আন্দালুসের (মুসলিমদের হারানো স্পেন) ইতিহাস নিয়ে লিখতে বসলে চোখের আগে মন কাঁদে। (কাজি কবির ভাষায়) ‘সে কাঁদনে আঁসু আনে’ অভাগা চোখে! নিজের অজান্তেই বারবার দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে আসে। ইতিহাসকে আশ্রয় করে লিখতে চাইলেও তখন তা আর হয়ে ওঠে না। ঐতিহ্য হারানোর বেদনায় মনের সব সত্তায় করুণ একটা সুর বাজতে থাকে। বাজতেই থাকে। এ সুর-ব্যঞ্জনায় যেনো বিশ্বমানবতা কেবলই বিলাপ করতে থাকে। অশ্রু ছলোছলো চোখে কলম ধরে বসে থাকি। বসেই থাকি। কলম কি চলবে না?

ভাঙা-ভাঙা শব্দে বেদনার নীলগাথা হোক না একটু লিখা!
ইতিহাসের নদী এখন হয়ে যাক বেদনার নীলবাহিত স্রোত!
সবুজে সবুজে ‘জান্নাতময়’ আন্দালুস হারানোর স্মৃতিচারণ হয়ে উঠুক এখন কোনো তাযিয়াতি জলসা!
আন্দালুসপ্রেমীর মনে বয়ে চলুক শোকের নদী।
চোখে নেমে আসুক পূঞ্জীভূত বেদনার শত হাহাকার।
নতুন আন্দালুসের দিকে মহাযাত্রার মহাঅভিলাষে―
মন গগণ-বিদারি চীৎকারে আবার হয়ে উঠুক দুর্বিনীত!

দুই.
৭৭১ সাল। হিজরি ৯২। উমাইয়া সালতানাতের আমীরুল মুমিনীন তখন ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক। ইসলামী সালতানাতের সবুজ মানচিত্রে যোগ হয়েছে ভূ-খণ্ডের পর ভূ-খণ্ড। সামরিক কৌশলগত কারণে এবং ভিতরগত জুলুম-নিপীড়ন ও অরাজকতার কারণে আন্দালুস বিজয় করা― সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছিলো। বিশেষ করে রাজা রডারিক কাউন্ট জুলিয়ানের মেয়ের শ্লীলতাহানি করার পর এবং মুসলমানদের কাছে জুলিয়ানের সাহায্য চেয়ে পাঠানোর পর অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো আন্দালুস অভিযান।

তাই ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের কাছে অনুমতি চেয়ে পাঠালেন― আফ্রিকা বিজয়ের পর সেখানকার শাসনকর্তা―মূসা ইবনে নোসায়র। অনুমতি মিললে প্রথমে তিনি একটি ছোট অভিযান পরিচালনা করলেন ৫০০ সৈন্যের। তারা সীমান্ত এলাকায় বেশ কিছু সফল অভিযান পরিচালনা করে প্রচুর মালে গনিমত নিয়ে ফিরে আসে। এরপরই মূসা ইবনে নোসায়র মূল অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করে ৭ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী প্রস্তুত করেন আর নেতৃত্ব তুলে দেন তারিক বিন যিয়াদের কাঁধে। তারিক বিন যিয়াদ মূসা ইবনে নোসাইয়র-এর হাত ধরেই ইসলাম কবুল করেছিলেন এবং তার আস্থাভাজন সেনাপতিতে পরিণত হন। ‘তানজা’ বিজয়ের পর মূসা তাকে সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন।

তিন.
যেতে হবে সমুদ্রপথে। জাহাজ লাগবে অনেক। কারো মতে তখন ব্যবস্থা ছিলো মাত্র ৪টি জাহাজের। তাও আবার ভাড়া করা। কেউ বলেন― না, তখন এ অভিযানকে সামনে রেখেই তৈরী করা হয়েছিলো অনেক জাহাজ। কিন্তু জাহাজ-যে কম ছিলো― এটিই ঐতিহাসিকভাবে বেশি নির্ভরযোগ্য মত। যাইহোক; সেই জাহাজে করেই শুরু হলো আন্দালুস অভিমুখে নৌ-অভিযান। সবাই একসঙ্গে যাওয়া সম্ভব হলো না। যেতে হলো দলে দলে। যারা গেলো তারা পাহাড়ে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় বেছে নিলো। আত্মগোপনের মতো করে অবস্থান করলো। সবাই আসার পর তারিক বিন যিয়াদ যুদ্ধের জন্যে ধীরে ধীরে সবাইকে প্রস্তুত করতে লাগলেন। রণকৌশলের অংশ হিসাবে প্রথমেই আশপাশের এলাকাগুলো তিনি বিজয় করে ফেললেন। আলজাযিরাতুল খাযরা বা ‘সবুজ দ্বীপ’ এলাকাটি ছিলো পাহাড়ের (জাবালুত তারিক-এর) মুখোমুখি। প্রথমেই তিনি এ সবুজ-শ্যামল এলাকাটি দখল করে ফেললেন। সেই সঙ্গে আশপাশের আরো কিছু এলাকা। এরমধ্যেই সম্রাট লডারিকের কাছে সংবাদ পৌঁছে গেলো যে, মুসলিম সৈন্যরা আন্দালুসে পা রেখেছে। লডারিক অবিলম্বে তাদেরকে মুকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিলো। প্রথমেই পাঠালো একটি বিশেষ বাহিনী। কিন্তু সে বিশেষ বাহিনী শোচনীভাবে পরাস্ত হলো তারিক বাহিনীর কাছে। একজন মাত্র জানে বেঁচে পালিয়ে গিয়ে লডারিককে জানাতে পারলো শুধু নিজের বেঁচে-যাওয়ার আশ্চর্য কাহিনী!

এরপর লডারিক নিজেই যুদ্ধযাত্রার ঘোষণা দিলো। সাজসাজ রবে প্রস্তুত হলো এক লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী। এক সময় যাত্রা হলো এ বাহিনীর। ওদের চোখে-মুখে দম্ভ ও অহমিকা ঠিকরে পড়ছিলো। লডারিকের নেতৃত্বে এগিয়ে আসছে খৃষ্টান বাহিনী― এ-খবর যথা সময়ে তারিক জানতে পারলেন। লডারিকের সাথে মহাযুদ্ধে নামার আগেই তারিক আরো সৈন্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন মূসা ইবনে নোসায়রের কাছে। যথা সময়ে সে সাহায্যও এসে গেলো। আরো ৫০০০ সৈন্য এসে যোগ দিলো মুসলিম শিবিরে। এখন মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা ১২ হাজার।

‘শাদূনা’ শহরের কাছে ‘ওয়াদি লাক্কা’য় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারিক বাহিনী ও লডারিক বহর। মাত্র ১২ হাজার সৈন্য দেখে লডারিক বাহিনীর আনন্দের কোনো সীমা রইলো না। ওদের চোখে মুখে একটা ভাবই কেবল ফুটে উঠছিলো― তোমাদের যুদ্ধসাধ মিটিয়ে দেবো আমরা মাত্র কয়েকঘন্টায়!

একদিকে এক লাখ আরেকদিকে বার হাজার। ভীষণ অসম চিত্র। মুসলিম সৈন্যদের মনোবলে যেনো দুশমনের সংখ্যাধিক্য কোনো চির ধরাতে না পারে, সে জন্যে তারিক বিন যিয়াদ সৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে ঈমান জাগানিয়া এক ভাষণ দিলেন― লডারিকের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ঠিক আগে। একটু পরই শুরু হবে যুদ্ধ। কিন্তু তার আগে আমরা নজর দেবো একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে।

চার.
না! সে ভাষণের আগে কিংবা তারও আগে―জাহাজ থেকে নেমে তিনি সবগুলো জাহাজ কিংবা কোনো একটি জাহাজ পুড়িয়ে দেন নি! যারা এ জাহাজ পুড়ানোর ঘটনা প্রচার করে, না-জেনে .. না-বোঝেই প্রচার করে।
কেনো তিনি জাহাজ পুড়িয়ে দেবেন?
কার জাহাজ পুড়িয়ে দেবেন?
যদি ভাড়া করা হয়ে থাকে তাহলে তো এগুলো অন্যের সম্পদ! অন্যের সম্পদ কে পুড়িয়ে দেয়? আর যদি রাষ্ট্রীয় সম্পদ হয়, তাহলে কেনো তিনি এতো দামী জিনিস পুড়িয়ে নষ্ট করে দেবেন? অপচয় হবে না কি?
আর যদি শুধু এ-অজুহাতে তিনি সবগুলো জাহাজ পুড়িয়ে দিয়ে থাকেন যে, এতে মুসলিম সৈন্যরা আর পালিয়ে যেতে পারবে না, যুদ্ধ তাদেরকে করতেই হবে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, তাহলে মুসলিম সৈনিকদের শিশিরশুভ্র চরিত্রে কি ছুরি চালানো হয় না?! এমন বাহিনীই কি তারিখ আন্দালুস বিজয়ের জন্যে নিয়ে এসেছিলেন― যারা পালিয়ে যেতে পারে সুযোগ পেলেই!
আস্তাগফিরুল্লাহ!

পাঁচ.
তারিক বিন জিয়াদের ভাষণে বুঝি যাদু ছিলো। ঈমানি চেতনায় ও সংগ্রামী জযবায় সৈন্যরা দ্যুতিময় বীরত্বের প্রহর গোনতে লাগলো। এরপর যুদ্ধ যখন শুরু হলো তখন সে চেতনা ও জযবা সত্যি সত্যি দ্যুতি ছড়াতে লাগলো। আটটি সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের পর মুসলিম শিবিরের পূব আকাশে মহাবিজয়ের লাল সূর্যটি যেনো হাসতে হাসতে উদিত হলো!
সঙ্গে সঙ্গে আন্দালুসের বুকে সূচিত হলো মহাবিজয়ের এক পুণ্যযাত্রা!
আগামী আটশত বছরে গড়ে ওঠবে যে-কালজয়ী গর্বিত সভ্যতা, এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হলো তার মুবারক সফর!

এ অসম লড়াইয়ে শহীদ হলেন তিনহাজার মুসলিম সৈন্য। আর লডারিক পালিয়ে গেলো এবং হারিয়ে গেলো। আর কখনো এ নামটা আন্দালুসের ইতিহাসে প্রবেশ করতে পারেনি। কেউ বলেন: যুদ্ধেই সে মারা গিয়েছিলো। কেউ বলেন পালিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু কিছুদূর যেতেই পানিতে ডুবে মারা গেলো।

বন্ধু!
যে-বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ও বাদশার এ-করুণ পরিণতি, সে বাহিনীর অবস্থা ‘ঐ জিজ্ঞাসে কোন্ জন’? তা-যে আরো বেশি করুণ, তা না-বললেও তো বোঝা যায়!
তবুও অগভীর কৌতূহল মিটানোর জন্যে এক কথায় বলা যায়― ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো তার বিশাল সৈন্যবাহিনী!
আন্দালুসের এই অশ্রু ও রক্তগল্প অনেক দীর্ঘ! পাঠক চাইলে আবার আসবো!


ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী
লেখক, গ্রন্থাকার-অনুবাদক ও মাদরাসাশিক্ষক

Facebook Comments