যে কোন ইবাদাতের মৌলিক শর্ত ‘ইখলাস’। ইখলাস মানে কেবলই আল্লাহর জন্যে হওয়া। মানুষ এর বাহবা, প্রশংসা কুড়ানো, ফেসবুকে লাইক কামানো, যশ খ্যাতির লালসা দ্বারা মিশ্রিত না হওয়া। ইখলাসের সাথে কাজ করলে যেমন এর ফায়দা রয়েছে, তেমনি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্যে না হয়ে দুনিয়া কামাই বা যশ খ্যাতির জন্যে হলে তার শাস্তিও রয়েছে।

হাদিসের ভাষ্যমতে, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম জাহান্নামের সিদ্ধান্ত হবে সেসব আলেম, মুজাহিদ, দানশীলদের উপর। যারা ইলম শিখেছে আলেম শাইখ উপাধি পাওয়ার জন্যে, জেহাদ করেছে বীর খেতাব অর্জনের জন্যে, দান করেছে যশ খ্যাতির জন্যে।

ইখলাস ও নিয়তের ব্যাপারে যত্নশীল ও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সালাফে সালেহীন ইখলাস এর ব্যাপারে ধারণাতীত যত্নবান ছিলেন । এমনই কিছু ঘটনা নিয়ে আজকের লেখা।

১- আব্দুর রহমান আবী লাইলা (ইন্তেকাল ৮৩ হি) রহ.০ একদিন গোপনে তার বাড়িতে নফল নামাজ আদায় করছিলেন। হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেলেন। নামাজ সেরে জলদি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। যেন তিনি ঘুমুচ্ছেন। এরপর আগন্তক প্রবেশ করল। যখন দেখল তিনি ঘুমিয়ে আছেন তখন বলল ‘এই লোকের ঘুমের কি কোন বিরতি নেই? বেশিরভাগ সময়ই দেখি বিছানায় শুয়ে ঘুমোয়।’ অথচ তিনি প্রচুর নফল নামাজ পড়তেন ও তাদের থেকে গোপন করতেন।

২- মুহাম্মদ বিন আ’ইউন। আব্দুল্লাহ বিন মুবারাক (ই- ১৮১ হি.) রহ. এর সফরের সঙ্গী। তার বর্ণনা, ‘আমরা রোমের সৈন্যদের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত ছিলাম। রাত হলো। আব্দুল্লাহ বিন মুবারক বিছানায় চলে গেলেন। মাথা রাখলেন বিছানায়। আমাকে দেখানোর জন্যে যে তিনি ঘুমিয়ে গেছেন। আমিও বর্শায় মাথা এলিয়ে দিলাম।

বোঝাতে চাইলাম আমিও ঘুমিয়ে গেছি। মুহাম্মদ বিন আ’ইউন বলেন, আব্দুল্লাহ বিন মুবারক মনে করলেন আমি বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছি। তিনি উঠে পড়লেন। নামাজ শুরু করলেন। এভাবেই নামাজে মাশগুল হয়ে রইলেন ফজর পর্যন্ত। পুরো সময়টা আমি তাকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। ফজর এর সময় হলে তিনি আমাকে জাগিয়ে তুললেন এই ধারণায় যে আমি ঘুমন্ত। তিনি ডাকলেন ‘মুহাম্মদ উঠো!’ আমি বললাম, আমি ঘুমাই নি। যখন তিনি এটা শুনলেন, আমার এই ঘুমের ভান করাকে তিনি পছন্দ করলেন না। এরপর থেকে আমার সাথে তিনি আর কথা বলেন নি। সে যুদ্ধে আমি তাকে প্রফুল্ল দেখি নি। এই ঘটনা তার ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত আমি প্রকাশ করি নি। আর আমি তার মত আর কাউকে নিজের আমল এতটা গোপন করতে দেখি নি।

৩- দাউদ বিন আবী হিন্দ (ই-১৩৯ হি) রহ. ৪০ বছর রোজা রেখেছেন অথচ ঘরের মানুষও তা জানতে পারে নি। তিনি যখন বের হতেন খাবার নিয়ে যেতেন সাথে করে। পরিবারের লোকেরা ভাবত তিনি আহার করতে খাবার নিয়েছেন। কিন্তু দাউদ বিন আবী হিন্দ সে খাবার রাস্তায় গিয়ে সদকা করে দিতেন। অতঃপর সন্ধ্যায় ফিরতেন ও পরিবারের সাথে খানা খেতেন।

৪- প্রখ্যাত হাফিজুল হাদিস আইয়ুব সাখতিয়ানী (ই-১৩১ হি) রহ. সারারাত নিঃশব্দে ইবাদাতে কাটিয়ে দিতেন। তারপর ভোর হলে ইচ্ছে করে গলার স্বর উচু করতেন, যেন মাত্রই জেগেছেন।

৫- সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ রহ, বলেন মুতাররিফ বিন আব্দুল্লাহ (৯৫ হি) এই দুয়া করতেন ‘ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাই এই জন্যে যে আমি ভেবেছি এই কাজ কেবল আপনার সন্তুষ্টির জন্যেই করেছি, অথচ অজ্ঞাতসারে আমার নিয়তে অন্য কিছুর মিশ্রণ ঘটে গেছে।
মুতাররিফ রহ. যখন হালাকায় বসে হাদিসের দরস দিতেন। হাদিস বর্ণনা করার পর প্রবলভাবে কাঁদতেন। আর পাগড়ি দিয়ে মুখ চোখ ঢেকে রাখতেন। কান্না থামলে এই বলে পাগড়ি দিয়ে চোখ মুছতেন ‘মারাত্মক সর্দি হয়েছে, এত বেশি সর্দি..’ অর্থাৎ সর্দি মছার ভাণ করে চোখের অশ্রু লুকাতে চাইতেন।

৬- ‌আলী বিন হুসাইন যাইনুল আবিদীন (৯৫ হি) রহ. খুব উদার ও দানশীল ছিলেন। তিনি রাতের বেলায় সদকা ও খাদ্যসামগ্রী নিজ কাধে বহন করে নিয়ে যেতেন। মদীনার বিধবা আর গরীবদের ঘরে রাতের আধারে সেসব রেখে আসতেন, কেও টেরও পেত না। এমনকি খাদেম ও গোলাম থাকা সত্তেও তিনি তাদেরকে সংগে নিতেন না। এ কারণে যে তারা জেনে যাবে তার দান এর কথা। এভাবে বহু বছর কেটে গেল। এত দীর্ঘ সময়েও বিধবা আর গরীব জানতে পারল না এই খাদ্য ও অর্থ কোথা থেকে আসে। তারপর যখন যাইনুল আবেদিন রহ. ইন্তেকাল করলেন, লোকজন তার পিঠে কালো দাগ দেখতে পেল। তখন তারা বুঝতে পারল অধিক পরিমাণে বস্তা বহনের ফলে পিঠে দাগ পরে গেছে। যাইনুল আবেদীন রহ এর ইন্তেকাল এর পর তার দানের কথা মানুষ জানতে পারে।

৭- মুহাম্মদ বিন কাসিম, যিনি অত্যন্ত উঁচু মাপের মুত্তাকী আলেম ও মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি বলেন, আমি মুহাম্মদ বিন আসলামের সান্নিধ্যে ছিলাম প্রায় ২০ বছর যাবত। তিনি বারবার কসম করে বলতেন, ‘আমি যদি এভাবে নফল ইবাদত করতে সক্ষম হতাম যে, আমার দু ফেরেশতাও তা দেখতে পারবে না। তবে ‘রিয়া’ থেকে নির্ভয় হতে তাই করতাম।’ (রিয়া মানে আল্লাহ ছাড়া কাউকে দেখানোর উদ্দেশ্যে কোন নেক আমল করা)।

ইবনে কাসিম বলেন, মুহাম্মদ বিন আসলাম যখন তার ঘরে প্রবেশ করতেন। দরজা বন্ধ করে দিতেন। জানার কোন উপায় ছিল না, বদ্ধ ঘরে তিনি কী করছেন? একদিন দেখি, তার ছোট ছেলেটা বাবার কান্নার বিবরণ দিচ্ছে। বাচ্চার মা তাকে বারণ করছে বাবার কান্নার কথা কাউকে বলতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? বাচ্চার মা জানালো, আবুল হাসান (মুহাম্মদ বিন আসলাম) যখন এই ঘরটিতে প্রবেশ করে। তিনি তেলাওয়াত করেন ও প্রচুর কাঁদেন। বাচ্চা সেটা শুনতে পেয়ে তার বিবরণ দিচ্ছিল।

মুহাম্মদ বিন আসলাম তার আমল শেষে যখন বের হতেন, পুরো চেহারা ধুয়ে নিতেন। চোখে সুরমা দিতেন। যাতে দেখলে বোঝা না যায় তিনি রাব্বে কারীমের দরবারে উদ্বাহু হয়ে অশ্রুর বাধ ভেংগেছেন।
মুহাম্মদ বিন আসলাম ছিলেন একজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, হাফেজে হাদিস ও ইমামে রাব্বানী। পুরো নাম, মুহাম্মদ বিন আসলাম বিন সালেম বিন ইয়াজিদ আল খুরাসানী
তিনি এমন বুজুর্গ ওয়ালী ছিলেন, যার থেকে হাদিস বর্ণনার সময় ইবনে খুজাইমাহ রহ. বলতেন ‘হাদ্দাসানা মান লা তারা আইনায়া মিছলাহু’ (আমাকে হাদিসটি এমন ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, যার মত ব্যক্তিত্ব আমার দু নয়ন কখনো দেখে নি।)

মুহাম্মদ বিন কাসিম বলেন, ইবনে আসলামের ইন্তেকাল এর ৪ দিন আগে আমি তার ঘরে প্রবেশ করলাম। তিনি আমাকে দেখে বললেন ‘আবু আব্দুল্লাহ, এসো। আমি তোমাকে সুসংবাদ দিব যে, রাব্বে কারীম আমার জন্যে জন্যে কল্যাণের ফয়সালা করেছেন। আমার মৃত্যু সন্নিকটে। আল্লাহ তায়ালা আমার উপর মেহেরবানি করেছেন যে, আমার এমন কোন অর্থকড়ি নেই যার জন্যে আল্লাহ আমার হিসাব নিবেন।’

এরপর তিনি দরজা বন্ধ করার আদেশ করলেন। বললেন ‘কাউকে প্রবেশের অনুমতি দিয়ো না, যতক্ষণ না আমার মৃত্যু হয়। জেনে রাখো! আমি দুনিয়া থেকে এই অবস্থায় বিদায় নিচ্ছি। আমার রেখে যাওয়া কোন মীরাস নেই। কেবল এই পোশাক, পশমের কাপড়টি, আর এই উজুর পাত্র ছেড়ে যাচ্ছি।’

মুহাম্মদ বিন কাসেম বলেন, তার কাছে একটা মুদ্রার থলে ছিল। তাতে প্রায় ৩০ দিরহামের মত রয়েছে। ইবনে আসলাম বললেন, ‘এই মুদ্রাগুলো আমার ছেলের। তার কোন আত্মীয় তাকে হাদিয়া দিয়েছে। আমি জানি না, আমাত জন্যে এর চেয়ে হালাল কিছু আছে কিনা।

কারণ নবীজী সা. বলেন, ‘তুমি ও তোমার সম্পদ তোমার বাবার জন্যে। অন্য হাদিসে আছে, ‘মানুষ তার উপার্জন থেকে যা খায় সেটাই বেশি উত্তম। আর সন্তানও তার এক উপার্জন।’ ইবনে আসলাম বললেন, ‘তোমরা এই অর্থ দিয়ে আমার কাফনের ব্যবস্থা করো। যদি দশ দেরহামেই এপরিমাণ কাপড় কেনা সম্ভব হয় যা দ্বারা আমার সতরটুকু ঢাকে তবে ১৫ দেরহাম খরচ করো না। জানাযার সময় আমার লাশের উপর এই পশমের কাপড়টি বিছিয়ে দিয়ো। আর এই পোশাক দিয়ে ঢেকে দিয়ো। আমার যে পানির পাত্রটা দেখছ, সেটা কোন মিসকীনকে দিয়ে দিয়ো।…. ইয়া আবু আব্দুল্লাহ! আজকাল সবাই কুরআন সুন্নাহ অধ্যয়ন করছে, কিন্তু এই ব্যাপারে ফিকির করছে না যে তাদের মধ্যে দুনিয়ার মোহাব্বত প্রবল হয়ে গেছে।”

(সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৯/৫৪২, হিলয়াতুল আউলিয়া ৯/২৪৩)
আল্লাহ তায়ালা, লেখককে ও এ লেখার পাঠককে সর্বোপরি উম্মাহর খেদমতে নিয়োজিত সকল খাদেমে দ্বীনকে ‘পরিপূর্ণ ইখলাসের’ তাওফিক দিন। আমীন!

Facebook Comments