সেক্যুলারিজম এবং নৈতিকতা

সততা, সত্যবাদীতা, বিশ্বস্ততা, সচ্চরিত্র, সতীত্ব এর মতো মূল্যবোধগুলো ফিতরাতী (Natural disposition) বা সহজাত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষের অন্তরে এগুলো গেঁথে দিয়েছেন। অতঃপর তিনি তাঁর রসূলগণকে (আলাইহিমুস সালাম) এমন দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন যা এ ফিতরাহ বা সহজাত মূল্যবোধগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

“তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে এই ধর্মে প্রতিষ্ঠিত করো। এটা আল্লাহর প্রকৃতি; যার ভিত্তিতে তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহর প্রকৃতির কোনো পরিবর্তন নেই, এটাই সরল ধর্ম, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না।” (সূরা আর-রূম :৩০)

একজন মুমিন এ নৈতিকতা ও মূল্যবোধগুলোকে মেনে চলে কারণ ঈমানের দ্বারা সুদৃঢ় হওয়া তাঁর ফিতরাহ তাঁকে এদিকে প্রভাবিত করে। এবং তাঁর ধর্ম তাঁকে বলে সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করতে এবং এর জন্য আখিরাতে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়। অন্যদিকে নৈতিকতার এ দুটি ভিত্তিতেকে সেক্যুলারিজম নষ্ট করে ফেলে। এটা সব ধরণের সেক্যুলারিজমের ক্ষেত্রে সত্য। রাজনৈতিক জীবন থেকে ধর্মকে আলাদা করা এবং আইন প্রনয়ণের ভিত্তি হিসেবে ধর্ম ও মানুষের এই স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রত্যাখ্যান করা সেক্যুলারিযমের তুলনামূলকভাবে নিরীহ যে রূপ, সেটার ক্ষেত্রেও একথা সত্য। আর সেক্যুলারিযমের চরমপন্থী নাস্তিকতার যে রূপ, সেটা এদুটো ভিত্তিকে পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করে সেখানে মানবীয় খেয়ালখুশিকে বসায়। সেটা হতে পারে স্বৈরতন্ত্রের অধীনে গুটিকয়েক নেতার খেয়ালখুশি, অথবা গণতন্ত্রের অধীনে সংখ্যাগুরুর খেয়ালখুশি।

“তুমি কি তাকে দেখনি, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহরূপে গ্রহণ করেছে? তবুও কি তুমি তার যিম্মাদার হবে?”(২৫:৪৩)
.
যেহেতু খেয়াল-খুশি এবং কামনা-বাসনা প্রকৃতিগতভাবেই নিত্য পরিবর্তনশীল, তাই সেগুলোকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং আচরণও পরিবর্তনশীল হবে এটাই স্বাভাবিক। আজ যেটাকে অন্যায় মনে করা হচ্ছে, যার জন্য কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দেয়া হচ্ছে, কাল হয়তো সেটাই বৈধ কিংবা প্রশংসনীয় কাজে পরিণত হবে। এবং কাল যখন কেউ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে সে ‘পলিটিকালি ইনকারেক্ট’ হয়ে যাবে। মানুষের অন্তর্নিহিত ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে সমাজের বিচ্ছিন্নতার কারণে বারবার অবস্থান ও মূল্যবোধ বদলে ফেলার এ ব্যাপারটা ঘটে।
.
ট্র্যাডিশানাল সমাজ যতোই অজ্ঞ হোক না কেন, এর সদস্যদের মধ্যে একটা নূন্যতম পরিমাণ সহজাত বৈশিষ্ট্য কিংবা ফিতরাতী মূল্যবোধ টিকে থাকে। কিন্তু একটা সমাজে সেক্যুলারিজম যতো বৃদ্ধি পায় ততোই এধরনের মানুষ ও মূল্যবোধ কমতে থাকে, কমতে থাকে সমাজে তাদের প্রভাবও। এবং এক পর্যায়ে পুরো সমাজ ঐ অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে যা একসময় তারা সযত্নে লালন করতো। বিভিন্ন ট্র্যাডিশানাল জাহেলি সমাজে কিছু কিছু ফিতরাতী মূল্যবোধ টিকে থাকার পেছনে আরেকটি সম্ভাব্য কারণ আছে। তারা কিছু মূল্যবোধ আকড়ে থাকে কারণ সেগুলো তাদের ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাদের খেয়ালখুশির সাথে সাঙ্ঘর্ষিক না।

“ওদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ এবং তার রাসুলের দিকে ওদেরকে আহ্ববান করা হলে,ওদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়।সিদ্বান্ত ওদের স্বপক্ষে হবে মনে করলে,ওরা বিনীতে ভাবে রসুলের নিকট ছুটে আসে।(২৪:৪৮-৪৯)
.
সত্যের সাথে তাদের সম্পর্কটা অনেকটা শয়তানের মতো। আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে শয়তান আয়াতুল কুরসি পড়ার কথা জানিয়েছিল। একথা শোনার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, সে তোমাকে সত্য বলেছে যদিও সে এক চরম মিথ্যাবাদী।
.
জাহেলি সভ্যতার এ ক্রমপরিবর্তনশীল, স্ববিরোধী চেহারার সবচেয়ে স্পষ্ট দৃষ্টান্ত হল এখন পশ্চিমা সেক্যুলার সমাজগুলো। একদিকে এরা সংস্কৃতি এবং এর অন্তর্নিহিত মূল্যবোধকে আপেক্ষিক ও পরিবর্তনশীল মনে করে। অন্যদিকে কিছু কিছু মূল্যবোধকে এরা সর্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ ঘোষণা করে, এগুলোর লঙ্ঘন মারাত্মক অপরাধ মনে করে এবং লঙ্ঘনকারীকে কঠিন শাস্তি দেয়।
.
এ স্ববিরোধীতার উৎস হল এমন দুটি মৌলিক নীতি যেগুলোকে আধুনিক গণতান্ত্রিক সেক্যুলার সমাজগুলো তাদের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে।

প্রথমটি হল, সংখ্যাগুরুর মতকে ভালো-মন্দ নির্ধারনের মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করা।

দ্বিতীয়টি, হল ব্যাক্তিস্বাধীনতার মূলনীতি।

এ দুটি মূলনীতি অবধারিতভাবে পরস্পর সাংঘর্ষিক হবে, যদি না তৃতীয় কোন মূলনীতির অধীনস্ত করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করা হয়।
.
সেক্যুলারিজম সহজাতভাবে ধর্মকে অস্বীকার করে, আর মানবজাতির জন্য কোনটা উপকারী আর কোনটা ক্ষতিকর সেটা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ফিতরাহকে (সহজাত মূল্যবোধ) পশ্চিমা সেক্যুলারিজম গোণায় ধরে না। তাই কোন আচরণগুলো বৈধ ও উপযুক্ত তার ঠিক করার পরম মানদন্ড হিসেবে সংখ্যাগুরুর মত আর ব্যাক্তি-স্বাধীনতার মূলনীতিকে গ্রহণ করা ছাড়া সেক্যুলার সমাজের অন্য কোন উপায় থাকে না। সেক্যুলার সমাজে এ দুটো নীতির সাংঘর্ষিকতা সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যু থেকে স্পষ্ট। এসব সমাজে একদল মানুষ সমকামীতাকে মেনে নেয়ার কথা বলে। সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে এরা সমকামীদের সমান অধিকারের কথা বলে। গত কয়েক দশকে তারা এসব লক্ষ্য অর্জনে ব্যাপকভাবে সফলও হয়েছে। তাদের এ দাবির ভিত্তি হল ব্যাক্তি স্বাধীনতা তথা ব্যাক্তি অধিকারের মূলনীতি। তাদের কথা হল, অন্য কারো অধিকার নেই তাদের ‘যৌনতা’ নিয়ে কথা বলার।
.
অন্যদিকে গর্ভপাতের পক্ষেও একদল ঠিক একই যুক্তি দেয়। আপনি দেখবেন গর্ভপাতের পক্ষে এরা যুক্তি দেবে – ‘আমার ব্যাক্তিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা আমার। আমার শরীরের কী হবে, সেটা আমি ঠিক করবো। অন্যদের এখানে কথা বলার কোন অধিকার নেই।’ এ কথার বিপরীতে বিরোধী পক্ষ কেবল এটুকুই বলতে পারে যে, এধরনের আচরণ সমাজের অধিকাংশ মানুষের মূল্যবোধের পরিপন্থী। যদিও বাস্তবতা হল তাদের অনেকেই গর্ভপাতের বিরোধীতা করে নৈতিক ও ধর্মীয় জায়গা থেকে। কিন্তু সেক্যুলার সমাজের সেক্যুলার সদস্য হিসেবে তারা সেটা মুখ ফুটে বলতে পারে না। কারণ সেক্যুলার সমাজ কখনো সেটা মেনে নেবে না। সেক্যুলার সমাজে নৈতিকতা ও ধর্মের কোন স্থান নেই।
.
যদি আমরা আমরা মেনে নেই যে সংখ্যাগুরুর মত আর ব্যাক্তি-স্বাধীনতা ছাড়া মূল্যবোধের অন্য কোন ভিত্তি নেই, তাহলে মূল্যবোধগুলো ক্রমশ বদলানোই স্বাভাবিক। সমাজ আর সময় ভেদে মূল্যবোধগুলো তো বদলাবেই। যার অর্থ হল নিয়ত পরিবর্তনশীল বিভিন্ন সেক্যুলার মূল্যবোধের সাথে মানুষের সামাজিক ও আত্মিক উন্নতির কোন সম্পর্ক নেই। একটি কোন সেক্যুলার মূল্যবোধগুলোকে গ্রহণ করলো আর কোনগুলো বর্জন করলো, তাতে আসলে কিছু যায় আসে না। কারণ সবগুলোই সমানভাবে সঠিক, যেহেতু সবকিছু আপেক্ষিক।

কাজেই আজকের সেক্যুলার সমাজে যেসব আচরণকে জঘন্য মনে করা হচ্ছে – যেমন ধরুন ধর্ষন কিংবা শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন – এগুলোকে ঘৃণ্য অপরাধ মনে করার কারণ হল এগুলোর ব্যাপারে মানুষের বর্তমান মনোভাব। কিন্তু এ মনোভাবে কালকে বদলে যেতে পারে। যেমন ব্যভিচার, বহুগামীতা ও সমকামীতার ব্যাপারে তাদের মনোভাব বদলেছে। আর যখন মনোভাব বদলে যাবে তখন আর এ কাজগুলোকে ঘৃণ্য অপরাধ মনে করা হবে না। বরং বৈধ কিংবা প্রশংসনীয়ও ভাবা হতে পারে। অর্থাৎ ব্যাক্তি স্বাধীনতার মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে ভয়ংকর সব অপরাধও এক সময় সামাজিক ও আইনী বৈধতা পেতে পারে।
.
এসব নিয়ে প্রশ্ন করলে সেক্যুলাররা কনফিউযড হয়ে যায়, কারণ ধর্ষন কিংবা শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের মতো অপরাধগুলোর প্রতি তার ঘৃণার ভিত্তি আসলে এ দুটোর মূলনীতি (সংখ্যাগুরুর মত, ব্যাক্তিস্বাধীনতা) না। তাদের ঘৃণার মূল কারণ হল সেক্যুলারিযম সত্ত্বে এখনো তাদের মধ্যে অবশিষ্ট থাকা আল্লাহ প্রদত্ত ঐ সহজাত মূল্যবোধের ছিটেফোঁটা।
.
কেন তুমি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করো, কেন তুমি সংখ্যাগুরুর মতকে অন্য সব মূল্যবোধ ও আচরণের মাপকাঠি বানিয়েছো? – এ প্রশ্নগুলো করলে একজন সেক্যুলারিস্ট হয়তো আরো কনফিউযড হয়ে যাবে। সে জবাব দিতে পারে যে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি এ শ্রদ্ধার কারণ হল তার ব্যাক্তিগত অনুরক্তি ও আদর্শিক অবস্থান। অথবা সে বলতে পারে, সে মনে করে গণতান্ত্রিক সেক্যুলার সমাজই সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ। এখন আরেকজন যদি তার ব্যাক্তিগত অনুরক্তি, আদর্শিক অবস্থান ও মতের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক অবস্থান গ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে সেক্যুলারিস্টের জবাব কী হবে? এক্ষেত্রে উপযুক্ত কোন জবাব সেকুলারিস্টের থাকবে না।
.
সেক্যুলার সমাজগুলোর এ নড়বড়ে ভিত্তির কারণে, আজ যা কিছুকে মূল্যবান মনে করে তারা আকড়ে ধরছে কালই হয়তো সেটার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। এছাড়া এ মূলনীতিগুলো দখলদারিত্ব ও উপনিবেশবাদের দিকে সেক্যুলার সমাজের অধঃপতনের পথ সুগম করে দেয়। কারণ এ থেকে বিরত থাকার ভালো কোন কারণ তাদের আদর্শ দেয় না। একজন দাঁড়িয়ে বলবে, ‘অমুক দেশ আক্রমণ করলে আমাদের দেশ ও অর্থনীতির এই এই লাভ হবে’ –তার সহ-নাগরিকদের অনেকেই একথা বিশ্বাস করে তার পক্ষে নেবে। যদি সংখ্যাগুরু নাগরিক তার পক্ষ নেয় তাহলে তার ব্যাক্তিগত বিশ্বাস, রাষ্ট্রীয় পলিসিতে পরিণত হবে। কিন্তু আদতে এর কোন নৈতিক ভিত্তি নেই। এর পেছনে একমাত্র কারণ হল লোভ। ইতিহাসের সব সীমালঙ্ঘনের পক্ষে বারবার এ যুক্তিই দেয়া হয়েছে। এক পশুকে আরেক পশুকে এ যুক্তিতেই আক্রমণ করে।
.
বাস্তবতা হল ব্যাক্তি স্বাধীনতা এবং সংখ্যাগুরুর মত, সেক্যুলার সংস্কৃতির মৌলিক ভিত্তি না। কারণ স্বাধীনতার ফলাফল হল সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা। কিন্তু স্বাধীনতা সিদ্ধান্ত নেয়ার মাপকাঠি না। অর্থাৎ কাউকে যদি সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা দেয়াও হয় তবুও প্রশ্ন থাকে যে সে কীসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে? তাই স্বাধীনতা থাকলেও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে একটি মাপকাঠির প্রয়োজন হয়। একইভাবে সংখ্যাগুরুর মত কোন মাপকাঠি হতে পারে না। সংখ্যাগুরুর মত হল বিভিন্ন ব্যাক্তির নেয়া সিদ্ধান্তের সামস্টিক ফল। কিন্তু এই ব্যাক্তিরা কিসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? তাদের মাপকাঠি কী?

সেক্যুলার ব্যবস্থায় স্বাধীন সমাজ, স্বাধীন ব্যাক্তিদের সিদ্ধান্ত নেয়ার মাপকাঠি কী?
.
নিঃসন্দেহে এ মাপকাঠি হল তাদের খেয়ালখুশি ও কামনাবাসনা, যেগুলোকে তারা নিজেদের ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
.
মূল – শায়খ জাফর শেইখ ইদ্রীস [Secularism & Moral Values]
অনুবাদক – নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

Facebook Comments