হযরত উমর(রা) খলীফাতুল মুসলিমীন। মদিনা শাসনকেন্দ্র, অঘোষিত রাজধানী। পবিত্র মসজিদে মদিনা এখানেই। এই শহরেই মুসলমানদের প্রধান বিচারালয়। প্রধান বিচারপতি কাজী উবাই ইবনে কাব (রা)।
মসজিদে নববীতে মুসলমানদের অবিরাম যাতায়াত। ভিড় লেগেই থাকে। খলীফাতুল মুসলিমীন এই মসজিদেই নামাজ পড়েন।
এই মসজিদের দেয়াল ঘেঁষেই হযরত আব্বাস(রা) এর ঘর। সম্পর্কে তিনি রাসূলুল্লাহ(সা) এর চাচা হন। তাঁর ঘর আর মসজিদের নববীর মাঝে ফাঁক ছিল না। তাঁর ছাদের নালাটিও ছিল মসজিদ বরাবর। এই নালা দিয়ে বৃষ্টি হলেই পানি পড়তো। মুসল্লিদের কষ্ট হতো এতে। এই ভেবে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর(রা) নালাটি তুলে ফেললেন।
ঘটনাক্রমে হযরত আব্বাস(রা) তখন ছিলেন বাড়ির বাইরে, অন্য কোথাও। বাড়িতে এসে যখন এই কাণ্ড দেখলেন, চটে গেলেন। মামলা দায়ের করলেন মদীনার আদালতে। মদীনার এক নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছেন মুসলিম জাহানের মহান শাসক উমর(রা)। কিন্তু তাতে কি? খলীফা বলেই কি তাঁর বিচার হতে নেই? তাহলে আইন বেঁচে থকবে কার ভরসায়!
কাজী উবাই মোকদ্দমা গ্রহণ করলেন। পরোয়ানা জারী করলেন। যথাসময়ে হাজির হওয়ার আদেশ দিলেন খলীফা উমর(রা)কে।
উমর(রা) প্রস্তুত। প্রহর গুনছেন। যথারীতি যথাসময়ে আদালতে হাজির হলেন।অনুমতি চাইলেন প্রবেশের। কিন্তু অনুমতি এলো না। খবর এলো কাজী এখন ব্যস্ত। বাইরে অপেক্ষা করতে হবে। আরো দশজনের মত আদালতের আঙিনায় অপেক্ষায় রইলেন খলীফা উমর(রা) ।
কিছুক্ষণ পর অনুমতি এলো। প্রবেশ করলেন উমর(রা) । দাঁড়ালেন আসামির কাঠগড়ায় এবং বলতে চাইলেন কিছু। কিন্তু বাধা দিলেন বিচারক উবাই(রা)। বললেন-
”আমিরুল মুমিনীন! একটু থামুন। আদালতের বিধান মতে আগে বাদীকে বলতে দিন। তারপর আপনি বলুন।”
উমর(রা) খামোশ হয়ে গেলেন। এবার বলা শুরু করলেন আব্বাস(রা)। তিনি তাঁর ঘরের পানির নালা স্থানান্তরের পুরো ঘটনা আদালতে উত্থাপন করলেন। সবশেষে বললেনঃ
“আমি এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, মর্মাহত হয়েছি, সীমাহীন দুঃখ পেয়েছি। আমার অনুরোধ, আমি আশা করবো, আদালত আমার প্রতি ইনসাফ করবেন।”
কাজি বললেন,
আপনি নিশ্চিত থাকুন। আপনার প্রতি ইনসাফ করা হবে। আদালতের আশ্বাস।
আমিরুল মুমিনীন! বলুন,আপনার কি বলার আছে। আদালতের জিজ্ঞাসা।
উমর(রা) বললেন
“নালাটি আমি সরিয়েছি। আমি এর দায়িত্ব নিচ্ছি।”
কাজি জিজ্ঞাসা করল,
”কিন্তু অনুমতি ছাড়া অন্যের বাড়িতে হস্তক্ষেপ করলেন কেন? সে কারণও বলতে হবে আপনাকে।”
উমর রা. বললেন,
জনাব ! এই নালা বেয়ে পানি পড়তো। কখনো কখনো মুসল্লিদের কাপড়ও নষ্ট হয়ে যেত। মুসল্লিদের সুবিধা ও আরামের দিকে লক্ষ্য করেই আমি এমনটি করেছি। আমার ধারণা, আমি অন্যায় করিনি।
ইতিহাসের আরেক বীর –সালাহুদ্দীন আইয়ুবী-সময়ের এক সাহসী বীর !
কাজি বললেন,
“এর জবাবে আপনার কিছু বলার আছে, আব্বাস? আদালতের প্রশ্ন।”
হযরত আব্বাস(রা) বললেন,
“অবশ্যই বলার আছে, আদালত! আমার মনে আছে, প্রিয় নবী(সা) এর হাতে লাঠি ছিল। লাঠি দিয়ে তিনি মাটিতে ক’টি চিহ্ন এঁকে দিলেন। আর আমাকে বললেন- সেই চিহ্ন অনুসরণ করে ঘর বানাতে। আমি তাই করলাম। আমার ঘর যখন তৈরি হয়ে গেল , তখন রাসূলুল্লাহ(সা) বললেন, আব্বাস! আমার কাঁধের উপর ওঠ এবং এখানে পানি সরে যাবার নালাটি লাগিয়ে দাও। আমি বেয়াদবি মনে করলাম। বললাম; এ কি করে সম্ভব! হুযুর আমাকে বারবার বলতে লাগলেন। অগত্যা রাসূল(সা) এর কাঁধে চড়েই আমি নালাটি স্থাপন করেছিলাম। রাসূলের যুগে এটি সেখানেই ছিল। প্রথম খলীফার আমলেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু আপনি আমিরুল মুমিনীন, আমার সেই নালাটি উঠিয়ে ফেলেছেন। সত্যি আমি মর্মাহত “
কাজি জিজ্ঞাসা করলেন,
এই ঘটনার কোন সাক্ষী আছে আব্বাস? আদালত জানতে চাইলেন।”
হযরত আব্বাস(রা) বললেন,
“শুধু সাক্ষী, অসংখ্য সাক্ষী আছে।”
কাজী উবাই বললেন,
“তাহলে সাক্ষী ডাকুন। ফয়সালা এখনই হয়ে যাবে।”
হযরত আব্বাস(রা) বাইরে গেলেন। কয়েকজন আনসারী সাহাবী(রা)সহ আদালতে প্রবেশ করলেন। তাঁরা সকলেই বললেন,
“হ্যাঁ, আমরা তখন উপস্থিত ছিলাম যখন রাসূল(সা) তাঁর চাচা হযরত আব্বাস(রা)কে রাসূলের কাঁধে চড়ে এই নালাটি স্থাপন করেতে বলেছিলেন।”
অবনতে মস্তকে দাঁড়িয়েছিলেন এতক্ষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শাসক উমর(রা) । এবার এগিয়ে এলেন ধীর কদমে হযরত আব্বাস(রা) এর কাছে। কাছে এসে অনুশোচনা জানালেন। অবনমিত কণ্ঠে বলতে লাগলেন,
“আবুল ফযল! আমি ঘুণাক্ষরে জানতাম না এটা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ(সা) স্থাপন করিয়েছিলেন। অন্যথায় আমি ভুল করেও এমনটি করতাম না। রাসূলের নালা ওঠাবার হিম্মত কার আছে- তুমিই বল! যতটুকু হয়েছে ভুলক্রমে হয়েছে।আমার এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত এই হতে পারে, আপনি আমার কাঁধের উপর উঠে নালাটি যথাস্থানে স্থাপন করবেন।”
বিচারক উবাই বললেন,
“হ্যাঁ, আমিরুল মুমিনীন ! এটাই ইনসাফের কথা এবং আপনাকে এমনটিই করতে হবে।”
থমথমে পরিবেশ। রা নেই কারো মুখে। ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন আমিরুল মুমিনীন হযরত আব্বাসের বাড়ির দিকে। সকলের অপলক দৃষ্টি উমর(রা) দিকে। বিশ্বের পরাক্রমশীল শক্তি কায়সার-কিসরা-রুম-পারস্য যার তলোয়ারের কাছে পরাজিত, কম্পমান পৃথিবী যার নামে, সে উমর দেয়ালের কোল ঘেঁষে দাঁড়ালেন যেন পাথরের সিঁড়ি হয়ে। তাঁর কাঁধে চড়ে আপন ঘরের ছাদে নালা স্থাপন করছেন তাঁরই প্রজা হযরত আব্বাস(রা)।
পৃথিবীর কোন ইতিহাসে এর তুলনা পাওয়া যাবে কি? নিশ্চয়ই না। তাঁর সে ইনসাফ সকলকেই বিস্মিত হয়েছিল। হৃদয়টি গলে গিয়েছিল হযরত আব্বাসেরও। তাই নালাটি স্থাপনের পর তিনি বলেছিলেন,
“আমিরুল মুমিনীন! একটি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যেই আমি এতখানি করেছি। আপনি আমাকে মাফ করে দিবেন এবং আমি আমার এই বাড়িটি আল্লাহর নামে ওয়াকফ্ করে দিচ্ছি। আপনি ইচ্ছে করলেই ওটাকে ভেঙ্গে মসজিদে নববীর অংশে হিসেবে শামিল করে নিতে পারেন।”