দুইটি স্বর্ণালী সূত্র

584
সফলতার সূত্র

সফল হওয়ার মূল দুটি সূত্র

গতকাল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে (Carleton University) একটা পেডাগগিকাল (শিক্ষা-সংক্রান্ত) সেমিনারে এটেন্ড করেছিলাম। এই সেমিনারগুলোতে এটেন্ড করলে বাড়তি কিছু টাকা পাওয়া যায় বিধায় টিচিং এসিস্টেন্টরা সাধারনত এগুলোতে এটেন্ড করে থাকে। বেশীরভাগ পেডাগগিকাল সেমিনারগুলোই খুবই বোরিং কিসিমের হয়। লম্বা, লম্বা হাই তুলতে তুলতে দেড়-দুই ঘণ্টা কাটাতে হয়। কিন্তু, গতকালের সেমিনারটা দুইটি কারণে দারুণ ছিল।

এক – ফ্রি কফি ও ডোনাট ছিল, আর দুই – দারুণ প্রেসেন্টেশন ছিল। সেমিনারের স্পিকার ম্যাট একজন হিউমেন রাইটস এক্টিভিস্ট এবং সেমিনার পরিচালনার ক্ষেত্রে সে খুবই দক্ষ। যদিও সেমিনারের টপিক ছিল – ওয়ার্কপ্লেসে কিভাবে বৈষম্য দূর করা যায় তার উপর, কিন্তু, মূল বিষয়কে ছাপিয়ে হিউমান রাইটস, হিউমান বিহেভিয়ার, লিডারশিপ স্কিল – সব কিছু নিয়েই ম্যাট খুব প্রানবন্ত ভাবে সবার সাথে আলোচনা করে গেল। সেমিনারের শেষে – সে উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল – এবার আপনারা এক এক করে, যদি আপনার ইচ্ছা করে, তাহলে বলুন এই সেমিনার থেকে কোন জিস্ট (সারকথা) মেসেজ নিয়ে আপনি বাড়ি ফিরবেন? যদি আপনি চান এই সেমিনার থেকে একটা জিনিস আপনার মাথায় থাকুক – তাহলে সেটা কি?

সবাই তাদের বক্তব্য বলল, আর আমিও বললাম, সেমিনার শেষ হল। সেমিনার শেষে ম্যাট আমার কাছে এসে ব্যক্তিগত ভাবে বলল – এত জোরে বলল যে সবাই শুনতে পেল – “তোমাকে স্পেশালি থ্যাঙ্কস জানাচ্ছি, তুমি এত সুন্দর করে মাত্র দুই পয়েন্টে পুরো সেমিনারটির বক্তব্য তুলে ধরেছ যা অসাধারণ। তুমি যা বলেছ – তা সবাইকেই অনেক সাহায্য করেছে”।
সেমিনার থেকে আসার পর থেকেই আমার মাথার মধ্যে এর কথাগুলি ঘুরছিল, ভাবলাম চট করে বসে লিখে ফেলি –

The two golden rules to deal with humans.

Rule 1: It is OK to be different.(মতভিন্নতার স্বাভাবিকতা)

আরেকজন আমার মত না-ই হতে পারে, আবার আমিও আরেকজনের মত না-ও হতে পারি – এতে কোন সমস্যা নেই। আমাদের সবাইকে যে ঠিক একটা জিনিসকেই সঠিক বলে মেনে নিতে হবে – তারও কোন কারণ নেই। অমুক মনে করে কাজই জীবন, আমার হার্ড ওয়ার্ক করতে ভালো লাগে না – কোন সমস্যা নাই; অমুক মনে করে ইসলাম সন্ত্রাসী ধর্ম, আমি মনে করি ইসলাম শান্তির ধর্ম – মানুষের মধ্যে ভিন্ন বিশ্বাস থাকতেই পারে; কেউ মনে করে মনের ভিতর তুফান চললেও প্রকাশ করা ছেলেমানুষী, আর কেউ নিজের কষ্টের কথা শেয়ার না করে থাকতে পারে না – থাকতেই পারে আবেগ প্রকাশের ভিন্নতা।

হ্যাঁ, আমি যদি মনে করি অমুকে যা বিশ্বাস করে তার চেয়ে ভালো কিছু আমি জানি, আমি তার সাথে আলোচনা করতে পারি, নিজের মতামত তুলে ধরতে পারি – কিন্তু ‘লোল’ (LOL) দিতে পারি না, তাকে কটাক্ষ করতে পারি না, তাকে ছোট দৃষ্টিতে দেখতে পারি না, ‘ওকে বুঝিয়েই ছাড়ব আমি রাইট’ – না এটা হবে না। একইভাবে, আমাকেও বাকী সবার মত হতে হবে এমন কোন কথা নেই। এক বন্ধুর বাসায় ১০ জন মিলে এক হলাম, মাগরিবের সময় হলো, কেউ নামাজ পড়তে উঠে দাড়ালো না, কিন্তু আমি নামাজে দাড়াতেই পারি, আমাকে তাদের মত হতে হবে না। It is OK to be different. Have the courage to be different. Have the maturity to accept the differents.


এ লেখাটি পড়তে পারেন- আহা, এ কবর যদি আমার হত !


Rule 2: Stand up against injustice.(অন্যায়ের প্রতিবাদ)

নিজে কারো উপর অবিচার করব না, নিজের উপর অবিচার হতে দিব না, অন্য কারো উপর অবিচার হতে দেখলে তার প্রতিবাদ জানাব। ম্যাট খুব সুন্দর একটা উদাহরণ দিল। সে বলল – বাসের ভিতর হ্যারাসমেন্টের স্বীকার হয়েছে এরকম বহু যাত্রীর সাথে সে কাউন্সেলিং করেছে। এদের কেউ হিজাব বা পাগড়ি পড়ার কারণে বাজে কথা শুনেছে, কেউ আপত্তিকর স্পর্শের স্বীকার হয়েছে, কেউ তার গায়ের বর্ণের জন্য বর্ণবাদের স্বীকার হয়েছে। ম্যাট বলল – হ্যারাসমেন্টের স্বীকার এই মানুষগুলোর মধ্যে একটা বিষয় কমন ছিল, তারা হ্যারাসমেন্টের মূল কাজটায় যতটা না আঘাত পেয়েছিল, তার চেয়েও বেশী আঘাত পেয়েছিল তাদের আশের-পাশের মানুষের নীরবতায়। আমাদের একটু ভালো কথা, একটু সাপোর্ট একজন আহত মানুষের মনে অনেক বড় আশার, অনেক বেশী আত্মবিশ্বাসের যোগান দেয়। কোন ভাল কাজ, তা সে যত ছোটই হোক না আমরা যেন ছোট মনে না করি। আমার জন্য যা কয়েক ফোঁটা, আরেকজনের জন্য সেটাই তৃষ্ণা নিবারক।

‘সেন্স অফ হিউমার’ চাঙ্গা রাখবে হবে। ‘কুল’ (cool) থেকে মানুষের ভুল ধরিয়ে দেয়ার স্কিল আয়ত্ত করতে হবে। না শুনলে না শুনুক, we can still get along together. মানুষে-মানুষে পার্থক্য থাকবেই আর এই পার্থক্যের জন্য পৃথিবীটা বোরিং না, এক্সাইটিং!

শেষ কথা: উপরে বর্ণিত রুল দুইটার সাথে ইসলামের কি কোন মিল পাওয়া যায়? লক্ষ্য করলে দেখবেন, রাসূলুল্লাহ (সা) এর পুরো জীবনের সারমর্ম হচ্ছে উপরের দুইটি রুল। তাঁর মাক্কী জীবন হলো ১ নং রুল, আর তাঁর মাদানী জীবন হলো ২  নং রুল। মাক্কী জীবনে রাসূলুল্লাহ (সা) সবার থেকে ভিন্ন ছিলেন, আর তাঁর মাদানী জীবনের যুদ্ধগুলো ছিল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস।

==============

লেখক-আদনান ফায়সাল

Facebook Comments