ইমরান রাইহান ১. আমি ছিলাম। এখনো আছি। আমি তোমাদের আলো দেই। জ্ঞানের আলো। সূর্যের আলোর চেয়েও মহান সে আলো। আমি তোমাদের শিক্ষা দেই। আলোকিত করি। গড়ে তুলি নববী আদর্শে। তোমরা সবাই জানো আমার পরিচয়। আমি মাদরাসা।
…. আমার আগেও বিভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। সবার জন্যে নয়, অভিজাতদের জন্য। এরিস্টটল মহিলা ও গোলামদের শিক্ষার অনুমতি দেন নি। ভারতে মনু বিরোধিতা করেছেন শুদ্রদের শিক্ষার। শুদ্র বেদ পড়লে তার কানে ঢোকানো হতো গলিত সীসা। পৌনে দুইশ বছর আগে, ১৮৩৪ সালেও দক্ষিণ ক্যারোলিনাতে আইন ছিল কোনো কালো মানুষকে শিক্ষা দেয়া যাবে না। শুরু থেকেই আমি এসব ভেদাভেদ থেকে মুক্ত। আমার খেজুর পাতার চাটাইয়ে সবাইকেই স্বাগতম। আমার জন্ম দারুল আরকামে। সেই থেকে পথচলা শুরু।
২. ইসলামের শুরুর দিকে বাচ্চাদের পড়াশোনা ঘরেই হতো। হযরত উমর (রা) স্বীয় খেলাফতকালে মদীনায় তিনটি মকতব প্রতিষ্ঠা করেন। এসব মকতবে কুরআন তিলাওয়াত, হস্তলিপি ও অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তীর চালনা, অশ্বারোহণ, তরবারী চালনা ইত্যাদি শেখানো হতো। রাসুল (সা) এর যুদ্ধের ঘটনাবলী পড়ানো এবং মুখস্থ করানো হতো। শিক্ষকদের মাসিক ভাতা ছিল পনেরো দিরহাম।
এক পত্রে হযরত উমর (রা) শামের মুসলমানদের লিখেন, ‘তোমরা সন্তানদের তীর চালনা ও অশ্বারোহণ শিক্ষা দাও’ হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা) তার সন্তানদের পাশে বসে তাদেরকে যুদ্ধের ঘটনাবলী শোনাতেন। সেগুলো মুখস্থকরণে উৎসাহ দিতেন। মদীনায় উরওয়াহ বিন যুবায়েরের দরসগাহতে মাগাজী বিষয়ক বর্ণনা পড়ানো হতো। এই দরসগাহ প্রসিদ্ধ ছিল ‘কুত্তাবে উরওয়াহ’ নামে। খলীফা হিশাম বিন আব্দুল মালেক তার সন্তানের শিক্ষক সুলাইমান কালবিকে বলেছিলেন, ‘তাকে (শাহজাদাকে) হালাল, হারাম শিক্ষা দাও এবং বয়ান ও যুদ্ধে পারদর্শী করে তোলো’
৪১০ হিজরীতে মাথুরা বিজয়ের পর সুলতান মাহমুদ গজনভী গজনীতে একটি মাদ্রাসা নির্মান করেন। সেই মাদরাসার লাইব্রেরীতে অনেক ভাষার বই ছিলো’ লিখেছেন কাসিম ফিরিশতা। এমনকি হাকিম নাসির খসরু যখন নিশাপুর পৌছান, ৪৩৮ হিজরীতে, সেখানেও তিনি দেখেন একটি মাদ্রাসা। যা নির্মিত হয়েছে তুগরিল বেগের আদেশে।
![](https://articlebari.com/wp-content/uploads/2018/05/জামে-আয-যাইতুনা.jpg)
![জামেয়া মুস্তানসিরিয়া](https://articlebari.com/wp-content/uploads/2018/05/জামেয়া-মুস্তানসিরিয়া.jpg)
৪. ভারতবর্ষেও আমি ছিলাম। আমার আলাদা কাঠামো ছিলো। ছিলো নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা। এমনকি আমার জন্য নির্ধারিত ভবনও ছিলো। অনেকদিন পর্যন্ত আল্লামা শিবলী মনে করতেন, ভারতবর্ষে আমার আলাদা কাঠামো ছিলো না। পরে অবশ্য তিনি সে বক্তব্য থেকে ফিরে এসেছিলেন। ভারতবর্ষে আমি কোথায় ছিলাম?? প্রথমদিকে আমি ছিলাম মসজিদের প্রশস্ত আঙিনায়। দিল্লী, আগ্রা, লাহোর, জৌনপুর, আহমেদাবাদ, গুজরাট ও অন্যান্য শহরের প্রাচীন মসজিদগুলোতে আজো ছোট ছোট কক্ষ দেখা যায়। এগুলো ছিল আমার ছাত্রাবাস। সেকালের খানকাহগুলোতেও ছিলো আমার সরব উপস্থিতি। সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে খানকাহগুলোকে যে অর্থ দেয়া হতো তার বেশিরভাগই খরচ হতো আমার জন্য। আবার কখনো কখনো, বুজুর্গ কিংবা সম্রাটদের কবরের পাশে নির্মাণ করা হতো ছোট ছোট কক্ষ। শুরু হতো দরস ও তাদরিস। জন্ম নিতাম আমি। মাদরাসা।
![কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ, দিল্লী।](https://articlebari.com/wp-content/uploads/2018/05/কুওয়াতুল-ইসলাম-মসজিদ.jpg)
দিল্লীতে সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির কবরের পাশে ছিল একটি মাদরাসা। এ মাদরাসা কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের সাথে সংযুক্ত ছিল। মাদরাসার ভবন আজো বিদ্যমান।
৫৮৭ হিজরীতে আজমির জয় করার পর শিহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী বেশকিছু মাদরাসা নির্মান করেন। ৬০৭ হিজরীতে সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ বাদায়ুনে একটি মসজিদ ও মাদরাসা নির্মান করেন। তার সন্তান নাসিরুদ দুনিয়া ওয়াদ দ্বীন শাহজাদা মাহমুদ দিল্লীতে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদরাসার নাম ছিল নাসিরিয়্যাহ। তবাকাতে নাসিরির লেখক আবু ওসমান মিনহাজুদ্দিন ছিলেন এই মাদরাসার প্রধান শিক্ষক। মুহাম্মদ বিন তুঘলক কেল্লা খুররমাবাদ নির্মানকালে ভেতরে মসজিদ ও মাদরাসা নির্মান করেন। আকবরের শাসনামলে মাহিম বেগম পুরনো কেল্লার পশ্চিম দরজার পাশে একটি মসজিদ ও মাদরাসা নির্মান করেন। মাদরাসার নাম খাইরুল মানাযিল। নির্মাণকাল ৯৬৯ হিজরী।৫. ‘মোল্লা নিজামুদ্দীন কেনো প্রসিদ্ধ হলেন ?? তিনি কিছু বই লিখেছেন, কিন্তু এটাই তার খ্যাতিলাভের মূল কারণ নয়। সে যুগে বড় বড় অনেক আলেমই ছিলেন। যেমন, মোল্লা মুহিব্বুল্লাহ বিহারী, মোল্লা জিয়ুন, মীর গোলাম আলী আহমদ। তারাও বিভিন্ন শাস্ত্রে বই লিখেছেন। তবু অন্যদের চেয়ে মোল্লা নিজামুদ্দীনের প্রসিদ্ধি বেশী। আজ সারা ভারতবর্ষেই তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হচ্ছে। এসবই হচ্ছে তার প্রণীত নেসাব তথা পাঠ্যক্রমের অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে। পিতা মোল্লা কুতুবুদ্দীনের দেখানো পথেই হেটেছেন পুত্র নিজামুদ্দীন। পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেছেন তিনি। তার প্রণীত নেসাবের বৈশিষ্ট্য ছিলো :
১. এই নেসাবেই প্রথম ভারতীয় উলামায়ে কেরামের লিখিত বইপত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২. প্রত্যেক শাস্ত্রের ওই বই নির্বাচন করা হয় যার চেয়ে কঠিন বই ওই শাস্ত্রে নেই।
৩. অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে মানতেক ও ফালসাফার বইপত্র ছিলো বেশী।
৪. হাদিসের শুধু একটি কিতাব পড়ানো হতো। মিশকাত।
৫. আদব পড়ানো হতো খুবই কম। একজন মাঝারী মেধার ছাত্রও ১৬/১৭ বছর বয়সের মধ্যেই এই নেসাব সমাপ্ত করে ফারেগ হতে পারতো। ফিরিঙ্গী মহলের অধিকাংশ ওলামাগন এই বয়সেই ফারেগ হয়েছেন। মোল্লা নিজামুদ্দীনের এই নেসাব ‘বাহরুল উলুম’ আব্দুল আলী কিংবা মোল্লা কামালের মতো আলেম তৈরি করেছে । মোল্লা নিজামুদ্দীনের ছাত্ররা পুরো ভারতবর্ষে এই নেসাবের প্রচার প্রসার করেছেন। সহেলী আর বালাগ্রামের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলও হয়ে উঠেছে ইলমের মারকায। মোল্লা নিজামুদ্দীনের সেই দরসগাহ এখনো আছে। আমি ১৮৯৬ সালে সেই দরসগাহ পরিদর্শন করতে যাই। বাদশাহ আলমগীর প্রদত্ত সেই অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। এই অট্টালিকাই ছিলো আমাদের ভারতবর্ষের কেমব্রিজ।- (আল্লামা শিবলী নোমানীর মাকালাত থেকে)
৭. হিন্দুস্তান কী কদিম ইসলামী দরসগাহে — আবুল হাসানাত নদভী
মাদরাসা নিয়ে এটা পড়ুন – এটি হাদীস নয়: ‘মাদরাসা রাসূলের ঘর’