তালাক দেওয়া হল অমনি সবাই শান্ত সুবোধ হয়ে গেল। এখন ছোট ছোট সন্তানের কথা মনে পড়ে, নিঃষ্পাপ সন্তানদের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠে এবং ঘর ভাঙ্গা সংসারের চিত্রটা এমন বিভৎস আকারে ধরা দিতে থাকে যে, প্রত্যেকে নিজের ভুল বুঝতে পারে। স্বামী-স্ত্রী নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়। মাফ চাওয়া-চাওয়ির মাধ্যমে অতীত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে বৈবাহিক সম্পর্ক পুনর্বহাল করতে মরিয়া হয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে বড় দেরি হয়ে গিয়েছে। নিজ হাতে সকল সুযোগ বিনষ্ট করা হয়েছে।

তালাক দেওয়ার শরীয়তসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ না করার কারণে স্ত্রী তার জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে গিয়েছে। এখন স্ত্রীকে ইদ্দত চলা অবস্থায়ও পুনরায় গ্রহণ করারও সুযোগ নেই, নতুন করে বিবাহ করারও সুযোগ নেই। উপরন্তু শরীয়তের নিয়ম অমান্য করে মারাত্মক গুনাহ করা হয়েছে। আর অন্যায়ভাবে তালাক দেওয়া হলে স্ত্রীর উপরও চরম যুলুম করা হয়েছে, যা আরেকটি কবীরা গুনাহ ও হারাম।

যারা তিন তালাক দেওয়ার পর শরীয়তের বিধান জানতে মুফতী সাহেবদের কাছে আসেন তাদের অনেককে দেখা যায়, অত্যন্ত অসহায়ত্বের সাথে নিজের দুঃখের কথা বলে মুফতী সাহেবের মন গলাতে চেষ্টা করেন। নিষ্পাপ সন্তানদের কথা বলেন আর চোখ থেকে অশ্রু ঝরে। বিনয়ের সাথে অনুরোধ করতে থাকেন যেভাবেই হোক কোনো হিলা-বাহানা বের করে তার পরিবারটাকে যেন ধ্বংস হওয়া থেকে বাঁচানো হয়।

এমনকি তিন তালাকের হুকুম নস্যাৎ করার জন্য বিশেষ কোনো কাফফারা থাকলে তা যেন বাতলে দেওয়া হয়। মোটকথা, যেকোনো উপায়ে দাম্পত্য সম্পর্ক ফিরে পাওয়ার জন্য অনুনয় বিনয় করতে থাকে। কিন্তু তাদের এ সকল আবদার-অনুরোধ বিফল। এতে শরীয়তের বিধানে পরিবর্তন হয় না। স্ত্রী তার জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে গেছে। আর এটা হয়েছে শরীয়তের নিয়ম লঙ্ঘন করে একসাথে তিন তালাক দেওয়ার কারণে। এখন পুনরায় তাকে স্ত্রী রূপে ফিরে পাওয়ার যে সম্ভাবনাটি রয়েছে তা অত্যন্ত দূরবর্তী সম্ভাবনা। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বৈধ পন্থার পরিবর্তে নানা রকম হিলা-বাহানার আশ্রয় নেওয়া হয়, যা যেমন অশালীন তেমনি শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ ও লানতযোগ্য কাজ।

রুজু করার মনগড়া পদ্ধতিসমূহ

অনেক জায়গায় তালাকের শরয়ী বিধান উপেক্ষা করা হয়। স্পষ্ট তিন তালাক দেওয়া সত্ত্বেও তালাকপ্রাপ্তা মহিলার সাথে অনায়াসে ঘর-সংসার করতে থাকে। এমনও শোনা যায়, তালাক দেওয়ার পর স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে গেছে। পরে তালাকদাতা চাপে পড়ে কিংবা মনের টানে মহিলাটিকে নিজ বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছে এবং স্বামী-স্ত্রীর মতো জীবন-যাপন করছে। অথচ এভাবে তালাকপ্রাপ্তাকে ফিরিয়ে আনা এবং একসাথে জীবন-যাপন করা সম্পূর্ণ হারাম।

সমাজে এমনও ঘটে যে, এভাবে হারাম জীবন-যাপনের পক্ষে অনেক প্রগতিবাদী ‘মুরববী’র সমর্থন থাকে। সান্ত্বনার সুরে একেকজন একেক ধরনের উপদেশ দেন আর বলতে থাকেন,

আরে রাগের মাথায় তালাক দিলে স্ত্রী তালাক হয় না। অন্তরে তালাকের নিয়ত না থাকলে তালাক হয় না। স্ত্রী তালাক দেওয়ার সময় নিজ কানে না শুনলে তালাক হয় না। স্ত্রী যদি তালাকের রেজিস্ট্রি গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দেয় তাহলে তালাক হয় না। যতক্ষণ স্ত্রী তালাকনামা না পড়বে এবং কবুল না করবে ততক্ষণ তালাক কার্যকর হয় না। শুধু লিখে তালাক দিলে তালাক হয় না, মুখে উচ্চারণ করতে হয়। স্ত্রী গর্ভবতী থাকা অবস্থায় তালাক দিলে তালাক হয় না ইত্যাদি।

এভাবে একের পর এর তালাকের ‘সমাধান’ বাতলাতে থাকে। এগুলো সব জাহেল ও মুর্খদের অজ্ঞতাপ্রসূত ও মনগড়া যুক্তি, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। নিঃসন্দেহে এ সকল ক্ষেত্রেও শুরু থেকেই তিন তালাক কার্যকর হয়ে যাবে। সুতরাং তিন তালাক দেওয়ার পর এভাবে স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণ করার অর্থ হল, প্রকাশ্য ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। তারা যতদিন একসাথে জীবন কাটাবে ততদিন হারাম কাজের মধ্যেই জীবন অতিবাহিত হবে।

এতে শুধু তালাকদাতা এবং তালাকপ্রাপ্তা গুনাহগার হবে না; বরং তাদেরকে এই হারাম জীবন-যাপনের সুযোগ যারা করে দিয়েছে তারাও গুনাহগার হবে।

কেউ কেউ তিন তালাক দেওয়ার পর তা গোপন রাখে। ঘটনাক্রমে দু’ একজন জেনে ফেললেও সাক্ষী প্রমাণ না থাকার কারণে সাফ অস্বীকার করে বসে। কখনও কখনও তিন তালাক দেওয়া সত্ত্বেও এক তালাক বা দুই তালাক দেওয়ার কথা প্রচার করে। এভাবে মিথ্যা বলে তিন তালাকের হুকুম-স্ত্রী সম্পূর্ণরূপে স্বামীর জন্য হারাম হয়ে যাওয়া- থেকে বাঁচতে চায়।

অতঃপর যখন মুফতী সাহেবের কাছে ফতোয়া নেওয়ার জন্য আসে তখন তিন তালাককে দুই তালাক বানিয়ে কাগজে লিখে দেয়। মুফতী সাহেব যেহেতু গায়েব জানে না তাকে লিখিত বিষয়ের উপর নির্ভর করে, প্রয়োজনে মৌখিক বক্তব্যের মাধ্যমে যাচাই করে উত্তর প্রদান করতে হয়। যদি প্রশ্নপত্রে দুই তালাকের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তিনি দুই তালাকের শরয়ী হুকুম অনুযায়ী ফতোয়া প্রদান করবেন। ফলে উত্তরপত্রে দেখা যাবে দুই তালাকের বিধানানুযায়ী মহিলাটি তালাকদাতার জন্য এখনও সম্পূর্ণ হারাম হয়নি।

(যদিও কার্যত আল্লাহর বিধানে মহিলাটি তালাকাদাতার জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়েছে। কেননা, তাকে তিন তালাক প্রদান করা হয়েছে) এই ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে মুফতী সাহেব কোনো ভুল করেননি। তিনি তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন। কিন্তু প্রশ্নকর্তা এখানে খেয়ানত করেছে। সত্যের বিপরীতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। তিন তালাককে দুই তালাক বানিয়েছে এবং তিন তালাকের পরিবর্তে দুই তালাকের হুকুম নিয়ে নিয়েছে।

যদিও সে মুফতী সাহেবকে ধোকা দিয়েছে এবং হয়তো এই ফতোয়া নিয়ে এলাকাবাসীকেও ধোকা দিবে, কিন্তু আল্লাহকে তো ধোকা দিতে পারবে না। তার সকল কাজ আল্লাহ জানেন। এলাকাবাসীর প্রতিবাদের ভয়ে হয়তো এই ফতোয়াকে সনদ বানিয়ে প্রচার করবে যে, অমুক মুফতী সাহেব কিংবা অমুক বড় মাদরাসা থেকে এই ফতোয়া দেওয়া হয়েছে। সত্য গোপন করা হবে। সমাজ তাদেরকে স্বামী-স্ত্রী মনে  করবে, কিন্তু শরীয়তের বিচারে মহিলাটি তালাকদাতার জন্য হালাল হয়ে যাবে না; বরং বিধান অনুযায়ী হারামই থাকবে এবং তাদের মেলামেশা ব্যভিচার বলে গণ্য হবে। এই জঘন্য অপরাধের কারণে পরকালে কঠিন শাস্তি তাদেরকে ভোগ করতে হবে।

কেউ কেউ তিন তালাকের কঠিন হুকুম থেকে বাঁচার জন্য শরীয়তের বিধানের মধ্যে ফাঁক-ফোকর তালাশ করে থাকে। যখন ফিকহে হানাফীতে কোনো ছাড়-মহিলাটিকে পুনরায় গ্রহণ করার সুযোগ-খুঁজে পায় না তখন হানাফী মাযহাব ছেড়ে গায়রে মুকাল্লিদদের কাছে ধর্ণা দেয়। কারণ তাদের প্রোপাগান্ডা হল, একসাথে একই মজলিসে তিন তালাক দিলেও এক তালাক হয় এবং স্বামী পুনরায় তালাকপ্রাপ্তাকে গ্রহণ করতে পারে।

যারা এই ব্যতিক্রমী মত অনুসরণ করবে তারা নিঃসন্দেহে অবৈধ জীবন যাপন করতে থাকবে। কারণ এই মত কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস, শরীয়তের এই চার দলীলের সম্পূর্ণ বিরোধী। এছাড়া সাহাবা, তাবেয়ীন, প্রসিদ্ধ চার ইমাম এবং জুমহুরে উম্মতের অনুসৃত মত ও আমলের পূর্ণ খেলাফ। অতএব গুটি কতক মানুষের ভ্রান্ত মত অনুসরণ করে সারা জীবন হারাম কাজে অতিবাহিত করা নিজের জন্য জাহান্নামের গর্ত খোঁড়া ছাড়া আর কিছু নয়।

আমাদের ভুল এই যে, বিবাহের আগে তালাকের মাসআলা ভালোভাবে জানি না এবং জানারও প্রয়োজন বোধ করি না। এমনকি বিবাহের পরও তালাকের মাসআলা জানার চেষ্টা করি না। ফলে এই ভুলের খেসারত পরে দিতে হয়। যদি মাসআলা জানার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হত তাহলে নির্দ্বিধায় তিন তালাক দেওয়ার সাহস হত না এবং সুখের সংসার ভেঙ্গে যেত না। দুই পরিবারের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি হত না এবং অনাকাংখিত পরিস্থিতির শিকার হতে  হত না। সুতরাং হুট করে তিন তালাক দিতে উদ্যত হবে না। রাগের অবস্থায় ভুলেও তালাকের নাম নিবে না। প্রচন্ড রাগ হলে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করবে। সম্ভব হলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করবে। তালাক দিলেই যে জীবনে শান্তি ফিরে আসবে এমন তো নয়। তাই ধৈর্য্য ধারণ করাই শ্রেয় এবং শরীয়তের  পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা কর্তব্য।

তালাকদাতার জন্য মহিলাটি কখন হালাল হবে

তালাকপ্রাপ্তা মহিলা যদি ইদ্দত শেষে অন্যত্র বিবাহ হয় এবং সে স্বামীর সাথে তার নিশ্চিত মেলামেশা হয় অতঃপর সেই স্বামী কোনো কারণে স্বেচ্ছায় মহিলাটিকে তালাক দেয় কিংবা স্বামীর মৃত্যু হয় তাহলে মহিলাটি ইদ্দত পালন করার পর পূর্ণ স্বাধীন থাকবে-ইচ্ছা করলে অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। আবার ইচ্ছা করলে প্রথম স্বামীর সাথে বিবাহ বসতে পারবে। তাকে প্রথম স্বামীর সাথে বিবাহে বাধ্য করা যাবে না; তারা নিজেরা যদি পুনরায় দাম্পত্য সম্পর্কে আগ্রহী হয় তাহলে নতুন মহর ধার্য করে স্বাক্ষীদের উপস্থিতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে।

এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে, দ্বিতীয় স্বামীকে জোর করে তালাক দিতে বাধ্য করা সম্পূর্ণ নিষেধ এবং বিবাহের আগে এই শর্ত জুড়ে দেওয়া যে, বিবাহের পর দ্বিতীয় স্বামী অবশ্যই স্ত্রীকে তালাক দিতে বাধ্য থাকবে, সম্পূর্ণ নাজায়েয। কেউ যদি এ রকম করে তাহলে সেটা আল্লাহর লানত ও আযাবের কারণ হবে। হাদীস শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি এভাবে (শর্তের সাথে) হালাল করার দায়িত্ব নিবে এবং যার জন্য করবে উভয়ের উপর আল্লাহর লানত।

বলাবাহুল্য যে, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনো মানুষ কখনই তালাকপ্রাপ্তা মহিলাকে ঘরে উঠানোর জন্য হিলা বাহানার পথ বেছে নিতে পারে না। এটা সুস্থ আকলেরও পরিপন্থী। সুতরাং তালাকের ক্ষেত্রে কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা যথাযথ অনুসরণ করা কর্তব্য এবং সুস্থ সুন্দর জীবন যাপনের ব্যবস্থা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

একসাথে তিন তালাক

যদি কেউ পূর্বাপর না ভেবে ঠান্ডা মাথায় হোক কি রাগের ঝোঁকে হোক একসাথে তিন তালাক দিয়ে ফেলে তাহলে সে একটি মারাত্মক অপরাধ করল এবং এক নিমিষেই একটি সুখের সংসার তছনছ করে দিল। সে নিজেই  কৃতকর্মের কুফল টের পাবে।

এভাবে তালাক দেওয়া মারাত্মক গুনাহ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু কেউ দিয়ে ফেললে এই যুক্তি চলবে না যে, সে অন্যায়ভাবে তালাক দিয়েছে অতএব তা কার্যকর হবে না। কিংবা শুধু এক তালাক হবে। যারা এরূপ ধারণা করেন তারা শরীয়তের বিধান না জানার কারণে করে থাকেন।

শরীয়তের বিধান হল, তালাক সংকল্প করে দিক অথবা ঠাট্টাচ্ছলে, খেল-তামাশা করে দিক সর্বাবস্থায় তালাক কার্যকর হয়ে যাবে। আর স্পষ্ট শব্দে তালাক দেওয়ার সাথে অন্তরের নিয়ত থাকা শর্ত নয়। সুতরাং যেভাবেই হোক একসাথে তিন তালাক দেওয়ার সাথে সাথেই স্ত্রীর উপর তিন তালাক কার্যকর হয়ে যাবে।

একাধিক সহীহ হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একসাথে তিন তালাক দেওয়াকে তিন তালাকই গণ্য করেছেন। যদিও এভাবে তালাক দেওয়ার কারণে অত্যন্ত রাগান্বিত হয়েছেন।

প্রথম হাদীস :

عن محمود بن لبيد قال : أخبر رسول الله صلى الله عليه وسلم عن رجل طلق امرأته ثلاث تطليقات جميعا فقام غضبان، فقال : أيلعب بكتاب الله وأنا بين أظهركم؟ فقام رجل فقال : يا رسول الله صلى الله عليه وسلم ألا أقتله.

মাহমুদ ইবনে লাবীদ বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানো হল যে, জনৈক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছে। তিনি (একথা শুনে) রাগান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের মাঝে আমি থাকা অবস্থায় আল্লাহর কিতাবের সাথে উপহাস করা হচ্ছে? এ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি তাকে কতল করব না?-সুনানে নাসায়ী ২/৯৮

এই হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একসাথে তিন তালাক দেওয়ার উপর নেহায়েত অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন এবং কেউ কেউ তার ওই কাজকে হত্যাযোগ্য অপরাধ মনে করেছেন। আর এ কথা কোথাও নেই যে, তিনি এই তিন তালাককে তালাক হিসেবে গণ্য করেননি অথবা এটাও এক তালাকে রজয়ী করে মহিলাটিকে তালাকদাতার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন।

কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবী এই হাদীসে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন তালাকের হুকুম কার্যকর করেছেন।

দ্বিতীয় হাদীস :

সাহাবী উয়াইমির আজলানী রাহ. সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি এবং তার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে লিআন করলেন। যখন লিআন শেষ হল, তখন উয়াইমির রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এখন যদি আমি তাকে আমার কাছে রাখি তাহলে আমি মিথ্যাবাদী। অতঃপর  উয়াইমির রা. হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে স্ত্রীকে তিন তালাক দিলেন। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা কার্যকর করলেন এবং তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটালেন।-সহীহ বুখারী হাদীস ৫৩০৯; সুনানে দাউদ হাদীস ২২৫০

এই হাদীস থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন তালাককে তিন তালাকই গণ্য করেছেন এবং তার হুকুমও কার্যকর করেছেন। আর পূর্বে উল্লেখিত মাহমুদ ইবনে লাবীদের হাদীসটিও তা প্রমাণ করে। পক্ষান্তরে কোথাও একথা পাওয়া যায় না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একসাথে দেওয়া তিন তালাককে তালাক সাব্যস্ত করেননি বা এক তালাকে রজয়ী গণ্য করেছেন।

তৃতীয় হাদীস

হযরত আলী রা.-এর শাহাদাতের পর যখন হযরত হাসান রা. খলীফা নির্বাচিত হলেন তখন তার স্ত্রী আয়েশা খাছআমিয়া তাকে মোবারকবাদ জানান। হযরত হাসান রা. স্ত্রীকে বললেন, তোমার এই মোবারকবাদ কি হযরত আলী রা.-এর শাহাদাতের কারণে? তুমি এতে খুশি প্রকাশ করছ? তোমাকে তিন তালাক দিলাম।

যখন তার ইদ্দত শেষ হয়ে গেল তখন হাসান রা. তার অবশিষ্ট মহর এবং অতিরিক্ত দশ হাজার দিরহাম পাঠিয়ে দিলেন। আয়েশা খাছআমিয়ার হাতে যখন এগুলো পৌঁছল তিনি বলতে লাগলেন, প্রিয়ের  বিচ্ছেদের তুলনায় এ সম্পদ অতি তুচ্ছ। হযরত হাসান রা. যখন এ কথা শুনলেন তখন অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন-

لو لا أني سمعت جدي أو حدثني أبي أنه سمع جدي يقول : أيما رجل طلق امرأته ثلاث عند الأقراء أو ثلاثا مبهمة لا تحل له حتى تنكح زوجا غيره لراجعتها.

আমি যদি নানাজানকে বলতে না শুনতাম কিংবা বলেছেন, আমার আববার মাধ্যমে নানাজানের এ কথা না শুনতাম, ‘যে ব্যক্তি স্ত্রীকে হায়েয থেকে পবিত্র অবস্থায় পর্যায়ক্রমে তিন তালাক দিল কিংবা একসাথে তিন তালাক দিল তার জন্য ওই স্ত্রী হালাল হবে না অন্য পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ছাড়া, তাহলে আমি তাকে ফিরিয়ে আনতাম। -আসসুনানুল কুবরা ৭/৩৩৬

চতূর্থ হাদীস

عن عبادة بن الصامت قال : طلق جدي امرأته له ألف تطليقة، فانطلقت إلى النبي صلى الله عليه وسلم فسألته، فقال : أما اتقى الله جدك، أما ثلاثة فله، وأما تسع مأة وسبعة وتسعون فعدوان وظلم، إن شاء الله عذبه وإن شاء غفر له.

উবাদা ইবনে ছামেত রা. বলেন, আমার দাদা তার স্ত্রীকে ‘এক হাজার তালাক’ দিলেন। আমি তখন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গিয়ে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, তোমার দাদা কি আল্লাহকে ভয় করেনি? তিনটি তো তার অধিকার (যা কার্যকর হয়ে গেছে) আর বাকি নয়শত সাতানববইটি হল সীমালঙ্ঘন ও জুলুম। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন অথবা শাস্তিও দিতে পারেন।

এসকল হাদীস দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, একসাথে তিন তালাক প্রদান করলে তিন তালাকই হয়। নানা রকম হিলা-বহানা করে তিন তালাককে বাতিল তালাক অথবা এক তালাকে রজয়ী সাব্যস্ত করার অপচেষ্টা মুর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর কারণে মহিলা কখনও হালাল হয়ে যাবে না।

সারকথা হল, বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর জন্য সময় নিয়ে প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে হয়। অনেক বুঝে, চিন্তা-ফিকির করে শরীয়তসম্মত পন্থায় বিবাহ সম্পন্ন করতে হয়। তাই আগ-পিছ না ভেবে হুট করে তালাক প্রদান করা কখনই উচিত নয়। যখন তালাক দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না তখন শরীয়তের নির্দেশিত পন্থায় তালাক দিবে। চিন্তা-ভাবনা ছাড়া শুধু রাগের বশবর্তী হয়ে নির্দ্বিধায় তালাক দিয়ে ফেলা শুধু অবৈধ ও গুনাহই নয়; বরং সামাজিক জীবনেও এর মারাত্মক ক্ষতি রয়েছে। এর ফলে দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা ও দুশ্চিন্তা ভর করে।

একমাত্র শান্তি ও কামিয়াবি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে শিক্ষা ও নির্দেশনা উম্মতের মাঝে রেখে গেছেন তার মধ্যে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঐ নির্দেশনার উপর অবিচল থাকা আবশ্যক। সমস্ত ভুল পথ ও পদ্ধতি পরিহার করে চলতে হবে। পূর্বের গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে কায়মনো বাক্যে ইস্তেগফার করতে হবে। আগামী জীবন নবীর আদর্শ অনুসরণ করে পরিচালনা করতে দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমীন।


লেখক – মাওলানা হাসীবুর রহমান
সম্পাদনা – মুফতি আব্দুল মালেক দাঃবাঃ
প্রধান মুফতি,মারকাযুদ্দাওয়া আল ইসলামিয়া ও
সম্পাদক- মাসিক আল-কাউসার

রাস্তার হক ও আমাদের করণীয়

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এমন দ্বীন দান করেছেন, যা শুধু কিছু ইবাদত-আকীদার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। এর বিধানাবলী জীবনের সকল বিষয়কে বেষ্টন করে। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের যত ধাপ ও স্তর সবক্ষেত্রেই রয়েছে ইসলামের শিক্ষা ও নির্দেশনা। ফলে একজন মুসলিম জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে হেদায়েত গ্রহণ করতে পারে এবং তা মেনে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারে।

এই নিবন্ধে পথ ও পথিকের হকের বিষয়ে ইসলামের কিছু নির্দেশনা তুলে ধরা হচ্ছে।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِيَّاكُمْ وَالجُلُوسَ عَلَى الطُّرُقَاتِ، فَقَالُوا: مَا لَنَا بُدٌّ، إِنَّمَا هِيَ مَجَالِسُنَا نَتَحَدَّثُ فِيهَا، قَالَ: فَإِذَا أَبَيْتُمْ إِلَّا المَجَالِسَ، فَأَعْطُوا الطَّرِيقَ حَقَّهَا، قَالُوا: وَمَاحَقُّ الطَّرِيقِ؟. قَال: غَضُّ البَصَرِ، وَكَفُّ الأَذَى، وَرَدُّ السَّلاَمِ، وَالأَمْرُ بِالْمَعْرُوفِ، وَالنَّهْيُ عَنِ المُنْكَرِ.

তোমরা রাস্তার পার্শে বসে থেকো না। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমাদের তো এর প্রয়োজন হয়। পরস্পরে প্রয়োজনীয় কথা বলতে হয়।  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বসতেই যদি হয় তবে রাস্তার হক আদায় করে বস। সাহাবীগণ বললেন, আল্লাহর রাসূল! রাস্তার হক কী?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, রাস্তার হক-

১. দৃষ্টিকে অবনত রাখা।

২. কাউকে কষ্ট না দেওয়া।

৩. সালামের জবাব দেওয়া।

৪. সৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজ হতে বিরত রাখা। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৬২২৯

(বিভিন্ন বর্ণনায় আরো কিছু বিষয় এসেছে। যেমন,)

৫. পথহারাকে পথ দেখিয়ে দেওয়া।

৬. মযলুম ও বিপদগ্রস্তের সাহায্য করা।

৭. বোঝা বহনকারীকে  (বোঝা উঠানো বা নামানোর ক্ষেত্রে) সহযোগিতা করা।

৮. ভালো কথা বলা।

৯. হাঁচির জবাব দেয়া।

সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৮১৯; মুসনাদে বাযযার, হাদীস ৫২৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৬১; মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদীস ৬৬০৩

১০. দম্ভভরে না চলা (বিনয় অবলম্বন করা)। সূরা বনী ইসরাঈল : (১৬) ৩৭

প্রথম নির্দেশনা; রাস্তায় বসো না, কারণ এতে যাতায়াতকারীদের কষ্ট হয়। রাস্তা তো বৈঠকখানা নয়; চলাচল করার জন্য।

কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাহাবায়ে কেরামের অপারগতা দেখলেন, হক আদায় করার শর্তে প্রয়োজন পরিমাণ বসার অনুমতি দিলেন।

প্রথম হক : দৃষ্টি অবনত রাখা

সেই হকের একটি হচ্ছে,  নযরের হেফাজত। যে ব্যক্তি রাস্তায় চলবে বা দাঁড়াবে কিংবা বসবে সে নজর নিচু রাখবে। কারণ রাস্তায় বেগানা নারী যাতায়াত করবে, নাজায়েয দৃশ্য নজরে পড়তে পারে। এসব থেকে নজরের হেফাজত করবে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

قُلْ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ یَغُضُّوْا مِنْ اَبْصَارِهِمْ وَ یَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُم ذٰلِكَ اَزْكٰی لَهُمْ  اِنَّ الله خَبِیْرٌۢ بِمَا یَصْنَعُوْنَ .

মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য উৎকৃষ্ট পন্থা। তারা যা কিছু করে আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবগত। সূরা নূর (২৪) : ৩০

নারীদের ব্যাপারে বলেছেন,

وَ قُلْ لِّلْمُؤْمِنٰتِ یَغْضُضْنَ مِنْ اَبْصَارِهِنَّ وَ یَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ وَ لَا یُبْدِیْنَ زِیْنَتَهُنَّ .

এবং মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে এবং নিজেদের ভূষণ প্রকাশ না করে। সূরা নূর (২৪) : ৩১

এই দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নারী ও পুরুষদের আলাদাভাবে সম্বোধন করেছেন। যাতে তারা যথাযথভাবে বিষয়টির গুরুত্ব  অনুধাবন করতে পারে। অন্যান্য আহকামের ক্ষেত্রে সাধারণত নারী-পুরুষকে একত্রে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু এই হুকুমের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা নারী-পুরুষকে ভিন্ন ভিন্ন সম্বোধনে উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা যায়। এর উপর আমল করলে অসংখ্য গুনাহ থেকে বাঁচা যাবে ইনশাআল্লাহ।

চোখের গুনাহের একটি বড় কারণ

অনেক নারী সেজেগুজে বেপর্দা হয়ে বের হয়, ফলে সে নিজেও গুনাহগার হয়, অন্যের গুনাহেরও কারণ হয়। পরপুরুষের সাথে পর্দা করা ফরজ। এই ফরজ ত্যাগ করা নামায, রোযা, হজ্ব বা যাকাত ত্যাগ করার মতই কবিরা গুনাহ। নামায-রোযা ছাড়লে শুধু নিজে গুনাহগার হয়, কিন্তু পর্দা না করলে নিজেও গুনাহগার হয় সাথে অসংখ্য মানুষেরও গুনাহের কারণ হয়। এ জন্য ঘর থেকে বের হতে হলে শরয়ী পর্দার সাথে ঘর থেকে বের হওয়া প্রত্যেক মুসলিম নারীর জন্য ফরজ। এই ফরজ আদায় করা হলে অনেক মানুষ চোখের গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে।

কুদৃষ্টি গুনাহের প্রথম ধাপ। যদি প্রথমেই নজর নিচু করে নেয়া হয়, সামনের সকল গুনাহ হতে বেঁচে যাবে। আর যদি আল্লাহ না করুন প্রথমেই সর্তকতা অবলম্বন না করে তখন একটি গুনাহ থেকে আরেকটি গুনাহ, এভাবে অসংখ্য গুনাহের ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে যায় এবং একপর্যায়ে শয়তান চরম গুনাহে পৌঁছে দেয়।

দ্বিতীয় হক : কাউকে কষ্ট না দেওয়া

রাস্তায় দাঁড়ানো বা বসা ব্যক্তির খেয়াল রাখা উচিত, যেন তার দ্বারা কোনো চলাচলকারীর সামান্য কষ্টও না হয়।

কষ্ট দেওয়ার বিভিন্ন পন্থা

  • এমনভাবে দাঁড়ানো বা বসা যে যাতায়াতকারীর কষ্ট হয়।
  • কিংবা রাস্তায় গাছের গুড়ি ফেলা,
  • টায়ার জ্বালানো,
  • অহেতুক রাস্তা বন্ধ করা,
  • ফলের খোসা, ময়লা,
  • উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলা,
  • আল্লাহ রক্ষা করুন-পানের পিক ফেলা,
  • দুর্গন্ধ ছড়ায় এমন কোনো জিনিস ফেলে রাখা যেগুলো সবই কষ্ট দেওয়ার নানা উপায়।
  • তেমনি ফুটপাতে বা রাস্তায় হকার মার্কেট বসানো,
    যার কারণে চলাচলের পথ সংকীর্ণ হয়ে যায় এটিও কষ্ট দেওয়ার অন্তর্ভুক্ত।
  • (দোকানের) সীমানা বাড়ানো কষ্টদায়ক,
  • দোকানের সীমানা বাড়াতে বাড়াতে রাস্তার মধ্যে চলে যাওয়া,
  •  যে কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় বা সংকীর্ণ হয়ে যায়। এটিও পথিকের  কষ্টের কারণ।

আমাদের বাজারগুলোতে দেখা যায়, দোকানের অর্ধেক ভেতরে আর অর্ধেক বাইরে ফুটপাতে। মনে হয় যেন ফুটপাত দোকানদারের হক! অথচ সবাই জানে এটি দোকানের অংশ নয়; ক্রেতাদের জন্য বানানো হয়েছে, যাতে যাতায়াত সহজ হয়। কিন্তু এখন ফুটপাতই দোকান বনে গেছে। অনেকে তো ফুটপাতে ঘর বানিয়ে শাটার লাগিয়ে রীতিমত মার্কেট বানিয়ে ফেলে।

যাদের দোকান নেই তারা ফুটপাত দখল করে ভ্যান দাঁড় করিয়ে দোকান খুলে বসে। এতে  রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যায়। অথচ এটি সরকারীভাবে নিষিদ্ধ। আইন থাকতেও আমাদের এই অবস্থা। এ কারণে বাজারে আসা-যাওয়ার সময় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

একটি হুকুমের উপর আমল না করার কারণে সকল মুসলমান কষ্ট পাচ্ছে। আমরা যদি রাস্তার এই হক বুঝে এর উপর আমল করি, তাহলে আমাদের রাস্তাগুলো প্রশস্ত হয়ে যাবে, চলাচলে কষ্ট হবে না।

ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা
রাস্তা বন্ধ করে কষ্ট দেওয়া তো দূরের কথা রাস্তায় কোনো কষ্টদায়ক জিনিস দেখলে ঈমানের দাবি হল তা সরিয়ে দেওয়া, এটি ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন

الْإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ – أَوْ بِضْعٌ وَسِتُّونَ – شُعْبَةً، فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الْأَذَى عَنِ الطَّرِيقِ، وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الْإِيمَانِ.

ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা রয়েছে, সর্বোত্তম শাখা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা, সর্বনিম্ন শাখা রাস্তা হতে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া, আর লজ্জা ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা। ­সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৫

আরেক রেওয়ায়েতে আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু যর গিফারী রা.-কে নসীহত করেন; তার মাঝে একটি উপদেশ ছিল-

وَإِمَاطَتُكَ الحَجَرَ وَالشَّوْكَةَ وَالعَظْمَ عَنِ الطَّرِيقِ لَكَ صَدَقَةٌ.

রাস্তা থেকে পাথর, কাঁটা, হাড্ডি সরানোও সদাকা। জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৫৬

মুমিনের কাছে ঈমানের ন্যূনতম দাবি হল, সে যখন রাস্তায় চলবে কষ্টদায়ক কিছু দেখলে সরিয়ে দেবে। হতে পারে এই ওসীলায় সে নাজাত পেয়ে যাবে।

রাস্তা  থেকে কাঁটাদার গাছ কাটার পুরস্কার
এই ঘটনা একাধিক হাদীসে এসেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি এক ব্যক্তিকে জান্নাতের গালিচায় গড়াগড়ি খেতে দেখলাম (অর্থাৎ শান্তি ও আরামের সাথে সুখময় জীবন কাটাচ্ছে)। মানুষের চলাচলের পথে একটি গাছ ছিল, যার কারণে চলাচলে কষ্ট হচ্ছিল। এ ব্যক্তি তা কেটে দিয়েছিল। (ফলে আল্লাহ খুশি হয়ে তাকে জান্নাতে দাখেল করেন।) সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯১৪

কোনো বড় আমলের কারণে নয়; বরং মানুষের যাতায়াতের রাস্তায় একটি কাঁটাদার গাছ ছিল, এ ব্যক্তি সেটি কেটে দিয়েছিল, যাতে পথিকের পথ চলা নির্বিঘ্ন হয় এই আমলের বরকতেই আল্লাহ তাকে জান্নাতে পৌঁছে দিয়েছেন।

আমরা রাস্তায় চলার সময় কত কষ্টদায়ক বস্তু নজরে পড়ে, কিন্তু আমরা মনে করি এটা তো সরকারের কাজ, তারা করবে। ঠিক আছে তাদের করা উচিত, কিন্তু আমরা মুসলমান সুতরাং এটা আমাদেরও দায়িত্ব। কারণ এটি ঈমানের দাবি।

গাড়ি পার্কিংয়ের দ্বারা মানুষকে কষ্ট দেওয়া
রাস্তায় কষ্টদায়ক কাজের মধ্যে সাইকেল, মোটর সাইকেল, গাড়ি পার্ক করাও শামিল। আমরা নিষিদ্ধ জায়গায় গাড়ি পার্ক করব না। আর যেখানে অনুমতি আছে সেখানেও এমনভাবে করব, যেন অন্য গাড়িওয়ালাদের কষ্ট না হয়। অনেক সময় আমরা কারো দোকানের সামনে এমনভাবে গাড়ি রাখি যে, দোকান বন্ধ হয়ে যায়। গ্রাহক আসতে পারে না বা আসতে কষ্ট হয়। আমি তো গাড়ি রেখে চলে গেলাম, দোকানদার কিছু বলতে পারল না বা কাজে ব্যস্ত ছিল, পরে পেরেশান হল। এভাবে যাতায়াতের রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করানো হতে বেঁচে থাকব।

গাড়ি চালানোর সঠিক পদ্ধতি
হযরত ডা. হাফিজুল্লাহ ছাহেব রাহ. বলেন, মুফতী মুহাম্মাদ হাসান রাহ.-এর একজন খাদেম ছিলেন বাঁট সাহেব। তিনি বলেন, আমার প্রতিদিনের রুটিন ছিল মুফতী ছাহেবকে গাড়িতে করে বাড়ি থেকে মাদরাসায় নিয়ে যাওয়া ও বাড়িতে নিয়ে আসা। একবার মুফতী ছাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি গাড়ি চালাতে পার?

হযরতের এ প্রশ্ন শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম, কী জবাব দিব? চিন্তা করতে লাগলাম, প্রতিদিন হযরতকে নিয়ে আসা যাওয়া করি, আর তিনি বলছেন গাড়ি চালাতে পারি কি না! ভয়ে ভয়ে বললাম, কিছু কিছু পারি। আপনি বলে দিন কীভাবে চালাতে হয়। তিনি বললেন, ‘এমনভাবে চালাতে হয় যেন কোনো মানুষ ও প্রাণী কষ্ট না পায়’। এভাবে গাড়ি চালাবে যে, কুকুর বিড়াল সামনে দিয়ে গেলে তাদেরও পেরেশানি না হয়।

তৃতীয় হক : সালামের জবাব দেওয়া

রাস্তার তৃতীয় হক وَرَدُّ السَّلاَمِ সালামের জবাব দেওয়া। সালামের সাধারণ নিয়ম হল, আরোহী ব্যক্তি পায়েহাঁটা ব্যক্তিকে আর হেঁটেচলা ব্যক্তি বসা ব্যক্তিকে সালাম দিবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

يُسَلِّمُ الرَّاكِبُ عَلَى المَاشِي، وَالمَاشِي عَلَى القَاعِدِ، وَالقَلِيلُ عَلَى الكَثِيرِ.

আরোহী পায়দলকে, পায়দল উপবিষ্টকে ও অল্প মানুষ বেশি মানুষকে সালাম দিবে। [সহীহ বুখারি হাদীস  ৬২৩২, সহীহ মুসলিম হাদীস ২১৬০]

আরেক রেওয়ায়েতে আছে-

يُسَلِّمُ الصَّغِيرُ عَلَى الْكَبِيرِ وَالْمَاشِي عَلَى القاعد والقليل على الكثير.

ছোট বড়কে, গমনকারী উপবেশনকারীকে ও কমসংখ্যক বেশি সংখ্যককে সালাম দিবে। সহীহ বুখারী, হাদীস ৬২৩২

রাস্তায় বসা অবস্থায় থাকলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালামের জবাব দিতে বলেছেন। কারণ সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, হেঁটে চলা মানুষ উপবিষ্টকে সালাম দিবে। তাহলে বসা ব্যক্তির দায়িত্ব সালামের জবাব দেওয়া।

সালামের বিভিন্ন স্তর

এক হাদীসে আছে, এক ব্যক্তি একদিন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে এসে বলল, السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ নবীজী জবাব দিয়ে বললেন, তার দশ নেকি লেখা হয়েছে। এরপর আরেক ব্যক্তি এসে বললেন,  السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ নবীজী জবাব দিয়ে বললেন, তার জন্য বিশ নেকী লেখা হয়েছে। এরপর আরেকজন এসে বলল,

السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ

নবীজী জবাব দিয়ে বললেন, তার জন্য ত্রিশ নেকী লেখা হয়েছে। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৮৯

বেশি বেশি সালাম দেওয়া

সালামের ফায়েদা অনেক বেশি। দুনিয়াতে ও আখিরাতে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনÑ

لَا تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا، وَلَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا، أَوَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى شَيْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ؟ أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ.

তোমরা মুমিন হওয়া ছাড়া জান্নাতে যেতে পারবে না, আর পরস্পরে (আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য) ভালবাসা ছাড়া মুমিন হতে পারবে না। আমি কী তোমাদের এমন বিষয়ের কথা বলব না, যার দ্বারা তোমাদের মাঝে মুহাব্বত সৃষ্টি হবে? নিজেদের মাঝে সালামের প্রসার ঘটাও। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৪

আরেক রেওয়ায়েতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

وَتَقْرَأُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ.

পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দিবে। সহীহ বুখারী, হাদীস ১২

হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

إِذَا لَقِيَ أَحَدُكُمْ أَخَاهُ فَلْيُسَلِّمْ عَلَيْهِ، فَإِنْ حَالَتْ بَيْنَهُمَا شَجَرَةٌ أَوْ جِدَارٌ أَوْ حَجَرٌ ثُمَّ لَقِيَهُ فَلْيُسَلِّمْ عَلَيْهِ أَيْضًا.

কারো সাথে তার (মুসলিম) ভাইয়ের দেখা হলে তাকে সালাম দিবে। যদি তাদের মাঝে কোনো গাছ, দেয়াল বা (বড়) পাথর আড়াল হয় এবং আবার দেখা হয় তাহলে (আবার) সালাম দিবে। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২০০

 

চতুর্থ হক : সৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা

এ এমন এক আমল, যা প্রত্যেক মুমিন ও মুসলমানের জন্য সর্বদা জরুরি। বিশেষত রাস্তা-ঘাটে। কারণ সেখানেই সব শ্রেণীর মানুষের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। তাই ‘সৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা’কে বিশেষভাবে রাস্তার হকের মাঝে গণ্য করা হয়েছে।

হযরত হামযা ইবনে আবু উসাইদ রাহ. তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন-

أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: وَهُوَ خَارِجٌ مِنَ الْمَسْجِدِ فَاخْتَلَطَ الرِّجَالُ مَعَ النِّسَاءِ فِي الطَّرِيقِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُعَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِلنِّسَاءِ: اسْتَأْخِرْنَ، فَإِنَّهُ لَيْسَ لَكُنَّ أَنْ تَحْقُقْنَ الطَّرِيقَ عَلَيْكُنَّ بِحَافَّاتِ الطَّرِيقِ فَكَانَتِ الْمَرْأَةُ تَلْتَصِقُ بِالْجِدَارِ حَتَّى إِنَّ ثَوْبَهَا لَيَتَعَلَّقُبِالْجِدَارِ مِنْ لُصُوقِهَا بِهِ.

একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখতে পেলেন, রাস্তায় নারী-পুরুষ মিলেমিশে চলাফেরা করছে, তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা পুরুষের পরে যাও। তোমাদের জন্য রাস্তার মাঝভাগে দিয়ে চলাচল করা উচিত নয়। বরং তোমাদের উচিত পথের একপাশ দিয়ে চলাচল করা। হযরত আবু উসাইদ রা. বলেন, এরপর থেকে মহিলারা এতই দেয়াল ঘেষে চলতেন যে, তাদের কাপড় দেয়ালের সাথে ঘষা খেত। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২৭২

আর এটা শুধু রাস্তায় চলার আমলই নয়, বরং সব অবস্থায়ই এটি মুমিনের দায়িত্ব; কোনো অন্যায় দেখলে সাধ্যমত তা দূর করার চেষ্টা করা।

পঞ্চম হক : পথহারাকে পথ দেখিয়ে দেওয়া

পথ চলতে এমন অনেক মানুষ পাওয়া যায়, যারা পথ চেনে না। এমন পথিকদের পথ দেখিয়ে দেওয়া মহৎ নেক কাজ। এর গুরুত্ব কেবল পথহারা লোকেরাই উপলদ্ধি করতে পারে।  এটিকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদাকা বলে গণ্য করেছেন। তিনি বলেছেন-

وَإِرْشَادُكَ الرَّجُلَ فِي أَرْضِ الضَّلاَلِ لَكَ صَدَقَةٌ.

পথ না চেনা ব্যক্তিকে পথ দেখিয়ে দেয়া তোমার জন্য একটি সদাকা। জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৫৬

এলাকার বাইরে থেকে কোনো লোক কোনো এলাকায় এল। সে ঠিকানা বলতে পারে বা ব্যক্তির নাম বলতে পারে, কিন্তু তার বাড়ি চেনে না বা খুঁজে পাচ্ছে না। আমি এলাকার সব চিনি, শুধু একটু আন্তরিকতা থাকলেই তাকে পেরেশানী থেকে বাঁচাতে পারি।

হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত. তিনি হযরত আবু যর রা. থেকে তাঁর ইসলাম গ্রহণের পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন। সে দীর্ঘ ঘটনার মাঝে রয়েছে যে, হযরত আবু যর রা. বলেন, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পুরোপুরি খোঁজ-খবর নিতে আমি নিজেই মক্কা শহরে পৌঁছলাম। কিন্তু তাঁকে চিনলাম না। কাউকে যে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করব সে সাহসও হচ্ছিল না। ফলে আমি মসজিদে বসে রইলাম। হযরত আলী রা. আমাকে দেখে বুঝলেনÑ আমি মুসাফির। সাথে করে বাসায় নিয়ে গেলেন। পানাহারের ব্যবস্থা করলেন। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। দ্বিতীয় দিনও তিনি আমাকে মসজিদে ঐরকম দেখতে পেলেন, ফলে আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। আমি কাউকে কিছু না বলার শর্তে তা জানালাম। তিনি আমাকে বললেনÑ

أَمَا إِنَّكَ قَدْ رَشَدْتَ، هَذَا وَجْهِي إِلَيْهِ فَاتَّبِعْنِي، ادْخُلْ حَيْثُ أَدْخُلُ.

আপনি সঠিকের সন্ধান পেয়েছেন। আমিও সেদিকেই যাচ্ছি। আপনি আমার সাথে চলুন। আমি যেখানে প্রবেশ করব আমার সাথে সাথে প্রবেশ করবেন।

অতপর হযরত আলী রা. আমাকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পৌঁছে দিলেন। সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৫২৮

এ ছিল দুনিয়া ও আখেরাতের পথহারাকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় পথের সন্ধান দান।

এ আদবের অন্তর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হল, অন্ধ, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধিদের রাস্তা পারাপারে সাহযোগিতা করা।

ষষ্ঠ হক : মযলুম ও বিপদগ্রস্তের সাহায্য করা

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। অনেকসময়ই রাস্তা-ঘাটে মানুষ যুলুমের শিকার হয়। বিপদের সম্মুখীন হয়। ফলে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। আমি অন্যের সাহায্যে এগিয়ে গেলে আল্লাহ আমার সাহায্য করবেন। আমি অপর ভাইকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলে আল্লাহ কিয়ামতের দিন আমাকে মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ

الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ، وَلَا يُسْلِمُهُ، مَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ فَإِنَّ اللَّهَ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ بِهَا كُرْبَةً مِنْكُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.

মুসলমানগণ পরস্পর ভাই ভাই। কেউ কারো প্রতি যুলুম করে না এবং শত্রুর কাছে হস্তান্তর করে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করবেন। যে কোনো মুসলমানের একটি কষ্ট লাঘব করবে আল্লাহ তার কেয়ামতের দিনের একটি কষ্ট লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটিও গোপন রাখবেন। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৮৯৩

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেন, একদা পথে এক ব্যক্তির খুবই তৃষ্ণা পেয়েছিল। সে একটি কূপ দেখতে পেয়ে তাতে নামল এবং পানি পান করে উঠে আসল। তখন দেখতে পেল, একটি কুকুর তৃষ্ণার জ্বালায় জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছে এবং তৃষ্ণা মেটাতে কাদামাটি খাচ্ছে। তখন লোকটি মনে মনে বলল; আমার যেমন ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছিল, এ কুকুরেরও ঠিক তেমনি তৃষ্ণা পেয়েছে। সে কূপে নেমে চামড়ার মোজা ভরে পানি নিয়ে এল এবং কুকুরকে পান করাল। ফলে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হলেন এবং তাকে মাফ করে দিলেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন-

يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَإِنَّ لَنَا فِي البَهَائِمِ لَأَجْرًا؟ فَقَالَ: فِي كُلِّ ذَاتِ كَبِدٍ رَطْبَةٍ أَجْرٌ.

ইয়া রাসূলাল্লাহ! গবাদী পশুর ক্ষেত্রেও কি আমাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, প্রত্যেক প্রাণীতেই আজর-সওয়াব রয়েছে। সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৬৬

হযরত আবু মাসউদ আনসারী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি পথে বিপদে পড়েছি (অর্থাৎ আমার বাহন মারা গেছে), আমার জন্য একটি বাহনের ব্যবস্থা করে দিন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাকে দেওয়ার মত কোনো বাহন আমার কাছে নেই। তবে তুমি অমুকের কাছে যাও। আশা করি সে তোমাকে বাহনের ব্যবস্থা করে দিবে। অতপর সে ঐ ব্যক্তির কাছে গেল এবং সে বাহনের ব্যবস্থা করে দিল। পুনরায় সে (পথিক) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এল এবং তা জানাল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি  (যে কোনো উপায়ে) কোনো সৎকর্মের পথ দেখাবে সে ঐ সৎকর্মকারীর সমান প্রতিদান পাবে। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১২৯

সপ্তম হক : বোঝা বহনকারীকে সহযোগিতা করা

রাস্তায় চলাচলকারীদের মধ্যে কেউ থাকে খালি হাতে, কারো সাথে থাকে ভারি বোঝা। ভারি বোঝা যদিও একা বহন করা যায়, কিন্তু উঠানো বা নামানোর সময় কারো না কারো সাহায্যের প্রয়োজন পড়েই। যে ব্যক্তি এ কাজে সাহায্য করে তার জন্য বোঝা বহনকারীর হৃদয় থেকে দুআ আসে, এটাই স্বাভাবিক। আর আমি আল্লাহ্র সন্তুষ্টির নিয়তে কারো মাথা থেকে ভারি বোঝা নামিয়ে দিলাম তো হতে পারে এর অছিলায় আল্লাহ আমার গোনাহের বোঝা নামিয়ে দিবেন, মাফ করে দিবেন।

মাথায় করে ভারি বোঝা বহন করা কষ্টকর। এক্ষেত্রে যদি এমন হয়, আমার বাহনে আমি কারো ভারি বোঝা বহন করে দিলাম। সেটা উঠানো-নামানোর চেয়ে আরো বেশি ফযীলতের। তেমনি আমার বাহন আছে, আরেকজনের নেই। আমার বাহনে আরেকজনকে নিতে পারি। এক ভাইয়ের সাথে দেখা হল, আমি ও সে একই দিকে যাচ্ছি। সেক্ষেত্রে যদি আমার বাহনে তাকে উঠিয়ে নেই এটা হবে অনেক বড় সওয়াবের কাজ।  হাদীস শরীফে এসেছে-

وَتُعِينُ الرَّجُلَ فِي دَابَّتِهِ فَتَحْمِلُهُ عَلَيْهَا، أَوْ تَرْفَعُ لَهُ عَلَيْهَا مَتَاعَهُ صَدَقَةٌ.

কোনো ব্যক্তিকে সাওয়ারীতে ওঠানো বা তার সামানা বহনে সহযোগিতা করাও একটি সদাকা। সহীহ বুখারী, হাদীস ২৯৮৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০০৯

অষ্টম হক : ভালো কথা বলা

পথে একে অন্যের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। কুশলাদি বিনিময় হয়। এক্ষেত্রে  সহাস্য বদনে সুন্দরভাবে কথা বলা উচিত। কারণ, অনর্থক, অশালীন, অন্যায় কথার কারণে অনেক সময় পথে ফ্যাসাদ হয়। আর মুমিনের শানই হল ভালো কথা বলা; অন্যথায় চুপ থাকা। হাদীস শরীফে এসেছে-

مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ.

যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১৮

আর সবচেয়ে ভালো কথা হল, আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করা। ভালো কাজের প্রতি আহ্বান করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلاً مِمَّنْ دَعا إِلَى اللهِ.

কথায় কে উত্তম ঐ ব্যক্তির চেয়ে, যে মানুষকে আল্লাহর প্রতি আহ্বান করে। Ñসূরা হা-মীম আসসাজদাহ (৪১) : ৩৩

নবম হক : হাঁচির জবাব দেয়া

সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণ এটি মুসলিমের একটি বৈশিষ্ট্য। দৈনন্দিন জীবনের মাসনূন দুআগুলো আল্লাহর স্মরণের মাধ্যম। হাঁচি আসা, এটি আল্লাহর রহমত। এর মাধ্যমে শরীর থেকে অনেক জীবাণু বের হয়ে যায়। তাই হাঁচি এলে মুমিন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলে, আলহামদু লিল্লাহ। হাদীস শরীফে একেও পথ চলার হক বলা হয়েছে। সুতরাং পথেও এ সুন্নতের প্রতি খেয়াল রাখা কর্তব্য। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

إِذَا عَطَسَ أَحَدُكُمْ فَلْيَقُلْ: الْحَمْدُ لِلَّهِ، وَلْيَرُدَّ عَلَيْهِ مَنْ حَوْلَهُ: يَرْحَمُكَ اللَّهُ، وَلْيَرُدَّ عَلَيْهِمْ: يَهْدِيكُمُ اللَّهُ وَيُصْلِحُ بَالَكُمْ.

কেউ হাঁচি দিলে বলবে, আলহামদু লিল্লাহ। এর জবাবে আশপাশে যারা থাকবে, বলবেÑ ইয়ারহামুকাল্লাহ। প্রতি উত্তরে হাঁচিদাতা বলবে- ইয়াহদীকুমুল্লাহু ওয়া ইউছলিহু বা-লাকুম। সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭১৫

দশম হক : দম্ভভরে পথ না চলা

দম্ভভরে পথচলার বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে।  রাস্তায় কাউকে পাশ না দেয়া। অন্যের চলাচলের পথে বাধা সৃষ্টি করা। অন্যের যানবাহন আটকে রেখে নিজের পথ সুগম করা। বুক ফুলিয়ে ও মাথা উঁচু করে হাঁটা ইত্যাদি। এ সবই বর্জনীয়। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

وَ لَا تَمْشِ فِی الْاَرْضِ مَرَحًا  اِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْاَرْضَ وَ لَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُوْلًا .

ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে চলো না। তুমি তো পদভারে ভূমিকে বিদীর্ণ করে ফেলতে পারবে না এবং উচ্চতায় পাহাড় পর্যন্তও পৌঁছতে পারবে না। সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩৭

আল্লাহ তাআলা আমলের তাওফীক দান করুন। আমিন।


লেখক – আবদুল ওয়াহিদ বিন মঞ্জুরে এলাহী
ও মুহাম্মাদ ইরফান

সান্নিধ্যের অনুভবে কুরআন তেলাওয়াত / ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

কুরআন মজীদ আল্লাহর কালাম। আমরা আল্লাহকে দেখি নি, এই দুনিয়াতে আল্লাহকে দেখা সম্ভবও নয়; তবে আল্লাহ পবিত্র বাণী কুরআন মজীদ আমাদের মাঝে আছে। এর একেকটি আয়াত আল্লাহর নিদর্শন। এর সাহায্যে আমরা আল্লাহর পরিচয় পেতে পারি। নগণ্য বান্দা আল্লাহর সঙ্গে গড়ে তুলতে পারে গভীর বন্ধন। এতবড় কাজ কীভাবে সম্ভব তার বাস্তব দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় আল্লাহর দু’জন বান্দার জীবনের অভিজ্ঞতা হতে। যারা এক হিসেবে আমাদের খুব কাছের লোক ছিলেন।

আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল উর্দু ও ফারসি ভাষার বিশ্ববিখ্যাত কবি ও দার্শনিক। তার কাব্যসমগ্রের দুই তৃতীয়াংশ রচিত হয়েছে ফারসি ভাষায়, মাত্র এক তৃতীয়াংশ লিখেছেন তার মাতৃভাষা উর্দুতে। তার জন্ম ৯ নভেম্বর ১৮৭৭ সালে পাকিস্তানের শিয়ালকোটে আর ইন্তিকাল ২১ এপ্রিল ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে।

কবির চেয়েও দার্শনিক হিসেবে ইকবালের মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে। গবেষকদের মতে গত ৫০০ বছরে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ইকবালের সমকক্ষ কোন দার্শনিক জন্মান নি। বিগত শতাব্দীতে ইউরোপে রেনেসাঁ আন্দোলনের প্রভাবে চারদিকে যখন ধর্মহীনতার বিস্তার হয়, মানুষ তখন বস্তুবাদ তাড়িত হয়ে ধর্ম ও স্রষ্টার প্রতি অবিশ্বাসী ও সন্দিহান হয়ে পড়ে। স্রষ্টার প্রতি এই অবিশ্বাসের অভিশাপে তারা সবকিছুর প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে পড়ে। তারা সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ বা অবস্তুগত সবকিছু অস্বীকার করে বলেন যে, জগতের সবকিছুই আপেক্ষিক।

আমরা কোন জিনিসকে সুন্দর অসুন্দর ভাবি ও বলি বলেই তা সেরূপ। অন্যথায় সুন্দর অসুন্দরের স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই। তারা দর্শনের যুক্তিজাল বিস্তার কওে বোঝাতে থাকেন যে, আমাদের সামনে যে বস্তুজগৎ তারও কোন অস্তিত্ব নাই। সবই আমাদের মনের কল্পনার প্রতিভাস বা প্রতিচিত্র মাত্র। এমন কি নিজের মধ্যে যে রূহ আছে তার অস্তিত্বও অস্বীকার করেন। এভাবে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী জীবনদর্শন সংশয়বাদের গোলক ধাঁধায় পতিত হয় আর মানুষ নিজের প্রতিও আস্থা হারিয়ে ফেলে।

অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বের অবস্থা ছিল এই যে, তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর উপর নির্ভরের দোহাই দিয়ে নিজের কর্মক্ষমতা ও দায়িত্ব অস্বীকার করার প্রবণতা তাদের পেয়ে বসে। তাসাউফ সাধনার নামে ‘ফানা ফিল্লাহ’র ভাবাদর্শে দুনিয়া ও দুনিয়াবী সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আল্লাহকে পাওয়ার মিথ্যা প্রবঞ্চনার ভয়াবহ বিস্তার ঘটে। এখানেও ইখলাসের নামে ব্যক্তির নিজস্ব সত্তাকে অস্বীকার করার দুরারোগ্য ব্যাধি সংক্রমিত হয়।

আল্লামা ইকবাল এই দুই প্রান্তিক মতবাদের মাঝখানে নতুন জীবন দর্শন উপস্থাপন করে মানব সভ্যতার সামনে একটি মাইলফলক স্থাপন করেন, যা খুদি (আত্মসত্তা) দর্শন নামে প্রসিদ্ধ। অর্থাৎ ‘আমি নিজে আছি’ এ কথা তো অনস্বীকার্য সত্য। কাজেই আমার নিজস্ব অস্তিত্ব আছে। তাই আমার স্রষ্টাও আছেন এবং স্রষ্টার সূত্রে জগতের সবকিছুই অস্তিত্ববান। একই যুক্তিতে এ বিশ্বে আমার দায়িত্ব আছে এবং সে দায়িত্ব সূত্রে এখানে আমার অবস্থান – আমি পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা। আল্লাহর অভিপ্রায় বাস্তবায়ন ও আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী পৃথিবীকে সাজানোর দায়িত্ব নিয়ে আমি পৃথিবীতে এসেছি।

ইকবাল তার এই বিস্ময়কর চিন্তা ও দর্শনের রসদ সংগ্রহ করেছেন কুরআন মজীদ হতে। কুরআন মজীদের বড় বিশেষজ্ঞ না হয়েও প্রাণের সবটুকুন আবেগ দিয়ে প্রত্যহ কুরআন তেলাওয়াত তাকে মহাকবি ও কালজয়ী চিন্তানায়কে পরিণত করে। পিতার উৎসাহে ইকবাল কুরআন মজীদ হতে এমন অতুলনীয় সম্পদ কীভাবে সংগ্রহ করেন সে তথ্য বড় চমৎকার ও তাৎপর্যপূর্ণ।

উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলিম মনীষী মওলানা সুলায়মান নদভী ইকবালসহ আফগানিস্তান সফরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ইকবালের ছোটবেলার একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : “কাবুল সফর থেকে ফেরার পথে কান্দাহারের বালুরাশির বিশাল প্রান্তর অতিক্রম করছি। সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের পাহাড়ের উপর আমাদের গাড়িগুলো দৌড়াচ্ছিল। সন্ধ্যা নেমেছিল। আমরা দু‘জন একই গাড়িতে বসা ছিলাম। আধ্যাত্মিকতা নিয়ে কথাবার্তা চলছিল। আলোচনা হচ্ছিল দিব্যদৃষ্টির বুযর্গদের প্রসঙ্গ নিয়ে। এসময় তিনি বড় আবেগ নিয়ে নিজের জীবনের দু’টি ঘটনা বর্ণনা করলেন। আমার মতে এই দু-টি ঘটনা তার (ইকবালের) জীবনের যাবতীয় সুকীর্তির আসল বুনিয়াদ।

তিনি বলেন – আমি যখন সিয়ালকোটে পড়ালেখা করছিলাম, তখন ভোরবেলা উঠে প্রতিদিন কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতাম। মরহুম ওয়ালেদ সাহেব (বাবা) তার নিয়মিত দোয়া দরূদ হতে অবসর হয়ে আসতেন এবং আমাকে দেখে চলে যেতেন। একদিন ভোরে তিনি আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন মুচকি হেসে বললেন : “কখনো সুযোগ হলে আমি তোমাকে একটি কথা বলব।” কথাটি বলার জন্য আমি দু-তিনবার অনুরোধ জানালে তিনি বললেন : “যখন পরীক্ষা দিয়ে নেবে, তখন।” যখন আমি পরীক্ষা দিয়ে ফেললাম এবং লাহোর থেকে ঘরে আসলাম, তখন বললেন : “যখন পাশ করে ফেলবে।” পাশ করার পর জিজ্ঞাসা করলাম। তখন বললেন যে :

“(ঠিক আছে) বলব।” একদিন ভোরে নিয়মমাফিক কুরআন তেলাওয়াত করার সময় তিনি আমার কাছে এলেন এবং বললেন : “বেটা, বলছিলাম যে, তুমি যখন কুরআন পড় তখন এরূপ যে, কুরআন তোমার উপরই নাযিল হচ্ছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তোমার সঙ্গে কথা বলছেন।”

ইকবাল বলছিলেন যে, বাবার এই উক্তি আমার অন্তরের মধ্যে বসে যায়। আর তার স্বাদ অন্তরে এখনো অনুভব করছি। এটিই ছিল সেই বীজ, যা ইকবালের অন্তরের মধ্যে বপন করা হয় আর তার পল্লবিত শাখা-প্রশাখা জগতের বিশাল আঙ্গিনায় মধুর বচনামৃতরূপে ছড়িয়ে আছে।

এ জাতীয় আরো তথ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, কুরআন তেলাওয়াতের সময় আল্লামা ইকবালের অনুভব ছিল, এখনই বুঝি পবিত্র কুরআন মজীদ তার উপর নাযিল হচ্ছে। কুরআন মজীদের প্রতি তার এ আসক্তি ছিল আশৈশব। এ প্রসঙ্গে হাকীম মুহাম্মদ হাসান কুরেশী লিখেছেন, কুরআনে হাকীমের প্রতি তার সীমাহীন আসক্তি ছিল। ছোটবেলা থেকেই তিনি উচ্চৈঃস্বরে কুরআন তেলাওয়াত করতে অভ্যস্ত ছিলেন। কুরআন তেলাওয়াতকালে মনে হত, তিনি এর দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন। কণ্ঠস্বর বসে যাওয়ার ফলে তার মধ্যে সবচে অস্বস্তির কারণ ছিল, তিনি কুরআনে হাকীম উচ্চৈঃস্বরে পড়তে পারছিলেন না। অসুস্থতার দিনগুলোতেও কেউ তার সম্মুখে মধুর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করলেই তার অশ্রু প্রবাহিত হত এবং শরীরে কম্পনের অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যেত।
হৃদয়ের জ্বলন ও আসক্তি নিয়ে তিনি কুরআন তেলাওয়াত করতেন। তিনি পড়তে থাকতেন আর কেঁদে সারা হতেন। এমনকি কুরআন মজীদের পাতাগুলো একেবারে ভিজে যেত। আর তা রোদে শুকানো হত। তিনি যে কুরআন মজীদটি নিয়মিত তেলাওয়াত করতেন, তা লাহোরের ইসলামিয়া কলেজের লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে এবং এই বর্ণনার বাস্তব প্রমাণ হয়ে রয়েছে।

কুরআন মজীদ কতখানি গভীর মনযোগ ও হৃদয়ের আবেগ ও একাগ্রতা নিয়ে তেলাওয়াত করা উচিত তা বিভিন্ন রেওয়ায়াত থেকেও অনুমান করা যায়। যেমন : হযরত খাব্বাব ইবনুল আরাত রা. বলেন, তুমি যতদূর সম্ভব আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য অর্জন কর আর তুমি এমন কোন জিনিস দিয়ে তার সান্নিধ্য অর্জন করতে পারবে না, যা তার কাছে তার কালাম (কুরআন)-এর চেয়ে অধিক প্রিয়।”

এ মর্মে সুনানে দারেমীতে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। হযরত আতিয়া (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহর কাছে তাঁর কালাম (কুরআন)-এর চাইতে মর্যাদাসম্পন্ন আর কোন বাক্য নাই। আর এমন কোন বাক্য বান্দাকে আল্লাহর সান্নিধ্য দান করে নি, যা তার কাছে তার কালামের চেয়ে অধিক প্রিয়। [সুনানে দারামী]

কুরআনে হাকীমে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন : “নিশ্চয়ই মু‘মিন তারা, আল্লাহর কথা স্মরণ করা হলে যাদের অন্তরসমূহ প্রকম্পিত হয় এবং যখন তাদের কাছে তার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয় তখন তা তাদের ঈমানকে বৃদ্ধি করে আর তাদের প্রভুর উপর তারা নির্ভরশীল হয়।” [সূরা আনফাল : আয়াত-২]
এই আসক্তি নিয়ে ইকবাল অন্যদেরকেও কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। যেমন নিয়াজ উদ্দীন খানকে লেখা এক পত্রে ইকবালের এই দৃষ্টিভঙ্গি এভাবে ব্যক্ত হয়েছে।

“কুরআন বেশি বেশি পাঠ করা চাই। যাতে অন্তর মুহাম্মদী সম্বন্ধ লাভ করতে পারে। এই মুহাম্মদী সম্বন্ধ (ইকবালের ভাষায় নিসবতে মুহাম্মদীয়া) লাভ করার জন্য “কুরআনের অর্থও জানতে হবে – তা জরুরী নয়। হৃদয়ের নিষ্ঠা নিয়ে কেবল পাঠ করাই যথেষ্ট।”

ইকবালের আরেকজন গবেষক ফকির সৈয়দ ওয়াহিদুদ্দীন ‘রূযেগারে ফকির’-এর ১ম খ-ে আল্লামা ইকবালের জীবনের কুরআন সম্পর্কিত ঘটনাবলীর বর্র্ণনা দিয়েছেন। তাতে ইকবালের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন : একবার লাহোরে ফোরমিন ক্রিশ্চিয়ান কলেজের বার্ষিক সভা হচ্ছিল। কলেজের প্রিন্সিপাল ড. লুক্স আমাকেও সে সভায় আমন্ত্রণ জানান। সভার প্রোগ্রামাদি শেষে চা আপ্যায়নের আয়োজন ছিল। আমরা চা পান করতে বসলাম। এ সময় ড. লুক্স আমার পাশে এলেন এবং বলতে লাগলেন, চা পানের পর চলে যাবেন না কিন্তু। আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। আমাদের চা পান শেষ হলে ড. লুক্স এসে আমাকে এক কোণায় নিয়ে গেলেন এবং বলতে লাগলেন যে, ইশবাল, আমাকে বলুন তো, আপনাদের নবীর উপর কুরআনের কি ভাবার্র্থ অবতীর্ণ হয়েছিল এবং যেহেতু তিনি শুধু আরবি ভাষাই জানতেন, সেহেত কুরআন মজীদকে (সেই ভাবার্থ) তিনি আরবি ভাষায় রূপান্তরিত করে দিয়েছেন? নাকি বর্তমান ভাষ্যই এভাবে নাযিল হয়েছে? আমি বললাম, এই ভাষ্যই নাযিল হয়েছে। ড. লুক্স বিস্মিত হয়ে বললেন, ইকবাল আপনার মত লেখাপড়া জানা লোক কীভাবে একথা বিশ্বাস করেন যে, কুরআনের ভাষ্যই এভাবে অবতীর্ণ হয়েছে। আমি বললাম, ড. লুক্স! নিশ্চয়ই আমার অভিজ্ঞতা আছে। আমার উপর কবিতা তো পূর্ণাঙ্গরূপে অবতীর্ণ হয়। তাহলে পয়গাম্বর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর ভাষ্য কেন পূর্ণাঙ্গরূপে অবতীর্ণ হবে না?
ইকবাল গবেষক ইবাদুল্লাহ ফারুকী লিখেছেন, আল্লামা ইকবাল তার বিখ্যাত ‘খুতবাত’ এর এক জায়গায় বলেন, সূফিয়ায়ে কেরামের মধ্যকার একজন বুযর্গ বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত মু‘মিনের অন্তরের উপর কিতাব (কুরআন মজীদ) সেভাবে নাযিল না হবে, যেভাবে আঁহযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল হয়েছিল ততক্ষণ তাকে বোঝা সম্ভব নয়। …ইকবাল তাঁর অনবদ্য রচনা ‘বালে জিব্রিল’ (জিব্রাঈলের ডানা)Ñএর মধ্যে এ অভিব্যক্তিটি এভাবে ব্যক্ত করেছেন : তোমার অন্তঃকরণে যতক্ষণ না হবে অবতরণ কিতাবের, জট খুলতে পারবে না রাজি কিংবা রচয়িতা কাশশাফের।
রাজি মানে বিখ্যাত বিশাল তাফসীর গ্রন্থ ‘তাফসীরে কবির’-এর রচয়িতা ইমাম ফখরুদ্দীন রাজি। আর ‘রচয়িতা কাশশাফে’র মানে ইসলামী জাহানে কুরআন মজীদের অলৌকিত্বের অকাট্য প্রমাণ হিসেবে সর্বমহলে সমাদৃত তাফসীরগ্রন্থ ‘কাশশাফ’Ñএর রচয়িতা আল্লামা জারুল্লাহ যামাখশারী। ইকবাল বলছেন যে, কুরআন তেলাওয়াতকারীর অনুভবে যদি এখনই কুরআন তেলাওয়াত হচ্ছে এমন উপলব্ধি না আসে তাহলে ইমাম রাজি বা আল্লামা যামাখশরীর তাফসীর পড়লেও তা তোমার অন্তরের জট খুলতে পারবে না।
মনে হবে কুরআন তেলাওয়াতে আল্লামা ইকবালের নিমগ্নতা ইসলামের ইতিহাসের নতুন অভিজ্ঞতা। কিন্তু না। অন্যান্য বুযর্গের জীবনেও এর নজির বিদ্যমান। এ সম্পর্কে সাম্প্রতিককালের একজন বুযুর্গের অভিব্যক্তি এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
বাংলাদেশের অন্যতম আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মীর মুহাম্মদ আখতার (রহ.)। তিনি আত্মপরিচয় লুকিয়ে রাখলেও তার স্থলবর্তী খলিফা মওলানা আব্দুল জব্বার (রহ.) বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। মওলানা মুহাম্মদ আব্দুল জব্বার (রহ.)-এর অনুলিখনে মওলানা মীর মুহাম্মদ আখতর (রহ.)-এর একটি কিতাবের নাম ‘বেশারাতুল ইখওয়ান ফী খাওয়াচ্ছিল কুরআন’। কুরআন ও হাদীস ভিত্তিক দোয়া দরূদ সংক্রান্ত এই কিতাবের শেষভাগে কুরআন তেলাওয়াতের আদব ও নিয়ম সম্পর্কিত বর্ণনাটি সত্যিই বিস্ময়কর। তিনি কথাগুলো বলেছেন, হযরত আব্দুল আযীয দেহলভী (রহ.)-এর বরাতে। তিনি বলেন, “এই স্থানে বরকতের জন্য খাতিমূল মুফাছছিরীন হজরত শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিছ দেহলবী (রা)-এর কতেক ভাষ্য উদ্ধৃত করা হইল। তিনি ফরমাইয়াছেন : পাক কোরআন তেলাওয়াতের নিয়মাবলী এই যে, সভ্য শায়েস্তাভাবে যথাসম্ভব কেবলামুখী হইয়া তেলাওয়াত করা এবং অক্ষরকে যথাস্থান হইতে বাহির করিয়া প্রত্যেকটি শব্দের উচ্চারণ করা এবং মদ্দা ও তশদীদকে সঠিক আদায় করা, ছাড়িয়া না যাওয়া আর ওয়াকফের জায়গায় ওয়াকফ করা। এই সমস্ত হইতেছে কোরআন পাঠের যাহেরী আদব। আর বাতেনী আদাবের মধ্যে অবশ্য তেলাওয়াতকারীর শ্রেণী হিসাবে পার্থক্য বিদ্যমান। যদি তিনি তরীকত মা‘রেফতের প্রাথমিক শ্রেণীর লোক হন, তবে তাহার তেলাওয়াতের বাতেনী আদব এই যে, তিনি মনে প্রাণে এইরূপ ধারণা করিয়া লইবেন যে, আমি আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সম্মুখে তেলাওয়াত করিতেছি এবং তিনি স্বয়ং ওস্তাদের জায়গায় বসিয়া আমার তেলাওয়াত শ্রবণ ফরমাইতেছেন। আর যাঁহারা মা‘রেফতের উচ্চাসন লাভ করিয়াছেন তাঁহাদের তেলাওয়াতের বাতেনী আদব এই যে, যখন তিনি পড়িতেছেন যদিও নিজ মুখে পাঠ করিতেছেন, কিন্তু তিনি নিজকে হারাইয়া ফেলিয়া এই খেয়ালের বশীভূত হইয়া যাইবেন যে, আল্লাহর বাণী আল্লাহরই দরবার হইতে প্রচার হইতেছে অথবা আল্লাহর বাণীর প্রচার আল্লাহর তরফ হইতে এবং শ্রবণের কর্তব্য আমার কর্ত দ্বারা আন্জাম্ হইতেছে। হজরত জা‘ফর সাদিক (রহ.) এই মাকামের দিকে ইঙ্গিত করিয়াছেন। যেমন শায়খুশ শুয়ুখ আওয়ারিফ কিতাবে তাঁহার বক্তব্য উদ্ধৃত করিয়াছেন : “অবশ্য (আমি তেলাওয়াতকালে) ততক্ষণ কোন আয়াত তেলাওয়াত করি না, যতক্ষণ সেই তেলাওয়াত উহার ভাষ্যকার হইতে আমি না শুনি।” (বেশারাতুল ইখওয়ান ফী খাওয়াচ্ছিল কুরআন, পৃ. ১৯৪-১৯৫)

প্রশ্ন আসতে পারে, মানুষ আল্লাহর কাছ থেকে কুরআনের বাণী শ্রবণ করবেন, তা কীভাবে সম্ভব? অথবা মানুষের মুখ দ্বারা কীভাবে সরাসরি আল্লাহর বাণী উচ্চারিত হওয়া সম্ভব। এর ব্যাখ্যায় কুরআন মজীদে বর্ণিত আল্লাহর সঙ্গে  মূসা (আ.)-এর কথাবলার একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। মূসা (আ.) স্ত্রী বিবি সারাকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি হযরত শোয়াইব (আ.)-এর কাছ থেকে আসছিলেন। পথিমধ্যে দেখা দেয় তার স্ত্রীর প্রসব বেদনা। মুসাফিরির হালতে এমন কষ্টকর পরীক্ষা হয়ত আল্লাহর নবীদের জন্যই বরাদ্দ ছিল। বিজন প্রান্তর, আঁধার রাত, শীতের মওসুম। মূসা (আ.) একটুও বিচলিত হলেন না। স্ত্রীকে সান্তনা দিয়ে বললেন, ঐ দূরে পাহাড়ের গায়ে আগুন দেখা যায়। আমি যাই। হয়ত সেখান থেকে আগুন পাব অথবা আগুনের কোন ব্যবস্থা হবে। মূসা আ. আগুনের আশায় পাহাড়ের কাছে গেলেন তো অবাক। যে গাছটিতে আগুন জ্বলছিল, তা কথা বলে উঠল।

মূসাকে নাম ধরে ডাক দিয়ে বলল, হে মূসা! আমি তোমার প্রভু আল্লাহ। তুমি তো এক পবিত্র প্রান্তরে উপনীত। কাজেই তোমার পাদুকা খুলে ফেল। কাজেই গাছ যেভাবে দাবি করল যে, আমি আল্লাহ আর একই সঙ্গে আল্লাহর হয়ে কথা বলল, তেমনি কুরআন তেলাওয়াতকারীরও এরূপ অনুভবে আত্মহারা হওয়া সম্ভব। মওলানা মীর মুহাম্মদ আখতর (রহ.) শেখ শাহাব উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী প্রণীত আওয়ারেফুল মাআরেফ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন।

তিনি বলেন : আওয়ারিফ কিতাবে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করা হইয়াছে যে, তেলাওয়াতের সময় হযরত ইমাম জাফর সাদিক (রা) হজরত মূসা (আ.)-এর সেই বৃক্ষের পর্যায়ে হইতেন, যাহা হইতে বাণী প্রচার হইয়াছিল : “নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ সমগ্র বিশ্বের প্রভু পালনকর্তা। (হজরত মূসা আ. ) যদিও উক্ত বাণী বৃক্ষ হইতে শ্রবণ করিলেন কিন্তু আসলে প্রচার হইতেছিল আল্লাহর তরফ হইতে। উচ্চ পর্যায়ের আউলিয়াগণ কোরআন তেলাওয়াতকালে সেই বৃক্ষের মতই হইয়া যান।(বেশারাতুল ইখওয়ান, পৃ. ১৯৫)

কারো সঙ্গে সম্পর্ক করতে চাইলে করণীয় কী? এ প্রশ্নের জবাব হবে, তার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। আবার যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কারো সঙ্গে পরিচিত হওয়ার উপায় কী? তাহলে উত্তর হবে, কারো সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সবচে সহজ ও একমাত্র পথ হচ্ছে তার সঙ্গে কথা বলা। যদি কল্পনা করা হয় যে, কোন একজন বিদেশী লোক, তার সঙ্গে পরিচয় ও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তাহলে সবচে কার্যকর পথ হচ্ছে, তার ভাষাতেই কথা বলা।

এমনকি অর্থ না বুঝেও যদি কোন বিদেশীকে তার কোন উক্তি শুনিয়ে দিতে পারে তাহলে তার মনযোগ আকর্ষণ করতে মোটেও কষ্ট হবার কথা নয়। এই উপমাটি পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত এবং তেলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও সান্নিধ্য অর্জনের দর্শন বোঝার ক্ষেত্রে শতভাগ প্রযোজ্য। তেলাওয়াতের সময় যে যতখানি আল্লাহর জন্য নিবেদিতপ্রাণ হতে পারবে তার পক্ষে ততখানি আধ্যাত্মিক উন্নতি ও আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করা সম্ভব হবে। কেননা, আরেক রেওয়ায়াত অনুযায়ী কুরআন মজীদ হচ্ছে আল্লাহকে পাওয়ার রশি।

শুধু তাই নয়, এটি এমন রশি যার একপ্রান্তে আছেন মহান আল্লাহ তাআলা আর অপর প্রান্তে আল্লাহর বান্দা।
ইরশাদ হয়েছে : “হযরত আবু শুরাইহ আল-খাযায়ী (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে উপস্থিত হলেন। তখন তিনি বললেন : তোমরা সুসংবাদ নাও, সুসংবাদ নাও। তোমরা কি সাক্ষ্য দাও না যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই। আর আমি আল্লাহর রাসূল। তারা বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই কুরআন হচ্ছে এমন অবলম্বন (রশি) যার এক প্রান্ত রয়েছে আল্লাহর হাতে, আরেক প্রান্ত তোমাদের হাতে। কাজেই তোমরা একে মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধর। একে মজবুতভাবে ধরার পরে তোমরা কখনো ধ্বংস হবে না এবং পথহারাও হবে না।” [বুখারী ও মুসলিম]