Firas Alkhateeb-এর “What was special about pre-Islamic Arabia?” লেখাটি  Niaz Morshed কর্তৃক অনুদিত।

খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে আরবে একটি ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটেছিলো। নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর মাধ্যমে প্রেরিত জীবনধারা (ইসলাম) খুব অল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র আরবের জীবনযাপনের একমাত্র পথনির্দেশনায় পরিণত হয়েছিল। এতই দ্রুত এটি ঘটেছিল এবং এতই মনোমুগ্ধকর ইসলামের শিক্ষা যে, বিশ্বাসীদের জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি ব্যাপারে এটি সুপ্রতিষ্ঠিত হতে সময় লেগেছিলো মাত্র কয়েক বছর। কী খাওয়া উচিত আর কী খাওয়া উচিত নয়, রাতে কিভাবে ঘুমানো উচিত, বাথরুমে যাওয়া-আসার নিয়ম থেকে শুরু করে রাজনৈতিক এবং সরকারী নিয়মাবলীর সবকিছু এতগুলো মানুষের মধ্যে এত অল্প সময়ে এভাবে আমূলে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া এর আগে কোনো গণজাগরণের ইতিহাসে নেই।

কীভাবে সেটি তখন সম্ভব হয়েছিল তা এখনো পর্যন্ত ইতিহাসবিদদের কাছে একটি রহস্য! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, ইসলামের প্রথম চার খলিফার শাসনামলের পূর্ণতা পেতে পেতে ইসলামিক রাষ্ট্রের পরিধি আরব থেকে পশ্চিমের লিবিয়া, আর সেখান থেকে চলে গিয়েছিলো পূর্ব প্রান্তের পারস্যে। আর এর মাত্র একশ’ বছরের মধ্যেই ইসলামিক সাম্রাজ্য স্পেন এবং ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিল!

আগেই বলেছি, বিশ্ব ইতিহাসে কখনো অন্য কোনো জাগরণ ইসলামের প্রথম একশ’ বছরের মতো এতটা দ্রুত প্রসারিত হয়নি। আর এটা কেবলই মুসলিমদের দাবী নয়, বরং সর্বজনস্বীকৃত সত্য। আমরা মুসলিম হিসাবে অবশ্যই বিশ্বাস করি যে, আল্লাহর হুকুমেই ইসলাম এরকম অকল্পনীয় সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিল।

কিন্তু, সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে: কী এমন বিশেষত্ব ছিল ইসলামের যার ফলে এই অভূতপূর্ব অর্জন সম্ভব হয়েছিল? কোন্‌ সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি এই সাফল্যকে ত্বরান্বিত করেছিল? কোনো কোনো ইতিহাসবিদ এক বাক্যে এর কারণ ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন, আর অবশ্যই সেটি ইসলামের প্রতি তাদের লালিত আক্রোশকে চরিতার্থ করার জন্যই। তারা বলতে চান যে, ইসলাম-পূর্ব আরবে যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং জাতীয়তার অহংকার খুব প্রবল ছিল, আর সেটিকে পুঁজি করেই ইসলামের নাম দিয়ে যুদ্ধ এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে আরব দেশগুলোকে দখল করে নিয়েছিল মুসলিমেরা।

বলাই বাহুল্য, এহেন দাবী কোনো বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসবিদের মুখে মানায় না, কারণ জটিল এবং দীর্ঘ একটি ইতিহাসের সবকিছু অগ্রাহ্য করে একটি এক বাক্যের স্লোগান কখনোই ইতিহাসভিত্তিক সত্য বলে গৃহীত হতে পারে না। সত্যি কথা বলতে কি, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়: তৎকালীন আরব ভূখন্ড ও তাদের আশেপাশের এলাকাগুলোকে যেন নিঁখুতভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল এক-স্রষ্টায় বিশ্বাসী কোনো ঐক্যবদ্ধকারী মতাদর্শকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি, ভাষা, জলবায়ু এবং রাজনীতি সবই যেন ইসলামের আগমনের অপেক্ষা করছিল! ( ইসলাম পূর্ব আরবের অবস্থা )

ইসলাম-পূর্ব আরবের রাজনৈতিক পরিস্থিতি:

আবহাওয়া এবং জলবায়ু বিচারে আরবের ভৌগোলিক পরিবেশ এবং বাসভূমি সেখানে বসবাসকারীদের জন্য ভয়ংকর প্রতিকূল হয়ে উঠতে পারে। তার কারণ এখানে কোনো স্থিতিশীল নদী, জলপ্রবাহ কিংবা হ্রদ নেই। জীবনধারণের প্রধান উত্‍সই ছিলো অপ্রতুলভাবে আরবের এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট সবুজ এলাকা যাতে একটি বা দুটি পানির উত্‍স (ফোয়ারা কিংবা কুয়া) থাকে। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমণ করা বেশ কঠিন একটি কাজ। এমনকি, আজকের দিনেও আরবের মরুভূমির কিছু কিছু বিস্তৃত জায়গা সম্পূর্ণ জনমানবহীন, কারণ এসব জায়গায় পানির কোনো উত্‍সই নেই। আর পানির নিয়মিত যোগান ছাড়া কোনো স্থানে জনবসতি গড়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব।

আরব মরুভূমির এই জনমানবহীন বিশাল এলাকাগুলো আরবদের এবং আরবের বাইরে বসবাসকারীদের মধ্যে একই সাথে একটি বাধা এবং একটি সংযোগকারী হিসেবে কাজ করতো। বস্তুতই, এই এলাকাগুলোকে একসাথে বলা হতো ‘জাজিরাত আল-আরব’ কিংবা ‘আরবদের দ্বীপ’। এই নামটি দিয়েছিলো ইসলাম-পূর্ব আরবের অধিবাসীরা। দ্বীপ বলে এদের আখ্যায়িত করার কারণ অন্যান্য সব এলাকা থেকে এই এলাকাগুলো কার্যত সম্পূর্ণই বিচ্ছিন্ন ছিলো।

এই এলাকা এতই বেশী বসবাসের অনুপযোগী এবং বন্য ছিলো যে, শুধুমাত্র বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অত্যন্ত সহনশীল আরবদের পক্ষেই এই এলাকায় বেঁচে থাকা সম্ভব ছিলো। আর আরবে প্রবেশের আগেই এহেন দুর্যোগপূর্ণ বিশাল এলাকার পরিবেষ্টন আরবকে বহির্বিশ্বের আক্রমনের হাত থেকে বেশ নিরাপদ রেখেছিলো। যদিও ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, দু’দুটি বড় সম্রাজ্য আরব আক্রমনের চেষ্টা করেছিলো।

ইসলামের আগমনের পূর্বে বিশ্বের কোনো শক্তিশালী সাম্রাজ্যই আরবের উপর কতৃত্ব করতে পারেনি। তত্‍কালীন সময়ে রোমানরাই তখনো পর্যন্ত প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্রাজ্য ছিলো। রোমানদের কর্তৃত্ব ভূমধ্যসাগর (Mediterranean Sea) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। আর তাই কেউ যদি আরব জয় করতে পারতো, সেটা হতো রোমানরাই। এমনকি তারা আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে সেই চেষ্টা করেছিলোও – খৃষ্টপূর্ব ২৪ সালে ওদের আরব আক্রমণ সেটাই আমাদের দেখায়।

তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের এই চেষ্টা শেষ পর্যন্ত একটি প্রকাণ্ড ব্যর্থতা হিসেবে থেকে গিয়েছিলো তাদের সামরিক এবং রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে। বিশ্বখ্যাত রোমান সৈন্যবাহিনী খুব ভালোভাবেই কাজ করেছিলো Mediterranean জলবায়ুতে। কিন্তু, আরবের বিরূপ আবহাওয়ার ধকল সামলে যুদ্ধে জেতার মতো ক্ষমতা কিংবা যুদ্ধশৈলী তাদের ছিলো না মোটেই। আর তাই আরবের উত্তর মরুভূমির উত্তর প্রান্তের সীমানা পেরিয়ে রোমানরা কখনোই তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

Map_of_Arabia
ইসলাম পূর্ব আরবের গোত্র

ইসলাম-পূর্ব বিশ্বের অন্য পরাশক্তিটি ছিল পারস্য সাম্রাজ্য। আরবের উত্তর এবং পূর্ব পাশে অবস্থিত এই সাম্রাজ্যটিও চেষ্টা করেছিলো এই অঞ্চলের উপর তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে, যার ফলশ্রুতিতে তারা রোমানদের সঙ্গে একটি নিরবিচ্ছিন্ন সংঘাতেও জড়িয়ে পড়েছিলো। রোমান এবং পারস্য বাহিনীর মধ্যকার এই নাছোড়বান্দা রেষারেষি আর একে অন্যকে আক্রমনের চেষ্টার মধ্যে পড়ে দুই বাহিনীর রণক্ষেত্রের ঢাল হতে বাধ্য হয়েছিল ইরাক ও সিরিয়ার ভূখণ্ড। যেহেতু এই দুই বাহিনী একে অন্যের আক্রমণ প্রতিহত করতেই ব্যস্ত ছিলো, এদের কেউই শেষ পর্যন্ত আরবের ভূখণ্ডের দখল নিতে পারেনি।

আরবের উত্তর পাশের এই দুই প্রতিবেশী প্রায় সারাক্ষণই যুদ্ধে লিপ্ত থাকতো, আর সেই সুযোগে আরব ছিলো সম্পূর্ণ স্বাধীন। আর এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে থাকার কারণে আরববাসীদের কখনোই বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যাপারস্যাপারগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়নি। তারা কোনো ধরনের প্রভুত্বের দাস না হয়েই তাদের জীবনযাপন করতে পারতো, আর ফলশ্রুতিতে নিজেদের মধ্যেই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তৈরী করে নিয়েছিল।

এভাবে যে রাজনীতির প্রবাহ তাদের সমাজে এবং গোত্রগুলোর মধ্যে তৈরী হয়েছিল সেটি বলতে গেলে ছিলো সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রীত। তার মানে, আরবের রাজনীতিতে কারো একচ্ছত্র প্রভাব বা কর্তৃত্ব ছিলো না। সেখানে মানুষ ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক স্বাধীনতা খুব ভালোভাবে উপভোগ করতো। গোত্রীয় সংঘবদ্ধতা ছিলো সে অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক বল। আরবের সেসকল গোত্রের মানুষজন খুব সহজ একটি জীবনধারা তৈরী করে নিয়েছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মরুভূমিতে যাযাবরদের মতন ঘুরে বেড়ানো, বিভিন্ন স্থানে কেনাবেচার হাট আয়োজন করা, দ্রব্য বিনিময় কিংবা ক্রয় বিক্রয় করা, আর হালকা চাষাবাদ ইত্যাদি।

ইসলাম-পূর্ব আরবের ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি:

তৎকালীন আরব সংস্কৃতি তাদের ভৌগোলিক অবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। রুক্ষ মরু পরিবেশ আরবদের বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে, এই ভূমি একাকী জীবনযাপনের জন্য নিতান্ত অনুপযোগী। আত্মীয়দের উপর নির্ভরশীলতাই ছিল তাদের জীবনের প্রতি হুমকিস্বরূপ বিরূপ প্রকৃতি আর চরম উত্তাপের বিরুদ্ধে প্রাথমিক রক্ষাকবচ। আর সেকারণে পরিবার ও গোত্রই হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। তদুপরি, মরুভূমির এই রুক্ষতার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আরববাসীদের মধ্যে অতিথিপরায়নতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখতো।

এটা রীতিমতো তাদের নীতিবোধের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। যেকোনো ভ্রমণকারী অতিথিরাই আরবের যেকোনো গোত্রের কাছে আশ্রয় এবং নিরাপত্তা চাইলে কোনো রকম প্রশ্ন ছাড়াই তা দেয়া হতো। শত্রুর হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো অতিথিদের জন্যও সেটি সমানভাবে প্রযোজ্য ছিল। নিজ পরিবারের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং নিরাপত্তা প্রদান করার ব্যাপারটি সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকের আরবদের মধ্যে হয়ে উঠেছিল একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ম। এব্যাপারে তাদের মধ্যে কখনো দ্বিমত ছিল না এবং তারা কখনোই এর কোনো ধরনের ব্যতিক্রম ঘটাতে রাজি ছিল না।

ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে আরবদের মধ্যে বহু দেবতার (একের অধিক প্রভুর) উপাসনা কিংবা পুজো করা ভয়াবহভাবে সংক্রমিত হয়ে গিয়েছিলো। নবী ইব্রাহীম এবং তাঁর পুত্র ইসমাইল (তাঁদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক) প্রায় ১৮০০ খ্রিস্টপূর্ব সালে কাবা নির্মাণ করেছিলেন এবং তত্‍কালীন সময়ের আরবদেরকে এক প্রভুর উপাসনার ধর্মের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আরবরা প্রভুর একত্ববাদের সেই শিক্ষা বিকৃত করে ফেলেছিল এবং সৃষ্টিকর্তার সাথে সাথে আরও অনেক ছোট ছোট দেবতা কিংবা প্রভুর পুজো করা শুরু করেছিলো।

এইসব দেবতাদের মূর্তি তৈরী করে তারা পুজো করত, যার ফলশ্রুতিতে খোদ কাবার ভেতরেই ৩৬০টির বেশী মূর্তি তারা সবসময় সাজিয়ে রাখতো। যেই কাবা নবী ইব্রাহীম (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) এক প্রভুর উপাসনা করার জন্য তৈরী করেছিলেন, সেটাই দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল এক প্রভুর সাথে অন্যসব মানব-নির্মিত এবং কল্পনাপ্রসূত দেবতাদের উপাসনা করার মতো ঘৃণিত কাজে।

কাবা নিয়ে তাদের ব্যবসা এবং ধর্মীয় অনুভূতি যাই হোক না কেন, আরবদের প্রধান সাংস্কৃতিক রত্ন ছিল তাদের ভাষা। মরুভূমিতে শৈল্পিক নৈপুন্যের ক্ষেত্র খুব একটা ছিল না, থাকার কথাও নয়। রোমান এবং গ্রীকদের মতো মূর্তি নির্মানের কিংবা চিত্রাংকনের শিল্প মরুভূমিতে বসবাসকারী আরবদের জন্য মোটেই বাস্তবসম্মত ছিল না। আর তাই সেটি সীমাবদ্ধ ছিল কেবলমাত্র পুজোর মূর্তি তৈরীর কাজে।

এধরনের শিল্পের অনুপস্থিতিতে কাব্যশিল্প তার সমস্ত ডালপালা মেলে বিকশিত হয়েছিল আরবদের মধ্যে। আরবী ভাষার গঠন খুবই তাল ও ছন্দময়, যে কারণে এটি কাব্য রচনার জন্য ছিল অতীব চমত্‍কার একটি ভাষা। আরবে প্রতিবছর সবচেয়ে ভালো সব কবিদের একটি মিলনমেলা হতো, যেখানে এসে ভালো কাব্য উপহার দিতে পারলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সে পুরো আরবের মধ্যে রীতিমতো তারকাখ্যাতি পেয়ে যেত এবং তাদের কাব্যিক শিল্পগুনের জন্য সবাই তাদেরকে চিনতো।

ইসলামের জাগরণের সাথে এটি কীভাবে সম্পর্কিত?

যখন কুরাইশ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত একজন সম্মানিত এবং ‘বিশ্বাসী’-খ্যাতিপ্রাপ্ত ব্যক্তি মক্কায় ৬১০ সালে এক-প্রভুর উপাসনার ধর্ম প্রচার শুরু করলেন তখন কেউই ধারনা পর্যন্ত করতে পারেননি কীভাবে এই ধর্মের কথা সবখানে ছড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে তত্‍কালীন আরবের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি সহায়ক ভূমিকা রাখবে। যদিও এই ধর্মের বাণীর অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য এবং যে পরিস্থিতিতে এটি মানুষের মাঝে প্রেরণ করা হয়েছিল সেটি পর্যালোচনা করে আজ প্রতিটি বিশ্বাসীই (মুসলিম) এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, পুরো ব্যাপারটিই স্বয়ং প্রভুর পরিকল্পিত ছিলো, যেটি তার পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যেই ইসলামকে বিশ্বের প্রধান ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছিলো।

রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইসলাম বাইরের বিশ্বের কাছে পৌছানোর আগেই নিজেদের মধ্যে বেড়ে ওঠার এবং একটি শক্ত ভিত তৈরী করার যথেষ্ট সময় পেয়েছিল। এর মূল কারণ ছিলো তত্‍কালীন বহির্বিশ্বের দুই মূল শক্তি পারস্য এবং রোম সৈন্যবাহিনী বারবার একে অন্যের আক্রমণ প্রতিহত করে দিচ্ছিল, আর সেইসাথে আরবের মরুভূমির দুর্যোগ অতিক্রম করে আসাও তাদের জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ হয়ে থাকতো সবসময়। মক্কা যদি নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর জীবদ্দশায়ই রোমান কিংবা পারস্যের দখলে চলে আসতো, তাহলে তাঁর ﷺ পক্ষে ইসলামের বাণী প্রচার করা আরো অনেক বেশীগুনে কঠিন হয়ে যেত। সপ্তম শতাব্দীতে রোমানরা ছিলো গোঁড়া খ্রিস্টান এবং তারা অন্য কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে একেবারেই সহনশীল ছিলো না।

অন্যদিকে, আরবের নিজেদের মধ্যে গোত্রীয় রাজনীতি মুহাম্মাদকে ﷺ একটি কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তির মোকাবিলা করার হাত থেকে রক্ষা করেছিলো। আরবের রাজনীতিতে কোনো কেন্দ্রীয় শক্তি ছিলো না, বরং সব গোত্রই ছিলো স্বাধীন। যদিও কুরাইশরা শুরুর বছরগুলোতে ইসলামের প্রচার বন্ধ করতে চেয়েছিল, তারা ছিলো অনেক গোত্রের মধ্যে একটি মাত্র। আর তাই নবী মুহাম্মাদকে ﷺ শুধুমাত্র মদীনায় চলে আসতে হয়েছিল যেখানে আরবে প্রচলিত অতিথিপরায়নতার নীতি তাঁকে ﷺ এবং তাঁর অনুসারীদেরকে রক্ষা করেছিলো, আর একইসাথে কুরাইশ গোত্রের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে অনেক দূরে থাকতে সাহায্য করেছিলো।


এটা পড়ুন আল বিরুনি বিশ্বখ্যাত মুসলিম শিক্ষাবিদ ও গবেষক


তদুপরি, আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় যুগের পর যুগ ধরে যে যুদ্ধ করে আসছিল তা মদীনার তরুন প্রজন্মকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল, তারা এর থেকে মুক্তি চাচ্ছিল। তদুপরি, ইহুদীদের সাথে সহাবস্থানের কারণে তারা জানত অচিরেই মুহাম্মাদ ﷺ এর মতো একজন মানুষ নবী হিসাবে আবির্ভূত হবেন। কাজেই, মুহাম্মদ ﷺ কে নেতা হিসাবে বরণ করে নেয়া তাদের সকল সমস্যার একটা চমৎকার সমাধান ছিল। অতএব, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তত্‍কালীন আরবের গোত্রসমূহের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে পৃথক এবং স্বাধীন থাকার ক্ষমতা এবং পরিস্থিতি নবীর ﷺ প্রতি প্রেরিত যুগান্তকারী বাণীর নির্বিঘ্ন প্রচারে পুরোপুরিভাবে সহায়ক ছিলো।

তদুপরি, নবীর ﷺ মৃত্যুর পর যখন মুসলিমরা উত্তরদিকে তাদের রাজ্যসীমানা বাড়িয়ে চলেছিল, তখন রোমান এবং পারস্য – এই দুটি পরাক্রমশালী রাজ্যই বছরের পর বছর নিজেদের মধ্যে এবং অন্যান্য শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহে জড়িত থাকার কারণে অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দুর্বলতা মুসলিম বাহিনীর বিজয়কে সম্ভব করে তুলেছিল এবং তাদের স্থাপিত সাম্রাজ্যের দখল নেবার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্ব দ্রুত মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে আরো বিস্তৃত হয়েছিলো।

Map_of_expansion_of_Caliphate
ইসলাম প্রসারের চিত্র (৬৩২খ্রি- বাদামী) (৬৬১খ্রি- কমলা) (৭৫০ খ্রি – হ্লুদ )

তত্‍কালীন আরব সমাজ সাংস্কৃতিকভাবেও ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য মোক্ষম ছিল। সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে মক্কার সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ধন ছিলো পারিবারিক বন্ধন। আর তাই মুহাম্মাদ ﷺ যখন ইসলাম প্রচারের মাধ্যমে মক্কার বহুদেবতার পূজারীদের বিরাগভজন হয়ে পড়েছিলেন, তখন তিনি ﷺ তাঁর পরিবারের উপরই নির্ভর করেছিলেন তাঁর ﷺ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। আর এই কাজে সবচেয়ে বেশী সাহায্য তিনি ﷺ পেয়েছিলেন তাঁর ﷺ চাচা আবু তালিবের কাছ থেকে। ইসলামের বাণী কখনোই বিশ্বাস না করেও আবু তালিব শুধুমাত্র তাঁর পারিবারিক ভালোবাসা এবং কর্তব্য থেকে তাঁর ভাতিজা মুহাম্মাদকে ﷺ নিরাপত্তা দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। যদি পরিবারের সকল সদস্যের সুরক্ষা প্রদানের এই সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক রীতি আরবে না থাকতো, তাহলে হয়তো মুহাম্মাদকে ﷺ কুরাইশ গোত্রের রাজনৈতিক নেতারা অনেক আগেই তাঁর ﷺ নবী জীবনের শুরুতেই নিস্তব্ধ করে দিতে পারতো।

আগেই আমরা আলোচনা করেছি যে, ইসলামের আগমনের পূর্বে আরবরা সবাই বহুদেবতার পূজারী ছিলো, তারপরেও তারা নবী ইব্রাহীমের (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) প্রভুর একত্ববাদের বাণী কিছুটা হলেও বুঝতে পারতো। ফলশ্রুতিতে, যখন আরবরা নবী মুহাম্মাদের ﷺ ইসলাম প্রচার এবং কুরআনের বাণী শুনতে শুরু করলো, তাদের জন্য এটি ছিলো ইব্রাহিমের ﷺ কাছ থেকে শিখে আসা বাণীরই একটি পুনরাবৃত্তি। কিন্তু মুসলিম হবার যে পূর্বশর্ত ছিলো এক আল্লাহ’র সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করা এবং মুহাম্মাদকে ﷺ তাঁর প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও বার্তাবাহক হিসেবে স্বীকার করা, সেটি আরবদের জন্য বহুদেবতার উপাসনা পুরোপুরিভাবে বন্ধ করা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলো। বাস্তবতার দিকে তাকালে আমরা দেখি, তাদের বেশীরভাগের জন্যই এটা খুব একটা কঠিন কাজ ছিলো না, বরং এটি তাদের বিশ্বাসকে পরিশুদ্ধ করে তাদের মনে প্রকৃত শান্তি এনে দিয়েছিলো।

সেইসাথে, আরবের এই বহুদেবতার পুজো করার রীতি (Paganism) মুহাম্মাদের ﷺ কাছে প্রেরিত বাণীর একটি অলৌকিক বৈশিষ্ট প্রকাশ করে। আব্রাহামিক ধর্মগুলো থেকে অনেক অনেক দূরে, পুরোপুরিই পৃথক একটি মরুভূমিতে জন্ম নেয়া মুহাম্মাদের ﷺ কাছে প্রেরিত কুরআনে যেভাবে পূর্বের নবীদের কাহিনী নির্ভুলভাবে বর্ণিত হয়েছে সেটি স্বয়ং প্রভুর কাছ থেকে না আসলে মুহাম্মাদের ﷺ নিজের পক্ষে কখনোই এরকম একটি ধর্মগ্রন্থ রচনা করা সম্ভব ছিলো না। কারণ, মুহাম্মাদের ﷺ জন্য আদম, মুসা, ইউসুফ আর ঈসা-র জীবনের সব কাহিনী জানা তো দূরে থাক, তাদের নাম জানাই অনেক কঠিন ছিলো। অথচ, এই মূর্তিপূজারী আরবদের মাঝেই এমন একজন নবী আসলেন যার কাছে আগের সব নবীদের ব্যাপারে নির্ভুল জ্ঞান ছিলো, আর তিনি ছিলেন প্রভুর প্রেরিত সর্বশেষ নবী। তাই অনেকের জন্যই, বিশেষ করে হেজাজ-এর ইহুদীদের জন্য কুরআনের এই বাণীগুলো অলৌকিক ছিলো কারণ তারা জানত কোনোভাবেই মুহাম্মাদের ﷺ পক্ষে তাদের তাওরাত পড়া সম্ভব ছিলো না কারণ তিনি পড়তে জানতেন না, আর তারাও নিজেদের গোত্রের বাইরে কারো সাথে তাওরাতের বাণী নিয়ে কথা বলতে অনিচ্ছুক ছিলো।

সবশেষে, কুরআনের বাণীর কাব্যিক ছন্দময় রচনাশৈলী তত্‍কালীন আরবের কাব্যিক সমাজ এবং সংস্কৃতির জন্য ছিলো পুরোপুরি উপযুক্ত। যে সমাজে কবিদের সম্মান অন্য যেকোনো কিছুর চাইতে বেশী ছিলো, যে সমাজে কবিরা সবসময়ে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগীতা করতেন কে কার চেয়ে ভাল কবিতা রচনা করতে পারবেন, ঠিক সেখানেই কুরআনের বাণীর রচনাশৈলী এই কবিদের যেকোনো সময়ের রচিত যেকোনো কবিতার রচনাশৈলী থেকে অনেক বেশী উচ্চমানের ছিলো। কুরআন যদি এধরনের একটি কাব্যমুখরিত সমাজ ব্যবস্থার কাছে প্রেরিত না হতো, তাহলে কুরআনের বাণীকে মানুষ প্রভুর বাণী বলে বিশ্বাস করার মতো অলৌকিক কিছু হিসেবে গ্রহণ করতো না। আর তাই আরবদের জন্য তাদের মনে কুরআনের ব্যাপারে কোনো ধরনের সন্দেহ ছিলো না, যার ফলশ্রুতিতে তারা তাদের সবটুকু দিয়ে এই বাণী চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলো আর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিল এই বাণী তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকেই এসেছে।

উপসংহার:

ইসলামের আগমন এবং বিকাশের জন্য ভৌগোলিকভাবে তত্‍কালীন বিশ্বের বড় দুই পরাশক্তির কাছ থেকে পৃথক থাকা, নবী মুহাম্মাদের ﷺ বৈচিত্রপূর্ণ জীবনের জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে তৈরী থাকা এবং কাব্যিক রচনাশৈলীতে প্রেরিত কুরআনের জন্য ভাষাগত দিক থেকে প্রস্তুত থাকা — সেই আরবের চেয়ে উপযুক্ত আর কোনো স্থান পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য কোথাও কখনোই ছিলো না। মুসলিমদের জন্য এটা বুঝতে একটুও কষ্ট করতে হয় না যে, এত চমত্‍কার এবং উপযুক্ত একটি সময় এবং স্থানে ইসলামের আগমন কোনোভাবেই সাধারণ একটি ঘটনা হতে পারে না, বরং এটি স্বয়ং স্রষ্টার নিখুত পরিকল্পনারই একটি অংশ ছিলো। যদিও অমুসলিম ইতিহাসবিদরা সেটা মানতে নারাজ, কিন্তু তাদের প্রথাগত ইতিহাস বিশ্লেষণের উপাদান ব্যবহার করে ইসলামের এত অল্প সময়ের মধ্যে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়াটি তাদের জন্য একটি রহস্যই হয়ে আছে।

গ্রন্থপঞ্জী:
১. Hodgson, M. G. S. The Venture of Islam, Conscience and History in a World Civilization. 1. Chicago, IL: University of Chicago Press, 1974.
২. Hourani, Albert Habib. A History Of The Arab Peoples. New York: Mjf Books, 1997. Print.
৩. Kennedy, Hugh. The Great Arab Conquests: How the Spread of Islam Changed the World We Live In. Philadelphia: Da Capo Press, 2007. Print.
৪. Saunders, JJ. A History of Medieval Islam. London: Rout ledge, 1965. Print.

Facebook Comments