মাওলানা যুবাইর আহমদ: আল্লাহ তার মাঝে নবুওয়াত ও রাজত্বের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। আল্লাহ তাকে প্রজ্ঞা ও বাকপটুতা দান করেছিলেন। তিনি এমন নবী ছিলেন, যার সাথে পাখ-পাখালী, পাহাড়, পর্বত তাসবীহ পাঠ করত। চিরবিরল এক কণ্ঠস্বর আল্লাহ তাকে দান করেছিলে। শয়তান জালুতকে হত্যা করার জন্য আল্লাহ তাকে বনী ইসরাঈল সম্প্রদায় থেকে নবী হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। ফলে সে দাউদ আ. এর হাতেই নির্মমভাবে নিহত হয়েছিল। তিনি ছিলেন অসীম সাহসী; যার কারণে কখনো তিনি যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করেননি। এবং শত্র“র তরবারীর ঝঞ্ঝনানীতে ভীত হননি।
আল্লাহ তাকে একত্রে রাজত্ব ও নবুওয়াত দান করেছিলেন। এমনকি তাকে লৌহ বর্ম তৈরির কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলেন। আর লোহাকে তার আদেশের অধীন করে দিয়েছিলেন। এভাবেই আল্লাহ তার মর্যাদাকে সমুন্নত করেছিলেন।
আল্লাহ তার ওপর যাবুর কিতাব অবতীর্ণ করেছিলেন। আর তাকে এমন সুমধুর, সুন্দর ও কোমল কষ্ঠস্বর দান করেছিলেন যা তিনি ইতোপূর্বে অন্য কাউকে দান করেননি। যখন তিনি যাবুর কিতাব পড়তেন তখন মানব-দানব, পশু-পাখি সব স্থির হয়ে যেত। এবং তার তেলাওয়াতের মাধুর্যে মুগ্ধ ও বিমহিত হয়ে পড়ত। তিনি ছিলেন দুনিয়া বিরাগী, অধিক নামায আদায়কারী।
তিনি ছিলেন স্বভাব গাম্ভীর্যের অধিকারী ও বিনয়ের মূর্তপ্রতীক। আল্লাহ তাআলার স্মরণ তার যবান থেকে বিচ্ছিন্ন হতো না, তিনি সকাল যাপন করতেন আল্লাহ যিকিরের মাধ্যমে এবং তার প্রতিপালকের নেয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের মাধ্যম দিয়ে। হালকা আওয়াজে তার জবানে সদা আল্লাহর জিকির চলমান থাকত। যখনই সময় পেতেন তখনই তিনি যাবুর কিতাব তেলাওয়াত করতেন। আল্লাহ তার জবানে হেদায়েতের নূর ঢেলে দিয়েছিলেন। পাহাড়-পর্বত তার অধীন করে দিয়েছিলেন। এরা সকাল-সন্ধ্যায় তার সাথে তাসবীহ পাঠে মগ্ন থাকত। পাখ-পাখালিরাও তার কাছে জমা হয়ে আল্লাহর গুণকীর্তন করতো এবং যাবুরের কিতাবের তেলাওয়াত শ্রবণ করতো। তাঁর ইবাদত ছিল অনুসরণীয় ও অবিস্মরনীয় ইবাদত। কারণ তাঁর নামায ছিল সর্বোত্তম নামায এবং তার রোযা ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ রোযা।
এটা পড়ুন – আদি মানব ও আজাযিল
রাসূল সা. বলেছেন, আল্লাহ তাআলার কাছে পছন্দনীয় রোযা হল দাউদ আ. এর রোযা। তিনি অর্ধরাত্র ঘুমিয়ে একতৃতীয়াংশ নামাযে কাটাতেন। এরপর আবার এক ষষ্ঠাংশ ঘুমাতেন। তিনি সারা বছর একদিন অন্তর অন্তর রোযা রাখতেন। তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! যদি আমার প্রতিটি পশমের দুটি করে মুখ থাকতো যা দিন রাত এবং যুগ যুগ ধরে আপনার তাসবীহ পাঠ করতো, আমি মনে করি, তবুও আপনার নেয়ামতের হক আদায় হওয়ার মত নয়। হযরত দাউদ আ. এর অন্তর বিচার দিবস ও জাহান্নামের ভয়ে সদা সংকিত থাকতো। তিনি পৃথিবীতে বসবাস করতেন আখেরাতকে সামনে রেখে। তার চোখের অশ্র“ এক মুহূর্তের জন্য থেমে থাকতো না।
এক পর্যায়ে তার চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে ছিল, তখন লোকেরা তাকে তিরস্কার করে বলত- এটা কোন ধরনের কান্না যার কারণে আপনি দিন দিন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন। উত্তরে তিনি বলতেন তোমরা আমাকে এ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবেনা। শরীরের সমস্ত অংশ পুরে যাওয়ার আগপূর্ব পর্যন্ত এবং কান্নার দিন আসার আগ পর্যন্ত আমি কাঁদতে থাকবো।
তিনি আরো বলতেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার সূর্যের তাপ সহ্য করতে পারি না, তাহলে আমি কিভাবে আপনার জাহান্নামের ঐ কঠিন আগুন সহ্য করবো? তার হৃদয়ে সামান্যতম অহংকার ছিল না।
তার নবুওয়াত তার গাম্ভীর্যকে বৃদ্ধি করেছে আর তার রাজত্ব বৃদ্ধি করেছে তার বিনয়কে। তিনি নিজ হাতের উপার্জন দ্বারা আহার করতেন। বিশাল রাজত্ব ভান্ডার থেকে এক লুকমা খাবারের মূল্য তিনি গ্রহণ করতেন না; বরং তিনি নিজ হাতে বর্ম তৈরি করতেন এবং তা বাজারে বিক্রি করে অর্জিত অর্থ দিয়ে খাবার খেতেন। এই ব্যাপারে রাসূল সা. দাউদ আ. এর প্রশংসা করে বলেছেন- আল্লাহর নবী দাউদ আ. নিজ হাতে উপার্জন করে খাবারের ব্যবস্থা করতেন, তাই মানুষ যা ভক্ষণ করে তার মধ্যে সর্বোত্তম হল যা সে নিজ হাতে উপার্জন করে।
তিনি তার বাড়িতে উৎকৃষ্ট মানের রুটি দ্বারা লোকদের মেহমানদারী করতেন অথচ তিনি নিজে সাধারণ যবের রুটি খেতেন। বিরল আত্মমর্যাদাবোধের অধিকারী ছিলেন দাউদ আ.। তিনি যখন বাড়ি থেকে বের হতেন, দরজা বন্ধ করে বের হতেন। ফলে তিনি বাড়িতে ফেরা পর্যন্ত কেউ তার বাড়িতে প্রবেশ করতে পারত না। একবার দাউদ আ. এর স্ত্রী অন্দর মহল থেকে বের হয়ে দেখেন যে, বাড়ির ভেতরে এক লোক দাড়িয়ে আছে, তখন তিনি বললেন, বাড়িতে কে প্রবেশ করেছে? দরজা বন্ধ থাকা সত্বেও এই লোকটি কিভাবে বাড়িতে প্রবেশ করল? ঠিক এই মুহূর্তে হযরত দাউদ আ. বাড়িতে এলেন। তিনি অবাক হলেন, যে বাড়ির দরজা বন্ধ থাকা সত্বেও কিভাবে একজন পুরুষ লোক বাড়িতে প্রবেশ করল? তখন দাউদ আ. লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? লোকটি বলল আমি এমন একজন লোক, যে কোন রাজা বাদশাহকে ভয় করে না এবং যার ব্যাপারে কোন পর্দার বিধান নেই। একথা শুনে দাউদ আ. বললেন। এবার আমার বোঝার আর বাকি নেই। আল্লাহর কসম, নিশ্চয় আপনি মালাকুল মাউত। আল্লাহর আদেশ পালনে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। তারপর লোকটি কিছুক্ষণ হযরত দাউদ আ. এর নিকট অবস্থান করে তার জান কবজ করে নিয়ে যায়। তার গোসল ও দাফন কাফনের কাজ সম্পন্ন হতে হতে সূর্যের তাপ প্রখর হয়ে উঠল। তাই সুলাইমান আ. পাখ-পাখালিকে বললেন, তোমরা হযরত দাউদ আ. এর কবরকে ছায়া দিয়ে রাখো। তার আদেশে পাখিরা কবরের ওপর ছায়া বিস্তার করল। এক পর্যায়ে দেখা গেল যে পুরা এলাকা ছায়ায় ঢেকে গেছে। পরবর্তীতে তিনি আবার তাদেরকে চলে যেতে বললেন।
তথ্য সূত্র : আয-যুহহাদু মিয়াতুন
লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষক- দারুল কুরআন ইসলামীয়া মাদরাসা, উত্তরখান, ঢাকা।