মুসলিম বাণিজ্য অভিযাত্রা

356

‘বিশ্ব ইতিহাসে বাণিজ্যকে আর কোনো ধর্ম এতটা বিকশিত করেনি, যতটা ইসলাম করেছে’— কথাটি ইতিহাসবিদ রিচার্ড ফোলজের। আর আরবদের ইতিহাস বিষয়ে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম পণ্ডিতদের একজন অ্যালবার্ট হাউরানি তার আ হিস্ট্রি অব দি আরব পিপলসে লিখেছেন, “ইসলামী যুগের তৃতীয় ও চতুর্থ শতকে (খ্রিস্টীয় নবম ও ১০ম শতক) ‘ইসলামী দুনিয়া’ বলে স্বীকৃত একটি দুনিয়ার আবির্ভাব ঘটে। এ দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে একজন পর্যটক মুসলমান শাসিত এবং মুসলমান অধ্যুষিত একটি ভূখণ্ডে সে কী দেখেছে, শুনেছে, সেটা বর্ণনা করতে শুরু করল। এটা সম্ভব হয়েছিল মানুষের চলাচলের মাধ্যমে। রাজত্ব এবং তাদের সেনাবাহিনীর চলাচল, ভারত মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগর দিয়ে বণিকদের চলাচল, শাসক ও ধনীদের পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষ কারুশিল্পীদের বিভিন্ন শহরে গমনের কারণে।

ইসলামী দুনিয়া থেকে আমদানি করা ও রফতানি হওয়া বিভিন্ন পণ্য, যেমন— বই, ধাতু নির্মিত সামগ্রী, সিরামিকস, বোনা কাপড় প্রভৃতির নকশা বা ধরনের মাধ্যমে এ দুনিয়ার একটি চিহ্ন পৌঁছে যাচ্ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে।” উল্লেখ্য, অ্যালবার্টের বইটি সম্পর্কে মধ্যপ্রাচ্যের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছেন, ‘অবশেষে সত্যি সত্যি আরবদের নিয়ে পাঠযোগ্য সংবেদনশীল একটি ইতিহাস আমাদের হাতে এসেছে।’ বিশিষ্ট ইতিহাসবিদদের প্রায় সবাই একমত যে, ইসলাম ও বাণিজ্যের বিকাশ হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। আধুনিক বাণিজ্যের অনেক রীতিনীতিকে আরবের মুসলমানরাই প্রতিষ্ঠা করেছিল।

বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে মুসলমানদের আধিপত্য ইসলামীকরণ বা ইসলামের বিকাশে সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রভাবক হিসেবে কাজ  করেছে। একজন ব্যবসায়ী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তিনি মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-চুক্তিতে বিশেষ সুবিধা পাবেন— এটা সবাই বুঝতেন। মুসলিম কর্মকর্তারা তাদের সম্প্রদায়ের জন্য যে বিশেষ সুবিধা দিতেন, তাও পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকত। অন্যদিকে ইসলামী আইন থেকেও কিছু সুবিধা মিলত। মুসলিম শাসন, বাণিজ্য ও ধর্মান্তরের মধ্যে এ সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ থেকে এটা বলা যায় যে, ইসলামীকরণ মূলত শুরু হয়েছিল সিল্ক রুটসংলগ্ন শহরাঞ্চলে। পরবর্তীতে তা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামাঞ্চলে। এরপর মধ্য এশিয়ার যাযাবর তুর্কিদের ইসলামের পতাকার তলে আসা শুরু হয় ১০ম শতকে। রেশম রাস্তায় বাণিজ্যে নেমে তুর্কিদের এ পরিবর্তন হয়েছিল।

উমায়য়েদের মুদ্রা,

অষ্টম শতকেই আরবের মুসলিম শাসকরা পূর্বদিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন। খলিফার রাজধানী দামাস্কাস থেকে বাগদাদে স্থানান্তর করা হলো। ৮২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ খলিফার বার্ষিক রাজস্ব বাইজানটিয়ান সাম্রাজ্যের পাঁচ গুণ দাঁড়ায়। ব্রদেলের মতে, মুসলিম দুনিয়া ‘পুঁজিবাদী’ একটি বাণিজ্যিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বিরাট সম্পদ ও সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছিল। ব্যবস্থাটি তখনকার সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রসর ছিল। এ বাণিজ্যিক ব্যবস্থাটি চীন, ভারত, পারস্য উপসাগর, ইথিওপিয়া, লোহিত সাগর, ইফরিকায়া ও আন্দালুসিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। ‘পুঁজিবাদী’ শব্দটি এক যুগের শব্দকে আরেক যুগে ব্যবহার বলে মনে করার কারণ নেই বলে মত দিয়েছেন ব্রদেল। ইসলামী দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত গুপ্তচররা বণিজ্য নিয়ে ঝুঁকি নিত।
একজন আরব লেখক ও বণিক হারিরি লিখেছিলেন,

‘আমি পারস্যের জাফরান চীনে পাঠাতে চাই, শুনেছি সেখানে ভালো দাম পাওয়া যায়। চীনা পোর্সেলিন জাহাজে করে পাঠাব গ্রিসে। গ্রিসের জরি পাঠাব ভারতে আর ভারতের লোহা আলেপ্পোতে, আলেপ্পোর কাচ ইয়েমেনে আর ইয়েমেনের ডোরাকাটা বস্তু পাঠাব পারস্যে।’

বিখ্যাত ফরাসি ইতিহাসবিদ ফার্নান্দ ব্রদেল মত প্রকাশ করেছেন, সে সময় বসরা বন্দরে বণিকদের মধ্যে যে সমঝোতা হতো, সেটা আজকের যুগের বন্দরের ক্লিয়ারিং সিস্টেম। ( ইসলামী খেলাফত কালের মুদ্রা দেখুন এখানে )

মুসলিম সাম্রাজ্যের গড়ে ওঠা এবং পরবর্তী সময়ে সেই ভূখণ্ডে অনেক রাষ্ট্রের তৈরি হওয়া বৃহৎ নগরের বিকাশের পথ করে দেয়। এসব শহরে ধনিক শ্রেণী ও সরকারের সম্পদ ও ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য খাদ্য, উৎপাদনের কাঁচামাল এবং বিলাসদ্রব্যের দরকার হয়ে পড়ে। নগরজীবনের এ পরিবর্তন ও জটিলতা ক্ষমতাবান বা বিদেশীদের নতুন ফ্যাশন অনুসরণের তাড়না জোগায়। নগরের নতুন চাহিদা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি দূরপথের বাণিজ্যকে (যা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল) নতুন পথ ও পদ্ধতির সন্ধান দেয়। দূরপথের বাণিজ্যের জন্য ভারী ও স্তূপাকারের মালপত্র উপযুক্ত ছিল না। শহরগুলোর খাদ্য চাহিদা পূরণ হতো নিকটবর্তী গ্রামাঞ্চল থেকে। কিছু পণ্যের মুনাফা এতটাই বেশি ছিল যে, অনেক দূরের পথে সেগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়াটাও ছিল ব্যবসার জন্য লাভজনক। মরিচ, অন্যান্য মসলা, মূল্যবান পাথর, মিহি কাপড়, পোর্সেলিন আসত ভারত ও চীন থেকে। পশমি কাপড় আসত উত্তরের দেশগুলো থেকে। এসবের বিনিময়ে আরব থেকে রফতানি হতো হাতির দাঁত, প্রবাল ও বোনা কাপড়। মধ্য-পূর্ব শহরগুলো শুধু ভোক্তাই ছিল না, তাদের নিজেদের ব্যবহার ও রফতানির জন্য বিভিন্ন কারখানাজাত পণ্যও উৎপাদন করত। কিছু উৎপাদন হতো বড় আকারে, যেমন— যুদ্ধের উপকরণ প্রস্তুত হতো রাষ্ট্রীয় অস্ত্র কারখানায়। এছাড়া তৈরি হতো প্রাসাদের জন্য মিহি কাপড়। চিনি পরিশুদ্ধকরণ ও কাগজ তৈরির কারখানাও ছিল। তবে এসব উৎপাদনের বেশির ভাগ হতো ছোট ছোট কারখানায়।

আধুনিক যুগে রেলগাড়ি, তারপর মোটরকার তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত স্থলপথের চেয়ে জলপথে পরিবহন অপেক্ষাকৃত সস্তা, দ্রুত ও নিরাপদ ছিল। অধিবাসীদের খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য এ সময় বড় শহরগুলো অবশ্যই কোনো সাগরের কাছে বা নদীপথের পাশে গড়ে উঠত। দীর্ঘপথের নৌ-বাণিজ্য এ সময় পরিচালিত হতো সাগরপথে, বিশেষত ভারত মহাসাগরে। আব্বাসীয় আমলে এ পথের বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল ইরাকের বসরা এবং পারস্য উপসাগরের ইরান উপকূলের সিরাত। এ দুটো স্থানই ছিল আব্বাসীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণে এবং রাজধানীর চাহিদা পূরণে অনুকূল অবস্থানে। ১০ম শতকে নৌ-বাণিজ্য পারস্য উপসাগর থেকে সরে লোহিত সাগরে চলে যায়। আর এর পেছনে ছিল বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে কায়রোর উত্থান। কায়রোর উত্থানের পেছনে ছিল ইতালির বাণিজ্য শহরগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদা। কিন্তু এটা ছিল মাত্র শুরু।

বিশ্রামরত মুসলিম কাফেলা

একসময় তারা চীনেও পৌঁছে যায়। তবে ১০ম শতকের পর তারা দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার বন্দরগুলো পেরিয়ে আর কোথাও যেত না। তারা দক্ষিণ ও পশ্চিম আরব ও পূর্ব আফ্রিকায় যেত। বসরা থেকে নদীপথে মালপত্র যেত বাগদাদে, বাগদাদ থেকে সিরিয়ার মরুপথ ধরে সিরিয়া এবং মিসর ও আনাতোলিয়ার মধ্য দিয়ে যেত কনস্টান্টিনোপল, ত্রেবিজোন্ডে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ ছিল বাগদাদ থেকে উত্তর-পূর্ব ইরানের নিশাপুর এবং সেখান থেকে মধ্য এশিয়া ও চীন। লম্বা দূরত্বে মালপত্র পরিবহন করা হতো উটের পিঠে আর কম দূরত্বে খচ্চর বা গাধার পিঠে। ইসলামী সাম্রাজ্যের পত্তনের পর নিকট-পূর্বের এলাকাগুলো থেকে চাকাযুক্ত পরিবহন যান অদৃশ্য হয়ে যায় এবং উনিশ শতকের আগ পর্যন্ত সেগুলো আর এ অঞ্চলে ফিরে আসেনি। এর পেছনে বিভিন্ন কারণকে দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেমন— রোমানদের পথগুলো ক্ষয়ে গিয়েছিল, আরব শাসকদের উট পালনে আগ্রহ ছিল, উটের পিঠে পণ্য পরিবহন চাকার গাড়ির তুলনায় বেশি সস্তা ছিল।

শুরুর দিকে ভূমধ্যসাগরে বাণিজ্য ছিল বেশ বিপজ্জনক এবং এর পরিসর ছিল সীমিত। পশ্চিম ইউরোপে তখনো রফতানি করার মতো উদ্বৃত্ত পণ্য উৎপাদন বা নিজেদের অধিক ভোগের সক্ষমতা অর্জন হয়নি। বাইজানটাইন সাম্রাজ্য চেষ্টা করছিল আরব নৌশক্তি ও নৌবাণিজ্যকে গণ্ডিবদ্ধ করে রাখার। দক্ষিণ উপকূল ধরে বাণিজ্য চলত স্পেন, মাগরিবের সঙ্গে— সিরিয়া ও মিসরকে যুক্ত করে। এক্ষেত্রে তিউনিসিয়া এক ধরনের বাজারই ছিল বলা যায়। এ পথ ধরে বণিকরা বিশেষত ইহুদি বণিকরা স্প্যানিশ সিল্ক, পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আনা স্বর্ণ এবং ধাতু ও অলিভ অয়েলের বাণিজ্য সৃষ্টি করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১০ম শতকে ভেনিস ও আমালফির সঙ্গে বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে।

বাণিজ্য মানে শহর, নগর। বসরা, কায়রো, দামাস্কাস, তিউনিস, কর্ডোবাসহ আরো অনেক ছোট ছোট নগর গড়ে ওঠে। অ্যালবার্ট মুসলিম দুনিয়ায় বড় বড় শহর গড়ে ওঠার পেছনে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভূমিকা ব্যাখ্যা করেছেন, “কৃষক ও যাযাবররা তাদের নিজেদের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি উৎপাদন করতে পারতেন। কৃষকরা তাদের নিজেদের ঘর নিজেরাই কাঁদা-ইট দিয়ে তৈরি করতে পারতেন। কম্বল ও কাপড় বুনতে পারতেন ঘরের নারীরা। আর ধাতুর কাজ করে দিতেন ভ্রাম্যমাণ কারিগররা। যাহোক, তাদের উৎপাদনের উদ্বৃত্ত অন্যান্য জিনিসের জন্য
বিনিময় করার প্রয়োজন হতো। এক্ষেত্রে তাদের উৎপাদনের উদ্বৃত্তের সঙ্গে বিনিময় হতো গ্রামাঞ্চলের অন্যান্য অংশের উৎপাদন বা দক্ষ কারিগরদের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্য, তাঁবু, আসবাব, পশুর প্রয়োজনীয় সামগ্রী, রান্নার সরঞ্জাম এবং অস্ত্রের। এগুলো তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল।

কৃষিভিত্তিক জেলাগুলোর সংযোগস্থলের কোনো সহজগম্য ও সর্বজনসম্মত সমাবেশস্থলে নিয়মিত বাজার বসত। সম্ভবত এগুলো সপ্তাহে একবার বসত, যেমন জানা যায় সুক আল-আরবা বা বুধবারের বাজারের কথা। এছাড়া বার্ষিক বাজারও ছিল, যেগুলোর জন্য বার নির্ধারিত হতো কোনো ‘স্রষ্টার প্রিয়’ মানব বা মানবীর মাজারের সংশ্লিষ্ট কোনো দিন অনুসারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব বাজারের কোনো কোনোটি স্থায়ী বসতি বা শহরের রূপ নেয়। শহরে কারিগরদের নিজেদের খাদ্য উৎপাদনের প্রয়োজন না থাকায় তারা তাদের পণ্য তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন। এসব বাজারনির্ভর শহরগুলো ছিল ছোট আকারের, প্রকৃতপক্ষে কোনো কোনো সময় কিছু গ্রামের চেয়েও ছোট। এসব শহরে থাকত কয়েকশ থেকে হাজারখানেক অধিবাসী, শহরে থাকত একটি কেন্দ্রীয় বাজার এবং একটি মূল সড়ক, যেখানে বিভিন্ন দোকান ও কারখানা থাকত। আশপাশের গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে এসব শহরের কোনো সুনির্দিষ্ট বিভেদরেখা ছিল না। শহরের কিছু মূল অধিবাসী ছাড়া অন্যরা পরিস্থিতি অনুযায়ী এসব শহর ও গ্রামের মধ্যে স্থানান্তরিত হতো। বড় শহর থেকে দূরবর্তী ছোট শহর বা মরূদ্যানের শহরের নিয়ন্ত্রণ থাকত সংশ্লিষ্ট এলাকার নিকটবর্তী গোত্রের শেখ বা স্থানীয় প্রভুদের হাতে। গোত্র বা গ্রামের জায়গিররা বাজারে ব্যবসা করত না। কারিগর ও বণিকদের গোত্রের রীতিনীতির বাইরে রাখা হতো। গোত্রের সদস্যদের কোড অব অনার বা গোত্রের প্রতিশোধের বাইরে রাখা হতো এদের।

তবে যা-ই হোক, কিছু শহর বাজারভিত্তিক শহরের চেয়ে বেশি কিছু ছিল। সেসব শহর ছিল বিভিন্ন ধরনের কৃষিভিত্তিক জেলার মিলনকেন্দ্র। এসব শহরে পণ্যের বিনিময় হতো ব্যাপকভাবে এবং এর বিনিময় প্রকৃতি ছিল জটিল। যেমন— উত্তর সিরিয়ার আলেপ্পো ছিল এমন এক মিলনস্থল, যেখানে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ সমতলে উৎপাদিত শস্য, উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে বন এবং ফলদ বৃক্ষের ফল, পাহাড়ে পালিত মেষ ও সিরিয়ার মরুভূমিতে পালিত উট ক্রয়-বিক্রয় হতো। শহরগুলোর আশপাশের জেলাগুলোয় খুব সহজে শহরের বাজারে আনা যায় এমন যথেষ্ট উদ্বৃত্ত খাদ্য ও কাঁচামাল উৎপাদন হলে সেসব শহর দক্ষ কারিগরদের কেন্দ্রে পরিণত হতো। আর এমন শহর যদি সাগর, নদী বা মরুভূমির পথের পাশে অবস্থিত হতো, একই ধরনের অন্য শহরগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকত, তাহলে সেই শহর মূল্যবান পণ্যের দূরগামী বাণিজ্যের সংগঠিত কেন্দ্র বা বন্দরে পরিণত হতো। আর এ বাণিজ্যে লাভ এতই বেশি হতো যে, বণিকরা সেই দূরযাত্রার ঝুঁকি ও খরচ দুটোই নিতে রাজি হতেন।

এ ধরনের পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকত এবং জীবনযাত্রা দশক বা শতাব্দীজুড়ে স্থিতিশীল থাকত, তাহলে সেখানে বড় নগর গড়ে উঠত। ইসলামী সাম্রাজ্য বিস্তৃত হওয়ায় এবং ইসলামী সমাজের বিকাশ ঘটায় ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং ইসলাম দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দালুসের কর্ডোভা, সেভিয়া ও গ্রানাডা; মরক্কোর ফেজ, মারাকেশ; তিউনিসিয়ার কেরাওয়ান (পরবর্তী সময়ে তিউনিস); মিসরের ফুসতাত এবং পরে কায়রো; সিরিয়ার দামাস্কাস, আলেপ্পো; পশ্চিম আরবের মক্কা, মদিনা; ইরাকের বসরা, মসুল, বাগদাদ ও ইরানের শহর ট্রানজোক্সানিয়া (মারওয়াননাহার) এবং উত্তর ভারত পর্যন্ত এক সারি বড় শহরের আবির্ভাবের উপযোগী শর্ত সৃষ্টি হয়। ইসলামের সূচনার আগেই এসব শহরের মধ্যে অনেকগুলো গড়ে উঠেছিল, অন্যগুলো ইসলামের বিজয় অভিযান বা তার পরবর্তী সাম্রাজ্যের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল। এসব শহরের বেশির ভাগই ছিল স্থলভাগে, সমুদ্রতীর থেকে বেশ ভেতরে। ভূমধ্যসাগরের মুসলিম নিয়ন্ত্রিত উপকূল অনিরাপদ ছিল এবং বন্দরগুলো সাগর থেকে শত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাযুক্ত ছিল।

দশম ও একাদশ শতকে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর বড় বড় শহর দুনিয়ার পশ্চিমাংশের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল। আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের শাসনামলে বাগদাদের জনসংখ্যা ছিল ১০ লাখ বা তার বেশি। সংখ্যাটা অবশ্যই অনেক বেশি। তবে এটা ছিল আয়তনে কায়রোর সমতুল্য শহর। ১৩০০ সাল নাগাদ এ শহরের ব্যাপক ক্ষয় হয় এবং এর কারণ ছিল পারিপার্শ্বিক শহরতলি এলাকার সেচ ব্যবস্থা ধসে পড়া এবং মোঙ্গলদের হাতে শহরের পতন। স্পেনের কর্ডোভাও প্রায় একই আকারের ছিল। পঞ্চদশ শতক নাগাদ আলেপ্পো, দামাস্কাস ও তিউনিসের জনসংখ্যা ছিল ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ। পশ্চিম ইউরোপে সে সময় কায়রোর সমআয়তনের কোনো শহর ছিল না। ফ্লোরেন্স, ভেনিস, মিলান ও প্যারিসের লোকসংখ্যা ছিল খুব সম্ভব ১ লাখ। আর ইংল্যান্ডের শহর, জার্মানি ও মধ্য ইউরোপের শহরগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট।”

শহরের প্রভাবশালী ও সম্পদশালী মানুষ ছিলেন বণিকরা। তারা গ্রামাঞ্চল থেকে কাঁচামাল ও খাদ্য শহরে আনতেন, আবার অনেকে মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী দূরবর্তী স্থানে রফতানি করতেন। সে সময় এ বাণিজ্যের মূল পণ্য ছিল টেক্সটাইলস, কাচ, চীন থেকে সংগৃহীত বাসনপত্র এবং এসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আনা মসলা। ইসলামের প্রাথমিক কালে এসব পণ্য আনা হতো উপসাগর, সিরাফ ও বসরার বন্দরগুলোয়। এসব বন্দর থেকে পণ্য পাঠানো হতো লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে মিসরের বন্দরে এবং সেখান থেকে কায়রোতে। আর এই কায়রো থেকেই পণ্য পুরো ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে পাঠানো হতো। এসব পণ্য হয় স্থলপথে অথবা সাগরপথে দামিয়েত্তা, রোসেটা ও আলেকজান্দ্রিয়া থেকে পরিবাহিত হতো। ইথিওপিয়া থেকে নীল নদে করে স্বর্ণ আনা হতো এবং তারপর ক্যারাভানে করে কায়রোতে পৌঁছানো হতো। নাইজার নদীসংলগ্ন এলাকা থেকে মাগরিবে স্বর্ণ আনা হতো সাহারার মধ্য দিয়ে। সুদান, ইথিওপিয়া ও স্লাভ অঞ্চল থেকে দাস আনা হতো।

তবে সব বাণিজ্যই মুসলিম বণিকদের হাতে ছিল এমনটা নয়। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার পণ্য পরিবহন বাণিজ্যের একটি বিরাট অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন ইউরোপের বণিক এবং তাদের জাহাজ। এসব ইউরোপীয় বণিকের মধ্যে শুরুর দিকে ছিলেন অ্যামালফি এবং তারপর জেনোয় ও ভেনিসের বণিকরা। পঞ্চদশ শতকে ফরাসি ও ইংরেজ বণিকদের আবির্ভাব ঘটে। মুসলিম শহরের বণিকরা মাগরিব, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার স্থলবাণিজ্য পথ এবং ভারত মহাসাগরের রুট নিয়ন্ত্রণ করতেন। অবশ্য পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে এসে পর্তুগিজরা কেপ অব গুড হোপ রুটটি চালু করে। আরবের বেশির ভাগ বণিক ছিলেন মুসলিম। যেমন— করিমি বণিকরা একটা সময় পর্যন্ত মসলা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বাগদাদ, কায়রো ও মাগরিবের ইহুদিদের সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে যোগাযোগ ছিল ইতালি, উত্তর ইউরোপ, বাইজানটিয়ান সাম্রাজ্যের। বড় শহরের এসব বণিক বাদে বিভিন্ন ছোট স্থানে অনেক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত জোট ছিল, যারা বিভিন্ন নির্দিষ্ট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন (আধুনিককাল পর্যন্ত এ ধারা বজায় ছিল। মাগরিবে শেষের দিকে এ ধরনের জোট ছিল তিউনিসিয়ার উপকূলের জারবা দ্বীপ, মজাব মরূদ্যান ও দক্ষিণ মরক্কোর সুস জেলায়)।

সিল্ক রুট

ব্যবসায়ের উদ্যোগ ছিল দুই ধরনের। একটি হলো অংশীদারি, যেখানে অনেক সময় একই পরিবারের সদস্যরা ব্যবসায়ে যুক্ত হতেন। এক্ষেত্রে কোনো পরিবারের দুই বা আরো বেশি সদস্য যুক্ত হতেন এবং ব্যবসায়ের ঝুঁকি ও মুনাফা তাদের বিনিয়োগের হার অনুসারে বুঝে নিতেন। অন্যটি ছিল কমেনডা (মুদারাবা)। এ পদ্ধতিতে একজন বিনিয়োগকারী বিশ্বস্ত কাউকে পণ্য অথবা পুঁজি জোগান দিতেন এবং সেই ব্যক্তি ব্যবসা করে বিনিয়োগকারীকে শর্তমতো মুনাফার অংশ ও মূল পুঁজি ফেরত দিতেন। এক শহরের বণিকের অন্য শহরে এজেন্ট থাকত। সুসংগঠিত ব্যাংক ব্যবস্থা না থাকলেও দূরবর্তী স্থানে ঋণ দেয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি ছিল। যেমন— রসিদের মাধ্যমে। ব্যবসায়ের মূল ভিত্তি ছিল মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বাস ও স্বীকৃত মূল্যবোধ।

বড় শহরগুলোয় স্থানীয় বাজারের জন্যও বিভিন্ন পণ্য উৎপাদিত হতো— টেক্সটাইল, ধাতব জিনিস, মাটির তৈরি জিনিস, চামড়াজাত পণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য। আর একটু বৃহৎ আকারের বাজার ধরার জন্য তৈরি হতো বেশ উন্নত মানের পণ্য, যেমন— সূক্ষ্ম ও মিহি কাপড়। প্রমাণ আছে, একাদশ শতক এবং তার পরবর্তী সময়ে মুসলিম দুনিয়ার বাইরের বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এর পরিবর্তে চীন, ভারত ও পশ্চিম ইউরোপে উৎপাদিত পণ্যের পরিবহন ব্যবসা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর কারণ ছিল ইউরোপে শহুরে জীবনের পুনরুজ্জীবন এবং বিশেষত ইতালিতে কাপড় তৈরির কারখানার বিকাশ।

সাধারণভাবে উৎপাদনের ইউনিট ছিল ছোট। একজন কারিগরের কয়েকজন শ্রমিক ও শিক্ষানবিশ থাকতেন। বড় আকারের কারখানা ছিল শাসক ও সেনাবাহিনীর জন্য উৎপাদন কাজে— অস্ত্র উৎপাদন কারখানা ও কাপড় উৎপাদনের রাজকীয় কারখানা এবং মিসর ও অন্যান্য অঞ্চলের চিনির কারখানা। তবে শহরের সঙ্গে মিশে থাকা একমাত্র গোষ্ঠী কিন্তু শুধু এ বণিকরাই নন। কারিগর ও দোকানিরা শহরে একটি শ্রেণী তৈরি করেছিলেন। কর্মকৌশল বংশপরম্পরায় পিতা থেকে পুত্রে প্রবাহিত হতো। দোকান অথবা কারখানার মালিকানা বংশপরম্পরায় রক্ষিত থাকত, তবে দোকান বা কারখানার সংখ্যা সীমিত থাকত জায়গার অভাব অথবা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের কারণে। একজন আধুনিক ইতিহাসবিদ দেখিয়েছেন, মূল বাজারের আকার, অবস্থা ও কারখানাগুলোর আকার নিয়ে লিও আফ্রিকানাস (১৪৮৫-১৫৫৪) ষোড়শ শতকে যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, বিশ শতকের শুরুতেও অবস্থাটা প্রায় তেমনই ছিল। এ কারিগর ও দোকানদাররা আয়ের দিক থেকে বড় বণিকদের তুলনায় পিছিয়ে ছিলেন। কারিগরি দক্ষতা আর খুচরা ব্যবসা করে মূল্যবান দ্রব্যের দূরপথের বণিকদের মতো উজ্জ্বল ভাগ্য তৈরি করা যেত না। অনেক কারিগরেরই যথেষ্ট পুঁজি ছিল না। কায়রোর একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, সে সময় অনেক দোকান ও কারখানার মালিক ছিল বড় বণিক ও ধর্মীয় ফাউন্ডেশন। কারিগররা সম্মান পেতেন। জনসংখ্যা বেশ স্থিতিশীল থাকায় সততার জন্য নির্দিষ্ট সাধারণ নিয়ম ও যথাযোগ্য কারিগরি দক্ষতাসহকারে সম্মানজনক বাণিজ্য অব্যাহত ছিল। কারিগরদের সম্মানের ক্ষেত্রে একটি ক্রম ছিল— মূল্যবান ধাতু ব্যবহারকারী কারিগর, কাগজ ও সুগন্ধি কারিগরদের সম্মান বেশি ছিল আর অপরিষ্কার কাজ, যেমন— কসাইয়ের কাজ, রঙের কাজ ও চামড়ার কারিগরদের সম্মান ছিল কম।

ইসলাম আফ্রিকায় সম্প্রসারণ হয়েছে মিসরের পথ ধরে। নীল নদের তীরবর্তী এ শহর ছিল আরব ও আফ্রিকার সংযোগস্থল। পূর্ব আফ্রিকায় মুসলিম বণিকরা আজকের দিনের সুদানে পৌঁছেছিলেন। আরব মুসলিম বণিকদের কাছ থেকে সুবিধা পেতে আফ্রিকার অনেক শাসকই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে মুসলিম বণিকরা আফ্রিকার দক্ষিণে এগোলেন এবং উপকূলীয় অঞ্চলের অভিজাত পরিবারের নারীদের বিয়ে করলেন। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়, অভিজাতদের মধ্যে একতাও বিস্তৃত হয়। এভাবে ইসলাম আরবের অভিজাত সম্প্রদায়ের ধর্ম হয়ে ওঠে। এ বাণিজ্যের মাধ্যমে আফ্রিকার পশ্চিমাংশে আফ্রিকা, আরব ও ইসলামী সংস্কৃতির মিলনে নতুন সামাজিক, রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভব ঘটে। অঞ্চলটি বর্তমানের তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া ও মরক্কো। পশ্চিম সাব-সাহারা অঞ্চলে ব্যবসায়ীদের আকর্ষণ ছিল লবণ ও স্বর্ণ। মুসলিম বণিকরা তাদের বিভিন্ন গুণাবলি ও পরামর্শ দিয়ে স্থানীয় শাসকদের মুগ্ধ করেন। আফ্রিকার পশ্চিমাংশে বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল ঘানা। স্থানীয় শাসকরা ঘোড়া এবং আরো কিছু প্রয়োজনে উত্তর আফ্রিকার ওপর নির্ভর করতেন। তাই বাণিজ্যের সুবিধায় ঘানার শাসকরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এভাবে ইসলামী দুনিয়া বাণিজ্য সম্পর্কের মাধ্যমে এশিয়ার সঙ্গে আফ্রিকাকে যুক্ত করেছিল। চীনে তৈরি একটি কম্বল এক বছরের মধ্যেই আলজেরিয়ায় পৌঁছে দেয়া সম্ভব ছিল। চীনে আবিষ্কৃত সুতা কাটার চরকা ইসলামী বাণিজ্যপথ ধরে ইউরোপে হাজির হয়।

এ বাণিজ্যপথের আরেকটি মূল্যবান অবদান ছিল বইয়ের স্থানান্তর। অর্থাৎ বইয়ের বাণিজ্যও বিকশিত হয়েছিল। বাগদাদ ও পারস্যে অনূদিত, লিখিত গ্রিক ও আরব দর্শনের বইপত্র বাণিজ্যপথ ধরেই ইউরোপে হাজির হয়। এসব গ্রন্থ ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তার বিকাশে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।

ইসলামী দুনিয়ায় অনেক ক্যারাভান রুট একে অন্যকে ছেদ করেছিল। ঐতিহ্যবাহী পুরনো পথগুলোর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন শহরের মধ্যে যোগাযোগের জন্য চাকাওয়ালা যান চলাচলের উপযোগী রাস্তা তৈরি হয়। ক্যারাভানের মূল চালিকাশক্তি ছিল উট। একটি ক্যারাভানে পাঁচ হাজার উটও থাকত। বিখ্যাত রেশমপথের যাত্রা পূর্বপ্রান্তে শুরু হতো চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজধানী জিয়ানে। সেখানে সুদৃশ্য মসজিদের দেখা পাওয়া যায়। এ পথ এশিয়ার সমরখন্দ, বুখারা, মের্ভ হয়ে পারস্য থেকে বাগদাদে যেত। আরেকটা পথ এশিয়ার মধ্য দিয়ে কৃষ্ণ সাগরের বন্দরে পৌঁছত। রাশিয়ার মধ্য দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত একটি পথ ছিল, যার মাধ্যমে ইসলামী দুনিয়ায় বিভিন্ন পণ্যের চালান আসত। আরেকটি ক্যারাভান চলার পথ ছিল বাগদাদ থেকে আরবের মরুভূমির মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগর পর্যন্ত।


এটা পড়ুন – বিটকয়েন — পরিচিতি ও শরঈ পর্যালোচনা


সড়কপথের পাশাপাশি নৌপথের মুসলিম বণিকরা তাদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। ভারত মহাসাগর ছিল ইসলামী দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য নৌপথ। নৌবাণিজ্য অপেক্ষাকৃত সহজ ও নিরাপদ ছিল। স্থানীয় নৌবাণিজ্য হতো নদীপথে। আর বণিকদের বড় বড় জাহাজ পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর, ভূমধ্যসাগর ও ভারত মাহসাগর হয়ে আফ্রিকার উপকূলে চলাচল করত। আরেকটি জলপথ ছিল শ্রীলংকা থেকে চীনের দক্ষিণাঞ্চলের গুয়াংঝৌ পর্যন্ত। সাগরের মৌসুমি বায়ু পূর্ব আফ্রিকা থেকে ভারত, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এ বাণিজ্য যোগাযোগকে সহজ করে দিয়েছিল।

ইসলামী দুনিয়ায় বাণিজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রা ব্যবস্থাপনাও নিজস্ব আকার ধারণ করতে থাকে। ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আবদ আল-মালিক পুরনো বাইজানটিয়ান ও সাসানিয়ার মুদ্রার পরিবর্তে নতুন মুদ্রার প্রচলন করেন। আগের মুদ্রায় শাসকদের প্রতিকৃতি বা ঐতিহ্যবাহী চিত্র অংকিত থাকত। কিন্তু ইসলামে চিত্রের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার কারণে কোরানের বাণীসংবলিত ক্যালিগ্রাফি দিয়ে মুদ্রা প্রচলিত হয়। মুসলমানদের প্রথম মুদ্রা ছিল স্বর্ণের দিনার। রোমানদের রৌপ্যমুদ্রা দিনারিয়াস থেকে এ নাম এসেছিল। মুসলমান বণিকরা বাণিজ্যে মূলত ব্যবহার করতেন রৌপ্যমুদ্রা বা দিরহাম। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বর্তমান ইউক্রেন, চীন ও জিম্বাবুয়েতে মধ্যযুগের প্রচুর দিরহাম খননের মাধ্যমে উদ্ধার করেছেন।

ক্রিস হারম্যান আ পিপলস হিস্টরি অব দি ওয়ার্ল্ড গ্রন্থে মুসলিমদের বাণিজ্য বিস্তারের একটি বিশেষ অর্জন সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বাণিজ্যের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছিল। এ ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রধান দপ্তর ছিল বাগদাদে আর শাখাগুলো বিস্তৃত ছিল ইসলামী দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে। এ ব্যবস্থায় চেক ও লেটার অব ক্রেডিটের প্রচলন ছিল। এর ফলে বণিকদের দূরযাত্রায় স্বর্ণ বা অর্থ নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলো না। বাগদাদ থেকে চেক নিয়ে মরক্কো, কর্ডোবা বা চীনে ভাঙানোর সুযোগ সৃষ্টি হলো। অনেক গবেষক মনে করেন, প্রক্রিয়াটি ছিল আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার একটি রেপ্লিকা। সাসানিয়ান ব্যাংকিং মডেল থেকে এ ব্যবস্থা প্রেরণা পেয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

 

তথ্যসূত্র:


আ হিস্ট্রি অব দি আরব পিপলসঅ্যালবার্ট হাউরানি
আ হিস্টরি অব সিভিলাইজেশনফার্নান্দ ব্রদেল
রিলিজিয়নস অব দ্য সিল্ক রোডরিচার্ড ফোলজ
আ পিপলস হিস্টরি অব দি ওয়ার্ল্ডক্রিস হারম্যান
ট্রেড অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ইন দ্য মেডিয়েভাল ইসলামিক ওয়ার্ল্ড (প্রবন্ধ), ব্রাডলি এ. স্কিন

Facebook Comments