একজন অ্যান্টনি ফ্লিউয়ের গল্প

374
নাস্তিক বিশ্বাস অ্যান্টনি ফ্লিউ

প্রায় ৫০ বছর ধরে নাস্তিকতার প্রচার চালিয়ে যাবার পর ২০০৪ সালে পৃথিবীর নেতৃত্বস্থানীয় এবং সুপরিচিত নাস্তিক অ্যান্টনি ফ্লিউ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, অবশ্যই এ মহাবিশ্বের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন।

জীবনভর দার্শনিক অনুসন্ধানের পর, এবং একজন নাস্তিক হিসেবে নিজের প্রায় সম্পূর্ণ জীবন কাটানোর পর শেষপর্যন্ত অ্যান্টনি ফ্লিউ এই উপসংহারে পৌছোন যে সকল যুক্তিপ্রমাণ একজন স্রষ্টার অস্তিত্বের দিকেই নির্দেশ করে।

জীবনের বেশীরভাগ সময় ধরেই নাস্তিকতায় দার্শনিক বীরপুরুষ হিসেবে পরিচিত ফ্লিউ যখন তার এই উপসংহার ঘোষণা করলেন তখন তাড়াহুড়ো করে অন্যান্য নাস্তিকরা তাকে জরাগ্রস্থ, ভীমরতিতে পাওয়া বুড়ো বলে প্রমানের জন্য উঠেপড়ে লাগলো। তারা প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে গেল শেষবয়সে গিয়ে ফ্লিউ কিছু খ্রিষ্টানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের মত বদলেছেন।

ফ্লিউ এই অভিযোগ অস্বীকার করলেন এবং নাস্তিকতা থেকে আস্তিকতার দিকে তাঁর এই দার্শনিক যাত্রা বর্ননা করে একটি বই লিখলেন, There Is A God, How The World’s Most Notorious Atheist Changed His Mind

কোন যুক্তি ও প্রমানের প্রেক্ষিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌছুলেন এই বইতে ফ্লিউ তা ব্যাখ্যা করলেন।

এখন আমি বিশ্বাস করি এক অসীম বুদ্ধিমত্তা এই মহাবিশ্বকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনয়ন করেছেন। আমি বিশ্বাস করি যে সুক্ষাতিসুক্ষ নিয়মগুলো দ্বারা এই মহাবিশ্ব পরিচালিত হয় সেগুলোর মাধ্যমে একজন স্রষ্টার ইচ্ছা ও অস্তিত্ব প্রতিভাত হয়। আমি বিশ্বাস করি জীবন এবং জীবন ধারার উৎস ঐশ্বরিক। [১]

অ্যান্টনি ফ্লিউ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমাজতান্ত্রিকদের পাঠচক্রে খুঁজে পাওয়া স্রোতের সাথে গাঁ ভাষানো নিরামিষ নাস্তিক কিংবা সামওয়্যার ইন ব্লগ বা মুক্তমনাতে ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে “মুক্তচিন্তার” পতাকা উড়ানো গালিবাজ শব্দসন্ত্রাসী জাতীয় নাস্তিক ছিলেন না। খুব অল্প বয়সে নাস্তিকতার উপর একটি লেখা প্রকাশ ফ্লিউ করে দার্শনিক অঙ্গনে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত Theology and Falsification নামের এই পেপারটি গত পঞ্চাশ বছরে বারবার পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে। ফ্লিউয়ের এই লেখা দার্শনিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল এবং ফ্লিউয়ের জন্য এনেছিল একজন তুখোড় দার্শনিক হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি।


এটা পড়ুন  বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী মুহাম্মদ সাঃ সম্পর্কে যা তাঁর নবুওতের অনন্য দলীল ।


পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই একাডেমিক জগতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল ফ্লিউয়ের অবস্থান। একপর্যায়ে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসর হিসেবেও দায়িত্বরত ছিলেন। তবে অধিকাংশ নাস্তিকদের মধ্যে উপস্থিত একটি বৈশিষ্ট্য থেক ফ্লিউ মুক্ত ছিলেন। অধিকাংশ নাস্তিক নিজের নাস্তিকতার দিকে যাত্রার প্রাথমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান, দশন, যুক্তি নিয়ে সামান্য ঘাঁটাঘাঁটি করে। কিন্তু নাস্তিকতার বিশ্বাসে সম্পূর্ণভাবে প্রবেশ করার সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, এবং দার্শনিক যুক্তিতর্ক সম্পর্কে তারা চিন্তা করা বন্ধ করে দেয়, অথবা শুধুমাত্র নিজেদের সংকীর্ণ অবিশ্বাসের বিশ্বাসের লেন্স দিয়ে সবকিছুকে বিচার করে।

এই জায়গাটাতে ফ্লিউ ছিলেন আলাদা। ফ্লিউয়ের একটি দুর্লভ গুণ ছিল, “প্রমাণাদি যেদিকে নিয়ে যায় তার অনুসরণ করা”র নীতির কথা তিনি বাকি নাস্তিকদের মতো শুধু মুখে দাবি করতেন না, বরং সত্যিকার ভাবেই এই নীতির অনুসরণ করতেন।

ফ্লিউয়ের নিজের ভাষায় –

এমনকি বিগ ব্যাং তত্ত্ব কিংবা ফাইন-টিউনিং তত্ত্ব প্রকাশের বহুপূর্বেই আমার অন্যতম সেরা দুইটি ধর্মতত্ত্ব বিরোধী বই প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু আশির দশকের শুরুর দিকে আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে পুনরায় চিন্তাভাবনা শুরু করতে বাধ্য হলাম । আমি এই কথা স্বীকার করেছিলাম যে সমসাময়িক মহাজাগতিক আবিষ্কারগুলোর কারনে নাস্তিকরা বিব্রত হতে বাধ্য। কারন থমাস অ্যাকুইনাস দশর্নের মাধ্যমে যেটি প্রমাণ করতে পারে নি [“মহাবিশ্বের একটি শুরু আছে] তা মহাবিশ্বতত্ত্ববিদরা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করতে শুরু করলেন।” [২]

আর এ কারনেই শেষপর্যন্ত আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতিই এবং নতুন আবিষ্কার তাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করে যে – একজন বুদ্ধিমান সত্তাই এই মহাবিশ্বের উদ্ভাবন এবং ডিজাইন করেছেন। তিনি দেখলেন যে বিগ ব্যাং তত্ত্বানুসারে ধারণা করা হয় মহাবিশ্ব আনুমানিক তের বিলিয়ন বছর আগে সৃষ্টি হয়েছে। যদি একে সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে আমরা বর্তমানে জটিল পর্যায়ের জীব এবং জীববৈচিত্র [complex life & complexity of life] দেখি, বিবর্তনের মাধ্যমে তাতে উপনীত হবার মতো যথেষ্ট সময় পাওয়া যায় না। এছাড়া, মাইক্রো বায়োলজি এবং ডিএনএ এর ব্যাপারে আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিস্কার তাকে এই সিদ্ধান্তে আস্তে বাধ্য করে যে, এসব কিছুর পেছনে অবশ্যই একটি বুদ্ধিমান সত্ত্বা আছে।

২০০৭ সালে বেনজামিন উইকারের সাথে সাক্ষাৎকারে ফ্লিউ বলেছিলেন –
.
আমার সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করার পেছনে কাজ করেছে আইনস্টাইন সহ আরো বহু বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের মতের সাথে ক্রমবর্ধমান একাত্মতা যা আমি অনুভব করছিলাম। আইনস্টাইন সহ আরো অনেক বিজ্ঞানী তাদের সুক্ষদর্শিতার কারনে এই মত ব্যক্ত করেছিলেন যে এই মহাবিশ্বের অন্তর্নিহিত এবং সুসংহত জটিলতার (integrated complexity) পেছনে একজন বুদ্ধিমান সত্ত্বার ভূমিকা আবশ্যক। এছাড়া আমি নিজে ব্যক্তিগত এই উপসংহারে পৌছেছিলাম যে জীবন ও জীববৈচিত্র – যা মহাবিশ্বের চাইতেও বেশি জটিল – শুধুমাত্র একটি বুদ্ধিমান উৎসের দ্বারাই ব্যাখ্যা করা যায়।” [৩]
.
নাস্তিকরা সবসময় দাবি করে শুধু সাধারণ অশিক্ষিত, অজ্ঞ লোকেরা যারা কোন চিন্তাভাবনা করে না তারাই ধর্মে বিশ্বাস করে। কিন্তু অ্যান্টনি ফ্লিউ নাস্তিকদের সব যুক্তি জানতেন। এমনকি বর্তমানে নাস্তিকরা যেসব যুক্তি ব্যবহার করে এর অনেকগুলো তিনি নিজেই দাঁড় করিয়েছিলেন। নাস্তিকতার পক্ষে তিনি ৩০টির মতো বই লিখেছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি অন্ধ অবিশ্বাসী ছিলেন না তাই শেষপর্যন্ত তিনি সেই উপসংহারে পৌছেছিলেন সব যুক্তি ও প্রমাণ যে দিকে নির্দেশ করছিল। আর তাই তিনি স্বীকার করে নিয়েছিল, এ মহবিশ্বের একজন স্রষ্টা থাকা আবশ্যক।

একজন নাস্তিক হিসেবে অ্যান্টনি ফ্লিউয়ের দার্শনিক পথ পরিক্রমার সবচেয়ে ইউনিক বৈশিষ্ট্য হল প্রমাণ ও যুক্তির অনুসরণের ব্যাপারে তার স্বদিচ্ছা, যা অন্যান্য নাস্তিকদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই অনুপস্থিত। যখন ফ্লিউয়ের পাশাপাশি আপনি একজন ডকিন্স, হ্যারিস কিংবা ডেনেটকে দাড় করাবেন তখন তাদের আত্বকেন্দ্রিক, উগ্র, অপরিপক্ক এবং ঝগড়াটে রূপ খুব সহজেই ধরা পড়বে।

২০১০ সালে অ্যান্টনি ফ্লিউ মারা যান। একজন আস্তিক হিসেবে কিন্তু কোন নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী না হয়ে। আর এখানেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। আমরা সত্যকথনের পাঠকদের জন্য, কিংবা নাস্তিকদের জন্য অ্যান্টনি ফ্লিউকে আস্তিকতার স্বপক্ষে কোন প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করছি না। আমরা এই কারনে অ্যান্টনি ফ্লিউয়ের গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করছি কারন নাস্তিক এবং মুসলিম – দুই পক্ষের জন্যই এতে শিক্ষণীয় বিষয় আছে।

নাস্তিকদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়টি ইতিমধ্যে আলোচিত হয়েছে – আর তা হল অবিশ্বাসের অন্ধ বিশ্বাস বাদ দিয়ে বিশুদ্ধ ভাবে স্রষ্টার অস্তিত্ব বিষয়ে চিন্তার স্বদিচ্ছার বিষয়টি।

আর মুসলিমদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়টি হল আস্তিক হওয়া শেষপর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য না। নাস্তিকদের তর্কে পরাজিত করাও আমাদের উদ্দেশ্য না। যদিও আমরা স্বীকার করি এ কাজটা আনন্দদায়ক। আমাদের উদ্দেশ্য ঈমান ও বিশুদ্ধ তাওহিদ অর্জন করা। আস্তিক হওয়া মানে হেদায়েত পাওয়া না। এ হল শুধু বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়া। আমাদের কাজ হল বাস্তবতাকে স্বীকার করার পর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার আনুগত্য করা।

অনেক সময়েই দেখা আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক, কম্পারেটিভ রিলিজিয়েন নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি নিয়ে আমরা এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে আমরা আমাদের ঈমানের দিকে আমাদের তাওহিদের বিশ্বাসের দিকে অমনযোগী হয়ে পড়ি। বুদ্ধি আপনাকে একটা পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে দিবে, যেমন অ্যান্টনি ফ্লিউয়ের ক্ষেত্রে তা তাকে সত্য পর্যন্ত পৌছে দিয়েছিল। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট না। সত্য পর্যন্ত পৌছানোর পর আমাদের দায়িত্ব শেষ না, বরং আমাদের মূল দায়িত্ব শুরু।

আমাদের মূল দায়িত্ব হল সত্যকে খুঁজে পাবার পর তার অনুসরণ করা। শোনা ও মানা। কারন যখন আপনি বুঝবেন মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা আছে, যখন আপনি উপলব্ধি করবেন আপনার একজন স্রষ্টা আছে, তখন আপনি এও বুঝবেন যে এই স্রষ্টার প্রতি আপনার দায়িত্ব আছে।
নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিকর্তা, এই সুবিশাল মহাবিশ্ব ও এই অবিশ্বাস্য জটিল ও বৈচিত্রময় জীবনের সৃষ্টিকর্তা নিরর্থক আপনাকে, আমাকে, এই সবকিছুকে সৃষ্টি করেন নি।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন –
.
হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যেমনভাবে করা উচিৎ এবং তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যু বরণ করোনা।

[আলে ইমরান, ১০২]
.
নিশ্চয় হেদায়েত কেবলমাত্র আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল -এর পক্ষ থেকেই।

======================
১। There Is A God, page 88
২। There Is A God, page 135.
৩। Dr. Benjamin Wiker: Exclusive Flew Interview, 30 October 2007
======================
.
সত্যকথন ডেস্ক

Facebook Comments