8.3 C
New York
Friday, October 24, 2025

Buy now

spot_img
Home Blog Page 22

মক্তব : ইসলামী শিক্ষার প্রথম সোপান

ইমরান রাইহানঃ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহী ওয়া সাল্লামের সময়ে বাচ্চাদের শিক্ষার জন্য আলাদা কোনো মক্তব ছিল না । সাহাবায়ে কেরাম তাদের সন্তানদের কে ঘরেই শিক্ষা দিতেন। সাধারণত কথা বলা শিখলেই তারা বাচ্চাদের সাতবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়াতেন। সাত বছর বয়স থেকে তাদের কোরআন তিলাওয়াত ও নামাজের পদ্ধতী শিক্ষা দিতেন। হযরত উমর রা এর শাসনামলে সর্বপ্রথম বাচ্চাদের জন্য মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি এসব মক্তবে শিক্ষক নিয়োগ দেন । মদীনায় তখন তিনটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিটি মক্তবের শিক্ষকদের মাসিক ১৫ দিরহাম ভাতা দেয়া হতো ।বিভিন্ন ঘটনাবলী দ্বারা বুঝা যায় হযরত উমরের শাসনামলে মক্তবগুলোতে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি ছিল। আইয়ুব বিন হাসান রাফেয়ী বলেন, আমরা প্রতি শুক্রবার মদীনার মক্তবের বাচ্চাদের সাথে বাইরে যেতাম।

ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির সাথে সাথে মুসলিমরা বিজীত অঞ্চলের শিক্ষাদীক্ষার দিকেও মনোযোগ দেন। শাম বিজয়ের পর সেখানে অনেক মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। মুসলমানদের সন্তানরা এসব মক্তবে পড়াশুনা করতো। হেমসের বিখ্যাত কবি আদহাম বিন মেহরাজ বাহেলি এমনই এক মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।

পুরো মুসলিম বিশ্বে মক্তব প্রতিষ্ঠার এই ধারা এতোটাই বেগবান হয় যে, বিখ্যাত পর্যটক ও ভুগোলবিদ ইবনে হাউকাল সিসিলির একটি শহরেই তিনশো মক্তব দেখেছেন। এসব মক্তবে শিশুরা আরবী ভাষার প্রাথমিক জ্ঞান ও কোরআনুল কারীমের তিলাওয়াত শিখতো ।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ প্রথম জীবনে এমনই এক মক্তবে শিক্ষকতা করেছেন। ইবনে খাল্লিকান লিখেছেন, হাজ্জাজ রুটির বিনিময়ে বাচ্চাদের পড়াতেন। জনৈক কবি তাই হাজ্জাজকে কটাক্ষ করে লিখেছিলো,
أ ينسى كليب زمان الهزال
و تعليمه سورة الكوثر
رغيف له فلكة ما ترى
و آخر كالقمر الأزهر
কুলায়ব (কুকুর ছানা) কি ভুলে গেছে সেই কংকালসার দিনগুলোর কথা, যখন সে রুটির বিনিময়ে সুরাতুল কাউসার শিক্ষা দিত। হরেক রকমের রুটি, কোনোটা ফোলা ফোলা , কোনোটা উজ্জ্বল চাদের মতো গোল। (অনুবাদ : শায়খ আবু তাহের মিসবাহ)
যাহহাক ইবনে মুজাহিম কুফার একটি মক্তবে পড়াতেন। তার মক্তবে তিন হাজার ছাত্র পড়তো। ইয়াকুত হামাভী লিখেছেন আবুল কাসেম বলখীর মক্তবের কথা। তার মক্তবেও তিন হাজার ছাত্র ছিল। তিনি গাধায় চড়ে ছাত্রদের চারপাশে চক্কর দিতেন এবং তাদের দেখাশোনা করতেন। তিউনিসিয়া ও মরক্কোতে প্রচুর মক্তব গড়ে উঠে। কিছু কিছু মক্তব ছিল শুধু সুলতান ও আমিরদের সন্তানদের জন্য। সাধারনত প্রাসাদের এক কক্ষ এসব মক্তবের জন্য নির্ধারিত ছিল। আবু ইসহাক ইবরাহিম বিন আহমদ বিন আলী (মৃত্যু ৩৯৯ হিজরী) ছিলেন কাইরাওয়ানের বিখ্যাত আলেম। তিনি নিজের গ্রামের মক্তবে শিশুদের পড়াতেন।
এসব মক্তবে কখনো কখনো একের অধিক শিক্ষক থাকতো। সিসিলির মক্তবগুলোতে কমপক্ষে পাচজন শিক্ষক থাকতো। একজন থাকতেন প্রধান। তিনি সব দেখভাল করতেন।একারনে সিসিলিতে প্রচুর মক্তব শিক্ষক ছিলেন। ইয়াকুত হামাভী লিখেছেন শুধু পালের্মো শহরেই ৩০০ মক্তব শিক্ষক ছিলেন।
মুসলিম বিশ্বের খ্যাতনামা আলেম ও ফকীহরা তাদের বাল্যকালে এসব মক্তবেই প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছেন। ইমাম শাফেয়ী নিজের বাল্যকালের কথা বলেছেন, ‘আমি ছিলাম এতীম। আমার মা আমাকে মক্তবে ভর্তি করেন। কোরআনুল কারীম খতম করার পর আমি মসজিদে প্রবেশ করি এবং উলামায়ে কেরামের মজলিসে বসি। ইবনে আব্দুল বার ‘জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাদলিহি’তে এই বর্ননা এনেছেন। আবু মুসলিম খুরাসানিও তার বাল্যকালে এমন এক মক্তবে পড়াশুনা করেছেন বলে ইবনে খাল্লিকান উল্লেখ করেছেন।
অভিবাবকরা চাইতেন সন্তানদের প্রসিদ্ধ ও স্বনামধন্য শিক্ষকের কাছে পাঠাতে। সেকালের এমনই এক প্রসিদ্ধ শিক্ষক মুসলিম বিন হুসাইন বিন হাসান আবুল গানায়েম (মৃত্যু ৫৪৪ হিজরী)। ইবনে আসাকির তার প্রসিদ্ধির কথা উল্লেখ করেছেন। সাধারণ জনগন মক্তবের শিক্ষকদের সম্মান করতো। এমনকি খলীফা ও আমীররাও মক্তবের শিক্ষকদের সম্মান করতেন।
খলীফা হারুনুর রশীদ তার দুই সন্তান মামুন ও আমিনের জন্য মালেক ইবনে আনাস রহিমাহুল্লাহকে গৃহশিক্ষক নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন। ইমাম মালেক তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ইলমের কাছে আসতে হয়। ইলম কারো কাছে যায় না। শেষে খলীফা তার দুই সন্তানকে ইমাম মালেকের কাছে পাঠাতে সম্মত হন।
ইমাম মালেক শর্ত দেন, তারা সবার চোখের আড়ালে মজলিসের একেবারে শেষ প্রান্তে বসবে। খলীফা এই শর্ত মেনে নেন। মেহরাজ বিন খালাফ তিউনেসিয়ার একটি মক্তবে পড়াতেন। পরে তিনি প্রসিদ্ধি অর্জন করেন।
মকতব
শিল্পির চোখে সেকালের মক্তব।
মক্তবে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মহিলারাও পিছিয়ে ছিলেন না । তারাও সকাল বেলা বাচ্চাদেরকে পড়াতেন। তাবেয়ী আবদু রব্বিহী ইবনে সুলাইমান জানিয়েছেন উম্মে দারদা কাঠের ফলকে বিভিন্ন প্রজ্ঞামূলক বাক্য লিখে তাকে শিক্ষা দিতেন। এর মধ্যে একটি ছিল ‘বাল্যকালে প্রজ্ঞা শিখ, পরবর্তী জীবনে সে অনুযায়ী কাজ করবে’।
এ সকল মক্তবের পাঠ্যক্রমও ছিল বৈচিত্র্যময়। এসব মক্তবে শেখানো হতো কুরআনুল কারিমের তিলাওয়াত ও হস্তলিপি। পড়ানো হতো প্রয়োজনীয় মাসআলা -মাসায়েল, কবিতা ও আরবী ব্যকরণ। প্রাথমিক হিসাব নিকাশও ছিল পাঠ্য এমনকি ছাত্ররা পড়তো ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাবলীও। আলকামা বিন আবি আলকামার মকতবে আরবী ভাষা, ব্যকরন ও ছন্দ পড়ানো হতো। সাধারণত পাচ ছয় বছর বয়সী বাচ্চারাই এসব মক্তবে পড়তো । এই বয়সেই বাচ্চারা কুর আন হিফজ শুরু করত।এসব মক্তব শিক্ষকদের অনেকেই নিজের জীবনে উন্নতি করেছেন পরে। শুরুতে বলা হয়েছে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কথা । শুরুর দিকে ছিলেন মকতবের শিক্ষক। পরে আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের শাসনামলে তিনি ইরাকের গভর্ণর হন। এমনই আরেকজন হলেন ইসমাঈল বিন আব্দুল হামিদ । জীবনের শুরুর ভাগে মক্তবের শিক্ষক ছিলেন। পরে অবস্থার পরিবর্তন হলে মারওয়ান বিন মুহাম্মদের শাসনামলে তিনি মন্ত্রী হন।
সাধারণত শিক্ষকরা ছাত্রদের থেকে বিনিময় গ্রহণ করতেন। তবে যাহহাক বিন মুজাহিম ও আব্দুল্লাহ বিন হারিস সম্পর্কে ইবনে কুতাইবা লিখেছেন তারা শিক্ষাদানের বিনিময় গ্রহণ করতেন না । এখানে বিস্ময়কর এক শিক্ষকের কথা বলা যেতে পারে। আবু আবদুল্লাহ তাউদি (মৃত্যু ৫৮০ হিজরী)। তিনি মরক্কোর ফাস শহরে মক্তবে পড়াতেন। তার নিয়ম ছিল ধনী ব্যক্তিদের সন্তান পড়িয়ে বিনিময় গ্রহণ করতেন এবং সেই অর্থ দরিদ্র ছাত্রদের হাতে তুলে দিতেন।

আরও পড়ুন – ভারতবর্ষের কাগজ


ইবনে যুবাইর আন্দালুসী ও ইবনে বতুতার সফরনামায় এসব মক্তবের বিবরণ পাওয়া যায়। ইবনে বতুতা দামেশকের উমাভী মসজীদের মক্তবের বর্ননা দিয়েছেন এভাবে,
‘একদল শিক্ষক কোরআনুল কারীমের পাঠদানে ব্যস্ত। তারা বসেছেন মসজিদের পিলারে হেলান দিয়ে। তারা কাঠের ফলকে লিখে নয়, বরং মুখে উচ্চারণ করে করে পড়ান। এছাড়া আছেন হস্তলিপির শিক্ষক। তারা বিভিন্ন কবিতার পংক্তি লিখে ছাত্রদের হস্তলিপিতে পারদর্শী করে তোলেন।’
এসব মক্তবের শাসনপদ্ধতীর দিকেও উলামায়ে কেরামের সতর্ক নজর ছিল। আহমদ ইবনে হাম্বলকে প্রশ্ন করা হয়েছিল বাচ্চাদের প্রহার করা যাবে কিনা? তিনি বলেছিলেন, করা যাবে, অপরাধ অনুসারে তবে ভালোমন্দের পার্থক্য করতে অক্ষম এমন শিশুদের প্রহার করা যাবে না। এসব মক্তবের শিক্ষকরা সমসাময়িক সামাজিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। মিসরের অধিপতি আহমদ ইবনে তুলুন যখন অসুস্থ হন, ২৭০ হিজরীতে, তখন তার সুস্থতার জন্য বিভিন্ন মক্তবে দোয়া করা হয়।
বাংলায় সুলতানী আমল ও মুঘল আমলে প্রচুর মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাধারনত এসব মক্তবের ব্যয়ভার রাষ্ট্র কিংবা অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের জমিদান ইত্যাদী থেকে করা হতো। প্রতিটি মসজিদে মক্তব ছিল। এমনকি ধনী ব্যক্তিদের বাড়ির সামনেও মক্তব থাকতো। হিন্দু কবি মুকুন্দরামের উক্তি থেকে জানা যায়, হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় গড়ে উঠা ক্ষুদ্র মুসলমান পল্লীতেও মক্তব ছিল। সাধারনত পাচ বছর বয়সে শিশুদের শিক্ষা শুরু হত।
বাংলাসহ সমগ্র ভারতে একটা সাধারন রীতি ছিল চার বছর চার মাস চার দিন বয়সে শিশুদের শিক্ষা শুরু করা হত। শিশুদের শিক্ষা শুরুর দিনে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হত। পূর্ব থেকে নির্ধারিত সময়ে শিশু তার শিক্ষকের সামনে বসতো। শিক্ষক কোরআন শরীফ থেকে একটি আয়াত তিলাওয়াত করতেন, শিশু তা পুনরাবৃত্তি করতো।অনুষ্ঠানের দাওয়াত পত্র লেখা হতো ফারসীতে। এই অনুষ্ঠানকে বিসমিল্লাহ-খানি বলা হত।
এসব মকতবে বালক-বালিকা একসাথেই পড়ত। মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি দৌলত উযির বাহরাম খানের লাইলি মজনু কাব্য থেকে জানা যায়, বাল্যকালে লাইলি ও মজনু একই মক্তবে পড়ত।
ধর্মীয় শিক্ষাদানই ছিল মক্তবের প্রধান উদ্দেশ্য। কবি বিপ্রদাস লিখেছেন, মক্তবে মুসলমান ছেলেমেয়েদের অযু করা ও নামাজ পড়া শেখানো হতো। ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও মক্তবে আরবী, ফার্সী ও বাংলা পড়ানো হতো। ‘শমসের গাজীর পুথি’ থেকে জানা যায় , শমসের গাজী একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। সেই মক্তবের জন্য ঢাকা থেকে একজন মুন্সী (ফার্সি শিক্ষক), হিন্দুস্তান থেকে একজন মৌলবী (আরবী শিক্ষক) এবং জুগদিয়া থেকে একজন পন্ডীত (বাংলা শিক্ষক) নিয়োগ দেন।
সেকালে ফার্সী ছিল রাজভাষা । ফলে হিন্দু বালকরা , বিশেষ করে কায়স্থ পরিবারের ছেলেরা প্রায়ই মক্তবের মৌলভীর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করতো। বিদ্যাসুন্দরের লেখক রামপ্রসাদ সেনকে তার পিতা একজন মৌলভীর নিকট প্রেরণ করেন এবং তিনি ফার্সী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। রাজা রামমোহন রায়ও বাল্যকালে মক্তবে ফার্সী শিখেছেন।
তথ্যসূত্র :
১। দুহাল ইসলাম — ড. আহমদ আমীন
২। মাজা কদ্দামাল মুসলিমুনা লিল আলম — ড. রাগেব সারজানি
৩। আল হায়াতুল ইলমিয়্যা ফি ইফ্রিকিয়া — ড. ইউসুফ বিন আহমাদ হাওয়ালাহ
৪। আল হায়াতুল ইলমিয়া ফি সকিলাতিল ইসলামিয়া — ড আলী বিন মুহাম্মদ বিন সাঈদ যাহরানি
৫। খাইরুল কুরুন কী দরসগাহে — কাজী আতহার মোবারকপুরী
৬। হিন্দুয়ো কি ইলমি ও তালিমি তরক্কি মে মুসলমান হুকুমরানো কি কোশিশে — সাইয়েদ সুলাইমান নদভী।
৭। বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস — ড. এম এ রহিম
৮। সুলতানি আমলে বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষার উৎপত্তি ও বিকাশ — মো. আব্দুল করিম
৯। লাইলি মজনু — দৌলত উযির বাহরাম খান (আহমদ শরীফ সম্পাদিত)

বাংলার মুসলিম জাগরণে ইসলাম প্রচারক মুনশী মেহের উল্লাহ

আমরা খুব সহজে যেসব কীর্তিমান মানুষকে ভুলে যেতে বসেছি, মুনশী মেহের উল্লাহ তাঁদের অন্যতম। উপমহাদেশে মুসলমানদের বৃদ্ধিবৃত্তিক অসহায়ত্ব ঘোচাতে তাঁর কর্মতৎপরতা আমাদের জন্যে কেবলই মুগ্ধতা ও অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করে। এই আলোকিত মানুষটির বিস্ময়কর জীবন ও কর্ম বিস্মৃতির অতলে হারাতে চলেছে।

জাতি হিসেবে ইতিহাস চর্চা ও সংরক্ষণের প্রতি আমাদের এমনিতেই কোন দায়বোধ নেই, তার ওপর আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যের চেতনাকে ধারণ ও লালন করে ভবিষ্যতের পথরেখা অঙ্কনের চিন্তাও এখন বিরল। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের গর্ব ও অহঙ্কার মুনশী মেহের উল্লাহ তেমনই একজন বিস্মৃত বিস্ময়।

মুনশি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ বৃটিশ বাংলার অন্যতম বাগ্মী, ইসলাম প্রচারক, সমাজসংস্কারক ছিলেন। মেহেরুল্লাহ ১৮৬১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বৃহত্তর যশোর জেলার (বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলা) কালীগঞ্জ উপজেলার ঘোপ গ্রামে মামা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস যশোর সদর উপজেলার ছাতিয়ানতলা গ্রামে। যশোর শহরে সামান্য দর্জিগিরি করে জীবকা নির্বাহ করতেন। এ সময় খ্রিষ্টান পাদ্রিরা ইসলাম ধর্ম বিরোধী প্রচারে এবং ইসলামের কুৎসা রটনায় তৎপর ছিল।

মুনশী মেহের উল্লাহ মুসলমানদের বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করার জন্য কী করেননি? মুনশী মেহের উল্লাহর পরিচয় তাঁর কর্মে। এ কারণেই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সীমাবদ্ধতা ও পেশাগত জীবনের দৈন্য জয় করতে পেরেছিলেন। রাজশক্তির বলে বলিয়ান খিষ্টানদের ধর্ম প্রচারের নামে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার রোধে তিনি সর্বত্রই যুক্তি নিয়ে হাজির হয়েছেন। বিভ্রান্তির অন্ধকার দূর করেছেন। লেখনী, বাগ্মিতা আর ক্ষুরধার যুক্তির অনল বর্ষণে মিশনারিদের সব অপতৎপরতার জবাব দিয়েছিলেন তিনি।

দুটো উদাহরণ দেই:

খ্রিস্টান পাদ্রীদের পক্ষ থেকে একটি বাহাসে প্রশ্ন করা হোল: ‘ইসলাম ধর্ম মতে জান্নাত হলো ৮টি এবং জাহান্নাম হলো ৭টি। এটা নিতান্তই হাস্যকর কথা। কারণ, আপনারাই বলেন মুসলমানরা ব্যতীত আর কেউ জান্নাতে যাবেনা। কিন্তু পৃথিবীতে মুসলমানদের বিপরীতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাই বেশি। আবার বলেছেন মুসলমানদের মধ্যেও সবাই জান্নাতে যাবেনা। খাঁটি ঈমানদারেরাই যাবে কেবল। দেখেন, তাহলে এই গুটিকয়েক মানুষের জন্য ৮টা জান্নাত আর বিপরীতে এই বিশাল সংখ্যক মানুষের জন্য ৭টা জাহান্নাম! এর চে’ বড়ো কৌতুক আর কী হতে পারে?’ বলেই সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।

মুনশী মেহের উল্লাহ মুচকি হেসে ধীর-স্থির ভাবে এগিয়ে আসেন। প্রশ্ন করেন, ‘বাদুর দেখেছেন জনাব?’ পাদ্রী বললেন, ‘হ্যাঁ, দেখেছি’। মুনশী এবার হাসি দিয়ে বললেন, ‘দেখেন, রাতের বেলা যখন শিকারীরা ত্রিশ থেকে চল্লিশটা বাদুর শিকার করেন। দিনের বেলায় সেই বাদুরগুলোকে শুধু একটা মাত্র বস্তায় চেপে চেপে ভর্তি করে নিয়ে আসে। কিন্তু জনাব, ময়না দেখেছেন না? মানুষ কিন্তু শুধু একটা ময়নার জন্যই ইয়া বিশাল খাঁচা কিনে আদর করে রাখে। এবার আপনারাই বলেন, চল্লিশটা বাদুরের জন্যে একটা বস্তা, আর একটা ময়নার জন্যে সেই বস্তার সমান পুরোদস্তুর একটা খাঁচা! এটা কি হাস্যকর শোনাবে?’ সবাই নীরব। মুনশী এবার বললেন, ‘ঠিক সেটাই। যার যেমন কদর, যার যেমন মূল্য।

এখন আপনারা যারা বুক ফুলিয়ে বলেন জাহান্নামে যাবো, তারা ঠিক বাদুরের মতোই! তাদেরকে জাহান্নামে রাখা হবে ঠাসাঠাসি করে। আর আমরা যারা জান্নাতে যাবার স্বপ্ন দেখি, আমাদেরকে ময়না পাখির মতোই আদর-যত্ন করে রাখা হবে তো, এ জন্যে অল্প মানুষের জন্যে বরাদ্দটা বেশি আর কি!’
আরেকবার একজন পাদ্রী বললেন, ‘ইসলাম ধর্মে দাবী করা হয় মুহাম্মদই শ্রেষ্ঠ নবী। এবং তাঁর আগমনে নাকি পূর্বের সব নবী-রসূলের শরীয়ত রহিত হয়ে গেছে। এটা পুরোটাই তাদের বানোয়াট কথা ছাড়া আর কিছু নয়। দেখেন, মুসলমান ভায়েরা, আমাদের নবী ঈসাকে আল্লাহ কিন্তু আসমানের ওপর তুলে নিয়েছেন। আর আপনাদের নবী মাটির নীচে শুয়ে আছে। এবার আপনারাই বিচার করুন, কে শ্রেষ্ঠ? আমাদেরকে মুসলমান হতে না বলে বরং আপনারাই খ্রিস্টান হওয়া যৌক্তিক।’

মুনশী দেখছেন এদের ভাষা এবং প্রশ্ন করার ঢঙে যথেষ্ট বাড়াবাড়ি হচ্ছে এবং সীমা অতিক্রমের সম্ভাবনা আছে। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি খুব শান্ত ভাবে বললেন, ‘জনাব! আমরা কিন্তু কুরআনের নির্দেশ মতো কোন নবী-রাসূলের মাঝে পার্থক্য করি না। তাঁরা সকলেই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। কিন্তু তর্কের খাতিরে যদি আপনি মান উঁচু-নীচুর প্রশ্নে আসেন, তাহলে একটা প্রশ্ন করতেই হয়, মুক্তা দেখেছেন? মুক্তা কিন্তু সমুদ্রের তলায় থাকে, আর উপরে যা থাকে, তা হলো জোয়ারের ফেনা!’ উপস্থিত সবাই নীরব এবং বিস্মিত!

দুই হাতে লিখেও গিয়েছেন প্রচুর। খ্রিষ্টানদের অপপ্রচার, সমাজের কুসংস্কার এবং অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি গদ্যে-পদ্যে বহু বই পুস্তক রচনা করেছিলেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

খিষ্টান ধর্মের অসারতা (খৃষ্টীয় ধর্মের অসারতা), রদ্দে খ্রিস্টান/খ্রিষ্টান, দলিলুল ইসলাম, দেবলীলা, খিষ্টান মুসলমান তর্কযুদ্ধ, জেয়াবুন নাসারা (জওয়াবে নাসারা), পন্দনামা, হিন্দু ধর্ম রহস্য বা দেবীলীলা, বিধবা গঞ্জনা, মেহেরুল ইসলাম প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্ল্খেযোগ্য। মৃত্যুর পর ১৯০৯ সালে তৎকালীন সরকার তার বিধবা গঞ্জনা ও হিন্দু ধর্ম রহস্য বই দুটি বাজেয়াপ্ত করে।

মুন্সী জমির উদ্দিন নামে এক মুসলমান, পাদ্রিদের প্ররোচনায় পড়ে খ্রিষ্টানধর্ম গ্রহণ করে এলাহাবাদের ডিভিনিটি কলেজের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে তিনি রেভারেন্ড জন জমির উদ্দিন নাম ধারণ করেন। পাদ্রি জমির উদ্দিন ইসলাম ও কোরআনের বিরুদ্ধে লিখতে শুরু করেন।

মুনশী মেহের উল্লাহর সাহিত্যকর্মের মধ্যে ১৮৯২ সালে খ্রিষ্টান জন জমির উদ্দিন লিখিত ‘আসল কুরআন কোথায়’ এর জবাবে সুধাকর পত্রিকায় ‘খিষ্টানি ধোঁকাভঞ্জন’ শীর্ষক সুদীর্ঘ গবেষণামূলক প্রবন্ধ তৎকালীন সময়ে বিশেষভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। এরপরও তিনি ‘আসল কুরআন সর্বত্র’ শীর্ষক আর একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ সুধাকর ও মিহির পত্রিকায় প্রকাশ করেন।

এই প্রবন্ধ প্রকাশের পর খ্রিষ্টানেরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আর কিছু লেখার ও বলার ভাষা যেন হারিয়ে ফেলে। তখন স্বয়ং জন জমির উদ্দিন মুনশী মেহেরুল্লাহ সাথে এক বিতর্কে পরাজিত হয়ে পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বাকি জীবন ইসলামের খেদমতে কাটিয়ে দেন।

মুন্সী মেহেরুল্লাহকে ইংরেজরা এক সভায় ভারতবর্ষের মানুষকে বলতেছিলো তোমাদের দেশের মানুষ-বাটু,লম্বা,খাটো,বড়,কালো,ধলো কেন। আর আমাদের দেশে সব সাদা। ইংরেজদের কথার উওরে “শুওরক্য বাচ্ছা এক কিছিম হ্যায়- টাট্টু ক্যা বাচ্ছা হ্যারেক রকম হ্যায়”

উপস্থিত বুদ্ধিতে আসলেই এই মানুষটির কোন তুলনা হয় না। জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বিচার-বুদ্ধিতে এতো বেশি বিচক্ষণ, সত্যিই বিরল! অবশ্য আমি বিশ্বাস করি, এখানে আল্লাহর সাহায্যও তাঁকে ছায়া দিয়েছে বারবার।

আমাদের কাছে যুক্তিতর্কগুলো খুব সাধারণ মনে হলেও, তখনকার প্রেক্ষাপটে এগুলোর যথেষ্ট আবেদন ছিলো। তার কারণ, বাহাসে যারা আসতো, তারা নিছক মজা পাবার জন্যে আসলেও তর্কের জয়-পরাজয় তাদের অনেকেরই ধর্মচ্যুত হবার সম্ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতো (ইতিহাস বলে)। শাসকগোষ্ঠৗর বৈরিতা ও রক্তচক্ষু অনেক মুসলিম পণ্ডিত, জ্ঞানী ও নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিকে আপোষকামিতায় বাধ্য করেছিলো।

খ্রিষ্টানেরা হাটবাজারের দিন হাটে আগত মুসলমানদের জড়ো করে মিথ্যার তুবড়ি উড়িয়ে তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে চাইলে তিনি ওই সভার পাশে দাঁড়িয়ে অসাধরণ ওজস্বিনী ভাষায় তার জবাব দিতেন। তিনি শুধু স্থানীয়ভাবে প্রতিবাদ করতেন না। বাংলার সর্বত্র তার উপস্থিতি ও প্রতিবাদ ছিল। পিরোজপুর জেলায় একবার খ্রিষ্টানদেও সাথে মুসলমানদের তিন দিন ধরে তর্কযুদ্ধ চলে। ওই তর্কে মুনশী মেহের উল্লাহ খ্রিষ্টানদের সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করেন।
তিনি মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় সচেতনতাবোধ জাগিয়ে তোলার জন্য ১৮৮৯ সালে যশোরে গড়ে তোলেন ‘ইসলাম ধর্মোত্তেজিকা’ নামে একটি ইসলাম প্রচার সমিতি। বৃহত্তর আঙ্গিকে কাজ করার জন্য তিনি কলকাতায় গঠিত ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলমান শিক্ষা সমিতি’র সাথে যুক্ত হন। ইসলামের বিরুদ্ধে যে ধরণের ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার হতো মুনশী মেহের উল্লাহ সে ধরণের দাঁতভাঙা জবাব দিতেন।

ঠিক সেই সময়ে এগিয়ে এসেছিলেন তেজোদ্দীপ্ত ঈমানের অধিকারী সাহসী পুরুষ মুনশী মেহের উল্লাহ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিজেই উদ্যোগ নিয়ে সভা-সমিতির আয়োজন করে মুসলমানদের ভগ্নহৃদয়কে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ইতিহাস সাক্ষী, একদিকে ব্রিটিশ রাজশক্তির রক্তচক্ষু, অন্যদিকে খ্রিস্টান মিশনারি ও বিদ্বেষী হিন্দু নেতৃবৃন্দের যুগপৎ ষড়যন্ত্রের পরও মুনশী মেহের উল্লাহ অনেকটাই সক্ষম হয়েছিলেন জনতার হৃত মনোবল ফিরিয়ে আনতে।

শুধু তাই নয়, মুসলমানদের ভাগ্যাকাশে যখন কালো মেঘ ছেয়ে গিয়েছিলো; তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন সাহিত্য ও সমকালীন জ্ঞানচর্চায় মুসলমানদের এগিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা। সংবাদপত্র ও সাময়িকীর মাধ্যমে এবং শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝে ধর্মীয় মূল্যবোধের অনুভূতি জাগ্রত করে মুনশী মেহের উল্লাহ অনিবার্য জাগরণ ঠেকানোর সকল ফন্দি-ফিকিরের মূলে কুঠারাঘাত হেনেছিলেন।

একবার খ্রিষ্টানেরা মুসলমানদের এই বলে বিভ্রান্ত করছিল, তাদের নবী ঈসা আ. শ্রেষ্ঠ নবী বলে তার স্থান চৌঠা আসমানে। বড়দের স্থান ওপরেই হয়।
মুনশী মেহের উল্লাহ এ কথার জবাব দিয়েছিলেন হাতেনাতে প্রমাণ দেখিয়ে। তিনি একটা দাঁড়িপাল্লা নিয়ে এক পাশে ছোট বাটখারা এবং অন্য পাশে বড় বাটখারা রাখলেন। পরে দাঁড়িপাল্লা নিক্তি ধরে উঁচু করলে ছোট বাটখারার পাশ ওপরে উঠে যায় এবং বড় বাটখারার পাশ নিচে নেমে যায়। তিনি বলেন, ছোট বড়র বিচারের জন্য এর চেয়ে আর কি চান? এ ঘটনার পর খ্রিষ্টানেরা ওই ধরণের কথা আর কোনোদিন বলেনি।

আমাদের এখনকার ইন্টেলেকচুয়াল লড়াইয়ের গতি-প্রকৃতির সাথে তখনকার যুক্তি-তর্কগুলোর একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। সময়, চাহিদা এবং জনসাধারণের অবস্থান বিবেচনায় মিশনারি তৎপরতাও ছিলো ভিন্ন। ধর্মান্তরিতকরণের জন্যে তারা মূলত ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম রিলেটেড কিছু কমন পয়েন্টকে লজিক্যালি আক্রমণ করতো। এরা কিন্তু বেশ সফলও হয়েছিলো। তার অন্যতম প্রমাণ মহাকবি শ্রী মধুসূদনের ‘মাইকেল মধুসূদন’ হওয়া। মুন্সী জমির উদ্দীন- ইনিও বেশ সমাদৃত ছিলেন থিংক ট্যাঙ্ক হিসেবে; কিন্তু তাঁকেও ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলো মিশনারি গোষ্ঠী। পরে অবশ্য মুনশী মেহের উল্লাহর প্রচেষ্টায় তিনি পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

আজকে আমরা যাঁদের নিয়ে গর্ব করি, সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন, শেখ ফজলল করিম- এঁদের পৃষ্ঠপোষক এবং প্রেরণাদাতা ছিলেন মুনশী মেহের উল্লাহ। মুসলমানদের মধ্যে বিরাজিত মতানৈক্য এবং বিরোধ নিরসন করা এবং পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝির উর্ধ্বে ওঠে ঐক্যের পতাকাতলে সবাইকে সমবেত করতে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তার অসাধারণ প্রজ্ঞা ও প্রতিভার ক্ষমতায় পেশায় একজন সামান্য দর্জি এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত মানুষ হয়েও নিখিল ভারত ইসলাম প্রচার সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হতে পেরেছিলেন। নিজের চেষ্টা ও আন্তরিকতায় কম্পরেটিভ রিলিজিওন-এ এতো বেশি ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন, ভাবতেই অবাক হতে হয়। ঔপনিবেশিক শাসনামলে খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর ভয়ানক দৌরাত্ম্য এবং তার বিপরীতে মুসলিম সমাজের দৈন্য অবস্থায় তিনি ব্যথিত হন এবং নিজেই উদ্যোগী হয়ে পড়াশোনা শুরু করেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে। ১৯০৬ সালে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠনে যে ক’জনের ভূমিকা স্মরণযোগ্য তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম।

তিনি জীবনকে উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত এক দিনের সূর্যের মতো মনে করতেন। আর কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌছানোর পথকে দীর্ঘ ভাবতেন। তাই তো তিনি বলতেন, ‘ভাব মন দমে দম/রাহা দূর বেলা কম।’ মুনশী মেহের উল্লাহ সময় পেয়েছিলেন খুব কম। মাত্র ৪৬ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি অল্প সময় পেলেও তার প্রখর সময় চেতনাকে কাজে লাগিয়ে অসাধারণভাবে অজস্র কর্মধারার কল্যাণে সেই অল্প সময়কে বহুগুণে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৯০৭ সালে এক জুমাবার তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের পাখি হিসেবে ক্ববূল করুন। তাঁর বিদায়ের পর তাঁরই হাতে গড়া সুযোগ্য শব্দশিল্পী ইসমাঈল হোসেন সিরাজী অনুভব করতে পেরেছিলেন কি বিশাল শূন্যতা মুসলমানদের উপর জেঁকে বসলো আজ থেকে! মুনশী মেহের উল্লাহর কর্মময় জীবন আর অনন্য সাধারণ অবদানগুলোর বর্ণনাসহ তাঁকে হারিয়ে কবি যে শোকগাঁথা রচনা করেছিলেন, তাতে বোঝা যায় কি অমূল্য রত্ন ছিলেন তিনি!

“একি অকস্মাৎ হল বজ্রপাত। কি আর লিখিবে কবি।
বঙ্গের ভাস্কর প্রতিভা আকর অকালে লুকাল ছবি।
কি আর লিখিব কি আর বলিব, আঁধার যে হেরি ধরা।
আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল খসিয়া কক্ষচ্যুত গ্রহ তারা।
কাঁপিল ভূধর কানন সাগর প্রলয়ের প্রভঞ্জনে,
বহিল তুফান ধ্বংসের বিষাণ বাজিল ভীষণ সনে!
ছিন্ন হ’ল বীণ কল্পনা উড়িল কবিত্ব পাখী,
মহা শোকানলে সব গেল জ্বলে শুধু জলে ভাসে আঁখি।
কি লিখিব আর, শুধু হাহাকার শুধু পরিতাপ ঘোর,
অনন্ত ক্রন্দন অনন্ত বেদন রহিল জীবনে মোর।
মধ্যাহ্ন তপন ছাড়িয়া গগন হায়রে খসিয়া প’ল,
সুধা মন্দাকিনী জীবনদায়িনী অকালে বিশুষ্ক হ’ল।
বাজিতে বাজিতে মোহিতে মোহিতে অকালে থামিল বীণ,
প্রভাত হইতে দেখিতে দেখিতে আঁধারে মিশিল দিন।
মলয় পবন সুখ পরশন থামিল বসন্ত ভোরে,
গোলাপ কুসুম চারু অনুপম প্রভাতে পড়িল ঝরে।
ভবের সৌন্দর্য্য সৃষ্টির ঐশ্বর্য্য শারদের পূর্ণ শশী,
উদিতে উদিতে হাসিতে হাসিতে রাহুতে ফেলিল গ্রাসি।
জাগিতে জাগিতে উঠিতে উঠিতে নাহি হ’ল দরশন,
এ বঙ্গ-সমাজ সিন্ধুনীরে আজ হইলরে নির্গমন।
এই পতিত জাতি আঁধারেই রাতি পোহাবে চিরকাল,
হবে না উদ্ধার বুঝিলাম সার কাটিবে না মোহজাল।
সেই মহাজন করিয়া যতন অপূর্ব বাগ্মিতাবলে,
নিদ্রিত মোসলেমে ঘুরি গ্রামে গ্রামে জাগাইলা দলে দলে।
যার সাধনায় প্রতিভা প্রভায় নূতন জীবন ঊষা,
উদিল গগনে মধুর লগনে পরিয়া কুসুম ভূষা।
আজি সে তপন হইল মগন অনন্ত কালের তরে,
প্রবল আঁধার তাই একেবারে আবরিছে চরাচরে।
বক্তৃতা তরঙ্গে এ বিশাল বঙ্গ ছুটিল জীবন ধারা,
মোসলেম-বিদ্বেষী যত অবিশ্বাসী বিস্ময়ে স্তম্ভিত তারা।
হায়! হায়! হায়! হৃদি কেটে যায় অকালে সে মহাজন,
কাঁদায়ে সবারে গেল একেবারে আঁধারিয়া এ ভুবন।
কেহ না ভাবিল কেহ না বুঝিল কেমনে ডুবিল বেলা,
ভাবিনি এমন হইবে ঘটন সবাই করিনু হেলা।
শেষ হল খেলা ডুবে গেল বেলা আঁধার আইল ছুটি,
বুঝিবি এখন বঙ্গবাসিগণ কি রতন গেল উঠি।
গেল যে রতন হায় কি কখন মিলিবে মাজে আর?
মধ্যাহ্ন তপন হইল মগন বিশ্বময় অন্ধকার।”

কবির আশঙ্কা তবে কি সত্য হতে চললো? ইসলাম ও ইসলামী আদর্শের ওপর চতুর্মুখী আক্রমণ ও ষড়যন্তের বিপরীতে আমাদের পণ্ডিত সমাজ তাঁর মতো কি এগিয়ে আসবে না? বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বের পাগলা ঘোড়া দেখে হতচকিত হয়েই বসে আছি যেনো আমরা সবাই; সেই ঘোড়ার গতিবেগ রুখে দিতে, আর ঘোড়ার সহিসকে লাগাম টেনে ধরায় বাধ্য করতে আমরা কি কেউ মুনশী মেহের উল্লাহর পথে হাঁটবো না? মাথা উঁচু করে স্বীয় আদর্শের কীর্তিধ্বজা পতপত করে উড়ানোর সাহস কি আমাদের হৃদয়ে সৃষ্টি হবে না?

মুনশী মেহের উল্লাহর সময় বাংলার মুসলমানদের এমন দুঃসময় ছিল, খ্রিষ্টানদের মুখরোচক প্রচারণা ও স্বার্থের লোভে দলে দলে মুসলমানেরা খ্রিষ্টধর্মে ভিড়তে থাকে। এ অবস্থা থেকে মুসলমানদের ঠেকাতে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়ান তিনি। সভা সমাবেশ তো ছিলই, তার ওপর ছিল লেখনি সংগ্রাম।

যেখানেই ইসলাম ধর্মের বিরোধীতা সেখানেই মুনশী মেহের উল্লাহর সভা, সমাবেশ, তেজস্বী বক্তৃতা। তার অসাধারণ বাগ্মিতা এবং অখন্ডনীয় যুক্তির কাছে হার মানতো খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারকেরা। স্বল্প শিক্ষিত মেহেরুল্লাহ তার তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সাহায্যে তৎকালীন উচ্চ শিক্ষিত এবং সরকারি মদদপুষ্ট খ্রিষ্টান পাদ্রিদের ধর্ম প্রচারের গতিকে বিঘ্নিত করেছিলেন।

কর্মবীর মুনশী মেহের উল্লাহর মুসলিম জাগরণে অনলবর্ষী বক্তৃতা, লেখনি ও কর্মযজ্ঞে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার বিভিন্ন জেলায় বহু স্কুল কলেজ মাদরাসা মক্তব ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। তার নিজ গ্রাম ছাতিয়ানতলার পাশে মনোহরপুরে বাংলা ১৩০৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মাদরাসায়ে কারামতিয়া ও আর একটি মাইনর স্কুল। পরে সেটি রুপান্তরিত হয়ে এম,ই স্কুলে। আদর্শবান চরিত্রবান সুনাগরিক গড়ে তোলাই ছিলো তাঁর লক্ষ। সমাজের কূসংস্কার দুরীকরণ ও ইসলামী মুলবোধ সৃষ্টি ছিল তাঁর কর্মময় জীবনের ব্রত। সর্বপরি খৃষ্টান মিশনারীদের তৎপরতাঁর বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন খড়হস্ত। তাই তাঁর প্রতিষ্ঠানটি ছিল তাঁর আদর্শের প্রতিক। তার কীর্তি বহন করে চলেছে যশোর সদর উপজেলার ঝাউদিয়া গ্রামের মুনশী মেহের উল্লাহ অ্যাকাডেমি (মাধ্যমিক বিদ্যালয়)।

‘মুসলিম জাগরণের বিপ্লবী পথিকৃৎ’ শীর্ষক প্রবন্ধের লেখক মোহাম্মদ আবদুল জব্বার উল্লেখ করেছেন, মেহের উল্লাহর শাব্দিক অর্থ আল্লাহর অনুগ্রহ। প্রকৃত অর্থেই তিনি পথহারা বাংলার মুসলমানদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ ছিলেন। মাদরাসায় পড়া খেতাবধারী আলেম না হয়েও আল্লাহ প্রদত্ত বিধানকে সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য নানারূফ প্রতিকুলতার মধ্যে থেকেও অবিরাম সংগ্রাম, সাধনা, ত্যাগ, তিতিক্ষা, কষ্ট, পরিশ্রম ও নিস্বার্থ আন্দোলন করে গেছেন।
মুনশী মেহের উল্লাহ ১৯০৭ সালের ৭ জুন ইন্তেকাল করলে কিছু দিন তার নাম যেন হারিয়ে ছিল। প্রায় ছয় দশক একান্ত অবহেলা উপেক্ষায় থেকে ১৯৬৬ সালে মুনশী মেহের উল্লাহর নাম স্বমহিমায় উঠে আসে জনারণ্যে। বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিভিন্ন সময়ে অংশগ্রহণ করেছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি জসিমউদ্দিন, কবি কাদের নওয়াজ, ড. গোলাম সাকলায়েন, সুন্দরবনের ইতিহাস লেখক এএফএম আবদুল জলিল, কবি নাসিরউদ্দিন আহমদ, ড. নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুমসহ খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিক গবেষকেরা। এ ছাড়া মন্ত্রী, এমপি এবং উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে মেহের উল্লাহর জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করেছেন।

মুনশী মেহের উল্লাহ বাংলাদেশের মুসলমানদের হৃদয়াসনে প্রতিষ্ঠিত একটি নাম। বিভিন্ন পর্যায়ে তার স্মৃতি ধরে রাখতে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন তার ভক্ত অনুরক্তরা। তার নামে ডাক বিভাগ স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করায় তিনি জাতীয় মর্যাদা পেয়েছেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি রেলস্টেশনকে মেহের উল্লাহ নগর রেল স্টেশন নামকরণ করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও রেল ভ্রমণকারীদের কাছে তার নামের পরিচিতি প্রচারের ব্যবস্থা করেছে। যশোর টাউন হল ময়দান আজ মেহের উল্লাহ ময়দান নামে পরিচিত। যশোর শহর এবং তার নিজ এলাকার একাধিক সড়কের নামের সাথে কর্মবীরের নাম জড়িয়ে স্মৃতি অম্লান করা হয়েছে।

কালান্তরের কড়চায় মুনশী মেহের উল্লাহ বিস্মৃত ঠিকই, কিন্তু অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তিনি ভাস্বর থাকবেন ইতিহাস-সচেতন বাঙালী মুসলমানের মানস পটে। ঐশী আলোর দীপশিখা অনির্বাণ রাখার দুর্জয় প্রত্যয়ে মুনশী মেহের উল্লাহ হোক সাহস ও প্রেরণার প্রোজ্জ্বল বাতিঘর।

তথ্যসূত্র:
1. শতাব্দীর দর্পন, ফজলুর রহমান, পৃষ্ঠা ৫২, প্রকাশ ১৯৯৫।
2. Hussain, Mohsin। “Meherullah, Munshi Mohammad”।
3. Banglapedia। Asiatic Society of Bangladesh। সংগৃহীত ২ জানুয়ারি ২০১৫।
4. মুসলিম বাংলার মনীষা

(‘Revert Stories : Journey To Islam – ইসলামে আসার গল্প’ ফেসবুক পেজ থেকে)

গ্যারি মিলার,কুরআনের ভুল খুঁজতে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করা এক অধ্যাপক!

কানাডার একজন প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ, অধ্যাপক এবং সাবেক খ্রিস্টধর্ম প্রচারক ড. গ্যারি মিলার । একসময় তিনি পবিত্র কুরআনের মধ্যে ভুল তথা অসামঞ্জস্য খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন, যাতে ইসলাম ও কুরআন বিরোধী প্রচারণা চালানো সহজ হয়। কিন্তু এর ফল হয়েছিল বিপরীত। অবশেষে আল্লাহর কুদরাতে তিনিই প্রবেশ করলেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে।

পবিত্র কুরআনের সত্যকে আবিষ্কারের পর তিনি তার মুসলিম নাম গ্রহণ করেছেন আবদুল আহাদ উমার।

dr-garyঅধ্যাপক ড. গ্যারি মিলার বলেন, আমি কোন একদিন কুরআন সংগ্রহ করে তা পড়া শুরু করলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম কুরআন নাযিল হয়েছিল আরবের মরুচারীদের মধ্যে। তাই এতে নিশ্চয় মরুভূমি সম্পর্কে কথা থাকবে। কুরআন নাযিল হয়েছিল ১৪০০ বছর আগে। তাই খুব সহজেই এতে অনেক ভুল খুঁজে পাব ও সেসব ভুল মুসলিমদের সামনে তুলে ধরব বলে সংকল্প করেছিলাম।

কিন্তু কয়েক ঘণ্টা ধরে কুরআন পড়ার পরে বুঝলাম আমার এসব ধারণা ঠিক নয়, বরং এমন একটা গ্রন্থের ভেতরে ঢুকে আমি অনেক আকর্ষণীয় তথ্য পেলাম। বিশেষ করে সূরা নিসার ৮২ নম্বর আয়াতটি আমাকে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত করে। সেখানে আল্লাহ বলেন, ‘এরা কী লক্ষ্য করে না কুরআনের প্রতি? এটা যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও পক্ষ থেকে নাযিল হ’ত, তবে এতে অবশ্যই বহু বৈপরিত্য দেখতে পেত’।

এই আয়াতের প্রভাবে আরো গভীরভাবে কুরআন অধ্যয়ন করলেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারক গ্যারি মিলার । আর তার এই অধ্যয়নই তাঁকে নিয়ে গেল ইসলামের পথে। ইসলামের দোষ খুঁজতে গিয়ে তিনি হয়ে গেলেন একজন মুসলিম— তথা মহাসত্যের কাছে সমর্পিত একজন। মহান আল্লাহ ইসলামের জন্য তাঁকে কবুল করুন।

তিনি বলেছেন, ‘আমি খুব বিস্মিত হয়েছি যে, কুরআনে ঈসা (আ.)-এর মাতা মারিয়ামের নামে একটি বড় পরিপূর্ণ সূরা রয়েছে। আর এ সূরায় তাঁর এত ব্যাপক প্রশংসা ও সম্মান করা হয়েছে যে, এত প্রশংসা বাইবেলেও দেখা যায় না। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর নাম মাত্র ৫ বার এসেছে। কিন্তু ঈসা (আ.)-এর নাম এসেছে ২৫ বার। আর এ বিষয়টি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে আমার ওপর ব্যাপক প্রভাব রেখেছে।’

প্রাসঙ্গিক আলোচনা

ইসলাম মানুষের জীবনকে করে লক্ষ্যাভিসারী। কারণ এ ধর্মের দৃষ্টিতে মানুষের জীবনের রয়েছে সুনির্দিষ্ট অর্থ ও লক্ষ্য। কিন্তু পশ্চিমা সরকারগুলো ইসলাম ও মুসলিমদের সম্পর্কে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা মুসলিমদেরকে পাশ্চাত্যের জন্য বিপজ্জনক বলে তুলে ধরছে। আর এই অজুহাত দেখিয়ে পশ্চিমা সমাজে মুসলিমদের উপর আরোপ করা হয়েছে নানা বিধি-নিষেধ।

ইউরোপ-আমেরিকার ক্ষমতাসীন সরকার ও ইসলাম-বিদ্বেষী দল বা সংস্থাগুলো এভাবে মুসলিম ও ইসলামের উপর আঘাত হানার পাশাপাশি নিজেদেরকে পশ্চিমা সভ্যতা এবং পশ্চিমা জনগণের সমর্থক হিসাবে জাহির করার পাশাপাশি জনগণকে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে।

পাশ্চাত্যে ইসলামের জনপ্রিয়তা ও প্রভাব ক্রমেই বাড়তে থাকায় ইসলাম বিরোধী মহলগুলোর ইসলাম-বিদ্বেষী তৎপরতাও জোরদার হয়েছে। বর্তমানে মুসলিমদের নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম ও জনমত ব্যাপক বিতর্কে মেতে রয়েছে। পাশ্চাত্যের উগ্র লেখক ফিলিপ রনডু বলেছেন, ‘মুসলিমরা হচ্ছে বিস্ফোরণের বোমার মত এবং ইসলাম বহু মানুষকে, বিশেষ করে ইউরোপের বহু মানুষকে আকৃষ্ট করছে।’

বহুল প্রচারিত ম্যাগাজিনগুলোতে ইউরোপে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধিকে ‘ইউরোপের পরিচিতি সংকট’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। ২০১০ সালের শেষের দিকে সুইজারল্যান্ডে মসজিদের মিনার নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞার আইন চালু করার লক্ষ্যে এক গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এই পদক্ষেপের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল ‘সুইস পিপলস পার্টি’ নামের একটি উগ্র খ্রিস্টানপন্থী দল।

মুসলিমদের ব্যাপারে আতঙ্ক সৃষ্টি করাই ছিল এই পদক্ষেপের লক্ষ্য। শেষ পর্যন্ত এই আইন পাশ করতে সফল হয় দলটি। দলটির পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম এই আইন চাপিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন সুইস রাজনীতিবিদ ড্যানিয়েল স্ট্রিচ। তিনি পুরো সুইজারল্যান্ডে ইসলাম-বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে দেন এবং জনগণের মধ্যে ইসলাম-অবমাননার বীজ বপন করেন। ফলে সুইস জনগণ মসজিদের মিনার নির্মাণের বিরোধী হয়ে পড়ে এবং মিনার নির্মাণ নিষিদ্ধ হয়।

কিন্তু পরবর্তীতে ইসলাম পাশ্চাত্যে পূর্বের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠে। ফলে এক পর্যায়ে তিনি ইসলামের যৌক্তিক শিক্ষাগুলো ও পবিত্র কুরআন নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন এবং ইসলামের অকাট্য যুক্তি ও বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এভাবেই সুইজারল্যান্ডে ইসলাম-বিদ্বেষী আন্দোলনের প্রধান নেতা সুইস রাজনীতিবিদ ড্যানিয়েল স্ট্রিচ নিজেই ইসলাম গ্রহণ করেন।

ড্যানিয়েল স্ট্রিচ এখন একজন সামরিক প্রশিক্ষক এবং পৌরসভার সদস্য ও প্রতিশ্রুতিশীল মুসলিম। তিনি নিয়মিত মসজিদে যাতায়াত করেন, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করেন ও কুরআন অধ্যয়ন করেন। ইসলাম গ্রহণের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘ইসলাম জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর যৌক্তিক জবাব দেয়, যা আমি কখনও খ্রিস্টধর্মে খুঁজে পাইনি। আমি ইসলামের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছি জীবনের বাস্তবতা।’

ড্যানিয়েল স্ট্রিচড্যানিয়েল স্ট্রিচ এখন তার অতীতের কাজের জন্য লজ্জিত। তিনি সুইজারল্যান্ডে ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছেন। দেশটিতে এখন ৪টি মসজিদ সক্রিয় রয়েছে। ড্যানিয়েলের স্বপ্নের মসজিদটি নির্মিত হলে সুইজারল্যান্ডে মসজিদের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫টিতে। তিনি দেশটিতে ইসলাম বিরোধী যে তৎপরতা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এভাবেই তার ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। ড্যানিয়েল এখন ধর্মীয় স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আন্দোলন গড়ে তোলারও চেষ্টা করছেন।

‘ওপিআই’ নামের একটি ইসলামী সংস্থার প্রধান আবদুল মজিদ আদলি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ইউরোপের জনগণ ইসলাম সম্পর্কে জানতে ব্যাপকভাবে আগ্রহী। তাদের অনেকেই সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করতে চান। ঠিক যেভাবে সুইজারল্যান্ডের ড্যানিয়েল এ পথে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি ইসলামের মোকাবেলা করতে গিয়ে পবিত্র কুরআনের সঙ্গে পরিচিত হন এবং ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক পড়াশুনা শুরু করেন। তিনি চেয়েছিলেন ইসলামের সঙ্গে খুব কঠোর আচরণ করবেন। কিন্তু এর ফল হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত।’

ড্যানিয়েল বলেন, ‘মহান ধর্ম ইসলামের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, যারাই এর মোকাবেলা করতে চায় তাদেরকে এই পবিত্র ধর্ম চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার মাধ্যমে এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানায়। ফলে ইসলামের খুঁত বের করার চেষ্টা করতে গিয়ে তারা— এ যে খাঁটি আল্লাহ প্রদত্ত ধর্ম, তা উপলব্ধি করতে পারেন। কারণ ইসলাম মানুষের প্রকৃতির চাহিদার আলোকে প্রণীত হয়েছে। সত্য অনুসন্ধানের ইচ্ছা নিয়ে যারাই ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা করেন তারা এই আসমানী ধর্মের সত্যতা অস্বীকার করতে পারেন না।

বিশিষ্ট ব্রিটিশ গবেষক জন ডেভেনপোর্ট বলেছেন, ‘কুরআন ভুল-ত্রুটিমুক্ত হওয়ায় এতে কোন ছোটখাট সংশোধনেরও দরকার নেই। তাই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কুরআন পড়ার পরও সামান্যতম বিরক্তিও সৃষ্টি হবে না কারো মধ্যে। বছরের পর বছর ধরে পাদ্রীরা আমাদেরকে পবিত্র কুরআনের বাস্তবতা ও মহত্ত্ব থেকে দূরে রেখেছেন।

কিন্তু আমরা যতই জ্ঞানের পথে এগুচ্ছি ততই অজ্ঞতা ও অযৌক্তিক গোঁড়ামির পর্দা মুছে যাচ্ছে। শিগগিরই এ মহাগ্রন্থ, যার প্রশংসা ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য কারো নেই। বিশ্বকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করবে এবং বিশ্বের উপর গভীর প্রভাব ফেলবে ও শেষ পর্যন্ত বিশ্বের মানুষের চিন্তা-চেতনার প্রধান অক্ষে পরিণত হবে।’

তথ্য সুত্র–

১। https://islamhashtag.com/dr-gary-miller-islam-christianity/

২। http://www.usislam.org/converts/drgary.htm

রামাদানের প্রস্তুতি – জেনে নিন প্রয়োজনীয় ৮ টি সহজ টিপ্‌স

আপনি কি কখনো বিস্মিত হয়েছেন যে, রামাদানে বা হজ্জের সময় ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় কেন সালাতে মনোযোগ দিতে কষ্ট হয় কিংবা কেন আমাদের ঈমান দুর্বল থাকে? এর কারণ হতে পারে, সচরাচর আমরা সাধারণত একটি ফোনালাপের পরপরই তাকবীরে চলে যাই কিংবা অন্য আর সবার মতোই আমরা আমাদের চারপাশের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হই, যা আমাদের প্রকৃত অনুভূতি নয়।

আমাদের অনেকেই খুব সাধারণ জীবন যাপন করি, আর অনেক ক্ষেত্রে আমাদের ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি নির্ভর করে আসন্ন কোন ঘটনার উপর, উদাহরণস্বরূপঃ ‘রামাদান শুরু হলেই আমি প্রতিদিন এক পাতা কুর’আন তিলাওয়াত করবো; হজ্জ থেকে ফিরেই আমি প্রতি রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করবো; আমার সন্তান জন্মলাভ করলেই আমি ধুমপান ছেড়ে দিব।’ আর এ ধরনের চিন্তাভাবনার কারণেই সাধারণত আমাদের প্রাপ্ত ফলাফল হয় সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা ধুমপান ছাড়তে পারি না, নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করতে পারি না, আর কুর’আন তিলাওয়াত শুরু করলেও কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ পর আমরা আবার আমাদের আগের অবস্থায় ফিরে যাই।

কারণ, আমাদের এই ‘সংকল্প’ কিংবা ‘অনুভূতিগুলো’ আবেগ কিংবা ঝোকের কারণে সৃষ্ট; প্রকৃত চিন্তাভাবনার ফসল নয়। সাধারণত রামাদান কিংবা হজ্জের জন্য আমাদের কোন প্রস্তুতি থাকে না, যা আমাদের ঈমানকে বৃদ্ধি করতে পারে; অন্য সবাই যা করে আমরাও তা করি এবং আশা করি আমাদের ঈমান বেড়ে যাবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এমন কিছু ঘটে না।

আপনি কি চান না আপনার রামাদান শুরু হোক অত্যন্ত ভালোভাবে এবং রামাদানের এই সুন্দর প্রভাব স্থায়ীভাবে বিরাজ করুক আপনার জীবনে? তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব? আসুন জেনে নেই…

নিম্নে ৮ টি ধাপ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো যা ইনশা আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করবে রামাদানের একটি স্থায়ী ফলাফল পেতে।

ধাপঃ ১ – একটি রমাদান ‘কাউন্ট ডাউন’ তৈরি করুনঃ রামাদানের দিন গণনা (মনে মনে কিংবা ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে) আপনার মনে এবং আপনার চারপাশে থাকা মানুষদের মাঝে সৃষ্টি করবে এক উম্মাদনা এবং গুঞ্জন। যখন আপনি এবং আপনার বন্ধুরা একই কর্মসূচীর জন্য দিন গুণতে থাকবেন তখন তা আপনাদের প্রতিদিনকার কথাবার্তা ও আনন্দ ভাগাভাগির অংশে পরিণত হবে।

ধাপঃ ২ – রামাদান সম্পর্কে জ্ঞান অন্বেষণ করুনঃ এটা আপনাকে রামাদানের ইবাদাতসমূহ সঠিক ও পূর্ণভাবে পালনের নিশ্চয়তা দিবে এবং আপনার মাঝে রামাদানের অনুপ্রেরণামূলক দিক ও কাজগুলো সম্পর্কে এক উম্মাদনার সৃষ্টি করবে। রামাদান সম্পর্কে আপনি যতো বেশি জানবেন ততো বেশি ইবাদাত করে আপনার প্রতিদানকে বহুগুণে বাড়িয়ে নিতে পারবেন।

ধাপঃ ৩ – রামাদানের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করুনঃ হতে পারে এটা সম্পূর্ণ কুর’আন খতম দেয়া, নিয়মিত তারাওয়ীর সালাত আদায় করা কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের ইফতারে আমন্ত্রণ করা; প্রথমে এই রামাদানে আপনি কোন ইবাদাতগুলো করতে চান তার একটি তালিকা তৈরি করুন, তারপর পরিকল্পনা করুন সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, আপনার পরিকল্পনাগুলো যেন বাস্তবসম্মত হয় এবং সেগুলো যাতে আপনার স্বাভাবিক জীবন-যাত্রায় কোন ব্যাঘাত না ঘটায় (উদাহরণস্বরূপ, এমন কোন পরিকল্পনা না করা যাতে আপনাকে পুরো এক মাস ছুটি নিতে হয় কিংবা কাজের সময় পরিবর্তন করতে হয়), তাহলে রামাদানের পরেও আপনি এই ইবাদাতগুলো চালিয়ে যেতে পারবেন ইনশা আল্লাহ। এই রামাদানে আপনি কী অর্জন করতে চান তা জানা থাকলে লক্ষ্য পূরণের ব্যাপারে আপনি অবিচল থাকতে পারবেন। রামাদানে প্রতিদিন রাতে পরবর্তী দিনের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করুন (চেষ্টা করুন রামাদানের পরেও এই অভ্যাসটি চালিয়ে যেতে)।

ধাপঃ ৪ – নিজের জীবন সম্পর্কে সচেতন হোনঃ রামাদানে কিংবা রামাদানের পরপরই ঘটতে পারে এমন কোন বিষয়ের ব্যাপারে সচেতন হোন। রামাদানের মধ্যে কি আপনার পরীক্ষা আছে? কিংবা রামাদানের পরপরই কোন বিয়ের অনুষ্ঠান? অথবা বাসা বদলানো? যদি এ ধরনের কোন কর্মসূচী থেকে থাকে তবে এখন থেকেই সেগুলোর ব্যাপারে পরিকল্পনা করুন। এখন থেকেই পড়তে থাকুন, তাহলে রামাদান শুরুর আগেই আপনার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ। সবকিছু গুছিয়ে নিন এবং রামাদান শুরুর আগে কিংবা পরে বাসা বদলানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করুন, যাতে তা আপনার ইবাদাতের সময় কেড়ে না নেয়। সর্বশেষ আপনার যে কাজটি করার সম্ভাবনা আছে তা হলো রামাদানে শপিং সেন্টারে ঘুরে সময় অপচয় করা। তাই ঈদ কিংবা বিয়ের কেনাকাটা রামাদানের আগেই সেরে ফেলুন।

ধাপঃ ৫ – আধ্যাত্মিকভাবে তৈরি হোনঃ আমরা সবাই জানি রামাদান হচ্ছে সিয়াম পালন, সালাত আদায়, কুর’আন তিলাওয়াত এবং সাদাকাহ (দান) করার মাস। রামাদানের ঠিক প্রথম দিনটির জন্য বসে না থেকে এখন থেকেই এই ইবাদাতগুলো করা শুরু করুন। এখন থেকেই নফল সালাত, কুর’আন তিলাওয়াত, মানুষের প্রতি উদারতা প্রদর্শন প্রভৃতি ইবাদাতসহ নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ সমূহ অনুসরণ করার চেষ্টা করুন। আর শাবান মাসে নফল সিয়াম পালনের কথা ভুলবেন না কিন্তু।

ধাপঃ ৬ – আপনার মনকে প্রস্তুত করুনঃ সাওম হচ্ছে আমরা আমাদের মুখের মাধ্যমে যা কিছু গ্রহণ বা বর্জন করি তা থেকে বিরত থাকা। এখন থেকেই সংযমের চেষ্টা করুন, বিশেষ করে আপনার কথোপকথনের ব্যাপারে। পরনিন্দা, পরচর্চা কিংবা সকল প্রকার অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা থেকে বিরত থাকুন।

ধাপঃ ৭ – বদ অভ্যাসগুলোকে বলুন ‘শুভ বিদায়’: নিজের বদ অভ্যাসগুলো চিহ্নিত করুন এবং রামাদানের জন্য বসে না থেকে এখন থেকেই সেগুলো ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করুন। আপনার যদি দেরিতে ঘুমানোর অভ্যাস থাকে, তবে এখন থেকেই তাড়াতাড়ি ঘুমানোর চেষ্টা করুন; আপনি যদি ফেসবুক আসক্ত হোন তবে এখন থেকেই  ফেসবুক কম ব্যবহার করার চেষ্টা করুন; কফির প্রতি খুব দুর্বল? তবে এখন থেকেই তা কমিয়ে আনার চেষ্টা করুন। আমরা সবাই জানি কোন কিছু বলা খুব সহজ কিন্তু করা কঠিন। তবে আপনি যদি একবার শুরু করেন এবং আপনার নিয়্যাহ যদি বিশুদ্ধ থাকে তবে দু’আর মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করুন। ইনশা আল্লাহ আপনি যতটা কষ্ট হবে ভেবেছিলেন তার চেয়ে অনেক সহজেই আপনার বদ অভ্যাসগুলো ছেড়ে দিতে পারবেন।

ধাপঃ ৮ – নিজের জীবনকে ইবাদাতের উপযোগী করে পরিকল্পনা করুনঃ সালাতের সময় কাজ কিংবা মিটিংয়ের আয়োজন না করে অন্য সময় করুন, যাতে সালাতের জন্য আপনার কিছু সময় বিরতি থাকে। আপনি যেখানে সালাত আদায় করেন সেখানে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন এবং দুনিয়ার কথা ভুলে যান, কারণ সালাতের মাধ্যমে আপনি আল্লাহর সামনে  দাঁড়াচ্ছেন।

আশা করি এই ৮ টি ধাপ যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে আপনারা সকলেই রামাদানে সামান্য হলেও উপকৃত হবেন। আর এর বাইরেও যদি আপনাদের কোন ব্যক্তিগত পরিকল্পনা থাকে তবে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন। জাযাক আল্লাহ খাইরান।

মূল লেখকঃ ওয়েসাম কেরায়েম
অনুবাদ কৃতজ্ঞতা – শহীদুল ইসলাম মজুমদার

রাজার দেওয়া বীজ

অনেক অনেক দিন আগে এক দেশে এক রাজা বাস করতো। তার রাজ্যটি ছিলো খুব সুন্দরসুখী ও সমৃদ্ধশালী। কিন্তু একটি ব্যাপারে রাজা ছিলেন কিছুটা চিন্তিত। তিনি প্রায় বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু তখনো পরবর্তী রাজা নির্বাচন করতে পারেননি। নিজের সহকারী কিংবা সন্তান-সন্ততিদের মধ্য থেকে রাজা নির্বাচন না করে তিনি চাইছিলেন নতুন কিছু করতে। তাই একদিন তিনি তার রাজ্যের সকল তরুণ ও যুবকদের একত্রিত করে ঘোষণা করলেন, “বয়সতো আমার অনেক হলো। তাছাড়া পরবর্তী রাজা নির্বাচিত করার সময়ও এসে গেছে। তাই আমি ঠিক করেছি তোমাদের মধ্য থেকেই পরবর্তী রাজা নির্বাচিত করবো।

রাজার কথায় সবাই অবাক হয়ে গেলো! কিন্তু তিনি তার কথা চালিয়ে গেলেন, “আজ আমি তোমাদের সবাইকে একটি করে বীজ দেবো। আর বীজটি এক বিশেষ প্রজাতির। আমি চাই তোমরা এই বীজটি রোপন করে নিয়মিত পানি দাও ও এর পরিচর্যা করো। আর আজকের দিন থেকে ঠিক এক বছর পর তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে বীজ থেকে কে কী উৎপাদন করেছো তা নিয়ে। তারপর তোমাদের আনা গাছগুলো পরীক্ষা করেই আমি ঠিক করবো কে হবে আমাদের পরবর্তী রাজা।”

 

মাহমুদ নামে এক বালকও সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলো। অন্য সবার মতো সেও একটি বীজ পেয়েছিলো। বাড়ি ফিরে গিয়ে সে তার মাকে ঘটনাটির কথা জানালো। তিনি খুব আগ্রহের সাথে মাহমুদকে বীজটি রোপন করার জন্য একটি টব ও অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করে দিলেন। তারপর সে খুব যত্নের সাথে বীজটি রোপন করলো এবং তাতে পানি দিলো। সে নিয়মিত তার যত্ন নিতে থাকলো এবং খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতো কোনো চারা জন্মাচ্ছে কিনা। এভাবে প্রায় তিন সপ্তাহ কেটে গেলো। তারপর কিছু বালক বলাবলি করতে লাগলো তাদের বীজ থেকে চারা গজিয়েছে এবং সেগুলো খুব ভালোভাবে বেড়েও উঠছে।

মাহমুদ নিয়মিত দেখতে লাগলো কিন্তু কোনো চারা গজানোর লক্ষণ সে দেখলো না। তিন সপ্তাহ, চার সপ্তাহ, পাঁচ সপ্তাহ করে এভাবে অনেক দিন কেটে গেলো। কিন্তু কোনো কিছুই ঘটলো না। অন্য সব ছেলেরা তাদের গাছ নিয়ে আলোচনা করতে থাকলো কিন্তু মাহমুদের বীজ থেকে কোনো চারাই জন্মালো না। ছয় মাস পরও মাহমুদের টবটি শুরুতে যেমন ছিলো তেমনই রইলো। তাই সে মনে করতে লাগলো সে তার বীজটি মেরে ফেলেছে।

মাহমুদ ছাড়া সব ছেলের কাছেই একটি করে গাছ ছিলো এবং সেগুলো অনেক বেড়েও উঠেছিলো। তাই মাহমুদ কারো সাথে কথা বলতো না। সবসময় তার বীজ থেকে চারা গজানোর আশায় বসে থাকতো।

এভাবে পুরো এক বছরই কেটে গেলো। তাই রাজ্যের সব ছেলে রাজ দরবারের সামনে উপস্থিত হলো রাজাকে তাদের গাছ দেখানোর জন্য। মাহমুদ তার মাকে বললো সে খালি টব নিয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু তার মা তাকে বুঝালো, “মাহমুদ, এতে লজ্জিত হবার কিছু নেই। কারণ তুমি তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছো। তাই তোমার উচিত রাজার সামনে গিয়ে সত্য কথাটা বলা।”যা ঘটে গেলো তার জন্য কিছুটা লজ্জিত হলেও মাহমুদ বুঝতে পারলো তার মায়ের কথাই ঠিক। সে তার খালি টব নিয়েই রাজ দরবারে গেলো। রাজদরবারে পৌঁছে মাহমুদ অন্যান্য ছেলেদের আনা বিভিন্ন জাতের ও আকারের গাছ দেখে খুব অবাক হলো। সে তার টবটি নিচে রেখে দিলো। কেউ কেউ তাকে দেখে হাসাহসি করতে লাগলো। কেউ কেউ আবার তার চেষ্টার জন্য তাকে সহমর্মিতাও জানালো।


এ গল্পটি পড়ুন- তিনস্তরের ছাঁকনী


উপস্থিত হয়ে রাজা পুরো কক্ষটি ঘুরে দেখলেন এবং সকল বালককে মুবারকবাদ জানালেন। আর মাহমুদ সর্বদা রাজার দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করছিলো। রাজা বলে উঠলেন, “তোমরা সকলেই চমৎকার গাছ ও ফুল উৎপাদন করেছো! আজ তোমাদের মধ্য থেকেই আমাদের পরবর্তী রাজা নির্বাচিত হবে!” তারপর হঠাৎ তিনি মাহমুদ ও তার খালি টবটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন এবং প্রহরীদের বললেন তাকে সামনে নিয়ে আসতে। এতে মাহমুদ খুব ভয় পেয়ে গেলো এবং মনে মনে ভাবতে লাগলো“রাজা জেনে গেছেন আমি ব্যর্থ হয়েছি। হয়তো তিনি আমাকে হত্যার আদেশ দিবেন।”

সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মাহমুদকে রাজা তার নাম জিজ্ঞেস করলো। জবাবে সে বললো, “আমার নাম মাহমুদ।” আর সাথে সাথে সকল ছেলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করলো। রাজা সকলকে চুপ করার নির্দেশ দিলেন। তিনি মাহমুদের দিকে তাকালেন এবং জনতার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন, “তোমাদের নতুন রাজাকে সম্মান দেখাও! তার নাম মাহমুদ!” মাহমুদের যেনো কিছুই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তার বীজ তো অঙ্কুরিতই হয়নি। কিন্তু তারপরও কীভাবে সে রাজা নির্বাচিত হলো? রাজা বললেন, “ঠিক এক বছর আগে আজকের এই দিনে আমি তোমাদের প্রত্যেককেই একটি করে বীজ দিয়েছিলাম। আমি তোমাদের বলেছিলাম বীজটি রোপন করে নিয়মিত পরিচর্যা করতে এবং তা আজ আমার কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু আমি তোমাদের দিয়েছিলাম সিদ্ধ করা বীজ যা থেকে চারা গজাতে পারে না। মাহমুদ ছাড়া তোমরা সকলেই চারা, গাছ কিংবা ফুল নিয়ে এসেছো। যখন তোমরা দেখলে আমার দেয়া বীজটি থেকে চারা গজাচ্ছে না, তোমরা সেটির জায়গায় অন্য আরেকটি বীজ রোপন করলে। একমাত্র মাহমুদই সাহস ও সততার সাথে আমার দেয়া বীজ ও খালি টব নিয়ে এসেছে। আর এ কারণেই সে হবে তোমাদের পরবর্তী রাজা।”

সত্যবাদীতার গুরুত্ব সম্পর্কে নবী করীম (ﷺ) বলেছেনঃ

 

সত্য নেকীর দিকে পরিচালিত করে আর নেকী জান্নাতের দিকে পৌছায়। আর মানুষ সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে অবশেষে সিদ্দীকের দরজা লাভ করে। আর মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যায়, পাপ তাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। আর মানুষ মিথ্যা কথা বলতে বলতে অবশেষে আল্লাহর কাছে মহামিথ্যাবাদী রূপে সাব্যস্ত হয়ে যায়।

[সহীহ বুখারী :: খন্ড ৮ :: অধ্যায় ৭৩ :: হাদিস ১১৬]

ভারতবর্ষের কাগজ

আবু জাফর নদভীঃ আজকাল ভারতবর্ষে যে হারে কাগজ ব্যবহার করা হচ্ছে তা দেখে কেইবা ভাববে এক যুগে এখানে কাগজের প্রচলনই ছিল না। ভারতবর্ষের বেশিরভাগ এলাকায় কাগজের পরিবর্তে অন্যান্য জিনিস ব্যবহার করা হতো। লেখালেখির প্রয়োজন হলে ভুজ পাথর, খেজুরের পাতা, তাল গাছের পাতা, রেশমী কাপড়, তামা ইত্যাদীর উপর লেখা হতো। পাথরের উপর লেখা সম্রাট অশোকের একটি ফরমান এখনো টিকে আছে। মুম্বাই মিউজিয়ামে আছে তামার উপর লেখা একটি পত্র।
এ বিষয়ে ঐতিহাসিকরাও উল্লেখ করেছেন। ইবনে নাদীম লিখেছেন, আরবরা সাধারনত উটের হাড় ও খেজুরের পাতায় লেখালেখি করে। ভারতবর্ষের লোকেরা তামা, পাথর ও সাদা রেশম কাপড়ে লেখালেখি করে। (১)
বেরুনী লিখেছেন, দক্ষিন ভারতে খেজুর ও নারিকেল গাছের মতো উচু এক প্রকারের গাছ দেখা যায়। এই গাছের ফল খাওয়া হয়। এই গাছের পাতা প্রায় এক হাত লম্বা হয়। এই গাছকে তাল গাছ বলা হয়। এই গাছের পাতার উপর লেখা হয়। মধ্য ভারত ও উত্তর ভারতের এলাকাগুলিতে তুজ গাছের ছালের উপর লেখা হয়। (২)
সজন রায় উড়িষ্যা সম্পর্কে লিখেছেন, তালের পাতায় লোহার কলম দিয়ে লেখা হতো। কালি খুব কম ব্যবহার করা হতো।
কাশ্মীর সম্পর্কে লিখেছেন, সাধারণত ভুজ পাথরের উপর লেখা হতো। কাশ্মীরে এটি প্রচুর মিলতো। (৩)
এইসব উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় ভাতবর্ষে কাগজের প্রচলন ছিল না। পাতার উপরই বেশিরভাগ লেখা হত। বেরুনী বলেছেন পাতার উপর অনেক পুথি লেখা হতো। এসব পুথির কিছুকিছু আজো ভারতবর্ষে টিকে আছে। একবার আহমেদাবাদে আমি জৈন ধর্মের একটি পুথি দেখি। এটি লেখা হয়েছে ভুজ পাথরের উপর। মিয়ানমার সফরকালে (৪) রেংগুনের বৌদ্ধ মন্দিরে একটি প্রাচীন পুথি দেখি যা লেখা হয়েছে তাল পাতার উপর।
কাগজের প্রথম প্রবর্তন করেছিল চীনারা। তারা এক প্রকার ঘাস থেকে কাগজ তৈরী করতো। ইবনে নাদীম লিখেছেন, চীনের লোকেরা চীনা কাগজে লেখে। এটি এক প্রকার ঘাস থেকে প্রস্তুত করা হয়। এই কাগজ তাদের আয়ের অন্যতম মাধ্যম। (৫)
শুরুর দিকে অন্যান্য অঞ্চলের লোকেরা এর ব্যবহার সম্পর্কে জানতো না। খ্রিস্টিয় অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমানরা এর ব্যবহার শিখে এবং দ্রুতই বিভিন্ন অঞ্চলে এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। বেরুনী লিখেছেন, মুসলমানরা সমরকন্দ বিজয়কালে যাদেরকে বন্দী করেছিল তাদের কয়েকজন ছিল কাগজ প্রস্তুতকারক। মুসলমানরা তাদের কাছ থেকে কাগজ প্রস্তুতপ্রনালী শিখে নেয় এবং এই শিল্পকে আরো সমৃদ্ধ করে। বেরুনী আরো লিখেন, ভারতবর্ষে গ্রীকদের মতো চামড়ায় লেখার প্রচলন নেই। (৬)
ভারতবর্ষ বিজয়ের আগেই মুসলমানদের মধ্যে কাগজের প্রচলন শুরু হয় এবং তারা বিভিন্ন অঞ্চলে কাগজের কারখানা স্থাপন করে। সম্ভবত খোরসান ও সমরকন্দে সর্বপ্রথম কাগজের কারখানা স্থাপন করা হয়। সেখানে এ জাতীয় ঘাস প্রচুর পাওয়া যেত। ১৩৪ হিজরীতে (৭৫১ খ্রিস্টাব্দ) আরবরা আরো এগিয়ে যায়, তারা তুলা থেকে কাগজ প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়(৭)। হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর শুরুতেই সরকারীভাবে এই কাগজের ব্যবহার শুরু হয় (৮)। ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমন হিজরী প্রথম শতাব্দীর শুরুর দিকেই শুরু হয়।
মুহাম্মদ বিন কাসিম এই শতাব্দীর শেষদিকে (৯৩ হিজরী) সিন্ধু জয় করেন। এই অভিযানে হাজ্জাজের নির্দেশ ছিল প্রতি তিনদিন পরপর তাকে পত্র লিখে সব জানাতে হবে। বালাজুরি লিখেছেন, তিনদিন পর পর হাজ্জাজের সাথে মুহাম্মদ বিন কাসিমের পত্র যোগাযোগ হতো। অভিযানের শুরুতেই হাজ্জাজ এ ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছিলেন (৯)।
এই পত্র কিসে লেখা হতো তা স্পষ্ট নয়। তবে কলকশান্দি লিখেছেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে সাদা পাথর ও খেজুরের ডালে লেখা হতো। পরবর্তীকালে সাহাবীরা পাতলা চামড়ায় লিখতেন। আব্বাসী যুগের শুরু পর্যন্ত এসবেই লেখা হতো। হারুনুর রশিদই প্রথম খলিফা যিনি আদেশ দেন, সরকারী সকল ফরমান কাগজে লিখতে হবে। সেদিন থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কাগজের ব্যাপক প্রচলন হয় (১০)। সম্ভবত সিন্ধু বিজইয়ের সময় পর্যন্ত ভারতবর্ষে কাগজ এসে পৌছেনি। আব্বাসী আমলেই আরবরা সিন্ধু ও আশপাশের এলাকায় কাগজ নিয়ে আসে। হিজরী পঞ্চম শতাব্দির শুরু পর্যন্ত সিন্ধুতে আরবদের শাসন টিকে ছিল। সম্ভবত, এসময় তারা খোরাসান ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা কাগজই ব্যবহার করতো।

হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভারতবর্ষে কাগজ নির্মান শুরু হয়। হামেদ গার্নাতি লিখেছেন, বলখের কাগজ, ইরাক , খোরাসান ও ভারতবর্ষের কাগজের অনুরুপ। (১১)


এটা পড়ুন – হারিয়ে যাওয়া কুতুবখানা


হামেদ গার্নাতি হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীর মানুষ। তার বর্ননা থেকে বুঝা যায় ততদিনে ভারতবর্ষে কাগজ প্রস্তুত শুরু হয়ে যায়। সম্ভবত লাহোর কিংবা দিল্লীতেই এই কাজ শুরু হবে কারন তখন এই দুই শহরই ছিল রাজধানী।
কাশ্মীর: শাহী খান কাশ্মীরের শ্রেষ্ঠ সুলতানদের একজন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। জীবনের শুরুর দিকে তিনি সমরকন্দে অবস্থান করে লেখাপড়া করেন। কাশ্মীর ফিরে আসার সময় তার সাথে অনেক কারিগরকে নিয়ে আসেন। তারীখে কাশ্মীরে গ্রন্থকার লিখেছেন, তিনি কিছুদিন সমরকন্দে অবস্থান করে বিভিন্ন শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেন। ফিরে আসার সময় সাথে করে কাগজ, কার্পেট, জীন নির্মানে দক্ষ একদল শ্রমিক নিয়ে আসেন।
৮২৬ হিজরীতে শাহী খান সিংহাসনে আরোহণ করে সুলতান যাইনুল আবেদিন নাম ধারণ করেন। তারীখে কাশ্মীরের গ্রন্থকার লিখেছেন, সুলতান তার সাথে নিয়ে আসা এইসব শ্রমিকদের জীবিকা নির্বাহের জন্য জায়গির দান করেন (১২)।
সম্ভবত এ সময় কাশ্মীরে কাগজের কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটিই ছিল ভারতবর্ষে স্থাপিত প্রথম কাগজ কারখানা। ইতিহাসের পাতায় এর আগের কোনো কারখানার বিবরণ পাওয়া যায় না।
দ্রুতই এই শিল্পে কাশ্মীর প্রসিদ্ধি অর্জন করে। অন্যান্য অঞ্চলে কাশ্মীরি কাগজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি বাদশাহর পক্ষ থেকে বিশেষভাবে এই কাগজ হাদিয়া পাঠানো হতো। সুলতান যাইনুল আবেদিন তার শাসনকালে গুজরাটের সুলতান মাহমুদ বিগ্রাহ ও খোরাসানের সুলতান আবু সাইদের কাছে কাশ্মীরি কাগজ উপহার পাঠান। খোরাসানে অনেক আগ থেকেই কাগজ প্রস্তুত করা হতো। তবু সুলতান কর্তৃক কাগজ উপহার দেয়ার ঘটনা থেকে বোঝা যায় সেসময় কাশ্মীরি কাগজের মান খোরাসানী কাগজের চেয়ে ভালো ছিল। ঐতিহাসিক আবুল কাসেম ফেরেশতা এই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন এভাবে, খোরসানের শাসক আবু সাইদ সুলতানের কাছে আরবী ঘোড়া ও উন্নত প্রজাতির উট উপহার পাঠান। সুলতান এই উপহারে খুব খুশি হন। তিনি মেশক, জাফরান, আতর ও কাগজ ইত্যাদী মূল্যবান জিনিস উপহার পাঠান (১৩)।
গুজরাট: হিজরী নবম শতাব্দীর শুরুতে গুজরাটের রাজধানী আহমেদাবাদের গোড়াপত্তন হয়। মাত্র পঞ্চাশ বছরে এই শহর এতটাই উন্নতি করে যে পুরো ভারতবর্ষে তখন এর সমকক্ষ দ্বিতীয় কোনো শহর ছিল না। সুলতান মাহমুদ বিগ্রাহ এই শহরের উন্নতির দিকে বিশেষ খেয়াল রেখেছিলেন। তিনি তার পাশে বিভিন্ন শাস্ত্রে দক্ষ ব্যক্তিদের ডেকে নেন। তখন গুজরাটে বেশকিছু কাগজের কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে নানা রংগের কাগজ তৈরী করা হতো। লোকেরা রোজনামচা ও ব্যবসায়িক হিসাব লেখার জন্য রংগিন কাগজ ব্যবহার করতো। যারা কাগজ প্রস্তুত করতো তাদের কাগজি বলা হতো। এভাবে কয়েকটি বংশের নামই কাগজি নামে প্রসিদ্ধ হয়। এখনো এই বংশের লোকদের দেখা মেলে। আহমেদাবাদে এখনো কাগজি মহল্লা নামে একটি মহল্লা আছে, যেখানে কাগজিরা বসবাস করতো। আহমেদাবাদের পীর মুহাম্মদ শাহ লাইব্রেরীতে বেশকিছু পুরনো বই পাওয়া যায় যা আহমেদাবাদে তৈরী কাগজে লেখা। মিরআতে আহমদিতে আহমেদাবাদের কাগজের বৈশিষ্ট্য বিবৃত হয়েছে এভাবে, বিভিন্ন শহরে কাগজ প্রস্তুত হলেও আহমেদাবাদের কাগজের শুভ্রতা ও উজ্জ্বলতা একে দিয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য (১৪)।
তবে এই কাগজের একটি দুর্বলতা ছিল। মিরআতে আহমদির লেখক লিখেছেন, আহমেদাবাদ যেহেতু মরু অঞ্চল তাই প্রায়ই কাগজ তৈরীর সময় বালু উড়ে মিশ্রণে পড়তো। শুকানোর পর এই বালুকনাগুলা ছোট ছোট লাল ফুটকির মতো দেখা যেত। এই কাগজের এটিই একটি দুর্বলতা (১৫)।
তবে এই দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও এই কাগজ আরব ও রোমে রফতানি করা হতো। মিরআতে আহমদির ভাষ্যমতে, প্রতিবছর হাজার রুপির এই কাগজ আরব ও রোমে পাঠিয়ে ব্যবসায়িরা অনেক লাভ করতো (১৬)।
দৌলতাবাদ: মুঘল আমলে ওখানে প্রস্তুতকৃত কাগজের বেশ সুনাম ছিল। এখানকার কাগজ পুরো দক্ষিণ ভারতে সরবরাহ করা হতো (১৭)
বিহার: বিহারের রাজধানী আজিমাবাদে (পাটনা) অনেকগুলো কাগজের কারখানা ছিল। সজন রায় বিহারের আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, পাটনায় খুব উন্নতমানের কাগজ প্রস্তুত হতো (১৮)।
আমার ব্যক্তিগত মত হলো, পাটনায় কাগজ তৈরী হতো না। এর কিছু দূরে যে এলাকা আছে, যাকে আজও কাগজি মহল্লা বলা হয়, সেখানেই কাগজ প্রস্তুত হতো। সে এলাকার বাসিন্দাদের এখনো কাগজি বলা হয়। যেহেতু পাটনা থেকে এই কাগজের বিপণন ও সরবরাহ হতো তাই হয়তো এই কাগজকে পাটনার দিকে সম্পর্কযুক্ত করা হয়।
গয়া: এখানেও বেশকিছু কাগজের কারখানা ছিল। গোলাম হোসেন খান তবতবায়ি এসব কারখানার কথা লিখেছেন (১৯)।
বাংলা: মুর্শিদাবাদ ও হুগলি অঞ্চলে প্রচুর কাগজ তৈরী করা হতো। এসব এলাকায় অনেককে কাগজি বলে ডাকা হতো।
জৌনপুর: আউধের যফরাবাদ গ্রামে অনেক কাগজি বসবাস করতেন। এখানকার বাশের তৈরী কাগজের খুব সুনাম ছিল। এখানেও কাগজি মহল্লা নামে একটি এলাকা আছে (২০)
পাঞ্জাব: পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে কয়েকটি কাগজের কারখানা ছিল। এখানকার কাগজ হতো ধবধবে সাদা ও শক্ত। পুরো পাঞ্জাবে এই কাগজ ব্যবহার করা হতো। সজন রায় লিখেছেন, এখানকার কাগজ খুবই ভালো। বিশেষ করে মান সিংগি, নিম হারিরি ও জাহাংগিরি কাগজের সুনাম সর্বত্র। এসব কাগজ খুবই সাদা ও শক্ত হতো (২১)।
এখানে নিম হারিরি কাপড় সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। রেশম কাপড়ের সাথে তুলা মিলিয়ে এই কাগজ তৈরী করা হতো। এই কাগজগুলো নরম ও শক্ত হতো।
এইসব কাগজের নমুনা এখন খুজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। সৌভাগ্যক্রমে নবাব সদরে ইয়ার জং হাবিবুর রহমান খান শেরওয়ানির ব্যক্তিগত কুতুবখানায় (কুতুবখানা হাবিবগঞ্জে) এসব কাগজের অনেক নমুনা সংরক্ষন করা আছে। নবাব সাহেব অত্যন্ত যত্নের সাথে প্রাচীন এসব বইপত্র সংগ্রহ করে সংরক্ষন করেছেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছে এই কুতুবখানা ঘুরে বিভিন্ন প্রকারের কাগজ দেখার। আহমেদাবাদী কাগজগুলো সাধারণত একটু মোটা। সোনালী রংগের বেশকিছু কাগজ দেখেছি। এই কাগজগুলো খুবই শুভ্র। এই কাগজের বৈশিষ্ট্যই এটি। হাবিবগঞ্জের কুতুবখানায় কাশ্মীরি কাগজে লিখিত কিছু বই দেখেছি। এই কাগজগুলোও খুব মজবুত।
শিয়ালকোটে তৈরী হতো জাহাংগিরী কাগজ, সম্রাট জাহাংগিরের নামে যার নামকরন। এই কাগজগুলো শুভ্র, নরম। কুতুবশাহী শাসনামলে হায়দারাবাদে যে কাগজ প্রস্তুত হতো তাও কয়েক রংগের হতো। ইতিহাসের কোনো বইতে ফয়েজাবাদের কাগজের উল্লেখ না পেলেও কুতুবখানা হাবিবগঞ্জে এই কাগজের একটি নমুনা আছে। কানপুরি কাগজ ছিল সাধারন মানের। এটি হতো খাকি রংগের। দৌলতাবাদে কয়েক প্রকারের কাগজ তৈরী হতো। ৯৩৯ হিজরীতে বাহাদুর শাহ যখন দৌলতাবাদ দখল করেন তখন থেকে তার নামে এক প্রকার কাগজ তৈরী করা হতে থাকে। এই কাগজের নাম ছিল বাহাদুরখানি। এছাড়া সাহেবখানি ও মুরাদশাহী নামে দুই প্রকার কাগজ তৈরী হতো সেখানে। বালাপুরি নামে এক প্রকার কাগজ তৈরী হতো যা ছিল হালকা সাদা। কাসেম বেগি নামক এক প্রকার কাগজ আছে। এটির নামকরন করা হয় এর নির্মাতার নামানুসারে। রুবকারী নামক কাগজে লেখা কিছু ফরমান দেখেছি। তবে এই কাগজ কোথায় প্রস্তুত হত তা জানা যায়নি। শরবতি নামে আরেকপ্রাকার কাগজ দেখেছি যা অন্যদের তুলনায় সাদামাটা।
=================
অনুবাদক — ইমরান রাইহান
টীকা
১। আল ফিহরিস্ত, ৩২ পৃষ্ঠা, মিসর।
২। কিতাবুল হিন্দ, ৮১ পৃষ্ঠা, লন্ডন।
৩। খুলাসাতুত তাওয়ারিখ, দারুল মুসান্নেফিন , আযমগড়।
৪। এই সফর নিয়ে লেখক একটি বই লিখেছেন, সফরনামায়ে বার্মা। অত্যন্ত তথ্যবহুল বই। –অনুবাদক।
৫। আল ফিহরিস্ত, ৩২ পৃষ্ঠা, মিসর।
৬। কিতাবুল হিন্দ, ৮১ পৃষ্ঠা, লন্ডন।
৭। এনসাইক্লোপেডিয়া, ২০শ খন্ড, ২৫ পৃষ্ঠা।
৮। সুবহুল আ’শা, ২য় খন্ড, ৪০৫ পৃষ্ঠা।
৯। ফুতুহুল বুলদান, ১৪২ পৃষ্ঠা, মিসর।
১০। সুবহুল আ’শা, ২য় খন্ড, ৪৭৫ পৃষ্ঠা।
১১। তুহফাতুল আলবাব, ২০২ পৃষ্ঠা।
১২। ওয়াকেয়াতে কাশ্মীর, কুতুবখানা হাবিবগঞ্জ, আলীগড়।
১৩। তারিখে ফেরেশতা, ২য় খন্ড, ৩৪৪ পৃষ্ঠা, নওল কিশোর প্রেস।
১৪। মিরআতে আহমদি, ১৮ পৃষ্ঠা, বোম্বাই।
১৫। প্রাগুক্ত।
১৬। প্রাগুক্ত।
১৭। মামলাকাতে বিজাপুর, ৩য় খন্ড, ২৯১ পৃষ্ঠা।
১৮। খুলাসাতুত তাওয়ারিখ, বিহার জেলার আলোচনা, দারুল মুসান্নেফিন। ১৯। সিয়ারুল মুতাআক্ষেরিন, ১ম খন্ড, ১৯ পৃষ্ঠা, নওল কিশোর প্রেস।
২০। আলীগড় ইউনিভার্সিটির সাবেক নাযেমে দ্বীনিয়াত মাওলানা আবু বকর শিস জৌনপুরী আমাকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। –লেখক।
২১। খুলাসাতুত তাওয়ারিখ, ভূমিকা, দারুল মুসান্নেফিন।

ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থনীতি

ভূমিকা: ব্যাংকিংয়ের ইতিহাস:

প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষ একে অপরের সাথে বিভিন্ন সম্পদের বিনিময় করে আসছে। একজনের পণ্য অপরজনের পণ্যের বিনিময়ে আদান-প্রদান করে আসছে। তবে পণ্য দিয়ে পণ্য বিনিময় অনেক সময়ই কঠিন হয়ে যায়। সব পণ্যের জন্য সবসময় বিনিময়যোগ্য পণ্য খুঁজে পাওয়া সহজ নয়।

অপরদিকে সমাজের একটি শ্রেণীর কাছে প্রয়োজনের তুলনায় সম্পদ বেশি থাকে, আরেকটি শ্রেণীর কাছে কম থাকে। সম্পদশালী শ্রেণীটি একই সাথে বিশ্বস্ত হওয়ায়, মানুষও তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় তাদের কাছে জমা রাখতে শুরু করে। কখনো কখনো সঞ্চয় থেকে সম্পদ ওঠানোর প্রয়োজন হলে, সম্পদশালী শ্রেণীটি তাদেরকে সম্পদ দেয়ার পরিবর্তে সম্পদের জমা রশিদ হস্তান্তর করে। জমা রশিদটি যে-ই জমা দেবে, সম্পদটি তার কাছেই হস্তান্তর করা হবে, উদ্দেশ্য ছিল এমন। এই জমা রশিদই পরবর্তীকালে কাগুজে নোট হিসেবে প্রচলন পায়।

ওদিকে সম্পদশালী বিশ্বস্ত শ্রেণীটি তাদের কাছে জমাকৃত মূল সম্পদ অলস ফেলে না রেখে সেগুলো বিভিন্ন উদ্যোক্তা ও চাহিদাসম্পন্ন মানুষের কাছে ঋণ দিতে শুরু করে। ঋণগ্রহীতারা তা দিয়ে ব্যবসা করে উদ্ভূত মুনাফা থেকে ঋণের ওপর একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করতে শুরু করে। সম্পদশালী শ্রেণীটি সে সুদ থেকে নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি সম্পদ জমাকারীদেরও একটি অংশ দিতে শুরু করে।

একটা পর্যায়ে সেই সম্পদশালী শ্রেণীটির মূল কাজ হয়, সমাজের এক শ্রেণীর সম্পদ জমা রেখে তার বিনিময়ে কাগুজে রশিদ লিখে দেয়া, এবং জমার বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে সুদ দেয়া। অন্য দিকে অন্য একটি শ্রেণীর কাছে উক্ত সম্পদ সুদের বিনিময়ে ঋণ দেয়া। জমাগ্রহণ ও বিনিয়োগের সুদের হারের তফাৎটাই হয়ে ওঠে উক্ত শ্রেণীটির আয়ের উৎস।

পরবর্তীকালে কাগুজে নোট প্রচলন, সুদের বিনিময়ে জমা গ্রহণ ও সুদের বিনিময়ে বিনিয়োগ –মোটামুটি মৌলিক এই তিনটি কাজকে সুষ্ঠুভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিকে আঞ্জাম দিতে ব্যাংক ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। এজন্যই অনেকে মনে করেন, ব্যাংক হলো এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যার প্রধান কাজই হলো ধার করা অর্থ অন্যকে ধার দেয়া।

ব্যাংকিং কার্যক্রমসমূহ তথা জমা গ্রহণ, ঋণ প্রদান, সম্পদ স্থানান্তর ইত্যাদি বহু আগেই শুরু হলেও ব্যাংকিংয়ে আধুনিক যুগের প্রবর্তন ১৪০১ খৃষ্টাব্দে ব্যাংক অব বার্সেলোনা প্রতিষ্ঠার পর থেকে। ১৬৯৪ সালে বিশ্বের প্রথম কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘দি ব্যাংক অব ইংল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ভারতীয় উপমহাদেশে ‘হিন্দুস্তান ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবেই ব্যাংকের আধুনিকায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। ১৭৮৫ সালে ‘দি সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ সালে সরকারী আইনবলে ভারতের প্রথম সুগঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে ‘দি রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে ‘স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান’ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে কাজ আরম্ভ করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান’ –এর ঢাকাস্থ শাখাটিকে এক বিশেষ আইনবলে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ নামে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা করা হয়। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থা গতিময় হয়। [১]

 

ব্যাংকিং ও রিবা:

আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থার সাথে সুদের সম্পর্কে অত্যন্ত গভীর। সুদ ছাড়া ব্যাংকিং ব্যবস্থা যেন কল্পনাই করা যায় না। অথচ ইসলাম সুদ বা রিবাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। আল-কুরআনে আছে:

الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا فَمَن جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّهِ فَانتَهَىٰ فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ وَمَنْ عَادَ فَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ﴿البقرة: ٢٧٥﴾ يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ ﴿البقرة: ٢٧٦﴾

যারা সুদ খায়তারা কিয়ামতে দণ্ডায়মান হবেযেভাবে দণ্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তিযাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যেতারা বলেছে: ক্রয়-বিক্রয় ও তো সুদ নেয়ারই মত! অথচ আল্লাহ তাআলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছেপূর্বে যা হয়ে গেছেতা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়তারাই দোযখে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে। [২:২৭৫] আল্লাহ তাআলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে। [২:২৭৬]

 

রিবা নিষিদ্ধের কারণ হিসেবে আল-কুরআনে যেসব বিষয় উল্লেখ হয়েছে:

১. রিবা সমাজকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অসৎ করে তোলে। সূরা রোমের ৩৭-৪১ নং আয়াতসমূহে তা স্পষ্ট।

২. রিবা অন্যায়ভাবে একজনের সম্পদ আরেকজনকে দেয়। সূরা নিসার ১৬০-১৬১ আয়াতদ্বয়ে তা উল্লেখ করা হয়েছে।

৩. রিবা সম্পদে পতনোন্মুখ বৃদ্ধি ঘটায়। সূরা বাক্বারার ২৭৬ নং আয়াতটিতে তা বুঝা যায়।

৪. রিবা মানুষের ব্যক্তিত্বকে খর্ব করে। সূরা বাক্বারার ২৭৫ নং আয়াতে তা স্পষ্ট।

৫. রিবা একটি জুলুম ও অন্যায়, ইনসাফপরিপন্থী। সূরা বাক্বারার ২৭৯ নং আয়াতে সে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। [২]

 

রিবা ছাড়াও ইসলামী অর্থনীতি আরো বেশ কিছু বিষয় নিষিদ্ধ করে। যেমন:

১. গারার বা চুক্তিতে যে কোনো অনিশ্চয়তা বা ঘাপলা থাকা। যেমন, চুক্তির কোনো একটি বিনিময়ের অস্তিত্বই নেই, বা কোনো বিনিময়ের ব্যাপারে তথ্য অপূর্ণ থাকা, বা একাধিক চুক্তিকে মিলিয়ে বা অনাকাঙ্ক্ষিত শর্ত দিয়ে চুক্তিকে জটিল করে তোলা ইত্যাদি।

২. ক্বিমার বা জুয়া, যেখানে পুরো বিষয়টি সম্পূর্ণ ঝুঁকি নির্ভর। এবং একপক্ষের সম্পূর্ণ ক্ষতির বিনিময়ে অপরপক্ষ সম্পূর্ণ লাভবান হন।

৩. এমন খাতে বিনিয়োগ যেগুলো শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে নিষিদ্ধ। বা সামাজিক ও চারিত্রিকভাবে দূষণীয়। যেমন, সুদ, শুকর, অশ্লীলতা, জুয়া, মাদক, বিবাহবহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক ইত্যাদি।

এছাড়া একচেটিয়া ব্যবসা, সমাজের জন্য ক্ষতিকর গুদামজাত ইত্যাদিও ইসলাম নিষিদ্ধ করে। বিপরীতে জাকাতের প্রচলন ও সমাজের কল্যাণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে ইসলাম নির্দেশ দেয়।

 

দর্শনগত দিক থেকেও ইসলামী অর্থনীতি ভিন্ন। অর্থনীতির তিনটি মৌলিক প্রশ্নে ইসলামের উত্তর অন্যসব প্রচলিত মতবাদের মতো নয়। কী উৎপাদন করা হবে, কীভাবে উৎপাদন করা হবে এবং কার জন্য উৎপাদন করা হবে – অর্থাৎ উৎপাদনগত সিদ্ধান্ত, ব্যবস্থাপনাগত সিদ্ধান্ত ও বন্টনগত সিদ্ধান্তেও ইসলামের দৃষ্টিকোণ ভিন্ন।

ইসলাম মনে করে মানুষের মৌলিক চাহিদা পাঁচটি বিষয়ের সুরক্ষা করা। এই পাঁচটি বিষয় যথাক্রমে: ধর্ম-দ্বীন ইসলাম, প্রাণ, মেধা-বুদ্ধি, বংশ ও সম্পদ। এই পাঁচটি বিষয় সুরক্ষায় যা না হলেই নয়, তা হলো অত্যাবশ্যক প্রয়োজন বা জারুরাহ। যা হলে একটু উন্নত হয়, তা স্বাভাবিক প্রয়োজন বা হাজাহ। আর যা হলে আরো উন্নত ও সুবিধাজনক হয়, তা উন্নতিসাধক বা তাহসীনিয়্যাহ।

যেমন, একটি ফাঁকা জায়গা। এতে মোটামুটি দেয়াল তোলা, দরজা-জানালা, পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হলো জারুরাহ। প্লাস্টার করা, ফ্লোর ফিনিসিং দেয়া হলো হাজাহ। আর রং করা, এসি লাগানো ইত্যাদি হলো তাহসিনিয়্যাহ।

জারুরাহ, হাজাহ বা তাহসীনিয়্যাহ – ব্যক্তি ও সমাজের ভিন্নতায় ভিন্ন হতে পারে। তবে মৌলিক বিষয়টা একই। ইসলাম ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কার্যকরণ নির্ধারণে এ ধারাক্রম অনুসরণের পরামর্শ দেয়। অনুরূপভাবে মৌলিক চাহিদার পাঁচটি বিষয়ের জন্য ক্ষতিকারক কোনো কিছুর অনুমতি ইসলাম দেয় না।

কাজেই একজন মুসলিম হিসেবে ইসলামী অর্থনীতি চর্চার বিকল্প নেই। ব্যাংক ব্যবস্থার উদ্ভব যেহেতু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল করার লক্ষ্যেই, তাই ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।

 

ইসলামী ব্যাংকিং – ইতিহাস ও অগ্রযাত্রা:

রাসূলুল্লাহ স. এঁর আগমনের মধ্য দিয়ে আরবে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। জাহিলিয়্যাতের নানা প্রথা ও অন্যায় ত্যাগ করে ইসলাম নামক ইনসাফের ছায়াতলে আসে মানুষ।

রাসূলুল্লাহ স. শৈশব হতেই আল-আমীন বলে পরিচিত ছিলেন। মানুষ তাঁর কাছে সম্পদ জমা রাখত, এবং প্রয়োজনে উঠিয়ে নিয়ে যেত। রাসূল স. নিজে বিবাহপূর্ব সময়ে উম্মুল মু’মিনীন খাদিজা রা. এঁর সম্পদ মুদারাবার ভিত্তিতে গ্রহণ করেন এবং তা দিয়ে বিশ্বস্ততার সাথে ব্যবসা করে বিপুল মুনাফাসহ মূলধন ফিরিয়ে দেন।

আরবদের মাঝে মুদারাবা ছাড়াও মূলধনভিত্তিক অংশীদারি ব্যবসা প্রচলিত ছিল। রাসূল স. বাইয়ে সালামের অনুমোদন দেন, যা মূলত পণ্য বাকীতে প্রদানের একটি চুক্তি। তো, এ সবকিছুই ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিভিন্ন কার্যাবলীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চর্চা ছিল।

সাহাবীদের যুগে হযরত যুবাইর বিন আওয়াম রা. এঁর কথা উল্লেখযোগ্য। মানুষ তাঁর কাছে অর্থ জমা রাখত। তিনি আমানত হিসেবে সেগুলো না নিয়ে ঋণ হিসেবে নিতেন, ফলে সেগুলো বিনিয়োগের সুযোগ থাকত। আবার প্রয়োজনে জমাকারীরা তা উত্তোলন করতে পারতেন। ইবনে আব্বাস রা. ও দিরহাম জমা গ্রহণ করে কুফায় তা ভাঙানোর স্বীকারপত্র লিখে দিতেন।

ইসলামের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রায় হাজার বছর ধরে ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে মুসলিমদের নেতৃত্ব অব্যাহত ছিল। ইমাম আবু ইউসুফ, মুহাম্মদ আশ শাইবানী, আবু উবায়দ কাসিম ইবনে সাল্লাম, ইমাম গাযযালী, ইবনে তাইমিয়্যাহ, ইবনে খালদুন ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. এঁর অর্থনৈতিক চিন্তা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। [৩]

আধুনিককালে ষাটের দশকে মুসলিম দেশগুলোর তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় মুসলিমদের হাতে প্রচুর ধনসম্পদ চলে আসে। তারা তাদের সম্পদ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইসলামের আলোকে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের কথা ভাবেন। এছাড়া শত শত বছরের উপনিবেশবাদ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম দেশগুলো ইসলামের আলোকে ভিন্ন অর্থনৈতিক চিন্তা শুরু করে। সত্তরের দশক থেকে মোটামুটি ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে থাকে।

 

এক নজরে ইসলামী ব্যাংকিং বিকাশের ইতিহাস:

  • ষাটের দশক: ১৯৬৩: মিট গামার লোকাল সেভিংস ব্যাংক, মিশর; মুসলিম পিলগ্রিমস সেভিং কর্পোরেশন, মালয়েশিয়া।
  • সত্তরের দশক: ১৯৭১: নাসের সোশাল ব্যাংক, মিশর। ১৯৭৫: ইসলামিক ডেলেভপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), জেদ্দা; দুবাই ইসলামী ব্যাংক, দুবাই। ১৯৭৭: ফয়সাল ইসলামী ব্যাংক, সুদান। ১৯৭৯: বাহরাইন ইসলামী ব্যাংক, বাহরাইন।
  • আশির দশক: ১৯৮২: আল বারাকা। ১৯৮৩: ব্যাংক ইসলাম মালয়েশিয়া; ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ; কাতার ইসলামী ব্যাংক। ১৯৮৪: দারুল মাল ইসলামিক ট্রাস্ট, জেনেভা। ১৯৮৯: এ.এন.জি গ্লোবাল ইসলামিক ফাইন্যান্স, ইউকে।
  • নব্বইয়ের দশক: ১৯৯১: বাহরাইনভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন মানদণ্ড (শরীয়াহ, হিসাব ও নিরীক্ষা) প্রণয়নকারী অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘আওফি’ প্রতিষ্ঠা।  ১৯৯৩: ইসলামিক ব্যাংক অব ব্রুনেই।
  • সমকালীন: ২০০৩: ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনকেন্দ্রিক মানদণ্ড প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান ‘ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বোর্ড (আই.এফ.এস.বি)’, মালয়েশিয়া। ২০০৬: ইসলামী অর্থনীতির আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইনসেইফ’। [৪]

এছাড়া ১৯৭৮ সনে পাকিস্তান ও ১৯৭৯ সনে ইরান তাদের সমগ্র ব্যাংকব্যবস্থাকে ইসলামীকরণের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। [৫]

মুসলিম দেশগুলোর পাশাপাশি বর্তমানে অনেক অমুসলিম দেশও ইসলামী ব্যাংকিয়ের দিকে যাচ্ছে। বিশেষ করে ২০০৭-০৮ এর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দায় ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের স্থিতাবস্থা তাদেরকে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে উদ্বুদ্ধ করছে।

বর্তমানে ইসলামিক ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিশ্বব্যাপী মোট বাজার প্রায় ১.৫ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার। [৬] ২০১১ তে তা ছিল মাত্র ১.০৮৬ ট্রিলিয়ন ডলারের। ২০১৪ –র শেষ নাগাদ তা ১.৮ ট্রিলিয়নে পৌঁছুবে বলে আশা করা যায়। বাৎসরিক বৃদ্ধির হার প্রায় ৩০ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৭৫টি দেশে হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান ইসলামী অর্থ ব্যবস্থাপনার কাজ করছে। [৭]

২০১০ এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ইউকে, জার্মানি, ফ্রান্স, মাল্টা, জাপান, সিঙ্গাপুর, হংকং ও সাউথ কোরিয়া ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার অনুকূলে প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে, বা করেছে। তন্মধ্যে কোনো কোনো দেশ ইতোমধ্যে ইসলামী ব্যাংকিং শুরু করেছে। কোনোটি আইন পাশ করেছে। [৮]

 

এক নজরে ২০১৩ তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামিক ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা:

  • মালদিভস: ছোট দেশ। জনসংখ্যা চার লাখের কিছু বেশি। মুসলিম ৯৮.৪৪%। ২.৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠা পায় মালদিভস ইসলামী ব্যাংক। প্রথম সুকুক (বন্ডের শরয়ী বিকল্প) ইস্যু হওয়ার পথে। বলা যায়, ইসলামিক ফাইন্যান্সের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
  • শ্রীলংকা: মোটা ব্যাংক ২৮টি। মোট আর্থিক প্রতিষ্ঠান ১৬টি। প্রথম ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা পায় ২ বছর আগে। বড় ব্যাংকগুলো ইসলামিক উইন্ডো খুলছে।
  • ব্রুনাই: ওআইসির সবচেয়ে ছোট দেশ। ১৯৯০ এ ইসলামিক ফাইন্যান্সের শুরু। ৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি ইসলামিক। এবং এটাই সবচেয়ে বড়। ব্যাংক ইসলাম ব্রুনাই দারুস সালাম। ইসলামিক ফাইন্যান্সের বাজার ৩০ শতাংশের বেশি। প্রথম সুকুক ২০০৩ এ ইস্যু করা হয়। সরকার ইসলামিক ফাইন্যান্সের ওপর একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। এবং ইসলামিক ফাইন্যান্স রেগুলেটরির জন্যও প্রতিষ্ঠান করেছে, পলিসি করেছে। মজার ব্যাপার হলো, অন্য দেশের মতো এখানে সরকারের সুকুক ইস্যু করার প্রয়োজন নেই। বরং সরকারের কাছে প্রচুর অতিরিক্ত ফান্ড রয়েছে, যা সঠিক খাতে বিনিয়োগের অপেক্ষায়।
  • তুরস্ক: ৪৯ টি ব্যাংক। তন্মধ্যে কেবল ৪টি ইসলামিক। ইসলামিক ফাইন্যান্সের মার্কেট শেয়ার ৫%, আর ক্যাপিটাল শেয়ার ৪% মাত্র। ১৯৯০ এ ইসলামিক ব্যাংকিং শুরু হয়। সুকুক প্রথম ইস্যু হয় ২০১০ এ। এ পর্যন্ত মাত্র দশটির মত সুকুক ইস্যু হয়। উল্লেখ্য, তুরস্কে ইসলামী ব্যাংককে বলা হয় পার্টিসিপেটরি ব্যাংক বা অংশীদারি ব্যাংক।
  • জাপান: মূলত এনার্জি ইম্পোর্টের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। আর এসব তেল ও গ্যাস আসে ইসলামিক দেশসমূহ থেকে। কাজেই এখানে ইসলামিক প্রোজেক্ট ফাইন্যান্সের সুযোগ অনেক। সম্প্রতি ইজারা ও ইস্তিসনার ভিত্তিতে একটি ২৪২ মিলিয়ন ইউএস ডলারের সুকুক ইস্যু করা হয়।
  • কাজাখিস্তান: একটি মাত্র ইসলামী ব্যাংক। আল হিলাল।
  • ইরান: মোট এ্যাসেট ৫০০+ মিলিয়ন ইউএস ডলার। বিনিয়োগ মোডসমূহ:  মুশারাকা ৩৯%, ইন্সট্রুমেন্ট সেল: ২৯% এবং কারদ: ৫%। ইরানের কিছু বৈশিষ্ট্য: সবগুলো ইসলামিক ব্যাংক; রিবামুক্ত ব্যাংকিং আইন ১৯৮৩; বাইয়ে দাইন নিষিদ্ধ (মালয়েশিয়ায় চলছে); একটি মাত্র শরীয়াহ বোর্ড, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে; তবে এখনো কোনো আন্তর্জাতিক শরীয়াহ মানদণ্ড অনুসরণ করা হয় না।
  • আফ্রিকায় খুব ধীর গতিতে ইসলামিক ফাইন্যান্স আগাচ্ছে। মরিতানিয়া, নাইজেরিয়া, সাউথ আফ্রিকা, উগান্ডা প্রভৃতি দেশে আশা সঞ্চার করছে।
  • ইউরোপে ইসলামিক ফাইন্যান্স: ইউরোপের ছোট দেশ লুক্সেমবার্গ। ইউরোপে যাকে ইসলামিক ফাইন্যান্সের হাব বা চক্রকেন্দ্র বলা চলে। ১৯৭৮ এ প্রথম পশ্চিমা দেশ হিসেবে ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখানে অনুমোদন পায়। ১৯৮৩ তে প্রথম ইউরোপিয়ান দেশ হিসেবে শরীয়াহ অনুসৃত ইনস্যুরেন্স (তাকাফুল) কোম্পানি প্রতিষ্ঠা পায়। ২০০২ এ প্রথমবার লুক্সেমবার্গ স্টক এক্সচেঞ্জে শরীয়াহ অনুসৃত সুকুক তালিকাভুক্ত হয়। ২০০৯ এ প্রথম ইউরোপিয়ান হিসেবে লুক্সেমবার্গ সেন্ট্রাল ব্যাংক আইএফএসবি [৯] এর সদস্য হয়। এরপর বর্তমান পর্যন্ত শরীয়াহ সুকুক ইস্যুকরণের গাইডলাইন প্রণয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে আরো সামনে এগিয়ে যায়। [১০]

গত ২৯-৩১ অক্টোবর ২০১৩ লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয় ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ইকোনমিক ফোরামের নবম আন্তর্জাতিক কনফারেন্স। এই প্রথম মুসলিম বিশ্বের বাইরে ইউরোপে এটি অনুষ্ঠিত হয়। ফোরামে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন তার উদ্বোধনী বক্তব্যে দুবাই ও কুয়ালা লাম্পুরের পাশাপাশি লন্ডনকে ইসলামিক ফাইন্যান্সের অন্যতম রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, ব্রিটেনে ২৫ টি ল’ ফার্ম রয়েছে, যারা ইসলামিক ফাইন্যান্স সার্ভিস দিচ্ছে। ১৬টি ইউনিভার্সিটি বা বিজনেস স্কুল রয়েছে, যারা ইসলামিক ফাইন্যান্স বা সমমানের বিষয়ের ওপর এমবিএ করার সুবিধা দিচ্ছে।

তিনি বলেন, ইসলামিক ফাইন্যান্স যখন ট্র্যাডিশনাল (কনভেনশনাল) ফাইন্যান্স থেকে ৫০% বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট ২০১৪ তে যখন ১.৩ ট্রিলিয়ন পাউন্ড ছুঁতে যাচ্ছে, তখন আমরা চাই ব্রিটেনে এর একটি বড় অংশ ইনভেস্ট হোক।

তিনি জানান, মুসলিম বিশ্বের বাইরে এই প্রথম ব্রিটেন সোভরেইন সুকুক (সরকারী বন্ডের ইসলামী বিকল্প) ইস্যু করার ঘোষণা দিচ্ছে। ২০১৪ এর শুরুর দিকে পরিকল্পিত এই ইস্যুটির মোট মূল্য হবে ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড (বা ৩২০ মিলিয়ন ডলার)। এছাড়া লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ ঘোষণা দিচ্ছে ইসলামিক মার্কেট ইনডেক্স চালু করার, যেন ইসলামিক ইনভেস্টররা সহজে জেনে নিতে পারে কোনটি ইসলাম অনুসৃত ইনভেস্টের জায়গা, কোনটি নয়। [১১]

 

ইসলামী ব্যাংকিং কার্যাবলী ও ইসলামী মোডসমূহ:

যে কোনো আর্থিক বাজারের মূল কাজ হলো সম্পদ সঞ্চয়ীদের হাত থেকে সম্পদ গ্রহণ করে উদ্যোক্তাদের হাতে তা তুলে দেয়া। এ কাজটি দুইভাবে হতে পারে। প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে। প্রত্যক্ষভাবে তা হয়ে থাকে দেশের স্টক মার্কেটের মাধ্যমে। যেখানে উদ্যোক্তা কোম্পানির তাদের প্রয়োজনীয় মূলধনের জন্য শেয়ার ছাড়ে, এবং বিনিয়োগে আগ্রহীরা শেয়ার ক্রয় করেন। ফলে সরাসরি বিনিয়োগকারীদের হাত থেকে উদ্যোক্তাদের হাতে মূলধন পৌঁছে যায়। একইভাবে এখানে বন্ড ও ঋণপত্রেরও ক্রয়-বিক্রয় হয়। মোটকথা এখানে সরাসরি উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীর সংযোগ ঘটে।

আর পরোক্ষভাবে হয়ে থাকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এরা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ জমা নেয়। পরে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে তা উদ্যোক্তাদের হাতে তুলে দেয়। এ হিসেবে ব্যাংকগুলোকে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান বলা যায়।

ইসলামী ব্যাংকগুলোও একইভাবে এক শ্রেণীর কাছ থেকে অর্থ জমা গ্রহণ করে। অপর শ্রেণীর কাছে তা তুলে দেয়। সে হিসেবে ফান্ড সংগ্রহ ও ফান্ড ব্যবহার – এই দুটি কাজই ইসলামী ব্যাংকের মূল কাজ। এছাড়া এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ফান্ড পাঠানো, সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ ইত্যাদি তো আছেই।

সাধারণত ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে কয়েক রকম হিসাবে ফান্ড সংগ্রহ করে থাকে। সঞ্চয়ী, চলতি ও মেয়াদী। চলতি হিসাবের সারকথা হলো, গ্রাহক যখন ইচ্ছে তখন টাকা তুলতে পারবে, এবং এতে কোনো মুনাফা দেয়া হবে না। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলো কারযে হাসানা বা ওয়াদীয়াহ চর্চা করে থাকে। যেন গ্রাহক ব্যাংককে কারযে হাসানা দিচ্ছে, বা টাকাগুলো ওয়াদিয়াহ হিসেবে রাখছে।

সঞ্চয়ী হিসাবটা অনেকটা চলতির মতোই, তবে গ্রাহক বড় অংকের জমা উত্তোলনের ক্ষেত্রে ব্যাংককে অবহিত করে নেয়। আর মেয়াদী হিসাবের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য জমা রাখে, এর মধ্যে সাধারণত উত্তোলন করা হয় না। এ দুটো ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলো মুদারাবা ব্যবহার করে থাকে। অর্থাৎ গ্রাহক এখানে রাব্বুল মাল বা বিনিয়োগকারী, আর ইসলামী ব্যাংকগুলো মুদারিব বা উদ্যোক্তা। ব্যাংক পুনরায় তা বিনিয়োগ করে ব্যবসা করে মুনাফার নির্দিষ্ট হার গ্রাহককে দিবে।

ফান্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক রকম ব্যবহার প্রচলিত আছে। সাধারণ গ্রাহকরা সাধারণত কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতে অর্থ নিয়ে থাকে। যেমন, বাড়ি কেনা বা নির্মাণের জন্য। বাড়ী কেনার প্রয়োজনে কেউ অর্থ চাইলে ইসলামী ব্যাংকগুলো তার সাথে মুরাবাহা মুয়াজ্জালাহ চুক্তি করতে পারে। মুরাবাহা হলো ক্রয়মূল্য বা খরচ ও মুনাফার পরিমাণ উল্লেখপূর্বক বিক্রয় করা। আর মুয়াজ্জালাহ মানে মেয়াদী বিক্রয়, যেখানে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে ক্রয়মূল্য পরিশোধের সুযোগ থাকে। এক্ষেত্রে গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক প্রথমে বাড়িটি নিজের নামে ক্রয় করে ও হস্তগত করে। অত:পর গ্রাহকের কাছে খরচ উল্লেখপূর্বক অতিরিক্ত মূল্যে ও মুনাফায় তা বিক্রয় করে। গ্রাহক তা কিস্তিতে নির্দিষ্ট মেয়াদে পরিশোধের সুবিধা পায়।

মুরাবাহা ছাড়াও এখানে ডিমিনিশিং (ক্রমান্বয়ে হ্রস্বীকৃত) মুশারাকা ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতির সারকথা হলো, বাড়িটি প্রথমে ব্যাংক ও গ্রাহকের যৌথ মালিকানায় কেনা হয়। অত:পর গ্রাহক ক্রমান্বয়ে ব্যাংকের অংশ ক্রয় করতে থাকে, এবং ব্যাংকের যে অংশ সে ব্যবহার করছে, তার বিনিময়ে পূর্ব নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধ করতে থাকে। গ্রাহকের মালিকানা একশ শতাংশ হয়ে গেলে বাড়িটি সম্পূর্ণ গ্রাহকের মালিকানায় চলে যায়। এ পদ্ধতিটির আরেকটি ব্যবহারও আছে। সেটি হলো, গ্রাহক প্রতি কিস্তিতে ব্যাংকের অংশের ভাড়া পরিশোধ করে যায়, তবে মালিকানা বৃদ্ধি পায় না। এভাবে একটি পর্যায়ে এসে ব্যাংক নামমাত্র মূল্যে গ্রাহকের কাছে তা বিক্রয় করে। এ পদ্ধতিটিকে এইচ.পি.এস.এম বা হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলকও বলা হয়।

বাড়ী নির্মাণের প্রয়োজনে অর্থ লাগলে ইস্তিসনা চুক্তি করা যায়। এক্ষেত্রে ব্যাংক হবে সানি বা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এবং গ্রাহক মুস্তাসনি বা বাড়ীর মালিক। ব্যাংক পুনরায় কোনো ডেভেলপার কোম্পানির সাথে ইস্তিসনা চুক্তি করবে, সেখানে ডেভেলপার কোম্পানি হবে সানি’ আর ব্যাংক মুস্তাসনি। অত:পর ব্যাংক সেই প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থ ছাড় করবে এবং চুক্তির সময় অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান ব্যাংককে বাড়িটি বুঝিয়ে দিবে। তারপর ব্যাংকও গ্রাহককে তা বুঝিয়ে দিবে। এবং প্রথম চুক্তি অনুযায়ী, যা ব্যাংক ও গ্রাহকের মাঝে হয়েছে, গ্রাহক কিস্তিতে ব্যাংককে ইস্তিসনার মজুরী পরিশোধ করবে।

বাড়ী নির্মাণ ছাড়া সাধারণ গ্রাহক গাড়ী কেনার জন্য অর্থ চেয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে সাধারণত মুরাবাহা ব্যবহার করা হয়। কোথাও এইচ.পি.এস.এমও ব্যবহার করা হয়।

এছাড়া অন্য সকল খাতকে (শিক্ষা, চিকিৎসা) ব্যক্তিগত অর্থায়ন বলা যায়। সুদী ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে সুদভিত্তিক ঋণ প্রদান করতে পারে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকগুলোর এ ক্ষেত্রে কারযে হাসানা (সুদবিহীন ঋণ) দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এজন্য সাধারণ ইসলামী ব্যাংকগুলো এতে উৎসাহী হয় না।

তবে মালয়েশিয়া এক্ষেত্রে তাওয়াররুক ও বাই ইনাহ ব্যবহার করে থাকে। বাই ইনাহ একটি সাজানো ক্রয়-বিক্রয়। যেখানে বিক্রেতা ক্রেতার কাছে একটি পণ্য বিক্রয় করে। এরপর ক্রেতা অধিক মূল্যে বিক্রেতার কাছে তা বিক্রয় করে। আসলে এটি ঋণের বিনিময়ে ঋণ, যার একটি পাশে অতিরিক্ত থাকে, আর এটাই সুদ। বাই ইনাহর হারাম হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম উম্মায় তেমন কোনো মতপার্থক্য নেই।

তাওয়াররুক প্রাথমিকভাবে মুরাবাহার মতো। এর সারকথা হলো, ক্রেতা বিক্রেতার কাছ থেকে পণ্য একটি মূল্যে বাকীতে ক্রয় করার পর অতিরিক্ত মূল্যে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির কাছে নগদে বিক্রয় করে। ক্রেতার নগদ টাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়, যা সে মূল বিক্রেতাকে কিস্তিতে পরিশোধ করে। ইনাহ’র সাথে এর মূল পার্থক্য হলো, দ্বিতীয় বিক্রয়টি বিক্রেতাভিন্ন তৃতীয় ব্যক্তির সাথে সম্পাদিত হয়।

ক্রেতার দ্বিতীয় বিক্রয় যদি সাজানো না থাকে, এবং এটি যদি কোনোভাবেই প্রথম বিক্রেতার কাছে পণ্য ফেরত পৌঁছানোর উদ্দেশে না হয়, তাহলে এর বৈধতার পক্ষে মত আছে। তবে সাজানো হলে বা প্রথম পক্ষের কাছে পণ্য ফেরত পৌঁছানো এবং নিছক ঋণের বিনিময় উদ্দেশ্য হলে অনেকেই একে ইনাহ’র মতো হারাম গণ্য করেন। [১২]

তাওয়াররুক ও ইনাহ ব্যাপক ব্যবহারের কারণে মালয়েশিয়াতে সুদী ব্যাংকগুলোর প্রায় সব লেনদেনেরই বিকল্প রয়েছে। তবে মুসলিম দেশগুলোর আপত্তির কারণে দেশটি সম্প্রতি বেশ কিছু পরিবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

ব্যক্তিগত খাত ছাড়া সরকার, বড় কোম্পানি ও বড় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলো প্রয়োজন মতো শরীয়াহর আলোকে বিনিয়োগ উপায় উদ্ভাবন করে বিনিয়োগ করে থাকে। এজন্য স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে, যারা শরীয়াহ বিভাগের সাথে আলোচনা করে কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে মুরাবাহা, ইজারা, মুদারাবা, মুশারাকা, সালাম বা ইস্তিসনার ব্যবহার হয়ে থাকে। আর আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সালাম বা ইস্তিসনা, নতুবা মুরাবাহার ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে।

তবে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মূল চেতনা মুদারাবা-মুশারাকার মাঝে। যেখানে উভয় পক্ষ বিনিয়োগ করবে, বা এক পক্ষ বিনিয়োগ করবে এবং অপরপক্ষ তা ব্যবস্থাপনা করবে। মুনাফা উভয় পক্ষের মাঝে পূর্ব নির্ধারিত হারে বন্টিত হবে। আর ক্ষতি হলে প্রত্যেক পক্ষ মূলধন বিনিয়োগের হার অনুযায়ী তা বহন করবে।

মানুষের নৈতিক অধঃপতন, মিথ্যা ও খেয়ানতের ছড়াছড়ি, ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী এখনো মুদারাবা-মুশারাকার ব্যাপক প্রচলন লক্ষ্য করা যায় না। তবে আলোচনা চলছে, সচেতন বাড়ছে, গবেষণা হচ্ছে। আশা করা যায় সেদিন বেশি দূরে নেয় যেদিন মুদারাবা ও মুশারাকাই হবে যে কোনো বিনিয়োগে সর্বাধিক ব্যবহৃত পদ্ধতি।

 

প্রশাসন, আইন ও নিয়ন্ত্রণ:

বিশ্বের মাত্র দুটি দেশে, ইরান ও সুদানে, সম্পূর্ণ ইসলামী ব্যাংকিং আইন ও কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ইসলামী ব্যতীত অন্য কোনো ব্যাংক পরিচালনার সুযোগ সেখানে নেই। এছাড়া অন্য সকল দেশে ইসলামী ব্যাংকের পাশাপাশি সুদী ব্যাংকও পরিচালিত হয়। তাই সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ভিন্নভাবে পরিচালনার জন্য পৃথক ইসলামী ব্যাংকিং আইনের প্রয়োজন।

মালয়েশিয়ায় ১৯৮৩ সনে ইসলামিক ব্যাংকিং আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৯৮৪ তে তাকাফুল আইন করা হয়। এছাড়া সেন্ট্রাল ব্যাংক অব মালয়েশিয়া অ্যাক্ট ২০০৯ -এ ইসলামী অর্থব্যবস্থার সপক্ষে বেশ কিছু ধারা যুক্ত করা হয়। তন্মধ্যে শরীয়াহ বোর্ডকে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী কর্তৃপক্ষ ঘোষণা প্রদান অন্যতম। [১৩]তাছাড়া মালয়েশিয়ায় সরকারী পর্যায়ে দুটো শরীয়াহ কাউন্সিল আছে। একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক – ব্যাংক নেগারায়। অপরটি এসইসি বা সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনে। আবার কোর্টে মুয়ামালাত ডিভিশন আছে। যারা শরীয়াহ অনুযায়ী মুয়ামালাতের মামলাগুলো দেখেন। [১৪]

ইসলামী ব্যাংকিংয়ে শরীয়াহ বিভাগের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শরীয়াহর আলোকে সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করাই এ বিভাগের মূল দায়িত্ব। যে কোনো প্রোডাক্ট বা পদ্ধতি উদ্ভাবনের শুরু থেকে প্রোডাক্টটির ডকুমেন্টেশন ও বাজারজাতকরণ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে শরীয়াহ রিভিউ, ও বাৎসরিক শরীয়াহ রিভিউ এ বিভাগ করে থাকে।

ইসলামিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে শরীয়াহ সুনিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ১৯৯১ সনে প্রতিষ্ঠিত হয় বাহরাইনভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন মানদণ্ড (শরীয়াহ, হিসাব ও নিরীক্ষা) প্রণয়নকারী অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘আওফি’। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এর শরীয়াহ বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছে জাস্টিস মুফতী তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহ।  বিশ্বের ৪৫ দেশের দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান আওফির সদস্যপদ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, আইনি পরামর্শের প্রতিষ্ঠান, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান।


এটা পড়ুন – বিটকয়েন — পরিচিতি ও শরঈ পর্যালোচনা


এ পর্যন্ত মোট ৮৮টি স্ট্যান্ডার্ড বা মানদণ্ড প্রণয়ন করেছে আওফি। তন্মধ্যে ৪৮টি শরীয়াহ, ২৬টি নিরীক্ষা, ৫টি হিসাব, ৭টি প্রশাসন ও দুটি নৈতিকতা সম্পর্কিত। নতুন মানদণ্ড প্রণয়ন করা ছাড়াও পুরনো মানদণ্ডসমূহ রিভিউ করে যথাযথ পরিবর্তন এনে থাকে আওফি। [১৫]

মানদণ্ড প্রণয়ন ছাড়াও শরীয়াহ বিষয়ক জ্ঞানের জন্য সার্টিফাইড শারিয়াহ এডভাইজর এ্যান্ড অডিটর (CSAA) ও সার্টিফাইড ইসলামিক প্রফেশনাল একাউন্টেন্ট (CIPA) নামক দুটি কোর্স পরিচালনা করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। [১৬]

আওফির পাশাপাশি মালয়েশিয়া ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বোর্ড (আইএফএসবি, প্রতিষ্ঠাকাল ২০০৩) ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক মানদণ্ড প্রণয়ন করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত মোট ১৫টি মানদণ্ড প্রকাশ করেছে। [১৭]

আইএসবি ছাড়াও মালয়েশিয়ায় উল্লেখযোগ্য আরো দুটো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ১. ইন্টারন্যাশনাল শারিয়াহ রিসার্চ অ্যাকাডেমি (ইসরা)। এতে দেশ-বিদেশের শারিয়াহ বিশেষজ্ঞ বা উলামায়ে কিরামের সমন্বয়ে মুয়ামালাত বিষয়ে গবেষণা করা হয়। [১৮] ২. ইনসেইফ: এটি বিশ্বের একমাত্র সম্পূর্ণ ইসলামিক ফাইন্যান্স বিশ্ববিদ্যালয়। [১৯]

 

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং:

বাংলাদেশে মোট ৮টি পরিপূর্ণ ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। ১৭টি ব্যাংকে রয়েছে ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো বা শাখা। ১৩টি ইসলামী ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ৬টি তাকাফুল ও ৩টি অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টরের ২১ শতাংশ মার্কেট শেয়ার ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের। গত ৪ বছরে ইসলামী ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। মোট এ্যাসেট ও ডিপোজিট ২০১২ তে ১ ট্রিলিয়ন টাকা অতিক্রম করেছে। [২০]

২০০১ সনে বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকসমূহের কেন্দ্রীয় শরীয়াহ বোর্ড ‘সেন্ট্রাল শরীয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ’। গবেষণা, প্রশিক্ষণ, ফাতওয়া ইত্যাদি নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৯ সনে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ‘গাইডলাইন্স ফর ইসলামিক ব্যাংকিং’ নামে ব্যাংকগুলোর জন্য একটি পৃথক গাইডলাইন প্রকাশ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক মালয়েশিয়া-ভিত্তিক আইএফএসবির সদস্যপদও গ্রহণ করেছে।

এসবই আশাব্যঞ্জক খবর। তবে এখনো বাংলাদেশে কোনো পৃথক ইসলামিক ব্যাংকিং আইন তৈরি হয় নি। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকেরও ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ভিন্ন নজরদারী ও নিয়ন্ত্রণ সেভাবে নেই।

অপরদিকে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে পারদর্শী গড়ে তোলার জন্য এখনো কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন ব্যাংকের নিজস্ব কিছু শিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে। অথচ যে কোনো ব্যবস্থাকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম।

 

উপসংহার:

বাংলাদেশে আইন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সামনে যাওয়ার পথ বিপদসংকুল হয়ে উঠছে। পারদর্শী ও সচেতন ব্যক্তিদের অভাব ছাড়াও এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শরীয়াহ বিশেষজ্ঞদের অভাব প্রকট।

প্রতি বছর এ দেশে হাজার হাজার ছাত্র কওমী মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা শেষ করা সত্ত্বেও ফিকহুল মুয়ামালাত ও আধুনিক অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে পারদর্শী আলিমের সংখ্যা হাতে গোনা। অল্প কিছু ইফতা বিভাগ আধুনিক মুয়ামালাতের বিষয়ে স্বতন্ত্র বিশেষায়িত শিক্ষা দিচ্ছে।

ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা প্রতিটি মুসলিমের ঈমানের দাবী। আর ঈমান বাঁচানোর কাজ উলামায়ে কিরামই বেশি করে থাকেন। তাই এ সেক্টরে উলামায়ে কিরামের সবচেয়ে অগ্রগামী হওয়া সময়ের দাবী।

মসজিদের খুতবায়, দৈনিক-সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকায় লেখনীতে, বিভিন্ন বয়ানে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। সকল ইফতা বিভাগে এ বিষয়ে স্বতন্ত্র গবেষণা, মুতালায়া ও তামরীনের পাশাপাশি ছাত্রদেরকে বাস্তবে ব্যাংকগুলোর অবস্থা যাচাইয়ে পাঠানো যেতে পারে। বেফাকসহ সকল বোর্ডের সিলেবাসে আধুনিক মুয়ামালাতের ওপর লিখিত বই ওপরের ক্লাসে পাঠ্যবই করা যেতে পারে। পাকিস্তানের জামিয়াতুর রশীদে ইফতা বিভাগে অধ্যয়নকারী একই সাথে মুফতী ও এমবিএ ডিগ্রী লাভ করে ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে অবদান রাখেন।

অনুরূপভাবে সাধারণ মানুষের জন্যও আধুনিক মুয়ামালাত বুঝার কোর্স চালু করা যেতে পারে। মুফতী তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহর পরিচালনায় দারুল উলূম করাচীতে ব্যাংকার ও সাধারণ মানুষের জন্য কোর্স পরিচালিত হয়। দারুল উলূম করাচীতে এজন্য স্বতন্ত্র একটি বিভাগ রয়েছে, ‘সেন্টার ফর ইসলামিক ইকনমিক্স’ নামে। [২১]

শরীয়াহ বোর্ডের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন দক্ষ উলামায়ে কিরাম। এ জায়গাটায় বর্তমানে যোগ্য লোকের প্রচণ্ড অভাব। ফলে শরীয়াহ লঙ্ঘন হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।

ঈমান ও আমল হেফাজতের অন্য সকল ক্ষেত্রের ন্যায় এ জায়গাটারও হক উলামায়ে কিরামের। বর্তমানে রিবামুক্ত অর্থনীতি চিন্তা করতে গেলে এ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। তাই সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে উলামায়ে কিরাম যেন এই সেক্টরের নেতৃত্ব দেন, সেই দোয়া ও প্রত্যাশা করছি।

লেখক – ইউসুফ সুলতান ,বিশিষ্ট ইসলামী অর্থনীতিবিদ ।

 

তথ্যসূত্র:

১. ব্যাংকিং ও বীমা – কাজী ফারুক ও কাজী সায়মা – পৃষ্ঠা ৪-১১
২. ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম – ইন্টারন্যাশনাল শারিয়াহ রিসার্চ অ্যাকাডেমি – পৃ:১২
৩. ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা, মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান, পৃ: ২৫-৪৪
৪. ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম – ইন্টারন্যাশনাল শারিয়াহ রিসার্চ অ্যাকাডেমি – পৃ:১১৬
৫. ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা, মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান, পৃ: ৬৭-৬৮
৬. আইএফএন এশিয়া ফোরাম ২০১৩, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া, অক্টোবর ২০১৩
৭. আইএফএসবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ সেমিনারে ‘গ্লোবাল ইস্যুজ, অপরচ্যুনিটিস এ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক প্রেজেন্টেশন, দাউদ ভিকারী আব্দুল্লাহ, সেপ্টেম্বর ২০১৩
৮. ইসলামিক ফাইন্যান্স এ্যান্ড গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট ২০১০, আই.এফ.এস.বি
৯. আইএফএসবি IFSB
১০. ‘এক নজরে ২০১৩ তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামিক ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা’’  শিরোনামের অধীনে দেয়া এ পর্যন্ত সকল তথ্য: আই.এফ.এন এশিয়া ফোরাম ২০১৩, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া, অক্টোবর ২০১৩
১১. https://www.gov.uk/government/speeches/world-islamic-economic-forum-prime-ministers-speech
১২. তাওয়াররুক ও ইনাহ’ বিষয়ে মুফতী তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহর ‘কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুয়াসারাহ’ দ্রষ্টব্য।
১৩. ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম – ইন্টারন্যাশনাল শারিয়াহ রিসার্চ অ্যাকাডেমি – পৃ:৬৪৭
১৪. আই.এফ.এন এশিয়া ফোরাম ২০১৩, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া, অক্টোবর ২০১৩
১৫. আই.এফ.এন এশিয়া ফোরাম ২০১৩, ড. খালদি আল ফাকিহ-র প্রেজেন্টেশন, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া, অক্টোবর ২০১৩
১৬. বিস্তারিত দেখুন: www.aaoifi.com
১৭. বিস্তারিত দেখুন: www.ifsb.org
১৮. ওয়েবসাইট: www.isra.my
১৯. ওয়েবসাইট: www.inceif.org
২০. আই.এফ.এস.বি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ সেমিনারে প্রেজেন্টেশন, মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান, সেপ্টেম্বর ২০১৩
২১. দেখুন: www.cie.com.pk

সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ এর ব্যবসায়ীরা

ইসলামের স্বর্ণযুগের কাহিনী এটা, মুসলমানেরা একের পর এক দেশ দখল করে আল্লাহর শাসন কায়েম করে চলেছে। তখনকার মুসলিম সাম্রাজ্যের নেতৃত্বে ছিল অটোমানেরা, আর অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান ছিলেন মুহাম্মাদ আল ফাতিহ (English: Mehmed the Conqueror)। সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ প্ল্যান করলেন যে তিনি দখল করে নেবেন তৎকালীন পৃথিবীর সবচাইতে উন্নত নগরী – তুরস্কের কন্সট্যান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল), যা তখন ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দখলে। যুদ্ধ শুরুর আগে তিনি চিন্তা করলেন যে, আগে আমি পরীক্ষা করে দেখি আমার সাম্রাজ্যের মুসলিমদের মধ্যে ঈমান ও সততা কেমন। তাঁর চিন্তা-ভাবনা আমাদের চিন্তা-ভাবনার থেকে অনেক আলাদা ছিল। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, বিজয় আল্লাহর তরফ থেকে আসে। কাজেই মুসলিমদের মধ্যে যদি ঈমান ও আল্লাহর ভয়ই না থাকে, তাহলে বিজয় ছিনিয়ে আনা সম্ভব হবে না ।

সাধারণ মানুষদের হাল-চাল পরীক্ষা করার জন্য সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ ছদ্মবেশে বাজারে গেলেন। বাজারে যেয়ে তিনি এক বিক্রেতাকে বললেন: আমি তোমার থেকে পনির, দুধ আর মধু কিনতে চাই। বিক্রেতা বলল: তুমি আমার থেকে পনির কিনো, কিন্তু আমি তোমার কাছে দুধ আর মধু বিক্রি করব না। কারণ, আমি আজকে আমার চলার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বিক্রি করে ফেলেছি। কিন্তু, আমার অমুক বিক্রেতা ভাই আজ খুব বেশী বিক্রি করতে পারে নাই। তুমি তার কাছ থেকে দুধ আর মধু কিনে নাও। এই বলে সে অন্য এক বিক্রেতাকে দেখিয়ে দিলো।


এটা পড়ুন বিটকয়েন — পরিচিতি ও শরঈ পর্যালোচনা


সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ প্রথম বিক্রেতার থেকে পনির কিনে নিয়ে দ্বিতীয় বিক্রেতাকে গিয়ে বললেন: আমি তোমার থেকে দুধ আর মধু কিনতে চাই। দ্বিতীয় বিক্রেতা বলল: তুমি আমার থেকে দুধ কিনো, কিন্তু আমি তোমার কাছে মধু বিক্রি করব না। কারণ, আমি আজকে আমার চলার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বিক্রি করে ফেলেছি। কিন্তু, আমার অমুক বিক্রেতা ভাই আজ খুব বেশী বিক্রি করতে পারে নাই। তুমি তার কাছ থেকে মধু কিনে নাও। এই বলে সে তৃতীয় আরেক বিক্রেতাকে দেখিয়ে দিলো।

সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ তৃতীয় বিক্রেতা থেকে মধু কিনলেন আর উচ্ছাসী কন্ঠে বলে উঠলেন: সুবহান আল্লাহ! আমার সাম্রাজ্যের মুসলিমদের সততা আর ভ্রাতৃত্ববোধ যদি এরকম দৃঢ় হয় তো শুধু কন্সট্যান্টিনোপল নয় বরং আমরা পুরো বিশ্বকে জয় করতে পারব!

সূত্র:  The Great Islamic Empire by Ustadh Musa Cerantonio

তিনস্তরের ছাঁকনী

ঘটনাটি আব্বাসীয় খিলাফার স্বর্ণযুগের সময়কার। মুসলিম সালতানাতের রাজধানী বাগদাদে বাস করতেন এক জ্ঞানী ব্যক্তি যিনি তাঁর অসাধারণ জ্ঞানের জন্য সুপরিচিত ছিলেন।

একদিন তাঁর পরিচিত এক লোক তাঁর সাথে দেখা করতে এসে বলতে লাগলো, “জানেন, এইমাত্র আপনার বন্ধু সম্পর্কে আমি কী শুনেছি?”

ইসলামি গল্প জ্ঞানী লোকটি বললেন, “দাঁড়াও। কোনো কিছু বলার আগে আমি চাই তুমি একটি ছোট্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হও। পরীক্ষাটির নাম তিনস্তরের ছাঁকনী পরীক্ষা।”

“তিনস্তরের ছাঁকনী?”

“ঠিক তাই,” জ্ঞানী লোকটি বলতে লাগলেন,“আমার বন্ধু সম্পর্কে কোনো কিছু বলার আগে তুমি যা বলতে চাও তা একটু পরীক্ষা করে নিলে খুব ভালো হবে।

সে কারণেই আমি একে তিনস্তরের ছাঁকনী পরীক্ষা বলে ডাকি।

প্রথম স্তর হচ্ছে সত্য। তুমি কী এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে যা বলতে চাইছো তা পুরোপুরি সত্য?”

“নাহ্‌,” লোকটি বললো, “আসলে আমি বিষয়টি সম্পর্কে এইমাত্র জেনেছি এবং…”

“ঠিক আছে,” জ্ঞানী লোকটি বললেন, “অর্থাৎ তুমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নও যে ঘটনাটি পুরোপুরি সত্য কিনা।

এবার দ্বিতীয় স্তরে যাওয়া যাক। আর এই স্তরটি হলো কল্যাণ। আমার বন্ধু সম্পর্কে তুমি যা কিছু বলতে চাইছো তার মাঝে কী কোনো কল্যাণ রয়েছে?”

“নাহ্‌, বরং তা…”

জ্ঞানী লোকটি বললেন, “অর্থাৎ তার সম্পর্কে তুমি এমন কিছু বলতে চাইছো যাতে কোনো কল্যাণ নেই, এমনকি তার সত্যতা সম্পর্কেও তুমি নিশ্চিত নও। তারপরও তুমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারো। কারণ এখনো একটি স্তর বাকী রয়েছে। আর এটি হচ্ছে কার্যকারীতা।

তুমি আমার বন্ধু সম্পর্কে যা বলতে চাইছো তা কী আমার কোনো কাজে আসবে?”

“একেবারেই না।”

সবশেষে জ্ঞানী লোকটি বললেন, “ভালো কথা। তুমি আমাকে যা বলতে চাইছো তা যদি সত্যই না হয় অথবা তার মাঝে যদি কোনো কল্যাণই না থাকে কিংবা তা যদি আমার কোনো কাজেই না আসে, তবে তুমি কেনইবা আমাকে তা বলতে চাচ্ছো?”

মুমিনগণ, কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই যালেম।

[সূরা আল হুজুরাতঃ ১১]

মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গুনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে?বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।

[সূরা আল হুজুরাতঃ ১২]

জীবনকে সুখী করতে কয়েকটি অতি মূল্যবান কথা ।

● যখন আপনার রক্ত সম্পর্কীয়দের পক্ষ থেকে আঘাত পান, এই বলে মনকে সান্ত্বনা দেবেন, ইউসুফ (আঃ)-এর সাথে তাঁর আপন ভাইরাও কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন ।
● যদি আপনার মাতা-পিতা আপনার বিরোধিতা করেন, স্মরণ করবেন
ইব্রাহীম (আঃ) -কে, যার পিতা তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন।
● যদি এমন একটা সমস্যাতে আটকে পড়েন যেখানে উদ্ধার পাওয়া কঠিন, ভুলে যাবেন না ইউনুস (আঃ) মাছের উদরে কিভাবে আটকে ছিলেন!
● যদি আপনি রোগাক্রান্ত হয়ে কষ্টের জ্বালায় কাঁদেন, স্মরণ করুন আয়ুউব (আঃ) -র রোগ- দুর্দশা কিন্তু আপনার অপেক্ষা বহুগুণ বেশী ছিলো ।
● যখন আপনার নামে কেউ অপবাদ ছড়ায়, ভুলবেন না মা আয়েশা (রাঃ) -ও কিন্তু এমন অপবাদ থেকে রেহাই পান নি ।


এটা পড়ুন দুইটি স্বর্ণালী সূত্র


● যদি আপনি একাকীত্ব অনুভব করেন, স্মরণ করুন আদম (আঃ)-যাকে যাকে নিঃসঙ্গ সৃষ্টি করা হয়েছিলো ।
● যখন কনো যুক্তি খুঁজে পাবেন না, ভেবে দেখুন যে নূহ (আঃ) (লোকের চোখে) কনো যুক্তি ছাড়াই কিন্তু সেই জাহাজটি বানিয়েছিলেন ।
● যদি আপনাকে কেউ বিদ্রূপ বা উপহাস করে আমাদের নবী (সাঃ)-কেও কিন্তু বহু উপহাস সহ্য করতে হয়েছে !
● আল্লাহ সুবহানআল্লাহু তা’য়ালা তাঁর নবী রসুলদের নানা পরীক্ষায় ফেলেছিলেন যাতে তাঁদের উম্মাহ এবং বংশধররা শিক্ষা গ্রহন করে আল্লাহর হুকুমের উপর সবর করতে শেখে ।
● আল্লাহ সুবহানআল্লাহু তা’য়ালা, আমাদের কে উপরের কথা গুলো বুঝার ও আমল করার তৌফিক দেন। আমীন…